Sunday 30 September 2018

পরকীয়া ২


কাল বনধ ছিল বলেই হয়তো আজ আউটডোরে মারাত্মক চাপ, পিলপিল করছে পেশেন্ট, সকাল থেকে দম নেবার ফুরসৎ নেই তাপসের। ইন্টারনেটের মাহাত্ম্যে সবাই আজকাল আধা ডাক্তার, বিনা বাক্যে ডাক্তারের নির্দেশ মানতে তাদের ঘোর অনীহা, গণ্ডা খানেক প্রশ্নের জবাব দিয়েও কোন পেশেন্ট পার্টিকে আজকাল সন্তুষ্ট করতে পারে না তাপস। মোটামুটি বেলা আড়াইটে নাগাদ ঘর ফাঁকা হতে, মোবাইল চেক করার টাইম পেল, গুচ্ছ খানেক ফোন, যার মধ্যে একটা মেঘার। তাপসের কপালে ভাঁজ পড়ল, হাসপাতালে থাকলে সাধারণত ফোন করে না মেঘা, আসলে ভাবতে যতই বুক টনটন করুক না কেন, বিনা প্রয়োজনে কখনও ফোন করে না মেঘা। বিয়ের পর তাপসই করত, আজও করে, ফোন করে খোঁজ নেয়, “টিফিন খেয়েছ?” বা “কটায় ফিরলে?” মামুলী কেজো কথাবার্তা, গভীর প্রেমময় কথা আগে বলতে ইচ্ছে করত, তবে মেঘার ভয়ে, সেসব আর গলা দিয়ে বের হত না। পেটেই থেকে যেত, দুএকবার যাও বা বলছেন, মেঘার নিরাসক্তি শুধু ব্যথাই দিয়েছে তাপসকে। বিশ বছরের বিবাহিত জীবনে, মেঘাকে কখনও আবেগ বিহ্বল দেখেনি তাপস। বরাবরই কেমন যেন রুক্ষ, শুষ্ক, চূড়ান্ত যুক্তিবাদী অথচ ভয়ানক রহস্যময় মেঘা।
ফোনে রিং হচ্ছে, হাসপাতালের সোডা দিয়ে গামছা ফোটানো জল, ছোপ ধরা সাদা কাপে দিয়ে গেল পল্টু। এটা নাকি পল্টুর স্পেশাল চা। চায়ে চুমুক দিয়ে, তাপস বলল, “বলো, ফোন করেছিলে, সব ঠিক আছে তো?” মেঘা বোধহয় কিছু করছে, হাল্কা আনমনা গলায় বলল, “অভিনন্দন।“ মানে? তাপস কিছু বুঝল না। মেঘা আবার বলল, “খবর পাওনি বুঝি? আদালত তোমাদের ব্যাপারটাকে আইনসিদ্ধ ঘোষণা করেছে।“ তাপসের  মাথায় কিছুই ঢুকছে না। ব্যাপার কি? মেঘার এই হেঁয়ালি গুলো চিরদিনই ওকে বেকুব প্রমাণ করে। মেঘা অত্যন্ত আপডেটেড, সোশ্যাল মিডিয়ায় অত্যন্ত অ্যাক্টিভ, না না সামাজিক ইস্যুতে ভয়ানক সরব। নিয়মিত লেখালিখি করে, সামাজিক মাধ্যমে। আর তাপস? পেশার চাহিদা মেটাতে মেডিক্যাল জার্নাল আর হৃদয়ের চাহিদা মেটাতে চটুল হিন্দি গান এর বাইরে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তাপসের চূড়ান্ত আলস্য তথা অনীহা। হাই চেপে তাপস বলল, “ব্যাপারটা কি বলবে?”” পরকীয়া আইনসিদ্ধ হল আজ থেকে। কেন ঋষভ ফোন করেনি বুঝি?” মেঘার গলার শ্লেষ, যেন গরম সীসা ঢেলে দিল তাপসের কানে।
“ঋষভ” কতদিন বাদে এই নামটা শুনল। বছর দশেক আগে ঋষভের সাথে প্রথম আলাপ, অংশুমানের পার্টিতে। কি কুক্ষণে যে হঠাৎ দেখা হয়ে ছিল অংশুর সাথে। মেডিক্যালে চান্স পাবার আগে, এক বছর সাইন্স নিয়ে পাশ কোর্সে কলেজে ভর্তি হয়েছিল তাপস। সেখানেই অংশুর সাথে আলাপ এবং বন্ধুত্ব। অংশু উত্তর কলকাতার বিশাল অভিজাত বাড়ির ছেলে।অতীব সুদর্শন। অংশু ছিল স্বঘোষিত সমকামী।তখন অবশ্য তাপস ভাবত, বড়লোকের বকাটে ছেলের উটকো বদ খেয়াল। সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে যাবে। দীর্ঘ সতেরো বছর বাদে কি যেন সেমিনারে আবার অংশুর সাথে দেখা।অংশু ততদিনে নামী কলেজের দামী অধ্যাপক। তার সাথে সাথে সমকামী আন্দোলনের এক বড় নেতাও বটে। সেমিনার শেষে অংশুই পাকড়াও করে নিয়ে গেল, ওর বাড়িতেই মিটিং ছিল। অনেকের সাথে আলাপ হল। ব্যাপারটা কি রকম অবিশ্বাস্য লাগছিল তাপসের, এরা সকলেই পুরুষ, অনেকেই সুদর্শন, সুঠাম দেহী, অথচ এদের নারী দেহের প্রতি কোন আকর্ষণ নেই? একজন পুরুষ, কিভাবে আর একজন পুরুষকে কামনা করতে পারে? মনে জাগছিল অনেক প্রশ্ন, কিন্তু কাউকে বলার সাহস হয়নি, ঋষভ ছাড়া। ঋষভ গাঙ্গুলী, মাঝারী দোহারা চেহারা, গালে কায়দা করা দাড়ি, পাজামা-পাঞ্জাবী, কাঁধে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ, বয়সে বছর দশেকের ছোটই হবে তাপসের থেকে। ছোট খাটো কবি, লিটল ম্যাগাজিন বার করত একটা, নাম “উন্মেষ”।তাপস ভেবেছিল নির্ঘাত ভয়ানক আঁতেল। এর সাথে মেঘার ভালো জমতে পারে, ঈশ্বরের দিব্যি এই কথাটাই সেদিন ভেবেছিল তাপস। বেশ খানিকক্ষণ গল্প করেছিল দুজনে সেদিন, কারো সাথে কথা বলে এত নির্ভার কোনদিন বোধ হয়নি তাপসের। ভীষণ প্রানবন্ত ছেলে ছিল ঋষভ। 
তারপর কথা হত মাঝে সাঝে। আর রোজ মেসেজ চালাচালি। মামুলী কথা। অপ্রকাশিত কবিতা পড়তে দিত ঋষভ মেসেজ করে। মতামত চাইত। মেঘার সাথে বিবাহিত সম্পর্ক তখনও বেশ জটিল ছিল। মেঘার গুরুগম্ভীর ব্যক্তিত্বের চাপে হাঁসফাঁস করত তাপস সেদিনও, তবে খুলে বলতে পারেনি কাউকে ঋষভ ছাড়া। তারপর এল সেইদিন, ভালোবাসার দিন।প্রেমের প্লাবনে ভেসে গেল মহানগরী। হাসপাতালে যথাবিহিত রোগী নিয়ে নাস্তানাবুদ তাপসের, খেয়ালই ছিল না এসব। আচমকা ঋষভের মেসেজ দিল সব ঘেঁটে। খুব সহজ সরল, অনাড়ম্বর ভাষায় লিখেছিল ঋষভ, তার মনের কথা।“ প্রথম দর্শনে প্রেম নয়, দীর্ঘ সাত আট মাস ধরে যত  তোমায় জেনেছি, ততোই গভীর ভাবে অনুভূত হয়েছে প্রেম। জানি তুমি বিবাহিত, বউ একটু গম্ভীর দিদিমণি প্রকৃতির,মনেপ্রাণে চাই তোমরা সুখে থাকো।তোমাদের বিবাহিত জীবন হোক নিরুপদ্রব।শুধু নিজেকে বড় বঞ্চিত বোধ হয় আজকাল।“
দীর্ঘক্ষণ থম মেরে বসেছিল তাপস সেদিন। ঋষভের প্রতি ওরও অব্যক্ত ভালোলাগা কোথাও না কোথাও ছিল, তবে ব্যাপারটা এদিকে গড়াতে পারে, তাপস স্বপ্নেও ভাবেনি। সচেতন ভাবে তো ও কোনদিন ঋষভকে কোন আশা দেয়নি, তাহলে? টাইপ করতে গিয়ে তাপসের হৃদয় সেদিন ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল, তবু ও লিখেছিল, “ঋষভ আমি বিবাহিত। আশা করব, আজকের পর আমাদের আর কখনও দেখা হবে না। ভবিষ্যতে আমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা নিষ্প্রয়োজন।“ কি ভাবে যেন মেঘার চোখে পড়ে যায় দুজনের এই মেসেজ চালাচালি। তাপসের অনুমতি নিয়েই ওর ফোনে হাত দিয়েছিল মেঘা, কাকে যেন ফোন করার ছিল, সেখান থেকেই মহিলা সুলভ অনুসন্ধিৎসায় ইনবক্স খুলেছিল মেঘা-
বিগত দশ বছরে, অন্তত দশলক্ষ বার বলেছে মেঘা, “তুমি আমার জীবন বরবাদ করে দিয়েছো।“ কিভাবে সেটা তাপস আজও বুঝে উঠতে পারেনি যদিও। মেঘার প্রশ্নের উত্তরে একটিও মিথ্যা বলেনি তাপস, আজ পর্যন্ত বলেনি। মেঘার চিৎকার- চেঁচামিচি, হিস্টিরিয়া মুখ বুঝে সয়ে গেছে। শুধু বার বার বলতে চেষ্টা করেছে, "“মেঘা, তুমি ছাড়া আমার কারো সাথে কখনও কোন সম্পর্ক ছিল না।“ প্রতিবারই চতুর চূড়ামণি, মহাধান্ধাবাজ মিথ্যাবাদীর শিরোনামে ভূষিত করেছে মেঘা। তাপসের বৃদ্ধ বাবা-মা বোন, শ্বশুর শাশুড়ি সবার সামনে অসংখ্য বার তাপসকে লোচ্চা ঘিনঘিনে সমকামী প্রমাণ করেছে মেঘা। এমনকি মেঘা এবং তাপসের বাবা-মা ষড়যন্ত্র করে একজন সমকামী পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে মেঘার জীবন বরবাদ করেছে এ অভিযোগও করতে ছাড়েনি মেঘা। কি সৌভাগ্য একমাত্র কন্যা রিয়ার সামনে কখনও এই প্রসঙ্গ তোলেনি মেঘা। প্রতিবারই তাপসের নিজেকে অপরাধী মনে হয়েছে, ঈশ, ওরই উচিৎ হয়নি, ঋষভ সমকামী জেনেও ওর সাথে গভীর ভাবে মেলামেশা করার।দশ বছর ধরে একটা  ঋষভ না থেকেও রয়ে গেছে দুজনের মধ্যে,মাঝে মাঝে নিজেকে মেঘার পোষ্য সারমেয় বলে ভ্রম হয় আজকাল তাপসের।
আর ভালো লাগে না, বিনা দোষে অপরাধী হতে আর ভালো লাগে না তাপসের, বড্ড ক্লান্ত লাগে আজকাল।মাঝে মাঝে তীব্র ক্রোধ হয়, বিনা অপরাধেই যদি হাজতবাস হয়, তাহলে অপরাধ করে হাজতবাস করাই তো ভালো। সেবারে যাদের সক্রিয় সমর্থন পেয়েছিল মেঘা, আজ তারা সকলেই হয় অথর্ব না হলে মেঘার ওপর বিরক্ত।  আর যদি তারা মেঘাকে সমর্থনও করে, তাতেই বা কি? ডঃ তাপস চৌধুরী কি কাউকে ডরায়? সামাজিক মিডিয়ার দৌলতে কি আজকাল কেউ কারো জীবন থেকে হারিয়ে যায় নাকি? মেঘা কি ভেবেছে? ঋষভকে তাপস খুঁজে বার করেছে বহুদিন, বহুবার নিশপিশ করেছে আঙুল, বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেবার জন্য। তীব্র অপরাধ বোধে কতবার যে ফেসবুক ডিঅ্যাক্টভেট করে দিয়েছে তাপস, আজ আর করবে না।এই তো ঋষভ, সেই দাড়ি, সেই পাজামা-পাঞ্জাবী, সেই হাসি। “অ্যাড ফ্রেন্ড” বোতাম থেকে কয়েক মিলিমিটার দূরে তাপসের আঙুল---।
“হেলো মেঘা। রাগ করেছো? কেন? আদালতের সিদ্ধান্তকে কি আমি অনুপ্রাণিত করেছি বলতে চাও? কে ঋষভ? কবেকার পচাগলা কেস তুলে নিয়ে এসে ঝামেলা পাকাও। সহ্যের ও তো একটা সীমা আছে। এরপর কোনদিন যদি এই নিয়ে আমায় উত্যক্ত করেছো আমি কিন্তু সত্যি সত্যি ঋষভের কাছে চলে যাব।“ কড়ায় খুন্তি নাড়তে নাড়তে ভেঙিয়ে উঠল মেঘা, “যে চুলোয় পারো যাও,খালি আজ দয়া করে বাড়ি ফিরো। দেশী মুর্গি রাঁধছি, তোমার জন্য। দয়া করে সময়মত পায়ের ধুলো দেবেন ডাক্তারবাবু।“ হেসে ফোনটা পকেটে ঢোকালো তাপ্স।রাউন্ডে যাবার সময় হল, ঋষভের সাথে বন্ধুত্বটা আর করা হল না আজকের মত। থাক। যেমন আছে থাক, একমুঠো কাঁঠালি চাঁপার মত বুকের ভিতর ঋষভের স্মৃতির মৃদু সৌরভ নিয়ে রাউন্ডে চললেন ডঃ তাপস চৌধুরী।
©Anindita Bhattacharya ©Anindita's  Blog

No comments:

Post a Comment