Wednesday 10 October 2018

এক যে ছিল কন্যা-

ঠাণ্ডাটা আজ বেশ জব্বর পড়েছে, জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের সামনে একাকিনী এক নারী। জ্বলতে থাকা আগুনের আভায় ভাস্বর এক দেবী। যেন বিষাদের প্রতিমূর্তি। রমণী এক মনে মাথা নীচু করে সেলাই করে চলেছেন। “রাণীমা!” জনৈকা সহচরীর ডাকে চমকে উঠলেন নারী, সহচরী নতমস্তকে কুর্নিশ করে জানাল,“ রাজামশাই এর ব্যক্তিগত সহায়ক  আপনার সাক্ষাৎ প্রার্থী। ”
মৃদু কেঁপে উঠল বুক, রাজামশায়ের এই ব্যক্তিগত সহায়কের রাণীমাকে এক্কেবারেই না পসন্দ, এ কথা অজ্ঞাত নয় নারীর। একদিন প্রশ্নও করেছিলেন,“আমার প্রতি আপনার এই বিরাগের কারণটা জানতে পারি কি?”  জবাবে কুর্নিশ করে তিনি বলেছিলেন,“আমি এক তুচ্ছ সেবক রাণীমা, বলতে গেলে আপনি আকাশের চাঁদ,আর এ অধম ক্ষুদ্র বামন মাত্র। ” অন্যমনস্ক ভাবে ইশারা করলেন রাণীমা, দুই সহচরী দৌড়ে এল, অন্তর্বাসহীন রাত পোশাকের ওপর জড়িয়ে দিল রেশমী আচ্ছাদন। মাথায় চড়িয়ে দিল রত্নখচিত মুকুট। এমন মুকুট রাণীমার অগণিত। বর্তমানে সাদা পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে মাথায় পরলেন মুক্তার মুকুট। এক একটা মুক্তা প্রায় পায়রার ডিমের আকারের।
সহায়ক প্রবেশানুমতি পেলেন। নতজানু হয়ে অভিবাদন জানালেন রানীমাকে। ব্যক্তিগত ভাবে এই রাজ্যের আপামর অধিবাসীর মত উনিও পরম শ্রদ্ধা করেন এই জনমদুখিনী নারীকে। কোন ছোট্ট বেলায় বাগদত্তা হয়ে ভিনদেশ থেকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এদেশে এসেছিলেন, তখন বোধহয় রাণীমার বয়স পাঁচ থেকে ছয় বছর হবে। শোনা যায় জাহাজে ওঠার আগে মাকে জড়িয়ে আকুল কেঁদেছিলেন সেদিনের  সেই বালিকা। বদলে শুনতে হয়েছিল উপদেশ,“রাজকন্যারা দেশ এবং রাজনীতির জন্য বলিপ্রদত্ত। বুক ফাটবে কিন্তু চোখ না ফাটে।” কালাপানি পেরিয়ে এসে যুবরাজের বাগদত্তা হলেন শিশু রাজকন্যা। যুবরাজের যখন চোদ্দ বছর বয়স, জানা গেল হবু যুবরাণী সদ্য রজঃস্বলা হয়েছেন। চটজলদি বিয়ের আয়োজন করলেন তৎকালীন মহারাজ। দেশবিদেশ থেকে এলেন অথিতিদের দল, হবু যুবরাণী আশা করেছিলেন এত বছর বাদে হয়তো দেখা হবে বাবা-মায়ের সাথে। বদলে এল আশির্বাদ জ্ঞাপক পত্র মাত্র। ওণার দেশে নাকি রাষ্ট্রবিপ্লব  ঘটেছে,তাই রাজা বা রাণীর পক্ষে দেশত্যাগ অসম্ভব,বদলে এল থরে থরে ধনসম্পত্তি,মণিমাণিক্য আর ধর্মগুরুর আশির্বাদ।
বিয়ের পর তরুণ যুবরাজ আর যুবরাণী পাড়ি দিল অঙ্গরাজ্যে,এখান থেকেই দেশ শাসনের হাতে গরম তালিম পাবে যুবরাজ। এখানেই হবে ফুলশয্যা।

একি ফুলশয্যা? শয়নকক্ষে প্রবেশ করে চমকে উঠলেন সালংকারা নববধূ । শয়ন কক্ষ ভর্তি লোক,গিজগিজ করছে। কে নেই তাদের মধ্যে? যুবরাণীর সহচরীবৃন্দ-যুবরাজের সহচর বৃন্দই গোটা ছয়, এদের কর্তব্য যুবরাজ এবং যুবরাণীকে বিবস্ত্র করা। এছাড়া দাস-দাসী অন্তত এক ডজন, নানারূপ ফল,মিষ্টি নিয়ে নতমস্তকে দণ্ডায়মান। এছাড়া কমসেকম তিনজন যাজক, তাঁদের কর্তব্য হল, যুবরাজ আর যুবরাণীর প্রথম মিলনের মুহূর্তে সোচ্চার প্রার্থনা করা, যাতে প্রথম মিলনেই যুবরাণীকে গর্ভবতী করতে সক্ষম হন যুবরাজ এবং কালানুক্রমে একটি সুস্থ সবল পুত্র সন্তান প্রসব করেন যুবরাণী।
কি আড়ষ্টই না ছিলেন কিশোর যুবরাজ আর সদ্য বিবাহিত যুবরাণী। সর্বসমক্ষে বস্ত্র উন্মোচন করে পাতলা দুধ সাদা রাত পোশাক পরানো হল , সুগন্ধী আগরবাতি  নিয়ে পরিক্রমা করা হল , যাতে যাবতীয় কুনজরকে ঝেড়ে ফেলে নতুন জীবনে প্রবেশ করতে পারেন দোঁহে। ছেটানো হল সুগন্ধী, যাতে শরীরের যাবতীয় বদগন্ধ দূর হয়, অতঃপর পালঙ্কে উঠলেন যুবরাজ এবং যুবরাণী,  কয়েক বছর আগেও যাঁরা ছিলেন একে অপরের খেলার সাথী। কত হাতাহাতি, কত মারামারির সাক্ষী এবং সঙ্গী। পালংকের দুপাশে থরে থরে সাজানো না না সুস্বাদু ফল,দুধ, মিষ্টি এবং সুরা। পাতলা সাদা মখমল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হল পালঙ্ককে।  
বাইরে অতন্দ্র প্রহরায় সকলে, সোচ্চারে মন্ত্রপাঠ চলছে, ফিসফিস করে রসের আলোচনা চলছে যুবরাজ এবং যুবরাণীর সহচর এবং সহচরী  বৃন্দের মধ্যে, উৎকীর্ণ  সকলের কান। এইবার শোনা যাবে যুবরাণীর তীব্র শীৎকার। কিন্তু এতো শীৎকার নয়,এযে চিৎকার। তীব্র চিৎকার করে উঠলেন যুবরাজ, উচ্চ স্বরে কেঁদে উঠলেন কিশোরী যুবরাণী । রসালো ইঙ্গিতে খলবলিয়ে উঠল যাজকদের চক্ষুও।
উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল চিৎকার, ভোরের দিকে যুবরাজের আর্তনাদ ক্রমশ পরিণত হল গোঙানিতে।যুবরাণীর কাতর চিৎকার আর হৃদয়বিদারক কান্না আর অনুনয় বিনয়ে  আর থাকতে পারল না পরিচারকের দল, এত দীর্ঘ সময়ব্যাপী চলতে পারে না এই প্রক্রিয়া। ব্যাপার কি? ধীরে ধীরে পর্দা তুলে আঁতকে উঠল সকলে, তীব্র শারীরিক বেদনায় কাটা পাঁঠার মত ছটফট করছে দোঁহে, দুজনের ঘামে জবজবে ভিজে গেছে রাজশয্যা।  ক্রমেই নেতিয়ে পড়ছে দুই সদ্যবিবাহিত কিশোর কিশোরী।  ডাকা হল রাজবৈদ্যকে। তিনি দেখেই বললেন, “এতো ঘামরোগ। ভয়ানক ছোঁয়াছে। ” শুনেই আঁতকে উঠল সকলে।এতো রোগ নয়,মহামারী।  দুদ্দাড় করে পালিয়ে গেল সহচর আর পরিচারক বৃন্দ। পালাল যাজকগণ।
কোন মতে জনা দুয়েক দাসকে জবরদস্তি আটকে রাখলেন রাজ বৈদ্য। যাঁর পোশাকী নাম ডাক্তার। এই রোগের কোন সম্ভাব্য চিকিৎসা তিনিও জানেন না। শুধু শুনেছেন শরীর থেকে বদরক্ত যদি বের করে দেওয়া যায় হয়তো প্রাণে বাঁচতে পারে রোগী। যুবরাজের শরীরে ভোঁতা পেরেকের মত যন্ত্র হাতুড়ি দিয়ে ঠুকে ঠুকে রক্ত বার করতে লাগলেন ডাক্তারবাবু। পাশ থেকে গোঙানির সুরে অনুরোধ করলেন যুবরাণী,“ডাক্তারবাবু, আমাকে বাঁচান। আর সহ্য হচ্ছে না এ যাতনা। ডাক্তার নির্বিকার। তাঁর ওপর নির্দেশ আগে বাঁচাতে হবে যুবরাজকে। ভিনদেশী রাজকুমারী বাঁচল না মরল তাতে এই মুহূর্তে কিস্যু যায় আসে না এই রাজ্যের রাজারাণীর। বরং ঐ অশুভ মেয়ে মরে গেলেই তো ভালো। বিনা চিকিৎসায় পড়ে রইলেন যুবরাণী। ভরসা শুধু প্রার্থনা। , দিগ্বিজয়ী  সম্রাটের আদরের আত্মজা, এতবড় রাজ্যের হবু রাণীর ভরসা শুধুই ঈশ্বর।
যে বদরক্ত যুবরাজের দেহ থেকে অতি যাতনায়, অতি কষ্টে  বার করতে হল, তা এমনিই অঝোরে ঝরে গেল সদ্য রজঃস্বলা তরুণীর দেহ থেকে। ফলে দেশ জুড়ে যখন মড়ক, জনশূণ্য হয়ে পড়ছে পল্লীর পর পল্লী, গণচিতায় আগুন দেবার লোক নেই, তারই মধ্যে আশ্চর্য ভাবে বেঁচে উঠলে যুবরাণী। বাঁচলেন না শুধু যুবরাজ। বিয়ের ভোজ হজম হবার আগেই বিধবা হলেন যুবরাণী।
(চলবে)
©Anindita  Bhattacharya
এক যে ছিল কন্যা- ২
প্রথম বৈধব্যের অনুভূতি কেমন, আজ যদি এ প্রশ্ন করেন, তবে সেদিনের সেই অ-শোকাতুরা বালিকার কথা ভেবে ভয়ানক লজ্জা পাবে এই মধ্যবয়সী রাজরাজেশ্বরী। না সেদিনের সেই বালিকা নিজের সদ্য মৃত স্বামীর কথা ভেবে ছিটেফোঁটাও চোখের জল ফেলেনি।যদিও আজ বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। সেদিনে সেই দুর্গে বর্তমান থাকা সকল সহচর-সহচরী, দাসদাসী প্রত্যক্ষ করেছিল সদ্যবিধবা যুবরাণীর মর্মান্তিক শোক। হাপুস নয়নে কেঁদে গেছে যুবরাণী,সকলে ভেবেছে হয়তো সদ্য মৃত যুবরাজের জন্য, আসলে সে কান্না ছিল কোন ছোটবেলায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মায়ের জন্য। অসুস্থ অবস্থায় মায়ের কথা বড় মনে পড়ত মেয়েটির।
কাল অবধি যে ছিল সকলের নয়নের মণি, দেশের হবু রাণী, যুবরাজের মৃত্যু পলকে যেন তাকে করে তুলল চোখের বালি। তদানিন্তন রাণীমা তো মুখদর্শনেও সম্মত হলেন না হতভাগ্য বিধবা পুত্রবধূর। বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে অলক্ষ্মী কন্যাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল, রাজধানী থেকে বহুদূরে এক অনামা অখ্যাত দুর্গে। নামমাত্র পরিচারক আর গোটা চারেক সহচরী সমেত। সহচরীরা সকলেই রাজকন্যার সাথে এদেশে এসেছিল। সকলেই  হয় অভিজাত পরিবারের অনুঢ়া কন্যা অথবা কোন ধনী বণিকের দুহিতা। মূল লক্ষ্য ভালো বর যোগাড় করে,পরিবারের মুখোজ্জ্বল করা। মুস্কিল হচ্ছে ভালো বর পেতে হলে রাজধানী তথা রাজপ্রাসাদে থাকা বাধ্যতামূলক। তবেই না এদেশের অভিজাত জমিদার বা তাদের পুত্রদের সাথে মোলাকাৎ হবে। অভাগিনী সখীর সাথে সাথে তাদেরও নির্বাসন দেওয়া হল।
তিনদিকে ঘন সবুজ মাঠ আর আঙুর বাগিচা আর একদিকে গাঢ় নীল সমুদ্র, মাঝে কে জানে কত শত বছরের পুরানো সেই দুর্গ। জায়গায় জায়গায় বিশাল ফাটল,শিকড় মেলতে চায় মহীরুহ, খোদ রাজকুমারীর ঘরের ছাদই ফুটো। বৃষ্টি নামলে পাঁচ সখী দৌড়ত রন্ধনশালা থেকে হাঁড়িপাতিল আনতে। দুর্গে প্রহরী বলতে জনা পঁচিশেক রাজ সৈন্য। যাদের কেউ কেউ বেশ সুদর্শন ছিল। সাগরের ঝড়ো হাওয়ায় দপদপ করতে থাকা মোমবাতির আলোয় আলোকিত দুর্গের আলোআঁধারি যেন ছিল কোন রূপকথা। রাতের পর রাত জেগে সমুদ্রের ঢেউ গোণা দেখত কন্যা। ভোর রাতে চিঠি লিখতে বসত পিতামাতাকে। বয়ান মোটামুটি এক,“আমি ফিরে যেতে চাই। আমায় দয়া করে কাছে টেনে নাও মা। কতদিন তোমায় দেখিনি। কতদিন তোমার গায়ের গন্ধ শুঁকিনি মা-। ” নিজ হাতে গালা গলিয়ে সিল করত সে চিঠি। তারপর গভীর ক্লান্তিতে তলিয়ে যেত ঘুমে, স্বপ্নে আসত মা- জাহাজ থেকে নামত কন্যা নিজ দেশে, স্বদেশের সমুদ্রের লবণাক্ত হাওয়ায় প্রাণ ভরে শ্বাস নিত কন্যা।
হতভাগী জানত না,যে একটি পত্রও সাগর পেরোয় না। প্রতিটি চিঠি খুলে পড়ত একজন, তার নাম, ধরে নেওয়া যাক উলযি। রাজার মুখ্য পরামর্শদাতা। উলযির রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ছিল অসাধারণ, প্রতিবেশী দেশের মহাক্ষমতাধর সম্রাটের কন্যাকে এভাবে ফেরত পাঠানো যে এই দেশ তথা এই মহাদেশের জন্য আদৌ শুভ পরিণাম বহন করবে না, তা বুঝতে উলযির বাকি ছিল না। যদিও তৎকালীন রাণীমা মনেপ্রাণে চাইতেন প্রতিবেশী কন্যাকে পত্রপাঠ স্বদেশে পাঠাতে, নাগাড়ে বাধা দিতেন উলযি। একদিকে রাণীর জেদ অপরদিকে উলযির দূরদর্শিতায় নাজেহাল অবস্থা রাজার। উলযিই পরামর্শ দিলেন,“মহারাজ যাকে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য খাতির করে এদেশে এনেছেন,তাকে এভাবে নিষ্ফলা ফেরত পাঠাবেন না। ” “তাহলে কি করি?” হতাশ এবং বিরক্ত স্বরে বলে উঠলেন রাজা,“যুবরাজের সাথে বিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি তো পালন করেছি আমরা, কিন্তু সেই যখন নেই, তখন কি করি বলো তো?” রাজার বিরক্তি শেষের দিকে মৃদু গর্জনে পরিণত হলেও ভয় পেলেন না উলযি,“মহারাজ, অপরাধ মার্জনা করবেন,যুবরাজের আসন তো শূণ্য নেই, তাহলে যুবরাণী কেন-”। রাজার কুঞ্চিত ভ্রুর খাঁজ আরো গভীর হল,“কি বলতে চাও উলযি?আমার দ্বিতীয় পুত্রের সাথেও বিয়ে দেব ঐ মেয়ের?রাণী মানবেন?” উলযি বাঁকা হেসে বললেন,“মহারাজ-। ”
রাণী মানলেন কি মানলেন না,তাতে রাজামশাই কর্ণপাত করলেন না। ডেকে পাঠালেন নতুন যুবরাজকে,বয়সে কন্যার থেকে বছর পাঁচেকের ছোট, কন্যা যখন বাগদত্তা হয়ে এদেশে আসেন নতুন যুবরাজ তখন মাতৃক্রোড়ে,মুখে বুলি ফোটেনি। একসাথেই বড় হয়েছেন দুজনে,দুজনের সখ্যতাও ছিল গভীর। অবশ্য জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যুর পর বিগত কয়েক বছরে আর দেখাসাক্ষাৎ হয়নি দুজনার। এই যুবরাজ বড় একরোখা,বড় জেদী,বড় বেশী সুদর্শন, বড় বেশী রঙ্গিলা। অভিজাত পরিবারের অনুঢ়া এবং স্বল্পবয়সী বিবাহিত রমণীরা ছেঁকে থাকে এই যুবরাজকে। যোগ্যসঙ্গত করেন যুবরাজও। কন্যার সাথে বিবাহের প্রস্তাব এক কথায় খারিজ করে দিলেন তিনি। “পাগল নাকি? আজ যে যুবরাণী,কাল সে রাণী হবে, আর রাণী হবার প্রথম শর্তই হল অক্ষত যোনি হয়ে বাসরে প্রবেশ- আর এক্ষেত্রে-”। এক্ষেত্রে কি বুঝলেন রাজা, বুঝলেন উলযিও।

কিছু জানল না,বুঝল না শুধু কন্যা। রাজধানী থেকে বহুদূরে  প্রাসাদ আর আঙুরক্ষেত  আর সমুদ্র নিয়ে যার দিন কাটছিল মহানন্দে। প্রতিদিন সূর্যোদয়ের সাথে সাথে, একাকী কন্যা আঙুর ক্ষেত টপকে হেঁটে যেত দূরে গ্রামের মধ্যে এক ছোট্ট গির্জায়। যেখানে একাকী যিশু দুহাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকতেন রক্তাক্ত ক্রুশে। পুবে লালনীল কাঁচের জানলা গলে আসা প্রথম সূর্যের আলো চুম্বন করত তাঁর চরণ যুগল। একাকী প্রার্থনা করত কন্যা,হাতের জপমালা ঘুরে যেত অবিশ্রাম,ওষ্ঠে কাতর ফিসফিস অনুরোধ,“আমায় ফিরিয়ে নাও প্রভু। আমি নিজের দেশে ফিরতে চাই। ” সেদিনও বিড়বিড় করে তাই বলছিল কন্যা, বেলা হয়েছে অথচ সূর্যের মুখ ডেকেছে গাঢ় মেঘ আর কুয়াশা। আচমকা কে যেন পিছন থেকে বলে উঠল,“তুমি কোনদিনই আর স্বদেশে ফিরতে পারবে না। ”হকচকিয়ে উঠল কন্যা,“কে?কার এত সাহস?” যিশুর পিছন থেকে বেরিয়ে এল এক অল্পবয়সী যুবা,পরনে যাজকের পোশাক, দুই চোখে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি,“আমি জানি। আমি জানি। একদিন তোমার জন্যই পুড়ে মরব আমি। উঃ আঃ জ্বলে গেলুম-হে ঈশ্বর”বলে আর্তনাদ করতে করতে দৌড়ে গির্জা ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে। হতচকিত  কন্যার বুক ধড়ফড়ানি কমলে ধীরে ধীরে দুর্গে ফিরে এল,পথে প্রতিজ্ঞা করল, আর কোনদিন একা যাবে না। দুজন প্রহরী সঙ্গে থাকলে হয়তো এমনটা হত না। দুর্গে প্রবেশ করা মাত্র দৌড়ে এল সখীরা,“রাজকন্যা, পত্র এসেছে। দেশ থেকে পত্র এসেছে। ” এতদিন-এত বছর পর-আনন্দে নেচে উঠল কন্যার প্রাণ।
(চলবে)
©Anindita Bhattacharya

No comments:

Post a Comment