Tuesday 11 September 2018

অনির ডাইরি


অনির ডাইরি ২/১১/১৮
সবে টিফিন বক্সের ঢাকায় লেগে থাকা, পাঁচফোড়ন আর শুকনো লঙ্কা দিয়ে হলুদ ছাড়া আলুর তরকারিটা আঙুল দিয়ে চেঁচে মুখে দিয়েছি, দরজা খুলে মুখ বাড়ালেন এক কৃষ্ণাঙ্গ  বয়স্ক ভদ্রলোক। “দিদি আসব?” পিছনে এক বয়স্কা মহিলা। এঁণাদের চিনি। মহিলা তাঁর স্বামীর গ্রাচুইটি চেয়ে কেস করেছেন। সেই কেসেরই হিয়ারিং আছে।কারখানাটি যখন বন্ধ হয়,তখন আমি কলেজে পড়ি। বর্তমানে মালিকপক্ষ বলে কেউ নেই। বার বার পাঠানো চিঠি ফেরৎ আসে। বন্ধ কারখানার ভেঙে পড়া দেওয়ালে আমার সই করা অগুন্তি চিঠি লটকান জারি করে ছবি তুলে নিয়ে এসেছে আমাদের ধীমান,নির্মল, কৌশিক। কারখানার জমিতে,ভেঙে পড়া শেডের তলায় কাশের মেলা।
গোটা সত্তর-আশিটা কেস এক পক্ষের কথা শুনেই অর্ডার দিয়েছি। এঁরা নতুন কেস করেছে। আগেও একদুবার এসেছেন। বয়স বছর পঁয়ষট্টি হবে। ভদ্রমহিলার সিমন্তে সিঁদুরের সুস্পষ্ট দাগ দেখেছিলাম। সঙ্গী ভদ্রলোকটির বয়স আশির কাছাকাছি। মহিলার প্রতি অত্যন্ত যত্নবান। সব কাগজপত্রও উনিই বহন করেন। মনে হল স্বামীই হবেন। নির্ঘাত প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর দ্বিতীয়বার বিবাহ করেছেন। এবার দুইজনে মিলে প্রথমের প্রাপ্য চাইছেন। চাইবেন নাই বা কেন?হকের টাকা।
যাই হোক,এই মুহূর্তে ওণাদের উকিল বাবু অনুপস্থিত। তাই সবিনয়ে বললাম,“একটু ওয়েট করুন। উকিল বাবু এলেই শুরু করব। ” ছোকরা উকিল আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন। ওকালতি ছাড়াও ছোকরার নানা ব্যাপারে উৎসাহ। প্লাস্টিক বর্জন, পরিবেশ দূষণ,সাপ সম্পর্কে মানুষের অকারণ ভয় দূরীকরণ, বৃক্ষ রোপন এবং সংরক্ষণ এসব নিয়ে চরকির মত ঘোরে। সম্প্রতি উত্তর বঙ্গে অনেক গাছ কাটা নিয়ে একটা ছোটখাট  স্বতঃস্ফূর্ত গণ অান্দোলন হয়। আমাদের এই উকিল বাবুটি ট্রেনে দাঁড়িয়ে-বসে,অসীম কষ্ট সহন করে চলে যায় উত্তরবঙ্গ প্রতিবাদ করতে। যাই হোক, আমার ঘরে ডেট থাকলে,ছোকরা টাইমেই আসে। কাল যে কি হল,আর আসেই না। নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পরে ফোন করে বলল,“ম্যাডাম,আমি হাওড়ায়। সেই ২০০৬ সাল থেকে পড়ে থাকা একটা গ্রাচুইটি কেসে আজ মালিকপক্ষ টাকা দিতে সম্মত হয়েছে। লেনদেন মিটিয়ে আসতে একটু সময় লাগবে।” আশ্বস্ত করলাম। আমি তো বাতানুকূল ঘরে বসে রুটিন কাজ করছি। যাঁরা বসে আছেন বাইরে,তাঁদেরই কষ্ট।
ঘন্টা দেড় দুই পর শুরু হল হিয়ারিং। আজ মহিলা এভিডেন্স দেবে। অর্থাৎ ওণার দাবীর সমর্থনে যা কাগজ পত্র আছে আর কি। দেখে নিলাম ভালো করে।অর্ডার লিখতে যদিও দেরী আছে। তবু ঠেকে শিখেছি,প্রথম বারেই দেখে নেওয়া ভালো। লাস্ট পে স্লিপ দেখলাম। এবার সুপার অ্যানুয়েশন লেটারের কপি খুঁজছি। উকিলবাবু বলল,“ ম্যাডাম ওণার সিভিল ডেথ হয়েছিল। মানে উনি নিখোঁজ। এই যে হাই কোর্টের অর্ডার। ” নিখোঁজ?কেমন যেন অদৃশ্য দেওয়ালে ধাক্কা খেলাম। মানে?মহিলা বললেন, “ কারখানা বন্ধ হওয়ার বছর চারেক বাদে উনি হঠাৎ একদিন বাড়ি ছেড়ে চলে যান। আর ফিরে আসেননি। ” বাতানুকূল যন্ত্রের বিরক্তকর ঘরঘর ছাড়া কোন শব্দ নেই। অনধিকার চর্চা তবু প্রশ্ন না করে পারলাম না,“ওণার কি অ্যালজাইমার্স রোগ ছিল?সব ভুলে যেতেন?” মহিলা এবং সঙ্গী পুরুষ একসাথে বলে উঠলেন,“না। না। দিব্যি শক্তসামর্থ্য,সুস্থ লোক। জলখাবার খেয়ে বললেন,একটু ঘুরে আসছি। দরজাটা বন্ধ করে দিও। ” ব্যাস? এরপর আর কখনও ফিরে আসেননি? মহিলা চশমা খুলে মুখ মুছলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন,“এর ঠিক একবছর বাদে,আমি ওণাকে দেখেছিলাম। সাইকেলে করে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে চলে গেলেন।  মনে হল আমায় দেখে আরো জোরে সাইকেল টেনে বেরিয়ে গেলেন। কে জানে? ভুলও দেখে থাকতে পারি,জানেন। চোখে চশমা ছিল না তো। তবে আমি জানি,। ওটা উনিই ছিলেন। তারপর কেটে গেছে একযুগেরও বেশী। ” জানতে চাইলাম, তারপর কি করলেন? উনি স্বাভাবিক স্বরে বললেন,“অপেক্ষা করলাম। আসেপাশে খুঁজলাম। দাদাদের বললাম। ওরা পুলিশে খবর দিল। কাগজে টিভিতে বিজ্ঞাপন দিল।” “পেলেন না?” “নাঃ।” শেষ প্রশ্ন করলাম,আপনাদের ইস্যু আছে?মানে সন্তান আর কি। মহিলা স্বাভাবিক সুরে বললেন,“না। আমি একাই থাকি। দাদারাই দেখে। বড়দাই তো আপনার এখানে নিয়ে এসেছে। ” এতক্ষণে বুঝলাম,সঙ্গী বয়স্ক ভদ্রলোক মহিলার দাদা। ফাইলে সই করে বললাম,ভালো থাকুন। আমি টাকা তো দিতে পারব না। তবে আমার যা করণীয় তা নিঁখুত ভাবে দ্রুত করে দেব। মহিলা করজোরে বললেন,“আশির্বাদ করুন। ”জিভ কেটে বললাম,আমি আশির্বাদ করার কে? আমি মামুলী সরকারী চাকর। তবে শুভেচ্ছা জানাতে তো পারি। বৃদ্ধকে বললাম,আপনিও ভালো থাকুন। এই স্বার্থপর,আত্মকেন্দ্রিক জগতে,কে কার কপর্দকশূন্য স্বামী পরিত্যক্তা বোনের জন্য এত করে বলুন? তাও আশি বছর বয়সে? ভদ্রলোক একগাল হেসে বললেন,“মায়ের পেটের বোন। আমরা না দেখলে কে দেখবে বলুন?”  হক কথা।  চলে যাবার আগে দেখলাম ওণারাও স্বাভাবিক হয়েছেন, জানালেন দীর্ঘ লড়াইয়ের পর মহিলার পেনশন চালু হয়েছে। মাসে হাজার দেড়েক,তাও নেই মামার থেকে কানা মামা ভালো। ছোকরা উকিলের অনেক প্রশস্তি করলেন,গরীব অসহায় মানুষের পাশে আজকাল কেই বা দাঁড়ায়? আমি যদিও এমন বেশ কিছু মানুষকে চিনি, এই ছোকরার মত,যারা প্রথাগত ইঁদুর দৌড়ের অংশীদার না হয়ে স্রোতের বিরুদ্ধে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে অসহায় ডুবতে থাকা মানুষের দিকে। সবাই যখন চলে যাচ্ছে ছোকরাকে বললাম, “তুমিও ভালো থেকো। আর এই ভাবেই আমায় জ্বালাতে থেকো। ”

অনির ডাইরি ১০সেপ্টেম্বর ২০১৮
গতকাল বনধ ছিল না? আহাঃ যাই বলুন বনধের দিন অফিস করার মজাই আলাদা। তাও সেই রকম কুলীন বন্ধ আজকাল আর হয় কোথায়?সে তো হত সেকালে। কল্লোলিনী তিলোত্তমা যাদুকাঠিতে পলকে জনশূণ্য মৃতপুরী।কাকভোরে যাও বা এক আধটা দুষ্টু ড্রাইভার বাস বার করত,সূর্যি মামা আড়ামোড়া ভাঙার সাথে সাথেই দড়াম। নেতার স্বহস্তে প্রক্ষিপ্ত আধলা ইঁটের চুম্বনে ঝনঝনিয়ে ভেঙে পড়ল বাসের কাঁচ। রিক্সা করে গলি গলি দিয়ে কেটে পড়বেন? মোড়ে মোড়ে কুচো নেতাদের জটলা। এই তো পাইছি, একটা রিক্সাওয়ালা পাইছি। কি রে ব্যাটা! বনধের দিন রুজির ধান্ধায় বেরোনো। মুলে দে ব্যাটার কান। সওয়ারি যদি দিদি বা বউদি হত তো কান মোলা খেয়ে রিক্সাওয়ালাকে আবার তাকে বাড়ি পৌঁছেও দিতে হত। সেবার এমন বনধ ডাকা হল যে, তিন মাস দ্বারভাঙায় ট্রেনিং করে মা আর বাড়িই ফিরতে পারল না। গোটা দিন অবাতানুকূল কামরায় সিদ্ধ হল, ট্রেন আটকে রইল ঝাঁঝাঁয়। সদ্য চাকরী পেয়েছি, শুধু মেডিকেল টুকু যা বাকি। ডাকা হল দুদিন ব্যাপী বনধ। আরটু হলেই যেত আমার চাকরীটাই ইন দা হোলি ভোগ অব মা।

তো যাই হোক,বনধ উপলক্ষে চেনা গলিঘুজি, চেনা রাস্তা, চেনা শহরের এই অচেনা মুখ আমার বরাবারই দারুণ লাগে। কান মুলে বেতন দেব না অথবা “ডায়েজ নন”করে দেব বলে ভয় না দেখালেও আমি বনধে অফিস যেতাম।

বনধের দিন অফিসে পদার্পণ করেই বেরোলাম ইন্সপেকশনে। সঙ্গী আমার দুই অতিপ্রিয় ইন্সপেক্টর নির্মল শেঠ আর সঞ্চিতা দাস পোদ্দার। নতুন বড় সাহেবের নির্দেশ, “অসংগঠিত ক্ষেত্র তো অনেক দেখলি বাবা, এবার একটু সংগঠিত ক্ষেত্রেও নজর দে। ” পুজো আসছে, বোনাস শুধু সব শ্রমিকের প্রত্যাশা নয় ন্যায্য দাবীও বটে। সংস্থা গুলো যথাযথ বোনাস দিচ্ছে কি না,অথবা আদৌ দিচ্ছে কিনা এটা দেখাই আপাততঃ আমাদের মূল লক্ষ্য।
প্রথম কারখানাটিতে প্লাস্টিকের পাইপ তৈরি হয়। ঝিম ঝিম দুপুর। নীলাকাশে উড়ছে চিল। হর্ন বাজাতে সিকিউরিটি থতমত খেয়ে ফোন করল ম্যানেজারকে।কি বলছে? কারা আবার জ্বালাতে এল? ম্যানেজার বাবু সদাহাস্যময় সৌম্যদর্শন প্রৌঢ়। জানালাম ভয়ের কিছু নেই। রুটিন ইন্সপেকশন। যে খাতাপত্র দেখতে চাওয়া হবে,দেখিয়ে দিন। না থাকলে লিখিত ভাবে জানিয়ে বানিয়ে নিতে হবে।পুকুরচুরি না হলে, দিব্যি গড়গড়িয়ে চলা ইন্ডাস্ট্রীকে উৎপাত করার সদিচ্ছা আমাদের নেই।বাতানুকূল অফিস ঘরে, নির্মল আর সঞ্চিতা গম্ভীর মুখে খাতাপত্র দেখছে, বাইরে বিশাল শেডে টনটন পাইপ সাজিয়ে রাখা। লরিতে তোলা হচ্ছে। একপাশে থরে থরে সিমেন্টের বস্তার মত কি সব রাখা। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম ওগুলো রমেটিরিয়াল। সুপ্ত ইচ্ছা ছিলই,ম্যানেজার সাহেব প্রস্তাব দিলেন,“ম্যাডাম ফাক্টরিটা একবার ঘুরে দেখবেন নাকি?”বিশাল লম্বা শেডের একদিকে দৈত্যাকৃতি ফানেলে ঢালা হচ্ছে সাদা গুড়ো, অতঃপর লম্বা মেশিন চলেছে তো চলেছেই- একজায়গায় অনেক টেম্পারেচার জ্বলজ্বল করছে-বিভিন্ন তাপমাত্রায় তৈরি হচ্ছে নানা গেজের পাইপ। কোথাও জল ঢেলে ঠান্ডা হচ্ছে। একদম ঐ প্রান্ত থেকে বেরিয়ে আসছে না না বর্ণের এবং ব্যাসের পাইপ।

পরের কারখানার সামনে গিয়ে হর্ন বাজিয়েই চলেছে গাড়ি, খোলেই না দরজা। কি ব্যাপাররে ভাই?বেশ কিছুক্ষণ পর সিকিউরিটি পাশের পুচকে দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল,“ফেক্টরি ফাঁকা। কেউ নেই। আজ বনধ না। ” ধ্যার ব্যাটা বনধ। সরকার সমর্থনই করে না বনধ। দরজা খোল,দেখি কেমন ফাঁকা। মিনিট পাঁচেক ধরে ধানাইপানাই করে শেষে বলে,“ দরজা খুললে চাকরী থাকবে না, স্যার। ” কে খাবে চাকরী?“ম্যানজার বাবু। ” হর্ণ বাজিয়ে, বিকট চিৎকার চেঁচামিচি করার পর, শার্টের বোতাম আটকাতে দৌড়ে এলেন ম্যানেজার বাবু।একনজরে মনে হল দক্ষিণভারতীয়। কপালে কমলা সিঁদুরের টিকা।  “ সরি সার। সরি মেডাম। একটু হাল্কা হতে গেইছিলুম আর কি।এই ইস্টুপিডটা খোল দরজা।” চিচিং ফাঁক। গড়গড় করে খুলে গেল দরজা।  চকচকে দরজার ওপাশে হলুদ ধুলোয় মাখামাখি একদল লোক। এই তোর ফাঁকা ফেক্টরী? সামনেই রাশিকৃত পেঁয়াজের খোসা। সরু সিড়িঁ বেয়ে উঠে অফিস ঘর। সবকিছুতে কেমন যেন কালিঝুলি মাখানো। আধা অন্ধকার অফিস ঘরে একজন খালি গায়ে কে জানে কি করছিল। আমাকে আর সঞ্চিতাকে দেখে এবং ইস্টুপিড গালি খেয়ে দৌড়ল শার্ট খুঁজতে। আমাদের বসিয়ে না না খাতাপত্র দেখাচ্ছে, খালি গায়ের লোকটা জামা পরে এসে চটজলদি টেনে দিল জানলা গুলো। চলল বাতানুকূল যন্ত্র। তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম, এসির গায়ে স্টীলের জালজাল জামা। অবাক হয়ে জানতে চাইলাম,বাতানুকূল যন্ত্রকে জামা পরিয়েছেন কেন। ‘ম্যানজার বাবু’ দন্তরুচি কৌমুদী করে জানালেন “এজ্ঞে বড় ইন্দুরের উৎপাত। ” এত ইঁদুর যে এসিকে জামা পরাতে হয়?এই আপনাদের কিসের ফ্যাক্টরী  বলুন তো?জবাব এল এজ্ঞে ছাতুর। টেবিলে কম্প্যুটারের আসেপাশে বেশকিছু প্যাকেট বন্দী ভুট্টার দানা। আমি আর সঞ্চিতা জানতে চাইলাম কিসের ছাতু?ছোলা আইজ্ঞা। ছোলা?কেনেন কোথা থেকে? উত্তরপ্রদেশ-মহারাষ্ট্র-পাঞ্জাব আজ্ঞে। ওখানকার ছোলা কিনে আমাদের রাজ্যে ছাতু করেন? জে আজ্ঞে। আর এই ভুট্টা দানার কি করেন,ম্যানেজার সাহেব হিন্দি মিশ্রিত বাংলায় জানালেন,“ঐ গরু টরু খায় আইজ্ঞা। ”
তৃতীয় কারখানাটি বিশাল। যেমন দৈর্ঘ্য,তেমনি প্রস্থ। বেকিংএর সৌরভে মম করছে হাইরোড অবধি। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে, আমার দুই দক্ষ সহকর্মী খাতাপত্র দেখতে ব্যস্ত। জানতে চাইলাম কিসের কারখানা? জবাব পেলাম বিস্কুট। ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলাম দেখতে পেতে পারি কি?পাইপের কারখানায় তো কিছুই বুঝতে পারলাম না, কি ভাবে কি হয়। এনারা সানন্দে রাজি। বিশাল শেডের তলায় অতিকায় সব মেশিন পত্র। কোথাও মাখা হচ্ছে ময়দা। কোথাও মেশিন তাকে বেলে পাতলা পাত বানাচ্ছে। সেই পাত কিছুদূর এগোবার পর ছাঁচে ফেলে কাটা হচ্ছে, কাটা বিস্কুট গুলি এদিয়ে যাচ্ছে ওভেনের দিকে। আর বাদপরা ময়দার পাত আবার গিয়ে মিশে যাচ্ছে যেখানে মাখা হচ্ছে ময়দা। ওভেনে বেক হবার পর টপ টাইপের বিস্কুটের গায়ে স্প্রে করা হচ্ছে তেল। কোকো পামওয়েল বললেন সম্ভবত। আর ক্রীম ক্রেকার টাইপের বিস্কুটগুলি সোজা চলে যাচ্ছে প্যাক হতে। জানতে চাইলাম কি দিয়ে মাখা হয় মণ্ড গুলি?জবাব পেলাম ময়দা, ডালডা,চিনি আর মল্ট। দুধ মেশালে খরচ অনেক বেড়ে যায়। তাই মল্ট মেশান। মল্ট মানে যব তো? ওণারা বললেন,যব থাকে। আরও অনেককিছু থাকে। এই মল্ট কি দিশী না বিলিতি?কয়েকমাস আগে এক বিশ্ববিখ্যাত মদ তৈরির কারখানার এইচআর ম্যানেজার গল্প করে গিয়েছিলেন,ওণাদের মদ্য প্রস্তুত হয় খাস বিলাইতি মল্ট থেকে। জাহাজে করে মল্ট নামে কলকাতার বুকে। এরা জানালেন না,না। পাতি দিশী মল্ট। আর মেশে পোড়া বিস্কুটের গুঁড়ো। ওভার বেকড বিস্কুটগুলি বাছাই করে একটা বাথটবে রাখা হয়। সেগুলি মেশিনে গুড়ো করে  দুএক কিলো মেশানো হয় ময়দার সাথে। হেসে বললাম,“কিচ্ছু ফেলেন না, নাকি?” ওঁরা সলজ্জ ভঙ্গীতে কান চুলকে বলল,“এজ্ঞে মেডাম, একটা কথা বলব?আপনার বাচ্ছাকাচ্ছা আছে তো?খবরদার ক্রীম বিস্কুট খেতে দিবেন না। ঐটা কিন্তু ক্রীন লয়,ঐটি ডালডা। বিদেশী বিস্কুটে কি দেয় জানি না। দিশী সব ডালডায় ভর্তি। ”তুত্তুরীর প্রিয় গোটা দুই চকোলেট বিস্কুটের নাম করলাম,“এগুলো?এতেও?”জবাব পেলাম হ্যাঁ। গাড়িতে উঠে সঞ্চিতা বলল,“কি হবে ম্যাডাম?আমার ছেলের তো ঐগুলো খুব প্রিয়?” ধুর এত ভাবলে চলে?বাবা যেন কি বলে প্রায়ই,“মন্বন্তরে মরিনি আমরা-মারি নিয়ে ঘর করি। ”সামান্য ক্রীমগন্ধী ডালডার সাধ্য কি বাঙালীর স্বাস্থ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলে? অবশ্য আপনি কি করবেন, সে সিদ্ধান্ত আপনার। সবটুকুই কার্যসূত্রে শোনা গপ্প, কষ্টিপাথরে যাচাই আর কে করতে গেছে?

অনির ডাইরি ১৫/০৯/১৮
পায়ের তলায় সর্ষে
আমি প্রায় বলি যে আমার জীবনের সবথেকে সেরা মুহূর্ত গুলি না তো ক্যামেরা বন্দী করতে পেরেছি, নাই সোশাল মিডিয়ায় আপলোড করতে পেরেছি। সময়টা ২০০৮। তখনও অবিবাহিত। বেড়াতে এসেছি উত্তর ভারত। বাবা-মা,তিন মাসি, মেসোমশাই,বোন এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজন ও তাদের বন্ধু পরিবার নিয়ে প্রায় জনা কুড়ির দল।আমাদের মত জনা তিন কেবল কুড়ির কোঠায় বাদে সকলেই বয়োজেষ্ঠ্য।  আমরা ওভাবেই যেতাম।আড্ডা দিতে দিতে বেড়ানো আর বেড়াতে বেড়াতে আড্ডা।
হরিদ্বার থেকে হলুদ চাটার্ড বাসে রওনা দিলাম হরিদ্বার থেকে। আমাদের বেড়ানোর আর একটা বৈশিষ্ট্য ছিল,সবসময় অব সিজনের শুরুতে আমরা গিয়ে হাজির হতাম। পর্যটকদের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত শহর নগরের আচমকা ক্লান্ত,ঝিমানো রূপ বড়ই মধুর লাগত। ফাঁকা ফাঁকা সড়কে ধুলি উড়িয়ে বেড়ানো শুকনো পাতা, ধরমশালার সার সার তালা বন্ধ ঘরের নিস্তব্ধতা কেমন যেন নেশা ধরিয়ে দিত।
সারাদিন বাস গড়াল,পিছনের সিটে বসে এন্তার গান গাওয়া, ফাল্গুনি কাকু মাঝে মাঝে নামছে আর কমলা গুলি লজেঞ্জ কিনে আনছে। যারই গা গুলোচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে একটা মুখে পুরে দিচ্ছে। ধীরে ধীরে বদলাল পাহাড়ের প্রকৃতি। বদলাল গাছপালা। নদীর জলের রঙ সাদা থেকে হাল্কা নীল হল যেন। বদলাল রাস্তার চরিত্র। বিকালে নামলাম উত্তরকাশি। ফাঁকা ধুধু করছে। গলি গলি দিয়ে হেঁটে গিয়ে লালকমলী মার্কা ধরমশালায় রাত্রিযাপন। সন্ধ্যের অন্ধকারে হেঁটে গিয়ে টিমটিমে বাল্বের আলোয় পুজো দেওয়া। পুরোহিত নেই। বাড়ি চলে গেছে। ভোলা মহেশ্বর একা নিঃসঙ্গ বসে আছেন। আবার অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে ফেরা। সারা রাত কানের কাছে গঙ্গার গর্জন।সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ঝলমলিয়ে উঠলেন নদীর বুকে বিশাল মহাদেব।
পরদিন নটার মধ্যে উত্তরকাশিকে বিদায় জানিয়ে আবার বেরিয়ে পড়া।এবার হিমালয় বড় রুখা। বিশাল বিশাল গাছ বহুনীচে থেকে খাড়া উঠে এসেছে। গিরিখাতের বুকে খঞ্জর চালিয়ে এগিয়ে যাওয়া নদীর জলে মিশেছে যেন আকাশ। আর আকাশ এত নীল হয়?টলটলে নীল আকাশ। আর রাস্তা?রাস্তা তো নেই দাদা। শুধু ধ্বংসস্তুপ। ধ্বসে পড়া পাথরকে পিসে দিয়ে টলতে টলতে এগোল বাস। গা গুলোনো বেড়ে গেল বহুদিন। আর দোকানপাট,মানুষজন কিছুই নেই। আছে শুধু হিমালয় আর আমরা। পলকে পলকে বাস বাঁক নিচ্ছে,একবার আর্তনাদ করে উঠল মা,দেখলাম বাসের সামনের একটা চাকা রাস্তায় আর একটা ঝুলন্ত। ড্রাইভারের বিশেষ হেলদোল নেই। হেঁইও,ঘুরে গেল বাস,হাফ ঝুলে ঝপাং করে রাস্তায় উঠলাম আমরা।
সন্ধ্যে নামার মুখে গঙ্গোত্রীতে পৌছলাম। ঠাণ্ডার কামড় বেশ বুঝতে পারলাম। চড়চড় করে ফেটে গেল পিঠের চামড়া।জিন্স, সোয়েটার, জ্যাকেট,টুপি চাদরেও হিহি করতে করতে ব্যাগ কাঁধে বাজারের ভিতর দিয়ে গঙ্গার ওপাড়ে যেতে হবে। নামা মাত্রই মা আরও বয়স্ক কয়েকজনের শুরু হল শ্বাসকষ্ট। বাতাসে অক্সিজেন বেশ কম। চোখের সামনে যে পাহাড়,তা আর সবুজ নয়। সবুজ ঝাউ টাইপ গাছের লাইন একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায় শেষ। তারওপরে কিছুদূর খসখসে পাথুরে পাহাড়,তারওপর জমাট বাঁধা সাদা বরফ। পড়ন্ত সূর্যের দীপ্তিতে গোলাপী সোনালী সাদা-

গঙ্গোত্রীর এপাশটা বেশ নিরিবিলি। ওপাড়ে ঝলমলে শহর,এপাড়ে নিকষ আঁধার। শীতের কামড়ও বহুগুণ বেশী যেন। যে ধরমশালায় থাকার কথা,গিয়ে জানা গেল তিন দিন ধরে পাওয়ার নেই। জেনারেটর চলে চলে ক্লান্ত।আর তেলও নেই। মোমবাতি ও পাঁচ ছটার  বেশী নেই। পুরো ধরমশালায় আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। কয়েকজনের একতলা আর কয়েকজনের দোতলায় ঘর বরাদ্দ  হল। অন্ধকার হিমশীতল ঘরে ঢোকা মাত্র হাড়ে হাড়ে কটকটি বাদ্য শুনতে পেলাম। এলসিডি টর্চ তো জ্বললই না। দুম করে চার্জ শেষ হয়ে গেল সবকটা মোবাইলের। টাওয়ার তো উড়ে গিয়েছিল অনেক আগেই।
এই অন্ধকারে আলাদা আলাদা থাকা অসম্ভব।কি অসহনীয় নিস্তব্ধতা। কানে যেন তালা ধরে যায়।  একটা বড় ঘরে আটজন থাকব ঠিক হল। তিনটি পুঁচকে সিঙ্গল খাটে বাবা-মা আর তিন মাসি ভাগ করে শুল। আর মাটিতে মেসোমশাই,আমার বোন দীপু আর আমি। মাটির ওপর একটা তোশক দিয়ে গেল কেয়ারটেকার,যার বয়স বড়জোর তেরো কি চোদ্দ। আর গায়ে দেবার জন্য লেপ। সেই লেপের ওজন কমসেকম দশ কিলো তো হবেই।
এবার মোমবাতির রেশন হল।রান্নাঘরে একটা,সিঁড়ির সামনে একটা আর তিনটি ঘরে একটি করে। একটি রিজার্ভ রইল রাতের জন্য। আটজন মানুষ একটি ঘরে,উপরন্তু একটি মোমবাতি, অক্সিজেনের সামগ্রিক অভাব বুঝতে লাগল মিনিট পাঁচ। তড়িঘড়ি মোমবাতিটিকে ঘরের বাইরে রেখে এলেনভ মেসোমশাই। ঐ প্রগাঢ় অন্ধকারে পা থেকে মাথা অবধি উলের জিনিসপত্রে ঢেকে দশ কিলো লেপের তলায় জড়াজড়ি করে শুয়েও ঠকঠক করে কাঁপছিলাম দীপু আর আমি। এমন সময় শুরু হল বাবা আর মায়ের দাম্পত্যকলহ। বাবা চেইন স্মোকার। তারওপর ফুসফুসের অসুখে আক্রান্ত, বার দুয়েক নিউমোনিয়া হয়ে গেছে। ফলে মায়ের উদ্বিগ্ন  হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। হাতে গ্লাভস্ পরো আর এই ঠাণ্ডায় সিগারেট খেয়ো না-এই টুকু বলাই ছিল মায়ের অপরাধ।
বাবা ক্রুদ্ধ হয়ে টুপি,গ্লাভস,মোজা না পরেই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। বলাইবাহুল্য সিগারেট আর দেশলাই কিন্তু ভোলেনি। মায়ের টেনশন কমাতে অগত্যা আমাকেই উঠতে হল লেপের ওম ছেড়ে বৃদ্ধকে খুঁজতে। ঘরের সামনের মোমবাতির শিখা থিরথির করে কাঁপছে,নিশ্চুপ ভুতুড়ে ধরমশালায় কেবল প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আমার পায়ের আওয়াজ। প্যাসেজের মোমবাতি নিভু নিভু। গেল কোথায়?তবে কি এই ঠাণ্ডায় খালি মাথায়,খালি পায়ে রাস্তায় বেরিয়েছে?সর্বনাশ। অবধারিত নিউমোনিয়া। পায়ে পায়ে দরজা খুলে বাইরে এলাম। শীতল হাওয়া যেন পলকে সব পশমী বস্ত্রের আস্তর ভেদ করে ফালা ফালা করে দিল। দূরে গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে আছে বাবা। হাতে জ্বলন্ত সিগারেটের আগুনটা যেন এক জ্বলন্ত জোনাকি। চিৎকার করে ডাকতে গিয়েও পারলাম না,মোহিত হয়ে গেলাম নৈশ প্রকৃতির ভুবনমোহিনী রূপে। মাথার ওপর দিগন্তবিস্তৃত মসিকৃষ্ণ মহাকাশ,আর তার গায়ে খচিত শতসহস্র হীরের কুচির মত ঝকঝকে তারা।যেন হাত বাড়ালেই ধরতে পারি আমার নিজস্ব কোহিনুর। ঘোর অন্ধকারে গঙ্গার ওপাড়ের শহরের টিপ টিপ আলো যেন কালো সিল্কের শাড়িতে খচিত সলমা চুমকির আলপনা। আর অদূরে পাহাড়ের মাথায় বরফের মুকুট -সব মিলিয়ে বোধহয় এই অধমের ক্ষুদ্র জীবনের সবথেকে মোহময়, রোমাঞ্চকর মুহূর্ত ছিল সেটা।
অনির সাপ্তাহিক রোজনামচা ১৮-২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৮
প্রথম কর্মদিবস
“যদি কিছু মনে না করেন, কি হয়েছিল?” সামনে যিনি বসে আছেন, মুখটা কেমন যেন চেনা চেনা। বয়স বেশী না, ত্রিশের কোঠায়। নিরাভরণ।পরনে সাদামাটা ছাপা কুর্তা-পাজামা, হাতে একটা সস্তা প্লাস্টিকের ব্যাগ, তাতে এক গাদা কাগজ। শুকনো মুখে একজোড়া ছলছল আঁখি। ব্যাপারটা কিছুটা জানি, ওনার স্বামী আমাদের একজন নথিভুক্ত শ্রমিক ছিলেন, অকস্মাৎ মারা গেছেন। জনৈক সিনিয়র দিদি বার দুয়েক ফোনে অনুরোধ জানিয়েছে, “বড় অসহায়, একটু দেখিস।“ কি কি করতে হবে, আগের দিন আমাদের প্রীতি বলেই দিয়েছিল, আজ জমা করতে এসেছেন। আগের দিন ব্যস্ত ছিলাম, তাই আর ঘরে ঢুকতে সাহস পাননি, আজ ফাঁকা দেখে একবার সাক্ষাৎ করতে এসেছেন। কাজের কথা হয়ে যাবার পরও দেখলাম মেয়েটি উঠল না। বসে বসে শূন্য হাতে কাল্পনিক চুড়ি ঘুরিয়ে চলেছে। কেন জানি না মনে হল, ও কিছু বলতে চায়। এতটাই ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে কোন প্রশ্নোত্তর আমার রুচিতে বাঁধে, কিন্তু মন বলল, ইনি জানাতে চান,নিছক অনুদান বা বেনেফিটের জন্য নয়, আমার এই নির্জন চেম্বারের  বুড়ো বাতানুকূল যন্ত্রের বাতাসে একটু শ্বাস  নিতে চান।
“হার্ট অ্যাটাক। বুঝতেও পারিনি জানেন।“ বলতে বলতেই ধরে এল গলা, বললাম, “প্লিজ কাঁদবেন না।“ মেয়েটি মাথা তুলে ফলস শিলিং এর আলো দেখতে দেখতে বলল, “আর পারছি না ম্যাডাম, জানেন তো। সেদিন থেকে কাঁদতে পারিনি। কখনও বুড়ো বাবা-মা, কখনও মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে। আর পারছি না।“ কি বলি। মেয়েটি কড়ে আঙুল দিয়ে গড়িয়ে পরা এক ফোঁটা চোখের জল ঝেড়ে ফেলে বলল, “সব পাপ। জানেন তো। সব পাপ।“ কিসের পাপ? “বাবা-মা নিষেধ করেছিল, বার বার নিষেধ করেছিল, এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করিস না। ঐ ছেলেকে করিস না।শুনিনি। প্রেমে অন্ধ ছিলাম কিনা। উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোবার আগেই পালিয়ে বিয়ে করলাম, তখন ও কাঠ বেকার।বাবা বলেছিল ‘তুই কখনও সুখী হবি না। কিন্তু বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, সুখেই তো ছিলাম। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মেয়ে হল। কি আনন্দ ওর। মেয়ে ছিল ওর প্রাণ। এমনি তে শান্তশিষ্ট, কিন্তু বাপ আর মেয়ে এককাট্টা হলে কি হুড়োহুড়ি।“ মৃদু হেসে উঠল মেয়েটি। “মেয়েটা টেনে উঠেছে। কত শখ ছিল, মেয়ে ডাক্তার হবে-“। দুজনেই চুপ, বুড়ো এসি একাই ঘড়ঘড়িয়ে চলেছে, মেয়েটি পায়ের দিকে তাকিয়ে বসেছিল, এবার চোখ তুলে বলল, “বাবা-মার অবাধ্য হবার শাস্তি পেলাম, বলুন ম্যাডাম? নাহলে, ৩৯? মাত্র ৩৯ বছরে কেউ এভাবে চলে যায়? কি হয়েছিল জানেন? আগের রাতে খুব ঘাম হচ্ছিল, ঘাড়ে আর পিঠে বেদনা, তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম, ডাক্তার বললেন, ‘ও কিছু নয় গ্যাস।‘ সেদিন বাড়িতে খাসির মাংস রান্না করেছিলাম, আর রাতে ওকে ছাতুর ঘোল খেতে দিল, খেতে খেতে বলল, “ কোথায় মাংস খাব ভাবলাম, তুমি মাংসটা ফ্রিজে রেখে দাও। কাল বাড়ি গিয়ে খাব। গ্যাসই তো। কাল ছেড়ে দেবে-“। সকালে উঠে মাংসটা তড়িঘড়ি গরম করতে বসালাম, যদি ছেড়ে দেয়-“। দীর্ঘক্ষণ নীরবতা, এবার আমি একটু উসখুস করে উঠলাম অজান্তে, একটু পরেই একটা মিটিং আছে, কয়েকজন মুখ বাড়িয়ে গেল নীরবে। মেয়েটি অবশ্য দরজার দিকে পিছন করে বসেছে, তবু কি বুঝল কে জানে, আনমনা হয়ে, কাগজ গুলো প্লাস্টিকে ঢোকাল, “সরি ম্যাডাম, নিজের দুঃখের কথা বলে আপনাকে বিব্রত করলাম। আসলে কাউকে বলতে পারছি না। মেয়েটা সেদিন থেকে কাঁদেনি জানেন তো? ফিরে এসেই বই নিয়ে বসেছে, খালি এক কথা “বাপি বলত ডাক্তার হতে, আমায় হতেই হবে। “ আমার বাবা-মাও ছুটে এসেছে, ওরাই সব সামলাচ্ছে, তবু খালি মনে হচ্ছে, সেদিন ওদের অবাধ্য না হলেই বোধহয় ভালো হত বলুন। লোকটা হয়তো-“।
দ্বিতীয় কর্মদিবস
হিয়ারিং চলছে, কারখানা ইন্সপেকশন করতে গিয়ে যথারীতি কিছুই পাওয়া যায়নি। কোন রেজিস্টার, লাইসেন্স কিস্যু না। এসব ক্ষেত্রে এরা সবাই একই কথা বলে, “আছে স্যার। সঅব আছে।“ হয় বলবে আলমারির মধ্যে আছে, তালা মেরে ম্যানজার বাবু ঘুরতে গেছেন, নয় বলবে হেড অফিসে আছে, নয় বলবে জাহান্নমে আছে, কিন্তু আছে। বেশ আছে তো এসে দেখিয়ে যাও। হিয়ারিং চলাকালীন অন্য গল্প শোনা যায়, যে খাতাপত্র বলা হয়, তার কিছুই পাওয়া যায়না। কিছু বললেই বলবে, “হুজুর, মাই বাপ, বানিয়ে ফেলব। যা আইনে আছে তাই দিব। শুধু কোর্টে তুলবেন না।“ খুব ত্যাঁদড় মালিকপক্ষ না হলে, বা বিশাল নিয়মভঙ্গ না করলে, আমরাও চাই না কাউকে আদালতে তুলতে।এমনিতেই শিল্পের যা হাল, যেটুকু আছে, সেটুকু বেঁচেবর্তে থাক বাবা। এটা সেই ছাতুর কারখানা, যারা কিছুতেই দরজা খুলছিল না, কারখানায় খালি গা- হাফ প্যান্ট বা লুঙ্গি-গামছা পরা যাদের দেখেছিলাম, তারা কেউ আসেনি। দিব্য ভদ্রসভ্য পোশাক পরা দুই সৌম্য দর্শন ভদ্রলোক এসেছেন। একই বুলি, “স্যার, ম্যাডাম যা বলবেন সব করে দেব।“ আমাদের নির্মল প্রচুর ভাও খাচ্ছে, “ ম্যাডাম তাহলে এটা কেস দিয়েই দি। একটা ছোট কেস, হাজার খানেক ফাইন হবে।“ দুই ভদ্রলোক না স্যার, একটা সুযোগ দিন ম্যডাম করছেন, এরই মধ্যে নির্মল বলল, “ম্যাডাম এরা সেই ছাতু তৈরির কারখানাটা। বুঝলেন তো? যারা দরজা খুলতে চাইছিল না।“ দিব্যি মনে আছে, সবথেকে বেশী মনে আছে, ইঁদুরের ভয়ে এসির গায়ে স্টিলের জালিওলা জামা পরানোর কথা। বললাম, পরিস্থিতি লঘু করার জন্য। দুই ভদ্রলোক বললেন, “হ্যাঁ ম্যাডাম। ইঁদুরে খুব জ্বালায়। সব কেটেকুটে ছিঁড়ে খুঁড়ে খায়। কিন্তু মালিকের নির্দেশ কোন ইঁদুর মারা চলবে না। বিষ তো দূরের কথা, হাত পা দিয়েও মারা চলবে না।“ অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, আপনাদের মালিক জৈন বুঝি? দুজনে মাথা নেড়ে বললেন, “না ম্যাডাম। বিহারী হিন্দু। গণেশের বাহন না ইঁদুর? তাই ওনার হুকুম ওরা যা খায় খাক। পেট পুরে খেয়ে বেঁচে থাকুক।“ নির্মল কোনমতে হাসি চেপে বলল, “ও সব ইঁদুর বাঁদর অনেক হয়েছে, এবার লেবার গুলোকে একটু দেখুন। লেবারদের মেরে মূষিক মহারাজের সেবা করা, ম্যাডাম এদের একটা কেস দিতেই হবে দেখছি।“
তৃতীয় কর্মদিবস
শিয়ালদা মেন লাইনের দাগী ষ্টেশন সোদপুর। বিগত দু বছরে কতবার যে সোদপুরে অবরোধ আর গণ্ডগোল হল, তার ইয়ত্তা নেই। আজো নির্ঘাত কিছু হয়েছে, ট্রেন আর নড়েই না।যেমন গা জ্বালানো গরম, তেমনি ঠাসাঠাসি ভিড়। তারই মধ্যে হকারদের উৎপাত। “সোনা নেবে নাকি? সোনা?” মহিলা ঝুটো সোনার গয়না বিক্রি করে। ডিজাইন বেশ ভালো, অন্যান্য সহযাত্রীনিরা  পাঁজা পাঁজা কেনেন, আমি একবারই কিনে পরেছিলাম, ঘামে জলে রঙটা উঠে যেতেই হাতে  এমন জল ভরা গুড়ি গুড়ি ফোস্কা উঠল যে বাপ বাপ বলে খুলতে বাধ্য হলাম। তাও দিদি ছাড়ে না। ভিড়ে ভরা কামরায় খুঁজে খুঁজে আমাদেরই বার করে, এবং আগে গয়না কিনতে পেড়াপিড়ি করে তারপর না না গপ্প করে। আজও তাই, একটা প্লাস্টিকের শাঁখা, কিছুতেই নেব না, আর গয়না দিদিও ছাড়বে না। দেখতে দারুণ। লোভও লাগছিল, যদিও পরতে গিয়ে দেখি ফাটা। গয়না দিদি ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, “দাড়াও কাল এনে দেব। তোমার মাপের।“ ট্রেন দৌড়চ্ছে, পার্শ্ববর্তিনীর সাথে অলস গল্প করছি, গয়না দিদি সামনে দাঁড়িয়ে খদ্দেরদের সাথে বার্তালাপ করছে, হঠাৎ আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আচ্ছা, তোমাদের একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করব?” ব্যক্তিগত প্রশ্ন শুনলেই মনে হয়, নির্ঘাত প্রশ্ন করবে, বিয়ে করেছি কি না, বাচ্ছা কাচ্ছা কটি ইত্যাদি। সেইমত মানসিক প্রস্তুতি নিলাম, দিদি বললেন, “ কি খেলে কাউকে ভোলা যায়?” মানে? দুই সহযাত্রী এক সাথেই বলে উঠলাম, “তোমার প্রশ্নটা বুঝলাম না বাপু।“  গয়না দিদি আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে এল, ট্রেনের ঘটাং ঘটাং আওয়াজ আর নিত্যযাত্রীদের মাছের বাজারের ভিতর মিনমিনে স্বরে প্রায় ফিসফিস করে বলল, “মানে, তোমরা তো এত পড়ানেখা করেছ, এমন কি কোন ওষুধ আছে? যা খেলে কাউকে ভোলা যায়?” আমরা দুজনেই হতভম্ব, এবার কি প্রশ্ন। গয়না দিদি গলা খাকরে বলল, “ তাহলে বলি শোন, আমার মেয়েটা যখন খুব ছোট, আমার বর আমায় ছেড়ে চলে যায়। কি কষ্ট করে যে মেয়েকে মানুষ করেছি, তা আমিই জানি। আজ সেই মিনসে ফিরে এসেছে। বলে কি, সেই বজ্জাত মাগীটাকেও রাখবে আর আমাকেও। আমার কি করা উচিৎ তোমরা বল।“ পার্শ্ববর্তিনী কিছু বলার আগেই আমি খটখট করে বলে উঠলাম, “কি আর করবে? মুড়ো খ্যাংরা দিয়ে পিটিয়ে সেই হারামজাদাকে এই দণ্ডেই ঘর থেকে দূর করে দাও।“ সহযাত্রীও সায় দিল, “একদম।“ গয়না দিদি মাথা নত করে বলল,” আমার মেয়েও তাই বলে।“ দুজনে মিলিত ভাবে বললাম, “তোমার মেয়ের মাথায় ঘিলু আছে বলতে হবে।“ গয়না দিদি এবার চাপা হাহাকার করে উঠল, “কিন্তু আমি যে তাঁকে ভুলতে পারিনি গো দিদিরা। পনেরো বচ্ছর হয়ে গেছে, আজও ভুলতে পারিনি। তোমরাই বল না, কি করি? কোন ওষুধ যদি থাকে? যা খেলে তাদের কথা আর মনেই পড়বে না, যারা একদণ্ডের জন্যও আমাদের ভালোবাসেনি, আর আমরা প্রতিটি মুহূর্ত যাদের ভালবেসে চলেছি।“

No comments:

Post a Comment