শৌভিকের সাথে আলাপ হবার পর সেটাই প্রথম জন্মদিন। ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাত্রের দিকে পা বাড়াবার সাথে সাথেই দ্রুত হচ্ছিল হৃদস্পন্দন,সত্যি যদি আমি তার কাছে বিশেষ হই, তাহলে নিশ্চয় মধ্যরাত্রে একবার অন্তত আমার দুয়ার খটখটাবে। তখন আমি এএলসি খড়্গপুর। ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করার তীব্র ক্লান্তিতে ভেঙে পড়া শরীরকে কশাঘাত করে জাগিয়ে রাখল লোভী হৃদয়। হা হতোষ্মী। ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাত্রি টপকে গেল, প্রতিবছর নিয়ম করে পাওয়া মেসেজ গুলো এসে পড়ল একে একে। থিতিয়ে এল সমস্ত উত্তেজনা। ধুৎ। সবই আমার মনের কষ্টকল্পনা।কয়েকদিন আগেই মানি স্কোয়ারে ঘুরতে ঘুরতে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শৌভিক বলেছিল,“ধুর্। আমার মা ঘটি। বউও যদি ঘটি হয়, আমিও তাহলে ঘটি হয়ে যাব।” আজ যদিও শৌভিক কিছুতেই স্বীকার করে না এই কথা বলেছিল, যাই হোক আমি ওমনি নির্বোধের মত ভেবে বসলাম, কথাটা আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছে। কেন রে বাপু? পৃথিবীতে কি আর ঘটি মেয়ে নেই?সত্যিই যদি তাই হত, একটি বার কি উইশ করত না?
মনের দুঃখ মনে চেপে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। ভোর ছটার সময় ঢ্যাং ঢ্যাং করে শৌভিকের মেসেজ। পড়ে গা জ্বলে গেল, সাতসকালে আমার ঘুম ভাঙিয়ে শুভ জন্মদিন জানানো হচ্ছে? তাও আদর করে, সে আদরের কি ছিরি?প্রথম সম্বোধনটা আমার চেহারা এবং দ্বিতীয়টা আমার বয়স তুলে। হাড় জ্বালানো মেসেজ যত। শুধু লিখলাম “এই মেসেজটা কি মধ্যরাত্রে পাঠানো যেত না? ”
সঙ্গে সঙ্গে শৌভিকের ফোন,“ আরে তুমি ভোর ছটায় জন্মেছ বলে আমি অ্যালার্ম দিয়ে ঘুম থেকে উঠে ছটায় মেসেজ পাঠালাম। খামোকা মাঝরাতে পাঠাব কেন?” ভোর বেলা মৃদু স্বরে মান অভিমানের পালা চলল,পরিশেষে শৌভিক বলল,“ আজ বেড়োতে পারবে?তাহলে ফ্লুরিজে ট্রীট দেব। ” নাঃ। সেদিন ফ্লুরিজে যায়নি।আমিই যেতে চায়নি। সন্ধ্যাটা কেটেছিল মোহরকুঞ্জে একরাশ রঙিন ফোয়ারার মাঝে,একে অপরের সান্নিধ্যে, বাতাসে মৃদু কুয়াশা আর মোহরকুঞ্জ ভেসে যাচ্ছিল অসিতবরণের (জানি না অন্যকারো গলায় কি না। মন বলে অসিতবরণই) গলায়,“ আমরা দুজনা স্বর্গখেলনা গড়িব না ধরণীতে-”র মুর্চ্ছনায়।
মোহরকুঞ্জ ছেড়ে ধর্মতলা অবধি একসাথে হাঁটতে হাঁটতে এলাম, বাসে ওঠার আগে বললাম, “ফ্লুরিজটা কিন্তু বাকি রয়ে গেল। অন্যদিন হবে। ”সেদিন সহাস্য সম্মতি জানালেও পরে শৌভিক নিয়েই যায়নি ফ্লুরিজে। এত বছরে যতবার গেছি বন্ধু বা সহকর্মীদের সাথেই গেছি।
এতবছর পর আবার আমার বর আজ প্রস্তাব দিল, মার্কোপোলো তে নিয়ে যাবার। কিন্তু আবার পিছিয়ে গেলাম আমি। হোটেল, মল, রেস্টুরেন্ট, খাওয়াদাওয়া, ছবি, ফেসবুক তো সারাবছর চলে। আজ থাক। আজ শুধু প্রিয়জনেদের সান্নিধ্য আর উষ্ণতা টুকু পেতে চাই অাশ মিটিয়ে। মায়ের হাতের রান্না, বাবার পাশে বসে গায়ে নাক ঠেকিয়ে গায়ের গন্ধ শোঁকা,বৃদ্ধা বেতোরুগী জেঠাইমার দেওয়াল ধরে রোদ পোয়াতে পোয়াতে গল্প করা, অর্ধান্ধ থপথপে পিসির শুধু আমার জন্য দশবার দৌড়ে দোকান যাওয়া- এগুলো আর কতদিন? যে হারে গুরুজনদের ছাওয়া সরে যাচ্ছে মাথার ওপর থেকে-- আজকে শুধু আজকের দিনে আঁকড়ে ধরতে চাই আমার প্রতিটা প্রিয়জনকে, আর বলতে চাই-- যাই হোক না কেন আমায় ছেড়ে যেও না। সময় যতজোরেই দৌড়ক না কেন, আমি বদলাইনি। তোমরাও বদলে যেও না।
#Aninditasblog
https://amianindita.blogspot.in
No comments:
Post a Comment