Friday 6 January 2017

শ্রমিক আমি (কলকাতা পর্ব) 1-3

শ্রমিক আমি (কলকাতা পর্ব) ৩০.১২.১৬
প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর আগে, যেদিন অর্ডারটা বেড়িয়েছিল, আজো মনে আছে, পরপর দুটো এসএমএস পেয়েছিলাম। একটা পাঠিয়েছিলেন ডিএলসি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন দীপক দা আর একটা আমার সদ্য প্রাক্তন ডিএলসি শৈবাল দা। বক্তব্য একই, শুধু একটা শব্দ, “কলকাতা”। সময়টা অগস্ট ২০১১, আমি তখন এএলসি খড়গপুর। চার অক্ষরের একটা শব্দ যে এত আনন্দবাহী হতে পারে আগে জানতাম না। ট্রান্সফার অর্ডার বেরনোর পর থেকে শুধু দিন গোনার পালা, কবে মুভমেন্ট অর্ডার বেরোবে, কবে যাব কলকাতায়? সাড়ে চার বছর পশ্চিম মেদিনীপুরে কাটাবার পর মহানগরে প্রবেশের অধিকার পাওয়া গেছে, তাও একা নয়, আমি এবং সুকন্যা দুজনেই কলকাতায় যাচ্ছি, এত আনন্দ রাখি কোথায়? সেই ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে দুজনের গাঁটছড়া বাঁধা।
খড়গপুর থেকে বিদায় নেবার প্রাক্কালে আমার তৎকালীন এবং প্রাক্তন ডিএলসি তীর্থ দা এবং শৈবাল দা দুজনে একই সঙ্গে সাবধান করে দিলেন, কলকাতা খুব সাংঘাতিক জায়গা। মেপে পা ফেলতে হয়, বুঝে কথা বলতে হয়। দশটা পনেরো বেজে গেলেই লাল দাগ আর তিনটে লাল দাগ পড়ে গেলেই একটা সিএল ঘ্যাঁচ। পৌনে ছটার আগে অফিস ছাড়া যাবে না। আজো মনে আছে শৈবাল দা বলেছিলেন, “দেখ বাপু তুমি একটু হাবলা আছ। বুঝে শুনে চলো।”
কলকাতায় তখন “সু” অর্থাৎ সুকন্যা এবং আমার গুরু হচ্ছেন সুমিতা দি। সু আর আমার কলকাতা পোস্টিং হওয়াতে সুমিতা দি প্রচন্ড খুশি হয়েছিলেন। সুমিতা দি ফোন করে জানালেন, “তোমরা যেন ভুলেও ট্রান্সিট লিভ নিও না। চটজলদি নিউ সেক্রেটারিয়েটে এসে আগে একটা ভাল ঘর জোগাড় কর। দেরী করলে কিন্তু সব ভাল ফাঁকা ঘর গুলো হাতছাড়া হয়ে যাবে।” সুমিতাদির কথা তখন বেদবাক্য। রিলিজ নেবার পরদিনই সকাল পৌনে দশটার মধ্যে পৌঁছে গেলাম নিউ সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং। ফাঁকা লিফটে চড়ে হুশ করে উঠে গেলাম এগারো তলা। লিফট থেকে নেমে ভয় পেয়ে গেলাম, ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। অধিকাংশ ঘর এবং হলঘরের দরজাই খোলেনিলেবার কমিশনারের ঘরের দরজা অবশ্য খোলা এবং আলো ও জ্বলছে। তখন লেবার কমিশনার ছিলেন শ্রী অমল রায়চৌধুরী। উনি দশটার মধ্যেই এসে যেতেন। কি করি? সেকশনে ঢুঁ মারলাম। মাত্র দুজন সবে এসে ব্যাগ রেখে চা খেতে যাচ্ছেন। ওনাদের থেকে জানতে পারলাম, দশটা পনেরো নয়, সাড়ে দশটার পর খাতা লেবার কমিশনারের ঘরে ঢোকে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম, যাক কাল থেকে একটু বেশীক্ষণ ঘুমানো যাবে।
দশটা পনেরোর পর আসতে আসতে সবাই আসতে লাগলেন। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম সুকন্যার জন্য। সুদীর্ঘকাল মেদিনীপুরবাসের পর, নিউ সেক্রেটারিয়েটের সুসজ্জিতা সুন্দরীদের পাশে নিজেকে কি হতকুচ্ছিতই যে লাগছিল তা বলার নয়। গতকাল রাত্রেই এই নিয়ে সুকন্যাতে আর আমাতে একপ্রস্ত বিলাপ করেছি। মেদিনীপুরে আমাদের সাজগোজের কোন বালাই ছিল না, রঙ জ্বলা জামা পরে দিনের পর দিন অফিস করে গেলেও কিছু বলার ছিল না। মূলত অসংগঠিত শ্রমিকদের নিয়ে কাজ, তাদের সামনে সেজে গুজে পটের বিবি সেজে বসলে না তারা স্বচ্ছন্দ্য বোধ করত, না আমরা। আর সবার ওপর আমরা ছিলাম হদ্দ কুঁড়ে। আবার সাজতে হবে? ভাল জামা কাপড় কিনতে হবে? কেন? বিয়েতে যা পেয়েছি আর পুজো – ভাইফোঁটায় যা আমদানি হয় তাতে তো দিব্যি চলে যায়, এই ছিল আমাদের মানসিকতা। কিন্তু কলকাতায় রঙ জ্বলা জামা? কলকাতায় কারা আছে? প্রথমতঃ সুমিতা দি, যাকে সচেতন ভাবেই আমরা আইডলাইজ করতাম। তার ওপর মনীষা দি, শর্মিলা দি, রুমা দি, যার শাড়ির সম্ভার রীতিমত ঈর্ষণীয়। আর সেকশনে যে অগুন্তি সুন্দর সুন্দর মহিলা আছেন তাদের কথা তো বলেই কাজ নেই। সুদূর পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে যখন আসতাম কোন কাজ নিয়ে, রীতিমত হাঁ করে দেখতাম তাঁদের রূপ এবং বেশভূষা। এত সুবেশা সুন্দরীদের মাঝে রীতিমত অসহায় বোধ করছিলাম সুকন্যাকে ছাড়া। সুকন্যাকে তখন ডাক্তার বাসে চড়তে নিষেধ করেছিলেন, বেচারা সোয়া দশটার মধ্যেই অতি কষ্টে ট্যাক্সি জোগাড় করে ছুটতে ছুটতে এল। একটু পরেই এসে হাজির হল শর্মিষ্ঠা, একই অর্ডারে ও এসেছে শ্রীরামপুর থেকে কলকাতা। ভালোই হল, দল ভারি হল।
অতঃপর? খাতায় নাম তোলা। আর সকলের ঘরে ঘরে গিয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ।তখন শ্রী সুবল বিশ্বাস সাহেব অ্যাডিশনাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। ওনার সাথে দেখা করে একে একে রসুল সাহেব, দীপক দা, মনীষা দি, শর্মিলা ম্যাডাম, সুমিতা দির সাথে দেখা করলাম আমরা। সুমিতা দি সটান চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আমাদের জড়িয়ে ধরলেন। অনেক প্ল্যান পরিকল্পনা হল একসাথে খেতে যাওয়া, শপিং এর। আমাদের অবশ্য শপিং এই উৎসাহ বেশী ছিল, কারণ দুজনেই যে যার মায়ের শাড়ি ধার করে পড়েছিলাম। পরবর্তী পদক্ষেপ ঘর দখল করা। কোন ঘর দখল করি? সব ঘরেই তো অফিসার রয়েছে, এবং তাঁরা রীতিমত কাজ করছেন। বেলা বাড়ার সাথে সাথেই এগারো তলা গমগম করছে নানা ট্রেড ইউনিয়ন, ম্যানেজমেন্ট এবং ওয়ার্কারদের তর্কবিতর্কে। অবশেষে, কোনের একটা সরু ঘর ফাঁকা পেলাম, সেখানেই গিয়ে বসলাম তিনজনে। একটা ঘরে তিনজন অফিসার!! কে নেবে ঘরটা? এ যেন কালনেমির লঙ্কাভাগ।
একফাকে নীচে নেমে মুগল গার্ডেনের এগ রোল খেয়েএলাম তিনজনে।  মুগল গার্ডেনের এগ রোল ছিল তখন আমাদের কাছে এক দেবভোগ্য বস্তু। কিন্তু খেতে গিয়ে দেখলাম, এত বড় রোল গলদ্ধকরণ মোটেই সহজ কার্য না। টিফিন করে ওপরে এসে তিনজনে গল্প করছি, এমন সময় লেবার কমিশনার সাহেবের জরুরী তলব। তিনজনে একসাথে ওনার ঘরে ঢুকে দেখি, বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপাশে গম্ভীর মুখে বসে আছেন, লেবার কমিশনার, আর তাঁকে ঘিরে ততোধিক গম্ভীর মুখে বসে আছেন আমাদের বড় সাহেবেরা, বিশ্বাস সাহেব, রসুল সাহেব, নাসিম সাহেব এবং আমানুল হক সাহেব। বুঝলাম পরীক্ষা সমাসন্ন।
শ্রমিক আমি (কলকাতা পর্ব-২) ০১.০১.১৭
বর্তমান লেবার কমিশনার জাভেদ আখতার সাহেব বসেন, ওনার চেম্বারে ঢোকার দরজার ঠিক উল্টো দিকে। যে কেউ দরজা ফাঁক করে উঁকি মারলেই ওনার সাথে দৃষ্টি বিনিময় হতে বাধ্য। কিন্তু ওনার পূর্বসূরি রায়চৌধুরী সাহবে বসতেন দরজার বাঁ দিকে দরজার দিকে পিছন করে, ফলে আমরা যখন ওনার চেম্বারে ঢুকলাম, উনি রীতিমত ৯০ ডিগ্রি ঘাড় ঘুড়িয়ে আমাদের দিকে তাকালেন। ইশারায় বসতে বললেন, আমরা ভয়ে ভয়ে যে যার স্থান দখল করলাম। বসা মাত্রই বিশ্বাস সাহেব অর্থাৎ শ্রী সুবল বিশ্বাস আমাদের পুনঃ পরিচয় করিয়ে দিলেন। সুকন্যার ভূয়সী প্রশংসা করলেন সকলে এমনকি খোদ লেবার কমিশনার পর্যন্ত (অন্তত ওনার মাথা নাড়ানো এবং অন্যান্য শারীরিক বিভঙ্গে তাই বোধ হয়েছিল)। এবং এই প্রতিটি তারিফের যোগ্য হকদার ছিল সুকন্যা ভট্টাচার্য২০০৮ থেকে ২০১১ অবধি একা ঝাড়গ্রাম আরএলও (Regional Labour Office) চালিয়েছে, যখন ঝাড়গ্রাম শব্দটা শুনলেই অনেকের শিরদাঁড়া দিয়ে হিমেল স্রোত বয়ে যেত। ঝাড়গ্রাম তখনও প্রায় মুক্তাঞ্চল। আর শর্মিষ্ঠা ঘোষের পরিচয় দেওয়া হল গ্রাচুইটি স্পেশালিষ্ট হিসেবে। একা হাতে শ্রীরামপুরের বহু বন্ধ জুটমিল ওয়ার্কারদের ন্যায্য প্রাপ্য গ্রাচুইটির অর্ডার বেরিয়েছে শর্মিষ্ঠার হাত দিয়ে। লেবার কমিশনার শ্রী অমল রায়চৌধুরী (যিনি বর্তমানে পে-কমিশনের এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য) প্রীত স্বরে জানতে চাইলেন, “তোমাদের কার কি ভালো লাগে, স্কীম? না কনসিলিয়েশন?” আমার আর সুকন্যার জবাব ছিল “স্কীম” অর্থাৎ অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য যে সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার স্কীম গুলি শ্রম কমিশনারেট চালায়, যথা- ভবিষ্যনিধি প্রকল্প (সাসফাউ), নির্মাণকর্মী দের জন্য প্রকল্প (বোকয়া) এবং পরিবহন শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প। স্কীমের কাজ করতে সত্যি ভাল লাগে, কেন জানি না মনে হয়, প্রত্যক্ষ ভাবে কারো উপকারে আসলাম। অন্যদিকে কনসিলিয়েশন আমার কোনদিন ও ভাল লাগে না। এ যেন বরের ঘরের পিসি আর কনের ঘরের মাসির ভূমিকা পালন। সত্যি কথা বলতে কি, কনসিলিয়েশন বস্তুটা আমার দ্বারা হয়ও না। মালিক-শ্রমিক বিবাদে আমি বরাবরই শ্রমিকের পক্ষে,তাদের দুঃখে বিগলিত হয়ে যাই। কনসিলিয়েশন অফিসার খোদ যদি পক্ষপাতদুষ্ট হয়, তাহলে সেই বিবাদের মীমাংসা কি আদৌ হতে পারে? যাইহোক রায়চৌধুরী সাহেব মাথা নেড়ে বললেন, “তা বললে তো হবে না, কনসিলিয়েশন ও করতে হবে।”
লেবার কমিশনারের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের ছোট্ট ঘরটায় ঢুকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। শর্মিষ্ঠাকে অবশ্য কি কারণে যেন আবার ডেকে পাঠানো হয়েছিল, কিয়ৎক্ষণ পরে ফিরে এসে বলল, “বাপরে, তোমরা চলে আসার পরও সবাই তোমাদেরই প্রশংসা করছিল” আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার প্রশংসা করছিলেন খোদ রসুল সাহেব, ডিজিটাইজেশন নিয়ে খুব প্রশংসা করছিলেন।” তখন সদ্য সাসফাউ প্রকল্পটির অনলাইন রেজিস্ট্রেশন শুরু হয়েছিল, এবং খড়গপুরে কাজটা বেশ ভালই দ্রুততার সাথে চলছিল।
যাইহোক লেবার কমিশনার যে কেন, ঐ প্রশ্নটি করেছিলেন, তা বুঝলাম দিন কয়েক পর, যখন আমাদের জব অ্যাসাইনমেন্টের অর্ডার ধরানো হল। সুকন্যাকে বোকয়া এবং আমাকে ট্রান্সপোর্ট বোর্ডে দেওয়া হল। শর্মিষ্ঠার পোস্টিং হল কলকাতা সেন্ট্রালে কনসিলিয়েশন অফিসার হিসাবে। মাঝের কটা দিন যে কি আনন্দে কেটেছে তা বলার নয়, আমাদের ধারণা বদ্ধমূল হচ্ছিল যে কলকাতায় কোন কাজ নেই। শুধু প্রজাপতির মত ভেসে বেড়ানো। সুমিতা দি ফ্রি থাকলেই ডেকে নিতেন, আড্ডা গল্প মজা আর কেনাকাটার গল্প করে ফিরে আসতাম নিজেদের ঘরে। মাঝে হঠাৎ একদিন সুমিতা দি বললেন, “আমি কটা দিনের জন্য ছুটি নেব, আমার একটা অপারেশন আছে। ফিরে এসে দেখা হবে।” সুমিতা দি ফিরে আসার আগেই অর্ডার বেরিয়ে আমাকে ঐ বাড়ি পাঠানো হল। ঐ বাড়ি অর্থাৎ ৬ নং চার্চ লেন। নিউ সেক্রেটেরিয়েট ছেড়ে যাকেই চার্চ লেন পাঠানো হয়, তারই বোধহয় প্রথম চোটে কান্না পায়। আমারও পেল, চার্চ লেন? ইশ, কি জঘন্য বাড়িটা। যদিও ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের বাড়ি, কিন্তু আদৌ কোন সারাইসুরাই হয় না। মালিকদের কি সব কোর্ট কেস চলছে তার জন্য। সামান্য বৃষ্টিতেই ছাদ দিয়ে জল পড়ে, সবথেকে বড় কথা আমার পরবর্তী গন্তব্য হল ঐ বাড়ির পাঁচ তলা, প্রতিটি তলা উঠতে ২৮টি সিঁড়ি ভাঙতে হয়। দুটি লিফটের একটি এখনও জীবিত, তবে তা মাসের মধ্যে ১৫টি কর্ম দিবসেই মৃতপ্রায় হয়ে থাকেন।লিফট চলে সকাল ১০টা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত (যেন সবাই পৌনে পাঁচটার মধ্যেই কেটে পড়ে), মাঝে ১-২ টো বন্ধ থাকে। চার্চ লেনের ভাম আর ইঁদুরের উৎপাত তো প্রসিদ্ধ। আর সবথেকে বড় ভয়ের কারণ হলেন আমার হবু বস, ট্রান্সপোর্ট বোর্ডের সিইও মহম্মদ আমানুল হক সাহেব। প্রথমেই আমাকে সবাই সাবধান করে দিল, হক সাহেব কিন্তু ভীষণ স্ট্রিক্ট। ওখানে সত্যি দশটা কুড়িতে লাল দাগ দেবার রেওয়াজ আছে, এবং হক সাহেবের অফিসাররা কেউ ছটার আগে ছাড়া পায় না। উনি নিজেও সন্ধ্যা সাতটা অবধি অফিস করেন। আরো সাংঘাতিক কথা শুনলাম, ও বাড়িতে নাকি ডিসেম্বর মাসে কোন সিএল নেওয়া যায় না, কারণ জানুয়ারি মাসটা আমরা পালন করি সামাজিক সুরক্ষা মাস (Social Security Month) হিসাবে। আরো যে কত কি শুনলাম, আজ আর মনে নেই, তবে মোদ্দা কথায় স্বয়ং হিটলারের অধীনে কাজ করতে যাচ্ছি সেটা বেশ বুঝতে পারলাম। প্রচন্ড দুঃখ হচ্ছিল সুকন্যাকে ছেড়ে যেতে। কিন্তু কি করতে পারি? মনখারাপ করে সকলের থেকে বিদায় নিলাম, বিশ্বাস সাহেবের ঘরে বিদায় নিতে গেছি, উনি একটু বিরক্ত হয়েই বললেন, “কে বলেছিল তোমাকে বলতে যে স্কীম ভালো লাগে?” বুঝলাম স্বখাত সলিলে ডুবেছি। না বলতাম স্কীম ভালো লাগে, না আমাকে পাঠানো হত --- কিন্তু কি আর করা যাবে, তীর ধনুক ছেড়ে বেড়িয়ে গেছে। কাল দশটায় চার্চ লেন।
শ্রমিক আমি (কলকাতা পর্ব- ৩) ০৪/০১/১৭
মহম্মদ আমানুল হক, বিগত পাঁচ বছর চার মাস যাবত আমার বস ছিলেন, এবং একথা আমি নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে পারি, আমার বিগত দশ বছরের এএলসি গিরিতে আমি এত ভালো বস কখনও পাইনি। আজো মনে আছে, প্রথম যেদিন চার্চ লেনে গিয়ে জয়েন করলাম, তার কিছুদিন আগেই ওনার পিতৃবিয়োগ হয়েছে। স্যারের ঘরে ঢুকে দেখি উনি উদাস স্বরে দুজন বয়স্ক ব্যক্তির সাথে এই নিয়েই কথা বলছেন। আমাকে দেখে, সানন্দে পরিচয় করিয়ে দিলেন বাকি দুজনের সাথে-দুজনেই অত্যন্ত বর্ণময় ব্যক্তিত্ব, প্রথমজন শ্রী সত্য ঘোষ আর দ্বিতীয়জন হলেন শ্রী নজরুল ইসলাম। সত্য বাবু ছিলেন বিশাল বপু( আড়ে এবং বহরে প্রায় সমান), বাজখাই গলা এবং চোখে কালো চশমা। প্রমোটি এএলসি তথা এগ্রি-মিনি অ্যাসোসিয়েশনের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা।সত্য বাবুর সাথে আমার মাঝে মাঝেই ঝামেলা লেগে যেত। কেন যাবে না মশাই? আমাকে এবং সঙ্গীতা মুখার্জ্জীকে (চার্চ লেনের সুন্দরীতম এএলসি) দেখলেই ওনার মনে পড়ে যেত, ডাইরেক্ট অফিসার মাত্রই হোঁৎকা, আইনকানুন জানেও না আর তার ধার ও ধারে না। কোন ডাইরেক্ট এএলসি কে ওনার সংগঠন কোথায় কি ভাবে বংশদণ্ড প্রদান করেছে বা করতে চলেছে একথা আমাদের শোনাতে এলে আমরাই বা কেন ছেড়ে কথা বলব? ফলে লেগে যেত তুলকালাম। আমি আর সঙ্গীতা চিল চিৎকার জুড়তাম, আর সত্য বাবু ফ্লোর কাঁপিয়ে হাসতেন। কিছুদিনের মধ্যেই খেয়াল করলাম, যে উনি আমাদের রাগিয়ে নেহাত মজা পান।

ট্রান্সপোর্ট বোর্ডে যখন জয়েন করলাম, হক সাহেব, আমি, সত্য বাবু আর নজরুল ইসলাম ছাড়া বোর্ডে আর কেউ ছিল না। কেউ না। না কোন ইনস্পেক্টর, না ক্লার্ক না গ্রুপ ডি। না ছিল কোন কম্পুটর, ফ্যাক্স, ফোন, ব্রডব্যান্ড বা ফটোকপিয়ার মেশিন। হক সাহেব তখন জয়েন্ট কমিশনার, ওনার চেম্বারের বাইরে দুটো ছোট চেম্বার ছিল, যার একটাতে বসত সঙ্গীতা, আর একটিতে বসতেন নজরুল ইসলাম। স্যার নজরুল সাহেবকে বললেন, “আপনার চেম্বারটা আপনি অনিন্দিতাকে ছেড়ে দিন। ওকে অনেক কাজ করতে হবে।” সদ্য আলাপিত হবার পরই ওনাকে আমার জন্য চেম্বার চ্যুত হতে হল, আমি অত্যন্ত সঙ্কুচিত হয়ে বললাম, “না। না। ছি ছি। উনি আমার সিনিয়র। আমি ওনার চেম্বার কি করে দখল করতে পারি?” কিন্তু তাতে না স্যার পাত্তা দিলেন না নজরুল সাহেব। নজরুল ইসলাম অত্যন্ত খুশি খুশি ওনার চেম্বারটা আমাকে ছেড়ে দিলেন। ছেড়ে তো দিলেন, কিন্তু সে কি চেম্বার? একখানা ঘুণ ধরা সেমি সেক্রেটারিইয়েট টেবিল, যার ওপরে একটা পুঁচকে কাঁচ পাতা আছে। টেবিলের এক দিকের ভেলভেট ছিঁড়ে খানিকটা উঠে এসেছে। ড্রয়ার খুলতেই এক গাদা আরশোলার ডিম আর নোংরা কাগজ। ভয়ে ড্রয়ারটাই বন্ধ করে দিলাম। এতো গেল টেবিল, আর চেয়ার বলতে বিবর্ণ একখানা রাজকীয় কেদারা। যাতে আমার মত ছোট্ট খাট্টো লোক বসলে মাটিতে পা ঠেকে না। ঘরে আর কিছু নেই। না আলমারি, না পেন স্ট্যান্ড, না পেন বা কাগজ। বেল পর্যন্ত নেই। মন খারাপ করে বসে রইলাম, কিছুক্ষণ, টিফিনের সময় হল, গুটগুট করে রওনা দিলাম নিউ সেক্রেটারিয়েটের দিকে। সুকন্যার সাথে এক সাথে টিফিন করে বেশ খানিক ঘ্যানঘ্যান করে ফিরে এলাম। স্যারকে দেখাও দিয়ে এলাম, টেবিলে এক বোতল জল ও দেয়নি কেউ। সদ্য জেলা থেকে এসেছি, সেখানে আর যাই হোক এসব নিয়ে ভাবতে হয় না। স্যারকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমায় কে জল দেবে? স্যার ব্যস্ততার মধ্যে একজনকে পাঠিয়ে দিলেন। একে নিউ সেক্রেটারিয়েটে আগে দেখেছি, আমার বরাবর ধারণা ছিল এ মহিলা, আজ দেখলাম না পুরুষ না হলেও ছেলে তো বটেই। এসেই তার বক্তব্য ছিল সে স্ট্যাটের পিওন, ট্রান্সপোর্টের এএলসিকে কেন জল দেবে? বাবা বাছা করে বললাম, জল দে বাপ। কাল তোতে আমাতে গিয়ে লেবার কমিশনারকে এই প্রশ্নটাই করব আপাতত জল দিয়ে প্রাণ বাঁচা। জল দিল। সেপ্টেম্বর মাসের প্রচন্ড গরম, এক লিটার জল কোথা দিয়ে নেমে গেল বুঝলাম না, আর একবার দিতে বললাম, “বলল, ম্যাডাম, কাল থেকে একটা বড় বোতল আনবেন। তাহলে আর বারবার জল দিতে হবে না।” বুঝলাম সত্যি আমার মহানগরে প্রবেশ হয়েছে। জল দেওয়া নিয়ে নিত্য খিচিরমিচির চলতেই লাগল, ও দেবে না, আর আমিও ছাড়ব না। সেকশনে দাঁড় করিয়ে ঝাড়তাম, তখন জল দিয়ে যেত। যেদিন কিছু বলতাম না, সেদিন নির্জলা। এভাবে অন্যদের দমানো গেলেও অনিন্দিতা চ্যাটার্জীকে (এখন ভট্টাচার্য) দমানো যায় না। তারপর থেকে ঠিক করলাম অফিসে এসে আমার প্রথম কাজই হবে ওকে ডেকে আগাপাস্তলা ঝাড়া। কিছুটা সাইজ হল, একদিন এসে বলে, “ম্যাডাম ১০০টা টাকা দিন তো।খুব দরকার।” বেশ দিলাম। নিয়ে সেই যে বেরিয়ে গেল আর তার পাত্তা নেই দিন দুয়েক। দুদিনের পর অঞ্জন দা (শ্রীমান অঞ্জন মুখোপাধ্যায়, তৎকালীন এএলসি স্ট্যাটিস্টিক্স) দৌড়ে দৌড়ে এসে হাজির হলেন, আমার ঘরে, “তুমি অমুক চন্দ্রকে টাকা দিয়েছ?” ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়লাম। কি করলাম রে বাবা? ১০০টাকা দিয়ে কি আরডিএক্স কিনল নাকি? অঞ্জন দা রাগত স্বরে বলল, “আরে কেন দিয়েছ? ঐ টাকা নিয়ে ও ইয়ে তে যায়।” “কি’য়ে তে?” “ইয়ে মানে খারাপ পাড়ায় যায়।” অঞ্জন দা মুখ লাল করে বললেন। আমি বুঝতে পারছিলাম না হাসব না কাঁদব। ভগবান! কোথায় এলাম? লোকে আমার টাকায় ইয়েতে যায় আর আমি বসে বসে আরশোলার ডিম গুনি? এঃ 

No comments:

Post a Comment