Monday 16 January 2017

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি January to March 2017

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ৪থা জানুয়ারী ২০১৭ #1
যে কোন লোকাল ট্রেনে উঠলেই বোঝা যায় বাঙালীর দুই মারণ ব্যধি- ‘অম্বল-বদহজম-গ্যাস’  আর ‘দাদ-হাজা-চুলকানি’। ঐ রোগেই ঘোড়া ইয়ে মানে বাঙালি মরেছে। মা-- মা গো রক্ষা কর মা🙏🏼🙏🏼🙏🏼

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ৫ই জানুয়ারী ২০১৭ #2
লোকাল ট্রেনের সাথে এখনও ঠিক মানিয়ে নিতে পারলাম কই? কাল সন্ধ্যা বেলা ফিরছি, কোথায় কোন নিষ্কর্মার দল অবরোধ করেছিল কে জানে, ট্রেন যেমন লেট তেমন ভিড়াক্রান্ত। ক্ষুধায় নাড়ি জ্বলছে,ব্যাগে সাধের আপেল পচছে, খাব কি? বসেইছি তো অর্ধেক ঝুলন্ত হয়ে। হঠাৎ শুনলাম “এগ চাউমিন। ” চমকে উঠলাম।  আহাঃ ট্রেনে চাইমিন।  ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি এক মুখপোড়া হকার কি যেন একটা বিক্রি করছে আর বলছে,“এই তো আমি। এসে গেছি। চটপট কিনে নিন। ” ‘এই তো আমি’ কে শুনেছি এগ চাউমিন। হা হতোষ্মি।

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ৬ই জানুয়ারী২০১৭ #3
কি ভুলভাল দিন মাইরি। সকাল থেকে ট্রেনের গণ্ডোগোল। সকালে বলল কালিনারায়ণপুরে মালগাড়ি উল্টেছে, তাই কল্যাণীর পর আর ট্রেন যাবে না। এ বেলা কোথায় কি উল্টেছে কে জানে?থিকথিক করছে ভিড়। গুতোগুতি করে তিনজনের সীটে চারজন বসেছি। পুরো নিমপাতা চিবানো মুখ করে বসে আছি।  এমন সময় চতুর্থ জন বলল,“ আর একটু চাপা যাবে না?আমরা কেউই তো তেমন মোটা নই। চারজনের আরামসে ধরে যাবে।” ঠিক শুনলাম কি? কেউই তেমন কি নেই? থাক আর বলতে হবে না।  যতদূর সম্ভব হাত পা পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে বসলাম।
চেপে চুপে বসে আছি, দেখি কে যেন মাথায় হাত বোলাচ্ছে তাকিয়ে দেখি জনৈক বৃহন্নলা! আমাকে দেখে এক গাল হেসে বলল,“সুন্দরী!এ্যাই সুন্দরী দুটো টাকা দে না”। সুন্দরী!!! নাঃ একটু আগেও পরিস্থিতি যতটা নারকীয় মনে হচ্ছিল এখন আর ততোটা লাগছে না। ভালোই তো বেশ। 😊😊😊😊😊

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ৯ই জানুয়ারী ২০১৭ #4
যতবার ফোন করতে যাই, নতুন করে খুঁজতে হয়।  কনট্যাক্ট লিস্ট খোলো রে, খোঁজো রে, কোথায় আছে জয়িতা, কোথায় মৃণাল আর কোথায়ই বা সুতপা দি। অভ্যাসবশতঃ প্রতিবার ফেভারিট এর তালিকা  খুঁজি আর হতাশ হই।  সেখানে আলো করে বসে আছেন হক সাহেব, সনাতন স্যার আর অফিস। ধুত্তোর!! এ অফিস সে অফিস নয়।  এ আমার আগের অফিস, পুরাতন প্রেম। কিন্তু সে যে ঢাকা পড়ে গেছে নবপ্রেমজালে, আর যে মনে রাখতে পারলাম না। তাই হ্যাপিলি ম্যারেড এক্স গার্ল ফ্রেণ্ডের মত পাল্টে ফেললাম পুরানো ফেভারিটের তালিকা। হক সাহেবের স্থলে সুতপা দি এএলসি,সনাতন দার স্থলে মৃণাল আইএমডব্লু, অফিসের জায়গায় আরএলও চুঁচুড়া। নির্দয় ভাবে বদলে ফেললাম সবকিছু বিন্দুমাত্র  পিছুটান না রেখে। এই তো জীবন কালি দা!!!!

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ১৪ই জানুয়ারী ২০১৭ #5
মঙ্গলবার শ্রমিক মেলা, শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা তুঙ্গে। সবার ছুটি বাতিল, বড় সাহেব নিজে আসছেন  তদারকি  করতে। যুগলে একসাথেই বেরিয়েছি। শিয়ালদহ-বর্ধমান লোকাল, শম্বুকগতিতে সবে নৈহাটি। শৌভিক দিব্যি ঘুমোচ্ছে,চেষ্টা করেও ঘুমোতে পারলাম না। মাথায় নানা পরিকল্পনা আর রিপোর্ট গজগজ করছে।  ট্রেন এখনও ছাড়েনি। হঠাৎ ঘোষণা হল, তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে শিয়ালদহ লালগোলা প্যাসেঞ্জার  আসছে। লালগোলা!!! আমার দিদার বাড়ি যাবার ট্রেন। হারিয়ে যাওয়া শৈশব যেন হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল ভিড়াক্রান্ত ট্রেনের জানলা দিয়ে।সেই কু-ঝিকঝিক কয়লার ইঞ্জিন, রাণাঘাটে দাঁড় করিয়ে ইঞ্জিন বদল, কৃষ্ণনগর পার হয়ে ধিকধিক করতে করতে দেবগ্রাম-পাগলাচণ্ডী স্টেশন পের হয়ে পলাশী। ঠিক দ্বিপ্রহরে গিয়ে পৌছতাম পলাশীতে।  অতঃপর রিক্সায় গঙ্গার ঘাট, নদী পেরিয়ে ওপারে আমাদের রামনগর।  দিদার বাড়ি, দোতলা, মাটির বাড়ি টালের চাল। বন্যাপ্রবণ এলাকা বলে, রাস্তা থেকে অনেক উঁচুতে হত বাড়ি গুলো। বাড়ির সামনে একটা বিশাল পিটুলী গাছ ছিল।  আর ছিল এক জোড়া নারকেল গাছ। ডাব পড়ে প্রায় দিদার চালের টালি ভাঙত। ছিল দিদার হাতে লাগানো জাম গাছ, সজনে ডাঁটা গাছ, লেবু গাছ,পেঁপে গাছ আর টগর ফুলের গাছ। বাড়ির সামনে একটা লাল বিশাল গরু বাঁধা থাকত। তার নাম ছিল “ববি”। তখন কোথায় মোবাইল, গোটা গ্রামে একটা ল্যাণ্ড ফোন পর্যন্ত ছিল না।  চিঠিথে জানাত মা, যে আমরা অমুক দিনে আসছি। আমরা যাচ্ছি জানতে পারলেই দিদা দিন গোণা শুরু করত।  যাবার দিন উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করত বারন্দায় দাঁড়িয়ে। ছোটখাট সাদা শাড়ি পড়া নিখাদ মিষ্টি একটা মানুষ, সীমাহীন ভালবাসার খনি। কোথায় যে হারিয়ে গেল-- কেন যে প্রিয়জনেরা হারিয়ে যায়-- ভাবতে বসলে শুধু একরাশ মনখারাপ আর কয়েক ফোঁটা চোখের জলই অবশিষ্ট  থাকে। চোখের জল ও এমন অবাধ্য, স্থান কাল পাত্র কিছুই মানে না----

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি, ১৬ই জানুয়ারি ২০১৭ #6
শনিবার, শেষ বিকাল পর্যন্ত শ্রমিক মেলার মিটিং এবং অন্তিম পর্যায়ের তদারকি করে, জয়েন্ট কমিশনার সাহেবকে খুশি খুশি মুডে গাড়িতে তুলে, বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরেছি। যথারীতি ট্রেনে খুব ভিড়, দুইজনার সিটে গোঁতাগুঁতি করে তিনজন বসেছি। সহযাত্রীগণ অত্যন্ত সহৃদয়, আগেভাগেই জানিয়ে রেখেছেন শ্যামনগরে নেমে যাবেন, নেমে গেলেই জানলার ধারটি আমার। মাথায় মেলা সংক্রান্ত চিন্তা গজগজ করছে, তার সাথে যুক্ত হয়েছে মুঠো ফোনের অত্যাচার। হয় কেউ ফোন করে উপদেশ চাইছে, নয়তো কাউকে ফোন করে নির্দেশ দিতে হচ্ছে। এই ঝামেলায় খেয়াল করিনি, কখন এক বৃহন্নলা ও আমাদের কামরায় সওয়ার হয়েছে। খেয়াল করলাম, যখন তিনি এক সহযাত্রীকে প্রবল ধমক লাগালেন, “বললাম না, আমি একটাকা করে নি।”   বাপরে! এ কে রে? এক টাকা করে নেয়, বেশি দিলে বকে!!!!
সাগ্রহে লক্ষ্য করতে লাগলাম বৃহন্নলাকে। আমার উল্টো দিকে বসা এক গ্রাম্য মাঝ বয়সী মহিলা, কৌতুকের সুরে বললেন, “আমায় আশীর্বাদ করলে না তো? ওর মাথায় হাত দিলে-” । ব্যস আর যায় কোথায়, বৃহন্নলা চোখ পাকিয়ে, ধমকাতে লাগল, “ আমার আশীর্বাদ, আমি যাকে খুশি দেব। আমার মন থেকে যদি আসে, আমি তার মাথায় হাত দেব। না আসলে দেব না। বুঝেছিস। এসব জোর করে হয় না।” বাপরে!!! আবার চমকে উঠলাম।
এতক্ষণ আমার দিকে খেয়াল পড়েনি। এবার আমার সামনে হাত বাড়িয়ে বলল, “দে রে মেয়ে। একটাকা। আমি একটাকার বেশি নিই না।” ব্যাগ হাতড়ে একটা দুটাকার কয়েন উঠল, ভাবলাম, এবার আমার পালা ধমক খাবার। ও বাবা, কিছু বলল তো নাই, উল্টে এক হাতে আমায় জড়িয়ে ধরে বলল, “এটা আমার নাতনী হয় গো।” খুব খানিক আদর করে, মাথায় হাত দিয়ে প্রচুর আশীর্বাদ করে (করো বাবা, ভাল করে করো। আমার মেলাটা যেন ভালো ভাবে উৎরে যায়) যখন চলে যাচ্ছে, অভ্যাসবশতঃ বললাম, “থ্যাঙ্কু”। বৃহন্নলা ঘুরে তাকিয়ে বলল, “মেনশন নট। থ্যাঙ্কু  ভেরি মাচ।” আবার চমকালাম। বৃহন্নলা না থেমে বলেই চলেছে, “ আমি ও পড়াশোনা করেছি গো। মহসিন কলেজে পড়তাম। ফার্স্ট ইয়ারে ফার্স্ট ক্লাশ পেয়েছিলাম। সেকেন্ড ইয়ারে সেকেন্ড ক্লাশ। কত জজ বেরিষ্টার ম্যাজিস্টর, আমার সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে থাকত জানিস?” মাথা নাড়লাম। সত্যি জানি না। আমার অজ্ঞতায় খুশি হলেন।  “আমার নাম হল আশা মুখার্জী, কি?” “আশা মুখার্জী” উল্টো দিক থেকে অভিভূত স্বরে সেই ধমক খাওয়া সহযাত্রীনীটি বলে উঠলেন। “হ্যাঁ। আমার বয়স হল, সিক্সটি ফাইভ। কত?” তৃপ্ত স্বরে বলল বৃহন্নলা ওরফে আশা।  এবার আর  কাউকে জবাব দিতে হল না, উনি নিজেই নিজের কথার পুনরাবৃত্তি করলেন, “ সিক্সটি ফাইভ।। ওই  যে সুন্দরপানা ছেলেটাকে দেখছিস, ওকে আমি ইয়ে অবস্থায় নাচিয়েছিলাম বুঝলি?” সুন্দরপনা কাউকে পেলাম না দেখতে, তবে একটি ঘোর কৃষ্ণবর্ণ নব্য যুবক মুহূর্তে বেগুনী হয়ে গেল। আশা দেবী পেন্ডুলামের ছন্দে কোমর দুলিয়ে গিয়ে হাজির হল তার সামনে,“দে রে বাবা।একটা টাকা--- ”।
ছেলেটির থেকে আদায় করে পুনরায় এসে হাজির হল আমাদের দিকে, একটু আগে যাকে আশিস্ দিতে অস্বীকার করেছিল আবার তাকে  বলল,“দে রে মা।  একটা---”। বেচারা তুতলে বলল,“দিলুম যে?” “অ। দিলি বুঝি? ” বলে বিড়বিড় করে তার মাথায় হাত বুলিয়েই আমার সামনে হাত পাতল,“দে রে মেয়ে।  একটা--”।  এবার আমি চমকাতেও ভুলে গেলাম, পাশের বৃদ্ধ সহযাত্রী ফিসফিস  করে বলল,“বুঝছনি? নেশা করে আছে কি না। ” হায়রে, তাই যখন আমায় নাতনী বলে আলিঙ্গন করল, ঐ রকম একটা হাল্কা  মিষ্টি -মিষ্টি পচা-পচা গন্ধ পাচ্ছিলাম---

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ২৭শে জানুয়ারী ২০১৭ #7

সম্ভবতঃ ২০১১সালের শেষ দিক, মাত্র কয়েক মাস হয়েছে কলকাতায় জয়েন করেছি, হক সাহেব আমাকে আর সঙ্গীতা (মুখার্জী) কে পাঠালেন গণেশ অ্যাভিনিউ বিএসএনএলের অফিস। দীর্ঘদিন ধরে চার্চ লেনের ফোন মৃত, বিল মেটানো সত্ত্বেও তাতে প্রাণ সঞ্চার হয়নি। অগত্যা দু-দুজন মহিলা অফিসারকে পাঠানো হল ঝগড়া করার জন্য। পৌছবার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সংযোগ পুনঃস্থাপিত হওয়ায় ঝগড়া আর করতে হয়নি অবশ্য। কিন্তু নেমে দেখি আমাদের ড্রাইভার কোথাও পার্কিং না পেয়ে আবার অফিসেই ফিরে গেছে।

ড্রাইভার সহ দুনিয়ার লোকের মুণ্ডুপাত করছিলাম দোহে,রাজপথের পার্শ্বে দাড়িয়ে, হঠাৎ দেখি পাশেই একজন লিট্টি বানাচ্ছে। জ্বলন্ত  কয়লার উনুনের ওপর গোটা চারেক বর্তুলাকার  লিট্টি পক্ক হচ্ছে, দেখেই জিভে জল এল। সঙ্গীতাও আপত্তি করল না। ইতিপূর্বে কখনও খাইনি কেউই। স্টিলের থালায় চারটে লিট্টি এবং খানিকটা ডাল বা চাটনি জাতীয় কিছু তরল ঢেলে দিল, যাতে তখনও গোটা দুয়েক রসুনের খোলা ভাসছিল। সহর্ষে  মুখে দিলাম, নিজের মুখ না দেখতে পেলেও সঙ্গীতার সেই করুণ মুখ আজো ভুলিনি। কোন মতে   দুবার চিবিয়ে ভয়ানক মুখব্যাদান করে বলল,“আমি মুখেরটা ফেলে দিলে তুমি কিছু মনে করবে?” ঐ অবস্থায় প্রবল হাসি পাচ্ছিল,ঘাড় নেড়ে দুজনে দৌড়লাম ডাস্ট বিনের দিকে। ওয়াক্ থুঃ।  কি জঘণ্য খেতে। কাঁচা আটার ডেলা, মাঝে একটু ছাতুর পুর। সাথে তীব্র রসুন গন্ধী ডাল নাকি চাটনী ভগবানই জানেন।
সেই থেকে সঙ্গীতার আর আমার কাছে লিট্টি ছিল এক বিভীষিকা। কারো ওপর রাগ হলে আমরা বলতাম তাকে আদর করে ধরে এনে জবরদস্তি লিট্টি খাওয়াব। কত লোককে যে আমরা কল্পনায় ঐ লিট্টি ভক্ষণ  করিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই।
আজ আবার লিট্টি খেলাম। এতদিন বাদে। কিছুতেই খাব না, কিন্তু সুতপা দি করুণভাবে বললেন,“ আমার কথা শুনে একটি বার খেয়ে দেখ। ” মহিলা এত ভাল না, ওণার সাথে আমার মায়ের এত স্বভাবজ মিল, যে ওণার সব কথাই আমি প্রথম চোটে বলি কিছুতেই শুনব না, কিন্তু পর মুহূর্তেই ওণার কথাটা শুনি। আজোও ওণার অনুরোধে গেলাম লিট্টি খেতে। নৈহাটি স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে এক বাঙালি (?) মহিলা লিট্টি বিক্রি করেন। ছোট ছোট রুটির মত দেখতে। সুতপাদি বললেন,“চাটনী একটু বেশি করে দেবেন।  কেমন?” মহিলা গরম রুটির মত লিট্টিটি নিয়ে ঘ্যাঁচ করে তার পেট ফাটিয়ে এক চামচ আলুর ছোঁকা আর দুই চামচ ধনে পাতার চাটনি ঢুসে শাল পাতায় করে আমার হাতে দিলেন। মুখে দিতেই এক ঝলক রসুনের গন্ধ পূর্ব স্মৃতি জাগাতে গিয়েও ব্যর্থ হল। কি অপরূপ স্বাদ। গরম, কুড়মুড়ে টকটক ঝালঝাল অমৃত। লিখতে লিখতেও জিভে জল আসছে। আহাঃ।
আমার আর সঙ্গীতার লিট্টি ভাল লাগেনি শুনে কে যেন নাক সিঁটকে বলেছিল,“ গরীব মানুষের খাবার তো। তোমাদের মত মেয়েদের ওসব ভাল লাগার কথাও নয়। ” কে যে বলেছিল মনে নেই, তবু মনে মনে তার একচোট মুণ্ডুপাত করে বললাম, “ আর একটা খাব- সুতপাদি। ” আহা নৈহাটির লিট্টি----

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ৮ই ফেব্রুয়ারি ২০১৭ #8

জেলায় কাজ করতে গেলে বেশ রগড় হয়। কিছুদিন আগে এক জঙ্গী ট্রেড ইউনিয়নের নেতা এসেছিলেন ডেপুটেশনের ডেট চাইতে। তখন আমরা মেলা নিয়ে মারাত্মক ব্যস্ত। ডেপুটেশন কে নেবে? ওণাকে বলা হল একটু দাঁড়িয়ে যান। মেলা মিটলে আগে পাওনাদারদের বিদেয় করি তারপর নেওয়া যাবে আপনার ডেপুটেশন। সব মিলিয়ে ১৪ই ফেব্রুয়ারি ডেট দেওয়া হল। ওনারা বলছিলেন ২০জনকে নিয়ে আমার উল্টো দিকে বসবেন, অতি ভদ্র ভাষায় বললাম ৪জনের বেশি ঢুকতে দেব না। ডেট নিয়ে ওনারা বিদায় হবার পর খেয়াল হল, হায় যাঃ ঐ দিন ভ্যালেন্টাইনস ডে । যাক গে ভালবাসার দিনই না হয় ডেপুটেশন খাওয়া যাবে।
চুঁচুড়া লেবার অফিসের বিরুদ্ধে ওনারা ইতিপূর্বেই ওপরমহলে অভিযোগ দায়েব করেছেন। মেলার মধ্যেই সেই চিঠির কপি ধরালেন  ডিএলসি সাহেব। চিঠিতে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। ভাবছিলাম ওনাকে ডেকে বলব লিখিত ভাবে জানান ঠিক কি ধরনের  সহযোগিতা, কবে থেকে পাচ্ছেন না। হঠাৎ  দেখি দরজা ফাঁক করে নেতামশাই  মাথা গলিয়ে জিজ্ঞাসা করছেন,“ ম্যাডাম আসব। ” হাতে চাঁদ পেলাম। “আসুন। আসুন। আপনার কথাই ভাবছিলাম। আপনাকেই ডাকতাম, একটু লিখিত  ভাবে--”। কথা শেষ করতে পারলাম না। নেতামশাই একা আসেননি। পরপর চারজন ঢুকলেন। সবাই বয়স্ক নেতা টাইপ। অবাক হয়ে বললাম,“ডেপুটেশন তো ১৪তারিখে না?” উনি স্মিত হেসে বললেন,“না আজ ডেপুটেশন দিতে আসিনি। ম্যাডাম ঐ ডেটটা কি চেঞ্জ করা যাবে?আগে বা পরের যে কোন ডেট?” মনে মনে বললাম এমনি তে আমার নামে কমপ্লেন করছ আর এখন বলছ ডেট পিছোও? মুখে বললাম,“ কেন? কত ভাল দিন। ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ভ্যালেন্টাইনস্ ডে। ভালবাসার আবহে ডেপুটেশন দেবেন, বেশ তো-”।  বাকি তিন বৃদ্ধ মুখে হাত চাপা দিয়ে খুকখুক্ করে হাসতে লাগলেন, আর নেতামশাই মাথার উপর দুই হাত তুলে অসহায় ভাবে বললেন,“ আর বলবেন না ম্যাডান। এই নিয়ে গোটা জেলা এমনকি পার্টির ওপরমহলেও হাসাহাসি হয়েছে। যে নতুন ম্যাডাম এয়েছেন,খুব সুন্দর দেখতে, আর--”। ভদ্রলোক ক্রমশঃ বেগুনী হয়ে যাচ্ছেন দেখে কোনমতে হাসি চেপে  ডাইরির পাতা ওল্টাতে লাগলাম। অন্য ডেট নিয়ে ওনারা বিদায় হতেই, ফোন তুলে ওসি ইলেকশন হুগলীকে বললাম,“দ্যাখ ___। তুইই খালি কদর দিলি না ভাই। ”
#Aninditasblog
https://amianindita.blogspot.in

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি, ১১ই ফেব্রুয়ারি ২০১৭ #9
জেলায় কাজ করার বেশ একটা রগড় আছে। রোজই নতুন নতুন অভিজ্ঞতা। আমার পূর্বসুরির জমানায় এএলসির চেম্বারের দরজা সব সময় খোলা থাকত। আক্ষরিক অর্থেই অবারিত দ্বার। যখন তখন যে সে ঢুকে পড়ে একগাদা প্রশ্ন এবং নালিশ নিয়ে। আমি এসেই আগে দরজা বন্ধ করেছি।  প্রশ্ন অবশ্যই করতে পারেন, কিন্তু সেই প্রশ্ন যার জবাব আমার পিওন, ক্লার্ক বা ইন্সপেক্টর দিতে পারবে না। অহেতুক একই প্রশ্ন পর্যায়ক্রমে সবাইকে করা চলবে না। এতে আপনারও সময় নষ্ট এবং আমাদেরও। একই কথা নালিশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য । অফিসে একে লোক নেই, আমার পিওন এবং বাচ্ছা ক্লার্ক দুটি নাস্তানাবুদ হয়ে যায় প্রশ্নের চাপে। ইন্সপেক্টরদের অবস্হা অকহতব্য।
অধিকাংশ প্রশ্নের ধরণ দেখে,  বললাম “কোন স্কিমে কি টাকা পাওয়া যাবে এবং পেতে গেলে কি কাগজ পত্র লাগবে,বাইরে সাঁটিয়ে দাও।যারা পড়তে পারেন তাদের বল দেখে নিন।” নির্দেশ মত সমস্ত নিয়মাবলী প্রিন্ট করে বাইরে টাঙানো হল, ও বাবা কে যেন পরদিনই সেটাকে ছিঁড়ে নিয়ে বাড়ি চলে গেল। ফলতঃ যথা পূর্বম---
সেদিন আমাদের ইন্সপেক্টর পিয়ালীকে একজন বেপোট দাঁত খিঁছোচ্ছিল, কারণ কি? প্রচন্ড ব্যস্ততার দরুন পিয়ালী তাকে বলেছে একটু বাইরে দাঁড়ান। দশ মিনিট কেটে গেছে পিয়ালী তাকে ডাকেনি। এই হল অপরাধ। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে দেখি পিয়ালী ভয়ে সিঁটিয়ে আছে এবং মহিলা প্রবল বিক্রমে ঝগড়া করেই চলেছেন, “ আমাদের কি কাজকর্ম নাই?কতক্ষণ দাঁড়াব?” অবস্থা দেখে গলার স্বর তুলে বললাম, ”অফিসে একদম চ্যাঁচাবেন না। আপনার কাজ আছে, ওর নেই?” মহিলা বোধহয় আমার বিক্রম দেখে একটু দমে গিয়ে বলল, “খাচ্ছে তো।” “তো? খাওয়াটা কাজ নয়? বেলা দুটো বেজে গেছে, জন্ডিস রুগী না খেয়ে উল্টোলে কি আপনি আমার অফিস চালাবেন?” মহিলা থতমত খেয়ে চুপ করে যাওয়াতে, গলার স্বর নামিয়ে বললাম, “ আপনার সমস্যাটা কি?” আবার তেরিয়া হয়ে বলল,“ সাইকেল দিচ্ছেন না।  ঐ দিদি-” অঙ্গুলিনির্দেশ করল পিয়ালীর দিকে। পিয়ালী অপরিসীম অসহায়তার সঙ্গে হাত দুটো উল্টোলো। ব্যাপারটা হল আমাদের নির্মানকর্মী প্রকল্পে এককালে নাম নথিভুক্ত করাতে পারলেই ছয় মাস বাদে সাইকেল কেনার জন্য তিন হাজার টাকা পাওয়া যেত। মাত্র পঞ্চাশ টাকা দিলেই হাতে গরম সাইকেল। পরবর্তী কালে তা নির্দেশানুসারে সাময়িক ভাবে বন্ধ করা হয়েছে।এতে বেচারা পিয়ালী ইন্সপেক্টরের কোন কালো হাত নেই।  আমি বেপোট হাসি চেপে বললাম, “ঐ দিদি কেন? কোন দাদা দিদিই আপাততঃ আপনাকে সাইকেল দিতে পারবে না। ” মহিলা দমে গিয়ে বললেন,“ কবে পাব?” এবার আমার হাত উল্টাবার পালা।
এর জবাব কি আমাদের মত তুচ্ছ এএলসি বা ইন্সপেক্টর দিতে পারে?অগত্যা জানালাম দেওয়া হলে জানতে পারবেন, ফোন নম্বর দিয়ে যান।
সে যাত্রা মিটল বটে, তবে দিন দুয়েক বাদে সবে  টিফিন বক্স খুলেছি, এক ব্যক্তি হুড়মুড় করে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে এলেন। একমুখ রুটি নিয়ে অঙ্গুলিসঙ্কেত করে বললাম বাইরে যান, দশ মিনিট পর ডাকছি। সুতপা দি আর আমি একত্রে টিফিন করছিলাম, লোকটি বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে গেল। যতই বলি টিফিন করছি, কাজ তো আর বন্ধ হয় না, আমাদের সবেধন নীলমণি  পিওন ধীমানকে পাঁচ বার ডাকতে হচ্ছে না না নির্দেশাবলী দিতে হচ্ছে,চার বার ঢোকার পর পঞ্চম বার ধীমান যখন ঢুকতে যাবে, তাকে কনুই এর গুঁতো মেরে লোকটি ঢুকে এল, ধীমান শশব্যস্ত হয়ে বলল,“ আরে দাদা এখন নয়। একটু দাঁড়ান, ম্যাডামদের খাওয়া শেষ হলে ডাকবেন। ” লোকটি উল্টে চিৎকার করতে লাগল,“আমি ঢুকবই। আপনি বারবার ঢুকছেন, আমি ঢুকলেই দোষ?”ধীমান তাও ঠান্ডা মাথায় বলল,“আমি তো স্টাফ । অফিসের লোক-”। “তো? আমিও অফিসের লোক। বাইরের লোক নাকি?” অবস্থা দেখে ধীমান ক্রমেই পিছু হটছে দেখে আমায়ই মঞ্চে নামতে হল, বাঁধা গৎ,  “অফিসে চ্যাঁচানো চলবে না। স্টাফের সাথে অভব্য ব্যবহার করলে আপনার কোন কথাই শুনব না। বাইরে দাঁড়ান। যান”। এক ধমকে কাজ হল।
মুখে যাই বলি, যথা সময়ে ডাকলাম ভদ্রলোককে,“কি ব্যাপার বলুন। ”“ক্লেম পাচ্ছি না, অনেক দিন হল। ইন্সপেক্টর সাহেব বদমাশী করে ফেলে রেখেছে”।  বুঝলাম সবই, ক্লান্ত স্বরে বললাম,“ কি ক্লেম?সাইকেল তো?” “হ্যাঁ।  আর যন্ত্রপাতি আজ্ঞে”।  যন্ত্রপাতি অর্থাৎ টুলস্ । নির্মানকর্মী অর্থাৎ রাজমিস্ত্রি যোগাড়ে এদের যন্ত্রপাতি কেনার জন্যও আগে টাকা দেওয়া হত। এখন অন্তর্বতী অর্ডারে বন্ধ আছে। তাও অনেকদিন হয়ে গেল। আগে ঐ প্রকল্পে নাম লেখালেই ছয় মাস বাদে পাঁচ হাজার টাকা পাওয়া যেত নানা খাতে। হঠাৎ  বন্ধ হয়ে যাওয়া তেই সমস্যা। বুঝিয়ে বললাম। লোকটি অবাক হয়ে বলল,“সবাই দিচ্ছে। কত সাইকেল বিলি হচ্ছে আর আপনারা দিবেন না কেন?ব্যাপারটা জানাতে হচ্ছে। ” মাথা নাড়লাম, যাকে পারিস জানা বাপ। মুখে যদিও বললাম,“অর্ডার না এলে-”। লোকটি বলল,“আচ্ছা দেখি। কেমন না দিয়ে থাকেন। দিদিকে জানাব। ”কোন দিদি? প্রশ্ন নিষ্প্রয়োজন। মুখে বললাম,“একদম। এটাই করুন। আপনার সাইকেল অবধারিত।”
গত বৃহস্পতিবার, শেষ বেলা, কাজ করছি, আসলে আমার তিনজন ইন্সপেক্টর হঠাৎ  প্রোমশন পেয়ে চলে গেছে, কিন্তু ব্যাপারটা এখনও অবধি বিডিওদের জানাতেই পারিনি।কম্পুটার জানা ক্লার্ক (সিকেসিও) নিয়োগ নিয়ে দম ফেলার ফুরসত নেই। কর্মী সংখ্যা এত স্বল্প যে  প্রায় ২০০ জনের ইন্টারভিউ এর চিঠি রেডি করে ছাড়তেই আমাদের নাভিশ্বাস উঠছে। তাও তো এডিএম ডেভালাপমেন্ট হুগলী আর ডিএলসি চন্দননগর সাধ্যাতীত সহযোগিতা করছেন। ওনাদের সহায়তা ছাড়া নির্ঘাত মারা পড়তাম।  যাই হোক এরই মধ্যে বিডিও দের চিঠি এবং ঐ শূন্যস্থানের চার্জ অন্য ব্লকের ইন্সপেক্টরের ঘাড়ে চাপানোর চিঠিটা কোন মতে টাইপ করিয়ে সই করার আগে শেষবারের  মত পড়ে নিচ্ছি, হঠাৎ দরজা ফাঁক করে একজন মুণ্ডু গলাল,“ ম্যাডাম  আসব?” পাঁচটা আঙুল দেখিয়ে বললাম, পাঁচ মিনিট দাঁড়ান। ও বাবা লোকটি বলল,“পাঁআচ মিনিট? ঠিক আছে।  আমি তাহলে একটা কাজ করে আসি সেই ফাঁকে-”।  হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম, এ কোন জেলায় এলাম বাপ?
#Aninditas_Blog

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ১৬ই ফেব্রুয়ারি ২০১৭ #10

উফ্ কতদিন বাদে আবার লিট্টি মাসিকে দেখলাম। সেই যে নৈহাটির লিট্টি মাসি? যার বানানো লিট্টি দেবভোগ্য। হপ্তা দুয়েক আগেই বুঝেছি যে আমি লিট্টি মাসির প্রেমে পড়েছি। সাড়ে পাঁচটা বাজলেই  প্রাণটা হাঁকডাক  করে, আহা কখন যাব, কখন তার দর্শন পাব, কখন বলব ‘মাসি চাটনি বেশি। ঝাল বেশি। ’উলস্।
এই প্রসঙ্গে বলি আমার জীবনের দৈনন্দিন খুঁটিনাটি ব্যাপার জানাতে যদি আপনার আপত্তি থাকে, তো মশাই অনুগ্রহ করে এই মুহূর্তে আমায় আপনার বন্ধুতালিকা থেকে দূর করে দিন। আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব। পারলে শৌভিককেও করে দিন। কারণ আমার জীবনে যাই ঘটুক তার সঙ্গে শৌভিক সবসময়ই অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত।স্বয়ং ঈশ্বরই যখন দুজনে একসাথে ট্যাগ করেছেন তো আমি কোন ছার। কাজেই ওকে আমি ট্যাগাবোই। আপনারও বিরক্তি উদ্রেক হবে। বিবমিষা জাগবে,অম্ল বদহজম পেটখারাপ খুজলি না জানি আরো কি সব বিভৎস রোগ হবে। তার থেকে ছেড়ে দাও বাবা, কাজ কি? আর একটা কথা মশাই, অ্যাকাউন্টটা যখন আমার তখন আমার দেওয়ালে কি লিখব বা কি সাঁটব সেটা তো আমিই ঠিক করব মশাই।

যাক গে। কথা হচ্ছিল আমার লিট্টি মাসিকে নিয়ে, দুসপ্তাহ ধরে তার দর্শন পাইনি। না না, লিট্টি মাসির কিছু হয়নি, আমি এবং সুতপা দি ফেরার পথে অন্যান্য খাবার ট্রাই করছিলাম। যেমন একদিন খেলাম কটকটে ঝাল আর তেমনি নোনতা ছোলা চেপ্টি। আর একদিন বেশটি করে লেবু নুন লঙ্কা মাখানো ভুট্টা।এছাড়া ঝালনুন ছড়ানো আলুর পাঁপড়, ছোলা মাখা, ডালমুট তো আছেই। মেন লাইনের মত সুস্বাদু ডালমুট আমি আর কোথাও খায়নি। যেমন কুড়মুড়ে,তেমন নুন আর ঝাল। আহাঃ।

আর যেদিন শৌভিকের সঙ্গে ফিরি সেদিন তো ওসব দিকে তাকানোও পাপ---।

কিন্তু আজ আমি একেবারে একা। সাধ্য কি ঐ দুর্বার আকর্ষণ অগ্রাহ্য করি? দীর্ঘ অদর্শনে তথা  অনাস্বাদিত হওয়ায় বোধহয় লিট্টির স্বাদ আরো বেড়ে গেছে।গিয়ে দাঁড়াতেই মাসি একটা গরম কুড়মুড়ে লি্ট্টি নিয়ে চামচের পিছন দিয়ে ঘ্যাঁচ করে দিলেন তার পেটটা ফাটিয়ে,তারপর একচামচ আলু আর দুই চামচ ধনে পাতার চাটনি ঠুসে যখন শালপাতা মুড়ে আমার হাতে দিল--- সারাদিনের খিটখিট, ক্লান্তি, গ্লানি, রক্তচাপ এক লহমায় ফুররর্। আহা আমার লিট্টি মাসি বেঁচে থাক--- সাধে কি বলি লিট্টি মাসির প্রেমে পড়েছি?

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ২৩শে ফেব্রুয়ারি ২০১৭
দোহে ফিরছি। অফিস থেকে বের হতে বেশ দেরী হয়েছে, লঞ্চ থেকে নেমে আজ আর হাঁটার অবকাশ নেই। অন্যদিন হলে শৌভিক অবশ্যই আমাকে কান ধরে হাঁটাত, কিন্তু আজ আর সেই চেষ্টাও করল না। এই ট্রেনটা ফস্কে গেলে রাত নটাতেও বাড়ি ঢুকতে পারব না।
স্টেশনে পৌছে দেখি ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে।  ও তো রোজই থাকে, তাই বলে লিট্টি খাব না? বললাম সে কথা, এমন দৃষ্টি দিল যে আর একটু হলেই ভস্ম হয়ে যাচ্ছিলাম আর কি। হৃদয়বেদনা গোপন করে সুবোধ বালিকার মত বরের অনুগামী হলাম। মন্দ কপাল আমার, উঠে বসতেই ছেড়ে দিল। অন্য দিন ছাড়ে না কিন্তু। প্লাটফর্ম ছেড়ে যেতে যেতে উদাস ভাবে প্রত্যক্ষ করলাম যে ঐ বসে আছে আমার লিট্টি মাসি। জ্বলন্ত কয়লার উনুনে পরিপক্ব হচ্ছে জিভে জল আনা ছাতুর লিট্টি। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল জঠরানল। আমার শুকনো মুখ দেখে কি বুঝল কে জানে ব্যাগ থেকে বার করে দিল একটা ইয়া বড় আপেল। ইঃ লিট্টি ছেড়ে আপেল? কি করি বিরসবদনে তাই চিবোতে লাগলাম। মাঝে মাঝেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছি ছোলা চেপ্টি উঠল কি?নুন-নুন ঝাল ঝাল ছোলা চেপ্টি? ধুৎ। কিচ্ছু ওঠে না। কি বাজে ট্রেন বাপ। মনের দুঃখে আপেল যখন শেষ করে এনেছি, হঠাৎ  দেখি, কে যেন চিৎকার  করছে, “এই তো লিট্টি খান। ছাতুর লিট্টি। পাঁচ টাকা প্যাকেট। বড় প্যাকেট দশ টাকা”--আর আমায় পায় কে? আয় বাবা এদিকে আয়-- আমার জন্যই তো উঠেছিস❤❤❤।  আড় চোখে তাকিয়ে দেখি হিটলারের জামাইটা ঢুলছে, আয়- আয় জলদি আয়, ঢুলুনি ভাঙার আগেই আয় সোনা--- এল বটে, কিন্তু লিট্টি নয় নিমকি। ছাতুর নিমকি। আমার ক্ষুধার্ত বিরহাতুর কান নিমকিকে লিট্টি শুনেছে।  সাধে কি বলি, ব্যাড লাকটাই ইয়ে-_-  লিট্টি মাসি গো মিস ইউ টু মাচ।😢😢

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি ২৭শে ফেব্রুয়ারি ২০১৭ #11
প্রথম যেদিন অর্ডার বেরোলো এবং জানা গেল আমার পরবর্তী  গন্তব্য চুঁচুড়া, তৎকালীন ধনিয়াখালির ইন্সপেক্টর বর্তমানে এএলসি জয়িতা আমায় প্রবল ভয় দেখালো,“ম্যাডাম, কোথায় যাচ্ছেন?ওখানে কোন লেডিজ টয়লেট নেই জানেন? যেখানে যেতে হয়, সেটায় টিনের দরজা। তাও  পুরো বন্ধ হয় না।  ছ ইঞ্চি ফাঁক থাকে। ”
খারাপ বাথরুম আর আমার কর্মজীবন অঙ্গাঙ্গি  ভাবে জড়িত। ও সব নিয়ে ভয় পেলে আর লেবার গিরি করা যায় না। কার্যক্ষেত্রে দেখলাম, বাথরুম একটা আছে বটে। বেশ পরিষ্কার, সকালে ফিনাইলের গন্ধ পাওয়া যায়। ফাঁক আছে বটে তবে ছ ইঞ্চি নয়, তিন আঙুল মাত্র। খড়্গপুরে আমি যে টয়লেট ব্যবহার করে সাড়ে চার বছর চালিয়েছি তার কাছে থো এটা রূপকথা। কিন্তু একটাই মুস্কিল, মাত্র দু ফুট বাই দু ফুট মাত্র।সর্বোপরি শুধুই ইউরিনাল। পেট কামড়ালে, আমি জানি না---_

দিন দুয়েক বাদে সত্যিই চুঁচুড়ার ইন্সপেক্টর মেসেজ করল,“ম্যাডাম আসতে পারছি না। কারণটা কাল সকাশে বলব। ”বলতে হল না বেশ বুঝলাম কারণটা।
শ্রী আশিস সরকার আমাদের নতুন ডিএলসি চার্জ নিয়েই আমার অফিস পরিদর্শনে এসেছেন, কথা প্রসঙ্গে বাথরুমের কথা উঠল, আমরা সাফ জানিয়ে দিলাম,“স্যার যেদিন যাকে ফোন করে অফিসে পাবেন না, বুঝবেন তার পেটের ইয়ে মানে ইয়ে হয়েছে”। আশিসদা হাসতে হাসতে বিষম খেয়ে বললেন,“ আগে অফিস পাল্টাও। যেখানে ইয়ে নেই সেখানে কেউ অফিস করতে পারে?”

এতো গেল ইয়ের কথা, আরো আছে, দেখি টয়লেটে কোন লিটারবিন নেই। একিরে বাবা!!বললাম বাথরুমে একটা ডাস্টবিন দাও, তো গ্রুপ ডি গিয়ে একটা প্লাস্টিকের চিটচিটে নোংরা ঝাঁঝরি বালতি নিয়ে এল, কোন ইন্সপেক্টরের টেবলের তলা থেকে। যাঃ বাবা, সে এবার কাগজ, চায়ের কাপ ফেলবে কোথায়? অন্য আরেকজনের পায়ের কাছে রাখা চিটচিটে বালতিতে?বেরোও। দূর হও। যত পাগল কি আমার কপালেই জোটে ভগবান??

অর্ডার দিয়ে ঢাকা ওলা লিটারবিন আনালাম। অফিসে ঢুকে দেখি আমার পূরানো ডাস্টবিনের পাশে সুন্দর করে সেটিকে সাজিয়ে রেখেছে আমাদের নিতাই বাবু। নিতাইবাবু আমাদের সুইপার কাম ওয়াটার কেরিয়ার। কোন অনুমোদন নেই যদিও। কিভাবে যে পয়সাদি তা আমরাই জানি।

যাই হোক আবার এক প্রস্ত চিল্লাচিল্লি করে সেটাকে টয়লেটে রাখার ব্যবস্থা করলাম।গত সপ্তাহে একদিন বাথরুমে গেছি, দেখি কলে জল নেই। হাঁক পাড়লাম,“নিতাই বাবু জল নেই কেন?” নিতাই বাবু ঘাবড়ে গিয়ে বলল,“ ম্যাডাম ছটার পর তো জল থাকে না।”ছটার পর জল থাকে না? ছটার পর কেউ ইয়ে করে না এখানে?এ আমায় কোথায় পাঠাল😈😈!!!নিতাই বাবু আরো এক প্রস্ত হাত কচলে বললেন,“ম্যাডাম বালতিতে জল আছে তো!”বালতি?গোটা অফিস খুঁজেও কোন বালতি পেলাম না।

আজ বালতির রহস্য উন্মোচিত হল। দুফুট বাই দুফুট বাথরুমে টাল সামলাতে না পেরে ঢাকা দেওয়া ডাস্টবিনের লিভারে পা পড়ে গিয়েছিল, মুখ হাঁ হতে দেখি টলটল করছে এক বালতি জল।
সন্ধ্যাবেলা নিতাই বাবু অফিস বন্ধ করতে এসেছেন, আমি আর সুতপাদি তখন ব্যাগ বাগিচা নিয়ে বেরোচ্ছি, খপ করে ধরলাম,“ নিতাই বাবু আপনি ডাস্টবিনে জল ভরে রেখেছেন?”
“ওটা ডাস্টবিন নাকি ম্যাডাম? আমি ভাবলাম ছটার পর জল থাকে না বলে আপনি বাথরুমে একটা বালতি রেখেছেন। ”সুতপা দি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসি চাপতে গিয়ে বেপোট হেঁচকি তুলতে লাগল।
হে ভগবান, এ আমি কোথায় এলাম। বলতে গেলাম, “বাথরুমে ডাস্টবিন শুনে কেন আকাশ থেকে পড়ছেন মশাই, বিয়ে থা করেছেন তো নাকি?” বলতে পারলাম না, বৃদ্ধ আমায় বড় ভালোবাসেন, প্রায় বলেন,“আমার ম্যাডাম আছে  আমার কোন চিন্তা নেই”। এ হেন ‘মা-ডামে’র মুখে এই কথা শুনলে না বৃদ্ধের হার্ট অ্যাটাক হয়। শুধু বললাম,“ওটা ডাস্টবিনই। বালতি নয়। বুঝলেন”।

অনির চুঁচুড়ার ডাইরি #১২, ১৪ই মার্চ ২০১৭
একাই যাচ্ছি। শৌভিক আগের ট্রেনে চলে গেছে। ব্যাগ ঢুঁড়েও এক টুকরো রদ্দি কাগজ পেলাম না, অগত্যা হাতেই টুকছি, গিয়েই কি কি করতে হবে। কয়েকজনকে এখুনি ফোন করতে পারলে ভাল হয়,  কিন্তু --- এই সব সাতপাঁচ ভাবছি, হঠাৎ  চমকে উঠলাম, এক সৌম্য দর্শন হকার কি যেন বিক্রি করছেন, এতক্ষণ খেয়াল করিনি। পার্শ্ববর্তীনী বললেন,“একটু ফ্রি স্যাম্পল দাও তো। ”
লোকটি তাচ্ছিল্যপূর্ণ ভাবে বললেন,“ফ্রি স্যাম্পল? ফ্রি দেবার সময়ই নেই। এ লাইনে এই জিনিস শুধু আমার কাছেই পাবেন। ” চমকে উঠলাম। বাপরেঃ এ লাইনে একথা প্রথম শুনছি যে। কি বিক্রি হচ্ছে? কান করে শুনলাম ভদ্রলোক চিৎকার করছেন,“এই তো আমি এসে গেছি। সঙ্গে নিয়ে,‘মাঞ্চুরিয়ান দিলবাহার আমলা। খাস জয়পুরের মাল। প্যাকেট খুলে শুধু মুখে দেবেন--আর দেখবেন।। পেট ছেড়ে  গ্যাস  পালাতে পথ পাবে না। গ্যাসের যম।  “
বাপরেঃ ।  আমি নেমে যাব----
#অনির_চুঁচুড়ার_ডাইরি
https://amianindita.blogspot.in

No comments:

Post a Comment