Friday 23 September 2016

অনির (পুজোর) ডাইরি ২০১৬, ২৩শে সেপ্টেম্বর

পুজোর ডাইরি, মানেই আনন্দ, উৎসব, হৈচৈ যেখানে শোক দুখের কোন বালাই নেই। এমনিতেও শোক দুঃখ আমার লেখায় খুব একটা পাবেন না, কারণ এই আননবই/ আমার ব্লগে আমি লিখি শুধু মাত্র  আনন্দ- হর্ষটুকু ভাগ করে নিতে, দুঃখ তো একান্তই ব্যক্তিগত। বেদনা ভাগ করা যায় না, সে চেষ্টাটুকুও যে কতখানি হাস্যকর, সেই প্রসঙ্গে একটা গল্প না বলে পারছি না, বছর পাঁচেক আগের কথা, আমার এক বন্ধু হঠাৎ ঠিক করল, অনেক হয়েছে, এবার বিয়ে করে ঘর সংসারী হতে হবে।বিয়ে তো করবে, কিন্তু করবে কাকে? পাত্র খুঁজতে হবে, খুঁজবে কে? কেন আমরা বাকি দুই বন্ধু আছি না। সুপাত্র অন্বেষণ শুরু হল, আমার দৌড় বলতে বাড়িতে শৌভিক আর অফিসে অঞ্জনদা, দুজনকেই বললাম, “ভাল ছেলে/ বন্ধু-বান্ধব থাকলে বলুন/বল।” শৌভিকের বেশ কিছু অবিবাহিত বন্ধু/ সহকর্মী ছিল বটে, কিন্তু আমার বর হাত উল্টে জানিয়ে দিল, “বিডিও গিরি অবধি হচ্ছে, বউয়ের বন্ধুর জন্য ঘটকালী আমার দ্বারা হবে না।” আমি ব্যর্থ হলেও আমাদেরই অপর এক বন্ধু বেশ কিছু সুসম্পর্ক তথা সুপাত্রর খবর জোগাড় করল। খবর পাবার পরের কাজ ছিল, সম্মিলিত ভাবে ফেসবুকে সেই ব্যক্তিটিকে খুঁজে বার করা, এবং তার ছবি, পোস্ট ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে তার সম্পর্কে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নেওয়া। বেশ কয়েকজনকে নাকচ করার পর (বেচারারা জানেও না) একটি নব্য(?) সুবেশ যুবাকে সবার পছন্দ হল। বেশ সুদর্শন, নিয়মিত জীবনানন্দ, সুনীল, শক্তির কবিতা-টবিতা শেয়ার-টেয়ার করে, বেশ আঁতেল টাইপ। সব ঠিক-ঠাক এবার বন্ধুর বাবা-মা অর্থাৎ কাকু-কাকিমাকে বলা হবে, হঠাৎ যে বন্ধু সম্বন্ধ এনেছিল, সেই বেঁকে বসল, “এই না। না। না। এ ছেলে চলবে না?” বাকিরা সম্মিলিত ভাবে প্রতিবাদ করলাম (সবই মেসেঞ্জারে, তখন আমাদের হোয়াটস অ্যাপ ছিল না), “কেন? কেন? কেন? এত হ্যান্ডু! তায় আঁতেল।” ঘটকী দাঁত খিঁচিয়ে, যথাসম্ভব শ্রাব্য গালি দিয়ে বলল, “আব্বে দেখ, কয়েক মাস আগে, ছেলেটার হাত কেটে ছিল, সেই হাতের ছবি দিয়ে কি লিখেছে, “গট থ্রি স্টিচেস। ফ্রেন্ডস প্লিজ প্রে ফর মি।” মাত্র তিনটে সেলাই এর জন্য যে ছেলের বন্ধুদের প্রেয়ারের দরকার পরে, তার সাথে কে ঘর করবে ভাই?” নেহাত বোকা বোকা লজিক হয়তো, কিন্তু এই অভিজ্ঞতা আমাকে এই শিখিয়েছিল, যে দুঃখ আমাদের নিছক আপন অত্যন্ত স্পর্শকাতর ব্যাপার। তা ভাগ করে নেওয়া যায় না।
          মা আসতে আর তিন সপ্তাহও বাকি নেই। কিন্তু কেন যেন কিছুদিন ধরে সেভাবে আনন্দ উপভোগই করতে পারছি না। যখনি ডাইরি নিয়ে বসছি, কি এক অব্যক্ত যন্ত্রণা আমার আঙুল গুলোকে আঁকড়ে ধরছে। কিছু বলতে চাই, নিজের মানসিক যন্ত্রণা ভাগ করে নিতে আমি ব্যাকুল কিন্তু ভয় করে, ব্যক্ত করতে গিয়ে কারো ব্যক্তিগত জীবনের চৌহদ্দির মধ্যে না পদার্পণ করে বসি। কারো নিদারুণ ব্যথা না আমার কলম এক্ষেত্রে কি-বোর্ডের মাধ্যমে জনসমক্ষে উন্মোচিত না হয়ে পড়ে। তবু না বললে আমার পুজোর ডাইরি অসম্পূর্ণ।
অ্যালার্ম এর ডাকে বুধবার ভোরে ঘুম চোখে অ্যালার্ম বন্ধ করতে গিয়ে দেখি বসের মেসেজ। কি মর্মান্তিক সেই মেসেজ, মাত্র দুলাইনে স্যার লিখেছেন, ওনার স্ত্রী মঙ্গলবার রাতে হঠাৎ মারা গেছেন। তাঁকে সমাধিস্থ করতে উনি দেশের বাড়ি যাচ্ছেন। ম্যাডাম বা বউদিকে (স্যার সব সময় বলতেন তোমাদের বউদি) কখনো দেখিনি, কিন্তু বিগত পাঁচ বছরে স্যারের মুখে ওনার কথা এত শুনেছি, এই মধ্যবয়সী দম্পতির আভ্যন্তরীণ ভালবাসা এত গভীর ভাবে প্রত্যক্ষ করেছি যে ওনার মেসেজ পড়ে চোখের জল চেপে রাখতে পারলাম না। দীর্ঘদিন ধরে ডায়বেটিসে ভুগছিলেন, সাথে যোগ হয়েছিল নার্ভের অসুখ। অফিসের শত ব্যস্ততার মধ্যেও কি অসীম মমতায় স্যার ওনাকে ফোন করে খোঁজ নিতেন। বৌদি অপারগ হয়ে পড়ার পর বেশ কিছুদিন স্যার স্বয়ং রান্না করে অফিস আসতেন। বউদি একা থাকতে মাঝে মাঝে ভয় পেতেন, তখন ওনার একটা ফোনেই স্যার হাফ ডে দিয়ে বাড়ি চলে যেতেন। নিয়মিত প্রেসক্রিপশন ধরে গোছা গোছা অসুধ কেনাতেন স্যার, একবার ছুটি নিয়ে দক্ষিণ ভারতেও ঘুরে এলেন, যদি একটু ভালো থাকেন বৌদি। বেশ কিছুদিন বাদে আবার যাবার কথা ছিল।  গত সপ্তাহে সিমলা ট্রেনিং এ যাবার আগেও স্যার বলে গেলেন, “ ফিরে এসে তোমার বউদিকে নিয়ে আর একবার দক্ষিণে যাব।”  এই তো বোধহয় সোমবার বা মঙ্গলবারই স্যার আমাকে আর ডিএলসি সাহেব কে পাকড়াও করে শোনাচ্ছিলেন, আয়াদের সাথে বউদির না বনিবনা হবার গল্প। হতাশ হয়ে বলছিলেন, “ আরে একটা আয়াকেও না পছন্দ হলে হয়? যার সাথে সমস্যা তাকে ছাড়িয়ে দিয়ে আর একজনকে খুঁজে কাজে লাগালাম, এ রান্নাও করবে, চেনা মেয়ে আগে আমাদের বাড়ি কাজ করত। এখন বলছে, একেও না পসন্দ। পুরানো আয়াকেই চাই।” আমরা হাসছিলাম, এ সমস্যা স্যারের কাছে নতুন হলেও আমার মা-শাশুড়ির প্রায়ই হয়। কক্ষনই কোন কাজের লোককে ওদের পছন্দ হয় না। যতক্ষণ তাকে না ছাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, এরা শান্তি পায় না, আর ছাড়িয়ে দিলেই মা’রা ঐ পরিচারিকার গুণকীর্তন শুরু করেন। বললাম, ওনাকে, উনি ভালো করে মাথা চুলকে বললেন, “তোমাদের ছাড়া আর কার সঙ্গেই বা শেয়ার করব বল?”  তার সাথে মঙ্গলবার মধ্যরাতে স্যারের পাঠানো মেসেজকে আমি কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না। আজো পারছি না। সবথেকে মর্মন্তুদ ব্যাপার হচ্ছে আজি খবর পেলাম, ওনার পদোন্নতি হয়েছে। ইশ আর আড়াইটে দিন আগে যদি এই অর্ডারটা বের হত?
খবরটা বাড়িতে বলতে ফোন করেছিলাম, বাবা শুনে বলল, “ঈশ। মন খারাপ হবার মতই খবর। তবে আমাদের ও একটা খারাপ খবর আছে। জগন্নাথের বউ মারা গেছে।” জগ্ননাথ? অর্থাৎ জগুদা, আমার মাসতুতো দাদার শালা। তার বউ অর্থাৎ জুঁই? সম্পর্কটা শুনতে বা লিখতে যতটা দূরের মনে হয়, আসলে তা নয়। যৌথ বিরাট পরিবারে এগুলো নিতান্তই কাছের কুটুম্ব। দাদার কাছে আমি লেখাপড়া শিখেছি, বাবার পরই আমার দাদা। মাসতুতো শব্দটা নেহাত শব্দ মাত্র, অর্থ কিছু নেই আমার কাছে। দাদার শালা অর্থাৎ জগুদাকে চিনি বিগত আঠারো বছর ধরে, নিতান্ত ভালোমানুষ, গোবেচারা, সাত চড়ে রা কাড়ে না টাইপ ভালো ছেলে।  আর জুঁই? ওকে চিনি তা প্রায় দশ বছর। চোখ ধাঁধানো রূপসী ছিল না বরং স্নিগ্ধ মিষ্টি মাখনের ডেলা ছিল মেয়েটা। ঘাম তেল মাখানো চকচকে ফর্সা রঙ,গোল পানা মুখ আর জগত ভোলানো এক গাল হাসি।  এত সাদাসিধে মেয়ে সত্যি দুর্লভ। যেখানে যেত, নিজ রূপে গুণে সকলের মন জয় করে নিত। জুঁই তো জুঁইই, মিষ্টি মধুর সুগন্ধে ভরিয়ে রেখেছিল গোটা পরিবারকে। জগুদা পাক্কা কর্পোরেট ম্যান,কখন অফিস যায়, কখন ফেরে কোন ঠিক নেই। ফিরতে যত রাতই হোক না কেন, জেগে বারন্দায় অপেক্ষা করত বরের, একসাথে রাতের খাওয়াটুকু সারবে বলে। কি যে গভীর ভালবাসা ছিল দুজনের মাঝে, তা যুগলকে একনজর দেখলেই অনুভব করা যেত। এই তো দু-এক হপ্তা আগেই ফেসবুকে ছবি দেখছিলাম ওরা চাদিপুর বেড়াতে গেছে। হাসি হাসি মুখে, যুগলের ছবি, একা জুঁই, ছেলের হাত ধরে হাসি মুখে জুঁই।
হঠাৎ কি হল? চাদিপুর থেকে ফিরেই জ্বর, পেটের অসুখ আর র‍্যাশ। ফেলে না রেখে পরদিনই হস্পিটালাইসড করা হল মেয়েটাকে। সবাই ভেবেছিল ডেঙ্গু। রক্ত পরীক্ষা করে দেখা গেল, প্লেটলেট কাউন্ট সাড়ে তিন লাখ। জরুরি ভিত্তিতে ডায়লিসিস করা দরকার বলে ছোট নার্সিং হোম তৎক্ষণাৎ রেফার করে বড় হসপিটালে। মধ্য রাতে নিয়ে যাওয়া হয় এশিয়ার সেরা বলে নিজেদের দাবী করে এমন এক সুপার স্পেশালিটি হসপিটালে। সারা রাত এমারজেন্সিতে ফেলে রাখা হল মেয়েটাকে, কারণ কোন ডাক্তার এবং বেড খালি নেই। পরদিন আই সি ইউতে যখন স্থান পেল, ততক্ষণে ইউরিন ফরমেশান স্তব্ধ হয়ে গেছে। বারংবার অনুরোধেও ডায়ালিসিস চালু করল না, বড় হসপিটাল। কারণ ছোট হসপিটালের টেস্টে ওদের ভরসা নেই। ড্রিপ আর ক্যাথেটার লাগিয়ে ফেলে রেখে আবার সব টেস্ট করা হল। ফলাফল জানতে জানতে কেটে গেল সারা বেলা। বিকালে যখন ডায়লিসিস করার সিধান্ত নিল ওরা, ততক্ষণে রোগীর চেতনা লুপ্ত হয়েছে। প্রেসার এত কম, ডায়লিসিস অসম্ভব। অবচেতন মেয়েটাকে বাঁচার সম্ভবনা তখন ওদের ভাষায় মাত্রই ৫%। অন্তিম প্রচেষ্টা করল হসপিটাল, একটা ইঞ্জেকশন, যার মূল্য ৮০ হাজার টাকা। ফুলের মত ফুটফুটে মেয়েটা আর ধকল নিতে পারেনি।
আমার তুত্তুরীর থেকে মাত্র এক বছরের বড় ওদের ছেলেটা। মাকে ছেড়ে কোনদিন থাকেনি। সুপার স্পেশিয়ালিটি হসপিটালকে স্পেশাল অনুরোধ করে, ভেন্টিলেশনে থাকা কালীন অচেতন মাকে একবার দেখিয়ে আনা হয়েছে। যাতে মা কোথায় জিজ্ঞেস করলে কিছু জবাব দেওয়া যায়।

No comments:

Post a Comment