Friday 2 September 2016

ফেবু


রবিবার সকাল আটটা, আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে, ফুল স্পিডে ফ্যান এবং এসি চালিয়ে আরাম করে ঘুমোচ্ছিল রাই, আচমকা মুঠো ফোনের তীব্র আর্তনাদে ধড়মড়িয়ে উঠে দেখে বাবার ফোন। হ্যালো? হ্যালো? বাবা? কি হয়েছে? অ্যাঁ? মা- তুমি- পিসি সব ঠিক আছ তো? এত সকালে কি ব্যাপার?” ওপাশ থেকে অসহিষ্ণু গলায় বসন্ত বাবু বলে উঠলেন, “ ফাইন। ফাইন। অল ইজ ওয়েল। তোমার গর্ভধারিণী এখনও শয্যা ত্যাগ করে উঠতে পারেননি। আর পিসি বুধুয়া মেথরকে দিয়ে নর্দমা সাফ করাচ্ছে। সকাল থেকে এক কাপ চাও জোটেনি এই বৃদ্ধের। ” “তবে?” হতভম্ব হয়ে বলল রাই।
বসন্ত বাবু হড়বড় করে বললেন,“ আরে কাল থেকে কি যে হয়েছে কিছুই খুলছে না? খালি গোল গোল হয়ে ঘুরেই যাচ্ছে।হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না রাই। কাল থেকে বাবার ফোনে নেট কাজ করছে না, এটাই হল সমস্যা। দোষ সম্পূর্ণ রাইয়ের, সত্তরোর্দ্ধ বৃদ্ধ পিতার হাতে স্মার্ট ফোন ঐ তুলে দিয়েছে। আসলে কাকা, জেঠু, মামা, পিসেমশাই সবাই মারা গেল এক এক করে। বাবার বন্ধুরাও এক এক করে পরলোকে পাড়ি দিতে লাগল। ভীষণ একা হয়ে যেতে লাগল বাবা। মা- পিসির তাও টিভি সিরিয়াল আছে। বাবা কি নিয়ে থাকবে? সকালটুকু প্রাণায়াম আর কাগজ পরে কেটে যায়। দুপুর থেকে সময় আর কাটতেই চায় না। দোকান বাজার ও আজকাল আর যেতে পারে না স্বাস্থ্যের কারণে। বাগবাজারে ওদের বিশাল সাবেকী বাড়ি। রাইয়ের বৃদ্ধ প্রপিতামহের বানানো। মূল ভিটেটা প্রপিতামহের আমলে দুভাগে ভাগ হয়ে পার্টিশন হয়ে গিয়েছিল। রাইয়েরা ছোট তরফ। বড় তরফের সঙ্গে মনোমালিন্য বিগত একশ বছরেও মেটেনি। এখনও দুতরফের কিছু মামলা মোকদ্দমা বিভিন্ন আদালতে ঘুমিয়ে আছে। রাইয়ের বাবা বাদে অন্য ভাইয়েরা কবেই মারা গেছে। রাইয়ের খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোনেরাও কেউ আজ কলকাতায় নেই। বাবা একাই লড়ে যাচ্ছে সম্পত্তি নিয়ে। মাঝে বাবা এতটাই হতাশ হয়ে পড়েছিল যে দিবারাত্র মৃত্যুচিন্তা করত। বাবাকে সেই হতাশা তথা নিঃসঙ্গতা থেকে বাঁচানোর জন্যই রাই বাবার হাতে স্মার্ট ফোন তুলে দিয়েছিল। বেশি কিছু নয় শুধু ফেসবুক।
ফেসবুক প্রথম দিকে কিছুই বুঝতেন না বসন্ত বাবু। রাইই বেশ কিছু পরিচিত তথা আত্মীয় স্বজনের সাথে ফ্রেন্ডশিপ পাতিয়ে দেয়। একটু হাতবশ হবার পর নিজে নিজে খুলতে শিখে ভেবলে যান প্রবলপ্রতাপ বসন্তদূত বন্দোপাধ্যায়। এরা কারা? ভাগনে পটাই, প্যাংলা, আজন্ম নাক দিয়ে সর্দি গড়াত, মেজ মামার ভয়ে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলত, সে ওণাকে ফেসবুকে সম্বোধন করে মামুজান বলে। আর কি সব ছবি পাঠায়? লাল হাফপ্যান্ট হলুদ গেঞ্জি - ঈশ জাত ঘটির ছেলে হয়ে শেষে লাল হলুদ? আর ভাইঝি মামনি? সে নাকি প্রাউড লেসবি। বিদেশ থেকে নিজের লিভ ইন গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে যে সব ছবি পাঠায় তা সেন্সর্ড হওয়া আবশ্যক। ওণাদের যুগেও হোমো লোকজন ছিল, কিন্তু তারা এসব লুকিয়ে চুরিয়ে চালাত। প্রকাশ্যে রামঃ। আর ওণার আদরের বুল্টি ওরফে রাই? হায়দ্রাবাদে গিয়ে কি হয়ে গেছে মেয়েটা? কি সব পোশাক পরে? প্রকাশ্যে মদ্যপান করে, বিড়ি ফোঁকে, অন্য পুরুষবন্ধুদের জড়িয়ে ছবি তোলে। সে ছবি কে তুলে দেয়? না ওণার আদরেরে জামাই। উচ্ছন্নে গেছে এই জেনরেশন। প্রথম দিকে এই নিয়ে বলতে গিয়ে ব্যাপক ঝাড় খেয়েছিলেন বুল্টির কাছে। আজকাল আর কিছু বলেন না, শুধু স্যাড বা অ্যাঙরি ইমোজি পাঠান।
কি ভাবে জানি না, পাড়ার লোকজনও জেনে গেছে বসন্তদূত বাবু ফেবু তে আছেন আজকাল ভুরি ফ্রেন্ডরিকোয়েস্ট আসছে।বাজারওলা, মাছওলা, পেপারওলা, দুধওলা থেকে মায় যে ছেলেটি বাড়ি এসে চুল দাড়ি কেটে দিয়ে যায়। সবাইকেই অ্যাকসেপ্ট করেন বসন্ত বাবু। ফেবুতে উনি কিছু লিখলেই এদের অনেকেই লাইক করে। আর লাইক পেতে কে না ভালবাসে। কথাও হয় ফেবুতে, কিছু দরকারী কিছু অদরকারী।
কাল বিকালে একটা ফ্রেন্ড রিকয়েস্ট পেয়ে চমকে গেছেন উনি। বন্দোপাধ্যায় বাড়ির বড় তরফের বিধবা বড় বধু নিভাননী ওণার বন্ধু হতে চেয়েছেন। বড় তরফের সাথে ওণাদের মুখ দেখাদেখি বহু দিন বন্ধ। নিভার সাথে জীবনে একবারও বার্তালাপ হয়নি ওণার। দেখা হয়েছে বেশ কয়েকবার আদালত চত্বরে, নিভার বরটা ন্যালাখ্যাপা ছিল। দেখা হলে হাসার চেষ্টা করত, নিভার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই গোমড়া হয়ে যেত। বসন্ত বাবুর কেমন যেন ধারণা ছিল নিভা ওঁকে সইতে পারেন না। একাধিক ব্যক্তির কাছে নিভা ওঁর নামে বিষোদ্গার ও করেছিলেন। তবে? দোনামোনা করে অ্যাকসেপ্ট করেই নিলেন বসন্ত বাবু। তৎক্ষণাৎ মেসেজ এল, “বন্ধুত্বের হাত ধরার জন্য ধন্যবাদ। হৃদপিণ্ডকে ধমকে গতি কমাতে বলে বসন্ত বাবু লিখলেন, “অবাক হয়েছিলাম। মিথ্যা বলব না। ” “কিন্তু কেন? আমরা কি বন্ধু হতে পারি না?তুমি তো কোনদিন এগিয়ে এলে না, তাই অগত্যা আমাকেই--আধ ঘন্টা ধরে ভেবে লম্বা উত্তর লিখলেন বসন্ত বাবু কিন্তু মুখপোড়া হারামজাদা ফোন ফেসবুকটাই খুলছে না গো? সারা রাত ঘুমোতে পারেননি। কি যে হয়েছে ফোনটার কিছু বোঝেন ও না ছাই। সকাল হতেই বুল্টির দ্বারস্হ হয়েছেন, ফোনটা ঠিক করে দে মা। বহু বছর ধরে একজন জবাবের প্রতীক্ষায় আছে আর একজন ব্যগ্র হয়ে আছে জবাব দেবার জন্য। প্লিজ বুল্টি হেল্প।


No comments:

Post a Comment