Tuesday 20 December 2022

অনির ডাইরি ২০শে ডিসেম্বর, ২০২২

 


দাঁড়িয়েই আছি, মিনিট দশেক হয়ে গেল। আমি অবশ্য একা নেই, আসেপাশে দাঁড়িয়ে আছেন আরো অনেকেই। দূর পাল্লার একেকটা বাস আসছে, অমনি ছুটে যাচ্ছে লোকজন। কোনটা এগরা যাচ্ছে তো কোনটা পটাশপুর, কোনটা বা নন্দীগ্রাম।  আমাকে ধরতে হবে দীঘার বাস। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে উত্তমকুমার, বললাম,  চলে যাও। তাও গেল না। আজ দিনের আলো থাকতে থাকতেই বেরিয়েছি, প্রথমবার বাসে ফিরব। সকাল বেলা পাখি পড়া করে বুঝিয়েছে উত্তমকুমার,“অনেক বাস পাবেন ম্যাডাম। দু চারটে ছেড়ে দিবেননি। সিট আছে কিনা দেখে উঠবেন। নিমতৌড়িতে সিট না পেলেও নন্দকুমার মোড়ে পেয়েই যাবেন। কন্টাক্টরকে একটু বলে রাখবেননি।”  


বেশি জল খেতেও নিষেধ করেছে উত্তমকুমার। জল যদিও আমি বেশ কমই খাই। “বুঝে শুনে জল খাবেন ম্যাডাম। অনেকটা রাস্তা। একবার আমার যা হয়েছিল নি-”। পূর্ব মেদিনীপুর সত্যিই কেমন যেন লম্বাটে জেলা। তমলুক এবং কাঁথি যদিও একই জেলার দুইটি শহর, তাও খাতায় কলমে আমার বাসা থেকে আপিসের দূরত্ব প্রায় সত্তর কিলোমিটার ছুঁইছুঁই। 


ঘটাং করে একটা বড় বাস এসে দাঁড়াল। দরজা খুলে ব্রুস লির মত লাফিয়ে নামলেন এক চশমা পরা ভদ্রলোক, অতঃপর হাঁকতে লাগলেন কাঁথি, কাঁথি করে। উত্তমকুমারকে পিছনে ফেলে, হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গিয়ে কিঞ্চিৎ  ভীতু স্বরে জানতে চাইলাম, ‘সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ড?’ লোকটা পাত্তাও দিল না, তাচ্ছিল্যপূর্ণ ভাবে বলল,‘উঠুন, উঠুন।’ উঠেই পড়লাম, কপাল ঠুকে। সিট থাকলে বাঁচি। 


বেশ উঁচু আর লম্বা দূর পাল্লার বাস। একদিকে তিনজন আর একদিকে দুজন বসার ব্যবস্থা। আমার আগে যারা উঠেছিলেন, তারা পিছন দিকে এগিয়ে গেলেন। দূরপাল্লার বাসের পিছনে বসাটা কতটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে বুঝলাম না, তাই সামনে থেকে গুটি কয়েক সিট পরেই যে সিট পেলাম, তাতেই বসে পড়লাম। দুই শুঁটকে চেহারার ভদ্রলোক এতক্ষণে হাত পা ছড়িয়ে বসে গপ্প করছিলেন, ‘দাদা’ বলে আমি গিয়ে দাঁড়াতে, ধারের ভদ্রলোক ভিতরে ঢুকে গেলেন। 


বাস ছাড়ল, ছাড়ার সাথে সাথেই রুদ্ধশ্বাস দৌড়। অধিকাংশ জানলারই কাঁচ বন্ধ, ফলে ভিতরটা একটু গুমোট। জানলার বাইরে ক্রমশঃ কমে আসছে আলো। সূর্য ডুবেছে কিছুক্ষণ পূর্বেই। অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, চমকে উঠলাম কার যেন স্পর্শে। এক বিকলাঙ্গ ব্যক্তি উঠেছেন বাসে, সবার কাছে ভিক্ষা চাইছেন। বাস তো থামেনি এর মধ্যে, নির্ঘাত আগেই উঠে বসেছিলেন।  কয়েকবার মৃদু স্বরে দিদি/মা বলে ডেকেছেন বোধহয়, সাড়া না পেয়ে রড ধরে থাকা হাতটায় টোকা দিয়েছেন। বয়স কম না লোকটার, মসিকৃষ্ণ গাত্রবর্ণ। পিঠে মস্ত কুঁজ। এই শীতেও খালি গা, পরনে একটা ট্যানা। কারা কেন জিজ্ঞাসা করল,‘গরম জামা নেই?’ বিরক্ত হয়ে মাথা নেড়ে এগিয়ে যায় লোকটি। 


পাশের লোকটি হঠাৎ বলে ওঠে, ‘ গান্ধী বুড়ি’! বাইরে দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারি নন্দকুমার মোড় ঢুকছি। গোল চক্কর কেটে ডান দিকে বাঁকব আমরা। বাঁদিকে বাঁকলে তমলুক শহর আর সোজা চলে গেলে হলদিয়া। চৌমথার মোড়ে উন্নীত  নিশান কাঁধে দাঁড়িয়ে আছেন তমলুকের ঘরের মেয়ে। সঙ্গে তাঁর অনুগামী বৃন্দ। বাস গুলো এখানে বেশ কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়ায়, আগেই বলে রেখেছে উত্তমকুমার। এর মধ্যে একবার ফোন করে খোঁজও নিয়ে নিয়েছে,‘ম্যাডাম সিট পেয়েছেন তো?’ ছোলা,বাদাম,মশলা মুড়ির ঝাঁকা নিয়ে হকাররা ওঠে। অনেকে নেমে গিয়ে চা খেয়ে আসেন, টুকটাক কেনাকাটা করে আনেন পথে খাবার জন্য। 


বেশি ক্ষণ দাঁড়াল না অবশ্যি বাসটা। চাকা গড়াল কাঁথি শহরের দিকে। টিকিট কাটতে এগিয়ে এলেন কন্ডাক্টর দাদা। জানতে চাইলাম, ‘সেন্ট্রাল বাসস্টান্ড কত?’ জবাব এল,‘সেন্ট্রাল বাসস্টান্ড তো যাবেনি। আপনাকে বাইপাসে নামতে হবে।’ কোন বাইপাস রে ভাই? এখানে তো গণ্ডা গণ্ডা বাইপাস। জবাব দিল বটে লোকটি, একে তো কাঁথির লোকের কথা বুঝতে সামান্য একটু সমস্যা হয় আমার তার ওপরে বাসের তীব্র গর্জন। লোকটি আশ্বস্ত করল,‘বেশী দূর নয়। আপনি হেঁটে চলে যাবেন।’ এদিকের লোকের ‘বেশি দূর নয়’ এই সংলাপটিকেও বড় ভয় পাই আমি। কতটা দূর যে ঠিক বেশি দূর এদের কাছে, বুঝতে আজও অপারগ আমি। 


একটু আগেই মেসেজ করেছিলাম শৌভিককে, ‘বাসে উঠেছি। সিট পেয়েছি।’ জবাবে একগাল হাসির ইমোজি পাঠিয়েছিল আমার বর। আবার মেসেজ পাঠালাম, ‘ ওরে, এখন বলছে, এটা সেন্ট্রাল বাস স্ট্যান্ড যায় না। কি যেন বাইপাসে নামাবে আমাকে।’ এবার ওদিক থেকে একটা কান্নার ইমোজি এল। রাগে দুঃখে আমারই চোখে জল আসছে তখন। কোন বাইপাসে নামাবে রে বাবা। বাড়ি পৌঁছাব তো ঠিকঠাক- 


নরঘাট ব্রিজ পেরিয়ে যায় গাড়ি, নীচে হলদি নদীতে তখন মিশছে সন্ধের আঁধার। পেরিয়ে যায় বাজে চণ্ডীপুর-চণ্ডীপুর-বাজকুল-হেড়িয়া। দরজার সামনের জোড়া সিটে বসা লোকটি নেমে যেতেই লটবহর সহ তার আসনটি দখল করে বসি আমি। কাতর স্বরে কন্ডাকটরকে মনে করিয়ে দিই, ভাই প্লিজ বোলো। আমি কিন্তু কিছুই চিনি না। তিনি আবার হেল্পারকে বলেন, ‘বৌদিটাকে মনে করে খড়্গপুর বাইপাসে নামিয়ে দিস তো।’ যাক এতক্ষণে বাইপাসটার নামটা অন্তত বুঝলাম। 


বাস ছুটে চলে রুদ্ধশ্বাসে মারিশদা-দুর্মুঠ-নাচিন্দা। কাঁথি বাইপাস বলে চিৎকার করে ওঠে হেল্পার ভদ্রলোক। তড়িঘড়ি উঠতে যাই আমি, পাশের অল্পবয়স্ক সহযাত্রীটি বলে ওঠে,‘দিদি আপনি পরেরটায় নামবেন।’ কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভালো করে কান মাথা ঢেকে নিই। কি প্রচণ্ড হাওয়া ঢুকছে বাসে। ড্রাইভার আমি আর হেল্পার ছাড়া আর কেউ জেগে আছে বলেও মনে হচ্ছে না। প্রায় পৌনে দুই ঘন্টা হল বাসে উঠেছি। 


পরের চৌরাস্তায় যত্ন করেই নামিয়ে দেয় হেল্পারটি।  আঙুল দিয়ে দেখায় কোন রাস্তাটা ধরব আমি। ছুট্টে রাস্তা পেরিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি আমি। রাত একটু ঘন হয়েছে। রাস্তাও বেশ ফাঁকা মহানগর বা শহরতলীর তুলনায়।কিছুই চিনি না। এবার কি করব? তাকে ফোন করব কি?পরক্ষণেই মত বদলাই, এভাবে নিজেকে তাচ্ছিল্য করা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। এই সামান্য কারণে তাকে বিব্রত করার মত অসহায়া অবলা অন্তত আমি নই। পাশের চায়ের দোকানের বৃদ্ধকে শুধাই, দাদা অমুক জায়গায় যাব। কি ভাবে যাব একটু বলুন না। 


গনগনে কয়লার উনুনে চায়ের কেটলি চাপাচ্ছিলেন ওণার বৃদ্ধা স্ত্রী, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বললেন,‘ঐ দেখো টোটো দাঁড়িয়ে আছে। ধরে চলে যাও।’ জানতে  চাই ভাড়া কত? হাবলা পেয়ে ঠকায় যদি। সে প্রশ্নেরও  জবাব দেন উনি। টোটোয় উঠি, গন্তব্য জানাই, টোটোওয়ালা জানায়, অত দূর যাবে না। কাছাকাছি একটা জায়গায় নামিয়ে দেবে। সেখান থেকে মহকুমা শাসকের করণ থুড়ি নিবাস খুব বেশি দূর না। 


রাতের কাঁথি শহরের বুক চিরে হাঁটতে থাকি আমি। দুদিকে আলোকমালায় সাজানো দোকানের সারি। কোথাও গরম পকোড়া ভাজছে তো কোথাও রসে টইটম্বুর জিলিপি। জামাকাপড়-গয়নাগাটি- বইপত্র-চশমার দোকানের সারির বুক চিরে অবশেষে যখন আপিস চত্বরে ঢুকছি, জনৈক টোটোওয়ালা জানতে চাইল, ‘যাবেন নাকি?’ কেমন রাগটা হয়! 


পরপর আপিসগুলোর অনেককটাই তখন অন্ধকারে ডুবেছে। শৌভিকের চেম্বারে যদিও আলো জ্বলছে। গাড়িও দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। দেশোদ্ধার করছেন আমার বর বাবাজী। এর জন্য মহানগর ছেড়ে আসা একেবারে বেকার। একটুও ভালোবাসে না। দুটো সহানুভূতির কথা বলে না, কেবল ইমোজি পাঠায়।  আপদ 


বিড়বিড় করতে করতে খানিকটা এগিয়েই থমকে দাঁড়ালাম, আধো অন্ধকারে গা এলিয়ে বসে আছে দু-দুটো গাব্দা ষাঁড়। তাদের একজন সুপ্ত বটে অপরজন জুলজুল করে তাকিয়ে আছে আমারই দিকে। কোন মতে ইষ্টনাম জপতে জপতে তাদের পাশ কাটিয়ে বাংলোয় ঢুকলাম। ভেবেছিলাম সবাই আহাঃ আহাঃ করবে। উল্টে বাংলোর পাকশালা সামলায় যে ছেলেটি, সে বলল,‘মাত্র দুটো দেখতে পেলেন ম্যাডাম? ওখানে তো পনেরো বিশটা ষাঁড় থাকে। মাঝে মধ্যে কন্টাই বাজারে খেতে যায়। খেয়ে আবার পালিয়ে আসে।’ 


মা গো। আমি আর থাকব না এখানে। রোজ সন্ধ্যে বেলা এই ভাবে, ভোলে বাবা পার করে গা করতে আমি নাচার। আসুক আজ বুজুর বাবা। আগে ষাঁড় তাড়াবে তারপর অন্য কথা। ছেলেটি একগাল হেসে বলল,‘ ওরা কিচ্ছু বলে না ম্যাডাম। এই তো আমি বাজার করে ওর গায়ের পাশ দিয়ে নিয়ে এলুম, কিচ্ছু বলল না।’ দুধের কাপে চুমক দিয়ে নৈর্ব্যক্তিক ভাবে তুত্তুরী বলল, ‘বলবে না তো। সোজা উঠে গুঁতিয়ে দেবে।’ হে ভগবান সবাই আমার বিপক্ষে- আসুক আজ বুজুর বাপ।

অনির ডাইরি ১৮ই ডিসেম্বর, ২০২২

 

#কাঁথিরকিস্যা 


“একবার তো একটা মেয়ে সুইসাইডই করে ফেলল। রাত তখন আড়াইটা। সে কি ক্যাচাল ম্যাডাম।’ বক্তা  মহকুমা শাসকের বাহন চালক। 


মাস খানেক আগের কথা, তখনও শীত পড়েনি। সদ্য রঙ বদলেছে রোদ। বাতাসে লেগেছে সামান্য হিমেল স্পর্শ। যত্ন করে নতুন সাহেবকে শুঁটকি মাছ চাষ দেখাচ্ছিলেন ভদ্রলোক। মাছ ধরার পাশাপাশি, মাছ শুকানোও এই উপকূলীয় অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। অনভ্যস্ত শহুরে নাক হলে গন্ধটা বড় তীব্র লাগে। আগে জানলে সত্যিই আসতাম না। শৌভিক বলেছিল, পেটুয়াঘাট মৎস বন্দর দেখতে যাবে। বন্দর শুনে  হ্যাংলার মত লেজুড় হয়েছিলাম তুত্তুরী আর আমি। 


বন্দর দেখলাম, শৌলা আর জুনপুটে তারে ঝোলানো সারি সারি শুঁটকি মাছ দেখলাম। রঙবেরঙের ট্রলার দেখলাম। দেখেই অকুল দরিয়ায় ভেসে পড়তে ইচ্ছে করে। সাহস হয় না যদিও। বড় গন্ধ। বাঁধের ওপর দিয়ে পাকা রাস্তা চলে গেছে। পথের দুধারে দিগন্তপ্রসারী ফাঁকা মাঠ। মাঠ জুড়ে চলেছে মাছ শুকানোর কাজ। কোথাও খুঁটি পুঁতে, দড়ি টাঙিয়ে ঝোলানো রয়েছে সারি সারি বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, কোথাও বা মাটিতে গর্ত করে পোঁতা, কোথাও বা সেই পুঁতে রাখা মাছকে তুলে ঝাড়াই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। মাটি থেকে মাছ আলাদা করে জড় করা হচ্ছে স্তুপাকারে। মাছ শুকানোর কাজ মূলত বাড়ির মহিলারাই করছেন। হাত লাগিয়েছে সদ্য তারুণ্যে উপনীত হওয়া ফ্রক পরা মেয়ের দল ও। 


এদিকের মাটিটা বেশ বালি মেশানো। ড্রাইভার সাহেব বললেন কয়েক দশক পূর্বেও এই অঞ্চল ছিল সমুদ্র গর্ভে। রীতিমত ঢেউ খেলত। বাঁধের গায়ে আছড়ে পড়ত লবণাক্ত জলরাশি। এখন অবশ্য তিনি পিছিয়ে গেছেন বেশ অনেকটা। জোয়ারের সময় অবশ্য বেশ কিছুটা এগিয়ে আসেন আজও।  বাঁধের দুদিকে যত খানাখন্দ আছে, তাদের মধ্যে একদিকের জল মিষ্টি, অন্যদিকে লবণাক্ত। একদিকে প্রচুর সব্জি ফলেছে, অন্যদিকে পুকুর কেটে চলছে মাছ চাষের কাজ। প্রকৃতি হেথায় বড়ই উদার। সবকিছুই দিয়েছেন উজাড় করে। সবকিছুরই বড় প্রাচুর্য হেথা। ড্রাইভার সাহেব বললেন, ‘এদিকের লোককে মাছ কিনে খেতে হয় না স্যার।’ 


দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে, গ্রাম বাংলার রূপ- রস- গন্ধ- বর্ণে মোহিত হয়ে ফিরে চলেছি আমরা কাঁথি শহরের দিকে। একথা অনস্বীকার্য যে সমুদ্র দেখার সুপ্ত ইচ্ছে নিয়ে এসেছিলাম, ব্যর্থ মনোরথ হয়েই ফিরছি, তবে তাই নিয়ে তেমন ক্ষুন্নি বোধ নেই আমাদের। 


বেশ অনেক বছর ধরে কাঁথির মহকুমা শাসকের বাহন চালাচ্ছেন ভদ্রলোক। মহকুমাটাকে হাতের তালুর মত চেনেন। অনেক গল্প জানেন,বলতেও ভালোবাসেন। সাহেবের অনুমতি নিয়ে সামান্য ঘুরপথে নিয়ে চলেছেন আমাদের। উদ্দেশ্য হল মৎস দপ্তরের কি যেন একটা দীঘি দেখানো। সে দীঘি নাকি আয়তনে তেপান্তরের মাঠের সমান। কাকচক্ষুর মত টলটলে তার জল। অতি দক্ষ সাঁতারুও নাকি এপাড়- ওপাড় করতে হারিয়ে ফেলেন দম। চুনোপুঁটিদের পাশাপাশি রাঘববোয়ালরাও সেথা হাত-পা ছড়িয়ে সাঁতার কেটে বেড়ায়। শুধু ছিপ ফেলার অপেক্ষা। অবশ্য ছিপ ফেলতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনুমতি লাগে। 


গাড়ি চালাতে চালাতে বিভিন্ন সাহেব-মেমসাহেবদের সময় ঘটে যাওয়া না না ঘটন- অঘটনের গল্প শোনাচ্ছিলেন ভদ্রলোক। জনৈক সরকারী কর্মচারীর আত্মহত্যা তারই অঙ্গ। কোন এক নিশুতি রাতে গলায় দড়ি দেয় মেয়েটি। পাকেচক্রে কাঁথির তৎকালীন মহকুমা শাসক সে রাতেই কাঁথিতে উপস্থিত ছিলেন না। কি যেন দপ্তরী কাজে আটকে পড়েছিলেন দীঘায়। মধ্যরাত্রি অবধি দিব্যি জেগেই ছিলেন তিনি, ফোন সাইলেন্ট করে শুয়েছেন তার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই এত বড় অঘটন ঘটায় মেয়েটি।


অকালে ঝরে যাওয়া এক অপরিচিতা কন্যার জন্য বেদনার্ত হয়ে ওঠে হৃদয়। আহা রে। না জানি, কত  যতনে লালনপালন করে বড় করে তুলেছিল বাবা মা। সেই সন্তান যদি এমন অবিবেচকের মত, নিজেকে শেষ করে দেয়, কিছু বলার থাকে না। উনিও সম্মতি জানান,‘ ঠিক বলেছেন ম্যাডাম।’ জানতে চাই, মেয়েটি কেন এমন করেছিল,কারণ জানা গেছে কি? কাজের চাপ নাকি মানসিক অবসাদ? জবাব আসে, ওসব তো ছিলই, সাথে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল প্রেম। 


আবার গল্পে ফিরে যান ভদ্রলোক। বলতে থাকেন গভীর রাতে যখন আবিষ্কৃত হয় মেয়েটি অমন অঘটন ঘটিয়েছে, কতৃপক্ষ আতঙ্কিত হয়ে ফোন করে মহকুমা শাসককে। তখন রাত আড়াইটে। ওণার ফোন সাইলেন্ট ছিল, ফলে ফোন ধরতে কিঞ্চিৎ  বিলম্ব হয়। ইত্যবসরে মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং মৃত বলে ঘোষিত হয়। পরে যখন সাহেব/মেমসাহেব জানতে পারেন তিনি কিছুক্ষণের জন্য মানসিক ভাবে রীতিমত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এমন নয় যে সেরাতে তিনি ফোন ধরলে মেয়েটি বেঁচে যেত, তবুও-।


 প্রাক্তন ওপরওয়ালা(ঈ) র প্রতি একরাশ মায়া মাখানো কণ্ঠে ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্ন করেন ভদ্রলোক, ‘ আপনিই বলুন স্যার, এতে সাহেব/মেম সাহেবের কি দোষ?  রাত আড়াইটের সময় আপনাকে যদি কেউ ফোন করে, আপনি ধরবেন-’! 


দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, “হ্যাঁ” বলে লম্বা ঘাড় নাড়ে শৌভিক। ‘ আমার ফোন সারা রাত খোলা থাকে, কখনও সাইলেন্ট থাকে না। খুব গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এ না থাকলে আমি সব ফোন ধরি।’ থতমত খেয়ে গাড়ি চালানোয় মন দেন ভদ্রলোক। হাসি চাপি আমি, সত্যিই আমার বর ফোন ধরে ভাই। রাতবিরেতে , সময়- অসময়ে সবসময় ধরে। ধরতে পারে না কেবল যখন ইয়ে করতে যায়। কপালের এমন গেরো,যে ওই ঘরের চৌকাঠ ডিঙানো মাত্রই লাইন দিয়ে আসতে থাকে ফোন। ঘন্টি শুনে ছুট্টে এসে দরজার বাইরে থেকে চিল্লাই আমি বা তুত্তুরী, অমুকের ফোন/ তমুকের ফোন/ অজানা নম্বর থেকে আসা ফোন ইত্যাদি প্রভৃতি। 


এই অজানা নম্বর থেকে আসা ফোন গুলির মধ্যে আবার কেউ কেউ থাকেন, যাঁরা ফোনটি না ধরা পর্যন্ত করতেই থাকেন- একবার, দুবার, তিনবার। ওদিকে ফোন চিৎকার করে এদিকে আমি, ‘ওরে আমার বরটাকে ইয়েটা করতে দে বাপ।’ কতবার হয়েছে দাঁত মাজতে মাজতেও ফোন ধরেছে শৌভিক। এমনকি কুলি থুড়ি কুলকুচি করতে করতেও। বিগত বছর দেড়েকে আমাদের দাম্পত্য আলাপ তথা কলহও হয়েছে অমনি, থেমে থেমে, পূর্ণচ্ছেদ, কমা, কোলন, সেমি কোলন ইত্যাদি দিয়ে। ওটা যে কাজেরই অঙ্গ, সেটা বুঝে, মেনে নিয়েছি আমরা। অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি আমরা। 


এর মধ্যে শুধু একদিনই ফোন সাইলেন্ট রেখেছিল শৌভিক, যেদিন প্রযুক্তি গত কি যেন গড়বড় হয় আর লক্ষ্মীর ভাণ্ডার সংক্রান্ত একটা মেসেজের সাথে সাথে ওর মোবাইল নম্বরটা পৌঁছে যায় তমলুক মহকুমার ঘরে ঘরে, মা লক্ষ্মী দের মুঠোয় রাখা মুঠি ফোনে। পরিণতি সহজেই অনুমেয়।  মিনিটে মিনিটে আছড়ে পড়তে থাকে, ৩০/৪০ খানা ফোন প্রবাহ। একটা ফোন ধরে, ছাড়ার আগেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছিল গুচ্ছ গুচ্ছ কল ওয়েটিং। সে এক রাত গেছে বটে। আক্ষরিক অর্থেই ছেড়ে দে মা (লক্ষ্মী), কেঁদে বাঁচি। 


তখন কি আর জানতাম যে বছর ঘোরার আগেই ঘটতে চলেছে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি । দিন তিন চার আগের কথা, কাক ডাকা ভোর থেকে বানের জলের মত আসতে শুরু করল ফোন। সেবার ফোনের ওপারে শুধু মা লক্ষ্মীরা ছিলেন, এবার অবশ্য কোন লিঙ্গবৈষম্য পরিলক্ষিত হল না। সবার একই প্রশ্ন, একই অনুরোধ " স্যার, অমুক প্রকল্পে নাম ওঠেনি। একটু আমার ব্যবস্থা করে দিন স্যার।"  যে প্রকল্পের জন্য ফোন,তা আদৌ মহকুমা শাসকের দপ্তর থেকে দেখা হয় না। প্রথম জনা পঞ্চাশকে সেটাই বলল শৌভিক। শান্ত ভাবে জানাল,কোন অফিসে যোগাযোগ করতে হবে। এমনকি এটা যে আপাতত কেবল পঞ্চায়েত এলাকায় হচ্ছে, পুরসভায় নয়,তাও বোঝালো কাউকে কাউকে। এই জেলা তথা মহকুমার লোকজন এমনিতে খুব বাধ্য,বললে অযথা তর্ক করে না। অবশ্য ব্যতিক্রম তো সর্বত্র বিদ্যমান। তেমনি এক ব্যক্তি বেশ বকেই দিলেন আমার বরটাকে। " আপনার অফিসে হবে না যখন, আপনার নম্বর দিয়েছেন কেন?"  


কোথায় নম্বর দিলাম রে বাবা,আকাশ থেকে পড়ে শৌভিক। ধীরে ধীরে ঝুলি থেকে বেরোন বাঘের মাসি। এক স্থানীয় সংবাদ পত্রের জনৈক সাংবাদিক মহাশয়, উক্ত প্রকল্পটি নিয়ে এক আগুনে প্রতিবন্ধ লিখেছেন। লিখতে লিখতে উদ্দীপনার বশে তিনি এই জেলার চার মহকুমা শাসকের ব্যক্তিগত নম্বরগুলিও টুকে দিয়েছেন। বিশদ জানতে ফোন করুন বা নালিশ জানান- এই ধরণের কোন শিরোণামে। 


পত্রিকাটি যেহেতু কাঁথিতেই প্রকাশিত হয়, স্থানীয় লোকজনই কেবল পড়েন ফলে নম্বরটা হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়েছে আগুনের মত। পরিণতি অনুমেয়।আপদে বিপদে মানুষ অবশ্যই ফোন করবে, করেও, কিন্তু তাই বলে ওটা যে আদৌ কোন প্রকল্পের হেল্পলাইন নম্বর নয়, ওই সংক্রান্ত রিপোর্টে করো নম্বর ছাপতে হলে অন্তত তার মৌখিক অনুমতি টুকু নেওয়া দরকার, তথাকথিত সাংবাদিকদের থেকে এইটুকু নৈতিকতা কাঙ্ক্ষিত বটে, কে আর তার মর্যাদা দেয়। ভাগ্যে জনগণের স্মৃতিশক্তি  অত্যন্ত দুর্বল, আজকের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলি গুণোত্তর প্রগতিতে হারাতে থাকে তাদের তাৎপর্য, সেটাই আপাতত আমাদের ভরসা।

Thursday 15 December 2022

তুত্তুরী উবাচ ১৫ই ডিসেম্বর, ২০২২

 


👩🏻- বাবু ওঠ। সোয়া ছটা বাজছে। স্কুল যেতে হবে। 

👧🏻- (দু হাত জড়ো করে ছলছল চোখে) মা প্লিজ মা, আজ স্কুল যাব না। সারা রাত কানের ব্যথায় ঘুমাতে পারিনি। 

👩🏻- (উদ্বিগ্ন স্বরে) সে কি! আবার? ঠিক আছে, স্কুল যেতে হবে না, শুয়ে পড়। (মেয়ের গায়ে কম্বল চাপা দিতে দিতে, ছেলে ভোলানো স্বরে) বাবু জানিস তো, কাল আর্জেন্টিনা জিতেছে। 

👧🏻-(চোখের জল মুছে, মিনমিনে স্বরে) জানি। তিন-শূণ্যে। মড্রিচের জন্য আমার খুব মন খারাপ। 

👩🏻-(সন্দিগ্ধ স্বরে) তুই জানলি কি করে? খেলা তো রাত আড়াইটায় শেষ হয়েছে!

👧🏻-(ধরা পড়ে যাওয়া স্বরে) আসলে খুব কান ব্যথা করছিল তো, তাই মাসির ফোনটা নিয়ে দেখছিলাম চোখের ড্রপ কানে দেওয়া যায় কি না। গুগল বলল যায় না। (মাকে ভোলাতে, ছদ্ম উত্তেজনা দেখিয়ে) জানো মা, আর কি শিখলাম,  এমনকি নাকের ড্রপ ও কানে দেওয়া যায় না।

অনির ডাইরি ৯ই ডিসেম্বর, ২০২২

 


ভদ্রলোকের আজ জন্মদিন। যখন ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন, আক্ষরিক অর্থেই পৃথিবী কাঁপাচ্ছেন ওণার সমনামধারী জনৈক গুঁফো জার্মান সাহেব। অবিভক্ত ভারত। ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে আবেদন-নিবেদনের রাজনীতির উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে, সদ্য নতুন দল গঠন করেছে সুভাষ। ভারত ছাড়ো আন্দেলন থেকে নেতাজীর অন্তর্ধান, ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে থেকে দেশ ভাগ কিছুই তখনও লেখা হয়নি সময়ের খেরোর খাতায়। 


বিশ্বাসই হয় না, দেখতে দেখতে ৮৩টা বসন্ত পার করে ফেললেন ভদ্রলোক। সাক্ষী রইলেন কত না উত্থান-পতন, কুশীলব থেকে পট পরিবর্তনের। ভদ্রলোক নিজেও কম বর্ণময় চরিত্র নন। ওণাকে নিয়ে একটা-দুটো নয়, গল্প লেখা যায় ভুরি ভুরি। যেমন সপ্তম শ্রেণীর সেই দিনটা, স্কুলের বড় গেট থেকে বেরোনোর সাথে সাথে যেদিন আমাকে ছেঁকে ধরেছিল একদল সুহৃদ। সবার চোখে উৎকণ্ঠা, মুখে একটাই প্রশ্ন ‘ কি রে,কি হল?’ 


উদ্বিগ্ন হওয়াটাই স্বাভবিক, যা কেলো বাঁধিয়েছিলাম আমি। সেই সময় হাওড়া গার্লস কলেজে যারা BT পড়তেন, তাদের প্রাকটিক্যাল পড়ত আমাদের স্কুলে। সে এক দারুণ মজার ব্যাপার। রোজ, রোজ নতুন দিদিমণিরা আসতেন ক্লাস নিতে। কেউ বকতেন না, গল্প বলার ছলে সামান্য হাসি মস্করা মিশিয়ে পড়াতেন। সময় যে কোথা দিয়ে কেটে যেত। এই নবাগতা সুবেশা তরুণী শিক্ষিকাকুলের রীতিমত অনুরাগী হয়ে পড়তাম আমরা। 


কদাচিৎ আবার কেউ কেউ রাগী দিদিমণি সুলভ হাবভাবও দেখাতেন। ভাগ্যক্রমে তেমনি এক দিদিমণির সাথে সম্মুখ সমরে জড়িয়ে পড়েছিলাম আমি। ভূগোল পড়াতে এসে সামান্য ভুল তথ্য দিয়ে ফেলেছিলেন। হয়তো নার্ভাস হয়েই, কারণ ক্লাস চলাকালীনই চলত ওণাদের অ্যাসেসমেন্ট। ক্লাস রুমের পিছনের দরজা দিয়ে যখন তখন নিঃসাড়ে ঢুকে আসতেন ওণাদের শিক্ষক- শিক্ষিকারা। যদিও সেই সময় তেমন কেউ উপস্থিত ছিলেন না ক্লাসে। চিরকালের ডেঁপো আমি, দিদিমণির ভুল ধরতে পারার উত্তেজনা আর চাপতে না পেরে মুখ ফুটে বলেই বসলাম। সঙ্গত দিল আরো গুটি তিনেক সহপাঠী। 


ভুল স্বীকার করে নিলেই ল্যাটা চুকে যেত, অথবা আমাদের ধমকে বসিয়ে দিলেও ব্যাপারটা ওখানেই মিটে যেত। উনি সেসব কিছু না করে সটান নালিশ করে বসলেন ওণাদের হেডুর কাছে। তিনি আবার অনুযোগ জানালেন আমাদের বড়দির কাছে। সালিশি করতে পাঠানো হল বাংলার কমলকলিদি দিকে। উনি ক্লাস এসে হাই তুলে বললেন, ‘ এই BTর বিটি(বেটি)দের নিয়ে আর পারি না। কে কি বলেছিস বাবা, যা গিয়ে মার্জনা চেয়ে ধন্য কর।’ 


ছুটির ঘন্টা বাজার পর সেই মার্জনাই চাইতে গিয়েছিলাম চার ইয়ার মিলে, কমন রুমে।  অভিযোগকারিণী এতটাও বোধহয় আশা করেননি, ফলে মার্জনাভিক্ষা পর্ব তো বেশ নির্বিঘ্নেই সমাপন হল। বাইরে বেরিয়ে দেখি, ‘যেখানে বাঘের ভয়,সেখানেই’ ইয়ে , পিসির পরিবর্তে সেদিনই বাবা আনতে এসেছে। বাবার সামনেই বন্ধুদের ঐ প্রশ্নবাণ যে কি মারাত্মক আতঙ্ক জাগিয়েছিল, তা শুধু আমিই জানি। কোন মতে মাছি তাড়ানোর মত সবকটাকে কাটিয়ে বাবার হাত ধরে টানলাম, বাড়ি যাব। বড় রাস্তা পেরানো অবধি বাবা নীরবই ছিল, গলিতে ঢুকে ফস্ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে, এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে জানতে চাইল,‘স্কুলে এক্জাক্টলি কি করেছিলি?’ 


বিস্তর ঢোঁক গিলে, হেঁচে-কেশে, ‘ব্রহ্মা-বিষ্ণু-কালী’ ইত্যাদি তেত্রিশ কোটি দেবদেবীকে স্মরণ করে বলেই ফেললাম সবিস্তারে। ভেবেছিলাম খুব বকবে, বকা তাও ভালো,  গৃহত্যাগ না করে বসে। একবার মায়ের কথায় খার খেয়ে, বাবার নেশা ছাড়াতে এক প্যাকেট সিগারেট কুচিয়ে নষ্ট করেছিলাম, যার জন্য করেছিলাম তিনি তো ধমকে আমার গুষ্টি উদ্ধার করেছিলেন, বাবা কিছু বলেনি, কেবল গৃহত্যাগের হুমকি দিয়ে আরেক প্যাকেট সিগারেট কিনতে বেরিয়ে গিয়েছিল। যখন ফিরেছিল, ততোক্ষণে কেঁদে গোটা বাড়ি মাথায় তুলেছি আমি। সেই থেকে বৃদ্ধের গৃহত্যাগের হুমকিকে বড় ভয় আমার। সেবার অপরাধ লঘু ছিল, ফিরে এসেছিল। এবার যে কি হবে। 


আমার যাবতীয় শঙ্কাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিল বাবা। হো হো করে হেসে উঠে বলল, ‘বেশ করেছিস। স্কুল - কলেজে অমন আমিও অনেক করিছি, বুঝলি-। শুনবি নাকি সে সব গল্প?’। 


ভদ্রলোক অমনিই। বেশ খানিকটা খামখেয়ালি, আর অনেকটা, ‘সৃষ্টিছাড়া-নিয়মহারা-হিসাবহীন।’ তা নাহলে কেউ কিশোরী কন্যার হাতে জ্বলন্ত সিগারেট ধরিয়ে বলে,‘টেনেই দেখ না, কেমন খেতে-’। দোষের মধ্যে আমি জানতে চেয়েছিলাম, যে সিগারেট খাওয়া নিয়ে নিত্য অশান্তি হয় এ বাড়িতে, সেটা খেতে কেমন? নির্ঘাত খুব সুস্বাদু। অতঃপর যা হয় আর কি, বাবাকে নকল করে ধোঁয়া টানা এবং প্রবল কাশি। কাশির দমক থামলে,মায়ের উদোম খিস্তির ঝড় শান্ত হলে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,‘এটা কেন করলে?’ ফিচেল হেসে লোকটা বলেছিল,‘আমার মেয়ে, বড় হয়ে তো ফুঁকবিই। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে গোল্লায় যাস না। খেতে ইচ্ছে হলে আমার থেকে চেয়ে খাস।’ 


বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে প্রথম ইয়ে খেয়েছিলাম যেদিন,সেদিনও একই কথা বলেছিল বাবা। তখন সদ্য চাকরী পেয়েছি। মনের মত চাকরী। খড়্গপুরে পোস্টিং। দীর্ঘ ট্রেন যাতায়াতের পথে গড়ে ওঠা কিছু বন্ধুর সাথে ছুটির পর, খড়্গপুর স্টেশনের কাছে এক পার্কে বসে, আক্ষরিক অর্থেই এক ছিপি করে খাওয়া আর কি। ডাক্তার কাকুর হোমিওপ্যাথি ওষুধের মত খেতে লেগেছিল মাইরি। তাও কি ভয়। এতটা রাস্তা একা ফিরব, বাকিরা নেমে যাবে মেচেদা থেকে দেউলটির মধ্যে। নবু পইপই করে সাবধান করে দিল,‘ আজ অন্তত হ্যাংলার মত ট্রেনে গজা বা পান্তুয়া উঠলে খাস না। পারলে জানলার ধারেও বসিস না। খোলা হাওয়ায় নেশা বাড়ে-।’ নেশা -টেশা কিছুই বুঝলাম না। দিব্য দাশনগর স্টেশনে নেমে,রিক্সাওয়ালার সাথে ব্যাপক দরাদরি করে গলির মুখে নামলাম। নবু বলেই দিয়েছিল, বাড়িতে ঢোকার আগে একটা পান খেতে। গন্ধ চাপার জন্য। পানের দোকানে গিয়ে দেখি, বাবাও এসেছে সিগারেট কিনতে। আমার বাড়ি ফেরার সময়, প্রায়ই কিছু না কিছু কেনার অছিলায় গলির মুখে চলে আসত বাবা। মিষ্টি পান আমি বরাবরি ভালোবাসি, তাতেও কোন অস্বাভাবিকতা নেই। পান কিনলাম, বাবা পয়সা দিল। পান গালে পুরে, সারাদিনের গল্প বলতে বলতে ফুরফুরে মনে বাড়ি ফিরছি, বাবা হঠাৎ বলল,‘পয়সা দিয়েছিলি?’ এ্যাঁ! কি? খেই হারিয়ে জানতে চাই আমি। দুই আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট ধরে, বাতাসে স্বভাবসিদ্ধ আঁকিবুকি কাটতে কাটতে বাবা বলল ,‘ জীবনে আর যাই করিস, পরের পয়সায় নেশাটা করিস না। আর যদি খেতেই হয়, কি ব্রাণ্ড তোর বন্ধুরা খায়, জেনে বলিস, আমি কিনে এনে দেব। এতটা রাস্তা একা আসিস, পথে কি বিপদ আপদ হয়, তার থেকে বাড়িতে বসেই না হয়-’। 


একই কথা বলেছিল বাবা, যেদিন আমি কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে অশান্তি করেছিলাম, আমার সব বন্ধুরা ইয়ে সিনেমা দেখে ফেলেছে, আমি কেন দেখিনি। রীতিমত হ্যাটা দেয় সবাই। ' গুড গার্ল ', ' আব্দেরে আলুভাতে ' বলে খেপায় সবাই। তখনও ইন্টারনেট আসেনি, লাল-নীল ছবির জন্য সিডিই ভরসা। মা তো গালি দিয়ে ভূত ভাগিয়ে দিয়েছিল, মুড়ো খ্যাংরা যে জোটেনি কপালে এই ঢের। আর বাবা বলেছিল, ‘দুয়েকটা সিনেমার নাম জেনে আসিস, আমি পার্লার থেকে সিডি এনে দেব, বাড়িতে বসে দেখে নিস।’ 


বাবা অমনিই, ঘোরতর বাস্তব হয়েও কেমন যেন ইচ্ছে পূরণের স্বপ্ন। শুভ জন্মদিন বাবা। খুব ভালো থাকো,সুস্থ থাকো। যেমনি আছো, তেমনি থাকো। Love you to the moon and back.

Sunday 4 December 2022

শৌভিক বাণী


শৌভিক বাণী ২৯শে ডিসেম্বর,২০২২


👨🏻- (রিলস্ দেখতে দেখতে, এক গাল হাসি নিয়ে) একটা ছেলেকে ভিডিও তুলতে বলেছে, ছেলেটা ক্যামেরাটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়েছে। 

👩🏻-(গেম থেকে মুখ তুলে) ওটা ২৫ বছর ধরে বাজারে চলছে। তুই আজ দেখলি। 

( অতঃপর কফির কাপে চুমুক দিতে গিয়ে) এ ম্যা গো! আমার কফিতে একটা পোকা পড়ে বসে আছে। 

👨🏻- (তির্যক স্বরে) তা পোকাটার কি দোষ? কফিটা এত ক্ষণ ধরে ফেলে রেখে দিয়েছিস ও ভেবেছে ওটা বোধহয় সুইমিং পুল। তাই গরম জলে সাঁতার কাটতে নেমেছে। 

👩🏻- 🫤

শৌভিক বাণী ২৭শে ডিসেম্বর,২০২২


👨🏻- পৌঁছতে এখন তিন ঘন্টা।  ঘুমিয়ে পড়। 

👩🏻-(হাই চেপে) আমার গাড়িতে ঘুম আসে না। 

👨🏻- একা থাকলে আমি তো দারুণ ঘুমাই। 

👩🏻-(সন্দিগ্ধ স্বরে) দোকায় কি প্রবলেম?

👨🏻-(দীর্ঘশ্বাস ফেলে) প্রবলেমটা সঙ্গে থাকে তো। 

👩🏻-😡

শৌভিক বাণী ১৮ই ডিসেম্বর, ২০২২


👨🏻-(খেলা শুরুর আগে, বিজ্ঞ স্বরে) দীনু কাকুকে বললাম, আজ ফ্রান্স জিতলে আমি খুব খুশি হব। 

👩🏻-সে কি? তুই তো চিরকালীন আর্জেন্টিনার সমর্থক রে। 

👨🏻-( উদ্দীপ্ত স্বরে) হ্যাঁ, কিন্তু ফ্রান্স হল বিপ্লবের আঁতুড় ঘর। উদার দেশ। বর্ণ বিদ্বেষ নেই। অনর্থক ইমিগ্রেশনের ঝামেলা নেই। কড়া বিধিনিষেধ নেই। কত জন কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় আছে দেখছিস না। যুদ্ধটুদ্ধও তেমন পারে না-----_-। 


(খেলা শুরু হতেই) গোওওওওওল। 

👩🏻- আর্জেন্টিনা গোল করল তো। তো তুই খুশি হচ্ছিস কেন?

👨🏻-(বিরক্ত হয়ে)হব না?

👩🏻- তবে যে দীনু খুড়োকে পট্টি পড়ালি, যে ফাইনালে তুই ফ্রান্সকে সমর্থন করবি। 

👨🏻-( চোখ পাকিয়ে, দাঁত কিড়মিড় করে) মোটেও আমি তাই বলিনি। বলেছি ফ্রান্স জিতলেও এএএএ মানে ঠিইইইক আছেএএ।  

👩🏻- 🐻😡

শৌভিক বাণী, ৪ঠা ডিসেম্বর,২০২২

👨🏻- এত পড়ার চাপ দিচ্ছিস কেন(তুত্তুরীকে)?

👩🏻- চেপে পড়তে না বসালে, ও জীবনে পড়তে বসবে? পরীক্ষায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফেল করবে যে। 

👨🏻- বসে বসেই ফেল করুক না। কি যায় আসে। 

👩🏻- 😡

 


শৌভিক বাণী ৯ই মে, ২০২২

👩🏻-আঁকশি কাকে বলে জানিস?

👨🏻-হুঁ যেটা দিয়ে আম পাড়া হয় তো?

👩🏻- হ্যাঁ। একটা লম্বা লাঠির ডগায়, আরেকটা ছোট লাটি ভি এর মত করে-

👨🏻-(মাঝপথে বিরক্ত হয়ে) জানি রে বাবা। 

👩🏻-(বিড়বিড় করে) না মানে বাঙালরা আবার আঁকসিকে ঠিক কি বলে, তা তো জানি না। তাই ভাবলাম 

👨🏻-(অত্যন্ত শীতল স্বরে) জানতাম না তো। শ্বশুর মশাইয়ের কাছে শেখা। সেই যে সেবার ওণার সাথে কামচাটকা গিয়েছিলাম, কৃষক বিদ্রোহ সংগঠিত করতে। 

👩🏻-( হাসি চেপে) কামচাটকায় কৃষক বিদ্রোহ-

👨🏻-হয়েছিল তো। আমার শ্বশুর মশাই সংগঠিত করেন। সেখানেই একজন কৃষক একটা আঁকসি নিয়ে এসেছিল অস্ত্র হিসেবে। শ্বশুরমশাই বোঝালেন,এটা শুধু অস্ত্র হিসেবেই ব্যবহার করা যায় না, এটা দিয়ে ফলও পাড়া যায়। এটা দিয়ে তোমরা আম আর খেজুর পেড়ে খেও। তারপরই তো ফল পাড়তে আঁকসির ব্যবহার শুরু হল। তার আগে তো ওটা দিয়ে চাষ করা হত। 

👩🏻- (হাসির দমকে, বিষম খেয়ে) সিরিয়াসলি, বিয়ের পর এত বছর হয়ে গেল, এবার আমার বুড়ো বাপটাকে একটু ছাড়। তোর শ্বশুর নিয়ে অবসেশনটা দিন দিন মাত্রা ছাড়া হয়ে যাচ্ছে মাইরি।


 শৌভিক বাণী ১১ই অক্টোবর, ২০২১

"We enjoy as a family, we suffer as a family."

শৌভিক বাণী- ২৫শে জুলাই, ২০২১

‘পরীক্ষা বছরে চারটে করে হয়, আর অলিম্পিক  চার বছরে একবার। ওকে(শ্রীমতী তুত্তুরী) শান্তিতে অলিম্পিক  দেখতে দে। অত পড়াশোনা করার দরকার নেই।’

অতঃপর আহ্লাদী কন্যাকে আর পায় কে?😡


শৌভিক বাণী- ৭ই ফেব্রুয়ারি ২০২১

"বিয়রকে বলা হয়, সফ্ট ড্রিংক ফর অ্যাডাল্টস্। এই ব্রীজার ব্যাপারটা নির্ঘাত বিয়র ফর কিডস।"

শৌভিক বাণী- ৫ই এপ্রিল ২০২০

“করোণা মাই কি জয়। আসছে বছর আবার হবে। ” 


শৌভিক বাণী ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

“এবার মুখর করে দাও হে তোমার নীরব মোদী’রে”- শৌভিক বাণী অদ্য প্রাতে-




‘পরীক্ষা বছরে চারটে করে হয়, আর অলিম্পিক চার বছরে একবার। ওকে(শ্রীমতী তুত্তুরী) শান্তিতে অলিম্পিক দেখতে দে। অত পড়াশোনা করার দরকার নেই।’




অতঃপর আহ্লাদী কন্যাকে আর পায় কে?😡


তুত্তুরী উবাচ ১লা ডিসেম্বর, ২০২২

 


👩🏻- দুধের কাপ নিয়ে আর কতক্ষণ বসে থাকবি বাবু? পড়তে বসবি কটায়? রাত নটায়?

👧🏻- (ফোঁস দীর্ঘশ্বাস ফেলে, হতাশ হয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে) এই জন্যই বলেছিলাম। আমি অনেক আগেই বুঝেছিলাম ব্যাপারটা। তুমিই মানতে চাও না। 

👩🏻-(ঘাবড়ে গিয়ে) কি?

👧🏻- আরে অলিম্পিক-ওয়ার্ল্ড কাপ চার বছরে একবার আসে, আর পরীক্ষা বছরে চার বার। কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ তুমিই বলো।

Sunday 27 November 2022

অনির ডাইরি (তমলুক ছেড়ে কাঁথির পথে)

 

 

অনির ডাইরি ৯ই নভেম্বর, ২০২২

(পর্ব - ১)

এই তো সেদিন বদলি হয়ে এল শৌভিক। সোহাগী ফোনটা প্রথম করেছিল এষা। বাড়িতে সেদিন একাই ছিল শৌভিক। তুত্তুরীকে নিয়ে হাওড়া গিয়েছিলাম আমি। 


আমাদের এই ছুটকো-ছাটকা ঝটিকা সফর গুলো ভীষণ ভাবে উপভোগ করে শৌভিক। আমরা না থাকা মানেই নাকি অখণ্ড নির্জনতা, অপার শান্তি আর স্বাধীনতা। এই দিনগুলোয় নিজের হাতেই টুকটাক রান্না করে শৌভিক। সেদিনও তেমনি নৈশভোজের জন্য ম্যাগি আর ডিম সিদ্ধ বসাতে গিয়েছিল। এষার উচ্ছ্বাসের ধাক্কায় হাত থেকে ধড়াম করে প্যানটাই পড়ে গিয়েছিল মাটিতে। আর শৌভিক পড়েছিল রীতিমত আকাশ থেকে। 


বিস্মিত শৌভিকের ন্যাতানো প্রতিক্রিয়ায় চটে গিয়েছিল এষা। ‘ধুৎ দাদা, তুমি সত্যিই জানতে না। অর্ডার দেখোনি?’ এষার ফোনের মাঝেই ঝড়ের মত আসতে শুরু করেছিল শুভেচ্ছা বার্তা এবং শুভকামনামূলক ফোন। সমস্ত কিছু থেকে অনেক দূরে, আমি তখন গলা ফাটাচ্ছি বাবার বৈঠকখানায় চাটুজ্জেদের সান্ধ্যকালীন আড্ডায়। জম্পেশ করে মুড়ি মেখেছিল মা, মুড়ি শেষে চা চাপিয়েছি এমন সময় বরের ফোন। 


শৌভিকের প্রথম সম্ভাষণ আজও আমার কানে ভাসছে। ‘ কপাল পুড়েছে’।  খোলসা করে আর বলতে হয়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমার ইনট্যুশন বেশ ধারালো। বেশ কিছুদিন ধরে এমনিই মনে হচ্ছিল, বলছিলামও বার বার,‘তুই বাপু বাঁচবি না। তোর কপালে এসডিও গিরি নাচছে।’ তবে সেটা যে এইভাবে সত্যি হয়ে যাবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। ঐ জন্যই ঠাকুমা বলত, কথা ক্ষণে পড়ে। মুখ খোলার সময় বুঝেশুনে বলতে হয়, কখন কি ঘটে যায়, কিচ্ছু বলা যায় না। 


৯ই জুলাই শুক্রবার জয়েন করতে গেল শৌভিক। একসাথেই বেরোলাম দোঁহে, যে যার আপিসের উদ্দেশ্যে। শৌভিকের ড্রাইভার, সিকিউরিটি উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিল নতুন সাহেবের জন্য। উর্দি পরা, কোমরে বন্দুক গোঁজা নিরাপত্তা রক্ষী তড়িঘড়ি এগিয়ে এসে শৌভিকের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিল। দরজা খুলে ধরল, ভ্যানিলা আইসক্রিম রঙা মস্ত জাইলো গাড়িটার। গাড়িতে যখন উঠে বসল শৌভিক, প্রবল গর্বের সঙ্গে সঙ্গে কেন যে টনটনিয়ে উঠছিল হৃদয় আর এত করকর করছিল দুটো চোখ। এবার তাহলে সত্যিই আলাদা হবার পালা, ভাবলেই ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। 


মার্চ মাস নাগাদ বিধাননগরে বদলির অর্ডার হয়েছিল আমার। মুভমেন্ট অর্ডার অর্থাৎ কবে কাকে চার্জ দিয়ে যাব সেই সংক্রান্ত অর্ডারের জন্য  দিন গুণছিলাম আমি। সেদিন মনে হল পলকে উল্টোপাল্টা হয়ে গেল চেনা অঙ্কটা। 


মহানগরের সদর দপ্তরে যেদিন সনির্বন্ধ অনরোধের ডালি নিয়ে গিয়ে হাজির হলাম, উর্ধ্বতন কতৃপক্ষ অত্যন্ত সহমর্মিতার সঙ্গেই জানতে চাইল কেন? তুত্তুরীর কি হবে? সোজা জবাব, স্কুল বদল হবে তুত্তুরীর। তারপর? যখন বদলি হয়ে যাবে যে কোন একজন তখন কি করবে? আবার স্কুল পাল্টাবে কি? স্নেহশীল দাদা,দিদি,বন্ধুরা বলল, হঠকারিতা নয়, একটু ভেবে সিদ্ধান্ত নাও। ও আসবে না হয় সপ্তাহান্তে,তোমরাও যাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে।


 মুস্কিল হল ব্যাপারটা ভাবতে যতটা সোজা,বাস্তব রূপায়ন ততোটাই জটিল। যাবতীয় ঝঞ্ঝাট- ঝামেলা, ঝড়- বৃষ্টি- তুফান দেখতাম বেছে বেছে সপ্তাহান্তেই এসে হাজির হত। আর ঐ ভাবে প্রতি সপ্তাহে তুত্তুরীর মাসিকে বাড়ি পাঠিয়ে, বাসন মাজার দিদিকে নিষেধ করে সব বন্ধ করে, তাল-ছন্দ মিলিয়ে আমাদের আসা যাওয়াটাও মোটেই সহজ ছিল না। অনেকেই করেন, বেশির ভাগ এমনি অফিসারদের সুগৃহিনীরাই তাই করেন। কিন্তু আমি যে মোটেই অত ভালো গিন্নি নই। অবুঝ হৃদয় যে কথাই শোনে না। পশ্চিম মেদিনীপুর ছেড়ে পুরুলিয়া গিয়েছিল যখন সুকন্যা, কি খিল্লিই না করেছিলাম আমি। বরকে ছেড়ে থাকতে পারে না বলে রীতিমত আওয়াজ দিতাম বেশ কিছুদিন।  অথচ যখন একই পরীক্ষায় বসতে হল আমায়, সু এর থেকেও খারাপ ফল করলাম আমি। একটা লোকের অনুপস্থিতিতে রাতারাতি যে কি বিবর্ণ, বিশ্রী হয়ে গিয়েছিল কল্লোলিনী তিলোত্তমা। 


২৭শে অক্টোবর যখন শেষ পর্যন্ত বদলির অর্ডারটা বেরোল, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর দিন,মেয়ে আর মেয়ের মাসীকে বগলদাবা করে, এতদিনের সংসার, সাধের গাছপালা ফেলে নির্দয়ের মত চলে এলাম পূব মেদিনীপুর। চারটে দেওয়াল আর একটা ছাতে বাড়ি হয় থোড়াই, বাড়ি বা সংসার গড়তে লাগে প্রিয়জন সাহচর্য। ব্যাপারটা বেশ ন্যাকা শোনালেও আমার মত অপদার্থ অলবড্ডেদের জন্য নির্মম সত্যি।


 নতুন করে গড়ে তুললাম আমরা আমাদের, ' লাল- নীল সংসার'। মহকুমা শাসকের মহা ফাঁকিবাজ ডেজিগনেটেড রাঁধুনীকে হাত ধরে রান্না শেখালাম তুত্তুরীর মাসি আর আমি। কি যে ভয়ানক রান্না করতেন তিনি। সব ডাল, সব তরকারি,সব মাছে যে কি করে একই স্বাদ আর গন্ধ আনতেন ভগবানই জানেন। 


প্রথম প্রথম ফেলে আসা, তালা বন্ধ বাড়িটার জন্য কাঁদত তুত্তুরী। মন খারাপ করত,ফেলে আসা স্কুল আর বন্ধুদের জন্য। ধীরে ধীরে ভালো লেগে গেল নিমতৌড়ির এই নিরালা প্রান্তর। বিরাট বিরাট কাঁচের জানলা, সক্কাল সক্কাল মোটা পর্দার ফাঁক গলে জবরদস্তি ঢুকে আসেন দিনমণি। আর আসে পাখির ঝাঁক। জানলার পর্দা সরালেই ঝাঁক বেঁধে উড়ে যায় মোটকু ধুসর বলের মত ছাতারে পাখিদের গুষ্টি। বারন্দার রেলিংএ, কাপড় শুকাতে দেবার তারে বসে নেচেই যায় মস্ত ল্যাজ ওয়ালা ঘোর কৃষ্ণাঙ্গী, চেরা ন্যাজ ফিঙে সুন্দরীদের দল। বাগানের ঘাসে নাক উঁচিয়ে চরে বেড়ায় ধপধপে সাদা বকের দল। গেটের বাইরের নারকেল গাছে বাসা বাঁধে গোলগোল চোখওয়ালা এক গুরুগম্ভীর প্যাঁচা। বৃষ্টি নামলে ডানা দিয়ে কি সুন্দর মাথা ঢেকে রাখে, দেখে তাজ্জব হয়ে যায় তুত্তুরী।  


বাংলোর সিকিউরিটি ছেলেগুলো কবে যেন কাকু হয়ে যায় তুত্তুরীর। রান্না করা, বাসন মাজা আর বাগানে কাজ করতে আসা দিদিরা হয়ে যায় মাসি।এমনকি তাদের ছেলেমেয়েদের সাথেও গভীর দোস্তি হয়ে যায় তুত্তুরীর। একসাথে হৈচৈ করে সরস্বতী পুজো হয় বাংলোয়। পুঁচকে গুলো সম্মিলিত ভাবে সাজায় মহকুমা শাসকের সরকারি নিবাসটাকে। পাকা হাতে নিপুণ, নিখুঁত আল্পনা দেয় সিকিউরিটি অমিত। অঞ্জলির দেবার সে কি লাইন আর ধুম সেদিন। 


ওদের থেকেই ধার করে সাইকেল চালাতে শেখে তুত্তুরী কিছুটা। অবসরে হরেক রকম গাছ চেনে তুত্তুরী। শাক চেনে। ফুল চেনে। পাখি চেনে কত যে। এছাড়াও সাপ চিনেছে বেশ কয়েকরকম, ব্যাঙ আর পোকার গুষ্টি চিনেছে এই তমলুকে এসেই না। 


       ব্যাঙ আর পোকা নিয়ে কত যে মজার মজার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে তুত্তুরী এখানে এসে। সেই যে সেদিন সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়ে ঢিল ভেবে একটা গাব্দা ব্যাঙের গায়ে শট্ মেরেছিলাম আমি, তাতে ব্যাঙটা বেপোট রেগে কটমট করে খানিকক্ষণ নাকি আমার দিকে তাকিয়েছিল। সেই প্রখর দৃষ্টির সামনে ভয়ে নাকি রীতিমত কুঁকড়ে গিয়েছিল তুত্তুরীর মারকুটে জননী। বেশ খানিক্ষণ তাকিয়ে থেকে, প্রবল ঘ্যাম নিয়ে, নাক উঁচু করে  থপথপ্ করতে করতে চলে গিয়েছিল ব্যাঙটা।  আজও সে গল্প করতে গিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ে তুত্তুরী। আর সেই যে সেবার, বাগানের দরজা বন্ধ হচ্ছে না দেখে প্রবল টানাটানি করেছিলাম আমি। ফলে দরজার ফাঁকে আটকে থাকা ব্যাঙটা জিভ বার করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ধড়াম করে। সেই দেখে কাঁদতে কাঁদতে নাকি  বিকট হট্টগোল জুড়ি আমি।  'কেন বাড়িতে চশমা পরি না গোওওও।' 'আমার জন্য ব্যাঙটা বেঘোরে মরে গেল গোওওও।' সেই দেখে শৌভিক কি ভাবে পেটে হাত দিয়ে অট্টহাস্য করতে করতে উল্টে পড়েই যাচ্ছিল,  হুবহু দেখিয়ে দেয় তুত্তুরী। 


দিন যায়, এপ্রিল মাসে নতুন স্কুলে ভর্তি হয় তুত্তুরী। প্রথম দিন কি যে বিকট ভয় বুকে চেপে স্কুলে গিয়েছিল মেয়েটা আমার। সব ভয় অমূলক প্রমাণ করে, কেউ bully করে না তুত্তুরীকে, কেউ উত্যক্ত বা বিরক্ত করে না। বরং খুব ভালো ভাবেই মিশেছিল সবাই। জনৈকা বান্ধবী শুধু দু একবার বলেছিল, ‘ঐ ব্যবসাটার নাম জানিস? ওটা কার জানিস? আমার দাদুর। আমরা কত বড়লোক জানিস? ফরেন ট্যুর করি আমরা। তুই কখনও বিদেশে গেছিস? যাসনি? বেড়াতে তো যাস বাকি? কোথায় যাস? মধ্য প্রদেশ? ওখানে দেখার কি আছে?  এই শীতে সুইজারল্যান্ড যাব আমরা।জানিস স্পেনে গিয়ে আমার বাবা স্প্যানিশ লিকর খেয়েছিল। তোর বাবা মদটদ খায়? খেতে বলবি। ক্ল্যাসি লাগবে।’ বাড়ি ফিরে হাসতে হাসতে বিষম খেয়েছিল তুত্তুরী। আজও বাড়িতে কোন পরিচিত অতিথি এলে, সর্বাগ্রে সেই গল্প শোনায় তুত্তুরী। 


মে মাসে প্রথম প্রাইভেট টিউটর রাখা হল তুত্তুরীর। নতুন ম্যাম এলেন, বেজায় ডিগ্রি ধারী। কিন্তু বয়সে ছুকরি। শৌভিক এবং আমি যগপৎ বলেও দিলাম, এসডিওর বাচ্ছা বলে আলাদা খাতির করার কোন দরকার নেই। প্রয়োজনে এমনকি অপ্রয়োজনেও হাত খুলে প্যাঁ- ইয়ে ঠ্যাঙাবেন। তুত্তুরীকেও বলা হল ম্যাম ব্ল্যাক বেল্ট ,সেটা যে সর্বৈব মিথ্যে বুঝতে তুত্তুরীর লেগেছিল দুটো দিন মাত্র। তারপর এমন দোস্তি হল দুজনের, যে উভয়ের হাহা-হিহি-হোহোর ঠ্যালায় বাংলো ভেঙে পড়ার খাপ। কে যে পড়ায় আর কে যে পড়ে বোঝা দায়। পড়াতে আসার সময় বাড়ি থেকে কুমড়ো ফুল, টাটকা শাক, গাছের পেয়ারা, তালের বড়া নিয়ে আসে দিদিমনি। যোগাড় করে আনেন পিরিয়ডিক টেবিলের ছক।  


বেশ জমিয়ে বসেছিলাম আমরা,  ভুলতেই বসেছিলাম আমরা ভূমিপুত্র বা কন্যা নই, আমরা হলাম পরিযায়ী পাখি। আজ এখানে, কাল না জানে কোথায়। আমাদের শিকড় ছড়াতে নেই। গত পরশু সন্ধ্যেয় যখন পুনরাবর্তিত হল ইতিহাস, ঠিক পৌনে সাতটা নাগাদ এসে হাজির হওয়া অর্ডার কড়া নেড়ে জানাল, বদলি হয়ে গেছে শৌভিক, ক্ষণিকের জন্য যেন বজ্রাহত হলাম আমরা। সেই একই রকম ভাবে আসতে লাগল শুভেচ্ছা বার্তা আর শুভকামনায় মোড়া ফোনগুলো। লাফাতে লাফাতে সোহাগী ফোন করল এষা, 'কি গো, তোমরা তো এবার রোজ দীঘা যাবে?' সেই একই রকম ন্যাতানো জবাব দিলাম আমরা। ঠিক একই রকম যুগপৎ হতাশ এবং ক্রুদ্ধ হল এষা। 


তিনজনেরই কমবেশি মনখারাপ,তবে তারই মধ্যে শ্রীমতী তুত্তুরীর মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না দোঁহে। ‘আমাদের সত্যিই তমলুক ছেড়ে চলে যেতে হবে বাবা? আমি তো একটা সেশনও শেষ করতে পারলাম না মা? নতুন ব্লেজারটা পরতেও পারলাম না। আমার সাইন্স এক্সিবিশন এর কি হবে মা? স্কুল ম্যাগাজিনে আমার লেখাটা ছাপা হল কি না, সেটাও তো জানতে পারব না বাবা। ইত্যাদি, প্রভৃতি। ’ ভ্যাবাচাকা খেয়ে, বারবার বলেই যাচ্ছিল তুত্তুরী। সান্ত্বনা দেব কি, আমার নিজেরই বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে। পাততাড়ি গোটানোর সময় সমাগত।  


 সরকারি চাকরির এই তো বিড়ম্বনা। মাতৃসুলভ কাতরতার সাথে শৌভিককে বলতে গিয়ে বেজায় ঝাড় খেলাম। ‘স্কুল পাল্টালে কিছু খারাপ হয় না। নজির তোর সামনেই আছে।’ সত্যিই তো, শ্বশুরমশাইয়ের চাকরির দৌলতে বহুবার এমন স্কুল পাল্টেছে শৌভিক। আর প্রতিবারেই মিড সেসনে। খারাপ তো কিছু মানুষ হয়নি বাপু। এটাও কিছু হয়েই যাবে নির্ঘাত। ‘আর না হলেই বা কি’ মেয়ের পিঠে হাত রেখে পাশ থেকে বলে শৌভিক, ‘ গরু চরালেই বা কার কি। শ্বশুরটা তো বলেইছে যে দুটো গরু কিনে দেবে। তাই চরাবে।' সবকথায় আমার বেচারী বাপকে না টানলে আমার বরের ঠিক পোষায় না।


ছদ্ম দাম্পত্য কলহে নিমজ্জিত হই আমরা, ঝুটো হাসি ঠাট্টা মশকরায় ডুবে যাই আমরা, মনখারাপী মনের ওপর পরে নিই নকল হাসির মুখোশ। সামলে নিই একে অপরকে। এই তো জীবন কালী দা। 


দেখতে দেখতে এসে পড়ে আজকের সন্ধ্যা। বিদায়বেলায় উপহার পাওয়া রাশি রাশি ফুলের সৌরভে মম করে ওঠে সরকারি নিবাসের চেনা বৈঠকখানা। জমে ওঠে উপহারের স্তুপ। মিষ্টির প্যাকেট। শৌভিক এর মোবাইল ভর্তি হয়ে যায় আবেগে মাখামাখি মেসেজে। সবকিছু যেন নীরবে, অথচ চিৎকার করে বলে, আর মাত্র কিছুটা সময়, তারপরই ছেড়ে যেতে হবে প্রিয় শহরটাকে।


 বিদায় সাধের তাম্রলিপ্ত নগরী, বড় ভালোবেসে ফেলেছিলাম তোমায়। খুব ভালো থেকো প্রিয় নগর আর তার অধিবাসীরা। অনেক অনেক সুখ স্মৃতি নিয়ে পরবর্তী গন্তব্যের দিকে চলেছি আমরা। সকলের জন্য রেখে গেলাম একরাশ শুভেচ্ছা আর শুভকামনা।

(চলবে)

 অনির ডাইরি ১৯ শে নভেম্বর, ২০২২

(পর্ব -২)

বেশ নরম, রেশমি একটা রোদ উঠেছে। বাতাসে হাল্কা হিমেল ভাব। তমলুকের থেকে এদিকে ঠাণ্ডাটা কেন জানি একটু বেশিই লাগে। কাঁথির মহকুমা শাসকের সরকারি নিবাসটা বেশ প্রাচীন। কথায় কথায় এরা বৃটিশ আমলের গল্প শোনায়। মহকুমা শাসকের বাংলো চেম্বারে টাঙানো বিশাল বিশাল দুটি বোর্ড জুড়ে, ১৯৪২ সাল থেকে পদাধিকারী  নানা রথী-মহারথীর নাম। সবার উপরে জ্বলজ্বল করছেন শ্রী এস সেন, আই সিএস। সময়কাল ১৮ই জুন, ১৯৪২ থেকে ২৩শে ডিসেম্বর,১৯৪৩। সত্যি মিথ্যে জানি না, জনশ্রুতি শুনি ইনিই সেই প্রবাদপ্রতিম সুকুমার সেন। স্বাধীন বাংলার প্রথম মুখ্যসচিব। ভারতের প্রথম নির্বাচন সংগঠিত হয় যাঁর তত্ত্বাবধানে। 


 তাঁর উত্তরসূরি শ্রী এম ভট্টাচার্য ছিলেন BCS, বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের অফিসার। বাংলা ভাগ হয়নি যে, পশ্চিমী তকমা লাগেনি আমাদের গায়ে। প্রথম IAS মহকুমা শাসক পায় কাঁথি ১৯৪৮ সালে। আর প্রথম WBCS (Exe) ঐ চেয়ারে বসেন ১৯৬১ সালে।   


চতুর্দিকে বাগান দিয়ে ঘেরা ছিমছাম একতলা বাংলো। বাগান মানে তমলুকের বাংলোর মত শৌখিন বাগান নয়, রীতিমত গা ছমছমে মহীরুহের সমাহার। ছতলা বাড়ির সমান লম্বা ইউক্যালিপটাস, নারকেল গাছ, আম গাছ, জাম গাছ, নিম, লিচু, তেঁতুল, শাল, জামরুল, বেল, কুল, পেয়ারা, সজনে ডাঁটা গাছ কি নেই সেই তালিকায়। এছাড়াও আছে দেবদারু আর ঝাউ গাছের সারি, দুখানা বিশাল কাজু বাদাম গাছ, তেজ পাতার গাছ,কারি পাতার গাছ, লবঙ্গ গাছ এমনকি দুটো শ্বেত চন্দনের গাছও। সামান্য খুঁটে দেখলাম, গন্ধ পেলাম না যদিও। 


এত গাছ থাকার জন্য পাখিদের আনাগোনা লেগেই থাকে। ভোর বেলা জানলা ঠকঠকায় কাঠঠোকরা, জানলার ফাঁক গলে ফুড়ুৎ করে ঢুকে আসে চড়াই দম্পতি। নিম গাছের কোটর থেকে মুখ বাড়ায় ডিমে তা দেওয়া মা টিয়া পাখি। বাগানে পেতে রাখা বেঞ্চে গিয়ে বসলে পায়ে সুড়সুড়ি দেয় হ্যাংলা কাঠবেড়ালির দল। আগের স্যার ম্যাডামরা নাকি বাসি রুটি, মুড়ি, বিস্কুট ইত্যাদি খেতে দিত। সেই লোভেই আমার কাছে এসেছিল, আমি যদিও কিছু না জেনে,  দলবেঁধে  পায়ে কামড়াতে এসেছে ভেবে ব্যাপক চিল্লিয়েছি। ফলশ্রুতিতে আপাতত হাতে বিস্কুট নিয়ে বসে আছি, আমাকে বয়কট করেছে কাঠবিড়ালির দল। তাদের জন্য ছড়ানো বিস্কুট খেয়ে যাচ্ছে একদল মোটু ছাতারে। 


সব মিলিয়ে ঝিম ধরানো পরিবেশ,নির্ভেজাল শান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দেয় বিগত দশদিনের উত্তেজিত স্নায়ুর ওপর। বড় উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনায় কেটেছে গত কয়েকটা দিন। সাত তারিখ সন্ধ্যেবেলায় যখন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত আছড়ে পড়েছিল অর্ডারটা, সাময়িক ভাবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম আমরা। মানছি বদলির চাকরী, অর্ডার বেরোলে যেতেই হবে, তাও একটু দম ফেলার সময় যদি পাওয়া যেত, বড় উপকার হত আর কি।


 আট তারিখটা গুরুনানকের জন্মদিন ছিল। কি যেন দপ্তরী কাজে মহানগরে আসার কথা শৌভিকের, মায়ের তুলে রাখা পেনশনটা ওর হাত দিয়েই পাঠিয়ে দিলাম। অজুহাত দিলাম সময় বড় কম,সংসার তুলে নিয়ে যেতে হবে, কত যে কাজ বাকি। আসল উদ্দেশ্য ছিল মায়ের একটু মনোবল বাড়ানো। মহানগর ছেড়ে আমাদের তমলুক চলে আসাটাই হজম হয়নি আমার মায়ের। ভুগতে শুরু করেছিল মানসিক অবসাদে। বিগত একবছর ধরে নিয়মিত বাড়ি যাওয়া আসা করে, প্রতিটি উৎসব অনুষ্ঠানে চাটুজ্জে বাড়ি গুলজার করে, কলকাতার মত তমলুকে বসে বাবার ইলেকট্রিক বিল, টাটা স্কাই, ফোন রিচার্জ করে, অনলাইন মাসকাবারি সওদা করে দিয়ে, পুজোর বাজার করে, সময়মত ডাক্তার দেখিয়ে এনে ইত্যাদি প্রভৃতিতে একটু মানসিক জোর পেয়েছিল মা। তাও পুরোপুরি ভয় মুক্তি হয়নি মায়ের, আমার স্কুলের বন্ধুদের পেলে আজও ডুকরে কেঁদে ওঠে, ‘পারলে আসিস। খোঁজখবর রাখিস। ও তো অনেক দূরে চলে গেছে’ ইত্যাদি, প্রভৃতি। আর এখন তো আরও একটু বেশি দূরে সরে যাবার পালা। ফোনের ওপারে মায়ের নীরব কাতর কণ্ঠ সোচ্চারে বলছিল, মোটেই ভালো ভাবে বদলির ব্যাপারটা নিতে পারেনি মা। ভাবছে আর হয়তো বাড়িই যেতে পারব না আমি/আমরা। এমতবস্থায় শৌভিকের পজিটিভ এনার্জি, ভালোবাসা মাখানো মিষ্টি ধমকের বড় দরকার ওদের।


 

নয় তারিখ, বুধবার চার্জ হ্যান্ডওভার করার পর গোছগাছে হাত দিলাম আমি।এই বাংলো এখন নতুন আধিকারিকের। তিনি যত উদারই হন না কেন, অনির্দিষ্ট কালের জন্য তাঁর সরকারি আবাস তো দখল করা যায় না। আর শৌভিকের পক্ষেও তমলুক থেকে কাঁথি নিত্য যাতায়াত করা বেশ চাপের। যত তাড়াতাড়ি পারা যায়, বোঁচকাবুঁচকি নিয়ে রওণা দিতে হবে নতুন বাসায়। শৌভিকের ইচ্ছে ছিল রবিবারের মধ্যেই পুরাণ বাসা ছেড়ে দেওয়া। বাধ সাধল তুত্তুরী। বাংলো ছাড়া মানে তো স্কুলও পরিত্যাগ করা। শিশু দিবসের আগে কিছুতেই পুরাণ স্কুল ছেড়ে যেতে রাজি হল না তুত্তুরী। 


তুত্তুরীর ভাষায়, কলকাতার স্কুলটা ছেড়ে আসতে তেমন দুঃখ হয়নি ওর। কারণ অতিমারির প্রকোপে দুবছর স্কুল বন্ধ ছিল, বন্ধুদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম বলতে ছিল হোয়াটস্অ্যাপ। তাও তো ছিল। শিক্ষককুলের সঙ্গে তো তাও ছিল না। কি যে অনলাইন ক্লাস হত, অর্ধেক দিন শুনতাম স্যারের ডেটা শেষ হয়ে গেছে। ম্যাম বলেছেন তোমরা পড়ে নাও ইত্যাদি প্রভৃতি। তাম্রলিপ্ত পাবলিক স্কুল, মফস্বলের সাদামাটা পুঁচকে স্কুল হতে পারে, কিন্তু আন্তরিকতা ছিল সীমাহীন। এখানে এসে যেমন ভালো বন্ধু পেয়েছিল তুত্তুরী, তার থেকেও ভালো পেয়েছিল শিক্ষক শিক্ষিকাদের। তাদের সাথে কত পরিকল্পনা করেছিল শিশুদিবস উদযাপনের, সে সব ফেলে কিছুতেই যাবে না তু্ত্তুরী।


 শৌভিকের বদলিতে আপাততঃ সবথেকে বেশি কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটাই, তার জন্য এইটুকু তো করতেই হবে। নতুন আধিকারিকের কাছে কটা দিন সময় চেয়ে নেয় শৌভিক। দীর্ঘদিনের পরিচিত, ভ্রাতৃপ্রতিম আধিকারিক এক গলা জিভ কেটে বলে,‘কি বলছ দাদা। তোমার যতদিন ইচ্ছে, থাকো না।’ 


বাংলো না ছাড়লেও পলাশকে ছেড়ে দেয় শৌভিক। মহকুমা শাসকের নিজস্ব গাড়ি চালায় পলাশ, এতদিন সকাল সকাল তুত্তুরীকে স্কুলে পৌঁছে দেবার কাজটা স্বেচ্ছায় নিজেই করত পলাশ। ফেরৎ আনার দায়িত্ব ছিল আমার আর উত্তমকুমারের। আমি ব্যস্ত থাকলে মাসি আর উত্তমকুমার যেত।যেদিন আমি আর উত্তমকুমার উভয়েই ব্যস্ত থাকতাম, সেদিন পলাশই আনতে যেত। বকবক করতে করতে গাড়ি চালাত পলাশ, তুত্তুরীকে শহর চেনাত। এতদিন পলাশের আবোলতাবোল বকবকানিতে রেগে যেত তুত্তুরী, বুধবার সন্ধ্যেয় যখন আনুষ্ঠানিক ভাবে পলাশকে ছেড়ে দেওয়া হল, তার জন্যই কেঁদে ভাসাল তুত্তুরী। নতুন আধিকারিক এবং পলাশ উভয়েই বলেছিল, আর তো তিনটে দিন স্কুল যাবে মেয়েটা, এই কটা দিন না হয় পলাশই দিয়ে আসুক। শৌভিক রাজি হয়নি। অধিকার ছাড়তেও তো জানতে হয়। 


আমরা ছাড়তে চাইলেও কমলি ছাড়ে কই। পুরাণ আপিসের লোকজন পলাশ, নবেন্দু আব্দার করে, ‘আমরা গিয়ে সব প্যাকিং করে দেব স্যার।’ ভাগিয়ে দেয় শৌভিক। প্যাকিং করার মত আছেটাই বা কি? কটা তো জামাকাপড় আর বইখাতা। ও আমি দিব্য পেরে যাব। শুধু কটা প্যাকিং বক্স লাগবে। লোকজন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এসে দিয়ে যায় কার্ডবোর্ডের বাক্স, নারকেল দড়ি, টেপ। খোঁজ নিয়ে যায় বারবার, আর কিছু লাগবে কি? আর কোন সহায়তা লাগবে কি? লাগবে না বললে অখুশি হয়, দুঃখ পায়,তাও বেশ বুঝতে পারি আমরা। 


শ্বশুরমশাইয়ের চাকরি সূত্রে বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, লবণহ্রদ ইত্যাদি মিলিয়ে সাকুল্যে চোদ্দ না পনেরো বার বাড়ি পাল্টেছিল শৌভিকের। বিয়ের আগে থেকে শুনে আসছি সেসব গল্প। শাশুড়ি মায়ের আসুরিক শক্তি আর কর্মতৎপরতার গল্প। শৌভিক বলত, আজও বলে, ‘মা একাই, একটা আর্মি ছিল।’ মুভার্স এণ্ড প্যাকার্স  মার্কা কারো হেল্প লাগত না। যাবতীয় প্যাকিং- আনপ্যাকিং সবকিছু একা হাতেই সামলেছেন উনি। শ্বশুরমশাই বা তাঁর লোকজন বড়জোর বাক্স গুলো গাড়িতে তুলে দিয়েছে বা নামিয়ে নিয়েছে। আর ওণার বাড়ি বদল মানে খাট-বিছানা- আলমারি- বাসনকোসন- টিভি-ফ্রিজ সবকিছু। 


তাঁর সবথেকে অযোগ্য পুত্রবধূ আমি। বিয়ের পর বার চারেক বাড়ি পাল্টেছে বটে, তবে সবকিছুই আগে থেকে সাজানো গোছানো ছিল। মামুলি কিছু জিনিস নিয়ে গেছি, দু একটা ব্যাগে ভরে ফিরে গেছি। এবারে কোথা থেকে যে এত জিনিস জমা হল বুঝতেই পারিনি। তুত্তুরীর মাসিকে নিয়ে চারজনের জামাকাপড়, জুতো, রাশি রাশি গল্পের বই, তুত্তুরীর পড়ার বই, খাতা, পুতুল, শৌভিকের ক্যামেরা, চার্জার, বুড়ো ল্যাপটপ,  ঝুটো গয়নাগাটি, প্রসাধন দ্রব্য, বিভিন্ন সময় উপহার পাওয়া ঘর সাজানোর সামগ্রী সব মিলিয়ে ১৬টা প্যাকিং বক্স উপচে গেল। এর বাইরেও বাড়িতে যতগুলো সুটকেস, হ্যান্ডব্যাগ ছিল, ভর্তি হয়ে গেল সেই কটাও। এরওপর ছিল গত বছরের না বিসর্জন দেওয়া সরস্বতী প্রতিমা, উপহার পাওয়া কাঁচের বাটিতে বসানো লাকি বাম্বু। নিত্য পুজো পাওয়া ঠাকুর, তাঁদের বাসনকোসন। পুজোর মাসে বেশ কটা দিন অনুপস্থিত ছিলাম বলে, মাসকাবারি তেমন ভাবে হয়নি। নভেম্বর মাসে তাই চাল,আটা, তেল, মশলা সবই বেশি বেশি নেওয়া হয়েছিল। সেই সব গুছিয়ে প্যাক করা কি চাট্টিখানি কথা। তারওপর ভাগাভাগির ঝামেলা, কিছু কৌটো মহকুমা শাসকের ছিল। কিছু আমরা বাড়ি থেকে এনেছিলাম। পরবর্তী কালে কফি, জ্যাম, বড় বিস্কুট ইত্যাদি কেনার জন্য কিছু কৌটো জমেছিল। কোনটা সরকারি ডাব্বা, আর কোনটা বেসরকারি তার হিসেব করতে বসে তুত্তুরীর মাসির আর আমার মাথার চুল ছেঁড়ার যোগাড়। শেষ পর্যন্ত একটা ডাব্বা নিয়ে সংশয় আর যায়ই না। উত্তরসূরিকে যেদিন বাংলোয় চা খেতে ডাকল, লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই দিলাম আমি, ‘ভাই মনে হচ্ছে তোমার একটা কৌটো আমরা নিয়ে যাচ্ছি। বিস্কুটগুলোকে প্যাকেটে ভরে নিয়ে যেতে গেলে ভেঙে যাবে কি না।’ বেচারা এত অপ্রস্তুত বোধহয় জীবনেও হয়নি। 


একই সংশয় দেখা দিয়েছিল জামাকাপড় ঝোলানোর হ্যাঙার আর কাপড় শুকাতে দেবার ক্লিপ নিয়ে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য শৌভিকের হস্তক্ষেপে প্রমাণ হয় ওগুলো সবই মহকুমা শাসকের সম্পত্তি।  


 একটা একটা করে বাক্সবোঝাই হয়, টেপ মারি আমরা, অতঃপর কালো মার্কার পেন দিয়ে লেখা হয় বাক্স নম্বর- আর ছোট করে কি আছে তাতে। তারপর সেই বক্সের একটা বড় তালিকা বানাই আমরা, গুছিয়ে লিখি কোন বক্সে কি ভরেছি। অতঃপর ভাগাভাগি করে দোতলা থেকে একতলায় নামাই তুত্তুরী আর আমি। মাসি দৌড়ে আসে, আহাঃ ও কেন, আমায় ডাকবে তো। সিকিউরিটি ছেলেগুলো দুঃখ পায়,  ঘড়ির কাঁটা কেবল টিক টিক করে জানায় একটু জলদি করো হে, আর তো মাত্র কয়েকটা ঘন্টা। এখনও বাকি কত যে কাজ। 

(চলবে)

অনির ডাইরি, ২৭শে নভেম্বর, ২০২২

(অন্তিম পর্ব)

কয়েকটা মুহূর্তের জন্য হৃদস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল আমার বরের, যখন ৭ই নভেম্বরের সন্ধ্যেয় জনৈক শুভানুধ্যায়ী দাদা ফোন করে খবর দিয়েছিলেন,‘ তোর জায়গায় অমুকের অর্ডার হয়েছে।’  তমলুকের মহকুমা শাসকের বাংলো চেম্বারের সেদিন চলছিল কোন রুদ্ধদ্বার বৈঠক। উল্টো দিকে বসেছিল শৌভিকের অত্যন্ত স্নেহভাজন দুই অফিসার। দরজার বাইরে সদ্য নেমেছে সন্ধ্যা। অন্যান্য সন্ধ্যা গুলোর মতই খাবার টেবিলে এক কাপ দুধ নিয়ে বসে অনর্থক সময় নষ্ট করা তুত্তুরী বা পড়তে বসার জন্য নিরন্তর তাগাদা দেওয়া আমি, কেউ জানিই না ছোট্ট ঘরটার মধ্যে উল্টেপাল্টে যাচ্ছে সবকিছু। 


শৌভিকের কাঁথির অর্ডারটার গুরুত্ব প্রথমে কিছুক্ষণ উপলব্ধিই করতে পারেনি তুত্তুরী। অতঃপর সারা সন্ধ্যে একটাই কথা বলে গেছে,‘ আবার স্কুল বদলাতে হবে? আমি তো একটা সেশনও শেষ করতে পারলাম না এই স্কুলে।’ মোটামুটি চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে চার্জ দেওয়া-নেওয়া মিটিয়ে ফেলার পর শৌভিকের ইচ্ছে ছিল যত তাড়তাড়ি সম্ভব তাম্রলিপ্ত নগরী পরিত্যাগ করা। এখানেই বেঁকে বসে তুত্তুরী, শিশু দিবসের আগে কিছুতেই প্রিয় স্কুল ছাড়তে রাজি নয় সে। প্রতি মুহূর্তে ভিতরে ভিতরে ক্ষতবিক্ষত  হওয়া সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে শৌভিকের পাষাণ হৃদয়  ও বোধহয় গলে ছিল কিছুটা। 


চারটি অতিরিক্ত দিন স্কুল করার অনুমতি দেওয়া হল তুত্তুরীকে। ৯ইনভেম্বর, বুধবার স্কুলে গিয়ে সবার আগে নিজের প্রিয় বান্ধবী রিমলিকে খবরটা দিল তুত্তুরী। রিমলির সাথে প্রথম দিকে অবশ্য তেমন ভাব ছিল না তুত্তুরীর। তুত্তুরীর ভাষায়,‘ একবার মিউজিক স্যার ক্লাশে এসে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আগুনের পরশমণি গানটা কারা গাইতে পারবে। আমি আর রিমলি দুজনেই হাত তুলেছিলাম। স্যার দুজনকে একসাথে গাইতে বললেন, গাইলাম, গান শেষ হবার পর ও আমায় ডেকে বলল, ‘আমার পেটের বোতামটা খুলে গেছে, একটু লাগিয়ে দিতে পারবি?’ অবাক লেগেছিল জানো মা, আমি তো ক্লাসে নতুন, পুরাণ বন্ধুদের না বলে আমায় বলল কেন? তারপর খেয়াল করে দেখলাম, ওর পাশে কেউ বসে না। ও এসে একাই একটা বেঞ্চে বসে। দু-তিনদিন পর আমি একদিন ওকে জিজ্ঞাসা করলাম,‘তোর পাশে বসতে পারি?’ ও বলল,‘বস। বস।’ সেই যে আমরা একসাথে বসা শুরু করলাম, শেষ দিন অবধি একসাথেই বসেছি।’ 


গতকালও রিমলির গল্প বলতে বলতে ভেঙে এসেছিল তুত্তুরীর গলা। প্রথম দিকে তুত্তুরী আর রিমলির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল কেউ, কেউ। রিমলির গাত্রবর্ণ, রিমলির মেদুল চেহারা, রিমলির অতিরিক্ত সিরিয়াস হাবভাব, তরল কথাবার্তায় অনীহা ইত্যাদি তুলে ধরে তুত্তুরীকে কুমন্ত্রণা দিয়েছিল,‘ওর পাশে বসিস না। আমাদের পাশে বসবি আয়।’ আর রিমলিকে বলা হয়েছিল, তুত্তুরী একে তো কলকাতা থেকে গেছে তারওপর বাবার বদলির চাকরি, ওর স্থায়িত্বই বা কদিন, ওর সাথে মেশা মানে সময় অপচয় করা। 


প্রতিটি কুমন্ত্রণা আরো কাছাকাছি  এনেছিল মেয়েদুটোকে। একসাথেই বসত ওরা। ভাগ করে খেত একে অপরের টিফিন। গল্প করত প্রিয় নায়কদের নিয়ে। কবে যেন কুমন্ত্রণা দেওয়া সহপাঠীগুলোও একে একে এসে বসতে শুরু করেছিল ওদের ঘিরে। প্রাথমিক নেতিবাচক মেঘলা আবহাওয়া কেটে গিয়ে উঠেছিল ঝলমলে বন্ধুত্বের রোদ। তুত্তুরীর বিদায় সংবাদ শুনে প্রাথমিক ভাবে সিঁড়িতেই বসে পড়েছিল রিমলি। ‘তুই চলে যাবি? সত্যি চলে যাবি? এত তাড়াতাড়ি?’ 


স্কুল প্রদর্শনীতে জীববিজ্ঞানের কি যেন মডেল বানানোর কথা ছিল দোঁহের। হাত ধরাধরি করে বলে এল বায়োলজি স্যারকে,‘ আমরা আর বানাতে পারব না।’ স্কুল ছুটির পর সিঁড়িতে ক্লাশ টিচারকে পাকড়াও করে জিজ্ঞাসা করে নিল তুত্তুরী,‘স্যার, সামনেই তো ইউনিট টেস্ট, এমন সময় আমায় টিসি দেবেন তো? নাহলে বাবা বলেছে, নতুন স্কুলে আমায় নেবে না।’ প্রিয় ছাত্রীর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে তিনতলা থেকে নেমেছিলেন মাননীয় শিক্ষক মহাশয়। মনমরা মেয়েটাকে যুগিয়েছিলেন অপরিসীম সাহস। ইংরেজি বলার বাধ্যকতা ছেড়ে মাতৃভাষায় বুঝিয়েছিলেন‘ আরে মন খারাপ করছিস কেন? কাঁথি অনেক বড় শহর। অনেক বড় স্কুল পাবি ওখানে। আর যখন যাবি দেখবি, ঐ স্কুলের প্রিন্সিপাল স্যারের মনটা না পুরো সোনা দিয়ে তৈরি। নিখাদ সোনা। তারপর তো আমরা রইলামই। যেকোন দরকারে তোর পুরাণ স্যার ম্যাডামদের ফোন করবি।’ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, মহানগরে বড় হওয়া তুত্তুরী, হাওড়ায় বড় হওয়া আমি কোনদিন এত সহৃদয় বার্তা পাইনি কোন শিক্ষক-শিক্ষিকার থেকে। 


পরবর্তী দুদিনের মধ্যে গোটা ক্লাশ জেনেই গেল। যাকে/ যাদের বেশ অপছন্দ করত তুত্তুরী, স্কুল থেকে যাবার আগে যাদের রূঢ় বা বিদ্রুপ মাখানো বিদায় সম্ভাষণ জানাবে ঠিক করেছিল, তারাও খবরটা শুনে এমন আবেগ বিহ্বল হয়ে পড়েছিল, একজন তো তুত্তুরীকে জড়িয়ে ভ্যাক করে কেঁদেই ফেলল। কিছুদিন আগে ঐ মেয়েটিই তুত্তুরীর কাছে জানতে চেয়েছিল, ক্লাসের ফার্স্ট বয়কে কি করে প্রপোজ করতে হয়। জবরদস্ত আইডিয়ার জন্য তুত্তুরী আবার কথাটা জানায় তার দাদুকে। কারণ তুত্তুরীর মতে যাবতীয় উৎকট আইডিয়া দাদুর থেকে ভালো কেউ দিতে পারে না। অব্যর্থ আইডিয়ার জন্য কটা দিন সময় চেয়েছিল দাদু, ভাগ্যে তারই মধ্যে শৌভিকের ট্রান্সফারটা হয়ে গেছে। নাহলে এই দাদু-নাতনীকে নিয়ে যে আমি কি করতাম ঠাকুর!


১৬ই নভেম্বর বুধবার সকালে যখন আমরা সত্যিসত্যিই তমলুক ছেড়ে রওণা দিলাম কাঁথির দিকে, অবিকল শিশুর গলা নকল করে বার বার একই কথা বলে যাচ্ছিল তুত্তুরী,‘ অ্যায়াম ছো ছ্যাড।’ বিষাদের চোটে জ্বরই এসে গেল মেয়েটার। বৃহস্পতিবারই নতুন স্কুলে ভর্তি হবার কথা ছিল,নতুন স্কুলের প্রিন্সিপাল স্যার আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন, ঐ স্কুলে এখন ইউনিট টেস্ট শুরু হয়ে গেছে। ফলে কটা দিন লাইব্রেরিতে বসে থাকতে হবে তুত্তুরীকে। 


জ্বর অবশ্য নেমে গেল একদিনেই। পরদিন নতুন স্কুলে ভর্তি হতে গেল তুত্তুরী। প্রিন্সিপ্যাল স্যারের ঘরে বসে ফর্ম ফিলাপ করতে লাগল শৌভিক, আর তুত্তুরীকে নিয়ে গেল ইনচার্জ ম্যাডাম। মাপা হল ওজন, উচ্চতা ইত্যাদি। তারপর দু জন দিদিমণি ধরলেন কিছু প্রশ্নোত্তর। কি যে কাগের ঠ্যাং, বগের ঠ্যাং মার্কা উত্তর দিল তুত্তুরী, ভয়ে তো গলা দিয়ে আওয়াজই বেরোচ্ছিল না। শুধু নাক দিয়ে কি সব যেন ঝরছিল। ম্যামরা বকলেন তো নাই, উল্টে দুহাতে দুটো টফি নিয়ে ফেরৎ এল মেয়েটা। বেশ কিছুক্ষণ খোশ গল্প করলেন বড় স্যার। জানতে চাইলেন, পুরাণ স্কুলের জন্য মন খারাপ কি না? জানালেন মন খারাপ হলেই ওণার কাছে বা ভাইস প্রিন্সিপ্যাল স্যার বা ইনচার্জ ম্যাডামের কাছে গিয়ে মনোবেদনা উজাড় করে দিতে। বললেন,‘আমাদের ছাত্রছাত্রীদের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমাদের কাছে কেউ নই। নির্দ্বিধায় এসো আমার ঘরে। যত ব্যস্তই থাকি না কেন-’।  


 কিছুটা খুশি খুশি মনে ফিরে এল তুত্তুরী। সঙ্গে নিয়ে এল নতুন বই, খাতা। মাপ দেওয়া হল  নতুন পোশাকের। পুরাণ স্কুলের ব্লেজারটা আর পরতে পারবে না বলে খুব দুঃখ ছিল তুত্তুরীর, নতুন স্কুল থেকে অনুমতি দেওয়া হল, রঙটা যখন খুব কাছাকাছি, তখন ঐটাই পরুক তুত্তুরী। শুধু পুরাণ স্কুলের লোগোটা তুলে দিলেই চলবে। ছাত্রছাত্রীদের খুশিটাই বেশী জরুরী এই স্কুলে।  


নতুন স্কুলে, নতুন স্যার-ম্যাডামদের সাথে ধীরে ধীরে আলাপ হল। দুচারজন সহপাঠীর সাথেও আস্তে আস্তে ভাব হল। ইনচার্জ ম্যাডাম, ভাইস প্রিন্সিপাল, প্রিন্সিপ্যাল স্যার যার সাথেই দেখা হয়, প্রত্যেকে নিয়মিত খোঁজ নেন,‘কি পুরোযা, ভালো আছ তো? নতুন বন্ধু হল? কোন অসুবিধা হলেই আমাদের বলবে কিন্তু।’ শুধু তুত্তুরী নয়, প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর সাথেই এমন ভাবেই কথা বলেন ওণারা। খোঁজ নেন সকলের। 


অন্যদের ইউনিট টেস্ট চলতে লাগল রুটিন মেনে, তাই বলে মন খারাপ করে একাকী লাইব্রেরিতে বসতে হল না মেয়েটাকে আমার। সবাই যখন পরীক্ষা দেয়, ক্লাশেই চুপ করে বসে থাকে মেয়েটা। জানলা দিয়ে আকাশ দেখে। মফস্বলের স্কুল,  স্কুলের উল্টো দিকে বিরাট ধান ক্ষেত। পেকে উঠেছে সোনায় ফসল। বড় বড় জানলা গলে হুহু করে ছুটে আসে হাওয়া। বাড়ি ফিরে গল্প শোনায় তুত্তুরী,‘জানো মা, অমুক সাবজেক্টের স্যার/ম্যাডাম আমাকেও প্রশ্নপত্র ধরিয়েই দিয়েছিলেন প্রায়। আমি হাত জোড় করে বললাম, স্যার আমি তো নতুন এসেছি। সিলেবাস জানা নেই।’ বলে একটু দম নেয় মেয়েটা, চোখ দুটো বড় বড় করে অপ্রয়োজনে, তারপর বলে,‘পাশের মেয়েটার পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবার পর, বললাম, তোর প্রশ্নপত্রটা একবার দিবি? নিয়ে দেখি, সব চেনা। আমি সব পারতাম মা। সব পারতাম।’ বলতে বলতে চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে তুত্তুরীর।তুত্তুরীর মায়ের হৃদয় যেন এফোঁড়-ওফোঁড়  হয়ে যায় সাময়িক ভাবে। ক্ষণিকের জন্য কাঁথির মহকুমা শাসকের বাংলো চেম্বারে বিরাজ করে অখণ্ড নীরবতা। তারপরেই সামলে নেয় মা, জীবনের ঘাত প্রতিঘাত থেকে কতদিন বাঁচিয়ে রাখবে মেয়েকে, পাখির মাকেও তো একদিন বন্ধ করতে হয় ডানা। জোর করে উড়িয়ে দিতে হয় ছানাগুলোকে। উড়তে না শিখলে বাঁচবে কি করে? লড়তে না শিখলে টিকবে কি করে? আর ইতিহাস তো এটাই শেখায়, ‘যে টিকে গেছে, সেই জিতে গেছে।’

(শেষ)