Tuesday 15 October 2019

হিন্দুস্তানের হৃদয় হতে- পর্ব- 3




আদি ওঁঙ্কারেশ্বর সিদ্ধনাথের দেউল। নির্মাণকাল সম্ভবতঃ দ্বাদশ শতক। নির্মাতা রাজবংশ- পরমার। বিগতঃ আটশ বছর ধরে অগুনতি উত্থান-পতনের সাক্ষী এই দেউল। বারংবার আক্রান্ত তথা পরিত্যক্ত এই দেউল তবু কালের চক্রান্তকে তুচ্ছ করে আজও দণ্ডায়মান তথা স্বমহিমায় ভাস্বর। বড় দুর্গম। তাই খুব বেশী তীর্থাভিলাষী আসে না। একাই বসে থাকেন বৃদ্ধ জ্যোতির্লিঙ্গ। সঙ্গী ততোধিক বৃদ্ধ এক নির্লোভ পুরোহিত। প্রভাতী সূর্যের আলোকে মন্দির গাত্রের অনুপম ভাস্কর্য

Monday 14 October 2019

হিন্দুস্তানের হৃদয় হতে- পর্ব- ২


আদি ওঁঙ্কারেশ্বর সিদ্ধনাথের দেউল। নির্মাণকাল সম্ভবতঃ দ্বাদশ শতক। নির্মাতা রাজবংশ- পরমার। বিগতঃ আটশ বছর ধরে অগুনতি উত্থান-পতনের সাক্ষী এই দেউল। বারংবার আক্রান্ত তথা পরিত্যক্ত এই দেউল তবু কালের চক্রান্তকে তুচ্ছ করে আজও দণ্ডায়মান তথা স্বমহিমায় ভাস্বর। বড় দুর্গম। তাই খুব বেশী তীর্থাভিলাষী আসে না। একাই বসে থাকেন বৃদ্ধ জ্যোতির্লিঙ্গ। সঙ্গী ততোধিক বৃদ্ধ এক নির্লোভ পুরোহিত। প্রভাত কালে পরিমার্জন করছিলেন শিবলিঙ্গকে, আমাকে আর তুত্তুরীকে দেখে স্বয়ং এগিয়ে দিলেন ছোট্ট তামার পাত্র ভরা জল আর কিছু কুচি ফুল।কোন মন্ত্রোচ্চারণ নেই, কোন কথা নেই,  ব্যস্ত হয়ে পড়লেন নিজ কাজে।  দক্ষিণা দিতে গেল তুত্তুরী, ইশারায় দেখালেন বাবার কাছে রেখে দিতে। বাইরে তখন সদ্যোদয় হয়েছে প্রভাত তপন-

হিন্দুস্তানের হৃদয় হতে- (পর্ব-১)



ঐ যে ফিরিঙ্গী ভাষায় বলে না, “মান্ডু ইজ নট জাস্ট আ ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন। মান্ডু ইজ অ্যান এক্সপিরিয়েন্স। ” এটা যে কত বড় সত্যি মান্ডু না এলে বোঝা যাবে না। অবশ্য যদি আপনার ইতিহাসের সাথে পুরানো প্রেম থাকে তবেই-। আমাদের জনৈক বুড়ো  গাইড যেমন বলছিল, “আপ চাহেঁ তো এক দিন মে ভি মান্ডু দেখ সাকতে হ্যায়, অর চাহেঁ তো এক মাহিনা ভি কম পড়েগা সাব”।  এখানে ইতিহাস ফিসফিস করে কথা কয়। গোটা শহর জুড়ে ছড়িয়ে আছে ৩৬০০ সৌধ, মিনার আর মকবরা। দিনে যদি মেরে কেটে দশটাও দেখেন- এক সাল ভি কম পড়েগা  সাব।
ভিডিওটি কারবাঁ সরাইয়ের। কোন এককালে বড় বড় মানুষজন এসে থাকতেন, বিশাল আঙিনা জুড়ে সারি সারি কামরা। এখন শুধু ঘুরে বেড়ায় মান্ডুর তপ্ত বাতাস। কে জানে? হয়তো রাত নামলে এখনও তাঁরা আসেন, লাফিয়ে নামেন ঘোড়া থেকে, তারপর শুরু হয় কোন নতুন কাহানি।

Saturday 5 October 2019

অভিযোগ পুজোর গল্প,অনির গপ্প -(ষষ্ঠী)



আশ্বিন মাসে কারো বিবাহবার্ষিকী হয়? তাও আবার মহাষষ্ঠীর দিন? বাঙালী হিন্দুদের তো হয় না বাপু। কথাটা মুখে এসেই গিয়েছিল, শুধু বলাই হয়নি। মামিমা হয়তো বুঝতে পেরেই বলেছিলেন, “সন্টু আর লালি ঐ সময় কলকাতা আসবে তো, তাই ঐদিনেই দুপুরবেলা সামান্য আয়োজন, দুটি ডাল-ভাতের।সবই তোর ভাইবোন আর তাদের বাচ্ছাদের আব্দারে বুঝিসই তো। বেশী কেউ নয়, শুধু আমরা আর আমাদের ছেলেমেয়েরা, এই আর কি-”। মামি ওকে বাড়ির মেয়ে বলল? নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না অপর্ণার। আশৈশব যা তাচ্ছিল্য কুড়িয়েছে মামার বাড়ির সকলের থেকে।
দোষ তো মায়ের। অপর্ণা আর ওর ছোট বোন অমৃতার তো কোন দোষ ছিল না। তাও কেন যে ওদের এত কথা শোনাত সবাই। মামারা, মামিরা মায় দিদু-দাদুও। বছর পাঁচেকেই অপর্ণা বুঝে গিয়েছিল ওরা হাওড়ার হেমচক্রবর্তী লেনের বাড়িটায় অনভিপ্রেত অনুপ্রবেশকারী। বুঝে গিয়েছিল ওর মা একটি জেদী তথা অবাধ্য, আত্মসুখ সর্বস্ব মেয়েমানুষ। যে বাবামায়ের মতের বিরুদ্ধে, পালিয়ে গিয়ে নাপিতদের ছেলেকে বিয়ে তো করেছিল, কিন্তু ঘর করতে পারেনি। দুবছরের মাথায় অপর্ণার হাত ধরে, আর অমৃতাকে গর্ভে  নিয়ে ফিরে এসেছিল সিঁথের সিঁদুর মুছে। প্রথমে তো ঢুকতেই দেয়নি দাদু আর মামারা। অপর্ণাকে কোলে নিয়ে দরজার সামনে বসেই ছিল মা। না জানি কতক্ষণ। ভিড় জমতে দেরী হয়নি। পাড়ার লোকেদের ভৎসনার মুখে সিঁড়ির তলার ঘরে জায়গা হয় মা আর অপর্ণার।
বাবা নামের লোকটাকে তারপর আর দেখেনি অপর্ণা। কোন দিন খোঁজ নিতেও আসেনি। মা নাবালক ছিল, ফলে আইনানুগ বিবাহবিচ্ছেদের দরকার পড়েনি। দিব্যি আবার বিয়ে থা করে সংসার বসিয়েছিল লোকটা। মামারাই বলত। মামিরা খোঁটা দিত। সে পেরেছে, মা পারেনি। মা নাকি সংসার করার উপযুক্তই নয়। তাই তো বর ঘাড়ধাক্কা দিয়ে দূর করে দিয়েছে।
মা তো থাকত না, এই সব কথা শুনতে হত অপর্ণা আর অমৃতাকে। ন্যূনতম নিরাপত্তা দেবারও কেউ ছিল না। দাদু দিদুও কেমন যেন দূরের মানুষ ছিল। মামাতো ভাইবোনদের অবাধ প্রবেশাধিকার ছিল দাদুর ঘরে। ওদের দুবোন ঢুকলেই যেন অচ্ছুত কেউ প্রবেশ করেছে এমন মুখভঙ্গী করত দাদু মায় দিদুও। পুজোয় বাকি নাতিনাতনীদের পাঁচশ-ছশ করে টাকা দিত দাদু জামা কেনার জন্য। ওদের দুইবোনের হাতে একশটাকা ধরিয়ে বলা হত, “ফুচকা খাস। ” মা সারাদিন বাড়ির বাইরে কাটিয়ে ফিরত রাত নটা দশটা করে। মায়ের কোন শনিরবি ছিল না। কি যে করত মা, কে জানে?প্রতিমাসেই এক গল্প।  মাসের শুরুতেই টাকা চাইত দাদু। মায়ের হাতে টাকা থাকত না। আর  দাদুর হাতে টাকা দিতে দেরী হলেই লেগে যেত ঝগড়া। গলার শির ফুলিয়ে ঝগড়া করত মা। চিৎকার করত দাদুও, বক্তব্য একই,“বেরিয়ে যাও। এটা দাতব্য আশ্রম নয়, যে বাপের ঘাড়ে দুই মেয়ে নিয়ে বসে বসে চারবেলা গিলবে।” একবার তো ছোটমামা হাতও তুলেছিল মায়ের গায়ে। হাউ হাউ করে কাঁদছিল অপর্ণা সেদিন, আর অমৃতা গুমগুম করে কিল মারছিল ছোটমামাকে। মার খেয়েও মায়ের তেজ কমেনি, দুচোখে আগুন নিয়ে বলেছিল,“ চললাম আমি ব্যাঁটরা থানায়। ” সেরাতে দিদু খোদ মায়ের পায়ে ধরতে এসেছিল, “ছোটভাইটাকে মার্জনা করে দে টুসি। ” নাঃ মা থানায় যায়নি। তবে পরের মাস থেকেই মা আর ওদের দুইবোনকে ভিন্ন করে দিয়েছিল দাদু। পৃথগান্ন যাকে বলে।
ক্লাশ ফোর ফাইভ থেকেই লাইন দিয়ে কেরোসিন তুলে আনতে হত ওদের দুইবোনকে। জনতা স্টোভে রান্না করত মা। একই মেনু। সেদ্ধ ভাত। সাথে ঘি। ঘিটাই একমাত্র বিলাসিতা ছিল জীবনে। মাঝে সাঝে ডিম। আর দুই বোনের জন্মদিনে মাংস। রেঁধে বেরিয়ে যেত মা, ওরা ওদের সময় মত খেয়ে নিত।  সেদিন কেন যে বারবার চোখ মুছত মা, যতদিন না নিজে মা হয়েছে বোঝেনি অপর্ণা।

মা কি যে করত,ভালো জানত না ওরা দুই বোন। মা কাজের কথা বাড়িতে বলত না তেমন। বলত হাসপাতালের কাজ। কথাই তেমন বলত কোথায়? সারাক্ষণ তিক্ত খিটখিটে মেজাজে থাকত। একটা পেন চাইলেও দাঁত খিঁচোত। স্কুলের ফিজ কটাই বা টাকা ছিল? সারা বছরে ষাট সত্তর মাত্র। তাই দিতে গিয়ে কি আফশোস করত মা। ঘেন্না ধরে যেত অপর্ণার। অন্যবন্ধুদের বাড়ি গেলে বা তাদের মায়েদের দেখলে ভীষণ কান্না পেত দুই বোনের। কত ভালো ছিল ওদের মায়েরা। কত সুন্দর দেখতে হত তাদের। মায়ের কেবল একজোড়া ছাপা শাড়ি ছিল। মঙ্গলাহাট থেকে প্রচুর দরদাম করে কিনত মা।  তাই পরে কাজে যেত। রঙ চটে গেলে বাড়িতে পড়ত।একবার সস্তায় জোড়া শাড়ি কিনে যা ঠকেছিল। দুই বোনের জন্য ছিট কিনে জামা বানিয়ে দিত পাড়ার দর্জিকে দিয়ে।
মায়ের প্রতি অসূয়া বাড়ছিল দুইবোনের। দুটো মিষ্টি কথাও কি বলতে পারে না মা? একটু আদরও কি করতে পারে না? কোনদিন কি একটু ঘুরতে বেড়াতেও নিয়ে যেতে পারে না।শীতের চিড়িয়াখানা-গড়ের মাঠ-তারামণ্ডল সব বন্ধুরা দেখেছে, দেখেনি শুধু অমৃতা আর অপর্ণা।
আগুনে ঘি পড়ল অপর্ণা তখন কলেজে। এক বন্ধুর বাড়িতে নোটস্ নিতে গেছে, বন্ধুর মা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ, ইদানিং আর উঠতে পারেন না।তবু এসেছে যখন একবার দেখা করা উচিৎ। বন্ধুই নিয়ে গেল কাকিমা মানে ওর মায়ের ঘরে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই শুনতে পাচ্ছিল কাকিমার চিৎকার। খুব খারাপ ভাষায় কাউকে গালাগাল দিচ্ছেন উনি। উল্টো দিক থেকে কেজো আবেগহীন স্বরে কেউ বলে উঠল,“খেয়ে নিন বৌদি।খেয়ে নিয়ে যা খুশি বলবেন।আপনার হেগোমুতো জামাকাপড় গুলো কাচতে হবে। আমার অনেক কাজ- ”  গলাটা শুনে লাফিয়ে উঠল অপর্ণার হৃদপিণ্ড। মায়ের গলা না?
ভেবেছিল পালিয়ে আসবে, পা নড়েনি। বন্ধু হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল, অশ্লীল গালি দিচ্ছেন কাকিমা, পায়ের কাছে আবেগহীন মুখে ভাতের থালা আর চামচ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মা। মায়ের দিকে তাকাতে পারেনি অপর্ণা। লজ্জায় মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিল। প্রাণ চাইছিল পালিয়ে আসতে।
যা ভয় পেয়েছিল তাই হল, সবার সামনে কথা বলে উঠল মা। “তুই এখেনে? কলেজ যাসনি?” ছুটে পালিয়ে গিয়েছিল অপর্ণা।  রাতে বাড়ি ফিরে অনেক কথা শুনিয়েছিল মা, সেই একই কথা,“এত কষ্ট করে তোদের পড়াচ্ছি-। নিজের কোন শখ সাধ মেটাতে পারিনা তোদের জ্বালায়। ” ছুটে ছাতে চলে গিয়েছিল অপর্ণা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ছিল তারার আলোতে কতক্ষণ কে জানে? দিতিপ্রিয়ার মায়ের পেচ্ছাপ-পায়খানা ফেলে ওর মা? ওরা গরীব জানত, এত গরীব? ছিঃ। মা আর কোন কাজ পেল না?কলেজে সবাই জানতে পেরে যাবে। কি হবে এবার?
কলেজে আরও দুঃখ লেখা ছিল কপালে, সবার সামনে কত কথা যে শুনিয়েছিল দিতিপ্রিয়া, ওর মায়ের সাথে নাকি দিতিপ্রিয়ার বাবার খারাপ সম্পর্ক আছে।ওর মা ফাঁসিয়েছে দিতির বাবাকে- দুহাতে কান চেপে ধরেছিল অপর্ণা। আর কলেজে ফিরে যায়নি অপর্ণা। গ্রাজুয়েশনটা আর করাই হয়নি।

ভেবেছিল আসবে না। তবে শেষ পর্যন্ত আর মামা—মামির অনুরোধ ফেলতে পারেনি অপর্ণা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কেমন যেন নখদন্তহীন সিংহ হয়ে গেছে বড় মামা। বিক্রম কমেছে মামিদেরও। আশৈশব যাদের মুখে একটা মিষ্টি কথাও শোনেনি, সেই বড় মামি আজ যেভাবে অপর্ণাকে আদর করল, “এসেছিস মা” বলে জড়িয়ে কাঁদল, মন ভরে গেছে অপর্ণার। দিলশাদ যদিও বলছিল,“কিচ্ছু বদলায়নি তোমার মামা-মামি। সবটুকুই ধান্দাবাজি। মেয়ে বিদেশে থাকে আর ছেলে প্রবাসে। তোমার বোনের সাথে ওদের পটে না, কোন বিপদআপদ হলে কে দৌড়ে যাবে তুমি আমি ছাড়া? তাই এত খাতির। ” হতেও পারে। নাও পারে। ভিন্নধর্মে বিয়ে করা নিয়ে কম অশান্তি তো করেনি মামারা, দিলশাদ হয়তো সেই তিক্ততা আজও ভুলতে পারেনি।ততোদিনে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা বছর, মায়ের সাথে বাক্যালাপ একদম বন্ধ। পড়া ছেড়ে দেওয়া নিয়ে প্রবল অশান্তি করেছিল মা। দেওয়ালে মেরে মেরে মাথাটা আলু করে ফেলেছিল মা। অপর্ণা গলেনি। দিদুর কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করে, শাড়িতে জারদৌজি কাজ শিখেছিল অপর্ণা। তাই করত বাড়িতে বসে। করতে করতেই দিলশাদের সাথে আলাপ। ওদের জামাকাপড়ের বড় ব্যবসা। দিলশাদের মাও বাড়ি বসেই শুরু করেছিল, এখন লাখে কামায়। আলাপ থেকে প্রেম। বিয়ের কথা দিলশাদই পেড়েছিল। মা শুধু বলেছিল,“তোমাদের তো তালাক বললেই ছাড়াছাড়ি। ছেড়ে দিলে আমার মেয়েটা খাবে কি? আমি যে জ্বালায় জ্বলছি, ওকে না তা সহ্য করতে হয়।” 
লজ্জায় মাথা নীচু হয়ে গিয়েছিল অপর্ণার। এভাবে কেউ বলে? দিলশাদ যদিও খুব স্পোর্টিংলি নিয়েছিল। ওর মাও তালাকপ্রাপ্ত। বিয়ের পর আর কোন যোগাযোগ রাখেনি অপর্ণা মায়ের সাথে। হেমচক্রবর্তী লেনের সাথে একমাত্র যোগাযোগ বলতে ছিল অমৃতা। মোম হবার আগে দিলশাদই বলেছিল,“তোমার মাকে বলো না,কটা দিন এসে থাকতে। এটা তো ওণারও বাড়ি। আর তোমার এই অবস্থায় বাড়িতে কেউ থাকলে একটু শান্তি পাই।”   অমৃতার মুখ দিয়ে খবর পাঠিয়েছিল অপর্ণা। মা আসেনি। অমৃতা বলেছিল,“রাগ করিসনি দিদি। একটা লোক রাখ। তোর তো রাখার ক্ষমতা আছে। এবাড়ির যা অবস্থা, মা না থাকলে, মামারা আমাকে ঘাড়ধাক্কে বের করে দেবে। একবার চলে গেলে আর ঢুকতে পারবে না মা। ” অপর্ণা আজও ক্ষমা করতে পারেনি মাকে। মোমের অন্নপ্রাশন হয়েছিল ধুমধাম করে। মামাতো ভাই সন্টু খাইয়েছিল প্রথম ভাত। কার্ডটা রেখে এলেও নিজ মুখে মাকে নিমন্ত্রণই করেনি অপর্ণা। আর করেই বা কি লাভ? বেনারসী আর ভারী গয়নায় মোড়া অপর্ণার মা, সামান্য আয়ার কাজ করে, আবার দিতিপ্রিয়ার ভাষায় “কাজ টিকিয়ে রাখার জন্য বাবুদের সাথে শুয়েও পড়ে”  এমন মহিলাকে নিজের জীবনের অন্যতম শুভদিনে ডেকে পাঁচজনের সামনে নিজেকে আর ছোট করতে চায়নি অপর্ণা। ভুলে যেতে চেয়েছে নিজের অতীত।  অমৃতাকে বলেছিল, অবশ্য। অমৃতা এসেছিল। অপর্ণারই কিনে দেওয়া একটা শাড়ি পরে, আর কেউ না জানে অপর্ণা বুঝেছিল, এটাই অমৃতার একমাত্র দামী শাড়ি।অমৃতা এসেছিল একটা পিতপিতে সোনার আংটি নিয়ে বলেছিল, মা পাঠিয়েছে। বলতে বলতে চোখ মুছছিল অমৃতা। মোমকে কোলে নিয়ে সরে গিয়েছিল অপর্ণা। পাছে ভরে ওঠে ওর চোখ। অমৃতা খেয়েছিল কি না জানে না অপর্ণা। পরে আমন্ত্রিতদের মধ্যে অনেক খুঁজেছিল নিজের সহোদরাকে। স্বপ্নপূরণের দিনেও কেন যে কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছিল অপর্ণা, আজও বোঝেনি।

অমৃতার ভরসায় আইন আদালত করে, বাড়ির ওপর নিজের স্বত্ব তথা দখল নিয়েছে মা। সমান তিনভাগের এক ভাগ পেয়েছে মা। মামারা অবশ্য পত্রপাঠ পার্টিশন করে আলাদা করে দিয়েছে একমাত্র বোনকে। আজই শুনছিল বড় মামীর মুখে। এতবছরেও এতটুকু বদলায়নি মা। উল্টে অমৃতা নাকি মায়ের ফটোকপি তৈরি হয়েছে। মামা-মামিদের সাথে তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে ঝগড়া করে। অমৃতার চরিত্র নিয়েও ব্যাঁকা ইঙ্গিত করতে চাইছিল ছোট মামী। অপর্ণা থামিয়ে দিয়েছে যদিও। এসব জটিলতা নোংরামি আর সহ্য হয় না। এসব থেকে অনেক দূরে সরে গেছে অপর্ণা।

বেরোতে বেরোতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত।এতদিন বাদে সবার সাথে দেখা। কত গল্প।  কত স্মৃতি। তবু মনটা কেন যে এত খারাপ হয়ে আছে বুঝতেই পারছে না অপর্ণা। আজ ষষ্ঠী।   ওলা উব্র কিছুই ঢুকবে না পঞ্চাননতলায়। নো এন্ট্রি। অগত্যা রিক্সাই ভরসা। সন্টুই তুলে দিল।রিক্সা থেকে আলোকজ্জ্বল হাজরা বাড়ির দিকে তাকিয়ে মনটা কেমন যেন হুহু করে উঠল অপর্ণা। বাড়িটার  একটা অংশে যেন জমে আছে পুঞ্জ পুঞ্জ বিষাদ। অন্ধকার। গেটে ঝুলছে তালা। তালাটাও বেশ বয়স্ক। কেউ ফেরেনি তারমানে। সারাদিন অপর্ণা রইল এই বাড়িতে অথচ একটিবারও দেখা হল না কারো সাথে। মামা-মামিরাও তাই চায়। তাই বোধহয় আরো আরো বিষিয়ে দিচ্ছিল ওর মন-। ওর মায়ের অদম্য লড়াইয়ের একমাত্র পরাজয় তো অপর্ণাই। প্রহ্লাদকুলে রাক্ষসী।
কি অখাদ্য জ্যাম পঞ্চাননতলা রোডে। রিক্সা নড়ছেই না। খুশির প্লাবন এসেছে যেন। সুবেশ নারী পুরুষ আর শিশুদের উচ্ছ্বাস বাঁধনহীন। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে আটটা ছাড়িয়ে নয়ের দিকে দৌড়চ্ছে। রাস্তার দুইধারে নানা সুস্বাদু খাবারের দোকান। ভেসে আসছে রোল, চাউমিন আর বিরিয়ানির সৌরভ। মোম ছটফট করছে। পারলে নেমে দৌড়য়, আইসক্রীম আর বেলুন কিনতে। “চুপ করে বসো” মেয়েকে চেপে বসাতে গিয়ে নজর পড়ল পাশের রুটিসব্জির দোকানে। এটা পুজো উপলক্ষে গজিয়ে ওঠা নয়, চিরাচরিত, এখান থেকে কতরাতে রুটি আর আলুর তরকারি কিনে নিয়ে যেত কাজ ফেরৎ ক্লান্ত মা। মাঝে মাঝে আলুর সাথে মুলোও দিত। সেদিন কাঁদতে বসত অপর্ণা আর অমৃতা। কি বকত মা। ভাবতে ভাবতে আবার ভরে উঠল চোখ। আবছা দৃষ্টিতে চোখের সামনে ফুটে উঠল মা, সেই ছাপা শাড়ি, মেরুন ব্লাউজ। মেরুন আর কালো ব্লাউজ কিনত মা, যাতে সব শাড়িতে চলে যায়। পিঠটা বেরিয়ে আছে, ব্লাউজটা নেমে গেছে,বড্ড রোগা যে। চোয়াল গুলো ঝুলে পড়েছে, গাল তোবড়ানো, দাঁত পড়ে যাওয়া মা। বাঁধায়নি। বললেই বলত “পয়সা কে দেবে? তোদের বাপ?” পাশেই অমৃতা। অমৃতার ঢলঢলে মুখ। আগুন ধরা দুই চোখ। কোমর ঝাপানো বিনুনি। মা আর অমৃতা খেতে বসেছে, কাঠের বেঞ্চে, শালপাতার থালায়, রুটি আর কি?আলু মুলো নির্ঘাত। পাশে ফুলো মামা। মায়ের আশৈশব একমাত্র বন্ধু। অবিবাহিত। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো অর্ধোন্মাদ টাইপ।
রিক্সা থেকে নেমে পড়ল অপর্ণা। মোমের হাত ধরে, সটান মায়ের পাশে,“আমিও খাব মা”। অমৃতার দুই চোখ ঝাপিয়ে গেছে, ঝাপিয়ে গেছে অপর্ণার আঁখিও, ফুলো মামা কিংকর্তব্যবিমূঢ়, মায়ের গলা কি ভাঙল? কে জানে মা শুধু বলল, “ আজ কিন্তু আলু মুলো।তাও ছিবড়ে।  এই নিয়ে কোন অভিযোগ যেন না শুনি। ”

Sunday 15 September 2019

অনির ডাইরি ১৫ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯


“আবছায়া জানলার কাঁচ”
আকাশের রঙ ফলসা। আর রাস্তার রঙ আয়না। দুপাশের নয়ানজুলিতে মুখ দেখছে ফলসা রঙা আকাশ। নয়ানজুলি টপকালেই ধানক্ষেত। সেথায় জমে থাকা  জলের ওপর মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে গাঢ় সবুজ রঙা ধানের চারা। যেন কার্পেটের মত বিছিয়ে দেওয়া দামি সবুজ মুর্শিদাবাদ সিল্ক। মহীরুহদের জটলায় আজ অখণ্ড নিস্তব্ধতা। বুড়ো গাছগুলো কেমন যেন ভিজে জড়সড়।
এই তো আমার ভূস্বর্গ। শুধু সামনের ট্রাকটা যদি আমাদের পথ ছেড়ে দিত। এমন গদাইলস্করি চালে চলছে, গতি বেগ মেরেকেটে ৪০ হবে। হর্ন বাজিয়ে বাজিয়ে হাত ব্যথা করে ফেলল সুশান্ত। অন্য গাড়িগুলিকে দিব্যি রাস্তা ছেড়ে দিলেও, আমাদের প্রতি কিসের যে আক্রোশ কে জানে? যেদিক দিয়েই গলে বেরোনোর চেষ্টা করছি, সেদিকেই পথ আটকে দাঁড়াচ্ছে ট্রাকটা। মুষিককে নিয়ে কি এমন খেলাই খেলে মার্জার? 
ইথারে আবছা ভেসে আসছে একযুগ আগের কোন বিস্মৃতপ্রায় বন্ধুর গলা, “ রাস্তা ছাড়ছিল না জানিস। কবার আপার-ডিপার মেরেছিলাম। রাস্তা তো দিল। ছাড়িয়ে এগোতে যাব টুক করে ঠেকিয়ে তুলে দিল উল্টো দিকের লেনে। উল্টো দিক থেকে ঠিক সেই মুহূর্তেই আসছিল আরেকটা ট্রাক-। ”
বলতে গেলাম, সুশান্ত ট্রাক হল হাইওয়ের রাজা। ওকে বিরক্ত করো না। আচমকা পাশ দিল ট্রাকটা। সজোরে বেরোতে গিয়ে ধরাশায়ী কয়েকটা কমলা রঙা ট্রাফিক কোণ। অন্তিম কোনটির সামনেই ভীত সন্ত্রস্ত কটি হাবাগোবা মুখ- মুখ ছাপিয়ে নোটিশ-“মেন এট ওয়ার্ক”।

“তারারাও নাকি অভিমানী হয়-”
রাগ হচ্ছে, খুব রাগ হচ্ছে। কেন পাত্তা দিচ্ছে না বিউটি ম্যাম? আজ নিয়ে তিন তিনটে দিন, এই  তো আমার পাশ দিয়ে জলপরীর মত মসৃণ ভাবে সাঁতরে চলে গেল, চিৎকার করল না তো, “কি হল? পা কই? পা চলছে না কেন? এইটুকু যেতে এতগুলো হাত লাগছে কেন?”
কতবার বলেছিলাম, আমি তো সাঁতার জানি। শহরের অন্যতম উঠতি প্রজাপতি ক্লাবে শিখেছিলাম তো। সে অনেকবছর হল, হাজার দুয়েক টাকায় ১৫টা ক্লাশে ফ্রি স্টাইল, ব্যাক স্ট্রোক সব শিখিয়ে দিয়েছিল। তাই নিয়েই কি উল্লাস। লঞ্চ পেরোবার সময়, বার বার সাবধান করা সত্ত্বেও লাইফ জ্যাকেট নিতাম না। কি হবে? আমি তো সাঁতার জানি।

শেখার দরকার তো তুত্তুরীর। টুকটুকে লাল মনোকিনি  পরে যে বিগত আড়াই তিন মাসে শুধু খলবল করতে শিখেছে। তাকে কেউ কিছু বলে না। শুধু মাঝে মাঝে গণেশ স্যার চিৎকার করে,“থামিস না। থামিস না। জল কাউকে থামার অবকাশ দেয় না। ”

দিব্যি সাঁতার কাটতাম আড়াআড়ি এপাড়-ওপাড়। বিউটি ম্যামই তো টেনে নিয়ে গেল গভীর জলে। ৫০মিটার? আমি কি পারব? ঐ প্রান্তে গভীরতা বোধহয় ১০মিটার। জলের রঙ বিমর্ষ কালো। বড় বেশী শীতল ঐ জল। বড় গুরুগম্ভীর। বড় নিথর। কেউ যায় না। গোটা কয়েক মুস্কো সাঁতারু ছাড়া। মাঝে মাঝে দল বেঁধে বাচ্ছাগুলোকে নিয়ে যায় স্যারেরা। বড় মেয়েরা তেমন কেউই যায় না। অবশ্য তারা আর সাঁতার কাটে কোথায়। কতজন যে ছিল বিউটি ম্যামের শিক্ষানবিশ, সব ঝরে গেছে একে একে। 
১৫মিটারের মাথায় আড়াআড়িভাবে বাঁধা থাকে নাইলনের দড়ি। সেখানে থেকেই ডুব জল।  যখন প্রতিযোগিতা বা পরীক্ষা হয়, খুলে দেওয়া হয় দড়ি। জেলা, রাজ্যস্তরীয় সাঁতারু তৈরি করে লালকুঠি নেতাজী সংঘ। ট্রেনাররা শেখাতে ব্যাকুল, শিখতেই যে চায়না কেহ।

প্রজাপতি ক্লাবের শৌখিন সুইমিং পুলে শিখে আসা সাঁতারকে রীতিমত তাচ্ছিল্য করে এরা। “আমি তো সাঁতার জানি”র আত্মবিশ্বাসকে দুমড়ে মুচড়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। পুরানো স্মৃতি মুছে ফেলে, নতুন করে লিখতে বাধ্য হয়েছি স্মৃতির শ্লেট।

প্রথম প্রথম বড় কষ্ট হত, দমে পারতাম না। ৫০মিটার টানা, মনে হত অসম্ভব। অথচ বিউটি ম্যাম পরশুদিন ২৪টা ল্যাপ টেনেছেন। গতকাল ৩৬টা। আজকের লক্ষ্য ৫০।

বাতাস- এক চিলতে বাতাসের জন্য হাঁকুপাকু করে হৃদপিণ্ড। দেওয়াল ধরে প্রবল হাঁপানি। দৌড়ে আসতেন বাপি দা, উনি হেড ট্রেনার। জলে নামেন না, পাড় বরাবর বাঘের মত পায়চারি করেন। কি বাজখাঁই গলা বাপরে বাপ। ছাত্রছাত্রীদের সামনেই ট্রেনারদের ধমকান। থলথলে লোক বা বাচ্ছা দেখলেই, ছড়ি হাতে ব্যায়াম করান। মহিলাদের অবশ্য সাতখুন মাপ।
“ডুব দিন। কি হল?” বাপিদার গলার আওয়াজে চমকে সত্যিই ডুবে যাই। “ফুঁ গুলো জলের ভিতরে ছাড়ুন। ডুব দিন”।  দেওয়াল ধরে ফুঃ ফুঃ করে শ্বাস ছাড়ছিলাম, ঠিক খেয়াল করেছিলেন বাপি দা।

বিউটি ম্যাম বলতেন, পরীক্ষা নেবে বাপিদা। একটু বেগড়বাই করলেই আউট। তখন ঝাড় খাবে আমার দিদিমণি।
তাও কি হয়? কেমন ৫০মিটার সাঁতারই বিউটি ম্যাম? আপনি তো ইদানিং জলেই নামতেন না। আমার পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে যেতেন। উল্টোদিক থেকে আসা মুস্কো সাঁতারুর সাথে ধাক্কাধাক্কি হবার সম্ভবনা দেখলে তখন ঝপাং করে ঝাঁপিয়ে পড়তেন।

কেমন ডাইভ দিতে শেখালেন আপনি? প্রথমে বসে ঝপাং করে ঝাঁপিয়ে পড়া, ক্রমে ক্রমে দাঁড়িয়ে। সত্যি বলছি বিউটি ম্যাম, প্রথম দিকে খুব লাগত। মনে হত গালে সাঁটিয়ে চড় মারছে জল। তবে মজাও হত খুব। ওয়ান-টু-থ্রি রেডি? ঝপাং করে ঝাঁপিয়ে পড়তাম দিদিমণি আর ছাত্রী। লাল টুকটুক তুত্তুরী হাঁ করে দেখত। প্রথম বার ডাইভ দেবার সময় মনে হয়েছিল, সর্বনাশ, শ্যালো হ্যালের কেস হবে না তো? আমি জলে, আর জল গ্যালারিতে? আপনাকে বলেছিলাম।  শুনে আপনার  কি হাসি। মনে আছে?

আর জলে সাইক্লিং শেখানো? কতবার যে আপনি বলতেন,“পা তোলো। লাথি মারো। ” তাও আবার তেরচা করে। শুধু লাথি আর চড় মেরে নিজেকে উল্লম্ব ভাবে ভাসিয়ে রাখা বেশ চ্যালেঞ্জিং যাই বলুন। বললাম নর্মাল সাইক্লিং করি? বাপিদার কি কিছুই নজর এড়ায় না?“ এই দেখুন, দুই হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে শরীরটাকে নীচু করুন। করুন। এবার পাটাকে পেটের কাছে টেনে এনে লাথি মারুন। অ্যায়। এই ভাবে। ” লোকটাকে কে বোঝাবে, ডাঙায় ওটা আমিও করতে পারি। কিন্তু জলে করা এত সহজ?

বারবার ডুবে যেতাম। তাও আপনি ছাড়েননি। নখ দিয়ে আমার নীলচে কস্ট্যুমের প্রান্ত ধরে থাকতেন, আর বলতেন,“করো। এইতো ধরে আছি ডুববে না। ”
এতভালো দিদিমণি আমার, বয়সে হয়তো আমার বয়সী বা একটু ছোট বা বড়ই হবে, তবুও দিদিমণি তো।
সেই দিদিমণি আমার শুনলাম লাইফ সেভার হবে। জলে ডুবতে বসা মানুষের কুঁকড়ে যাওয়া ফুসফুসে ভরে দেবে টাটকা মুক্ত বাতাস। জলের নীচে মাথা ডুবিয়ে দম ধরে রাখা প্রাকটিশ করছিল বিউটি ম্যাম। বাপিদা একটা চেয়ার টেনে বসলেন। কাকে যেন বলছেন,“ডুবুরিরা তো অক্সিজেন নিয়ে নামে। এদের ওসব লাগে না। এরা এমনি একদমে জেটির তলায় এফোঁড় ওফোঁড় করে দেবে। ”
কে যেন জানতে চাইল, জেটির তলা কেন? বাপিদা আবেগহীন স্বরে বললেন,“লাশগুলো তো জেটির তলায়ই আটকে থাকে। যখনই কেউ ডুবে যায়, আগে আসেপাশে যত জেটি আছে, তাদের তলাগুলো খোঁজা হয় তন্নতন্ন করে-। ”

“কাঁচামিটে ছোঁয়া দিয়ে মাপি মন-
ছোট কাগজের ভিড়ে ছাপি মন”
জলের ভিতর দিয়ে ভেসে এল টুকরো টুকরো ছবি, জানুয়ারী মাস। মেলার শেষ দিন। স্টলে স্টলে উপচে পড়া ভিড়। খুশির আমেজ মাখিয়ে ডুবছে কমলাটে সূর্য। দুটি ছেলে ছুটে এল,“ম্যাডাম, আমাদের স্টলেও একটু আসতে বলুন না। কেউ আসছে না। ” কোন স্টল? শুনলাম সিভিস ডিফেন্স। 
তোমাদের স্টল তো ফাঁকা ছিল। সকাল থেকে কোথায় ছিলে হে বাপু? “ঐ যে ম্যাডাম, গিয়েছিলুম। দুটি ছেলেমেয়ে ডুবে গিয়েছিল তো। তাদের খুঁজতে। ” পেয়েছো? “হ্যাঁ ম্যাডাম পেয়েছি। ছেলেটাকে শ্রীরামপুরের ঘাটে। জেটির তলায় আটকে গিয়েছিল। মাছে খানিক খুবলে খেয়ে নিয়েছে। ” কেঁপে উঠে জানতে চাইলাম, আর মেয়েটাকে? জবাব পেয়েছিলাম, মেয়েটাকে মাছে খায়নি। আর প্রশ্ন করার সাহস হয়নি।
বেল বাজছে। এবার শুরু হবে দৈনন্দিন কর্মযজ্ঞ। কারো স্কুল, তো কারো চাকরগিরি। জমতে থাকা ধুসর অভিমানকে নেতাজী সংঘের ঘোলাটে নীল জলে ভাসিয়ে দিয়ে উঠে পড়লাম। অল দা বেস্ট বিউটি ম্যাম। খুব ভালো করে পরীক্ষা দেবেন-।