Sunday 15 September 2019

অনির ডাইরি ১৫ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯


“আবছায়া জানলার কাঁচ”
আকাশের রঙ ফলসা। আর রাস্তার রঙ আয়না। দুপাশের নয়ানজুলিতে মুখ দেখছে ফলসা রঙা আকাশ। নয়ানজুলি টপকালেই ধানক্ষেত। সেথায় জমে থাকা  জলের ওপর মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে গাঢ় সবুজ রঙা ধানের চারা। যেন কার্পেটের মত বিছিয়ে দেওয়া দামি সবুজ মুর্শিদাবাদ সিল্ক। মহীরুহদের জটলায় আজ অখণ্ড নিস্তব্ধতা। বুড়ো গাছগুলো কেমন যেন ভিজে জড়সড়।
এই তো আমার ভূস্বর্গ। শুধু সামনের ট্রাকটা যদি আমাদের পথ ছেড়ে দিত। এমন গদাইলস্করি চালে চলছে, গতি বেগ মেরেকেটে ৪০ হবে। হর্ন বাজিয়ে বাজিয়ে হাত ব্যথা করে ফেলল সুশান্ত। অন্য গাড়িগুলিকে দিব্যি রাস্তা ছেড়ে দিলেও, আমাদের প্রতি কিসের যে আক্রোশ কে জানে? যেদিক দিয়েই গলে বেরোনোর চেষ্টা করছি, সেদিকেই পথ আটকে দাঁড়াচ্ছে ট্রাকটা। মুষিককে নিয়ে কি এমন খেলাই খেলে মার্জার? 
ইথারে আবছা ভেসে আসছে একযুগ আগের কোন বিস্মৃতপ্রায় বন্ধুর গলা, “ রাস্তা ছাড়ছিল না জানিস। কবার আপার-ডিপার মেরেছিলাম। রাস্তা তো দিল। ছাড়িয়ে এগোতে যাব টুক করে ঠেকিয়ে তুলে দিল উল্টো দিকের লেনে। উল্টো দিক থেকে ঠিক সেই মুহূর্তেই আসছিল আরেকটা ট্রাক-। ”
বলতে গেলাম, সুশান্ত ট্রাক হল হাইওয়ের রাজা। ওকে বিরক্ত করো না। আচমকা পাশ দিল ট্রাকটা। সজোরে বেরোতে গিয়ে ধরাশায়ী কয়েকটা কমলা রঙা ট্রাফিক কোণ। অন্তিম কোনটির সামনেই ভীত সন্ত্রস্ত কটি হাবাগোবা মুখ- মুখ ছাপিয়ে নোটিশ-“মেন এট ওয়ার্ক”।

“তারারাও নাকি অভিমানী হয়-”
রাগ হচ্ছে, খুব রাগ হচ্ছে। কেন পাত্তা দিচ্ছে না বিউটি ম্যাম? আজ নিয়ে তিন তিনটে দিন, এই  তো আমার পাশ দিয়ে জলপরীর মত মসৃণ ভাবে সাঁতরে চলে গেল, চিৎকার করল না তো, “কি হল? পা কই? পা চলছে না কেন? এইটুকু যেতে এতগুলো হাত লাগছে কেন?”
কতবার বলেছিলাম, আমি তো সাঁতার জানি। শহরের অন্যতম উঠতি প্রজাপতি ক্লাবে শিখেছিলাম তো। সে অনেকবছর হল, হাজার দুয়েক টাকায় ১৫টা ক্লাশে ফ্রি স্টাইল, ব্যাক স্ট্রোক সব শিখিয়ে দিয়েছিল। তাই নিয়েই কি উল্লাস। লঞ্চ পেরোবার সময়, বার বার সাবধান করা সত্ত্বেও লাইফ জ্যাকেট নিতাম না। কি হবে? আমি তো সাঁতার জানি।

শেখার দরকার তো তুত্তুরীর। টুকটুকে লাল মনোকিনি  পরে যে বিগত আড়াই তিন মাসে শুধু খলবল করতে শিখেছে। তাকে কেউ কিছু বলে না। শুধু মাঝে মাঝে গণেশ স্যার চিৎকার করে,“থামিস না। থামিস না। জল কাউকে থামার অবকাশ দেয় না। ”

দিব্যি সাঁতার কাটতাম আড়াআড়ি এপাড়-ওপাড়। বিউটি ম্যামই তো টেনে নিয়ে গেল গভীর জলে। ৫০মিটার? আমি কি পারব? ঐ প্রান্তে গভীরতা বোধহয় ১০মিটার। জলের রঙ বিমর্ষ কালো। বড় বেশী শীতল ঐ জল। বড় গুরুগম্ভীর। বড় নিথর। কেউ যায় না। গোটা কয়েক মুস্কো সাঁতারু ছাড়া। মাঝে মাঝে দল বেঁধে বাচ্ছাগুলোকে নিয়ে যায় স্যারেরা। বড় মেয়েরা তেমন কেউই যায় না। অবশ্য তারা আর সাঁতার কাটে কোথায়। কতজন যে ছিল বিউটি ম্যামের শিক্ষানবিশ, সব ঝরে গেছে একে একে। 
১৫মিটারের মাথায় আড়াআড়িভাবে বাঁধা থাকে নাইলনের দড়ি। সেখানে থেকেই ডুব জল।  যখন প্রতিযোগিতা বা পরীক্ষা হয়, খুলে দেওয়া হয় দড়ি। জেলা, রাজ্যস্তরীয় সাঁতারু তৈরি করে লালকুঠি নেতাজী সংঘ। ট্রেনাররা শেখাতে ব্যাকুল, শিখতেই যে চায়না কেহ।

প্রজাপতি ক্লাবের শৌখিন সুইমিং পুলে শিখে আসা সাঁতারকে রীতিমত তাচ্ছিল্য করে এরা। “আমি তো সাঁতার জানি”র আত্মবিশ্বাসকে দুমড়ে মুচড়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। পুরানো স্মৃতি মুছে ফেলে, নতুন করে লিখতে বাধ্য হয়েছি স্মৃতির শ্লেট।

প্রথম প্রথম বড় কষ্ট হত, দমে পারতাম না। ৫০মিটার টানা, মনে হত অসম্ভব। অথচ বিউটি ম্যাম পরশুদিন ২৪টা ল্যাপ টেনেছেন। গতকাল ৩৬টা। আজকের লক্ষ্য ৫০।

বাতাস- এক চিলতে বাতাসের জন্য হাঁকুপাকু করে হৃদপিণ্ড। দেওয়াল ধরে প্রবল হাঁপানি। দৌড়ে আসতেন বাপি দা, উনি হেড ট্রেনার। জলে নামেন না, পাড় বরাবর বাঘের মত পায়চারি করেন। কি বাজখাঁই গলা বাপরে বাপ। ছাত্রছাত্রীদের সামনেই ট্রেনারদের ধমকান। থলথলে লোক বা বাচ্ছা দেখলেই, ছড়ি হাতে ব্যায়াম করান। মহিলাদের অবশ্য সাতখুন মাপ।
“ডুব দিন। কি হল?” বাপিদার গলার আওয়াজে চমকে সত্যিই ডুবে যাই। “ফুঁ গুলো জলের ভিতরে ছাড়ুন। ডুব দিন”।  দেওয়াল ধরে ফুঃ ফুঃ করে শ্বাস ছাড়ছিলাম, ঠিক খেয়াল করেছিলেন বাপি দা।

বিউটি ম্যাম বলতেন, পরীক্ষা নেবে বাপিদা। একটু বেগড়বাই করলেই আউট। তখন ঝাড় খাবে আমার দিদিমণি।
তাও কি হয়? কেমন ৫০মিটার সাঁতারই বিউটি ম্যাম? আপনি তো ইদানিং জলেই নামতেন না। আমার পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে যেতেন। উল্টোদিক থেকে আসা মুস্কো সাঁতারুর সাথে ধাক্কাধাক্কি হবার সম্ভবনা দেখলে তখন ঝপাং করে ঝাঁপিয়ে পড়তেন।

কেমন ডাইভ দিতে শেখালেন আপনি? প্রথমে বসে ঝপাং করে ঝাঁপিয়ে পড়া, ক্রমে ক্রমে দাঁড়িয়ে। সত্যি বলছি বিউটি ম্যাম, প্রথম দিকে খুব লাগত। মনে হত গালে সাঁটিয়ে চড় মারছে জল। তবে মজাও হত খুব। ওয়ান-টু-থ্রি রেডি? ঝপাং করে ঝাঁপিয়ে পড়তাম দিদিমণি আর ছাত্রী। লাল টুকটুক তুত্তুরী হাঁ করে দেখত। প্রথম বার ডাইভ দেবার সময় মনে হয়েছিল, সর্বনাশ, শ্যালো হ্যালের কেস হবে না তো? আমি জলে, আর জল গ্যালারিতে? আপনাকে বলেছিলাম।  শুনে আপনার  কি হাসি। মনে আছে?

আর জলে সাইক্লিং শেখানো? কতবার যে আপনি বলতেন,“পা তোলো। লাথি মারো। ” তাও আবার তেরচা করে। শুধু লাথি আর চড় মেরে নিজেকে উল্লম্ব ভাবে ভাসিয়ে রাখা বেশ চ্যালেঞ্জিং যাই বলুন। বললাম নর্মাল সাইক্লিং করি? বাপিদার কি কিছুই নজর এড়ায় না?“ এই দেখুন, দুই হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে শরীরটাকে নীচু করুন। করুন। এবার পাটাকে পেটের কাছে টেনে এনে লাথি মারুন। অ্যায়। এই ভাবে। ” লোকটাকে কে বোঝাবে, ডাঙায় ওটা আমিও করতে পারি। কিন্তু জলে করা এত সহজ?

বারবার ডুবে যেতাম। তাও আপনি ছাড়েননি। নখ দিয়ে আমার নীলচে কস্ট্যুমের প্রান্ত ধরে থাকতেন, আর বলতেন,“করো। এইতো ধরে আছি ডুববে না। ”
এতভালো দিদিমণি আমার, বয়সে হয়তো আমার বয়সী বা একটু ছোট বা বড়ই হবে, তবুও দিদিমণি তো।
সেই দিদিমণি আমার শুনলাম লাইফ সেভার হবে। জলে ডুবতে বসা মানুষের কুঁকড়ে যাওয়া ফুসফুসে ভরে দেবে টাটকা মুক্ত বাতাস। জলের নীচে মাথা ডুবিয়ে দম ধরে রাখা প্রাকটিশ করছিল বিউটি ম্যাম। বাপিদা একটা চেয়ার টেনে বসলেন। কাকে যেন বলছেন,“ডুবুরিরা তো অক্সিজেন নিয়ে নামে। এদের ওসব লাগে না। এরা এমনি একদমে জেটির তলায় এফোঁড় ওফোঁড় করে দেবে। ”
কে যেন জানতে চাইল, জেটির তলা কেন? বাপিদা আবেগহীন স্বরে বললেন,“লাশগুলো তো জেটির তলায়ই আটকে থাকে। যখনই কেউ ডুবে যায়, আগে আসেপাশে যত জেটি আছে, তাদের তলাগুলো খোঁজা হয় তন্নতন্ন করে-। ”

“কাঁচামিটে ছোঁয়া দিয়ে মাপি মন-
ছোট কাগজের ভিড়ে ছাপি মন”
জলের ভিতর দিয়ে ভেসে এল টুকরো টুকরো ছবি, জানুয়ারী মাস। মেলার শেষ দিন। স্টলে স্টলে উপচে পড়া ভিড়। খুশির আমেজ মাখিয়ে ডুবছে কমলাটে সূর্য। দুটি ছেলে ছুটে এল,“ম্যাডাম, আমাদের স্টলেও একটু আসতে বলুন না। কেউ আসছে না। ” কোন স্টল? শুনলাম সিভিস ডিফেন্স। 
তোমাদের স্টল তো ফাঁকা ছিল। সকাল থেকে কোথায় ছিলে হে বাপু? “ঐ যে ম্যাডাম, গিয়েছিলুম। দুটি ছেলেমেয়ে ডুবে গিয়েছিল তো। তাদের খুঁজতে। ” পেয়েছো? “হ্যাঁ ম্যাডাম পেয়েছি। ছেলেটাকে শ্রীরামপুরের ঘাটে। জেটির তলায় আটকে গিয়েছিল। মাছে খানিক খুবলে খেয়ে নিয়েছে। ” কেঁপে উঠে জানতে চাইলাম, আর মেয়েটাকে? জবাব পেয়েছিলাম, মেয়েটাকে মাছে খায়নি। আর প্রশ্ন করার সাহস হয়নি।
বেল বাজছে। এবার শুরু হবে দৈনন্দিন কর্মযজ্ঞ। কারো স্কুল, তো কারো চাকরগিরি। জমতে থাকা ধুসর অভিমানকে নেতাজী সংঘের ঘোলাটে নীল জলে ভাসিয়ে দিয়ে উঠে পড়লাম। অল দা বেস্ট বিউটি ম্যাম। খুব ভালো করে পরীক্ষা দেবেন-। 

No comments:

Post a Comment