Wednesday 10 October 2018

এক যে ছিল কন্যা-

ঠাণ্ডাটা আজ বেশ জব্বর পড়েছে, জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের সামনে একাকিনী এক নারী। জ্বলতে থাকা আগুনের আভায় ভাস্বর এক দেবী। যেন বিষাদের প্রতিমূর্তি। রমণী এক মনে মাথা নীচু করে সেলাই করে চলেছেন। “রাণীমা!” জনৈকা সহচরীর ডাকে চমকে উঠলেন নারী, সহচরী নতমস্তকে কুর্নিশ করে জানাল,“ রাজামশাই এর ব্যক্তিগত সহায়ক  আপনার সাক্ষাৎ প্রার্থী। ”
মৃদু কেঁপে উঠল বুক, রাজামশায়ের এই ব্যক্তিগত সহায়কের রাণীমাকে এক্কেবারেই না পসন্দ, এ কথা অজ্ঞাত নয় নারীর। একদিন প্রশ্নও করেছিলেন,“আমার প্রতি আপনার এই বিরাগের কারণটা জানতে পারি কি?”  জবাবে কুর্নিশ করে তিনি বলেছিলেন,“আমি এক তুচ্ছ সেবক রাণীমা, বলতে গেলে আপনি আকাশের চাঁদ,আর এ অধম ক্ষুদ্র বামন মাত্র। ” অন্যমনস্ক ভাবে ইশারা করলেন রাণীমা, দুই সহচরী দৌড়ে এল, অন্তর্বাসহীন রাত পোশাকের ওপর জড়িয়ে দিল রেশমী আচ্ছাদন। মাথায় চড়িয়ে দিল রত্নখচিত মুকুট। এমন মুকুট রাণীমার অগণিত। বর্তমানে সাদা পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে মাথায় পরলেন মুক্তার মুকুট। এক একটা মুক্তা প্রায় পায়রার ডিমের আকারের।
সহায়ক প্রবেশানুমতি পেলেন। নতজানু হয়ে অভিবাদন জানালেন রানীমাকে। ব্যক্তিগত ভাবে এই রাজ্যের আপামর অধিবাসীর মত উনিও পরম শ্রদ্ধা করেন এই জনমদুখিনী নারীকে। কোন ছোট্ট বেলায় বাগদত্তা হয়ে ভিনদেশ থেকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এদেশে এসেছিলেন, তখন বোধহয় রাণীমার বয়স পাঁচ থেকে ছয় বছর হবে। শোনা যায় জাহাজে ওঠার আগে মাকে জড়িয়ে আকুল কেঁদেছিলেন সেদিনের  সেই বালিকা। বদলে শুনতে হয়েছিল উপদেশ,“রাজকন্যারা দেশ এবং রাজনীতির জন্য বলিপ্রদত্ত। বুক ফাটবে কিন্তু চোখ না ফাটে।” কালাপানি পেরিয়ে এসে যুবরাজের বাগদত্তা হলেন শিশু রাজকন্যা। যুবরাজের যখন চোদ্দ বছর বয়স, জানা গেল হবু যুবরাণী সদ্য রজঃস্বলা হয়েছেন। চটজলদি বিয়ের আয়োজন করলেন তৎকালীন মহারাজ। দেশবিদেশ থেকে এলেন অথিতিদের দল, হবু যুবরাণী আশা করেছিলেন এত বছর বাদে হয়তো দেখা হবে বাবা-মায়ের সাথে। বদলে এল আশির্বাদ জ্ঞাপক পত্র মাত্র। ওণার দেশে নাকি রাষ্ট্রবিপ্লব  ঘটেছে,তাই রাজা বা রাণীর পক্ষে দেশত্যাগ অসম্ভব,বদলে এল থরে থরে ধনসম্পত্তি,মণিমাণিক্য আর ধর্মগুরুর আশির্বাদ।
বিয়ের পর তরুণ যুবরাজ আর যুবরাণী পাড়ি দিল অঙ্গরাজ্যে,এখান থেকেই দেশ শাসনের হাতে গরম তালিম পাবে যুবরাজ। এখানেই হবে ফুলশয্যা।

একি ফুলশয্যা? শয়নকক্ষে প্রবেশ করে চমকে উঠলেন সালংকারা নববধূ । শয়ন কক্ষ ভর্তি লোক,গিজগিজ করছে। কে নেই তাদের মধ্যে? যুবরাণীর সহচরীবৃন্দ-যুবরাজের সহচর বৃন্দই গোটা ছয়, এদের কর্তব্য যুবরাজ এবং যুবরাণীকে বিবস্ত্র করা। এছাড়া দাস-দাসী অন্তত এক ডজন, নানারূপ ফল,মিষ্টি নিয়ে নতমস্তকে দণ্ডায়মান। এছাড়া কমসেকম তিনজন যাজক, তাঁদের কর্তব্য হল, যুবরাজ আর যুবরাণীর প্রথম মিলনের মুহূর্তে সোচ্চার প্রার্থনা করা, যাতে প্রথম মিলনেই যুবরাণীকে গর্ভবতী করতে সক্ষম হন যুবরাজ এবং কালানুক্রমে একটি সুস্থ সবল পুত্র সন্তান প্রসব করেন যুবরাণী।
কি আড়ষ্টই না ছিলেন কিশোর যুবরাজ আর সদ্য বিবাহিত যুবরাণী। সর্বসমক্ষে বস্ত্র উন্মোচন করে পাতলা দুধ সাদা রাত পোশাক পরানো হল , সুগন্ধী আগরবাতি  নিয়ে পরিক্রমা করা হল , যাতে যাবতীয় কুনজরকে ঝেড়ে ফেলে নতুন জীবনে প্রবেশ করতে পারেন দোঁহে। ছেটানো হল সুগন্ধী, যাতে শরীরের যাবতীয় বদগন্ধ দূর হয়, অতঃপর পালঙ্কে উঠলেন যুবরাজ এবং যুবরাণী,  কয়েক বছর আগেও যাঁরা ছিলেন একে অপরের খেলার সাথী। কত হাতাহাতি, কত মারামারির সাক্ষী এবং সঙ্গী। পালংকের দুপাশে থরে থরে সাজানো না না সুস্বাদু ফল,দুধ, মিষ্টি এবং সুরা। পাতলা সাদা মখমল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হল পালঙ্ককে।  
বাইরে অতন্দ্র প্রহরায় সকলে, সোচ্চারে মন্ত্রপাঠ চলছে, ফিসফিস করে রসের আলোচনা চলছে যুবরাজ এবং যুবরাণীর সহচর এবং সহচরী  বৃন্দের মধ্যে, উৎকীর্ণ  সকলের কান। এইবার শোনা যাবে যুবরাণীর তীব্র শীৎকার। কিন্তু এতো শীৎকার নয়,এযে চিৎকার। তীব্র চিৎকার করে উঠলেন যুবরাজ, উচ্চ স্বরে কেঁদে উঠলেন কিশোরী যুবরাণী । রসালো ইঙ্গিতে খলবলিয়ে উঠল যাজকদের চক্ষুও।
উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল চিৎকার, ভোরের দিকে যুবরাজের আর্তনাদ ক্রমশ পরিণত হল গোঙানিতে।যুবরাণীর কাতর চিৎকার আর হৃদয়বিদারক কান্না আর অনুনয় বিনয়ে  আর থাকতে পারল না পরিচারকের দল, এত দীর্ঘ সময়ব্যাপী চলতে পারে না এই প্রক্রিয়া। ব্যাপার কি? ধীরে ধীরে পর্দা তুলে আঁতকে উঠল সকলে, তীব্র শারীরিক বেদনায় কাটা পাঁঠার মত ছটফট করছে দোঁহে, দুজনের ঘামে জবজবে ভিজে গেছে রাজশয্যা।  ক্রমেই নেতিয়ে পড়ছে দুই সদ্যবিবাহিত কিশোর কিশোরী।  ডাকা হল রাজবৈদ্যকে। তিনি দেখেই বললেন, “এতো ঘামরোগ। ভয়ানক ছোঁয়াছে। ” শুনেই আঁতকে উঠল সকলে।এতো রোগ নয়,মহামারী।  দুদ্দাড় করে পালিয়ে গেল সহচর আর পরিচারক বৃন্দ। পালাল যাজকগণ।
কোন মতে জনা দুয়েক দাসকে জবরদস্তি আটকে রাখলেন রাজ বৈদ্য। যাঁর পোশাকী নাম ডাক্তার। এই রোগের কোন সম্ভাব্য চিকিৎসা তিনিও জানেন না। শুধু শুনেছেন শরীর থেকে বদরক্ত যদি বের করে দেওয়া যায় হয়তো প্রাণে বাঁচতে পারে রোগী। যুবরাজের শরীরে ভোঁতা পেরেকের মত যন্ত্র হাতুড়ি দিয়ে ঠুকে ঠুকে রক্ত বার করতে লাগলেন ডাক্তারবাবু। পাশ থেকে গোঙানির সুরে অনুরোধ করলেন যুবরাণী,“ডাক্তারবাবু, আমাকে বাঁচান। আর সহ্য হচ্ছে না এ যাতনা। ডাক্তার নির্বিকার। তাঁর ওপর নির্দেশ আগে বাঁচাতে হবে যুবরাজকে। ভিনদেশী রাজকুমারী বাঁচল না মরল তাতে এই মুহূর্তে কিস্যু যায় আসে না এই রাজ্যের রাজারাণীর। বরং ঐ অশুভ মেয়ে মরে গেলেই তো ভালো। বিনা চিকিৎসায় পড়ে রইলেন যুবরাণী। ভরসা শুধু প্রার্থনা। , দিগ্বিজয়ী  সম্রাটের আদরের আত্মজা, এতবড় রাজ্যের হবু রাণীর ভরসা শুধুই ঈশ্বর।
যে বদরক্ত যুবরাজের দেহ থেকে অতি যাতনায়, অতি কষ্টে  বার করতে হল, তা এমনিই অঝোরে ঝরে গেল সদ্য রজঃস্বলা তরুণীর দেহ থেকে। ফলে দেশ জুড়ে যখন মড়ক, জনশূণ্য হয়ে পড়ছে পল্লীর পর পল্লী, গণচিতায় আগুন দেবার লোক নেই, তারই মধ্যে আশ্চর্য ভাবে বেঁচে উঠলে যুবরাণী। বাঁচলেন না শুধু যুবরাজ। বিয়ের ভোজ হজম হবার আগেই বিধবা হলেন যুবরাণী।
(চলবে)
©Anindita  Bhattacharya
এক যে ছিল কন্যা- ২
প্রথম বৈধব্যের অনুভূতি কেমন, আজ যদি এ প্রশ্ন করেন, তবে সেদিনের সেই অ-শোকাতুরা বালিকার কথা ভেবে ভয়ানক লজ্জা পাবে এই মধ্যবয়সী রাজরাজেশ্বরী। না সেদিনের সেই বালিকা নিজের সদ্য মৃত স্বামীর কথা ভেবে ছিটেফোঁটাও চোখের জল ফেলেনি।যদিও আজ বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। সেদিনে সেই দুর্গে বর্তমান থাকা সকল সহচর-সহচরী, দাসদাসী প্রত্যক্ষ করেছিল সদ্যবিধবা যুবরাণীর মর্মান্তিক শোক। হাপুস নয়নে কেঁদে গেছে যুবরাণী,সকলে ভেবেছে হয়তো সদ্য মৃত যুবরাজের জন্য, আসলে সে কান্না ছিল কোন ছোটবেলায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মায়ের জন্য। অসুস্থ অবস্থায় মায়ের কথা বড় মনে পড়ত মেয়েটির।
কাল অবধি যে ছিল সকলের নয়নের মণি, দেশের হবু রাণী, যুবরাজের মৃত্যু পলকে যেন তাকে করে তুলল চোখের বালি। তদানিন্তন রাণীমা তো মুখদর্শনেও সম্মত হলেন না হতভাগ্য বিধবা পুত্রবধূর। বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে অলক্ষ্মী কন্যাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল, রাজধানী থেকে বহুদূরে এক অনামা অখ্যাত দুর্গে। নামমাত্র পরিচারক আর গোটা চারেক সহচরী সমেত। সহচরীরা সকলেই রাজকন্যার সাথে এদেশে এসেছিল। সকলেই  হয় অভিজাত পরিবারের অনুঢ়া কন্যা অথবা কোন ধনী বণিকের দুহিতা। মূল লক্ষ্য ভালো বর যোগাড় করে,পরিবারের মুখোজ্জ্বল করা। মুস্কিল হচ্ছে ভালো বর পেতে হলে রাজধানী তথা রাজপ্রাসাদে থাকা বাধ্যতামূলক। তবেই না এদেশের অভিজাত জমিদার বা তাদের পুত্রদের সাথে মোলাকাৎ হবে। অভাগিনী সখীর সাথে সাথে তাদেরও নির্বাসন দেওয়া হল।
তিনদিকে ঘন সবুজ মাঠ আর আঙুর বাগিচা আর একদিকে গাঢ় নীল সমুদ্র, মাঝে কে জানে কত শত বছরের পুরানো সেই দুর্গ। জায়গায় জায়গায় বিশাল ফাটল,শিকড় মেলতে চায় মহীরুহ, খোদ রাজকুমারীর ঘরের ছাদই ফুটো। বৃষ্টি নামলে পাঁচ সখী দৌড়ত রন্ধনশালা থেকে হাঁড়িপাতিল আনতে। দুর্গে প্রহরী বলতে জনা পঁচিশেক রাজ সৈন্য। যাদের কেউ কেউ বেশ সুদর্শন ছিল। সাগরের ঝড়ো হাওয়ায় দপদপ করতে থাকা মোমবাতির আলোয় আলোকিত দুর্গের আলোআঁধারি যেন ছিল কোন রূপকথা। রাতের পর রাত জেগে সমুদ্রের ঢেউ গোণা দেখত কন্যা। ভোর রাতে চিঠি লিখতে বসত পিতামাতাকে। বয়ান মোটামুটি এক,“আমি ফিরে যেতে চাই। আমায় দয়া করে কাছে টেনে নাও মা। কতদিন তোমায় দেখিনি। কতদিন তোমার গায়ের গন্ধ শুঁকিনি মা-। ” নিজ হাতে গালা গলিয়ে সিল করত সে চিঠি। তারপর গভীর ক্লান্তিতে তলিয়ে যেত ঘুমে, স্বপ্নে আসত মা- জাহাজ থেকে নামত কন্যা নিজ দেশে, স্বদেশের সমুদ্রের লবণাক্ত হাওয়ায় প্রাণ ভরে শ্বাস নিত কন্যা।
হতভাগী জানত না,যে একটি পত্রও সাগর পেরোয় না। প্রতিটি চিঠি খুলে পড়ত একজন, তার নাম, ধরে নেওয়া যাক উলযি। রাজার মুখ্য পরামর্শদাতা। উলযির রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ছিল অসাধারণ, প্রতিবেশী দেশের মহাক্ষমতাধর সম্রাটের কন্যাকে এভাবে ফেরত পাঠানো যে এই দেশ তথা এই মহাদেশের জন্য আদৌ শুভ পরিণাম বহন করবে না, তা বুঝতে উলযির বাকি ছিল না। যদিও তৎকালীন রাণীমা মনেপ্রাণে চাইতেন প্রতিবেশী কন্যাকে পত্রপাঠ স্বদেশে পাঠাতে, নাগাড়ে বাধা দিতেন উলযি। একদিকে রাণীর জেদ অপরদিকে উলযির দূরদর্শিতায় নাজেহাল অবস্থা রাজার। উলযিই পরামর্শ দিলেন,“মহারাজ যাকে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য খাতির করে এদেশে এনেছেন,তাকে এভাবে নিষ্ফলা ফেরত পাঠাবেন না। ” “তাহলে কি করি?” হতাশ এবং বিরক্ত স্বরে বলে উঠলেন রাজা,“যুবরাজের সাথে বিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি তো পালন করেছি আমরা, কিন্তু সেই যখন নেই, তখন কি করি বলো তো?” রাজার বিরক্তি শেষের দিকে মৃদু গর্জনে পরিণত হলেও ভয় পেলেন না উলযি,“মহারাজ, অপরাধ মার্জনা করবেন,যুবরাজের আসন তো শূণ্য নেই, তাহলে যুবরাণী কেন-”। রাজার কুঞ্চিত ভ্রুর খাঁজ আরো গভীর হল,“কি বলতে চাও উলযি?আমার দ্বিতীয় পুত্রের সাথেও বিয়ে দেব ঐ মেয়ের?রাণী মানবেন?” উলযি বাঁকা হেসে বললেন,“মহারাজ-। ”
রাণী মানলেন কি মানলেন না,তাতে রাজামশাই কর্ণপাত করলেন না। ডেকে পাঠালেন নতুন যুবরাজকে,বয়সে কন্যার থেকে বছর পাঁচেকের ছোট, কন্যা যখন বাগদত্তা হয়ে এদেশে আসেন নতুন যুবরাজ তখন মাতৃক্রোড়ে,মুখে বুলি ফোটেনি। একসাথেই বড় হয়েছেন দুজনে,দুজনের সখ্যতাও ছিল গভীর। অবশ্য জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যুর পর বিগত কয়েক বছরে আর দেখাসাক্ষাৎ হয়নি দুজনার। এই যুবরাজ বড় একরোখা,বড় জেদী,বড় বেশী সুদর্শন, বড় বেশী রঙ্গিলা। অভিজাত পরিবারের অনুঢ়া এবং স্বল্পবয়সী বিবাহিত রমণীরা ছেঁকে থাকে এই যুবরাজকে। যোগ্যসঙ্গত করেন যুবরাজও। কন্যার সাথে বিবাহের প্রস্তাব এক কথায় খারিজ করে দিলেন তিনি। “পাগল নাকি? আজ যে যুবরাণী,কাল সে রাণী হবে, আর রাণী হবার প্রথম শর্তই হল অক্ষত যোনি হয়ে বাসরে প্রবেশ- আর এক্ষেত্রে-”। এক্ষেত্রে কি বুঝলেন রাজা, বুঝলেন উলযিও।

কিছু জানল না,বুঝল না শুধু কন্যা। রাজধানী থেকে বহুদূরে  প্রাসাদ আর আঙুরক্ষেত  আর সমুদ্র নিয়ে যার দিন কাটছিল মহানন্দে। প্রতিদিন সূর্যোদয়ের সাথে সাথে, একাকী কন্যা আঙুর ক্ষেত টপকে হেঁটে যেত দূরে গ্রামের মধ্যে এক ছোট্ট গির্জায়। যেখানে একাকী যিশু দুহাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকতেন রক্তাক্ত ক্রুশে। পুবে লালনীল কাঁচের জানলা গলে আসা প্রথম সূর্যের আলো চুম্বন করত তাঁর চরণ যুগল। একাকী প্রার্থনা করত কন্যা,হাতের জপমালা ঘুরে যেত অবিশ্রাম,ওষ্ঠে কাতর ফিসফিস অনুরোধ,“আমায় ফিরিয়ে নাও প্রভু। আমি নিজের দেশে ফিরতে চাই। ” সেদিনও বিড়বিড় করে তাই বলছিল কন্যা, বেলা হয়েছে অথচ সূর্যের মুখ ডেকেছে গাঢ় মেঘ আর কুয়াশা। আচমকা কে যেন পিছন থেকে বলে উঠল,“তুমি কোনদিনই আর স্বদেশে ফিরতে পারবে না। ”হকচকিয়ে উঠল কন্যা,“কে?কার এত সাহস?” যিশুর পিছন থেকে বেরিয়ে এল এক অল্পবয়সী যুবা,পরনে যাজকের পোশাক, দুই চোখে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি,“আমি জানি। আমি জানি। একদিন তোমার জন্যই পুড়ে মরব আমি। উঃ আঃ জ্বলে গেলুম-হে ঈশ্বর”বলে আর্তনাদ করতে করতে দৌড়ে গির্জা ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে। হতচকিত  কন্যার বুক ধড়ফড়ানি কমলে ধীরে ধীরে দুর্গে ফিরে এল,পথে প্রতিজ্ঞা করল, আর কোনদিন একা যাবে না। দুজন প্রহরী সঙ্গে থাকলে হয়তো এমনটা হত না। দুর্গে প্রবেশ করা মাত্র দৌড়ে এল সখীরা,“রাজকন্যা, পত্র এসেছে। দেশ থেকে পত্র এসেছে। ” এতদিন-এত বছর পর-আনন্দে নেচে উঠল কন্যার প্রাণ।
(চলবে)
©Anindita Bhattacharya

Sunday 30 September 2018

পরকীয়া ২


কাল বনধ ছিল বলেই হয়তো আজ আউটডোরে মারাত্মক চাপ, পিলপিল করছে পেশেন্ট, সকাল থেকে দম নেবার ফুরসৎ নেই তাপসের। ইন্টারনেটের মাহাত্ম্যে সবাই আজকাল আধা ডাক্তার, বিনা বাক্যে ডাক্তারের নির্দেশ মানতে তাদের ঘোর অনীহা, গণ্ডা খানেক প্রশ্নের জবাব দিয়েও কোন পেশেন্ট পার্টিকে আজকাল সন্তুষ্ট করতে পারে না তাপস। মোটামুটি বেলা আড়াইটে নাগাদ ঘর ফাঁকা হতে, মোবাইল চেক করার টাইম পেল, গুচ্ছ খানেক ফোন, যার মধ্যে একটা মেঘার। তাপসের কপালে ভাঁজ পড়ল, হাসপাতালে থাকলে সাধারণত ফোন করে না মেঘা, আসলে ভাবতে যতই বুক টনটন করুক না কেন, বিনা প্রয়োজনে কখনও ফোন করে না মেঘা। বিয়ের পর তাপসই করত, আজও করে, ফোন করে খোঁজ নেয়, “টিফিন খেয়েছ?” বা “কটায় ফিরলে?” মামুলী কেজো কথাবার্তা, গভীর প্রেমময় কথা আগে বলতে ইচ্ছে করত, তবে মেঘার ভয়ে, সেসব আর গলা দিয়ে বের হত না। পেটেই থেকে যেত, দুএকবার যাও বা বলছেন, মেঘার নিরাসক্তি শুধু ব্যথাই দিয়েছে তাপসকে। বিশ বছরের বিবাহিত জীবনে, মেঘাকে কখনও আবেগ বিহ্বল দেখেনি তাপস। বরাবরই কেমন যেন রুক্ষ, শুষ্ক, চূড়ান্ত যুক্তিবাদী অথচ ভয়ানক রহস্যময় মেঘা।
ফোনে রিং হচ্ছে, হাসপাতালের সোডা দিয়ে গামছা ফোটানো জল, ছোপ ধরা সাদা কাপে দিয়ে গেল পল্টু। এটা নাকি পল্টুর স্পেশাল চা। চায়ে চুমুক দিয়ে, তাপস বলল, “বলো, ফোন করেছিলে, সব ঠিক আছে তো?” মেঘা বোধহয় কিছু করছে, হাল্কা আনমনা গলায় বলল, “অভিনন্দন।“ মানে? তাপস কিছু বুঝল না। মেঘা আবার বলল, “খবর পাওনি বুঝি? আদালত তোমাদের ব্যাপারটাকে আইনসিদ্ধ ঘোষণা করেছে।“ তাপসের  মাথায় কিছুই ঢুকছে না। ব্যাপার কি? মেঘার এই হেঁয়ালি গুলো চিরদিনই ওকে বেকুব প্রমাণ করে। মেঘা অত্যন্ত আপডেটেড, সোশ্যাল মিডিয়ায় অত্যন্ত অ্যাক্টিভ, না না সামাজিক ইস্যুতে ভয়ানক সরব। নিয়মিত লেখালিখি করে, সামাজিক মাধ্যমে। আর তাপস? পেশার চাহিদা মেটাতে মেডিক্যাল জার্নাল আর হৃদয়ের চাহিদা মেটাতে চটুল হিন্দি গান এর বাইরে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তাপসের চূড়ান্ত আলস্য তথা অনীহা। হাই চেপে তাপস বলল, “ব্যাপারটা কি বলবে?”” পরকীয়া আইনসিদ্ধ হল আজ থেকে। কেন ঋষভ ফোন করেনি বুঝি?” মেঘার গলার শ্লেষ, যেন গরম সীসা ঢেলে দিল তাপসের কানে।
“ঋষভ” কতদিন বাদে এই নামটা শুনল। বছর দশেক আগে ঋষভের সাথে প্রথম আলাপ, অংশুমানের পার্টিতে। কি কুক্ষণে যে হঠাৎ দেখা হয়ে ছিল অংশুর সাথে। মেডিক্যালে চান্স পাবার আগে, এক বছর সাইন্স নিয়ে পাশ কোর্সে কলেজে ভর্তি হয়েছিল তাপস। সেখানেই অংশুর সাথে আলাপ এবং বন্ধুত্ব। অংশু উত্তর কলকাতার বিশাল অভিজাত বাড়ির ছেলে।অতীব সুদর্শন। অংশু ছিল স্বঘোষিত সমকামী।তখন অবশ্য তাপস ভাবত, বড়লোকের বকাটে ছেলের উটকো বদ খেয়াল। সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে যাবে। দীর্ঘ সতেরো বছর বাদে কি যেন সেমিনারে আবার অংশুর সাথে দেখা।অংশু ততদিনে নামী কলেজের দামী অধ্যাপক। তার সাথে সাথে সমকামী আন্দোলনের এক বড় নেতাও বটে। সেমিনার শেষে অংশুই পাকড়াও করে নিয়ে গেল, ওর বাড়িতেই মিটিং ছিল। অনেকের সাথে আলাপ হল। ব্যাপারটা কি রকম অবিশ্বাস্য লাগছিল তাপসের, এরা সকলেই পুরুষ, অনেকেই সুদর্শন, সুঠাম দেহী, অথচ এদের নারী দেহের প্রতি কোন আকর্ষণ নেই? একজন পুরুষ, কিভাবে আর একজন পুরুষকে কামনা করতে পারে? মনে জাগছিল অনেক প্রশ্ন, কিন্তু কাউকে বলার সাহস হয়নি, ঋষভ ছাড়া। ঋষভ গাঙ্গুলী, মাঝারী দোহারা চেহারা, গালে কায়দা করা দাড়ি, পাজামা-পাঞ্জাবী, কাঁধে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ, বয়সে বছর দশেকের ছোটই হবে তাপসের থেকে। ছোট খাটো কবি, লিটল ম্যাগাজিন বার করত একটা, নাম “উন্মেষ”।তাপস ভেবেছিল নির্ঘাত ভয়ানক আঁতেল। এর সাথে মেঘার ভালো জমতে পারে, ঈশ্বরের দিব্যি এই কথাটাই সেদিন ভেবেছিল তাপস। বেশ খানিকক্ষণ গল্প করেছিল দুজনে সেদিন, কারো সাথে কথা বলে এত নির্ভার কোনদিন বোধ হয়নি তাপসের। ভীষণ প্রানবন্ত ছেলে ছিল ঋষভ। 
তারপর কথা হত মাঝে সাঝে। আর রোজ মেসেজ চালাচালি। মামুলী কথা। অপ্রকাশিত কবিতা পড়তে দিত ঋষভ মেসেজ করে। মতামত চাইত। মেঘার সাথে বিবাহিত সম্পর্ক তখনও বেশ জটিল ছিল। মেঘার গুরুগম্ভীর ব্যক্তিত্বের চাপে হাঁসফাঁস করত তাপস সেদিনও, তবে খুলে বলতে পারেনি কাউকে ঋষভ ছাড়া। তারপর এল সেইদিন, ভালোবাসার দিন।প্রেমের প্লাবনে ভেসে গেল মহানগরী। হাসপাতালে যথাবিহিত রোগী নিয়ে নাস্তানাবুদ তাপসের, খেয়ালই ছিল না এসব। আচমকা ঋষভের মেসেজ দিল সব ঘেঁটে। খুব সহজ সরল, অনাড়ম্বর ভাষায় লিখেছিল ঋষভ, তার মনের কথা।“ প্রথম দর্শনে প্রেম নয়, দীর্ঘ সাত আট মাস ধরে যত  তোমায় জেনেছি, ততোই গভীর ভাবে অনুভূত হয়েছে প্রেম। জানি তুমি বিবাহিত, বউ একটু গম্ভীর দিদিমণি প্রকৃতির,মনেপ্রাণে চাই তোমরা সুখে থাকো।তোমাদের বিবাহিত জীবন হোক নিরুপদ্রব।শুধু নিজেকে বড় বঞ্চিত বোধ হয় আজকাল।“
দীর্ঘক্ষণ থম মেরে বসেছিল তাপস সেদিন। ঋষভের প্রতি ওরও অব্যক্ত ভালোলাগা কোথাও না কোথাও ছিল, তবে ব্যাপারটা এদিকে গড়াতে পারে, তাপস স্বপ্নেও ভাবেনি। সচেতন ভাবে তো ও কোনদিন ঋষভকে কোন আশা দেয়নি, তাহলে? টাইপ করতে গিয়ে তাপসের হৃদয় সেদিন ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল, তবু ও লিখেছিল, “ঋষভ আমি বিবাহিত। আশা করব, আজকের পর আমাদের আর কখনও দেখা হবে না। ভবিষ্যতে আমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা নিষ্প্রয়োজন।“ কি ভাবে যেন মেঘার চোখে পড়ে যায় দুজনের এই মেসেজ চালাচালি। তাপসের অনুমতি নিয়েই ওর ফোনে হাত দিয়েছিল মেঘা, কাকে যেন ফোন করার ছিল, সেখান থেকেই মহিলা সুলভ অনুসন্ধিৎসায় ইনবক্স খুলেছিল মেঘা-
বিগত দশ বছরে, অন্তত দশলক্ষ বার বলেছে মেঘা, “তুমি আমার জীবন বরবাদ করে দিয়েছো।“ কিভাবে সেটা তাপস আজও বুঝে উঠতে পারেনি যদিও। মেঘার প্রশ্নের উত্তরে একটিও মিথ্যা বলেনি তাপস, আজ পর্যন্ত বলেনি। মেঘার চিৎকার- চেঁচামিচি, হিস্টিরিয়া মুখ বুঝে সয়ে গেছে। শুধু বার বার বলতে চেষ্টা করেছে, "“মেঘা, তুমি ছাড়া আমার কারো সাথে কখনও কোন সম্পর্ক ছিল না।“ প্রতিবারই চতুর চূড়ামণি, মহাধান্ধাবাজ মিথ্যাবাদীর শিরোনামে ভূষিত করেছে মেঘা। তাপসের বৃদ্ধ বাবা-মা বোন, শ্বশুর শাশুড়ি সবার সামনে অসংখ্য বার তাপসকে লোচ্চা ঘিনঘিনে সমকামী প্রমাণ করেছে মেঘা। এমনকি মেঘা এবং তাপসের বাবা-মা ষড়যন্ত্র করে একজন সমকামী পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে মেঘার জীবন বরবাদ করেছে এ অভিযোগও করতে ছাড়েনি মেঘা। কি সৌভাগ্য একমাত্র কন্যা রিয়ার সামনে কখনও এই প্রসঙ্গ তোলেনি মেঘা। প্রতিবারই তাপসের নিজেকে অপরাধী মনে হয়েছে, ঈশ, ওরই উচিৎ হয়নি, ঋষভ সমকামী জেনেও ওর সাথে গভীর ভাবে মেলামেশা করার।দশ বছর ধরে একটা  ঋষভ না থেকেও রয়ে গেছে দুজনের মধ্যে,মাঝে মাঝে নিজেকে মেঘার পোষ্য সারমেয় বলে ভ্রম হয় আজকাল তাপসের।
আর ভালো লাগে না, বিনা দোষে অপরাধী হতে আর ভালো লাগে না তাপসের, বড্ড ক্লান্ত লাগে আজকাল।মাঝে মাঝে তীব্র ক্রোধ হয়, বিনা অপরাধেই যদি হাজতবাস হয়, তাহলে অপরাধ করে হাজতবাস করাই তো ভালো। সেবারে যাদের সক্রিয় সমর্থন পেয়েছিল মেঘা, আজ তারা সকলেই হয় অথর্ব না হলে মেঘার ওপর বিরক্ত।  আর যদি তারা মেঘাকে সমর্থনও করে, তাতেই বা কি? ডঃ তাপস চৌধুরী কি কাউকে ডরায়? সামাজিক মিডিয়ার দৌলতে কি আজকাল কেউ কারো জীবন থেকে হারিয়ে যায় নাকি? মেঘা কি ভেবেছে? ঋষভকে তাপস খুঁজে বার করেছে বহুদিন, বহুবার নিশপিশ করেছে আঙুল, বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেবার জন্য। তীব্র অপরাধ বোধে কতবার যে ফেসবুক ডিঅ্যাক্টভেট করে দিয়েছে তাপস, আজ আর করবে না।এই তো ঋষভ, সেই দাড়ি, সেই পাজামা-পাঞ্জাবী, সেই হাসি। “অ্যাড ফ্রেন্ড” বোতাম থেকে কয়েক মিলিমিটার দূরে তাপসের আঙুল---।
“হেলো মেঘা। রাগ করেছো? কেন? আদালতের সিদ্ধান্তকে কি আমি অনুপ্রাণিত করেছি বলতে চাও? কে ঋষভ? কবেকার পচাগলা কেস তুলে নিয়ে এসে ঝামেলা পাকাও। সহ্যের ও তো একটা সীমা আছে। এরপর কোনদিন যদি এই নিয়ে আমায় উত্যক্ত করেছো আমি কিন্তু সত্যি সত্যি ঋষভের কাছে চলে যাব।“ কড়ায় খুন্তি নাড়তে নাড়তে ভেঙিয়ে উঠল মেঘা, “যে চুলোয় পারো যাও,খালি আজ দয়া করে বাড়ি ফিরো। দেশী মুর্গি রাঁধছি, তোমার জন্য। দয়া করে সময়মত পায়ের ধুলো দেবেন ডাক্তারবাবু।“ হেসে ফোনটা পকেটে ঢোকালো তাপ্স।রাউন্ডে যাবার সময় হল, ঋষভের সাথে বন্ধুত্বটা আর করা হল না আজকের মত। থাক। যেমন আছে থাক, একমুঠো কাঁঠালি চাঁপার মত বুকের ভিতর ঋষভের স্মৃতির মৃদু সৌরভ নিয়ে রাউন্ডে চললেন ডঃ তাপস চৌধুরী।
©Anindita Bhattacharya ©Anindita's  Blog

Friday 28 September 2018

মধ্যমেধার মধ্যবিত্তের রোজনামচা

মধ্যমেধার মধ্যবিত্তের রোজনামচা ১৩ই নভেম্বর,২০১৮। ছটপুজার পূণ্যলগ্নে-

ইটালী আর পূর্ণাপাণি। বরযাত্রী আসবে সি প্লেনে। ধরবে তাতে ১৪ জন।কি তাজ্জব ব্যাপার দেখুন দুই সপ্তাহে মারা গেছে বেশী না,মাত্র ১৪জন।
তো যা বলছিলাম আর কি, ফিরে চলুন ইটালীতে, এত্ত বড় বিয়েয় অথিতি মাত্র ১৪জন? তাও আবার হয় নাকি হে? বাকিদের জন্য রইল বিলাসবহুল প্রমোদতরী। এদিকে পূর্ণাপানি,নামটা দারুণ, আগে তো কিছুই ছিল না। এখন দেখুন-  বসতবাড়ি,চাষের জমি, ইলেকট্রিসিটি থেকে অবৈতনিক স্কুল। অভাব শুধু নজরদারি। তাহলে বলি শুনুন,লোকগুলো তেমন সুবিধের না। যা পায়, সব বেচে খায়। মদ খায় না,মদই খায় মানুষগুলোয়,বুঝলেন কি না।
তরচেয়ে চলুন ইটালী যাই। বর-বউয়ের পোশাকআশাক,মস্তবড় ডিজাইনারের ব্যস্ততা যে চূড়ান্ত, রঙমিলান্তি সাজেগোজে চকমকাবে বাবুবিবি। আহাঃ যেন তাসের দেশ।বলতে ভুলে গেছি সেই মেয়েটা শুনি আর স্কুলে আসে না। নানা ইটালী নয় খাস কলকাতা। কতই বা বয়স,বছর ছয়েক। এরই মধ্যে এতকিছু, শুনছি মাস্টারটা জামিন পেল। ছাড়ুন শুধু ছুটির দিনে অকারণে বিষণ্ণতা আর মনখারাপ।
ইটালীতে সুইজারল্যাণ্ডের  শেফের সাথে চুক্তি হল,সব পদই হতে হবে আনকোরা। অন্য কোথাও রাঁধলে পরেই পরতে হবে হাতকড়া। অথিতিদের জন্য শুনি নিখাদ সোনার কাটলারি- অন্যকোথাও মেয়ে হলেই মারধর আর গাজোয়ারি।পাঁচের পাতায় সাতের কলম,পড়েছেন নাকি বাবুবিবিরা। প্রথম সন্তান মেয়ে হলে পণ চাওয়া হল লক্ষ দুই। জামাইয়ের পেশা দীনমজুরী, তবে সাকিন খাস  দুবাই। দ্বিতীয়বারে চাপ ছিল খুব, ছেলেই চাই,দিতে হবে না বংশে বাতি? বেচারা মা ডাহা ফেল। আবার যখন মেয়েই হল, দাবী বেড়ে হল পাঁচ লাখ। বাঃ স্ত্রী কন্যাদের আজীবন ভরণপোষণ, এটুকু তো দিতেই হবে। তারওপর বিয়েশাদি। লাখ পাঁচেক আর এমন কি? মেয়ের বাড়ি বোধহয় আর পারেনি, পরিণামে মারধর আর শ্বাসরোধ। গলা টিপেও, নাঃ মরেনি। মায়ের জান। তবে আহত বেশ গুরুতর।আপাততঃ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।আচ্ছা হাসপাতালে কি কাগজ পাবে? পেলে নির্ঘাত সেও পড়ছে, কত দফায় বিয়ে হবে,হরেক প্রথায় অনুষ্ঠান।তারওপর বম্বে আর বেঙ্গালুরু,রেডি ফর জমকালো রিশেপসন।
©Anindita Bhattacharya
মধ্যমেধার মধ্যবিত্তের রোজনামচা- 30.09.18

সকাল থেকে ধস্তাধস্তি  চলছে মা আর মেয়ের। কাল পরীক্ষা,মায়ের দৃঢ় বিশ্বাস মেয়ে হলদিরামের লাড্ডু পাবে। মেয়ে একটু ভাবুক প্রকৃতির,লিখতে পড়তে গেলেই মাথায় বিশ্ব সংসারের ভাবনা চিন্তা গজগজ করে ওঠে। যেমন আজ বলছিল,“বইয়ের পাতা গুলো কচকচিয়ে চিবিয়ে খেয়ে নিতে পারলে কেমন হত। বই খেতাম আর খাতায় গিয়ে-”। রবি ঠাকুরের তোতা কাহিনী মনে পড়ে গেল।

অশান্তির পারদ চড়ছে দেখে বাবা গৃহত্যাগ করল,নাহলে দুপক্ষই অবলা পুরুষটিকে ধরে টানাটানি করবে যে। এসব ক্ষেত্রে বাবা অবশ্য প্রকট ভাবে কন্যাকে সমর্থন করে,তবে দিদিমণি রূপে গিন্নীকে সাংঘাতিক ডরায়। এগারোটা নাগাদ তুত্তুরী ঘোষণা করল,“আর পড়তে পারব না।” তারপরই আব্দার,“আজ আর মাছের ঝোল ভাত খাব না। আজ স্পেশাল কিছু বানাও। ”স্পেশাল বানানোই যেত,তবে তার জন্য প্রস্তুতি লাগত সকাল থেকে। বেলা দেড়টা এবাড়ির স্টান্ডার্ড লাঞ্চ টাইম। সাড়ে বারোটা থেকেই আমার বর আর মেয়ে হ্যাংলা বেড়ালের মত রান্নাঘরের রাউণ্ড দেওয়া শুরু করে। হাঁড়িকুড়ি হাটকে দেখে কি রান্না হল। সত্যিই তো,চাকুরীজীবি পরিবারের রবিবার, বাবা বলত,“সারা সপ্তাহ গিলি। আর রবিবার খাই। ”

অগত্যা, কি বানাই? ঘরে মাছ ছিল দুরকমের। চটজলদি তিনপিস ভেটকি মাছকে হলুদ, নুন,লেবুর রস আর অল্প লঙ্কাগুঁড়ো মাখিয়ে জরতে দিলাম। এবার শিলনোড়ার পালা। দুচামচ সর্ষে আর এক চামচ পোস্ত বাটা হল। মা শিখিয়েছিল সর্ষে বাটার সময় নুন দিয়ে বাটলে নাকি তেতো হয় না। তাই নুন দিয়েই বাটলাম শুকনো শুকনো করে। এবার জরানো ভেটকীর গায়ে মাখিয়ে ,পরিমাণ মত সর্ষের তেল আর গোটা তিনেক চেরা কাঁচা লঙ্কা সহ অ্যালুমিনিয়ামের টিফিন বক্সে সাজালাম। আর একটা জিনিস দিলাম হাফ চামচ মাদার ডেয়ারির মিষ্টি দই। ভালো করে মিশিয়ে শুকনো প্রেশার কুকারে নুন দিয়ে বিছানা পেতে তার ওপর বসিয়ে দিলাম কৌটো টাকে। ওয়েট লাগালাম না। গ্যাস থাকল সিমে।  আধ ঘন্টা চল্লিশ মিনিটের মধ্যেই ভুরভুর করে ভাপা ভেটকীর গন্ধ বেরোতে লাগল। পুঁচকেটা একবার ভাববাচ্যে জিজ্ঞাসা করল,“কি রান্না হচ্ছে আজকে?” বুঝলাম সকালের অভিমান এখনও কাটেনি।

তাহলে তুত্তুরী প্রিয়পদ হয়ে যাক-মুড়িঘন্ট।মুঠি দুয়েক আতপচাল ভিজিয়ে দিলাম বাটিতে। ছোট ছোট টুকরোয় কেটে নিলাম একটা গোব্দা আলু। একটা ধেড়ে আর একটা খুদে পেঁয়াজ কাটা হল ঝিরিঝিরি করে। পেতে রাখা শিলে এবার পালা রসুন আর আদা বাটার। সব ঝপাঝপ রেডি করে এবার কড়ায় তেল দিয়ে ভাজতে দিলাম নুন হলুদ মাখানো চালানী কাতলার বিকট মাথা। এতক্ষণে তুত্তুরীর পিতা প্রভাতফেরী সেরে ঘর্মাক্ত কলেবরে বাড়ি ফিরেছেন। এসেই রান্নাঘরে উঁকি,পিছন পিছন ছানা বেড়ালের মত ঢুকতে এল তুত্তুরী,সর্বনাশ সারপ্রাইজ নষ্ট হয়ে যাবে তো। ভাববাচ্যে তাই গলায় ভয় মিশিয়ে বললাম,“কাতলার মাথাটা কিন্তু এখনই ফাটবে। কারো ফোস্কা পড়লে আমি দায়ী নই। ” ব্যাস ময়দান ফাঁকা।
ভাজার সাথে সাথেই একটু থেতলে দিলাম মুড়োটাকে,যাতে ভেঙে ভেঙে যায়। প্রকাণ্ড ঘিলু সমেত মাথা দেখতে ভালো হলেও খেতে ভালো লাগে না মোটেই। ভাজা ভাজা হয়ে এলে,তুলে রেখে ঐ তেলেই একটা তেজপাতা,গোটা দুয়েক শুকনো লঙ্কা,আইসক্রীমের চামচের একচামচ জিরে, দুতিনটি লবঙ্গ, দারুচিনির টুকরো আর দুটি ছোট এলাচ ফোড়ন দিয়ে প্রথমে আলু অতঃপর পেঁয়াজ দিলাম।  নুন হলুদ দিয়ে ভাজা ভাজা করে টমেটো কুচি দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কসার পর আদা রসুন বাটা আর অল্প লঙ্কাগুঁড়ো মেশালাম। কসতে কসতে তেল ছাড়লে ভেজা আতপ চালের পালা। চাল মিশিয়েও আমি কিছুটা ভেজেনি। যখন ভালোমত ভাজা হয়ে আসবে তখন মিষ্টি দিয়ে জল ঢেলে দেওয়া। চাল অর্ধসিদ্ধ হয়ে এলে মাছের মাথার টুকরো গুলো মিশিয়ে ঢাকা দিয়ে সিমে বসিয়ে রাখা। শেষে জল মরে গেলে নুন মিষ্টি চেখে দেখে আধ চামচ ঘি মিশিয়ে ঢাকা দিয়ে রাখা। একটু ঝুরো ঝুরো হবে। খেয়াল রাখবেন চাল যেন গলে না যায়। আর চাল যেন খুব বেশীও না হয়। মুড়িঘন্ট কখনই বিরিয়ানি তুল্য নয়।
পরিশেষে ওলের বড়া। ওল শৌভিকের প্রিয় সবজি। আমাদের বাড়িতে বারো মাস, অফিসের দিনগুলিতে হয় ওল সিদ্ধ হয়, নাহলে উচ্ছে সিদ্ধ।  সিদ্ধ ওলে ঘেন্না ধরে গেল মাইরি। ওলের বড়া আমার শাশুড়ী মায়ের রেসিপি। ওলকে হাল্কা সিদ্ধ করে, কাঁটা চামচ দিয়ে থেতলে,পরিমাণ মত নুন,মিষ্টি, কাঁচা লঙ্কা কুচি, দুএক চিমটি বেকিং পাউডার, কর্নফ্লাওয়ার, অল্প আটা আর একটা ডিম মিশিয়ে ভালো করে ফেটিয়ে চ্যাপ্টা বড়ার আকারে ভাজা। ছোট গোল গোল করেও ভাজতে পারেন। দেখতে ভালো লাগে। তবে সেক্ষেত্রে আমার সংখ্যা অনেক বেশী হত,আর আমার স্বাস্থ্যসচেতন বর দুটির বেশী ভাজা খাবেন না,অগত্যা বড় বড় আর চ্যাপ্টা করে ভাজা।

খেতে বসতে বসতে পৌনে দুটো বাজল। খেয়ে উঠে অবশ্য বাপ-মেয়ে দুজনে সম্মিলিতভাবে  বাবারে-মারে করছিল। প্রচুর খাওয়া হয়ে গেছে। আর জল খাবারও জায়গা নেই,  ইত্যাদি আরকি।  এই না হলে মধ্যবিত্ত বাঙালির রবিবার।

মধ্যমেধার মধ্যবিত্তের রোজনামচা- 28/09/18

ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষা দিতে গেছি,পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ভিতরের রেলিংএ ঠেস দিয়ে দুই সখীতে শেষ মুহূর্তের জন্য বইগুলোকে আত্মস্থ করার চেষ্টা করছি, সামনেই বিয়ে, আর লিখে দিতে পারি বিয়ের পর শতকরা পঞ্চাশ ভাগ বাঙালিনীর মতই আর কোন পরীক্ষায়ই পাশ করা এই অধমের কম্ম নয়। আচমকা  মাথায় এক চাঁটি। কে রে?নেহাত পিএসসি, আসেপাশে গম্ভীর মুখে বিভিন্ন সার্ভিসের লোকজন অধ্যয়নরত তাই “শালা”টা কোনমতে গলদ্ধকরন করলাম। তাকিয়ে দেখি জনৈক সুহৃদ দন্তবিকাশপূর্বক দাঁড়িয়ে আছে। খিস্তি ছাড়া কোনদিন একে অপরকে সম্বোধন করিনি, আর সেক্সুয়াল হ্যারাজমেন্ট অ্যাক্ট তখনও কষ্টকল্পনা,তাই ভদ্র ভাষায় বললাম,“মারছিস কেন রে আপদটা। ” মারার কারণ অচীরেই বুঝলাম, হবু বরের প্ররোচনায় অরকূটে আগের রাতেই রিলেশনশিপ স্টেটাস কমিটেড করেছি। বিশদে বলতে হল কাকে বিয়ে করছি,কেন করছি,কোথায় থাকে। ভিআইপি শুনে বলল,“মালদার পার্টি ফাঁসিয়েছিস শালা। ” তো যাই হোক বেশ খানিক হাসাহাসির পর বলল,“শোন না, বিয়ের পর প্রথম পরকীয়াটা আমার সাথেই করিস কিন্তু। ” আহাঃ প্রথম পাওয়া প্রেম প্রস্তাবে এত পুলকিত হইনি, যত না প্রথম পরকীয়ার প্রস্তাবে হয়েছিলাম। পরীক্ষা দিয়ে উড়তে উড়তে সল্টলেক সিটি সেন্টার।  হবু বরকে বললাম, বিশদে। ভাবলাম খেপে টেপে যাবে, ওবাবা শৌভিক বলল,“ভালই তো। অ্যাপ্লিকেশন জমুক। সময় এলে দেখা যাবে।”

পরকীয়া নিয়ে যাবতীয় রসালো গপ্পের সঙ্গী আমার বর, আহা বৈবাহিক সম্পর্কে আবার লুকোছাপা কিসের মশাই।বিয়ের আগেই শৌভিক জানিয়ে দিয়েছিল,“আমার পরকীয়াতে একবিন্দু আপত্তি নেই। বরং বলিস আমিই খুঁজে দেব।” হ্যাঁ দেয় তো,না বলতেই দেয়, বাজারের মাছওলা,সিকিউরিটি গার্ড,হোঁৎকা হাতি মহাচোর অ্যাকাউন্টস্ অফিসার আর কত বলব। প্রসঙ্গতঃ এদের প্রত্যেকেরই ভয়ানক সুন্দরী বউ ছিল বা আছে। বিরক্ত হয়ে বছর পাঁচেক আগে বললাম,“থাক বাপ। তোকে আর খুঁজতে হবে না। তুই যে কার জন্য খুঁজিস আমার বুঝতে বাকি নেই। ” সেদিন কাদের যেন বলছিলাম,“সিরিয়ালসি মাইরি,আমি পরকীয়া করলে,আমার বরই বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে বাসে তুলে দিয়ে আসবে। এমনকি টিকিটও কেটে দেবে। ” তারা যদিও বলল,“পাগল নাকি?চিন্তা করিস না অনি,তোর বর বাসে তুলে দিলেও আমরা নামিয়ে আনব। ”

কাউকে রূপে বা গুণে আপনি যদি মোহিত হন, তাতে কি আদৌ কোন দোষ আছে?ঐ যে বলে না দিল তো বাচ্ছা হ্যায় জী। রীতি শৃঙ্খলের বাঁধনে আবার প্রেমকে চাপা দেওয়া যায় নাকি?এতো ধূপের ধোঁয়ার মত, যতই দরজা জানলা বন্ধ করে রাখুন,ব্যাপন পক্রিয়ায় সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়বেই। ভারতীয় বলে গর্ব বোধ করেন,নিজেদের ঐতিহ্যশালী সনাতনী সংস্কৃতি নিয়ে আত্মশ্লাঘায় ভোগেন আবার পরকীয়াকে খিস্তি মারেন? কি মাইরি আপনি? কৃষ্ণ করলে লীলা আর আমাদের যত দোষ?

দুটি পূর্ণবয়স্ক হৃদয়ের সম্মতিক্রমে যা ঘটে তা কি আদৌ অপরাধ হতে পারে?অনুগ্রহপূর্ক একে জমিদারদের রক্ষিতা রাখার সাথে তুলনা করবেন না। ব্যতিক্রম সর্বত্র বিরাজমান। আর বিয়ে না করে তো দয়া করে পরকীয়া নিয়ে কোন মন্তব্য করবেন না, ওসব আমরাও করতাম, জীবন ভীষণ জটিল জানেন তো,আর জগৎ জোড়া প্রেমের ফাঁস, পা দিলেই ধপাস। কবে কোথায় যে জীবন আপনার জন্য ফাঁস দিয়ে প্রতীক্ষারত,হয়তো আপনি জানেনই না। আরে ভাই কে জানে কঘন্টা আছে এই জীবনটা। আর যদি আপনি বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও আপনি দাবী করেন যে আপনার পরনারী বা পরপুরুষে ছিঁটেফোঁটাও উৎসাহ নেই,তাহলে দাদা/দিদি ব্যাপারটা আসলে ঠিক উল্টো নয় তো? ছাড়ুন তো,আপদ আঁতেল আর অশিক্ষিত গোভূতদের লুচির মত ফুলতে দিন। গলা খুলে গান, “তুঝকো ভি হ্যায় ইজাজৎ করলে তু ভি মুহাব্বত-। ”

©Anindita Bhattacharya