Thursday 10 September 2015

অপেক্ষা সেই মাহেন্দ্র ক্ষণের



মঙ্গল পাণ্ডে কোথায় তুমি?
সত্যিই কি তুমি তবে এনফিল্ড বুলেটের সুতো দাঁতে কাটতে স্বীকৃত হলে?
মাত্র ১৫৮ টা বছর, এত দুর্বল নুব্জ হয়ে পড়ল তোমার মেরুদণ্ড ?
জানি কামানের গোলায় শতছিন্ন হওনি ,
জানি তুমি আসবে, আসবেই,আসতেই হবে,
অপেক্ষা শুধু সেই মাহেন্দ্র ক্ষণের, ততোদিন না হয় আরো একটু শূলপক্ক হই আমরা।

Wednesday 9 September 2015

অনির ডাইরি ৩রা সেপ্টেম্বর ২০১৫



 নাঃ এবার এটা শেষ করতেই হবে।  অনির ডাইরি আমার মনের খোলা জানালা, দৈনন্দিন একঘেয়েমি যখন অসহনীয় হয়ে ওঠে আমার মধ্যে না লেখা গল্পের চরিত্রগুলো সম্মিলিত ভাবে ক্যাঁচোর ম্যাচোর শুরু করে অথচ লেখার অবকাশ বা উদ্যম পাই না তখন নানা ছোটখাট আপাত সাধারণ ঘটনাবলী নিয়ে দু চার কথায় ডাইরি লিখতে বসি।  বেশিটাই বাড়ি ফেরার পথে চার্টার্ড বাসে আধো অন্ধকারে লেখা।
এদিকে ক্যান্সার রোগাক্রান্তা চম্পু মাসিকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বসে আছি চম্পু আর ফেলুকে নিয়ে “একটি নিটোল প্রেমের গল্প ” লিখব। খানিকটা লিখে আর লেখাটা পছন্দ  হচ্ছে না। সম্পূর্ণ অপরিচিত এক ব্যক্তির চিত্রাঙ্কন  কি এতই সোজা? এদিকে আমার প্রাক্তন সহপাঠী রঞ্জা গত সপ্তাহ থেকে  উত্যক্ত  করছে ওদের বংশ নিয়ে একটি গল্প লিখতে হবে। রঞ্জাকে আজকাল দূরদর্শনে প্রায়শই দেখা যায় নারীর অধিকার এবং নারী স্বাধীনতা বিষয়ক আলোচনা চক্রে। দিল্লীর নামজাদা কলেজের অধ্যাপক এবং প্রবাসী বাঙালি আমলার সাথে সহবাসী। রঞ্জার প্রতি আমার দুর্বলতার প্রধান কারণ ওর বাবাও আমার বাবার মত জেলখাটা  নক্শাল নেতা ছিলেন। ওর বাবার প্রতি প্রতিহিংসা বশতঃ ওর জেঠুকে সত্তরের দশকে কারা যেন কুপিয়ে খুন করেছিল।  লাশ পাওয়া যায়নি।  রঞ্জা বলত ওর জেঠু যে কলেজে পড়াতেন সেখানকার কেয়ারি করা বাগানে কোথাও  পুঁতে রাখা আছে জেঠুর লাশ। শুধু তাই নয় রঞ্জার পিতামহ তাঁর যৌবনে পালিয়ে রেঙ্গুন গিয়েছিলেন  সশস্ত্র বিপ্লবীদের জন্য অস্ত্র আমদানি করতে। রঞ্জার ছোটদাদু নাকা “ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায় ” আন্দোলন করতে গিয়ে শহীদ হন।  পুরো ঘটনাবহুল ইতিবৃত্ত ।
ওদিকে “কিছুই হারায় না” ও আধখেঁচড়া পড়ে আছে। অমিয়া রহমত আর ফরজানাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে, লিখে বসলাম অমিয়ার সহকর্মী দীপক আর তার স্ত্রী মিলির “পরকীয়া”।  বেচারা রহমত মুম্বাই এর পতিতা পল্লী গুলিতে ফরজানাকে খুঁজেই চলেছে।

যাই হোক আবার মাদপুরে ফিরে যাই, এল পি সি নিয়ে খড়্গপুর তথা মাদপুরকে আপাত বিদায় জানিয়ে ফিরে এলাম মহানগরে।  মনে বারংবার অনুরণিত হতে লাগল শৌভিকের দীর্ঘশ্বাসযুক্ত উক্তিগুলি, সত্যই ঐ নিঃসঙ্গতা অবর্ণনীয় । দিন পাঁচেক বাদে অফিস থেকে ফিরছি, বাসে অকথ্য ভিড়। আমার মত দু একজন অফিস ফেরতা হতভাগ্য  বাদে বেশির ভাগই পুজোর বাজার করে ঢাউস ব্যাগ নিয়ে সুখী সুখী দম্পতি, সবৎসা জননী বা মনপসন্দ মার্কেটিং করে ফেরা কলেজ পড়ুয়া মেয়েদের দল।  অতি কষ্টে বসার জায়গা পেলাম, উপবেশনের  পর হঠাৎ মনটা দুখী হয়ে উঠল আমার হতভাগ্য বরের জন্য।  মা আসছে, আনন্দস্রোতে ভাসমান মহানগর ।  একাতীত্ব নিঃসঙ্গতা সাময়িক  ভাবে বিজাতীয়  শব্দ মনে হচ্ছিল। যদিও অবহিত ছিলাম ঐ মুহূর্তে   এস ডিও সাহেবের চেম্বারে মিটিং চলছে তবু একবার দুরাভাষে জ্বালানোই যায়।  বড়জোর ফোন কেটে দেবে। এমন তো কতই হয়।  শৌভিক ফোন ধরে কি যে বলছে কিছুই বুঝতে  পারছিলাম না। সাময়িক  ভাবে অসহ্য লাগছিল মহানগরীর আনন্দ কলতান।  এক কান চেপে ধরে যা অনুধাবন করতে পারলাম শৌভিক যথাসম্ভব  সোচ্চারে কোন ট্রান্সফারের কথা বলছিল।  শুনতে অপারগ অগত্যা ও বলল একটু পরে জানাচ্ছে।  তীব্র উৎকণ্ঠা নিয়ে গুঁতোগুঁতি করে বাস থেকে  নেমে আবার ফোন করাতে শৌভিক বলল,“আমারও ট্রান্সফার হয়ে গেছে।  ”
“কার?” আমি চিৎকার  করে উঠলাম।
“আমার।  ”
“ কোথায় ??”
“জানি না!”
“মানে?”
“মানে আমার উত্তরসুরীর অর্ডার বেড়িয়ে  গেছে।  আমারটা এখনও---”
বোধগম্য হল না।  বদলির কোন প্রার্থনা জানাবার  অবকাশ ও পায়নি।  বদলি অবশ্যই প্রয়োজন । কিন্তু স্পাউস পোস্টিং এর প্রার্থনা ছাড়াই বদলির অর্থ পশ্চিমবঙ্গের ৩৪১টি ব্লকের মধ্যে যে কোন একটিতে হতে পারে।  ততোদিনে প্রায় সমস্ত মহকুমাতেই আমাদের অফিস খুলে গেছে।  কিন্তু সদ্য কলকাতায় ঢোকার পক্ষকালের মধ্যেই যদি আবদার করি স্বামীর কর্মক্ষেত্রের কাছাকাছি আমাকেও বদলি করতে হবে, তাহলে তৎকালীন এ্যাডিশনাল লেবার কমিশনার শ্রী সুবল বিশ্বাসের যতই অমায়িক মিষ্টভাষী  হন বা আমি ওণার স্নেহধন্য হই না কেন, উনি কান ধরে চেম্বার থেকে বার করে দিতেন এ ব্যাপারে আমি নিঃসংশয় ছিলাম। সুতরাং সেই মুহূর্তে দমবন্ধ-করা প্রতীক্ষা ছাড়া করণীয় আর কিছুই ছিল না। দীর্ঘ কুড়ি একুশ দিনের নিদারুণ যাতনা এবং প্রার্থনার পর অবশেষে অর্ডার বের হল। ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যা বেলা জানা গেল পরবর্তী  গন্তব্য মগরাহাট। পরে জানতে পারি জায়গাটার আসল নাম উস্তি।
এই জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু লিখতে পারছি না কারণ এই ব্লকের সাথে আমার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ কখনই স্থাপিত হয়নি। মেয়ে নিয়ে যে কয়বার গেছি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডারমন্ড হারবারে থেকেছি। মগরাহাটের চার বছরে অনেক ঘটনা ঘটেছে যেমন সংগ্রামপুরের বিষমদ কাণ্ড।  তবে এই সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর সাথে সকলেরই সম্যক পরিচয় আছে তাই চর্বিতচর্বণ আর এই মুহূর্তে করছি না। হয়তো আবার কখনও মনে হলে লিখব। আজ নয়।  শুধু অন্তিম লগ্নে এই বিডিও গিরি থেকে অব্যাহতির কাঙ্ক্ষিত অর্ডার বের হওয়া নিয়ে যে টানাপোড়েন চলছিল, তা আমাদের পাশাপাশি তুত্তরিকেও কতটা প্রভাবিত  করেছিল তা এই মুহূর্তেও বোঝা যায় যখন ও বাবাকে দেখলেই বলে ওঠে,“অর্ডার বেরোবে বাবা। ”


Monday 7 September 2015

অনির ডাইরি ২রা সেপ্টেম্বর ২০১৫



ডাক্তারের পরামর্শে আমাকে আশ্বাসন দেওয়া হল, ক্ষত সারলেই তুত্তুরী সহ আমাকে মাদপুর নিয়ে যাওয়া হবে। এক সপ্তাহ নার্সিং হোমে অতিবাহিত  করে মেয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম রবিবার সকালে।  সোমবার  ভোরে বিদায় জানাতে হল শৌভিককে।  এক সপ্তাহব্যাপী  ছুটি উবে গেল কর্পূরের মত। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে তখন ইলেকশনের সামারি রিভিশন চলছে।  কোনমতেই বিডিওর ছুটি পাবার কথা নয়। পেত ও না, যদি না তদানিন্তন মহকুমা শাসক শ্রী অরিন্দম দত্ত নিজ উদ্যোগে না ছাড়তেন। এই নিয়ে কিছু প্রশাসনিক জটিলতার সৃষ্টি হয়, তবে দত্ত সাহেব একাকী তার মোকাবিলা করেন।  আঁচটুকুও লাগতে দেননি শৌভিকের গায়ে। শুধু  তাই নয় আমার দুশ্চিন্তা বৃথা করে উনি প্রতি সপ্তাহান্তেই শৌভিককে ছেড়ে দিতেন, যাতে সদ্যোজাত সন্তানের সাথে অন্তত  কিছুটা সময় অতিবাহিত  করতে পারে।

সাড়ে চার মাসের মাতৃত্বকালীন অবকাশযাপন অন্তে নভেম্বরে যখন মাদপুরে প্রত্যাবর্তন করলাম, মাদপুর বড়ই বিবর্ণ লাগল। চারমাসের তুত্তুরী রয়ে গেল হাওড়ায় আমার মা বাবার সাথে।  সকলের সম্মিলিত আপত্তিতে আর ওকে আনা সম্ভব হল না।  সত্যি তো এত পোকামাকড়,  ব্যাঙ সর্বোপরি ধেড়ে  ইঁদুর।  তাও হয়তো আনতাম কিন্তু সারাদিন লক্ষ্য রাখার মত লোক অনেক খুঁজেও পাওয়া গেল না।
মাদপুরের সেই ন্যাড়া কোয়ার্টর ইতিমধ্যে আমূল পরিবর্তিত।  চতুর্দিকে উচু প্রাকার পরিবেষ্টিত ,  সামনে বিশাল গেট।  গেটে নিওন সাইন “সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিকের নিবাস” তাতে শৌভিকের নাম লেখা। বাদবাকি সবই পূর্বাবৎ। জীবন আবার গড়াতে লাগল নিজ ছন্দে। কিন্তু শতচেষ্টাতেও আর খড়্গপুর বা মাদপুরকে ভাল লাগাতে পারছিলাম না। কানাঘুষো শোনা যেতে লাগল শীঘ্রই ট্রান্সফার হব। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ভোটের দামামা বেজে উঠল।  সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম থেকে নেতাইগ্রাম হয়ে লালগড় নানাঘটনা তুফান তুলছে বাঙালির চায়ের কাপে।  দেখতে দেখতে এসে পড়ল পরিবর্তনের  ইলেকশন।
এই সময় বেশ কিছুদিেনর জন্য বাবা- মা তুত্তুরীকে নিয়ে মাদপুর ঘুরে যাওয়াতে আমরা কিছুটা অক্সিজেন পেলাম।
মাদপুরবাসের দিনগুলিতে কোন অথিতি এলেই আমরা তাঁদের নিয়ে পাতরা যেতাম।  মনোরম কাঁসাই নদীর বেশ কিছু পুরাতন ভগ্নপ্রায়  টেরাকোটা মন্দির যা স্থানীয় এক মুসলিম ভদ্রলোকের একার প্রচেষ্টায় সংরক্ষিত হয়েছে।  ওনার নাম দুর্ভাগ্যবশত এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।  ইয়াসিন মালিক বা ইয়াসিন পাঠান সম্ভবত । আমার বাবা এবং শ্বশুর মশাই দুজনেই ওনার সাথে আলাপে উৎসাহী ছিলেন।  যদিও সময়াভাবে তা আর হয়ে ওঠেনি।  পাতরার অপর এক বৈশিষ্ট্য ছিল, অধিকাংশ মন্দির বিগ্রহশূন্য ছিল।  কারণ অজ্ঞাত । এছাড়াও আমাদের যুগলের প্রিয় ঘোরার জায়গা ছিল খড়্গপুরের একমাত্র মল, নাম ছিল “পূজা মল। ” একতলায় সদ্য খোলা ক্যাফে কফি ডের আমরা নিয়মিত অতিথি ছিলাম।বাঁধা মেনু  গ্রিলড্ চিকেন স্যান্ডউইচ আর ডেভিলস্ ওন।  সাথে নিভৃত আলাপচারিতা । তিনতলায় ছিল একটি হাবিবস্ শ্যালোন।  কলকাতার তুলনায় অন্তত দেড়গুণ সস্তা ছিল সবকিছু ।  ওদের নিয়মিত খরিদ্দার ছিলাম আমি।  তখনও এত খারাপ অবস্থা ছিল না আমাদের, মাত্র ১০ শতাংশ ডিএ কম পেতাম। একদিন সন্ধ্যা বেলা হাবিবস্ এ আছি, হঠাৎ শৌভিকের ফোন ফিসফিস  করে জিজ্ঞাসা করল, আমার আশেপাশে কোন কালো মোটা লোক ফেসিয়াল করাচ্ছে কি না।  যার মাথায় রিং টাক অথচ চাপদাড়ি।  পাশে চোখে শশার টুকরো আর মুখে প্যাক মেখে গোল গলা গেঞ্জি পরা একটি লোক বসেছিল, ভয় পেয়ে গেলাম,  বর্ণনা অনেকটাই নামি দুষ্কৃতি তথা হাজতবাসকারী রামবাবুর   সাথে মিলে যাচ্ছে। তবে তার মুক্তি আসন্ন জানতাম, তবে কি ছাড়া পেয়েই গেল? পরে শুনলাম উনি জনৈক অবজার্ভার। ওণার বায়নাক্কার ঠেলায় প্রশাসনের নাভিশ্বাস উঠছিল।  তাতে নতুন যোগ হয়েছিল হাবিবস্ এর আতিথ্যগ্রহন।

সেবার শৌভিকের এ্যাসেম্বলী কনস্টিটিউয়েন্সীর অবসার্ভার হয়ে এলেন ডঃ গনি।  কাশ্মীরি  ক্যাডারের আই এ এস।  প্রথম দর্শনে মনে হবে কবির বেদির যমজ ভাই।  কাশ্মীরি  আপেলের মতই গাত্র বর্ণ, নীল চোখ, খড়্গনাসা। নির্মেদ, কবির বেদির থেকেও লম্বা।  এপ্রিল মে মাসের ঐ চাঁদিফাটা গরমে উনি কাহিল হয়ে পড়ছিলেন।  বাধ্য হয়ে জয়েন্ট বিডিও সাহেবের অপেক্ষাকৃত ছোট চেম্বারটিকে বাতানুকূল করার ব্যবস্থা করা হয়। যতদূর মনে পড়ে যন্ত্রটি ধার করা হয়েছিল এবং সম্ভবত জেনারেটরের মাধ্যমে চালানো হত। গনি সাহেবের জন্য স্করপিও গাড়ি বরাদ্দ  করা হয়েছিল।  ঝকঝকে  নতুন গাড়ি।  কিন্তু জনাবের ঐ গাড়ি নাপসন্দ।  ওনার কাম্য ইনোভা।  তৎকালে মফঃস্বলে ইনোভা গাড়ি দুষ্প্রাপ্য ছিল।  অবজার্ভার সাহেবের আবদারে অনেক অন্বেষণের  পর যোগাড় হল ইনোভা গাড়ি। সাহেবের নির্দেশে উনি গাড়িতে সওয়ার হবার অন্তত আধঘন্টা পূর্বে এসি চালিয়ে রাখতে হত। বাঙালি খাবার উনি পূর্বে কখনও চাখেননি।  পোস্ত খেয়ে মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন।  ওণাকে খাওয়ানোর দায়ভার অবশ্য শম্ভু নিমাই কে দেওয়া হয়নি। নামি ক্যাটারার সরবরাহ করত।  তবে গনি সাহেব যখন অন্নগ্রহণ করতেন পাশে কাউকে থাকতে হত, প্রতিটি পদ সম্পর্কে সবিস্তারে বর্ণনা করতে হত।  আগে শুক্তো শেষে দই মিষ্টি না বলে দিলে বুঝবেন কি করে। দ্বৈপ্রাহরিক আহার উনি বিডিওকে ছাড়া করতেন না। বেচারা শৌভিক সকালে আমার সাথে ভাত না খেয়ে অফিস গেলে আমি রুষ্ট হতাম, খেয়ে গেলে গনি সাহেব। এতো গেল বায়নাক্কা, তবে কাজের বেলা অসম্ভব খুঁতখুঁতে ছিলেন উনি। বুথ দর্শন থেকে ভোটার টার্ন আউট রিপোর্ট সব কিছু খোদ ‘সক্রুটিনি’ না করলে ওনার শান্তি হত না। প্রসঙ্গত না বলে পারছি না সেবার উপমন্যু চট্টোপাধ্যায়ও অবসার্ভার হয়ে আসেন মেদিনীপুরে।

 ইলেকশন শেষ।  কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন।  গণনার পরের দিন শেষ বাবের মত জ্বালাতন করে  কাশ্মীর ফিরে গেলেন ডঃ গনি।  অপরাহ্নে আমরাও বাড়ি আসার জন্য তৈরি হঠাৎ সব পরিকল্পনা বানচাল করে দিল একটি বাঁদর। ৬ নং জাতীয় সড়কের ধারে বুড়ামালা বলে একটি অঞ্চল আছে।  ঐটি খড়্গপুর ২নং ব্লকের অন্তর্গত ।  প্রতি শীতে ওখানে মহাবীর মেলা বসে। কস্মিনকালে একটি হনুমান রাস্তা পেরোতে গিয়ে ঐ স্থানে গাড়ি চাপা পড়েছিল।  তারপর নানান আধিভৌতিক ঘটনা ঘটতে থাকে, পরিশেষে স্থানীয় অধিবাসীবৃন্দ মৃত হনুমানের উদ্দেশ্যে একটি মন্দির নির্মাণ করেন এবং প্রতি বৎসর মেলা বসাতে শুরু করেন। বিগত শীতে আমরা যুগলে সে মেলা উদ্বোধনও করে এসেছি। ইলেকশনের সময় যে কেন্দ্রীয় বাহিনী এসেছিল তাদের মধ্যে একটি নাগা ব্যাটেলিয়ন ছিল।  যাদের সাময়িক ঠিকানা ছিল বুড়ামালার সন্নিকটে কোন স্কুল । নাগারা আসার পর রাস্তার সারমেয় কূল ক্রমহ্রাসমান হয়ে পড়ে, এই নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষুব্ধ ছিলই।  সমস্যা আরো সঙ্গীন হয় যখন নাগা সৈন্যরা লোভ সংবরণ করতে না পেরে একটি হনুমানকে কাটতে যায়।  দা জাতীয় কোন অস্ত্র দিয়ে কোপ মারা হয়।  মারাত্মক আহত হলেও প্রাণীটি মরেনি।  ঐ রক্তাক্ত অবস্থায় গাছের মগডালে উঠে প্রবল আর্তনাদ করতে থাকে।ঐ ভয়াবহ দৃশ্য দেখে স্থানীয়দের ক্ষোভ বাঁধ ভাঙে, খোদ মহাবীরের পীঠস্থানে হনুমান ভক্ষণের প্রয়াস? ঘোর পাপাচারের বিরুদ্ধে জাতীয় সড়ক অবরোধ করে ধিক্কার জানানো শুরু হয়। ভোট শেষে খবরের আকাল চলছিল, এইরকম চটকদার খবর পেয়ে বেশ কিছু বাঙলা সংবাদ চ্যানেল ও এসে জুটে যায়।  শৌভিককে দৌড়তে হয়।  খবর পেয়ে বনদপ্তরের আধিকারিক গণ আসেন।  হনুমানটিকে পরিচর্যার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।  সেদিন আমাদের বাড়ি ফেরা হয়নি বটে তবে বেশ কিছু আত্মীয় স্বজন দূরাভাষ মারফৎ জানান যে শৌভিককে বোকা বাক্সে দেখাচ্ছে। সত্যি রোদে পুড়ে তামাটে, চোখের নীচে কালি, ক্লান্ত, আধা ঘুমন্ত শৌভিক শেষ কাচা টি শার্টটি পড়ে বাঁধাগৎ আওড়াচ্ছে,  তোতাপাখির মত।
 সেদিন হনুমান হলে পরেরদিন একটি গরুর জন্য আমাদের বাড়ি ফেরা আরো বিলম্বিত  হল। পূর্বরাত্রে ঠিক ছিল পরদিন কফি খেয়েই বেড়িয়ে পড়ব।  প্রাতরাশ বাড়ি ফিরে করা হবে।  সেই মত বের হতে যাব ফোন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের খোলা সেপটিক ট্যাঙ্কে একটি গরু পড়ে গেছে। উঠতে পারছে না,তাকে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে!!!!

দেখতে দেখতে আবার আমাদের বিবাহ বার্ষিকী এসে গেল।  তৎকালীন উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে অর্ধদিবস ছুটি নেওয়াও দুষ্কর ছিল। অগত্যা ঠিক হল রাত্রি বেলা রোজভ্যালিতে ডিনার করতে যাওয়া হবে। মেদিনীপুর শহরে রোজ ভ্যালির ঐ রেস্টুরেন্টটি ছিল তৎকালীন সবথেকে বিলাসবহুল রেস্তোরাঁ । বাতানুকূল সুসজ্জিত  স্বল্পকালের জন্য মনে হত পার্কস্ট্রীট। অফিস করে সেজে গুজে যুগলে গেছি রোজভ্যালি, কথাপ্রসঙ্গে  শৌভিক জানালো একটি “কেলো” হয়েছে।  জনৈক স্টাফ ছুটি চাইতে এসেছিল, উপলক্ষ্য নবপরিণীতা স্ত্রীর শুভজন্মদিন। আমার বর শুধু আবেদন নাকচ করেই ছাড়েনি, উল্টে খানিক সদুপদেশ দিয়ে শেষে বলেছে,“এই তো আজ আমাদের অ্যানিভার্সারি।  ম্যাডাম ও অফিস গেছেন,  আর আমি ও। ” কথা ছড়াতে সময় লাগেনি।  সাব এ্যাসিস্টান্ট ইঞ্জিনিয়ার অরিজিৎ বাবুর নেতৃত্বে স্টাফেরা আবদার জানান ওণারা কিছু উপহারের মাধ্যমে শুভেচ্ছা  জানাতে ইচ্ছুক । পত্রপাঠ আবেদন নাকচ হবার পরও ওণারা হতোদ্যম হননি। ছুঁতোনাতায় জেনে নিয়েছেন আমরা রাত্রে রোজ ভ্যালি যাব। বিরাট সুসজ্জিত  ডাইনিং রুমের এক কোণে আমরা নিভৃত আলাপচারিতায় মগ্ন হঠাৎ শৌভিক আঁতকে উঠল, “এইরে অরিজিৎ বাবু উঁকি মেরে গেলেন, সদর দরজা দিয়ে। ” কিয়ৎক্ষণ পরেই অরিজিৎ বাবু ঢুকলেন দুটি পুষ্পস্তবক এবং রাংতা মোড়া তিনটি উপহার নিয়ে। সর্বসমক্ষে  আমাদের সোচ্চারে শুভেচ্ছা  জানালেন এবং আমাদের হাতে উপহার তুলে দিলেন।  এমনকি অনুপস্থিত তুত্তুরীকেও ওণারা ভোলেননি। আমরা যৎপরনাস্তি আপ্লুত এবং অভিভূত।  হঠাৎ পাশের টেবলে আহাররত অবাঙালি দম্পতির মধ্যে মৃদু বাকবিতণ্ডা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল।  মহিলা অনুযোগের সুরে কিছু বলছিলেন, ভদ্রলোক অসহায় ভাবে ইংরেজিতে জানালেন আজ ওণাদের ও শুভদিন। ওণার স্ত্রী অনুযোগ করছেন কেন ওণাদের কেউ এমন উপহার বা শুভেচ্ছা  জানাল না।  চার জনেই হেসে উঠলাম।

মাস দুই তিনের মধ্যেই বহুকাঙ্খিত এবং বহুবিলম্বিত ট্রান্সফার। চার বছর তিনমাস  পশ্চিম মেদিনীপুরে অতিবাহিত করার পর মহানগর কলকাতা। সদর দপ্তর থেকে তাগাদা এল সত্বর এস। প্রথম গড়ে তোলা সংসার, স্বামী, কোয়ার্টর, ধানক্ষেত, আমগাছ, রেললাইন, পোকামাকড়,  ধেড়ে ইঁদুর সব ফেলে সানন্দে চলে এলাম কলকাতা, মেয়ের কাছে।  চার দিন পর এলপিসি আনতে গিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। সব যেন আরো মলিন, ধুলি ধুসরিত, শৌভিককে এত বিমর্ষ অসহায় কখনও দেখিনি। রাতে খেতে যাওয়া হল রোজ ভ্যালি মেদিনীপুর।  সেই রোজ ভ্যালি কেমন যেন বিবর্ণ। খেয়ে ফিরছি জনশূন্য অন্ধকার রাস্তা দিয়ে বুলেটের মত ছুটছে শৈবাল দার গাড়ি, শৌভিক বিমর্ষ হয়ে বলল,“এই নির্জনতা,  এই একাতীত্ব অসহনীয়।বৃটিশ আমলে পর পর উত্তর পূর্বের তিনজন রেসিডেন্ট কমিশনার আত্মহত্যা করেছিল শুধু এই একাতীত্বের আতঙ্কে। ” আমি চলে যাবার  দুই দিন পরেই প্রথম সাপ ঢুকেছিল কোয়ার্টরে।

 (চলবে ?)

Friday 4 September 2015

অনির ডাইরি ১ লা সেপ্টেম্বর,২০১৫


 আমাদের আড়াই বছর মাদপুর বাসের সবথেকে রোমহর্ষক অংশ অবশ্যই রাত্রি বেলা ভূূল ট্রেনে উঠে আমার কলাইকুন্ডায় পথ হারানো এবং শৌভিক শৈবালদা ডুয়োর উদ্ধার করা।  তবে সেটা “শ্রমিক আমির” অংশ। আগেই বলেছি ♣।

তখন শীতকাল , শৌভিককের এক গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে এএলসিকে নিমন্ত্রণ জানানো হল “ পানিশিউলির মেলা”য়। শুধু নিমন্ত্রন পত্র পাঠিয়েই ওণারা ক্ষান্ত হলেন না, উপর্যুপরি অনুরোধ আসতেই থাকল।  এক হোমরাচোমরা নেতা নিজে এসে অনুরোধ  করে গেলেন পদধূলিধন্য করার জন্য। এমনি নয় অবশ্যই, মূল উদ্দেশ্য স্থানীয় অধিবাসীবৃন্দকে আমাদের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প গুলি সম্পর্কে সচেতন করা এবং নামনথিভুক্তি।খড়্গপুর ২ এর তৎকালীন নূন্যতম মজুরি পরিদর্শক ছিলেন সমীর সর্দার । সমীর বাবু আর আমাকে একত্রে ডিএলসি শৈবাল দা বলতেন “হাইপার এ্যাক্টিভ টিম”। বিনা অর্থব্যয়ে  তথা বিনাআয়াসে সচেতনতা শিবির তখন চরম কাঙ্ক্ষিত বস্তু । আমরা একপায়ে খাড়া। মেলা যদিও সন্ধ্যা বেলায়, পথ অনেকটা এবং বেশ রিমোট জায়গায় ।  বিকাল চারটে নাগাদ আমরা এএলসি ইন্সপেক্টর মিলে রওনা  দিলাম।  যাবার আগে স্যার বেশ কিছুক্ষণ ধরে জেরা করলেন, বুঝতে পারলাম আমাদের উত্তর ওণার আদৌ মনঃপূত হয়নি। চলে আসছি উনি ডেকে বললেন,“দেখ তোমাদের অভিজ্ঞতা কম।  সব শুনে আমার বেশ চিন্তা হচ্ছে কোন বিপদ আপদ না হয়।  যাবে মনস্থ করেছ যাও,  কাল জানিও কটা রেজিস্ট্রেশন হল। ” আমরা অকুতোভয় বেড়িয়ে  পড়লাম।  শৌভিক সকালে জানিয়েছিল ও যাবে। ফোনে জিজ্ঞাসা করাতে বলল ব্লক থেকে ওকে তুলে নিতে।  শেষ পর্যন্ত যখন আমরা রওনা  দিলাম সূর্য পাটে বসতে চলেছে।  আমাদের গাড়ি ছেড়ে বিডিওর গাড়িতেই আমরা সওয়ার হলাম। কারণ আর কিছুই না ঐ রাস্তা কেবল ড্রাইভার শৈবালদাই চিনতেন।
মরা গোধূলিরআলোয় সে এক রোমহর্ষক সওয়ারি ।  হাইওয়ে থেকে নেমে সরু কাঁচা মাটির রাস্তা, বাঁশ ঝাড়, পুকুরের পাশ  দিয়ে টলটলিয়ে চলল এ্যাম্বাসাডর। মাঝে মাঝে উঁচু রাস্তা থেকে ডাইভ মেরে নীচে নামছে, আবার কখনও হড়কে পড়তে পড়তে উপরে উঠে যাচ্ছে।

মাঝে মাঝে চোখজুড়ানো সূর্যমুখী আর গাঁদার ক্ষেত।  হঠাৎ ঝাঁকুনি খেয়ে থমকে  দাঁড়ালো গাড়ি।  সামনে বাঁশ দিয়ে রাস্তা আটকানো। একদল ফচকে ছেলে দৌড়ে এল একটা বিল বই নিয়ে।  শৈবাল দা সবে হুঙ্কার  দিতে যাবে, শৌভিক ইশারায় নিষেধ করল।  পুচকে গুলো যখন গাড়ির খুব কাছে এসে গেছে, ধড়াম করে দরজা খুলে তীব্র হুঙ্কার  ছুড়ল শৌভিক,“বিডিওর থেকে চাঁদা নিবি?”দুদ্দাড় করে দৌড়ল সবকটা।  “কিসের পুজো রে এই?” বলতে বলতে খানিক ধাওয়া করল বিডিও আর তাঁর ড্রাইভার। ভয় দেখানোই আসল উদ্দেশ্য ।  ফিরে এসে শৈবাল দা বাঁশ খুলে দিয়ে আবার ইঞ্জিন চালু করলেন।  পথে একই নাটকের আরো দুবার পুনরাভিনয় হল। যত মেলাপ্রাঙ্গনের দিকে এগোতে লাগলাম যত্র তত্র ছোট ছোট জটলা চোখে পড়তে লাগল।  আমার চোখে কোন অস্বাভাবিকতা ধরা না পড়লেও শৈবাল দা চাপা গলায় বলে উঠল ,“দেখছেন স্যার এখন থেকেই নেশা করে বসে আছে। ”

অবশেষে যখন  আমরা মেলা প্রাঙ্গণে পৌছলাম তখন সন্ধ্যা নামছে।  মেলা প্রাঙ্গণ শব্দটা একটু বাড়াবাড়ি , একটা মাঝারি সাইজের মাঠ।ইতিউতি হাতে গোনা কয়েকজন ছেলে মেয়ের জটলা ছাড়া কোন কর্তা ব্যক্তি চোখে পড়ল না।  আদৌ কোন স্টল ছিল কি না আজ আর মনে নেই।  একটা অন্ধকার অর্ধনির্মিত মঞ্চ অবশ্য অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য।  সমীর বাবু আর আমি হতভম্ব কিংকর্তব্যবিমূঢ়  হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।  শৌভিক খানিক এদিক ওদিক পায়চারি করে নিল।  শৈবাল দা অসহিষ্ণু হয়ে বলল, “কাছেই প্রধান সাহেবের বাড়ি। ” অনুমতি পেলে উনি প্রধানকে পাকড়ে  আনতেন, আমার কাছে নম্বর না থাকায় ইশারায় সমীর বাবুকে বললাম সেই নেতামশাইকে ফোন করতে।  ফোনে যা কথা হল, বুঝতে  পারলাম উনি অপেক্ষা করতে বললেন।  শৌভিক অবশ্য আর এক মুহূর্ত নষ্ট করতে রাজি হল না।  আমরাও দেখলাম অন্ধকার ক্রমে ঘন হচ্ছে এমতাবস্থায় অযথা সময় অপচয় করে কোন লাভ নেই।  সর্বোপরি মেলায় উপস্থিত জনগনকে দেখে হতাশা আরো বাড়ছিল।  অসংগঠিত শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে যে এরা আদৌ উৎসাহী হবে না, অন্তত সেই মুহূর্তে তো হবেই না তা অনুমান করা কষ্টকর ছিল না। একরাশ হতাশা নিয়ে গাড়িতে উঠলাম, সাথে উৎকণ্ঠা, কাল ডিএলসি শৈবাল দা যখন জানতে পারবেন কি অমৃতবাণী যে শুনতে হবে। কি আর করা যাবে? পথে শৌভিক কুবুদ্ধি দিল ,“ডি এল সি সাহেব বকাবকি করলে বলিস,গোটা পঞ্চাশেক ফর্ম দিয়ে এসেছিস, ওরা ফিল আপ করে টাকা সমেত  ব্লক অফিসে পাঠিয়ে দেবে। ” অগত্যা আমরা ফিরে চললাম, নিকষ অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে ফেরাটা রীতিমত রোমহর্ষক ছিল।  অনেক পরে সমীর বাবুকে নামিয়ে যখন আমরা ফিরছি, শৌভিক বলল, “আজকে তোদের নিয়ে আমি বেশ টেনশনে ছিলাম।  জায়গাটা ভাল নয়।  আমার দুই পূর্বসুরীকে ওখানে হেকলড্ হতে হয়েছিল।  তাই একা ছাড়ার সাহস পাইনি। ”
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে দিন দুয়েক বাদে শৈবাল দা যখন জিজ্ঞাসা করলেন,“এই তোমাদের পানিশিউলির মেলা কেমন হল?” আমরা মিথ্যা বলতে পারিনি।  সব শুনে উনি শুধু বলেছিলেন,“ জানতাম। ”

দেখতে দেখতে মাতৃত্বকালীন ছুটি নেবার সময় ঘনিয়ে এল। জুলাই মাস।   প্রাক পরিবর্তন রাজনৈতিক  পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।  ইলেকশন আসতে আর দশ মাস মাত্র।  ওদিকে কিশনজী আর যৌথ বাহিনীর দ্বৈরথ।  খড়্গপুরের এস ডি ও তখন শ্রী অরিন্দম দত্ত। দত্ত সাহেবের ব্যক্তিগত উদ্যোগে মাত্র পাঁচ দিন ছুটি মঞ্জুর  হল শৌভিকের।  আমার বাবার ইচ্ছায় মধ্য হাওড়ার এক সাবেকী নার্সিংহোমে জন্ম হল তুত্তুরীর।  আমাদের বৃহত্তর পরিবারের অনেকেরই পুত্র কন্যা ঐ প্রৌঢ় ডাক্তারবাবুর হাতে হয়েছে।  স্বামী গাইনি, স্ত্রী শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ।  নিজেদের বাড়িতেই নার্সিং হোম।  চিকিৎসা  পদ্ধতি  ও বেশ সাবেকী ।  সাত দিনের আগে ওণারা কাউকে ছাড়েন না।  সেলাই কেটে সপ্তম দিন রেহাই দেন।  রবিবার ভরতি হয়েছিলাম অর্থাৎ পরবর্তী রবিবার সকালের পূর্বে  মুক্তি পাবার সম্ভবনা নেই।  সোম মঙ্গল তো সিডেটিভের ঘোরে কাটালাম কিন্তু বুধবার  সন্ধা থেকে শুরু হল আকুল ক্রন্দন । মনের মধ্যে বারংবার অনুরণিত হচ্ছিল, আর মাত্র কটা দিন, সোমবার ভোরেই ওকে চলে যেতে হবে।  আবার কবে ছুটি মিলবে? আবার কবে দেখা হবে? বারবার তো আর এসডিও সাহেব দাক্ষিণ্য দেখাতে পারবেন না।  শৌভিক সাধ্যমত বোঝাবার আকুল চেষ্টা করতে লাগল।  কান্না আর থামে না। বৃহস্পতিবার কান্নার বেগ বাড়ল বই কমল না।  দীর্ঘ দিনের পরিচিত প্রৌঢ় ডাক্তার দম্পতি প্রায় আত্মীয় সমতুল, প্রথমে সস্নেহে পরে ধমকে বোঝাবার অনেক চেষ্টা করলেন।  বেচারা আমার বৃদ্ধ বাপ বিনা দোষে আমার জন্য বকুনি খেল ডাক্তারের কাছে।  বেশি কিছু তো চাইনি শুধু অনুরোধ করেছিলাম আমাকে মুক্তি দিন।  শনিবার এসে সেলাই কাটিয়ে যাব।  সম্ভবত সবটুকুই ছিল পোস্টন্যাটাল ডিপ্রেসন্। অথবা নয়।  তবে সেদিনের কথা ভাবতে বসলে আজও হৃদয় ব্যথিত হয়। জানি যদিও এরকম  তো কতই হয়-----󾌮󾌮󾌮

(?)

Thursday 3 September 2015

অনির ডাইরি ২৯শে অগস্ট ২০১৫-৩১ শে অগস্ট ২০১৫



আজ অত্যন্ত খুশির দিন  মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কলমের একটি আঁচড়ে  শৌভিকের বিডিও গিরি সমাপ্ত হল  ২০১৩  সাল থেকে শুরু হওয়া অবর্ণনীয় যাতনার আজ অবসান না আমাদের যৌথ সিদ্ধান্ত এই নিয়ে বিন্দুমাত্র  আদিখেত্যা আমরা করব না  তবু মন বারংবার স্মৃতিমেদুর হয়ে উঠছে 
  শ্বশুরমশাই এর কর্কট রোগ ধরা পড়ার পর ওণার সনির্বন্ধ অনুরোধে আইনানুগ বিবাহ চটজলদি সেরে ফেলা হলেও অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে আরো বেশ কিছুদিন পরে  বাবা তখনও জয়েন্ট সেক্রেটারী  আপতকালীন পরিস্থিতিতে প্রবেশনার শৌভিক বদলি হয়ে এল সিউড়ি থেকে আলিপুর আমি তখন এএলসি খড়্গপুর 

সপ্তাহান্তে দেখা হত  বিয়ের পরও ছয় মাস আলাদা আলাদা থাকা শৈবালদা তখন ডিএলসি খড়্গপুর ওণার অনুগ্রহে প্রতি শুক্রবার ২টা ২৫ এর খড়্পুর লোকাল ধরে টা নাগাদ সাঁতরাগাছি  সেখান থেকে হোয়াইট লাইনার ধরে ট্রাফিক জ্যাম না থাকলে সন্ধে  ৭টা নাগাদ এয়ারপোর্ট দুটো দিন কর্পূরের মত উবে যেত  রবিবার দুপুর থেকে শুরু করতাম কান্নাকাটি   সোমবার ভোরে যখন শৌভিক হাওড়াগামী ট্যাক্সিতে তুলে দিত, মনে হত সময় যেন ওখানেই থমকে  রয়ে গেল    আজও মনে আছে সেদিন মেদিনীপুরে চাইল্ড লাইনের কোন অনুষ্ঠান ছিল  অনুষ্ঠান শেষে দেবু সুকন্যার সাথে গাড়িতে ফিরছি শৌভিক ফোন করে জানালো ওর প্রথম পোস্টিং হতে চলেছে লালবাগ  মস্তকে বজ্রাঘাত  তখনও লালবাগে কোন আরএলও (Regional Labour Office ) ছিল না  বহরমপুরের এএলসি লালবাগের দায়িত্বভার সামলাতেন যদি কেঁদেককিয়ে বহরমপুর পাইও তবু একসাথে থাকা অসম্ভব সে যাত্রা শেষ মুহূর্তে জমা দেওয়া বিয়ের নথিপত্র আমাদের খণ্ডিত দাম্পত্যকে জোড়া লাগায়  শৌভিকের প্রথম পোস্টিং বিডিও খড়্গপুর পঞ্চায়েত্ সমিতি

 সবথেকে বেশি খুশি ছিলেন আমার শাশুড়ী মা  আমাদের  লালনীল সংসার হবে শৌভিক যোগ দেবার পর জানা গেল যে প্রাক্তন বিডিও  আপাতত কোয়ার্টার ছাড়তে অপারগ উনি পুরুলিয়া চলে গেলেও ওণার পরিবার এখানেই থাকবে অগত্যা শৌভিককে থাকতে হত বিডিও অফিস সংলগ্ন একটি ছোট্ট  ঘরে  জলচৌকির ওপর চিটচিটে বিছানায় আর আমি যথারীতি  ডেইলি পাষণ্ড   হাওড়া থেকে  খড়্গপুর  ভাবুন কি মর্মান্তিক ব্যাপার, রোজ আমার ট্রেন ওর অফিসের সামনে দিয়ে চলে যেত  তব একঝলক দেখা হত না আমরা ঠিক করলাম খড়্গপুরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকব  সেই মত বাড়ি খুজঁতে গিয়ে বৈদ্যুতিক ঝটকা খেলাম  খড়্গপুরের বাড়ি ভাড়া কলকাতার যে কোন সমৃদ্ধশালী এলাকার থেকে  কম তো নয়ই বরং বেশি  সময় কেটে যাচ্ছে হুহু করে  আমাদের এক বৃদ্ধ পিওন পরামর্শ দিল মন্দাকিনী লজে নৈশযাপনের  লিখতে গিয়ে আজ হাসি পেলেও সেই সময় প্রস্তাবটা আমাদের মনঃপূত হয়েছিল  ফোন করে বুক করাতে হত  এক রাতের ভাড়া পঞ্চাশ টাকা মাত্র একটা পুচকে ঘর  ঝুলপরা বাথরুম  একটা ১৪টিভি আর খাট বিছানা  আর কোন আসবাব ছিল কিনা মনে পড়ে না  যে বাচ্চা ছেলেটি  ঘর খুলতে আসত তাকে টাকা দিলে সে নিকটবর্তী কোন দোকান থেকে পরোটা আর ভাঁড় ভর্তি ঝাল আলুরদম এনে দিত  তারপর জগৎ বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে যেত ঘরটা  আমরা ছাড়া আর কাউকে কখনও দেখিনি নিজের বিবাহিত বরের সাথে লজে শিরশিরে  নৈশযাপন অনন্য অভিজ্ঞতা কজনের হয় বলুন?

  লা ডিসেম্বর ২০০৯ আমরা একসাথে থাকতে শুরু করলাম প্রাক্তন  বিডিও সাহেব সময়ের অনেক আগেই কোয়ার্টর খালি করে দেন  একটি ঢাউস ব্যাগ নিয়ে যখন দাশনগর থেকে ট্রেনে উঠলাম বাবার চোখ ছলছল করছিল সেদিন বিকাল বেলা বিডিও অফিসের ড্রাইভার শৈবালদা তাঁর দুধ সাদা অ্যাম্বাসাডর গাড়ি করে আমাকে নিয়ে গেল কোয়ার্টরে নং জাতীয় ধরে বেশ খানিকটা গিয়ে, বাঁ দিকে নয়নমনোহর ইউক্যালিপ্টাসের জঙ্গল পেরিয়ে মাদপুর  গ্রাম  ততক্ষণে  সন্ধ্যা ঘনিয়েছেসভাপতি কাকলি ভুইঞ্যা সাউ অপেক্ষা  করছিলেন যুগলকে একত্রে শুভেচ্ছা জানালেন অতঃপর গৃহপ্রবেশের পালা  ছিমছাম একতলা বাড়ি আম বাগান দিয়ে ঘেরা  পাশেই পুকুর আর ধানক্ষেত একটু দূরেই রেললাইন নিরালা নিস্তব্ধতায় ঘেরা স্বপ্নপুরী
ঈশ্ অরকূট আর নেই  থাকলে  সেই সব মায়াবী দিনগুলির কিছু ছবি পুনরায় শেয়ার করতে পারতাম  সবুজ ধানক্ষেত, টলটলে ডোবা, ঘাড় বেঁকিয়ে  হেঁটে  যাওয়া  উদ্ধত হাঁস আর  ভীতু  ভীতু মুরগির  দল অগুনতি  রঙবেরঙের পাখি আসত  বারমাস কোকিল ডাকত  ভোরবেলা সেই তীক্ষ্ন সুরেলা  গান ঘুম ভাঙিয়েই ছাড়ত  রাতে উত্যক্ত  করত ব্যাঙ আর ঝিঝিপোকাদের সম্মিলিত কোলাহল বেশ শ্লথ গতিতে চলছিল জীবন  অজগ্রামে থেকেও যাবতীয় নাগরিক সুবিধা ভোগ করা  বিরাট একটি মাঠকে ডানদিক থেকে চক্রাকারে ঘিরে ছিল পর্যায়ক্রমে গ্যারেজ, ফুডের গুদাম, বিডিওর করণ, ডোবা যেখানে শৌভিক শখের এনআরএজিএ বিল্ডিংটা আর বানিয়ে আসতে পারেনি, আমাদের কোয়ার্টর, ক্যান্টিন, বিএসএনএলের অফিস আর ব্লক পশুচিকিৎসকের দপ্তর   অফিস চত্বর ফুলগাছ দিয়ে সাজাবার প্রস্তাব দিলেই  স্টাফেরা হাঁহাঁ করে উঠত  ইতিপূর্বে যতবার চেষ্টা করা হয়েছে টিকা নিতে আসা গরুর দল চেটেপুটে সাফ করে দিয়ে গেছে 
সন্ধ্যা নামলেই সব ফাঁকা   অফিসে অফিসে তালা  দূরে গেটের কাছে গ্যারেজের ওপর জয়েন্ট সাহেব থাকতেন  পাশে বড়বাবু আর ইন্সপেক্টর বিসিডব্লু  আর কোণাকুণি ন্যাড়া কোয়ার্টরে আমরা সেই সময় কিশনজীর দাপটে জঙ্গলমহল কাঁপছে  যৌথ বাহিনী সবে ঘুরিয়ে মারতে শুরু করেছে, খবর এল কিশনজী নাকি লুকিয়ে আছে মাদপুরেই থানা বহুদূর প্রায় ১৫ কিমি  তার ওপর থানায় গাড়ির তীব্র অভাব ছিল  পুলিশ আনতে হলে বিডিওকেই গাড়ি পাঠাতে হত আর বিডিও অফিসের নাইট গার্ড? ছিলেন তো  তাঁর নাম ছিল বলাই বাবু  রিটায়ার্ড পঞ্চায়েত্ কর্মী   সন্ধ্যা ঘনালে টর্চ, বালিশ আর বৃদ্ধা স্ত্রীকে নিয়ে আসতেন ডিউটি  দিতে আজো মনে আছে সপ্তাহান্তে বাড়ি ফিরছি, বলাই বাবু গাড়ির জানলা দিয়ে মুণ্ড গলিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,“ স্যার আপনি কবে ফিরবেন?”
কেন
এজ্ঞে একা থাকতে বড় ভয় করে

একরাতে হঠাৎ  থানা থেকে ফোন এল, গোপন সূত্রের খবর আজ রাতেই বিডিও অফিসে ডাকাত পড়বে  তখন রাত সাড়ে আটটা শৌভিকের কপালে গভীর ভাঁজ  পড়ল  থানা জানালো এই মুহূর্তে যথেষ্ট ফোর্স নেই  রাত এগারোটার আগে কিছু করা সম্ভব নয় একাধিকবার ফোন করার পর বলাই বাবুর সাড়া পাওয়া গেল, সব শুনে তার যা অবস্থা হল তা আর বলছি না  বিরক্ত শৌভিক শুধু বলল,“ তিন তলায় তালাচাবি দিয়ে বসে থাকুন  প্রসঙ্গত সিন্দুক ছিল দোতলায় গা ছমছমে নিস্তব্ধতা   পাল্লা দিয়ে ঝিঁঝির ডাক  খাওয়া দাওয়া মাথায় উঠল  কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর শৌভিক বারন্দায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে আর আতঙ্কে আমি অবশ হয়ে যাচ্ছি  লোহার গেটে দাঁড়ালেই প্রথমেই ওকে দেখতে পাবে আর ভাবতে পারছিলাম না  শেষে অনেক ভাবনার পর শৌভিক স্থানীয় এক দোর্দোণ্ডপ্রতাপ রাজনৈতিক নেতাকে ফোন করল  তিনি তৎক্ষণাৎ প্রতিশ্রুতি  দিলেন পার্টির ছেলেদের পাঠাচ্ছেন  “কিচ্ছু চিন্তা করবেন না সার  আমরা আছিআছেন কিনা কিছুই বুঝিনি অবশ্য কাউকেই দেখতে পেলাম না  উৎকণ্ঠার প্রহর আর কাটেই না  শেষে প্রায় মাঝরাতে গাদা বন্দুকধারী  গোটা চার জওয়ান এসে হাজির  স্বস্তির শ্বাস নেবো কি, বলাই বাবু আর নামেও না, গেট খোলে না  বহু ফোন, পুলিশের জীপের হর্ণআমাদের সম্মিলিত চিৎকার , ঘটাং ঘটাং ইত্যাদির পর বলাই বাবুর বউ নেমে এসে গেট খোলে

 সে রাতেই শৌভিককে বললাম, “ বলাইকে কালই দূর করে দেবলাই বাবুর বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমছিল বেশ কিছুদিন ধরেই  আমরা না থাকলেই সাধের আম গাছগুলি ফাঁকা হয়ে যেত  অফিস স্টাফেরা একবাক্যে বলাইকে দায়ী করত  ব্লকের যে মাসি আমাদের বাসন মাজতে আসত, তার বক্তব্যানুসারে বলাই তার মেয়েকে বিরক্ত করত এই নিয়ে দিনকয়েক আগেই বলাই বাবুর বউ খুব এক চোট হুজ্জতি করেছিল এসব নিয়ে পঞ্চায়েত্ সমিতিও খাপ্পা ছিল সুতরাং সরিয়ে দেওয়াই যায় শৌভিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,“ পারলে এই দণ্ডেই  কিন্তু লোক কই?”
 লোক তো তৈরি  যেদিন আমাদের যুগলে গৃহপ্রবেশ হয়েছিল, সেদিনই তার সাথে আলাপ  শৌভিকই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল,“এই যে এরাই আমায় বিগত এক মাস ধরে খাইয়ে পড়িয়ে রেখেছে নিমাইশম্ভু আর ইন্দ্র তিন ভাই, ক্যান্টিন চালায়  নিমাই লম্বা, রোগা, মুখভর্তি না কাটা আধপাকা দাড়িগোঁফ  শম্ভু মেজ  অতটা লম্বা নয়  গাঁট্টাগোট্টা   গোঁফ আছে আর ইন্দ্র নিতান্তই বাচ্ছা ছেলে  ছোট্টোখাট্টো  সর্বদা হাসিখুশি   কিন্তু হাবা যাইহোক আমার বরকে যে কি খাইয়ে রেখেছিল পরদিনই বুঝতে পারলাম  রান্নার  ব্যবস্থা তখনও হয়নি তাই সকালের খাবার ওরাই তিনভাই মিলে নিয়ে এল, লা ওপালার প্লেটে গরম ভাত, বাটিতে ডাল, পোস্তোর বড়া, মাছের ঝাল আর টমেটোর অম্বল

সাথে একটা তরকারি  এটা বিডিও সাহেবের ইসস্পেশাল রান্না  পোস্তোর বড়াটা মুখে দিয়েই ঝটকা খেলাম  “একিরে এতো রসুনের গন্ধ  রসুনের খোলাও আছেশৌভিক মুচকি হেসে বলল, “সবে তো খাওয়া শুরুতরকারিটা মুখে দিয়ে আঁতকে উঠলাম,“এটা কি?” শৌভিক হাসি চেপে বলল,“ কেন? চিনতে পারছিস না?”
অখাদ্য  এটা কি?”
পেঁপে  পোস্তো ঐযে ক্যান্টিনের পাশে যে পেঁপে গাছ আছে, পেঁপের পোস্ত
বাপরে বাপ  কেন যে টিকা নিতে আসা গরুর  পাল পেঁপে  গাছ গুলোকে মুড়িয়ে খেত না কে জানে খেলে আমার পৈশাচিক আনন্দ হত  আর মাছ?দেশি রুই মাছের রিং পিসকে কড়কড়ে করে ভেজে রসুনগন্ধী ঝোলে ফোটানো   এক দুবার খেয়ে আমার মাছে ঘেন্না ধরে গিয়েছিল  সোমবার সকাল ৭টা১০ এর ট্রেন ধরে বেলা ৯টা নাগাদ পৌছতাম  এরপর আর রেঁধে খেয়ে অফিস যাবার অবকাশ থাকত না অগত্যা শম্ভু- নিমাই ভরসা  পইপই করে বলে আসতাম নিরামিষ রান্না করতে, কিন্তু বিডিও সাহেব আর ম্যাডামকে নিরামিষ খাওয়াতে ওদের তীব্র পাপবোধ হত  ফলতঃ দেশি রুই বাঁধা একবার বলে এলাম ডিমের ঝোল করতে এতে রসুন দিলেও সমস্যা  নেই  কত খারাপ আর করবে  খেতে বসে ভির্মি খেলাম  শৌভিকও আমার ওপর ক্ষেপে গেলওকে না জিজ্ঞাসা  করে নির্দেশ দেবার জন্য  কি দেখলাম? এক বাটি লালচে হলুদ ঝোল তাতে ভাসছে একটি ডিম এবং গুটিকয়েক ঝিঙে ক্যান্টিনের পিছনে যে একটি ঝিঙে গাছ হয়েছে আমি খেয়াল করিনি

 যাই হোক এই শম্ভু বেশ কিছুদিন ধরে আমাকে বারবার অনুরোধ করছিল, নাইট গার্ডের পদটির জন্য ব্লকের এফ এবং অমল বাবু ছিলেন শৌভিকের ডান এবং বাঁ হাত দুজনে মিলে এই কুবুদ্ধিটা দিয়েছিলেনম্যাডামকে ধর ম্যাডামকে বললে সার না করবেননিযত বলতাম,“তা তুমিই বল
না আপনি বলেন ভয় করে
সেরাতে সত্যই বললাম  শৌভিক বলল,“জানি কিন্তু পারবে না

মুখে যাই বলুক অচীরেই বলাই বাবুর জায়গায় শম্ভু বহাল হল ঠিক এই সময়ই সপ্তাহখানেক ছুটি নিতে হল দিন দশেক পরে অফিস করে ফিরছি, দেখি আমার আগে আগেই বলাই বাবু তার বউ, টর্চ আর বালিশ নিয়ে ঢুকছেন  শৌভিক ফিরতেই জিজ্ঞাসা  করলাম,“বলাই বাবু আবার কি করতে এলেন?”
নাইটগার্ড ” 
 “শম্ভু?”
চাকরি ছেড়ে দিয়েছে
মানে? কেন?”
 “ বউকে ছেড়ে থাকতে পারছে না  বউও নাকি কান্নাকাটি করছে
ধপ্ করে বসে পড়লাম চেয়ারে খানিকপরে আবার জিজ্ঞাসা  করলাম,“হ্যাঁরে সত্যি বউ ছেড়ে থাকতে পারছে না? নিজের বউ? ” শৌভিকের সেই দমফাটা হাসি আজো মনে পড়ে
পুনশ্চ শম্ভু তখন মধ্যচল্লিশ তো বটেই
মন্দ কাটছিল না মাদপুর বাস সকালে কোকিলের ডাকে ঘুম ভাঙা থেকে  নিশুতি রাতে ঝিঝিপোকার ডাকে ঘুমিয়ে পড়া  মিনিট চার হাঁটলেই রেল লাইন, লাইন পেরোলেই বাজার  টাটকা সবজিদেশী মুরগির ডিম, হরেকরকম শাক একবার শৌভিককে ওর কোন স্টাফ এক ব্যাগ নিজের ক্ষেতের বাদশাভোগ চাল দিয়েছিল সে যে কি দেবভোগ্য বস্তু তা ভাষায় অপ্রকাশ্য   অনভিজ্ঞতা বশতঃ চাল শেষ হয়ে যাওয়ায় চালের ভাত করেছিলাম  গোটা কোয়ার্টর সুরভিত হয়ে উঠেছিল অতি মূল্যবান বাসমতি চালেও কখনত্ত সে সুগন্ধ পাইনি  বাজার করে দিতেন শৈবাল দা  আমাদের শত অনুরোধেও উনি বেশি করে সব্জি বা মাছ আনতেন না  বললে বলতেন ,“ফ্রীজে রাখা মাছ সবজি খাবেননি স্যার ”   দৈবাৎ শৈবাল দা না থাকলে আমাদের ম্যান ফ্রাইডের নাম ছিল জামাই  কস্মিনকালে কোন স্টাফের তুতো  জামাই ছিল হয়তো, জামাই এর একটি জম্পেশ মুসলিম নাম ছিল যা দীর্ঘ আড়াই বছরে আমরা জেনে উঠতে পারিনি ব্লক অফিসের পাঁচিল ঘেষে ছিল জামাই এর ছোট্ট মণিহারি দোকান কিন্তু ব্লক অফিসের  সর্বঘটে জামাই ছিল কাঁঠালীকলা ট্যাঙ্কে জল নেই, পাম্প  চালাবে কে? লোডশেডিং, জেনারেটর চালাবে কে? ট্রাক থেকে  মাল নামাতে লোক ডাকবে কে? মোট কথা জামাইকে ছাড়া ব্লক অফিস কানা শুধু নয় নিতান্তই অক্ষম

কনকনে শীত  মনোরম পুষ্পশোভিত বসন্ত মাদপুর অপরূপা  নাম না জানা রঙ বেরঙের কত যে ফুল ফুঠত  শীতে যাত্রা হত দিন সাতেক আগে থেকে চলত তার ঘোষণা, সাথে তারস্বরে  বাজত বাংলা সমসাময়িক সিনেমার গান  একই গান বারবার লাগাতার সোহম-পায়েল বেশ কয়েকবার ঘুরে গেল, কখনও মাদপুর, কখনত্ত শ্যামচক, কখনত্ত বা বালিচক   সবথেকে বড় হাঙ্গামা হল যে বার বালিচকের ছেলে শ্রীযুক্ত দেবকুমার অধিকারী এলেন মাদপুরে সেবার উদ্যোক্তারা নাছোরবান্দা বিডিও সাহেবকে দেখতে যেতেই হবে যায়নি যদিও চোখের পলকে সপ্তাহ পার হয়ে যেত  শনিবার বিকাল থেকে নিস্তব্ধতা অসহনীয় হয়ে উঠত

মনোরম  মাদপুর রাতারাতি ভোল বদল করল এপ্রিল থেকে  মার্চ মাসেও রাতে হাল্কা  গায়ের চাপা লাগত, হঠাৎ শুরু হল তীব্র দাবদাহ  ভয়াবহ চামড়া জ্বালানো রোদ সাথে মারাত্মক  আদ্রতা  দিন যাও বা ব্যস্ততার মধ্যে কেটে যেত,রাত কাটতেই চাইত না  কোয়ার্টর ছাড়ুন খোদ বিডিও অফিসেই কোন বাতানুকূল যন্ত্র ছিল না  কারণ আর কিছুই না, রেল লাইনের দিকে বিদ্যুত সরবরাহকারী এক অতি দুর্বল ট্রান্সফরমার বারংবার অনুরোধউপরোধ, চিঠি চাপাটি, ধমক, হুমকি সব ব্যর্থ বাতানুকূল যন্ত্র ছাড়ুন, ভোল্টেজের এত ভয়াবহ অবস্থা ছিল

যে  আমরা রীতিমত প্রার্থনা করতাম, যাতে রাতে লোডশেডিং হয়, ইনভার্টররের দৌলতে অন্তত পাখাটা তো জোরে ঘুরবে  শুধু গরম না সাথে দেখা দিল ভয়াবহ পোকামাকড়ের উৎপাত   বিভিন্ন আকৃতি এবং বর্ণের শয়ে শয়ে  পোকা  কেউ আসত ঝাঁক বেঁধে কেউ ছিল একাই একশ  সন্ধ্যাবাতি জ্বললেই ঝাঁকে  ঝাঁকে উড়ে আসত পাশের ধান ক্ষেত থেকে  প্রাণান্তকর গরমেও সব জানলা ঢেকে ফেলা হল হলুদ নাইলনের নেট দিয়ে  বারন্দার দিকের সব দরজা হয় বন্ধ রাখতে হত নতুবা বাতি নিভিয়ে নিকষ আঁধারে খুলতে হত  সব রকম সাবধানতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও তারা আসত বিশেষ করে রান্না করার সময় একাকী আমাকে আক্রমন করে তাদের যে কি অপরিসীম  উল্লাস হত তা আজো এক রহস্য

মনে আছে একবার রান্নাঘরে  ঢুকেই উচ্চঃস্বরে কাঁদতে কাঁদতে বেড়িয়ে এসেছি, শৌভিক ইউটিউবে ভিভ রিচার্ডসের খেলা দেখছিলআতঙ্কিত হয়ে দৌড়ে এল  পটল ভাজতে দিয়ে এক পলকের জন্য রান্নাঘর ছেড়ে এসেছি, ওমনি কোথা থেকে একটি মথ ঝাঁপিয়ে  পড়েছে গরম তেলে আত্মহত্যা করতে  গিয়ে দেখি পটল এবং মথ একসাথে পক্ক হচ্ছে!!
 শুধু পোকা কেন এত সুপুষ্ট টিকটিকি অন্য কোথাও খুব বেশি দেখিনি  টিকটিকিগুলির আজব বৈশিষ্ট্য ছিল, ঘরের এমন এক কোণায় গিয়ে দেহত্যাগ  করত, যে আমরা শত অন্বেষণেও হদিশ পেতাম না  শুধু গন্ধে গোটা বাড়ি করত  এছাড়াও ছিল ব্যাঙ  যখন তখন বিনানুমতিতে প্রবেশ করত এবং ব্যাপক লম্পঝম্প জুড়ত  হাওয়াই চপ্পল ফটফটিয়ে ব্যাঙ তাড়াতে শৌভিক বিশেষজ্ঞ  হয়ে উঠেছিল  সাপ অবশ্য প্রথম ঢুকেছিল আমি বদলি হবার পর

তবে নিঃসন্দেহে মাদপুরে ভিআইপি ছিল ধেড়ে ইঁদুর প্রায় ছুঁচোর সমান আকৃতি এবং বিডিও কে বিন্দুমাত্র  ভয় পেত না  শৈবাল দা খুঁজে  খুঁজে বিষ আনত,পরম যত্নে আমার বর কখনত্ত চানাচুর, কখনত্ত বা আটার গুলি দিয়ে তা মেখে টোপ ফেলত  সব চেটেপুটে সাফ করে দিলেও কিছু হত না  ওদের প্রিয় খাদ্য ছিল সাবান সুগন্ধী সাবান কিন্তু   কাপড়কাচা সাবান স্পর্শও করত না  এমনকি সাবান কেস বাদ যেত না মাঝে মাঝে গভীর রাতে খাটের ওপর দিয়ে শর্টকার্ট নিত  আমি কখনও অনুভব করিনি যদিও  শৌভিকের কষ্টকল্পিত হতেও পারে

 দেখতে দেখতে এসে গেল আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী   সপ্তাহের মাঝে তো আর এস ডিও বা ডিএলসি সাহেবের কাছে বেয়াড়া আবদার করা যায় না  অগত্যা অন্যান্য  দিনের মতই যে যার অফিস গেলাম  বন্ধু বান্ধব ,আত্মীয়-স্বজন  ফোনে শুভেচ্ছা  জানালেন ডিএলসি শৈবাল দা ঠাট্টার সুরে লেগপুল করলেন, কোথাও ঘুরতে যায়নি বলে  ঠাঠা রোদে কোথায় বা যেতাম? দুঃখী মনে কাজ করছি হঠাৎ শৌভিকের ফোন,“দূরঃ  জাহান্নামে যাক সব  চল কোথাও ঘুরে আসি রেডি থাক  আসছি
দুপুর তিনটে নাগাদ আমরা রওনা  হলাম ড্রাইভার শৈবাল দাকে বলা হল আজ আমাদের বিশেষ দিন একটা জম্পেশ জায়গায় নিয়ে চল  ধূধূ ফাঁকা রাস্তায় লাগাম ছেড়ে দৌড়ল গাড়ি  লাল মোরাম বিছানো পথ ধরে, ঘন নিরিবিলি ঝাউ আর ইউক্যালিপটাসের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, উচ্চাবচ কালভার্ট পেরিয়ে হারিয়ে যাওয়া  নির্বাক নিশ্ছিদ্র   ভালোলাগায় মন যখন কানায় কানায় ভর্তি  হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে শৈবাল দা বলল,“যান স্যার খুব ভাল লাগবেতৎকালীন মেদিনীপুরের সবথেকে বড় এবং জনপ্রিয় পার্ক, নাম ঝিলমিল অল্পবয়সীদের প্রিয় রোমান্টিক ডেসটিনেশন তবে আদপেই সেন্ট্রাল পার্ক সুলভ নয়  শৌভিক কিছুতেই নামবে না  বেচারা শৈবাল দা হতভম্ব   এমন সুন্দর পার্ক সাহেবের নাপসন্দ? আর আমি অসভ্যের মত হেসেই যাচ্ছিলাম

(চলি?)