#তাম্রলিপ্তকড়চা
'ম্যাডাম যাবেননি?' তাগাদা দেয় উত্তমকুমার। এমন দিনে আপিস ছেড়ে যেতে একটুও ইচ্ছে করছে না। কিন্তু যেতেই হবে। লাটসাহেবকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি যে। লাটসহেব নামটা আমারই দেওয়া। প্রতিদিন সবার শেষে হাঁপাতে হাঁপাতে আপিস ঢোকেন লাটসাহেব। এবং যতক্ষণ না তিনি এসে পৌঁছান, হাজিরা খাতাটি এসে পৌঁছায় না আমার কাছে। পাছে ছোকরাকে লাল দাগ দিই, কোন না কোন অছিলায় খাতাটা লুকিয়ে রাখেন আমাদের হক বাবু।
অবশ্য একথা অনস্বীকার্য যে ছেলেটা লেট লতিফ হলেও ফাঁকিবাজ নয়। বরং কাজের ক্ষেত্রে এক্কেবারে যাকে বলে রত্ন বিশেষ। কাজে কোন আপত্তি নেই ছেলেটার, উৎসাহ এবং উদ্দীপনাও প্রচুর। প্রয়োজনে গভীর রাত পর্যন্ত জেগেও কাজD তুলে দেয়। লাটসাহেব বলেন তাতেই নাকি তাঁর সুবিধা। কম্পুটার, প্রোগ্রামিং ইত্যাদি নিয়ে গভীর জ্ঞান ছেলেটার। আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর তাম্রলিপ্তর জন্য একখানা নিজস্ব ওয়েবসাইটই বানিয়ে ফেলেছে ছেলেটা। আমাদের লাটসাহেবের কল্যাণে আপিসের প্রয়োজনীয় তথ্যাদি, হিসেবনিকেশের ফর্মূলা কেবল একটা মাউস ক্লিকের দূরত্বে।
এহেন লাটসাহেবকে আমি একদিন প্রশ্ন করেছিলাম, রোজ এত দেরী কেন করিস বাবা? জবাবে জানতে পারি, সকাল সকাল কোন কোচিংR সেন্টারে পড়াতে যায় ছেলেটা। সেখান থেকে ফিরে চটজলদি স্নানাহার সেরে আপিস ঢুকতে একটু বিলম্ব হয় আর কি। ওদের ক্যাডারের বেতনের যা হাল, আর মূল্যবৃদ্ধি যে হারে উর্দ্ধগামী , আমার আপিসের কাজ গুছিয়ে কেউ যদি আপিসটাইমের আগে পরে দুটি ছাত্র পড়ায়, আমার তাতে কোন আপত্তি নেই।
ছেলেটির মুখে বিশদে শুনেছিলাম ওদের কোচিং সেন্টারের গল্প। মূলতঃ কম্পিউটার পড়ায় এবং শেখায় ওরা। নবম থেকে দ্বাদশের ছাত্রছাত্রীই বেশি। কিছু অষ্টম শ্রেণীর পুঁচকেও অবশ্য আছে। যেমন আছে কিছু কলেজের ছাত্রছাত্রী। পড়ানোটা যে ছেলেটার কাছে নিছক জীবিকা-নির্বাহ নয়, তা ওর কথা শুনেই বোঝা যায়। পড়াতে ভালোবাসেK ছেলেটা, শেখাতেও। এমনকি মাঝে মধ্যেই সুযোগ পেলে উপযাচক হয়ে আমাকে নানা জ্ঞান দেয় লাটসহেব । নেহাৎ আমি ছাত্রী হিসেবে একেবারেই অগাকান্ত অকর্মণ্য।
তো এহেন লাটসাহেব কিছুদিন আগে ভীতু ভীতু স্বরে অনুরোধ করে ,‘ম্যাডাম আমাদের কোচিং সেন্টারে বাৎসরিক রাখিবন্ধন অনুষ্ঠান হবে। আপনি যাবেন?’ লাটসাহেব তো আর সত্যি সত্যি অনুরোধ করেন না, আব্দার করেন। তা তিনি যে দিন এবং যে ক্ষণের উল্লেখ করেছিলেন, আপিসের ডাইরি অনুযায়ী তখনও পর্যন্ত তা ঢাকা পড়েনি কোন মিটিংমিছিলে। ফলতঃ মৌখিক সম্মতি দিয়েছিলাম। শুধু যে লাটসাহেব আমন্ত্রণ জানিয়েছিল তা নয়, উক্ত কোচিং সেন্টারের মুখ্য আহ্বায়ক স্বয়ং এসে জানিয়ে গিয়েছিলেন, অন্যান্য মান্যগণ্য অতিথি সমাবেশের মাঝে মুখ্য অতিথি হিসেবে ওণারা আমাকেই যাচ্ঞা করেন।
আহ্বায়ক মহোদয় পরে আবার একবার এসেছিলেন, এবার একাকী নয় একঝাঁক “নূতন যৌবনের দূত” এবং দূতীসহ। ‘ওরা আপনাকে নিমন্ত্রণ জানাতে এসেছে ম্যাডাম।’ লাজুক অথচ গর্বিত স্বরে জানিয়ে ছিল লাটসাহেব। এই তো সেদিনের কথা, সবাই মিলে কার্ড দিয়ে গেল, ছবি তুলে গেল। এত কিছুর পর যাওয়াটাই তো শিষ্টাচার। বাধ্যতামূলক ও বটে।
মুস্কিল হল প্রতিশ্রুতি দেবার সময় খেয়াল করিনি, দিনটা যে স্বাধীনতা দিবসের আগের শেষ কর্মদিবস। স্বাধীন ভারতের জন্মদিন উপলক্ষে এখানে কিছু হবে না? আপিস সাজাব না আমরা? তৎকালীন চুঁচুড়া আপিসটার তো ভোলই পাল্টে যেত এইদিনগুলোতে। তেরঙা বেলুন আর কাগজের ত্রিকোণ তেরঙা পতাকায় মুড়ে দেওয়া হত বুড়ো কালেক্টরেটের ছোট্ট লেবার অফিস আর তার সামনের বারন্দাটাকে। চন্দননগরের বড়সাহেব থেকে শুরু করে এসএলওরা পর্যন্ত সকলের বুকে আটকানো হত তেরঙা ব্যাজ। সম্মিলিত ভাবে গাওয়া হত জাতীয় সঙ্গীত। উদাত্ত গলায় দেশাত্মবোধক গান ধরত ধনিয়াখালির ইন্সপেক্টর চঞ্চল। গলা মেলাত আরএলও ইন্সপেক্টর কৌশিক। সবার শেষে গান ধরত ধনিয়াখালির SLO অমৃতা। মুহূর্তগুলো হারিয়ে গেছে বটে, রয়ে গেছে স্মৃতিগুলো। কে যেন সেদিন কটূক্তি করেছে শুনলাম, ’আগের চুঁচুড়া আপিসটা নাকি কেবল ছবি তোলার আপিস ছিল’ বলে। ভাগ্যে তাই ছিল, তাই না ফেসবুক জুড়ে জ্বলজ্বল করে সেইসব সোনালী মুহূর্ত গুলো।
কেবল মাত্র জহরবাবু ছাড়া এখানে গানবাজনায় কারো তেমন উৎসাহ না থাকলেও, আপিস সাজানোয় দেখলাম সবার তীব্র উৎসাহ। পুরসভার ইন্সপেক্টর বেদজ্যোতি তো অত্যুৎসাহী হয়ে তেরঙা বেলুনের গেট বানানোর আব্দার জুড়ে ছিল। অতি কষ্টে নিরস্ত করা হল তাকে।
আমার ফরমাইশ মত বেলুন আর পতাকা কিনে আনল অরূপ। জসুয়ার ফরমাইশ মত তাদের সাথে যুক্ত হল তেরঙা রিবন।
শুক্রবার দিন আপিসে বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধি আর পরিবহন শ্রমিকদের ভিড় লেগে থাকে। আরএলও ইন্সপেক্টর সৌরভ আর শহীদ মাতঙ্গিনী ব্লকের সিকেসিও নন্দন অন্যদিন দম ফেলার ফুরসৎ পায় না। আজও ওদের ব্যস্ততা চরম, তারই মাঝে আজ অপরাহ্নে শুরু হয়েছে বেলুন ফোলানো,পতাকা টাঙানোর কাজ। কাজ মিটে গেলেও ফিরে যাচ্ছে না আগত অতিথিদের দল। সবাই সমবেত হয়ে বেলুন ফোলানো, পতাকা ঝোলানো, রিবন লাগানো দেখছেন। বিশেষজ্ঞ মতামত দিচ্ছেন।
এমন দিনে, এমন আপিস ছেড়ে যেতে কার মন চায়? পাছে আমি আপিস ছেড়ে না নড়ি, তাই শুধু উত্তমকুমারের ভরসায় না থেকে ফোন করে নিজেই তাগাদা দেয় লাটসাহেব, ‘বেশীক্ষণ আটকাবনি ম্যাডাম। আপনি আসবেন, ছেলেমেয়েগুলোকে উৎসাহব্যঞ্জক দু-চারটে কথা বলবেন, ব্যাস।’ উৎসাহের মোড়কে জ্ঞান দিতে অবশ্যি আমার বরাবরই দারুণ লাগে।
নির্দিষ্ট সময়ের মিনিট পনেরো পরে পৌঁছে দেখি ব্যস্ত রাজপথের এক প্রান্তে ছোট্ট ম্যারাপ বেঁধে সাজানো হয়েছে মঞ্চ। পাতা হয়েছে আসন। গলায় মোটা পুষ্পহার নিয়ে পাশাপাশি বসেছেন রবীন্দ্র-নজরুল। পাশে বিনম্র ভাবে দাঁড়িয়ে টলটলে তেল ভর্তি লম্বা পিতলের পঞ্চপ্রদীপ। শতরঙী প্রজাপতির মত উড়ে বেড়াচ্ছে শাড়ি পরা পুঁচকি সুন্দরীদের দল। পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান ম্যাডাম এসে গেছেন আমার আগেই। এসে গেছেন স্থানীয় মহাবিদ্যালয়ের মহাধ্যক্ষ মহোদয়, স্থানীয় কাউন্সিলর, এসপি সাহেবের প্রতিনিধি। পুরসভার চেয়ারম্যান সাহেব এসে পৌছাবেন যে কোন মুহূর্তে।
অতঃপর এত সাড়ম্বর রাখি উৎসবে যা হয় আর কি, 'মাত্র পনেরো মিনিটে ছেড়ে দুব ম্যাডাম' বলে জনে জনে প্রতিশ্রুতি দিলেও ছাড় পেতে পেতে প্রায় ঘন্টার কাঁটা গড়িয়ে যায়।
কপালে চন্দনের টপ্পা, হাতে ভারী ফুলের রাখি, গলায় উত্তরীয় নিয়ে যখন উত্তমকুমারের গাড়িতে উঠলাম, বেলা গড়িয়ে গেছে। দূরের লোকজনের ঘরে ফেরার সময় সমাগত। সামনে তিনদিনের লম্বা সপ্তাহান্ত। একে তো ফুরফুরে ছুটির মেজাজ তার ওপর আমি নেই, আর থোড়াই কেউ আপিসে বসে থাকবে আজ। অবশ্য যাবার আগে বলে যায় সবকটা। মুঠোফোন খুলে দেখি বাস্তবিকই দুটি মিসড্ কল। প্রথমজনকে ফোন করতেই, লাজুক আব্দার, ‘বাড়ি যাব ম্যাডাম?’ বেপোট গরম পরেছে আজ, ঘন্টাখানেকের রাখি উৎসবে প্রায় তিন লিটার ঘেমে ক্লান্ত হয়ে নিজেরই বাড়ি ফেরার ইচ্ছা দুর্দম, আমি আবার অন্যকে আটকাব! বললাম জলদি পালাও। আমিও ভাবছি আর আপিসে ঢুকব না। গাড়ি চালাতে চালাতে উত্তমকুমার বলে,‘হায় ম্যাডাম, অফিসে ঢুকবেননি? ওরা যে এত কষ্ট করে অফিস সাজালো গো?’
বলতে না বলতেই সঞ্জয়ের ফোন,সঞ্জয় আপাততঃ আমার সবথেক সিনিয়র ইন্সপেক্টর। আগেও একবার করেছিল দেখলাম সঞ্জয়, ‘ম্যাডাম, আমাদের অফিস সাজানো তো কমপ্লিট। আপনি কতদূর?’ ঘড়ি বলছে আপিসের সময় প্রায় শেষ। বলতে গেলাম, বাড়ি যাও, স্বাধীনতা দিবসের আগাম শুভেচ্ছা, উল্টে সঞ্জয় বলল,‘আমরা বসে আছি। ছবি টবি তোলা হবে তো নাকি?’ এরপর আর বাড়ি ফিরি কি করে? উত্তমকুমারকে বললাম,‘চালাও পানসি’। ঘাড় ঘুরিয়ে উত্তমকুমার বলল,‘ আজ্ঞে!’ বললাম, আরেঃ আপিসে চল রে ভাই লোকজন বসে আছে।
আপিসে ঢুকে দেখি, সৌরভ-সন্দীপ আর নন্দন তখনও পেনশনের কেসের গোছা নিয়ে লড়ে গেলেও বাকি সবাই মুখ-টুক মুছে,চুল-টুল আঁচড়ে প্রস্তুত। জহর বাবু তিনছড়া তেরঙা রিবনের হার পরে বসে আছেন ছবি তোলা হবে বলে। অরূপ, আশিস, জসুয়া, সৌমেন, চঞ্চল বাদানুবাদে মত্ত কোথায় তুললে বেশী বেলুন চোখে পড়বে, কোথায় আলো বেশী। কি ভাবে তোলা হবে,সবাই দাঁড়িয়ে নাকি কিছু দাঁড়িয়ে কিছু বসে, তাহলে কারা দাঁড়াবে, কারাই বা বসবে ইত্যাদি প্রভৃতি। ঘামে ভেজা, তেলতেলে পাঁপড় ভাজার মত মুখের ওপর আঁচল ঘষতে ঘষতে বিড়বিড় করে বললাম, তোমাদের কপালেও বদনাম নাচছে বাপু। আমায় যেতে দাও, ঠিক কেউ না কেউ বলবে, 'এটা তো ছবি তোলার আপিস ছিল।' সে বলুক, আপাততঃ আমরা ছবিগুলো তো তুলি। ভাগ্যে মুঠো ফোন এসেছিল, ছবি তোলা এত সুলভ হয়েছিল। নাহলে এমন কত মুহূর্ত যে নিছক হারিয়েই যেত সময়ের অভিঘাতে, স্মৃতির যাদুঘরে-