আমাদের স্কুলের নাম ছিল তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবন,
তৎকালীন মধ্যহাওড়ার সেরা মেয়েদের স্কুল হিসাবে পরিগণিত হত আমাদের স্কুল।আমরা
প্রাক্তনীরা আজো নিজেদের “তারা” বলে পরিচয় দিতে অত্যন্ত শ্লাঘা বোধ করি। তারাদের একটা গ্রুপ আছে, ছোট গ্রুপ, সেই গ্রুপে
হঠাৎ চৈতালিই কথাটা তুলল, “এই ভূত দেখতে যাবি?” “ভূত” দেখতে? কোথায় যাব? রাখি
প্রথমেই উড়িয়ে দিল, “ভাগ শালা। ভূত আবার একটা দেখার মত জিনিষ? গেলে শান্তিনিকেতন
চল, মন্দারমনি চল- ও সব ভূত-টুত চলবে না বস।” চৈতালি হাল ছাড়ল না, “বাকিরা কি
বলিস? শোন আমার এক সহকর্মীর কাকার বেনারসের বাঙালিটোলায় একটা বাড়ি আছে। সেই বাড়িতে
নাকি ভূত আছে।” অস্মিতা অট্টহাস্য করে উঠল, “ চৈ তুই ঠিক কি খেয়ে চ্যাট করছিস
বলতো? এক ছিলিম গাঁজা টেনেছিস নাকি আরো বেশি? আমরা প্রতিবছর বেনারস যাই মামণি,
বাঙালিটোলা হল এককথায় বেনারসের বড় বাজার।সারি সারি দোকান, থিকথিক করছে লোকজন, শয়ে
শয়ে ধর্মশালা আর সবার ওপর বাবা বিশ্বনাথ, ওখানে আর যাই থাক, ভূত নেই বাপ।” চৈতালি
শান্ত ভাবে জবাব দিল, “ইউ আর রাইট। ওটা একটা ভিড়ভাট্টা ওলা বাজার এলাকা, তাই তো?
তাহলে ওখানে বিগত ষাট-সত্তর বছর ধরে কোন বাড়ি ফাঁকা পড়ে থাকার কথাই নয়। ট্রাষ্ট মি
গার্লস, দ্বারভাঙ্গা ঘাটের কাছে, বাঙালিটোলায় ঐ কোঠা বাড়িটা জনমানব শূন্য হয়ে
দাঁড়িয়ে আছে প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে। আমার বন্ধুর কাকা হোটেল বানাবে বলেই কিনেছিল,
ওরা মাড়োয়ারি, কোন প্রপার্টি কিনে ফেলে রাখার লোক নয়। ঐ বাড়িতে কেউ থাকতে পারে না,
একজন কেয়ারটেকার রেখেছিলেন, সে দুরাত
কাটাবার পর নাকি উন্মাদ হয়ে যায়। এমনকি কোন দারোয়ান পর্যন্ত থাকে না।” “বাবা গো।
যদি সত্যি হয় আমি নেই” বলেই দিল সঞ্চিতা। আর কেউ কোন উচ্চবাচ্য করল না, চৈতালি
হতাশ হয়ে বলল, “কেউ যাবি না, তাহলে? আমি কিন্তু যাব। যাবই।”
চুপচাপ
ওদের কথা পড়ছিলাম, কিছু লিখিনি। ফোনটা বন্ধ করে চোখ বন্ধ করে অনেক ভাবলাম, বেনারস-
হানা বাড়ি- বন্ধুদের সাথে একা একা বেড়াতে যাওয়া- বাড়ির বাইরে একা রাত কাটানো। সব
কটার আকর্ষণই প্রবল। কিন্তু মেয়েকে ছেড়ে? নাঃ থাক। দেখি ওরা কেউ যায় কি না। আবার
ফোনটা খুলে দেখি, শুধু অন্তরা জবাব দিয়েছে, “কদিনের জন্য যাবি চৈ? ছেলে ছেড়ে
বেশীদিনের জন্য যেতে পারব না বাপু।” চৈ উৎফুল্ল হয়ে লিখেছে, “যাবি? সত্যি?
বেশীদিনের জন্য কে যাবে বে? আমার বস ছাড়বে? বেড়াতে যাচ্ছি বললে তো হরগিজ ছাড়বে না।
সিম্পলি যাব না আর বলব পেট খারাপ। শুক্রবার ট্রেনে উঠব, শনিবার ভুতের বাড়িতে
রাত্রিবাস, রবিবার বাবা বিশ্বনাথের দর্শন করে রাতে ট্রেন, সকালে আবার ছুটতে হবে
ইয়ের অফিসে-।”অন্তরা জবাব দেবার আগেই আমি বলে উঠলাম, “এই আমি যাব।” চৈতালি বা
অন্তরা কিছু বলার আগেই সঞ্চিতার মেসেজ, “সর্বনাশ। শয়তানটা একা থোড়াই যাবে, আমাকে
শুদ্ধ টেনে নিয়ে যাবে। অনি আমি কিন্তু যাব না বলেদিলাম, নিজের দায়িত্ব নিজে নিবি।”
আমি অন্তরা এবং চৈতালি তিনজনেই বুঝলাম, এ হল, ‘আর একবার সাধিলেই খাইব।” চৈতালি
শুধু বলল, “ আমি আজ রাতেই চার জনের টিকিট কেটে নিচ্ছি। শুভরাত্রি।”
প্রচন্ড অপরাধ বোধে জর্জরিত হয়ে, শৌভিককে বললাম, বরকে
ছাড়া আমি কোথাও বেড়াতে যাই না। শৌভিক শুধু মাথা নেড়ে বলল, “যাচ্ছিস যা। কিন্তু মাঝ
রাতে আমায় ফোন করে যেতে বললে কিন্তু আমি যেতে পারব না।” আমার ভীষণ ভূতের ভয়।
যেরাতে শৌভিক ফিরতে পারে না, তুত্তুরীর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও আমি টিউবলাইট
জ্বালিয়ে শুই। সারারাত বাথরুমের চৌকাট ও ডিঙোই না। এমনকি মেয়েকেও বলি, “চেপে শুয়ে
থাক। ভোরবেলা যাবি।” এতদসত্ত্বেও ভূতের ছবি দেখা ছাড়ি না। ইলেকশন চলাকালীন একবার বাহাশিস কাপুরের ভুতের
শর্ট ফিল্ম দেখে এত ভয় পেয়েছিলাম যে, রাত দুটোর সময় শৌভিককে ফোন করে কান্নাকাটি
জুড়েছিলাম, খালি মনে হচ্ছিল ভুতটা খাটের তলায় লুকিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে। পায়ের
আঙুল বা হাতের আঙুলের ডগা পেলেই ধরে টানবে। সেই খোঁটাটাই সুযোগ বুঝে দিল আর কি।
যাই হোক
শেষ পর্যন্ত আমরা রওনা দিলাম, আমরা চার তারা শুক্রবার সন্ধ্যা বেলার কালকা মেলে
চড়ে, গন্তব্য বারানসি। লোকে যায় ভূতনাথের দর্শন করতে, আর আমরা চলেছি স্বয়ং ভূতের
সন্ধানে।
রাত পৌনে আটটা নাগাদ ট্রেন ছাড়ল, ভোর সাড়ে ছটায় মুঘলসরাই
নামতে হবে, ওখান থেকে অটো বা ট্যাক্সি করে বারানসী। এসি টু টায়ার, কিন্তু চার জনের
সিট এক সাথে পড়েনি, শেষ পর্যন্ত অবশ্য আমাদের মতই ভুলভাল সিট পড়া অপর একটি
পরিবারের সাথে রদবদল করে তিনজন এক কাট্টা হলাম, আর অন্তরার লাস্যময় অনুরোধ না
ফেলতে পেরে এক ওড়িয়া ভদ্রলোক স্বেচ্ছায় তাঁর সিটটি আমাদের সাথে বদল করে নিলেন। পর্দা
টেনে আরাম করে বসে যে যার বাড়িতে ফোন করলাম, সিঙ্গুর নিয়ে শৌভিকের মাত্রাতিরিক্ত
ব্যস্ততার জন্য তুত্তুরীকে আমার মা-বাবার কাছে রেখে গেছি। আড়াই দিনের তো মাত্র
ব্যাপার, যাই হোক, বাড়িতে ফোন করা মাত্রই তুত্তুরী ধরল, “মা! ভূত দেখলে?” হাসি
চেপে বললাম, “সবে তো ট্রেন ছাড়ল মা। আগে পৌঁছই।” “ওঃ” নিতান্ত বিরস গলায় তুত্তুরী
জিজ্ঞাসা করল, “মা, রাতে তোমার কাছে কে শোবে? কোন বাচ্ছা?” হাসতে হাসতে বললাম, “
কে আবার শোবে? ট্রেনে কোন বাচ্ছা নেই। তুই নিশ্চিন্ত থাক।” যা জানার ছিল জানা হয়ে
যাওয়াতে তুত্তুরীর আর কথা বলার উৎসাহ রইল না, দায়সারা ভাবে, “এ নাও দাদুর সাথে কথা
বল,” বলে বাবাকে ধরিয়ে দিল। বাবা প্রবল উৎসাহে চিৎকার করতে লাগল, “মানা! ট্রেন
ছেড়েছে?” উত্তর শোনার সাথে সাথেই বাবা বলে উঠল, “ বাবা ভূতনাথের ওখানে যাচ্ছ, ভূত
দেখতে পাও বা না পাও গাঁজা খেতে ভুলো না।” এই না হলে আমার বাবা। ভাল করেই জানে আমি
ধোঁয়া টানতে পারি না, জীবনে একবারই সিগারেট টেনেছিলাম তাও বাবারই দেওয়া কাউন্টার,
হেঁচে, কেশে কেঁদে সে যা বিকট কান্ড হয়েছিল, সেই প্রথম সেই শেষ। বললাম, “ও সব
ছিলিম টিলিম টানা আমার পোষাবে না।” বাবা উল্টে ষড়যন্ত্র মূলক স্বরে ফিসফিস করে
বলতে লাগল, “আরে, ছিলিম টানবি কেন? সিগারেটের পেটটা টিপে টিপে হাফ মশলা ফেলে দিবি-
তারপর গাঁজা পাতাটাকে ওর মধ্যে ঠুসে ঠুসে ভরে নিবি। ব্যস। গাঁজা আর বেনারসের
রাবড়ি- আহা।” আমি কিছু বলার আগেই শুনতে পেলাম, ওদিক থেকে মায়ের চিল চিৎকার, “
ধিঙ্গি মেয়ে, কচি বাচ্ছা ফেলে রেখে বন্ধুদের সাথে ধিঙ্গিপনা করতে যাচ্ছেন আর বাপ
তাকে কি করে গাঁজা খেতে হয় সেই শিক্ষা দিচ্ছেন- কি পাগলের সংসারে পড়েছি বাপু আমি?”
বাবা রীতিমত গম্ভীর স্বরে বলল, “হ্যাঁ ঠিক আছে রাখছি। পৌঁছে ফোন করিস” আর ফিসফিস
করে বলল, “গাঁজা খেয়ে রাবড়ি খেতে কিন্তু ভুলিস না।” “রাবড়ি খাব কিন্তু গাঁজা
খাচ্ছি না” বলে ফোন রাখা মাত্রই চৈতালি বলে উঠল, “খাবই। বাবা বিশ্বনাথের থানে গিয়ে বাবার প্রসাদ সেবন করবি না কি যে বলিস?”
রাত নটা নাগাদ বর্ধমান ছাড়ানো মাত্রই বাকি প্যাসেঞ্জাররা
নৈশাহারে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমরা চারজন গল্পেই মশগুল। কি ভাবে চৈতালি পেট খারাপের
নাটক করে পাঁচটা নাগাদ অফিস কেটেছে সেই নিয়ে ব্যাপক হাসাহাসি হল এক চোট। তারপর
চৈতালি ব্যস্ত হয়ে পড়ল ক্যামেরার সেটিং নিয়ে আর আমরা তিনজন মত্ত হলাম পিএনপিসিতে।
সত্যি তো বাবারা যখন বউ বাচ্ছা ফেলে ট্রেক করতে যায় বা বন্ধুদের সাথে বেড়াতে যায়
সমাজ কিচ্ছু বলে না, অথচ আমরা দুই মা নিজেদের বাচ্ছাকে দাদু-দিদাদের কাছে রেখে
আড়াই দিনের জন্য বেনারস কি যাচ্ছি, যেন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। অন্তরা তেঁতো
গলায় বলল, “ভালো হয়েছে জানিস। বাচ্ছা গুলোরও একটু বোঝা দরকার, যে মায়েরা ওদের
জীবনের কতখানি জুড়ে আছে।” চৈতালি ধড়াম করে ফ্ল্যাশটা বন্ধ করে বলল, “ আমি সাধারণত
তোদের এই মেয়েলী ঘ্যানঘ্যানানি গুলো শুনি না। মানে পড়ি না
আর কি। আজ তো কোন উপায় নেই, কানে ঢুকেই যাচ্ছে, তোদের কত সমস্যা, কত কষ্ট- এর সব
কিছুর একটাই সমাধান।” আমরা তিনজন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম, চৈতালি মুচকি হেসে
বলল, “চল মাল খাই।” সঞ্চিতাই জবাবটা দিল, “ তুই খা না চৈ। ভূতের সঙ্গে আসর জমাস।
আমরা দেখব খন।” চৈতালি হেসে বলল, “ সে তো খাবই। আর অনির সাথে ভূতের ছবিও তুলব।
বেচারার এত সেলফি তোলার শখ।” আড্ডা ফাজলামি আর বৃথা ঘুমের চেষ্টায় রাতটা যে কখন
কেটে গেল বোঝার আগেই নেমে পড়লাম মোগলসরাই স্টেশনে। অটোয় চেপে যখন বেনারসের
গোধডুলিয়ায় নামলাম তখনও কুয়াশার চাদর সরিয়ে সূর্যি দেব ওঠেননি। গোধডুলিয়া থেকে
সাইকেল রিক্সা করে হরিশ্চন্দ্র বোর্ডিং হাউস(নাম পরিবর্তিত)। ঘিঞ্জি বাজারের
মধ্যে তিনতলা সাবেকি ধর্মশালা। একতলায় সারি
সারি দোকান সবই হিন্দি সাইনবোর্ড। শুধু ধর্মশালাটার নাম টিনের বোর্ডে বাঙলা এবং
হিন্দি উভয়েই লেখা, তাও বিবর্ণ। কড়ি বরগা ওলা ছাত, চুনকাম করা দেওয়াল, ঘন সবুজ
জানলা দরজা, দোতলা এবং তিনতলায় লম্বা বারান্দা, এবং বারান্দার লাগোয়া সারি সারি
ঘর। মালিক বাঙালি, কর্মচারীরাও সকলেই বৃদ্ধ এবং বাঙালি।
চা জলখাবার খেয়ে স্নান সেরে দশটা নাগাদ আমরা বেরোলাম
হানা বাড়ি দেখতে। বর্তমানে যে বেতনভুক কর্মচারীটি ঐ বাড়ির দেখভাল করে, তাকে বলা
ছিল, সেও আসবে, আমাদের দেখে শুনে জানাতে হবে আমরা কোন ঘরটায় রাত্রিবাস করব, তাহলে
সেই ঘরটা সাফ করে বিছানার ব্যবস্থা করে দেবে আরো যদি আনুসাঙ্গিক কিছু প্রয়োজন হয়
তাকে বললে সে ব্যবস্থা করে দেবে, তবে সব কিছুই দিনের আলো থাকতে থাকতে। সন্ধ্যা
বেলায় আমাদের ধরমশালায় এসে আমাদের চাবিটা দিয়ে যাবে, আগে রামভরসা।
বিশাল সাবেকি বাড়ি, পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, আসেপাশে থিকথিক
করছে দোকান, শুধু ঐ বাড়িটার পাঁচিলের লাগোয়া কোন দোকান নেই। রাস্তা থেকে তিন ধাপ
ইট বের করা সিড়ি উঠে গেছে, তারপর বিশাল রঙ জ্বলা সেগুন কাঠের সদর দরজা। দরজায় ইয়া
বড় তালা ঝুলছিল।দরজার পাশে ভাঙা শ্বেত পাথরের ফলকে বাড়ির নাম লেখা, প্রায় অপাঠ্য,
তবু পড়া যায় বাঙলায় লেখা “শ্রীকৃষ্ণনিবাস”।
দারোয়ানজী তালা খুলে ইশারায় আমাদের ঢুকতে বললেন, ঢুকেই বিরাট উঠোন, উঠোনকে
চারদিক দিয়ে ঘিরে বাড়িটা উঠেছে। ভুল বললাম, ভাল করে দেখলে বোঝা যায়, তিন দিকে
একতলা ছোট ছোট ঘর সম্ভবত রান্না ঘর,ভাঁড়ার ঘর, দাসদাসীদের ঘর কলতলা, একটা বড়
ইঁদারা ইত্যাদি আর দক্ষিণ কোনে বিরাট দোতলা বাড়ি। পলেস্তারা খসে ইট বেরিয়ে গেছে,
কোথাও কোথাও ছোট ছোট চারা গাছ মাথা তুলেছে। ছাত থেকে একটা বড় অশ্বত্থ গাছ ক্রমশ
শিকড় প্রসারিত করছে। বাইরে বাজারের শোরগোল এই উঠনে যেন ভয়ে সম্ভ্রমে প্রবেশ করতে
গিয়েও করতে পারছে না। কি দম চাপা এক নৈশব্দ। দারোয়ানজী সদর দরজার লাগোয়া তালা
দেওয়া বৈঠকখানায় রাত্রি বাসের সুপারিশ করছিলেন। চৈতালি রাজি হল না। বড় উঠোনটা যখন
আমরা পেরোচ্ছি মহলে ঢুকব বলে, কেন জানি না অজান্তেই সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল,
আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বরাবর প্রবল এবং সেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বারবার নিষেধ করতে লাগল, আর
না, সীমানায় দাঁড়িয়ে আছিস, আর এগোনো উচিত নয়। ফিরব কি? চৈতালি, অন্তরা, সঞ্চিতা
ততোক্ষণে একতলার বারন্দায় পা রেখেছে।
“অনি আয় রে-” ওদের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলাম, উঠোনের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাঁ
করে বাড়িটাকে দেখছিলাম। সাবেকি বাংলো প্যাটার্নের দোতলা বাড়ি। একতলা এবং দোতলায়
লম্বা বারন্দা, এবং বারন্দার পিছনে সারি সারি ঘর। বারন্দা গুলো কোন এক কালে কাঠের
জাফরি দ্বারা অর্ধাবৃত ছিল। দোতলার বারন্দায় কাঠের জাফরি থেকে খসখস জাতীয় কিছু ঝোলানো
ছিল, সম্ভবত শীতলতার জন্য
এবং কিছুটা আব্রুর জন্য। যা এই দীর্ঘ অবহেলায় বিবর্ণ-ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে এমন ভাবে
ঝুলছে যে দেখে এক নজরে মনে হল, আগন্তুকদের খাবার জন্য বাড়িটা হাঁ করে আছে। বাড়িটার
আর একটা বৈশিষ্ট্য হল বাড়ির পূর্বদিকে রয়েছে বড় ইঁদারাটা আর পশ্চিমদিকে উঠোন থেকে
সোজা সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলা হয়ে ছাতে। বাড়ির বাইরে দিয়ে এমন সিঁড়ি আমি এর আগে কোন
বাঙালি বাড়িতে দেখিনি। একতলায় চারটে ঘর, কোনটাতেই ভাল আলো ঢোকে না, তায় স্যাঁতস্যাঁতে
গন্ধ। কোনটাই ওদের পছন্দ হল না। পরম উৎসাহে চৈতালি আর অন্তরা সিঁড়ি দিয়ে দোতলায়
উঠতে লাগল। আমি আর সঞ্চিতা তখনও উঠোনেই দাঁড়িয়ে। দারোয়ান জী ফিসফিস করে বলল,
“মেমসাব, কিঊ আপলোগ খুদখুশি করনে পে তুলে হুয়ে হো? মেরি বাত মানো, আপলোগ মেরে
বেহেন জ্যায়সা হো, উপরওয়ালা কামরে কুছ ঠিক নেহি হ্যায় জী।” কিছু বলতে যাব, ওপর
থেকে অন্তরার চিৎকার “ সঞ্চি-অনি শিগ্রি আয়।”
দোতলায়
ও চারটে ঘর, সিঁড়ি দিয়ে দুদ্দাড় করে আমরা যখন দোতলায় পৌঁছলাম, উত্তরপূর্বের ঘরের
দরজা হাট করে খোলা, সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অন্তরা। “আমরা আজ রাতে এই
ঘরটায় থাকব। দেখে যা। এটা এ বাড়ির সেরা ঘর।” লম্বা বারন্দা দিয়ে হেঁটে
উত্তরপূর্বের ঘরে যাবার সময় একটা জিনিষ খেয়াল করলাম, এই ধরণের বাড়ির বারন্দা গুলি
সাধারণত পায়রাদের পীঠস্থান হয়। পায়রাদের মল জমে জমে পাথর হয়ে যায়, কিন্তু বারন্দায়
ধুলো থাকলেও একটিও পায়রার বিষ্ঠা নজরে পড়ে না। কথাটা ফিসফিস করে সঞ্চিতাকে বলাতে ও
বলল, যে ব্যাপারটা ও খেয়াল করেছে।
সত্যি ঐ ঘরটা ঐ বাড়ির সেরা ঘর। ঘরের তিনদিকেই বড় বড়
জানলা, ভিতরে কাঁচের শার্সি, ধূলিমলিন কিন্তু অটুট। প্রতিটা জানলার মাথায় রঙ
বেরঙের কাঁচের আর্চ, সেই লাল-নীল- সবুজ কাঁচের মধ্য দিয়ে সৌরশ্মি ঢুকে মেজে তে
চিত্র বিচিত্র আল্পনা কাটছে। ঘরে এখনও কিছু আসবাব পত্র রয়েছে। যেমন একটা পেল্লায়
খাট, যার ছত্রি গুলো ভেঙে পড়েছে, খাটে কোন গদি পাতা নেই, ছিল হয়তো নষ্ট হয়ে গেছে।
কেবল দুটো ভাঙাচোরা পিসবোর্ড একটার ওপর আর একটা বেখাপ্পা ভাবে চেপে খাটটির লজ্জা
নিবারণ করছে। একটা পুরানো দেরাজ, যার একটা পাল্লা কোথায় হারিয়ে গেছে, আর একটা
সুদৃশ্য ড্রেসিং টেবিল। নির্ঘাত বিলিতি মাল, আয়নাটা যে আসল বেলজিয়াম গ্লাস তা বলা
নিষ্প্রয়োজন। আমি আর সঞ্চিতা ধুলো পড়া
আয়নায় মুখ দেখার আর সেলফি তোলার
চেষ্টা করছিলাম যখন, চৈতালি আর অন্তরা দারোয়ানজীকে ডেকে সবিস্তারে বুঝিয়ে দিল কি
করতে হবে। ঘর ভালো করে সাফ করে, কার্বলিক অ্যাসিড ছড়িয়ে একটা তোষক আর গোটা আটেক
তাকিয়া (মাথা এবং পা চাপানোর জন্য) দিতে হবে। গোটা চারেক এমারজেন্সি লাইটের
ব্যবস্থা করে দিতে হবে আর রাতে যদি কারো ছোট বাইরে যেতে হয় তাই নীচে ইঁদারার ধারে
গোটা দুই বালতি জল ভরে রেখে যেতে হবে। আর হ্যাঁ মশা মারার কয়েল আর লিটার তিন চার
মিনারেল ওয়াটারও রেখে দিতে বলা হল। এই সব কিছুর জন্য হাজার দুয়েক টাকাও দেওয়া হল,
কম পড়লে রাতে নিয়ে নেবে আর বেশি হলে ফেরত দেবার দরকার নেই।
বাকি দিনটা বেনারসের গঙ্গায় নৌকা বিহার, রাবড়ি সেবন,
টুকটাক কেনা কাটা, ছবি তোলা আর দিবানিদ্রা দিয়ে কেটে গেল (রাত জাগতে হবে না?)।
আমরা যখন নৈশাহার সমাপ্ত করে তালা খুলে শ্রীকৃষ্ণনিবাসে ঢুকলাম, ঘড়ির কাঁটা তখন
সবে রাত দশটাকে ছুঁইছুঁই করছে। বাইরে বাজারের হৈহট্টগোল কিছুটা স্তিমিত, সবাই
দোকান গুটোতে ব্যস্ত। তালা খুলে বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই বুকটা ধড়াস করে উঠল। বাইরে
বাঙালিটোলা রোড নিয়ন লাইটের আলোকে ঝকমক করছে, সেই আলো কিছুটা চুইয়ে ঢুকে উঠোনে
নানা রহস্যময় আঁকিবুঁকি কাটছে বটে, কিন্তু ঐ পর্যন্তই। আসল বাড়িটা নিকষ অন্ধকারে
হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। “কি ব্বে? ভয় পাচ্ছে নাকি মামণিরা?” চৈতালি হাসি চেপে
জিজ্ঞেস করল। ভয় ভালোই পাচ্ছিল, আর হারামজাদা দারোয়ান চারটে এমাজেন্সি লাইটও জোগাড়
করতে পারেনি। সম্বল মাত্র দুটো।
দুটো লাইটে ঘরটা মন্দ আলোকিত হয়নি, কিন্তু চৌকাটের বাইরে
নিকষ ঘন অন্ধকার যে ওঁৎ পেতে আছে তা আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমায় বারবার বলে চলেছিল।
কেবল মনে হচ্ছিল, ঐ দরজাটা খোলা রাখার থেকে বন্ধ রাখলে বিপদকে কিছুক্ষণের জন্য
হলেও এড়ানো যেতে পারে। বিপদের কথাটা লুকিয়ে(নইলে সবাই হাসবে যে) দরজা বন্ধ করার
কথাটা বলাতে দেখলাম কেউ আপত্তি করল না। উঠে গিয়ে ভেজিয়ে এলাম, খিল ভেঙে পড়েছে।
চুপচাপ বসে আছি চারজনে, বাইরে বাজারের কোলাহল ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে ক্রমশঃ।
চৈতালি গলা ঝেড়ে বলল, “ব্যস? তোদের চার্জ শেষ? শুরু থেকেই কেলিয়ে পড়লে কি করে হবে?
এই সঞ্চিতা ওঠ। একদম শুবি না। শুলেই মাল তুমি ঘুমিয়ে পড়বে। এই আমি বলে দিচ্ছি যে
ঘুমিয়ে পড়বে তার গায়ে আমি ঠাণ্ডা বিয়র ঢেলে দেব।” “বিয়র? বিয়র কোথা থেকে পাবি?”
আমরা তিনজন সমস্বরে বলে উঠলাম। “হু হু বাবা। জোগাড় করতে হয়। হানাবাড়িতে ভূতদর্শন
করতে হলে ভূতেশ্বরীর আশীর্বাদ অবশ্যপ্রয়োজনীয়। মা কালির আশীর্বাদ ধন্য এই কারণ পান
কর বালিকারা, সব ভয়, ভয় তো কি, ভয়ের বাবা ও জানলা গলে পালাবে।”
সত্যি বিয়রের প্রভাবে কি না জানি না, অল্পক্ষণের মধ্যেই
আমরা সব ভুলে গল্পে মত্ত হলাম। বাইরে বাজারের হট্টগোল যে কখন স্তব্ধ হয়ে গেছে
খেয়াল করিনি। হঠাৎ অন্তরা যখন বলল, “ শালা অ্যাডাল্ট ডায়পার আনা উচিত ছিল।”
সঞ্চিতা বলল, “হ্যাঁরে আমাকেও যেতে হবে। অনেকক্ষণ থেকে চেপে আছি একা যেতে হবে
ভেবে।” চৈতালি বলল, “একা কেন যাবে মামণি? চল সবাই মিলে যাই। যাবি অনি?” যাবার
প্রয়োজন না থাকলেও যেতাম, একা ঐ ঘরে কে থাকবে? আর যেতে হবে তো লম্বা বারন্দা টপকে
পাক্কা ২৪টা সিঁড়ি ভেঙে আড়াআড়ি উঠোন টপকে কুয়োতলায়। ষষ্ট ইন্দ্রিয় ফিসফিস করে যেন
কি সব বলে চলেছে, শুনতে শুনতে উঠে পড়লাম। হাত ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে বারোটা। একটা
এমারজেন্সি ঘরে রেখে আমরা আর একটা নিয়ে বেরোলাম। বেরোবার সময় আমার ব্যাগপ্যাকটা
আমি পিঠে চাপিয়ে নিলাম। চৈতালি আর সঞ্চিতা খুব হাসতে লাগল, “শালা ইয়ে করতেও পিঠে
ব্যাগ নিয়ে যাবি? পালাবার তাল করছিস নাকি বে অনি? চাবি কিন্তু আমার পকেটে।” কিছু
বললাম না।
কাজ মিটিয়ে আমরা যখন ফিরছি, চতুর্দিক নিস্তব্ধ, সিঁড়ি
দিয়ে দোতলায় উঠলাম, দূরে ঘরটা থেকে রেখে আসা আলোটা লম্বা আলোর রেখাপাত করেছে
দোতলার বারন্দায়। আচমকা আমাদের হাতের এমারজেন্সিটা দপ করে নিভে গেল। “কি হল?” বলার
আগেই ঘরের দরজাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল, কোথাও কোন হাওয়ার নাম মাত্র নেই। আবার সেই
ঘন দম বন্ধ করা অন্ধকার, ঝুপ করে ঘিরে ধরল আমাদের। তৈরি ছিলাম, জানতাম এমন কিছু
হবে, কাছে আসার আগেই মুহূর্তের মধ্যে ফস করে জ্বালিয়ে দিলাম মোবাইলের টর্চটা।
সাময়িক বিহ্বলতা কাটিয়ে, সঞ্চিতা আর চৈতালিও নিজের নিজের
মোবাইলের টর্চ জালিয়ে দিল, দ্রুতপদে আমরা গিয়ে দাঁড়ালাম উদ্দিষ্ট ঘরটির সামনে।
বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। দরজার ওপারে কি অপেক্ষা করে
আছে কে জানে? দড়াম করে এক ধাক্কায় দরজা খুলে আগে ঢুকল অন্তরা, ভিতরে ঘুটঘুটে
অন্ধকার। মোবাইল টর্চের আলোয় দেখলাম আমাদের বিছানা এবং জিনিসপত্র যেমন ছিল তেমনি
আছে। তড়িঘড়ি চৈতালি আর সঞ্চিতা ব্যস্ত হয়ে পড়ল এমারজেন্সি দুটো কে নিয়ে, অন্তরা
আনমনে গিয়ে দাঁড়াল ড্রেসিং টেবিলটার সামনে, আমি আগে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। ষষ্ঠ
ইন্দ্রিয় যদিও ফিসফিস করে বলেই চলেছে বৃথা সবই বৃথা।
মিনিট খানেক ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে ওরা রণে ভঙ্গ দিল।
একটা এমারজেন্সিও কাজ করছে না। চৈতালি বেশ ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “কি হবে রে? মোবাইল তো
বেশি ক্ষণ চলবে না।” আমি আর সঞ্চিতা প্রায় এক সাথে বলে উঠলাম, “চল বেড়িয়ে যাই এখান
থেকে।” সঞ্চিতা আবার বলল, “দেখ এই রকম হানাবাড়িতে আমরা রাত পৌনে একটা অবধি
কাটিয়েছি, আমার কাছে এটাই বিরাট অ্যাচিভমেন্ট। সারা রাত কাটাতে গিয়ে কোন বিপদে
পড়তে চাই না। আর আমার মন বলছে কোন বড় বিপদ ঘটতে চলেছে।” চৈতালি হতাশ সুরে বলল,
“পালিয়ে যাব? বুক বাজিয়ে বলে এলাম আমরা চার তারা ভূতের বাড়িতে-”। “আমি কোথাও যাব
না।” অন্যমনস্ক গলায় বলল অন্তরা। মোবাইল ততক্ষণে কাঁপতে লেগেছে। আমরা বোঝাবার
চেষ্টা করলাম, সে রকম হলে সদর দরজা খুলে বাইরের সিঁড়িতে বসে রাতটা কাটিয়ে দেওয়া
অধিক নিরাপদ। অন্তরা কোন জবাব না দিয়ে, সটান একটা তাকিয়ায় মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল। চৈতালি
অসহায় ভাবে বলল, “তাহলে কি হবে? এই অন্ধকারে?”
ব্যাগপ্যাকটা ঐ জন্যই কাছছাড়া করিনি। ব্যাগে চারটে বড় বড়
মোমবাতি ও দেশলাই ছিল। আসার আগে শৌভিকই গুছিয়ে কিনে দিয়েছিল, যদি কোন কারণে দেশলাই
ভিজে যায় তাই একটা লাইটারও সঙ্গে দিতে ভোলেনি। মনে মনে নিজের বরকে অশেষ ধন্যবাদ
জানিয়ে একটা মোমবাতি ধরালাম। মোমবাতির হলুদ আলোয় ঘরটা যেন আরও রহস্যময় হয়ে উঠেছে।
কোথাও হাওয়ার নাম মাত্র নেই তাও মোমের শিখা থিরথির করে কেঁপেই চলেছে, যেন এখুনি
নিভে যাবে। সঞ্চিতা দুহাত দিয়ে শিখাকে আঁকড়ে বিড়বিড় করে কোন মন্ত্র পড়ে চলেছে। আমি
আর চৈতালি চুপ করে বসে আছি, অন্তরা সেই যে শুয়েছে আর ওঠেনি। ঘুমোয়নি যদিও চোখ
খোলা।
ঘড়ির কাঁটা দেড়টা ছাড়িয়ে পৌনে দুটোর দিকে পা বাড়িয়েছে। বিগত পয়তাল্লিশ মিনিটে নতুন কিছুই ঘটেনি। আমাতে আর সঞ্চিতাতে ঘেঁষাঘেঁষি করে
বসে আছি। একটু দূরে চৈতালি এক দৃষ্টিতে মোমবাতির শিখার দিকে তাকিয়ে আছে। দম আটকানো
পরিবেশকে হাল্কা করতেই
যেন ও বলে উঠল, “ হে হে। তিনিই বোধহয় আমাদের ভয় পেয়েছেন জানিস। ভেবেছিল সামান্য
আলো নিভিয়ে বা ক্যাঁচ করে দরজা বন্ধ করে আমাদের ভাগাতে পারবে। জানে না তো, আমরা
হাওড়ার মেয়ে তায় আবার তারাসুন্দরীর বাচ্ছা।” আমরা অল্প হাসলাম। এবার সিরিয়াস গলায়
চৈতালি বলল, “তবে তোদের জন্য আমার খুব খারাপ লাগছে ভাই। আমার দোষেই তোদের এই
শাস্তি পোয়াতে হচ্ছে।”
“শাস্তি?” অন্তরার গলা শুনে আমরা চমকে উঠলাম। কখন উঠে
বসেছে, “শাস্তি কাকে বলে তোরা জানিস না। সবথেকে বড় শাস্তি হল অমরত্ব। মানুষ ভাবে
মরলেই সব জ্বালা জুড়োবে, কিন্তু সত্যিই কি তাই? যদি জ্বালা না জুড়োয়? আর তো কোথাও
যাবার নেই? কোথাও পালাবার নেই?” আমরা চুপ। অন্তরা বলেই চলেছে, “একটা গল্প বলি শোন,
হৈমবতীর গল্প। সময়টা ১৯৩০ এর দশক। হৈমবতীর বাবা ছিলেন হাওড়ার ব্যাঁটরা এলাকার বেশ
ধনী ব্যক্তি।তার ওপর জাতীয় কংগ্রেসের ছোটখাটো নেতাও বটে। হৈম ওনাদের প্রথম সন্তান
পরম আদরের দুলালী। হৈমর মামার বাড়ি ছিল আহেরিটোলায়। হৈম তখন আট, মামার বাড়িতে
বেড়াতে গেছে। তখন বেশ রাত, ছোট্ট মামাতো ভাইকে দোতলায় হৈমর জিম্মায় দিয়ে ওর
মা-মাসি-মামিরা হেঁসেলে খেতে বসেছে। ভাই ঘুমোচ্ছে, আর হৈম পাশে বসে পুতুল নিয়ে
খেলছিল, যদিও মামার বাড়িতে বৈদ্যুতিক বাতি আছে, তবে সেদিন লোডশেডিং, খাটের পাশে
একটা হ্যারিকেন রাখা আছে। আপন মনে খেলতে খেলতা হৈমর হঠাৎ মনে হল, জানলা দিয়ে কে
যেন ওকে দেখছে, চমকে তাকিয়ে দেখে গোটা জানলা জুড়ে একটা প্রকান্ড মুখ, তার জিভটা
জানলার গারদ গলে ততক্ষণে ঘরে প্রবেশ করেছে এবং খাটের দিকে দ্রুত বেগে এগিয়ে আসছে,
ঠিক যেখানে ভাই ঘুমোচ্ছে। তীব্র আতঙ্কে হৈম গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল। কয়েক
মিনিটের মধ্যে সবাই দুদ্দাড় করে ছুটে এল, যথারীতি জানলায় কাউকে পাওয়া গেল না। সেই
রাতে হৈমর ধুম জ্বর এল আর পরদিন দুপুরে হৈমর ছোট্ট মামাতো ভাইটা দুম করে মরে গেল।
সেই থেকে কেন জানি না কিন্তু হৈম মৃত্যুকে অনুভব করতে
পারত। ওর বাবার জেঠিমা, যেরাতে মারা গেল, হৈম সেরাতেও বাড়ির উঠোনে একটা কালো ছায়া
দেখেছিল। যেই ঠানদি মারা গেল, ছায়াটাও আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। বললে কেউ বিশ্বাস
করত না, তাই হৈম নীরব থাকত। তের বছর বয়সে হৈমর বিয়ে হল, কাশির ধনাঢ্য বাবু মাধব
বন্দ্যোপাধায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রীমান বিনোদের সাথে। মাকে ছেড়ে ট্রেনে করে কাশি
যাবার সময় কি অসম্ভব কষ্টই যে হচ্ছিল, মাকে ছেড়ে কোনদিন থাকেনি হৈম।
কাশীর বাড়িতে প্রবেশ করার সময় কেন জানি না, হৈমর গায়ে কাঁটা
দিয়ে উঠল, উঠোনে মাঝে দাঁড়িয়ে শাশুড়ি যখন ওদের বরণ করছিল, তখন হৈম না তাকিয়ে
স্পষ্ট বুঝতে পারছিল, দোতলার বারন্দায় জমাট বেঁধে আছে একটা কালো ছায়া। বিয়ের পর
বরের সাথে ভাব জমতেই হৈম তাকে কথাটা বলল, “ ওগো এ বাড়িটা মোটে ভাল নয়। এখানে কেউ
একজন আচে, যে চায় সব জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাক।” বিনোদ কলকাতার রিপন কলেজ থেকে
সদ্য স্নাতক, এসব বুজরুকি বিশ্বাস করে না। দিনে দিনে হৈমর চারদিকে
সেই ছায়া গাড় হচ্ছে, আতঙ্কে হৈমর ঘুম আসে
না। সুযোগ পেলেই বিনোদকে কাকুতিমিনতি করে, “ আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে চল। এ বাড়ি
আমাদের সবাইকে খাবে।”
এরই মধ্যে হঠাৎ জানা গেল, হৈম গর্ভবতী। বিনোদ খুশি হয়ে
বলল, “হৈম এবার যাও, তোমার বাবা আনতে আসচে। বাপের বাড়ি গিয়ে কটাদিন কাটাও আর আমিও
দেকি কলকাতায় কোন কাজ জোগাড় করতে পারি না।” ভেবেছিল হৈম আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাবে,
হৈম তাকিয়ে দেখলও না পর্যন্ত, শুধু বলল, “ বড্ড দেরি হয়ে গেছে গো। অত করে বললুম
শুনলে না আর পালাবার পথ নেই।”
হৈমর একটা মেয়ে হল, ফর্সা, ফুটফুটে তুলোর বল। বাড়ুজ্জে
বাড়ির প্রথম সন্তান, সকলের নয়নের মণি। মেয়ের যখন ছ্ মাস বয়স, একদিন রাতে হঠাৎ
ফোঁপানির আওয়াজে বিনোদের ঘুম ভেঙে গেল, কি হল আবার? হৈম তো আজকাল আর ও সব আজেবাজে
বকে না। ভীষণ চুপচাপ হয়ে গেছে হৈম, এক মুহূর্তের জন্য মেয়েকে চোখের আড়াল করে না।
তাহলে? আধো অন্ধকারে পাস ফিরে দেখে, মেয়ের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে হৈম ফুঁপিয়ে
ফুঁপিয়ে কাঁদছে, আর বলছে, “আমার কি দোষ ছিল? তবে কেন? কেন-” আর কথা বলতে পারল না
মুখে আঁচল গুজে ফোঁপাতে লাগল। হৈম না বুঝলেও মেয়ে বোধহয় বুঝতে পারল যে বাবা জেগে
গেছে, তখনি বাবার দিকে ফিরে খিলখিল করে হেঁসে উঠল। হতভম্ব বিনোদ মেয়ের দিকে তাকিয়ে
বলল, “হৈম কি হয়েচে?” হৈম আর চাপতে না পেরে হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ ও গো
বুজতে পারচ না? ও সে। আমাদের শাস্তি দিতে এয়েছে। কেন এলি তুই? যদি আমার কাচে নাই
থাকবি তুই কেন এলি মা? আমি যে তোকে বড় ভালোবেসে ফেলেচি। আমার প্রথম সন্তান তুই।”
যত দিন যেতে লাগল, মেয়ের প্রতি হৈমর অধিকার বোধ
সীমা ছাড়াতে লাগল। কিছুতেই মেয়েকে কাছছাড়া করতে চায় না। সব সময় চোখে চোখে রাখাটা
প্রায় বাতিকের পর্যায়ে গিয়ে ঠেকল। বেচারা বিনোদ, ওদের দাম্পত্য শুধু মাত্র
পিতামাতার সম্পর্কেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ল। তাতে বিনোদের খুব একটা সমস্যা না থাকলেও,
মাধব বাবু এবং তাঁর গিন্নী ক্রমশঃ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তে লাগলেন। নাতনী যতই আদরের হোক,
এত বড় হয়ে গেল, অথচ এখনও পর্যন্ত আর একটিও
ভাইবোন হল না, ব্যাপারটা ওনাদের কাছে আদৌ সহজপাচ্য ছিল না। বিনোদের প্রতি
হৈম যে কোন কর্তব্যই পালন করে না, বরং বেশ
অবহেলা করে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে উঠল। ফলতঃ বিনোদের বাবা-মা প্রায় চেষ্টা করতেন
যাতে হৈমকে তার মেয়ের থেকে দূরে
রাখা যায়, অন্তত কিছুটা সময়ের জন্য হলেও যাতে রাধা বিনোদের সাথে একটু সময় কাটাতে
পারে। নাতনীও দাদু-ঠাকুমার একান্ত অনুগত ছিল। মায়ের দম বন্ধ করা শাসনের পাশে দাদু ঠাকুমার
অফুরন্ত স্নেহ তথা প্রশ্রয় শিশুকে বেশি
আকর্ষণ করত। মাধব বাবু পরম আদরে নাতনীর
নাম রেখেছিলেন শ্রীরাধিকা। মাধবের নয়নমণি প্রাণাধিকা শ্রীরাধিকা ওরফে রাধু। রোজ
সকালে মাধব বাবু যখন সেরেস্তায় গিয়ে কাজে বসতেন, রাধুও গিয়ে বসত দাদুর কোলের কাছে।
যথারীতি হৈম আপত্তি করেছিল, কিন্তু সে কথা কেউ কানে তোলেনি।
রাধু
তখন পাঁচ, দাদুর কিনে
দেওয়া ট্রাইসাইকেল নিয়ে সারাদিন গোটা বাড়ি
ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেদিন ও দোতলার দালানে সাইকেল চালানো নিয়ে সকালবেলাই একচোট ঝামেলা হয়ে গেল
মা-মেয়ের। রাধু
প্রচন্ড জেদি
হয়ে উঠছে, হৈম কিছুতেই দোতলায় চালাতে দেবে না, রাধুও কথা শুনবে না।
শেষে রাধু
কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে নালিশ
করল দাদুকে। ঠিক সেই
সময় বিনোদ
খেয়েদেয়ে আপিসে
যায়, মাধববাবু গম্ভীর গলায় হুকুম
দিলেন, “দিদি
তুমি দোতলাতেই সাইকেল চালাও।আমার আর সেরেস্তায় বসে কাজ নেই, খাতাপত্র ওপরের দালানে বসেই দেখে নেব। আমি তোমার কাছে বসছি আর মাকে বল, বাবা এখুনি খেতে
বসবে, মা যেন হেঁসেলে যায়। আমার
ছেলেটার দিকে
তো কারো
কোন নজরই
নেই।” পুরো নিমপাতা খাওয়া মুখে
রান্নাঘরে গিয়ে
বিনোদকে খেতে
দিল হৈম।
বেচারা বিনোদ, দুএকটা কথা বলার চেষ্টা করল বটে
হৈমর সেদিকে কানই নেই।
খালি রান্না ঘরের জানলা
দিয়ে গলা
বাড়িয়ে দেখছে, হঠাৎ প্রবল আওয়াজ, আর মাধববাবুর হৃদয়বিদীর্ণ চিৎকার, “দিদিইইইইইইইই”।হৈম পাথরের মত বসে রইল, বিনোদ খাওয়া
ফেলে লাফিয়ে উঠে দৌড়ল, রাধু সাইকেল সমেত দোতলার বারন্দা থেকে
সিঁড়ি দিয়ে
গড়িয়ে পড়ে
গেছে। অজান্তে কখন
সাইকেল চালাতে চালতে সিঁড়ির কাছে চলে
গিয়েছিল মাধববাবু খেয়াল করেননি।হয়তো সাময়িকভাবে একটু
ঝিম লেগে
গিয়েছিল।
রাধুর মৃত্যুর শোক সবথেকে বেশি প্রভাব ফেলেছিল মাধব
বাবুর ওপর। চোখের সামনে
নাতনীর মৃত্যু উনি মেনে নিতে
পারেননি, ফলশ্রুতি সান্নিপাতিক রোগে (সেরিব্রাল)একেবারে পঙ্গু হয়ে পড়লেন মাধব
বাবু, চোখের দৃষ্টিও হারালেন সাথে সাথে। বিনোদের হল শিরে সংক্রান্তি, একদিকে পঙ্গু
অন্ধ বাবা ওপর দিকে জীবনের প্রতি সম্পূর্ণ
উদাসীন হৈমবতী, স্নান করে না, খায় না, চুল
আঁচড়ায় না, কারো সাথে বার্তালাপ পর্যন্ত করে না। ঘর থেকে টেনেও বার করা যায় না।
তারওপর পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র হিসাবে বাবার পঙ্গুত্বের জন্য জমি-বাড়ি, দোকান,
মামলামোকদ্দমা সবই দেখাশোনা করতে হচ্ছে বিনোদকেই। বিনোদের ইচ্ছা করে, সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে হৈমকে নিয়ে কোথাও
পালিয়ে যায়। কেন যে বিয়ের পর
হৈমর কথা শোনেনি? আজ খুব আফসোস হয়, সত্যি যদি সেদিন বাড়ি ছেড়ে কোথাও চলে যেত?
দিনগুলো যেমন তেমন ভাবে কেটে যায়, কাটে না রাত গুলো।
তীব্র ক্লান্তিও ঘুমকে টেনে আনতে ব্যর্থ হয়।
সোনার পুতুল থেকে হৈমর দিকে
তাকালে ওর চোখ ফেটে জল আসে। বিনোদ রোজ বোঝায়, সেরাতেও
বিনোদ বোঝাচ্ছিল, “যা ঘটে গেছে, তা মর্মান্তিক, কিন্তু এভাবে ভেঙে পড়লে
চলবে কেন? আমাদের সামনে গোটা জীবন পড়ে আছে, তোমার কি বা বয়স। আবার কেউ আসবে, হয়তো
রাধুই ফিরে আসবে।” ঠান্ডা শান্ত চোখ তুলে
হৈম ওর দিকে তাকালো, তারপর অদ্ভুত শীতল স্বরে বলল, “ রাধু আর কোনদিন ফিরে আসবে না।
ও এসেছিল প্রতিশোধ নিতে। তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস কোর লীলা কে?” লীলা আবার কে রে বাবা? বিনোদ আর কথা বাড়ায়নি। হৈমর এসব
খামখেয়ালী কথাবার্তার সঙ্গে ওর পরিচয় তো আর অল্প দিনের নয়।
শেষ পর্যন্ত ওর অনুরোধ না ঠেলতে পেরে ওর পাশে শুতে
রাজি হয়েছিল হৈম। বহুদিন বাদে স্ত্রীকে
জড়িয়ে হৈমর চুলের আঘ্রাণ নিতে নিতে কখন যে
ঘুমিয়ে গিয়েছিল বিনোদ নিজেও জানে না। ভোর বেলা যখন ঘুম ভাঙল, হৈম ওর পাশে নেই,
পরনের কাপড় গলায় দিয়ে ছাত থেকে ঝুলছে। হৈমর মৃত্যু বিনোদ কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। হৈমকে
দাহ করে ফিরে এসে ফাঁকা ঘরে বসে হুহু করে কেঁদে উঠল বিনোদ। মাত্র কয়েক বছরের
দাম্পত্যের স্মৃতি ছাড়া আর তাহলে কিছুই রইল না বিনোদের? কেন এমন হল? কার অভিশাপে
বিনোদের জীবনটা এভাবে ধ্বংস হয়ে গেল? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বিনোদের মনে পড়ে গেল, হৈম
কি বলছিল? “লীলা?” কে এই লীলা? বাবার যা শারীরিক অবস্থা বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে
সাহসে কুলাল না, তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে সেরেস্তায় ঢুকল বিনোদ। নায়েব মশাই, বহু
বছর ধরে ওদের সেরেস্তায় কাজ করছেন, বিনোদের বাবাকেও উনি ছোট থেকে চেনেন। বিনোদ
ওনাকে ধরল, “কাকাবাবু আপনি বহু বছর আছেন আমাদের পরিবারে। বলতে পারেন লীলা কে?” নায়ব মশাই মাথা চুলকে
বললেন, “লীলা? কই এ নামে তো কাউকে চিনি না?”
বাবাকে আপনি আশৈশব চেনেন।বাবার সাথে কোন লীলার--? কথাটা শেষ করার আগেই
নায়েব মশাই এর দেহের ভাষা পাল্টে গেল। বেশ ভয় পেয়েই উনি বললেন “আমি জানি না ।”
নায়েব মশাই চলে যেতে উদ্যত হলেন কিন্তু বিনোদ তার আগেই তাঁর সামনে হাঁটু মুড়ে বসে
পড়েছে, “কাকাবাবু আমাকে জানতেই হবে। অনুগ্রহ করে বলুন। কে এই লীলা? হৈম বলেছিল এই
লীলার জন্যই আমাদের সর্বনাশ হল, আগে রাধু তারপর হৈম। আমার কই দোষ বলুন?” নায়েব
মশাই শশব্যস্ত হয়ে বিনোদকে তুলে দাঁড় করালেন, “দেখ বাপু বিনু, লীলা যেই হোক সে
তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না,বহু বছর হল সে মৃত।” “মৃত? মানে?” হতভম্ব বিনোদের
দিকে তাকিয়ে নায়েব মশাই মাথা নামিয়ে বললেন, “ কর্তাবাবু খুব ভালো মানুষ। দেবতুল্য।
কিন্তু যৌবনে জেদের বশে একটা ছোট ভুল করে ফেলেছিলেন। এই বারাণসীর কাছে আখোদা
গ্রামে আমাদের কিছু জমি জিরেত ছিল। সেটা দেখতেই বড় বাবু কর্তা বাবুকে পাঠিয়েছিলেন।
সঙ্গে ওনার কিছু বন্ধু-বান্ধব ও গিয়েছিল, কটা দিন গ্রামে কাটিয়ে আসবে, আরাম করে।
খাজনাও আদায় হয়ে যাবে আর সাথে শিকারেরও সুযোগ ছিল। ঐ গ্রামেরই কোন প্রজার মেয়ে ছিল
লীলা। আমি দেখিনি, তবে শুনেছি দেখতে শুনতে মন্দ ছিল না। দিন কয়েকের মধ্যেই মেয়ের
বিয়ে বলে লীলার বাপ অনুরোধ করতে এসেছিল খাজনা যদি কিছু মাপ হয়। গরিবগুর্বো মানুষ
জন। কর্তামশাই এর মাথায় কি ভূত চাপল, নাকি বন্ধু রাই ওসকাল, বললেন, মেয়েকে আজ রাতে
পাঠিয়ে দিস, তোর খাজনা মাপ হয়ে যাবে। বুড়ো তো শাপ-শাপান্ত করতে করতে চলে গেল,
যাবার সময় বোধহয় বাঙালি বলেও কিছু গালি দিয়েছিল। যাই হোক রাতের বেলা কর্তা মশাই
পাইক নিয়ে গিয়ে মেয়েটাকে তুলে আনলেন। দিন দুয়েক পরে ছেড়ে দেন, তবে তার আগে নিজে
এবং ওনার বন্ধুরা-”। বিনোদের মাথা ঘুরছিল, ছিঃ বাবা? নায়েব মশাই চোরের মত মাথা
নীচু করে বললেন, “মেয়েটা ফিরে গিয়েছিল মা-বাবার কাছে, কিন্তু” একটু থেমে বললেন,
“যা হয় আর কি। নষ্ট মেয়েকে কি কেউ আর গ্রহণ করে? নাকি তাদের বিয়ে হয়। ওর ভবিষ্যৎ
বারানসির কোন কোঠাই ছিল হয়তো, কিন্তু মেয়েটা তার আগেই আত্মহত্যা করে। শুনেছি গলায়
দড়ি।” বিনোদ আর পারল না, ধীর পদক্ষেপে
বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে গেল। আর ফিরে এল না। বুড়ো কর্তা গিন্নী এত শোক আর নিতে পারল না,
তারাও চলে গেল একে একে। আর যারা ছিল তারাও সব কে কোথায় মরে হেজে গেল। বাড়ি এখন
লীলার। লীলা একাই থাকে। লীলা চায় না কেউ এবাড়িতে আসুক। বিশেষত রাতের বেলা-”।
“অন্তু প্লিজ চুপ কর।” চিৎকার করে উঠলাম
আমি, ভয়ে গলা ভেঙে গেল, চোখ ফেটে জল আসছে। অন্তু মাথা নেড়ে হাসতে হাসতে বলল, “লীলা
আসছে-।” ঘরের বাইরে সত্যি কার যেন পায়ের আওয়াজ, একবার মনে হল কোন বাচ্ছা যেন
সাইকেল চালাচ্ছে, পর মুহূর্তেই এক গা গয়না পরে কে যেন মল বাজাতে বাজাতে এগিয়ে
আসছে। হে ভগবান কি করি? মোমের শিখা প্রায় নিভু নিভু, সঞ্চিতা আমায় ভয়ে আঁকড়ে
ধরেছে, চৈতালি সমানে অন্তরাকে ঝাঁকাচ্ছে, “পিঙ্কি? পিঙ্কি?” ভয়ে আমাদের ঘাড়ের রোম
খাড়া হয়ে উঠেছে, সে আসছে, তার পায়ের আওয়াজ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। যে কোন মুহূর্তে
এক ধাক্কায় খুলে যাবে দরজা, তারপর কি হবে? আমিও জানি না।
[শেষ]