Saturday 12 November 2016

পাঁচশ- হাজার টাকা



- এজ্ঞে স্যার, এতক্ষণ ধরে এখেনে বসে আছেন, তাই ভাবছি-
- (অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে) তাতে তোমার কি হে ছোকরা? আরো তো বেঞ্চ আছে, তাতে বসো না। তা না তখন থেকে এই বেঞ্চেই বসে আছে।
- না, মানে স্যার, জায়গাটা তো বিশেষ ভালো না তাই আর কি। সামনেই মা গঙ্গা খলখল করে বয়ে যাচ্ছে-
- তো?
- অনেকেই সুসাইড করে আর কি!
- (ক্রোধে হতবাক হয়ে) মানে? আমাকে দেখে কি তোমার মনে হচ্ছে যে আমি সুইসাইড করব বলে বসে আছি?
- আজ্ঞে! সেই রাত আটটা থেকে বসে আছেন, এখন রাত বারোটা প্রায়। এতক্ষণে একটাও ফোন করলেননি। কেউ আপনাকে ফোনও করলনি। এর মানে আপনি মোবাইলটা বন্ধ করে –
- (গলার পর্দা বেশ উঁচুতে তুলে) তুমি বোধহয় জানো না, আমি কে?
- আজ্ঞে, জানি তো। আপনি মুখুজ্জে বাড়ির মেজ কর্তা। লতুর বাপ।
- লতু? হাউ ডেয়ার ইউ? লবঙ্গলতিকা কে লতু?
- চটছেন কেন স্যার? লতু তো পুরো মহল্লার গর্ব। কত সুন্দর দেখতে,এনজিনিইয়ার। তারপর বিয়ে করে বিদেশ যাচ্ছে।  কি চাবুকের মত ইংরাজি বলে।আমি তো চুনোপুঁটি। খোদ রন্তুদাই ফিদা ছিল ওর ওপর। রোজ সকালে যখন লতু স্কুলের বাস ধরতে যেত পেছন পেছন যেত। আবার ফেরার সময়ও। একদিন লতু পেছন ফিরে ইংরাজিতে এমন গটমটখট করে বকে দিল, যে রন্তুদা দুহাত তুলে, “ইয়েস- নো- সিস্টার-মাদার-” বলে দে দৌড়। হা হা হা।
- গুড। এই না হলে রামদুলাল মুখুজ্জের মেয়ে। তা এ শালা রন্তু আবার কে?
- রন্তুদা স্যার? এম এল এ সাহেবের ইয়ে আগে ডান হাত ছিল- এখন বোধহয় বাঁ হাত হবে। চিনতে পারছেন না, ওর ভালো নাম রতনচূর ভটচাজ্যি?
- অঃ। মনোময় বাবুর অপোগণ্ড ছোট ছেলেটা। ঠিক করেছে লতু। বেবুন হয়ে চাঁদে হাত- স্কাউন্ড্রেল।
- এমন বলবেননি স্যার।চাকরি পায়নি তাই এম এল এ সাহেবের আসেপাশে ঘোরে। সবাই কি জজ ব্যারিস্টার হবে বলুন? ভেবেছিল এম এল এ সাহেব খুশি হয়ে অন্তত ওকে কাউন্সিলার করে দেবে। ওমা? সে যে তলে তলে তার শালির ছেলের জন্য দরবার করছিল সে কি আর রন্তুদা জানে? আর তা ছাড়া রন্তুদার সাথে তো আপনারাই লতুর বিয়ে দেবেন বলেছিলেন।
- হে ভগবান! সে তো কোন ছেলেবেলায়---। মানিনী মানে আমার স্ত্রী আর মনোময় বাবুর স্ত্রী বলত, আদিখ্যেতা যত। মানিনী চলে গেছে আজ বিশ বছর হয়ে গেল----। সারা জীবন পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে রাখেনি তার দেওয়া খেলনা প্রতিশ্রুতি রাখার কোন দায় আমার নেই (গলা ভেঙে গেল- চোখ মুছলেন ধপধপে ধুতির খুঁটে)
- তা তুমি কে হে? তখন থেকে আমার পিছনে পড়ে আছ?
- না পিছনে পড়ে নেই স্যার। তবে কি না কেমন সন্দ হচ্ছে যে আপনার অভিপ্রায়ে কিছু গড়বড় আছে- আর তাছাড়া আপনি উঠে গেলে আমি – (মাথা নামিয়ে কান চুলকে) একটু মদটদ খেতাম আর কি।
- তা খাও না। এত বড় ঘাট পড়ে আছে-
- আপনার সামনে না আজ্ঞে-
- হু। তা তোমার নাম কি?
- আলি আজ্ঞে।
- আলি? কার ছেলে?
- তহমিনা বিবির। বাপের নাম আমি করি না। সেই শুয়ারটা আমার জন্মের আগেই মাকে তালাক দিয়ে অন্য একজনকে নিয়ে ভেগেছিল।
- ত-হ-মি-না? নামটা চেনা চেনা- ( বলতে বলতেই ভদ্রলোকের মুখে শোকের ছায়া নেমে এল) ওঃ- তুমি তহমিনার ছেলে।
- আজ্ঞে। (অল্প হেসে)আমার আম্মিকে সবাই চেনে একডাকে- । এই ঘাটের পাশেই মায়ের লাশ মিলেছিল। আমি তখন তিন। সেদিন সন্ধ্যে বেলা মা আমাকে নিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি থেকে বেরোবার সময় নানীকে বলে বেরিয়েছিল, “আম্মু নিকে করে নতুন জামাই নিয়ে ফিরব। দেখিস কি সুন্দর জামাই আনব-”। তালাকের পর নানী আর মামুদের সাথেই থাকতাম আমি আর আম্মি। কুত্তার বাচ্ছাটা আম্মিকে নিকে করার লোভ দেখিয়ে ভোগ করতে চেয়েছিল। আমার আম্মিটা এত বোকা ছিল না- (গলার নোংরা গামছায় চোখ মুছে গলা ঝেড়ে) নিকে করো- নিকে করো করে লোকটার পিছনেই পড়ে গিয়েছিল। সবই শোনা- শাদিসুদা বালবাচ্চাওলা লোকটা থোড়াই একটা তালাকশুদা মেয়েকে বিয়ে করত? তা সে যত ডবকাই হোক না-। নিকে করার নাম করে ডেকে এনে গলার নলি কেটে দিয়েছিল—সারা রাত মরা আম্মিকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছিলাম। সকালে উঠে দেখি চারদিকে লোকেলোকারন্য- কত কাঁদলাম- আম্মিকে কত ডাকলাম- সাড়াই দিল না স্যার (উচ্চ স্বরে কান্না)
- (কাঁধে হাত রেখে) তারপর?
- আর কি স্যার? নানী যতদিন বেঁচে ছিল নানীর কাছেই ছিলাম, আট বছর হতে না হতেই নানীও- । মামুরা থোড়াই দেখত? ওদেরও শাদি-তালাক- বালবাচ্চা নিয়ে নাজেহাল অবস্থা। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলাম কটা দিন আধপেটা খেয়ে না খেয়ে- তারপর পাঁচু দা ডেকে ওর চায়ের দোকানে কাজ দিল। ওখানেই থাকতাম রাতে- ওখানেই রন্তুদার সাথে আলাপ- আমার সামনেই লতু ওকে ইংরাজিতে ধমকেছিল- আরে হাঁ- পরশু লতুর বিয়ে না? আপনি এখেনে কি করছেন স্যার? এখনো কত কাজ বাকি- মন খারাপ নাকি?
- কি বলব বাপ। তুই ঠিকই ধরেছিস। আমি এখানে মরতেই এসেছিলাম-। আমার মত অপদার্থ পিতার জীবিত থাকার কোন অধিকার নেই- মানিনী চলে যাবার পর দ্বিতীয় দারপরিগ্রহ করিনি। জেদ করে ভেবেছিলাম মেয়েকে একাই মানুষ করে দেখিয়ে দেব। আর তাছাড়া উপায়ই বা কি ছিল? কেউ পাশে ছিল না বাপ। কেউ না।  পাছে দায়িত্ব নিতে হয় সবাই এড়িয়ে যেত জানিস। অথচ সকলের দায়ে অদায়ে আমি ছুটে গেছি সবার আগে-
-জানি তো।  পাড়ায় আপনার কত সম্মান- কত খাতির করে সবাই-
- হাতির মাথা করে।  আজ আমার এতবড় বিপদে কেউ পাশে দাঁড়াল?
- বিপদ?  মানে?
- আমার লতুর বিয়ে ভেঙে যাবে- কাল সকালে দুই লাখ টাকা তুলে এনেছিলাম। কেটারার ডেকরেটার লাইট জল মিষ্টি -- আজ সে গুলো এক বস্তা কাগজ মাত্র। কি করব?   আমি কি করব? একলা বুড়ো মানুষ। পায়ে ধরতে বাকি রেখেছি শুধু।  বিয়েটা হয়ে যাক আমি ধার রাখিনা---
- ইল্লি আর কি? লতুর বিয়ে ভেঙে যাবে? কোন হারাম--( জিভ কেটে) কাল সকালেই চলুন।  আমি আর রন্তুদা গিয়ে চমকালে সুড়সুড় করে দিয়ে দেবে চাচা।  আপনি  ঘর যান। আমরা কাল ভোরেই আসছি।  আর হ্যাঁ (লুঙ্গির গেঁজে থেকে এক গোছা নোট বার করে) এটা রাখুন।  বেশি নেই হাজার সাত হবে। একটু একটু করে জমাচ্ছিলাম একটা চায়ের দোকান করব বলে।  আমি আর রন্তুদা- রন্তুদা বলে কি জানেন স্যার,“ আলি সবাই আমাদের খারাপ ভাবে- ভাল হবার সুযোগ কেউ দিতে চায় না। আরে একটা সুযোগ দিয়ে তো দেখুক-”
- বেঁচে থাক বাপ। কিন্তু এ টাকা আমি নিতে পারব না।
- নিন স্যার । পিলিজ। ভালো কাজের সুযোগ রোজ থোড়াই আসে- লতুর বিয়ে বলে কথা। ধারই তো--- একটাও পাঁচশ হাজার নাই স্যার।
-বেশ। নিলাম। তবে শুধু টাকা নয়, টাকার মালিককেও চাই। আমার একতলার গ্যারাজের পাশে বেশ খানিকটা জায়গা আছে।  ওখানে চায়ের দোকান বানা।  তবে ঠেক বানালে চলবে না।
- স্যার।
-নো স্যার।  চাচা বা কাকাবাবু চলতে পারে। তবে আমি ম্যানেজারি করব কিন্তু। শুধু চা নয় বুঝলি- আলুর দম, ঘুঘনি, ডিম পাউরুটি----- আস্তে আস্তে আমরা হোম ডেলিভারি করব----

https://www.facebook.com/amianindita.blogspt.in/
#Aninditasblog

No comments:

Post a Comment