ঘরে ঢুকেই দেখলেন মানিনী একগাল হেসে ওনার দিকে তাকিয়ে
আছেন। চট করে মাথাটা গরম হয়ে গেল রামদুলাল বাবুর। রাগে গরগর করতে করতে বললেন “সব
সময় দাঁত কেলিয়েই আছেন।”মানিনীর হাসি তো কমলই না, উল্টে বোধহয় বেড়েই গেল। কৌতুকের
সুরে বললেন, “ কার রাগ কার ওপর ঝাড়ছ শুনি? মেয়ে ফোন করেনি বলে এত উত্তেজিত হচ্ছ
কেন? কোনদিন করে না?” “কোনদিন করে না?” ভেঙিয়ে উঠলেন রামদুলাল বাবু। “বুঁচু জানে
যে বাবা রাত এগারোটায় ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ে-।” কথা শেষ করতে পারলেন না, তার
আগেই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন মানিনী দেবী, “বুঁচু? ইশ। ফের যদি ঐ ঘেটো নামে ডেকেছ।” “বেশ
করব। বেশ করব” গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগলেন রামদুলাল বাবু। “ আমি ঘটি। আমার
মেয়েও ঘটি। কি আমার বাঙাল এলেন রে? এ দেশে জন্ম কম্ম, শিক্ষা দীক্ষা চাকরি, আর
বলার বেলায় ‘আমাগো দ্যাশ’? যাও না। যাও- তোমাগো দ্যাশে গিয়ে থাকো। যদি পারো তো আমি
কান কেটে ফেলে দেব। বিয়ের সময় মা বলেছিল, ‘রামু বাবা তুই আর মেয়ে পেলি না? একে
বাঙাল তায় চাকরী করে। তার ওপর আবার জাতে সুঁড়ি।”
“ওরে আমার কুলীন কায়েৎ রে। আমার বাবাও বলেছিল, ‘ মানু,
এত কষ্ট করে তোদের দুই বোনকে বড় করলাম, লেখাপড়া শেখালাম। তোরা দুজনেই নিজ চেষ্টায় সরকারি চাকরীও জোটালি। আর
শেষে কিনা রামদুলালকে বিয়ে করবি? কোন অংশে ও তোর সমকক্ষ বল দেখি? সারা জীবন তুই
ফার্স্ট হলে ও এক থেকে দশের মধ্যেও আসতে পারত না। দিদির বর সেইলের কর্মচারী আর তোর
বর মামুলী রাজ্য সরকারী কেরানী। এতো দেখছি তোর সংসারও আমায়ই টানতে হবে।”
“তোমার বাপটা একটা রাম ঢ্যামনা ছিল। শালা মালের দোকানের
পয়সা অথচ কোনদিন এক বোতল মাল ও দেয়নি।” হাত ঝেড়ে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতে বললেন
রামদুলাল বাবু। মানিনী কোমরে হাত দিয়ে ঝুঁকে পড়ে বললেন, “ হাঁ। তাই তো। আমার বাপ
ঢ্যামনাই হোক আর যাই হোক, তোমার মায়ের মত বিষধর নয়। ভুলে যেও না, রাকার জন্য যা
করার আমার মা-বাবাই করেছে। তোমার মা-বোনের টিকিটিও দেখা যায়নি। ঐ দুর্দিনে মা-বাবা
যদি রাকাকে নিজেদের কাছে না নিয়ে গিয়ে রাখত, রাকা বাঁচত? বুকে হাত দিয়ে বল দেখি?”
রামদুলাল বাবু গলা ঝেড়ে, রণে ভঙ্গ দেবার গলায় বললেন, “ সেতো আয়াও ছিল বাবা।”
“আয়া?” হিসহিসিয়ে উঠলেন মানিনী, “আয়া তো এখানেও ছিল রাম। তোমার মা কি বলেছিলেন মনে
আছে? এতটুকু বাচ্ছার দায়িত্ব আমি নিতে পারব না। আমার বাবা-মাও যদি তাই বলত? কি
করতাম আমরা? বাবা তো ঐ জন্যই বলত, সব দায়দায়িত্ব যখন আমাদেরই, তখন, মেয়েটার নামটাও
পাল্টে রাকা বসু থেকে রাকা সাহা করে দিলেই তো হয়। আসলে কি জানো তো, নাতিনাতনির
ক্ষেত্রে মেয়ের বাবা-মায়েদের সব সময়ই মনে হয়, এটা আমার সন্তানের সন্তান, আর ছেলের
বাবা-মায়ের মনে হয় এটা বউমার বাচ্ছা। হুঃ”
ঝগড়ার প্রাথমিক পর্ব মানিনীই জিতছেন, বুঝতে পেরে, অন্য
দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসলেন রামদুলাল বাবু, ধরা ধরা গলায় বললেন, “ সে যাই হোক, সাড়ে
এগারোটা বাজে, বু ইয়ে মানে রাকা এখনও কল করল না। বিয়ের পর মেয়েরা সত্যি পর হয়ে
যায়।” “হাঃ।” শাণিত ছুরির মত মানিনী বলে উঠলেন, “তোমার মা তো উল্টোটাই বলেন-। ছেলে
নাকি বউ অন্ত প্রাণ।”
গাঢ় গলায় রামদুলাল বাবু বলে উঠলেন, “সেটা কি খুব ভুল
বলে? আমার জীবনের চার নারী, মা-দিদি-তুমি আর রাকার মধ্যে যে আমি তোমাকেই সবথেকে
বেশি ভালোবাসি তা কি আর কোন প্রমাণের অপেক্ষা রাখে?” মানিনী কিছু বললেন না,
কৃষ্ণবর্ণ গালে কি অপরূপ আলতার ছোপ ফুটে উঠল, আজ এত বছর পরেও। মুগ্ধ দৃষ্টিতে
তাকিয়েছিলেন রামদুলাল বাবু তাঁর সাতাশ বছরের পুরানো স্ত্রীর দিকে। তির্যক কটাক্ষে
মানিনী বললেন, “ যত বয়স বাড়ছে, বুড়োর ঢলানিও ততো বাড়ছে।” রামদুলাল বাবু হেসে
বললেন, “কত বছর কেটে গেল মানু। আমরা বুড়ো হয়ে গেলাম।” মানিনী মুখ ঝামটা দিয়ে বলে
উঠলেন,”তুমি বুড়ো হয়েছ, আমি নই।” সত্যি তো মানিনী বুড়ো হননি, এখনও কোমর ছাপানো এক
মাথা ঘন কালো চুল, মুক্তোর মত ঝকঝকে দাঁত, সরু হিলহিলে কোমর, টানাটানা দুটি আয়ত
চক্ষু রামদুলাল বাবুর আদরিনী স্ত্রী। রামদুলাল বাবু বললেন, “মানু, আমরা দুজনেই
চেয়েছিলাম, জানতাম ও যে মেয়ে হবে। মেয়েই হবে। তোমার সেই ফোলা পেটে হাত রেখে তখনও আমরা
ঝগড়া করতাম, আমি বলতাম ওর নাম হবে বুঁচু আর তুমি বলতে কক্ষনও নয় ওর নাম রাকা। সবই
হল মানু। শুধু...”। কথা শেষ করতে পারলেন না, ফোনটা বেজে উঠল, “হ্যালো বাবা?” রাকার
ফোন, রামদুলাল বাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “এত ক্ষণে বুড়ো বাপকে মনে পড়ল?” রাকা হাসি
চেপে বলল, “সরি বাবা। মিটিং ছিল। এই শেষ হল। শেষ হতেই হল থেকে বেড়িয়ে তোমায় কল
করছি। চিন্তা কোরনা, মহাবীর গাড়ি নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছে, আমাকে বাড়ি নিয়ে যাবে
বলে। আর রাতের ব্যাঙ্গালোর অনেক সেফ, তোমাদের কলকাতার মত নয়। আর আমার বর তো আমার
সঙ্গেই আছে।” “হু। সাবধানে ফিরিস। আমি জেগেই রইলাম। বাড়ি ফিরে ফোন করিস।” অধৈর্য
গলায় রাকা বলে উঠল, “ মেসেজ করে দেব বাবা। নাউ বি আ গুড বয়, ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে
পড়। মায়ের ছবির সাথে আর গল্প করতে বস না। প্লিজ বাবা। ইউ নিড আ লাইফ। পচিশ বছর ধরে
একটা মৃত মানুষের স্মৃতি জড়িয়ে বেঁচে আছ। আর কত দিন? মেনে নাও বাবা। শি ইজ নো মোর।
মা নেই। কোথাও নেই...। শুভরাত্রি বাবা।”
https://www.facebook.com/amianindita.blogspt.in/
No comments:
Post a Comment