#অনিরডাইরি #স্যান্টাবুড়ো_কে
"স্যান্টাবুড়ো কে?"র কথাটা প্রথম তুলি আমিই। সেদিন ১২ই ডিসেম্বর, আর তিন দিন পরেই শুরু হতে চলেছে অষ্টম দুয়ারে সরকার। ব্যস্ততার সীমা নেই, ব্রাউনিয় গতিতে চতুর্দিকে ছুটছে সবাই। টিম তাম্রলিপ্তর অফিসিয়াল হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সকাল থেকে পোস্ট হয়েই চলেছে, একের পর এক অর্ডার, বাংলা/ইংরেজি SOP, নতুন প্রফর্মাওয়ালা ফর্ম, ম্যানিং এর প্রপোজাল ইত্যাদি প্রভৃতি। আর এসবের মাঝে আমার ছোট্ট মেসেজ, বড়দিনের আগে তো এমনিতেই আমাদের অফিস সাজানো হয়। এবারে তার সাথে একটা " সিক্রেট স্যান্টা" গেম রাখলে কেমন হয়?
তখন রাত সোয়া এগারোটা, শুধু প্রস্তাব রেখেই ক্ষান্ত হলাম না, খুঁজে পেতে খেলার নিয়মাবলীও পোস্টালাম গ্রুপে। সকালে উঠে দেখি কেবল যোশুয়া একটা বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করেছে, আর সৌম্য লিখেছে, "খেলাই যায়।" নাঃ দমলাম না, ১৩ তারিখে যে কয়জন অফিসে ছিল তাদেরকে ডেকে বসালাম আমার উল্টোদিকে। তারপর বললাম, " বাপু হে সবাই দুদণ্ড জিরোও। কাজ তো ১২ মাসই থাকবে। ওপরতলা সবসময়ই বলবে " এখনই করো"। আর নীচের তলা যখন একই দাবী করবে, বদলে জুটবে হিরণ্ময় নীরবতা। সরকারি চাকরগিরির এটাই শাশ্বত নিয়ম। তাই কাজের পাশাপাশি নিজেদেরকেও ভালো রাখা অত্যন্ত জরুরী। চলুক না দুয়ারে সরকার, থাকুক না ক্যাম্প, ঘনাক না সন্ধ্যা, বড়দিন আমরা পালন করবই।
কেক তো যোশুয়া খাওয়াবেই, সাথে ক্যান্টিনের দুধ-কফি থাকুক, থাকুক গৌরাঙ্গের সুইটসের মোয়া আর একটা করে কমলা লেবু। এই তো বাঙালির বড়দিন। দু'দণ্ড জিরিয়ে, কেক খেয়ে, আবার ফিরে যেও "ওয়ার্ক মোড" এ। এখন যে যার কাজে যাও, তবে যাবার আগে বলে যাও গেম খেলবে কিনা।
খুব সহজ খেলা, প্রত্যেকের নামের চিরকুট রাখা থাকবে একটা বাক্সের মধ্যে। সবাই একটা করে চিরকুট তুলবে, যার ভাগ্যে যার নাম উঠবে সে তার জন্য একটা উপহার কিনে আনবে। খুব দামি কিছু নয়, ৫০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে। দশ টাকা কমতেও পারে, বিশ টাকা বাড়তেও পারে, তবে কোনোমতেই আড়াইশোর বেশি যেন না হয়।
আর হ্যাঁ, কে কার নাম পেলে, সেটা কিন্তু কাউকে বলা যাবে না। উপহার কিনে, মোড়কে পুরে উপরে প্রাপকের নাম লিখে, লুকিয়ে ফেলে আসতে হবে আমাদের "গুপ্তধনের প্যাঁটরায়"। নির্দিষ্ট দিনে সবাই পাবে তার উপহার।
খেলার নিয়ম বুঝিয়ে দেবার সাথে সাথেই, সবার কি উৎসাহ। যারা সেদিন অফিসে ছিল তারা টুপটাপ চিরকুট তুলে নিল, যারা ছিল না তাদের বলা হল, তুলে নাও বাপু সময়মত এসে। উপহারের সর্বাধিক মূল্য ২০০ টাকা ধার্য হল বটে, বাস্তবে দেখলাম ওই টাকায় কিছু কেনা খুব চাপের ব্যাপার। তাও এমন কিছু , যা আমি স্যান্টা হয়ে যাকে দেব, তার মনোমতো হয়।
চুপচাপ উপহার কেনা চলতে লাগল, তার পাশাপাশি চলতে লাগল সীমাহীন ফাজলামি। মণীশ এসে নালিশ করল," রবি আমার পিছনে পড়ে আছে।কেবল বলছে, ' আপনার থেকে গিফট আমি নিয়েই ছাড়ব'।" হাসি চেপে জানতে চাইলাম তোমার ভাগ্যে কি রবি উঠেছে? মণীশ এক গাল হেসে বলল," সেটা বলব না। আপনি নিষেধ করেছেন।" রবি আবার এসে নালিশ করে গেল হক বাবুর নামে। "তুই কার জন্য, কি কিনেছিস, আমি জানি" এই বলে নাকি তাকে ক্ষেপাচ্ছেন হক বাবু। এই একই কথা বলে জহর বাবুর পিছনে লেগে খুব একটা সুবিধে করতে পারল না বেদজ্যোতি। সৌম্য বায়না জুড়ল," আমার চিরকুটটা আমি বদল করব। আমার ভাগ্যে এমন একজন উঠেছে, তার জন্য কি কিনব আমি বুঝে উঠতে পারছি না।" নভোনীল বাবু আর শুভদীপ্তর কপালে ওদের নিজেদেরই নাম উঠল। নভোনীল বাবু তাও সুবোধ হয়ে চিরকুট ফেরৎ/ বদলে নিলেন, শুভদীপ্ত কিছুতেই বদলাবে না, " আমি বেশ নিজেকেই গিফট দুব -" ইত্যাদি প্রভৃতি। কে বলবে পাশাপাশি দুয়ারে সরকার চলছে।টার্গেটের চাপে চাঁদি ফাটছে সবার।
দেখতে দেখতে এসে গেল নির্দিষ্ট দিনটা, ক্যাম্প সেরে অরূপ আর শান্তনুকে সঙ্গী করে ঝুরি আলো, রঙিন ফিতে, নকল শিকলী আর গুচ্ছগুচ্ছ তারা দিয়ে অফিস সাজিয়ে ফেলল যোশুয়া মুর্মু। বড়দিনের সঙ্গে তারার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক যে। আর মাত্র কয়েকটা ঘন্টা, তারপরেই ধরাধামে ২০২৩ তম বারের জন্য আবির্ভূত হবেন বেথলেহেমের শিশু। সঙ্গে আসবেন স্যান্টা বুড়ো।
এখন প্রশ্ন হল, আমাদের অফিসের স্যান্টা বুড়ো ওইদিন আসবেন কি! গতবার রঞ্জিত স্যান্টা সেজেছিল, এবার এত চাপের মধ্যে আদৌ সাজতে রাজি হবে কি? আমার থেকেও দেখি রঞ্জিতের উৎসাহ বেশি, "হ্যাঁ ম্যাডাম, সেজে নেব। জহর বাবু, আপনার লাল পাঞ্জাবিটা ভালো করে ধুয়ে আনবেন কিন্তু।" উৎসাহের দাপট সামলে যোশুয়াকে বললাম, এসে আগে ব্যাটার দাড়ি খুঁজো, গতবছর গুছিয়ে রাখা হয়েছিল যদিও, তবুও বলা তো যায় না ইঁদুরে কেটে থাকে যদি।
দেখতে দেখতে এসে গেল নির্দিষ্ট দিনটা, চারটে- সাড়ে চারটে বাজলে ক্যাম্প গুটিয়ে একে একে এসে হাজির হল সবাই। অনুষ্ঠান শুরু হতে হতে গড়িয়ে গেল সন্ধ্যা। স্যান্টা এসে, " হো হো হো" করে গেল, কফির কাপ, কেকের বাক্স ছেঁচে পুঁচে সাফ হয়ে গেল, কমলালেবুটা দেখলাম সম্মিলিত অ্যাসিড ভীতিতে বাতিল হয়েছে। এবার "আমার স্যান্টা কে" র পালা। গুদাম ঘর থেকে টেনে আনা হয়েছে পুরাণ এক কম্পিউটারের খালি বাক্স। ওটাই আজ আমাদের গুপ্তধনের প্যাঁটরা। সুযোগ বুঝে চুপি চুপি উপহার ফেলে এসেছে সবাই। উপহারের আধিক্যে আপাতত বন্ধই হচ্ছে না বাক্স খানা।
স্যান্টা বুড়ো, প্যাঁটরার মধ্যে হাত ঢোকাচ্ছে আর তুলে আনছে, সুদৃশ্য সব মোড়ক। পড়া হচ্ছে প্রাপকের নাম। যে পাচ্ছে, সে আন্দাজ করছে কে দিয়েছে। সৌরভ পেল দারুণ একটা মাফলার। কে দিয়েছে খুঁজতে হল না, কারণ ওই রকম একটি মাফলার বিগত সপ্তাহে পরে আসছিল চঞ্চল। যোশুয়ার ভাগ্যে বেরোলো, পেনড্রাইভ আর বেশ অনেকগুলো চকলেট।" হুম, যে দিয়েছে সে জানে আমি ভাঙ্গা পেনড্রাইভ দিয়ে কোনমতে কাজ চালাই। তাতেও এত ভাইরাস কিলবিল করে, যে মেশিনগুলো ওটার সাথে কাজ করতেই চায়না।" বলতে বলতে খপ করে একটা টফি মুখে পুরতেই, হাঁ হাঁ করে উঠল সৌম্য, "আরে ওগুলো তোমার মেয়ের জন্য-"।
কেলো বাঁধালো সুরজিৎ, প্রাপকের সাথে সাথে ভালোবাসা সহ নিজের নামটাও লিখে ফেলে, সবথেকে বড় বাক্সটা পেল শান্তনু, ভিতরে অসাধারণ একটি শোপিস। কে দিয়েছে ও আন্দাজ করতে না পারলেও, যারা হক বাবুকে ঢাউস ব্যাগ নিয়ে গুপ্তধনের ঘরে ঢুকতে দেখেছে তারা ধরেই ফেলল। IMW মণীশের স্যান্টা বেরোল, তারই CKCO নন্দন। মণীশ হেঁসে বাঁচে না, "উনি আমার পাশে বসেই আমাজন ঘাঁটছিলেন, আর আমি বলছিলাম বেশি দামি কিছু কিনবেন না, ম্যাডাম নিষেধ করেছেন।" নন্দনের স্যান্টা বেরোল কয়াল, কয়ালের স্যান্টা আবার মণীশ। উপহার পাওয়া পারফিউমের সৌরভে মম করে উঠল গরীবের চেম্বার খানা।
কাকতালীয় ভাবে বেদজ্যোতি আর রঞ্জিত বেরোল একে অপরের স্যান্টা। হক বাবু পেলেন এক কফি মগ। যার দুদিকেই জাজ্বল্যমান হক বাবু। একদিকে লুঙ্গি - পাঞ্জাবি - ফেজ পরা হক বাবু, ইফতারের অব্যবহিত পূর্বে সদ্য নামাজ পড়ে উঠেছেন। তো অন্য দিকে বসন্তৎসবের লাল - কমলা - গোলাপী রং মাখা ভূত হক বাবু, জনে জনে মঠ - ফুটকড়াই বিলি করছেন। মাথা খাটিয়ে কি অসাধারণ উপহার বেছেছে শুভদীপ্ত।
স্যান্টা হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের বই কেনাটা মস্ত ভুল হয়েছিল আমার। কিছুদিন আগেই ব্যাটাদের বলেছিলাম, ভদ্রলোক আমার অত্যন্ত প্রিয় লেখক। তুত্তুরীকে দিয়ে নাম লিখিয়েও আত্মপরিচয় গোপন রাখতে পারলাম না। মোড়ক খুলেই সন্দীপ চিৎকার করে উঠল, " ম্যাডাম এটা আপনি দিয়েছেন।" কিন্তু আমার স্যান্টাকে আমি এত সহজে ধরতে পারলাম না। এমন সুন্দর বাদামী - চন্দন আর কালো রঙের হাতব্যাগটা কে দিতে পারে আমায়? শেষে হক বাবু উদ্ধারকর্তা হলেন, " রবি দিছে ম্যাডাম। যেদিন থেকে চিরকুট পেয়েছে, উফঃ, উফঃ করেই যাচ্ছিল। তখনই বুঝেছি,ওর ভাগ্যে আপনিই জুটেছেন।"
সবার সব উপহার আদানপ্রদান হয়ে গেল সৌম্যর উপহার কই? কি সর্বনাশ! আমার টিমে দুটো অভিমানী শিশু আছে, বয়স যাই হোক, যাদের মনের বয়স বাড়েনি, তাদের একজন সৌম্য। ওকে খালি হাতে ফেরানো যায় নাকি? আমরা অফিস তোলপাড় করছি, সবাই সবাইকে জিজ্ঞাসা করছি, কার ভাগ্যে ওর নাম উঠেছিল, একদম অভিমানী শিশুর মতই মাথা নত করে মোবাইল ঘেঁটে যাচ্ছে সৌম্য। মাঝে মাঝে উদাস চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে,খানিক দাড়ি চুলকাচ্ছে, দুঃখী সুরে " ঠিক আছে। আমার উপহার না হলেও চলবে" বলছে। ঘরে উপস্থিত প্রতিটা সদস্য বুঝতে পারছে অভিমানের পাহাড় জমছে, এত অভিমান যে ভালো করে মিথ্যাও বলতে পারছে না।
শেষ পর্যন্ত হক বাবুর আলমারি থেকে বেরোয় সৌম্যর উপহার। ওর স্যান্টা আমাদের বৈদ্যনাথ, চূড়ান্ত শারীরিক অসুস্থতার কারণে নিজে হাজির হতে পারেনি বটে, তবে উপহারটা পাঠিয়ে দিয়েছিল হক বাবুর হাতে। সেটা প্যাঁটরায় রাখতে ভুলে গেছেন হক বাবু। তাই যত কেলো।
উপহার আদান প্রদান অন্তে সবাই যখন বেরোচ্ছি, সন্দীপ আর সৌরভ বলল, " বিশ্বাস করুন ম্যাডাম ভুলেই গেছি দুয়ারে সরকার চলছে।" জহর বাবু তখন রবিকে পাকড়াও করেছেন, " সব পড়বে। মুখস্থ করবে। আমি পড়া ধরব। পারলে আরো বড় ডিকশনারি উপহার পাবে।" বেচারা রবি, বেজায় কড়া স্যান্টার পাল্লায় পড়েছে যা দেখি।
No comments:
Post a Comment