Sunday, 14 January 2024

অনির ডাইরি ২৪শে ডিসেম্বর, ২০২৩

 


#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 


আজও সুস্পষ্ট ভাবে মনে আছে দিনটার কথা। সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি বোধহয়, বিবেকানন্দ ইস্কুলের কাছে জনৈক স্যারের কাছে পড়তে যেতাম। বাড়ি থেকে বেশ অনেকটা দূর, রিক্সা ভাড়া দিতে কসুর করত না বাবা, তবুও হেঁটে যেতাম, হেঁটে ফিরতাম। বেকার মেয়ে, চাকুরী থেকে সদ্য স্বেচ্ছা অবসর নেওয়া বাপের ওপর এমনিতেই বোঝা, আর অতিরিক্ত চাপ দিতে মন চাইত না। 


সেদিনও হেঁটে ফিরছি, শ্যামাশ্রী সিনেমার সামনে জনৈক প্রাক্তন সহপাঠিনীর সাথে দেখা। আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগা, নিজেকে চূড়ান্ত পিছিয়ে পড়া, হেরে যাওয়া, অবাঞ্ছিত, কুৎসিৎ কদর্য মনে করা সেদিনের আমি, এরকম কারো সাথে দেখা হলেই মাথা নীচু করে কেটে পড়ায় বিশ্বাসী আমি, সেদিনও পালিয়েই গিয়েছিলাম প্রায়। রাস্তা পেরিয়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল সহপাঠিনী মেয়েটি। " কি রে, সেদিন এলি না যে?" বেশ খানিক অপ্রস্তুত হয়ে, পলায়ন পর মনোবৃত্তিকে সাময়িক দমিয়ে, ঘেমো মুখের ওপর সস্তা বাটিক এর রুমালের বেশ অনেকগুলো প্রলেপ বুলিয়ে কোন মতে জিজ্ঞাসা করলাম, " কোথায়? কবে?" 


মেয়েটি হেসে বলল, " আরে ওই যে অমুকের বাড়ি? আমরা সবাই এসেছিলাম।" যার বাড়ির কথা হচ্ছে তার বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি হাঁটা পথে মিনিট চার। আমাদের স্কুলেই পড়ত সেই মেয়েটিও। তার বাড়িতে খামোখা যাব কেন? বলাতে আলিঙ্গন রত সহপাঠিনী থতমত খেয়ে বলল, " কেন? তোকে বলেনি? আমরা যারা এক সাথে বিজ্ঞান বিভাগে পড়েছিলাম সকলকেই বলেছিল তো? সবাই এসেছিল, তুই আর অমুক বাদে।"


লজ্জায় বেশ কয়েকটা ঢোঁক গিলেও সাহস অর্জন করতে পারলাম না বলার যে আমাকে তো বলেইনি মেয়েটা। সাহস করে বলতে পারলাম না, ওই মেয়েটার দুর্দিনে অর্থাৎ যেদিন চূড়ান্ত খারাপ ফল করে এক ঘরে হয়ে গিয়েছিল মেয়েটি, আমারই কলেজে ভর্তি হয়েছিল কোনমতে, প্রথমে পাশ কোর্সে, পরে সেযুগে  গ্ল্যামারহীন কোন বিষয়ে স্নাতক হিসেবে, তার ঘনিষ্ট তম বান্ধবীরাও পাত্তা দিত না,সেদিনও আমি গায়ে পড়ে কথা বলেছি মেয়েটার সাথে। যুগিয়েছি সাহস, নির্দ্বিধায় ভাগ করে নিয়েছি নিজের নোটস।


 আমাদের বাড়িতেও তো এসেছিল মেয়েটা কয়েকবার, আমাদের দেড়শ বছরের পুরাণ রহস্যময় ভাগের বাড়ি। পলেস্তারা খসা দেওয়াল, কার্নিশে গজিয়ে ওঠা বট,অশ্বত্থের চারা। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় একটা বিশেষ জায়গায় দাঁড়িয়ে হাততালি দিলে ঝুম ঝুম শব্দ হত। আমরা ভাবতাম নির্ঘাত ঘড়া ভরা মোহর লুকিয়ে রেখেছেন প্রপিতামহ অথবা আমাদের চিলে কোঠার ছাত, যার একটা বিশেষ জায়গায় একটা তামার পয়সা পোঁতা ছিল। চার্বাক পন্থী প্রপিতামহ বিশেষ তিথিতে সারা রাত ধরে সস্ত্রীক আরাধনা করে, ব্রাহ্ম মুহূর্তের অব্যবহিত পূর্বে, বিশাল তামার পরাতে করে পঞ্চব্যঞ্জন ভোগ রেখে আসত যেখানে। সূর্যের প্রথম কিরণের সাথে সাথে সেখানে গিয়ে হাজির হতেন তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর তথা গৃহ পরিচারক, আর প্রতিবারই আবিষ্কার করতেন খালি থালা বাটি। কে যেন চেটে পুটে খেয়ে যেত সব। বাড়িটাকে ঘিরে ছিল আম - কাঁঠাল - পেয়ারা - নাগকেশরের জঙ্গল, বেঁজি, ভাম, হনুমানের গুষ্টি থাকত সেথায়, তাঁদেরই কেউ খেয়ে যেত হয়তো, কিন্তু বৃদ্ধ প্রপিতামহ ভাবতেন শিবায় খেয়ে গেছে সব। সব গল্প শুনিয়েছিলাম মেয়েটাকে। উল্টে শুনেছিলাম তার মনোবেদনা। মা অফিসে, পিসি গৃহকর্মে নিমজ্জিত,তাতেও কসুর থাকত না লৌকিকতার। স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে চা বানিয়ে দিত জ্যাঠাইমা। ফাটা কাপ, হাতল ভাঙ্গা কাপের  চাটা আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিত মেয়েটা। 


আর সেই মেয়ে একবার বলার প্রয়োজন বোধ করল না আমায়? অন্য যে মেয়েটি অনুপস্থিত ছিল এই গেট্টুতে, তারও আমাদের মতই অর্থনৈতিক অবস্থা। সদ্য অবসর নেওয়া বাবা, বর্ষায় জল পড়া ফাটা ছাদ, নিতান্ত সাধারণ গৃহকোণ। সেও একই কলেজে পড়ত, আমি পদার্থ বিদ্যা,আর সে রসায়ন। সেও জানত না এই গেটটুর কথা। আমি শুধাতে আকাশ থেকে পড়েছিল সেও। তারপর খানিক দম নিয়ে বলেছিল, " আসলে আমার বাবা তো খুব গরীব -"। হয়তো এটাই কারণ, তাও মানতে পারিনি আমি, আমার বাবার অর্থনৈতিক অবস্থা দিয়ে যেন যাচাই করা হবে আমায়? আমাদের ভাঙ্গা বাড়ি, আমাদের কার্নিশে গজিয়ে ওঠা বটগাছের চারা বা আমাদের হাতল ভাঙ্গা কাপ দিয়ে কেন আমার মূল্যায়ন হবে? আমি অনিন্দিতা,  আমি নম্বর দেখে কারো সাথে মিশি না, আমার জ্যাঠাইমা তার দেওর ঝি আর তার বন্ধুর মধ্যে কোন প্রভেদ করে না, আমার অকপট ভাবে বন্ধুর সাথে মেশা এগুলো কেন হিসেবে ধরা হবে না?


বাড়ি এসে যখন বাবার বুক ভিজিয়ে দিয়েছিলাম তপ্ত নোনতা জলে, প্রবল হেসে ছিল বাবা। তারপর শুনিয়েছিল সেই গল্পটা, গলির মুখে দাঁড়িয়ে প্রবল গালাগালি করছে একটা লোক। কোনমতে তার পাশ কাটিয়ে, ইশ্বরচন্দ্রের বাড়ি গিয়ে হাজির হলেন জনৈক অনুগামী। বিদ্যাসাগরের পদে প্রণতি জানিয়ে কইলেন, "মহাশয়, গলির মুখে জনৈক ভদ্রলোক আপনাকে অত্যন্ত কটু ভাষায় আক্রমণ করছে। কি সব অশ্রাব্য গালাগাল, কানে শোনা যায় না।" বাঙালির প্রাণ পুরুষ অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন, হাসির চোটে বেদম। উল্টো দিকের ভদ্রলোক পুরো বেকুব। বেশ খানিক পর, দম নিয়ে বিদ্যাসাগর কইলেন, " লোকটা আমায় খিস্তি করছে? কিন্তু কেন? আমি তো ওর কোন উপকার করিনি -"।


কলিযুগে উপকারীকে বাঘে খায়, ঠাকুমা বলত। পরবর্তী কালে বাবা ও সেই একই কথা বলে গেছে। বারবার, লাগাতার। আমি শুনিনি। কেমন যেন মনে হত , আজও হয়, কাউকে কাঠি করার থেকে কারো উপকার করা ভালো, বিশেষত আমাদের মত সরকারী আধিকারিকদের। তাই করি, বদলে কোন প্রত্যাশা রাখি না। কারণ বাবা শিখিয়েছে, 'প্রত্যাশাতেই যন্ত্রণা'। তাও খারাপ তো লাগেই। সেদিন যেমন জনৈকা বান্ধবী কইল, " অনিন্দিতা দি উনি তোমায় ক্লাস নিতে ডাকেননি? অমুককে তো ডেকেছেন। ক্লাস প্রতি এত টাকাও পাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আর তোমায় ডাকেননি? তোমার সাথে তো কত ভালো সম্পর্ক! তুমি তো সুযোগ পেলেই ওনাকে ডাকো।"


তা ডাকি বটে, আগামী দিনেও ডাকব। ঘুরিয়ে ওনার থেকে কিছু আশাও করি না। তবুও -। জুতোয় যেন কাঁকড় ঢুকল। শৌভিককে বললে নির্ঘাত খিল্লি ছাড়া কিছু জুটবে না। বাবা অন্তত খিল্লি করবে না। বাবাকেই বললাম। বাবা সেই একই কথা বলল, " তোমায় বলেছি তো। কলিযুগে উপকারীকে বাঘে খায়।" তা খায় বটে, তাই বলে কারো উপকার করতে পারব নি? তেনাদের জগৎ দেনাপাওনায় চলে হয়তো, আমার তো নয়। হাসল বাবা। "তা বটে, হাজার হোক চাটুজ্জে বাড়ির রক্ত, তোমার পিতামহ ও পারেনি। আমিও না। জিন ভূত থুড়ি আমাদের জিন, তোমার মধ্যেও ফুটে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। শুধু একটা জিনিস ত্যাগ করো, প্রত্যাশাটা। দেখবে সুদ সমেত ফিরে পাবে সব। হ্যাঁ যার উপকার করবে,সে হয়তো সবসময় পারবে না। কিন্তু যখন তোমার প্রয়োজন হবে, যখন তুমি বিপদে পড়বে, দেখবে তোমায় উদ্ধার করতে অন্য অনেক লোক এসে হাজির হবে। মিলিয়ে নিও।" 


হাফ বিশ্বাস নিয়ে অফিসে এলাম। আজ শুক্রবার, বড়দিন আসতে আর মাত্র দিন দুয়েক বাকি। এখনও একটা ও কেক কেনা হয়নি। দূর আমার বরটাকে যে আটকে রেখেছে মহানগর, আসন্ন নির্বাচনের ট্রেনিং উপলক্ষে। কেকটা কিনবে কে? বানাতেও ইচ্ছে করছে না।  আসল লোকটা বাড়িতে না থাকলে ভালো লাগে নাকি। সবে চেয়ারে বসেছি, দরজা খুলে মুখ বাড়ালো একদল নীল সাদা শাড়ি পরিহিত মহিলা। এনারাই সম্মিলিত ভাবে সাফ রাখেন নিমতৌড়িরির এই নব্য প্রশাসনিক ভবন চত্বর। কেউ শৌচাগার সাফ করেন তো কেউ করিডর ঝাঁট দেন, কেউ বাগানের পাতা তোলেন তো  কেউ গাছে জল দেন, তো কেউ আবর্জ্জনা পূর্ণ আঁস্তাকুড় সাফ করেন। মাঝে মাঝে বিভিন্ন দাবী নিয়ে আমার কাছে আসেন। এমন সব দাবী যার কোনকিছুই আমার হাতে নেই। তবু শুনি। সরকারী দপ্তর সম্পর্কে সাধারণ মানুষের সব থেকে বড় নালিশ হল কেউ কথা শোনে না। তাই শুনি। টুকটাক পরামর্শ ও দিই। কোথায় কার কাছে আবেদন করতে হবে সেটা জানিয়ে দিই, অনেক সময় আবেদন পত্র গুলো মকস ও করে দিই। মাঝে মাঝে বিরক্ত ও হই। "এখন ব্যস্ত " বলে ভাগিয়ে ও দিয়েছি একবার। তাও আসেন ওনারা। আজও এসেছেন, ভাবলাম নতুন কোন সমস্যা নিয়ে, ভ্রু ভঙ্গিমায় বোধহয়  ফুটেও উঠেছিল মনের পটচিত্র, ওনারা জিভ কাটলেন। বদলে আমার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল একখান কেক। বুঝতে পারলাম, কালেক্টরেট এর সামনের দোকান থেকে কেনা। বুঝতে পারলাম চাঁদা তুলে কেনা এবং ওই দোকানের সবথেকে দামী কেকটা কেনা হয়েছে আমার জন্য। 


এহেন ভালোবাসার উপহার ফিরিয়ে দেওয়ার হিম্মত আমার নেই। পরম আনন্দে গ্রহণ করলাম ওনাদের উপহার। সবাইকে বড়দিন এবং আসন্ন নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানালাম। আর ওনারা বললেন, " ম্যাডাম এই চত্বরে, এত গুলা অফিস আছে, এত জন সাহেব, ম্যাডাম বসেন, কিন্তু তাদের কারো সাথে আমাদের কথা বলার সাহস হয় না। একমাত্র আপনিই আছেন, যিনি আমাদের কথা শোনেন। শলা পরামর্শ দেন। আপনার উৎসাহেই আমরা বিভিন্ন দাবী দাওয়া তুলতে পারি। আমরা আপনাকে বড্ড ভালোবাসি। আপনি খুব ভালো থাকুন। কচি ( তুত্তুরী), স্যার (শৌভিক) ও খুব ভালো থাকুন। আপনার জন্য আমরা সব কিছু করতে পারি। আপনি যা বলবেন আমরা করব।" হাসব না কাঁদব বুঝতে না পেরে হেসেই বিদায় করলাম সবকটাকে। আর মনে মনে ভাবলাম চাটুজ্জে বাড়ির জিন ভূতটা এমনও কিছু খারাপ নয়। আরে বাবা তুমি অধম হতেই পারো, it's your choice baby, তাই বলে আমি উত্তম হব না কেন? It's my choice after all

No comments:

Post a Comment