Monday 15 October 2018

ঘন্টা-


“মানা,এর মধ্যে কোনটা তোর দেওয়া?” উফ্ কি জ্বালাতন মাইরি,বেলা নটার সময় কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে এ কি প্রশ্ন রে বাবা। কোনমতে চোখ খুলে দেখি বাবার হাতে তিনতিনটে আনকোরা টিশার্ট। কোন মতে হাই চেপে বললাম,“রেমণ্ডের কোনটা দেখো না?অলিভ গ্রীন কালার। ”“হুঁ। তাহলে এটা। ”হৃষ্ট চিত্তে বলল বাবা। বুঝলাম আপাততঃ ঘুমের দফা গয়া। ঐ টি শার্টটি এবার গায়ে গলিয়ে বাবা জানতে আসবে, কেমন লাগছে? পেটটা কমেছে কি না? মাস তিনেক ধরে প্রাণায়াম করছে,তাতে নাকি বাবার ভুঁড়ি হড়হড়িয়ে কমে যাচ্ছে। সবকটা প্যান্ট ঢলঢলে হয়ে গেছে। বিগত শুক্রবার থেকে আমার পিছনে পড়ে আছে,“তুইও কর। ”
একটু বাদে আবার এসে হাজির,“মানা,দেখো তোমার মোচি। ”কি কুক্ষণে অনলাইন মোচির চটি কিনে দিয়েছি মাইরি,দাম শুনে ইস্তক গাল দিয়ে বাপের নাম ভুলিয়ে দিচ্ছে, তবে আজ মাঞ্জা দেবার জন্য পায়ে গলিয়ে পায়চারি করছে দেখলাম। আজ ঘন্টার বিবাহবার্ষিকী। আশ্বিন মাসে বিবাহ?আজ্ঞে হ্যাঁ মশাই,ঘন্টা ওরফে শ্রী দিলীপ দাস, আজ থেকে আঠারো আগে এমনি এক শারদ প্রভাতে সইসাবুদ করে বিয়ে করেছিলেন পাড়ার বুঁচিকে। শনিবার সাত সক্কালে লাঠি ঠুকঠুক করতে করতে ঘন্টানন্দ এসেছিলেন বাবাকে নিমন্ত্রণ করতে। আমি তখন মুরগীর মাংসে দই আর রসুন বাটা মাখিয়ে চটকাচ্ছি, বললাম,“খেয়ে যাও। ” বলল,“পাগল?তোর কাকিমা পঞ্চব্যঞ্জন রেঁধে বসে থাকবে রে পাগলী। ” তাজ্জব হয়ে গেলাম, কাকিমা অন্তত ৭৫,তিনি এত রাঁধেন নাকি? উত্তরে একগাল হাসতে গিয়ে বাঁধানো দাঁত প্রায় ছিটকে এল,“নাঃ। রাঁধুনী আছে,তবে বেড়ে তো দেয়। ঠাণ্ডা হয়ে গেলে গরম করে দেয়। ”বললাম,“চা খেয়ে যাও অন্তত। ” তো বলল,“দূর পাগলী। এখন চা খেলেই হিসি পাবে। তারপরই পাইখানা পাবে। ” মধ্যহাওড়ার ঘটি আমরা অত পরিশীলিত বাক্য ঘরোয়া আড্ডায় অনুগ্রহ করে আশা করবেন না।
১৯৫৮ সালে হাওড়া বেলিলিয়াস স্কুল থেকে স্কুল ফাইনাল পাশ করেছিল ৩৬জন ছেলে। তারপর কেটে গেছে ৬০টা বছর, গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে না জানি কত জল আর কত রক্ত, সেদিনের তরুণ তুর্কীরা আজ অশীতিপর বৃদ্ধ,বিভিন্ন সময় ঝরে গেছে অনেকে,হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে, কিন্তু ১৯৫৮ব্যাচের একতা আজও ঈর্ষণীয় ভাবে অটুট।
তো শ্রীমাণ ঘণ্টা বাবু,হ্যাট্রিক করে স্কুল ফাইনাল কোন মতে পাশ করেই বুঝেছিলেন মা সরস্বতী ওণার প্রতি তেমন সদয় নয়। বিশাল পরিবারের জেষ্ঠ্য পুত্র,মা বছর বছর মা ষষ্ঠীর কৃপায় বংশবৃদ্ধি করে চলেছে, বাবার রোজগারে আর হরিমটরও জোটে না। গোকুলে বাড়ছে ছয় ভাই আর চার বোন। অগত্যা পেটের ধান্ধায় ঘন্টা কাকু পাড়ি দিল সুদূর পাঞ্জাবের ফাগুয়ারা।
ফাগুয়ারা হতাশ করেনি,কটন মিলের দয়ায় হাতে দুচার পয়সা আসতেই দিলে জাগল আশনাই। যে পাঞ্জাবি মালকিনের বাড়িতে ভাড়া থাকত,তার ডাগর কন্যা, মনে হল গররাজি। রোজ সকালে স্নান করে ঘন্টা যখন ছাতে উঠত ভিজে গামছা মেলতে, অন্দরমহলের সিঁড়ি দিয়ে ঠিক সেই সময় বানোও উঠত ছাতে, তারপর? বিশাল ছাত জোড়া ভিজে পোশাকের এপাশ থেকে ওপাশে ছুটে যেত তির-এ-নজর। জখমি জিগর নিয়ে মিলে যেত ঘন্টানন্দ। ধীরে ধীরে সাহস করে ফুটোফাটা ইংরেজিতে প্রেম পত্র লিখেই ফেলল ঘন্টা। লুকিয়ে হস্তান্তর ও হল। জবাবও এল,চতুর্গুণ ভুলে ভরা,কিন্তু প্রেমরসে জবজবে। দিব্যি চলছিল,হঠাৎ বাধ সাধল,বানোর “মঙ্গেতর”।কি ভাবে যেন জানাজানি হয়ে গেল।  বেজাতে পিরীত? ব্যাপারটা এমন দাঁড়িলো ভোলি পাঞ্জাবন কে প্রেমের জালে ফেলেছে “শালা বাঙ্গালী”। কৃপাণ নিয়ে বানোর গোষ্ঠী গিয়ে হাজির কটন মিলে। কোনমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বাঁচল ঘন্টা। কাপুরথালা জেলারই অন্য মিলে কাজও জুটে গেল কর্মক্ষেত্রে অর্জিত সুনাম এবং ভদ্র ব্যবহারের জন্য।
এরপর আর জীবনে কোন মেয়ের দিকে তাকায়নি ঘন্টা। একমনে চাকরী করে গেছে আর বাড়িতে পয়সা পাঠিয়েছে। ঘন্টার অর্থেই মেরামতি হয়েছে ফুটিফাটা বাস্তুভিটের। একএক করে বিয়ে হয়েছে ভাই এবং বোনেদের। শুধু ঘন্টার বিয়ের কথাই কেউ কখনও ভাবেনি,বলেওনি। ঘন্টাও পেটে খিদে মুখে লাজ নিয়ে পালন করে গেছে জেষ্ঠ্য পুত্রের গুরুদায়িত্ব।
ষাট বছর বয়সে,অবসর নেবার পর, বোরিয়া-বিস্তর নিয়ে বাস্তুভিটেয় হাজির হয়ে ঘন্টা দেখল যে মায়ের অনুমতি এবং প্রচ্ছন্ন প্রশয়ে ভাইবোনেরা বাড়ি আপোসে ভাগ করে নিয়েছে। শুধু ঘন্টার ভাগেই লবডঙ্কা। এত মালপত্র নিয়ে থাকবে কোথায়?ভাইয়েরা নিরুত্তর।মাকে বলল,“মা তোমার ঘরে অন্তত থাকতে দাও। ”মা আমতা আমতা করে জানালেন, তাঁর ঘরটা তিনি তাঁর কোন প্রিয় নাতিকে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ। তাই জ্যেষ্ঠপুত্রকে সেখানে জায়গা দেওয়া সম্ভব নয়। স্বদেশে ফিরে প্রথম রাতটা ঘন্টার কাটল সিঁড়ির সামনের তক্তোপোশে।
আজও মনে আছে,অফিস থেকে ফিরে সদ্য চায়ের কাপটা মুখে তুলেছে বাবা, পিসি চিৎকার করে উঠল,“হিটলার,তোর সঙ্গে একজন দেখা করতে এসেছে। ” আজ্ঞে হ্যাঁ আমার বাবার ডাকনাম হিটলার।
ঘন্টা কাকু নাকি আমাদের সাবেকী সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রীতিমত হাউমাউ করে কেঁদেছিল সেদিন। ধন্য বাবাদের ব্যাচের একাত্মতা। সেরাতে আর নিজের বাড়ি ফিরতে হয়নি ঘন্টাকে। মনোজকাকুর কিনে রাখা অতিরিক্ত ফ্ল্যাটে সাময়িক আশ্রয় পায় ঘন্টা কাকু। দিন সাতেকের মধ্যেই সরস্বতী ক্লাবের গলিতে এক সদ্য নির্মিত ফ্ল্যাটবাড়ির একতলায় একটা আনকোরা ফ্ল্যাটের চাবি ঘন্টা হাতে তুলে দেয় হারু কাকু। ঘন্টা নাকি ইতস্ততঃ করে বলেছিল,“এতগুলো টাকা-কোথায় পাই?সবটাকা তো ভাইঝিগুলোর বিয়ের জন্য ফিক্সড করে বসে আছি। ” বন্ধুরা একসঙ্গে নাকি চিৎকার করে উঠেছিল,“বাঞ্চোৎ ভাইঝি দেখাচ্ছো?রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছিলে,কোন ভাইঝি বাঁচাতে এসেছে তোমায়?” মা পোস্টাফিস থাকায় খুব সুবিধা হয়,নামমাত্র সুদ হারিয়ে সব ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙে ফ্ল্যাট কেনা হয়।
মাস ছয়েকের মধ্যে আমাদের বৈঠকখানা ঘরে সে কি হল্লা, হারু কাকুর গলা বোধহয় গলির মোড় থেকে শোনা যাচ্ছিল,“হারামজাদা বুড়ো হয়েও অালুর দোষ যায়নি?এটা ভদ্দরলোকের পাড়া।” নতুন বাড়িতে উঠেই ঘন্টা পাড়ার বুঁচির সাথে আশনাই জুড়ে দেয়। বুঁচি ও পাড়ার অত্যন্ত সম্মানীয় মহিলা, পিতৃমাতৃহীন ভাইবোনেদের একা হাতে মানুষ করেছেন,নামি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন, শ্রী অরবিন্দের শিষ্যা ছিলেন,বছরে একবার পন্ডিচেরী যেতেন। নিয়মিত প্রাতঃভ্রমণ আর ধ্যান করতেন। এহেন বুঁচিকে কি ভাবে জপালো কটন মিলের এক মামুলী শ্রমিক কে জানে। তবে পাড়ায় ঢিঢি।
বাবা শেষে বলল,“কি চাস ঘন্টা? এভাবে আমাদের মুখ ডোবাস না। বিয়ে করবি?” ঘন্টা তো সাধিলেই রাজি। ওদিকে কুমারী বুঁচিও। এমনি শারদ প্রভাতে বন্ধুদের উদ্যোগে নতুন ফ্ল্যাটে সইসাবুদ করে সম্পন্ন হল বিয়ে।ঘন্টার পক্ষে অন্যতম স্বাক্ষরকারী আমার পিতা স্বয়ং। বুঁচির তরফে তার সহোদর। তারপর কেটে গেছে বছর আঠারো। বুড়োবুড়ি দুজনাতে মহাসুখে থাকে- বুড়ি বসে তামাক সাজে,বুড়ো বসে কাশে। ঘন্টাকাকুর বেতো নিম্নাঙ্গে ডেনিম ব্লু জিন্স সোচ্চারে ঘোষণা করছিল এই পচাগলা সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কি অসম্ভব সুখে আছে দুজনায়।
ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছি আমরা মা মেয়েতে, ঘড়ির কাঁটা সন্ধ্যে পাঁচটার ঘর পেরিয়েছে, রাস্তায় কি অসভ্যের মত জ্যাম মাইরি। একটা ট্যাক্সি পাচ্ছি না। ওলা উব্র সব ভোঁভা। ইতিমধ্যে “মা জিও” বার দুয়েক ফোন করে ফেলল। কি জ্বালা মাইরি,ওলা গাড়ি খুঁজছে,এমন সময় ফোন ধরলে সব ঘেঁটে যাবে। কেটে দিলাম। উফ্ মা যদি ফোন কেটে দেওয়াটা বোঝে। আবার করছে দেখো। খ্যাঁক করে ফোন করে বললাম,“ ট্যাক্সি খুঁজছি তো। পেলে ফোন করব। ”ওপার থেকে বাবার নিঃস্ব স্বর ভেসে এল,“মানা। মানা রে-। ”বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল,বাবা তো এমন করে না। কি হল বাবা?সব ঠিক আছে?“ঘন্টা মারা গেছে। ” সে কি?কি করে? আজই তো বাবাদের নিমন্ত্রণ ছিল। বাবা আর দেবা কাকু একসাথেই রিক্সা করে গেল। ওদিক থেকে সলিল কাকু আসছিল,পথে দেখা আমাদের সঙ্গে। বাবা ব্যথিত স্বরে বলল,“জানি না। সবাইকে খাইয়ে দাইয়ে রওণা করে,বুঁচিকে বলেছে,‘একটু শুই বুঝলে। এত সুখ এত আনন্দ- বড় দেরী হয়ে গেল বুঁচি। ” ফোনটা কেটে গেল, আনন্দমুখর উৎসবের কলকাতা,নিয়ন আলোয় জ্বলজ্বলে,সব ছাপিয়ে দুচোখে ভেসে উঠল এক আনন্দোদ্বেল বৃদ্ধের প্রশান্ত মুখমণ্ডল-সত্যিসত্যিই যিনি পাড়ি দিয়েছেন মহাসিন্ধু।
(সবচরিত্র কাল্পনিক। শুধু কিছু মানুষের নাম ধার নিয়েছি মাত্র)©Anindita Bhattacharya

No comments:

Post a Comment