Sunday 4 December 2016

স্বপ্ন ২


স্বপ্ন দেখলাম, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। না মিত্র-শ্ত্রু পক্ষ মার্কা কিছু পশ্চাৎপক্ক দেশের যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা নয়।  আইসিস মার্কা কোন উগ্র ধর্মান্ধ শক্তির সাথে তথাকথিত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন প্রথম বিশ্বের  মানবতা রক্ষার সংঘাত ও নয়। এ এমন এক যুদ্ধ, যা প্রতিনিয়ত মানবজাতিকে অবলুপ্তির দিকে এক ধাপ করে এগিয়ে দিচ্ছে। কতদিন কোন নবজাত শিশুর কান্না ধ্বনিত হয়নি এই ধরায়। ধরা আজ দুই গোষ্ঠীতে বিভক্ত। একদিকে আমাদের মত মুষ্টিমেয় আশাবাদী মানব সন্তান, যাদের না আছে কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা, না কোন মিলিটারি ট্রেনিং। আছে শুধু মনের জোর। আমরা রোজ লড়ি বা, বলা ভাল লড়ার চেষ্টা করি। হারি-জিতি যাই হোক আমরা আশা ছাড়ি না, আমাদের নেতা বলেন, “ যেদিন আমরা আশা ত্যাগ করব, সেদিনটি হবে পৃথিবীতে মানব প্রজাতির অন্তিম দিন।” আমাদের নেতা কোন আর্মি জেনারেল নন। বরং এক ক্ষীণকায়, খর্বাকৃতি, মুণ্ডিতমস্তক, খেটো ধুতি পড়া ন্যুব্জ বৃদ্ধ। গুজরাটের কোন জঙ্গুলে উপজাতির সর্দার ছিলেন এককালে। মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষাও জানেন না। চোখে গোল চশমা, যার একটি ডাঁটি ভাঙ্গা, দড়ি দিয়ে কানের পিছনে আটকানো। আমরা আদর করে ডাকি “বাপুজি” বলে।
আমি এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর একজন উদ্ধারক। প্রত্যহ সকালে, বাপুজির নির্দেশ মোতাবেক আমার উদ্ধারকরা ছড়িয়ে পড়ি, পৃথিবীর না না প্রান্তে, যেদিন যেখানে শত্রুপক্ষের হামলা হতে পারে, তার আগাম আভাষ পেয়ে জান বাপুজি। আমরা টেলিপোর্টেশন মারফৎ সেখানে পৌঁছে, সেখানকার জনগণকে নিরাপদে আমাদের এই ক্ষুদ্র ক্যাম্পে নিয়ে আসি। কিন্তু এই ক্যাম্প ও বেশিদিন নিরাপদ থাকে না, ফলে এক্সোডাসের মত, প্রায়ই বাপুজির পিছু পিছু শিবির ত্যাগ করি আমরা। গড়ে তুলি কোন নতুন কলোনি। এই প্রায় যাযাবর জীবনযাপনের ফলে খাদ্যের বড় অভাব আমাদের। যাই হোক আজ সকালেও অপেক্ষা করছিলাম আমার গন্তব্য সংক্রান্ত নির্দেশাবলীর জন্য, আচমকা আমাকে জানানো হল, বাপুজি আমায় ডেকেছেন। চমকে উঠলাম, এক নিতান্ত মামুলী উদ্ধারক আমি। এক- দুই জনের বেশি কাউকে টেলিপোর্ট করার ক্ষমতা আমার নেই। বাপুজি কেন আমার সাথে দেখা করতে চান? আমার মত পৃথুলা, অবলা নারীকেও এই কাজ করতে হচ্ছে, কারণ সমর্থ পুরুষ বা সবলা নারীদের আগেই দখল করে নিয়েছে শত্রুপক্ষ। ভাবতে ভাবতে কখন যে বাপুজির সামনে এসে দাঁড়িয়েছি খেয়াল করিনি। বাপুজি একটা বড় গাছের তলায় ছেঁড়া আসন পেতে ধ্যান করছিলেন, আমাকে দেখে হেসে নিজের ভাষায় কিছু বললেন, যা আমি আমার মাতৃভাষায় স্পষ্ট শুনতে পেলাম, আমার মাথার মধ্যে। উনি বলছেন, “নিজেকে দয়া করা, মানুষের সবথেকে প্রিয় চিত্তবিনোদন।” জিভ কাটলাম। বাপুজি যে মনের কথা পড়তে পারেন তা ভুলে গেছিলাম।
বাপুজি গলা ঝেড়ে বললেন, “বাংলাদেশে আজ হামলা হবে রে মা।” বাংলাদেশে? মানে কোথায়? ওদিকে তো আজকাল হামলা হয় না। এই রে বাকি উদ্ধারকরা তো বেরিয়ে গেল। বাপুজি বললেন, “ তোমাদের ঐ সব দেশ সীমানা আমি বুঝি না। তোমাদের মহল্লায় হামলা হবে।” মাথাটা টলে গেল। আমাদের মহল্লা? বাবা-মা-তুত্তুরী? আমাদের মহল্লায় এর আগেও একবার হামলা হতে পারে বলে সতর্ক করেছিলেন বাপুজি। আমরা উদ্ধারকরা সকলকে না পারলেও বেশ কিছু মানুষকে নিরাপদে টেলিপোর্ট করতে পেরেছিলাম। তাদের মধ্যে  বাবা-মা-তুত্তুরীও ছিল। ওরা এখানে আমাদের সাথেই ছিল বেশ কিছুদিন। তারপর বাবা উসখুস করতে লাগল। নিজের পিতৃপুরুষের ভিটে, বাবার ঠাকুমা, কাকা, পিসি আমার দাদু-ঠাকুমা,জেঠু, কাকু, পিসির স্মৃতিবিজড়িত। মায়ের বউ হয়ে আসা, আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা, বিয়ে, তুত্তুরীর জন্ম, শৈশবের লীলাক্ষেত্র। বাবার প্রাণ কাঁদত ঐ ভিটার জন্য। বাপুজির সাথে ব্যাপক দোস্তি হয়ে গিয়েছিল বাবার। বাপুজির অনুমতি নিয়ে একদিন ফিরে গেল ঐ ভিটেয়। সঙ্গে মা আর তুত্তুরীও। বাবাকে ছেড়ে মা থাকবে না, আর মাকে ছেড়ে তুত্তুরী। আমি তখন উদ্ধারকার্যে ব্যস্ত অন্যত্র। ফিরে এসে প্রবল রাগারাগি করেছিলাম। তারপর মেনে নিলাম। আমাদের ভাঙাচোরা জনমানবহীন শহরে বেশ জমে উঠেছিল ওদের লালনীল সংসার। মাঝে মাঝে আমিও যাই।
শুধু ওদের জন্য আমাদের মহল্লায় হামলা করবে? আমার চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়ছে। মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাব। আর একজন উদ্ধারক নেই। আমি একা তিনজনকে আনতে পারব না। কি করি? বাপুজির নির্দেশে ঈশ্বরকে ডাকার পুরানো অভ্যাস ছেড়েছি বহুদিন। বাপুজির মতে ঈশ্বর বড় বিভেদের জন্ম দেয়। মন স্থির করতে না পারলে আমিও পৌছতে পারব না। দরকার হলে তিনবার যাব, আগে তো পৌঁছই।
নীরব জনহীন শহরে, শুধু আমাদের বাড়ি থেকেই প্রবল কলরোল ভেসে আসছে। মা আর তুত্তুরী খাবার নিয়ে কোস্তাকুস্তি করছে। অন্যদিন হলে মাথায় আগুন জ্বলত, যেখানে কেউ পেট ভরে খায় না, সেখানে আমার কন্যা খাওয়া নিয়ে নখরা করছে? আজ প্রবল কান্না পেল। মা আমাকে দেখে খুশি হতে গিয়েও থমকে গেল, “কি রে?” গলায়  ব্যথা ঝেড়ে বললাম, “বাবা কোথায়? এখুনি যেতে হবে।” তুত্তুরী দৌড়ল ভিতরে, “দাদুউউউউউউ। মা ডাকছে।” বাবা সিগারেট লুকোতে লুকোতে দৌড়ে এল, কোথায় পায় কে জানে? আমি কিছু বলার আগেই সদর দরজার অদূরে এসে দাঁড়ালো একটা ট্যাঙ্ক। সারি দিয়ে নামতে লাগল, শত্রু সৈন্যের দল। ভাবলেশহীন রোবটের দল। কোন এককালে আমাদের মত মানুষই ছিল। আজ আর তার কোন অনুভূতিই অবশিষ্ট নেই। ওদের নেতার নির্দেশ মোতাবেক শিকার ধরে নিয়ে যায় ওরা। ওদের কাছে কোন শস্ত্র থাকে না। ট্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে এল, ওদের নেতা। এতদিন শুধু গুজব শুনেছি, আজ দেখলাম। নারী না পুরুষ বুঝলাম না। কালো চকচকে ট্রেঞ্চ কোট আর কালো প্যান্ট পরা। শ্বেতাঙ্গ। মাথায় কালো চুল, প্রায় কোমর অবধি। কপাল ঢাকা চূর্ণ কুন্তলে। আমরা চারজনেই আঁতকে উঠলাম চোখ দুটি দেখে। চোখ পুরো সাদা। কোন মণি নেই।
শোনা যায়, এই চোখ দিয়েই নাকি মানুষের আত্মা শোষণ করে নেয়। মানুষটা বেঁচে থাকে, কিন্তু তার মধ্যে কোন ক্ষুধা তৃষ্ণা, সুখ, দুঃখ, ভালবাসা, ব্যথা বেদনার অনুভূতি থাকে না। জড় পদার্থ রোবটে পরিণত হয় মানুষ। রোবটের মত ওনার হুকুম তামিল করে, তারপর একদিন অনাহারে, জলশূন্যতায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাঁ বসে বসে মরে যায়। পৃথিবীর অর্ধেকের ওপর জনসংখ্যা এভাবেই শেষ হয়ে গেছে। এবার আমাদের পালা।

কি করি? আমি কি করি? তিনজনকে এক সাথে তো নিয়ে যেতে পারব না। আর ফিরে আসার অবকাশ ওরা আমায় দেবে না।  বাবা সিগারেট ছুড়ে ফেলে বলল, “তুত্তুরী। ওকে বাঁচা।” মেয়েকে বাঁচাব বলে বাবা-মাকে মৃত্যুর মুখে ছেড়ে চলে যাব? পারছি না। কেঁদেই যাচ্ছি। মায়ের মায়া মাখানো মুখ, ছলছল চোখ, বাবার মুখের সিগারেটের গন্ধ আর তুত্তুরীর গা থেকে ভেসে আসা দুধের গন্ধ। এদের বিনিময়ে আমি মরতে রাজি আছি। কিন্তু প্রাণ থাকতে আমি পারব না। “আঃ। তুত্তুরুকে বাঁচা”। বাবা চিৎকার করে উঠল। আমি কেঁদেই যাচ্ছি। বাবা এগিয়ে এসে আমার কাঁধ ধরে প্রচণ্ড ঝাঁকাতে লাগল, চোখ খুলে দেখি, শৌভিক ঠেলছে, “কাঁদছিস কেন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে? এই? কি হল?” কাহিনীর এই অংশটার কথা তো ভুলেই গেছিলাম। উদ্ধারক এসে গেছে। আর চিন্তা নেই। J

No comments:

Post a Comment