Thursday 29 October 2015

আলতামাধবী



 পুজোর কলকাতা কি কুৎসিত,  জনগণ  যেন উন্মাদ হয়ে ওঠে, সেই একই সবৎসা দশভুজা মূর্তি , তবু মত্ত হস্তির মত এ মণ্ডপ থেকে সে মণ্ডপ ঘুরে বেড়ায় । হাঘরের মত গোগ্রাসে  গেলে রোল, চাউমিন থেকে ফুচকা মায় ফুটপাতের  কউয়া বিরিয়ানি। যত্রতত্র এটোকাঁটা আর মূত্র ত্যাগ করে। আবর্জনায় ভরিয়ে দেয় কলকাতাকে। সাথে কর্ণপটহ ফাটানো মাইকের চিৎকার ।  এই সময় চেনা শহরটা যেন আচমকা অচেনা হয়ে ওঠে , আর এই অপরিচিত শহরটাকে বড় ভয় পায় জিনি, জিনিয়া সর্বাধিকারী।  কিছুতেই এই আনন্দ যজ্ঞে সামিল হতে পারে না।  ফলতঃ পুজোর চারদিন বাড়ি পাহারা দেওয়াই ওর কাজ।  বাবা সকাল থেকেই পাড়ার ক্লাবে আড্ডা জমান।  অশীতিপর গুটিকয়েক বন্ধুই মাত্র জীবিত, তবু কি উন্মাদনা পুজোর, মা তাই বলে, “তুুই ঐ লোকটার মেয়ে হতেই পারিস না।  নির্ঘাত পাল্টে গিয়েছিলি। ”
আর মা? মাই বা কিসে কম যায়? বেতো রুগী, দিব্যি মাঞ্জা দিয়ে ঠাকুর দেখতে বের হয়।  শুধু ঠাকুর দেখার জন্য মাসিকে টেনে আনায় বোকারো থেকে । কি করবে? বহু সাধ্যসাধনাতেও জিনি তো বের হয় না।

আজ নবমী, বাধ্য হয়ে জিনিকে বেরোতে হল, বেশি দূর নয়, পাড়ার দোকান।  গরম মশলা শেষ। গরম মশলা ছাড়া আবার কচি পাঁঠার মাংস জমে? তিন বুড়োবুড়ির সম্মিলিত এবং কাতর অনুরোধে ঢেঁকি গিলে, পাঁচন খাওয়া মুখে, মাথা নামিয়ে হনহনিয়ে হাঁটছিল জিনি।  আশেপাশের সুবেশ নারী পুরুষদের মাঝে কি সাংঘাতিক বেমানান । হঠাৎ  এক সুবেশ বলিষ্ট বছর বত্রিশ তেত্রিশের যুবক ওর রাস্তা আটকে দাঁড়াল।  জিনি ক্রুদ্ধ তথা হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকাতেই, সে বলে উঠল, “কি দেখছিস বে? শালা জিনি জিনি করে আধ ঘন্টা ধরে চেল্লাচ্ছি, কালা মদন। ” জিনি চিনতেই পারছে না, আমতা আমতা করে কিছু বলতে  যাবে, যুবক আবার বলে উঠল, “কি দেখছিস বে? চিনতে পারছিস না? এরম করিস না শালা, নতুন বউয়ের সামনে ইজ্জত কা ফালুদা হয়ে যাবে মাইরি। ” কাতর হয়ে জিনির হাত চেপে ধরল ছেলেটি, মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠল জিনির মুখ, অংশু।  এ অংশু ছাড়া আর কেউ হতে পারে না।  কত বছর হল, স্কুল ছেড়েছে বারো না কি পনেরো?

অংশু আর তার নবোঢ়া স্ত্রী জমিয়ে দিল নবমীর দুপুর।  সর্বাধিকারীদের বাড়িতে এত হইচই কস্মিনকালেও  কেউ শোনেনি।  দুপুরের  জমাটি পোলাও মাংসের পর সবাই গড়াগড়ি  দিতে লাগল, অংশু আর জিনি ফুঁকতে গেল চিলেকোঠার ঘরে, এই ঘরটাই জিনির নিজস্ব জগৎ।  করো প্রবেশানুমতি  নেই, তবে অংশু ব্যতিক্রম । জানলা দিয়ে গলা সোনার মত রোদ আজব আঁকিবুকি  কাটছে মেঝেতে।  পাশাপাশি শুয়ে বহুযুগ  বাদে দুই বন্ধু সিগারেট ধরালো।  পলকে মনে হল জীবন থেকে লুপ্ত হয়ে গেছে পনেরোটা বছর।  কিছু কথা, কিছু নীরবতায় স্মৃতিচারণ।  হঠাৎ অংশু বলে উঠল,“ বিয়ে করলিনি জিনি?” জিনি জবাব দেবার প্রয়োজন অনুভব করল না। অংশু বলেই চলল, “ আর কতদিন যোগিনী হয়ে থাকবি। এদিকে তুই অনূঢ়া রয়ে গেলি, ওদিকে অঙ্কিত ও একা। ওর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেছে।  ও এখন কলকাতায়।  ”
কানে যেন গরম সীসা ঢেলে দিল জিনির।  ধড়মড় করে উঠে বসল। ‘অঙ্কিত ’ কত সহস্র বছর পর শুনল এই নামটা।  আপাত শান্ত সুজলা সুফলার ধরিত্রীর হৃদয়ে লুকিয়ে  আছে কত লক্ষ কোটি মেগাটন লাভা।  আজ কি আবার অগ্নুৎপাত হবে?
কোন ক্লাসে প্রোপজ্ করেছিল? ক্লাস থ্রি বোধহয়।  জিনি আর অঙ্কিত ছিল অবিচ্ছেদ্য জুটি।  ছকে ফেলেছিল জীবন, ওদের পুরানো পাড়া কসবাতেই ফ্লাট কিনবে, বেডরুমের  রঙ হবে লাইল্যাক।  নাইট ল্যাম্প ব্লু।  রোজ রাতে হাল্কা লয়ে বাজবে ব্রায়ান অ্যাডামস্ না হলে জর্জ মাইকেল।  দক্ষিণের খোলা বারন্দা দিয়ে হুহু করে বাতাস এসে টুংটাং  করে বাজাবে উয়িন্ড চাইম। একটিই সন্তান হবে, ছেলেমেয়ে যাই হোক, নাম হবে “বাপন”।
মেডি পড়তে চলে গেল নাগপুর।  চিঠিপত্র আদানপ্রদান  চলত, কমে এল তাও। সে বার পূজার ছুটিতে দু চার দিনের জন্য বাড়ি এসেছিল অঙ্কিত, ফ্লাইটে।  প্লেনেই ফিরবে, শুধু মায়ের আব্দার তাই। জিনি পাগল হয়েছিল এক ঝলক দেখার জন্য। অঙ্কিতের আর অবকাশ হয় না। অবশেষে সেই বহু কাঙ্ক্ষিত ক্ষণ এল, অঙ্কিত ওর হাত ধরে, গভীর আবেগের সাথে জানাল,“ছেলেবেলার পাগলামি আঁকড়ে বাঁচিস না। গ্রো আপ জিনিয়া।” জিনি অতি কষ্টে বুঝতে পারল, ওর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। অঙ্কিত সব সম্পর্ক শেষ করে চলে যাচ্ছে। এত সোজা? এভাবে আছড়ে ফেলে দেয়া?
ভুলতে পারে নি জিনি। বারবার চিঠি লিখেছে, জানতে চেয়েছে কেন? কেন? কেন? জবাব আসেনি।  অঙ্কিত শুধু দুলাইন লিখেছিল,“আই অ্যাম নট ইয়োর কাপ অব টি।  নিজের স্টান্ডার্ডের কাউকে খুঁজে নে।”
মা শুনে বলেছিল ওর জীবনে অন্য কেউ আছে।  জিনির বিশ্বাস হয়নি। এই সময় বাবার মৃত্যুপথযাত্রী নিঃসন্তান পিসি তাঁর শোভাবাজারের বাড়িটা ওর বাবার নামে লিখে দেয়। জিনিরা কসবা ছেড়ে চলে আসে। সচেতনভাবে কোন পুরোনো বন্ধুর সাথে জিনি যোগাযোগ  রাখেনি। এমনকি ফেসবুকেও ও নিজের নামে অ্যাকাউন্ট খোলেনি। সহকর্মী তথা ছাত্রছাত্রীদের চাপে ও ফেসবুক করে বটে, এখানে ওর নাম,“ আলতা- মাধবী”।

 আননবই এ অঙ্কিতকে অবশ্য খুঁজে  বার করেছে জিনি।  রোজ সকাল সন্ধ্যা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অঙ্কিতে প্রোফাইল দেখা ওর প্রাত্যহিক রুটিনের অঙ্গ।  মা জানে, কাছাকাছি থাকলেই ওর ছবি দেখে শাপশাপান্ত করে।  জিনি বিরক্ত  হয়, কিন্তু মায়ের ঐটুকুই বিনোদন। অঙ্কিত চলে যাবার পর জিনি কোন সম্পর্কে জড়ায়নি।  সম্পর্ক বলতে যেখানে  দৈহিক এবং মানসিক উভয় ইনভল্ভমেন্ট জড়িত, নাহলে খুচরো  দৈহিক  সম্পর্ক অগুন্তি হয়েছে। এ ব্যাপারে জিনি নিজেকে আদৌ বঞ্চিত করেনি।
অঙ্কিতের বিয়ের সংবাদ অবশ্য ও আননবই মারফৎ পায়নি, তখন ও রাকেশকে ডেট করত।  কোন একটা হলিউড ছবি দেখতে গিয়ে মাল্টিপ্লেক্সে দেখেছিল ওদের।  মেয়েটি জিন্স টপ পড়লেও সদ্যবিবাহিত বোঝাই যাচ্ছিল।  হেসে হেসে কথা বলছিল ওরা। জিনি রাকেশের বিশাল বপুর আড়ালে দমবন্ধ করে দাঁড়িয়েছিল। মাথা ঘুরছিল, সাথে প্রচন্ড  বমিবমি ভাব।  ওরা একটা রোমান্টিক  হিন্দি ছবি দেখতে ঢুকে গেল।  জিনি আর দাঁড়ায়নি।  ধুম জ্বর নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল।  মা সব শুনে শাপশাপান্ত করেছিল, “ আমি যদি বামুনের মেয়ে হই, এ বিয়ে টিকবে না। হারামজাদার ডিভোর্স হবেই হবে। জেল ও হবে। ” বাবা অবশ্য পাশ থেকে ফোড়ন কেটেছিল,“ ব্রাম্ভণের সে তেজ নেই, সিং নেই আর লেজ নেই। ”

 সত্যই বিচ্ছেদ হল তাহলে?  তাই কিয়ৎকাল ধরে অঙ্কিতের রিলেশনশিপ স্টেস্টাস,“ ইটস্ কমপ্লিকেটেড” ? অংশু বকেই যাচ্ছে, “ বোঝ জিনি।  ওকে একটা সুযোগ দে। ও প্রায়ই তোর কথা বলে। ” জিনি শীতল স্বরে বলল, “ আমি কাউকে ফোন করতে পারব না। ”
“ বুঝেছি।  ও করবে?” জিনি নিরুত্তর।

আজ বিজয়াদশমী।  মা আর মাসি গরদ পড়ে হেব্বি মাঞ্জা দিয়ে বরণ করতে গেছে, বাবাও ময়ুরপুচ্ছ ধুতি আর আদ্দির পাঞ্জাবি সাথে কোলাপুরি চপ্পল পড়ে লটরপটর করতে করতে গেল। জিনি ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে, হঠাৎ মুঠো ফোনটা ঝনঝনিয়ে উঠল, অচেনা নম্বর, হৃদপিণ্ডটা কি ফেটে যাবে?  “ হেলো!”
বহুযোজন দূর থেকে ইথারনেটে ভেসে এল এ কার স্বর? “ শুভ বিজয়া। ”
“শুভবিজয়া।  কে বলছেন?”
“গলাটা কি এতটাই পাল্টে গেছে জিনিয়া?” জিনি জবাব দিতে পারল না। কলকাতার বাতাসে অক্সিজেনের  কি হঠাৎ অভাব হল? শ্বাস নিতে এত কষ্ট ! অঙ্কিত বলেই চলেছে, “ আমার জন্য বিয়ে করলে না জিনি? আমি খুব গর্বিত, আমাকে একজন এত ভালবাসে। আমি তোমাকে  বিগত এক বছর ধরে খুঁজে  চলেছি। যা ঘটে গেছে সব ভুলে এস আজকের এই পবিত্র দিনে আমরা নতুন করে শুরু করি।  ” হঠাৎ হাসি পেল জিনির, “ অঙ্কিত আমি বিয়ে না করলেও অন্ততঃ পাঁচ ছয় জনের অঙ্কশায়িনী হয়েছি। ” থতমত খেয়ে গেল অঙ্কিত, “ পাঁচ ছয় জন? যাক কি আর করা যাবে। নতুন করে শুরু করি এস। ”
“দাঁড়াও।  নতুন করে শুরু করার আগে পুরোনোটা তো শেষ করতে হবে। কি বলেছিলে তুমি? আমি তোমার যোগ্য নই”
“ তোমার সব মনে আছে জিনি? কিছু ভোলোনি দেখছি” গর্বিত স্বরে বলে উঠল অঙ্কিত ,“ এত ভালবাস আমায় আজো?” অঙ্কিতের গদগদ স্বরে গা গুলিয়ে উঠল, জিনিয়ার, “ আমি নিজেকে ভালোবাসি।  অপমান আমি ভুলতে পারি না। যাই হোক সম্পর্ক শেষ হওয়া নিয়ে কোন অভিযোগ নেই, শিট হ্যাপেন্স।  কিন্তু কেন? সেটা জানার অধিকার আমার সেদিনও ছিল, আজ ও আছে। ” ইস্পাত কঠিন স্বরে বলল জিনিয়া।  মা দুর্গা এগিয়ে আসছেন, ঢাকের আওয়াজ তীব্র হচ্ছে।  অঙ্কিত আমতা আমতা করে বলল,  “ আসলে মা”।  “ মা? মা তো আজোও আছেন। নয় বছরের সম্পর্ক একটানে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলে মায়ের জন্য? ওয়াও। যদি বলতে অন্য কেউ এসেছিল, বলতে আজ আর মনে নেই, মেনে নিতাম।  মা বড্ড দুর্বল লজিক সোনা। ”  
অঙ্কিত চুপ করে রইল।  জিনি বলল, “রাখছি।  আমরা দীর্ঘ তের বছর একসাথে পড়াশোনা করেছি, সে অধিকারে তুই একশ বার আমায় ফোন করতে পারিস।  কিন্তু বাবার ভাষায় থুথু ফেলে থুতু চাটিস না।  প্লিজ। ” মা দুর্গা ঠিক ওদের বাড়ির নীচে, পাড়ার কচিকাচা গুলো উদ্দাম নাচ জুড়েছে, সবাই ডাকছে ওকে। ইশারায় জিনি জানাল আসছে।  ফোন কেটে দুদ্দাড় করে নিচে নামছে জিনিয়া, নামতে নামতে আলতা- মাধবী মুছে ফেসবুকে নিজের নাম লিখছে জিনিয়া সর্বাধিকারী।
#Amiani #AninditasBlog

No comments:

Post a Comment