Saturday, 10 October 2015

সহযাত্রী –অন্তিম পর্ব


 পয়লা জানুয়ারি। বৎসরের প্রথম দিন নিত্যযাত্রীদের ভিড় অপেক্ষাকৃত কম। তবে ট্রেন ফাঁকা নেই। ভ্রমণ পিয়াসী জনগণের চাপে লেডিস কামরায় পা রাখাই দায়। তার ওপর বেলুন, বাঁশি আর খেলনা ওয়ালাদের দাপট। কোন মতে ওরা চারজন একটি কোণায় গুটি সুটি হয়ে বসেছিল। পাশকুড়া স্টেশনে আরযু যেন ওদেরই প্রতীক্ষা করছিল। ভিড়ের মধ্যে ত্রস্তা হরিণীর মত দুটি চোখ ঠিক খুঁজে বার করল ওদের, ঊষা ও হাত নেড়ে ডেকে নিলেন। কোনমতে একটু জায়গা হল আরযুর বসার মত। মুখ চোখ শুকনো। চোখের চার দিকে পুরু কালির পোঁচ। চোখ দুটি যেন রসাল ফলের মত টুসটুস করছে, টুসকি মারলেই ঝরঝর করে ঝরে পড়বে সব গ্লানি। ঊষা ভালো করে মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল, “হ্যাঁ রে, আজ্জু, কাল রাতে ঘুমোসনি?” আরযু কোন মতে চোখের জল চেপে মাথা নাড়ল। তারপর ঊষার বুকে মাথা ডুবিয়ে দিল। ঊষা দুই বাহু দিয়ে আঁকড়ে ধরল সদ্য পরিচিত মেয়েটিকে। মৃদু স্বরে আওড়াতে লাগল গত কালের প্রতিশ্রুতি। “ ঘাবড়াচ্ছিস কেন? আমি বলেছি না।” নবনী এত ক্ষণ শ্যেন দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছিল। হটাত প্রশ্ন করল, “আরযু তুমি আবার ওকে ফোন করেছিলে?” আরযু মুখ না তুলে কাঁপতে কাঁপতে জানাল, করেছিল এবং যথারীতি অপমানিত হয়েছে। নবনী ঈষৎ ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, “ ঊষাদি তোমার প্রিয়তমকে ফিরিয়ে দেবার জন্য কতদূর কি করতে পারবে আমি জানি না, তবে আমার একটা উপদেশ যদি শোন তাহলে, সে ফিরে আসলেও আসতে পারে।” দ্রুত মুখ তুলল আরযু, নবনী না থেমে বলেই চলল, “ তুমি আগামী তিন মাস ওর সাথে কোন যোগাযোগ রেখ না। ফোন কর না। করলেও ধর না। দেখা হলেও মুখ ঘুড়িয়ে চলে যাবে। যদি ওর মনে তোমার প্রতি কোন অনুভুতি অবশিষ্ট থেকে থাকে ও অবশ্যই ফিরে আসবে।” দপ করে নিভে গেল চোখের আলো। আরযু আবার কাঁদতে লাগল। “আমি পারব না দিদি। মরেই যাব। দিক গালি, তবু দিনান্তে একবার ঐ কন্ঠ না শুনলে যে মরেই যাব।” লিপি কঠোর স্বরে বলল, “কিচ্ছু মরবে না। নবনী দির কথা যদি না শুনতে পার তাহলে অন্তত যতদিন কাকিমা তোমার জন্য চেষ্টা করছে, ততদিন কথা দাও ওর সাথে কোন যোগাযোগ রাখবে না।” আরযু নিমরাজি হল। ট্রেনটাও ফাঁকা হয়ে এসেছে। শিলা এবার ঊষা কে জিজ্ঞাসা করল, “ তুমি কি করবে কিছু ভেবেছ? কথা বলবে কি?” ঊষা একটু ভেবে নিয়ে বলল, “ শোন খড়গপুরে একটা কালি মন্দির আছে। ঐ মন্দিরের যিনি পাণ্ডা উনি ভালো হাত দেখতে পারেন। ওষুধ টষুধ ও দেন। আমি নানা ভাবে বিপদে পড়ে ওনার কাছে গেছি, উনি আমায় রক্ষা করেছেন। এক বার তো এমন বিপদ যে ভাবলাম বাড়িই বিক্রি করে দেব,” লিপি মাঝ পথেই ওনাকে থামিয়ে দিল, “আরযু তোমার ঐ ছেলেটির নাম কি?” আরযু কিছুক্ষণ নীরব থেকে জানাল, “ ওসমান আলি।” লিপি হাত নেড়ে বলল, “হয়ে গেল কাকিমা। ওসমান আলির জন্য মা কালি? চলবে না।” ঊষা তাও নাছোড়বান্দা। “মায়ের কাছে আবার সন্তানের জাত কি রে?” তাও একটু ভেবে বললেন, “ আজ্জু তাও আমি একবার ঠাকুর মশাইকে জিজ্ঞেস করে দেখি কেমন?” আরযু হতাশ হয়ে মাথা নাড়ল।
ঊষার পুরোহিত মশাই আপত্তি করেননি। দ্বিপ্রহরে ওরা চারজন গিয়ে উপস্থিত হল মায়ের দরবারে। নবনী আসতে পারেনি। জায়গাটা গ্রাম গ্রাম।বেশ ফাঁকা। সোজা সিঁড়ি উঠে গেছে, ওপরে মা করাল বদনী রক্তাত জিহ্বা বার করে দাঁড়িয়ে আছেন, সিঁড়ির নিচে একটি ঘরে এক ভদ্রলোক বসে বসে কথা বলছিলেন। শিলা এবং লিপি জল্পনা করেছিল, নির্ঘাত রক্ত বর্ণ পোশাক মস্তকে রক্ত তিলক কাটা, রক্ত চক্ষু, এক মুখ গোঁফ দাড়ি, গালপাট্টা ওলা কাপালিক হবে, কিন্তু দেখা গেল,চোখে চশমা, পরনে ধুতি আর স্যাণ্ডো গেঞ্জি এক অতি সাধারণ দেখতে ভদ্রলোক। ঊষা এক গাল হেসে কুশল বিনিময় করল। অতঃপর আরযুর সাথে পরিচয় করিয়ে  দিয়ে বলল, “দাদা এই যে আমার মেয়ে আজ্জু। বড় ভালো মেয়ে দাদা। বড় ব্যথা পেয়েছে। একটু দেখুন না, মায়ের দয়ায় যদি ছেলেটি ফিরে আসে।” আরযু ঢপ করে প্রণাম করে বসল। ভদ্রলোক সংকুচিত হয়ে বললেন, “থাক মা থাক। মায়ের মন্দিরে আর কারো পদস্পর্শ করা উচিৎ নয়। তোমার বাঁ হাতটি একটু দেখাও।” একটি বিশাল আতশ কাঁচ দিয়ে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলেন, আরযুর দুটি হাত। অতঃপর বললেন, “নাম কি?” আরযু নাম জানাল। ঠাকুর মশাই আঁখি বন্ধ করে কিয়ৎ ক্ষণ বসে রইলেন, অবশেষে জানালেন, “ ওসমান আলি নামের লোক কখনই কোন সম্পর্কের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারে না।” লিপি ফট করে বলে উঠল, “ কেন ঠাকুর মশাই বিধর্মী বলে?” উনি মৃদু হেসে বললেন, “নারে মা। মায়ের কাছে আবার সন্তানের ধর্ম কি? ও সব ভেদাভেদ তো আমরা করি। সংখ্যা তত্ত্বের নিরিখে বিশ্লেষণ করে বললাম।” আরযুর দিকে তাকিয়ে উনি বললেন, “মন শক্ত কর মা। আমি তবু দেখব মাকে বলে। আসছে শনিবার যজ্ঞ আছে মায়ের, রাত আটটার পর দিদি আপনি আমায় ফোন করবেন, আমি বলে দেব মায়ের কি নির্দেশ।” ঊষা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।
ফেরার পথে লিপি শুধু বলল, “দেখ শিলু এরা কি অসম্ভব মাস সাইকোলজি বোঝে। আরযুর দৈহিক ভাষা থেকেই উনি সাফ বুঝতে পেরেছেন, এ সম্পর্ক জোড়া লাগানো অসম্ভব। ভাঙলেন তবু মচকালেন না।” আরযুকে দেখে অবশ্য বেশ খুশি খুশি লাগছিল। শিলালিপি অস্ফুটে বলল, “বিশ্বাসে যদি মিলায় বস্তু।” লিপি রেগে বলল, “ বাল মিলবে শালা।”
শনিবার রাত্রে ঊষা দুরাভাষ মারফৎ বাকি তিন সখিকে জানাল, ওনার ‘দাদা’ জানিয়েছেন, এ সম্পর্ক জোড়া লাগার কোন সম্ভবনাই নেই। তবে গ্রহ শান্তির যজ্ঞ করে দেখা যেতে পারে। সোমবার ঊষা রাগে গরগর করতে করতে বলল, “ ফেরেব্বাজে দেশ ছেয়ে গেল। দৃশ্যত হতাশ এবং ক্লান্ত আরযু আজ আর বসে থাকতে পারেনি। ঊষাঙ্গিনির কোলে মাথা দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল ট্রেনের ফাঁকা সিটে। জমিয়ে শীত পড়েছে, সব জানলা বন্ধ, তবু দরজা দিয়ে হুহু করে বাতাস আসছে। নবনী উত্তপ্ত স্বরে বলল, “তোমাকে বলেছিলাম ঊষাদি, মা কালীর দ্বারা হবে না। ফকির খোঁজো।” ঊষাঙ্গিনি দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “ চুপ করছু। শোন না আজ্জু, আমি খোঁজ নিয়েছি, ঘোড়াঘাটায় এক পির বাবা বসেন। খুব ভাল। ওনার ওষুধ অব্যর্থ। আমাদেরই অফিসে একটি মেয়ের প্রায় ডিভোর্স হয় আর কি। পির বাবা এমন ওষুধ দিলেন, এখন দিব্যি আছে দুজনে।” নবনীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “ আরে আমাদের সরস্বতীদির মেয়েকেই তো মেরে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। মেয়েটা বোবা মেরে গিয়েছিল জানিস। সরস্বতীদি বলল, পির বাবার ওষুধ খেয়ে অনেক ভাল আছে।” নবনী অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে কাঁধ নাচাল। ঊষা রেগে বললেন, “নেকাপড়া জানা মেয়ে গুলোর সবেতেই অবিশ্বাস।”
মঙ্গলবার দিনই পির বাবার কাছে আরযুকে নিয়ে গেল ঊষা। বাকিরা কেউ আর অফিস ছেড়ে যেতে পারল না যদিও। বুধবার আরযু এল না। ঊষা জানাল, আরযু দেশের বাড়ি গেছে, পির বাবা যে ওষুধ দিয়েছেন, বাড়ির পশ্চিম কোণে যে গাছ আছে, তাতে বাঁধতে হবে। পীর বাবা বলেছেন, হাওয়ায় যেমন যেমন ঐটি দুলবে, ওসমান আলির হৃদয় ও উদ্বেল হয়ে উঠবে আরযুর জন্য। রুদ্ধশ্বাসে ওরা অপেক্ষা করতে লাগল সুখবরের জন্য। কার যেন বিয়ে ভাঙতে ভাঙতে আটকে দিয়েছেন পীর বাবা। ঊষা পইপই করে আরযুকে বলে দিয়েছেন, ওসমান আলি ফিরে এলেই ওদের ফোন করতে। রবিবার অবধি কোন ফোন এল না।
 সোমবার আরযুকে দেখেই ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ল। আরযুকে আগের থেকে একটু ভাল লাগছিল দেখতে, ন্যুব্জ শিরদাঁড়া যেন একটু ঋজু হয়েছে। আরযু হেসে হেসেই ওদের জানাল, তাবিজটা কদিন ধরে হাওয়ায় খালি দুলছে আর দুলছে। ওসমান আলির টিকিও দেখা যায়নি। আরযুও যোগাযোগের চেষ্টা করেনি।
এবার কিংকর্তব্য? ঠাকুর তাবিজ সবই হল। শেষ উপায় একটিই অবশিষ্ট আছে, ওসমান আলির সাথে কোন তৃতীয় ব্যক্তির কথোপকথন। কি কারণে এই ভুল বোঝাবুঝি সেটা জানা গেলে, পরে প্রয়োজনে দুজনকে মুখোমুখি বসিয়ে ত্রিপাক্ষিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে যদি ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলা যায়। সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, কাল ঊষাঙ্গিনি কথা বলবে ওসমান আলির সাথে। মাঝে শুধু আজকের রাত। নেমে যাবার আগে আরযুকে বারংবার নিষেধ করা হল, কোন ভাবেই যেন ওসমানের সাথে যোগাযোগ না করে। আরযু ঘাড় নেড়ে জানাল, “পাগল নাকি? তোমরা আমার জন্য এত করছ, তোমাদের আদেশ শিরোধার্য।”    
 পরদিন সবাই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে চাপল, কিন্তু সমস্ত উত্তেজনায় জল ঢেলে দিল আরযু। পইপই করে নিষেধ করা সত্ত্বেও বিগত রাতে সে ওসমান আলিকে ফোন করেছিল। শুধু তাই নয়, ওসমান যাতে দ্রুত  ফোন কেটে না দেয়, বাক্যালাপকে দীর্ঘায়িত করার জন্য বিগত কদিন ধরে ঊষাঙ্গিনি, নবনী, লিপিলেখা এবং শিলালিপি ওর জন্য বা বলা যায় ওদের জন্য কি করেছে, সবিস্তারে বর্ণনা করেছে ওসমান আলিকে। মূর্খ বালিকা ভেবেছিল ওসমান প্রেমে গদগদ হয়ে ওর বান্ধবীদের কৃতজ্ঞ চিত্তে ধন্যবাদ জানাবে। বাস্তবে হল, ঠিক উল্টো। ওদের ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে চারটে ধুমসি মিলে এত কাটাছেড়া করেছে, শুনে ওসমান তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। তার ওপর ওকে বশীকরণ করার চেষ্টা সেই আগুনে ঘৃতাহুতি দেয়। উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়, খিস্তি খেউরের বন্যা বয়ে যায়। আরযু এদিন নীরব শ্রোতা ছিল না, ওসমান আলির কিছু বাছাই করা গালি স্ট্রেট ব্যাটে ফিরিয়ে দেয় আরযু। শেষ পর্যন্ত ওসমানকে বরাহনন্দন এবং ওসমানের মাকে বারবনিতা বলে ফোন কেটে দেয় আরযু।
বাকি চার মহিলা উৎফুল্ল হয়ে পিঠ থাবড়ায়, “ ঠিক করেছিস আরযু। আরও আগে করা উচিৎ ছিল। মামুলী ক্লাস এইট পাস জমির দালাল, কোন সাহসে তোর মত মেয়েকে ওসব বলে।” আরযু মাথা নিচু করেই বসে থাকে, মুক্ত বিন্দু ঝরতেই থাকে অঝোরে। অবশেষে হাল্কা নাকি সুরে বলে ওঠে, “আমি ওকে ছাড়া বাঁচব না, কাকিমা। প্লিজ কিছু কর।” তীব্র আকুতি ভরা দুটি চোখ ঘুরতে থাকে চার জনের ওপর।
এরপর বেশ কিছুদিন আরযু এল না। ওরা প্রথমে আমল দেয়নি, ভেবেছে বাড়ি গেছে হয়ত। ফোন ও বন্ধ। তীব্র দুশ্চিন্তায় পাগলপারা হয়ে উঠল বাকি চার বান্ধবী। আরযুর অফিস শিলা আর লিপির অফিসের নিকটেই। সপ্তাহখানেক বাদেও যখন আরযু ফিরল না, বাঁ কোন রকম যোগাযোগ করা গেল না, লিপি আর শিলা উদ্বেগ চাপতে না পেরে আরযুর দপ্তরে গিয়ে হাজির হল। অফিস না জাহান্নম। লোকে আড়ালে বলে, ঐ অফিসে সারা মাস মাইনে হয়, আর একদিন বোনাস। হাওয়ায় টাকা ওড়ে, সন্ধ্যের মুখে নাকি ভাগ বাটোয়ারা হয়ে লাল শালুতে মুড়ে বখরা চলে যায় সবথেকে বড় সাহেবের কাছে। দুটি মেয়েকে দেখে প্রথম চোটেই বাবুটি বুঝে গিয়েছিলেন, এরা মাল দিতে আসেনি। তবু প্রশ্নের উত্তরে চিরতার জল খাবার মত মুখ করে জানালেন, “ কি হয়েছে জানিনি। আসছেননি। ফোন ও ধরছেননি।” লিপি তবু নাছোড়বান্দা। “বাড়ির ঠিকানাটা যদি পাওয়া যায়। আমরা ওর বন্ধু।” বাবুটি মাছি তাড়াবার ভঙ্গীতে জানালেন, “ অনাত্মীয় ব্যক্তিকে ঠিকানা দিতে পারবনি। নিয়ম নেই।”
হতাশ হয়ে ওরা ফিরে আসছে, একটি দালাল টাইপ লোক ইশারায় ডাকল। “আজ্জু দিদিকে খুজছেন? বড় ভালো মেয়ে ছিল গো। পাপের আখড়ায় হাঁপিয়ে উঠেছিল। নির্ঘাত চাকরী ছেড়ে দিয়েছে।” “ওনার বাড়ি কোথায় জান?” ওরা আশান্বিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল। লোকটি হেঁসে বলল, “ওনাদের গাঁয়ের নাম জানি। তবে আপনারা যেতে পারবেননি।”
“কেন?”
“কাগজে পড়ছেননি কি সব হচ্ছে? নির্বিচারে খুন জখম, মেয়েদের ওপর অত্যাচার চলছে।” “সে কি? কেন?” “ আরেঃ এই তো কদিন আগেই সতেরো জন লোক কে মেরে কেটে পুড়িয়ে দিল। কেউ ঢুকতে পারছে না, ঐ মহল্লায়। জমি নিয়ে বিবাদ, সেখান থেকে   ” লোকটি আর কথা শেষ করল না।
দিন কাটতে লাগল আপন ছন্দে, শুধু ওদের চারজনের যেন কেমন তাল কেটে গেল। মাত্র কদিনের আলাপ, তাও ওদের দৈনিক আলাপচারিতা জুড়ে শুধুই আরযু। সত্যি আরযু দের মহল্লায় ব্যাপক গোলমাল। সাংবাদিক রাও ঢুকতে পারছে না। রোজই কাগজে বের হচ্ছে। বিদগ্ধ জনেরা মোমবাতি মিছিল করছে, বোকা বাক্স ফাটিয়ে দিচ্ছে লোকজন। রাজ্য ছাড়িয়ে জাতীয় স্তরে পৌঁছে গেছে ওদের অঞ্চলের নাম। সবাই আলোচনা করছে, করছে না কেবল চার রমণী। প্রত্যহ ওরা তন্নতন্ন করে খোঁজে, মৃতের তালিকায় কোন আরযু চৌধুরী বা ওসমান আলির নাম আছে কি না। থাকে না।  কটা লোকেরই বা থাকে। বন্ধ থাকা ফোনে রোজই ফোন করে শিলা বা লিপি। আরযুর অফিসেও যোগাযোগ রাখা হয়, কিন্তু আরযু নিপাত্তা।
মাস খানেক পর লিপিলেখা একদিন শিলালিপিকে জানাল, “ আমি মাস খানেকের মধ্যেই বিয়ে করছি।” “মানে? এত তাড়াতাড়ি? দু বছর পরে করবি বলেছিলি?” জানাল হতভম্ব শিলা। লিপি চোখ সরিয়ে জানাল, “ আর পারছি না রে। আরযুকে দেখার পর থেকেই কেমন যেন তরাশে  আছি। কেবলই ভয় করে, যদি ওসমানের মত রণজয় ও? কি করে বাঁচব রে?” শিলা বিমর্ষ ভাবে জানায়, “ সত্যি আরযুকে কত বলতাম, ছেড়ে দে, মেরে আয়, লাথ মার, গুলি মার। অথচ নিজেদের ক্ষেত্রে?”
বিয়ে করে চলে গেল লিপিলেখা। চাকরী ছেড়ে সুদূর দক্ষিণ ভারত। নবনীর হঠাৎ করে সন্তান সম্ভবনা দেখা দিল। রয়ে গেল শুধু ঊষাঙ্গিনি আর শিলালিপি। আর একরাশ সুখ স্মৃতি। আস্তে আস্তে আলগা হয়ে আসছিল বাঁধন। ডেইলি পাষণ্ডদের বন্ধুত্বের এটাই ভবিতব্য, পথেই শুরু, পথেই শেষ। কেউ কেউ লিপির মত বিদায় জানাবার সুযোগ পায়, কেউবা আরযুর মত আচমকা হারিয়ে যায়।
সব সয়ে যায়। যাবার আগে লিপিলেখা গালে চুমু খেয়ে বলেছিল, “ আমিই যোগাযোগ রাখব। কিচ্ছু ভাবিস না। ছেড়ে যাচ্ছি না।” পৌঁছে সত্যি ফোন করেছিল। ব্যস তারপর আর কোন খবর নেই। শিলালিপির বস ইতিমধ্যে বদলে গেছেন। নতুন বস এসে পুরো অফিসটাই শিলার হস্তে সমর্পণ করেছেন। তাতে শিলা যৎপরনাস্তি উল্লসিত। পুরানো সাদাকালো অফিস যেন হঠাৎ রামধনু রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে। অরকুটের নেশাও জমিয়ে ধরেছে। অবসর পেলেই অরকুট। কটা স্ক্রাপ এল? কে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাল? শিলালিপির পরিচিত খুব বেশিজন অবশ্য অরকুটে নেই। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ব্যাপারটাই দুর্বোধ্য ওর পরিমণ্ডলে। কিন্তু এ এমন এক কাঁঠাল যার আঠা আদৌ ছাড়ে না। খুব দ্রুত ছড়াচ্ছে অর্কুট। হঠাৎ একদিন লিপিকে পেয়ে যায়, না আসলে, লিপিলেখাই ওকে খুঁজে বার করে। অফিসে ঢুকে, ক্যম্পুটার চালাতেই দেখে, লিপির স্ক্রাপ, “ ওরে কত কষ্ট করে তোকে খুঁজে বার করলাম। বরকে গ্যালন গ্যালন তেল দিয়ে এসব শিখলাম, তোর জন্য, আর তুই কি সেটিংস লাগিয়েছিস মাইরি, কিছুতেই ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে পারছি না।” আনন্দে চোখে জল এসে যায় শিলালিপির। কে বলে সহযাত্রীদের সম্পর্ক পথেই হারিয়ে যায়? কিচ্ছু হারায় না মশাই।  হয়তো কোনদিন আরযুকেও এভাবেই ওরা খুঁজে পেয়ে যাবে, কে বলতে পারে? জীবন সমুদ্র সম কিছুই হারায় না।
#Aninditasblog #AmiAni

No comments:

Post a Comment