ঊষাঙ্গিনি যেদিন
লিপিলেখার সাথে শিলালিপির পরিচয় করিয়ে দিলেন, সাময়িক ভাবে শিলালিপির মনে হল,
নিজেরি প্রতিচ্ছবির সাথে পুনঃ পরিচিত হল। দুজনেরই মাঝারি উচ্চতা, হৃষ্টপুষ্ট
চেহারা, গৌর বর্ণ, গোল মুখ, তফাৎ বলতে লিপিলেখা মাথায় একটু লম্বা আর শিলালিপির
কেশদাম একটু বেশি লম্বা। ভাব জমতে দেরি লাগল না। উপরন্তু দুজনের অফিসও একই পাড়ায়,
ফলে ট্রেন থেকে নেমে বাকি রাস্তাটাও দুজনে
একসাথেই যায়। লিপিলেখা দীর্ঘ দুই বৎসর পশ্চিম বঙ্গের বাইরে থেকে পড়াশোনা করেছে,
স্বভাবতই একটু বেশি স্মার্ট। আজকাল আর ওরা স্টেশন থেকে বেড়িয়ে অটো ধরতে দৌড়য় না,
বরং ভাগাভাগি করে রিক্সায় চাপে। দরাদরি বা ঝগড়া করার ব্যাপারে লিপিলেখা রীতিমত
দক্ষ। শিলালিপি প্রথম দিন একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল, আপাত শান্ত, মিষ্টি লিপিলেখার ঝগড়া
দেখে, লিপিলেখা পরে বুঝিয়েছিল, “ওরে মদন, গ্রুপে ঝগড়া করা আর ঝাড়ি মারার মজাই
আলাদা। এখানে আর কাকে ঝাড়ি মারব? তাই একটু ঝগড়াই করে নিলাম।”
তবে ঊষাঙ্গিনি,
শিলালিপি আর লিপিলেখার বন্ধুত্ব জমে ক্ষীর হয় যখন নবনী এসে ওদের সাথে মিলিত হয়।
নবনী হল এই চতুষ্কোণের সবথেকে বর্ণময় অঙ্গ। নবনী এক গুঢ় রহস্য। ঊষাঙ্গিনির মত
ডেইলি প্যাসেঞ্জাররা নবনীকেও প্রকাশ্যে এড়িয়ে চলে। অথচ নবনীর গুণের শেষ নেই। নবনী
হস্তরেখা বিশারদ, গ্রহ শান্তি বিশারদ, কোন দিনে কোন রঙ পরলে সব গ্রহ খুশি থাকে, তা
নবনীর নখ দর্পণে। নবনী শুধু জানেই না, অক্ষরে অক্ষরে তা মেনে চলে। প্রতি সোমবার
নবনী সাদা শাড়ি পরে আসে, মঙ্গল বার লাল, বুধ বার সবুজ ইত্যাদি ইত্যাদি। রামদেব
বাবার একনিষ্ট ভক্ত। রোজ প্রাণায়াম করে, এবং দাবি করে প্রতিনিয়ত নাকি ২৫গ্রাম করে
ওজন কমছে। প্রসঙ্গত নবনী একটি ছোট্ট খাট্টো ননীর পাহাড়। তবে লিপিলেখা আর শিলালিপির
কাছে নবনীর সবথেকে আকর্ষণীয় গুন হল তার অফুরন্ত আদি রসের ভাণ্ডার। ঐ রকম
লক্ষ্মীশ্রী মার্কা এক বছর ত্রিশের বঙ্গনারী এবং এক সন্তানের জননী যে ঐ রূপ আদি
রসে টইটুম্বুর হতে পারে, তা নবনীর সাথে অন্তরঙ্গ আলাপ না থাকলে লিপিলেখা আর
শিলালিপি জানতেও পারত না। পরিচয় জমার দিন দুয়েকের মধ্যেই নবনী ঊষাঙ্গিনি, লিপিলেখা
আর শিলালিপির সামনে আক্ষরিক অর্থে নিজের স্বামীকে বিবস্ত্র করে দিল। নবনীর মতে তার
স্বামী বাঙালি নয়, শক্তি তথা সামর্থে পাঞ্জাবি সমতুল। পুঙ্খনাপুঙ্খ ভাবে শুধু
নিজের বরের দেহ সৌষ্ঠব বর্ণনাই নয়, ফুলশয্যার রাত্রের প্রতিটি মুহূর্ত সবিস্তারে
বর্ণনা করতে শুরু করল। লিপিলেখা আর শিলালিপি লজ্জায় লাল বেগুনী হয়ে গেলেও নীল ছবি
দেখার মত মুখ করে শুনছিল। এত উৎসাহী শ্রোতা পেয়ে নবনীও পূর্ণ উদ্যমে সবিস্তারে বলে
যাচ্ছিল, কিন্তু রণে ভঙ্গ দিলেন, ঊষাঙ্গিনি, এত ক্ষণ উনিও লোলুপ ভাবে শুনছিলেন,
কিন্তু শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে নবনী যখন নীল ছবি শুরু করেছে, উনি মুখ ঝামটা দিয়ে
বলে উঠলেন, “ কি হচ্ছে, লবনী? তোর তো সাত আট বছর আগে বিয়ে থা হয়েছে, ওদের তো এখনও
বাকি। সব কি তুই বলে দিবি?” উত্তরে বিন্দুমাত্র অপ্রস্তুত না হয়ে নবনী বলল, “তাও
বটে। তবে সব জেনে রাখাই ভালো। এই তোমরা বিয়ে করবে কবে? বয় ফ্রেন্ড আছে?” লিপিলেখা
আর শিলালিপি দুজনেই জানাল আছে। অতঃপর নবনী জিজ্ঞাসা করল, “ কে কি করেছো?” লিপিলেখা
আর শিলালিপি সমস্বরে বলে উঠল, “মানে?” নবনী চোখ মেরে বলল, “ নেকু। বয় ফ্রেন্ডের
সাথে কে কি করেছো? আমি তো সব বললাম। এবার তোমাদের পালা।” বহু জোর জবরদস্তির পর
দুজনেই জানাল, চুম্বনের বেশি কিছু না। শুনে আকাশ থেকে পড়ল নবনী। “অ্যাঁ?? কত দিনের
সম্পর্ক?” লিপিলেখার পাঁচ আর শিলালিপির মাত্র এক বছর। কর্মসূত্রে লিপিলেখার বয়
ফ্রেন্ড রণজয় থাকে সুদূর ব্যাঙ্গালোর আর শিলালিপির সৌর জলপাইগুড়ি। মাত্র এক বছর
বলে সৌরকে আপাতত ছাড় দিয়ে রণজয়কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল নবনী। “পাঁচ বছরের সম্পর্ক
অথচ চুমু ছাড়া কিছু হয়নি??? শালা নির্ঘাত নপুংসক।” “নবনীদিইইইইইই” বলে চিৎকার করে
উঠল লিপিলেখা। “ভাল হবে না বলছি।” নবনী অত্যন্ত সিরিয়াস মুখে বলল, “ আরে তোমরা
আমার ছোট বোনের মত। এটা সিরিয়াস ব্যাপার। না পরীক্ষা করে একদম বিয়ে করতে যেও না।”
শিলালিপি দাঁত বের করে হাসছিল, নবনী তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমিও। ছেলেখেলা নয়।”
হেসে গড়িয়ে পড়তে পড়তে লিপিলেখা বলল, “ কি করে পরীক্ষা করব নবনীদি? সেটাও তো বলে
দাও? পরীক্ষা করতে গেলেই তো ” বলে চোখ টিপল লিপিলেখা। হাসতে হাসতে প্রায় বিষম খেল
শিলালিপি, ঊষাঙ্গিনি ঠোঁট মুচড়ে, বলে উঠল, “মরণ।” কিন্তু নবনী অদম্য। “আরে এত
দিনের সম্পর্ক, মানুষটার শরীরে একটা অঙ্গ আছে কিনা, সেটাও তোমরা দেখতে পারবে না?”
নবনী চোখ গোল করে বলল।
“তুমি দেখেছিলে বোধহয়?” বলল শিলালিপি।
“অবশ্যি। উফ আমার বরটা
না পুরো পাঞ্জাবি মাইরি। জান ফুলশয্যার পরদিন আমাকে টিটেনাস দিয়েছিল।” গরবিনী
পায়রার মত ঘাড় ঘুড়িয়ে জানাল নবনী।
“সে কি??? কেন???”
সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল লিপিলেখা আর শিলালিপি।
“দিতে হয়।” জবাবটা অবশ্য আর বেশি দিল না নবনী।
তবে শারীরিক বিভঙ্গে বুঝিয়ে দিল অনেক কিছুই। সেদিন রাতে সৌর এবং রণজয় যখন যে যার প্রিয়
বান্ধবীকে ফোন করল, শিলালিপি আর লিপিলেখা প্রথমেই নবনীদির গল্প শুরু করল। নপুংসক
কিনা পরীক্ষা করার যে পদ্ধতি নবনী শিখিয়েছে, সেটা শুনে, সৌর বলল, “ হুম। আমার ঐ
পরীক্ষায় বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। তবে কাল তোমার নবনিদিকে জিজ্ঞেস কোর, অঙ্গটা
আছে, তা নাহয় বোঝা গেল, কিন্তু সেটা আদৌ কর্মক্ষম কিনা, সেটা কি ভাবে জানা যাবে? ”
আর রণজয়কে লিপিলেখা যখন জানাল, যে ফুলশয্যার পরদিন বউকে টিটেনাস দিতে হয়, তা শুনে
রণজয় আকাশ থেকে পরে বলল, “ কি সব আজগুবি কথাবার্তা। বাপের জন্মে শুনিনি। তোমার
নবনীদির বরটা একটা গান্ডু।”
যে কোন কারনেই হোক ঊষাঙ্গিনি, নবনী কে
একদম পছন্দ করে না। সামনা সামনি অবশ্য দেখে বোঝার উপায় নেই, গলা জড়িয়ে প্রায়ই গান
গায় দুজনে, লিপিলেখা আর শিলালিপির জন্যই ওদের বন্ধুত্ব নাকি প্রগাঢ় হয়েছে, তাই
দুতিন দিন ছাড়া ছাড়াই ওরা একবার করে বেসুরো গলায়, বেখাপ্পা স্বরচিত গান গায়, যদিও
গানটা শুরু হয়, “এই স্বর্ণালী সন্ধ্যায়, একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু।” কিন্তু আড়ালে
ঊষাঙ্গিনি নবনীকে “মটকী” বলে ডাকেন। নবনী প্রায় দিনই ভাল ভাল শাড়ি পরে আসে আর
সগর্বে ঘোষণা করে, “এই শাড়িটা আমার বর দিয়েছে।” উষাঙ্গিনির এতেই আপত্তি, নবনী না
থাকলেই বলে, “ আমার বর দিয়েছে না হাতি দিয়েছে। তোরা জানিসনি, ও মটকীর কত গুণ। সাধে
কি লেডিস কমপার্টমেন্টের কোন মেয়েছেলে ওকে দেখতে পারে নি? ওর অফিসে সুজন বলে একটা
ছেলের সাথে মটকীর লটঘট ছিল। একদিন প্লাটফর্মে কি হাতাহাতি দুজনে। আজকাল মটকী একটা বুড়ার সাথে ঘোরে, এই নিয়ে
সুজনের সাথে মন কশাকশি। সুজন ওকে ভালবেসে সোনার বালা দিয়েছিল, এবার যখন বলছে ফেরত
দে, মটকী আর দেয়নি। জানিস সুজন নিজে আমায় কেঁদে কেঁদে বলেছে, ‘ দিদি ও কুহকিনী।
ডাইনি। ওর জন্য আমি আমার বউটাকে কত কষ্ট দিয়েছি। শাড়ি, সোনার বালা যা চেয়েছে
দিয়েছি, সে আমার সাথে এমন করল।’”
“আহা রে। গলায় দেবার
দড়িও জোটে না হারামজাদার। নবনীর কাছে লাথি খেয়ে বউ এর জন্য শোক উথলে উঠল। গান্ডু
শালা। হারামি” লিপিলেখা রেগে অশ্লীল শব্দ বর্ষণ করতেই থাকে, আর শিলালিপি হাসতে
হাসতে ট্রেনেই শুয়ে পরে।
মন্দ কাটছিল না ডেইলি
পাষণ্ডগিরি। নবনীর আদিরস আর পরকীয়া, ঊষাঙ্গিনির গালমন্দ, নাচন কোঁদন আর এদের
দুজনকে নিয়ে আবডালে শিলালিপি আর লিপিলেখার পরচর্চা। খড়গপুর স্টেশনের পাঁচ এবং ছয়
নম্বর প্লাটফর্মের মাঝে একটি জুস কাউন্টার আছে। নিত্যযাত্রীরা সকলেই জানে ঐটি হল
পরকীয়ায় নিমজ্জিত রাধা শ্যামদের অবাধ মিলনক্ষেত্র। একত্রে জুস খাওয়ার অর্থ হল,
পরকীয়ার ওপর শিলমোহর পরা। ঐযে বলে না “ইটস্ অফিশিয়াল”। এই জুস কাউন্টারেই একদিন
ওরা নবনীকে দেখেছিল সেই “বুড়া”র সাথে। ঘটনাচক্রে পঞ্চায়েত নির্বাচনের দামামা
বাজতেই শিলালিপিদের কাজও আকস্মিক বহুগুণ
বেড়ে গিয়েছিল। এই কর্মযজ্ঞে শিলালিপির প্রত্যক্ষ ভুমিকা না থাকলেও, মাঝে মাঝেই
বসের নির্দেশে নানা ক্যাম্পে যেতে হত। শিলালিপি হতাশ হয়ে বলত, “গ্লামার কোশেন্ট
বাড়াতে নিয়ে যায়। কি হচ্ছে কিছুই বুঝি না। করনীয় কিছু নেই, শুধু হুকুম তামিল করা।”
ফলে পাঁচটার ট্রেন ধরা সর্বদা সম্ভব হত না। তবে ওদের বন্ধুত্ব এতই সুদৃঢ় ছিল যে,
লিপি ঊষা এবং নবনী শিলালিপির জন্য অপেক্ষা করত। পরের ট্রেন পৌনে ছটায়। আসতে আসতে
ছটা তো বটেই। এই সময় প্লাটফর্ম বেশ ফাঁকা হয়ে যেত। বেশ কিছু বাজারউলি, জনা কয়েক উর্দিধারী
আর স্টলওয়ালা ছাড়া বিশেষ কেউ থাকত না।
এইটাই ছিল ঊষাঙ্গিনির সুবর্ণ সুযোগ। কাঁধে আর হাতে দুটি ব্যাগ নিয়ে গোটা প্লাটফর্ম
চক্কর কাটত, কোথায় কোন উর্দিধারী কি তোলা তুলছে দেখার জন্য। দেখতে পেলেই ঝাঁপিয়ে
পড়ত ঝগড়া করার জন্য। সাথে লিপিলেখা যথাযথ সঙ্গত দিত। কদাচিৎ নবনীও অংশ গ্রহণ করত।
প্রায় দিনই শিলালিপি এসে দেখত ওর তিন বান্ধবী স্টেশনে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে বসে
আছে। সেদিনও এসে দেখে তুমুল ঝগড়া চলছে, জনৈক উর্দিধারী ব্যক্তি আর কিছু না পেয়ে,
এক ফুলওয়ালীর থেকে খানিক ফুলই তুলে নিয়েছে। ঐ উপরি ফুলে মায়ের পূজা করবে, এত বড়
অনাচার? ঊষাঙ্গিনি যখন বলতে গেছে, লোকটি নির্বিকার ভাবে জবাব দিয়েছে, “ তা আপনিও
নিন না। ” ফলত ঊষা আর লিপি ঝাঁপিয়ে ঝগড়া করছে, ভাগ্যিস তখন ক্যামেরাওয়ালা মোবাইল
বা অর্ন্তজালের এই দৌরাত্ম্য ছিল না, নাহলে নির্ঘাত সেদিন ওটাই ব্রেকিং নিউজ হত।
শিলালিপিকে দেখে ওরা রণে ভঙ্গ দিল। সেদিন নবনী বলেই রেখেছিল, ও তাড়াতাড়ি ফিরবে।
বাকি তিন কন্যা ফাঁকা বেঞ্চ দেখে বসে গল্প করছে, ঊষাঙ্গিনি বীরদর্পে বর্ণনা করছে
কেমন করে ওরা ঝগড়া করেছে, হঠাৎ লিপি বলে উঠল, “ নবনী দি না? হ্যাঁ নবনী মোটিই তো।”
ঊষা আর শিলা ঘুরে দেখে, বাস্তবিকই নবনী। অত্যন্ত রোম্যান্টিক দৃষ্টিতে কারো দিকে তাকিয়ে
মুচকি হাসছে, এবং জুসে চুমুক দিচ্ছে। লাস্য চুইয়ে পড়ছে, প্রতিটি বিভঙ্গে। শিলালিপি
বলে উঠল, “ কি বেহায়া মাইরি। জানে আমরা এই ট্রেনে ফিরব। তাও?” ঊষাঙ্গিনি প্যাঁচার
মত মুখ করে বলল, “ দেখ। কবে থিনি বলছি। ও নির্ঘাত সেই বুড়ার সাথে যাবে। মাঝে মাঝেই
যায়। আর আমাদের বলে অফিসে চাপ আছে, পরে যাব।” ইতিমধ্যে ট্রেনের ঘোষণা হয়ে গেছে,
ট্রেন আসছে, নবনী লেডিজ কম্পার্টমেন্টের দিকে তাকাচ্ছেও না। বুড়ার সাথে দিব্যি
ঘনিষ্ট ভাবে দাড়িয়ে আছে, বোঝাই যাচ্ছে সাধারণ কামরায় সোয়ার হবে। লিপি আর থাকতে
পারল না, “দাঁড়া। মোটির প্রেম করা ঘোচাচ্ছি।” স্বভাব বিরুদ্ধ প্রগলভা হয়ে চিৎকার
করে উঠল, লিপিলেখা, “নবনীদিইই । তাড়াতাড়ি এস। ট্রেন এসে গেল যে।” নবনীর মুখের হাল
ভাষায় অপ্রকাশ্য। দেখন হাসি হেসে, মত্ত হস্তিনীর মত এগিয়ে এসে বলল, “ শিলু, কেমন
চমকে দিলাম। তোমাদের সাথে যাব বলেই তো তাড়াতাড়ি ফিরলাম না। কোথায় ছিলে খুঁজেই
পাচ্ছিলাম না।”
নবনীর পরকীয়া নিয়ে
প্রায় একটা মহাভারত লেখা যায়। শুধু সেই বুড়া নয়, ধীরে ধীরে নবনীর আরও একাধিক
সম্পর্কের খোঁজ তথা চাক্ষুষ প্রমাণ পাওয়া যেতে লাগল। মাওবাদীরা তখন জঙ্গল মহলে
সক্রিয় হতে শুরু করেছে, মাঝে মাঝেই তেনাদের কারণে ট্রেন বাতিল হতে লাগল। সেদিনও
৪.৪৫ এর মেদিনীপুর লোকাল কোন কারণে বাতিল হয়েছিল। অগত্যা ঊষাঙ্গিনি, নবনী,
লিপিলেখা এবং শিলালিপিও আরও অগণিত নিত্যযাত্রীদের মত আরণ্যক এক্সপ্রেসে সওয়ার হল।
পাশকুড়ায় নেমে অন্য লোকাল ধরা হবে। আরন্যকে সেদিন থিকথিকে ভিড়। ঊষাঙ্গিনির বয়স
দেখে একজন দয়াপরবশ হয়ে সিটটা ছেড়ে দিল বটে, নবনী, শিলা আর লিপি দাঁড়িয়েই চলল।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আরণ্যকের নিত্যযাত্রীদের একটি দলের সাথে নবনী জমিয়ে আড্ডা মারতে
লাগল। খানিক পরে চা ওয়ালা উঠল, তীব্র শীত পড়েছে বলে, সেদিন কফি নিয়ে উঠেছে।
শিলালিপিদের আর কিনতে হল না, নবনীর সাথে ফষ্টিনষ্টি করা সাহেবদের একজন সবাইকে কফি
খাওয়াল। কফি তে দু এক চুমুক দিয়েই গলায় এক রাশ লাস্য নিয়ে নবনী দূরে বসা একজনের উদ্দেশ্যে বলে উঠল, “এই সুজন,
কফি খাবে?” এক ঘোর কৃষ্ণকায় হোঁৎকা মত অল্পবয়সী ছেলে এতক্ষণ জানলার ধারে বসে গভীর
মনোযোগ দিয়ে অন্ধকার মাঠঘাট দেখার চেষ্টা চালাচ্ছিল এবং মাঝে মাঝেই আড় চোখে নবনীর
দিকে তাকাচ্ছিল। সে হটাত এই সহৃদয়তায় বিগলিত হয়ে, এক রাশ মুলোর মত দাঁত বার করে
জানাল, খুব খাবে। এদিকে মুস্কিল হল, যে কফিওয়ালা ততোক্ষণে অন্য কামরায় চলে গেছে,
আর ফেরার সম্ভবনা নেই। বিন্দুমাত্র না ঘাবড়িয়ে নবনী নিজের এঁটো আধখাওয়া কফিটা
বাড়িয়ে দিল, এবং সেই সুজন নির্লজ্জের মত উঠে এসে, সেই কফিটি শেষ করল। লিপি শুধু
হিসহিস করে বলে উঠল, “হ্যাঁ গো, উষা কাকিমা, এই তোমার সুজন? এই কান্নাকাটি করছিল,
মোটি নবনী ওর থেকে সোনার বালা হাতিয়ে বুড়ার সাথে ভেগেছে? হারামি শালা, ওর হয়েছে
কি? নবনীর পোষা কুত্তা কাহিকা।”
শুধু পরকীয়া কেন, মদ্য পান এবং উদ্দাম
ফুর্তি করাতেও নবনীর উৎসাহের ঘাটতি ছিল না। এ ব্যাপারে প্রায়ই না না বিদ্ঘুটে
পরিকল্পনা বার করত। যেমন একদিন বায়না ধরল, খড়গপুরের কোন ভালো হোটেলে একটা রুম নিয়ে
চার জনে মিলে সারা রাত উদোম হয়ে উদ্দাম নাচাগানা করা হোক। সাথে মদ্য এবং মাংস
থাকবে। উষা সাগ্রহে রাজি হয়ে গেল। শিলালিপি তো রেগে বাক্যহারা, কি অসভ্য মার্কা
আব্দার। হিডেন ক্যামেরা ব্যাপারটা বহুল প্রচলিত না হলেও অজানা ছিল না। তাছাড়া
চারটি মাতাল মহিলা সারারাত উদ্দাম নাচানাচি করলে, হোটেলওয়ালারা ছেড়ে দেবে। লিপি তো
হেসেই খুন। শেষে অতি কষ্টে সে যাত্রা নিরস্ত করা গেলেও মদ খাবার আব্দার চলতেই
লাগল। নবনী এবং উষার যুগ্ম আব্দারের কাছে শিলা আর লিপি অবশেষে পরাজয় স্বীকার করে
নিল। তবে শর্ত এই, শিলালিপিকে মদ খাবার জন্য জোরাজুরি করা চলবে না। লিপির ও সব
ট্যাবু নেই। বাইরের হস্টেলে থাকাকালীন সিনিয়র দিদিরা ওদের দিয়ে মদ এবং কনডম কেনাত।
নির্দিষ্ট
দিনে যে যার অফিস থেকে হাফ ডে নিয়ে চার জনে হাজির হল, খড়গপুরের বিখ্যাত “পার্ক
হোটেলে”। ভর দুপুর বেলা হোটেল খালি। ওদের দেখে সিকিউরিটি ফ্যামিলি সেকশনে নিয়ে
যেতে উদ্যত হল, কিন্তু নবনী জানাল, বার কাম রেস্তরাঁই ওদের গম্য। আজ থেকে আট বছর
পূর্বে খড়গপুরের মত মফস্বল শহরে ঘোর দ্বিপ্রহরে চার জন চাকুরিরতা মহিলা মাল টানতে
আসবে বোধহয় সিকিউরিটি ভদ্রলোকটির কাছে অকল্পনীয় ছিল। উনি ঘাবড়ে, মাথা চুলকে বললেন,
“আজ্ঞে দিদি, ওখানে মদ টদ বিক্রি হয়...।।” লিপি গম্ভীর ভাবে বলল, “হু”। ফাঁকা বারে
মদ্য পান সাথে ভয়াবহ পোড়া ফিসফ্রাই, ফ্রায়েড রাইস আর চিকেনের একটা আইটেম, যা খেতে
অবিকল চিলি চিকেনের মত সাথে দুর্বার আড্ডা, সময় পাখনা মেলে উড়ে গেল। হোটেল থেকে
বেড়িয়ে ফুরফুরে মেজাজে চারজন হাটা দিল আই আই টির দিকে, কারণ মাঝে কোথাও অটো পাওয়া
যায় না। ঊষাঙ্গিনি ফুর্তিতে বেজায় বেসুরো গলায় গান ধরল, “এই সুন্দর সরনালি সন্ধ্যায়,
একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্দু” একবার শিলার থুতনি ধরে চুমু খাচ্ছে, এক বার লিপির।
নবনী বিরক্ত হয়ে বলল, “চলবে না উষাদি। এই খটখটে রোদে এ গান জমছে না।” ঊষা অন্য গান
ধরল, “ওরে তোরা হাত ধর, পিতিজ্ঞে কর, চিরদিন তোরা বন্ধু হয়ে থাকবি।” গেয়েই লিপির
হাত শিলার হাতে ধরিয়ে দিলেন, যেন কন্যা সম্প্রদান করছেন। সম্মিলিত হাসির রোল উঠল।
ঠিক সেই সময়, জলপাইগুড়ি থেকে সৌর ফোন করে বসল শিলালিপিকে। কাল রাতেই শিলালিপি
জানিয়েছিল আজ ওরা সদলবলে মদ্যপান করতে যাবে। শিলালিপি যদিও খাবে না। বাবা মা জানতে
পারলে কেটেই ফেলবে, তবু। সৌরও নিষেধ করেছিল, পান করতে। কারণ এতটা রাস্তা একা ফেরা,
কোথায় বমি টমি করে এক কাণ্ড বাঁধাবে, ভুল ষ্টেশনে নেমে যাবে ইত্যাদি। তবু কেমন যেন
সন্দেহের বশবর্তী হয়েই ফোনটা করেছিল সৌর, ফোন ধরতেই হেঁড়ে গলার ঐ গান সাথে উদ্দাম
হাসির কলতান। সৌরর আর সন্দেহ রইল না, শিলা মাতাল হয়ে, একদল মাতাল মেয়েছেলের সাথে সার্বজনীন
মাতলামি করছে। শিলা হাসতে হাসতে যতই বলে, “আমি খাইনি। আর এরাও মাতাল নয়। কাকিমা
ইচ্ছা করে মাতাল হবার নাটক করছে,” সৌর অবুঝ। বাধ্য হয়ে ফোনটাই কেটে দিল, শিলালিপি।
ফাঁকা রাস্তায় ঊষা শ্রীচৈতন্যের মত উদ্বাহু হয়ে গান ধরল, “ওরে আমি মাতাল সেজেছি।”
ওরা হাসতে হাসতে অসুস্থ্য হয়ে পড়ছিল, হঠাত, ঊষা চিৎকার করে উঠল, “এই
হারামজাদিইইইইইই। মরবে দেখ। কানে ফোন দিয়ে রেললাইনের ওপর দিয়ে যাচ্ছে।” সত্যই একটি
মেয়ে কানে মুঠোফোন দিয়ে আনমনা হয়ে হেঁটে যাচ্ছে, উষাঙ্গিনির কথা শেষ হতে না হতেই
দূরে দেখা গেল, সাক্ষাৎ যমদূত। সহস্র দাঁত বার করে ছুটে আসছে। মেয়েটির হেলদোল নেই।
কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে ওরা দাঁড়িয়ে দেখল, ঊষাঙ্গিনি দুটো ব্যাগ মাটিতে ফেলে লাইনের
ধার ধরে ছুটছে, একপাটি সস্তার চটি খুলে গেল, ভ্রূক্ষেপ না করেই ছুটছে ঊষাঙ্গিনি।
সম্বিৎ ফিরতেই নবনী তার পাহাড়ের মত চেহারা নিয়ে দৌড়ল, “ঊষাদি, সাবধান।” দৌড়তে
দৌড়তে ঊষাঙ্গিনির চটি আর ব্যাগ দুটিও তুলে নিল। লিপি উত্তেজিত হয়ে বলল, “শিলু চল।”
দৌড়তে লাগল ওরাও।
চার জনের সম্মিলিত
চিৎকার, হুটোপাটি এবং সর্বোপরি লেভেল ক্রসিং এর কাছে এসে ট্রেনের গতি হ্রাস সে
যাত্রা মেয়েটিকে বাঁচিয়ে দিল। ঊষাঙ্গিনি মেয়েটির কাছে যথা সময়ে পৌঁচে টেনে নিলেন
লাইনের বাইরে। মেয়েটি অবশ্য তার আগেই কান থেকে ফোন নামিয়ে পিছনে তাকিয়েছিল, এত
শোরগোল কিসের দেখতে, মৃদুমন্দ গতিতে ধাবমান যমদুতকে দেখে বোধহয় সাময়িক ভাবে
মেয়েটির বাহ্য জ্ঞান লোপ পেয়েছিল, কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, আসন্ন মৃত্যুর
প্রতীক্ষায়। দীর্ঘদিনের ডেইলি পাষণ্ড গিরির অভিজ্ঞতা থেকে, এরকম যে হতে চলেছে, তা
ঊষাঙ্গিনির অজানা ছিল না। ব্যর্থ হয়ে ফোঁসফোঁস করতে করতে ওদের পাশ দিয়ে চলে গেল
যমদূত। ঊষা তো মেয়েটিকে এই মারে তো সেই মারে, “হারামজাদি, মরার আর জায়গা পাউনি,
তুই মরলে ট্রেন বন্ধ হয়ে যেত, বাড়ি ফিরতুম কি করে?’’ মেয়েটির তখনও ঘোর কাটেনি। ঊষা
আবার বললেন, “তা এই বয়সে এত মরার শখ কিসের? বাড়িতে বাবা মা নেই? কত কষ্ট করে বড়
করেছে, আর মেয়ে এখানে সুসাইড করছে। গুছিয়ে পেদালে ঠিক হয়।” লিপি তাড়াতাড়ি ঊষাকে
ঠাণ্ডা করতে উদ্যত হল।এ যা মহিলা, সত্যই না দু চার ঘা দিয়ে বসে মেয়েটাকে। নবনী আর শিলা মেয়েটিকে নিয়ে পড়ল, মেয়েটি তখনও
কাঁপছে। মেয়েটিকে ওরা আগেও দেখেছে। ওদের সাথেই ফেরে। কৃষ্ণা, একটু রোগার দিকে ছিপছিপে
দোহারা চেহারা, লম্বা চুলে একটা মোটা বিনুনি বাঁধা। হরিণীর মত দুটি চোখ ক্রমশঃ সজল
হয়ে উঠছিল। নবনী বলল, “ ঊষাদির কথায় রাগ করো না। তোমার ভালোর জন্যই বলছেন। কানে
মোবাইল দিয়ে রেল লাইন ধরে কোথায় যাচ্ছিলে?”
মেয়েটি কম্পিত এবং ঈষৎ
খোনা স্বরে জানাল, “আই আই টি।” শিলা আর নবনী সমস্বরে বলে উঠল, “আই আই টি? সে তো
ক্রসিং টপকে ওদিকে। তুমি বাঁ দিকে লাইন ধরে কোথায় যাচ্ছিলে?” ঊষা জল খাচ্ছিল, লিপি
অনেকটাই ঠাণ্ডা করেছিল, আবার উত্তেজিত হয়ে পড়ল, “ ও মরতে যাচ্ছিল। নির্ঘাত কোন
হারামজাদার চক্করে পড়েছে। প্রেম করেই মরল, বাবা মা কিছু নয়।” মেয়েটিকে ওরা ছাড়ল
না, সঙ্গে করে আই আইটি নিয়ে গেল, সেখান থেকে অটো করে স্টেশন। পথে ওরা জানতে পারল,
মেয়েটির নাম আরযু চৌধুরী। নাম শুনে ঊষা ফিসফিস করে শিলাকে জিজ্ঞেস করল, “আজ্জু? এ
আবার কেমন নাম? মোছলমান নাকি?” শিলা ইশারায় চুপ করতে বলল, আর লিপি দাঁতে দাঁত চেপে
বলল, “ তাতে কি আসে যায়?”
আরযু পাশকুড়ায় পেয়িং
গেস্ট থাকে, বাড়ি পূর্ব মেদিনিপুরের কোন গ্রামে।খড়্গপুরে কোনও অফিসে কন্ট্রাকচুয়াল
স্টাফ। এদিকে কোন কাজে এসেছিল, ফেরার অটো পাচ্ছিল না, কেউ বলেছে আইআইটি থেকে পাবে,
তাই পথ ভুলে ঐ কান্ড বাঁধাচ্ছিল। মেয়েটির দুটি বৈশিষ্ট্য প্রথমতঃ ওর চিবুক নেই।
মুখটা তলার ঠোঁটে এসে হটাত শেষ হয়ে গেছে। শিলালিপি একদিন দেখেছিল, মেয়েটি বিকালের
ট্রেনে বসে টিফিন করছে, মাঝে মধ্যেই খাবার গুলো মুখ থেকে বেড়িয়ে আসছে, মেয়েটি দ্রুত
সবার অলক্ষ্যে আঙুল দিয়ে আবার মুখে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। দেখে মন খারাপ হয়ে যায়।
শিলালিপি দ্রুত মুখ ঘুড়িয়ে নিয়েছিল। যাতে মেয়েটি না দেখতে পায়। দ্বিতীয়তঃ ঐ খোনা
আওয়াজ। কথা বললেই, হাল্কা নাকি সুরে কথা বলে আরযু।
সেই ঘটনার পর, আরযুর
সাথে ওদের প্রায় রোজই দেখা হত, মৃদু হেসে দূরে গিয়ে বসত আরযু। ওরাও জবরদস্তি করত
না। চার জনের সুখের সংসার। শীত সে বছর জমিয়ে পড়েছে, সবাই খুশি খুশি। আড্ডা, হাসি, মজা, রেলওয়ে পার্কে পিকনিক
স্বপ্নের মত কাটচ্ছিল দিনগুলো। সেদিন ৩১শে ডিসেম্বর। অফিস টাইমেও ট্রেন ফাঁকা।
শিলা ট্রেনে উঠেই ঘ্যানঘ্যান শুরু করেছে, “আজকের দিনে কেউ অফিস যায়। শুধু আজ নয়
আবার কাল ও আসতে হবে।” গতকাল রাত্রে সৌরর সাথে এই নিয়ে এক চোট ঝগড়া হয়ে গেছে, ৩১শে
ডিসেম্বরও একজন উত্তর আর একজন দক্ষিণ বঙ্গে পড়ে আছে। লিপির অবস্থা আরও খারাপ। রণজয়
সেই সুদূর দক্ষিণ ভারতে, শুধু তাই না, তাদের বেসরকারি অফিসে আজ বিরাট পার্টি,
নাচাগানা, আকন্ঠ মদ্য পান এর ব্যবস্থা, নামি ডিজে আসবে। সারা রাত নাচাগানা চলবে।
নবনী আর ঊষা হেসে গড়াগড়ি যাচ্ছে, ওদের ছেলেমানুষি ক্ষোভ আর অভিমান দেখে। গোটা
কামরা খালি, একদিকে ওরা চার জন, আর একদিকে আরযু বসে বসে ফোন করছে। ঊষা আর নবনী
লম্বা হয়ে শুয়েই পড়ল বেঞ্চে। অকস্মাৎ লিপি বলে উঠল, “ এই আরযু কাঁদছে? নাকি রে?” আরযু
মুখের কাছে হাত নিয়ে এসে ফিসফিস করে কথা বলছে, কিন্তু দুচোখ দিয়ে ঝরঝর করে ঝরে
পড়ছে মুক্তোর দানা। শারীরিক বিভঙ্গে পরিষ্কার চরম আর্তি নিয়ে কাউকে অনুনয় করছে।
ঊষা মাথা তুলে বলল, “লভ কেস। সেদিনি বুয়েছি। তোদেরই মত মান অভিমান চলছে। ” বলে চোখ
টিপে শিলা আর লিপি কে মৃদু খোঁচা দিলেন। লিপি কিন্তু গলল না, “ না রে। সিরিয়াস
কিছু। খুব কাঁদছে মেয়েটা।” লিপির কথা শেষ হতে না হতেই আরযু উঠে পড়ল। ব্যাগ মোবাইল
সিটে রেখে, দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। লিপি আর বসে থাকতে পারল না। বিদ্যুৎ গতিতে
গিয়ে আরযুর হাত টা চেপে ধরল। আরযু প্রবল ধস্তাধস্তি শুরু করল, বাকি তিনজনও ছুটে
এল, জবরদস্তি আরযুকে এনে সিটে বসানো হল। আজ আরযুর মুখ চোখ সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম।
আত্মহত্যা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আজ আর ঊষা বকাবকি করলেন না। জড়িয়ে ধরলেন আরযুকে।
মাথাটা বুকে টেনে নিয়ে মাথায় আস্তে আস্তে হাত বোলাতে লাগলেন। নবনীও পিঠে স্নেহের
হাত রাখল। বন্য জন্তুর মত ফোঁসফোঁসানি আচিরেই ফোঁপানিতে পরিণত হল। শেষে হাউহাউ করে
কান্নায়। চেনা গল্প। প্রেম এবং বিচ্ছেদ। নিয়মিত ঝগড়া, তর্কতর্কি চলছিল, কাল রাতেই
ছেলেটি জানিয়ে দিয়েছে সে এই সম্পর্কে জড়াতে আর ইচ্ছুক নয়। ফের ফোন করলে কপালে দুঃখ
আছে। তাও আজ আরযু ফোন করেছিল। মন থেকে মানতেই পারেনি, ওদের সম্পর্ক কখনও ভাঙতে
পারে। জবাবে কুৎসিত ভাষায় চরম অপমান ছাড়া আর কিছুই জোটেনি। আরযু কাঁদছে আর বলছে, “আমাকে
বলল খানকি মাগী। শুয়োরের বাচ্ছা। বলল আমার মা শুয়োরের সাথে শুয়েছিল তাই আমাকে এরকম
দেখতে। আমাকে দেখলে নাকি ঘেন্না করে। ঈশ্বর আমাকে এরকম বানিয়েছে আমি কি করব??”
শিলা আর লিপি সমস্বরে বলল, “ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ। ও তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে। ও কি
মানুষ???” নবনী বলল, “ফোন করো, করে ঐ গালাগাল গুলো ফিরিয়ে দাও। এ সম্পর্কের কোন প্রয়োজন নেই।” আরযু অশ্রু সজল চোখে ওদের
দিকে তাকিয়ে ঊষার বুকে মাথা গুঁজে উচ্চ স্বরে কেঁদে উঠল, “ওকে ফিরিয়ে দাও কাকিমা।
আমি ওকে ছাড়া বাঁচব না।” লিপি কিছু বলতে যাচ্ছিল, ঊষা ইশারায় ওকে থামিয়ে বলল, “
আচ্ছা। ওকে ফেরাবার জন্য যা যা করার আমি সব করব। কিন্তু তুই কথা দে, আর সুসাইড
করতে যাবিনি।” “ফিরিয়ে দেবে কাকিমা? ও ফিরে আসবে?”
“হ্যাঁ রে বাবা। কথা
দিলুম তো।”
“আমি ওকে বড্ড ভালবাসি
কাকিমা। ওকে ছাড়া বাঁচব না।”
“জানি লো আজ্জু। জানি।”
একটু পরেই ঊষার কোলে মাথা রেখে সিটের ওপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল আরযু। শিশুর সরলতা
মাখানো মুখে পরম নিশ্চিন্ত ভাব। কিন্তু বাকি চার জন?
(চলবে)
No comments:
Post a Comment