Friday 6 November 2015

অনির ডাইরি ৫ই নভেম্বর  ,২০১৫

অনির ডাইরি ৫ই নভেম্বর  ,২০১৫

তখন আমি এ এল সি খড়্গপুর। শৈবাল দা ডি এল সি।  মেদিনীপুর অফিস তখনও হয়নি।  দুই মহকুমা মিলে ১৫টি ব্লক আর দুটি মিউনিসিপ্যালিটি ।  মাত্র চার জন ইন্সপেক্টর।  প্রত্যেক কে একাধিক ব্লকের চার্জ দিয়েও সমস্যা মিটত না।  অগত্যা কোথাও পিসি পি এস, কোথাও অবসর প্রাপ্ত ইন্সপেক্টর সাহেবরাই কাজ চালাতেন।  কোথাও বা বিডিও সাহেবরা স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে অন্য কোন এক্সটেনশন অফিসারকে চার্জ দিতেন।  সব মিলিয়ে অবস্থা সঙ্গীন।  দুটি মিউনিসিপ্যালিটি এবং পাঁচটি ব্লকের দায়িত্বভার ছিল একান্তই আমার। ওপরমহলে এ নিয়ে কান্নাকাটি করতাম বটে, ব্যাপারটা মন্দ ছিল না।  যদিও তৎকালে মাত্র দশ দিনের গাড়ি, তাও প্রচুর ঘুরতাম।  চকচকে ৬নং বা ৬০ নং সড়ক দিয়ে উড়ে যেত গাড়ি। কাঁচ ভেদ করে হু হু করে ছুটে আসত মাতাল হাওয়া।  এক, এক ঋতুতে বয়ে আনত এক, এক সুবাস ( মাঝে সাঝে দুর্গন্ধ ও)।  চারিপাশে নয়নাভিরাম প্রকৃতি ।  কোথাও সারি সারি ইউক্যালিপটাস, কোথাও বা শাল, কখনও ঘন সবুজ ধান ক্ষেত, কখনও হলুদ বা চুনেহলুদ গাঁদাফুলের ক্ষেত।  আবার কখনও চারপাশ জল থৈ থৈ। একদিনে গোটা দুই ব্লক ঘুরে অফিস ফিরতে গেলেই মোটামুটি ১০০ কিমির বেশি হত। এত দীর্ঘ পথ একা পরিভ্রমণ করা বেশ দুষ্কর । আমার নিত্যসঙ্গী ছিলেন বাগ বাবু আর নজরুল। বাগ বাবু পূর্বে পি ডব্লু ডি তে চাকরি করতেন।  অবসর গ্রহণের পর আমাদের দপ্তরে সামান্য কমিশনের বিনিময়ে সাসফাউ এর খাতা লিখতেন। আর নজরুল ছিল পিওন।  আজ ভাবতে অবাক লাগে কেন যে,ওনারা আমার ঐ বেয়াড়া আবদারে রাজি হতেন! আমরা শুধু ঘুরে বেড়াতাম তাই নয়, উদরের উপাসনাও হত। কোথায় কি ভালো  পাওয়া যায়, বাগ বাবুর নখদর্পণে ছিল। কিচ্ছু না পাওয়া গেলে পুরাতন বাজারের বাদাম লস্যি!! গ্লাস ভরা অমৃত।  ঘন দইয়ে প্রচুর কাজু দিয়ে বানানো হত।  চামচ দিয়ে ছাড়া খাওয়া যেত না। ওপরে একটা গোলাপ গন্ধী লাল সিরাপ ঢেলে দিত।  তীব্র গা জ্বালানো গরমে, এক চামচ খেলেই জন্নৎ দর্শন।

সেবার নজরুল হঠাৎ করে রোজা রাখতে শুরু করল, আমরাও উৎফুল্ল  হয়ে উঠলাম রোজা রাখার অর্থ বড় করে ইদ পালন এবং আমাদের ভুঁড়ি- ভোজ।  মুস্কিল হল এরই মধ্যে  একদিন হঠাৎ করে ব্লকে যাবার প্রয়োজন দেখা দিল, বাগ বাবু এবং আমি সম্মিলিত ভাবে নজরুলকে বোঝালাম , “এবারের মত ক্ষ্যামা দাও।  রোজারত অবস্থায় এতটা পথ যাওয়া প্রায় অসম্ভব। ” নজরুল নিমরাজি হল।  আমি মজা করে বললাম,“ এবারের মত বাদাম লস্যি তাহলে বাগ বাবু আপনি আর আমিই---”। পরের দিন বাগ বাবুকে নিয়ে গাড়ি এসেছে, কোয়ার্টর থেকে আমায় নিতে, গাড়িতে উঠে দেখি, ড্রাইভারের পাশের আসনে শ্রীমান নজরুল।  আঁতকে উঠলাম, “ একি? কাল যে বললে? এতটা ধকল নিতে পারবে?” নজরুল একগাল হেসে প্রায় নব্বুই ডিগ্রী ঘাড় হেলালো। “কিন্তু বাদাম লস্যি তো গেল?” হতাশ ভঙ্গীতে বললাম।  নজরুল সোৎসাহে জানাল, “খাবো ম্যাডাম।  আজ রোজা রাখিনি। ”
“ একি রে বাবা! একদিন রোজা রাখছ, একদিন রাখছ না। ”
“ সারা মাস তো রাখিনি ম্য্যাডাম। মাঝে কয়েকদিনের জন্য _”।
বাগ বাবু বিরস বদনে ছদ্ম গাম্ভীর্যসহকারে  বললেন, “ কাজটা কি ঠিক করলেন ম্যাডাম? বাদাম লস্যির লোভ দেখিয়ে এক ধর্মপ্রাণ মুসলমানের রোজা ভাঙালেন। ” নজরুল আমি তো বটেই  আমাদের মণিপুরী ড্রাইভার শুদ্দু হাসিতে ফেটে পড়েছিল। আজকালকার এই অসহিষ্ণুতার বাজারে ভাবতেও অবাক লাগে সেই  দিনগুলির কথা।  আমরা- ওরা এই দ্বি- জাতি তত্ত্ব আসছে কোথা থেকে? ওরা কারা? সবাই তো আমরা ।

 কলকাতায় এসে পেলাম দুই অভিন্নহৃদয়  বন্ধু তথা শুভাকাঙ্ক্ষী নজরুল ইসলাম আর নাজিমুদ্দিন সাহেবকে। সেই দিনগুলিতে চার্চ লেনে রমজানের উন্মাদনাই ছিল অন্যরকম ।  খড়্গপুরের নজরুলের মত এই নজরুল ইসলাম সাহেবও নিয়মিত রোজা রাখতেন না।  নাজিম সাহেব আবার অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি।  ওণাদের থেকেই শিখলাম, “ মাহে রমজান” হল রমজান মাস। মাহে রমজান আসার আগে থেকেই কত শত জল্পনা শুরু  হয়ে গেল, কত টাকার ফল কেনা হবে, আত্মীয় স্বজনের জন্য কি কি উপহার কেনা হবে।  সে বছর ইদের মাস খানেকের মধ্যেই দুর্গোৎসব ছিল, ফলে একত্রে পরিকল্পনা হত।  দেখতে দেখতে রমজান এসে গেল।  নজরুল সাহেবও অনুপ্রাণিত হয়ে কঠোর রোজা রাখতে শুরু করলেন।  অফিসে ঢুকেই আমার প্রথম কাজ ছিল গতকাল কে কি খেয়ে রোজা ভেঙেছেন এবং সকালে কি  সেরগি সেরেছেন তার বিস্তারিত  বিবরণ নেওয়া। আমার উৎসাহ দেখে নাজিম সাহেব ঠাট্টা  করে বলতেন, “ এক কাজ করেন, আপনিও বৃহস্পতি আর শনিবার উপবাস শুরু করেন। তাতে ওজন টাও কমে!!!” একদিন চা ওয়ালা চা দিয়ে গেছে, আমরা তিনজন একত্রে কাজ করছিলাম, কথা বলতে বলতে যেই চা টা মুখে তুলেছি, নজরুল সাহেব হাঁহাঁ করে উঠলেন, “ কর কি? রোজাদারের সামনে কিছু খাওয়া কিন্তু গুণাহ। ” বাকি মাসটা আমাকে একাই টিফিন করতে হয়েছিল।

 দেখতে দেখতে এসে গেল প্রকৃত খুশির ইদ।নাজিম বউদি ইদের পর আমাদের জন্য
মিষ্টি পরোটা আর চিকেন পাঠালেন।  সাথে সরু সুতোর মত সিমুই।  ঘিয়ে ভাজা, কাজু কিশমিশে সম্পৃক্ত।  সে স্বাদ আজো মুখে লেগে আছে।  দুর্ভাগ্যবশত অঞ্জনদা সেদিন অনুপস্থিত ছিল।  পরের দিন সব শুনে এক প্রস্থ কপাল চাপড়ে, নাজিম সাহেবকে ধরলেন, ‘বড়খাসি’ খাওয়াতে হবে। নাজিম সাহেব কিছুতেই  রাজি নন।  অঞ্জনদাও নাছোড়বান্দা।  শেষে নাজিম সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন,“ধুর মশাই ।  আপনার ধর্মে তো একটি জিনিসই খাওয়া নিষেধ।  সেটা মানুন না।  তাছাড়া কোন মুসলমান বাড়িতে আপনাকে গরুর মাংস দেওয়া হবে না। ”
আমি আর অঞ্জনদা সমস্বরে  বলে উঠলাম, “কেন?”
“ কারণ আমাদের ধর্মে নিষেধ আছে। কারো ধর্মে নিষেধ থাকলে, তাকে ঐ জিনিস খেতে দেওয়ার অর্থ গুণাহ। ”
যেদিন পড়লাম গোমাংসের  জন্য আমাদের দেশে সংগঠিত নরহত্যা হচ্ছে, হতভম্ব  হয়ে গিয়েছিলাম।  কি হচ্ছে? এসব কি হচ্ছে?
হুসেন মিঞা আমাদের অবসর প্রাপ্ত ক্লার্ক।  রিএমপ্লয়মেন্টে আছেন। আমি বলি উনি আমার অভিভাবক। রোজ কিছু না কিছু ফেলে আসি অফিসে।  পেন ড্রাইভ, চশমা, হেড ফোন মায় হাতঘড়ি পর্যন্ত ।  হুসেন মিঞা যত্ন করে তুলে রাখেন।  অনেক রাত পর্যন্ত ফাঁকা অফিসে একা কাজ করি জানি হুসেন আছে।  চার বার দেখে যাবে, কি করছি। অথচ পান থেকে চুন খসলে কি বকুনি না খায়।  ক্ষমা চাইলে বলে, “ধুর বাবা।  আপনি আমার মেয়ের মত।  কতবার বলব? আপনার কথায় কি মনে করব। ” সেদিন বকরিদ্ এর পর হুসেনের সাথে কথা হচ্ছিল, জিজ্ঞাসা করলাম,“কোরবানিতে কি দিলেন? ”
“ঐ যে বড় বড় খাসি গুলা হয় না। ”
“অ।  গরু?”
“না।  না।  খাসি-খাসি।  গ্রামের দিকে বড় বড় খাসি হয় না? ঐ গুলা”
“ দুম্বা ? ঐ গুলোকে দুম্বা বলে তো?”
“উফ।  আপনি কিচ্ছু চেনেন না।  বলছি খাসি।  গরু, দুম্বা কি সব বলছেন” হাসতে হাসতে বললেন হুসেন মিঞা।
“ মানে, ছাগল তাই তো?”
“ হ্যাঁ রে বাবা। ”
“ না খাওয়ালে বুঝব কি করে?” হেসে উঠলাম উভয়েই।  জিজ্ঞাসা করলাম,“গরু কেউ দেয়?”
“ দেয় ম্যাডাম।  গরিব মানুষ দেয়।  দুচারজন মিলে দেয়।  মাংসটাও অনেকটা হয় কি না”। মনটা হঠাৎ ভারি হয়ে উঠল।  যে দেশে মানুষ অনাহারে মরে, তারা লড়ে যাচ্ছে কি নিয়ে? কোথায় যেন দেখেছিলাম, এই সরকারের আমলে আমাদের দেশ বিফ এক্সপোর্টে শীর্ষস্থান অধিকার করেছে, অর্থাৎ গরু মারলে দোষ নেই, শুধু মুসলমানেরা গরু খেলেই দোষ।  গোটা দেশ মাথা ঘামাচ্ছে অসহিষ্ণুতা নিয়ে, উন্নয়নের দিকে আর কার নজর যাবে বলুন? একদল নীচু তলার রাজনৈতিক  নেতা আবার এই মওকায় কেরিয়ার বানানোর চেষ্টায় ব্যাপৃত।  কি বিস্ফোরক মন্তব্য মশাই , শাহরুখ খান নাকি পাকিস্তানী।  আরে ভাই শাহরুখ পাকি হলে, আমি কি,আমার গোটা গুষ্টি পাকি।
#Anirdiary #AmiAni #Aninditasblog #blogger #banglablogger

No comments:

Post a Comment