Thursday 12 March 2020

কয়েকটা “মাগী”র গল্প –

কয়েকটা “মাগী”র গল্প –
(নারী দিবসের পরিপ্রেক্ষিতে)
বললাম “হ্যাপ্পি উওম্যান্স ডে মাসি”। ঘোলাটে চশমার পিছনে এক জোড়া নিষ্পাপ ছানি পড়া চোখ, চামড়ায় অগুন্তি ভাঁজ, পরনের জীর্ণ সুতির শাড়িটার রঙ কোন এককালে লাল সবুজ ছিল বোধহয়, ব্লাউজটার রঙ কেমন ছিল বুঝতে পারা যায় না, তাপ্পির জালে মুখ লুকিয়েছে সে। ঠিক যেমন বুঝতে পারা যায় না মাসির বয়স কত,৮০-৯০ নাকি আরো বেশী? ঠিক যেমন জানা যায় না মাসির আসল নাম কি ছিল। মাসি পেশায় সব্জিউলি, ওটাই আজ মাসির পরিচয়। বাপের দেওয়া নামটা বিয়ের পর বদলে যায়। আর বিয়ের পরের নামটা ধরে বহুযুগ কেউ ডাকেনি।
প্রত্যহ গুটি কয়েক শশা,দিশি টমেটো, কয়েক ছড়া কাঁঠালি কলা, পাতিলেবু বা মরশুমের সজিনা ফুল বা কচি নিমপাতা নিয়ে বসে মাসি হুগলীর এক চটকল সংলগ্ন বাজারে। একে নারী, তায় পুঁজিহীন, ফলে মূল বাজারে মাসির প্রবেশ নিষেধ। যতবার ঢুকতে গেছে, ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয়েছে মাসিকে, মাসি তাই বসে বাজার থেকে বেশ খানিকটা দূরে, বলা যায় নিরাপদ দূরত্বে, ভিড়ে ভরা রাস্তায় প্লাস্টিক পেতে।
মাসির বাপের বাড়ি ছিল সুদূর ছোটনাগপুর মালভূমির কোন ছোট্ট মফস্বল শহর,নামধাম আর কিছুই মনে নেই মাসির, শুধু বলে, “অনেক বড় বড় গাছ ছিল রে মা, ঝুলা খাটিয়ে খুব দুলতাম আমরা। জলকষ্ট ছিল খুব।কতদিনই বা থেকিছি?” শাদি কবে হয়েছিল, তাও মনে নেই, মনে আছে শুধু গওণা হবার কথা। এক গলা ঘোমটা টেনে,নতুন ট্রাঙ্কে গুটিকয় কাপড় আর একটা সাধের হাত আয়না গুছিয়ে, অচেনা বয়স্ক বরের পিছু পিছু অনেকটা হেঁটে এসে, প্রথমে ভিড়ে ঠাসা ট্রেকার টাইপ গাড়ি তারপর টিরেন। মাসির ছোটছোট ভাই-বোন, সহেলিরা এসেছিল ট্রেকার অবধি, “মুন্না” ছুটেছিল অনেকটা পথ, ধাওয়া করেছিল দিদির ট্রেকারটাকে, লাল রাস্তা দিয়ে ধুলো উড়িয়ে চলা ট্রেকারের সাথে বেশীক্ষণ পারেনি মাসির স্নেহের মুন্না।।মা আসেনি ছাড়তে, মা আসতে চেয়েছিল। মা কাঁদছিল খুব, কাকুতিমিনতি করেছিল, কিছুটা পথ হাঁটতে চেয়েছিল মা, শেষবারের মত তার আত্মজার সাথে, অনুমতি পায়নি। বদলে শুনতে হয়েছিল, “বেহায়া বেশরম অউরত (নির্লজ্জ বেহায়া মাগী)”।
মাসির চটকলে কাজ করা শরাবি বর যখন মারা গেল, রেখে গেল “ফুটা কড়ি” দুটো ছেলেমেয়ে নিয়ে দুটো ভুখা রাত কাটিয়ে,মাসি ঠিক করল,এবার সময় এসেছে, “বেশরম- বেহায়া বাজারের মাগী” হবার। বৃদ্ধা লোলচর্ম খুরখুরে মাসির, আপাতত দুঃখ শুধু একটাই, “বাজারে ঢুকতে না দিল হারামজাদা মদ্দগুলো।“ এ কথা অবশ্য মাসি হাসতে হাসতে সস্নেহে বলে, এখনকার “মদ্দ”গুলোর অনেকের বাপ-দাদার সাথে কোন এককালে কোঁদল করে, বেসাতী শুরু করেছিল মাসি। তারাই উল্টে দিয়েছিল ডালা। অউরৎ দের জন্য সময় বড় ধীরে বদলায়।  

বললাম, “হ্যাপ্পি উওম্যান্স ডে চম্পাদি।“ চম্পাদি আয়া মাসির কাজ করে, পরনে ১২ মাস, সিন্থেটিক শাড়ি, কাঁধে সস্তার ব্যাগ, আর পায়ে বাটার চপ্পল। এই একটাই বিলাসিতা আছে মাসির, বাটার চটি ছাড়া পরে না। আর একটা দুর্বলতা হল বোরলীন। ব্যাগে সবসময় নিয়ে ঘোরে বোরলীন। বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে খসখসে দুহাতে বোরলীন মাখে চম্পাদি।দেখা হলেই গায়ে পড়ে কথা বলে চম্পাদি।
বছর পাঁচেক আগে, চম্পাদির সাথে আলাপ, বাস থেকে নেমে, চায়ের দোকানে জিজ্ঞেস করছিল একটা ঠিকানা। ঠিকানা বলতে,বোনের ভাশুরের আর আমাদের আবাসনের নাম।চম্পাদির বোন-ভগ্নীপতি বিদেশে থাকে। সেই কখনও বলেছিল, “বড়দি কোন সমস্যা হলে, আমার ভাশুর-জার কাছে চলে যাস। ওরা মানুষ ভাল। তারপর তো আমি আছিই।“ সেই আশ্বাসটুকু সম্বল করে, গুটি কয়েক টাকা হাতে, সেই সুদূর সীতারামপুর থেকে ট্রেন- বাস পাল্টে আমাদের আবাসনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল চম্পাদি। কি ভাগ্যি, ওনারা আমাদের বিল্ডিংএই থাকেন, না হলে এই সুবিশাল আবাসনে, শুধু নামের ভরসায় কাউকে খুঁজে বার করা শিবের অসাধ্য। একটা মোবাইল ফোনও যে ছিল না চম্পাদির।
চম্পাদি নিজেই স্বীকার করে, “আমরা হলাম বাংলু”। মুক্তিযুদ্ধের পর সর্বস্বান্ত হয়ে, সপরিবারে পালিয়ে এসেছিলেন চম্পাদির বাবা। তিনি অবশ্য বেশীদিন বাঁচেননি। দুই সমর্থ মেয়ে আর দুই নাবালক ছেলে নিয়ে মহা আতান্তরে  পড়েন চম্পাদির বিধবা মা। পেটের জ্বালায় বেপথু হবার আগেই, বিয়ের সম্বন্ধ আসে চম্পাদির, হবু জামাই একটু বয়স্ক, তবে বিশাল ধনী। দোজবরে। প্রথমা স্ত্রী তিন পুত্র রেখে গত হয়েছেন। পাত্র ইতিমধ্যে নাসবন্ধি করিয়ে বসে আছে, আর বাবা হতে পারবে না, তাই সংসার দেখার জন্য কোন দরিদ্র পরিবারের অল্পবয়সী কুমারী মেয়ে খুঁজছেন, কিচ্ছু লাগবে না, উল্টে হবু শ্বশুরবাড়ির দায়িত্বও তিনি বহন করবেন।
চম্পাদি বলে, “ গালভরা নাম বউ, আসলে বিনা মাইনের ঝি ছিলাম গো। দিনে সংসার টানতাম আর রেতের বেলা কত্তার সেবা করতি হত। বদলে থোক টাকা পৌঁছে যেত মায়ের হাতে। তেনার টাকায় তো মায়ের পাকা বাড়ি উঠল, ভায়েদের কারখানা হইল, বোনের বিয়ে হইল। সবার সব হল গো বুন, আমিই শুধু পড়ি রইলাম, ভেবেছিলাম, বুড়ার এত সেবা করিসি, মরার আগে কমসেকম আমার কথাটা এট্টু ভাববে। একটা বাড়ি না হলেও জীবনসত্ত্ব বা কিছু টাকা দিই যাবে। তা গেল কেমুন? একবার ভাবল না, থাকব কুথায়? খাব কি? যে ছেলেদের কোলে করি বড় করলাম, তারা দিল তাড়িয়ে, ওরা কোনদিন মা বলে মানিই নি। ওদের চোখে আমি ওদের বাপের সেবাদাসী।রক্ষিতা।বুঝলে বুন, রক্ষিতা। পরের ছেলিদের কি বলবা বল, আমার মায়ের পেটের ভাইরাই নিল না আমায়।“
বোনের ভাশুর-জা অবশ্য বিনা বাক্যে আশ্রয় দিয়েছিলেন, বোন বিদেশ থেকে পাঠাতে চেয়েছে বিদেশী মুদ্রা। কিন্তু আর কারো দয়ার দান নিতে সম্মত হয়নি চম্পাদি। আজীবন যে কাজ করে এসেছে, বিনা পারিশ্রমিকে আজকাল অর্থের বিনিময়ে সেই কাজই করে চম্পাদি। বড় মুখ করে বলেন, “গতর খাটিয়ে খাই বুন, মাথা উঁচু করে বাঁচি, কোন পুঙ্গির পূতকে ডরায় না এই মাগী।“

কয়েকটা “মাগী”র গল্প – আজ ৩ এবং ৪ নম্বর “মাগী”
(নারী দিবসের পরিপ্রেক্ষিতে)
বললাম, “হ্যাপ্পি উইমেন্স ডে দীপশিখা”। তুত্তুরীর দাঁতের ডাক্তার, এবং আমার অনুজা সমতুল। পানিহাটির মোটামুটি বনেদি সোনার বেনে পরিবারের মেয়ে, ডানা কাটা পরী না হলেও, দেখতে শুনতে ভালো বলেই জানত নিজেকে। দশ ক্লাসের পরীক্ষার পর, জয়েন্ট এন্ট্রান্সের জন্য পার্ক সার্কাসের কাছে, একটি প্রাইভেট কোচিং ইন্সটিটিউশনে ভর্তি হয়েছিল, আর পাঁচটা সমবয়সী ছেলেমেয়ের মত। সেখানেই সৌম্যর সাথে আলাপ। সৌম্য ছিল যাকে বলে একই সাথে কুল এবং হট, সৌম্য ছিল জটিলতাহীন  বিন্দাস, সৌম্য ছিল নারীপুরুষের সাম্যে বিশ্বাসী, উদারমনা, বন্ধুত্বপরায়ণ। এসব গল্পে যা হয় আরকি, তাই হল, প্রথমে বন্ধুত্ব- পরে প্রেম।
তাজ্জব ব্যাপার, যে সৌম্য বন্ধু হিসেবে এত উদার, প্রেমিকের চপ্পলে পা গলিয়ে, তার প্রথম বক্তব্যটাই ছিল, “চুলের যত্ন নে, আমার লম্বাচুল খুব পছন্দ, আমার আগের গারলফ্রেন্ডের তুলনায় তুই তো টেকো। এক জামা পরে, আর কতদিন ক্লাশে আসবি?রোজই কুর্তি পরে আসিস কেন? তোর দাঁতগুলো ভালো না, হাসলে মাড়ি দেখা যায়, মুখে হাত চাঁপা দিয়ে হাস। হিল পরিস না কেন? তবু একটু লম্বা লাগবে। যাই বলিস, আমাদের দুজনের মধ্যে কিন্তু আমাকেই দেখতে বেশী ভালো।ক্লাসের সব মেয়েরা তোকে ঈর্ষা করে দীপশিখা।“ দীপার মুখে এসে গিয়েছিল, “যাই বলিস, আমাদের দুজনের মধ্যে কিন্তু আমিই বেশী বুদ্ধিমান,আর আমি কি পরব, বা কতটা চুল রাখব এনিয়ে আমার বাবা-মা কোনদিন কিছু বলে না, তুই কোন হরিদাস এলি? “ কথাগুলো মুখের কাছে সুড়সুড় করলেও, সবসময়  বলা যায় না। পারিবারিক শিক্ষা, সহজাত ভদ্রতা বোধ লাগাম পরিয়ে দেয় অভদ্র রসনায়। আজ যখনই দেখা হয়, দিপা বলে, “জানো অনিদি, বলে দিলে ভালো করতাম।“
দীপার পাশে বসে, দীপার সাথে ঘুরতে বেরিয়ে, সৌম্যর নজর সবসময় থাকত আসেপাশে, মাঝে মাঝেই বলত, “ ঐ মেয়েটা অনেকক্ষণ ধরে আমায় ঝারি মারছে দ্যাখ। আঃ ওভাবে তাকায় না উজবুক।“ সিরিয়াসলি? অনেক বেশী নম্বর পেয়েও দীপা ছিল উজবুক? ফোন আসত মেয়েদের গুচ্ছ, গুচ্ছ। দীপার সাথে ফাঁকা বাড়িতে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তেও যদি সৌম্যকে কোন মেয়ে ফোন করত, সৌম্য দীপাকে চোখ মেরে তার সাথে খোলাখুলি ফষ্টিনষ্টি করতে লাগত। দীপা সামান্যতম আপত্তি করলেও শুনতে হত, “মফস্বলের মাল, যত নোংরা তোর মনে।“
জয়েন্টে  দীপা যখন খোদ কলকাতায় ডেন্টিস্ট্রি পড়ার সুযোগ পেয়ে গেল, রাতারাতি ভয়ানক আক্রমণাত্মক হয়ে উঠল সৌম্য। নির্দেশ দিল, “ ওসব বালের দাঁতের ডাক্তারি পড়তে হবে না। এ বছরটা গ্যাপ দে। সামনের বার দুজনে একসঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিঙে লাগাব।“ দীপা বাড়িতে কি বলবে? বাড়ির লোক মানবে কিনা, এসব নিয়ে একবিন্দু মাথা ঘামাতে রাজি নয় সৌম্য। কথা নয়, আদেশ। মানতে দীপা বাধ্য।না মানলে ভুলে যেতে হবে সৌম্যকে। ভুলতেও দেবে না সৌম্য, রোজ এই নিয়ে ঝগড়া ঝাঁটি,কথায় কথায় “খানকি-বেশ্যা” বলে গালমন্দ। রীতিমত বাড়ি এসে বন্ধুবান্ধব সমেত ঝামেলা করার হুমকি-।
তুত্তুরীর আধভাঙ্গা, পোকা খাওয়া  দুধে দাঁতের ওপর ঠুকঠুক করে প্লাস্টিকের হাতুড়ি ঠুকতে ঠুকতে দীপা বলছিল, “ কি দিন গেছে অনিদি। নিজেদের সাময়িক দুর্বলতার মুহূর্তে যতটুকু ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম, ফোনে যে সব আবেগ বিহ্বল কথাবার্তা বলেছিলাম, সেগুলো তুলে তুলে বলত, আমি খানকী। আমার মা সোনাগাছির বেশ্যা। আমার বাবা পারেনি বলে, বারো জনে মিলে আমার মাকে-।
যেন যা হয়েছিল সব একতরফা হয়েছিল। ফোন না ধরলে, নম্বর পাল্টে ফেললে, ল্যান্ডফোনে ফোন করে বাবাকে কুকথা শোনাত।মা হাউহাউ করে কাঁদত, জীবনে আমাদের বাড়িতে কেউ ঐ ভাষায় কথা বলেনি।মা নিছক গৃহবধূ। বাবা পাড়ার একজন সম্মানীয় ব্যক্তি, এখনও আমাদের বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়। আর সেই বাড়ির মেয়ে হিসেবে আমার অপরাধটা কি ছিল অনিদি? ভালোবাসা? দৈহিক আবেদনে সাড়া দেওয়া। আর দেহটা তো আমার,আমার তো কোন অপরাধ বোধ নেই তাহলে? অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল, যে ভেবেছিলাম সুইসাইড করব। সামনেই পরীক্ষা, পড়াশোনা ডকে উঠেছিল,রোজ রাতে মা-মেয়েতে ডুগরে ডুগরে কাঁদতাম। তারপর একদিন ঠিক করলাম, অনেক সয়েছি, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, এবার যে ভাষা সৌম্য বোঝে, সেই ভাষায়ই ওর সাথে কথা বলতে হবে।সেদিন সকালে সৌম্য যখন ফোন করল, তখন আমি ট্রেন ধরব বলে সোদপুর স্টেশনে দাঁড়িয়ে, তুলে বললাম, ‘কিরে শুয়োরের বাচ্ছা খানকীর ছেলে, কি বলবি? শুনে রাখ, তোকে আর ডরায় না এ মাগী।‘ ভেবেছিলাম আরো দশটা খিস্তি খাব, অবাক হয়ে গেলাম সৌম্যর প্রতিক্রিয়া দেখে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল, ‘কি বললি মাগী তুই? তুই আমায় এত বড় কথা বললি? আমার বাবাকে শুয়োর বললি? আমার মাকে--। আমার মা? আমার দেবীতুল্য মাকে তুই খানকী বললি, নরকেও জায়গা হবে না তোর। আমি তোর মুখ দেখতে চাই না। ভাবতেও ঘেন্না হয় এমন একটা মেয়েকে আমি এতদিন ভালবাসতাম’“। 

বললাম “হাপ্পি উইমেন্স ডে পাম্মি অ্যান্টি।“ পাম্মি ওরফে পরমিন্দর কউর, নাকি সিং? কখনও গোটা নামটা জিজ্ঞেস করা হয়নি। আন্টির বয়স ৭৫ তো হবেই, একটা ঝাঁ চকচকে বিউটি পার্লারের মালকিন। এই বয়সেও গায়ের রঙ কাশ্মীরি আপেলের মত। মাছি পিছলানো ত্বকে প্রতিফলিত হয় পার্লারের নিয়ন আলো। ঠোঁটে শোভা পায় লাল টুকটুকে লিপস্টিক, স্লিভলেস ধোপদুরস্ত সালোয়ার কামিজে ঝকমক করেন আন্টি। পার্লারে আসা প্রতিটা মেয়ের সাথে গায়ে পড়ে গল্প করেন আন্টি, বলেন, “আপনা ধ্যান রাখখা করো বেটা,আপনে লিয়ে। জো মন চাহে পহনো, খুব সাজো, খুদসে প্যার করনা শিখো। হাম সবসে তো প্যার কর লেতে, বস ভুল যাতে হ্যায় তো খুদ কো প্যার করনা।“
আন্টির জন্ম অবিভক্ত পাঞ্জাবে। ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার সাক্ষী আন্টির পরিবার। কোনমতে জান নিয়ে একবস্ত্রে পালিয়ে এসেছিলেন ওনারা। ঐ সময় মেয়েদের ওপর যে অকথ্য নির্যাতন হয়েছিল, তা প্রত্যক্ষ করে, কেমন যেন বিকারগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিলেন আন্টির বাবা। আন্টির পাঞ্জাবি মিশ্রিত হিন্দিকে বাংলায় অনুবাদ করলে, ওনার বাবা নাকি, দিনরাত খালি বলতেন,”হে ঈশ্বর আমার মেয়েদের না কোনদিন ঐ দিন দেখতে হয়। জলদি ওদের পাত্রস্থ করিয়ে দাও প্রভু।“
১৫ বছর বয়সে, আন্টির বিয়ে হয়। পাত্রের পরিবারও পূর্ব পাকিস্তানের, তবে তারা আর ফিরতে পারেননি। পাত্রের বয়সটাও অনেক বেশী। বিয়ের পর কলকাতায় আগমন। বরাবরই খুব সাজতে ভালোবাসতেন আন্টি।হাতে কাঁচের চুড়ি,ঝুমকা, মাথায় রঙবেরঙের ট্যাসেল, পাটভাঙা কুর্তা-চুড়িদার- চুন্নি। বাপের ঘরে সবাই বলত, “পরী হ্যায় হামারি লাডো।“ আর বিয়ের পর সাজগোজ থেকেই শুরু হল অশান্তি। ওনার স্বামীর এসব একদম পছন্দ ছিল না। “ আচ্ছি ঘর কি লেড়কিয়া কাহাঁ ইতনি বনঠন কে ছম্মক চ্ছল্লো বানকে ঘুমতি হ্যায়?”
সবথেকে জরাজীর্ণ, বিবর্ণ বসনে স্বামীর সঙ্গে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যেতেন আন্টি।“ ইতনি শরম আতিথি বেটা জী, সব লেড়কিয়া, নয়ে, নয়ে কাপড়ে, জেবর পহন কে তিতলিয়ো কি তরহা ঘুমতি থি, ওর ম্যায়, অহি আপনি দো জড়ি কাপড়ো মে, হর অকেশন মে।লিপস্টিক- পাউডার- কাজল কুছ নাহি থা মেরে পাশ বেটা জী। কিতনা রোই ম্যায়। আপনে কিসমত কো কোষা। মেয়েদের কপাল বেটা জী, শুধু সাজতে ভালবাসতাম বলে কতবার যে “ছেনাল” শব্দটা শুনেছি কি বলব। কিছুতেই তোমাদের আঙ্কলজীকে বোঝাতে পারিনি, যে আমি নিজের জন্য সাজতে চাই, কারো দিল বেহলাতে নয়, বা কারোকে ফাঁসাতে নয়।“
“ছিনাল- ছিনাল- ছিনাল শুনে শুনে কান পাক গেয়ে মেরে। ফির সোচা, আগর মেরে সাজনে সাব্রনে সে কিসিকো ইয়ে লাগে, কে ম্যায় ছিনাল হু, তো ম্যায় ছিনালই আচ্ছি। তোমাদের আঙ্কলজীর সাথে প্রায় ঝগড়া করে খুলি এই পার্লার। ততদিনে ছেলেমেয়েরা সব বড় হয়ে গেছে- সেদিনও বলেছিলেন “ছিনাল অউরত।“সেদিন আর খারাপ লাগেনি বেটা জী, বরং মজা লেগেছিল খুব, গালিওকে পিছে ছুপা হুয়া, উনকা ডর, তবতক দিখ চুকা থা মুঝে। ডরে হুয়ে আদমি গালি নেহি দেগা, তো কওন দেগা বেটা জী?”

কয়েকটা “মাগী’র গল্প- আজ ৫ এবং ৬ নম্বর “মাগী”র কথা
(নারী দিবসের পরিপ্রেক্ষিতে)
বললাম, “হাপ্পি উইমেন্স ডে বৈজয়ন্তী”। বৈজয়ন্তী একটা কলেজে পার্ট টাইম পড়ায়। মৈনাক ও পড়ায়, যদিও অন্য ডিপার্টমেন্ট। আলাপ থেকে বন্ধুত্ব হয়ে প্রেম। বৈজয়ন্তীর আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। টেকেনি। নিজের অতীত নিয়ে বৈজয়ন্তী বরাবরই অকপট। মৈনাক তার হৃদয়ের দ্বার উন্মুক্ত করেছিল যখন, সাবধান করেছিল বৈজয়ন্তী, “ সেকেন্ড হ্যান্ড মালকে প্রপোজ করছিস?” মনোহর দাস তড়াগের জলে তখন হোলি খেলতে নেমেছিলেন অপরাহ্ণের প্রবীণ তপন, একমুঠো আবীর ছুঁড়ে দিয়েছিলেন তিনশ বছরের বুড়ি শহরের দিকে, সেই আবীরের ছোঁয়া লেগেছিল মৈনাকের চকচকে ফর্সা সদ্য কামানো গালে।
আজীবন ভালোবাসার অঙ্গীকারের পাশাপাশি নারীবাদ-  লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে কি বিশাল লেকচার দিয়েছিল মৈনাক সেদিন। মৈনাকের বাবা-মাও মেনে নেন বৈজয়ন্তীকে হবু পুত্রবধূ হিসেবে। ওর অতীত নিয়ে ওনাদের কোন মাথা ব্যথা ছিল না। ওনারা শুধু বলেছিলেন, “তোমাদের সুখেই আমাদের খুশি।“ নিজের বাড়িতে বলতে একটু সময় নিয়েছিল বৈজয়ন্তী, মৈনাক কতটা সিরিয়াস না বুঝে বলতে চায়নি। বৈজয়ন্তী ওনাদের একমাত্র সন্তান, ইতিমধ্যেই যথেষ্ট দুঃখ পেয়েছেন ওনারা বৈজয়ন্তীকে নিয়ে। জানতে পেরে আনন্দের আর সীমা রইল না ওনাদের। দুজনে সমস্বরে বললেন, “ আইবুড়ো ছেলে? তাও তোকে- মানে ইয়ে কোন আপত্তি নেই?”বৈজয়ন্তীর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছিল, “না সেকেন্ড হ্যান্ডে মৈনাকের আপত্তি নেই।“
বাবা- মায়ের পিড়াপিড়িতে মৈনাককে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করল বৈজয়ন্তী। মৈনাককে পেয়ে যেন বিমোহিত বৈজয়ন্তীর বাবা-মা। বিয়ের কথা উঠতে দেরী হল না। “বিয়েটা তাহলে কবে করছ?” বাবার এই প্রশ্নের সামনে প্রথম বার থতমত খেতে দেখল মৈনাককে। বিয়ে? বিয়ে নিয়ে আজ অবধি দুজনের কোন কথা হয়নি, বৈজয়ন্তীর রীতিমত লজ্জা করছিল, বাবা-মা এমন করছেন, যেন এত ভালো পাত্র ছাড়া যায় না, পাছে মৈনাক পালায়, তাই আগেভাগেই ঝুলিয়ে দিতে চান নিজেদের “সেকেন্ড হ্যান্ড” কন্যাকে।
সেদিন বিয়ের কথা ওঠার পর থেকে, কেমন যেন নিস্প্রিয় মনে হয় আজকাল মৈনাককে। বৈজয়ন্তী যদিও ফেরার পথে ট্রেনে তুলে দিতে এসে ক্ষমা চেয়েছিল। বাবা-মা সেকেলে মানুষ, তাছাড়া যে মেয়ের গায়ে একবার দাগ লেগেছে, তাকে নিয়ে ওনারা  দুঃশ্চিন্তা করবেন এটাই তো স্বাভাবিক। দিন দশেক বাদে, মৈনাক বলল, “ বৈজয়ন্তী বিয়ে নিয়ে এত চাপ দিলে কি করে হবে?অনেস্টলি, আমি বিয়ে নিয়ে এখনও কিছু ভাবিনি।“
খুচখাচ অশান্তি চলতেই থাকছিল, মাঝে এসে পড়ল মৈনাকের জন্মদিন। মৈনাকের মা নিমন্ত্রণ করলেন হবু পুত্রবধূকে। খুব হাতে গোনা নিমন্ত্রিত, মৈনাকের দু-একজন বন্ধু, মাসি-মেসো, মামা-মামি। মৈনাকের মা, হাত ধরে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন, বৈজয়ন্তীর অতীতের কথাও লুকোলেন না। এত ভালো লাগছিল বৈজয়ন্তীর, মনে হচ্ছিল, এ বাড়িতে পূর্ণতা পাবে ও, ওর সবটুকু মানিয়ে নিতে, ভালবাসতে কোন সমস্যা নেই মৈনাকের পরিবারের। ধাক্কা খেল বাথরুম ঢুকতে গিয়ে, পাশেই রান্নাঘরে, মাকে চাঁচাছোলা ভাষায় ঝাড়ছে মৈনাক, “কে বলেছে, আমার বউ হিসেবে পরিচয় করাবার? বন্ধু বলতে শেখোনি? আর ও ডিভোর্সি এ কথা কি কেউ জানতে চেয়েছিল? গায়ে পড়ে শোনাবার কি দরকার? ওদিকে ওর বাবা-মা হাত ধুয়ে পিছনে পড়ে আছে, গলায় ঝোলাবে বলে, আর এদিকে আমার নিজের বাবা-মা আমার দুশমন।“
নাঃ কাঁদেনি বৈজয়ন্তী, নিজের ওপর রাগ হয়েছিল খুব। কেন যে এতটা লেখাপড়া শিখে, স্বোপার্জিত অর্থে স্বয়ম্বর মেয়েরাও বিয়েতে নিজের সম্পূর্ণতা খোঁজে। কলেজে যদিও অন্য গসিপ ছড়িয়েছিল, “সেকেন্ড ক্লাশ, সেকেন্ড হ্যান্ড মা-“।  
বললাম, “হ্যাপ্পি উইমেন্স ডে সঞ্চারী।“ পেশায় স্কুল টিচার।প্রাইমারী স্কুল। বয়স চল্লিশ ছুই ছুঁই। অবিবাহিতা। বিয়ে নিয়ে সঞ্চারীর বাবা-মার যত না মাথা ব্যথা, তার থেকেও অনেক বেশী মাথা ব্যথা ওর সহকর্মীদের। বিশেষতঃ বিজন বাবুর। এমনিতে যে সঞ্চারীকে বিজন বাবু খুব একটা পছন্দ করেন তা নয়, বরং জনে জনে বলে বেড়ান, “মাইয়াটা বড় ঠোঁট কাটা। গুরুজনদের সাথে কি ভাবে কথা কইতে হয়, সেটুকুও শিক্ষাদীক্ষা দেয়নি বাপ-মা’য়”। অথচ সঞ্চারীর বিয়ে নিয়ে ওনার উৎসাহ কম নয়।
অনেকবার আয়না দেখেছে সঞ্চারী, ঠোঁট দুটো তো দিব্যি জোড়া, তাহলে? একটা শিক্ষিত, স্বয়ম্বর মেয়ের নিজস্ব মতামত থাকবে না? আর সেটা খোলাখুলি ভাবে প্রকাশ করলেই ঠোঁট কাটা? বেহায়া? তাও তো সঞ্চারী গায়ে পড়ে বলতে যায় না। একটা মেয়ে যে স্বেচ্ছায় বিয়ে না করে থাকতে পারে, এটা এরা কিছুতেই বোঝে না। বিয়ে করা আবার কি? মেয়েদের তো বিয়ে হয়, তোমার হচ্ছে না কেন? এটাই সবার জিজ্ঞাসা। বিগত দশ বছরে কতবার যে জেরা করা হয়েছে সঞ্চারীকে। “ প্রেমিক আছে? বাবা- মা মানছেন না?” “ছেলের বাড়িতে আপত্তি করছে নির্ঘাত?” “আরে আমাদের বলো, আমরা গিয়ে কথা বলি-“। “ প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়েছো নির্ঘাত? তাই বিয়েতে আপত্তি। আরেঃ সব ছেলেরা খারাপ হয় না। আমরা দেখি?” না।না।না। বলতে বলতে মুখ ব্যথা হয়ে গেছে সঞ্চারীর।
প্রতিনিয়ত নতুন নতুন থিয়োরি, “এমন কাউকে ভালোবাসো, যে বিবাহিত?” আজ্ঞে না। “আজকাল তো আবার মেয়েরা মেয়েদের সাথেও- আইন আছে নাকি। তা সেরকম কিছু?” আজ্ঞে না। “ আর কতদিন কুমারী থাকবে? যৌবন বৃথা গেলে মরেও শান্তি পাবে না”। আজ্ঞে না, আর আপনাকে কে বলেছে আমি কুমারী? বিয়ে করার সাথে যৌবন উপভোগের কি সম্পর্ক? বিয়ে না করে, ইয়ে করা যায় না বুঝি?”  সাময়িক ভাবে সবাই চুপ হয়ে গিয়েছিল সেদিন। শুধু বিজন বাবু বলেছিলেন, “মাইয়াটা এক্কেরে বেশরম।আমাদের সামনে কইলেন কন, জনে জনে এসব কথা কয়ে বেড়াবেন না। ভালো পাত্র পাওয়া মস্কিল হবে। কে কমনে ভাংচি দেবে। আর আপনের বয়সটাও তো কম হল না।“
কয়েক মাস হল, সঞ্চারীদের স্কুলে একটা নতুন ছেলে জয়েন করেছে। ইন্দ্র। বয়স বেশী না, বাইশ- তেইশ। বিজনবাবু এবং তার দলবল পূর্ণ উদ্যমে উঠে পড়ে লেগেছে ইন্দ্রর হিল্লে করতে। সঞ্চারীর মাথা ব্যথা করে, কমনরুম তো নয়, যেন ম্যারেজ ব্যুরো। একটা একটা মেয়ের কথা ওঠে, আর ইন্দ্র কাটিয়ে দেয়, “বাপরে কি মোটা।“ “দূর এর তো চুলই নেই।“”ইনি তো সাক্ষাৎ শ্রীচৈতন্যদেব বিজন দা। হাঃ হাঃ হাঃ।“  “কপালটা কত বড়। উটকপালি মেয়ে চলবে না।“”একমাত্র সন্তান? ওরে বাবা, শবশুর-শাশুড়ি সমেত ঘাড়ে এসে চাপবে।“ “ এঃ এর মুখে কি ব্রণর দাগ।“ “বাব্বা এতো সাজুনি?” “নামমাত্র বিবাহে ডিভোর্সি? বিজনদা আপনি শেষে একটা সেকেন্ড হান্ড মেয়ের খোঁজ দিলেন? একদম চলবে না। ছবিও দেখাবার দরকার নেই।“ 
কানে হেড ফোন গুঁজে গান শুনছিল সঞ্চারী। পরীক্ষা শেষ, স্কুল ফাঁকা। তবু আসতে হয়, পুরো সময় কাটাতে হয় স্কুলে। একপাশে গজল্লা চলছে বিজনবাবু- বলাকাদিদের। হঠাৎ বিজনবাবু ডাকলেন, “দিদিমণি, শুনছেন?” পাশ থেকে মৈত্রী একটা কানের কর্ডটা টেনে খুলে দিল, “তোকে বিজনদা কি বলছে শোন।“ বিজনবাবু এবং তার টিম গুছিয়ে এসে বসলেন, “দিদিমণি, শোনেন, এবার বিয়েটা লাগিয়েই দিন। আমরা একটা পাত্র দেখেছি, না কইবেন না। আর না কইলেও শুনছে কে?” প্রাথমিক বিরক্তি কাটিয়ে বেশ কৌতুক বোধ হল সঞ্চারীর। এরা ছেলে দেখে, কথাও বলে নিয়েছে, বাপস। তা পাত্র কে? এবার ঝুলি থেকে বের হল বেড়াল, পাত্র হল শ্রীমান রাজকুমার। সঞ্চারীরই সহকর্মী। ব্যাপারটা যে রাতারাতি ঠিক হয়নি তা বেশ বুঝতে পারল সঞ্চারী। কিছুদিন ধরে একটু বেশীই উৎসাহ দেখা যাচ্ছিল রাজকুমারের মধ্যে। মাঝে মাঝে একদৃষ্টিতে সঞ্চারীর দিকে তাকিয়ে থাকতেও দেখেছে, ছুটির পর, স্কুটিতে করে বাড়ি পৌঁছতে চেয়েছে। রাজকুমারের সদ্য ডিভোর্স হয়েছে, বিয়ে ভেঙে যাবার অসীম শূন্যতা সঞ্চারী না বুঝলেও, রাজকুমারের নিঃসঙ্গতা বোধ সঞ্চারীকেও ছুঁয়ে যেত। যথেষ্ট সহানুভূতিশীল ছিল সঞ্চারী, বুঝত এই মুহূর্তে ঠিক কতটা স্পর্শকাতর রাজকুমার। ঠিক তারই সুযোগ নিয়েছে বিজনবাবু এন্ড পার্টি। সচেতন ভাবে, রাজকুমারকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে সঞ্চারীর দিকে।
দূর থেকে জুলজুল করে রাজকুমারের তাকিয়ে থাকাটা মনখারাপ করিয়ে দিল, কে বলে এদের ঘটকালী করতে? মাথা ঠান্ডা রেখে যতদূর সম্ভব ভদ্র ভাবে বলল, “না। আপনারা জানেন, আগেও বহুবার বলেছি, আমি বিয়ে করতে চাই না।“ কিন্তু কেন? “কারণ আমি বিয়ে করতে চাই না, আশ্চর্য তো?” “রাজকুমারের মধ্যে খারাপটা কি দ্যাখলেন, আগে কন?” এই একই প্রশ্ন আর উত্তর চলল, আধঘণ্টা ধরে, শেষে বিরক্ত হয়ে, সঞ্চারীর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “আমার জন্য সেকেন্ডহ্যান্ড ছেলে খুঁজলেন কেন?” ব্যাস মহিলা –পুরুষ নির্বিশেষে ঝাঁপিয়ে পড়ল সবাই, এমনকি ইন্দ্র পর্যন্ত। “ছেলেদের আবার সেকেন্ডহ্যান্ড কি? আমার ঠাকুমা বলত, ‘সোনার আংটি আবার ব্যাকা!” “বড় জেদ তোর। নিজেকে কি ডানাকাটা পরী ভাবিস? কচি খুকি নাকি তুই? মনের মত ছেলে কোনদিনই জুটবে না।৪০ এর মেয়েদের আবার ব্র্যান্ড নিউ পাত্র জোটে? যা পাচ্ছিস, নিয়ে নে।“ “নিজেরও তো সিলকাটা, নিজ মুখে কইছেন, আবার আমাগো রাজকুমারকে কয় কিনা সেকেন্ডহ্যান্ড, যত ফালতু ধুমসি বুড়ি মা-।“
এই ভাবেই চলতে থাকে- একটা গল্প শেষ হয়। শুরু হয় নতুন গল্প।

Monday 9 March 2020

অনির ডাইরি ৯ই মার্চ, ২০২০


“সখী ভালোবাসা কারে কয়-”
কি যেন বলেছিলি চৈ, সবথেকে ফুটফেটে চাঁদ ওঠে দোল পূর্ণিমায়? রাত বেশ গভীর, শুনশান তোদের গলি, দিনভর রঙ খেলে ক্লান্ত শহরটা বুঝি ঝিমোচ্ছে। ভ্যানিশ রাস্তার সারমেয় কুলও।  সিদ্ধি মেশানো ঠাণ্ডাইয়ের হিমেল পরশ মিহি জোছনার মত ছড়িয়ে পড়ছিল চিন্তা ও চেতনায়। তুই আর অন্তু এগিয়ে দিতে এলি বড় রাস্তা অবধি, পথে ঝপ্ করে নিভে গেল ইলেকট্রিক বাতি, চাঁদের সুষমায়  পলকে রূপালী পাঁচশ বছর পার করা শহরটা।

“ চাঁদ উঠেছিল গগনে-”

দেড়শ বছরের বুড়ো বাড়িটা  চাঁদের আলোয় যেন চুনকাম করা।গ্রীল, বন্ধ কাঁচপাল্লার ভিতর দিয়ে জবরদস্তি ঢুকে আসছে চাঁদনি। ঠাকুমার বিয়ের বার্মাটিকের নকশি পালঙ্কের ওপর খবরের কাগজ বিছিয়ে বসেছে আসর। অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচি ভরা এলাচ গন্ধী ঘণ দুধ, ঠাণ্ডাই, কালাকাঁদ, সিদ্ধি, চিপস্, চানাচুর, ক্যাডবেরি, কোল্ড ড্রিঙ্কস্। একতলায় উদ্বিগ্ন  মা, সিদ্ধি অবধি ঠিক ছিল-চিপস্-কোল্ড ড্রিঙ্কস্ আবার কেন? দুধ সয় না অন্তুর। সিদ্ধিও না। নেশা করার বিলাসিতা ওর পোষাবে না। বাড়ি গিয়ে রান্না বসাতে হবে। আজ কত মাস কেটে গেল, শয্যাশায়ী ওর মা। পিঠে গভীর শয্যা ক্ষত। সেরে গিয়েছিল। গজিয়েছিল নতুন চামড়া, আয়া দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় ঘষে উঠে গেছে কচি চামড়া। কাকিমা চিৎকার করে ওঠেননি? চোখ দিয়ে জল বেরোয়নি? প্রশ্ন করলে, জলে ভরে ওঠে দুই চোখ, মাথা নাড়ে অন্তু। “না রে। মা কিছু বলে না-”।
কি সিদ্ধি আনলি চৈতালী? নেশাই তো ধরে না। মাথা চুলকেই যায় চৈতালী, “বললাম, শ্লা-। ভালো সিদ্ধি দেবেন-। চাটুতে বেশ করে নেড়ে আনলাম-”। উপুড় করা জোছনায়, গান ধরে সঞ্চিতা। “ এখন আমার বেলা নাহি আর, বহিব একাকী বিরহের ভার--. ”। কান খাড়া করে শুনি আমরা, এরপর কি? রবি না রোদ্দুর?অঙ্গে অঙ্গে হাল্কা ঝিমঝিমানি, হৃদয়ে মথিত প্রেম- নাকে ভেসে আসে ধুনোর মিষ্টি সুবাস। অস্মি আকাশের দিকে তাকিয়ে ব্যগ্র হয়ে খোঁজে, মাথার ফুটফুটে চাঁদ-

“যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভোলে না মোরে-”

দোলের সকাল, ধপধপে সাদা পাঞ্জাবি পরে প্রস্তুত বুল্লু। তুত্তুরীর লাল রঙ চটা গেঞ্জি আর নীল তারা ছাপ বিবর্ণ ফুল প্যান্ট না পসন্দ। পিতলের রেকাবিতে চুড়ো চুড়ো করে সাজানো ছয় সাত রঙের আবির। চাটুজ্জে বাড়ির দস্তুর, প্রথম আবির পড়বে কুলদেবীর পায়ে। তাঁকে তো সরস্বতী নদীতে বিসজর্ন দিয়ে এসেছিলেন প্রপিতামহের বিধবা জননী। মড়ক লেগেছিল দেবানন্দপুরে। বাড়ির সমর্থ পুরুষগুলো ঝরে গেল অকালে। বিধবা গোলাপসুন্দরী তীব্র অর্থাভাবে কয়েকমাস থোড় সিদ্ধ দিয়ে উপাসনা করেছিলেন অষ্টভূজা কুলদেবীর। তারপর-।
মায়ের কুলুঙ্গী, যাকে বাবা বলে, “ঠাকুরের কাছারি বাড়ি” তথা বাড়ি জোড়া ঝুলন্ত ক্যালেণ্ডারে আসীন গুচ্ছ গুচ্ছ ঈশ্বরের চরণযুগল আবিররঞ্জিত করার পর, আবির পড়ে বয়সানুপাতে গুরুজনদের পাদপদ্মে। “দিদি কই?” সম্পর্কে তো বাবার দিদি, তবে তিন প্রজন্ম ধরে সবাই ডাকি দিদি। তিন প্রজন্মের লালন-পালন যে তাঁরই হাতে।চাটুজ্জে বাড়ি যে অন্ধকার তাঁকে ছাড়া।
পূবের ঘরে বন্দী দিদি। জানুয়ারীর শুরু থেকে অসাড় শরীরের ডান দিকে সবে জাগছে সাড়া। নিজে নিজেই উঠে বসতে পারে আজকাল। খানিকটা হলেও বাড়িয়ে দিতে পারে ডান হাত। হাত ধরলে পায়ের পর পা ফেলে পারে হাঁটতেও, যদিও ভাইদের প্রবল ধমকানির পর। আজও যেমন বড় ভাই বলল, “দাঁড়া দিদি নামবে। আমরা উঠব না। ”
কই গো দিদি নামো। বেলা মধ্যাহ্ন গড়িয়ে যায় অপরাহ্নের পথে। তুত্তুরী আর বুল্লুর মাথায় মুখে খেলা করে রঙবেরঙের আবির। কোথা থেকে এক আবির পিচকারি জোগাড় করে ভসভস্ করে আবির ছিটোয় ডাম্পি। পলকে ময়দান সাফ। এক বালতি জলে ভেসে বেড়ায় শুকনো পলাশ। জলের রঙ গড়ায় হলুদ থেকে লালের দিকে। অন্য বালতিতে গোলা হয় সবুজ রঙ। “মাখাবি না। মাখাবি না” করে অনর্থক চিৎকার করে মা। লাল-নীল-কমলা-হলুদে ভরে ওঠে মায়ের মুখ। গোলাপী শাড়িতে ফোটে লাল সবুজের ফোঁটা। বিনা আপত্তিতে রঙ মাখে বাবা।
দূর ছাই বলে দৌড়ই পূব-দখিন মুখো ঘরের দিকে। বিছানায় পরিপাটি করে শাড়ি পরে বসে আছে দিদি। অনেকদিন বাদে পরল। সৌজন্য আয়া মাসি। বাড়িয়ে দেওয়া গাঢ় সবুজ হাত ধরে পা ফেলে দিদি। পিছনে চিৎকার করে ডাম্পি, “ছেড়ে দাও ঝুনুদি। দিদি একা নামো। ” ডাম্পির চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার করতে করতে কখন যেন নেমে আসে দিদি। কুচো দুটো প্রস্তুত ছিল রঙের ডালি নিয়ে। পলকে খুনখারাবি। হাঁপাতে হাঁপাতে সোফায় বসে দিদি। বাবা শুরু করে, না জানি কোন মান্ধাতা আমলের বস্তাপচা গল্প। আপত্তি জানাতে যাওয়া মুখের ওপর হাত চাপা দেয় চৈতি, “ছেড়ে দাও দিভাই। দিদি এই গল্প গুলোকে খুব মিস করে। ” অতীত আঁকড়ে বেঁচে থাকা পঁচাশি বছরের পিসির সাথে পর্যায়ক্রমে ছবি তোলার হুজুক পড়ে যায়। এবার আমার পালা, মা বলে ওঠে, “যত বয়স বাড়ছে, ধিঙ্গিপনাও বাড়ছে মেয়েটার। ” কাঁপা কাঁপা হাতে সবুজ হাতটা চেপে ধরে পিসি, আদরের ছলে ফিসফিস করে বলে ওঠে “আমায় যেন ভুলিস না ঝুনু ”। আর ধিঙ্গি মেয়েটা? মনে মনে বলে, “কভি নেহি। কভি ভি নেহি। ” শুধু অসভ্য চোখটা কেন যে বারে বারে করকর করে ওঠে-

Wednesday 4 March 2020

অনির ডাইরি ৪ঠা মার্চ, ২০২০


মুখ লাল করে ঢুকেছিল নির্মল। সঙ্গী জনৈক প্রৌঢ় আর একটি চ্যাংড়া। প্রৌঢ়র বয়স বছর পঞ্চাশ, দোহারা খেটে খাওয়া চেহারা, হাতে একটি বাজার ব্যাগ, পরম সঙ্কোচে পিছনে লুকানো। চ্যাংড়ার গায়ে বর্ণময় পাঞ্জাবি।  ভাবহাব পুরো উঠতি নেতা মাফিক। ছোকরা মুখ খোলার আগেই, নির্মল পরিচয় করিয়ে দিল, “ইনি ইমদাদ হোসেন (সব নাম বদলে দিলাম)।  সেই যে ইসমত বিবির কেসটা-”।
কেস। মানে বেনিফিট। পেলে কারো পদধূলি ছাড়ুন, ছায়াও পরে না, এই তুচ্ছ শ্রম দপ্তরে। না পেলেই বাড়ে গোল। ইসমত বিবির কি কেস, প্রশ্ন করতে গিয়েও করলাম না। মনে পড়ে গেল ঝপ করে। আরে ইনি তো আগেও এসেছিলেন। ওণার বিবিজানের অকাল প্রয়াণের পর, প্রাপ্য অনুদানের তদ্বির করতে। নামের গড়বড়ের জন্য, আমাদের পূর্ণ সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পোর্টাল কিছুতেই অনুমোদন দেবার অনুমতি দিচ্ছে না। নির্মলই নিয়ে এসেছিল আগেরবার। ইমদাদ বাবু করজোড়ে অনুরোধ করেছিলেন, “টাকাটা পেলে বড় উবগার হয় দিদি। মেয়ের বিয়ে দিতাম-”।  সেদিন কত্ত কথা হয়েছিল, “কেন বিয়ে দেবেন? পড়ান।” উনি কপাল চাপড়ে বারবার বলছিলেন, “কাকে পড়াব দিদি? সে তো কলেজে ভর্তি হয়েও গেল না। মাটাও মরে গেল-।  বাড়িতে দেখাশোনার কেউ নেই। কেউ নেই দিদি আমার। বড়ছেলেটার চোখে যে কি হয়েছে, ভালো দেখতে পায় না। কত ডাগতার দেখালাম। কলকাতাও নিয়ে গেলাম। কিচ্ছু হল না। মেয়েটারও দেখছি, চোখটা কেমন যেন করছে-।  ভয় লাগে দিদি। ” খুব বকেছিলাম সেদিন। মেয়েটার চোখ খারাপ হবার আগেই পরের ঘরে পাঠাতে চাও? যাক শত্রু পরের ঘরে? তারপর? তাদের যদি না পসন্দ হয়? মন উঠে যায়? তখন ও কি করবে সারা জীবন। তারথেকে, নিজের পায়ে দাঁড়াক। নিজের শর্তে বাঁচুক। যাই বলি,একটি কথাই বারবার ঘুরে ফিরে বলছিলেন উনি, “আমার কেউ নেই দিদি। কেউ নেই। বিবিজান নেই, আমার ঘর ফাঁকা-। ”
তারপর অবশ্য কেটে গেছে বেশ কয়েকটা দিন। গতকালও অনুমোদন দেবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। তাই কি নেতা ধরে এনেছেন? কে যে কাকে ধরেছে জানি না। ছোকরার বক্তব্য খুব পরিষ্কার, বিশেষ সম্প্রদায়ভুক্ত বেনিফিশিয়ারি বলেই গা নেই সরকারী দপ্তরের। অমুক কমিশনের গুঁতো না খেলে, হবেও না চাচার কাজটা-।
চাচার কাজ এমনিও হচ্ছে না। হবে কি করে? হোসেন বানান তিন জায়গায় লেখা তিন রকম। পর্যায়ক্রমে Hossain, Hussain এবং Hosen। এই জট কাটাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি কদিন ধরে। পর্যায়ক্রমে হেড অফিস- সফ্টওয়ার ডেভেলাপার আর আমাদের অফিস। দিন দুয়েক আগেও ডেভেলাপার টিম বলেছে, আপনি দায়িত্ব নিয়ে লিখে দিন, হোসেন এবং হুসেন একই ব্যক্তি। ইনিই মরহুম বিবিজানের খসম। লিখে দিতে সর্বদা প্রস্তুত। লিখব কিসের উপর ভিত্তি করে? অগত্যা প্রৌঢ়ের কি কি কাগজ আছে, সব দেখতে চেয়েছিলাম আমরা। ক্যাক্যা ছিছি মার্কা কাগজ নয়। মামুলী ভোটার-আধার-ব্যাঙ্কের কাগজ। কাগজ চাওয়ার পরিণামেই এই চাপানউতোর।
এসব ক্ষেত্রে যা করি, যার জন্য আমি রীতিমত সুপ্রসিদ্ধ। নেতামশাইকে সেই অভ্যর্থনাই দিলাম। আমার অফিসে এসে হিঁদু-মোছলমান করা? আজ সকালেই এই কারণে এক সবজান্তা জ্ঞানবৃদ্ধকে  দূর দূর করে তাড়িয়েছি। অনবধানতা বশতঃ টাকা সমেত একটি পুরোনো ব্যাগ সেলাই করতে পাঠিয়েছিলাম, অফিস পাড়ার বুড়ো চর্মকারের কাছে। দিন তিনেক ব্যাগটা পড়েছিল সেকশনে। তারপর ধীমান তাকে বগলদাবা করে নিয়ে গিয়ে দিয়ে এসেছে চাচার কাছে। পরের দিন আনতে গিয়ে, চাচার ধমক খেয়েছে। “ক্যা রে? তোদের ম্যাডাম কুছু দেখে না? আপিস চালায় কেমন করে? অ্যাঁ?” ব্যাগের মধ্যে ছেঁড়া খামে মোড়া এক তাড়া একশ টাকার নোট। আর দুটি সাবেকী পাঁচশ আর হাজার টাকার বাতিল নোট। প্রথম মুখদর্শনের পর পেয়েছিল তুত্তুরী। যাঁরা দিয়েছিলেন অনেকেই আজ নেই এই পৃথিবীতে। নোট বন্দীর সময় বুড়ো দাদু আর মামমাম ছোটাছুটি করে জমা করেছিল সব বাতিল নোট। পরম যত্নে তুলে রাখা, তুত্তুরীর পাওয়া টাকার মধ্যেও যে লুকিয়ে ছিল দুইটি নোট, খেয়াল করেনি কেউ। যেদিন জানা গেল, প্রবল দাম্পত্য অশান্তি হল দাদু আর মামমামের।  অতঃপর টাকার প্যাকেটটা গছানো হল মামমামের মেয়েকে। তুই যত্ন করে রাখিস।

রেখেছিল তুত্তুরীর মা। ছেঁড়া ব্যাগে। রেখে বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। ফেলে যে দেয়নি ব্যাগটাকে, এই তুত্তুরীর সৌভাগ্য। দরজার পিছনে অ-ন-এ-এ-ক দিন কালি ঝুলি মেখে ঝুলত ব্যাগটা। বাড়ির সামনেই বসে চর্মকার, তবুও সারিয়ে উঠতে পারেনি মা। শেষ পর্যন্ত ধীমান মামার ঘাড়ে চেপে চাচার কাছে যাওয়া এবং নোটগুলির পুনরাবিষ্কার। ধীমান যখন শোনাচ্ছিল চাচার গল্প, ঘরে উপস্থিত ছিলেন লোকটি। এসেছিলেন শ্রম আইন সম্পর্কে কয়েকটি প্রশ্ন করতে, টাকা পাবার উত্তেজনায় নাকি চাচার ধমকের উত্তাপে,  মিটিংএর মাঝেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে এসেছিল ধীমান।  বিনা আমন্ত্রণে নাক গলিয়ে বলে উঠেছিলেন, “লোকটা মুসলমান তো। কিন্তু কি ভালো।” সকাল থেকেই গরম ছিল তুত্তুরীর মায়ের মটকা। টুইটার জুড়ে “দেশ কে গদ্দারো কো-” দেখতে দেখতে জন্মেছিল ধিৎকার- তাহলে কি এমন কেউ নেই, যারা আমাদের মতে বিশ্বাসী? নাকি তারা টুইটারে নেই।  পলকে ফেটে পড়েছিলাম লোকটার ওপর। আমার আপিসে হিঁদু মোছলমান করতে এলে কপালে দুঃখ আছে।  একই কথা বললাম উঠতি ছাগল দাড়িকে। নেতাগিরি নিজের মহল্লায় দেখাবে। এখানে মস্তানি করতে এসো না বাছাধন।পরের মস্তানি বরদাস্ত হয় না তেমন। ফোটো।

বৃদ্ধকে বসিয়ে জানতে চাইলাম, “হ্যাঁ গো, আপনি একেক জায়গায় একেক নামের বানান লিখেছেন কেন? মুসলিম বেনিফিশিয়ারি হলে, এই সমস্যাটা কিছুটা হয়, কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে তো মাত্রাছাড়া। সবাইকে ঘোল খাইয়ে আবার ছাগল দাড়ি ধরে আনা। সসঙ্কোচে জানালেন, “আমি তো ইংরেজি জানি না দিদি। যা নামের বানান, তাই বলি, ওণারা ইংরেজিতে কি লিখে দেয়-”।  হোসেন-হুসেনের জাল কাটিয়ে বাড়ি ফিরলাম সেদিন। বারবার অনুরোধ করলাম সফ্টওয়ার টিমকে, প্লিজ করে দিন। নেতামশাই নেতা হয়ত চান- উত্তপ্ত পরিস্থিতির ফায়দা তুলতে। তবে বৃদ্ধের প্রয়োজনটা নিখাদ সত্য। এদিনও চোখ মুছতে মুছতে বললেন, “মেয়েটা কেমনি হয়ে যাচ্ছে দিদি। বিয়ে পাগল এক্কেবারে। ওর খালুর পরিচিত একটি ছেলে, সুরাতে থাকে, পাথর বসানোর কাজ শিখছে, তার সাথে বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। তাকে বিয়ে করার জন্য পাগল পুরো। আমি বড় একা দিদি। সারাদিন মাঠেঘাটে কাজ করি। বাড়িতে আমার কেউ নেই। ছেলেটা চোখে দেখে না ভালো। তাও কলকাতায় একটা কাজ পেয়েছে। মেয়েটাকে দুটো রান্না করে দিতে বলি- তাও করে না। বলে আপনার সংসার আপনি বোঝেন। আমি পারব না। ” বিয়েটাই যেন জীবনের মোক্ষ। ”
গতকাল আবার এসেছিলেন ইমদাদ চাচা। টাকা ঢুকে গেছে। সামনেই মেয়ের বিয়ের দাওয়াত। বিয়ে নাকি এর মধ্যে হয়ে গেছে। মেয়েটা ব্যাণ্ডেলে চাকরিও  পেয়েছে একটা ছোটখাট। হাজার দশ মাহিনা দেবে বলছে। বর সুরাত নিয়ে যেতে চায়। পাগলি মেয়ে এখন আর যেতে রাজি নয়। জানতে চাইলাম দেনমোহর কত? জবাব পেলাম ৪০০০/-। মাত্র চার হাজার? উনি অমায়িক হেসে বললেন, “চার হাজার টাকা, আমাদের ধর্মে অনেক দিদি। ” ধর্ম নিয়ে জ্ঞান সীমিত বটে, তবে বাজারদর নিয়ে তো নয়। চার হাজার আবার অনেক টাকা কেমনে হয় অ্যাঁ? আপনার দেনমোহর কত ছিল চাচা? চাচার দুই গালে লাগল আলতার ছোপ, “আজ থেকে সাতাশ বছর আগের কথা দিদি। হাজার টাকা দেনমোহর ছিল-”। বলতে গেলাম তবে? বলতে গেলাম অনেক কিছুই, পারলাম কই?ছলছলিয়ে উঠল প্রৌঢ়ের দুই আঁখি। ধরা গলায় প্রৌঢ় আবার বলে উঠল,“ আমার বাড়ি ফাঁকা করে চলে গেছে দিদি। বিবিজান নেই, আমারও আর কেউ নেই-”। 

অনির ডাইরি, ২৭শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০


এমন রৌদ্রকরোজ্জ্বল ঝলমলে দিন, প্রভাতী বাতাসে বাসন্তী ফুলেল সুবাসের সাথে মিঠে  হিমেল শিরশিরানি, তবু মন ঘিরেছে প্রগাঢ় বিষাদ। আর পাঁচজন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মতই, রাজধানীর জন্য ভারাক্রান্ত এ হৃদয়।  গোদের ওপর বিষফোঁড়া, তারওপর দিন কতক আগে, শখ করে সদস্য হয়েছিলাম এক গাছপালার গ্রুপের। বারন্দায় বাগিচা আমার নতুন প্রেম- বাড়িওয়ালার ক্ষুদ্র ফ্ল্যাটের পুঁচকে বারন্দায় ঠাসাঠাসি করে আসর জমিয়েছে গোলাপ-গাঁদা-পিটুনিয়া-বেলি-গন্ধরাজ। ফাঁকে ফোকরে ক্যাকটাস-ঘৃতকুমারী আর পয়সাপাতা। সাধের পাতাবাহার দুটি আপাততঃ নির্বাসিত কমন প্যাসেজে। দিন রাত প্রাণ চায়, আরো-আরো- আরো সবুজ হোক এ ধরা। এদিকে বাড়িওয়ালা ভয় দেখিয়ে রেখেছে আর একটিও যদি গাছ কিনি, উনি সটান কিনে আনবেন একটি ছাগল। সেদিন বললাম, ঘৃতকুমারী গাছটাকে একটু রোদে দিতে, জবাব পেলাম, “বারন্দা গলিয়ে নীচে ফেলে দিলে আরও ভালো রোদ পেতে পারে। দেবো কি?”
অগত্যা, দেখি, পরের সাজানো বাগানই দেখি, আর ভাবি-“তুমি অন্য কারো সঙ্গে বাঁধো ঘর। ”তো এহেন ভার্চুয়াল সবুজ স্বর্গে, দেখি কে যেন পোস্টিয়েছেন, এক খ্যাতনামা রাজনৈতিক ব্যক্তির ছবি। সাথে জ্বালাময়ী আবেগময় বক্তব্য, “হে হিন্দুদের ত্রাতা,মহাহিন্দু, আপামর বিশ্ব, বাঁশঝাড় আর জলবিছুটি নিয়ে তোমার পিছনে পড়েছে বটে, তবে নো চিন্তা। আমরা, তোমার ভক্তবৃন্দ আছি তো। থাকব তব” ইয়ে মানে, পিছনে আর কি। প্রথম চোটে বেশ বিরক্ত লেগেছিল মাইরি, রাজনৈতিক স্তাবকতার জন্য তো গুচ্ছ গুচ্ছ গ্রুপ- পেজ আছে। আছে নিজের দেওয়ালও। তাহলে এই গ্রুপে কেন বাপু?দিনান্তে বা দিনপ্রভাতে এইটুকুই তো অম্লজান পাই, এই ভার্চুয়াল জগৎ থেকে।  লিখতে গিয়ে দেখি, ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজন লিখে ফেলেছেন, একই কথা। হয়তো আরো অনেক সুচারু ভাষায়- অনেকে ঘোষণা করেছেন গ্রুপ ছাড়ারও কথা। হয়েছে হাল্কা বাদানুবাদ- পরিণামে যে কদর্য ভাষায় আক্রান্ত হয়েছেন তাঁরা, তার কিছুটা প্রত্যক্ষ ভাবে গায়ে লাগে বৈকি। এত রোষ,দ্বেষ, অবিশ্বাস, ঘৃণা, প্রতিহিংসা  এসব কি গৃহযুদ্ধের অশনিসঙ্কেত?
অশক্ত অসুস্থ মন চায় বসে থাকি ঘরের কোণায়, আঁকড়ে থাকি আপনজনদের। বন্ধ রাখি, জানলা-দরজা, চোখ আর কান। বন্ধ রাখি  বেতার-দূরদর্শন আর মুঠো ফোন। কিন্তু পেট শুনলে তো? তার যে বড় ক্ষুধা। পেটের ধান্ধায় বেরোতেই হয় রাস্তায়। পথে ঠকঠক করে ঢোকে সুকন্যার মেসেজ-  সপুত্র ফিরে যাচ্ছে কর্মস্থলে। হাওড়া স্টেশনে হচ্ছে ঘোষণা, “কিপ আ ওয়াচ অন ইয়োর লাগেজ-”। শোনা মাত্রই উটো বাবু, যাঁর ভালো নাম অর্ক, বলছে, “মা, মা,শিগ্গির। তোমার ঘড়িটা খুলে ব্যাগের ওপর রাখো। ” দিনের প্রথম হাসিতে, হাল্কা করে, হাল্কা হয় মনখারাপের বাদল।
জুতো পরছি, ছুট্টে এসে জড়িয়ে ধরল তুত্তুরী। আসন্ন বার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে গতরাত থেকে প্রবল নিম্নচাপের আবহ বাড়িতে। একজন পরীক্ষায় রসগোল্লা-পান্তুয়া পাবেই, আরেকজন পেতে দেবে না। এই নিয়েই কলহ অশান্তি আর কি। সকাল থেকেও স্বল্পই ছিল মা-মেয়ের বার্তালাপ। মা বেরিয়ে যাওয়ার আনন্দ, তাই বোধহয় আজ তুরীয়। হাসি হাসি মুখে গল্প শুরু, “জানো মা, কাল একটা কাণ্ড ঘটেছে। আমাদের যে রুমে ক্লাশ হয়, সকালে ঐ ঘরে নার্সারি বসে। ওদের একটা বিচ্ছু ছেলেকে কাল ওদের মিস বাড়ি যেতে দেয়নি। আমরা ক্লাশে গিয়ে দেখি,একটা কুতুপুতু বাচ্ছা ছেলে রঙীন জামা পরে বসে বসে ঢুলছে। ওর কাল জন্মদিনও ছিল কি না। মৌমিতা ম্যাম যেই ঢুকেছেন, কি ভয় যে পেল ছেলেটা। মনে হল মাটিতে মিশে যাবে। ম্যাম বললেন, ‘একটা ইকোয়শন যদি করতে পার, আই’ল লেট উ লিভ। ’ ঋতমের ওপর ভার পড়ল ইকোয়শন দেবার। ঋতম লিখল ৭০†৪০=? ম্যাম বললেন, ‘লুক এট হিম। হি ইজ আ বেইবি। গিভ হিম সামথিং সিম্পল।’ আমায় ডাকলেন, মানে আমি হাত তুলেছিলাম তাই-। আমি দিলাম, ৭†৭=? ও তো তাও পারছিল না। বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঢুলছিল। তারপর গেল চকটা খেতে। আমি তড়িঘড়ি আঙুল নেড়ে দেখালাম ১০ আর ৪। ও কি করল জানো? ও খানিক মাথা চুলকে, বোর্ডে কয়েকটা আঙুলের ছবি এঁকে দিল-”। আর ম্যাম কি করল জানো? ম্যাম বলল, “ইয়েস। ইয়েস। রাইট। রাইট।  গো হোম চাইল্ড-”।  প্রবল হাসছিল তুত্তুরী। গতরাতের বিরক্তি আর আজ সকালের বিষাদ ভুলে হাসছিলাম আমিও। নাঃ রক্তবীজের উত্তরপুরুষরা যেমন আছে, তেমনি উটো আর তুত্তুরীও তো আছে। আছে তাদের সাঙ্গোপাঙ্গোরা। এরাই তো আমার সবুজ। এত সোজা বোধহয় হবে না খেলা এবং জেতা। চলো দেখাই যাক না-
পুনশ্চঃ ভেবেছিলাম একটা স্ক্রিনশট দেবো। বেলা গড়ানোর সাথে সাথে মনে হল, একজন অবয়বহীন ফেক অ্যাকাউন্টওয়ালীর কলুষিত কথাবার্তা, অনির দেওয়ালে থাকার যোগ্যতা নেই। কাজেই থাক।