Wednesday 1 February 2017

অনির পুরুলিয়া ডাইরি


অনির পুরুলিয়া ডাইরি ৩১শে জানুয়ারি ২০১৭

চলেছি পুরুলিয়া। বিকাল ৪টে ৫০ এর পুরুলিয়া এক্সপ্রেস যখন হাওড়া ছাড়ার হুইসেল দিচ্ছে শৌভিক স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কিছু খাবি? কিনে আনব?চিপস্?” শৌভিক চিপস্ কিনে দিতে চাইছে? প্রথমে বিশ্বাস হল না। আমার স্বাস্থ্য সচেতন বরের কাছে চিপস্ চপ আর বিষে খুব বেশি তফাৎ নেই। বিশেষতঃ খাদক যেখানে আমি।

প্রবল ভাবে মাথা নেড়ে না বললাম। হকার তো উঠবেই। আর আইআরসিটিসি তো আছেই।  কত রকম চপ, মশলা মুড়ি , সিদ্ধ ডিম, বাদাম চিঁড়ে ডালমুট উঠবে। খেতে খেতে যাব। সাথে চা কফি তো থাকবেই। মদন কটকটিও নির্ঘাত উঠবে। খড়্গপুরে থাকাকালীন কম খেয়েছি?

হাওড়া ছাড়ার একটু পরই বাদাম ওলা উঠল। শৌভিক আবার অনুরোধ করল,“খাবি?” দশ টাকার এক প্যাকেট বাদাম ভাগ করে খাওয়া হল তিনজনে। শৌভিক এত খাবার জন্য অধীর হচ্ছে কেন বুঝতে পারলাম না। ওটা তো সাধারণত আমার দপ্তর। এখনও রাত বাকি পথ বাকি, কত কিছু খাওয়া বাকি। খড়্গপুর তো আসুক।

সাড়ে ছটায় খড়্গপুর এল এবং চলেও গেল। সেই কখন খাওয়া চারটি বাদাম কোথায় হারিয়ে গেছে, আমরা দুই ক্ষুধার্ত মা মেয়ে লোভাতুর দৃষ্টিতে একবার এই দিকের দরজার দিকে তাকাচ্ছি একবার ঐ দিক। কেউ ওঠে না কেন? আই আর সি টিসি ওলারা কি মরে গেল নাকি? ট্রেন গিরিময়দান হয়ে মেদিনীপুর, শালবনী, চন্দ্রকণা রোড, গড়বেতা হয়ে বিষ্ণুপুর ঢুকতে চলল কেউ ওঠে না। মাঝে একজন হকার এল চাল ভাজা নিয়ে, তার হাতে বোধহয় সাকুল্যে চারটি প্যাকেট রয়েছে। তুত্তুরী ক্রমশঃ ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়ছে, বললাম ব্যাগে বিস্কুট আছে, আপেল আছে খেতে। তাও খেল না।  চালভাজা ওলাকে দেখে ভাবছে আরো কেউ উঠবে হয়তো। উঠল বটে অনেক পরে তবে উলের মোজাওলা। কি ভাগ্যি শৌভিক জলটা হাওড়া থেকেই তুলে নিয়েছিল, না হলে হয়তো নির্জলা থাকতে হত।
প্রায় বাঁকুড়া ঢোকার মুখে যখন কাঁদো কাঁদো মুখে বিস্কুট খেতে বাধ্য হচ্ছি, একজন হকারের প্রবেশ হল। কি যে বিক্রি করছে বোঝা গেল না, তবে গোটা সি ওয়ান বাতানুকূল কামরার সব যাত্রী প্রায় তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমরাও কিনলাম। চিঁড়ে পোলাও । ছোট্ট চকমকে প্যাকেট দশটি টাকা। খুলে মুখে দিয়ে দেখি, প্লেন ভাজা চিঁড়ে। সাথে গুটি কয় বাদাম। অল্প ঝুড়ি। আর শুকনো বোঁদে। বোঁদের জন্য কি না জানি না কি প্রচণ্ড মিষ্টি। চিঁড়ে পোলাও নয় এর নাম হওয়া উচিত চিঁড়ের হালুয়া। তুত্তুরী এবং তার বাবা যদিও তোফা তোফা করে গেল। একমুখ চিঁড়ে নিয়ে আধো আধো স্বরে আমার কন্যা বলল, “ কি ভালো খেতে মা। ইয়াম্ ইয়াম্ য়াম্ য়াম”

আদ্রা স্টেশনে পৌছবার কথা ছিল রাত নটা কুড়ি, ঘড়ি ধরে সঠিক সময়ে নামিয়ে দিল পুরুলিয়া এক্সপ্রেস। নামার সময় দেখি বাকি ট্রেন থেকে বাতানুকূল কামরায় ঢোকার ভেস্টিবিউলটা বন্ধ।  ওঃ হরি। তাই কোন হকার উঠতে পারেনি। 
গাড়ি তৈরি ছিল। সবই দেবময় দা থুড়ি এসডিও রঘুনাথপুরের আনুকূল্য ।  গাঢ় অন্ধকারের ভিতর দিয়ে গাড়ি ছুটল গড়পঞ্চকোটের উদ্দেশ্যে। দূরত্ব ২৪কিলোমিটার কিন্তু ড্রাইভার সাহেব জানালেন আধ ঘন্টার  বেশি সময় লাগার কথা নয়। কোথায় থাকব, তাও দেবময় দাই ঠিক করে দিয়েছেন। শৌভিকের বক্তব্যানুসারে দেবময় দা নাকি যে রিসর্টটি আমাদের জন্য বেছে দিয়েছেন, সেটি এই মহল্লার আপাততঃ সবথেকে সুন্দর রিসর্ট। একদম যাকে বলে পাহাড়ের কোলে। ঘুটঘুটে অন্ধকার জনমানবশূন্য পথে হুহু করে দৌড়চ্ছে সুইফট্ আর এদিকে আমার বর আর কন্যা  ফিসফিস  করে আলোচনা করছে পথে হঠাৎ  ডাকাত পড়লে কি হবে? এক মুখ ঝামটায় দুজনকে থামালাম, যতঃ অশুভ কথাবার্তা। রীতিমত ভয় করছে আমার।

অনির পুরুলিয়ার ডাইরি (পর্ব ২) ১লা ফেব্রুয়ারি ২০১৭

নিকষ  অন্ধকারে হুহু করে দৌড়চ্ছে সুইফট, হঠাৎ মনে হল দিগবলয় বরাবর  আবছা পাহাড়ের রেখা দেখা গেল। ঠিক ঠাহর  করতে পারলাম না, শুধু মনে হল এক বিশাল সরীসৃপ ক্রমশঃ আমাদের পেঁচিয়ে ধরছে। এক অদ্ভূত অবর্ণনীয়  শিহরণ খেলে গেল মুহূর্তের জন্য। গাড়ি এসে দাঁড়াল এক বিশাল লোহার গেটের সামনে। হর্ণের আওয়াজ পাওয়া মাত্রই দু তিন জন লোক দৌড়ে এল। এক প্রৌঢ় গায়ে শাল মুড়ি দিয়ে হাতে এক বিশাল সার্চ লাইট নিয়ে এসে চট করে দরজা খুলে দিলেন। ড্রাইভার মধু বাবু, যিনি আবার গাড়ির মালিকও বটে, দৌড়ে আসা একজনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, “স্যার উনি দেবাশীষ দা। ” দেবাশীষ বাবুকেই দেবময় দা আমাদের কথা বলে রেখেছিলেন। ট্রেন থেকে নামার আগেই উনি ফোন ও করেছিলেন। আমাদের খাতির করে নিয়ে গেলেন ভিতরে।

গাড়ি থেকে নেমে দেখি, বিশাল এলাকা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। গেটের ঠিক পাশেই এক বিশাল ওয়াচ টাওয়ার। বিরাট সুদৃশ্য লন, মাঝে আঁকাবাঁকা কংক্রীটের পথ। গেটের অপর প্রান্তে অর্ধচন্দ্রাকারে তিনটি ছোট ছোট কটেজ। মাঝে একটি দোতলা বাড়ি। প্রতিটি কটেজের রঙ হলুদ, গায়ে না না ছবি আঁকা। কটেজ গুলিতে তিনটি করে ঘর। আমাদের কটেজে তিনটি ঘর, নাম হল ভাদু, টুসু আর ঝুমুর। টুসুটা আমাদের জন্য বরাদ্দ। ঘরে ঢুকে মন ভরে গেল। বেশ বড় ঘর। মেঝেতে চকচকে টাইলস্ পাতা। কিং সাইজ খাটে পরিপাটী করে পেতে রাখা বিছানা দেখেই রাজ্যের ক্লান্তি ভর করল। সোফা, টিপয়‘ বড় টিভি, ওয়ার্ড রোব, দুদিকে বেড সাইড টেবল, কনসিল্ড লাইট ইত্যাদি ইত্যাদি সহ থ্রি বা ফোর স্টার হোটেলের মত ব্যবস্থা । সবথেকে ভালো লাগল ওঁদের আন্তরিকতা । দেবাশীষ বাবু বললেন,“স্যার অনেক রাত হয়ে গেছে, আজ আর আপনাকে সই সাবুদ করতে হবে না। আগে ডিনার করে রেস্ট নিন। ওসব কাল হবে।” আর ডিনার? ডিনারে ছিল গরম হাতে গড়া রুটি আর দিশি চিকেন কারি। সে যে কি অনবদ্য খেতে কি বলব। একটু ঝাল যদিও।আমরা ছাড়া রিসর্টে আপাতত আর অন্য কোন অথিতি নেই।

পরদিন ভোর বেলা ঘুম ভেঙে গেল। জানলার কাঁচ সরিয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল, গাঢ় কুয়াশার চাদর ভেদ করেও চোখে পড়ে ঘণ সবুজ গড়পঞ্চকোট পাহাড়। একদম রিসর্টের গা ঘেষেই উঠে গেছে। চটজলদি স্নান সেরে লুচি আর ফুলকপি আলু মটরশুটির ঝালঝাল তরকারি খেয়ে দৌড়লাম ওয়াচটাওয়ারের উদ্দেশ্যে। ইতিমধ্যে গাড়ি এসে গেছে। আজ জাইলো, ড্রাইভার ও নতুন। একটি অল্প বয়সী ছেলে নাম আমানুল।
কোথাও যাবার আগে শৌভিক সেই জায়গাটা সম্বন্ধে প্রচুর পড়াশোনা করে।  এ ব্যাপারে ওর আদর্শ হল ফেলুদা। আজ্ঞে হ্যাঁ শ্রীমান প্রদোষ চন্দ্র মিত্র। কোথাও বেড়াতে গিয়ে কবে কি কি দেখব এটা আমার বর আগে থেকেই ছকে রাখে। সেই মত আজ আমরা দেখব বড়ন্তী লেক, কাশিপুর রাজবাড়ি আর জয়চণ্ডী পাহাড়। সেই মোতাবেক আমানুল গাড়ি ঘোরালো বড়ন্তী লেকের দিকে। ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে দশটা ছুইছুই করছে, চারপাশ তখনও আবৃত হাল্কা-গাঢ় কুয়াশার চাদরে।
অনির পুরুলিয়া ডাইরি (পর্ব ৩) ১লা ফেব্রুয়ারি ২০১৭
বড়ন্তী পৌছে প্রথম চোটে বেশ হতাশ হলাম। একটা মাঝারি মাপের টিলা,  তার সামনে একটি বিরাট টলটলে লেক। আমার সহপাঠী দেবু অর্থাৎ শ্রীমতী দেবযানী খানের মুখে প্রায় শুনি পুরুলিয়ার ভয়াবহ জলভাবের গল্প। দেবু স্বাস্থ্য দপ্তরে কর্মরতা, আপাততঃ পুরুলিয়াতেই পোস্টেড। প্রতিবছর গ্রীষ্মে দেবুদের কর্ম ব্যস্ততা বহুগুণ বেড়ে যায়, কারণ তীব্র জলাভাবে গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ যে ডোবার জলে শৌচকর্ম করে, সেই জলই পান করতে বাধ্য হয়। পুরুলিয়ায় এসে দেখলাম, সত্যই ইতিমধ্যেই পুকুর-ডোবার জল প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। যে টুকু আছে তাও ঘোলা, সেখানে এত সুন্দর টলটলে লেক দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। কিন্তু বড়ন্তীর যে প্রশংসা শুনেছি, সে তুলনায় কিছুই অনুভব করলাম না। বড় লেক কিন্তু বোটিং এর কোন ব্যবস্থা নেই। আমরা টিলা যার পোশাকী নাম মুরারড়ি হিলের দিকে নামতে যাচ্ছিলাম, আমানুলই নিষেধ করল, “স্যার ছবি তুলবেন তো? ওদিকে যাই-”।  আড়াআড়িভাবে লেককে অতিক্রম করতে গিয়ে জিভ বেরিয়ে গেল। কি জঘন্য মাটির রাস্তা খানাখন্দে ভর্তি। একদিকে লেক আর একদিকে ঢালু খাত। আমানুল বলল, এই রাস্তা দিয়ে লৌহ আকরিক বহনকারী  ট্রাক যায় বলে রাস্তার এই দশা। ছোট গাড়ি হলে নির্ঘাত উল্টে যেত।  আমার বর এবং মেয়ে যথারীতি আলোচনা করতে লাগল, গাড়ি লেকে উল্টে পড়লে কি হবে, আর খাতে উল্টোলে কি হবে? শুভকথা বলতে তো শেখেইনি দুটোতে----

ওপারে গিয়ে যেখানে গাড়ি থেকে নামলাম, বেশ ভাল লাগল। লেকের ধার বরাবর লাল মাটির সরু রাস্তা, প্রচুর রঙ বেরঙের ফুল ফুটে আছে। জলে উল্টো দিকের মুরারডি হিলের হাল্কা প্রতিচ্ছবি পড়ছে। আমানুল হতাশ হয়ে বলল, “স্যার এই কুয়াশাটা যদি না থাকত, তাহলে পাহাড়ের প্রতিটা গাছ- পাথরের ছায়া দেখতে পেতেন। ” সত্যি তো কুয়াশার জন্যই অস্পষ্ট লাগছে, ভাল করে লক্ষ্য করে দেখলাম শুধু পাহাঢ় নয়, ওপাড়ের সমস্ত গাছপালারও নিখুঁত প্রতিবিম্ব পড়ছে জলে। লাল মেঠো পথ ধরে হাঁটতে লাগলাম, বেশ লাগছিল। আমরা ছাড়া দ্বিতীয় কোন পর্যটক নেই। স্থানীয় গ্রামের সদ্যস্নাত মেয়েরা কাঁখে জল নিয়ে যাচ্ছে পাশ দিয়ে, মাথার ওপর মিষ্টি সোনা রোদ, ঈষৎ  উষ্ণ বাতাসে দ্রুত অপসৃত হচ্ছে কুয়াশা, সব মিলিয়ে স্বপ্নের পরিবেশ। শৌভিক পটাপট ছবি তুলতে লাগল। একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, আমানুল যেখানে আমাদের গাড়ি থেকে নামিয়েছিল, ওখান থেকেই সবথেকে স্পষ্ট প্রতিবিম্ব দেখা যায়। সব মিলিয়ে বড়ন্তী বড় মায়াময়। পরে এসডিও দেবময় দার মুখে শুনলাম শীঘ্রই এখানে বোটিং ও চালু হতে চলেছে।  
বেশ খানিকক্ষণ বড়ন্তীর রূপসুধা পান করে, ওপাশে মুরারড়ি হিলে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমরা রওণা দিলাম কাশিপুর রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে। পথে দেখলাম অনেক গরু, পিঠে লাল রঙে তিনটি করে টিপ আর লম্বা লাইন কাটা। গরুগুলোকে এমন সঙ সাজানো হয়েছে কেনর জবাবে আমানুল বলল, ঐ গুলিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কাশিপুর রাজবাড়ি সংলগ্ন  হাটে। প্রতি বৃহস্পতিবার ওখানে গরুর হাট বসে, যাতে এই গরুগুলি সাধারণ গরুর সাথে না মিশে যায় , তাই লাল রঙে মার্ক করা হয়েছে। অচীরেই কাশিপুর রাজবাড়ির কাছাকাছি এসে পড়লাম। বিশাল এলাকা জুড়ে প্রকাণ্ড প্রাচীর রাজবাটীকে ঘিরে রেখেছে, অনেকটা গুণ্ডিচা বাড়ির  (জগন্নাথদেবের মাসির বাড়ি) প্রাকারের মত দেখতে। দেখলেই সম্ভ্রম জাগে। গাড়ি এসে দাঁড়ালো বিশাল গেটের সামনে। গেটে ইয়া বড় তালা। গেটের দুপাশে দারোয়ানদের ঘর। ঘরের সামনে বারান্দা। কিন্তু সব খালি। দরজার দুপাশে উঁচু পাঁচিলের ওপর সশস্ত্র প্রহরী বসার খোপ কাটা গোটা প্রাকার বরাবর। কিন্তু আজ তা অরক্ষিতই পড়ে আছে। আমানুল হর্ণ বাজালো, ডাকাডাকি করল কেউ বেড়িয়ে এল না। আমাদের কোন হেলদোল নেই, শৌভিক বাইরে থেকেই সিংহদুয়ারের ছবি তুলতে লাগল। আমরা ঐ ভাব গম্ভীর পরিবেশে অপার মুগ্ধতা নিয়ে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। আমানুল অধৈর্য  হয়ে বলল, গাড়ির মালিক মধু বাবু এসডিও সাহেব অর্থাৎ দেবময়দাকে ফোনে ধরার চেষ্টা করছে, এখানে ঢুকতে গেলে অনুমতি লাগে। কারণ এটা ব্যক্তিগত সম্পত্তি। দুর্ভাগ্যবশত এসডিও সাহেব ফোন তুলছেন না। আমি শৌভিককে বললাম,“ তুই একবার করবি কি? হয়তো তোর ফোন-”।  শৌভিক হাত নেড়ে উড়িয়ে দিল। আসলে সে দিন সরস্বতী পুজো, একদিনের জন্য দেবময় দা বাড়ি গেছেন, ঐ দিনই বইমেলায় বৌদির বই প্রকাশিত হবে।  এমতবস্থায় লোকটিকে আর ব্যতিব্যস্ত  করার কোন মানে হয় না। কাশিপুর রাজবাড়ি না দেখা হলেই বা কি????

অনির পুরুলিয়ার ডাইরি  (পর্ব ৪) ১লা ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেছে আমরা দাঁড়িয়ে আছি কাশিপুর রাজবাড়ির সামনে, আমানুল তো গেট ধরেই দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু খুলবে কে? বিশাল লোহার গেটের ভিতর দিয়ে যতদূর  চোখ যায় ফাগুন মাসের সোনা রোদে মুখভার করে দাঁড়িয়ে থাকা অতিকায় সম্ভ্রম জাগানো রাজপ্রাসাদ ছাড়া জনপ্রাণীর দেখা নেই। শৌভিক একবার সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলে দেবময় দাকে ফোন করেই বসল। কিন্তু বার চারেক রিঙ হতেই কেটে দিল। “নাঃ। এইভাবে ছুটির দিনে লোকটাকে জ্বালাতে পারব না। ” আমারও তাই মত। রাজবাড়ি না দেখা হলেই বা ক্ষতি কি? আর দেবময় দা তো কালই অর্থাৎ  ২রা ফেব্রুয়ারি ফিরেই আসছে, সেরকম হলে আমরা ৩ বা ৪ তারিখে ঘুরে নেব।   কিন্তু আমানুল কিছুতেই নড়বে না। “ না স্যার। আরটু দাঁড়ান। মধু বাবু ফোন করেছেন, বিডিও অফিস থিনি লোক আসছে। ” শৌভিক ক্ষেপে বলল, “ আমরা রাজবাড়ি দেখব বলে ছুটির দিনে বিডিও অফিসের লোকজনকে বিব্রত  করার কোন মানে হয়? চল। ” অগত্যা গাড়ি স্টার্ট দিতে বাধ্য হল আমানুল। এমনিতেও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। গেটের লাগোয়া দারোয়ান দে  থাকার ঘর থেকে একটা বিটকেল গন্ধে বমি আসছিল। যা শৌভিকের দাবি মত সুঁটকি মাছের গন্ধ। কিন্তু আমি জানি ঐটা পায়রা/ ঘুঘু এবং পায়রার বিষ্ঠার গন্ধ। আমাদের হাওড়ার বাড়িতে ঐ গন্ধ প্রায় পাওয়া যেত এককালে। এই নিয়ে তর্ক করছিলাম আমরা। আমানুল গাড়ি চালাতে চালাতে হেসে বলল,“ না স্যার। ঐ গুলান হল চামচিকা। নীচের ঘর ভরতি আছে। চিক্ চিক্ আওয়াজ শুনলেননি?”
একটু পরেই দেবময় দার ফোন, “ আরেঃ আমার একদম খেয়াল ছিল না, তোমরা আজই ওখানে যাবে। সকালে ওঁরা আমায় ফোনও করেছিলেন আমার কোন গেস্ট আছে কিনা জানতে। আমি ভুলে বলেছি না।” শৌভিক আশ্বস্ত করল, আমরা পরে যাব খন। শেষ পর্যন্ত তাই ঠিক হল ৩ তারিখ  সকাল১১ টায় যাব রাজবাড়ি দেখতে।
পরের গন্তব্য হল জয়চণ্ডী পাহাড়। রঘুনাথপুর লাগোয়া তিনটি ছোট ছোট পাহাড়। যার একটির মাথায় মা চণ্ডীর মন্দির আছে। কিন্তু মন্দিরে উঠতে হলে প্রায় ৫০০ সিঁড়ি ভাঙতে হয়। সিঁড়ি মানে সুন্দর বাঁধানো গোলাপী সবুজ সিঁড়ি। শৌভিক টরটরিয়ে উঠে গেল।  আমি আর তুত্তুরী টুকটুক করে। মাঝে মাঝেই বিশ্রাম নেবার জন্য সুন্দর বাঁধানো বেঞ্চ রয়েছে। আর সব জায়গায় লেখা আছে,“ বেঞ্চে বসে আড্ডা মারিবেন না। ” এবং সবথেকে ভয়াবহ হল,“জঙ্গলে আগুন লাগাবেন না। ” বাপরে। উঠতে উঠতে দেখলাম বেশ কয়েকটি বেঞ্চে দেবদাস এবং পারোর দল ঘনিষ্ঠ ভাবে প্রেমালাপে মত্ত। আহা দিনটি কি ভাবুন। সরস্বতী পুজো বলে কথা। আতঙ্কিত হলাম দ্বিতীয় সাবধান বাণীটিও না প্রত্যক্ষ করতে হয়। একটু উঠতেই দেখি কয়েকটি জায়গা পুড়ে কালো হয়ে আছে। হরি হরি।

কষ্ট করে উঠলাম যেমন, জয়চণ্ডী পাহাড়ের ওপর থেকে নীচে তাকিয়ে মন ভরে গেল। দূর দূর পর্যন্ত দেখা যায়। সে দৃশ্য বড়ই মনোরম।

নীচে নামার পর আমানুল আমাদের জয়চণ্ডী পাহাড়ের পিছন দিকে নিয়ে গেল। বিশাল ফাঁকা প্রান্তর। পিকনিক স্পট বোঝাই যায়। প্রচুর শোলার থালা এবং আনুষঙ্গিক আবর্জনা যত্রতত্র  পড়ে আছে। ঐ টুকু দৃশ্য দুষণ বাদ দিলে এক কথায় অপূর্ব। মাটি থেকেই পরপর তিনখানি খাড়া পাহাড় উঠে গেছে। কখনও হয়তো ধস নেমেছিল গোটা কয়েক বিশাল শিলা খণ্ড পড়ে আছে। মনোরম জনমানবশূন্য প্রকৃতি।
দিনের আলো থাকতে থাকতেই ফিরে এলাম আমাদের রিসর্টে। কফি আর কড়কড়ে গ্রিল্ড বাটার টোস্ট খেয়ে নিছক অবকাশ যাপন। তুত্তুরী ছোটা ভিম দেখতে লাগল। আমি অনির ডাইরি লিখছিলাম , শৌভিক বের হল হাঁটতে।  একটু পরে আমিও বেরিয়ে এলাম কটেজ ছেড়ে। আমরা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন আবাসিক নেই। রিসর্টের মুখ্য দুয়ারে তালা দিয়ে বৃদ্ধ দারোয়ান নিদ্রা যাচ্ছে। বিশাল কম্পাউন্ড জুড়ে গুটি কয়েক টিউব লাইট জ্বলছে। যা আঁধার কাটাতে ব্যর্থ হলেও সমগ্র পরিস্থিতিকে আরো রহস্যময় করে তুলছে। পিছনেই পঞ্চকোট পাহাড়, প্রগাঢ় অন্ধকারে নিদ্রিত সরীসৃপের মত ঝিম মেরে পড়ে আছে। নিস্তব্ধ চরাচর।  ঝিঁঝিঁর ডাকের সাথে তাল মেলাচ্ছে দূর থেকে ভেসে আসা ধামসার সুর। মাঝে মাঝে কি  একটা পাখি যেন ট্টিহিট্টিহু করে ডেকে উঠছে। শীতল বাতাস ছুটে এসে আলিঙ্গন করে গেল। সে আলিঙ্গন বড় আরামের, আবেশে চোখ বুজে আসে। শিউরে উঠে আকাশের দিকে তাকালাম ঠিক মাথার ওপরেই সপ্তর্ষিমণ্ডল জ্বলজ্বল করছে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং কালপুরুষ ।  শৌভিক এসে হাতটা ধরল- তৃপ্তির কলস যেন উছলে পড়ল।

অনির পুরুলিয়ার ডাইরি (পর্ব ৫) ২রা ফেব্রুয়ারি
আজ আমরা অযোধ্যা পাহাড় যাব। ৩১শে জানুয়ারি রাতে আমাদের গড় পঞ্চকোট পৌছবার সময়ই মধু বাবু বলছিলেন,“স্যার আজ এতদূর থেকে এলেন, কাল কাছাকাছি ঘুরে নিন। পরশু না হয় অযোধ্যা যাবেন। অযোধ্যা ঘুরতে সারাদিন লাগবে। যেতেই দুই আড়াই ঘন্টা তো লাগবে। সকাল সাতটা নাগাদ বেরোতে পারলে খুব ভালো হয়। ” সকাল সাতটায় বেরোনো মানে অন্তত ছটায় ঘুম থেকে ওঠা। আর অত সকালে তুত্তুরীকে তুলে স্নান করিয়ে রেডি করা বিশাল চাপের ব্যাপার। জয়চণ্ডী পাহাড় থেকে ফেরার পথে আমানুল অবশ্য আশ্বস্ত করল যে সাড়ে আটটায় বের হলেই চলবে। রাস্তা ভীষণ ভালো। হু হু করে গাড়ি দৌড়য়। ক্ল্যাচ নাকি ধরতেই হয় না।

সাড়ে সাতটায় সপরিবারে রেডি হয়ে প্রাতঃরাশ সেরে কটেজ দেখে বের হয়ে দেখি পুরু কুয়াশার চাদরে আচ্ছন্ন চরাচর। অদূরে ওয়াচ টাওয়ারটিকে ও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। ঘড়ির কাঁটা নিজ স্বভাবে এগিয়ে চলেছে। নটা নাগাদ মধু বাবু ফোন করে জানালেন যে এত কুয়াশা যে গাড়ি ছাড়তেই পারেনি। একটু কুয়াশা কাটলেই আমানুল আসছে। আমাদের তাতে কোন হেলদোল ছিল না অবশ্য। কুয়াশাচ্ছন্ন ওয়াচ টাওয়ারের ওপর থেকে আবছা পাঞ্চেত পাহাড় আর ঘষা কাঁচের মত ধোঁয়াটে প্রকৃতি দারুণ উপভোগ্য । অযোধ্যা পাহাড় না দেখলেই বা কি?
গাড়ি ছাড়ল সাড়ে নটায়। তখনও কুয়াশা ভালো কাটেনি। আমানুল ইশ্ ইশ্ করতে করতে গাড়ি চালাচ্ছিল। কারণ হল এত কুয়াশা থাকলে পাহাড়ের উপর থেকে নীচের কোন ভিউই পাওয়া যাবে না। বেলা বাড়ার সাথে সাথেই রোদ উঠছিল। কেটে যাচ্ছিল কুয়াশা। মাঠার ঘণ শালের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দূরে দেখা গেল বিশাল ঘুমন্ত পাহাড়। আমার ধারণা ছিল অযোধ্যা পাহাড় হয়তো পাঞ্চেত হিলস্ এর সাইজের হবে। শুনলাম এবং প্রত্যক্ষ করলাম যে অযোধ্যা পাহাড় বিশাল। ঐদিকে নাকি রাঁচি অবধি চলে গেছে।
প্রথমেই পড়ে পাখি পাহাড়। ছোট, গাছপালা বিবর্জিত পাথুরে টিলা। ঠিক উল্টানো বাটির মত। তবে শিখরটা বেশ খাড়াই। গায়ে অনেক গুলি মইয়ের মত বস্তু আটকানো। শুনলাম ওখানে রক ক্লাইম্বিং কোর্স হয়। আসে পাশে প্রচুর রঙ বেরঙের বুনো ফুল সোচ্চারে ঘোষণা করছে ঋতুরাজের আগমনের বারতা। সোনা রোদে নিখাদ অলসতায় বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম পাখি পাহাড়ের আসে পাশে। তুত্তুরী প্রচন্ড খুশি হল এক পাল ছাগল দেখে। জনৈক আদিবাসী বৃদ্ধ নিতান্ত অলস ভঙ্গীতে একপাল ছাগল নিয়ে যাচ্ছিলেন।  অলসতার ছোঁয়াচ বুঝি ছাগল গুলিকেও ছাড়েনি, কি রাজকীয় ভঙ্গীতে মাথা নাড়াতে নাড়াতে গদাই লস্করী চালে চলে গেল আমাদের সামনে দিয়ে। একটির গলায় আবার বড় স্টিলের গ্লাস বাঁধা। গ্লাসের ভিতর একটি ভাঙা সাঁড়াশির ডাঁটি ঝুলছে। প্রবল ঢং ঢং শব্দ করে আমাদের সামনে দিয়ে চলে গেল। পিছন পিছন আমার কন্যাও দৌড়ল।
অযোধ্যা পাহাড়ের মূল আকর্ষণ হল তিনটি বাঁধ। যাদের পোশাকি নাম হল -  লোয়ার, মিডল্ এবং আপার ড্যাম। লোয়ার ড্যামটি ভাল তবে আহামরি কিছু নয়। মুগ্ধ হয়ে যেতে হ্য়, মিডল ড্যামটি দেখে। ঘন সবুজ আর লাল পাহাড়ের (যদিও আদতে হয়তো টিলা) মাঝখান দিয়ে এঁকে বেঁকে বয়ে যাচ্ছে ঘন নীল জলের ধারা। মাঝে মাঝে ধাঁধা লাগে, হিমালয় বলে ভ্রম হ্য়।

আপার ড্যাম বলতে একটি বিশাল জলাশয়। জলের রঙ এখানেও গাড় নীল। চতুর্দিক শান বাঁধানো রাস্তা দিয়ে ঘেরা। এক প্রান্তে ন্যাড়া খাড়া পাহাড়, বাকিটা ঘন জঙ্গলে ঢাকা। উঁচু রেলিং দিয়ে ঘেরা জলাশয়, লেখাও আছে, জলে নামিবেন না। আমরা ছাড়া যে মুষ্টিমেয় ভ্রমণ পিপাসু সেই মুহূর্তে উপস্থিত ছিলেন, তাদের সবাই প্রায় রেলিং টপকে জলে নামছিলেন। একজন হড়কে পড়েও গেলেন। আমানুল হতাশ হয়ে বলল, “এ তো কিছুই নয় স্যার, জানুয়ারি মাসের শুরুর দিকে এখানে এত লোকের ভিড় হয়, এত লোক স্নান করে কি বলব—।” পরবর্তী গন্তব্য বামনী ফলস। আমানুল মাথা চুলকে বলল, “নামতে পারবেন কি? বিশাল খাড়াই, ধাপ কাটা আছে অবশ্য। পাথরে পা দিয়ে দিয়ে নামতে হয়।” কি আর এমন ব্যাপার? কাল জয়চণ্ডী পাহাড়ে উঠলাম, আর আজ পারব না?
বামনী ফলস সত্যিই বিশাল খাড়াই। নামার সিঁড়ি বলতে পাথরের ধাপ কাটা, কোথাও বা আড়াআড়ি গাছের শিকড়ই সিঁড়ির কাজ করে, জয়চন্ডী হিলের মত, পাশে কোথাও বসার জায়গা নেই। থাকবে কি করে? দুপাশে খাড়া পাহাড় আর জঙ্গল। মাঝে দু জায়গায় খাদের ধারে, গাছের সরু সরু ডাল একত্রে বেঁধে, তলায় দুটি বাঁশ আর ওপরে কাঠের তক্তা দিয়ে বেঞ্চের মত করা আছে। হাজার ক্লান্তি থাকলেও তার অপর বসতে আতঙ্ক হয়। নামা ওঠার রাস্তা এত সরু, যে এক সাথে দুই বা তার বেশি লোক নামতে বা উঠতে পারবে না। শৌভিক তুত্তুরীর হাত ধরে  নামতে লাগল, মুস্কিল হল আমার, নামতে গেলেই ভয় লাগে। কোথাও উঁচু কোথাও নিচু, কোথাও আবার নড়বড়ে পাথর। মাঝে মাঝেই শৌভিককে ডাকতে হচ্ছে, ‘এই, একটু হাত টা ধর-।” শেষে আমানুল বলল, “স্যার আমি বাচ্ছাকে নামাচ্ছি, আপনি ম্যাডামের সঙ্গে নামুন।” সঙ্গে মানে, পাশাপাশি নামা নয়। শুধু চোখের সামনে থাকা, যাতে প্রয়োজনে হাতটা বাড়িয়ে দিতে পারে।
(চলবে)

Wednesday 25 January 2017

তুত্তুরী উবাচ জানুয়ারী-মার্চ ২০১৭

তুত্তুরী উবাচ ২৫শে জানুয়ারী ২০১৭


-(রাত ৯টা নাগাদ বাবা বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই) বাবা বারাঙ্গনা কাদের বলে?
-(ঢোঁক গিলে) ঐ আর কি।  যারা সেজে গুজে বসে থাকে। গানবাজনা করে পয়সা উপার্জন করে আর কি।
-বারাঙ্গনারা কি খুব খারাপ মেয়ে হয়?
-না তা নয়।  তোকে কে বলল-
-মা তো। বেতাল পঞ্চবিংশতি পড়ে শোনাচ্ছিল।  তাতে একটা দুষ্টু বারাঙ্গনা ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, মা বলল ঐ যারা অনেক গুলো বিয়ে করে। বারাঙ্গনারা কি হাজার জনকে বিয়ে করতে পারে বাবা?
-না।  তা বোধহয় পারে না।
-তবে ওরা কি করে?
- ঐ তো বললাম, নাচ-গান, সাজ- গোজ এই সব।
- কিন্তু গল্পে তো একজন বারাঙ্গনা এক সাধুর তপস্যা ভঙ্গ করল।যেমন শকুন্তলার মা মেনকা করেছিল? মেনকা তো অপ্সরা ছিল বাবা।  বারাঙ্গনারা কি মর্ত্যের অপ্সরা?
-তুই বরং দাদুকেই ফোন কর---


তুত্তরী উবাচ, ২৯শে জানুয়ারী২০১৭


-মা? আমার বিয়েটা কালই দিয়ে দাও। 

-কালই? ১৮ বছরের আগে বিয়ে করলে পুলিশে ধরবে বাবু। আর তাছাড়া পাত্র ও তো খুঁজতে হবে-

-খুঁজতে হবে না। খুঁজতে হবে না। আমি তো বাবাকেই বিয়ে করব। 

-(বাবা পাশ থেকে আতঙ্কিত স্বরে) নাআআআ।  আমি আর বিয়ে করছি না। ন্যাড়া বেলতলায়--

-ওঃ। (বিমর্ষ হয়েই পরক্ষণে উৎফুল্ল হয়ে) তাহলে দাদা--

-দাদাকেও বিয়ে করা যায় না। পুলিশে ধরবে--

-পুলিশ মহাপাজি তো। 

-তুই এত বিয়ে পাগলাই বা হয়েছিস কেন?

-বিয়ে করলে কত সাজা যায় কাকিমার মত। কি সুন্দর লাল টকটকে বেনারসী। কত গয়না। কত ফুল। মুকুট। চন্দন। কোমরবন্ধনী--কি সুন্দর লাগছিল কাকিমাকে। আচ্ছা মা সালোয়ার পরে বিয়ে করা যায়?সেদিন টিভিতে দেখাল-

-হুঁ। যায়। এখন তো সই সাবুদ করলেই বিয়ে হয়ে যায়। সে বেনারসীই পর আর যাই পর। 

-তাই বলে সালোয়ার? 

- হ্যাঁ রে বাবা নাইটি পরেও বিয়ে করা যায়( বলেই প্রমাদ গুনলাম)

- নাইটি পরেও?

-হুঁ। 

-লুঙ্গি পরে?

-হ্যাঁ । চাইলেই যেতে পারে-

-মা, গামছা পরে বিয়ে করা যায়?

-(প্রবল হাসি চেপে) না বাবু। গামছা পরে রাস্তায় বেরোলে পুলিশে ধরবে কি না--


তুত্তুরী উবাচ ১৩ই মার্চ ২০১৭
-মা, কেউ লম্বা হয় কেউ বেঁটে হয় কেন?
- জানতে গেলে সাইন্স পড়তে হবে বাবু। সব প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে জিনের মধ্যে।
-জিন? ও জিনি!!
-না না আলাদিনের জিনি নয়। এ অন্য জিন। যা মানুষ বাবা-মার থেকে পায়। যেমন যদি বাবা-মা দুজনেই লম্বা হয়, সাধারণত বাচ্ছারা লম্বা হয়। আবার উল্টো হলে---
-যদি একজন লম্বা আর একজন বেঁটে হয়---
-সেটা জানতেই তো মেণ্ডেল সাহেব একটা পরীক্ষা করেছিলেন। একটা লম্বা মটর গাছের সাথে একটা বেঁটে মটর গাছের ইয়ে মানে বিয়ে দিয়ে দেখেন--
-গাছের বিয়ে কি করে হয় মা? দুটো গাছকে পাশাপাশি বসিয়ে, মঙ্গলঘট পেতে তার গায়ে স্বস্তিকা চিহ্ন এঁকে?
- (প্রবল হাসির দমক সামলে) না। না। একটা গাছের ফুলের রেণু আর একটা গাছের ফুলের ওপর ফেলে।
-বাঃ। গাছেদেরও বিয়ে হয়। (অবাক তথা উল্লসিত  স্বরে) প্রজাপতিদেরও বিয়ে হয় মা। জানো তো, দুটো প্রজাপতি পাশাপাশি বসে, এ ওর কাঁধে হাত রেখে বলে ,‘আজ থেকে তুই আমার বর, আর তুই আমার বউ। ’ তাই না মা?
- হুঁ। তা হবে এবার ঘুমোও।
-মা কাঠবিড়ালির  বিয়ে কি করে হয় শুনবে?
-না। আমি ঘুমোব।
-শামুকের বিয়ে কি করে হয়--
-জানি না। শামুকের বিয়ে হয় না। এবার মুখবন্ধ করে ঘুমোও।
-আরেঃ। কেন হবে না?বিয়ে না করলে বাচ্ছা হবে কি করে?তাহলে নতুন শামুক হবে কি করে?

তুত্তুরী উবাচ ১৪ই মার্চ ২০১৭
-উফ্ প্লাস্টিকের তরোয়াল দিয়ে বার বার দেওয়ালে খোঁচা মারছো কেন? ভেঙে যাবে যে!!
-(গম্ভীর ভাবে) আঃ। আমি ওয়ার্ল্ড অব ইমাজিনেশন এ আছি।
-হুঁ। সে তো বুঝলাম। তা কার মুণ্ডুচ্ছেদন করছ?
-ছোট ছোট ভাইবোন গুলোর।
-কি সর্বনাশ। খামোকা ভাইবোনেদের মুণ্ডু কাটছ কেন? তুমি কি ঔরঙ্গজেব?
-ঔ-ঔ-জে-ব? সে কে?
-কার মুণ্ডু কাটছ শুনি? কোন ভাইবোন?
-আঃ। বললাম না আমি ওয়ার্ল্ড অব ইমাজিনেশন এ আছি।
-তা তারা তোমার কি বিগড়ালো?
-ওরা জন্মালে তুমি আমাকে আর ভালবাসবে না।
-যাঃ বাবা। একি কথা?ঠাম্মা কি বাবাকে ভালবাসে বলে কাকাইকে ভালবাসে না? আমি সবসময় তোমাকেই ভালবাসব। শুধু তোমাকেই। বুঝলে?
-বুঝলাম। (ক্ষণিক নীরবতার পর) কিন্তু বিশ্বাস করলাম না।

তুত্তুরী উবাচ ২৯শে মার্চ ২০১৭
- না। না। না। তুমি বাজে। বাজে মাসি।
(প্রবল কান্না এবং চিৎকার  শুনে ছুটে গেলাম)
-কি হয়েছে? কাঁদছ কেন? আর এরকম ষাঁড়়ের  মত চেঁচাচ্ছোই বা কেন?
-তুমি এখুনি মাসিকে বাড়ি পাঠিয়ে দাও। বাজে মাসি। অন্য মাসি রাখো।
-এ আবার কি কথা? মাসি ছোট থেকে কোলে পিঠে করে এত বড় করল---
-(প্রবল অশ্রুপাত সহ) বাজে মাসি। তুমি এই ধনুকটা নাও। এটা দিয়ে মাসিকে দুঘা দাও।
-প্লাস্টিকের ধনুক দিয়ে মারলে মাসির কি হবে জানি না, ধনুকটা ভেঙে যাবে, এটুকু বলতে পারি।
-(পাশ থেকে মাসি মিনমিন করে বলল) এর মধ্যে অবশ্য সোনামা ই আমাকে ধনুক দিয়ে দুঘা দিয়েছে ।
-যাঃ বাবা। দাদু তোকে কেন তীর ধনুক কিনে দিল বলতো? বারণ করলাম, কথা শুনল না। লোকে তীর ছুড়ে শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করে। বাপের জন্মে শুনিনি কেউ ধনুক দিয়ে মারামারি করে--(মাসি এবং আমি প্রবল হাসিতে ফেটে পড়লাম।
-(আমাদের হাসি দেখে আরো ক্রুদ্ধ হয়ে,আরো প্রবল অশ্রুপাত সহ)বাজে বাজে। তোমরা দুজনেই বাজে। হ্যাঁ ধনুক দিয়েই মারো মাসিকে।
-বাজে তো ঠিকই। মা মাসিরা বাজেই হয়। কিন্তু তুই বল, রাম রাবণের যুদ্ধ হচ্ছে, দুজনেই তীর দিয়ে একে অপরকে বিদ্ধ করার চেষ্টা করবে   তো নাকি? না তোর মত, তুণীর  ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, ধনুক নিয়ে হাতাহাতি করবে---(কান্নার মাঝেও খিলখিল হাসি ছিটকে বেরোল) এবার বলো তো মাসির অন্যায়টা কি?
-মাসি বাজে।
-(মাসি হাসি চেপে গম্ভীর ভাবে বলল) মাসির দোষ হল, মাসি ফোন ঘাঁটতে দেয়নি। ফোনটা চাইছিল ফোন করবে বলে, কাকে না কাকে ফোন করে বসে?আমি  আলমারির মাথায় ফোন তুলে রেখেছি তাই।
-ওঃ। এই ব্যাপার? কাকে ফোন করবে বলো? আমি ধরে দিচ্ছি-
-মামমামকে(দিদা)। মামমাম সকাল থেকে ফোন করেনি।আমার বুঝি  মন খারাপ লাগে না। তাই ফোনটা চাইলাম মাসি দিল না। মাসিকে ধনুক দিয়েই মার---
#AninditasBlog

Monday 23 January 2017

অনির ডাইরি ২৩শে জানুয়ারী ২০১৭

শৌভিকের সাথে আলাপ হবার পর সেটাই প্রথম জন্মদিন। ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাত্রের দিকে পা বাড়াবার সাথে সাথেই দ্রুত হচ্ছিল হৃদস্পন্দন,সত্যি যদি আমি তার কাছে বিশেষ হই, তাহলে নিশ্চয় মধ্যরাত্রে একবার অন্তত আমার দুয়ার খটখটাবে। তখন আমি এএলসি খড়্গপুর। ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করার তীব্র ক্লান্তিতে ভেঙে পড়া শরীরকে কশাঘাত করে জাগিয়ে রাখল লোভী হৃদয়। হা হতোষ্মী। ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাত্রি টপকে গেল, প্রতিবছর নিয়ম করে  পাওয়া মেসেজ গুলো এসে পড়ল একে একে। থিতিয়ে এল সমস্ত উত্তেজনা। ধুৎ। সবই আমার মনের কষ্টকল্পনা।কয়েকদিন আগেই মানি স্কোয়ারে ঘুরতে ঘুরতে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শৌভিক বলেছিল,“ধুর্। আমার মা ঘটি। বউও যদি ঘটি হয়, আমিও তাহলে ঘটি হয়ে যাব।” আজ যদিও শৌভিক কিছুতেই স্বীকার  করে না এই কথা বলেছিল, যাই হোক আমি  ওমনি নির্বোধের  মত ভেবে বসলাম, কথাটা আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছে। কেন রে বাপু? পৃথিবীতে কি আর ঘটি মেয়ে নেই?সত্যিই যদি তাই হত, একটি বার কি উইশ করত না?

মনের দুঃখ মনে চেপে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। ভোর ছটার সময় ঢ্যাং ঢ্যাং করে শৌভিকের মেসেজ। পড়ে গা জ্বলে গেল, সাতসকালে আমার ঘুম ভাঙিয়ে শুভ জন্মদিন জানানো হচ্ছে? তাও আদর করে, সে আদরের কি ছিরি?প্রথম সম্বোধনটা আমার চেহারা এবং দ্বিতীয়টা আমার বয়স তুলে। হাড় জ্বালানো মেসেজ যত। শুধু লিখলাম “এই মেসেজটা কি মধ্যরাত্রে পাঠানো যেত না? ”

সঙ্গে সঙ্গে শৌভিকের ফোন,“ আরে তুমি ভোর ছটায় জন্মেছ বলে আমি অ্যালার্ম দিয়ে ঘুম থেকে উঠে ছটায় মেসেজ পাঠালাম। খামোকা মাঝরাতে পাঠাব কেন?” ভোর বেলা মৃদু স্বরে মান অভিমানের পালা চলল,পরিশেষে শৌভিক বলল,“ আজ বেড়োতে পারবে?তাহলে ফ্লুরিজে ট্রীট দেব। ” নাঃ। সেদিন ফ্লুরিজে যায়নি।আমিই যেতে চায়নি। সন্ধ্যাটা কেটেছিল মোহরকুঞ্জে একরাশ রঙিন ফোয়ারার মাঝে,একে অপরের সান্নিধ্যে, বাতাসে মৃদু কুয়াশা আর মোহরকুঞ্জ ভেসে যাচ্ছিল অসিতবরণের (জানি না অন্যকারো গলায় কি না। মন বলে অসিতবরণই) গলায়,“ আমরা দুজনা স্বর্গখেলনা গড়িব না ধরণীতে-”র মুর্চ্ছনায়।

মোহরকুঞ্জ ছেড়ে ধর্মতলা অবধি একসাথে হাঁটতে হাঁটতে এলাম, বাসে ওঠার আগে বললাম, “ফ্লুরিজটা কিন্তু বাকি রয়ে গেল। অন্যদিন হবে। ”সেদিন সহাস্য সম্মতি জানালেও পরে শৌভিক নিয়েই যায়নি ফ্লুরিজে। এত বছরে যতবার গেছি বন্ধু বা সহকর্মীদের সাথেই গেছি।
এতবছর পর আবার আমার বর আজ প্রস্তাব দিল, মার্কোপোলো তে নিয়ে যাবার। কিন্তু আবার পিছিয়ে গেলাম আমি। হোটেল, মল, রেস্টুরেন্ট, খাওয়াদাওয়া, ছবি, ফেসবুক তো সারাবছর চলে। আজ থাক। আজ শুধু প্রিয়জনেদের সান্নিধ্য আর উষ্ণতা টুকু পেতে চাই অাশ মিটিয়ে।  মায়ের হাতের রান্না, বাবার পাশে বসে গায়ে নাক ঠেকিয়ে গায়ের গন্ধ শোঁকা,বৃদ্ধা বেতোরুগী জেঠাইমার দেওয়াল ধরে রোদ পোয়াতে পোয়াতে গল্প করা, অর্ধান্ধ থপথপে  পিসির শুধু আমার জন্য দশবার দৌড়ে দোকান যাওয়া- এগুলো আর কতদিন? যে হারে গুরুজনদের ছাওয়া সরে যাচ্ছে মাথার ওপর থেকে-- আজকে শুধু আজকের দিনে আঁকড়ে ধরতে চাই আমার প্রতিটা প্রিয়জনকে, আর বলতে চাই-- যাই হোক না কেন আমায় ছেড়ে যেও না। সময় যতজোরেই দৌড়ক না কেন, আমি বদলাইনি।  তোমরাও বদলে যেও না।

#Aninditasblog
https://amianindita.blogspot.in

Saturday 21 January 2017

সুজয়---

-হ্যালো!
- নমস্কার ম্যাডাম। আমি সুজয় বলছি এবিসিডি ব্যাঙ্ক থেকে।
- হ্যাঁ বলুন।
-আমাদের ব্যাঙ্কে আপনার একটি অ্যাকাউন্ট আছে----
-একটু-একটু-একটু ধরো তো ভাই। জাস্ট এক মিনিট ।
(বেশ কিছুক্ষণ পর) হ্যাঁ হ্যালো?হ্যালো?হ্যালো? যা বাবা কেটে গেছে।
-(পরের দিন দ্বিপ্রহর ) হ্যালো ম্যাম। আমি সুজয় বলছি, আপনার ব্যাঙ্ক থেকে--
-হ্যাঁ বলুন। আপনি কাল ও ফোন করেছিলেন না?
-ইয়েস ম্যাম। আপনার অ্যাকাউন্টে একটু প্রবলেম হয়েছে।
-প্রবলেম?হে ভগবান । আমাদের তো ঐ একটাই অ্যাকাউন্ট। কি প্রবলেম ভাই? যেতে হবে কি? যাওয়াটা এই মুহূর্তে --- ঐ যাঃ। পড়ে গেল। ভাই একটু ধরুন প্লিজ।
- (পরের দিন)ম্যাডাম আমি সুজয় ব্যাঙ্ক থেকে। আপনি ফ্রি আছেন কি?
-ফ্রি? হ্যাঁ আমি তো চাকরী বাকরী করি না ভাই। ছাপোষা গৃহবধু । আমার আর কিসের ব্যস্ততা । তবে দোকান হাটবাজার ব্যাঙ্ক সব করতে হয় কি না। তারওপর ---

-ম্যাডাম। ম্যাডাম আমি শুধু এটাই বলতে চাই যে আপনার অ্যাকাউন্ট শীঘ্র লক হয়ে যাবে।
-লক?মানে? কেন ভাই? ঐ সব কেআইসি না কি তো করানো আছে। আধারটাও কি সব করতে বলল করা হল। আবার কি?
-ম্যাডাম আপনার এটিএম কার্ড--
-কার্ড?হ্যাঁ আছে তো একটা। সেটা তো ব্যবহার করি না ভাই?বছরে একবার কিছু টাকা তুলি যাতে ওটা বন্ধ না হয়ে যায়।
-আপনার অ্যাকাউন্ট ফ্রীজ হয়ে যাবে ম্যাডাম।
- হে ভগবান। প্লিজ এরকম করবেন না। আমি একা, স্বামী অসুস্থ । ঐ টাকায় সংসার চলে। দশবার ব্যাঙ্কের চক্কর কাটতে পারব না ভাই।
-আমরা দেখছি কি করতে পারি। আপনার কার্ড নম্বরটা বলবেন প্লিজ।
-এখুনি? খুঁজতে হবে যে ভাই? কাল-__
-দেখুন ম্যাডাম উই আর ট্রাইং টু হেল্প আপনি যদি কোঅপারেট না করেন---
-না ভাই। তা নয়। সব তো তোমার দাদা রাখতেন।ওনাকে জিজ্ঞাসা করে তো লাভ নেই।  একটু খুঁজে---
-কেন?ওনাকে জিজ্ঞাসা করে লাভ নেই কেন?
-(ক্ষণিক নীরবতার পর) উনি কথা বলতে পারে না বাবা। ছয় মাস হল -
-সে কি? কেন? ডাক্তার?
-দেখিয়েছি।  আমি অবলা বৃদ্ধা নারী আমার সীমিত সামর্থ্যের  মধ্যে যা পেরেছি করতে বাকি রাখিনি।
-কিন্তু হঠাৎ  হল কি? আপনি বলছেন ছয় মাস আগে?
- কি আর বলি বাবা।  সবই অদৃষ্ট । ছেলেকে গাড়ি চালানো শেখাচ্ছিল-- ।
- অ্যাক্সিডেন্ট? আর আপনার ছেলে?
- নেই(ডুকরে কেঁদে উঠে)। নেই বাবা। কেউ নেই। আমি একটু কাঁদতেও পারিনি গো। ওদিকে ছেলে চলে গেল। এদিকে লোকটা পঙ্গু । শোকে পাথর। চিকিৎসা করাতে সর্বস্বান্ত হলাম।
-মাসিমা।
-হ্যাঁ বাবা অফিস টাইমে তোমার সাথে কি ভ্যাজভ্যাজ করতে বসলাম দেখ। সত্তর হয়নি তবু বাহাত্তুরে ধরে গেছে।  আসলে কি জান তো আমার কথা বলার কেউ নেই। সারাদিন  --- যাক। ছাড়ো। কাল কার্ডটা খুঁজে রাখব বাবা।
-মাসিমা দাঁড়ান। আপনি কাগজ পড়েন না?
-কাগজ? না বাবা বন্ধ করে দিয়েছি। ফালতু খরচা।  আমি কোনদিনই পড়তাম না।  তোমার মেসোমশাই পড়তেন খুঁটিয়ে।  উনি প্রয়োজনীয় খবরাখবর দিতেন।  বড় ভালবাসতেন গো কাগজ পড়তে।  ঐ ঘটনার পরও দুমাস নিয়েছি। তোমার মেসোমশাইকে পড়ে শোনাতাম। যদি কিছু আর কি। তারপর থেকে আর---
-হুঁ। বুঝেছি। তাই আমরা বেছে  বেছে  আপনাদের মত বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের ফোন করি। যাদের প্রচুর মালকড়ি কিন্তু খবরাখবর  কিছু রাখে না। আপনি জানেন না যে আপনার ব্যাঙ্ক কোনদিন আপনাকে ফোন করে কার্ড নম্বর পিন নম্বর চাইবে না।
-মানে? কি বলছ বাবা আমি তো ঠিক---
-বলছি ভুলেও কোনদিন কাউকে নিজের কার্ড নম্বর দেবেন না। পিন ও না। দিলে যে কেউ ঐ টাকা তুলে নেবে।
-তাই নাকি?তাই তোমার মেসোমশাই কোনদিন কার্ডটা আমায় দেয়নি গো।
-ঠিক করেছেন।ঐ কার্ড আপনার না খুঁজে পাওয়াই মঙ্গল । আর শুনুন যে কেউ ব্যাঙ্ক  থেকে বলছি বললেই তার সাথে খোশগল্প জুড়বেন না। বলবেন আমি ব্যাঙ্কে গিয়ে আপনার সাথে কথা বলছি।
-আচ্ছা বাবা। আচ্ছা। সোনা ছেলে। আমি যখন ব্যাঙ্কে যাব তোমার সাথে অবশ্যই দেখা করে আসব। তুমি ঠিক আমার নান্টুর মত করে কথা বল(গলা ধরে এল)
-সেটাই তো সমস্যা। আপনি ও একদম আমার মায়ের মত কাছাখোলা। এখনও বোঝেননি ব্যাঙ্কে গেলে আমায় পাবেন না? ভাল থাকবেন মাসিমা। সাবধানে থাকবেন। তিনদিনের মেহনত জলে গেল শা---।
#Aninditasblog