Wednesday 28 September 2016

তুত্তুরী উবাচ


তুত্তুরী উবাচ ১৪ই জানুয়ারী ২০১৬
হ্যালো মামমাম্
হ্যাঁ  মা
তোমার মেয়েকে নিয়ে আর পার যায় না খালি বকে মারব বলে ভয় দেখায় সুযোগ পেলেই মারে
কেন রে? কিছু অপাট করোনি তো?”
না  ঐ আর কি মায়ের গয়নাগাটি গুলো সব ঢেলে আবার গুছিয়ে রেখেছি
কেন কর মা  মা রেগে যায়  আর কিছু করনি তো?”
নাঃ শুধু একটা টিউব লাইট ধড়াম করে ফেলে দিয়েছি
তা বেশ করেছ  যেমন তোমার হাতের কাছে রাখে
না ঠিক হাতের কাছে নয়, ঐ আর কি আলমারির ফাঁকে রাখাছিল
হুঁ  ব্যাস? আর কিছু করোনি তো?”
করেছি তো  মায়ের ঐ কি সব মুখে মাখার স্প্রে আছে না? ঐ গুলো তুলোয় দিয়ে ঘর মুছেছি
সর্বনাশ   তোকে আজ মা মেরেই ফেলবে
মায়ের লিপস্টিক গুলো খুলে দেখতে গিয়ে কি হল জানি না সব কটা ক্যাতক্যাত করছিল
উফ কি দুরন্ত মেয়েরে বাবা
আর মায়ের ল্যাপটপটায় কি সব টিপেছি, বাবা বলছে, ল্যাপটপটা মরে গেছে যাই হোক তাই বলে আমায় মারবে? তুমি এসে এখুনি তোমার মেয়েকে নিয়ে যাও

তুত্তুরি উবাচ- ২৬ শে জানুয়ারি ২০১৬
"মা, দুর্গা ঠাকুরের পায়ের  কাছে সবসময় একটা মোষ থাকে কেন?"
"মোষ? ও হ্যাঁ  মোষ তো থাকবেই, ওটা যে মহিষাসুরমর্দিনীরই মূর্তি মহিষাসুর তো মোষের ছদ্মবেশেই আক্রমণ করত গল্পটা বলেছি না?"
"হুঁ মর্দিনী মানে?"
" যে মর্দন অর্থাৎ বিনাশ করেছিল হত্যা করেছিল "
ক্ষণিক নীরবতার পর, “আমি কি মর্দিনী মা?”
তুমি তো আমার দশভূজা জগৎজননী
না আমি পিঁপড়েমর্দিনী আমি পিঁপড়ে মারি
প্রসঙ্গত জগজ্জননী নামটি ওর নিজের বেছে  নেওয়া  আমার চার চারটি নাতি নাতনী লকাই, সরো, কেতো এবং গণা কেতো আর গণা মহাপাজি  প্রায়শই তাদের মা রেগে গিয়ে তাদের জানলা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয় লকাই, সরো স্কুলে পড়েদিদিমা অফিস থেকে ফিরলে, আগে মায়ের হোমওয়ার্ক, পরে মেয়েদের হোমওয়ার্ক যেদিন মা, দিদিমার হাতে ঠ্যাঙানি খায়, সেদিন লকাই সরোর কপালের দুঃখ থাকে তাদের মা সেদিন প্লাস্টিকের গদা নিয়ে তাদের হোমওয়ার্ক করাতে বসেন

তুত্তুরি উবাচ৬ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
মা, আমি আর ঈশাণীর পাশে বসব না
কেন রে?”
ও বদ
কি করল আবার? ঈশাণী তো তোর প্রাণের বন্ধু এই সেদিন নিজের হাতে এঁকে তোকে গ্রিটিংস্ কার্ড দিল!!!”
হুঁ  কিন্তু আজ ওর দুলে হাত দিতে দেয়নিকি সুন্দর গোল গোল দুল পড়েছিল ভাবলাম একটু ঘুরিয়ে দেখি
সর্বনাশ নির্ঘাত কানে সদ্য ফুটো করেছে এই সময় খুব ব্যথা থাকে তারওপর সোনার দুল ধরে টানাটানি  করলে যদি হারিয়ে  যায়--”
হুঁ
ঝগড়া করেছো ? কি বলেছ?”
ক্ষণিক নীরবতার পরআড়ি  তোর পাশে আর বসব না সব সম্পর্ক শেষ
ওরে বাবা  সম্পর্ক শেষ তা বেশ  তবে যদি মন খারাপ করে, তাহলে কাল ঈশাণীর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে নিও
কি চেয়ে নেব? দুল?”
না  না ক্ষমা রে বাবা  মানে সরি বোলো এন্ড গিভ হার আ টাইট হাগ
আঃ হাগ বোলো না সিংহগুলোও শিখে গেছে, এক্ষুণি ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে
উপস্ ভুলে গিয়েছিলাম, আমার কন্যা যে জগজ্জননী বাড়িতে সিংহ, ময়ুর, পেঁচা গিজগিজ করছে

তুত্তুরী উবাচ- ৬ই মার্চ ২০১৬ 
বারোটা বাজছে কিন্তু , এবার মুখ বন্ধ আর একটা কথা বললেই মারব
ইঃ শুধু মারব আর মারব  ওপাশ ফিরে আহ্লাদী স্বরে, “ বাবা? তোমার ব্যথাটা কমেছে?”
না  আছে একটু
এস আমি মা দুর্গার নাম লিখেদি ব্যথা কমে যাবে
তুই! মা দুর্গার নাম লিখবি?” হাসি চেপে গম্ভীর ভাবে বাবা বলল,“ বানান জানিস?”
হ্যাঁ জানি
কি বানান বল দেখি?”
জানি  কাল সকালে বলব এখন মা কথা বলতে নিষেধ করেছে

তুত্তরী উবাচ ১৪ই মার্চ ২০১৬
মা, দাদা কি বাজে কথা বলে!!”
আবার দাদা কি করল?”
নাঃ কিছু করেনি শুধু বলছিল ভূত বলে কিছু নেই
নেই ই তো  ঠিকই তো বলেছে
নেই?”
না
মানুষ মরে ভূত হয় না?”
উঁ হুঁ
ব্রহ্মদত্যি? মামদো? ছেঁছো ভূত?কিচ্ছু হয় না?”
নাঃ
শাঁকচুন্নী? পেত্নী?”
ধুস্
আর লুল্লু? একানড়ে ও হয় না?”
ধুর ধুর  ওতো ত্রৈলোক্য--- ”
হয় না তো?তাহলে তোমরা  কেন ভয় দেখাও? ঘুমিয়ে পড়ো না হলে এক্ষুনি একানড়ে এসে জানলায় ঠকঠক করবে? অ্যাঁ? বল? বল?”

তুত্তুরী  উবাচ ১৭ই মার্চ২০১৬

"মা, মা মনসা কি লাউ ডগার পিঠেও চাপে?"
"চাপতে পারে, এখন কাজের সময় বিরক্ত করো না  "
একটু পরেই প্রবল চিৎকার ,“ মনসা! তোর কি কোন কাণ্ডজ্ঞান নেইঐ টুকু একটা লিকলিকে প্রাণীর পিঠে তুই চাপিস?”
প্রবল বকুনি  থামার পর আদুরে গলায় আব্দার, “ মা সরস্বতী শাড়ি ছিঁড়ে ফেলেছে ওকে একটা শাড়ি কিনে দেবে?”
বেশ দেব তা ওর কি একটাই শাড়ি?”
করুণ স্বরে লাল শাড়ি চাইছে মাহ্যাঁ একটাই শাড়ি  ওর বাবা তো শিব  গরীব লোক  গাঁজা খায়, সিদ্ধি খায় আর ধ্যান করে আমি বলেছি চিন্তা করিস না  মা কিনে দেবে
আচ্ছা তা মনসাকে এত বকলি কেন? ”
সব সময় সাপ নিয়ে ঘোরে  লক্ষ্মী ভয় পায় যে গোখরোর গায়ের রঙ তো হলুদ কালো,লক্ষ্মী ভাবে বাঘ এল বুঝি! ওমনি প্যাঁচায় চেপে উড়ে পালিয়ে যায়  হিঃহিঃ
জগজ্জননীর সংসার-

তুত্তুরী উবাচ ২৪শে মার্চ ২০১৬


  • “বাবা, লক্ষ্মী আর সরস্বতী বলছে ভোটের পর ঊনকোটি যাবে।”
  • “বাঃ তা যাওয়াই যায়।”
  • “আমি বলেছি না মরুভূমি দেখতে যাব। সেখানে সিংহটাকে বেশ বালির মধ্যে লুকিয়ে রাখা যাবে।”
  • “মরুভূমি! মানে রাজস্থান? ভেরি গুড।”
  • “বোকা গণেশটা বলছে মরুভূমিতে গিয়ে ঊটের জল খাবে।”
  • বাবা প্রায় বিষম খেয়ে, “ঊটের জল? মানে?”
  • “হ্যাঁ গো বাবা, ঊটের পীঠে একটা বিরাট জলের কি যেন থাকে, গণেশ বলছিল।”
  • “ওঃ ঊটের কুঁজ!!! সেটা থেকে শুধু ঊট জল খেতে পারে, তাও বিশেষ পরিস্থিতিতে। না হলে জল খেতে হলে ঊটটাকে কাটতে হবে। তাও পাবি না। ওটা চর্বি হয়ে জমে থাকে।”
  • “ঊটটাকে কাটতে হবে?” প্রচণ্ড ধমক দিয়ে, “ গণেশ! সাধে কি তোকে বোকা বলি? দিদিরা কবে পড়তে শিখে গেল। তুই এখনও অ আ লিখতে শিখলি না। দাঁড়া তোর শুঁড়টাই কেটে দেব। ” আমাদের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে, “চিন্তা করো না। শিব আবার জুড়ে দেবে।” কয়েক মুহূর্ত পরে স্বাভাবিক স্বরে, “ বাবা, গণেশ বলছে, সিংহটা বালি খুঁড়ে জল বার করে দেবে। কোন চিন্তা নেই। ”
তুত্তুরী উবাচ, ২৯শে মার্চ ২০১৬

  • "মা, রাবণের কটা হাত?গণেশ বলছে ওর নাকি দশটা হাত?"
  • "দুটোই তো জানি। "
  • "দশটা মাথা আর দুটো হাত? তাহলে রাবণ দাড়ি কামাতো কি করে?"
  • "উফ। কি প্রশ্নের ছিরি। যা বাবাকে জিজ্ঞাসা কর গিয়ে। "
  • "বাবা বল না? রাবণ কি করে দাড়ি কামাতো?"
  • "গুড কোয়েশ্চন। কামাত না। রাবণ মাকুন্দ ছিল। "
  • "মাকুন্দ মানে কি বাবা? "
  • "মাকে জিজ্ঞাসা কর?"
  • "মা মাকুন্দ মানে কি?"
  • "জানি না যা। সক্কাল সক্কাল কি সব অনাসৃষ্টি কথাবার্তা "
তুত্তুরী উবাচ, ২রা এপ্রিল ২০১৬

  • মা, বলছি যে, বাঁদর থেকে যেমন মানুষ হয়, মানুষ থেকে কি হয়?”
  • মানুষ থেকে?----- এখনও কিছু হয়নি।
  • হ্যাঁ হয় তো। মানুষ থেকে ভূত হয়মুচকি হেসে আহ্লাদী স্বরে, “ তুমি ভয় পেয় না। ভূত বলে কিছু হয় না। তোমাকে এপ্রিল ফুল বানালাম।
  • এপ্রিল ফুল? তারিখ রাতে এপ্রিল ফুল? সে তো পয়লা---”
  • সবার মন খারাপ ছিল যে--” (** ৩১ শে মার্চ বিবেকানন্দ রোড উড়ালপুলের পতন)
তুত্তরী উবাচ ৩রা এপ্রিল ২০১৬


  • মা। মা। মহাসমস্যা হয়েছে।
  • কি করেছো?”
  • আমি না। বোকা গণেশ। খেলতে খেলতে বেগুনী রঙের বালতিতে পড়ে গেছে। এখন সাফ করবো কি করে?”
  • ওঃ এই। চান করিয়ে দে। 
  • সানলাইটের জলে চুবিয়ে, কলিন আর ডেটল দিয়ে ধোব? ” 
  • যা খুশি কর। আমায় কাজ করতে দাও আর খবরদার! কলিন, ডেটলে যেন হাত দিতে না দেখি।
  • একটু পরে,“ মা একটা দাড়িওলা ভগবানের নাম বল তো?”
  • কেন? গণেশের দাগ ওঠার সঙ্গে দাড়িওলা ভগবানের কি সম্পর্ক? যাই হোক একটাই তো জানি।
  • কি?”
  • প্রজাপতি ব্রহ্মা
  • কেন লোকনাথ বাবা।
  • ওঃ। উনি তো মানুষ হয়ে জন্মেছিলেন।
  • সে যাই হোক। পুজো তো করি।
  • আবার কিছুক্ষণ পরে, “ মা কোন সম্পর্ক নেই মানে কি?”
  • মানে- ইয়ে- কোন যোগাযোগ নেই। দুটো জিনিসের মধ্যে অনেক ভেবেও কোন যোগসূত্র না পাওয়া গেলে-”
  • ওঃ। বুঝেছি। যেমন মা লক্ষ্মী আর দিদি নং ওয়ানের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই?”
  • আঃ কি গাঁজাখুরি কথাবার্তা। আর একটাও প্রশ্ন নয়। সকাল থেকে বকেবকে--”
  • না সম্পর্ক আছে মা। দুটো একই চ্যানেলে হয়। দুর্গা আর বিগবস্ যেমন।
  • আর একটাও কথা নয়। সকাল থেকে বকে বকে মাথাখারাপ করে দিল- ”
  • বেশ। চলে যাচ্ছি শুধু বল গাঁজাখুরি মানে কি। 
  • তুত্তরী উবাচ ৪ঠা এপ্রিল ২০১৬
  • ট্যাক্সিওলাদের মতে উড়াল পুলের পতনের দৌলতে হাওড়া নাাকিপ্রায় দুর্ভেদ্য এয়ারপোর্ট থেকে ভিআইপি রোড ধরে কাঁকুড়গাছি হয়ে, ফুলবাগান, বেলেঘাটা স্পর্শ করে সুরেন ব্যানার্জী রোড হয়ে ধর্মতলা বাসস্টান্ডের মধ্যে দিয়ে কার্জন পার্ক হয়ে রেসকোর্সের পাশ দিয়ে রবীন্দ্র সেতু টপকে বেলেপোল দিয়ে ইছাপুর জলট্যাঙ্কে পৌছে করজোরে বললাম,“ দাদা অনেক হয়েছে কলকাতা ভ্রমণ আমাদের অনুগ্রহ করে এখানেই নামিয়ে দিন
  • পথে তুত্তরী উবাচ-
  • মা জানো তো আমাদের স্কুলে দুটো হিন্দু পড়ে!!!”
  • মানে? হিন্দু তো তুইও, ঈশানী, অদ্রিজা সবাই এতে আশ্চর্য কি আছে?”
  • আরে নানা হিন্দু না অন্য
  • সে আবার কি? আবার শুরু করেছিস গাঁজাখুরি গপ্প?”
  • আঃ মিস্ যখন বলে প্রেপ কপি বার কর, তখন কি আমরা বলি, নেহি হ্যায়?”
  • ওঃ হিন্দি তে কথা বলে
  • হ্যাঁ তাই তো বলছি হিন্দু
  • ওদের হিন্দিভাষী বলে
  • কয়েক মিনিটের নীরবতার পর, “ মা দাদু বলেছে মুখোশ কিনে রাখবে রাবণের মুখোশ কিন্তু পরব কি করে?”
  • উফ্ মুখোশ পরতে তুই জানিস না বুঝি? আগে যেন কখনত্ত পরিসনি?”
  • পরেছি তোচিন্তান্বিত হয়ে, “কিন্তু রাবণেরটা--- কি করে যে পরি? আমার তো আর দশটা মাথা নেই
  • উফ্ মুখোশে একটাই মাথা থাকে চুপ করে বসো তো আর একটাও কথা বোল না
  • পাঁচ মিনিটের নীরবতার পর ,“ উঃ বড্ড মশা ট্যাক্সিতে খালি কামড়ায়
  • কোথায় ? আমায় তো একটাও কামড়াচ্ছে না চুপ করে বস এত নড়ছ কেন?”
  • হুঃ আমার বোধহয় চুলকুনি হয়েছে মা ঈশ্ জানো তো জানোয়ার গুলো না গিয়ে গাছে গা ঘসে ওদের তো হাত নেই যে সঘস্ করে ইয়ে করবে মা, ওরা নাএক ঝলক ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে, স্বর নামিয়ে, “ ইয়ে করেও ইয়েটা গাছে ঘসে নেয় ইয়ে মানে বুঝলে কি না?”
তুত্তুরী উবাচ ১৪ই এপ্রিল ২০১৬
  • “আজ পয়লা বৈশাখ,সকাল সকাল পড়তে বসো। জান তো, আমাদের ছোটবেলায় কি বলত, আজ যা করবে সারা বছরই তাই করতে হবে।”
  • “তাহলে তো রোজ পড়তে বসতে হবে, ওরে বাবা আজ আমি কিছুতেই পড়ব না।”
  • “বেশ, তবে আজ ঠ্যাঙানি খেলে কিন্তু সারা বছরই-”
  • “এই শুরু হল। খালি মারব আর মারব। আমাকে কি সারা জীবন ঠ্যাঙাবে?”
  • “যত দিন বড় না হচ্ছ।”
  • “শোন মা, বাচ্ছাদের ঠ্যাঙাতে নেই। জান না শিশু নারায়ন! ছ বছর অবধি বাচ্ছারা নারায়ন থাকে, তারপর ছয় থেকে পনেরো তারা শিব হয়ে যায়, তখন তাণ্ডব করে।”
  • প্রবল হাসি চেপে, “এটা আবার কোথা থেকে আমদানি করলি?”
  • “হাওড়া থেকে। দাদু বলেছে, পনেরো বছরের পর চিত্রগুপ্ত খাতা খুলে পাপ পুণ্যের হিসেব টোকে। এখন তুমি যতই মায়ের লিপস্টিক নষ্ট কর আর দেওয়ালে ছবি আঁক, চিত্রগুপ্ত কিছুই লিখছে না।”
  • “যেমন তুই, তেমনি দাদু। একে রামে রক্ষে নেই -”

  • তুত্তুরী উবাচ ১৮ই এপ্রিল ২০১৬
  • - হ্যালো বুকু, বাড়ি পৌঁছেচ?
  • - বাড়ি না পৌছলে তোমার সাথে কথা বলতাম কি করে? 
  • - তাও বটে! তা আজ স্কুলে কি শিখলে?
  • - আজ হাঁসজারু আর বকচ্ছপের বিয়ে হবার কথা ছিল, ওমা গিয়ে দেখি ঘোড়াহাতি আর টিয়াবুলবুলির বিয়ে হচ্ছে
  • - গল্প বটে কিছু বানাতে পারো তুমি ঘোড়াহাতি আর টিয়াবুলবুলি আবার কোথায় পেলে? পড়াশোনা কি করলে?
  • - মা তুমি আজ শাড়ি পরে গেছ তো?
  • - এই গরমে শাড়ি? 
  • - তুমি এত শাড়ি পড়তে কেন অপছন্দ কর বলতো? জগৎজননীর মা তো শাড়িই পরে নাকি?
  • - হু সে সত্য যুগে পরতো
  • - জানো তো মা দুর্গা আমায় কাল কি বলেছে? বলেছে, আমি যেমন স্বর্গের দুর্গা, তুই তেমনি মর্তের দুর্গা তোর মা যদি তোকে মারে, আমায় বলিস, আমি তোর মাকে অভিশাপ দিয়ে দেব
  • - হাঁ, মা দুর্গা আমায় বলেছে, ওটা একটা বাঁদর, ওকে মানুষ করতে হলে, হাত খুলে ঠ্যাঙাবি
  • - (চিন্তান্বিত হয়ে) মা দুর্গা আবার তোমায় কখন বলল? তুমি ভুল শুনেছ
  • - না ঠিকি শুনলাম তো
  • - না না তুমি ভুলে গেছ কালই বাবাকে বলছিলে না, আজকাল সব ভুলে যাও
তুত্তুরী উবাচ এপ্রিল ২০১৬

  • -মা, ছাগল কে কাজল পরাতে পারবে?
  • - উফ ভগবান।
  • -কোন ভগবানকে ডাকছ? আচ্ছা মা, অভিযোগ করাটাকে তো কমপ্লেন করা বলে, যেটা খায় সেটাকে কি বলে গো?
  • - কমপ্লান!
  • - কমপ্লান?
  • - হুঁ
  • - খালি কমপ্লান করো।কমপ্লান করো। হরলিক্স করো হরলিক্স করো। মাঝে মাঝে বোর্ণভিটা তো করতে পারিস লক্ষ্মী। (গলা নামিয়ে) জানো তো মা লক্ষ্মীটার খালি নালিশ আর অভিযোগ, কান ঝালাপালা হয়ে গেল
তুত্তুরী উবাচ ২২শে এপ্রিল ২০১৬

  • -      ওমা, দেখ দেখ কি সুন্দর পতাকা নিয়ে যাচ্ছে।  চল না আমরাও ওদের সাথে হাটি।
  • -      ঐ রঙের পতাকাধারীদের সাথে হাঁটলে আর বাবার আমার চাকরী থাকবেনা বাবু।
  • -      কেন? আমিও ভোট দেব মা।
  • -      তোমাকে ভোট দিতে দেবে না।
  • -      কেন? আমি মা লক্ষ্মী চিহ্নে ছাপ দেব মা।
  • -      ঐ সব চিহ্ন হয় না বাবু। আর তোমার আঠারো বছর বয়স না হলে তোমায় ভোট দিতে দেবে না।
  • -      সেদিন যে বললে আঠারো বছর না হলে বিয়ে করতে দেয় না? ভোটও দিতে দেয় না?
  • -      না।
  • -      যাঃ। তুমি কিছু জান না, আমি ভোট দিতে গিয়েছিলাম তো দাদুর সাথে। দাদু শুধু একটা বোতাম টিপল। বোতাম টেপা আর কি শক্ত মা? আমিও পারব। জান তো ভোট দিলে নেলপালিশ পরতে দেয়! আগের বার হাওড়ায়, দাদুকে যখন পরাচ্ছিল, দাদু বলাতে লোকটা আমাকেও পরিয়েছিল।
  • -      বেশ।
  • -      আচ্ছা মা, বোতাম টেপার আওয়াজে কি বোঝা যাবে, যে আমি কোন চিহ্নটা টিপলাম?
তুত্তুরী উবাচ ২৪শে এপ্রিল ২০১৬

-      মা, মা লক্ষ্মীর ছেলের নাম কি গো ?
-      মা লক্ষ্মীর ছেলে-মেয়ে আছে কি না জানি না। নেই সম্ভবত। আমাদের বাড়ির লক্ষ্মী পুজোয় লক্ষ্মী- নারায়নের সাথে কুবেরের মূর্তি গড়া হয় বটে, তবে কুবের লক্ষ্মীর নিজের ছেলে নয়।
-      সেকি? লক্ষ্মীর বিয়ে হয়েছে, অথচ--, ব্যাপারটা তো ভাল নয়?
-      বিয়ে হলেই বাচ্ছা হতে হবে? তুই তো দাদুর পিসিমাদের মত কথা বলছিস!
-      হ্যাঁ। যেমন আমি, তোমার বিয়ে হয়েছে, তারপর আমি হয়েছি।
-      শোন বুকু, বিয়ে হলেও বাচ্ছা নাও হতে পারে, আবার বিয়ে না হলেও হতে পারে। এটা বাবা এবং মায়ের ইচ্ছা। কর্ণের গল্প ভুলে গেলে?
-       কর্ণ বলতে মনে পড়ল, মা, সূর্য দেবের গোঁফ থাকে? না দাড়ি থাকে?
-      জানি না। যত ফালতু প্রশ্ন। তবে গোঁফ দেখেছিলাম মনে হচ্ছে কোন একটা ছবিতে।
-      গোঁফ দাড়ি তো কেবল রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর আর ব্রহ্মার ছিল বলো।
-      আঃ। কিসের সাথে কি। সকাল থেকে খালি ঠাকুর আর দেবতা, পাগল করে দিল।
-      আচ্ছা মা, কি করলে যেন, কালীঘাটের কুকুর হয় গো?
-      এটাই শেষ প্রশ্ন তো?কাউকে কিছু দিয়ে ফেরত নিলে।
-      কেন? কুকুর হব কেন? আমার কাউকে ভাল লাগল, ভালবেসে কিছু দিলাম, কাল রাগ হল, ফেরৎ নিতেই পারি।
-      (পাশ থেকে বাবা সহাস্যে) ঠিক বলেছিস। কাউকে কিছু দিস না।
-      (বাবার দিকে ফিরে) বাবা আর কি করলে পুরির কুকুর হয়?
-      (বাবা গম্ভীর স্বরে) রাতে না ঘুমোলে।
-      আঃ। ঘুম পেলে তবে তো ঘুমোব। বলো না, কি করলে বৃন্দাবনের কুকুর হয়?
-       রাতে না ঘুমোলে।
-      আর কাশীর?
-      রাতে না ঘুমোলে।
-      ধুৎ। তুমি জান না, মাই ভালো।

তুত্তুরী উবাচ ২৯শে এপ্রিল ২০১৬
  • - মা, মাসি একটা মন্ত্র শিখিয়েছে, শুনবে?
  • - না! রাত বারোটায় আমি কোন মন্ত্রতন্ত্র শুনতে রাজি নই।
  • -শোনই না।
  • - মন্ত্র পড়লে কি হবে? বকবক বন্ধ হবে? ঘুম আসবে?
  • - না। তবে সাধুবাবার স্বপ্ন দেখবে।
  • - আমি কোন সাধুসন্তর স্বপ্ন দেখতে চাই না।
  • - আঃ শোনোই না।
  • - না বলে ছাড়বি না যখন অগত্যা -
  • - সাধুবাবাজী দুটো মুরগী পুষেছি,
  • মুরগী দুটোর নাম রেখেছি গরম পেঁয়াজী। হিঃ হিঃ হিঃ
  • - মাগো। ঈশ্। ছিঃ। ওয়াক্।এটা কি? কি জঘন্য জিনিসপত্র শিখিস।
  • তুত্তুরী উবাচ ৮ই মে২০১৬
  • -(সাংঘাতিক গম্ভীর স্বরে)ভয়ানক রকমের দেব চমকে,
  • ভয় পেয়ে তুই যাবি ব্যোমকে।
  • -( বাবার তালে তাল মিলিয়ে, ততোধিক গম্ভীর স্বরে)হঠাৎ করে মুণ্ডুটা তোমার ঘচ্ করে ফেলব কেটে।
  • - এসব কি হচ্ছে রে সাতসকালে?
  • - উফ্ মা। একটু গান গাইতে ও দেয় না।
  • - এটা গান!!! হে ভগবান্ আজ যে ২৫শে বৈশাখ।

Friday 23 September 2016

অনির (পুজোর) ডাইরি ২০১৬, ২৩শে সেপ্টেম্বর

পুজোর ডাইরি, মানেই আনন্দ, উৎসব, হৈচৈ যেখানে শোক দুখের কোন বালাই নেই। এমনিতেও শোক দুঃখ আমার লেখায় খুব একটা পাবেন না, কারণ এই আননবই/ আমার ব্লগে আমি লিখি শুধু মাত্র  আনন্দ- হর্ষটুকু ভাগ করে নিতে, দুঃখ তো একান্তই ব্যক্তিগত। বেদনা ভাগ করা যায় না, সে চেষ্টাটুকুও যে কতখানি হাস্যকর, সেই প্রসঙ্গে একটা গল্প না বলে পারছি না, বছর পাঁচেক আগের কথা, আমার এক বন্ধু হঠাৎ ঠিক করল, অনেক হয়েছে, এবার বিয়ে করে ঘর সংসারী হতে হবে।বিয়ে তো করবে, কিন্তু করবে কাকে? পাত্র খুঁজতে হবে, খুঁজবে কে? কেন আমরা বাকি দুই বন্ধু আছি না। সুপাত্র অন্বেষণ শুরু হল, আমার দৌড় বলতে বাড়িতে শৌভিক আর অফিসে অঞ্জনদা, দুজনকেই বললাম, “ভাল ছেলে/ বন্ধু-বান্ধব থাকলে বলুন/বল।” শৌভিকের বেশ কিছু অবিবাহিত বন্ধু/ সহকর্মী ছিল বটে, কিন্তু আমার বর হাত উল্টে জানিয়ে দিল, “বিডিও গিরি অবধি হচ্ছে, বউয়ের বন্ধুর জন্য ঘটকালী আমার দ্বারা হবে না।” আমি ব্যর্থ হলেও আমাদেরই অপর এক বন্ধু বেশ কিছু সুসম্পর্ক তথা সুপাত্রর খবর জোগাড় করল। খবর পাবার পরের কাজ ছিল, সম্মিলিত ভাবে ফেসবুকে সেই ব্যক্তিটিকে খুঁজে বার করা, এবং তার ছবি, পোস্ট ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে তার সম্পর্কে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নেওয়া। বেশ কয়েকজনকে নাকচ করার পর (বেচারারা জানেও না) একটি নব্য(?) সুবেশ যুবাকে সবার পছন্দ হল। বেশ সুদর্শন, নিয়মিত জীবনানন্দ, সুনীল, শক্তির কবিতা-টবিতা শেয়ার-টেয়ার করে, বেশ আঁতেল টাইপ। সব ঠিক-ঠাক এবার বন্ধুর বাবা-মা অর্থাৎ কাকু-কাকিমাকে বলা হবে, হঠাৎ যে বন্ধু সম্বন্ধ এনেছিল, সেই বেঁকে বসল, “এই না। না। না। এ ছেলে চলবে না?” বাকিরা সম্মিলিত ভাবে প্রতিবাদ করলাম (সবই মেসেঞ্জারে, তখন আমাদের হোয়াটস অ্যাপ ছিল না), “কেন? কেন? কেন? এত হ্যান্ডু! তায় আঁতেল।” ঘটকী দাঁত খিঁচিয়ে, যথাসম্ভব শ্রাব্য গালি দিয়ে বলল, “আব্বে দেখ, কয়েক মাস আগে, ছেলেটার হাত কেটে ছিল, সেই হাতের ছবি দিয়ে কি লিখেছে, “গট থ্রি স্টিচেস। ফ্রেন্ডস প্লিজ প্রে ফর মি।” মাত্র তিনটে সেলাই এর জন্য যে ছেলের বন্ধুদের প্রেয়ারের দরকার পরে, তার সাথে কে ঘর করবে ভাই?” নেহাত বোকা বোকা লজিক হয়তো, কিন্তু এই অভিজ্ঞতা আমাকে এই শিখিয়েছিল, যে দুঃখ আমাদের নিছক আপন অত্যন্ত স্পর্শকাতর ব্যাপার। তা ভাগ করে নেওয়া যায় না।
          মা আসতে আর তিন সপ্তাহও বাকি নেই। কিন্তু কেন যেন কিছুদিন ধরে সেভাবে আনন্দ উপভোগই করতে পারছি না। যখনি ডাইরি নিয়ে বসছি, কি এক অব্যক্ত যন্ত্রণা আমার আঙুল গুলোকে আঁকড়ে ধরছে। কিছু বলতে চাই, নিজের মানসিক যন্ত্রণা ভাগ করে নিতে আমি ব্যাকুল কিন্তু ভয় করে, ব্যক্ত করতে গিয়ে কারো ব্যক্তিগত জীবনের চৌহদ্দির মধ্যে না পদার্পণ করে বসি। কারো নিদারুণ ব্যথা না আমার কলম এক্ষেত্রে কি-বোর্ডের মাধ্যমে জনসমক্ষে উন্মোচিত না হয়ে পড়ে। তবু না বললে আমার পুজোর ডাইরি অসম্পূর্ণ।
অ্যালার্ম এর ডাকে বুধবার ভোরে ঘুম চোখে অ্যালার্ম বন্ধ করতে গিয়ে দেখি বসের মেসেজ। কি মর্মান্তিক সেই মেসেজ, মাত্র দুলাইনে স্যার লিখেছেন, ওনার স্ত্রী মঙ্গলবার রাতে হঠাৎ মারা গেছেন। তাঁকে সমাধিস্থ করতে উনি দেশের বাড়ি যাচ্ছেন। ম্যাডাম বা বউদিকে (স্যার সব সময় বলতেন তোমাদের বউদি) কখনো দেখিনি, কিন্তু বিগত পাঁচ বছরে স্যারের মুখে ওনার কথা এত শুনেছি, এই মধ্যবয়সী দম্পতির আভ্যন্তরীণ ভালবাসা এত গভীর ভাবে প্রত্যক্ষ করেছি যে ওনার মেসেজ পড়ে চোখের জল চেপে রাখতে পারলাম না। দীর্ঘদিন ধরে ডায়বেটিসে ভুগছিলেন, সাথে যোগ হয়েছিল নার্ভের অসুখ। অফিসের শত ব্যস্ততার মধ্যেও কি অসীম মমতায় স্যার ওনাকে ফোন করে খোঁজ নিতেন। বৌদি অপারগ হয়ে পড়ার পর বেশ কিছুদিন স্যার স্বয়ং রান্না করে অফিস আসতেন। বউদি একা থাকতে মাঝে মাঝে ভয় পেতেন, তখন ওনার একটা ফোনেই স্যার হাফ ডে দিয়ে বাড়ি চলে যেতেন। নিয়মিত প্রেসক্রিপশন ধরে গোছা গোছা অসুধ কেনাতেন স্যার, একবার ছুটি নিয়ে দক্ষিণ ভারতেও ঘুরে এলেন, যদি একটু ভালো থাকেন বৌদি। বেশ কিছুদিন বাদে আবার যাবার কথা ছিল।  গত সপ্তাহে সিমলা ট্রেনিং এ যাবার আগেও স্যার বলে গেলেন, “ ফিরে এসে তোমার বউদিকে নিয়ে আর একবার দক্ষিণে যাব।”  এই তো বোধহয় সোমবার বা মঙ্গলবারই স্যার আমাকে আর ডিএলসি সাহেব কে পাকড়াও করে শোনাচ্ছিলেন, আয়াদের সাথে বউদির না বনিবনা হবার গল্প। হতাশ হয়ে বলছিলেন, “ আরে একটা আয়াকেও না পছন্দ হলে হয়? যার সাথে সমস্যা তাকে ছাড়িয়ে দিয়ে আর একজনকে খুঁজে কাজে লাগালাম, এ রান্নাও করবে, চেনা মেয়ে আগে আমাদের বাড়ি কাজ করত। এখন বলছে, একেও না পসন্দ। পুরানো আয়াকেই চাই।” আমরা হাসছিলাম, এ সমস্যা স্যারের কাছে নতুন হলেও আমার মা-শাশুড়ির প্রায়ই হয়। কক্ষনই কোন কাজের লোককে ওদের পছন্দ হয় না। যতক্ষণ তাকে না ছাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, এরা শান্তি পায় না, আর ছাড়িয়ে দিলেই মা’রা ঐ পরিচারিকার গুণকীর্তন শুরু করেন। বললাম, ওনাকে, উনি ভালো করে মাথা চুলকে বললেন, “তোমাদের ছাড়া আর কার সঙ্গেই বা শেয়ার করব বল?”  তার সাথে মঙ্গলবার মধ্যরাতে স্যারের পাঠানো মেসেজকে আমি কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না। আজো পারছি না। সবথেকে মর্মন্তুদ ব্যাপার হচ্ছে আজি খবর পেলাম, ওনার পদোন্নতি হয়েছে। ইশ আর আড়াইটে দিন আগে যদি এই অর্ডারটা বের হত?
খবরটা বাড়িতে বলতে ফোন করেছিলাম, বাবা শুনে বলল, “ঈশ। মন খারাপ হবার মতই খবর। তবে আমাদের ও একটা খারাপ খবর আছে। জগন্নাথের বউ মারা গেছে।” জগ্ননাথ? অর্থাৎ জগুদা, আমার মাসতুতো দাদার শালা। তার বউ অর্থাৎ জুঁই? সম্পর্কটা শুনতে বা লিখতে যতটা দূরের মনে হয়, আসলে তা নয়। যৌথ বিরাট পরিবারে এগুলো নিতান্তই কাছের কুটুম্ব। দাদার কাছে আমি লেখাপড়া শিখেছি, বাবার পরই আমার দাদা। মাসতুতো শব্দটা নেহাত শব্দ মাত্র, অর্থ কিছু নেই আমার কাছে। দাদার শালা অর্থাৎ জগুদাকে চিনি বিগত আঠারো বছর ধরে, নিতান্ত ভালোমানুষ, গোবেচারা, সাত চড়ে রা কাড়ে না টাইপ ভালো ছেলে।  আর জুঁই? ওকে চিনি তা প্রায় দশ বছর। চোখ ধাঁধানো রূপসী ছিল না বরং স্নিগ্ধ মিষ্টি মাখনের ডেলা ছিল মেয়েটা। ঘাম তেল মাখানো চকচকে ফর্সা রঙ,গোল পানা মুখ আর জগত ভোলানো এক গাল হাসি।  এত সাদাসিধে মেয়ে সত্যি দুর্লভ। যেখানে যেত, নিজ রূপে গুণে সকলের মন জয় করে নিত। জুঁই তো জুঁইই, মিষ্টি মধুর সুগন্ধে ভরিয়ে রেখেছিল গোটা পরিবারকে। জগুদা পাক্কা কর্পোরেট ম্যান,কখন অফিস যায়, কখন ফেরে কোন ঠিক নেই। ফিরতে যত রাতই হোক না কেন, জেগে বারন্দায় অপেক্ষা করত বরের, একসাথে রাতের খাওয়াটুকু সারবে বলে। কি যে গভীর ভালবাসা ছিল দুজনের মাঝে, তা যুগলকে একনজর দেখলেই অনুভব করা যেত। এই তো দু-এক হপ্তা আগেই ফেসবুকে ছবি দেখছিলাম ওরা চাদিপুর বেড়াতে গেছে। হাসি হাসি মুখে, যুগলের ছবি, একা জুঁই, ছেলের হাত ধরে হাসি মুখে জুঁই।
হঠাৎ কি হল? চাদিপুর থেকে ফিরেই জ্বর, পেটের অসুখ আর র‍্যাশ। ফেলে না রেখে পরদিনই হস্পিটালাইসড করা হল মেয়েটাকে। সবাই ভেবেছিল ডেঙ্গু। রক্ত পরীক্ষা করে দেখা গেল, প্লেটলেট কাউন্ট সাড়ে তিন লাখ। জরুরি ভিত্তিতে ডায়লিসিস করা দরকার বলে ছোট নার্সিং হোম তৎক্ষণাৎ রেফার করে বড় হসপিটালে। মধ্য রাতে নিয়ে যাওয়া হয় এশিয়ার সেরা বলে নিজেদের দাবী করে এমন এক সুপার স্পেশালিটি হসপিটালে। সারা রাত এমারজেন্সিতে ফেলে রাখা হল মেয়েটাকে, কারণ কোন ডাক্তার এবং বেড খালি নেই। পরদিন আই সি ইউতে যখন স্থান পেল, ততক্ষণে ইউরিন ফরমেশান স্তব্ধ হয়ে গেছে। বারংবার অনুরোধেও ডায়ালিসিস চালু করল না, বড় হসপিটাল। কারণ ছোট হসপিটালের টেস্টে ওদের ভরসা নেই। ড্রিপ আর ক্যাথেটার লাগিয়ে ফেলে রেখে আবার সব টেস্ট করা হল। ফলাফল জানতে জানতে কেটে গেল সারা বেলা। বিকালে যখন ডায়লিসিস করার সিধান্ত নিল ওরা, ততক্ষণে রোগীর চেতনা লুপ্ত হয়েছে। প্রেসার এত কম, ডায়লিসিস অসম্ভব। অবচেতন মেয়েটাকে বাঁচার সম্ভবনা তখন ওদের ভাষায় মাত্রই ৫%। অন্তিম প্রচেষ্টা করল হসপিটাল, একটা ইঞ্জেকশন, যার মূল্য ৮০ হাজার টাকা। ফুলের মত ফুটফুটে মেয়েটা আর ধকল নিতে পারেনি।
আমার তুত্তুরীর থেকে মাত্র এক বছরের বড় ওদের ছেলেটা। মাকে ছেড়ে কোনদিন থাকেনি। সুপার স্পেশিয়ালিটি হসপিটালকে স্পেশাল অনুরোধ করে, ভেন্টিলেশনে থাকা কালীন অচেতন মাকে একবার দেখিয়ে আনা হয়েছে। যাতে মা কোথায় জিজ্ঞেস করলে কিছু জবাব দেওয়া যায়।

Thursday 22 September 2016

She asked him, "Do you love me?" He could see the enthusiasm in her eyes, he felt miserable that his answer would break her heart, maybe forever, but he had to say. He looked into her eyes and said, "nope. I dont."
Her eyes were flooded but she smiled and said," But I do. I love you.... more than i ever loved anyone in my entire life."

Days passed, they grew older.... together they were the happiest couple in the whole world. Every morning she repeated the same question and he repeated the same answer... for him it was a relationship without any string attached.. and for her? It meant everything.

That morning, the sky was like a bright blue sapphire, the sun was shining like a giant golden football... every single bud in their tiny orchard bloomed and birds started singing in the melodious possible tune... .. his answer was finally changed and he waited imlatiently for her to ask him the same question... he waited ... waited and waited....but she was no where to ask him the stupid question....

That day onwards... whenever he sees a lovely flower he says, "I love you" or he sees a chirping bird, a naughty squirrel, a beautiful butterfly... he says , "I love you... ."

#Aninditasblog
https://www.facebook.com/amianindita.blogspt.in/

Saturday 17 September 2016

অনির (পুজোর) ডাইরি ২০১৬, ১৭ই সেপ্টেম্বর


পুজো নিয়ে আমার উন্মাদনা বরাবরের, তারা সুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবনের এ সেকশন খুব ভালো ভাবেই পরিচিত ছিল সেই উন্মাদনার সঙ্গে। আর হবে নাই বা কেন মশাই? বিশাল যৌথ পরিবার, জেঠু, কাকু, দিদিভাই, তিন মাসি, বড়দা আর সবার ওপরে বাবা সব মিলিয়ে জামাই পেতাম গোটা দশেক। বাবার বোনাসটা গোটা টাই বোধহয় খরচ হত আমার পিছনে, কম করে পাঁচটা জামা তো দিতই বাবা। অগস্ট মাস নাগাদ বোনাস পেত বাবা, তারপর কোন একটা রবিবার দেখে সপরিবারে হামলা করতাম নিউ মার্কেটে। তখন কোথায় সুপার মার্কেট আর কোথায় মল। নিউ মার্কেট ছিল একাই একশ। কি না কেনা হত, কাপড় শুকানোর ক্লিপ,জামা, চুড়ি, হার, মাথার ক্লি্প‌, হেয়ার ব্যান্ড, ব্যাগ, জুতো ইত্যাদি ইত্যাদি। হাওড়া থেকে বাসটা যখন প্রেস ক্লাবের সামনে নামাতো, আনন্দে মনটা টলটলিয়ে উঠত। মনে হত জীবনের সব সুখ বোধহয় এখানেই লুকানো আছে। বাবার হাত ধরে অবাক বিস্ময়ে তাকাতে তাকাতে পার হয়ে যেতাম মনোহর দাস তড়াগ। ওপারে চৌরঙ্গী পেরিয়েই গ্র্যান্ড হোটেল। গ্র্যান্ডের তলা দিয়ে হাঁটাই দায় হত, এত ভিড় হত, আজো হয় হয়তো। থরে থরে ইংরাজি বই (আজ জানি যার অধিকাংশই পাইরেটেড কপি), ফ্লিম স্টারদের বড় বড় পোস্টার, ঢেলে বিক্রি হওয়া জামাকাপড়, সস্তা হাত ঘড়ি যার ডিজাইন যে কোন দামি ব্র্যান্ডকে টেক্কা দিতে পারে, তার সাথে মিশে থাকা রোল আর ধোসার গন্ধ। আহা! শেষের দিকে একটু মুস্কিল হত এই, যে নিউ মার্কেটের জামা আমার গায়ে আর গলত না।
যাক গে, সে দুঃখের কথা আর বলে কি হবে। মোদ্দা কথা হল পুজো এলেই আমার মনটা নেচে ওঠে, সাথে সাথেই নাচতে থাকি আমিও এবং নাচাতে মানে জ্বালাতে থাকি আমার সব বন্ধু বান্ধবদের। আমার একটা বিশেষ শখ আছে, সেটা হল, প্রতি বছরের একটা পুজো অ্যালবাম থাকবে, এবং তাতে আমার সব বন্ধুদের ছবি থাকবে। মাঝে মধ্যেই সেই অ্যালবাম গুলো আমি দেখি আর নস্টালজিয়ায় ভুগি। ফেসবুকে বিগত চার বছরের অ্যালবাম আছে, তার আগের চার পাঁচ বছরের অ্যালবাম অরকুটের সাথে সাথে উড়ে গেছে। সব বন্ধুদের এই অল্প সময়ে একত্রে এনে হাজির করা অসম্ভব। তবু চেষ্টা করি, অন্তত যারা কাছাকাছি আছে। এর জন্যও বিশাল পরিকল্পনা করতে হয়, কার কবে সময় হয়, কে কোথায় আসবে নাকি আমি যাব পুরো ছক কষতে হয়। অন্যান্য বছর এর মধ্যে আমার পুজোর অ্যালবাম তৈরি হয়ে গোটা পাঁচেক ছবিও লেগে যায়। এবার কিছুই করিনি। ইচ্ছেই হয়নি। একে তো বাড়ি শুদ্ধ লোকের অসুখ- বিসুখ গেল। তার ওপর আমার প্রিয় বন্ধুর সাথে মনোমালিন্য।
আঠাশ বছরের বন্ধুত্ব আমাদের। অন্তত হাজার খানেক বার বিচ্ছেদ হয়েছে আবার পুনর্মিলনও ঘটেছে। আমার একটাও অ্যালবাম নেই যেখানে সঞ্চিতার ছবি নেই। বিগত ষোল বছরে আমরা একে অপরকে ছাড়া ঠাকুর দেখতে বের হয়নি। একে অপরকে ছাড়া পুজো অকল্পনীয়। কি নিয়ে যে ঝগড়া সেটা বলে নিজেদের মানসিক নাবালকত্বের প্রমাণ দিতে চাই না। তবে আমাকে ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ সর্বত্র ব্লক করে দিয়েছিল শয়তানটা। এবারও পুজোয় হাওড়া যাব অথচ সঞ্চিতার সাথে দেখা হবে না? পঞ্চমীর দিন সারা রাত জেগে দক্ষিণের ঠাকুর দেখব না? আর ষষ্ঠীর দিন টোটো চেপে হাওড়া? আর সপ্তমীর দিন ফিস্ট? অষ্ঠমীর দিন আমাদের ত্রিভুজের তৃতীয় কোণ পম্পার সাথে দেখা হবে না? নবমীর দিন রাস্তার আধ পোড়া রোল আর ফুচকা হবে না? ধুস বেঁচে থেকেই আর লাভ নেই।
পুজোর আর তিন সপ্তাহও বাকি নেই, শপিং হয়েছে শুধু মাত্র তুত্তুরির আর আমার দুই বাবার তাও অনলাইন। মনের দুঃখে ঠিক করেছি এবার আর কিছু কিনবই না। শৌভিকও তাতে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে রেখেছে, “হ্যাঁ হ্যাঁ। তোর অনেক শাড়ি আছে। ওগুলো পড়িস। আর জামা কাপড় কিনলে এবার রাখার জন্যও আর একটা ফ্ল্যাট কিনতে হবে।” মনের দুঃখে একটা বিষণ্ণ, বিদঘুটে পুজো কাটাব মনস্থির করেই রেখেছি, এমন কি আনন্দমেলা ছাড়া কোন পূজাবার্ষিকীও কিনিনি। পুজোয় ই-বুকই পড়ব, যাঃ। তাও ইংরাজি।
সব যখন ঠিকঠাক, আজ সকালে সঞ্চিতার মেসেজ- “ভাব করবি?”
[চলবে গোটা পুজো জুড়ে। আশা করি ;) ]
#PujorDiary #AnirDiary
https://www.facebook.com/amianindita.blogspt.in/

Friday 9 September 2016

অনির ডাইরি ৯ই সেপ্টেম্বর ২০১৬


ঠিক তুত্তুরীর মতই ছোট থেকেই বৃষ্টি আমার ভীষণ প্রিয়। স্কুলের দিন গুলোতে ঘন কালো আকাশ, গুরুগুরু মেঘের গর্জন, ঝমঝমে বৃষ্টি, রাস্তায় জমে থাকা হাঁটু জল ছিল পুরো স্বর্গীয় ব্যাপার। কেন জানি না আমাদের ছোট বেলায় আমাদের মধ্য হাওড়ায় জল প্রায় জমতই না। যত টুকু জমত তাতেই ব্যাঙের মত থপাস থপাস করে লাফাতে লাফাতে বাড়ি ফিরতাম। বড় হবার সাথে সাথে নোংরা জমা জলের প্রতি মোহটা ক্রমশঃ কাটতে লাগল, পরিবর্তে অন্য একটা ব্যাপারে চুম্বকীয় আকর্ষণ তৈরি হল, সেটা হল একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত, যখনই বৃষ্টি পড়ত, মনে পড়ত, “এমনও দিনে তারে বলা যায়, এমনও ঘন ঘোর বরিষায়-।” আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, জীবনে কখনও না কখনও, কেউ না কেউ, কোন না কোন বর্ষার দিনে এই কথা গুলো অবশ্যই বলবে। সদ্য শৈশব কাটিয়ে তারুণ্যে পড়েছি, শরৎ চন্দ্রকে হঠিয়ে বুদ্ধদেব গুহ তখন আমার প্রিয়তম লেখক হয়ে উঠেছেন। কি যে পাগলের মত, ওনার সৃষ্ট ন্যাকা ন্যাকা, ওপর চালিয়াৎ, সফিস্টিকেটেড পুরুষ চরিত্রদের প্রেমে পড়তাম। উফ আজো মনে আছে, “অভি”, “শুভ্র” আর “পলু” এই তিন নায়ককে আমি দোলা আর সংযুক্তা আপসে ভাগ করে নিয়েছিলাম। আমার ভাগে কে পড়েছিল সেটা আর বলছি না।

যাই হোক, দেখতে দেখতে নব্বই এর দশক শেষ হয়ে এক বিংশ শতাব্দী এসে গেল, খুব দ্রুত বদলে যেতে লাগল সবকিছু। স্কুল কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে তীব্র জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হল, দোলা আর সংযুক্তা কোথায় ছিটকে গেল, বুদ্ধদেব গুহর হাত ছাড়িয়ে শিডনি শেল্ডন হয়ে ড্যান ব্রাউনের হাত ধরলাম, রবার্ট ল্যাংডনের প্রেমেও কিছুকাল হাবুডুবু খেলাম, কিন্তু কেউ কোন দিন, কোন বর্ষায় বলল না, “এমনও দিনে তারে বলা যায়, এমনও ঘন ঘোর বরিষায়-।” তীব্র রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে ওঠা, বাড়ির লোকও হঠাৎ করেই ভীষণ উদার হয়ে গেল, মুঠোর মধ্যে মুঠো ফোন ও এসে গেল, এবার তো বল? কেউ তো বল? শৌভিকের সাথে আলাপ, বন্ধুত্ব, ঘনিষ্টতা পর্ব পেরিয়ে দু-দুবার বিয়েও হয়ে গেল (ধর্ম সাক্ষী এবং অগ্নি সাক্ষী) কিন্তু কেউ বলল না। বিয়ের পর প্রথম বর্ষা, মাদপুরের নির্জন কোয়ার্টারে, কিন্তু বৃষ্টি শুরু হলেই শৌভিক কাঁদতে বসত, “এঃ আই হেট রেন।” এটাই ছিল আমার বরের বাঁধা গৎ। কারণ হল, বৃষ্টি মানেই বিডিও র কাছে বন্যার আগমনী, আর বন্যা মানেই আপদকালীন পরিস্থিতি, ত্রান, চিঁড়ে, গুড়, কাপড়, ধুতি, চাল, গামছা (জানি না এটা দেয় কিনা?) ত্রিপল বিতরণ। তাই নিয়ে রাজনৈতিক দল গুলির মন কষাকষি, ঝগড়া ঝাঁটি, ডি এম, এসডিও, রাস্তা অবরোধ ইত্যাদি ইত্যাদি। কাজেই অমন দিনে সে আমাকে এক কলি গান শোনাবে, এ প্রত্যাশা নেহাত বাতুলতা মাত্র ছিল।
বিয়ের পর দ্বিতীয় বর্ষায় তুত্তুরীর জন্ম। সে বর্ষায় মাতৃত্বকালীন অবকাশ যাপন কালে ঠিক করলাম, ঢের হয়েছে। আর কেউ বলবে না, ““এমনও দিনে তারে বলা যায়, এমনও ঘন ঘোর বরিষায়-।” কুছ পরোয়া নেই, কুয়ো মহম্মদের কাছে না এলে কি হবে? মহম্মদই কুয়োর কাছে যাবে। আমায় কেউ নাই বলুক আমিই বলব। কিন্তু কাকে? চোখ বন্ধ করলে প্রথমেই যার মুখ মনে ভেসে আসে, তাকে ফোন করতেই, সে নাকে কাঁদতে লাগল, “ এঃ আবার বৃষ্টি হচ্ছে। আজ বৃষ্টি না বন্ধ হলে---। এঃ আই হেট রেন।”
আরও বছর তিনেক কেটে গেছে, আমি এএলসি হিসেবে ট্রান্সপোর্ট বোর্ডে জয়েন করে গেছি, শৌভিকও বিডিও মগরাহাট ওয়ান হিসেবে বছর খানেক কাটিয়ে ফেলেছে। আমরা আলাদাই থাকতাম, আমি মেয়ে নিয়ে মা-বাবার কাছে, আর ও উস্থিতে বিডিও কোয়ার্টারে। এটা ভালো ব্লক, এখানে বন্যা বন্যা হত না। যাই হোক একদিন অফিস থেকে বেরিয়ে দেখি, আকাশ অন্ধকার, চার্চ লেন, কিরণশঙ্কর রায় রোড সব জল থৈথৈ। প্রবল বর্ষণে স্ট্রান্ড রোড স্তব্ধ, অবরুদ্ধ।চারপাশে অফিস ফেরতা লোকজনের চিৎকার, গাড়ি, ট্যাক্সির হর্ন, ধাক্কাধাক্কি সব ছাপিয়ে মনে হল, আজই সেই দিন, আজ বলতেই হবে। ফোন করলাম, ওদিক থেকে উত্তর এল, “একটু পরে করছি অ্যাঁ? এখন দোকান ভাঙছি?” এবার আমার অ্যাঁ বলার পালা। শৌভিক উত্তেজিত হয়ে হড়বড় করে বলল, “ আরে এখানে একটা খাল আছে, সেই খাল সব জবরদখল করে দোকান বানিয়ে ফেলেছে। ফলে আর জল যেতে পারছে না। শিরাকোল সংলগ্ন সমস্ত অঞ্চল কয়েক দিন ধরেই জলমগ্ন হয়ে আছে। আর আজকের বৃষ্টির পর তো হাল আরো খারাপ। এঃ আই হেট রেন।”
ফোনটা কেটে দেবার পর মনে হল, বলতেই হবে কথা গুলো, কিন্তু কাকে? এমন কাউকে যে এই কথা গুলোর যথার্থ মূল্য দিতে পারবে। দ্বিতীয়বার চোখ বন্ধ করতেই যার মুখ ভেসে এল সে আমার সহপাঠী দেবারতি। দেবাকে আড়ালে এবং প্রকাশ্যে আমরা খেপাতাম, রবি ঠাকুর ওরফে দাড়ি বুড়ো ওর ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে। দাড়ি বুড়োর যত কবিতা, যত গান দেবা জানে বা জানত তখন আমার চেনা পরিচিত কেউ জানত না। দেবাকেই ফোন করলাম, ও তখন রাজাবাজার সায়ন্স কলেজের মাইক্রোবায়লজি সেকশনের ল্যাবে সাংঘাতিক কিছু নিয়ে রিসার্চ করছে, যা আমার জ্ঞানবুদ্ধির বাইরে। দেবা ধরল, “ হ্যাঁ অনি বল।” ইতস্তস্ত করে বললাম, “দেবা, তোকে একটা কথা বলতে চাই। প্লিজ কিছু মনে করিস না, বাঁ আমায় পাগল ভাবিস না।” “উফ। অনি ভ্যান্তারা না করে বলে ফেল? কি বলবি?” বললাম, “ আমার আজন্ম শখ এমন কোন বর্ষার দিনে কেউ আমায় বলবে, ‘এমনও দিনে তারে বলা যায়, এমনও ঘন ঘোর বরিষায়-।’ আমায় তো কেউ বলল না, তাই আমি তোকে বললাম এই কথা গুলো। জানি এমন দিনে এর সঠিক মুল্য কেবল তুই দিতে পারবি।” দেবাকে এত বিগলিত হতে কখনও দেখিনি।
বলার ছিল, বলে দিলাম, কিন্তু মন ভরল কই? বিচ্ছিরি ঘেঁটে যাওয়া মুড নিয়ে বাসে চাপলাম, যানজটের জন্য বাসের যা গতি, তা শম্বুককেও লজ্জা দেবে, প্রায় পঞ্চাশ মিনিট কেটে গেল, অথচ বাস নিউসেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং এর সামনে থেকে নড়ে নড়ে বড় বাজার পৌঁছতে পারল না। বৃষ্টির জন্য জানলাও বন্ধ করে দিতে হয়েছে, তেঁতো মুখে বসে আছি, শৌভিকের ফোন, ধরতেই বিগলিত গলায় বলল, “ ইয়েস? ইউ ওয়ার সেইং?” নিমপাতা চিবানো স্বরে বললাম, “ছাড় না। তোর শোনার সময় নেই, যখন আমি অন্য কাউকে বলে দিয়েছি।” শৌভিক জিজ্ঞেসও করল না, কি কথা, উল্টে বকবক করতে লাগল, “ উফ যা গেল না আজকের দিনটা। ফুল অন মস্তানি। সোজা কন্ট্রাক্টরকে বললাম, বুলডোজার নিয়ে আয় আর ভেঙে দে সব। সেই সকাল থেকে চলছে ভাঙাভাঙি। সকাল থেকে দাঁড়িয়ে আছি এখানে। হ্যাঃ। কতজন এসে বলে গেল, স্যার আপনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ভাঙলেন তাই-।” নিরাসক্ত ভাবে বললাম, “বাঃ।” শৌভিক পাত্তাও দিল না, “না ভাঙলে এখানেও বন্যা পরিস্থিতি হত। যাকগে তা কি বললি? বলেই যখন দিয়েছিস, আর একবার বলতে বাধা কি?” পাশের ভদ্রমহিলার বিকট হাই তোলা দেখতে দেখতে রিডিং পড়ার মত বললাম, “এমনও দিনে তারে বলা যায়, এমনও ঘন ঘোর বরিষায়-।” শৌভিক শুনে হেঁহেঁ করে হাসল, এই হাসিটা ও শুধু আমার আর তুত্তুরীর সামনেই হাসে, আমি ফোনের এপাশ থেকেও অনুভব করলাম। তারপর বলল, “ হ্যাঁ তো। যাক আমি যাই, আবার গিয়ে দেখি ভাঙচুর কতটা এগোল। তুই সাবধানে বাড়ি যা, বুজুর (তুত্তুরী) কাছে। রাতে ফোন করব।” আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, “কাকে বলেছি সেটা জানতে চাইবি না?” ও হেসে বলল, “আমি জানি। বুড়োর দাড়ি চিবানোর লোক তোর একটাই। এখন ছাড়ি? রাতে শুনব দেবারতি কি বলল।”
https://amianindita.blogspot.in/

Friday 2 September 2016

বেরিয়ে পড়লাম যশোধরা,

বেরিয়ে পড়লাম যশোধরা,
অকাতরে ঘুমোচ্ছ তুমি,এই তো সুযোগ। 
নিঃশব্দে আলমারি খুলে বার করে নিলাম ,
এখনও না খরচা হওয়া সংসার খরচের কটা টাকা। 
ব্যাগে গুছিয়ে নিলাম সামান্য কটা জামা,
বেরিয়ে পড়লাম যশোধরা, আমি আর ফিরব না।
ভোরের হাওড়া স্টেশন, টিকিট কাউন্টারের জানলা দিয়ে বাড়িয়ে দিলাম হাত,
একটা টিকিট দিন তো, সবথেকে দূরের একটা টিকিট- 
পাগল ঠাওরালো কি না জানি না, ছুঁড়ে দিল একটা টিকিট, 
বদলে খরচা হয়ে গেল কড়কড়ে দুশো টাকা।
না জানি কতক্ষণ ধরে ছুটেছে ট্রেনটা, আচমকা ক্লান্ত হয়েই বুঝি দাঁড়িয়ে পড়ল। 
মুখ বাড়িয়ে দেখি একটা ছোট্ট স্টেশন,
লাল কাঁকড় মাটির প্লাটফর্ম, দূরে একটা শিমুল গাছ রক্তবর্ষণ করছে। 
বুঝলাম, এটাই আমার গন্তব্য।
আধা গঞ্জ, অদূরেই একটা ছোট নদী ছলাৎ ছলাৎ । 
নীল আকাশ, সোনা রোদ, তপ্ত মাটির গন্ধ ওলা বাতাস, 
লেখাপড়া না জানা কালোকোলো খেটে খাওয়া মানুষজন। 
সব ছাপিয়ে বড় কষ্ট, বড় কষ্ট, তোমার জন্য যশোধরা। 
কি করবে তুমি? সবকটা টাকা তো আমার কাছে-
সংসার চলবে কি করে? আর তোমার পেটর ভ্রূণটা?
মাটি মাখা উলঙ্গ শিশুগুলো যে হঠাৎ মনে করিয়ে দিল তার কথা।
কি করলাম। এ আমি কি করলাম। 
ভাঙাচোরা ওভারব্রীজে হাঁটু মুড়ে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি আমি। 
এখানে কেউ বাংলা বোঝে না, কেউ এগিয়ে আসবে না সান্তনা দিতে। 
কি করলাম? এ আমি কি করলাম?
একটা উষ্ণ হাতের স্পর্শে চমকে উঠে দেখি,
বৃদ্ধ স্টেশন মাস্টার, সস্নেহ বললেন,“লওট যা বেটা। রাত পৌনে দশটার ট্রেন কলকাত্তা যায়। 
লওট যা।
প্রচণ্ড শীত, আলোয়ান মুড়ি দিয়ে অপেক্ষা করছি,
ঐ আসছে আমার ট্রেন, এক দুর্দম রাক্ষসের মত, ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। 
তোমার কাছে যশোধরা। 
কি যে হল, চলন্ত ট্রেনের সামনে ছুঁড়ে দিলাম আমার অন্তিম বাঁধন। 
বাঁধন ছেঁড়া বিবাগী আমি। 
ফিরব না আর যশোধরা। 
আমি আর ফিরব না। 


ফেবু


রবিবার সকাল আটটা, আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে, ফুল স্পিডে ফ্যান এবং এসি চালিয়ে আরাম করে ঘুমোচ্ছিল রাই, আচমকা মুঠো ফোনের তীব্র আর্তনাদে ধড়মড়িয়ে উঠে দেখে বাবার ফোন। হ্যালো? হ্যালো? বাবা? কি হয়েছে? অ্যাঁ? মা- তুমি- পিসি সব ঠিক আছ তো? এত সকালে কি ব্যাপার?” ওপাশ থেকে অসহিষ্ণু গলায় বসন্ত বাবু বলে উঠলেন, “ ফাইন। ফাইন। অল ইজ ওয়েল। তোমার গর্ভধারিণী এখনও শয্যা ত্যাগ করে উঠতে পারেননি। আর পিসি বুধুয়া মেথরকে দিয়ে নর্দমা সাফ করাচ্ছে। সকাল থেকে এক কাপ চাও জোটেনি এই বৃদ্ধের। ” “তবে?” হতভম্ব হয়ে বলল রাই।
বসন্ত বাবু হড়বড় করে বললেন,“ আরে কাল থেকে কি যে হয়েছে কিছুই খুলছে না? খালি গোল গোল হয়ে ঘুরেই যাচ্ছে।হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না রাই। কাল থেকে বাবার ফোনে নেট কাজ করছে না, এটাই হল সমস্যা। দোষ সম্পূর্ণ রাইয়ের, সত্তরোর্দ্ধ বৃদ্ধ পিতার হাতে স্মার্ট ফোন ঐ তুলে দিয়েছে। আসলে কাকা, জেঠু, মামা, পিসেমশাই সবাই মারা গেল এক এক করে। বাবার বন্ধুরাও এক এক করে পরলোকে পাড়ি দিতে লাগল। ভীষণ একা হয়ে যেতে লাগল বাবা। মা- পিসির তাও টিভি সিরিয়াল আছে। বাবা কি নিয়ে থাকবে? সকালটুকু প্রাণায়াম আর কাগজ পরে কেটে যায়। দুপুর থেকে সময় আর কাটতেই চায় না। দোকান বাজার ও আজকাল আর যেতে পারে না স্বাস্থ্যের কারণে। বাগবাজারে ওদের বিশাল সাবেকী বাড়ি। রাইয়ের বৃদ্ধ প্রপিতামহের বানানো। মূল ভিটেটা প্রপিতামহের আমলে দুভাগে ভাগ হয়ে পার্টিশন হয়ে গিয়েছিল। রাইয়েরা ছোট তরফ। বড় তরফের সঙ্গে মনোমালিন্য বিগত একশ বছরেও মেটেনি। এখনও দুতরফের কিছু মামলা মোকদ্দমা বিভিন্ন আদালতে ঘুমিয়ে আছে। রাইয়ের বাবা বাদে অন্য ভাইয়েরা কবেই মারা গেছে। রাইয়ের খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোনেরাও কেউ আজ কলকাতায় নেই। বাবা একাই লড়ে যাচ্ছে সম্পত্তি নিয়ে। মাঝে বাবা এতটাই হতাশ হয়ে পড়েছিল যে দিবারাত্র মৃত্যুচিন্তা করত। বাবাকে সেই হতাশা তথা নিঃসঙ্গতা থেকে বাঁচানোর জন্যই রাই বাবার হাতে স্মার্ট ফোন তুলে দিয়েছিল। বেশি কিছু নয় শুধু ফেসবুক।
ফেসবুক প্রথম দিকে কিছুই বুঝতেন না বসন্ত বাবু। রাইই বেশ কিছু পরিচিত তথা আত্মীয় স্বজনের সাথে ফ্রেন্ডশিপ পাতিয়ে দেয়। একটু হাতবশ হবার পর নিজে নিজে খুলতে শিখে ভেবলে যান প্রবলপ্রতাপ বসন্তদূত বন্দোপাধ্যায়। এরা কারা? ভাগনে পটাই, প্যাংলা, আজন্ম নাক দিয়ে সর্দি গড়াত, মেজ মামার ভয়ে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলত, সে ওণাকে ফেসবুকে সম্বোধন করে মামুজান বলে। আর কি সব ছবি পাঠায়? লাল হাফপ্যান্ট হলুদ গেঞ্জি - ঈশ জাত ঘটির ছেলে হয়ে শেষে লাল হলুদ? আর ভাইঝি মামনি? সে নাকি প্রাউড লেসবি। বিদেশ থেকে নিজের লিভ ইন গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে যে সব ছবি পাঠায় তা সেন্সর্ড হওয়া আবশ্যক। ওণাদের যুগেও হোমো লোকজন ছিল, কিন্তু তারা এসব লুকিয়ে চুরিয়ে চালাত। প্রকাশ্যে রামঃ। আর ওণার আদরের বুল্টি ওরফে রাই? হায়দ্রাবাদে গিয়ে কি হয়ে গেছে মেয়েটা? কি সব পোশাক পরে? প্রকাশ্যে মদ্যপান করে, বিড়ি ফোঁকে, অন্য পুরুষবন্ধুদের জড়িয়ে ছবি তোলে। সে ছবি কে তুলে দেয়? না ওণার আদরেরে জামাই। উচ্ছন্নে গেছে এই জেনরেশন। প্রথম দিকে এই নিয়ে বলতে গিয়ে ব্যাপক ঝাড় খেয়েছিলেন বুল্টির কাছে। আজকাল আর কিছু বলেন না, শুধু স্যাড বা অ্যাঙরি ইমোজি পাঠান।
কি ভাবে জানি না, পাড়ার লোকজনও জেনে গেছে বসন্তদূত বাবু ফেবু তে আছেন আজকাল ভুরি ফ্রেন্ডরিকোয়েস্ট আসছে।বাজারওলা, মাছওলা, পেপারওলা, দুধওলা থেকে মায় যে ছেলেটি বাড়ি এসে চুল দাড়ি কেটে দিয়ে যায়। সবাইকেই অ্যাকসেপ্ট করেন বসন্ত বাবু। ফেবুতে উনি কিছু লিখলেই এদের অনেকেই লাইক করে। আর লাইক পেতে কে না ভালবাসে। কথাও হয় ফেবুতে, কিছু দরকারী কিছু অদরকারী।
কাল বিকালে একটা ফ্রেন্ড রিকয়েস্ট পেয়ে চমকে গেছেন উনি। বন্দোপাধ্যায় বাড়ির বড় তরফের বিধবা বড় বধু নিভাননী ওণার বন্ধু হতে চেয়েছেন। বড় তরফের সাথে ওণাদের মুখ দেখাদেখি বহু দিন বন্ধ। নিভার সাথে জীবনে একবারও বার্তালাপ হয়নি ওণার। দেখা হয়েছে বেশ কয়েকবার আদালত চত্বরে, নিভার বরটা ন্যালাখ্যাপা ছিল। দেখা হলে হাসার চেষ্টা করত, নিভার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই গোমড়া হয়ে যেত। বসন্ত বাবুর কেমন যেন ধারণা ছিল নিভা ওঁকে সইতে পারেন না। একাধিক ব্যক্তির কাছে নিভা ওঁর নামে বিষোদ্গার ও করেছিলেন। তবে? দোনামোনা করে অ্যাকসেপ্ট করেই নিলেন বসন্ত বাবু। তৎক্ষণাৎ মেসেজ এল, “বন্ধুত্বের হাত ধরার জন্য ধন্যবাদ। হৃদপিণ্ডকে ধমকে গতি কমাতে বলে বসন্ত বাবু লিখলেন, “অবাক হয়েছিলাম। মিথ্যা বলব না। ” “কিন্তু কেন? আমরা কি বন্ধু হতে পারি না?তুমি তো কোনদিন এগিয়ে এলে না, তাই অগত্যা আমাকেই--আধ ঘন্টা ধরে ভেবে লম্বা উত্তর লিখলেন বসন্ত বাবু কিন্তু মুখপোড়া হারামজাদা ফোন ফেসবুকটাই খুলছে না গো? সারা রাত ঘুমোতে পারেননি। কি যে হয়েছে ফোনটার কিছু বোঝেন ও না ছাই। সকাল হতেই বুল্টির দ্বারস্হ হয়েছেন, ফোনটা ঠিক করে দে মা। বহু বছর ধরে একজন জবাবের প্রতীক্ষায় আছে আর একজন ব্যগ্র হয়ে আছে জবাব দেবার জন্য। প্লিজ বুল্টি হেল্প।