ঈশাণ সপ্তম শ্রেণীতে উঠেছে । ওকে নিয়ে দীপক আর মিলির
সুখের সংসার। মিলি স্কুলে পড়ায়, রায়চৌধুরী বাড়ির প্রথম চাকুরিরতা বধূ । ছিপছিপে, লম্বা, প্রকৃত গৌরবর্ণা। দিব্যি শ্বশুর
শাশুড়ী নিয়ে সংসার করছে। আত্মীয় স্বজনের চোখে আদর্শ পুত্রবধূ ।
কিন্তু এই
গণ্ডী ছাড়ালেই, না না গুজব শোনা যায়। বন্ধু
বান্ধবই বলুন বা সহকর্মী সবাই দুদলে বিভক্ত
। একদল মিলির কৃপাপ্রার্থী। বা সোজা কথায় প্রণয়প্রার্থী।
অপর পক্ষ অবশ্যম্ভাবী তারা যাদের প্রতি মিলি
আর সদয় নয়, বা কখনও সদয় ছিল না। এ পক্ষে মহিলাদের সংখ্যা একটু বেশিই। মিলি অবশ্য তার
কোন প্রণয়প্রার্থীকে চট করে অবহেলা করে না। মেলামেশা, ফেসবুক, হোয়াট্স্ অ্যাপ, কফিশপ্,
উপহার গ্রহন করে কৃতার্থ করে দেয়। তবে ঐ টুকুই। শরীরগন্ধী প্রেমালাপ চলতেই পারে,তবে বন্ধ দরজার
ওপারে যাবার মত সৌভাগ্য কারোরই হয়নি। শুধু স্কুলের সুতপার দাদার বন্ধুর, বন্ধুর বন্ধু নাকি এই বিরল সুযোগ পেয়েছিল। শোনা যায় সেই ভদ্রলোক মিলি তে এতই মোহিত হয়েছিলেন, যে নিজের স্ত্রীকে ছাড়তেও রাজি ছিলেন। মিলি নাকি তার কাছে দীপককের নামে যাতা বলেছিল। দীপক নাকি যৌনশীতল। দাঁড়ান মশাই, এ সব সুতপার অপপ্রচার
হলেও হতে পারে। সুতপাও ডাকসাইটে রূপসী। প্রতিদ্বন্দ্বিতা
অবশ্যম্ভাবী। দীপক যৌনশীতল হলে ঈশাণ জন্মাল কি করে? এত লম্বা চওড়া সুদর্শন পুরুষ। মানছি একটু ভুঁড়িদাস । কিন্তু ওটা আভিজাত্যের
চিহ্ন। রাণাঘাটের বিখ্যাত রায়চৌধুরী বাড়ির রক্ত আছে মশাই। সত্যি কথাটা হল মিলির হিংসুটে মহিলা সহকর্মীনীরা দীপককে নপুংসক, লোচ্চা ইত্যাদি
ভেবে এবং আলোচনা করে ধর্ষকাম আনন্দ পায়। দীপকটা কি? বউ এর বহুগামিতা কি আন্দাজ করতেও
পারে না। কিন্তু মুস্কিল হল, দীপক ঠিক কি তা
জানা ঐ মফঃস্বলের শিক্ষিকাদের পক্ষে সহজ না।
দীপক সেক্টর ফাইভের নামকরা আধা বিদেশী কোম্পানির দামী ইঞ্ছিনিয়ার।
দীপককে কি মিলিও বোঝে? পনেরো বছরের বিবাহিত জীবন
এক কথায় “পিকচার পারফেক্ট”। দীপকের বাবা মা অনেক দেখে শুনে মিলিকে পুত্রবধু করে এনেছিলেন। ওঁনারা কখনই চাননি বাড়ির বউ উপার্জন করতে বেরোক। প্রয়োজনটাই বা কি? কিন্তু দীপক চেয়েছিল। শুধু মৌখিকভাবে চাওয়া নয়, নিরন্তর
অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। চাকরির পরীক্ষাই
হোক বা ইন্টারভিউ, মিলির সঙ্গ দিয়েছে। হ্যাঁ কাব্যিক প্রেম ওদের মধ্যে কখনই ছিল না। বন্ধুত্বের বন্ধন এত দ্রুত এত প্রগাঢ় হয়ে উঠেছিল
যে বেচারা প্রেম অনুপ্রবেশ করার সুযোগই পায়নি।
দীপক মিলির সব গূঢ় রহস্য জানে। মিলি নিজেই বলে।
দীপক মনোযোগী শ্রোতা। দীর্ঘদিন কোন প্রেমিকের
নাম না শুনতে পেলে, দীপক খোঁচায়, “ কি হল মিলি? ঐ বেচারা কবে কৃপাধন্য হবে?”
একবারই
এক প্রেমিকের সাথে কিছুটা ঘনিষ্ঠতা বাদ দিলে,
শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে মিলি বেশ রক্ষণশীল । যদিও দীপক বারবার বলে ,“দেহ
বিবর্জিত পরকীয়া প্রেম হল কাঁঠালের আমসত্ত্ব।
কোন গাধা বিনা প্রলোভনে তোমার নকরা সইবে?”
শুরুতে মিলি বিশ্বাস করত না। এই গদগদ প্রেম , সীমাহীন মুগ্ধতা , স্তাবকতা এসব কি শুধুই এই দেহের জন্য। কিন্তু জীবন বড় নির্দয়
। ঠেকে শিখেছে মিলি, মুখে যতই স্বপ্নিল প্রেমের বুলি থাকুক না কেন, পরকীয়াচ্ছুক পুরুষদের
প্রকৃত উৎসাহ কেবল মাত্র শরীরকে ঘিরে। মিলির আপাত রক্ষণশীল মনোভাব, তাদের পর্যায়ক্রমে
হতাশ, ক্ষুব্ধ এবং বিরক্ত করে তোলে। আবেদন
নিবেদন বিফল হলে পালিয়ে বাঁচে। নামমাত্র কারণ দেখিয়ে সম্পর্কচ্ছেদ করে। প্রথম
পরকীয়ার বেলায় মিলি মানসিক ভাবে এতটাই বিপর্যস্ত
হয়ে পড়েছিল যে নাকখৎ দিয়ে তাকে ফিরিয়ে এনেছিল। তার মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য সব ইনহিবিশন ত্যাগ ওরা
বন্ধ দরজার ওপারে মিলিতও হয়, ব্যাপারটা আদপে অনুপভোগ্য ছিল না, কিন্তু চরম ব্যাপারটিতে
মিলি রাজী হতে পারেনি। ওর উপরোধে লোকটি যে
ওকে নিষ্কৃতি দিয়েছিল, সে কৃতজ্ঞতা মিলি আজও ভোলেনি। অতঃপর মামুলী চুম্বন আর সেক্সটিং
অবধি মিলির দৌড়।
সেই ঘটনার পর চূড়ান্ত অপরাধ বোধে মিলি দীপককে সব খুলে বলতে গিয়েছিল, দীপক কর্ণপাত
করেনি। উল্টে আলিঙ্গন করে বলেছিল, “ বয়স হয়ে যাচ্ছে মিলি। এ সুযোগ বেশিদিন আর পাবে না। আগেই বলেছি আমার কিচ্ছু
যায় আসে না। বাট্ প্লিজ্ ইউজ আ কনড্ম । কার
কি অসুখ আছে ---” ।
এহেন দীপক আর মিলির শান্ত, সুখী গৃহকোণে যে তুফান উঠেছে তার জন্য দায়ী শুধু
একজন, তাঁর নাম মার্ক জুকারবার্গ। না উনি এই “আনন বই” রচনা করতেন, না কাতারে কাতারে
বুভুক্ষু নরনারীর দল এতে ভিড় জমাতো। ওসব আলো না আঁধার কার্ড ছাড়ুন মশাই , আপাতত ফেসবুকই
আমাদের সামাজিক পরিচয় পত্র । আপনি এফ বি তে
অনুপস্থিত? সেকি মশাই ? “ ভূতের ভবিষ্যৎ ” এ ভূতেরাও অবধি তাদের সোশাল নেটওয়ার্ক “স্পুকবুক
” এ অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলেছিল, আর আপনি কি তালেবর মশাই ? যান, বরং ভীমবেটকার গুহায় গিয়ে
থাকুন ।
দীপক কিছুতেই এই তথাকথিত লেজকাটা শেয়ালদের দলে নাম লেখাবে না, মিলিও নাছোরবান্দা।
আরেঃ এটা হল, যাকে বলে “ম্যাটার অব সোশাল স্টেটাস্।
” মিলির বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় পরিজন, সহকর্মী , সহযাত্রী ছাড়ুন পুঁচকে ঈশান এবং তার বন্ধুরা পর্যন্ত আছে এফ বি তে, নেই
শুধু দীপক। সবাই মিলিকেই তো প্রশ্ন করে। কেউ কেউ ঠারেঠোরে একথাও বলেছে যে, মিলির এই
ফেসবুক প্রেম সহ্য করতে পারে না বলেই দীপক এই ভেড়ার পালে নাম লেখাতে অনিচ্ছুক । কথাটা কানে আসা ইস্তক
মিলি অগ্নিশর্মা । যত রকম প্রলোভন সম্ভব- ফ্রী গেমস্, উঠতি কবিদের টাটকা কবিতা থেকে
সরিতা ভাবীদের ঠসক্ সব ব্যর্থ । মিলি এও বলেছে
যে ফেসবুকে ঢুকলেই দীপক তার হারিয়ে যাওয়া রাণাঘাট হাইস্কুল আর শিবপুর বিই কলেজের বন্ধুদের
খুঁজে পাবে, তাতে আরো আতঙ্কিত দীপক । দীপক ভয়ানক অসামাজিক । শুনলে চমকিত হবেন কেবলমাত্র অমিয়া ছাড়া দীপকের আর
একটিও বন্ধু নেই।
অমিয়া
দীপকের সহকর্মী । প্রায় বিশ বছর আগে যাদবপুর
থেকে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ এ বাছাই হয়ে অমিয়া ওদের অফিসে যোগ দেয়। ওর প্রথম অ্যাসাইনমেন্টে
দীপক ছিল অমিয়ার টিমলিডার। বন্ধুত্ব জমতে সময় লাগেনি। সেই সম্পর্ক আজো টিকে আছে। স্বভাবের দিক দিয়ে অমিয়া একেবারে দীপকের বিপরীত।
দিলখোলা , সাহসী ঋজু ,স্পষ্টবাদী অমিয়া যাকে
বলে টমবয়।
মিলি
ছাড়া শুধু অমিয়ার কাছেই দীপক অকপট । বরং মাঝেমাঝেই মিলির মনে হয় দীপকের অন্তঃপুরে অমিয়ার
প্রবেশ অবাধ হলেও মিলির নয়। কোথাও একটা অদৃশ্য ঘর আছে, যেখানে মিলি কখনই প্রবেশের অনুমতি
পায় না। মিলি ঘরটাকে খোঁজার আপ্রাণ চেষ্টা
করেও ব্যর্থ হয়। এনিয়ে কিছু বলতে গেলে দীপক হেসেই উড়িয়ে দেয়। মিলি অনুভব করে ঘরটা আছে। মিলি এও জানে যে ঘরটার অস্তিত্ব সম্পর্কে অমিয়া
অবহিত। অমিয়া মিলিকে অসম্ভব স্নেহ করে। মিলি জিজ্ঞাসা করলে মিথ্যা বলতে পারবে না। কিন্তু
তাহলে দীপকের বিশ্বাসভঙ্গ হবে, যা মিলি কখনই
চায় না। দীপকের একমাত্র বন্ধু তথা বান্ধবী যদি দূরে সরে যায় বড় নিঃসঙ্গ
হয়ে পড়বে ওর দীপক। তাই মিলি আর আজকাল এসব নিয়ে
ভাবে না। আর তাছাড়া মিলিরও কিছু গোপন কথা আছে যা দীপক জানে না। বিয়ের পূর্বে শান্তিপুরের মেয়ে মিলি সেনকে তার প্রথম
প্রেমিক ত্যাগ করেছিল, গাঁইয়া বলে। আর লেডি ব্রেবোর্ণে পাঠরতা মিলিকে তার দ্বিতীয় প্রেমিক ডাম্প করেছিল কারণ ও নাকি যথেষ্ট রূপসী
ছিল না। আমাদের মিলি রায়চৌধুরী, এই চল্লিশ
বছর বয়সেও যার অগুনতি স্তাবক আর প্রণয়ী মাছির মত ভনভন করছে, সে নাকি যথেষ্ট রূপসী ছিল
না! লক্ষ লক্ষ রূপের প্রশংসা শুনেছে মিলি, রোজই শোনে, একান দিয়ে শুনে, ঐ কান দিয়ে বার
করে দেয়। কিন্তু ঐ অপমাননা আজো কুড়ে খায় ওকে। ভুলতে পারে না মিলি।
যাই হোক
দীপকের কথায় ফিরে আসা যাক। মিলির অবাক লাগে দীপকের কেন আর একটাও বন্ধু নেই। স্কুল কলেজের কারো সাথে নূন্যতম যোগাযোগটুকুও নেই
ওর। অবশ্য রাণাঘাট হাইস্কুল থেকে পাশ করে শিবপুর
বিই কলেজ, মাঝে কিছুদিন বিদেশে কাটিয়ে গল্ফগ্রীনের ডুপ্লেক্স। ফলে বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ
না থাকার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছুই নেই। আশির দশকের অন্তে বা নব্বই এর শুরুতে যোগাযোগব্যবস্থার
এই উন্নতি কষ্টকল্পনা ছিল মাত্র । যাই হোক অনর্গল দাম্পত্য কলহে উত্যক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত দীপক অনুমতি দিতে
বাধ্য হয়। “ খুলে দাও। তবে অপারেট করার মত
বাজে সময় আমার নেই। তুমিই কোরো। ” এই ভাবেই শ্রী দীপক রায়চৌধুরীর ফেসবুকে
পদার্পণ । পরম যতনে এ্যাকাউন্ট খুলতে বসে মিলি,
দীপকের স্কুল , কলেজ, ইয়ার অব্ পাশআউট সব সঠিক তথ্য দিয়ে। কিন্তু প্রবল আপত্তি করে দীপক। অবশেষে
কেবল নাম, ছবি আর জন্মদিন দিয়েই এ্যাকাউন্ট খোলা হয়। প্রথম বন্ধু
যথারীতি মিলি এবং অমিয়া। ধীরে ধীরে বন্ধু সংখ্যা বাড়তে থাকে। অধিকাংশই দীপকের সহকর্মী , মিলি বা দীপকের আত্মীয়
স্বজন, প্রতিবেশী । রাতে দীপক বাড়ি ফিরে গা-
হাত- পা ধুয়ে, ঈশাণের সঙ্গে সময় কাটিয়ে, বাবামার কুশল সংবাদ নিয়ে যখন এসি চালিয়ে বই
নিয়ে বসে, তখন মিলি ওর ল্যাপটপে দীপকের অ্যাকাউন্টটা খোলে। নতুন যারা বন্ধুত্বের হাত বাড়ায়, তাদের মধ্যে মিলির
পরিচিত লোক গুলিকে ও বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করে নেয়, অচেনা হলে দীপককে জিজ্ঞাসা করে। দীপক চিনলে ভাল, নইলে তৎক্ষণাৎ নাকচ । সেদিনও মিলি তাই করেছিল। কিন্তু দীপক কোন উত্তর না দিয়ে কেমন বোবা ঘোলাটে
দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। বিরক্ত হয়ে মিলি গলার
আওয়াজ তুলল,“ দীপক ? দীপ? কি করব?”
মহাশূন্য
থেকে যেন ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে এল,“ কি করবে?”
“ধুৎ এ্যাকসেপ্ট করব কি না? তোমাদেরই স্কুলের প্রাক্তণী?
ইমন কি যেন? অ চৌধুরী। চিনতে একে? ”
বিমর্ষ
ভাবে মাথা নাড়ে দীপক । “তবে? ডিক্লাইন করি?”
“ নাঃ। থাক। পরে
দেখছি। হয়তো চিনতাম বা না। ” ক্লান্ত ভাবে
সাড়া দেয় দীপক ।
“দীপক শেষে তুমি! ” মিলির আওয়াজ শুনে কেমন যেন আঁতকে উঠল দীপক। ধড়াম করে ল্যাপটপ
বন্ধ করে পিছন ফিরে দেখে মিটিমিটি হাসছে মিলি, হাতে চায়ের ট্রে। বিছানায় ট্রেটা নামিয়েই মিলি বলে উঠল,“তা কি দেখছিলে
শুনি তন্ময় হয়ে? সরো সরো দেখি। ” দীপককে ঠেলে
সরিয়ে ল্যাপটপ কোলে নিয়ে ডালা খোলে মিলি,“ হুঁ।
ইক্ শেষে ইমন চৌধুরী? আমি ভাবলাম সানি-” বলে চোখ টেপে মিলি। দীপকের মুখ মৃতের মত অভিব্যক্তি শূন্য । খেয়াল না
করে বকেই চলে মিলি। “ কি দারুণ দেখতে গো। এই বল না, এ তোমার সাথে পড়ত? ইয়ার অব পাশ
আউট তো দেখছি একই। ” দীপক নিরুত্তর। “ এই। এ্যাকসেপ্ট করে নিতে দাও না প্লিজ্। নাহলে আমি রিকোয়েস্ট পাঠাই কি করে?” আদুরে গলায়
মিলির কথা মাঝপথেই থেমে যায়। দীপক অকস্মাৎ
ল্যাপটপের ডালা ঝপাৎ করে বন্ধ করে বজ্র
কঠিন স্বরে জিজ্ঞাসা করে,“ও আমায় খুঁজে পেল কি করে? ”
“কে?”
“রোজ ৫/৬টা করে রাণাঘাটবাসী আমায় রিকোয়েস্ট পাঠাচ্ছে।
সাথে সাথে গাদা গাদা মেসেজ। ”
ঘাবড়ে
গিয়েও ওষ্ঠে হাসি লেগে থাকে মিলির,“ এফ বি
তে একটা রাণাঘাটবাসীদের কমিউনিটি আছে। মাস
খানেক আগে তোমাকে তার মেম্বার করে দি- ” কথা শেষ করতে না দিয়ে গর্জে ওঠে দীপক, “হাউ
ডেয়ার ইউ! আমাকে না জিজ্ঞাসা করেই?” দীপক রায়চৌধুরীর আদুরে বউ এর চোখ ছলছলিয়ে ওঠে।
কোনমতে কান্না চেপে কিছু বলতে যায়, দীপক কর্ণপাত করে না। মুখ লাল করে চিৎকার করে ওঠে,“ ডিলিট ইট। নাউ। ” মিলি হতবাক হয়ে যায়। বিগত এক মাস ধরে বহু লোক দীপকের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে, তার মধ্যে রাণাঘাটের লোক কম
নেই, তাহলে? কে এই ইমন, যার জন্য দীপক এত অশান্ত হয়ে পড়েছে। কোনমতে মিলি বলে,“দীপ। অনেক যত্নে তোমার এ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিলাম। ”
“করবে? না অমিয়াকে বলব?”
“ করছি”
চোখের জল মুছে বলল মিলি।
মিলির
ঔৎসুক্য বাড়তেই থাকে। কাকে জিজ্ঞাসা করা যায়?
অমিয়া নিশ্চিত জানে না। ব্যারাকপুরের মেয়ে আর দীপকের সাথে কলকাতায় আলাপ। শ্বশুর শাশুড়ি
অবশ্যই জানবেন। তবে উগ্রচণ্ডা শ্বশুরকে মিলি এড়িয়ে যায়। ভীষণ কটুভাষী ভদ্রলোক। মিলিরা যখন বিদেশ থেকে
ফিরে সবে এই ডুপ্লেতে থাকতে শুরু করে, উনি একবার সিকিউরিটিকে নির্দেশ দেন, কোন রাণাঘাটের
লোক যদি ওণাদের খুঁজতে আসে, তাকে যেন তৎক্ষণাৎ অর্ধচন্দ্র দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। তখন খুব হাসি পেয়েছিল , আজ যেন ভাবতে বসলে কেমন
অন্যরকম লাগে মিলির।
সময় মত শাশুড়ীকে পাকড়াও করল মিলি। দীপকের মা সহজ সরল মাটির মানুষ, সদাহাস্যময়ী। মিলি প্রথমেই জিজ্ঞাসা করল, “মা রাণাঘাটের ওপর এদের
এত রাগ কেন গো?” ভদ্রমহিলার মুখ দেখে মিলি
বুঝতে পারল উনি কিছুই জানেন না। একটু দম নিয়ে
মিলি আবার জিজ্ঞাসা করে, “মা, তুমি ইমনকে চেনো?”
অল্প চমকে উঠে তড়িঘড়ি মুখোশ পরতে সচেষ্ট হন ভদ্রমহিলা, “হ্যাঁ । ঐ আরকি ভাল চিনি না। বুবালের সাথে পড়ত। ” বুবাল
অর্থাৎ দীপক। অতিরিক্ত সরলতার জন্য এই মুখোশ
পরার অপচেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। যে ভদ্রমহিলা রোজ একটু করে অ্যালজাইমারের শিকার
হয়ে চলেছেন, মিলির নামটাও অর্ধেক সময় উনি ভুলে
যান, তার ইমনের কথা মনে থাকার পিছনে নিশ্চিত কোন গূঢ় কারণ আছে।
রহস্য আছে এতো জানা গেল। সমাধান হবে
কি করে। দীপক সেদিনের পর থেকে গুম মেরে আছে। চরম উদাসীন সব ব্যাপারে । মিলি অনেক ভেবে ঠিক করল একবার অমিয়াকে জিজ্ঞাসা
করে দেখা যেতে পারে। কিন্তু দীপককে টপকে অমিয়ার
নাগাল পাওয়া দুষ্কর । অচিরে সুযোগ পাওয়া গেল।
উপলক্ষ্য দীপকের জন্মদিন । বলাই বাহুল্য
নিমন্ত্রিত শুধুই অমিয়া। অমিয়া ক্যান্সার বিজয়িনী
ফলে ঝালমশলা কিছুই খেতে পারে না। তবে সেটা
বীয়ারে পুষিয়ে নেয়। প্রতিবার এই বীয়ার খাওয়া নিয়ে দুজনের ঝগড়া হয়।
দীপক মাত্রা ছাড়াতে নিষেধ করে অমিয়ার স্বাস্থ্যের
জন্য। অমিয়া পাত্তা তো দেয়ই না উল্টে খিস্তিখেউড় করে। রেগে দীপক ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। অমিয়াও
কিন্তু আর খায় না। প্রতিবার এই নাটক দেখে মিলির
পক্ষে হাসি চাপা কষ্টকর হয়। এবার মিলি না হেসে
সুযোগের সদ্ ব্যবহার করল।
“ইমনকে
চেনো?” অমিয়াকে প্রস্তুত হবার সুযোগ না দিয়েই প্রশ্ন করে মিলি।
“কে?
” দৃশ্যত চমকে ওঠে অমিয়া। পরক্ষণেই নিজেকে
সামলে বলে “হ্যাঁ । আমার এক পুরানো বন্ধু ।
” আর থাকতে পারে না মিলি। অমিয়ার হাঁটু জড়িয়ে
ভেঙে পড়ে মিলি। “ প্লিজ্ সত্যি কথাটা বল অমিয়াদি। প্লিজ্। প্লিজ্। প্লিজ্”
“ আমি
মিথ্যা বলি না, মিলি। তুই জানিস। ” ওকে সামলাতে সামলাতে বলে অমিয়া।
“ দীপকের
সাথে তার কি সম্পর্ক । ”
“ সেটা দীপককে জিজ্ঞাসা কর। ”
“ ইমন যেদিন থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে, ও
যেন কেমন বদলে গেছে। কথাবার্তা ছাড়, তাকিয়ে
দেখে না পর্যন্ত । ” কাঁদতে কাঁদতে বলে মিলি। “
স্ত্রী হিসাবে এটুকু জানার অধিকার ও কি আমার নেই?”
“ কিছু জিনিস না জানাই ভাল মিলি। পুরানো কাসুন্দি । ” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে
অমিয়া। “ তবে হ্যাঁ , তোর জানা উচিৎ। ”
দীপক
ঘরে ঢুকে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। অমিয়া শান্ত স্বরে বলে! “ দীপক । ও জানতে চায়। ” একটু দম
নিয়ে বলে’“ ইমনের কথা। ”
দীপক
ফিসফিস করে শুধু বলে ,“অমিয়া। ”
অমিয়া চলে গেছে। গোটা বাড়ি নিস্তব্ধ।
মিলি আলুথালু হয়ে মাটিতেই বসে আছে। দীপক খাটে বসে। আলো জ্বলছে।
,“ মিলি” আস্তে ডেকে ওঠে দীপক। মিলি
তাকায় না। “তুমি যা সিদ্ধান্ত নেবে, তাই শিরোধার্য।
শুধু মাঝেসাঝে ঈশাণকে দেখার অনুমতি যদি দাও। ” গলা ধরে এল দীপকের।
মিলি জ্বলে উঠল। “ শুধু ঈশাণ? আর আমি?
”
“ এই
ডুপ্লেটা তোমার নামেই কেনা। আর যা তুমি বলবে। ”
“ এত
বছরের ভালবাসা?” মিলি চোখের জল আটকাতে পারল না।
“ ভালো
কি আমি বাসিনি?” এবার দীপকের গলা ধরে আসে। “ইমন আমার প্রথম প্রেম। একমাত্র প্রেম। কিন্তু তুমি আমার অভ্যাস । ”
“অভ্যাস
? সকাল বেলায় প্রাতকৃত্য করার মত?” মিলি রাগতে গিয়ে হেসে ফেলে।
দীপক
হাসে না,“ হ্যাঁ । বা দাঁত ব্রাশ করা। ”
“ হরিবল্। রোমান্টিক কথা বলার চেষ্টা ও কর না। ইমনকে ছাড়লে কেন?”
“ বাবার
জন্য। সমকামী ছেলের বাবা হবার থেকে আত্মহত্যা
করা শ্রেয় । প্রথম দিকে ফাঁকা বুলি মনে হয়েছিল। দৈনন্দিন অশান্তি এড়াতে ইমনকে নিয়ে
জোহান্সবার্গ চলে যাবার পরিকল্পনা করেছিলাম।
সেই মত ট্রান্সফার করালাম নিজেকে।
”
“কিন্তু
জোহান্সবার্গ তো আমায় নিয়ে গিয়েছিলে বিয়ের পর। ” আর্তনাদ করে উঠল মিলি।
বিষণ্ণ
ভাবে মাথা নাড়ে। “বিয়ের আর মাত্র দিন পনেরো
বাকি। ইমন আমার কথায় পার্টটাইম পড়ানোর চাকরিতে ইস্তফা দেবে সব ঠিকঠাক্ । মাকে জানালাম।
আশিস্ দিল মা। কিন্তু কথাটা কি ভাবে
হিটলারের গোচরে এল জানি না। হয়তো ভয় দেখিয়ে মার মুখ থেকেই--। তিরিশটা ঘুমের
ট্যাবলেট আমার সামনে ফেলে হুমকি দিল গান্ডু
ছেলের বাবা মার বেঁচে থেকে লাভ কি? তাই আমি
বেড়িয়ে পড়লেই মায়ের গলার নলি কেটে ঐ ওষুধ খেয়ে বাবাও”।
“ সস্তার
ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলিং। ” তীব্র ঘৃণায় চিৎকার করে ওঠে মিলি। “ চলে গিয়ে দেখতে পারতে,
আত্মহত্যা করার সাহস ঐ বুড়োর নেই। ”
“ রিস্ক
নিতে পারিনি। মায়ের---”
“হুঁ। মায়ের দুলাল। তারপর?”
“ ইমনকে
কোন খবর দিতে পারিনি। এই অপরাধবোধ আমায় কুরে
খেয়েছে এত বছর। আই ডাম্পড্ হিম। আমার ছোট্টবেলার বন্ধু- প্রথম প্রেম । আর তোমার
সাথেও কি প্রতারণা নয়?”।
আঁতকে উঠল দীপক। মিলি গরম চায়ের কাপে
ঘুমন্ত দীপকের আঙুল ডুবিয়ে দিয়েছে।
“স্যরি।
এত ডাকছি উঠছ না” হাসতে হাসতে বলল মিলি। বেশ বেলা হয়েছে। শরতের সোনালি রোদ ঘরময় আঁকিবুকি কাটছে। হতভম্ব
দীপক হঠাৎ করুণ স্বরে বলে ওঠে,“ মিলি তুমি কি থেকে যেতে পার না?”
“ সি এল নেই বেশি। ”
“ না
মানে” দীপকের চোখ ছলছল করে ওঠে। মিলি সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। “ স্কুল যাচ্ছি। ফিরে এসে সব শুনব। ”চলে যেতে গিয়ে ও থমকে দাঁড়ায়
মিলি,“ প্রতিটা অন্তরঙ্গ মুহূর্তে তুমি কি ইমনের কথা ভাবতে? নাকি আলাদা আলাদা লোকের
কথা?”
দীপক
সলজ্জ ভাবে মাথা নামায়। যেতে যেতে মিলি শুধু বলে,“ শালা পরকীয়া সবাই করে। দোষ হয় কেবল মিলির। ”
image courtesy- google