যদি আপনার চেহারা একটু ইয়ে হয়, ঐ আরকি হৃষ্টপুষ্ট, তাহলে বিশ্বাস করুন, আপনাকে আর গাঁটের কড়ি খরচা করে উল্কি কাটাতে হবে না। এই সমাজই দেগে দেবে, যাবতীয় দৃশ্যমান তথা আচ্ছাদিত অঙ্গপ্রতঙ্গ সমূহ। আর আমি তো শৈশব থেকেই- মানে হেঁ হেঁ।
বাবা বলত, “আহাঃ আমার মেয়েকে দেখে কেউ আমার ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সের আন্দাজ পাবে না।” চুপিচুপি বলি, বাবার তো কোন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টই ছিল না, তো ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স আসবে কোথা থেকে? মা চাকুরী করত ভারতীয় ডাকবিভাগে, সেসব সোনার দিন ছিল মশাই। স্বল্পসঞ্চয় নিয়ে ব্যাঙ্কের সাথে ডাক বিভাগের চলত ঘোরতর আকচাআকচি। মা জীবনে মানে কর্মজীবনে আর কি, ব্যাঙ্কের ছায়াও মাড়ায়নি। আর বাবা তো অতিশয় পত্নীনিষ্ঠ ভদ্রলোক। ফলে উভয়ের কেউই আর -- ।
তা সে যাই হোক, বাবার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট না থাকলেও, আমার দৈহিক সৌষ্ঠব দেখে জনগণ বরাবরই বাবাকে বেশ ধনী বলেই সমীহ করেছে। বিদ্যালয় জীবনের জনৈকা সহপাঠী তো, আমার অসাক্ষাতে জনে জনে বলেই বেড়াত,“অনির বাবার অনেক কালো টাকা আছে। টাকাগুলো ওরা মাটির নীচে পুঁতে রাখে। ”
তবে সবাই যে অমন অসাক্ষাতেই বলত তেমন না, মুখের ওপরে বলার মত হৈতেষীও কম কিছু ছিল না- ট্রেনে সদ্য আলাপ হওয়া মহিলা মাকে জ্ঞান দিয়েছে- “ ওকে ভাত খেতে দেবেন না।” বাপরেঃ। মা আর আমি হতভম্বের মত একে অপরের দিকে তাকিয়েছিলাম বেশ খানিকক্ষণ, “ভাত দেবে না মা তুমি?”
মোটা হলে আর যেটা শুনতে হয়, সেটা হল, মোটা মানেই হাফ অপদার্থ। নিষ্কর্মা, ঢ্যাঁড়শ ইত্যাদি প্রভৃতি। সারা জীবন এই অপদার্থতার সাথে লড়াই করেই বাঁচতে হয়েছে, বাঁচতে হয়- শুধু আমায় নয়, আমার মত প্রতিটি মেয়েকেই। খিদে থাকলেও কম করে খেতে হয় জনসমক্ষে। আবার পেট ভর্তি হয়ে গেলেও খিল্লি করে জনগণ- “কি বলছিস? এতেই পেট ভরে গেল তোর? লজ্জা করিস না খা-”।
শুধু কি খাওয়াদাওয়া?পোশাকপরিচ্ছদ নয়? কোন পোশাক কাকে মানায়, এই নিয়ে রীতিমত থিসিস করে জনগণ। মোদ্দাকথা মোটাদের কিছুই মানায় না। তবে শাড়ি ঢেকে দেয় সব খুঁত- সিরিয়াসলি? খুঁত ঢাকার জন্য পোশাক পরি কি আমরা? বা খাওয়াদাওয়া করি? বা হাঁটাচলা? কথাবলা? তাহলে মশাই,নিজের ভালোলাগার জন্য কি করি? খুজলি?
ছাত্রজীবন শেষ করে কর্মজীবনে ঢুকলাম। সেখানেও শালা বৈষম্য- স্বাধীন অফিস কি মেয়েরা পারে? আর যদি পারেও, আমি পারব নাকি? আহাঃ পুতুল- পুতুল গড়ন। কত যে সাগর নদী এইভাবে পেরিয়ে এলাম- কত যে পচা শামুকে পা কাটলাম, কত যে খড়কুটো ঝড়ে উড়ে এলো আর গেল- কতজনের সাথে যে আমার তুলনা করা হল- কতজনের চপ্পলে যে পা গলিয়ে জুতোটাই চুরি করে নিলাম- সেসব লিখতে বসলে মহাভারত হবে।
মাথার অর্ধের কেশগুচ্ছ সফেদ হয়ে হাবিব বাবুর নিয়মিত খরিদ্দার হয়ে গেলাম। এখনও সমালোচনা হয় বৈকি- আহাঃ তেনারা আমার ভালো চান কি না। চান, চান আরও ভালো চান- আপনাদের শুভাশিসে আরও ফুলে ফেঁপে উঠি আমি। জীবন অনেক কিছু শিখিয়েছে, যার অন্যতম হল তোয়াক্কা না করা- বিশ্বাস করুন, জীবন বড়ই কর্মব্যস্ত, একসাথে বাপের বাড়ি-শ্বশুর বাড়ি- অাপিস-মেয়ে- উৎসব- পার্বন- ঘরের কাজ সামলে যেটুকু সময় পাই, আপনাদের কথা ভেবে (মাইরি বলছি, খিল্লী নয়) বড় মজা পাই। শুভ দীপাবলী।
No comments:
Post a Comment