Tuesday 3 September 2019

অনির ডাইরি ২২শে মে, ২০১৯

মা, হওয়া কি মুখের কথা? না বাপু, মোটেই মুখের কথা নয়। যেমন ধরুন, কি কুক্ষণে,যে তুত্তুরীকে বলেছিলাম, হৃদপিণ্ডের যে প্রচলিত প্রতীক, তা আসলে মানুষের পশ্চাৎদেশের উল্টানো প্রতিবিম্ব। মানে আমরা যাদের ভালোবাসি, শুধু তাদেরই নয়, ঘোরতর অপছন্দের পাত্র/পাত্রীকেও আমরা প্রয়োজন বিশেষে “হার্ট” পাঠাতে পারি। ফলশ্রুতি? আমার গোটা গায়ে, গোটা পাঁচেক বিভিন্ন বর্ণের হৃদপিণ্ডর ছবি জ্বলজ্বল করছে। অপরাধ? তুত্তুরীকে পর্যায়ক্রমে বকা, পড়তে বসতে বলা এবং গর্হিততম অপরাধ হল, তুত্তুরীর ভাগের তিনটি চকোলেট সাবাড় করে দেওয়া।
এখন আপনি বলতেই পারেন, এসব অসভ্য কথা, নিজের শিশুকন্যাকে শেখানোর কি দরকার ছিল বাপু? ওতো ছেলেমানুষ, তুমি বলবে, আর ও শিখলেই দোষ? কারণটা, ঐ যে বললাম মা হওয়া কি মুখের কথা? মোবাইল খোলার উপায় নেই মাইরি। যাই দেখতে বসি, যাকেই মেসেজ করতে বসি, যেই ফোন করুক, তিনি নিঃশব্দ চরণে পিছনে এসে দাঁড়াবেন। “কে ফোন করেছে?” “কি বলল?” “তুমি ঐ কথা বললে কেন?” “তুমি হাসলে কেন?” হরি হে মাধব, চান করব না গা ধোব! শৌভিককে এসব প্রশ্ন করে, বিশেষ সুবিধা হয় না, সদ্য জন্মানো বেড়াল বা কুকুরছানার মত ঘাড় ধরে, ঘর থেকে বার করে দেয়। মা হয়ে তো আর, অগত্যা-। তেমনি কোন ইংরাজি সিরিয়াল দেখার সময়, তিনি আমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে হামলে পড়ে ছিলেন। তলার সাবটাইটেল দেখে খানিকটা বুঝেছিলেন, বাকিটা অবশ্য এই অধমই-।
আরো যে কত রকমের প্রশ্নাবলীর সম্মুখীন হতে হয়, “ছেলে হয়ে, ছেলেকে চুমু খাচ্ছে কেন?” “ছেলেতে- ছেলেতে বিয়ে হয় নাকি?” “ জন যে স্যামকে বিয়ে করল, ওদের বেবি হলে, কে বাবা হবে, আর কে মা?” “যেমন সারোগেট মাদার হয়, তেমনি সারোগেট ফাদার হয়?” “মা হলে তো উম্ব ভাড়া দেয়, সারোগেট বাবারা কি ভাড়া দেয়?”  “পেনি বিয়ের সময় অত মোটা হয়ে গেল কি করে? কি বললে? বেবি হবে? ওর তো এখনও বিয়েই হয়নি। বিয়ে না হলে, কারো বেবি হয়?” “ হয়?” “তাহলে তুমি খামোকা বাবাকে বিয়ে করতে গেলে কেন?”
শুধু কি তাই? তুত্তুরীর জ্বালায় ঘনঘন মোবাইলের পিন বদল করতে হয় আমাদের। ঈশ্বরের দিব্যি, আমাদের মোবাইলে কোন উল্টোপাল্টা জিনিসপত্র পাবেন না। বন্ধুবান্ধবদের পাঠানো ইল্লি মার্কা ইয়ে আমরা পারতপক্ষে ডাউনলোডই করি না। করলেও, একে অপরকে পাঠিয়েই ডিলিট। তবু ঘনঘন বদলাতে হয় কোড। উপায় কি? বছর চার পাঁচ আগের, কোন এক মধ্য রাতে, যখন শৌভিক এবং আমি গভীর নিদ্রামগ্ন, তুত্তুরীর কোন অজ্ঞাত কারণে নিদ্রাভঙ্গ হয়, এবং আমাদের সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে জনৈক বড় সাহেবকে তুত্তুরী মেসেজ পাঠায়, “ইলেকট্রিক শক”।সাথে ২৫খানা ইমোজি। তখনও হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ ডিলিট করা যেত না, নেহাত তিনি অত্যন্ত সহৃদয় ব্যক্তি, ঈশ্বর তাঁর মঙ্গল করুন। কিন্তু এই টেনশন নিয়ে বাঁচা যায়? আমরা নতুন কোড দি, আর মোবাইলের ওপর আঙুলের নাড়াচাড়া দেখে তুত্তুরী বুঝে যায়, নতুন কোড কি-।
মা হওয়া মোটেই মুখের কথা না, যেমন ধরুন, আপনি একদিক থেকে ঘরদোর সাফ করবেন, অন্যদিক থেকে অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে তাকে পুনরায় পূতিগন্ধময় করে তুলবে তুত্তুরী। সত্যি বলছি, জুতো রাখার র‍্যাক থেকে ওয়াশিং মেসিনের মাথা পর্যন্ত থরে থরে সাজানো, তুত্তুরীর বই, খাতা, খেলনা এবং পুতুল। দাঁড়ান, দাঁড়ান, গোটা পুতুল ভাবলেন নাকি? না মশাই। কোথাও পুতুলের মুণ্ডু পাবেন, কোথাও ধড়। কোথাও কিছুই পাবেন না, এক দু পাটি চপ্পল পাবেন কেবল।  আর পাবেন, ক্লাশ শেষে স্কুলের মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়ে আসা গুচ্ছ-গুচ্ছ, গুড়ি-গুড়ি পেন্সিল এবং রাবার। সবকটিই ব্যবহারের সম্পূর্ণ অযোগ্য, তবুও, ঐ গুলির প্রতি তুত্তুরীর যে কি অপরিসীম মায়া। এছাড়াও পাবেন, আমার বাতিল করে দেওয়া বিবর্ণ ঝুটো গয়নাগাটি এবং কয়েকশ পেস্তার খোলা। ক্র্যাফট বানাবে তুত্তুরী, তাই যত্ন করে জমিয়ে রেখেছে। মাঝে মাঝেই গোনাগাঁথা করে দেখে, কিছু হারায়নি তো? আরও পাবেন শেষ হয়ে যাওয়া কয়েক ডজন স্কেচ পেন, যে গুলি, সময় বিশেষে দেওয়ালে ঘষে দেখা হয়,রঙ সত্যিই শুকিয়ে গেছে কি না। নতুন কোন শব্দ শিখলেও আগে তা দেওয়ালে লেখে তুত্তুরী। মাঝে মাঝে পুরানো পড়াও কি সুন্দর দেওয়ালে লিখে অভ্যাস করে। ঐ জিনিসটাই খাতায় লিখতে বলুন, দেখি-। কি বাজে লোক মশাই আপনি। অখাদ্য। ঠিক তুত্তুরীর মায়ের মত। শুধু পড়া নয়, মাঝে মাঝে ছবিও আঁকে তুত্তুরী। অবশ্যই দেওয়ালে। ভালো না হলে আবার ইরেজার দিয়ে মুছেও দেয়, অবশ্য।সেসব ছবি দেখে মাঝে মাঝে আমাদের হার্ট অ্যাটাক হবার উপক্রম হয় যদিও।
আরো অনেক কিছু করে তুত্তুরী, যেমন বোতল-বাটি- ঘটি- গ্লাসে করে ডিপ ফ্রিজে বরফ জমায় তুত্তুরী। অবশ্যই মায়ের অসাক্ষাতে। মামমামকে (দিদা) গায়ের জোর দেখাতে, ভিডিও কল করে, আসবাব পত্র ধরে পর্যায়ক্রমে টানাটানি এবং ঠেলাঠেলি করে তুত্তুরী। গ্লুকন ডি জলে গুলে, আইসক্রিম বানায় তুত্তুরী। ফুল ফুটতে দেরী হলে, গাছ গুলোকে প্রবল ধমকায় তুত্তুরী এবং সর্বোপরি ড্রয়ারের কোন কোণে অনাদরে পড়ে থাকা বাতিল মোবাইল ফোনে চার্জ দিয়ে সেটাতে আবোলতাবোল ভিডিও তোলে তুত্তুরী-

1 comment: