“হেলো বাবা! কি করছ-। ” আদুরে বেড়ালের গলায় এই প্রশ্ন গুলো যখন করলাম, ঘড়িতে রাত পৌনে দশ। সারাদিন মেঘলা আর জোলো হাওয়ার পর সদ্য শুরু হয়েছে রঙীন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। সদ্য শেষ হওয়া নৈশ আহারে স্বপাক, তীব্র ঘি গন্ধী সুবাসি আতপের সাথে সৌরভী সোনা মুগের খিচুড়ির যুগলবন্দি, সঙ্গতে পোস্ত মাখামাখি চাকা চাকা আলুভাজা এবং বেশী বেশী কাঁচালঙ্কা তথা পেঁয়াজ দিয়ে ভাজা ওমলেট। এই অনুপম যুগলবন্দির গপ্প শোনাতেই ফোন করা, নাহলে নৈশাহারের পর আমার বাবা তথা আমার ফোনের স্বত্ব বদলে যায়। স্বত্বাধিকারিনী আপাততঃ কি যেন একটা টিভি প্রোগামে মশশুল। সেই ফাঁকেই দাদু চুরি-
“ হ্যাঁ বলওওও। ” উচ্ছ্বসিত হলে চাটুজ্জেদের গলার জোর বেড়ে যায়, একই রকম আদুরে জবাব হলেও বিনা ফোনেই দিব্যি শোনা যায়। পরের প্রশ্নটা আমার বর বিড়বিড় করে প্রম্প্ট করে দিল,“কি করছ বাআবাআ?” সাধারণতঃ তাই বলি কিনা।
“কি আর করব? এই সবে বাড়ি ফিরলাম। ” মানে? এই বৃষ্টি বৃষ্টি রাত দশটায় কোথা থেকে ফিরল? নির্ঘাত রশদ সংগ্রহে বেরিয়েছিল। পরশু না তরশুই খুড়তুতো ভাই নালিশ করেছে,“ এই দেখ, এত রাতে, ছাতা মাথায় মেজজেঠু সেই অন্নপূর্ণার কাছে গেছে সিগারেট কিনতে।”
এই বুড়ো লোকটাকে শোধরানো আমার বাপেরও কম্ম না। বলতে গেলাম অনেককিছুই, তার আগে আসামীকে জেরা করার মত করে, গলার সব আবেগ ঝেড়ে ফেলে প্রশ্ন করলাম,“এত রাতে কেন বেরিয়েছিলে?” প্রত্যাশিত বিরক্তি তথা ধরা পড়ে যাওয়ার তিক্ততা গলায় জবাব ভেসে এল, “এত রাতে কি আর বেরিয়েছিলাম? বেরিয়েছিলাম সেই পৌনে ছটায়? কারণটা তোমার গর্ভধারিনীকেই জিজ্ঞাসা করো। তোমার মা আর তোমার মেয়ে একসাথে হলেই এই সব উটকো সমস্যা তৈরি হয় কি না। ” আমার মেয়ে? খামোকা আমার মেয়েকে ধরে টানাটানি কেন রে বাবা, সে তো দিব্যি বসে বসে তার বাপের টিভির রিমোটটা ধ্বংস করছে।
তবে কথাটা মিথ্যে নয়, তুত্তুরী, মামমাম এবং মামমামের ফোন এই তিনের কম্বোকে আমরা সবাই ডরাই। বাড়িতে কোন ফোনে হাত দেবার অনুমতি তথা সুযোগ পায় না বলেই হয়তো মামমামের ফোনের প্রতি তুত্তুরীর এমন ধর্ষকাম আকর্ষণ বা আক্রোশ ও বলতে পারেন। ফোনওয়ালির প্রত্যক্ষ প্রশয়ে ফোনের ওপর না না ধ্বংসাত্মক পরীক্ষা নিরীক্ষা চলে, আগে তুত্তুরী করে, তারপর মামমামকে প্রাকটিশ করায়। পরিণতি আমার বৃদ্ধ বাপের নিছক হয়রানি। গেল বার সিম লক হয়েছিল আর এবারে ফোনের চার্জারের প্রান্তটি ভেঙে আটকে গেছে ফোনের ভিতর। আর এসবই হয় বাবার সুখের দিবানিদ্রার সময়।
বাবার ভাষায়,“ তখনও সন্ধে নামেনি, তোমার মা আমার কাঁচাঘুম ভাঙিয়ে বলল, ‘ওগো দেখো কি করে ফেলেছি। ’” যাঃ। তারপর? “তারপর আর কি? নিয়ে গেলাম শুভর দোকানে। ” পাড়ার শুভর ফোন রিচার্জের দোকানের নিত্য খরিদ্দার আমরা। ফোনে টাকা ভরানো ছাড়াও শুভকে নিয়মিত বা বলা যায় নিয়ম করে জ্বালাতন বা আব্দার করা হয়, “শুভ আমার ফোনে কি সব আপডেট বলছে,কি করব রে?” “ শুভ এই কাগজে লেখা নম্বরে কি করে হোয়াট্সঅ্যাপ করব রে?” শুভ আমাদের সোনার চাঁদ। পাড়াতুতো জেঠু-জেঠিমাকে যতদূর পারা যায় সাহায্য করে। কিন্তু এবার প্রশ্নটাই যে সিলেবাসের বাইরে-।
তারপর? এক চুমুক মায়ের বানানো চিনি ছাড়া চা আর লোকাল বেকারির বিস্কুটে এক কামড় মেরে বাবা আবার শুরু করল,“ তারপর আর কি? ফোনটা নিয়ে গেলাম পাওয়ার হাউস। ঈশার দোকানে। ” প্রসঙ্গতঃ যাদের হাওড়ার টপোগ্রাফি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, তাদের বলি, আমাদের বাড়ি থেকে বড় রাস্তা চার মিনিটের হাঁটা পথ। তারপর দশ টাকার টোটো ভাড়া দিয়ে পৌঁছাতে হয় কদমতলা পাওয়ার হাউস। যেখানে দেশপ্রাণ শাসমল রোড় বেঁকে গেছে তিনটুকরো হয়ে। সংযোগ স্থলে একটি বুড়ো বটের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছেন শ্বেতশুভ্র ডঃ বিধান রায়, না জানি কোন স্মরণাতীত কাল থেকে। তাঁর পিছনেই গাছের তলায় একটি গুড়গুড়ে শনি ঠাকুরের মন্দির। তো কথা হল ঈশা হল গিয়ে মোবাইলের এক্সপার্ট সার্জন। দর খুব বেশী। তার কাছে বৃদ্ধের কষ্টার্জিত অর্থে কেনা তথা স্ত্রীকে উপহার দেওয়া সামান্য সামস্যাং জে সিক্স ফোন নিছক ফেলনা। বাবাও তাই বলল,“প্রথমেই হাঁকিয়ে দিল। রেখে যান। দিন দুয়েক পর খোঁজ নেবেন। ” কেন? “ কেন আর? বলল কারিগরেরা সব ঈদের ছুটিতে দেশে গেছে।” ঈদ? সে তো অনেকদিনের কথা। “হ্যাঁ। শুনতেই চায় না। শেষে ডাম্পিকে ফোন করলাম। ” ডাম্পি আমার খুড়তুতো ভাই। তার মোবাইলের কালেকশন অসামান্য। তাকে ঈশা মুসা সবাই খাতির করে। “ডাম্পি বলে দিল,‘এই সারিয়ে দে। মানার ফোন।’“ মানা অর্থাৎ মেজো জেঠি, অর্থাৎ আমার মা।
বাবা আবার শুরু করেছে, “তখন বলল, সারিয়ে দেব। দুঘন্টা লাগবে। ” দুঘন্টা? “হ্যাঁ। আবার ফিরে আসব? আবার যেতে হবে? তাই দুঘন্টা বিধান রায়ের মুর্তির তলায় বসে রইলাম। ” সে কি গো বাবা? এই ঝড়জলের রাতে তুমি দুঘন্টা বটতলায় বসে রইলে?
আরেক চুমুক চা খেয়ে বাবা বলল,“হ্যাঁ। আরো অনেক লোক বসেছিল। আমিও রইলাম। ঘড়ি পরিনি। সময়ও বুঝতে পারি না। আজকাল কেউ ঘড়ি পরে না বোধহয়? বৃষ্টিবাদলায় লোকজনও কম, যে কয়জন বুড়ো লোক ঘড়ি পরেছিল তাদের থেকেই সময় জেনে জেনে আন্দাজে পৌনে নটা নাগাদ গিয়ে হাজির হলাম। খানিখক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখে ফেরৎ দিল বটে, বলল আটশ টাকা। ” আট শ? “হ্যাঁ। সারাতে পাঁচশ। আর চটজলদি করে দেবার জন্য তিনশ টাকা।” বাপরেঃ। ডাম্পিকে ফোন করলে না কেন? “ধ্যাৎঃ।” টাকা ছিল? “হ্যাঁ। তবে সব খুচরো টাকা দিয়ে দেবার পর আর টোটো ভাড়া ছিল না। হাঁটুর যা অবস্থা, হেঁটেও ফিরতে পারব না। ধরলাম একটা টোটো। গলির মুখে নেমে দেখি বিপিন বাবুর দোকানটা খোলা। বললাম আমাকে দশটা টাকা দিন। টোটো ভাড়া দেব। ” বিপিন বাবুর আইসক্রীম চকলেটের দোকান। তুত্তুরীর কল্যাণে বাবার সাথে ওণার প্রবল ভাব। যাক শান্তি। কাল গিয়ে শোধ করলেই চলবে। “পাগল নাকি?কাল করলেই কালে ধরবে। কাল মানে যম। বললাম, আমার কাছে পাঁচশ টাকা আছে। আপনি আমাকে একটা পঞ্চাশ টাকার চকলেট দিন। আর দশটাকা কেটে, বাকিটা ফেরৎ দিন। উনি তো কিছুতেই নেবেন না। বললেন,‘ বাড়ি
যান। চকলেটও নিয়ে যান। কাল দিয়ে যাবেন এখন।’ ”
তারপর?“তারপর চকলেট, ফোন আর খুচরো নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। ” “বাবা। তুমি মাকে কত ভালোবাসো গো। প্রায় যুদ্ধ জয় করে ফিরলে। মা কি বলল?” ঠক করে চায়ের কাপ নামিয়ে বাবা বলল,“তোমার মা? তোমার মা রণং দেহী মূর্তিতে অপেক্ষা করছিলেন। এত দেরি কেন হল? নিশ্চয় তুমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আড্ডা মারছিলে। আর এখন গুলগল্প জুড়েছো। কি করে বোঝাই বলতো? আজকাল কেউ দাঁড়িয়ে গল্প করতেই চায় না। বেশ কয়েকজন বুড়ো লোক বসেছিল এপাশ ওপাশে, তারা সব উদাস হয়ে তাকিয়ে ছিল এদিকওদিক। কারো গল্প করার ইচ্ছে নেই। সবাই বিমর্ষ। কারো মনে আনন্দ নেই। ধুত্তোর।কথা বলার চেষ্টা করেও সফল হইনি। তোমার মা বুঝলে তো। এখনও গজগজ করছে।চকলেটটা দিলাম, তাও কোন লাভ হল না।”
“সাদাকালো এই জঞ্জালে ভরা মিথ্যে কথার শহরে” বুড়োবুড়ির প্রাগৈতিহাসিক প্রেমের হাতে গরম তপ্ততা মেখে, এক অদ্ভুত ভাললাগার গোলাপী রেশ মেখে ঘুমিয়ে পড়লাম।