সেদিন রাতে জেঠু যখন ফিরল না, পরদিন সকালে উৎকণ্ঠিত ঠাকুমা দাদুকে পাঠালো ঠাকুমার দাদার কাছে। ঠাকুমার বাবা আর আমার প্রপিতামহ অর্থাৎ দাদুর বাবা এককালে এক সাথে জাতীয় কংগ্রেস করতেন। আমাদের বাড়ির ভাঙা বৈঠকখানা আর পেতে রাখা বিবর্ণ ফরাশ বহু প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তির পদধূলিধন্য। ঠাকুমার বাপের বাড়িও কিছু কম যেত না। আমাদের বাড়ি সি আর দাশ আসতেন তো ও বাড়ি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ। পরবর্তী কালে, আমার দাদু কংগ্রেসের নরমপন্থা পরিত্যাগ করে উগ্রপন্থীদদের দলে নাম লেখান। দাদু এবং ঠাকুমার বড় দাদা একসাথেই কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু রাজনৈতিক মতাদর্শ তথা কার্যকলাপের জন্য দাদু অচীরেই বিতারিত হন। প্রপিতামহ দাদুকে মেদিনীপুর কলেজে রেখে আসেন, কিন্তু পড়াশোনা জলাঞ্জলি দিয়ে দাদু মেতে ওঠেন দেশোদ্ধারের নেশায়। আগেই বলেছি না, রাজনীতি এবং চাটুজ্যে বাড়ির নাড়ির বন্ধন। কুহকিনীর নেশায় দাদু, জাহাজের খালাসী সেজে পাড়ি দিল সোজা রেঙ্গুন। লক্ষ্য অস্ত্র আমদানি । পরিণাম সহজেই অনুমেয়। পরবর্তী গন্তব্য মান্দালয় জেল। দাদু যখন জীবনের পরম মূল্যবান্ দিনগুলি দেশোদ্ধারের নামে নষ্ট করছিলেন, ঠাকুমার দাদা ততোদিনে পাশ করে তৎকালীন রিপন কলেজ, যাকে আমরা সুরেন্দ্র নাথ কলেজ নামে চিনি, সেখানে অধ্যাপক হিসাবে যোগ দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, ততোদিনে উনি পারিবারিক দল অর্থাৎ কংগ্রেসেরও বড় নেতা হয়ে উঠেছেন। বাকিটা শুধু উত্থানের গল্প। জেঠু যখন নিখোঁজ হলেন, উনি তখন এম পি।
আমাদের পরিবারের প্রতি ওণার ছিল সীমাহীন অবজ্ঞা । সচেতন ভাবেই এই কুটুম্বিতা উনি অস্বীকার করতেন। এমনকি মেলামেশার ব্যাপারেও ওণার আপত্তি ছিল। ব্যাপারটা অনুভব করে দাদুও এড়িয়ে যেতেন। সেদিন অবশ্য পারেননি। বহু বছর বাদে শ্বশুরবাড়িতে পা দিলেন দাদু। শ্বশুর শাশুড়ি পূর্বেই মৃত। এমনকি ঠাকুমার ছোট ভাইও মারা গেছেন। বাবার বড় মামিমা অবশ্য খাতির করেই বসালেন। কুশল সংবাদ নিতে গিয়ে সব শুনে উনি স্তম্ভিত । নিজে গিয়ে ডেকে আনলেন বড় মামাকে। তিনি শুনেছি বাড়িতে খড়ম পরতেন। খটখট করতে করতে এসে হাজির হলেন বৈঠকখানায়। দাদু যে চেয়ারে বসেছিল তার ঠিক ওপরে একটি বিশাল বিলিতি দেওয়াল ঘড়ি ছিল। এক নজর সেদিকে তাকিয়ে, জলদ গম্ভীর স্বরে বললেন,“আজ একটু ব্যস্ত আছি। বিনা অ্যাপয়ন্টমেন্টে বেশি সময় দেওয়া যাবে না। ”
দাদু নিশ্চুপে বসে রইলেন। বড় মাইমা ব্যস্ত ভাবে বলে উঠলেন,,“ কি বলছ? তোমার বড় ভাগনে কাল থেকে বাড়ি---”
“ তো?আমি পুলিশ না টিকটিকি? প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে। কাল ফেরেনি। আজ হয়তো ফিরে আসবে। ব্যস্ত হবার কি আছে” উনি খিঁচিয়ে উঠলেন।
ওণার কথা শুনে দাদু কেন জানি না, কিছুটা আশ্বস্ত হল। কাল ফেরেনি, আজ ফিরবে। তার মানে জেঠু অন্তত জীবিত। যে অমঙ্গল আশঙ্কায় কাল সন্ধ্যা থেকে কেউ জলগ্রহণ করেনি তা হয়তো মিথ্যা শঙ্কা মাত্র।
দাদু উঠে পড়লেন। বাবার বড় মামা নিরাসক্ত গলায় বললেন,“চললে নাকি? আচ্ছা চল, তোমায় সদর দরজা অবধি এগিয়ে দি। ” সদর দরজার সামনে এসে দাদু বিদায় জানাবে, উনি চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,“ এতো হবারই ছিল জামাই। মেজ নকশাল হবার আগে, ভাবা উচিত ছিল”। দাদুর শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। টলে যেতে যেতে থামটা ধরে নিলেন। সব আশা শেষ। বড় মামা শীতল সাপের মত হিসহিস করে বললেন,“ মেজটাও রেহাই পাবে না। ” মেজ অর্থাৎ আমার বাবা।
জেঠু নিখোঁজ , বাবা নিরুদ্দেশ। সাড়ে সাত বিঘা জমির ওপর আমাদের বিশাল পৈত্রিক বাড়ি, যা সব সময় জনসমাগমে জমজমাট থাকে, বিগত দুদিন ধরে খাঁ খাঁ করছে। প্রাণী বলতে আমার বৃদ্ধ দাদু, ঠাকুমা,প্রৌঢ় মেজদাদু, মেজঠাকুমা , ছোটকাকু আর পিসি। দিন দুয়েক শোকাহত হয়ে কাটার পর তৃতীয় দিন সকালে পিসিকে স্কুলে পাঠান হল। ছোটকাকু সঙ্গে গেল। সাধারণত পিসি একাই যায়, সেদিন মেজ ঠাকুমার মন কু গাইছিল, তাই পিসির প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও কাকু সঙ্গে গেল।
অল্পকাল পরেই রুদ্ধশ্বাসে দৌড়তে দৌড়তে ফিরে এল দোহে। সদর দরজা পেরোতেই একদল অচেনা ছেলে পিছু নিয়েছিল। নানা কটুকাটব্য কানে আসছিল। পাড়ার পরিচিত লোকজন অচেনা মত পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। ঝপাঝপ দরজা জানলা দোকান বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। পরিস্থিতি সঙ্গিন বুঝে ছোটকাকু দ্রুত পিসিকে নিয়ে ফিরে আসে। পিসি অবশ্য তারই মধ্যে ঘুরিয়ে দুটি গালাগালি ফেরৎ দিয়ে এসেছে।
যে সদর দরজা সূর্যোদয় থেকে মধ্যরাত্রি অবধি খোলা থাকত, দ্রুত তা বন্ধ হয়ে গেল। থমথমে আতঙ্কের আবহ কুয়াশার মত ঘণ হতে লাগল। সারা দিন কেউ এল না। সন্ধ্যা গাঢ় হতে, আপাদমস্তক শাল মুড়ি দিয়ে তিনি এলেন। জেঠুর বাগদত্তা। বাবা ছোটকাকু পিসির অগ্নিকন্যা। আর আমার নেমসেক রঞ্জাবতী। জেঠু রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক বিবর্জিত হলেও, রঞ্জাবতী ছিল ঘোরতর ভাবে যুক্ত। প্রেসিডেন্সীর ছাত্রী। অসম্ভব সাহসী। তখন জিন্স বা ট্রাউজার্স পরার চল ছিল না। শাড়িকেই মালকোঁচা মেরে পড়ে, ইউনিভার্সিটির বন্ধ গেটে চড়ে পুলিশের সাথে সমানতালে খিস্তিখেউড় করত। দমাদ্দম পেটো ছুঁড়ত। মিছিলে পুলিশের সাথে নিয়মিত হাতাহাতি করত। বাবা স্বচক্ষে দেখেছিল, বাবাদের রঞ্জুদি একবার পুলিশের কাছ থেকে থ্রী নট থ্রী রাইফেল কেড়ে তাই দিয়েই তাকে পেটাচ্ছে। কোন অজ্ঞাত কারণে, রঞ্জুদিকে পুলিশ ধরলেও ঘন্টাখানেকর মধ্যেই ছেড়ে দিত।
রঞ্জাবতী বাবার খবর এনেছিল। বাবা নিরাপদেই আছে। খবর পাঠানো হয়েছে। বাবাকে আসতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ জেঠু ছিল টোপ। উনি সাবধান করে গেলেন, আপাতত বিনা প্রয়োজনে যেন কেউ বাইরে না বের হয়। গোটা মহল্লা ওরা ঘিরে রেখেছে। বাবার শুভার্থীরা কেউ ঢুকতে পারছে না। রঞ্জাবতী যন্ত্রের মত কথা বলে যখন চলে যাচ্ছে, ঠাকুমা ওর হাত দুটি চেপে ধরলেন, “ তুমি জান? বড়?”
রঞ্জাবতী মাথা নাড়ল। কালো শালটা নামিয়ে নিল চোখ অবধি। “কোথায় ? আমরা এখন কি করি? একবার শেষদেখা ও” ঠাকুমার কথা শেষ হবার আগেই উচ্চঃস্বরে কেঁদে ওঠে রঞ্জাবতী। না জেঠুর দেহ পাওয়া যায়নি। ওণার খণ্ড বিখণ্ড দেহ নাকি ওণার কলেজেরই বিশাল বাগানে কোথাও পুঁতে দিয়েছিল ওরা। জেঠুর তাই অন্তিম সংস্কার ও হয়নি। জেঠুর ছবিতে কোনদিন মালাও দেওয়া হয়নি।
আমাদের এলাকার তৎকালীন এম এল এর সাথে বাবার এক মৌখিক চুক্তি ছিল। অবিশ্বাস্য হলেও সিপিএম এবং নকশালদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চুক্তি। দুপক্ষই পোস্টার সাঁটাত। দুদলে খুচখাচ চোরাগোপ্তা মারামারি থাকলেও তা খুনোখুনি ছাড়ুন, হাত পা ভাঙা অবধিও গড়ায়নি। সত্তরের রক্তাক্ত পশ্চিম বঙ্গে ও আমাদের এলাকা ছিল শান্ত। জেঠুর ওপর আক্রমণ ছিল আদতে বিশ্বাস এবং চুক্তি ভঙ্গ। সমগ্র ঘটনাচক্রের পরিচালক ছিলেন সিপিএম এর জনৈক নেতা শ্রীমান ব্রতীন সেন। কানাঘুষো শোনা যেত বরানগর কাণ্ড ও ওণার মস্তিষ্কের ফসল।
আসল লক্ষ্য ছিল আমাদের এই মফঃস্বল শহরের ওপর একছত্র আধিপত্য। যার জন্য ছাত্র তথা কলেজ গুলিকে কব্জা করা বিশেষ দরকার।
যাই হোক জেঠু নিখোঁজ হবার দিন চারেক পরে নজরদারি শিথিল হল। বেপাড়ার ঠ্যাঙারে বাহিনী নিপাত্তা হয়ে গেল। দুচারজন অরাজনৈতিক শুভাকাঙ্ক্ষীর আনাগোনাও শুরু হল। পঞ্চম সন্ধ্যায় এসে হাজির হল বাবা। দলের উপুর্যুপরি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে। ঠাকুমা, দাদু কিংকর্তব্যবিমূঢ় । শুধু মেজদাদু বলল,“ বেশ করেছিস। কাপুরুষোচিত ভাবে আমরা বাঁচি না।” বাবার প্রত্যাবর্তনের খবর উভয় পক্ষের কাছেই পৌছল। রঞ্জাবতী এসে এক প্রস্থ হূলস্থূল বাঁধালো। বাবার ডান হাত আর বাঁ হাত ভূপাল আর চাঁদু ওরফে গ্যাঁড়া চাঁদু এসে বলে গেল,“ কিচ্ছু চিন্তা নেই গুরু। আমরা আছি। পোটেকশন দেবো। ”
কিন্তু এযাত্রা “ পোটেকশন” দেওয়া অত সহজ ছিল না। আমাদের পারিবারিক পুরোহিত ছিলেন ভট্টাচার্য মশাই। আদতে তিনি স্থানীয় হাই স্কুুলের সংস্কৃত শিক্ষক ছিলেন। বংশানুক্রমে ওণারা আমাদের পুরোহিত। জনসমক্ষে কংগ্রেস করলেও আদতে নকশালভাবাপন্থী পরিবার। ওণার কন্যা কণা আমার পিসির সহপাঠী ছিল। সেই দুর্দিনেও কণা নিয়মিত আমাদের বাড়ি আসত এবং খবরাখবর আনত। স্থানীয় সিপিএম পার্টি অফিসটা ছিল ওদের বাড়ি লাগোয়া। কণাই প্রথম খবর দিল ওরা সাংঘাতিক কিছুর পরিকল্পনা করছে। বাবার নাম বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। বরানগর মডেলে কিছু পরিকল্পনা হচ্ছে। দুর্ভাগ্যবশত কণার কথা কেউ যথোচিত গুরুত্বসহকারে নিল না।
দুচার দিন কাটল। কণা আবার খবর আনল পাড়ায় অনেক বেপাড়ার ছেলে ঢুকেছে। মহল্লার প্রতিটি সিপিএম বাড়িতেই কুটুম্ব আসছে। এবার আর কণার কথা উড়িয়ে দেওয়া গেল না। কারণ ঐ একই কথা শোনা গেল আমাদের প্রাক্তন এমএলএর মুখেও। মহঃ ঈশা ছিলেন ঐ মহল্লার দীর্ঘদিনের এমএলএ। উর্দু ভাষী খানদানী অবাঙালি মুসলমান। শোনা যায় লতায় পাতায় প্রাক্তন অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলি খাঁ সাহেবের বংশধর। কোটিপতি ব্যবসাদার । খানদানী কংগ্রেস নেতা। রাজনীতিতে যোগদানের আগে ওণাকে কেউ পাঁচ পিস স্যুট ছাড়া পরতে দেখেনি। আর জনপ্রতিনিধি হবার পর থেকে ওণার বেশ ছিল আলিগড়ি পাজামা, আদ্দির গিলে করা পাঞ্জাবি আর দোশালা।প্রায় কপর্দকশূন্য হওযা সত্ত্বেও দাদুকে খাতির করতেন হয়তো ওণার রাজনৈতিক অতীতের জন্য। সেদিন মহালয়া। বাজারে দাদুর সঙ্গে দেখা, ঈশা সাহেব ডেকে বললেন,“বড়দা। হাওয়া ভাল নয়। ওরা চব্বিশ পরগনা থেকে ঠ্যাঙারে বাহিনী আনছে। খোঁজ নিয়েছি পাড়ার প্রতিটা ঐ পার্টি করা পরিবারে একাধিক ছেলে আশ্রয় নিয়েছে। জিজ্ঞাসা করলে বলছে ভাগ্না, ভাইঝি জামাই এইসব। প্রমিলা বাহিনীও তৈরি, সাংঘাতিক কিছু ঘটতে চলেছে। মেজকে যত তাড়াতাড়ি পারেন মহল্লা ছাড়তে বলুন। ”
খবর বাবাদের দলের অগ্রজপ্রতিম নেতার কানেও পৌছেছিল। ব্যাঙ্ক কর্মচারী সেই নেতা গোপনে বাবাকে বোঝালেন,“ ওদের সঠিক পরিকল্পনা জানি না। তবে আমাদের সোর্স অনুসারে অস্ত্রবল বা জনবল দুদিক থেকেই এই আক্রমণ প্রতিহত করার সামর্থ্য এই মুহূর্তে আমাদের নেই। ওয়ান স্টেপ ফরোয়ার্ড টুস্টেপ ব্যাকোয়ার্ড। তুই আজই এলাকা ছাড়। ”
বাবাকে বিহারের রামগড়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হল। কোলিয়ারি বেল্ট। ওখানকার আইএনটিইউসি নেতা লছমণ সিং বাবাকে শেল্টার দিতে তৈরি ছিল। রাত দশটায় ট্রেন। বাবা বলল, “ একবার মাকে বলে আসি। ”
রাত সাড়ে আটটা বাবা খেতে বসেছে, খেয়েই বেড়িয়ে পড়বে, খিড়কির দরজা দিয়ে। হঠাৎ সাইরেন বাজিয়ে পুলিশের জিপ এসে থামল আমাদের বাড়ির সামনে। বাবা বুঝল, বড্ড দেরি হয়ে গেছে।
এক ভ্যান পুলিশ সাথে এক ভ্যান ভর্তি সি আর পি। সদর দরজায় সজোরে কড়া নাড়ার আওয়াজ । ভীত সন্ত্রস্ত বাড়ির মানুষ গুলো, বিশাল সাবেকী বাড়ির কালো রোয়াকে বসে গোগ্রাসে গিলছিল বাবা,মুখের গরাস টা পাতে নামিয়ে মাথা নীচু করল, শরীরের সব পেশী শিথিল হয়ে এল, ইঙ্গিতে বলল দরজা খুলে দিতে। রোয়াক থেকে নেমে উঠোন পেরিয়ে সদর দরজা,মেজঠাকুমা মাঝপথে থমকে দাঁড়াল, বড় শালবল্লা দিয়ে দমাদ্দম ধাক্কা পড়ছে সদর দরজায়। মড়মড় করে ভেঙে পড়ল দুটো প্ল্যাঙ্ক। বানের জলের মত ঢুকে এল পুলিশ, সিআরপি। সাথে প্রায় পাঁচ ছশো ছেলে। বাবাকে মাটিতে ফেলে বেদম প্রহার চলতে লাগল। পুলিশ ঠুঁটো জগন্নাথ। হাত পড়ল দাদু, ছোট কাকুর গায়েও। মেজদাদুর পা ভেঙেছিল, কিছুদিন আগে, তখনও পায়ে প্লাস্টার, তাও রেয়াত পেলেন না। একতলার দালানে যেখানে দাদুকে ঠাসঠাস করে চড় মারছিল ওরা, তার হাতখানেক দূরেই টাঙানো ছিল বৃদ্ধের তাম্রপত্র
দোতলার বারন্দায় পনেরোটা সুদৃশ্য ফ্রেঞ্চ উয়িন্ডো ছিল, লাল নীল কাঁচ লাগানো, একটি কাঁচও অবশিষ্ট রাখেনি ওরা। ঠাকুরদার বাবার বেলজিয়াম গ্লাসের আয়না, শখের ঝাড়বাতি , মায় শোখিন দেওয়ালগিরি অবধি ভেঙে খানখান করা হল। পরিকল্পনা মাফিক প্রথম একচোট গণপ্রহারের পর পুলিশ বাবাকে তুলে নিয়ে যায় ভ্যানে তুলবে বলে। ইতিমধ্যে ভ্যানটি পিছিয়ে গেছে প্রায় পৌণে এক কিলোমিটার । গোটা পথে বেদম মার মারা হয়। উদ্দেশ্যে গণপ্রহারে মৃত্যু । হয়তো তাই হত, যদি না এক পাঞ্জাবি সিআরপি হঠাৎ বাধা না দেয়। ততোক্ষণে বাবা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছে। সচেতন ভাবে বারংবার মাথায় আঘাত করছিল ওরা, সেটা নজরে আসতেই, সিআরপি পঞ্জাবি অফিসারটি ঝাঁপিয়ে অচেতন বাবার শরীরটা কাঁধে তুলে দৌড়।
বাড়িতে তখনও তুলকালাম চলছে। মেজঠাকুমা হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। কিন্তু ঠাকুমা কাঁদেনি। পিসিকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে ঠাকুমা শুধু একটি কথাই বিড়বিড় করে বলে যাচ্ছিল, “একটা খায়। দুটো নয়। ” ভূলে গেলেন? আমাদের পারিবারিক অভিশাপ, প্রতি প্রজন্মে একটি করে ছেলে রাজনৈতিক কারণে বলি হয়।
সংজ্ঞাহীন রক্তাক্ত বাবার শরীরটাকে লকআপে ঢোকানো হল, বিনা চিকিৎসায়। খানিক বাদে তিনি এলেন,শিবু ঘোষ। লোকাল মাস্টারমাইন্ড এবং বাবার এককালীন মাষ্টারমশাই। ওণার মারফৎ ই এককালে বাবার পরিচয় হয়েছিল মহান মার্ক্স,মহান এঙ্গেলস্, মহান লেনিন তথা মহান স্ট্যালিনের সাথে। গোল বাঁধালেন মহান মাও। দল ভেঙে গেল। কালকের রাজনৈতিক গুরু হয়ে উঠলেন প্রাণঘাতী শত্রু । তিনি ভেবেছিলেন পুলিশ বাবার লাশ নিয়ে ফিরেছে, প্রাণ আছে দেখে ক্ষোভে, হতাশায় উন্মাদ হয়ে উঠলেন। ওসির দিকে তেড়ে গিয়ে বললেন,“ ওটাকে মেরে ফেলতে পারলেন না। এত করে বোঝালাম”।ওসি গোপাল খাঁড়া মিনমিন করে জবাব দিল,“ কি করব স্যার? পৌণে কিলোমিটার হাঁটালাম, তাও আপনার ছেলেরা কাজ সাবার করতে পারল না। ”
বলেছিলাম না, আমার পিসি অসম সাহসী । সেদিন গোটা বাড়ি তছনছ করে ওরা যখন চলে যাচ্ছিল, পিসি তখন একটা ছেঁড়া লাল চাড্ডিকে একটা কঞ্চির মাথায় জড়িয়ে নাড়ছিল। সেই উড্ডীন লাল পতাকার দিকে তাকিয়ে কে যেন ব্যঙ্গ করে বলেছিল ,“বাবা! এতো ভিয়েতনাম চাইল্ড”।
(Writing this is extremely painful and stressful as well. Don't know whether I'll be able to continue or not. However you may read the previous parts in my page)
#AmaderKatha #AninditasBlog
(To be continued)
#Amaderkatha #aninditasblog
http:/ amianindita.blogspot.in
#AninditasBlog
#Aninditasblog #Amader_katha
#turbulent70s #Kolkata
No comments:
Post a Comment