Tuesday 22 December 2015

অনির ডাইরি ১৮ই ডিসেম্বর, ২০১৫


ফেসবুকে আমার এক বয়স্ক বন্ধু আছেন, ষাটোর্ধ, অবসর প্রাপ্ত, কৃতি সন্তানের জনক। সাম্প্রতিক বড়ই নিঃসঙ্গতায় ভুগছিলেন। বয়স্কা স্ত্রী তো ঘরকন্যা, পুজোআচ্ছা আর টেলিভিশনে প্যানপ্যানে বাংলা সিরিয়াল নিয়ে দিব্যি দিনযাপন করেন, কিন্তু আমার বন্ধুটির সময় আর কাটছিলই না। কাঁহাতক বই, পত্র আর খবরের কাগজ পড়ে থাকা যায়, ফলতঃ উনি খুব দ্রুত বৃদ্ধ হয়ে পড়ছিলেন। আচমকা সুগার, প্রেসার, রক্তে স্নেহ পদার্থের আধিক্য দেখা দিল। সাথে দেখা দিল তুমুল গৃহবিবাদ। গিন্নি বাড়িতে মিষ্টি ঢোকা বন্ধ করে দিলেন, বেপরোয়া বন্ধুটি পাড়ার মিষ্টির দোকানে খাতা খুললেন। নিন্দুকে বলতে লাগল, পাড়ার তেলে ভাজার দোকানেও ওনার নাকি খাতা আছে। নিন্দুক গণ শুধু আলোচনা করেই ক্ষান্ত হলেন না, সময় মত গিন্নি মার কানে কথা গুলি তুলেও দিলেন। পরিণাম সহজেই অনুমেয়। ব্যাপারটি যখন বিবাহ বিচ্ছেদের দিকে এগোচ্ছে, ভদ্রমহিলা আমাকে ঢেকে পাঠালেন, উদ্দেশ্য সাধু। এক স্বঘোষিত নারীবাদীর কাছে, ডোমেস্টিক ভায়লেন্সের বর্ণনা দেওয়া। কিন্তু মুস্কিল হল, যে, নারীবাদীরা আবার সাম্যবাদীও হন কি না। তাই সব শুনে আমার মনে হল, এ ক্ষেত্রে ভদ্রলোকটিই অধিক অত্যাচারিত। যদিও ভালবাসার অত্যাচার, তবুও-----।
ভদ্রলোকের নিঃসঙ্গতা কাটাতে আমিই ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খোলার পরামর্শ দি। প্রথম দিকে ব্যাপারটা বেশ ভালোই ছিল। দ্রত ওনার বন্ধু সংখ্যা বাড়ছিল। গৃহ যুদ্ধ ও সাময়িক ভাবে বন্ধ হয়ে গেল, যদিও চোরাগোপ্তা আক্রমণ চলতে লাগল। তবে ওটা ধর্তব্যের মধ্যে না আনাই ভাল। ভদ্রলোকটি প্রথম গোল বাঁধালেন, বয়সজনিত সরলতা হেতু কিছু লোককে নিজের মোবাইল নম্বর প্রদান করে। কোথা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বিভিন্ন বয়সী সমকামী পুরুষ ওনাকে প্রেম প্রস্তাব পাঠাতে লাগল। কেউ কেউ মোবাইলে ফোন তথা হোয়াটস অ্যাপ এর মাধ্যমে সকাল বিকাল, “হ্যালো ডার্লিং” বলে মেসেজ/ ফোন করতে লাগল। মধ্যবিত্ত মধযব্যস্ক বাঙালির জানা সমস্ত গালাগাল প্রয়োগ করেও নিষ্কৃতি মিলছিল না। অগত্যা আমার শরণাপন্ন হন এবং উকুন বাছার মত করে একটি একটি করে লোককে আমি ব্লক করতে বাধ্য হই। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ঐ সমকামী পুরুষ গুলি শুধু যে ভারতীয় ছিলেন তা নয়, আমাদের একাধিক প্রতিবেশী দেশ থেকেও উনি প্রেম প্রস্তাব পান। ইংরাজি হরফে বেশ কিছু দুদ্ধর্ষ উর্দু কবিতা পড়ার সৌভাগ্য হয় ওনার কল্যাণে। বেশ কিছু দিন অ্যাকাউন্টটি ডিঅ্যাক্টিভেটেড থাকে।
পুজোর পর আমার এবং ওনার অন্যান্য বন্ধু বান্ধব তথা ভাইপো ভাইঝি দের সনির্বন্ধ অনুরোধে উনি পুনরায় ফেসবুকে ফিরে আসেন। তারপর আর খোঁজ নিইনি। মাঝে আবার একদিন উনি  ফোন করে বললেন, আবার উনি প্রেম প্রস্তাব পাচ্ছেন। তবে এবার মহিলা দের থেকে। বুঝতে পারলাম না, এতে আপত্তির কারণ কি? বৃদ্ধ বয়সে ভুরি ভুরি প্রেম প্রস্তাব তো বহু লোকের স্বপ্ন। অভিনন্দন জানাতে গেলাম, বৃদ্ধ গেলেন ক্ষেপে। ওনার বক্তব্য হচ্ছে, একজন বিরল কেশ, স্ফীতোদর, প্রায়অন্ধ লোকের প্রেমে পড়ার কি কারণ থাকতে পারে? শুধু তাই নয়, “প্রেম ছাড়, এদের সাথে দুদণ্ড কথাও বলা যায় না। বাঙালির হল কি?” উনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, “ কেতাবি জ্ঞানের বাইরে এরা কি কিছু পড়াশোনা করে না? এত আকাট?  তুমি কেমন আছ? আমি ভাল আছি এর বাইরে কথা বলতে, আই লাভ ইউ। এর থেকে তো তোর কাকিমার সাথেই প্রেমের চেষ্টা করা ভাল।” হাসি চেপে বললাম, “ আনফ্রেন্ড করে দিন।”
সে যাত্রা বাঁচলেও, আজ আবার ফোন। বেশ রোম্যান্টিক আবহাওয়া। ভাবছি সন্ধ্যা বেলা এক চক্কর হেঁটে আসব, ইচ্ছা দমন করে ফোন ধরলাম। উনি উত্তেজিত ভাবে বললেন, “ আমার অ্যাকাউন্টটা ডিলিট করে দে। পাসওয়ার্ড তো জানিস।”
দীর্ঘশ্বাস চেপে বললাম, “আবার কে প্রেম নিবেদন করল? ধন্য ভাগ্য আপনার। এত প্রেম প্রস্তাব তো আমিও পাইনি।” উনি খিঁচিয়ে উঠলেন, “ না না। ও সব প্রেম ট্রেম না। আমি সামগ্রিক ভাবে বাঙালি জাতির ওপর বীতশ্রদ্ধ। এপাড় ওপাড় মিলে, হাতে গোনা কয়েকজনএর লেখা (অর্থাৎ স্ট্যাটাস) পড়লে মনে হয়, সত্যি আমরা বাঙালি। বাকি গুলো অখাদ্য। রোজ সকালে ফেসবুক খুললেই, খালি ছবি (পড়ুন সেলফি)। ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে সব এক পোজে, ঘাড় হেলিয়ে, চোখ টেরিয়ে, দাঁত কেলিয়ে ছবি।” এই রে প্রমাদ গুনলাম। লাস্ট সেলফিটা যেন কবে দিলাম? আজকেই কি? উনি না থেমে বলেই চললেন, “আর না হলে কবিতা। বাপস্। ও গুলো কি? কবিতা? আর মাঝে মাঝে বামপন্থার মা-বোন এক করা। বিন্দুমাত্র পড়াশোনা নেই। মার্ক্সের নাম ছাড়া কিছু জানে না। সেও নাকি বামপন্থী। জাতটা নষ্ট হয়ে গেছে বুঝলি। সামগ্রিক অবক্ষয়।”
কোনমতে ওনার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে, হাঁটতে বেরোলাম। হেডফোন লাগিয়ে, রেডিও চালিয়ে হাঁটতে দিব্যি লাগছিল। শিরশিরে হাওয়া। ফাঁকা ফাঁকা পথঘাট। রেডিওতে বিজ্ঞাপন চলছে, আমি হেঁটেই যাচ্ছি।দশ মিনিটের ওপর হয়ে গেল, একটিও গান শোনাল না। বেশ বিরক্তি লাগছে, চ্যানেল পাল্টাতেও ভয় করছে। পরেরটা আবার কতক্ষণ বিজ্ঞাপন দেবে কে জানে। এমনি বিজ্ঞাপন শেষ হয়ে রেডিওটিরই কোন শো এর বিজ্ঞাপন শুরু হল। এক মহিলা সহর্ষে বললেন, “সঙ্গে থাকবে, আর জে XYZ। যার গলা শুনলে, কাকও নিজের মাথায় পটি করে দেয়।” চমকে উঠলাম, বাপরে! কি সাংঘাতিক। যাই হোক। বিজ্ঞাপন শেষ, আর জে ফিরে এলেন, এক গাদা আজগুবি কথা বলে, একটা ফোন রিসিভ করলেন। সাগ্রহে লক্ষ্য করলাম, আপনির বালাই নেই। সবাই তুমি। এক মহিলা ফোন করেছেন, আর জে প্রশ্ন করলেন, “আজ সারাদিন কি করলে?”
“চপ বানালাম। ক্যাপ্সিকামকে কেটে”
“কি ভিতরে এঁটেল মাটি দিয়ে নাকি?” আর জের মন্তব্য শুনে হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না।
মহিলা অবশ্য লাস্যময় হেসে বললেন, উনি ভিতরে ফুলকপির পুর দিয়েছেন। অতঃপর উনি বললেন, “ জান আমার না খুব ইচ্ছে করছে, কুয়াশায় তোমায় কেমন দেখতে।” স্মার্ট (?) আর জে বললেন, “ আমার একটা ছবি নাও, আর ফটোশপে ব্লার করে দাও। না হলে সিগারেট ধরিয়ে আমার ছবিতে ধোঁয়া ছেড়ে দেখ। না হলে তোমার চশ্মার কাঁচটা ঘষে নাও, নিয়ে আমার ছবি দেখ।” মহিলাও বোধহয় আর নিতে পারলেন না। বোকা বোকা হেসে বললেন, “তাই করি।” ফোনটা কাটাতে আমি হাফ ছেড়ে বাচলাম। এর পরের ফোনটা একটা বাচ্ছা ছেলের (নাকি মেয়ের), সে উৎফুল্ল হয়ে বলল, “কাকু একটু লুঙ্গিড্যান্স গানটা চালাও না। আমি ওটা শুনতে খুব ভালোবাসি।” আর জে বললেন, “ হে হে তুমি লেপের তলায় বাবার লুঙ্গি ধরে ডান্স কর।” আর সহ্য করতে পারলাম না। রেডিও বন্ধ করে দিলাম। মনে হল আমার বন্ধুটি খুব ভুল কিছু বলেননি।
 
#AnirDiary #AninditasBlog http:/amianindita.blogspot.in

No comments:

Post a Comment