বাড়িতে জানানো দরকার। খুব ইচ্ছে করছে বাবাকে ফোন করতে, জানি না বাবা কি ভাবে নেবে। মা নির্ঘাত হাউমাউ জুড়ে দেবে।পিসিকে করব কি? পিসির যেমন ঠান্ডা মাথা, তেমনি দুদ্ধর্ষ সাহস। সত্তরের দশকে আমাদের বাড়িতে যখন হামলা হয়েছিল, পিসির তখন কতই বা বয়স? ক্লাস থ্রী/ ফোর। দিন দশেক আগে জেঠু নিখোঁজ হয়েছেন। মূল টার্গেট অবশ্য ছিল বাবা। আমাদের মফঃস্বল শহরের অবিসংবাদিত ছাত্র নেতা ছিল আমার বাবা। যাঁরা হাত ধরে বাবাকে এই রাজনীতিতে আনে, দীক্ষা দেয়,কালক্রমে তাঁরাই হয়ে ওঠে বাবার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী তথা গুপ্তশত্রু। একাধিকবার হামলা হয় বাবার ওপর। কিন্তু সফল হয় না। বাবার শুভাকাঙ্ক্ষী, অনুরাগী এবং অনুগামী ও কিছু কম ছিল না।
বাবার এক পরম হৈতেষী সিনিয়র কমরেডের পরামর্শে আরো বড় হামলা হবার আগেই, বাবাকে অজ্ঞাতবাসে পাঠানো হয়। সবাই মিলে চাঁদা তুলে নগদ তিনশো তিরিশ টাকা ওঠে। তিরিশ টাকার টিকিট কাটিয়ে বাবাকে একটা ট্রেনে তুলে দেওয়া হয়। গন্তব্য তুন্ডলা,সুদূর উত্তর প্রদেশ। পরবর্তী কয়েক মাস তুন্ডলায় বাবা এক প্রবাসী বাঙালি দম্পতির হোটেলে পেটভাতায় কাজ করে চালায়।
বাবা হাত ফসকে বেড়িয়ে যাওয়ায়, প্রতিপক্ষ ক্ষোভে উন্মাদ হয়ে যায়। জেঠু সদ্য কেমিস্ট্রীর অধ্যাপক হিসাবে স্থানীয় কলেজে যোগ দিয়েছে। তৎকালীন রাজনীতির সঙ্গে জেঠুর কোন যোগ ছিল না। শৈশবে ঠাকুমাকে নাকি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল জেঠু, যে জীবনে রাজনীতিতে জড়াবে না। আসলে কি জানেন? আমাদের ব্যাঁটরার চাটুজ্যে বাড়ির ছেলেমেয়েদের ওপর অভিশাপ আছে। সকলেই কখনও না কখনও জেলে গেছে এবং প্রতি প্রজন্মে একজন ছেলে শহীদ হয়েছে। বাবার ছোট কাকা "ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়" আন্দোলনে শহীদ হন। ওণার অত্যাচারিত বিকৃত শব যখন আমাদের উঠোনে আনা হয়, জেঠু তখন চার বছরের শিশু। ছোটদাদুকে ঐ অবস্থায় দেখে আতঙ্কিত ক্রন্দনরত ঠাকুমা নিজের জেষ্ট্য পুত্রকে দিব্যি দেন, “ রাজনীতি করলে মায়ের মরা মুখ দেখবি”। জেঠু সত্যই জড়ায়নি। কিন্তু পারিবারিক অভিশাপ এত সহজে কি যায়?
কলেজ থেকে ফিরে, সেদিনও জেঠু বলেছিল,“ মা মুড়ি মাখ। আচারের তেল দেবে কিন্ত। ” মুখ হাত ধুয়ে খেতে বসবে, হঠাৎ জেঠুর এক সহকর্মী ডাকতে এল। “ আসছি। এখুনি। ” বলে বেড়িয়ে গেল জেঠু। আর ফেরেনি। ঠাকুমা বসেছিল, সারা রাত। সারা দিন। তার পরের দিন। হয়তো তারও পরের দিন। আরো কতদিন জানি না। বাবা ফিরে আসে। হৈতেষীদের নিষেধ সত্ত্বেত্ত বাবার ফিরে আসাটা ছিল সাংঘাতিক ভুল।
ভুলের মাসুল দেয় গোটা চাটুজ্যে পরিবার । [চলবে]
#aninditasblog
No comments:
Post a Comment