Friday, 20 November 2015

সেই টেলিফোন



আজ কালিপুজো। সারা শহর উৎসবে মেতেছে। আলোর রোশনাই  এ ঝলমলে কানাগলি থেকে রাজপথ। আদালতের নির্দেশ মান্য করেও বাজি-পটকা ফাটাতে পিছিয়ে  নেই নগরবাসী।
বিকট বিরক্ত লাগছে অলক্তার।  মা- কাকিমা,  আর বোন সূর্য- তারাকে নিয়ে ঠাকুর দেখতে বের হল।  সূর্য - তারা ওর যমজ পুত্র কন্যা । এমনিতে ওরা দিল্লীবাসী। কোন অবাঙালি পরিবার তাদের পুত্রবধূকে দেওয়ালিতে বাপের বাড়ি যাবার অনুমতি দেয়? কিন্তু বেদ এবং তার পরিবার উজ্জ্বল ব্যতিক্রম । নাহলেও অলক্তা চলে আসত।  যদিও কাকার ছেলে, তবু ভাইফোঁটার দিন ও কলকাতায় নেই তা অলক্তা দুঃস্বপ্নেও ভাবে না।
যাই হোক এই মুহূর্তে বাড়িতে ও একা।  ঠিক একা নয়, একতলায় ঠাকুমা টিভি দেখছে। ঐ প্যানপেনে বাঙলা সিরিয়াল দেখলে অলক্তার গ্যাস হয়।  খানিক ছাতে পায়চারি করল, ভাল লাগল না।  কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে।  কিন্তু কে? বেদকে ফোন করল, ফোনটা কেটে দিল বেদ।  নির্ঘাত রাস্তায় আছে।  আর কে? বন্ধু অসংখ্য ।  কিন্তু ফেসবুকে।  আজ সবাই খুব ব্যস্ত।  কত রঙ-বেরঙের পোশাক পরে ছবি দিচ্ছে সবাই।  কেউ রঙ্গোলী বানাচ্ছে তো কেউ বাজি পোড়াচ্ছে।  শুধু অলক্তাই যেন নিষ্কর্মা এবং নিঃসঙ্গ । কর্ডলেস ফোনটা নিয়ে সোফায় গড়াগড়ি  খেতে খেতে এক আজব খেলা শুরু করল অলক্তা, স্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া ফোন নম্বরগুলি মনে করার খেলা।  আচ্ছা বাবার অফিসের নম্বর কি ছিল? আর মায়ের? কাকিমার বাপের বাড়ির নম্বর? কিছু মনে পড়ল, কিছু পড়ল না।  একটা নম্বর অলক্তা কিছুতেই মনে আনতে চাইছিল না, তবু বারবার মাছের মত ঘাই মারতে লাগল। বোধহয় অলক্তার জীবনে এককালে সবথেকে বেশিবার ডায়াল করা নম্বর ঐটাই ছিল। বিগত আট নয় বছরে একবারও ডায়াল করেনি।  তবে আজ কেন?
রঙ্গীতই ধরল ফোনটা, “ হ্যালো”।  বুকের মধ্যে অসহ্য কাঁপুনি।  গলা শুকিয়ে কাঠ।  পেটের মধ্য ডানা ঝাপটাচ্ছে কয়েক হাজার প্রজাপতি। কেটে দেবে কি? আজকাল সবার বাড়িতেই সিএলআই লাগানো থাকে। এখুনি ঘুরিয়ে ফোন করে যাতা বলবে।  সামান্য কিছু কথা বলে রেখে দেওয়াই ভাল।  গলা ঝেড়ে অলক্তা বলল, “ হ্যালো। ”
“ অলক্তা? অনেকদিন পর?” এক লহমায় চিনে নিল রঙ্গীত। তবে কি, মরে হেজে যাওয়া গাছের শিকড়ে আজও প্রাণ অবশিষ্ট আছে? কয়েক মুহূর্ত দুজনেই চুপ করে রইল।  রঙ্গীতই প্রথম কথা বলল, “ একটু ধর।  ছাতে গিয়ে কথা বলছি। ” ঝটকা খেয়ে বাস্তবে ফিরে এল অলক্তা। মনে পড়ে গেল বেদের কথা।  ছিঃ, একি করে বসেছে। এ তো বেদের সঙ্গে দ্বিচারিতা।  বেদ হয়তো কিছুই মনে করবে না, হেসে উড়িয়ে দেবে,কিন্তু এ কি করল অলক্তা।  ফোন কাটতে যাবে, ওদিকে গুঞ্জরিত হল রঙ্গীতের আবেশ মাখা কণ্ঠ, “ কেমন আছিস?”
“ ভাল। ” আড়ষ্ট স্বরে বলল অলক্তা। “ তুই? ছেলেমেয়ে কটি? কত বড় হল?” সন্তর্পণে  বউ এর কথা জিজ্ঞাসা করল না অলক্তা। রঙ্গীতের গলা থেকে আবেশ খসে পড়ল, কেজো গলায় বলল,“ বছর খানেক হল বিয়ে করেছি।  এখনও হয়নি। তোর?”
“ দুটি।  যমজ ছেলে-মেয়ে। ”
“ও।  কি নাম?”
“সূর্য - তারা। ”
“বাঃ। ”আবার নীরবতা।  অখণ্ড নীরবতা।  কলকাতা কি শান্ত হয়ে গেল? শ্মশানের নীরবতা কেন? আবার রঙ্গীতই কথা শুরু করল,“ সব ভুলে আমরা কি আবার বন্ধু হতে পারি না?”
অলক্তা মনে মনে বলল,“ শেষ আট নয় মাসের সম্পর্ক টুকু ছাড়া, আমরা তো বন্ধুই ছিলাম। সম্পর্ক শেষ করলি, সাথে সাথে বন্ধুত্বটুকুও।  হাতে পায়ে ধরেছিলাম, ঐটুকু থাক। শুনেছিলি?”
রঙ্গীত অধৈর্য হয়ে উঠল,“ হ্যালো?অলক্তা?”
“হুঁ। ”
“শুনলি? কি বললাম?”
“হুঁ।  এত বছর পর সেটা আর হয় না”।
“কেন হয় না? শেষ আট মাস আমরা ভূলে যাব। ”বলল রঙ্গীত।
অলক্তা বলল,“ ভুলেই তো গেছি। নতুন করে ভুলতে গেলে দেখবি, শেষ আট মাস টুকুই রয়ে গেল।  পূর্বের আট বছরটাই বিস্মৃত হলি। কাজেই” কথা শেষ করল না অলক্তা।
“ হুঁ। আমরা” দুঃখী গলায় বলল রঙ্গীত,  “কেন এমন হল অলক্তা? এত ভাল বুঝতাম একে অপরকে। কি করে যে-। ”
শান্ত গলায় জবাব দিল অলক্তা, “ কারণ আমাদের সব কথা শেষ হয়ে গিয়েছিল। দিনরাত শুধু ঝগড়া করতাম আমরা। আহত হতাম এবং আঘাত করতাম। ” রঙ্গীতের উদাস শ্বাসপ্রশ্বাস  শোনা যাচ্ছে, অলক্তা আবার বলল, “ যা হয়েছে সেটাই হওয়া উচিত ছিল।  শুধু ঐ তিক্ততা আর গালিগালাজটুকু না হওয়াই বাঞ্ছনীয়  ছিল।  মাঝখান থেকে বিদায় বলার অবকাশটুকু আর হয়নি। ”
“হুঁ। ”সম্মতি জানাল রঙ্গীত।
“রাখি।  ভালো থাকিস। ” বলল অলক্তা। “তুইও ভালো থাক। পারলে যোগাযোগ রাখিস। শোন তুই ফেসবুকে আছিস?”
“নারে। ও সব পারি না। ”মিথ্যা বলল অলক্তা। মনে মনে আবার বলল, “ পাগল।  যোগাযোগ তোর সঙ্গে? পাগল না পুলিশ। ”
“গুডবাই অলক্তা। ” গাঢ় স্বরে বলল রঙ্গীত। “ পারলে ফোন-” ততক্ষণে ফোন কেটে দিয়েছে অলক্তা।
দ্রুত হাতে ডায়াল করছে বেদের নম্বর, “কেয়া হ্যায় বিবি?আয়াম ড্রাইভিং না” অসহিষ্ণু গলায় বলল বেদ।  গলায় একরাশ অভিমান ঢেলে, ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল অলক্তা, “তো? মেরা ফোন নেহি উঠা সাকতে? ভাগ যাউঙ্গি তো পতা চলেগা। ”
ওপাশে বেদের অট্টহাস্য, “কব? কিসকে সাথ? ভাগনে কি ক্যায়া জরুরৎ? ম্যায় খুদ ছোড় আউঙ্গা জী। পর ও শুভ্ দিন আয়েগা কব?” এদিকে হেসে উঠল অলক্তা ও,মনে মনে বলল, “উফ।  ঈশ্বর যা করেন, মঙ্গলের জন্যই--”।
#love #Kolkata #blog #blogger #banglablog #bengali_blogger #AmiAni #Aninditasblog #Hope_you_like_it

No comments:

Post a Comment