২০০৯ এর ডিসেম্বর। আমি তখন এ এল সি খড়্গপুর। ডি এল সি ছিলেন শ্রী শৈবাল বিশ্বাস । মেদিনীপুর অফিস তখনও তৈরি হয়নি। ১৫টি ব্লক আর ২টি মিউনিসিপ্যালিটি, অথচ মাত্র ৪ জন ইন্সপেক্টর। প্রত্যেকেরই আয়ু কয়েক মাস মাত্র। যুবা ইন্সপেক্টর বা কম্প্যুটর জানা ক্লার্ক তখন কল্পনারও অতীত । মাসে মাত্র দশ দিনের গাড়ি। ফলে অনেক হিসাব করে চলতে হত।
খড়্গপুর আই আই টি তখন ঠিকা শ্রমিক অসন্তোষে জর্জরিত । প্রায়ই ত্রিপাক্ষিক মিটিং ডাকতে হত এস ডি ও সাহেবের চেম্বারে। যদিও এটা আমাদের এক্তিয়ার ভুক্ত ছিল না, কিন্তু বারংবার অনুরোধ করলেও কেন্দ্রীয় সরকারী লেবার এনফোর্সমেন্ট অফিসারের দেখা পাওয়া যেত না। তখন এস ডি ও ছিলেন শ্রী অরিন্দম দত্ত মহাশয়। ওনার প্রবল ব্যক্তিত্বের ভয়ে শুধু হাতাহাতি টুকু হত না।
সেদিনের মিটিং শেষ হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা ৬টা। শৌভিক তখন বিডিও খড়্গপুর-২। খড়্গপুরের মাত্র দুটো স্টেশন পর মাদপুর নামক গ্রামে আমাদের লালনীল সংসার । আমার ফিরতে দেরী হলে প্রায় দিনই ও ছুঁতোনাতা করে এস ডিও অফিসে এসে হাজির হত। দুর্ভাগ্যবশত সে দিন কি কাজে আটকে গিয়েছিল, ফলে ট্রেন ছাড়া গতি ছিল না। খড়্গপুর এস ডি ও অফিস থেকে রেল স্টেশন হেঁটে আড়াই মিনিট । ৫টা৪৫ এ একটা টাটা লোকাল ছিল, যে কখনই সময়ে আসত না। ফলে আশা ছিল পেয়েই যাব। স্টেশনে পৌছে দেখি থিকথিক করছে লোক। বহু ট্রেন বাতিল। তখন জঙ্গলমহল দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন কিশনজী। যৌথ বাহিনী তখনও সক্রিয় নয়। ট্রেন বাতিল হওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আমার টাটা প্যাসেঞ্জার ও বাতিল।
শৌভিক বলল,“স্টেশনে অপেক্ষা কর। আসছি। ” তুত্তরীর জন্ম হতে তখনও মাস ছয় সাত বাকি। কিন্তু প্রাকমাতৃত্বকালীন ক্লান্তি হঠাৎ হঠাৎ আক্রমণ করত। এমনি আক্রমণ সামলাতে না পেরে স্টেশনের বেঞ্চে বসে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই,হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে শুনি টাটা প্যাসেঞ্জার আসছে। তড়িঘড়ি শৌভিককে ফোন করে বারণ করলাম। ততক্ষণে ওর গাড়ি হাই রোডের কাছে এসে পড়েছিল। তাও আরো ১৮/১৯ কিলোমিটার তো বটেই। ভালোই হল। ও ফিরে গেল। আমাকে জানিয়ে দিল স্টেশনে গাড়ি থাকবে। স্টেশন থেকে আমাদের কোয়ার্টর হেটে গেলে চার মিনিট। তবে ফাঁকা মাঠ আর বাঁশঝাড়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হত। তাতে আমার আপত্তি না থাকলেও শৌভিকের ড্রাইভার শৈবালদার চূড়ান্ত আপত্তি ছিল।
শৌভিক বলল,“স্টেশনে অপেক্ষা কর। আসছি। ” তুত্তরীর জন্ম হতে তখনও মাস ছয় সাত বাকি। কিন্তু প্রাকমাতৃত্বকালীন ক্লান্তি হঠাৎ হঠাৎ আক্রমণ করত। এমনি আক্রমণ সামলাতে না পেরে স্টেশনের বেঞ্চে বসে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই,হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে শুনি টাটা প্যাসেঞ্জার আসছে। তড়িঘড়ি শৌভিককে ফোন করে বারণ করলাম। ততক্ষণে ওর গাড়ি হাই রোডের কাছে এসে পড়েছিল। তাও আরো ১৮/১৯ কিলোমিটার তো বটেই। ভালোই হল। ও ফিরে গেল। আমাকে জানিয়ে দিল স্টেশনে গাড়ি থাকবে। স্টেশন থেকে আমাদের কোয়ার্টর হেটে গেলে চার মিনিট। তবে ফাঁকা মাঠ আর বাঁশঝাড়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হত। তাতে আমার আপত্তি না থাকলেও শৌভিকের ড্রাইভার শৈবালদার চূড়ান্ত আপত্তি ছিল।
ট্রেন ছাড়লো। বেশ ভিড়। কোন মতে এক টুকরো সিট্ পেলাম। শীতের ভয়ে জানলা বন্ধ। বাইরেও ঘুট্ঘুটে অন্ধকার । বেশ কিছুক্ষণ পর ট্রেন থামল। আন্দাজ করলাম জকপুর। পরের স্টেশনে নামব। আর মিনিট পাঁচ মাত্র। দরজার কাছে এগিয়ে যাব বলে উঠে পড়লাম। আমার সামনে দাঁড়ানো প্রৌঢ়কে ইঙ্গিত করলাম বসতে, উনি সৌজন্যবশতঃ রাজি হলেন না। বলতে বাধ্য হলাম, যে আমার গন্তব্য মাদপুর । বলা মাত্র কামরায় যেন বাজ পড়ল। “ মাদপুর? এটাতো মাদপুর যায় না। ” বলে সমস্বরে চিৎকার করে উঠলেন একাধিক ব্যক্তি ।
“মানে? এটা হাওড়া যাচ্ছে তো?” ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। উত্তর শুনে আতঙ্কের শীতল স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে। ট্রেনটা ঝাড়গ্রাম হয়ে টাটা যাচ্ছে। ঝাড়গ্রাম তখন প্রায় মুক্তাঞ্চল। খুনজখম রোজকার ঘটনা।
“মানে? এটা হাওড়া যাচ্ছে তো?” ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। উত্তর শুনে আতঙ্কের শীতল স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে। ট্রেনটা ঝাড়গ্রাম হয়ে টাটা যাচ্ছে। ঝাড়গ্রাম তখন প্রায় মুক্তাঞ্চল। খুনজখম রোজকার ঘটনা।
ট্রেন তখনও ছাড়েনি। দৌড়ে নামতে গেলাম, পারলাম না। জায়গাটার নাম নিমপুরা। রাতের নিমপুরা কয়লা মাফিয়াদের বিচরণভূমি। একলা মহিলা সহযাত্রীকে সেখানে কেউ নামতে দিতে রাজি না। দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে যা দেখলাম, আমারও সাহস হল না। কোন প্লাটফর্মের বালাই নেই। অন্ধকার রেলইয়ার্ড। সারি সারি মালগাড়ি শবদেহের মত নিশ্চুপ পড়ে আছে। অগত্যা সহযাত্রীদের উপদেশ শিরোধার্য।
হতাশ হয়ে পড়লাম। আমার কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে জনৈক মহিলা বললেন, “ আমি কলাইকুন্ডা নামব।তুমিও নেমো। বাড়ির লোককে বল কলাইকুন্ডা আসতে। ” বাড়ির লোককে আসতেই হবে, কারণ বাস ট্রেকারের গল্প ছেড়েই দিলাম,রাতে ফিরে যাবার কোন ট্রেন পর্যন্ত নেই।সবই তেনাদের দয়া।
হতাশ হয়ে পড়লাম। আমার কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে জনৈক মহিলা বললেন, “ আমি কলাইকুন্ডা নামব।তুমিও নেমো। বাড়ির লোককে বল কলাইকুন্ডা আসতে। ” বাড়ির লোককে আসতেই হবে, কারণ বাস ট্রেকারের গল্প ছেড়েই দিলাম,রাতে ফিরে যাবার কোন ট্রেন পর্যন্ত নেই।সবই তেনাদের দয়া।
শৌভিককে ফোন করব কি, টাওয়ার শূন্য । কোনমতে কান্না সংবরণ করলাম। সৌভাগ্যবশত কলাইকুন্ডা আসার আগেই টাওয়ার পেলাম। রিং হতেই, শৌভিকের উদ্গ্রীব কন্ঠস্বর,“কোথায়? শৈবালদা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর খোঁজ নিয়ে জেনেছে ট্রেন ক্যানসেল। আমরা তোকে আনতে খড়্গপুর যাচ্ছি। ” ঐ মুহূর্তে ঐ কন্ঠস্বর শুনে আবেগে গলা বুজে আসল। কোনমতে সব বললাম। শুনে বলল,“সর্বনাশ । কলাইকুন্ডায় নেমে, নিজের পরিচয় দিয়ে স্টেশনমাষ্টারের ঘরে বস। আমি আসছি। ”
কলাইকুন্ডায় পৌছে চক্ষু চড়কগাছ। এ কোথায় এলাম? এটা কি চক্রাকারে ঘুরে আবার নিমপুরায় ফিরে এল? সেই অন্ধকার রেলইয়ার্ড। সারি সারি মৃতমালগাড়ি । প্লাটফর্ম বা স্টেশনমাষ্টারের ঘর কই? ভ্যাবাচাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছি, বাকিরা নেমে অন্ধকারে হারিয়ে গেল। শুধু সেই মহিলা যাননি। অধৈর্য হয়ে বললেন, “নামো। ট্রেন ছেড়ে দেবে যে। ” নামতে গিয়ে দেখি, সিঁড়ি শেষ হয়ে যাবার পরেও বেশ খানিকটা লাফাতে হবে। লাফিয়ে নামলাম। দুটি ট্রেনের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। কোন রাস্তা নেই। ভদ্রমহিলাকে অনুনয় করে বললাম, “যদি দয়া করে একটু স্টেশনমাষ্টারের ঘরটা দেখিয়ে দেন। ” উনি পাত্তা দিলেন না। বললেন ,“ ওখানে যেতে হবে নি। আমার সাথে এস। কে আসছে? বর? বল কলাইকুন্ডা বাজারে আসতে। হাইরোডের ওপর। আসতে সুবিধা হবে। ”
ফোন মৃত। টাওয়ার নেই। নিরুপায় হয়ে ওনাকে অনুসরন করতে থাকলাম। তেলের ট্যাঙ্কারের তলা দিয়ে কোনমতে গলে এপারে এসে দেখি, নিশ্ছিদ্র অন্ধকারময় চরাচর । অন্ধের মত মহিলাকে অনুসরণ করছি। উনি নানা প্রশ্ন করতে করতে চলেছেন। আমি কি করি। বাপের বাড়ি কোথায়। বর কি করে। বর কিসে আনতে আসছে ইত্যাদি। মেপে উত্তর দিচ্ছি। বললাম শ্রম দপ্তরে কাজ করি। বর মাদপুর বিডিও অফিসে মালপত্র সরবরাহ করে। বিডিও সাহেব খুব ভাল। ওনার গাড়িটা দিয়েছেন নিয়ে যাবার জন্য। মিথ্যা বলতে খারাপ লাগছিল। কিন্তু নিরূপায় । প্রায় প্রতিদিন কোন না কোন পঞ্চায়েত্ প্রধানের গলাকাটা মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দু একজন শিক্ষক বা সরকারি কর্মচারীও থাকত মৃত্যুমিছিলে।
বেশ কিছুটা হেটে হাইরোডে পরলাম। অন্ধকার কিছুটা ফ্যাকাশে । কয়েকটা ফাঁকা চালা দেখে বুঝতে পারলাম বাজারে এসেছি। জনমানবশূন্য বাজারের কঙ্কাল । শুধু একটা মিষ্টির দোকানে একটা জিরো ওয়াট আলো জ্বলছে। দোকান ফাঁকা। একটা বুড়ো লোক বসে বসে বিড়ি ফুঁকছে। মহিলা একটা বন্ধ দোকানে টোকা মারতে অর্ধেক ঝাঁপ খুলে এক বছর ২৩/২৪ এর ছেলের মুখ দেখা গেল। মহিলার নির্দেশে সে চেন দিয়ে বাঁধা একটা ল্যান্ডফোন এগিয়ে দিল। শৌভিক ফোনে মৃদু ধমকাল, ওর কথা না শুনে স্টেশন ছেড়ে এসেছি বলে। ফোন রেখে মিষ্টির দোকানের মচমচে বেঞ্চে এসে বসলাম। শৌভিক মিনিট পনেরোর মধ্যে পৌছে যাবে। আশ্বস্ত হয়ে মহিলাকে অনুরোধ করলাম বাড়ি যাবার জন্য। উনি কর্ণপাত করলেন না। নানা প্রশ্ন করছেন। আমাকে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে মাপছেন। আমি শুধু জানতে পারলাম ওনার নাম পার্বতী মাহাতো। এসি ডিসি এলে চাকরি করেন। নামেই হাইরোড। এতক্ষণ বসে রইলাম, বাস, ট্রেকার ছাড়ুন একটা মোটরবাইক, সাইকেল ও চোখে পড়ল না। মিনিট পনেরো পরে দূরে একজোড়া হেডলাইট দেখা গেল। উন্মত্ত হয়ে দৌড়ে গেলাম মাঝরাস্তায়। হ্যাঁ । শৌভিকের গাড়িই বটে। মহিলাও দৌড়ে এলেন। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষলেন শৈবাল দা। দরজা খুলে সরে বসল শৌভিক। লাফিয়ে উঠে দড়াম করে দরজা বন্ধ করলাম। জানলা দিয়ে হাত নাড়লাম পার্বতীদির দিকে। ইশারায় শৌভিককে দেখিয়ে বললাম “আমার বর”। উনি মৃদু হেসে হাত নাড়লেন। রকেটের বেগে উল্টোদিকে দৌড়ল গাড়ি।
কোয়ার্টারে ফিরে আমার দুই বাবাকেই বললাম আমার অ্যাডভেঞ্চারের গল্প। সব শুনে আমার বাবার দৃঢ় ধারণা হল, ভদ্রমহিলা নির্ঘাত স্থানীয় মাওবাদী কমিটির মহিলা কমান্ডার। নিজের মতবাদের সমর্থনে বাবা জোর গলায় চ্যালেঞ্জ করেছিল, যে ঐ মহিলার দেওয়া সব তথ্য ভূয়ো। আমি ওনাকে কিছুতেই খুঁজে পাব না। আমি কিন্তু সত্যি খুজে পায়নি। হয়তো অন্যমনস্ক ছিলাম, শুনতে ভূল করেছি— অথবা বাবাই ঠিক। কিছু রহস্য না সমাধান হওয়াই ভাল। কি বলেন?
No comments:
Post a Comment