Friday 17 May 2024

অনির ডাইরি মে, ২০২৪

 অনির ডাইরি ২৭শে মে, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় বেজে উঠল পাশে অনাদরে পড়ে থাকা মুঠো ফোনটা। কোন মতে হাত বাড়িয়ে কানে ঠেকাতেই, ওপাশ থেকে ভেসে এল চেনা, ছদ্ম কন্ঠস্বর, " দরজা খুলতে কি শ্বশুরমশাইকে ফোন করব?" অষ্টপ্রহর আমার বুড়ো বাপটাকে ধরে টানাটানি করে লোকটা। বিরক্ত হয়ে কিছুদিন আগেও বলতাম, " কেন? তোর ও তো একটা বাবা আছে, মাঝে মধ্যে তাকে ধরেও তো টানতে পারিস।" শ্বশুরমশাই চলে যাবার পর থেকে কথাটা আর বলতে পারি না। সেই সুযোগে লাগামছাড়া হয়ে উঠেছে শয়তানটা। 


গজগজ করতে করতে উঠে দিয়ে দরজা খুলে দিই। সাড়ে তিনটে অবধি তো জেগে ছিলাম আমিও। মাঝে মাঝেই চলছিল টুকরোটাকরা বার্তা বিনিময়। এটা আমার আজকের নয়, বিগত ১৬ বছরের অভ্যাস। শৌভিক রাত জাগলেই রাত জাগি আমি। মাঝে,মাঝেই ফোন- মেসেজ করে জানাই, একা নও, আমিও "জেগে আছি"। 


আগে একাকীই জাগতাম, ইদানিং অনেক রাত পর্যন্ত সঙ্গ দেয় তুত্তুরী। গতকালও রাত দেড়টা অবধি জেগেছে মেয়েটা। আরো হয়তো জাগত খানিকক্ষণ, আমার দোষেই রাগ করে নিজের ঘরে চলে গেল। আসলে হয়েছে কি,রাত দেড়টা অবধি আসন্ন অলিম্পিক, খেলার জগৎ, খেলা নিয়ে বিশ্ব রাজনীতির ওপর এন্তার বকবক করে আমার মাথা ধরিয়ে দেওয়ার পর, তাঁর মনে হয়েছে, মাকে একটা ধাঁধা ধরা যাক। সেটা যে ধাঁধা, সেই ঘোষণা ব্যতিরেকেই তিনি আমায় শুধালেন, " বলো তো মা, Bay of Bengal কোন state?" 


আমার সাদা মনে কোন কাদা নেই মাইরি, আমি বললাম, "বঙ্গোপসাগর কোন একটা স্টেটে কেন থাকবে? ভারতের গোটা পূর্ব উপকূল জুড়েই তো -"। তিনি সবজান্তা হাসি হেসে বললেন, " পারলে না তো? Bay of Bengal is in liquid state, এটা তো সবাই জানে।" কেমন রাগটা ধরে। শাণিত জিহ্বাকে শাসন করে, বললাম, " এবার আমি একটা প্রশ্ন শুধাচ্ছি,জবাব দে দেখি, বঙ্গোপসাগর ভারতের কোন কোন রাজ্যের সীমানা স্পর্শ করে -"। তিনি চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে শুরু করলেন, " বাংলা - উড়িষ্যা -"। তারপর অখণ্ড নীরবতা, তিনি ভাবছেন। ভেবে টেবে বললেন, " আসাম"। শায়িত অবস্থা থেকে উঠে বসলাম আমি। বললাম, " আসামের ধারে পাশে কোন সমুদ্র নেই।" ভড়কে গেলেন তিনি, ঢোঁক গিলে বললেন, " ঝাড়খণ্ড?" বললাম "land locked state।" এরপর একের পর এক উড়ে এল, " মহারাষ্ট্র এবং কেরালা।"


হাসতে হাসতে বিদ্যালয় জীবনের কথা মনে পড়ে গেল। মোটামুটি তুত্তুরীর বয়সেই আমার এক প্রিয় বান্ধবী ডিব্রুগড় তৈল খনির ম্যাপ পয়েন্টিং করেছিল অধুনা ছত্রিশ গড়ে। এখন অবশ্য তিনি জাঁদরেল দিদিমণি। ছাত্রছাত্রীদের কান ধরে ভূগোল পড়ান। সেটাই বললাম তুত্তুরীকে। বললাম, কাল সকালে ভারতের মানচিত্র মুখস্ত করবি। তাতে তিনি রেগে গরগর করতে করতে চলে গেলেন, যাবার সময় বলে গেলেন, " নিজে ভূগোলে ভালো বলে কি অহংকার।"


সেটাও সবিস্তারে লিখেছিলাম শৌভিককে। রাত সাড়ে তিনটে অবধি রেমালের গতিপ্রকৃতি নিয়ে মিনিটে মিনিটে windy দেখছি আমি। আর আকুল প্রার্থনা করছি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কাছে, একে তো ভোট নিয়ে জেরবার এই বঙ্গ, এরওপর তুফানের অভিঘাত যে বড় সাংঘাতিক হয়ে যাবে। অন্তত আমার বরের কাছে। জীবনের কঠিনতম অধ্যায়ের মধ্যে দিয়ে চলছে লোকটা। এমন ত্রহ্যস্পর্শ যোগ সচরাচর দেখা যায় না। একে তো নির্বাচনী গুঁতো, তারওপর নির্বাচনের ঠিক এগারো দিন পূর্বে আকস্মিক পিতৃবিয়োগ। তারও ওপর রেমাল বাবুর আগমনী। এবারেরটা প্লিজ তুমি নিয়ে নাও। পরের বারেরটা পাক্কা আমরা নিয়ে নেব। 


তারপরই বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সে আর কতটুকুই বা, ঘরের লোক ঘরে ফিরে এসেছে,এবার আরাম করে ঘুমাব। সে গুড়ে বালি, জ্বর নিয়ে ফিরেছেন তিনি। প্যারাসিটামল দিয়ে গরম কালো কফি খেয়ে, মাত্র কয়েক ঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে আবার যখন বেরোল শৌভিক,বলে গেল, " অপেক্ষা না করে খেয়ে নিস। কাঁথির কাজ গুটিয়ে, আমায় একবার দীঘা যেতে হবে।" 


আকাশের মুখ ভার, বইছে জোরালো বাতাস। সাথে ক্রমশই বাঁধন হারা হচ্ছে বৃষ্টি। জলভরা বাতাসের দাপটে ছিটকে পড়ছে বাগানের টব গুলো। "এমন দিনে তারে বলা যায়", বলাই যায়। বললামও, "আমাকে নিয়ে যাবে? প্লিজ?" জীবনের নানা ওঠাপড়ার মাঝে কবে যে আমাদের বিয়ের দিনটা এসে চলে গেছে,মনে রাখিনি কেউই। দেশ জোড়া গর্বের পর্বের মধ্যে, তা রাখার কথাও নয়। কিন্তু আজ তো আর সেই চাপ নেই, আজকের দিনটা তো একসাথে থাকাই যায়। 


জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে শৌভিক বলল, " কে বলল নেই? চাপের বাবা, কাকা, মেসোশ্বশুর সবাই আছে। গিয়ে যদি চুপ করে বসে থাকতে আপত্তি। না থাকে তো চল। আমাকে কিন্তু বিরক্ত করা চলবে না। আমাকে আমার কাজ করতে দিতে হবে। রাজি?" তাই সই, মামা না থাকার থেকে কানা মামাই ভালো বাপু। পরিস্থিতি অনুকূল হোক বা প্রতিকূল একসাথে থাকতে পারাটাই আসল। বাকিটা ঠিক হয়েই যাবে।


অনির ডাইরি ২৩শে মে, ২০২৪ 

#অনিরডাইরি 



বেশ কিছুদিন আগের কথা, অফিস থেকে ফিরে শ্রীমতী তুত্তুরীকে পড়তে বসিয়েছি, হঠাৎ চিৎকার করে উঠল মুঠোফোনটা। অচেনা নম্বর হলেও চিনতে পারলাম, আজ সকালেই বোধহয় ফোন এসেছিল এই নম্বরটা থেকে। তখন ধরতে পারিনি। এখন ধরলাম, ওপাশ থেকে এক পুরুষ কণ্ঠ বলল, " ম্যাডাম আমি অঞ্জন।" কোন অঞ্জন, এই নামে একাধিক ব্যক্তিকে চিনি। জবাব এল,ম্যাডাম আমি SLO অঞ্জন, তমলুক ব্লক। 


চিনতে আর কোন সমস্যা হল না। আমার সাথে চেহারা গত সাদৃশ্যের জন্য, অঞ্জনকে আমি আলাদা করে গোবলু SLO বলে ডাকি। অঞ্জনের ফোন পেয়ে প্রমাদ গুনলাম। আমার এই গোবলু SLO টি মাঝে মধ্যেই আমাকে রচনাসম মেসেজ পাঠায়। মেসেজ গুলো শুরু হয়, " ম্যাডাম আপনি কত ভালো" দিয়ে এবং শেষ হয়, " আমার সাথে কেন এমন হয়েছে? আমার খুব দুঃখ হয়েছে" এবং "মার্জনা করবেন ম্যাডাম, আমি আপনার নির্দেশ পালনে অপারগ।" 


শতাধিক সদস্য নিয়ে গঠিত আমার তাম্রলিপ্ত পরিবার। সবাই আমার কাছে সমান গুরুত্বপুর্ণ, সমান স্নেহের পাত্র, সবাইকে সমান ভালোবাসি। কিন্তু বিভিন্ন রোগের যেমন বিভিন্ন দাওয়াই হয়, তেমনি বিভিন্ন সহকর্মীকে ও বিভিন্ন ভাবে সামলাতে হয়। কাউকে বেপোট ধমকাতে হয়, "কেটেই ফেলব" না বললে জাস্ট সে নড়ে না, আবার কাউকে বকলেই কেলো। তাদের সোনা,বাবা, বাছা না বললে সে নড়ে না। অঞ্জন দ্বিতীয় পর্যায় ভুক্ত। অঞ্জনের সব অভিযোগ যে সব সময় আমি মেটাতে পারি, তা নয়। যাদের নামে দুদিন আগে আমার কাছে নালিশ করে, দুদিন পর তারাই এসে পান চিবাতে চিবাতে বলে যায়, "ম্যাডাম আজ ব্লকে অঞ্জন দা খাওয়াল। কি ভালো মুর্গীর ঝোলটা যে হয়েছিল। আর তরকারিটা ম্যাডাম, উফ কি বলব আপনাকে -"। মনে হয় ব্যাটাদের কান ধরে ঘর থেকেই বার করে দি। আর অঞ্জনটাকে দিই ব্লক করে। 


তেমনি কিছু আসতে চলেছে ভেবে বললাম, "বলো"। অঞ্জন বলল, " কাল অফিসে থাকবেন ম্যাডাম? আমি একটু যাব নিমন্ত্রণ করতে।" কিসের নিমন্ত্রণ রে, বিয়ে করছ নাকি? তাই সবাইকে মুরগির ঝোল আর তরকারি খাইয়েছ? অঞ্জন এক গলা জিভ কেটে বলে, "না না ম্যাডাম। বিয়ে তো অনেকদিন আগেই করেছি। আসলে আমার মেয়ের জন্মদিন। বর্গভীমা মন্দিরে ওই দিন ভোগ দেব। আপনাদের সকলের নিমন্ত্রণ। প্লিজ আসবেন।"


বললাম সে তো আসবই, কিন্তু তোমাকে আর কষ্ট করে আসতে হবে নি। আমি বলে দিলেই সবাই চলে যাবে। তাও কথা শুনল না অঞ্জন। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি, গোটা রাজ্য পুড়ছে অকস্মাৎ তাপ প্রবাহে, তারই মধ্যে ঘোর দ্বিপ্রহরে এসে হাজির হল অঞ্জন। জনে জনে নিমন্ত্রণ করল আলাদা করে। আমায় তো সপরিবারে। "ম্যাডাম স্যারকে অবশ্যই আনবেন। আর তুত্তুরীকেও।" বলেই দিলাম,ওসব পারব না বাপু। একজনের স্কুল আর এক জনের নির্বাচন, কাউকে পাবে নি। আমি একা অবশ্যই যাব।


বললাম তো যাব, কিন্তু এদিকে যে উত্তরোত্তর তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে বুড়ো তপন। গোটা পূব মেদিনীপুর জুড়ে ত্রাহি ত্রাহি রব। শান্তনু বলল, "খাবার না হয় লিয়ে চলে আসব ম্যাডাম। ঠাণ্ডা ঘরে বসে খেয়ে নিবেন।" ব্যাপারটা আমার যতটা পছন্দ হল, অঞ্জনের তার তিলমাত্রও হল না। " এলে অনেক ভালো হত ম্যাডাম। মেয়েটা খুব খুশি হত - "। এরপর আর কোন কথা চলে না। 


চলে না বললেও, আতঙ্ক তো যায় না। কি গরম বাপ রে! বর্গভীমা মন্দিরের নীচে জুতো খুলে ওই খাড়া সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পা পুড়ে আংরা না হয়ে যায়। অফিসে শুভাশিষ, শান্তনু, নন্দন যদিও বারবার বলতে লাগল, " কিচ্ছু চিন্তা নেই ম্যাডাম। পিছন দিক দিয়ে সুন্দর রাস্তা আছে, ছায়ায় ঢাকা, দোতলায় উঠে জুতো খুলতে হয়।" হক বাবু বললেন, " দেখবেন ম্যাডাম, দেবস্থানে গরম লাগবে নি।" 


তাই সই। তারপর ও আসতে থাকে না না চিন্তা। মন্দিরে ভোগ, নির্ঘাত মাটিতে বসে খেতে হবে। শাড়ি পরে গেলে সুবিধা না সালোয়ার পরি? শান্তনু বলল, "দাঁড়ান ম্যাডাম সব খবর লিয়ে লিচ্ছি।"মিনিট দশেক পরেই ফোন, "ম্যাডাম মাটিতে বসে খাওয়ার পাশাপাশি চেয়ার টেবিলও থাকবে। অঞ্জনদা নিজে বাজার করে দিচ্ছে, মন্দিরের ভোগ ছাড়াও আরো অনেক কিছু থাকছে ম্যাডাম।" 


সে তো আগেই শুনেছি, নন্দন আজ সকালেই বলেছে, "তিন রকম মাছ থাকছে ম্যাডাম। বাটা, রুই আর শোল।" দেবী বর্গভীমার নিত্য ভোগ শৌভিক তমলুকের এসডিও থাকাকালীন বেশ কয়েকবার খেয়েছি। সাদা ভাত, শুক্তো, মুগ ডাল, পোস্ত ছড়ানো চৌকো করে কাটা, খোসা সমেত গুঁড়ি গুঁড়ি আলু ভাজা, শাক পাতা-কুমড়ো দিয়ে একটা তেলতেলে ঘ্যাঁট, রুই মাছের ঝাল, শোল মাছের টক আর পায়েস। সব কটি পদই অনবদ্য, অনুপম খেতে। আমরা চাটুজ্জে, আমাদের বংশে শোল মাছ ভক্ষণ নিষিদ্ধ। ভাগ্যে বিয়ে করে গোত্রান্তর হয়েছিল, নাহলে দেবীর এই অনুপম প্রাসাদ থেকে বঞ্চিত হতাম। শোল মাছের টকের কথা লিখতে বসে এখনও রসে পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে আমার রসনা। ঠিক করলাম, বাটা রুই নয়, ওটাই খাব কেবল, আশ মিটিয়ে। 


নির্দিষ্ট দিনে, টিফিন টাইমে গিয়ে হাজির হলাম বর্গভীমা মন্দিরের কাছে। মেয়েকে নিয়ে অঞ্জন স্বয়ং এল খিড়কি দুয়ারের পথ দেখাতে। মেয়েটি যেন হুবহু বাপের ফটো কপি। শুভ জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে বললাম, তোমার বাবাকে কিন্তু আমি অন্য নামে ডাকি। মেয়েটি এক গাল হেসে বলল, "জানি তো। তুমি বাবার নাম দিয়েছ গোবলু SLO, বাড়িতে আমিও তাই বলে ডাকি। থুড়ি রাগাই বাবাকে।" এই পুঁচকে বয়সেই নিরুপম বাচিক শিল্পী মেয়েটি। দারুণ আবৃত্তি করে, নানা জায়গা থেকে মেডেল জিতে আনে। সামান্য অনুরোধেই গোটা তিনেক শোনাল আমাদের। 


মন্দিরের ভিতরে আলো ছায়ার আজব কারিকুরি। যেখানে রোদ পড়ছে,সেখানে পা রাখা যায় না। ছায়াময় অংশটি আবার বেশ শীতল। এক্কা দোক্কা খেলার মত করে মন্দির চত্বর পার হয়ে গেলাম।মাঝখানে রাজরাণীর মত বসে আছেন দেবী বর্গভীমা। প্রচুর বিয়ে হয় এখানে। এই প্রখর রৌদ্রেও বেশ কয়েক জোড়া বর বধূ সেজেগুজে প্রস্তুত। তাদের পাশ কাটিয়ে বাম দিকে খাবার জায়গায় গিয়ে হাজির হলাম আমরা। আজ গোটাটাই আমাদের জন্য সংরক্ষিত। তেমনই ব্যবস্থা করেছে অঞ্জন। 


এবার ভোজনের পালা। আমাদের জন্যই সবাই প্রতীক্ষা করছিল এতক্ষণ। একটা ছোট টেবিলে আমি, ALC নভোনীল বাবু,ইন্সপেক্টর মুকুল আর একজন অপরিচিত ব্যক্তি বসলাম,বাকিরা দলবদ্ধ ভাবে মাটিতে লম্বা করে পেতে রাখা আসনে বসে পড়ল। অঞ্জন স্বয়ং পরিবেশন করতে নামল। প্রায় দেড় মাস আগের কথা, তাও যতটুকু মনে পড়ে, প্রথমেই এল গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত, সাথে স্যাল্যাড, অসম্ভব ভালো শুক্তো, মুগ ডাল, ঘন্ট, পোস্ত ছড়ানো খোলা শুদ্ধ গুড়ি আলু ভাজা। প্রতিবারই ভাবি, এটা আর একটু নেব। চাইবার আগেই পরের আইটেম এসে যায় পাতে। কোনটা ফেলে কোনটা যে খাই। 


ভাবতে ভাবতেই এত্ত বড় বাটা মাছ স্বহস্তে পাতে তুলে দিল অঞ্জন। নিষেধ করার অবকাশ পেলাম না। বাটা আমার ঘোরতর অপছন্দের মাছ। এত কাঁটাওয়ালা মাছ আবার মানুষে খায়। ভেবেই এসেছিলাম, ওটা খাব না। না জিজ্ঞাসা করেই দিয়ে দিল যখন, অপচয় তো আর করতে পারি না। মুখে দিয়েই বুঝলাম, না খেলে পস্তাতাম। বাটাও এত সুস্বাদু হয়? ভাবলাম, অন্তত দুপিস টক শোল খাব। অসভ্য উদর জায়গা দিলে তো। আরো অনেক কিছু ছিল যে, চাটনি, পরমান্ন, ক্ষীরের মত দই,রসগোল্লা----। 


রাতে বাড়ি ফিরে দেখি অঞ্জন মেসেজ করেছে, "Mam আজ আপনি এসেছেন। আমার মেয়ে কে আশির্বাদ করলেন, আমি, আমার মেয়ে ও স্ত্রী খুব খুশি হয়েছি। আমরা সত্যিই খুব আনন্দ পেয়েছি। আমার খুব ভালো লেগেছে। Mam আমার পরিবারের পক্ষ থেকে আপনাকে প্রনাম জানাচ্ছি।" ভালো করে পড়লাম বার কয়েক, নাহ আজ আর কোন নালিশ করেনি অঞ্জন তার ম্যাডামের কাছে।


অনির ডাইরি ১৪ই মে , ২০২৪

#অনিরডাইরি 



ঢং করে বেল বাজতেই ধড়মড় করে উঠে বসলাম।ঘড়ি বলছে, রাত সাড়ে তিন-পৌনে চার। এই একটা আওয়াজের জন্যই এতক্ষণ সোফায় বসে আছি। জেগে বসে আছি লিখতে পারলাম না, কারণ বেশ বুঝতে পারছি আমার চোখ জুড়ে গিয়েছিল। 


দুঃসংবাদ আসার আধ ঘন্টার মধ্যেই বেরিয়ে পড়েছি আমরা কাঁথি থেকে। দুটো পিট্টু ব্যাগের মধ্যে কোন মতে ভরে নিয়েছি কিছু জামাকাপড়। কি নিয়েছি, কি নিইনি জানি না। মাথাই চলছিল না। শূন্যতা বুঝি একেই বলে। গাড়ি সময়মত এসে গেলেও, কিঞ্চিৎ বিলম্ব করছিল শৌভিকের ব্যক্তিগত দেহরক্ষক।  উত্তেজিত হয়ে বার বার ফোন করতে করতে বাইরের বাগানে পায়চারি করছিলেন ড্রাইভার নূপুর বাবু। মাঝে মাঝে বলছিলেন, " স্যার, জানেন তো, অমুক ভট্টাচার্য সাহেব যখন এসডিও ছিলেন, ঠিক এমনি হয়েছিল। সেবারও নির্বাচন চলছিল, তারই মধ্যে ওনাকে নিয়েও এমনি মাঝ রাতে ছুটতে হয়েছিল।"


কথার সুর টেনে শৌভিক বলে, " অমুক সাহেব যখন ডায়মন্ড হারবারের এসডিও ছিলেন, নমিনেশন চলাকালীন ওনার পিতৃবয়োগ হয়। উনিও অমনি গিয়ে, দাহ করে, কাছা নিয়ে পরের দিন নমিনেশন নিয়েছিলেন।" জিজ্ঞাসা করি, "তুই কাছা নিবি না তো?" দৃঢ় ভাবে মাথা নাড়ে শৌভিক। "নিয়ম কানুন কিছু মানবি?" একই ভাবে মাথা নাড়ে দৃঢ়তার সঙ্গে। জানতাম এটাই বলবে। শ্বশুর মশাই নিজে চূড়ান্ত নাস্তিক ছিলেন, দাদা শ্বশুর বা দিদি শাশুড়ি মারা যেতে মানেননি কোন নিয়ম। তাঁর শিক্ষায় শিক্ষিত তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র, অন্য কিছু করবে, এটা দুরাশা। 


জানাই, আমি কিন্তু মানব।  শৌভিকের নাস্তিকতা নিয়ে যতটা গর্বিত ছিলেন শ্বশুর মশাই, আমার আস্তিকতা, পুজো,উপোস ইত্যাদি নিয়ে অখুশি তো ছিলেন না। বরং ভোর বেলা টাটকা ফুল তুলে পুজো করতে দেখে এক অদ্ভুত খুশির আভা ছড়িয়ে পড়ত বৃদ্ধের চোখেমুখে। 


 "বাবার বন্ধুদেরও খবর দিতে হবে -" মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে শৌভিক। " সবার নম্বর তো নেই। দীনু কাকুকে বলি, যাকে পারবে খবরটা দিয়ে দেয় যেন।" প্রায় মিনিট পনেরো পর, বাংলোর সামনে এসে দাঁড়ায় এক দ্বিচক্র যান, পিছনের আসন থেকে নেমে দৌড়ে আসে শৌভিকের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী। কোন মতে উর্দিটা গলিয়েছেন, হাতে একটা প্লাস্টিকের ঝোলা। " সরি স্যার, আপনি ছুটি দেবার পর দিদির বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। খবর পেয়েই ছুটে আসছি।" শৌভিক প্রশ্ন করে, " খেয়ে এসেছ তো?" 


অন্ধকার হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলে গাড়ি। হৃদয়ে অদ্ভুত এক দোদুল্যমানতা, হয়তো আয়া দিদি ভুল দেখেছে। হয়তো এখুনি ফোন আসবে, " অ বড়দা, কাকু আবার জেগে উঠিছেন।" সেই ফোন আর আসে না। অন্য ফোন আসতে থাকে এক গাদা, কাকারা, পিসি, পিসেমশাই পইপই করে বলতে থাকে, " সাবধানে আয়। আমরা তো আছি।" ছোট ভাইকে ফোন করে একই কথা শোনায় শৌভিক। আজ দুর্গাপুর-আসানসোল এলাকায় ভোট ছিল,গাড়ি ঘোড়া কিছুই সহজলভ্য নয়। তারওপর সঙ্গে অত ছোট বাচ্ছা, এত রাতে কোন হঠকারি সিদ্ধান্ত নেবার কোন দরকার নেই। 


নাচিন্দা মন্দিরের সামনে আলোর মালা, অক্ষয় তৃতীয়া উপলক্ষে মেলা বসেছে। এই তো মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেই অফিস থেকে ফিরলাম এই পথ দিয়ে। তখন ভাবছিলাম শ্রীমতী তুত্তুরীকে যদি একবার দেখাতে পারতাম এই আলোকমালা। পাশে শুকনো মুখে বসে আছে তুত্তুরী, মাঝে মাঝে ফিসফিস করে বলছে, " আমার খুব ভয় করছে মা। দাদু কি সত্যিই চলে গেছে? ফুলঝুরি যে বড্ড ছোট, ওর কি দাদুর কথা আদৌ কিছু মনে থাকবে?"


রাত সোয়া একটা, ঘুমন্ত শহরের বুক চিরে গাড়ি এসে থামল চেনা বাড়িটার সামনে। আপাতদৃষ্টিতে সব একই আছে, অথচ কিছুই আর এক নেই। এত ক্ষণ মনে হচ্ছিল সময় যেন কাটছেই না। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, এই পথ না শেষ হলেই বোধহয় ভালো ছিল। ফ্ল্যাটের বাইরে ছেড়ে রাখা এত গুলো জুতোই বলে দিচ্ছে এই বাড়িতে আজ কোন কিছুই স্বাভাবিক নেই।  চার ভাই, দুই ভাই বউ, বোন, ভগ্নিপতি, ভাইপো, ভাগ্নে, ভাগ্নে বউ ঘিরে আছে আমার মজলিশি শ্বশুরটাকে। আড্ডা দিতে বড় ভালোবাসতেন ভদ্রলোক। স্টাডি রুমের সিঙ্গেল খাটটাতে আজ একাই শুয়ে আছেন ভদ্রলোক। একটা চোখ যেন আধ বোজা, মুখটা সামান্য খোলা, ঠিক যেন ঘুমাচ্ছেন। একটা ইঞ্চি পাড় সাদা কাপড় বুক অবধি চাপা দেওয়া। পাখার হাওয়ায় সেটা এমন থিরথির করে কাঁপছে যেন মৃদু মন্দ শ্বাস নিচ্ছেন উনি। " ক্যাথেটার নিয়ে পাজামা পরতে অসুবিধা হচ্ছিল বলাতে, আমাজন থেকে একজোড়া ধুতি অর্ডার করেছিলাম বাবার জন্য। শেষে এই কাজে লাগল ধুতিটা -!"  মৃদু অথচ হালকা সুরে কাকে যেন বলে ওঠে শৌভিক।


রাত দুটো নাগাদ একে একে বাড়ি পাঠানো হল কাকা পিসিদের। সবাই বয়োজ্যেষ্ঠ, কেউই সম্পূর্ণ সুস্থ তো নয়, রাতটা একটু না জিরোলে শরীর দেবে কি করে। আবাসিক সমবায়ের জনৈক কর্তাব্যক্তি আগেই ডেকে এনেছিলেন ডাক্তার, তিনি দেখে গেছেন শ্বশুরমশাইকে। কথা দিয়ে গেছেন ভোর পাঁচটার সময় এসে ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দেবেন। শববাহী গাড়ি ইত্যাদির জন্যও শৌভিককে চিন্তা করতে নিষেধ করে গেছেন। সকাল সাতটা-আটটার মধ্যে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কাকা - পিসিরাও ততোক্ষণে এসে হাজির হবে সবাই। আপাতত অনন্ত প্রতীক্ষা। প্রাথমিক প্রতীক্ষা উমাদের জন্য। রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ কোন মতে একটা গাড়ি যোগাড় করে দুর্গাপুর থেকে রওনা দিয়েছে উমারা। 


শ্বশুর মশাইয়ের কাছেই বসে রইল শৌভিক। ছোট ভাই বলেছে ফোনে, "বাবাকে যেন একা ছাড়িস না, দাদা। " খানিকক্ষণ আমিও বসলাম, তারপর জায়গা ছেড়ে দিলাম তুত্তুরীকে। জীবনে প্রথম মৃত্যু দেখল মেয়েটা। ব্যাপারটা এখনও অনুধাবন করতে অসুবিধা হচ্ছে ওর। টেবিলের ওপর এখনও রাখা আছে শ্বশুর মশাইয়ের শেষ না করা বই, ডাইরিতে ওনার হাতে লেখা আজ পর্যন্ত কি কি ওষুধ খেয়েছেন, ঢাকা দেওয়া গ্লাসে অর্ধেক জল - সবকিছুই বাবার সাথে ভাগ করে নিতে চায় তুত্তুরী। মেয়ের মুখে সব খুঁটিনাটি শুনতে চায় শৌভিক। 


শাশুড়ি মা কিছুক্ষণ পরপরই জানতে চাইছেন, ছোট ছেলে কতদূর এল। দুঃখিত ভাবে মাথা নেড়ে বলছেন, "যে যাবার সে তো চলেই গেছে, ওরা এত রাতে অতটুকু বাচ্ছা নিয়ে এভাবে না এলেই ভালো করত।" কখনও বা বলছেন, " আচ্ছা অনিন্দিতা, তুমি গ্যাস বুক করতে পারো? আমি তো কিছুই জানি না। সব তোমার শ্বশুরমশাই করতেন।" সত্যিই শ্বশুর মশাই সব করতেন, টাকাপয়সা তোলা, গৃহ সহায়িকাদের বেতন দেওয়া, ফোনে দোকানবাজার, ওষুধ আনানো, বাড়ির প্রতিটা কোণে নজর রাখা - সব, সব করতেন অসুস্থ বৃদ্ধ একাই। বৃদ্ধা তো মোবাইলে ফোনটুকুও ধরতে স্বচ্ছন্দ নন। 


কাঁথি থেকে কলকাতা আসার পথে এই কথাটাই বলছিলাম আমরা,  এনাকে একা গৃহ সহায়িকা বা আয়া দিদির ভরসায় মহানগরে ছেড়ে যাওয়া অবাস্তব। তবে সে তো অনেক পরের কথা, এখনও তো শ্বশুরমশাই আছেন। ঘুমিয়ে আছেন স্টাডি রুমে। অপেক্ষা করছেন আদরের কনিষ্ঠ পুত্র আর পুত্রবধূর জন্য। চোখ রগড়ে, "আসছি" বলে হাঁক পেড়ে, দরজা খুলি আমি। আমার সামনেই সপরিবারে আমাদের উমারাণী। উমার কোলে সদ্য ফোটা ফুলের মত ঘুমন্ত ফুলঝুরি, মুখের মধ্যে দুটো আঙুল পুরে ঘুমাচ্ছে। দুহাত বাড়িয়ে কোলে নিই মেয়েটাকে, উমা কোন মতে জানতে চায়, " দিদিভাই, বাবা কোথায়?"

অনির ডাইরি ১৩ ই মে, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



কিছু কিছু রাত কেন যে আসে? আসবে একদিন এতো জানা কথাই, তাই বলে এমন অতর্কিতে কেন এসে হাজির হয়! দিব্য তো চলছিল দিনটা, গতানুগতিক ভাবে, সেই ভোরে ওঠা, তুত্তুরীকে স্কুলে পৌঁছানো, আমাদের অফিস, ফিরে এসে কফির কাপে দৈনিক চব্য, শ্রীমতী তুত্তুরীকে পড়তে বসানো, পড়া আধখেঁচড়া ফেলে ঝটপট চিকেন স্টু রান্না করা, সাড়ে নটায় নৈশভোজ - কোথাও এক বিন্দু বিচ্যুতি ছিল না দিনটার মধ্যে। 


রাত দশটা নাগাদ, মোবাইলটা নিয়ে বসলাম। একটা নতুন ওয়েব সিরিজ ধরেছি, সেটাই এবার দেখব যুৎ করে। পাঁচ মিনিট দেখেছি কি দেখিনি, দরজা খুলে ঢুকে এল শৌভিক। একদম সাধারণ ভাবে বলল, " বাবা মারা গেছে।" লিখতে বসে, এখনও হাত কাঁপছে, ধড়পড় করছে বুক।শুনে আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, " যাঃ! কি যাতা বলছিস।" তারপর খুব রাগ হল, একি ধরণের অলক্ষুণে কথাবার্তা। 


শৌভিক একই রকম শান্ত ভাবে বলল, " হ্যাঁ রে, সত্যি। বাবা মারা গেছে।" কোন মতে বললাম কে বলল? জবাব এল, " সবিতা দি ফোন করেছিল। বলল, কাকু এই মাত্র চলে গেলেন।" সবিতা দি হল বাড়ির দিনরাতের সহায়িকা। বৃদ্ধ-বৃদ্ধার নড়বড়ে শারীরিক অবস্থার জন্য, দুই বউয়ের পরোক্ষ ইন্ধনে, প্রবল ধমকধামক দিয়ে যাকে রাখতে বাধ্য করেছিল দুই ছেলে। 


কথা বলতে বলতেই হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখে শৌভিক, পরক্ষণেই ফোন করে সবিতা দিকে, " তুমি আমায় ফোন করার কতক্ষণ আগে ঘটেছে ঘটনাটা? দশ মিনিট? আচ্ছা, তার মানে ৯টা ৫০।" ফোন রেখে আবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে শৌভিক, "চার ঘণ্টার আগে ডেথ সার্টফিকেট পাওয়া যাবে না। তার মানে রাত দুটো। শব বাহী গাড়িও যোগাড় করতে হবে।" 


আমি অঝোরে কাঁদছি, ঘড়ি থেকে আমার দিকে চোখ নামিয়ে ধমকে উঠল, " দাঁড়া এখন ঘ্যানঘ্যান করিস না। আত্মীয়স্বজনদের ফোন করতে হবে। পিসিকে ফোন করে দি, ওই বরং সবাইকে খবর দিয়ে দিক। আমি গাড়িকে খবর দি, ব্যাগ গুছাই। সিকিউরিটিকে কি নেব,না নেব না?"   


বেশ খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে থাকি আমি, আমার বরটা কি যন্ত্র হয়ে গেল! বাবাকে ঘিরেই তো ঘুরত ওর জীবন। বাবার শিক্ষা, বাবার আদর্শ, বাবার জীবন দর্শন - থেকে বাবা বিচ্যুত হলেও, আমার বর হয় না। আর আজ যখন সেই বাবা চলে গেছে চিরতরে, ও এতটুকু ভেঙে পড়ছে না কেন? 


চোখ মুছে পাশের ঘরে গিয়ে দেখি, কাকে যেন ফোন করছে শৌভিক, " গুড ইভনিং ম্যাম। আমি শৌভিক বলছি, এসডিও কন্টাই। এই মাত্র খবর এল, আমার বাবা মারা গেছেন। যদি অনুমতি দেন তো -"। বুঝতে পারলাম মাননীয়া জেলা শাসক মহোদয়াকে ফোন করছে, স্টেশন লিভের অনুমতি নিতে। কাঁথিতে আগামী ২৫ শে মে নির্বাচন, এই মুহূর্তে শেষ পর্যায়ের কাজ চলছে পুরোদমে। আগামী কাল সকাল সাতটা থেকে শুরু হবে ইভিএম কমিশনিং এর কাজ। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সামনে, প্রতিটা ইভিএম মেশিন খুলে তাতে ব্যালট পেপার ভরে সিল করা। সেই কর্মযজ্ঞ চলবে কাল পরশু দুই দিন ধরে। 


"অনেক ধন্যবাদ ম্যাম" দিয়ে ফোন শেষ হল। বুঝলাম অনুমতি পেয়েছে। এবার ড্রাইভারকে ধরার পালা। সে বেচারী সবে খেতে বসেছিল। ব্যক্তিগত নম্বরে ততোক্ষণে একের পর এক ফোন এসেই চলেছে। কিছু শৌভিক ধরছে, কিছু আমি। তীব্র শোকের মধ্যেও পিসি দায়িত্ব নিয়ে সবাইকে খবর দিয়ে দিয়েছে, আর যথারীতি কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। আমরাও কি পারছি? আমি তো পারছি না। বিগত ১৬ বছরে কোনদিন বৃদ্ধকে সুস্থ দেখিনি। দু বার কর্কট রোগ জরাজীর্ণ করে দিয়েছিল শরীরের সব অঙ্গ তন্ত্র। তারওপর ছিল মারাত্মক শ্বাসকষ্ট। দিনে একবার, কখনও দুবার নেবুলাইজ করতেন। অক্সিজেন ও রাখা থাকত, প্রয়োজন হলেই যাতে নিতে পারেন। ইদানিং দেখা দিয়েছিল প্রস্টেটের সমস্যা। 


কিছুদিন আগেই প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, আধ বেলা ছুটি নিয়ে দৌড়ে এসেছিল শৌভিক। অথচ কিছুতেই ডাক্তারের কাছে গেলেন না বৃদ্ধ। যেন বড় ছেলেকে দেখার জন্যই ঘাপটি মেরে বসে ছিল যত ব্যাধি। ছেলে এল, ওমনি সব ঠিক। ফিরে যাবার সময় বারবার বলল শৌভিক, "কাঁথি চল"। তাও এলেন না। কেন যে এলেন না, কি জানি এলে হয়তো অন্য রকম হত সবকিছু। সেবার শৌভিক বলে এসেছিল," আগামী ২৬ শে মে পর্যন্ত কিন্তু আর আসতে পারব না। সাবধানে থেকো।"


 এই বলাটাই যেন কাল হয়ে গেল, বিগত দিন কয়েক ধরে এমন ছেলেমানুষী শুরু করলেন বৃদ্ধ। আজই তো সকালে ফোন করেছিল ছেলেটা, এই আবাসনে বাড়ি বাড়ি ঘুরে রক্ত -মল-মূত্রের নমুনা সংগ্রহ করে ছেলেটা। রাগত স্বরে বলল, " দিদি আর পারছি না। মেসোমশাইকে নিয়ে আমি জ্বলে পুড়ে মরলাম। একবার করে বলে," সুপ্রিয় এসে ক্যাথিটারটা লাগিয়ে দিয়ে যাও। দুদিন যেতে না যেতেই বলে, সুপ্রিয় খুলে দিয়ে যাও।" শুনুন দিদি,প্রতিবার ক্যাথিটার লাগাতে ২০০০ টাকা লাগে। সে ওনার টাকা, উনি জলে দিন। কিন্তু এই খোলা পরার চক্করে প্রতিবার রক্তক্ষরণ তো হচ্ছে। এইভাবে চলতে থাকলে ঈশ্বর না করুন, প্রস্টেট ক্যান্সার না হয়ে যায়। পরশু লাগিয়েছি,আজ বলছে আমি ডাক্তারের কাছে যাব, খুলে দিয়ে যাও। আমি আর যাচ্ছি না।"


কি সর্বনাশ, কোন ডাক্তারের কাছে যাবে আবার? হেঁপো বৃদ্ধের তো একা একা বাড়ি থেকে বেরোনোই নিষেধ। সেসব পাত্তা না দিয়ে এই তো দুদিন আগে কোন হাসপাতালে যেন ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিল একাকী। প্রস্টেট সংক্রান্ত ডাক্তার। দুর্গাপুর থেকে আমার দেওর পইপই করে নিষেধ করেছিল, বলেছিল," একটু দাঁড়িয়ে যাও, আমি আসছি।ঘন্টা চার- পাঁচের মধ্যে পৌঁছে যাব।" যথারীতি কথা শোনেনি বৃদ্ধ। তাকে ভুজুংভাজুং দিয়ে নিরস্ত করে, একাই চলে গিয়েছিল। সাধে আমার দেওর গোঁসা করে, যে "বাবা কেবল দাদাকেই ভরসা করে।" 


এত যে জেদ করে ডাক্তারের কাছে গেল,তার কথাও তো পছন্দ হল না বাবার। ক্যাথেটার লাগানো নিয়ে কোন কথাই শোনেননি নাকি ডাক্তার। বলেছেন, "ওতে অভ্যস্ত হতে হবে। এই সমস্যা আপনার চলতেই থাকবে। এই বয়সে ভুলেও অস্ত্রোপচারের কথা ভাববেন না।" তাও কি সব টেস্ট করিয়ে প্রায় চার পাঁচ ঘণ্টা পর বাড়ি ফিরেছিলেন বৃদ্ধ। অতক্ষণ হাসপাতালের হাওয়ায় থাকার জন্য সেকেন্ডারি ইনফেকশন হতে পারে বলে, জ্যেষ্ঠ পুত্রের কাছে তার জন্য প্রবল ধমকও খেয়েছেন। 


আবার সেই জ্যেষ্ঠ পুত্রেরই শরণাপন্ন হলাম আমি, "ওগো দেখো, বাবা কি করছে।" সকাল পৌনে দশটা নাগাদ বাবাকে ফোন করল শৌভিক, " আজ আবার কোন ডাক্তারের কাছে যাচ্ছ?" জানা গেল, কোন্নগরের আহমেদ ডাক্তারের কাছে যাবে শ্বাসকষ্টের জন্য। তিনি তো হোমিওপ্যাথ। আজ প্রায় তিরিশ বছর ধরে শ্বাসকষ্টে ভোগেন শ্বশুর মশাই, দীর্ঘদিন ধরে যে অ্যালোপাথ ডাক্তারকে দেখাতেন, তাকে আজকাল বাতিল করেছেন। কারণ তাঁর কাছে গেলেই তিনি বলেন, "আমার কাছে ঠিক কেন এসেছেন? ওষুধ, পত্র, নেবুলাইজার, স্টেরয়েড, অক্সিজেন সবই তো বাড়িতে মজুত থাকে। শ্বাসকষ্টের আর তো কোন চিকিৎসা নেই।" যথারীতি বাবার তাঁকে আর পছন্দ হয় না। সম্প্রতি দুয়েক বছর অন্য এক ডাক্তারকে দেখাচ্ছিলেন, তিনি পরের বার ব্রংকিয়োস্কপি করে যেতে বলেছিলেন। সেটা করতেও বাবার আতঙ্ক, তা না করিয়ে এবার তিনি হোমিওপ্যাথ ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে চাইছেন।


মনে আছে শৌভিক বলেছিল, " তুমি আগে স্টেরয়েডটা তো চালু করো। ভাই আসছে -"। আমার দেওর সত্যিই আসছিল, কিন্তু কপাল গুণে আজ ১৩ ই মে, দুর্গাপুরে নির্বাচন। একটা বাস, গাড়ি কিছু পায়নি। ট্রেনে অমানুষিক ভিড়। খোঁজ নিয়ে জানাল, কাল বিকাল থেকে হয়তো কিছু বাস চলবে। প্রথম বাসেই এসে হাজির হবে কলকাতা। দরকার হলে আহমেদ ডাক্তারকে বলেও ওষুধ আনা যায়, তাই আনবে। শৌভিক বলল, " তুমি ক্যাথেটারটা লাগিয়েই রেখো। দু সপ্তাহ পর্যন্ত তো লাগানো যায়, তারমধ্যে আমার ভোট মিটে গেলেই আমি ২৬ শে রাতেই চলে যাব। তারপর তোমাদের কাঁথি নিয়ে চলে আসব। তার আগে আসতে চাইলেও কোন অসুবিধা নেই,অনিন্দিতা তো আছে।" মনে আছে বৃদ্ধ বলেছিল, " হ্যাঁ, সেই ভালো। এখন আমি এমনিতেই বেশ ভালো আছি।" 


তড়িঘড়ি খাটের নীচের বাক্স খুলে ব্যাগ বার করে শৌভিক, কি সব জামা কাপড় ভরে হড়বড় করে। মেশিনের মত করে যায় একের পর এক কাজ, ফোন ধরে চলে যন্ত্রের মত। দুর্গাপুর থেকে এক গলা কান্না নিয়ে ফোন করে আমার দেওর, " বৌদি, বাবা আর নেই না?" কি জবাব দিই? বলি, " কাঁদিস না বাবা। সবিতা দি কি দেখতে কি দেখেছে। আমরা এখনই বেরোচ্ছি, গিয়ে দেখি। নিজে না দেখলে আমি অন্তত বিশ্বাস করছি না -"। পাশ থেকে শৌভিক বলে চলে, "নেই। নেই। বাবা আর নেই।বাবা চলে গেছে-"।

অনির ডাইরি ১১ই মে, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


ঠিক করেছিলাম, হীরামাণ্ডী দেখব না। কিছুতেই দেখব না। স্বাধীনতা পূর্ব অখণ্ড ভারত, পতিতালয়, একজন জাঁদরেল মহিলা চরিত্র আর স্বাধীনতা সংগ্রাম - বড় চেনা ছক হে বাপু। একটা রাজকাহিনীই যথেষ্ট ভাই, থাক আর দেখে কাজ নেই। 


১ লা মে, সারা ভারত ভেসে গেল হীরামাণ্ডী ঝড়ে, আমি ডুবে রইলাম চাকরি থেকে সাসপেন্ড হওয়া, obsessive-compulsive disorder এ ভোগা এক সত্যান্বেষী সাধু সান্নিধ্যে। Mr. Monk, তাঁর জটিল জটিল সব কেস আর তাঁর হাজারো ফোবিয়া নিয়ে দিব্য রইলাম আমি। সিদ্ধান্তে অনড় আমি, হীরামাণ্ডী দেখছি না। দেখব না বিগত সোমবার সুকন্যা যখন লিখল, "দুদিন ধরে হীরামাণ্ডী দেখলাম। কি জঘন্য মেলোড্রামাটিক লাগল -"। নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ালাম। আমার বাপু Mr Monkই ভালো। 


তারপরই হল কেলো। আমার দেওয়ালে হঠাৎই একদিন এসে উদয় হলেন ফরিদা জালাল। তাঁর মুগ্ধ নয়ন জুড়ে এক তরুণ যুবক। বৃদ্ধার বিলাত ফেরৎ নাতি, তাজদার বালোচ। গোটা রিল জুড়েই তাজদার, বিভিন্ন ভঙ্গিমায় তাজদার। শুধু তাকানো, আর মধুর হাসি। তাতেই কাঁপন ধরিয়ে দেয় হৃদয়ে, যেমন দিতেন সাদা কালো যুগের নায়কেরা। কে এই তাজদার বালোচ? আগে কি দেখেছি কোথাও? মুগ্ধ হৃদয় কিছুই বলে উঠতে অক্ষম। গুগল বলল, দেখেছ তো। আলবৎ দেখেছ। "তাজ - ডিভাইডেড বাই ব্লাড" সিরিজে। আরে এই তো সেই রগচটা শাহজাদা মুরাদ। 


মাগো, তাতে তো একটুও ভালো লাগেনি এনাকে। চোখে পুরু সুর্মা, দুই চোখে রাজ্যের বিরক্তি আর ক্রোধ। দেখলেই কেমন যেন ক্ষ্যাপা বলির্বদ মনে হত। সিংহাসনের মত ওই সিরিজের সব গোলাপী আলোও একজনই চুরি করে নিয়েছিলেন - শাহজাদা সেলিম। মুরাদ ছিল নিছক বিরক্তি উদ্রেককারী এক আপদ। তাজদার একদমই তার উল্টো। সফিস্টিকেটেড, শান্ত, মৃদু ভাষী। গুগল বলল, ইন্টারনেটের লেটেস্ট ক্রাশ এখন তাজদার। আরও জানতে পারলাম, হীরামাণ্ডীতে তাজদারের পরিণতি মোটেই সুখকর নয়, বরং মর্মান্তিক। তাতে যেন আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠল চরিত্রটা। সুকন্যাকে সবার আগে জানালাম, দেখব ভাবছি সিরিজটা। শুধু তাজদারের জন্য। সু বলল, "আরে অদিতি রাও হায়দারিকেও দেখো। কি অসাধারণ সুন্দর।" 


দেখতে শুরু করে আর সময়ের হিসেব রইল না। কাকে ছেড়ে কাকে দেখি? মণীষা কৈরালা তো একাই একশ। সোনাক্ষির বিষাক্ত নজর। অদিতির বিখ্যাত swan walk, হাঁটতে হাঁটতে কাঁধ থেকে আঁচল নামিয়ে আঙুলে প্যাঁচানো, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানো। উফ্। সবার ওপর উস্তাদ জী। কি অসামান্য অভিনয় ভদ্রলোকের। গল্প ইত্যাদি নিয়ে অবশ্য বলার কিছু নেই। বেশ সাদামাটা গল্প, তা হোক, আমরা তো এরকম কত বিলাতী শো দেখে গদগদ হয়ে যাই। আর এতো খাঁটি স্বদেশী। 


দেখতে শুরু করার আগে, শৌভিককে ঢাক ঢোল পিটিয়ে শুনিয়ে এলাম, আমি হড়কেছি। তাজদারের রিলটাও দেখলাম,আহা একই বলে "আঁখো কি গুস্তাকিয়া-"। আমার বর দিনান্তে বাড়ি এসে কফি খেতে বসেছিল, যথারীতি তাজদারকে পছন্দ হল না। আজ অবধি আমার কোন ক্রাশকেই বা আমার বরের পছন্দ হয়েছে? সবার মধ্যেই ও গুচ্ছের খুঁত খুঁজে বার করে এবং সুকুমার রায়ের কথা "না বুঝবি তো মগজে তোর গজাল দিয়ে গোঁজাব" করে সে গুলো আমার মাথায় ঢোকায়। 


প্রথম আপত্তি তুলল তাজদারের গোঁফ নিয়ে। আরে গোঁফ তো তোরও আছে রে ভাই। যখন দেখল মাথা থেকে তাজদারকে কোনভাবেই বার করতে পারছে না, তখন অন্য পথ ধরল। " আজ একটা দারুণ ভূতের সিনেমা দেখব। মালায়ালাম সিনেমা। ব্লক বাস্টার শুধু নয়, খুব হাই ক্রিটিক রেটিং ও পাচ্ছে। দেখবি? মামুট্টি আছে।" মামুট্টি আমার বাবার প্রিয়তম নায়ক তথা অভিনেতা। খুঁজে খুঁজে ইউটিউব থেকে মামুট্টির সিনেমা বার করে দেখে বাবা। আমি বরাবরই বাবার মেয়ে, বাবার যাকে পছন্দ, আমারও তাকেই ভালো লাগে। তবে এ ক্ষেত্রে মামুট্টির থেকেও যাকে বেশি পছন্দ হল, সে হল ভূত। ভূত বা ভৌতিক সিনেমা আমার চিরকালীন দুর্বলতা। 


 জিজ্ঞাসা করলাম, কি নাম? জবাব এল ভ্রমযুগম। মুখে কি ভাব ফুটল জানি না, শৌভিক চোখ গোল গোল করে বলল, " ভ্রমযুগম মানে জানিস? Age of madness।" চটজলদি নৈশভোজের পাট চুকিয়ে, ঘর অন্ধকার করে একরাশ উৎসাহ নিয়ে যুগলে দেখতে বসলাম। শ্রীমতী তুত্তুরীকেও আহ্বান জানানো হয়েছিল, তিনি যখন শুনলেন প্রায় আড়াই ঘণ্টার ছায়াছবি, সটান পিঠটান দিলেন। "বাবা গো, এত বড় সিনেমা কে দেখবে -"। 


অগত্যা আমি আর তুমিই ভরসা। শুরু হল সিনেমা। সাদাকালো। শুনলাম গোটা সিনেমাটাই নাকি সাদাকালো। ষোড়শ শতকের কেরালা। দক্ষিণ মালাবার অঞ্চলে পর্তুগিজ আক্রমণে পর্যুদস্ত এক রাজার দুই কর্মচারী, কোন মতে দাস ব্যবসায়ীদের হাত থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় এক গহীন জঙ্গলে। জঙ্গলের পাশ দিয়ে বয়ে যায় খরস্রোতা নদী, নদী টপকাতে পারলেই নিরাপদ আশ্রয়। অন্ধকারে নদী না পেরিয়ে,জঙ্গলের মধ্যেই আশ্রয় নেয় দুজনে। রাতের বেলা এক সুন্দরী পেত্নী ( যক্ষী) আক্রমণে নিহত হয় একজন, অন্যজন পালাতে পালাতে গিয়ে উপস্থিত হয় ভগ্নপ্রায় এক বিশাল অট্টালিকায়। 


এত বড় হাভেলী, কিন্তু বাসিন্দা কেবল দুই জন। বৃদ্ধ কিছুটা ক্ষেপা গৃহকর্তা কদুমন পোট্টি আর এক পাচক তথা গৃহসেবক। গৃহকর্তার নিমন্ত্রণে একটা রাতের জন্য থেকে যেতে রাজি হয়ে লোকটি, এমনিতেই বেশ কিছুদিন ধরে অভুক্ত। সামান্য দুমুঠো অন্নের জন্য থেকেই যায় লোকটি। এই থেকে যাওয়াই কাল হয়ে দাঁড়ায় হতভাগ্য লোকটির জন্য। কেন এবং কিভাবে সেটাই নিয়েই গল্প। যদি প্রশ্ন করেন,ভালো লেগেছে কি না, তো আমি তো অন্তত বলব মোটামুটি। অভিনয় নিয়ে কোন কথা হবে না, মাত্র তিনজন চরিত্র নিয়ে গড়িয়েছে গল্পটা। কদুমন পোট্টি - পাচক আর আশ্রিত ব্যক্তি। তিনজনেই ফাটিয়ে অভিনয় করেছে, কাকে ফেলে, কার কথা বলি। গোটা ফিল্মটাই সাদাকালো, এই বর্ণহীনতা আলাদাই এক মাত্রা এনে দেয় ভৌতিক সিনেমায়। শুধু আর একটু ছোট হলে বড় ভালো হত।  


সেটাই বললাম শৌভিককে। আর বললাম, ভূতটা মোটেই ভয় দেখানো টাইপ লয়। ভয় টয় কিস্যু তেমন লাগল না বাপু। শৌভিক মানলে তো নাই, উল্টে রেগে আগুন হয়ে বলল, " আসলে তুই কিছু বুঝিসই নি। এই সব সিনেমা তোর জন্য না, তুই যা তো, যা, গিয়ে হীরামাণ্ডীই দেখ।" যেন না বললে আমি দেখতাম না 😤।

অনির ডাইরি ৯ই মে, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



অফিসে বেরিয়ে, গাড়িতে উঠেই ফোনটা করলাম, " হ্যাপি বাড্ডে বাবা।" বিগত দিন কয়েক ধরেই, শ্বশুরমশাইয়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, গলার জোরও এসে ঠেকেছে তলানিতে, সেই অবস্থাতেই কোন মতে বললেন, " সে তো কালকে ছিল।"


সে আবার কি কথা, গতকাল কি করে থাকতে পারে? আজই তো ২৬ শে এপ্রিল, বাংলায় ১২ই বৈশাখ। আজকের দিনেই তো ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন ভদ্রলোক। আজকের দিনটার জন্য কবে থেকে আঁচলে গিঁট বেঁধে রেখেছি আমি। ভেবেছিলাম, তুত্তুরীকে বগলদাবা করে, সটান গিয়ে হাজির হব মহানগরে। সঙ্গে নিয়ে যাব পায়েস, কেক আর ওনার প্রিয় দুয়েকটি পদ। বৃদ্ধের হঠাৎ অসুস্থতা দিলে সব কেঁচে গণ্ডুষ করে। এবার তাই শুকনো ফোনই সম্বল।


কিন্তু বৃদ্ধ মানলে তো। যতবার আমি বলি, আজই আপনার জন্মদিন, ততোবার বৃদ্ধ বলে, "মোটেই না, গতকাল ছিল -।" এতো মহাজ্বালা। ভ্রাইভারের কান বাঁচিয়ে, দুদিক থেকে হিসেব করতে বসলাম দুজনে - ১৪ই এপ্রিল ছিল পয়লা বৈশাখ, তাহলে ১৫ই এপ্রিল, ২রা------- করতে করতে দেখা গেল, সত্যিই ২৬ নয়, ২৫ শে এপ্রিলই ছিল ১২ই বৈশাখ। শ্বশুরমশাইয়ের ৭৮ তম জন্মদিন। 


এক অদ্ভুত বিষাদের মেঘ পলকে ঢেকে দিল আমায়। ইশ্ বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়ে, এত বড় ভুল কি করে করতে পারলাম? পিসি - বাবা - মা- শ্বশুর মশাই আর শাশুড়ি মাতা এই পাঁচ বয়োজ্যেষ্ঠকে কেন্দ্র করেই প্রতি মুহূর্তে আবর্তিত হয় আমাদের জীবন। আর এই পাঁচজনের মধ্যে, জন্মদিন নিয়ে আবেগ কেবল এই বৃদ্ধেরই আছে। বাকিদের ক্ষেত্রে জন্মদিনটা "ভূতের আবার জন্মবার" গোছের হলেও, শ্বশুরমশাই কিন্তু আশা করেন যে ওনার জন্মদিনে সবাই উপস্থিত থাকব, পায়েস বানানো হবে, কেক কাটা হবে। নাতনীরা শোরগোল করবে। সস্তাতম হলেও একটা নতুন জামা গায়ে গলাবেন উনি - একটা দিন, বছরে কেবল একটা দিনের জন্য উনিই হবেন সকল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। 


২০২১ সাল অবধি তাই তো হত। তখন যে একসাথে থাকতাম সবাই। পেশার টানে ইদানিং ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছি আমরা। গেল বার যখন কাঁথি আসেন, কথা প্রসঙ্গে বলেই ফেলেছিলেন শ্বশুরমশাই। " আমার জন্মদিনটা কারো মনে থাকে না।" অভিমানটুকু যদিও ছিল শাশুড়ি মাতার প্রতি। তিনি যে সত্যিই ভুলে যান। ভুলে না গেলেও, তাঁর নিজেরই যা শারীরিক অবস্থা কতটুকুই বা করতে পারতেন তিনি। 


দুর্বল অস্থিচর্মসার বৃদ্ধের অভিমানী কথা গুলো বড়ই মর্মন্তুদ লেগেছিল আমার। তখনই ঠিক করেছিলাম শৌভিক না পারলেও, সবৎসা আমি ঠিক গিয়ে হাজির হব ওনার জন্মদিনে। এমনই ভাগ্যের পরিহাস যে জন্মদিনের ঠিক তিনদিন আগে ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়লেন বৃদ্ধ। এমনিতেই দু-দুবার কর্কট রোগাক্রান্ত, তারওপর আছে তীব্র শ্বাসকষ্ট। গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে আবার প্রস্টেট সংক্রান্ত জটিলতা। ডাক্তার সাফ বলে দিয়েছে, অপারেশনের প্রশ্নই ওঠে না। ওনার যা শারীরিক অবস্থা, ওই ধকল উনি নিতে পারবেন না। 


সেই সংক্রান্ত জটিলতায় হঠাৎ এমন কাবু হয়ে পড়েন, যে নির্বাচনী ব্যস্ততার মধ্যেও একদিনের ছুটি নিয়ে দৌড়াতে হয় শৌভিককে। ফলে বাতিল করতে হয়েছে আমাদের অতর্কিত হামলার পরিকল্পনা। ভাবলাম শুকনো একটু শুভেচ্ছাই জানাই, তাও একটু ভালো লাগবে বৃদ্ধের। জানাতে গিয়ে দেখি, তাতেও কেলো করেছি। বিলম্বিত শুভেচ্ছা জানালাম, বৃদ্ধ ধন্যবাদ দিল বটে, ছিটেফোঁটাও যে খুশি হল না, তা আমি এই পৌনে দুশ কিলোমিটার দূর থেকেও দিব্য অনুভব করলাম। মদ্যাভাবে গুড়ং দদাৎ কেস হল আর কি।


নাঃ, এত দূর থেকে এই অভিমানী বৃদ্ধের জন্মদিন পালন,যা দেখছি আমার একার দ্বারা সম্ভব নয়। কেন যে ইংরেজি মতের জন্মদিনটা পালন করেন না ভদ্রলোক, কে জানে বাবা। ফোনটা রেখে, উমাকে ধরলাম। বাড়ির ছোট বউ শুধু নয়,উমা হল বৃদ্ধের আদরের কন্যা। আমার মত অপদার্থ নয়,ও নির্ঘাত ঠিক টাইমে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। ওকেই বলি,ভাই রে পরের বার থেকে সঠিক তিথিটা আমাকেও একটু মনে করিয়ে দিস তো। 


হরি ! হরি! ফোন ধরে তিনি কইলেন, " না দিদিভাই, বাবার জন্মদিন তো ২৮ শে এপ্রিল। এই দেখো না, আমি রিমাইন্ডার দিয়ে রেখেছি, ফোন করব বলে।" নিজেদের গুণপনায় নিজেরাই মুগ্ধ হলাম, হাসলাম গলা ফাটিয়ে। তারপর প্রতিশ্রুতি বদ্ধ হলাম, সামনের বছর থেকে এপ্রিল পড়লেই মনে করিয়ে দেব একে অপরকে। তারপর যে প্রান্তেই থাকি না, বরগুলো যত ব্যস্তই থাকুক না কেন, ছানাগুলোকে ট্যাঁকে নিয়ে আমরা দুজনে ঠিক গিয়ে হাজির হব মহানগরের এক প্রান্তে বুড়োবুড়ির সংসারে। একজন পায়েস আনব, অন্যজন কেক। 


কিন্তু সেতো আসছে বছরের কথা, এবছর কি হবে? সময় যে বড় নির্মম, নিমেষে লণ্ডভণ্ড করে দেয় সব হিসেব।সময় বড় চঞ্চলও, মুঠোর ফাঁক গলে কেবলই হারিয়ে যেতে চায়। তাই বলে আমরা ছাড়ব নাকি? দুজনেরই টুকটাক কাজ ছিল মহানগরে, জুটিয়ে বাটিয়ে, নানা অজুহাত দেখিয়ে সব একই সঙ্গে ফেললাম আমরা। যাতে ওই সুযোগে মেলে মহানগর যাওয়ার অনুমতি। তারপর? তারপর আর কি! শ্বশুরমশাইয়ের দুই পুত্রবধূর সম্মিলিত উদ্যোগে কেক ও হল,পায়েসও হল, নাতনীদের হুল্লোড়ও হল।মাত্র এক সপ্তাহ দেরী হল এই যা। পাট ভাঙ্গা পাঞ্জাবি পড়লেন শ্বশুর মশাই, পরিপাটি করে আঁচড়ালেন মাথার চার গাছি চুল, তারপর জমিয়ে এসে বসলেন গিন্নীর পাশে। আলগোছে বললেন, "তুমিও একটা ভালো শাড়ি পরলেই তো পারতে।" আমরা ততক্ষণে চিৎকার জুড়েছি, ফুঁ দাও, ফুঁ দাও। যতটা অভিমান জমিয়েছিলে, ততো জোরে ফুঁ দাও তো দেখি।


চিত্র সৌজন্য - শ্রীমতী তুত্তুরী

অনির ডাইরি ৬ই মে, ২০২৪

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 


অফিসে ঢোকার ঠিক মুখেই ফোনটা বাজল। আজ ICSE আর ISC এর রেজাল্ট বেরিয়েছে, অনেকেই ফোন করে তাঁদের সন্তানদের রেজাল্টের খবর দিচ্ছেন। যখনই কেউ ফোন করছে, অভিনন্দন জানানো দূর আমি আকাশ থেকে পড়ছি, " কি বলছেন গো? আপনার ছেলে/মেয়ে? ICSE/ISC পাশ করেছে? কি করে সম্ভব? ওই পুঁচকে মেয়ে/ছেলেটাকে তো সেদিনই দেখলাম, নাক দিয়ে ইয়ে গড়াচ্ছে/ লুকিয়ে নাক খুঁটছে। সে কোন যাদু মন্ত্রে এত ধেড়ে হয়ে গেল রাতারাতি?" সময় এত দ্রুত কেন ছোটে, কে জানে। 


ভাবলাম তেমনই কেউ করছে বুঝি। আমার যে বয়সের গাছ পাথর রইল না, সেই অনুভূতি নতুন করে জাগাতে। ফোন খুলে দেখি আমার বর। তার আবার কি হল? এই তো ঘন্টা খানেক আগেই দেখা হল। "বেরো - বেরো- বেরো- বেরো" করে প্রায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ভাগাল বাড়ি থেকে। রোজই তাই করে, নাহলে আমি নাকি আরো দেরী করব, অফিস বেরোতে। 


অসময়ে বাড়ির ফোন এলে একটু ভয় ভয়ই লাগে। ফোন ধরে তাই বললাম, "কি আবার হল? সব ঠিক -"। কথা শেষ করতে না দিয়ে ওদিক থেকে গম্ভীর গলায় শৌভিক বলল, " আমার জুতোয় একটা ব্যাঙ ঢুকে বসেছিল।" প্রথমে মনে হল, এটা বলতে এই নির্বাচনী ব্যস্ততার মাঝে আমায় ফোন করেছে?  পরক্ষণেই অনুধাবন করলাম, জুতোয় ব্যাঙ ঢোকা মোটেই ভালো ব্যাপার লয়। বললাম, " ঝেড়ে পরেছিলি তো?" 


উল্টো দিক থেকে কাঁদো কাঁদো সুরে শৌভিক বলল, " না তো।" মানে কি? অ্যাঁ? ব্যাঙ একটা বড়সড় জিনিস, কিন্তু আরশোলা-মাকড়সা -টিকটিকি তো ঢুকে থাকতেই পারে। হরবখত ঢোকে, তাই তুত্তুররীকে ছোট থেকে জুতো ঝেড়ে পরতে শিখিয়েছি। অথচ তার বাপ সেটা শেখেনি?


 বলাতে শোভিক বলল, "আরে রোজই তো পরি। আজ তাড়া ছিল, তারওপর একটা ফোন ও এসেছিল। তাই কথা বলতে বলতে সটান দিয়েছি পা গলিয়ে। একটা পা দিব্য গলে গেল, অন্যটা আর গলেই না। জোর করে ঢোকাতে গেলাম, পায়ের আঙুলে কেমন যেন কুড়কুড় করল।" 


 উফ ভগবান। এমন আপদ, যে  বোঝেওনি যে ভিতরে একটা আস্ত জীব ঢুকে বসে আছে। তারওপর দিয়ে চেপে পা ঢোকাতে গেছে আবার। কে জানে,ব্যাঙটা আছে, না থেঁতলে গেছে? শৌভিক আশ্বস্ত করার ঢঙে বলে, " আছে, আছে। পা কেন ঢুকছে না দেখার জন্য আমি যখন জুতোর ভিতরে হাত গলালাম, হাত বার করে দেখি, হাতের ওপর বসে একটা হোৎকা ব্যাঙ গম্ভীর মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর আমার হাত থেকে সটান এক লাফ মেরে বাগানে পালিয়ে গেল।" 


নিজের কানকে বিশ্বাস হয় না। বলি, " তুই আবার জুতোর মধ্যে হাত ঢুকিয়ে ব্যাঙটাকে টেনে বারও করেছিস? এত বুদ্ধি রাখিস কোথায় রে?" ফোনের ওপাশে হিহি করে হাসতে থাকে শৌভিক।ছোটবেলায় ঠাকুমা বলত, ব্যাঙের গায়ে গরল থাকে, হাত দিলেই হাতে ঘা হয়। কে জানে, কোন হাত ঢুকিয়েছিল। কে জানে, কি হবে লোকটার হাতে। তবু ব্যাঙ অবধি ঠিক আছে, কিন্তু ব্যাঙ যার খাদক তিনি যদি ওমন ঘাপটি মেরে বসে থাকেন, কি হবে? তাকেও কি ওমন ন্যাজ ধরে টেনে বার করে সোহাগী ফোন করবে?  হে ঈশ্বর, কার পাল্লায় পড়েছি? আর হ্যাঁ, হে ঈশ্বর এটাও বলো দিকি বাপু, এটা বাড়ি না চিড়িয়াখানা?


অনির ডাইরি ১লা মে, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



আমার বাবা আর মায়ের প্রেম তথা বিবাহের গল্প আগেও বহুবার লিখেছি। কখনও ইনিয়েবিনিয়ে, কখনও বা সোজাসাপ্টা। আসলে আমি জন্ম রোমান্টিক, আর শরৎ বাবু বা শরদ্বিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এর দুয়েকটি হাতে গোনা গল্প বাদে, এটাই আমার প্রিয়তম প্রেমের গল্প। 


গ্রাম রামনগর, ব্লক বেলডাঙ্গা ২, জিলা মুর্শিদাবাদ, এটাই ছিল আমার মায়ের আদি ঠিকানা। মাতামহ যখন মারা যান, মা তখন নবম শ্রেণী, মা সদ্য শাড়ি। মাত্র দুটো শাড়ি ছিল মায়ের। একটা কাচত, একটা পরতো। তারই একটা হঠাৎ চুরি হয়ে গেল একদিন। নিরূপায় হয়ে দিদার সাদা থান পরেই কাটাতে হল মাকে বেশ কিছুদিন। খবর পেয়েই  এক জোড়া নতুন শাড়ি কিনে পাঠিয়ে দিল বড় মেসোমশাই। 


 মাতামহের অকাল মৃত্যুর পর নিঃসহায় এবং মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত দিদার হাত ধরে আশ্বাস দিয়েছিলেন বড় মেসোমশাই, " কেউ না থাকুক, আমি আছি। জামাতা নয়, আজ থেকে আমাকে নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্র বলেই মনে করবেন।" আমৃত্যু সেই প্রতিশ্রুতি পালন করে গেছেন মায়েদের "জাম্বু"। এহেন জাম্বুর নির্দেশেই একদিন রামনগরের লক্ষণ রেখা পেরিয়ে মহানগরের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিল মা। লক্ষ্য একটা চাকরী। 


পড়ন্ত বিকালে ঢলে পড়া সূর্যের আলোয় স্নাত হয়ে, লালগোলা প্যাসেঞ্জার থেকে শিয়ালদা স্টেশনে যখন নামল মা, বাংলা তখন জ্বলছে আগুনের সত্তরের দহনে। আপাততঃ ঠিকানা বড় মাসির বাড়ি। বড় মেসোমশাইয়ের কড়া নির্দেশ, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। স্বাবলম্বী হতেই হবে। তার জন্য কাজ চাই, একটা চাকরী। কিন্তু চাকরী পাওয়া কি এতই সহজ? 


বেশ কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করে, স্থানীয় পোস্ট অফিসে ছোটখাট কাজ জুটল। এমন কিছু না, খাম পোস্টকার্ড লিখে দেওয়া, ফিক্সড ডিপোজিটের ফর্ম ভরে দেওয়ার মামুলী কাজ। ভ্যাক্যান্সি থাকলে দুয়েক দিনের এক্সট্রা ডিপার্টমেন্টাল কর্মীর কাজ। তাতেও চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা। রোজ যে কাজ জোটে তা নয়,কোনদিন বেশ কয়েক টাকা জুটল,কোনদিন ঠনঠন গোপাল।বড় মেসোমশাইয়ের কড়া নির্দেশ, লেগে থাকো। অধ্যাবসায় না থাকলে কিস্যু হয় না। 


 কর্মসূত্রেই আলাপ শান্তি মাসির সাথে। মহিলা সদ্য বিধবা, এক কন্যা সন্তান নিয়ে বড় বিপদে আছেন। অনেকদিন বাচ্ছার দুধের টাকাও জোটে না। মৃত স্বামীর বন্ধুদের কাছে হাত পাতেন। ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে দুই নিঃসহায় রমণীর। খুলতে থাকে লুকিয়ে রাখা বেদনার ঝাঁপি। মা জানতে পারে, শান্তি মাসির স্বামী আদতে মৃত নয়, নিখোঁজ। প্রতিপক্ষ বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল, তারপর আর তার কোন খোঁজ মেলেনি। শোনা যায় পিটিয়ে মেরে লাশ গুম করে দেওয়া হয়েছে। শান্তি মাসির মাধ্যমেই মা পরিচিত হয় তাঁর মৃত স্বামীর বন্ধু থুড়ি কমরেডদের সাথে। কমরেডদের মধ্যমণি, এক  ভয়ানক আঁতেল নকশাল নেতা। গ্রাম থেকে জীবিকার সন্ধানে আসা কৃষ্ণাঙ্গী মেয়েটাকে মোটেই পাত্তা দেয় না সে। কিন্তু মেয়েটির যে  ওণাকে বড় ভালো লাগে। সাম্য- বিপ্লব-যৌথ খামার মার্কা বুলি মেয়েটির স্বঘোষিত মোটা মাথায় একবিন্দু ঢোকে না। তবুও নেতাবাবুর অনুগামিনী হয়ে পড়ে সে। সময় পেলেই পিছনের সারিতে বসে শুনতে থাকে দিন বদলের বৈপ্লবিক স্বপ্নের ইতিকথা।  


একজনের নীরব প্রেম আর একজনের খেয়াল না করার গল্প গড়ায় বেশ কিছুদিন। আচমকা পট পরিবর্তন ঘটে সাধের বঙ্গভূমিতে। কাশিপুর বরানগর ভেসে যায় রুধির ধারায়। বছর ঘুরে যায়, বদলায় না, পরিস্থিতি। উল্টে শুরু হয় ব্যাপক ধরপাকড়। নেতামশাইয়ের পৈতৃক বাড়িতে হামলা হয় সিপিএম-পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর। লুটপাট ভাঙচুরের সাথে বেধড়ক মেরেধরে তুলে নিয়ে যায় নেতাকে। মরেই যেত হয়তো। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় ছেলেটি। 


এরপর আর কি?জেলহাজত। জামিনে ছাড়াতে হল যে জরিমানা প্রদানের প্রয়োজন, তা ছেলেটির বৃদ্ধ পিতার সাধ্যাতীত। অনির্দিষ্ট কালের জন্য জেল হাজতে থাকার জন্য যখন ছেলেটি মানসিক ভাবে প্রস্তুত, হঠাৎ একদিন জানানো হল তার জামিন মঞ্জুর হয়েছে। জরিমানা কে দিল? বিক্রি করার মত আর কোন গহণাও ততোদিনে ছেলেটির মায়ের অবশিষ্ট নেই। অবশিষ্ট বলতে সাড়ে সাত বিঘার শরিকি পৈত্রিক বাড়ি শুধু। তবে কি বৃদ্ধ পিতা সেটাই করে বসল?


উদ্বিগ্ন হয়ে জেলের বাইরে বেরিয়ে রীতিমত চমকে গেল ছেলেটি, জেলের বাইরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সেই পিছনের সারিতে বসে থাকা কৃষ্ণাঙ্গী সরল গ্রাম্য মেয়েটি। দুজনেই নীরব, শেষে ছেলেটি জানতে চাইল, “টাকা জোটালে কি করে?” মেয়েটি মাটির দিকে তাকিয়ে জানালো, দেশে গিয়ে ধান বেচে টাকা আনতে একটু দেরী করে ফেলেছে। 


এরপরের গল্প শুধুই প্রেমের,রোদে বৃষ্টিতে হাত ধরে মাইলের পর মাইল হেঁটে যাওয়া। অবশেষে ১৯৭৪এর ১লা মে,শ্রমিক দিবসের দিন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয় দুইজনে। সেদিন কোন শাঁখ বাজেনি, কেউ উলু দেয়নি, মানা হয়নি কোন লোকাচার, এমনকি বরবেশও পরেনি ছেলেটি। মেয়েটি অবশ্য সেজেছিল, সামান্য প্রসাধন, ছেলেটিরই কিনে দেওয়া তুঁতে রঙের বেনারসী আর ধার করে আনা দিদির বিয়ের গয়নায়। সামান্য রেজিস্ট্রি বিবাহ, কনের তরফে সই করেন মেয়েটির জামাইবাবু তথা আমার বড় মেসোমশাই স্বর্গীয় অজিত কুমার সিংহ মহাশয় আর ছেলেটির তরফে জনৈক অবসর প্রাপ্ত আইসিএস অফিসার এইচ এল বেরি সাহেব। বাংলার নকশাল আন্দোলন নিয়ে বেরি সাহেবের মাত্রাতিরিক্ত উৎসাহই ওণাকে ছেলেটির ঘনিষ্ট তথা শুভানুধ্যায়ী বানিয়ে ছিল। 


ক্লেদাক্ত মহানগরের কোন এক নিভৃত কিনু গোয়ালার গলিতে লালনীল সংসার সাজায় এক হেরে যাওয়া নকশাল নেতা আর চাকরী সন্ধানে উন্মুখ এক নিপাট সরল মেয়ে। ফুল বিবর্জিত নিভৃত বাসরে ছেলেটি প্রতিশ্রুতি দেয়, "আমার পক্ষে আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। তবে তোমায় নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে। আজ থেকে আমিই তোমার শিক্ষক, প্রস্তুত হও ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষার জন্য।” 


সেদিনের সেই দামাল দম্পতির প্রেমবিবাহের আজ পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হল।

Wednesday 10 April 2024

অনির ডাইরি এপ্রিল, ২০২৪

অনির ডাইরি ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



বাড়ি তো নয়, সাপেদের বারোয়ারি বৈঠক খানা যেন। তদসত্ত্বেও আলো না জ্বেলে, খালি পায়ে, প্রাণের ভয়কে তুচ্ছ করে, পা টিপে টিপে এসে যতটা সম্ভব নীরবে ফ্রিজের দরজা খুলে সবে কেকে এক কামড় দিয়েছি--- পিছন থেকে ভেসে এল শৌভিকের জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর, “কি করছিস?” একেই বোধহয় বলে, 'যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই -'। বাইরের ঘর থেকে এখনও ভেসে আসছে সুরের তীব্র মূর্ছনা, তার মধ্যেও টের পেয়েছে মাইরি। 


খট করে আলো জ্বালাল শৌভিক, কঠিন ভর্ৎসনার সুরে বলল, “এই তুই নাকি রোগা হবি? তোকে কতবার বলেছি, দরকার হলে রাতে একটা রুটি বেশী খাবি, কিন্তু মাঝরাতে উঠে চোরের মত ওই সব খাবি না। রাখ - ”। দুহাতে দুই স্লাইস, মুখ ভর্তি কেক, কি আর জবাব দি। ফোলা গাল নিয়ে চোরের মত মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। খানিকক্ষণ তিরস্কারের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর, একটু নরম হল মুখের রেখা গুলো। গলাটাও যেন সামান্য মোলায়েম হল, তিনি বললেন, “যেটা মুখে পুরেছিস, ওটা খা। বাকিগুলো ফ্রিজে রেখে বাইরের ঘরে আয়, তোকে একটা মজার গল্প বলার আছে।”


এই মজার গল্পটা সেই সকাল থেকে চলছে। অফিস টাইমে প্রথম ফোন করে বলেছিল, একটা দারুণ মজার কি যেন ঘটেছে, বাড়ি এলেই বলবে। বাড়ি এসে যখন মনে করে শুধালাম, বলল, রাতে খাবার পর বলবে। নৈশ ভোজের পর যখন জানতে চাইলাম, বলল, " এখন ভালো লাগছে না

 একটু গান শুনি, কাল বলব।" এখন আবার বলছে, এখুনি বলবে, এক মুখে যে কত কথা বলে লোকটা। 


গম্ভীর মুখে সোফায় গিয়ে বসলাম, শৌভিক বলল, “ শোন আজ দুপুরে একটা ফোন এসেছিল। অচেনা নম্বর। আমি “হ্যালো” বলতে ওপাশ থেকে এক অপরিচিত পুরুষ কণ্ঠ বলল, “আচ্ছা এটা কি কাঁথি মহকুমা শাসকের দপ্তর?” হ্যাঁ বলাতে বলল, আচ্ছা এসডিও সাহেবের নাম কি শৌভিক ভট্টাচার্য? বললাম হুঁ, তো বলল, “ওনার সাথে একটু কথা বলা যাবে?” অসহিষ্ণু হয়ে বললাম, বলছি তো, বলুন। 


ওদিকের কন্ঠস্বরে পলকে নেমে এল সম্ভ্রমের পর্দা, ভদ্রলোক অত্যন্ত বিনীত ভাবে নিজের পরিচয় দিলেন, জানলাম ভদ্রলোক বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের একজন পদস্থ আধিকারিক। অতঃপর তিনি বললেন, "স্যার যদি কিছু মনে না করেন, তো একটা প্রশ্ন করি।" অনুমতি পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, " আচ্ছা স্যার, আপনি কি গত বৃহস্পতিবার কোন ভাবে সল্টলেকে এসেছিলেন?" 


হেসে বললাম, আমি বিগত পাঁচ মাসে একবারও কলকাতা যাইনি। আর যেদিনকার কথা বলছেন, সেদিন তো এখানে পুরোদমে ইলেকশনের কাজ চলছিল। ভদ্রলোক শুনে আশ্বস্ত হলেন, তারপর যেটা বললেন সেটাই মজার। বললেন, " স্যার, গত বৃহস্পতিবার,দুপুর বেলা, সল্টলেকে অমুক জায়গায় ট্রাফিক পুলিশ একটা গাড়িকে, ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গের জন্য আটকায়। আটকানোর সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে একটি লোক নেমে আসে এবং সটান ট্রাফিক পুলিশের কলার চেপে ধরে। সাথে উদ্দাম খিস্তিখেউর। যার সারাংশ হল, " তুই জানিস, আমি কে? তুই জানিস, তুই কার গাড়ি আটকেছিস? আমি সায়ন মান্না, SDO কন্টাই"।" 


কি বলব,বুঝে উঠতে পারি না। কোন মতে বলি, সে আবার কে?বললেই হল, পুলিশ আই কার্ড দেখতে চায়নি? 


শৌভিক বলে, "আমিও তাই বললাম। SDO কন্টাই হলেও তো তার ট্রাফিক নিয়ম ভাঙার কোন অধিকার নেই। পুলিশ আইনানুগ ব্যবস্থা নিল না কেন? ভদ্রলোক বললেন, " কি আর বলব স্যার, ছেলেটি নতুন। সে ভয় পেয়ে গাড়িটাকে ছেড়ে দেয়। তারপরই স্থানীয় লোকজন, অন্যান্য গাড়িওয়ালারা ছেলেটির ওপর চড়াও হয়।" বাঃ অফিসারের গাড়ি বলে বেশ তো ছেড়ে দিলে -"। এই জল অনেকদূর গড়ায়, কমিশনারেটের মধ্যেও উত্তেজনা দেখা দেয়, এমন ভাবে কর্তব্যরত পুলিশের গায়ে হাত তোলা, গাল মন্দ করাটা কেউই ভালো ভাবে নিতে পারেনি। 


 কাঁথির মহকুমা শাসকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দিকে প্রথম পা বাড়াতেই ধরা পড়ে, যে কাঁথির মহকুমা শাসকের নাম মোটেই সায়ন মান্না নয়। অন্তত এখনও নয়। আর ভিডিও ফুটেজে যে লোকটির ছবি উঠেছে, তাকে মোটেই আমার মত দেখতে নয়। তারপরই ওরা ঘটনাটা আমাকে জানাতে ফোন করে।" 


সাগ্রহে জানতে চাই,ওরা ওর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে তো নাকি? শৌভিক কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিরুৎসুক ভাবে বলে, " নেবেই তো বলল। বলল দরকারে আপনারও সাক্ষ্য লাগবে স্যার।" বুঝতে পারলাম, মজার গল্প এখানেই শেষ। কিন্তু আমার মাথায় ঘুরতে থাকে হাজার গণ্ডা প্রশ্ন। কে এই মহাশয়? আর এত মহকুমা থাকতে কাঁথি কেন রে বাবা? কত আজব ঘটনাই যে নিত্য ঘটে চলেছে আমাদের আশেপাশে। নাহ্ লালমোহন বাবু ঠিকই কয়ে গেছেন, "ট্রুথ ইজ স্ট্রংগার দ্যান ফিকশন"।

অনির ডাইরি ২৩শে এপ্রিল, ২৯২৪ 

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 



সদ্য বিদেয় নিয়েছে শীত, বাতাসে লেগেছে সামান্য উষ্ণতার ছোঁয়া। এই সময়, প্রভাতী সূর্যের আলো মেখে হাঁটতে দারুণ লাগে। ভোর ভোর শ্রীমতী তুত্তুরীকে স্কুলে নামিয়ে, বাগানেই হাঁটছিলাম। হঠাৎ ডাকল শৌভিক, "জলদি একবার ভিতরে আয় -"। 


এই সময়টা সাধারণত স্নানে যায় শৌভিক, আজ আবার কি হল? স্নান না করে, ডাকাডাকি মানেই কিছু অপাট করেছি আমি। কি করলাম রে বাবা, ভাবতে ভাবতে বাড়ির ভিতরে ঢুকে দেখি, বাংলো চেম্বারের লাগোয়া বাথরুমের সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার বর। মুখে ভেবলে যাওয়া হাসি। নিশ্চিন্ত হলাম, হাসি মুখ যখন,তাহলে ফাঁসি দিবে নি। তবে সেই নিশ্চিন্ত ভাব বেশী ক্ষণ টিকল কই? 


বাথরুমের প্লাস্টিকের দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ, ভিতর থেকে প্রবল দুম - দুম, খচ মচ আওয়াজ আসছে। লতাদি ব্যবহার করে এই বাথরুম টা, হতবাক হয়ে বললাম, "সাত সকালে লতাদিকে বাথরুমে বন্ধ করে দিয়েছিস?" শৌভিকের হাসিটা যেন রবার দিয়ে কেউ মুছে দিল,কপালে পটপট করে পড়ে গেল অনেকগুলো ভাঁজ, নেহাৎ, কলিযুগ - নইলে ভস্ম হয়ে যেতাম নির্ঘাত। 


পিছন থেকে লতা দির গলা ভেসে এল, " আরে আমাকে কেন বন্ধ করবে? বাথরুমে গোসাপ ঢুকছে -"। অ্যাঁ! গোসাপ, আমাদের হাওড়ার ভাষায় গোহাড়গিলে। আছে বটে কয়েকখানা,মাঝে মধ্যে বাগানের পাঁচিল বরাবর গুটগুট করে হেঁটে যায়।  ছাতের জল যাবার নর্দমায় জমিয়ে বসে, ল্যাজ নেড়ে নেড়ে ঝগড়াও করে। কিন্তু বিগত এক দেড় বছরে কোনদিন বাংলোর ভিতরে ঢোকার ধৃষ্টতা দেখায়নি। 


শৌভিক বলল, " চান করতে যাবার আগে ভাবলাম ওয়াশিং মেশিন টা চালিয়ে দিয়ে যাই। জল বেরোনোর পাইপটা বাথরুমে ঢোকাতে দরজা খুলেছি,দেখি কোণাকুণি উল্টো দিকে বসে তিনি ঝিমোচ্ছেন। কাল রাতে বোধহয়, সান শেডের ওপর উঠেছিল পাখি বা কাঠবিড়ালির ছানা খেতে। তাল সামলাতে না পেরে বাথরুমের জানলার খড়খড়ি গলে ভেতরে পড়ে গেছে।" 


বুঝলাম যে পথ দিয়ে পড়েছে, সে পথ আর খুঁজে পায়নি।টাইলস লাগানো দেওয়াল বেয়ে প্রায় সাত ফুট চড়া, ওই ধুমসোর পক্ষে অসম্ভব। সারা রাত চেষ্টা করেছে নির্ঘাত। তারপর ক্লান্ত হয়ে যখন ঘুমাতে গেছে, তখনই আমার বর দরজা খুলে তাকে নতুন আলোর পথ দেখিয়েছে। তিনি আপাতত পূর্ণ বিক্রমে দরজা ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছেন। যে হারে ধুপধাপ করছেন, এই মান্ধাতার আমলের ফাইবারের দরজা কতক্ষণ টিকবে কে জানে। এক ধমক মেরে আগে তাকে শান্ত করলাম। 


ওনার আব্দার মত দরজা খুলে দিলেও জ্বালা।চৌকাঠ ডিঙালেই শ্যাম বাজারের মত পাঁচ মাথার মোড়ে গিয়ে পড়বে। যার  কোন দিকের রাস্তা গিয়েছে রান্না ঘর, খাবার ঘর, ভাঁড়ার ঘরের দিকে। তো কোনটা শৌভিকের বাংলো চেম্বারের দিকে। অবশিষ্ট পথ বেঁকে গেছে তুত্তুরী আর আমাদের শয়ন কক্ষের দিকে। কোন পথ যে তিনি ধরবেন, কে বলতে পারে। 


জানতে চাইলাম, বন দপ্তরকে খবর দিয়েছ? শৌভিক খানিক মাথা আর দাড়ি চুলকে, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, " নাহ, সামান্য একটা গোহাড়গিলের জন্য কেন শুধু শুধু আর ওদের জ্বালাব। নীলোৎপল বলেছে, ' স্যার আপনারা বেরিয়ে গেলে,আমি ওকে ঠিক বার করে দুব।" 


 এই না হলে আমার বরের বুদ্ধি। নীলোৎপল বলল, আর উনিও বিশ্বাস করলেন। নীলোৎপল বাংলোর যাবতীয় ঝাড়পোঁচ, বাগান ঝাঁট দেওয়ার কাজ করে। যাই বলা হয় খুব নিষ্ঠা ভরে করে, তাই বলে এই ধুমসো গোসাপকে বার করতে পারে কখনও। ওজনে নীলোৎপলের অর্ধেক হবে ব্যাটা। আপাতত আমার ধমক খেয়ে শান্ত হলেও, একটু আগে যে হারে গজরাচ্ছিল। 


রেগে গিয়ে বললাম, তুমি বন দপ্তরের আধিকারিককে ফোন করবে? নাকি আমি সুকন্যাকে ফোন করব? সুকন্যা বনবিবি কিনা,  বন দপ্তরের সঙ্গেই সহবাস করে। এইসব সমস্যায় আমার নির্ভরযোগ্য ঠিকানা।  আঁতে ঘা লাগল বোধহয় বাবুর, ফোন করলেন স্থানীয় আধিকারিককে, জানা গেল তিনি বদলী হয়ে গেছেন। তবে নতুন আধিকারিকের নম্বরটা দিয়ে দিলেন। তাঁকে মুঠো ফোনে ধরে,নিজের পরিচয় দিয়ে, অতিথির আগমন সমাচার দিতেই, তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়া হল, " ওটাকে রেসকিউ করতে হবে। ওটাকে রেসকিউ করতে হবে। মারবেন না যেন প্লিজ -"। 


মারব কি, আমরা তো শুধু ব্যাটাকে বাথরুম থেকে বার করে বাগানে ছেড়ে দিতে চাই। নেহাৎ নিজেদের সাহসে কুলোচ্ছে না। কে বলে সরকারি দপ্তর নড়ে না, আধা ঘন্টার মধ্যেই বন দপ্তরের লোকজন এত্ত বড় একটা সাঁড়াশি নিয়ে এল, দরজা খুলল, খপ করে ধরে একটা হাতখাঁচায় পুরে নিল। তিনি তখনও আমার ধমক খেয়ে নীরব। জুলজুল করে তাকিয়ে দেখছিল চারিধার। 


বন দপ্তরের লোকজন জানতে চাইল, " স্যার এটাকে নিয়ে কি করব?" আমরা দুজনেই কইলাম,বাগানে ছেড়ে দিতে। কিন্তু কি মনে করে,ওনারা বললেন, "দরকার নেই স্যার, আবার যদি ঢুকে পড়ে। সামনের রাস্তায় ছেড়ে দিচ্ছি, আসে পাশে এত ফাঁকা জায়গা আছে, চলে যাবে।" 


আমাদের চোখের সামনে দিয়ে চলে গেলেন তিনি।  আমরা যুগলে নিঃসন্দেহ ছিলাম, রাস্তায় ছেড়ে দেবার সাথে সাথেই খোকা বাবুর ( নাকি খুকি বিবি) প্রত্যাবর্তন হবে। কিন্তু আমাদের বিশ্বাসকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে, তিনি আর ফিরে এলেন নি। শুনেছিলাম গোসাপ থাকলে নাকি সাপ আসে না। কথাটা যে কতবড় সত্যি টের পেলাম কিছু দিনের মধ্যেই। বার তিনেক দেখা মিলল, মাননীয় পন্নগ মহোদয়ের। বুড়ো থপথপে গোহাড়গিলের মত তাঁরা সটাং শৌচাগারে সেঁধালেন না,বরং উঁকি ঝুঁকি মারতে লাগলেন শয়ন কক্ষে। আমার প্রবল বুদ্ধিমতী কন্যা তো, ফালতু তার মনে করে ওমন এক ফণাধরকে টান মেরে ফেলেই দিচ্ছিলেন সম্প্রতি। নেহাৎ অন্তিম মুহূর্তে তিনি চিড়িক করে একটু জিভ বার করেছিলেন,নাহলে যে কি হত, ভেবে আমার মা, পিসি, শাশুড়ির এখনও হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। 


ব্লিচিং, কার্বলিক অ্যাসিড যাই দাও,ব্যাটাদের ওপর কোন প্রভাব পড়ে না। এই ভাবেই চলছিল, সাপের সাথে লুকোচুরি। হঠাৎ করে আজ সকালে এসে উদয় হলেন ইনি। এবার ইনি যে তিনিই তার কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। DNA টেস্ট তো আর করিনি রে বাপু, তবে ওই আরকি, শিবরাম চক্রবর্তীর "হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন" সিরিজ পড়ে বড় হওয়া আমাদের মন, কেবলই বলে চলছে,  " আবার সে এসেছে ফিরিয়া।"অনির ডাইরি ২৩শে এপ্রিল, ২৯২৪ 

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 


সদ্য বিদেয় নিয়েছে শীত, বাতাসে লেগেছে সামান্য উষ্ণতার ছোঁয়া। এই সময়, প্রভাতী সূর্যের আলো মেখে হাঁটতে দারুণ লাগে। ভোর ভোর শ্রীমতী তুত্তুরীকে স্কুলে নামিয়ে, বাগানেই হাঁটছিলাম। হঠাৎ ডাকল শৌভিক, "জলদি একবার ভিতরে আয় -"। 


এই সময়টা সাধারণত স্নানে যায় শৌভিক, আজ আবার কি হল? স্নান না করে, ডাকাডাকি মানেই কিছু অপাট করেছি আমি। কি করলাম রে বাবা, ভাবতে ভাবতে বাড়ির ভিতরে ঢুকে দেখি, বাংলো চেম্বারের লাগোয়া বাথরুমের সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার বর। মুখে ভেবলে যাওয়া হাসি। নিশ্চিন্ত হলাম, হাসি মুখ যখন,তাহলে ফাঁসি দিবে নি। তবে সেই নিশ্চিন্ত ভাব বেশী ক্ষণ টিকল কই? 


বাথরুমের প্লাস্টিকের দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ, ভিতর থেকে প্রবল দুম - দুম, খচ মচ আওয়াজ আসছে। লতাদি ব্যবহার করে এই বাথরুম টা, হতবাক হয়ে বললাম, "সাত সকালে লতাদিকে বাথরুমে বন্ধ করে দিয়েছিস?" শৌভিকের হাসিটা যেন রবার দিয়ে কেউ মুছে দিল,কপালে পটপট করে পড়ে গেল অনেকগুলো ভাঁজ, নেহাৎ, কলিযুগ - নইলে ভস্ম হয়ে যেতাম নির্ঘাত। 


পিছন থেকে লতা দির গলা ভেসে এল, " আরে আমাকে কেন বন্ধ করবে? বাথরুমে গোসাপ ঢুকছে -"। অ্যাঁ! গোসাপ, আমাদের হাওড়ার ভাষায় গোহাড়গিলে। আছে বটে কয়েকখানা,মাঝে মধ্যে বাগানের পাঁচিল বরাবর গুটগুট করে হেঁটে যায়।  ছাতের জল যাবার নর্দমায় জমিয়ে বসে, ল্যাজ নেড়ে নেড়ে ঝগড়াও করে। কিন্তু বিগত এক দেড় বছরে কোনদিন বাংলোর ভিতরে ঢোকার ধৃষ্টতা দেখায়নি। 


শৌভিক বলল, " চান করতে যাবার আগে ভাবলাম ওয়াশিং মেশিন টা চালিয়ে দিয়ে যাই। জল বেরোনোর পাইপটা বাথরুমে ঢোকাতে দরজা খুলেছি,দেখি কোণাকুণি উল্টো দিকে বসে তিনি ঝিমোচ্ছেন। কাল রাতে বোধহয়, সান শেডের ওপর উঠেছিল পাখি বা কাঠবিড়ালির ছানা খেতে। তাল সামলাতে না পেরে বাথরুমের জানলার খড়খড়ি গলে ভেতরে পড়ে গেছে।" 


বুঝলাম যে পথ দিয়ে পড়েছে, সে পথ আর খুঁজে পায়নি।টাইলস লাগানো দেওয়াল বেয়ে প্রায় সাত ফুট চড়া, ওই ধুমসোর পক্ষে অসম্ভব। সারা রাত চেষ্টা করেছে নির্ঘাত। তারপর ক্লান্ত হয়ে যখন ঘুমাতে গেছে, তখনই আমার বর দরজা খুলে তাকে নতুন আলোর পথ দেখিয়েছে। তিনি আপাতত পূর্ণ বিক্রমে দরজা ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছেন। যে হারে ধুপধাপ করছেন, এই মান্ধাতার আমলের ফাইবারের দরজা কতক্ষণ টিকবে কে জানে। এক ধমক মেরে আগে তাকে শান্ত করলাম। 


ওনার আব্দার মত দরজা খুলে দিলেও জ্বালা।চৌকাঠ ডিঙালেই শ্যাম বাজারের মত পাঁচ মাথার মোড়ে গিয়ে পড়বে। যার  কোন দিকের রাস্তা গিয়েছে রান্না ঘর, খাবার ঘর, ভাঁড়ার ঘরের দিকে। তো কোনটা শৌভিকের বাংলো চেম্বারের দিকে। অবশিষ্ট পথ বেঁকে গেছে তুত্তুরী আর আমাদের শয়ন কক্ষের দিকে। কোন পথ যে তিনি ধরবেন, কে বলতে পারে। 


জানতে চাইলাম, বন দপ্তরকে খবর দিয়েছ? শৌভিক খানিক মাথা আর দাড়ি চুলকে, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, " নাহ, সামান্য একটা গোহাড়গিলের জন্য কেন শুধু শুধু আর ওদের জ্বালাব। নীলোৎপল বলেছে, ' স্যার আপনারা বেরিয়ে গেলে,আমি ওকে ঠিক বার করে দুব।" 


 এই না হলে আমার বরের বুদ্ধি। নীলোৎপল বলল, আর উনিও বিশ্বাস করলেন। নীলোৎপল বাংলোর যাবতীয় ঝাড়পোঁচ, বাগান ঝাঁট দেওয়ার কাজ করে। যাই বলা হয় খুব নিষ্ঠা ভরে করে, তাই বলে এই ধুমসো গোসাপকে বার করতে পারে কখনও। ওজনে নীলোৎপলের অর্ধেক হবে ব্যাটা। আপাতত আমার ধমক খেয়ে শান্ত হলেও, একটু আগে যে হারে গজরাচ্ছিল। 


রেগে গিয়ে বললাম, তুমি বন দপ্তরের আধিকারিককে ফোন করবে? নাকি আমি সুকন্যাকে ফোন করব? সুকন্যা বনবিবি কিনা,  বন দপ্তরের সঙ্গেই সহবাস করে। এইসব সমস্যায় আমার নির্ভরযোগ্য ঠিকানা।  আঁতে ঘা লাগল বোধহয় বাবুর, ফোন করলেন স্থানীয় আধিকারিককে, জানা গেল তিনি বদলী হয়ে গেছেন। তবে নতুন আধিকারিকের নম্বরটা দিয়ে দিলেন। তাঁকে মুঠো ফোনে ধরে,নিজের পরিচয় দিয়ে, অতিথির আগমন সমাচার দিতেই, তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়া হল, " ওটাকে রেসকিউ করতে হবে। ওটাকে রেসকিউ করতে হবে। মারবেন না যেন প্লিজ -"। 


মারব কি, আমরা তো শুধু ব্যাটাকে বাথরুম থেকে বার করে বাগানে ছেড়ে দিতে চাই। নেহাৎ নিজেদের সাহসে কুলোচ্ছে না। কে বলে সরকারি দপ্তর নড়ে না, আধা ঘন্টার মধ্যেই বন দপ্তরের লোকজন এত্ত বড় একটা সাঁড়াশি নিয়ে এল, দরজা খুলল, খপ করে ধরে একটা হাতখাঁচায় পুরে নিল। তিনি তখনও আমার ধমক খেয়ে নীরব। জুলজুল করে তাকিয়ে দেখছিল চারিধার। 


বন দপ্তরের লোকজন জানতে চাইল, " স্যার এটাকে নিয়ে কি করব?" আমরা দুজনেই কইলাম,বাগানে ছেড়ে দিতে। কিন্তু কি মনে করে,ওনারা বললেন, "দরকার নেই স্যার, আবার যদি ঢুকে পড়ে। সামনের রাস্তায় ছেড়ে দিচ্ছি, আসে পাশে এত ফাঁকা জায়গা আছে, চলে যাবে।" 


আমাদের চোখের সামনে দিয়ে চলে গেলেন তিনি।  আমরা যুগলে নিঃসন্দেহ ছিলাম, রাস্তায় ছেড়ে দেবার সাথে সাথেই খোকা বাবুর ( নাকি খুকি বিবি) প্রত্যাবর্তন হবে। কিন্তু আমাদের বিশ্বাসকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে, তিনি আর ফিরে এলেন নি। শুনেছিলাম গোসাপ থাকলে নাকি সাপ আসে না। কথাটা যে কতবড় সত্যি টের পেলাম কিছু দিনের মধ্যেই। বার তিনেক দেখা মিলল, মাননীয় পন্নগ মহোদয়ের। বুড়ো থপথপে গোহাড়গিলের মত তাঁরা সটাং শৌচাগারে সেঁধালেন না,বরং উঁকি ঝুঁকি মারতে লাগলেন শয়ন কক্ষে। আমার প্রবল বুদ্ধিমতী কন্যা তো, ফালতু তার মনে করে ওমন এক ফণাধরকে টান মেরে ফেলেই দিচ্ছিলেন সম্প্রতি। নেহাৎ অন্তিম মুহূর্তে তিনি চিড়িক করে একটু জিভ বার করেছিলেন,নাহলে যে কি হত, ভেবে আমার মা, পিসি, শাশুড়ির এখনও হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। 


ব্লিচিং, কার্বলিক অ্যাসিড যাই দাও,ব্যাটাদের ওপর কোন প্রভাব পড়ে না। এই ভাবেই চলছিল, সাপের সাথে লুকোচুরি। হঠাৎ করে আজ সকালে এসে উদয় হলেন ইনি। এবার ইনি যে তিনিই তার কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। DNA টেস্ট তো আর করিনি রে বাপু, তবে ওই আরকি, শিবরাম চক্রবর্তীর "হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন" সিরিজ পড়ে বড় হওয়া আমাদের মন, কেবলই বলে চলছে,  " আবার সে এসেছে ফিরিয়া।"


অনির ডাইরি ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 



 " কঁহি তো ইয়ে দিল কভি মিল নেহি পাতে, কঁহি সে নিকল আয়ে জন্মোঁ কে নাতে -"। নবুর আর আমার ক্ষেত্রে এই লাইনটা অব্যর্থ। আমি হাওড়ার মেয়ে, নবুর বাড়ি তমলুক। আর দুজনের দেখা হল কিনা, ভরা গ্রীষ্মে, তৎকালীন ভারতের দীর্ঘতম প্ল্যাটফর্মে। 


বছর সতেরো আগের কথা, আমার চাকরী জীবনের প্রথম পোস্টিং। পেশাদারী মনোভাব আসতে তখনও বাকি বেশ কিছু সময়। একদম ভালো লাগত না চাকরি করতে। প্ল্যাটফর্মে পা রাখলেই মনে হত ফিরতি ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরে যাই। হয়তো স্বভাব, অথবা আমার পেশাদারিত্বের অভাব, যে কোন কারণেই হোক, তৎকালীন বড় সাহেব কোন কাজেরই যোগ্য মনে করলেন না আমায়। সকাল থেকে বিকেল গালে হাত দিয়ে বসে থাকি, একটা অপরিচ্ছন্ন, আধা অন্ধকার স্যাঁতস্যাতে ঘরে। যার গাল ভরা নাম, "চেম্বার"। যাবার সময় দাশনগর থেকে একটা টাইমস অফ ইন্ডিয়া কিনে নিয়ে যাই, সারাদিন তাই মুখস্থ করি। এর জন্য দৈনন্দিন সাত আট ঘণ্টার জার্নি, কার পোষায়? 


আমার কম্পিউটার ইন্টারনেট কিচ্ছু নেই, আমার মোবাইল বলতে বোতাম টেপা পুঁচকে রিলায়েন্সের CDMA ফোন। রেডিও চলত বটে কিন্তু মেরেকেটে উলুবেড়িয়া পর্যন্ত। কি যে অপরিসীম যাতনায় কাটছিল দিনগুলো।  তারওপর লোকাল ট্রেনে নিত্য যাত্রা। "একটু সরে বসুন" বলতেও গলা শুকিয়ে যায়। যাতায়াত শুরু করার দিন দুই তিনের মধ্যেই প্রত্যক্ষ করলাম, এই সরে-নড়ে বসাকে কেন্দ্র করে এক মাঝবয়সী নিত্যযাত্রিনী সপাটে চড় কষালেন একটি অল্পবয়সী মেয়ের গালে। বাবা গো!


আরো কুঁকড়ে গেলাম আমি। আরো নত হল শির, আরো বেঁকলো শিরদাঁড়া। এমনি এক আঁকাবাঁকা দিনে হঠাৎ করে গায়ে পড়েই ভাব জমালো নবু। দিন দুয়েক ধরে লক্ষ্য করছিলাম বটে, লেডিজ কামরায় এক নতুন মুখ, কিন্তু ভাব জমানোর দুঃসাহস হয়নি। আলাপ হতে দেখলাম মেয়েটা মন্দ নয়। বরং বেশ ভালোই। দেখলাম প্রায় সব ব্যাপারেই দুজনে মোটামুটি সম মানসিকতাসম্পন্ন। দেখলাম একই ট্রেনে যাতায়াত করি দুজনে, এমনকি দুজনের কর্মস্থল ও পাশাপাশি।চেহারাও দুজনের গোলগাল, দুজনেই ভোজন বিলাসী,  দুজনেই বকবক করতে ভালোবাসি, সবথেকে বড় কথা দুজনেই নতুন এই শহরে। 


ভাব জমতে দেরী হল না। বিভীষিকার ট্রেন যাত্রা দেখতে দেখতে হয়ে উঠল চূড়ান্ত মনোরঞ্জক। ওই যে বললাম, উভয়েই খাদ্যরসিক, আমরা যেন ট্রেনে উঠতামই খাবার জন্য। মুখ না চললে আড্ডা জমে নাকি? মায়েরা এদিকে ভরপেট ডাল ভাত খাইয়ে পাঠাত, ব্যাগে ভর্তি টিফিন, ফল দিত, তাতে কি? ওগুলো আবার মানুষেখায়? টিফিন ফেলে, আমরা খুঁজতাম দশ টাকায় দশটা পুঁচকে মুসম্বি, মরশুমের সবেদা, জালে বাঁধা নারকেল কুল, ডাব, ঝালমুড়ি, কাঠি গজা, কুচো গজা,  কুচো পান্তুয়া, দিলখুশ, বাদাম চাক,মদন কটকটি, পাশকুড়ার চপ এবং  চা। অচীরেই আরও দুজন বাড়ল আমাদের টিমে, নিয়তি কাকিমা আর নন্দিতা দি। দুই চূড়ান্ত বর্ণময় চরিত্র। 


প্রসঙ্গত নিয়তি কাকিমাই হলেন সেই থাপ্পড় কষানো মহিলা। সামান্য রগচটা ছিলেন বটে, কি ভাবে যেন আমাদের দুজনকে অন্ধের মত ভালোবেসে ফেললেন। BSNL এ চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ছিলেন কাকিমা, যে কোন দপ্তরী বিষয়ে ওনার জ্ঞান ছিল বাঁধিয়ে রাখার মত। একবার কি কারণে যেন ট্রেন ভয়াবহ লেট। সবাই অফিস পৌঁছলাম সাড়ে বারোটার পর। সবাইকে হাফ সিএল আবেদন করতে হল। বাকি অর্ধেক দিবস অফিস করে, নবু, আমি, নন্দিতা দি তো জমায়েত হলাম খড়গপুর স্টেশনে, কাকিমার পাত্তা নেই। ফোন ও লাগে না। শেষে বাধ্য হয়ে ওকে ছাড়াই রওনা দিলাম আমরা। পরদিন যাবার ট্রেনে আবার কাকিমার সাথে দেখা, আমরা হই হই করে উঠলাম, কাল কোথায় ছিলে? কোন ট্রেন ধরলে? অফিসে কি খুব বকা খেলে ইত্যাদি প্রভৃতি। জুত করে বসে কাকিমা বললেন," আর বলিস নি। নতুন সাহেব হেব্বি কড়া।  আপিসে ঢুকতেই বলল, এটা অফিস আসার সময়? যান হাফ সিএল এর আবেদন করুন।  তাই করলাম। হাফ সিএল দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।" 


মাঝে মাঝে কাকিমা খাওয়াত। শুধু আমাদের নয়, প্রায় অর্ধেক লেডিজ কামরাকে। সবাই দীর্ঘ দিনের নিত্য যাত্রী,সবাই পুরাণ বন্ধু। সবাই টুকটাক খাওয়াত। কাকিমা যেদিন খাওয়াতেন, সবার জন্য মোচার চপ,আমাদের জন্য ডিমের চপ। কিন্তু সেটা বাকিদের বলাও যাবে না,দেখানো ও যাবে না। ডিম দেখা গেলেই কাকিমার রক্ত চক্ষু দেখতে হবে। সর্বোপরি বাকিরা কি ভাববে, ভয়ে গরম গোটা ডিমটা গালে পুরে বসে থাকতাম আমরা। 


আর নন্দিতাদির কথা যে কি বলি, প্রায় পাহাড়ের মত চেহারা ছিল নন্দিতাদির। চাঁদ পানা মুখ, বড় বড় এক জোড়া চোখ, মাছি বসলে পিছলে যায় এমন মসৃণ ত্বক। কাঁধ পর্যন্ত ছাঁটা রেশমী কালো চুল। সকালের ট্রেন পাঁশকুড়া ছাড়ালেই লেডিজ কামরা ফাঁকা হয়ে যেত, তখন সিটের ওপর পা মুড়ে বসে বাবা রামদেবের শেখানো প্রাণায়াম শুরু করতো নন্দিতাদি। বলতো রোজ নাকি ২৫ গ্রাম করে ওজন কমছে। দেখতে দেখতে শিল্পা শেট্টির মত হয়ে যাবে নন্দিতা দি। 


কেন যে শিল্পা হতে চাইত কে জানে। কে বলে মোটা মেয়েদের কোন আবেদন থাকে না? বিশাল মোটা হওয়া সত্ত্বেও নন্দিতাদির যে কত, কত শত অনুরাগী ছিল তার ইয়াত্তা নেই। কেউ ব্যাগ বয়ে দেয়, তো কেউ বাতাস করে। কেউ জুস খাওয়ায়, তো কেউ চা। লোকালের লেডিজ কামরায় অতটা খেলতে পারত না নন্দিনী দি। কিন্তু আরণ্যকে যেদিন ফিরতাম আমরা, মাঝে মাঝেই আধ গ্লাস চা খেয়ে বলতো, "এই সুজন খাবে?" সুজন নাম্নী ভদ্রলোক বিনা আপত্তিতে ওই আধ গ্লাস চা নিত আর খেয়েও ফেলত। কাকিমা দাঁত কিড়মিড় করে বলতো, " মরণ" আর নবু বলতো, "ওয়াক"। 


নিন্দুকে  বলত নন্দিতাদির হাতের মোটা সোনার বালাটা ওমনি কোন স্তাবকের দেওয়া উপহার।  প্রসঙ্গত এক্ষেত্রে নিন্দুক অর্থাৎ নিয়তি কাকিমা খোদ। কাকিমা এবং নন্দিতাদি কেউই কাউকে সহ্য করতে পারত না। দুজনেই একে অপরের অসাক্ষাতে, বিষ উগরে দিত অন্যজনের নামে। আর সাক্ষাতে গলা জড়াজড়ি করে গান গাইত, " -আবার দেখা যদি হল সখা, প্রাণের মাঝে আয়।"  কপাল চাপড়ে  বিড়বিড় করত নবু, " ওরে তোদের কি প্রেম রে" । 


 ভালো সময় কেন যে এত স্বল্প স্থায়ী হয়। আমাদের দৈনন্দিন অফিস যাওয়া,আমাদের অনন্ত আড্ডা, একসাথে ইমেল আইডি, অরকুট একাউন্ট খোলা, কাকিমার কাছে ঝগড়া, নন্দিতাদির কাছে বাৎস্যায়ন শিক্ষা, আমাদের  পার্ক হোটেলে আড্ডা, পুরাতন বাজারের নিউ রেস্টুরেন্টের ২৫ টাকায় আট পিস মাটন ( খেয়ে বেরিয়ে নিয়তি কাকিমা বলতো নির্ঘাত পাঁঠি খাইয়েছে),বোগদার বিস্কুটের মত ভাজা মোগলাই পরোটা, সকাল বাজারের ঘন বাদাম লস্যি, রেলওয়ে পার্কের পিকনিক- সব ফেলে  একদিন বিয়ে করে চেন্নাই চলে গেল নবু। জীবন হয়ে পড়ল আবার বিবর্ণ।ফাঁকা হয়ে গেল আমাদের লেডিজ কামরা, আরো ধুলি মলিন হয়ে পড়ল শহরটা, আরো অসহ্য হয়ে উঠল অফিসটা।


"এতো আকছার ঘটে, সাদা কালো লং শটে- "। এমনই ভেবে নিয়েছিলাম আমি। আমাকে তো আসতেই হবে এ পথে, পেয়ে যাব আবার নবুর মতই কাউকে। জমে উঠবে আবার আমাদের আড্ডা।অতই যদি সহজ হত জীবন। আরো আড়াই বছর থাকতে হয়েছিল ওই আপিসে, যাতায়াত করতে হয়েছিল ওই পথেই, কাউকে পাইনি নবুর মত। হয়তো নবুও কাউকে পায়নি আমার মতো। তাই না এত বছর বাদেও এত দূরে থেকেও মানসিক ভাবে এতটা বেঁধে আছি আমরা। আজও পাশাপাশি বসলে মনে হয়, কই সময় তো এগোয়নি। এই তো এখুনি এসে হাজির হবে কাকিমা, তার পিছু পিছু নন্দিতা দি। তারপরই জমে উঠবে আমাদের আড্ডা। ঠিক সতেরো বছর আগের মত। কে জানে, দৈনিক ২৫ গ্রাম করে কমতে কমতে, এতদিনে হয়তো সত্যিই শিল্পা শেঠি হয়ে গেছে নন্দিতা দি। বললেই হেসে গড়িয়ে পড়ে নবু, তারপর মুখ ঝামটে বলে, " তুই থাম।"

অনির ডাইরি ১৩ই এপ্রিল, ২০২৪ 

#অনিরডাইরি 



জানলার বাইরে নিকষ আঁধার। দূরে নিম গাছের মাথার ওপর জ্বলজ্বল করছে ঈদের বাঁকা চাঁদ। দূরে কোথাও বৃষ্টি হয়েছে নির্ঘাত, বাতাসে কেমন যেন হালকা হিমেল আমেজ। আশ মিটিয়ে ফুটেছে বেল আর কামিনী। খোলা জানলার ফাঁক গলে আসা হাওয়ায় চড়া ফুলেল সৌরভ। এই জন্যই বোধহয় বাতাসের আরেক নাম গন্ধবহ। 


এত সুন্দর পরিবেশ আর এমন মোহক প্রকৃতি, কিন্তু কিছুই যেন স্পর্শ করছে না আমায়। হৃদয় জুড়ে বিষাদের অন্ধকূপ। সদ্য মাতৃহারা হয়েছে জনৈক সহেলী। “মা চলে গেল রে---- আমার সব শেষ হয়ে গেল অনি-”-কয়েক ঘণ্টা আগে শোনা প্রিয়বন্ধুর মর্মান্তিক বিলাপ কিছুতেই ভুলতে পারছি না যেন। 


"কি রে, ঘর অন্ধকার করে ভূতের মত বসে আছিস কেন?" শৌভিকের কণ্ঠস্বরে চমকে উঠি, বেদনার কারণ ওর অজ্ঞাত নয়। তবে ছেলেদের শোকের প্রকাশ বড় কম। সমাজ সেটাই শেখায় যে। পুরুষ মানে সিংহ। হৃদয় বিদীর্ণ হোক, দায়িত্ব পালনে যেন কোন ত্রুটি না হয়। আলো না জ্বালিয়ে মিনিট দুয়েক পায়চারি করল শৌভিক, তারপর শুধাল, " গান শুনবি?" কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ঘর ভেসে গেল এলভিসের মধু ঢালা কণ্ঠ, " As the river flows, surely to the sea-"। আমাদের বিয়ের আগের রাতে এই গানের কয়েকটা লাইন লিখে পাঠিয়েছিল শৌভিক। আমি এমন পণ্ডিত, যে ভেবেছিলাম ওগুলো বুঝি আমার জন্যই লেখা। 


চুপচাপ শুনছিলাম দুজনে, হঠাৎ শৌভিক বলল, " মিক জ্যাগার মানে স্যার মিক জ্যাগার, একবার বলেছিলেন, ' ঈশ্বর যদি কখনও আমাদের সাথে কথা বলেন, তাহলে নির্ঘাত তাঁর কন্ঠস্বর এলভিসের মতোই হবে।' অথচ এই লোকটা মাত্র ৪২ বছর বয়সে কি মর্মান্তিক ভাবেই না মারা যায়। এমনিতেই শেষের দিকে মানসিক অবসাদে ভুগতেন। একে বিটলসের উত্থান, তারপর বব ডিলান তো ছিলেনই। একদিন পড়ে গেলেন বাথ রুমে। মাথায় এমন চোট লাগল, যে মাথার বেশ কিছু টিস্যু আলাদা হয়ে গেল। তারপর থেকে কি যে হল, শরীরের সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ফুলে যেতে লাগল। চরম অনাচার ও করতেন। প্রাসাদোপম বাড়ি গ্রেসল্যান্ড, একাই থাকতেন, খেতেন কেবল চীজ বার্গার আর কোক। আর কিচ্ছু না। পড়েও ছিল এমন এক ডাক্তারের পাল্লায় যে ওনার মৃত্যুর আগের সাত মাসে ৭৫৬টা ইনজেকশন আর ৫৩০০ বড়ি প্রেসক্রাইব করেছিল।" 


আঁতকে উঠি আমি, " এতো জীবন্ত গিনিপিগ বানিয়ে ফেলেছিল লোকটাকে।" বিষণ্ন ভাবে মাথা নাড়ে শৌভিক। বলে, "এর ফলে ওনার মারাত্মক কোষ্ঠ কাঠিন্য হয়। মলত্যাগ করতে বসে এমন চাপ দেন, যে হার্ট ফেল করে যায়। মারা যাবার অনেক পরে he was discovered with his pants down." এতক্ষণের পাথর চাপা বেদনা, হৃদপিণ্ডের ভালভ ঠেলে উঠে আসতে চায় গলার কাছে। অসহ্য বেদনায় শিউরে ওঠে স্বর তন্ত্রী। অন্য কি যেন গান চালায় শৌভিক। 


অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, গায়ে হাত দিয়ে ডাকল শৌভিক," তুই তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা পড়ছিলি না, কদিন আগে?" পড়ছিলাম বটে। পড়তে দিয়েছিল সুকন্যা। জোর করে ব্যাগে ভরে দিয়েছিল আগের বার যখন কলকাতা গিয়েছিলাম। এই কিন্ডলের যুগেও, বই চালাচালি আমাদের প্রায়ই হয়। শৌভিক বলে চলে, "কাকতালীয়ই বটে, আজকালের মধ্যেই তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে একটা লেখা পড়লাম। আমাদের সার্ভিসেরই এক অবসর প্রাপ্ত ভদ্রলোকের লেখা। উনি যখন ব্যারাকপুরে পোস্টেড ছিলেন, তারাদাস বাবুর সাথে অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। প্রায়ই আড্ডা দিতেন দুজনে। এমনি এক আড্ডায় তারাদাস বাবু বলেছিলেন, ' জানেন, বাবা (বিভূতিভূষণ) যখন মারা যান, আমার বয়স তিন বছর।' 


শৌভিককে থামিয়ে বলে উঠি, তাই বোধহয় যে কটা গল্প পড়লাম, কোন গল্পেই বাবার কথা নেই। কোন চরিত্রেরই বাবাকে নিয়ে তেমন কিছু লেখেননি। " হবে হয়তো," বলে শৌভিক, তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের জবানীতে ফিরে যায়, " বাবা যখন মারা যাচ্ছে, মানে আমার তো কিছু মনে নেই, শুনেছি আর কি, যে মা বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ' হ্যাঁ গো, তুমি চলে গেলে, আমাদের চলবে কি করে? আমরা খাব কি?' বাবা মৃত্যু শয্যায় বলেছিল, ' কেন তোমার বড় ছেলেকে রেখে গেলাম যে। ওই তোমাকে দেখবে।' মা তাজ্জব হয়ে বলেছিল, "বড় ছোট কি? আমার তো একটাই ছেলে, তার বয়স সবে তিন। সে কি করে সংসার টানবে?" বাবা হেসে বলেছিল, " কেন? অপূর্ব রইল তো।" বিশ্বাস করুন,বাবা মারা যাবার পর থেকেই ধীরে ধীরে পথের পাঁচালীর বিক্রি বাড়তে লাগল। পরে মাণিক বাবু যখন পথের পাঁচালী বানালেন বিক্রি আরও বেড়ে গেল। মাণিক বাবুর সৌজন্যে যেটা হল, পথের পাঁচালীর পাশাপাশি অপরাজিতও লোকে পড়তে লাগল। ফলে ওটারও বিক্রি বাড়ল। ওর জন্য দেখতে দেখতে আরণ্যক, দেবযান ইত্যাদি বইয়েরও বিক্রি বেড়ে গেল। রয়ালটির পয়সাতেই দিব্য চলে গেল আমাদের। কিভাবে বলেছিল জানি না, কিন্তু অপূর্ব একাই প্রায় ২৫/২৬ বছর আমাদের সংসারটা টেনে দিল, সত্যিই বাবার বড় ছেলে হয়ে -। " 


এতক্ষণ গলার কাছে জমাট বাঁধা ব্যথা ঝরঝর করে ঝরে পড়ল দুই চোখ, দুই গাল বেয়ে। জোরে জোরে ফোঁপাতে লাগলাম আমি, চোখের সামনে ভেসে ভেসে যেতে লাগলেন ফোকলা নুয়ে পড়া ইন্দির ঠাকরুন, হরিহর, সর্বজয়া, দুর্গা, অপু আর নিশ্চিন্দিপুরের খেলার মাঠ। যেখানে থোকা থোকা কাশ ফোটে। আর সেই কাশের বুক চিরে এক রাশ মেঘের মত ধোঁয়া ছেড়ে কু ঝিকঝিক করতে করতে ছুটে যায় স্বপ্নের রেলগাড়ি। 


মুখ ঝামটে বললাম, শত্তুর, শত্তুর! দিব্য একা একা কষ্ট পাচ্ছিলাম, তাও তো সহনীয় ছিল। গান শোনাতে ডেকে, সে কষ্ট বহুগুণ বাড়িয়ে দিল। ইচ্ছে করে, খুঁজে খুঁজে এই সব গল্প বলছে, যাতে কষ্ট বাড়ে। টকের জ্বালায় পালিয়ে এসে, তেঁতুল তলায় বাস করা হয়ে গেল আমার। উঠে চলে যাব বলে দরজা অবধি গেলাম ও, ওদিকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গান ধরলেন, " চৈত্রপবনে মম চিত্তবনে বাণীমঞ্জরী সঞ্চলিতা- ওগো ললিতা"। শৌভিক বলল "নাহ্ জমছে না। বড় বাবুরটা চালাই বরং।" শৌভিক বলল, "এই গানটা শুনে যা - ।"


গান ধরলেন দেবব্রত বিশ্বাস। একই সুর, একই কথা, একই গান। তবু যেন আলাদা। তবু যেন ব্যতিক্রম। এতক্ষণের উগ্র শোকের ওপর সামান্য হলেও যেন পড়ল যতি চিহ্ন। মুঠো ফোনটা আমার হাতে দিয়ে শৌভিক দেখাল, "দেখ একাই গাইছেন, বাড়িতে হারমোনিয়াম বাজিয়ে।" অবাক হয়ে ভাবি, কে রেকর্ড করেছিল, কিভাবেই বা করেছিল। তখন তো মোবাইল ক্যামেরার যুগ ছিল না, যে সবাই ডিজিটাল ক্রিয়েটর।


ভাবতে ভাবতে কি মনে হয়, জিজ্ঞাসা করি, রবি ঠাকুর ওনার গান শুনে গিয়েছিলেন। শৌভিক কি যেন ভাবে তারপর বলে, " এটা নিয়ে একটা মজার গল্প পড়েছিলাম। বোস বলছি। একবার ওনাকে, মানে দেবব্রত বিশ্বাসকে নাগরিক সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। তাতে ওনার হাতে মানপত্র তুলে দেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় খোদ। সেই সভায় দেবব্রত বিশ্বাস বলেন, যে উনি রবীন্দ্রনাথকে চিনতেন ব্রাহ্ম সমাজের 'রবি বাবু' বলে। ওনার জবানিতে, " মাঝে মাঝে রবি বাবু আসতেন আমাদের সমাজের সভায়। এসে কি যে গাইতেন,ঘুম পেয়ে যেত। তো একবার হয়েছে কি, আমার এক বন্ধু বলল, ' চলো শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসব দেখে আসি। সে বিশ্বভারতীরই ছাত্র।গেলাম তার সাথে। প্রার্থনার জন্য উপাসনা গৃহে সমবেত হয়েছি সবাই, দেখি ভিড়ের মধ্যে রবি বাবুও রয়েছেন। বললাম বন্ধুকে, ' আরে আমাদের সমাজের রবিবাবুও এসেছেন দেখি।" বন্ধু তো ভিরমি খাবার যোগাড়। বলে, "আরে গোটা বিশ্বভারতীই তো ওনার। উনিই তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।"


সেই রবীন্দ্র সঙ্গীতের সাথে আমার পরিচয়। তারপর গান শিখতে গেলাম ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীর কাছে। তিনি দুটি গান শিখিয়েছিলেন, একটা কি ভুলে গেছি, অন্যটা "সংকোচের এই বিহ্বলতা"। সংকোচের এই বিহ্বলতা খারাপ লাগেনি। বেশ একটা মার্চিং টিউনের মত লেগেছিল। প্রথম রেকর্ড ওটাই করি। তবে রবীন্দ্র সঙ্গীতের সাথে আমার গাঁটছড়া বেঁধে দিলেন আমার দুই ঈশ্বর, পঙ্কজ মল্লিক আর কানন বালা।" 


শুনতে শুনতে কখন যেন প্রলেপ পড়েছে ক্ষতের ওপর। শুকিয়ে গেছে চোখের জলও। থেমে গেছেন দেবব্রত বিশ্বাস ও। কানায় কানায় পূর্ণ হয়েছে হৃদয়ের ডালি। 'ব্রাহ্ম সমাজের রবি বাবু'র কথা ভেবে অধরের কোণে ফুটে উঠেছে একফালি হাসিও। দম ফেলে শৌভিক বলল, " আর গান না শুনলেও হয়। সিনেমা দেখবি? কাল তো তুত্তুরীর স্কুল ছুটি। ভোরে ওঠার তাড়া নেই।" গররাজি হয়ে জানতে চাই কি সিনেমা, জবাব আসে, " শ্রী স্বপন কুমারের বাদামী হায়নার কবলে।" এরপরের সময়টুকু শুধুই আফশোস আর হাত কামড়ানোর। কেন যে রাজি হলাম সিনেমাটা দেখতে। তবে সে তো অন্য গল্প।

অনির ডাইরি ৯ই এপ্রিল, ২০২৪

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 



ইফতার শব্দটা আজকাল লিখতে বড় ভয় লাগে। কে জানে কার কোন ভাবাবেগে আঘাত লাগে। বড় বেশি যেন আঞ্চলিক- সাম্প্রদায়িক হয়ে পড়েছি আমরা। কেউ যেন কাউকে দেখতে পারি না। সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই কেবল কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি, দম বন্ধ হয়ে আসে। কত যে অঢেল সময় এই নেটিজেনদের হাতে। 


মোরা ছাপোষা লেবার। এত জটিলতা কি আর মোদের মাথায় ঢোকে। আমরা তো বসে থাকি, কবে মাহে রমজান আসে আর হক বাবু রোজা রাখা শুরু করেন। আর আমরা শুরু করি মোদের ইফতার থুড়ি জলযোগের পরিকল্পনা। হক বাবু নিজেই নিরস্ত করেন, "একটু শেষের দিকে করুন ম্যাডাম, ফলের দামটাও একটু কমবে।" বেশ, শেষের দিকেই সই, কিন্তু মুস্কিল হল, মাস শেষ হবার আগেই যে নির্বাচনী নির্ঘণ্ট ঘোষণা হয়ে গেল। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল নির্বাচনী নিত্যকর্মে। তাহলে কি এবার আর আমাদের ইফতার পার্টি হবে নি?


তা আবার হয় নাকি। আমাদের সবার সব অনুষ্ঠানে সবার আগে অংশ নেন হক বাবু। সে যোশুয়ার ক্রিসমাস হোক বা আমাদের দীপাবলী। এই তো সেদিন আমাদের বসন্তোৎসব ছিল, বারবার বলা হল এবার আর আপনাকে থাকতে হবে নি। কি প্রাণান্তকর গরমটাই না পড়েছে, "তিনটে বাজলে বাড়ি চলে যান হক বাবু।" গেলেন কেমন? শেষ মুহূর্ত অবধি সব কিছুর তদারক করে গেলেন। সবার হাতে সিন্নির বাটি, ঘোলের গ্লাস তুলে দিলেন। যারা যারা ভালোবেসে রং মাখাতে গেল, কাউকে নিরস্ত করলেন না। শেষে থাকতে না পেরে পৌনে ছটার সময় আমি জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম, আজ রোজা রাখেননি নাকি হক বাবু? জবাব এল, "রেখেছি তো ম্যাডাম। এই বেরোব। রাস্তায় রোজা ভেঙে নেব ক্ষণ।"


এহেন হক বাবুর ইফতার কি আর ছোটখাট ভাবে হয়। মুস্কিল হল অন্যান্য অনুষ্ঠানে বাজার করার কাজটাও হকবাবু নিজেই করেন, এবার তো আর ওণাকে বলা যায় না। ইন্সপেক্টররাও সব ব্লকে। টিফিন টাইমে অরূপকে নিয়ে ফল কিনতে বেরোল রবি। অবস্থা দেখে হক বাবু বললেন," ম্যাডাম আমিও যাই। ওরা যে কি কিনবে-"।


ইফতার মানে তো শুধু ফল নয়, যতদূর জানি কিছু ভাজাভুজি ও থাকে। থাকে আদা আর ছোলাও। কে যেন বলল," একটু আখের গুড় ও আনব ম্যাডাম?" কেন রে বাবা হক বাবু মুগুর ভাঁজবেন নাকি? বুঝলাম কেন ফল কিনতে হক বাবু খোদ গেলেন। সাড়ে পাঁচটার ঘন্টা পড়ার সাথে সাথে‌ শুরু হয়ে গেল ফল কাটা। প্লাস্টিকের বালতিতে ঘোল বানাতে বসল বেদজ্যোতি। দই, কাজু, কিশমিশ মেশানো অমৃত। ৪০ টাকা দিয়ে এক চাঁই বরফ কিনে নিয়ে এল শান্তনু।নিখুঁত হাতে সব কিছু মিশিয়ে ওপর থেকে হালকা করে কোকো পাউডার ছড়িয়ে দিল বেদজ্যোতি। লস্যিতে কোকো? প্রথমে নাক সিঁটকালেও, শেষ হয়ে যাবার পর হেব্বি দুঃখ হচ্ছিল। গেলাম ও কাগজের গ্লাস হাতে যদি আরো খানেক পাওয়া যায়, দেখি বালতি উল্টে খেয়ে নিয়েছে ব্যাটারা। 


সন্ধ্যা গাঢ় হবার সাথে সাথেই বিভিন্ন ব্লক থেকে একে একে এসে উপস্থিত হতে লাগল ইন্সপেক্টর - CKCO রা।  এসে গেলেন আমাদের বড় সাহেবও। ততক্ষণে পোশাক বদলে ফেলেছেন হক বাবু। স্যারকে দেখে বিগলিত হয়ে বললেন, " স্যার আপনি আসায় আমি যে কি খুশি হয়েছি -"। খুশি আমরাও, এবার প্রতীক্ষা সেই মাহেন্দ্রক্ষণের, কখন রোজা ভাববেন হক বাবু। তার আগে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করবেন হক বাবু। সেই প্রার্থনায় যেমন থাকবে ওনার পরিবার - প্রিয়জন, তেমনি থাকবে এই আপিস আর আপিসের লোকজনও। থাকবে এই পোড়া দেশও। আহা বড় জ্বালা এই দেশের, পদে পদে বৈচিত্র্য। এত রকম বিবিধতা নিয়ে পথ চলা কি মুখের কথা। তাও যে টিকে আছে, সে কেবল আমাদের দেশ বলেই না। বড় উর্বর এই দেশের মাটি, আবাদ করলেই সোনা ফলে। তার সুযোগ নিয়েই ঘৃণা চাষ করতে নেমেছে একদল মানুষ, যাদের কেউ স্বদেশী, কেউ বা বিদেশী। ওরা জানে না, ওরা বোঝে না, ঘৃণার চাষ আগেও করার চেষ্টা করেছিল যেন কারা। গাল ভরা নাম দিয়েছিল, " divide and rule",  তখন তাদের সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না, আজ সে সাম্রাজ্য খুঁজতে অনুবীক্ষণ যন্ত্র লাগে।

অনির ডাইরি ৮ই এপ্রিল, ২০২৪

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 



মিটিংয়ের মাঝে হঠাৎ তেনার ফোন,একরাশ উত্তেজনা গিলে তিনি কইলেন,‘ হ্যালো মা! ব্যস্ত আছ?“ কাজের কথা শেষ হয়ে গেছে একটু আগেই, এখন আসন্ন নির্বাচন নিয়ে উত্তপ্ত বাদানুবাদ চলছে, সেটাই গোগ্রাসে গিলছিলাম। তবু মেয়ের ফোন বলে কথা, আর তিনি তো সচরাচর আপিস টাইমে ফোন করেন না। নির্ঘাত গুরুতর কিছু, তাই বললাম,‘ তেমন না। বল-। ’


প্রায় লাফাতে লাফাতে তিনি বললেন,‘জানো আমার ঘরে সাপ ঢুকেছিল!’ শুনে এমন ‘অ্যাঁ’ বলে চিৎকার করলাম আমি, সম্মুখের যুযুধান সব পক্ষ সাময়িক ভাবে ঘাবড়ে চুপ করে গেল। শ্রীমতী তুত্তুরী অবশ্য সরব রইলেন,‘ হ্যাঁ গো মা। আমি স্কুল থেকে ফিরে পোশাক বদলাব বলে জানলা বন্ধ করতে গেছি, দেখি বাইরে থেকে একটা তার ভিতরে ঢুকে ঝুলছে। আমি চিৎকার করে মাসিকে জিজ্ঞাসা করলাম, জানলায় কোন কাজ হয়েছে কিনা। মাসি তখন আমার জন্য ঘোল বানাচ্ছিল, শুনতে পেল না বোধহয়। ভাবলাম তারটাকে জানলা দিয়ে বাইরে বার করে দি। ওমা যেই হাত দিতে গেছি অমনি চিড়িক করে জিভ বার করেছে। আমি তো সঙ্গে সঙ্গে বাবা গো বলে এক লাফ -।”


 এই অবধি শুনে আমার হৃদপিণ্ডটাই প্রায় গলার কাছে উঠে এল বুঝি। কন্যা যথারীতি অদম্য, তিনি বলে চলেন,‘ আমার চিৎকার শুনে মাসি আর শঙ্কর কাকু( কেয়ারটেকার) দৌড়ে এল। ওরা কত খটখট, হ্যাটহ্যাট,ভাগভাগ করল সে ব্যাটা আর নড়েই না। শেষে বাবাকে ফোন করলাম। বাবা বলল, ‘একটু অপেক্ষা করে দেখ, নিজেই সটকে পড়বে।’ আরও পনেরো বিশ মিনিট ধরে সম্মিলিত চিৎকারেও যখন কিছু হল না। তখন বাবাকে বললাম এবার কি একটু বন দপ্তরকে খবর দেবে? মিনিট দশেকের মধ্যেই ওণারা এলেন এই এত্তবড় সাঁড়াশির মত একটা যন্ত্র নিয়ে আর ওটাকে ধরে নিয়ে চলে গেল।’ 


ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল, বললাম,‘ যাক শান্তি।’ মেয়েটা যে ঐ পরিস্থিতিতেও মাথা ঠাণ্ডা রেখে সর্প কাণ্ড সামলাতে পেরেছে তার জন্য অভিনন্দন জানাতে গেলাম, তিনি দুঃখী দুঃখী স্বরে বললেন,‘ কিন্তু আমার জন্য ও বাস্তুচ্যুত  হল মমি -’।


Sunday 3 March 2024

অনির ডাইরি মার্চ, ২০২৪

অনির ডাইরি ২৪শে মার্চ, ২০২৪

#অনিরডাইরি 




দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি। কি বিকট যানজট রে বাবা! আর তেমনি রোদ। কেমন যেন ট্যারাব্যাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে গাড়ি গুলো। সামনের গাড়িটা সামান্য একটু এগোলেই পারে, ওটার সামনে বেশ খানিকটা ফাঁকা পথ পড়ে আছে। বার দুয়েক হর্ন বাজালোও আমাদের গাড়িটা, ড্রাইভারের কোন হেলদোল নেই। তিনি কি যেন খাচ্ছেন থুড়ি পান করছেন আর স্টিয়ারিং হুইলের ওপর তাল বাদ্য বাজাচ্ছেন, সাথে সাথে স্লো মোশনে এদিকওদিক হচ্ছে টেকো মাথাটাও। আবার হর্ন বাজাতেই নেমে গেল পিছনের জানলার কালো কাঁচ, রোদ চশমা পরা এক এলোকেশী মুণ্ডু বার করে খুব এক চোট ধমক দিলেন আমাদের। তবে শুনতে পেলাম না কিছুই। কারণ কাঁচ নামাতেই হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এল কর্ণপটহ বিদরণকারী সঙ্গীতের গুষ্টি। রাস্তাটাই কেঁপে উঠল যেন। 


ড্রাইভার বাবুকে বললাম, ছেড়ে দিন। কাল দোল বলে কথা। বাঙালি (!) আজ থেকেই সুর এবং সুরায় আকন্ঠ নিমজ্জিত। "তাই বলে একটু এগোবে নি? সাইড দিবে নি? সক্কাল সক্কাল চড়িয়ে বসছে নাকি?" বিড়বিড় করে বলতে থাকে ড্রাইভার। হর্ণে অবশ্য হাত লাগায় না। মিনিট দুয়েক পর সামনের গাড়ির কাঁচ আবার নেমে যায়, আবার ভেসে আসে সঙ্গীতের মুষল, আবার হাত পা নেড়ে ধমকাতে এবং চমকাতে থাকেন রূপসী। ড্রাইভার বাবু হতবাক হয়ে বলেন, " যাঃ বাব্বা, আমি তো হর্ন বাজাই'ই নি।" বার চারেক চলে বিনা প্ররোচনায় একই দৃশ্যের পুনরাভিনয়। 


তারপর বোধহয় বোর হয়ে যায়, প্রেস লেখা গাড়িটার আরোহীরা। বাসন্তী রোদ আর মৃদুমন্দ হাওয়ায় বোধহয় ঝিম ধরে যায় আমারও। আচমকা কানের কাছে কে যেন চিৎকার করে ওঠে, " আলবাৎ। ঠিক বলেছে। আমি বলব এক্কেবারে ঠিক বলেছে।" ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসি। থেমে থাকা কোন গাড়ির দুই পুরুষ আরোহী হাওয়া খেতে নেমেছেন। তাঁদেরই একজন চিৎকার করছিলেন, এবার যোগ দিলেন অন্য জন, ষড়যন্ত্রের সুরে বললেন " কি বিশ্রী ভাবে শাড়িগুলো পরে তুমি দেখেছ?" অতঃপর গলা চড়িয়ে, " ছি ছি ছি। তাকানো যায় না জাস্ট।" প্রথম ব্যক্তি সঙ্গত দিলেন, " একদম। আর যারা এর বিরোধীতা করছে,তারা আসলে নিজেরাই ওই রকম। শালীনতা শব্দের বানানই জানে না তো মানে।" 


মিনিট দুয়েকে দুজনে আমার মস্তিষ্ক প্রক্ষালন করে দিলেন, যে সমাজ বিশেষতঃ এপার বাংলার বাঙালী সমাজ রসাতলে যাচ্ছে এবং তার জন্য দায়ী আধুনিক নারী এবং তাদের শাড়ি। দুই জনের পরনেই হাফ প্যান্ট এবং টি শার্ট। সপ্তাহান্ত বলে কথা, তাও আবার দোলের আগের দিন। ওটাই আপাতত শালীন পুরুষ কুলের জাতীয় পোশাক। আশেপাশের গাড়ি থেকে যত জন রাস্তায় নেমেছেন শতকরা নব্বই জনের পরণেই হাফ প্যান্টুল। 


কথা বলতে বলতে, রাস্তার ধারে চলে গিয়ে গাড়িগুলোর দিকে পিছন করে দাঁড়ালেন দুই অতি শালীন, অতি রক্ষণশীল পুরুষ। বোঝাই গেল, অতঃপর জল বিয়োগের পালা। পিছনে যে গোটা কুড়ি-পঁচিশ কি আরো বেশী গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, তাতে যে মহিলা, পুরুষ এমনকি বাচ্চারাও আছে, তাতে ওনাদের কি? না পোষালে চোখ সরিয়ে নিন না। পুরুষদের ওসবে দোষ নেই। তাদের অশালীন নেই। সবটুকুই শালীন।


 এই যে একটু আগে রাস্তা পার হতে গিয়ে একটা ছেলের মোবাইলটা পড়ে গেল, ঝুঁকে তোলার সময়, লো ওয়েস্ট জিন্স উপচে বেরিয়ে এল পশ্চাৎ দেশের ক্লিভেজ, তখনও আমরা কি করলাম?তড়িঘড়ি চোখ সরিয়ে নিলাম। দোষ নেই দাদা,দোষ নেই। ছেলেদের ওসবে দোষ নেই। ওর দেহ, ওর পোশাক, কতটা ঢাকবে আর কতটা খোলা রাখবে, সেই সিদ্ধান্ত ও,ওর। আরে বাবা ওরা হল পুরুষ। উপার্জনকারী শ্রেণী, বংশ রক্ষক প্রজাতি। পরিবারের জিন তো কেবল ওরাই বহন করে।  


" সোনার আংটি আবার ব্যাঁকা" কথাটা শোনেন নি? সোনার আংটি অর্থাৎ কিনা পুরুষ প্রজাতি। তাঁরা তো জন্ম নির্দোষ। মেয়েরাই তো তাদের ফাঁদে ফেলে। যেমন ফেলে পেটের দায়ে ল্যাম্প পোস্টের নীচে দাঁড়ানো মেয়েরা। খারাপ তম মেয়েদের উদাহরণ দিতে হলে কি সহজেই না তাদের আমরা টেনে আনি। কিন্তু যারা তাদের উন্মুক্ত দেহাংশের তুল্যমূল্য বিচার করে, দর করে তাদের পসরা কেনে তাদের নাম করে কোন গালাগালি দিতে দেখেছেন? ওখানে যেতেও দম লাগে। ওটাও তো পৌরুষের পরিচয় দাদা। ওটাও পৌরুষের পরিচয়। 


সামান্য চাঞ্চল্য দেখা দিল সামনের গাড়ি গুলোর মধ্যে। জল বিয়োগ সেরে, দুই হাফ প্যান্টুল ধারী শালীন ব্যক্তিও ফিরতে লাগলেন নিজেদের গাড়ির দিকে। মেয়েদের শাড়ি ছেড়ে শুনতে পেলাম আপাতত গ্যাস নিয়ে তাত্ত্বিক চর্চা চলছে, ব্রহ্মলোক কাঁপানো একখানা ঢেঁকুর তুলে একজন বললেন, "গ্যাসটা কিছুতেই বেরোচ্ছে না। পেটটা ফুলে আছে।" অন্য জন বললেন, " যাই বলো ভায়া,ঢেঁকুরটা বড় বাজে জিনিস। It's gross, শুনলেই গা ঘিনঘিন করে ওর থেকে পা🔇 ভালো।" অন্য জন হেসে উঠলেন, " হেহে, মানে গাড়িতে -"। উৎসাহিত হয়ে প্রথম ব্যক্তি আবার বললেন, " হ্যাঁ বিলকুল। ওটার মধ্যে একটা আর্ট আছে। আরে ওটার তো নামেই আর্ট আছে। শোনো নি, Fart is an art, that starts with an F." জয় বাঙালি, থুড়ি জয় শালীন বাঙালি।



অনির ডাইরি ২৩শে মার্চ, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


অফিসে এলে মনে হয়, ইশ কামাই করলেই হত। আবার অফিস কামাই করলেও, অপরাধ বোধে পাগল পাগল লাগে। এই দোদুল্যমানতার মধ্যেই কাটিয়ে দিলাম এত গুলো বছর, পেশাদারিত্বটা আর শিখে উঠতে পারলাম না। আজই যেমন, জানলার বাইরে ঝুলছে ইয়া মোটা কালো মেঘের চাদর, প্রবল বেগে মাথা দোলাচ্ছে দূরে ঘন সবুজ মাঠের পরিসীমা বরাবর বেড়ে ওঠা বুনো মহীরুহের দল আর ভিতরে ভিতরে ডুগরে উঠছি আমি। ইশ এমন দিনে বাড়ি থাকলে কি ভালো ঘুমানো যেত মাইরি- 


এমন সময় দরজা ঠেলে শান্তনুর প্রবেশ, “ম্যাডাম, এক ভদ্রলোক এসেছেন। বলছেন এই অফিস থেকে নাকি গত ৮ই নভেম্বর ওনাকে ফোন করা হয়েছিল। উনি মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে কিছু নালিশ করেছিলেন, সেই সংক্রান্ত কারণেই যে ওনাকে ফোন করা হয়েছিল সেটা বলতে পারছেন, কিন্তু কে করেছিল, করে কি বলেছিল কিছু বলতে পারছেন নি। কি বলব? ভোটের পরে আসতে বলি?” 


সদ্য নির্বাচন ঘোষিত হয়েছে, অনেক রুটিন কাজই আপাতত নির্বাচন কমিশন কতৃক নির্ধারিত আদর্শ আচরণ বিধিতে আটকায় বলে বন্ধ, তাই বলে একটা লোকের সমস্যাটা কি সেটাও কি শুধাতে পারব নি? বললাম, ডাকো দেখি, কি কন। শান্তনু দরজা খুলে লোকটাকে ইশারায় ডাকল, তবে নিজে ঘর ছেড়ে গেল না। কিছুদিন আগে অমন এক বৃদ্ধ এসেছিলেন, কি যেন গেরোয় দীর্ঘদিন আটকে ছিল ওনার পেনশন, সম্প্রতি এক সাথে তিন বছরের পেনশন ঢুকেছে। একজন দরিদ্র ইলেকট্রিক মিস্ত্রীর কাছে সেটা অনেক টাকা। ভদ্রলোক আনন্দে ডগমগ হয়ে নিজেই এসেছেন আমায় ধন্যবাদ দিতে। আমিও খুব আনন্দের সাথে ওনার সাথে একটা ছবি তুলে নিলাম, বলে দিলাম বছর বছর মনে করে নভেম্বর মাস পড়লেই এসে বেঁচে থাকার শংসা পত্রটা জমা করে যাবেন। মনে রাখার সুবিধার জন্য শান্তনু বলে দিল, “কালী পুজোর পরই চলে আসবেন।“ ভদ্রলোক উৎফুল্ল হয়ে বললেন, “আমি একটু কিছু খাওয়াতে চাই আপনাদের।সামান্য মিষ্টি মুখ-।“ এই সব ক্ষেত্রে আগে আমি বলতাম, কেন খাওয়াবেন, এটা তো আমাদের রুটিন কাজ ইত্যাদি প্রভৃতি। তারপর দেখলাম নিষেধ করলে, বাবুদের গোঁসা হয়, দুঃখ হয়, অপমান হয় ইত্যাদি। তাই আজকাল কেউ খাওয়াতে চাইলে শুধু দু- তিনটে প্রশ্ন করি, “নিজের ইচ্ছাতে খাওয়াচ্ছেন তো? আমি বা আমার অফিসের কেউ খাওয়াতে বলেনি তো? খাওয়ালে কি খুশি হবেন?" যদি উত্তর হ্যাঁ-না-হ্যাঁ আসে তাহলে উফ কি আনন্দ। কারণ আদতে যে আমি জন্ম হ্যাংলা এ নিয়ে তো কোন দ্বিমত নেই। 


তো ভদ্রলোক সঠিক উত্তর দিলেন। আমিও অনুমতি দিলাম যা প্রাণ চায় খাওয়ান। আমাদের কোন দাবী নেই। এরপরই ঘটল সেই ঘটনাটা, ভদ্রলোক ট্যাঁক থেকে বার করলেন একটা ময়লা কাপড়ের থলে এবং তার থেকে বেশ কয়েকটা নোট বার করে এগিয়ে দিলেন আমার দিকে, “ একটু মিষ্টি মুখ আজ্ঞে –।“ আমি চেয়ার থেকে আর শান্তনু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এক সাথে লাফিয়ে উঠেছিলাম সেদিন। “করেন কি? করেন কি-” বলতে বলতে দৌড়ে এসে যখন খপ করে লোকটার হাত চেপে ধরেছিল শান্তনু, তখনও বৃদ্ধর চোখেমুখে অপার বিস্ময়। সে যাত্রায় শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধ নিজেই মিষ্টি কিনে এনে খাইয়েছিলেন বটে তবে সেই থেকে আতঙ্কে ভোগে শান্তনু। আমার ঘরে কাউকে সঙ্গে করে নিয়ে এলে বেশ খানিক ক্ষণ অপেক্ষা করে যায়, ব্যাপারটা নিরাপদ কি না বোঝার জন্য। 


আজ যিনি ঢুকলেন, বয়স চল্লিশের কোঠায়। শ্যাম বর্ণ, মাঝারি উচ্চতা, চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। পরনে হাতা গোটান সামান্য বিবর্ণ ফুল হাতা শার্ট আর প্যান্ট। হাতে একটা বাজারের ব্যাগ। সামনের ফাঁকা চেয়ারে বসতে বলে জিজ্ঞাসা করলাম, “কি হয়েছে?” ভদ্রলোক একই কথা বললেন, ওনাকে বিগত নভেম্বর মাসের শুরুতে এই অফিস থেকে কেউ ফোন করেছিল। উনি দপ্তরের নাম আর তারিখটা টুকে রেখেছেন কিন্তু যে ফোন করেছিল তার নাম আর নম্বরটা লিখতে ভুলে গেছেন। ভ্রু কুঁচকে আমাকে শুধালেন, ”আপনাদেরও তো একটা ডেটা বেস থাকে নাকি?” ডেটা বেস অনেক ভারী কথা, তবে গরীবের দপ্তরে কিছু রেকর্ডস তো থাকেই। কিন্তু ভদ্রলোকের নাম সেখানে অনুপস্থিত। সেটা জানাতে উনি ভালো করে দাড়ি চুলকে বললেন, “কিন্তু তাহলে তো আমার খুব সমস্যা হয়ে গেল।“


বললাম, আপনাকে ফোন করে কি বলা হয়েছিল, সেটা বলতে পারবেন? তাহলেও না হয় বলে দেওয়া যাবে, পরবর্তী পদক্ষেপ কি হতে পারে। উনি সেটাও বলতে অপারগ। বললাম আচ্ছা, আপনি মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে নালিশটা কি করেছিলেন, সেটা বলতে পারবেন? তাহলেও একটা রাস্তা দেখা এবং দেখানো যেতে পারে। ভদ্রলোক বাজারের ব্যাগ থেকে একটা খেরোর খাতা বার করে আনলেন, চশমাটা নাকের ওপর তুলে বললেন, “নালিশ কি আর একটা। দাঁড়ান আপনাকে দিন ক্ষণ ধরে বলি-।”

প্রমাদ গুণলাম। প্রথম নালিশটা দেখা গেল আজ থেকে বছর দুয়েক আগের। জেলার জনৈক বড় নেতার নামে। “উনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন, অমুক জায়গায় আমার একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেবেন। কিন্তু কথা রাখেননি।“ জিজ্ঞাসা করি, কোন লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন? কোন টাকাপয়সা লেনদেন করেছিলেন? জবাব আসে নেতিবাচক। তাহলে? শুধু মৌখিক প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের নালিশ করেছিলেন? এবার জবাব ইতিবাচক আসে। 


দ্বিতীয় নালিশ খোদ ডিএম সাহেবের নামে। এই ডিএম সাহেব নন, পাক্কা এক দশক আগে যিনি এই জেলার ডিএম ছিলেন, তাঁর নামে। সেই সময় নাকি কিছু সরকারী দপ্তরে লোক নেবার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। ইনিও আবেদন করেছিলেন, কিন্তু সিলেক্টেড হননি। কেন হননি, সেটাই নালিশের বিষয়। আমি আবার জিজ্ঞাসা করি, এত বছর আগে আবেদন করেছিলেন তাহলে এত দেরীতে খোঁজ নিচ্ছেন কেন? ভদ্রলোক নেহাৎ ক্যাজুয়াল ভাবে বলেন, “হ্যাঁ একটু দেরী হয়ে গেছে “

তৃতীয় নালিশ গত মাসে করেছেন, হাইওয়ে অথোরিটি অব ইন্ডিয়ার নামে, কোন টোল স্টেশনে নাকি লোক নেওয়া হয়েছে, ওনাকে কেন নেওয়া হয়নি। জিজ্ঞাসা করি, আপনি আবেদন করেছিলেন? একই ভাবে জবাব আসে, “আমাকে জানানো হয়নি।” আমি শান্তনুর দিকে তাকাই, শান্তনু আমার দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকায়। গলা ঝেড়ে বলি দেখুন, তৃতীয় নালিশ তো সদ্য করেছেন, ওটা ছাড়ুন, বাকি দুটো নিয়ে আমাদের অফিস থেকে আদৌ কোন ফোন গিয়েছিল কি না আমরা জানি না। কারণ দুটোর কোনটাই আমাদের অধিকৃত ব্যাপার নয়। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের জন্য পুলিশের কাছে যেতেই পারেন বা আদালতের শরণাপন্ন হতেই পারেন, আর ডিএম সাহেবের ব্যাপারটা নিয়ে একটু ওনার করণেই কথা বললে ভালো হয়। এই তো উল্টো দিকেই ওনার আপিস- ।”


“আচ্ছা আপনাদের কাছে দিদির নম্বর আছে?” কথার মাঝেই আচমকা বলে ওঠে লোকটা। থতমত খেয়ে খানিক ক্ষণ শান্তনুর দিকে তাকিয়ে থাকি আমি। শান্তনুর মুখভঙ্গি দেখে বুঝতে পারি, এই মুহূর্তে আমার মুখটা কেমন লাগছে। নিজেকে সামলে, হাসি চেপে বলি, “না দাদা। এটা নেহাৎ গরীব অফিস, এখানে অত বড় মানুষের নম্বর থাকে না।“ লোকটা বলে, “ হুঁ।“ কেউ দিতে চায় না ওনার নম্বর। আমি কালীঘাটেও গেছি। বেশ কয়েকবার। ওরা কেবল বলে আপনার নালিশ আমরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়ে দিয়েছি। বললাম, দিদির নম্বর দিন, আমি নিজে কথা বলব-, তো বলে, দিদি তো ব্যস্ত মানুষ। তার নম্বর দেওয়াটা কি ঠিক হবে? আপনি বাড়ি যান, আপনার নালিশ আমরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়ে-।”


হাসি চেপে বলি, আপনি দিদির নম্বর চাইতে কালীঘাট চলে গেছেন? শান্তনু করজোড়ে নমস্কারই করে ফেলে লোকটাকে। ভাগ্যে পিছনে চোখ নেই, নাহেল হেব্বি ক্ষেপে যেত লোকটা। আমার ওপরেই যা ক্ষেপে গেল,বাপরে। " কেন যাব না? আমি তো অভিষেকের আপিসেও গেছি, দিদির নম্বর চাইতে। কিন্তু -" লোকটির মুখ ভঙ্গি দেখে বুঝলাম সেখানেও তিনি অসফল। " বললাম দিদির নম্বরটা দিন, তো বলল আপনার কমপ্লেন আমরা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দেব।" কে বলল? মাননীয় সাংসদ স্বয়ং? চোখ বড়বড় করে প্রশ্ন করি আমি। লোকটি হাত নেড়ে বলে, "নাঃ, নাঃ। তিনি নন। তাঁর আপিসের লোক।" 


লোকটি কি যেন ভাবতে থাকে। চোখের ইশারা করি, শান্তনু এগিয়ে এসে গায়ে হাত দিয়ে বলে, " দাদা, চলুন। ম্যাডামের অন্য কাজ আছে।" লোকটি কি যেন ভেবে উঠেও পড়ে, তারপর হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে, ঘুরে প্রশ্ন করে, " আচ্ছা মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে ফোন করলেই এই যে ছেলে মেয়েগুলো ধরে, এদের বেতন কে দেয়? সরকার?" কি বলব বুঝতে পারি না। তবে এটা বুঝি, হ্যাঁ বা না যাই বলব, সেটাই ভুল উত্তর হবে। ভদ্রলোক অবশ্য আমার উত্তরের মুখাপেক্ষী নন। নিজের মনেই বলতে থাকেন, " সরকারী পয়সায় বেতন নিবে, আর মুখ্যমন্ত্রীর নম্বর দিবে নি? ইয়ার্কি! এটা নিয়েই তো একটা নালিশ করতে হবে যা দেখি।" বলতে বলতে দরজার কাছে পৌঁছে যায় লোকটা। শান্তনু আগে ভাগেই দরজা খুলে ধরে আছে, লোকটা চৌকাঠ ডিঙাতে গিয়েও থমকে দাঁড়ায়, ঘুরে প্রশ্ন করে, " --- আচ্ছা ম্যাডাম,বলতেছি কি, আপনার বাড়িটা যেন কুথায়?" মুখ ফস্কে বেরিয়ে যায় কলকাতা। লোকটা থুতনিতে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, " কলকাতা? হুঁ। কলকাতা। কালীঘাট তো কলকাতাতেই, তাই না- "।


অনির ডাইরি ১৮ ই মার্চ, ২০২৪

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 


“Madam amar bus accident hieche”- সাথে একটা উল্টানো বাসের ছবি। সক্কাল সক্কাল এই রকম মেসেজ পেয়ে আঁতকে উঠলাম। এমনিতেই আজ অফিস বেরোতে বেশ দেরী হয়ে গেছে, কারণ অকস্মাৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আজ থেকে তুত্তুরীর নতুন সেশন শুরু, ভোর বেলা মেয়েকে যখন স্কুলে ছাড়তে গেলাম একেবারে ঝকঝক করছিল আকাশ। ঘুম ভাঙ্গা লাল চোখে আড়মোড়া ভাঙছিলেন সূয্যি মামা। তাঁর ভরসাতেই মাথায় ডিম মেখে শ্যাম্পু করতে গেলাম, বেরিয়ে দেখি ডিমের গন্ধে উত্যক্ত আমার বরের মতোই তাঁরও মুখ কালো। জানলার বাইরেটা যেন নিকষ আঁধারে মুড়ে দিয়েছে কেউ। অতঃপর যেমন ঝড়, তেমন বৃষ্টি। 


ঝড় বৃষ্টির দাপট কমতে তবে বেরিয়েছি। বড় সাহেবকে বিলম্বের সূচনা দিতে মুঠোফোন খুলেই দেখি ঐ ভয়াবহ মেসেজ আর ছবি। প্রেরক আমার এক বেবি ইন্সপেক্টর। আজ থেকে দেড়-পৌনে দুই বছর আগে যখন হঠাৎই জানতে পারলাম, যে আমি একটা নয়, দুটো নয়, তিন তিনটে আনকোরা ইন্সপেক্টর পেতে চলেছি, সেদিন থেকেই এই আপিসে ইন্সপেক্টরদের এক নতুন শ্রেণী বিন্যাস শুরু হল, ঝানু ইন্সপেক্টররা হল আমার সিনিয়র ইন্সপেক্টর, আর নবাগত গুলো আমার বেবি ইন্সপেক্টর। আদর করে প্রায়ই বলি, “আমার তিনটে বেবি।” সেই বেবিদেরই একজন আজ পথ দুর্ঘটনার শিকার। 


তড়িঘড়ি ফোন করে জিজ্ঞাসা করি, “তুমি আছ কেমন?” পথ দুর্ঘটনার খবর দিয়েছে এবং বাসের ছবি তুলে পাঠিয়েছে, তার মানে ঈশ্বরের দয়ায় বড় কিছু হয়নি। অন্তত আমার মন সমানে সেই প্রবোধ দিয়ে চলে। একজন মহিলা হিসেবে, আমি এই Women's intuition এর ওপর বড় বেশি নির্ভর করি। কিন্তু আজ যেন সব হিসেব গুলিয়ে যাচ্ছে। পচা নেটওয়ার্কের সৌজন্যে লাইন পেতে খানিক বিলম্ব হল বটে, বার তিনেকের চেষ্টায় ফোনটা বেজে উঠল। ওপাশ থেকে ভেসে এল চূড়ান্ত নার্ভাস কণ্ঠস্বর, “ম্যাডাম আমার বাস অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে ম্যাডাম। মেচেদা স্টেশন থেকে হলদিয়া-মেচেদা বাস ধরেছিলাম, এত জোরে যাচ্ছিল বাসটা, আচমকা ডিভাইডারে ধাক্কা মেরে আমার চোখের সামনে উল্টে গেল ম্যাডাম।” বুঝতে পারছি, ছেলেটা তার তুখোড় ম্যাডামের কাছে আশ্রয় চাইছে। কিন্তু আজ যে আমার নিজেরই হাত পা কাঁপছে, আমি ওকে কি করে সামলাই? 


গলা যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক রেখে বললাম, “আগে বলো কেমন আছ?” জবাব এল “ভালো আছি ম্যাডাম।” বলে ফেলার সাথে সাথেই ফিরে এল নার্ভাস কণ্ঠস্বর, “আমি বসে ছিলাম ম্যাডাম, আমার চোখের সামনে বাসটা উল্টে গেল ম্যাডাম। লোকজন আছড়ে পড়ল আমার ওপর। এমনিতেই প্রচণ্ড ভিড় ছিল বাসটাতে। কত জনের মাথা ফেটে গেল। আমার পাশের ভদ্রমহিলার হাতটা ভেঙ্গে বেঁকে ঝুলতে লাগল। উনি কি রকম বোকার মত আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, 'আমার হাতটা ভেঙ্গে গেছে দেখুন।' সে কি দৃশ্য ম্যাডাম! আমার জামায় এখনও রক্তের দাগ লেগে আছে ছাপকা ছাপকা।” 


 মাঝ পথে থামিয়ে জানতে চাই, “তুই কেমন আছিস বাবা?” জবাব আসে, “বুকে পিঠে প্রচণ্ড যন্ত্রণা ম্যাডাম। ঐ অবস্থায় সকলে বাঁচার জন্য হুড়োহুড়ি করছে, একে অপরকে ঠেলে, জানলার কাঁচ ভেঙে নামার চেষ্টা করছে, ঐ করতে গিয়ে কতজন যে আমায় মাড়িয়ে চলে গেল ম্যাডাম-।” আবার থামিয়ে দিই ছেলেটাকে, এখন কোথায় আছ? জবাব আসে, “আমার তেমন লাগেনি তো ম্যাডাম, মানে মাথা টাথা ফাটেনি বা কোথাও ভাঙে টাঙেনি বলে আমায় আর অ্যাম্বুলেন্সে তোলেনি, আমি একজন পুলিশের গাড়ি করে হাসপাতালে যাচ্ছি। উনি ছুটি থেকে ফিরছিলেন, আমার অবস্থা দেখে বললেন হাসপাতালে নামিয়ে দেবেন।”


জিজ্ঞেস করি, কোন হাসপাতাল? জবাব এলে বুঝতে পারি, তার সামনে দিয়েই অফিস যাব আমি। বলি, “ঠিক আছে, তুমি যাও। আমি আসছি। আরও আধেক ঘণ্টা লাগবে আমার। ভয় পেও না। কোন দরকার হলে নির্দ্বিধায় ফোন করো।” 


চণ্ডীপুর ফ্লাইওভার থেকে নেমে, সোজা যে রাস্তাটা নন্দকুমার যাচ্ছে, তার বাঁ হাতে বড় বড় করে লেখা হাসপাতালের নাম। মস্ত গেট, গাড়ি গলে বটে, কিন্তু বেশি দূর যেতে পারে না। গাড়ি থেকে নেমে কয়েক পা এগোলেই ডান হাতে টালির চালার নীচে বসে আছেন অনেক মানুষ। পাশের কাঁচের দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, ভিতরে দৌড়দৌড়ি করছে উর্দি পরা একদল নারী পুরুষ। সর্বত্র চূড়ান্ত ব্যস্ততার ছাপ। কি করি, কোথা যাই ভাবতে ভাবতে ফোন করি ছেলেটিকে। ওপাশ থেকে ভেসে আসে অচেনা পুরুষ কণ্ঠস্বর, “নমস্কার ম্যাডাম, আমি স্বপন, এসএলও। স্যার ভালো আছেন।” বলতে বলতেই ফোনটা কেড়ে নেয় ছেলেটি, “ম্যাডাম, হ্যালো ম্যাডাম। আমি ভালো আছি, আমায় তিনটে ইঞ্জেকশন দিয়েছে।  ব্যথা একটু কম। এবার এক্সরে করতে যাব।” 


জানাই আমি এসেছি। স্বপন বাবু সাত তাড়াতাড়ি জানান, “আপনি দাঁড়ান ম্যাডাম, আমি আপনাকে নিয়ে আসতেছি।” দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি। পাঁচ- দশ- পনেরো মিনিট কেটে গেল। গ্রুপ থেকে খুঁজে খুঁজে স্বপন বাবুর নম্বর যোগাড় করে ফোন করেই যাচ্ছি, ধরেনও না, আসেনও না। বেবি ইন্সপেক্টরটাকে ফোন করছি, তার ফোন ও নিরুত্তর। কি হল রে বাবা? হৃদপিণ্ডটা গলার কাছে চলে আসছে উত্তেজনায়।  বাঁ হাতে লেখা আছে বটে এনকয়ারি, কিন্তু সেখানে একদল রুগী ভিড় করে বসে আছে। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গাড়ির ড্রাইভার নেমে এসে এদিক ওদিক জিজ্ঞাসা করে ফিরে এসে বলে, “ম্যাডাম বলছে তিন তলায় আছে। নামটা জানতে চাইছিল, আমি তো স্যারের নাম জানিনি। বলল অবস্থা ভালো নয়।” 


সে আবার কি? এই তো কথা হল। সটান ভিতরে ঢুকে গেলাম, ক্যাশ কাউন্টারে প্রচণ্ড ভিড়, তারই মধ্যে একটি মেয়েকে পাকড়াও করে জিজ্ঞাসা করলাম, “ভাই আমার অফিস স্টাফ, পথ দুর্ঘটনায় আহত হয়ে এখানে ভর্তি, ও কেমন আছে? কোথায় আছে?” মেয়েটি নাম জেনে অনেক খুঁজেও কিছু বলতে পারল না। আরেকজনের কাছে পাঠাল। তিনিও সহায়তায় অপারগ। মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাব। আবার বলি, একটু আগেই হয়েছে অ্যাকসিডেন্টটা। পুলিশ নিয়ে এসেছে ছেলেটাকে। চেহারার বিবরণও দিই। খাতাপত্র ঘেঁটে মেয়েটি বলে, পথদুর্ঘটনাগ্রস্ত একজন ভর্তি হয়েছে বটে, তবে প্রথমতঃ তার নাম অন্য আর দ্বিতীয়তঃ তিনি গতকাল রাত্রে ভর্তি হয়েছেন।


 ধড়ে যেন প্রাণ আসে কয়েক মুহূর্তের জন্য। পরক্ষণেই মনে পড়ে যায়, তাহলে ছেলেটা গেল কোথায়? মেয়েটা সহানুভূতির সুরে বলে, "এমারজেন্সিতে একবার দেখুন-।"

আমার আগে ড্রাইভার দৌড়ায় এমারজেন্সিতে। সেখানেও নেই ছেলেটা। আমাদের দৌড়দৌড়ি দেখে এগিয়ে আসে আরেকটি উর্দি পরা ছেলে, “কি ব্যাপার বলুন তো?” খুলে বলি সবটা। ছেলেটা শুনে বলে, “ও হাসপাতাল, সেটা তো সরকারী। এটা বেসরকারি। নামটা এক বলে অনেকে ভুল করে। আপনারা এগিয়ে এসেছেন, পিছিয়ে যান খানিকটা, চণ্ডীপুর ব্রিজের নীচে দিয়ে বাঁহাতি যে রাস্তাটা নন্দীগ্রামের দিকে বেঁকে গেছে, ঐ পথে কয়েক কিলোমিটার গেলে এ্যাড়াশোল উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র। ঐ খানে দেখতে পারেন।” 


প্রায় আড়াই বছর আছি এই জেলায়, প্রথম পা রাখলাম এই পথে। সবটাই অচেনা। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করতে করতে অবশেষে গিয়ে পৌঁছালাম বিশাল সাদা প্রাচীর ঘেরা হাসপাতালে। এবারে আর ফোন করতে হল না, গাড়ি ঢুকতেই ছুটে এলেন এসএলও স্বপন বাবু আর বিশ্বজিত বাবু। ওনাদের অনুসরণ করে একটা একতলা বড় ঘরে ঢুকে দেখি থিকথিক করছে মানুষ। ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। আমার ইন্সপেক্টরটিও সেই ভিড়ে মিশে কি যেন জিজ্ঞাসা করছে। হাতে প্রেসক্রিপশনের একটা কাগজ, মুখটা ফুলে ফুটবলের মত হয়ে গেছে। গিয়ে গায়ে হাত দিতেই আবার সেই এক কথা বলতে শুরু করল, “আমি বসে ছিলাম ম্যাডাম, আমার চোখের সামনে বাসটা উল্টে গেল ম্যাডাম। লোকজন আমাকে মাড়িয়ে চলে গেল ম্যাডাম-।” মাতৃসুলভ আদরের স্বরে বললাম, “ ডাক্তার কি বলল? এক্সরে রিপোর্ট পেলে?” জাবাব দিল, “না ম্যাডাম, বলেছে মোবাইলে পাঠিয়ে দেবে। তবে বলেছে কিছু ভাঙ্গেনি।” 


বলি, বেশ এবার আমার সাথে অফিস চল। কাউকে দিয়ে ওষুধ গুলো আনিয়ে নিচ্ছি, আগে কিছু খাবে, তারপর ওষুধ খাবে। তারপর খানিক ক্ষণ চুপ করে শুয়ে থাকবে। তারপর গাড়ি করে যতটা সম্ভব বাড়ির কাছে পৌঁছে দেব। বাধ্য ছেলের মত আমার পাশে পাশে গাড়ি অবধি আসে ছেলেটা। প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে ব্যাগে রাখি আমি, হারিয়ে ফেলে যদি। গাড়িতে বসতে বসতে ছেলেটা বলে," বাড়িতে কিছু বলিনি ম্যাডাম। শুধু আপনাকে/ আপনাদের বলেছি। বললেই সবাই কাঁদবে, ছুটে আসবে। উফ আমার এত বছরের জীবনে এই অভিজ্ঞতা কখনও হয়নি, ম্যাডাম। বাসটা যখন উল্টে পড়ল, এক ঝলক চোখের সামনে বাবা মা আর বউয়ের মুখটা ভেসে উঠল-।"


ভিতর ভিতর কাঁপুনি ধরছে আমার বুঝতে পারি। বুঝতে পারি ছেলেটা ট্রমায় ভুগছে। কথা ঘোরাতে ড্রাইভারকে বলি একটা ওষুধের দোকান দেখে দাঁড় করাতে, ছেলেটা হুঁশ ফিরে পেয়ে, রক্ত লাগা টি শার্টের বুক পকেট থেকে এক মুঠো ওষুধ বার করে, “ওষুধ দিয়েছে ম্যাডাম। এই যে এটা খালি পেটে, এটা কিছু খেয়ে আর এই গুলো রাতের বেলা।”


 বাচ্ছাদের মত ওষুধ গোনে ছেলেটা। ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করে বলি, "খালি পেটেরটা আগে খাও। আর তোমাকে ওষুধও দিল? কি ভালো হাসপাতাল রে!" ছেলেটা বলে," বিডিও সাহেবকে ফোন করেছিলাম, উনি বিএমওএইচ সাহেবকে বলে দিয়েছিলেন।" হেসে বলি, বিডিও সাহেব তোমার জন্য এতটা করেছেন, তাঁকে জানাও অন্তত যে ভালো আছো। 


থতমত খেয়ে, জিভ কেটে ফোন করে ছেলেটা। বলে, “ স্যার, আমি ভালো আছি স্যার। জেএলসি ম্যাডাম নিজে এসেছেন আমায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।” ওদিক থেকে ভেসে আসে কিছু কথা, ফোন রেখে ছেলেটি বলে, “ম্যাডাম বিডিও স্যার বললেন একবার দেখা করে যেতে।” বিডিও অফিসের অপরিসর রাস্তায় ঢোকে গাড়িটা, এই অফিসে আমি আগেও এসেছি। বিডিও সাহেব বসেন দোতলায়। ছেলেটি কি উঠতে পারবে? যদি পারেও, তাহলেও আমি একা ছাড়ব না। অনাহূত হলেও যাব ওর সঙ্গে সঙ্গে। 


তার অবশ্য দরকার হল না, বিডিও সাহেব নিজেই নেমে এলেন আইএমডব্লিউকে দেখতে। ছেলেটি আবার এক কথা বলতে থাকে, কি ভাবে অ্যাকসিডেন্ট হল ইত্যাদি। বলে, " কার মুখ দেখে যে আজ উঠেছিলাম স্যার-"। মাঝ পথে কথা থামিয়ে মজার সুরে বিডিও সাহেব বলেন, “  যার মুখ দেখে উঠেছ,রোজ তার মুখ দেখে উঠবে। তার জন্যই এত বড় দুর্ঘটনা থেকে প্রাণে বেঁচে গেছ। ডাক্তার তিন দিন রেস্ট বলেছে, তুমি সাত দিন নাও। তারপর ফিরে এসো সুস্থ হয়ে, তোমাকে ছাড়া ইলেকশন হয় নাকি?” কে বলে প্রশাসন অমানবিক। 


গাড়ি গড়ায় অফিসের দিকে, হন্তদন্ত হয়ে ফোন করে বড় সাহেব, “আরে দূর, এমন একটা মিটিং এ ফেঁসে ছিলাম, এই দেখছি তোমার মেসেজ। কেমন আছে ছেলেটা?” নন্দকুমার মোড় থেকে নিমতৌড়ির দিকে বেঁকে যায় আমাদের গাড়ি, অন্য মনস্ক হয়ে মাথা থেকে একটা একটা করে কাঁচের টুকরো বার করতে থাকে ছেলেটা। অফিসের গ্রুপে লিখতে থাকি, সবাই অ্যাটেনশন, আমার বেবি ইন্সপেক্টরকে সঙ্গে নিয়েই ফিরছি আমি। কেউ ওর জন্য বরফের যোগাড় করো, কেউ গরম চা বানিয়ে রাখো, বেশি করে চিনি দিয়ে। ব্যাটার নার্ভ গুলোকে একটু চাঙ্গা করা দরকার। কেউ ক্যান্টিন থেকে কিছু খাবারদাবার নিয়ে এসো। লাটসাহেব যাতে ভরা পেটের ওষুধটা খেতে পারে। আর বাকিরা রেডি হয়ে যাও ওর মাথা বাছার আর গল্প শোনার জন্য, এক মাথা কাঁচের গুঁড়ো আর ট্রমা নিয়ে ফিরছে ছেলেটা। দুটোই বার করতে হবে মাথা থেকে।



অনির ডাইরি ১৪ই মার্চ, ২০২৪

#অনিরডাইরি #International_Day_of_Action_for_Rivers #আন্তর্জাতিক_নদী_কৃত্য_দিবস



আজ বুঝি আন্তর্জাতিক নদী কৃত্য দিবস। সক্কাল সক্কাল ঘুম ভাঙ্গিয়ে ফরমাইশ করলেন জনৈক গ্রুপের মাননীয় অনুশাসক মহোদয়, নদী নিয়ে কিছু লিখতে হবে। লিখতেই হবে। মুস্কিল হল, ফরমাইশি লেখা একদম লিখতে পারি না যে। মন ধায় একদিকে, আর আঙ্গুলের গতি, সম্পূর্ণ অন্য দিকে। 


এমনটিতে নদীর সাথে আমার সম্পর্ক চিরন্তন। এক নদীর ধারেই তো জন্ম আমার। উত্তরবঙ্গের সীমানা ঘেঁষা ঘন সবুজ এক গাঁয়ের যে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আমি জন্মেছিলাম, সেখান থেকে ঢিল ছুঁড়লেই নদী। “-বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে” মার্কা অর্বাচীন নদী নয়, রীতিমত অকুল দরিয়া বুঝলেন। বয়স নেহাৎ কম হল না, এখনও ফি বছর আমার জন্মদিনের আগের রাতে গল্প শোনায় বাবা, সেই নদী পারাপারের গল্প। 


সে বছর শীত পড়েছিল জম্পেশ। নির্দিষ্ট সময়ের সপ্তাহ তিনেক আগেই পিত্রালয়ে পাড়ি দিয়েছিল মা, একাকী। সেই যাত্রায় মাকে সঙ্গ দেবার সাধ থাকলেও সাধ্য বাবার ছিল না। শহুরে ডাক্তারের নিদান মোতাবেক যে রবিবার আমার ভূমিষ্ঠ হবার কথা, ঠিক তার আগের দিন অফিস সেরে, যৌথ পরিবারের সপ্তাহ ভরের রেশন তুলে, বাজার করে দিয়ে রাত এগারোটার ট্রেন ধরল বাবা। কয়লার ইঞ্জিন, ধিকিধিকি করতে করতে উদ্দিষ্ট স্টেশনে গিয়ে যখন পৌঁছাল, ঘড়িতে রাত আড়াইটে-পৌনে তিনটে। 


স্টেশন থেকে পাক্কা দশ কিমি গেলে তবে পড়ে নদী। নদীর ওপাড়ে মা, হয়তো বা আমিও। আশায় আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেল এক হবু পিতার হৃদয়।  

ছোট্ট স্টেশন, ট্রেন চলে যেতেই পলকে নিশুতি। শীতের কামড় ও যেন বেড়ে গেল বহুগুণ। ব্যাগ থেকে পাঁচ সেলের মস্ত টর্চটা বার করে বাবা। স্টেশনের বাইরে থেকেই বাস ছাড়ে, এত রাতে বাসের কঙ্কালটুকু পড়ে আছে কেবল। ফার্স্ট বাস সেই ভোর পাঁচটায়। নিকষ আঁধারের বুক চিরে টর্চের আলো ফেলে হাঁটতে থাকে বাবা। 


হাঁটতে হাঁটতে নদীর কুলে যখন এসে পৌঁছায়, কালো কম্বল মুড়ি দিয়ে তখনও ঘুমাচ্ছে নদী। চতুর্দিক জনশূন্য। কাকেরাও নিশ্চুপে সেরে নিচ্ছে রাতের শেষ ঘুমটুকু। নদীর এপারে নেই কোন জনবসতি। পারাপারের প্রথম নাও আসবে ওপার থেকে। তাও সকাল পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটার আগে নয়। তার মানে আরও একটা ঘণ্টা কাটাতে হবে নদীর পারে বসেই। একটা পরিত্যক্ত নৌকার গায়ে ঠেস দিয়ে সিগারেট ধরায় বাবা, নদীর বিস্তৃত কুল বরাবর বহু দূরে কোথাও বুঝি ঝুপ করে জ্বলে ওঠে কোন চিতা। এক ঝলক পোড়া গন্ধ বয়ে আনে নদীর সজল শীতল বাতাস। সামান্য ভয় পায় কি বাবা? পেলেও মানতে রাজি নয় শহুরে জেদি হৃদয়। 


শীতল বাতাস এবং পোড়া গন্ধের যুগপৎ আক্রমণ থেকে বাঁচতে, “বোট ঘরে” আশ্রয় নেয় বাবা। ঢালু পাড়ের সব থেকে উঁচু অংশে, একটা একতলা পাকা ঘর। যার না আছে দরজা, না জানলা। সময় অসময়ে নৌকা গুলিকে ওখানে রাখা হয় বলেই অমন নাম। বাইরের থেকেও ভিতরটা যেন আরও কয়েকগুণ বেশি ঠাণ্ডা। নতুন করে সিগারেট ধরায় বাবা। ফস করে দেশলাই জ্বালাতেই কে যেন কেশে ওঠে খকখক করে, চমকে সেদিকে তাকায় বাবা। কোণার জমাট আঁধার কি নড়ে ওঠে সামান্য? এমতবস্থায় টর্চ জ্বালবে কি জ্বালবে না দোনামনা করতে করতেই, কথা বলে ওঠে জমাট বাঁধা অন্ধকারটা, “ কে জামাই নাকি?”


কিঞ্চিৎ ঘড়ঘড়ে অচেনা গলা। এই সব ছোট গ্রামে এমনিই সবাই, সবাইকে চেনে। আর সেযুগে গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় এসে মায়ের চাকরি করা আর বাবা মায়ের অসবর্ণ বিবাহ ঐ ক্ষুদ্র পল্লীসমাজে ছোটখাট একটা আণবিক বোমা বিস্ফোরণের থেকে কম কিছু ছিল না। ফলে আসেপাশের তিনটে গাঁয়ের লোক বাবাকে চিনত। তাদেরই কেউ হয়তো রয়ে গেছে এপাশে, মনে করে সাড়া দেয় বাবা। জমাট অন্ধকারটা এগিয়ে আসে পায়ে পায়ে, “কি জামাই চিনতে পারছ না? আমি নিবারণ গো, সেই যে শীলুর সাথে পড়তাম।” মায়ের ডাক নামটা শুনেও ঠিক ঠাওর করতে পারে না বাবা। ঘাড় নাড়ে আন্দাজে। দলা পাকানো অন্ধকারটা জানতে চায়, “ওপাড়ে যাবা নাকি?” “চল, তোমায় নে যাই” বলে তড়বড় করে ঢালু পথ ধরে নদীর কাছে নেমে যায় মাঝি। বাইরের ঝাপসা অন্ধকারে বাবা দেখে এক নাতি দীর্ঘ মানুষ, মাথা জোড়া টাক। ঐ শীতেও পরনে লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি, তার ওপর আলগোছে একটা চাদর জড়ানো। পাড় থেকে একটা নৌকাকে ঠেলে জলে নামিয়ে চড়ে বসে নিবারণ। হাঁক পাড়ে, “কই গো জামাই? এসো গো।” কাঁধের ব্যাগ আর বড় টর্চটা নিয়ে চেপে বসে বাবাও। 


নৌকা ছাড়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে দুম করে উদয় হয় আরেক আগন্তুক। “ওপাড়ে যাও নাকি?” প্রশ্নকর্তার পরনে খাটো ধুতি, ধুতির নীচে এক জোড়া ধুলিমলিন পা। এত বড় পা বাবা ইতি পূর্বে দেখেনি, অবশ্য লোকটিও বিশাল লম্বা। তবে কৃশকায়। সম্ভবত ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। ঐ অন্ধকারে মুখ চোখ কিছুই দেখা যায় না। একটা সস্তার চাদরে মাথা মুড়ি দিয়ে নৌকায় উঠে বসে। নিবারণ একাই বকে যায় নৌকা বাইতে বাইতে, হযবরল গল্প শোনায়। যার কিছুটা বাবা শোনে, কিছুটা শোনে না। কিছু বোঝে, কিছু বোঝে না। নৌকা যখন মাঝ নদীতে আচমকা লক্ষ্য করে বাবা, যে নৌকার তলা দিয়ে প্রবল বেগে জল উঠে আসছে বুড়বুড়ি কেটে। 

কিছু নৌকায় যে এমন হয় না তা নয়, তাই এখানে সব নৌকাতেই বালতি মগ রাখা থাকে, জলটা চেঁছে ফেলার জন্য। ঐ অন্ধকারে বালতি মগ ঠাওর করতে পারে না বাবা। 


পরিস্থিতি দেখে মাঝির দৃষ্টি আকর্ষণ করে বাবা,জবাবে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে মাঝি। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে নিবারণ মাঝি। “কি আর হইবে জাম্বু, চিন্তা ছাড়েন। সেবারও তো এমনই হয়েছিল মাঝ নদীতে। ভালো মানষি করে পার করাতে গেলাম, মাঝ নদীতে কি যে হল---। জলের ভারে নৌকা গেল উলিটে। সোয়ারি গুলো তো সাঁতরে পলাইল, আমি গ্যালাম ফেঁসে। উল্টানো নৌকার নীচে আটকে গ্যাছিলাম কি না।”


 শুনে তো বাবার আত্মারাম খাঁচাছাড়া। কি করবে এই মাঝ নদীতে? এমন সময় এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটল, নৌকার অন্য সহযাত্রীটি “দুঃশালা” বলে সটান উঠে দাঁড়াল নৌকার ওপর, অতঃপর যুগপৎ নিবারণ মাঝি এবং আমার বাবাকে আশ্চর্যচকিত করে নৌকা থেকে লাফিয়ে নামল নদীতে, এবং বাকি পথ থুড়ি নদীটুকু গট গট করে হেঁটে ওপাড়ের আশ্যাওড়া গাছের জঙ্গলে মিলিয়ে গেল। 


কতবার যে শুনেছি গল্পটা আর ইয়ত্তা নেই। প্রায় ছাব্বিশ বছর হল চলে গেছে দিদা, গ্রামের সাথেও আর নেই কোন সম্পর্ক। শুনি আজকাল রাক্ষুসী হয়ে গেছে সেদিনের সেই রহস্যময়ী নদী। গোগ্রাসে গিলে ফেলছে গ্রামটাকে। কে জানে কিসের এত ক্ষোভ তার। তবু বড় মন কেমন করে আমার মেয়েবেলার সেই নদীটার জন্য। ভালো থাক নদী, ভালো থাকুক, বেঁচে থাকুক পৃথিবীর সব নদীরা।নদীর বুকেই যে লুকিয়ে আছে মানব সভ্যতার প্রাণভ্রমরা।


পুনশ্চঃ- নিবারণ নামে মায়ের সত্যিই এক সহপাঠী ছিলেন আর ভৌতিক মাঝি বনাম অদ্ভুতুড়ে সহযাত্রীর গল্পটা এক বিখ্যাত সাহিত্যিকের রচনা দ্বারা অনুপ্রাণিত। তিনিও আদতে আমার মায়ের জিলারই বাসিন্দা। সাকিন – খোসবাসপুর। বলুন তো কে?

অনির ডাইরি ৯ই মার্চ, ২০২৪

#অনিরডাইরি #হাওড়ার_কথা


অকাতরে ঘুমাচ্ছিলাম, আচমকা কার যেন উষ্ণ স্পর্শে ভেঙে গেল ঘুমটা। নাইট ল্যাম্পের নীলাভ আলোয়, যতটা দৃশ্যমান, তার থেকে বেশি অদৃশ্য। এক রাশ ঝাঁকড়া চুলের একটা মাথা ঝুঁকে আছে আমার ওপর, উষ্ণ এক জোড়া কচি ঠোঁট ফিসফিসিয়ে উঠল, " মা! মা! আচ্ছা, কাল কি মামমামের জন্মদিন?" 


সেই কোন সকালে বেরিয়েছি কাঁথি থেকে, বার্ষিক পরীক্ষা শেষে এক সপ্তাহের ধরে মাতুলালয় গুলজার করছেন শ্রীমতী তুত্তুরী, এবার তার পিতৃগৃহে প্রত্যাবর্তনের পালা। সারা দিন অফিস করে যখন হাওড়া পৌছালাম তীব্র জঠর জ্বালা আর দুঃসহ ক্লানিতে রীতিমত অবসন্ন। কোন মতে দুটো নাকে মুখে গুঁজে মেয়েকে জবরদস্তি জড়িয়ে সেই যে শুয়েছি, এই ঘুম ভাঙল। ঘুমানোর আগে এক প্রস্থ ঝগড়া করতে অবশ্য ভুলিনি মায়ের সাথে। ঘড়িতে মধ্য রাত সবে পেরিয়েছে, বাইরে থেকে এখনও ভেসে আসছে মায়ের কণ্ঠের অগ্নিবর্ষণ। সব কিছু থেকে আমাকে ত্যাজ্য করার ঘোষণা ভেসে আসছে, পিতামাতার প্রতি যাবতীয় দায়িত্ব থেকে আমাকে মুক্ত করা হচ্ছে, হুমকি দেওয়া হচ্ছে বাবাকে, যদি আমার সাথে কোন রকম সম্পর্ক রাখার গুস্তাফি করে, তাহলে তা মাফ করা হবে না। এমনকি আমার পক্ষ নেবার অপরাধে তুত্তুরীকেও যেন কিসব বলা হচ্ছে। ওগুলো এবাড়ির নিত্য কীর্তন। আমি আসব আর মায়ের সাথে একপ্রস্থ খটাখটি লাগবে না, তা আবার হয়?


সবকিছু ছাপিয়ে এক তীব্র লজ্জার আস্তরণ পলকে ঘিরে ফেলল আমায়। ছি ছি, এত বড় ভুল আমার হল কি করে? অনেক রাত অবধি জেগে এবং ভেবে কোন কুল পেলাম না। নিজের জন্মদিন সম্পর্কে মা যখন বলত, "ভূতের আবার জন্মবার" কত রাগ করতাম আমি, আর এবার আমিই বেমালুম ভুলে গেলাম। পরদিন সকালে অবশ্য মা প্রশান্তির প্রতিমূর্তি। কাল প্রতিজ্ঞা করেছিল আমার হাতে কিছু খাবে না, আজ চা বানিয়ে দিলাম, দিব্য খেল। জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর সাহস অবশ্য হলনি। ঘুমন্ত ভিসুভিয়াসকে না জাগানোই ভালো। 


এক রাশ কাজ নিয়ে এসেছি, বাবার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের KYC, মায়ের পোস্ট অফিসের পাশবই আপডেট, পেনশন সংক্রান্ত কিছু জটিলতা নিয়ে তত্ত্বতালাশ ইত্যাদি প্রভৃতি। জলখাবার খেয়ে বেরিয়েছিলাম, কাজ সেরে ফিরতে ফিরতে বেলা দুটো। কদমতলা বাজারে দেখি কি দারুণ আনারস বিক্রি হচ্ছে, বিক্রেতা বলেই দিল, " কাঁচা খেতে পারবেন না দিদি। চাটনি বানিয়ে খেতে হবে।" তাই কিনে আনলাম একটা মায়ের জন্য। বড় ভালোবাসে খেতে। বাড়ি ঢোকার মুখে বন্ধ হতে বসা পাড়ার দোকানে কপাল ঠুকে পেয়ে গেলাম কয়েক প্যাকেট দুধ ও। আমাদের এই মধ্যবিত্ত সাবেকি বাঙালি পাড়ায় অসময়ে দুধ পাওয়া প্রায় লটারি পাবার সামিল। 


মায়ের হাতে যখন আনারস আর দুধ ধরিয়ে জানতে চাইলাম, খুশি হয়েছে কি না। মা কান এঁটো করে হেসে জানাল আনারস পেয়ে ভীষণ খুশি। বললাম ফিরে এসে পায়েস বানাব, আমার হাতের পায়েস খেতে বড় ভালোবাসে মা। পায়েস বানানোর কথা শুনেও কোন সন্দেহ হল না মায়ের। কারণ মা জানেই না মায়ের জন্মদিন কবে। অফিসের খাতায় ৩০ শে জানুয়ারি, কারণ ইস্কুলে ভর্তি করার সময় ওটাই বলা হয়েছিল। বিয়ের পর মাতামহের খেরোর খাতা ঘেঁটে বাবা আবিষ্কার করেছিল আসলে মার্চ মাসে জন্ম আমার মায়ের। শুধু মা নয়, মাসিদের ক্ষেত্রেও বয়স ধরে গড়ে অমন মন গড়া জন্মতারিখ বসানো হয়েছিল, স্কুলে ভর্তি করার সময়। ফলে আমার মা মাসিরা নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগে অবসর গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। 


দুপুরের ভাত খেয়ে আবার বেরোলাম, সদ্য অবসর নেওয়া জনৈক বৃদ্ধ বড়দার সাথে সাক্ষাৎ করতে। বার বার ফোন করেই যাচ্ছে বৃদ্ধ, প্রলোভন দেখিয়ে যাচ্ছেন ডেকার্টস্ লেনের সুরুচির ফিশ রোল খাওয়ানোর। এ আহ্বানে সাড়া না দেবার মত মনের জোর আমার নেই বাপু। বেরোনোর আগে ফিসফিসিয়ে তুত্তুরী বলল, " মা বড় মামাকে বলেছি আজ মামমামের জন্মদিন। মা নিশ্চয়ই কিছু করছে।" কি যে করছি আমি নিজেই জানি না, অথচ আমার কন্যা সাক্ষাৎ অল ইন্ডিয়া রেডিও। তিনি শুধু বড় মামাকে বলেছেন তাই না, বড় মামী, ছোট মামা, বুল্লু দাদা মায় আমার পিসিকেও বলে বসে আছেন। খুড়তুতো ভাইগুলোও তেমন, একগাল হেসে, ষড়যন্ত্রের সুরে জানতে চাইল, "তাহলে ও বেলা আমরা কি করছি?" 


কি যে করি, ভাবতে ভাবতে ধর্মতলা পৌঁছে গেলাম। কোন রাজনৈতিক দলের সভার জন্য প্রায় অবরুদ্ধ ধর্মতলা, আড্ডা শেষে বাস পেতে যা হাঁটতে হল, আরেকটু হাঁটলে হাওড়া ব্রিজ পেরিয়ে যেতাম বোধহয়। যখন হাওড়া ময়দানে নামলাম খেয়াল হল আজ বৃহস্পতিবার। ময়দান মার্কেট পুরো বন্ধ। কি যে দিই ভদ্রমহিলাকে, ধুৎ। খালি হাতে বাড়ি ফিরছি যখন, সন্ধ্যা ঘনাচ্ছে। পাড়ার দোকানে দেখি গরম গরম জিলিপি ভাজছে। তাই কিনে নিয়ে গেলাম ভদ্রমহিলার জন্য। এত অল্পতে কেন যে এত খুশি হয়ে যান ভদ্রমহিলা। কোন যুগে ছেড়ে এসেছেন মুর্শিদাবাদ জিলা আর তার নিটোল গ্রাম্য জীবন, তাও মেলায়নি মনের সহজিয়া সুরটা। 


বললাম বসো মা, তোমার মুখটা একটু পরিষ্কার করে দিই। জীবনে কত বার ফেসিয়াল করেছে মা, কর গুণে বলা যায়। মায়ের কাছে ওসব অকারণ বিলাসিতা এবং অযথা সময় নষ্ট। প্লাস্টিকের চেয়ারে বসিয়ে ডবল ক্লিন করে, স্ক্রাব করে, গরম জলে ভেজানো তোয়ালে চেপে ধরছি যখন মায়ের মুখে, মা ততক্ষণে "ঘন্টা খানেক সঙ্গে সুমন"। গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছে সদ্য পদত্যাগ করে রাজনীতিতে প্রবেশ করা এক মানুষের কথা। "উহুহু আমার মুখটাই পুড়িয়ে দিলে গো" বলতে বলতেও টিভির পর্দা থেকে চোখ সরায় না মা, সুমনের আকর্ষণ এমনই তীব্র। "যত্ত বাজে কথা" বলে আরো চেপে ধরি আমি। 


মুখে জলজ স্প্রে করার পর, টিভিটা গার্ড করে দাঁড়িয়ে ভালো করে ঝাঁকিয়ে দিই মাথাটা, কি ছিটালাম বলো তো? ভালো করে শুঁকে টুকে বলে, "গোলাপ জল নাকি?" সাত বার স্প্রে করার দরকার ছিল, তৃতীয় বারেই মা এমন হাঁচতে আর কাশতে লাগল, ক্ষ্যামা দিলাম। "তোর জ্বালায় আমার বুকে পিঠে সর্দি বসে যাবে এবার।" হড়হড়ে একটা জিনিস মুখে লাগাতে লাগাতে বলি, এটা কি বলো তো? শামুকের লালা। ওয়াক তুলে মা বলে, "কোথা থেকে পাস এসব?" এবার শিট মাস্কের পালা, পাক্কা বিশ মিনিট পর, মুখ মুছে ক্রিম লাগিয়ে বললাম, এবার একটা ভালো শাড়ি পরো। 


মুখ ঝামটা দেয় মা। "তোর বাপ কি পরে আছে দেখেছিস? ওর পাশে আমি কি পটের বিবি সাজব?" সত্যি মাইরি, একটা নীল লুঙ্গি আর নীলচে পোলো নেক টি শার্ট পরে মনের আনন্দে খেরোর খাতা লিখছে বৃদ্ধ। আজ যে বউয়ের জন্মদিন সেটাও ভুলে বসেছে। বছর বছর পাট করা নতুন জামা আলমারিতে বসে বুড়ো হয়,বাবার সেই হাতে গোনা এক জোড়া জামা। এক সেট পরে, অন্য সেটটা কাচে। বলতে গেলেই বলে, "সব অমন পরে নষ্ট করতে আছে নাকি। কত কষ্ট করে আমরা বড় হয়েছি জানো।" 


আজকে ওসব সেন্টু দেবার দিন নয়, আজকে তার দিন, প্রতিনিয়ত যাকে ঘিরে আবর্তিত হয় বাবার জীবন। আলমারি হাঁটকে চকচকে একটা সেট বৃদ্ধের হাতে ধরিয়ে বলতেই হল, আজকের দিনের বিশেষত্ব। বাবাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয় মা। পোশাক বদলের পর একটা সোয়েটের টিপ পরাতে গিয়ে প্রথম সন্দিগ্ধ করে তুলি মাকে, " আমাকে এত সাজাচ্ছিস কেন?"  


 শৌভিক এর উপহার দেওয়া সেন্টের বোতল, খুঁজে ছড়িয়ে দিই মায়ের গায়ে। উনুনে ফুটতে থাকে ঘন ক্ষীরের মত পায়েস। ভাইয়েরা কেউ কেক নিয়ে আসে, তো কেউ রাতের খাবার। দুই নাতি নাতনী মিলে সাজায় কেকের ওপর মোমবাতি। ফোনে শুভেচ্ছা জানায় বড় মাসি, পিসিকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে মা। ফোন করে শুভেচ্ছা জানায় মায়ের জামাই, জানতে চায়, "ওষুধ গুলো ঠিক মত খাচ্ছেন তো?" আমরা তিন ভাই বোন আর তুত্তুরীরা দুই ভাইবোন সমস্বরে চিৎকার করি, " কিচ্ছু খাচ্ছে না। ওষুধ খাওয়ায় চূড়ান্ত গাফিলতি করে -"। আচমকা চিৎকারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় মা, থমকে যায় কয়েক মুহূর্ত, তারপর অশ্রু সজল চোখে, এক গাল হেসে বলে, " তোমরাই তো আমার ওষুধ বাবা। তোমরা সবাই ভালো থাকো, আমি এমনিই ভালো থাকব।"

অনির ডাইরি ৫ই মার্চ, ২০২৪

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা



সে অনেককাল আগের কথা, জানুয়ারি মাস, সদ্য শেষ হয়েছে আমাদের শ্রমিক মেলা, মন জুড়ে তখনও মেলার সুখস্মৃতির মৌতাত। সেদিন রবিবার, আনুষ্ঠানিক ঘরকন্নার দিন। একদিকে কন্যাকে পড়তে বসিয়েছি, অন্য দিকে কন্যার পিতাকে বসিয়েছি পেঁয়াজ কাটতে। বড় গামলায় তেল মশলা মাখিয়ে জরছে দিশি মোরগ। একেবারে "সুখী গৃহকোণ, শোভে গ্রামোফোন”।


এমন সময় যা হয় আর কি, ঝনঝনিয়ে বেজে উঠল মুঠোফোন। ওপারে মাননীয় অতিরিক্ত জেলা শাসক মহোদয়। আমার দপ্তরী ফোনটা কি যেন কারণে অচল ছিল কয়েকদিন,উনি আমার ব্যক্তিগত নম্বরটা যোগাড় করে ফোন করছেন, কারণ শিরে সংক্রান্তি। মাননীয়া আসছেন। 

ভদ্রলোক অল্প কথায় মানুষ, শুধু বললেন, "আপনার তো অনেক বেনিফিশিয়ারি (অর্থাৎ বিভিন্ন প্রকল্পে নথিভুক্ত শ্রমিক), দিন না কয়েকজন।" বললাম, এ আর এমন কি ব্যাপার, কত লাগবে বলুন, ২০০-৫০০-১০০০? উনি বললেন, স্টেজ বেনিফিশিয়ারি লাগবে, জনা দশেক। হয়ে যাবে, বলার পর খেয়াল হল, শুধালাম কোথায় আসছেন মাননীয়া? জবাব এল বালিঘড়ি, তারকেশ্বর। নির্মীয়মান গ্রীন ভিউ ইউনিভার্সিটির মাঠে। 


কি সর্বনাশ সে তো আমার এলাকার বাইরে। চন্দননগরের বড় সাহেবের খাস তালুক। বললাম ও সে কথা, উনি শুনলে তো। " অত জানি না, আমি আপনার থেকে মাথা গুণে নেব সেদিন।" বড় সাহেবকে জানালাম তৎক্ষণাৎ, শুনে বললেন, " চন্দননগর মহকুমায় হবে তো কি হয়েছে? এটা তুমিই সামলাবে।" শুধু মৌখিক নয়, লিখিত অর্ডার করে দিলেন, সর্ব ঘটে কাঁঠালি কলা আমি। আমায় সহযোগিতা করার জন্য রাখলেন লম্বা পল্টন।


বড় সাহেবের হুকুমে আমার অবস্থা হল নবাব মীর জাফরের মত। ক্ষমতাহীন দায়িত্ব। স্যারের সামনে নীরব থাকলেও, স্যারের অসাক্ষাতে বদলে যেতে লাগল পটভূমিকা। ইগোর লড়াই হতেই পারত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর, যদি না মাননীয়ার আগমন নিকট হত। সব লড়াইয়ে জেতা যায় না, পিছিয়ে আসতে বাধ্য হলাম। নাম তো পাঠালাম দশ জনের, যার মধ্যে আটজনই আমাদের ধনিয়াখালির। তারকেশ্বরের নিকটবর্তী ব্লক। 


ধনিয়াখালির ইন্সপেক্টর চঞ্চল একাই একশ। এই দশ জনকে একত্রিত করে, জেলা প্রশাসনের হাতে তুলে দেওয়া এবং অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি পৌঁছে দেবার দায়িত্ব চঞ্চলের। মাঠে শ্রম দপ্তরের স্টল ম্যানেজ করার দায়িত্ব আমার CKCO সোমনাথের। সহযোগী বলতে ধনিয়াখালির SLO অমৃতা। লম্বা লেন্স নিয়ে পোলবার SLO রমেশ রইল ছবি তোলার জন্য। 


কাজ তো উঠেই যাবে, স্যারকে বললাম, বিলটা যদি দেন তো কয়েকটা টিশার্ট ছাপাই। যাদের বুকে পিঠে লেখা থাকবে দপ্তর আর প্রকল্পের নাম। শুধু যাঁরা স্টেজ উঠবেন তাঁরাই নয়, ওই একই টিশার্ট পরবে IMW চঞ্চল, CKCO সোমনাথ, আমার SLO অমৃতা, রমেশ আর তারকেশ্বরের দুই SLO। স্টেজ বেনিফিশিয়ারিদের পাখি পড়া করে শেখানো হল, ম্যাডামের হাত থেকে যখন অনুদান নেবেন, একটু তেরছা করে দাঁড়াবেন,যাতে ঠিকঠাক ছবি তুলতে পারে রমেশ। 


দিনটা যে কি অবর্ণনীয় চাপের মধ্যে কেটেছিল, কেবল ভুক্তভুগীরাই জানেন। মাননীয়ার নিরাপত্তাবলয় এতটাই কঠিন যে ভাগ্যে অমৃতার বর, কৌশিক বুদ্ধি করে তারকেশ্বর থেকে খাবার আর জল কিনে নিয়ে ঢুকেছিল, নাহলে নিরম্বু উপবাসেই কাটত সারাদিন। শৌচালয় একটা ছিল বটে, দপ্তর গুলোর জন্য নির্দিষ্ট ঘেরাটোপে ঢোকার আগে সেখান থেকে ঘুরে এলে ভালো, নাহলে প্রকৃতির আহ্বান অস্বীকার করে চেপে বসে থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই। কাপড়ে-চোপড়ে যদি করেও ফেলেন তাহলেও মিলবে না বেরোবার অনুমতি। হুঁ হুঁ বাবা, এ হল সিএম সিকিউরিটি। ওই অবস্থায় নিরাপত্তা রক্ষীদের রক্তুচক্ষু দর্শন পূর্বক ন্যাজ গুটিয়ে ফিরে আসতে হবে। 


তবে দিনের শেষে রমেশের তোলা ছবি গুলো যখন মুঠো ফোনে ভেসে উঠছিল, হাসি মুখের মাননীয়া, কখনও করমর্দনর করছেন তো কখনও নমস্কার। কখনও পিঠ চাপড়াচ্ছেন তো কখনও কাঁধে হাত দিয়ে নিচ্ছেন কুশল সংবাদ, উল্টো দিকে বিগলিত আমাদের শ্রমিক কুল, পিঠে জ্বলজ্বল করছে দপ্তরের নাম, আমাদের সামাজিক সুরক্ষা যোজনার নাম, পলকে দূর হয়ে গিয়েছিল সব ক্লান্তি।


সেই গল্পই শোনাচ্ছিলাম বর্তমান টিমকে, CKCO শান্তনু বলল, "আমরাও করতে পারি ম্যাডাম।আমরাও পরতে পারি স্কিমের নাম লেখা, দপ্তরের নাম লেখা টি শার্ট।" সে তো পারো, কিন্তু সময় যে বড় স্বল্প। এত জলদি সব যোগাড় হবে কি করে? হক বাবু বললেন, " একবার শুধু অনুমতি দেন, কাল কলকাতা চলে যাই, একদম কিনে, লিখে নিয়ে চলে আসব।" কিন্তু ফাণ্ড? তখন অনেক টাকা এ্যালোটমেন্ট আসত, স্যার কথা দেওয়া সত্ত্বেও টিশার্ট, টিফিন আর গাড়ির বিল ছাড়া নিয়ে ওনার অফিসেএত রকম জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল, যে মনে হত আমার বাপের বাড়ির গুষ্টির জন্য জামা ছাপিয়েছি আর টিফিন কিনেছি বোধহয়। শেষে ধুত্তোর বলে আমার অফিস থেকেই দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। আর এবার তো ভাঁড়ে মা ভবাণী।


রসদ কম তো কি, সাধ যে অসীম। পরদিন সত্যি মহানগর রওনা দিলেন হক বাবু। তার আগের রাতে এক প্রস্থ খণ্ড যুদ্ধ হল কি রঙের টি শার্ট কেনা হবে এবার তাই নিয়ে। সেবারের রং ছিল সাদা, এবার আমার আর মুকুলের পছন্দ কচি-কলাপাতা, বেদজ্যোতি এন্ড পার্টি আকাশীর পক্ষে। শেষ পর্যন্ত সংখ্যা গুরুর জয় হল। আকাশী টি শার্ট এর বুকে - পিঠে ছাপানো হল দপ্তর আর প্রকল্পের নাম।


আর ছবি তোলা? রমেশ আর রমেশের লম্বা লেন্স কোথা পাই? শান্তনু বলল, " কেন অরূপদা আছে না। ওর এই এত্ত বড় লেন্সে ঠিক ভালো ছবি উঠবে।" দেখতে দেখতে এসে গেল দিনটা, সবার আগে সক্কাল সক্কাল টিশার্ট পরে গোটা মহল্লা ঘুরেও এল শুভদীপ্ত। "রংটা এমনিতে ভালোই হয়েছে,তবে পরে নিজেকে কেমন সিভিক ভলান্টিয়ার মনে হচ্ছে ম্যাডাম।" 


 সাকুল্যে পাঁচ জনকে আনলেই চলবে, যাদের মধ্যে দুজন স্টেজে উঠবে, আর বাকি তিনজন রিজার্ভ থাকবে। কোলাঘাট আর তমলুক ব্লকের পঞ্চায়েত এলাকা থেকে বেনিফিশিয়ারিদের ব্লকে নিয়ে বাসে তুলে দেবে ওই পঞ্চায়েতের SLO। কোলাঘাটের বাসে থাকবে SLO প্রণব বাবু আর তমলুকের বাসে লাল্টু। ওরা আবার হ্যান্ড ওভার করবে নির্দিষ্ট ব্লকের সিকেসিও অর্থাৎ শুভদীপ্ত আর শান্তনুকে। এই দুজনের থেকে মাথা গুণে নেবে IMW মুকুল। সেবারের চঞ্চলের মত, এবারে জেলা প্রশাসনের সাথে বেনিফিশিয়ারি আদান প্রদানের দায়িত্ব IMW মুকুলের। অনুষ্ঠান শেষে আবার একই চেনে চলবে বেনিফিশিয়ারি আদান এবং প্রদান। 


সেই মত চারটে স্টাফ কার্ড চেয়ে এবং পেয়েছি আমরা। মুকুল সামগ্রিক ভাবে সবকিছুর দায়িত্বে, সহযোগিতায় শান্তনু এবং শুভদীপ্ত আর ছবি তোলার জন্য অরূপ। 


অনুষ্ঠানের দিন সকাল সকাল বিপত্তি, এমন পা কাটল শুভদীপ্তর, যে সাহস করে তাকে ওই ভিড়ের মধ্যে পাঠাতেই পারলাম না। হক বাবু কইলেন, " আপনাকে ভাবতে হবে নি ম্যাডাম। আমি চলে যাচ্ছি, অরূপকে নিয়ে। একদম সামনে থেকে ছবি তুলে আনব ।" বলা যত সহজ, করা ততোটাই দুষ্কর। একে তো মাননীয়ার কড়া নিরাপত্তার গেরো, তার ওপর তাঁকে ঘিরে জন উন্মাদনা। 


 নিয়ম মেনে মাননীয়া আসার আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা আগে ঢুকে যেতে হয় সবাইকে। যত বেলা বাড়ে ততো কড়াকড়ি হয় নিয়মের। ততো বাঁধন ছাড়া হয় জনপ্লাবন। হুগলী হোক বা পূব মেদিনীপুর, সর্বত্র একই চিত্র। সেবার দপ্তর গুলোর নিজস্ব স্টল ছিল, যেখানে সবাই ভিড় করে বসেছিলাম। এবার কোন স্টলের গল্পই নেই। জেলার শ্রম দপ্তরের সর্বোচ্চ আধিকারিক হিসেবে বড় সাহেবের যাও বা একটা চেয়ার জুটল, বাকিদের দাঁড়ানো ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। 


সামনের দিকে দাঁড়ানো অসম্ভব, তাই মুকুল, শান্তনু, লাল্টু আর প্রণব বাবু থেকে যান পিছে, ছবি তোলার টিম এগিয়ে যায় গুঁড়ি মেরে একদম সামনে। মিশে যায় আগত জন জোয়ারে। এই সব থেকে নিরাপদ দূরত্বে, অফিসের ঘেরাটোপে নিজ নিজ ডেস্ক টপে, মোবাইলে লাইভ ফিড অন করি আমরা। আকাশে ভেসে ওঠে কালো ভ্রমরের মত আকাশযান। শোনা যায় চেনা ঘটঘট শব্দ। দূরে পুলিশ লাইনের মাঠে অবতরণ করে হেলিকপ্টার। মূল প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেন তিনি। হাত নাড়তে নাড়তে স্টেজে ওঠেন তিনি। উঠে দাঁড়ায় অরূপ আর হক বাবুও। লম্বা লেন্সের ফোকাস বিন্দুতে তিনিই শুধু তিনি। শাটার টিপতেই যাবে, আচমকা বুলেটের মত ছুটে আসে জলের পাউচ, সাথে সাথে ঝাঁপিয়ে আসে কুকথার বন্যা। কোন মতে দু চারটে ছবি তুলেই বসে পড়ে দুজনে। এতো মহা জ্বালা। বালিঘড়ির গল্প যখন শুনিয়েছিল ম্যাডাম, তখন তো বলেননি, যে এমন ও ঘটতে পারে। 


নির্দিষ্ট সূচি মেনে এগিয়ে চলতে থাকে অনুষ্ঠান। স্বাগত ভাষণ, বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কাজের উদ্বোধন, ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন ইত্যাদি প্রভৃতি। দেখতে দেখতে এসে যায় মাননীয়া কতৃক উপভোক্তাদের হাতে পরিষেবা তুলে দেবার সময়। পিছনের তিন চারটে সারির মানুষকে কর জোড়ে অনুরোধ জানায় হক বাবু, " এবার কিন্তু আমরা একটু উঠে দাঁড়াব, আমাদের দপ্তরের লোকজন স্টেজে উঠতেছে।" মৌখিক সম্মতি জানালেও, পাউচ ছুঁড়তে দ্বিধা বোধ করে না কেউ। কয়েকটা লক্ষ্য ভ্রষ্ট হলেও, বাকি গুলোর নিশানা অব্যর্থ। তাও টলে না আমার লোকজন। ঘাড়ে কাঁধে বেশ কয়েকটা আলু নিয়ে অফিসে ফেরে আমার লোকজন। মোবাইল, ক্যামেরা ভর্তি একরাশ স্মৃতি নিয়ে অফিসে ফেরে আমার লোকজন। অন্যের কাছে নিছক কেজো হলেও আমার কাছে অমূল্য এই স্মৃতি। বদলীর চাকরি আমার, গতকাল হুগলী ছিল, আজ পূব মেদিনীপুর, আগামী কাল আবার না জানে নিয়ে যায় কোন জেলায়। থেকে যাবে শুধু স্মৃতিগুলো। এই স্মৃতি গুলোই যে আমার সম্পদ।

অনির ডাইরি ৪ ঠা মার্চ, ২০২৪

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 



অনেক দিন ধরেই শুনছি, তিনি আসছেন, তিনি আসছেন- এই এলেন বলে, এই এসে পড়লেন আর কি। জেলা প্রশাসনের অঙ্গে, তন্ত্রে জাগছে কম্পন, আমাদের আর কি? আমরা হলাম অপাংক্তেয় লাইন ডিপার্টমেন্টের দল। আমাদের কাজ বলতে, কেবল এমন কিছু মানুষকে যোগাড় করা, যাঁরা স্টেজে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে নানা অনুদান গ্রহণ করবেন। আর কিছু এমন মানুষ যোগাড় করা, যারা ক্রিকেটের দ্বাদশ ব্যক্তির মত বাউন্ডারি লাইনের বাইরে বসে অপেক্ষা করবে, স্টেজ বেনিফিশিয়ারিদের মধ্যে কেউ গরহাজির হলে, বা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে, তবে ওনাদের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে। 


হোক না সামান্য কাজ, তাই নিয়েই মোদের উৎসাহ আর উদ্দীপনা দেখে কে? হতে পারি মোরা ল্যাবার, তাই বলে মোদের স্কিম কি কিছু কম আছে নাকি? বিনামুল্যে সামাজিক সুরক্ষা তো একাই একশ। জেলায় জেলায় দুয়ারে সরকার সফল করে কে? BMSSY আবার কে? তাছাড়াও বয়স্ক নির্মাণ কর্মীদের পেনশন দিই আমরা, বয়স্ক পরিবহন শ্রমিকদের পেনশন দিই আমরা, এমনকি পেনশন প্রাপকের মৃত্যু হলে, তাঁর স্বামী/ স্ত্রীকে ফ্যামিলি পেনশনও দিই আমরা। আর কর্মসাথী? গত ২৩ শে মার্চ, ২০২৩ থেকে দেশ বা রাজ্যের বাইরে কর্মরত পরিযায়ী শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা দেবার লক্ষ্য নিয়ে যে নবীন প্রকল্পটি এসেছে, তার সৌজন্যে সপ্তম দুয়ারে সরকারের সময় থেকে নাওয়া- খাওয়া ভুলতে বসেছে আমাদের ইন্সপেক্টর কুল, সিকেসিও থেকে এসএলওরা।  


প্রতিটা প্রকল্প থেকে বেছে বেছে ছয় জনের নাম পাঠালাম, জেলা প্রশাসন তাকে কেটে ছেঁটে করে দিল দুই। অনুমোদিত তালিকা অনুসারে বেশ কিছু দপ্তরের একই প্রকল্প থেকে একাধিক মানুষ স্টেজে উঠবেন, আর আমাদের দুটো প্রকল্প থেকে মাত্র দুই জনকে অনুমোদন দেওয়া হল, বাকি প্রকল্প গুলি বাদ। কে আর মৃত নির্মাণ শ্রমিক বা অবসর প্রাপ্ত বাস ডিপোর টাইম কিপারকে নিয়ে মাথা ঘামায়। শুধু তাই নয়, ছেঁটে ফেলা হল আমিনা বিবিকেও। স্যার ভদ্র ভাবে আর আমি কোমর বেঁধে ঝগড়া করলাম আমিনা বিবির জন্য। এই মেয়েটাকে স্টেজে তুলতেই হবে-


“সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী”তে নালিশ করেছিল আমিনা বিবি। সেই নালিশের তত্ত্বতালাশ করতে গিয়ে তমলুক ব্লকের তৎকালীন IMW যোশুয়া মুর্মু দেখে, একটা চার আর একটা সাত বছরের পুত্রকন্যাকে নিয়ে অত্যন্ত দুস্থ অবস্থার মধ্যে রয়েছে মেয়েটি। জানা যায় মেয়েটি উচ্চ মাধ্যমিক পাশ। দুই বাড়ির অমতে শেখ সানোয়ারকে বিয়ে করেছিল আমিনা বিবি। বিয়ের পর বরের সাথে পাড়ি দেয় সুদূর কর্ণাটকের উত্তর কানাড়া জেলার সিদ্ধাপুরা। সেখানেই একটা টাইলস তৈরির কারখানায় কাজ করতেন শেখ সানোয়ার। সম্প্রতি এই কারখানায় যাবার পথেই পথ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ছেলেটি। 


স্বামীর মৃত্যুর পর, তার কাগজপত্র হাঁটকে কর্মসাথীতে নাম নথিভুক্তির কাগজটা খুঁজে পান আমিনা বিবি। লেখাপড়া জানা মেয়ে, বুঝতে অসুবিধা হয়নি, এই প্রকল্পে নথিভুক্ত শ্রমিক যদি কোন দুর্ঘটনায় মারা যান, তাহলে এককালীন দুই লক্ষ টাকার অনুদান পাবে, তার মনোনীত ব্যক্তি। টাকার যে বড্ড দরকার আমিনার, কিন্তু কি ভাবে পাবে, কোথায় জানাতে হবে বুঝতে পারেনি। তাই “সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী”।


আমিনা জানত না, শুধু মৃত্যুকালীন অনুদানই নয়, মৃত স্বামীর মরদেহ ফিরিয়ে আনার জন্যও ২৫ হাজার টাকা অনুদান প্রাপ্য তার। প্রাপ্য তো বটে, কিন্তু আমরা দেব কি ভাবে? নতুন প্রকল্পের বেনিফিট মডিউল তো এখনও আসেইনি। তাহলে কি অফলাইন ছাড়ব? সেক্ষেত্রে কি কি কাগজ পত্র নেওয়া হবে? কি ভাবে সেসব প্রসেস করা হবে? ইন্সপেক্টর কোন এনকোয়ারি করবে কি? করলে কি ভাবে করবে? বাইরের সাক্ষী লাগবে কি না? তারপর কি সমস্ত কাগজ কলকাতা পাঠাতে হবে ইত্যাদি প্রভৃতির জালে জড়িয়ে হাবুডুবুই খাচ্ছিলাম আমরা, এমন সময় ঘোষিত হল, তিনি আসছেন। শুধু আসছেনই না, আসছেন আমাদের অফিসের ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে। 


এত তাড়াতাড়ি কি আর আমিনা বিবির সমস্যার সমাধান করতে পারব? দূর তার থেকে অন্য একজন নথিভুক্ত শ্রমিককেই স্টেজে পাঠিয়ে দেব। মাননীয়ার হাত দিয়ে বরং একটা নথিভুক্তির সার্টিফিকেটই দিয়ে দেওয়া হবে। সব শুনে সুকন্যা এমন ধমক লাগাল, আর সোমনাথ দা করল আশ্বস্ত, “অত তোকে ভাবতে হবে না। তুই কেসটা স্ক্যান কর আর টাকা চেয়ে পাঠা। একটা অ্যাপ্রুভাল দিতে ভুলিস না।তারপর চোখ বন্ধ করে বসে থাক-।”


আজ যখন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর হাত দিয়ে বেনেফিটটা দেওয়া হল, আমিনা বিবির হাতে, চার বছরের শিশু পুত্রকে সঙ্গে নিয়েই স্টেজে উঠেছিলেন আমিনা বিবি। বাচ্ছা দেখার কেউ নেই যে বাড়িতে। পরনে বোরখা, মাথায় হিজাব, তারওপর আমাদের দেওয়া টি শার্ট। যাতে আমাদের দপ্তর, আমাদের স্কিমের নাম লেখা। বেনিফিট তুলে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী, পুঁচকেটাকে গাল টিপে আদর করলেন মুখ্যমন্ত্রী, আমিনার কাঁধে হাত রেখে শক্ত হতে বললেন মুখ্যমন্ত্রী। তখন আমি বহুদূরে। নিজের চেম্বারে, নিজের চেয়ারে বসে লাইভ ফিড দেখছি। মাঠে কোন মতে বসতে পেয়েছেন স্যার, ইন্সপেক্টর মুকুল,সিকেসিও শান্তনু, SLO লাল্টু আর প্রণব বাবুর ভাগ্যে একটা চেয়ারও জোটেনি। ছবি তোলার অভিলাষে গুড়ি মেরে একদম সামনে এগিয়ে গেছে হক বাবু আর অরূপ। ছবি তুলতে গিয়ে দমাদ্দম উড়ে আসা জলের পাউচের বাড়ি খাচ্ছে অরূপ, তাও এক অদ্ভুত ভালো লাগায় পূর্ণ সকলের হৃদয়। হোক না নিছক পেটের দায়ে, পেশার গুঁতোয়, তবুও কিছু তো করলাম, কারো তো পাশে দাঁড়াতে পারলাম।

অনির ডাইরি ৩রা মার্চ, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



সেদিনটাও রবিবার ছিল। সে অনেককাল আগের কথা, ২০০৯ সাল। মাসটা হয় ডিসেম্বর, নয়তো জানুয়ারি। হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা পড়েছিল বটে কিছু। সেদিন পোলিও রবিবার। তখন বাচ্ছাদের পোলিওর ওষুধ খাওয়ানো নিয়ে তীব্র অসন্তোষ ছিল সমাজের একটি অংশের। একদিকে গণ অসন্তোষ অন্য দিকে WHO’র গুঁতো। পরিণামে জেলা শাসকের মাধ্যমে নির্দেশিকা নেমে এল, যে বিভিন্ন কেন্দ্রে এই পোলিও অভিযান কতটা সফল তা ঘুরে দেখবে এবং রিপোর্ট দেবে সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক স্বয়ং। 


শৌভিক নতুন বিডিও। খড়গপুরের দুটো স্টেশন আগে, মাদপুরে চতুর্দিকে পুকুর আর ধান জমি দিয়ে ঘেরা মোদের লাল-নীল সংসার। ছিমছাম একতলা কোয়ার্টার। কর্মব্যস্ত দিনে তাও কিঞ্চিৎ জনসমাগম হয়, ছুটির দিনগুলো কাটে চূড়ান্ত নিরিবিলিতে। ছুটির দিনে আমাদের দাম্পত্যালাপ ভিন্ন আওয়াজ বলতে, কেবল দূর থেকে ভেসে আসা আজানের সুর আর ট্রেনের বাঁশি। যে বাঁশির সুর শুনলেই আমার বর সব কাজ ফেলে দৌড়োয় বারন্দায়, ট্রেন দেখবে বলে। দিগন্ত প্রসারী সবুজ ধান ক্ষেতের বুক চিরে চলে গেছে এক ফালি রেল লাইন। লোকাল থেকে মালগাড়ি, আমার বরের সবাইকে দেখা চাইই চাই। 


শৌভিকের এই ট্রেন নিয়ে আদিখ্যেতা আমার মাথায় ঢুকত না, ঢোকার সময় ও থাকত না। শনি-রবি বা ছুটির দিন মানেই সেটা ছিল “ঘরসাফাই ডে”।  রান্নাবান্না থেকে ঝাড়পোঁচ, বাসন মাজা সবই আমরা নিজেরা করতাম। রান্না অবশ্য আমিই করতাম, রাতের বাসন ভোরে উঠে আমি মাজতাম, আর সকালের বাসন অফিস থেকে ফিরে শৌভিক। ঝাড়াঝাড়ির জন্য আমার ছিল ঝ্যাঁটা আর ন্যাতা আর শৌভিকের ভ্যাকুয়াম ক্লিনার। 


তো সেই রবিবারও যাবতীয় গৃহকর্ম নিপটে, দোঁহে বেরোলাম পোলিও রবিবার পর্যবেক্ষণে। আমি কেউ না, আমি যেতে খুব একটা আগ্রহীও ছিলাম না। কিন্তু রবিবারের জনশূন্য কোয়ার্টারে আমাকে একা রেখে যেতে মোটেই রাজি হল না শৌভিক। যদিও আমার সন্দেহ হচ্ছিল, ও ব্যাটা নিজে ঘুমাতে পারবে না বলে আমার দিবানিদ্রার ব্যাঘাত ঘটাল। ড্রাইভার (এবং মালিকও) শৈবাল দার সাদা অ-বাতানুকূল অ্যাম্বাসাডরে চেপে রওনা দিলাম দোঁহে। সারি বদ্ধ ইউক্যালিপ্টাস গাছে মোড়া পিচ রাস্তা দিয়ে বেশ অনেকটা গিয়ে হাই রোড। ফাঁকা হাই রোডে লাগাম ছাড়া ঘোড়ার মত ছোটে গাড়ি। দুদিকে যত দূর চোখ যায়, সবুজ চাষের জমি। মাটির রঙ বুঝি আমাদের হাওড়া-কলকাতার থেকে সামান্য একটু লালচে। 


গাড়ি থেকে নেমে, দুদিকে পুকুর আর মাঝখানে ঢালু লাল মোরাম বিছানো রাস্তা দিয়ে বেশ অনেকটা হেঁটে গিয়ে, একটা একতলা ঘর। ঘরের সামনের বারন্দায় বসে বসে হাই তুলছেন এক মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোক, পাশে এক ভদ্রমহিলা বসে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন দূরে কোন গাছের দিকে। আর তৃতীয় কোন জনমনিষ্যি নেই ধারেকাছে। তবে কি এখানেও পোলিও প্রতিরোধ কর্মসূচি বয়কট করেছে স্থানীয় বাসিন্দারা? তাই জন্যই কি শৈবাল দা এখানে নিয়ে এসেছেন আমাদের! সেটা শুধাতেও হাঁটতে হবে অনেকটা, কারণ গাড়ি দাঁড়িয়ে সেই হাইরোডে, আর ফোন গুলোতে একটাও টাওয়ার অবশিষ্ট নাই। 


তিন ধাপ সিঁড়ি টপকে খোলা বারন্দায় উঠল শৌভিক। পিছন পিছন আমি। শৌভিক শুধাল, “কি ব্যাপার? কেউ পোলিও খাচ্ছে-টাচ্ছে না?” ভদ্রলোক দাড়ি চুলকে বললেন, “সকাল সকাল এসে সব খেয়ে গেছে আজ্ঞে। আরো কয়েক জন আসবে হয়তো, এখন দুপুরবেলা তো- ।” সামনে রাখা রেজিস্টারের পাতা উল্টে পাল্টে শৌভিক বলল, “আচ্ছা আপনার পরিচয়টা- ।” ভদ্রলোক নিজের এবং পার্শ্ববর্তিনীর পরিচয় দিয়ে শুধালেন, “আর আপনি?” শৌভিক বলল, “আমি বিডিও।” ভদ্রলোক এতক্ষণ বসে কথা বলছিলেন, এবার উঠে দাঁড়ালেন। “শুনতেছি বটে নতুন বিডিও সাহেব আসতেছেন। স্যার আপনের বাড়ি কুথা? স্যার আপনের খোকা আছে-।”


প্রশ্নোত্তর পর্ব আর কোথায় গড়াত জানি না, এমন সময় দূর থেকে লাল মোরামের রাস্তা ধরে এক মহিলাকে হেঁটে আসতে দেখা গেল। কোলে একটি শিশু সহ। ভদ্রলোক কইলেন, “সার- ম্যাডাম একটা বাচ্চাকে অন্তত ভ্যাকসিন খাইয়ে যাননি-।” কাঁথায় মোড়া তুলোর বল। কপাল জোড়া এত্ত বড় কৃষ্ণবরণ চাঁদ মামা। দুই চোখেও পুরু করে কাজল পরান। মাখনের থেকেও মোলায়েম দুটো গালকে আঙুল দিয়ে সামান্য টিপতেই পুতুলের মত ছোট্ট হাঁ করল। শৌভিক সামান্য চাপ দিল ভায়ালে, গোলাপি জিভের ওপর টুপটাপ ঝরে পড়ল লালচে রঙা দুফোঁটা তরল। 


তারপর ঘটে গেল কত কি। আমরা দুই থেকে তিন হলাম। মাদপুরের পাট চুকল। শৌভিকও দেখতে দেখতে বিডিও থেকে কবে যেন এসডিও হয়ে গেল। এসডিওগিরির ও প্রায় তিন বছর হতে চলল। ইতিমধ্যে ঘোষিত ভাবে পোলিও মুক্ত হয়েছে ভারত। বিগত ১২ বছরে আক্রান্ত হয়নি আর একটাও শিশু। খুঁজেই পাওয়া যায়নি হতভাগা ভাইরাসটাকে। রবিবার-রবিবার সেই পোলিও অভিযানও বন্ধ হয়ে গেছে। অথবা হলেও আমাদের কানে আর পৌঁছায় না। আমাদেরটা পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে যে। তাই গত রাতে শৌভিক যখন বলল, “ সুপার সাহেব কাল সকালে একবার যেতে বলেছেন। কাল বাচ্ছাদের পোলিও খাওয়ানো হবে, আমার হাত দিয়ে শুরু করতে চান।” আকাশ থেকে পড়লাম আমি, পোলিও আবার ফিরে এসেছে নাকি? 


কাঁথি মহকুমা হাসপাতালের আউটডোর ইউনিটে যখন পৌঁছালাম, ঘড়িতে সদ্য নটা। তখনও ভিড় জমেনি তেমন। সুপার সাহেব আর হাসপাতালের দিদিরাই রয়েছেন। সাজানো হচ্ছে আউটডোরটাকে, রঙবেরঙের বেলুন দিয়ে। সুপার সাহেব অত্যন্ত সুবক্তা, গুছিয়ে বললেন," বিগত ১২ বছরে ভারতে এই ভাইরাসের উপস্থিতির কোন প্রমাণ আমরা পাইনি। কিন্তু সম্প্রতি কিছু শিশুর মলে এই ভাইরাসের নমুনা পাওয়া গেছে। আসলে দুয়েকটি প্রতিবেশী দেশে তো সেই ভাবে পোলিও খাওয়ানো হয় না, ওখান থেকে শ্রমিকরা যখন আসে, তাদের বাচ্ছাদের মারফৎ এই ভাইরাসটাকেও নিয়ে আসে। আমরা তাই সম্পূর্ণ বিপন্মুক্ত নই।"


এবার ভ্যাকসিন দেবার পালা। ভাগ্যে ওরাল ভ্যাকসিন, সূচ ফোটানো হলে আমি মোটেই যেতাম না। মাননীয় মহকুমা শাসকের শুভ হস্তেই কর্মসূচি শুরু হবার কথা। তবে ওনার ঘরণী বলে, প্রথম ডোজটা আমাকেই খাওয়াতে বলা হল। আমার জন দিব্য বাবার হাত ধরে হেঁটে এসে লাফিয়ে চেয়ারে উঠে বসল। হাঁ করাতেও হল না। তিনি জিভ বার করেই রেখেছেন। টুপটাপ ঝরে পড়ল ওষুধ। একহাতে ধরানো হল দুটি চকলেট, অন্য হাতের কড়ে আঙুলে লাগানো হল মার্কার। ছোটবেলায় তুত্তুরী বলত, “দ্যাখ দ্যাখ মা, কেমন ভোট দিইছি।” 


এবার শৌভিকের পালা। ওর ভাগ্যে যিনি পড়লেন, তাঁকে দেখে শৌভিক বেশ ভড়কে গেল। “ও বাবা, একে আমি খাওয়াতে পারব না।” তিনি যে বড্ড ছোট। কুৎকুতে দুই চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু। গা থেকে ভেসে আসছে দুধ আর বেবি পাউডার মেলানো-মেশানো মোহক সুবাস। সবাই সাহস দিল, “দিন স্যার, দিন। ঠিক পারবেন।”এক হাতে পুঁচকে দুটো গাল টিপে অন্য হাতে যখন ওষুধটা ঢালছিল শৌভিক, মনে হচ্ছিল পনেরো বছর আগের মুহূর্তটারই পুনরাভিনয় দেখছি বুঝি। বিডিও থেকে এসডিও, সেদিনও ওর পাশে ছিলাম, আজও থাকতে পেরেছি ঈশ্বরের কৃপায়। দুজনের দুই রকম চাকরি, মেয়ের লেখাপড়া, বয়স্ক বাবামা, শ্বশুর শাশুড়ি সামলে সেটা যে কতটা দুরূহ, কতটা জটিল, ভুক্তভোগীরাই জানে। সবার ওপর তিলোত্তমার কুহকিনী আকর্ষণ। দিনের শেষে কেবল হাতে থেকে যায়, আরেক জোড়া হাতের উত্তাপ। এই তো চাই কালীদা,বাকিটা ঠিক হয়েই যাবে।