অনির ডাইরি ২৪শে মার্চ, ২০২৪
#অনিরডাইরি
দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি। কি বিকট যানজট রে বাবা! আর তেমনি রোদ। কেমন যেন ট্যারাব্যাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে গাড়ি গুলো। সামনের গাড়িটা সামান্য একটু এগোলেই পারে, ওটার সামনে বেশ খানিকটা ফাঁকা পথ পড়ে আছে। বার দুয়েক হর্ন বাজালোও আমাদের গাড়িটা, ড্রাইভারের কোন হেলদোল নেই। তিনি কি যেন খাচ্ছেন থুড়ি পান করছেন আর স্টিয়ারিং হুইলের ওপর তাল বাদ্য বাজাচ্ছেন, সাথে সাথে স্লো মোশনে এদিকওদিক হচ্ছে টেকো মাথাটাও। আবার হর্ন বাজাতেই নেমে গেল পিছনের জানলার কালো কাঁচ, রোদ চশমা পরা এক এলোকেশী মুণ্ডু বার করে খুব এক চোট ধমক দিলেন আমাদের। তবে শুনতে পেলাম না কিছুই। কারণ কাঁচ নামাতেই হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এল কর্ণপটহ বিদরণকারী সঙ্গীতের গুষ্টি। রাস্তাটাই কেঁপে উঠল যেন।
ড্রাইভার বাবুকে বললাম, ছেড়ে দিন। কাল দোল বলে কথা। বাঙালি (!) আজ থেকেই সুর এবং সুরায় আকন্ঠ নিমজ্জিত। "তাই বলে একটু এগোবে নি? সাইড দিবে নি? সক্কাল সক্কাল চড়িয়ে বসছে নাকি?" বিড়বিড় করে বলতে থাকে ড্রাইভার। হর্ণে অবশ্য হাত লাগায় না। মিনিট দুয়েক পর সামনের গাড়ির কাঁচ আবার নেমে যায়, আবার ভেসে আসে সঙ্গীতের মুষল, আবার হাত পা নেড়ে ধমকাতে এবং চমকাতে থাকেন রূপসী। ড্রাইভার বাবু হতবাক হয়ে বলেন, " যাঃ বাব্বা, আমি তো হর্ন বাজাই'ই নি।" বার চারেক চলে বিনা প্ররোচনায় একই দৃশ্যের পুনরাভিনয়।
তারপর বোধহয় বোর হয়ে যায়, প্রেস লেখা গাড়িটার আরোহীরা। বাসন্তী রোদ আর মৃদুমন্দ হাওয়ায় বোধহয় ঝিম ধরে যায় আমারও। আচমকা কানের কাছে কে যেন চিৎকার করে ওঠে, " আলবাৎ। ঠিক বলেছে। আমি বলব এক্কেবারে ঠিক বলেছে।" ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসি। থেমে থাকা কোন গাড়ির দুই পুরুষ আরোহী হাওয়া খেতে নেমেছেন। তাঁদেরই একজন চিৎকার করছিলেন, এবার যোগ দিলেন অন্য জন, ষড়যন্ত্রের সুরে বললেন " কি বিশ্রী ভাবে শাড়িগুলো পরে তুমি দেখেছ?" অতঃপর গলা চড়িয়ে, " ছি ছি ছি। তাকানো যায় না জাস্ট।" প্রথম ব্যক্তি সঙ্গত দিলেন, " একদম। আর যারা এর বিরোধীতা করছে,তারা আসলে নিজেরাই ওই রকম। শালীনতা শব্দের বানানই জানে না তো মানে।"
মিনিট দুয়েকে দুজনে আমার মস্তিষ্ক প্রক্ষালন করে দিলেন, যে সমাজ বিশেষতঃ এপার বাংলার বাঙালী সমাজ রসাতলে যাচ্ছে এবং তার জন্য দায়ী আধুনিক নারী এবং তাদের শাড়ি। দুই জনের পরনেই হাফ প্যান্ট এবং টি শার্ট। সপ্তাহান্ত বলে কথা, তাও আবার দোলের আগের দিন। ওটাই আপাতত শালীন পুরুষ কুলের জাতীয় পোশাক। আশেপাশের গাড়ি থেকে যত জন রাস্তায় নেমেছেন শতকরা নব্বই জনের পরণেই হাফ প্যান্টুল।
কথা বলতে বলতে, রাস্তার ধারে চলে গিয়ে গাড়িগুলোর দিকে পিছন করে দাঁড়ালেন দুই অতি শালীন, অতি রক্ষণশীল পুরুষ। বোঝাই গেল, অতঃপর জল বিয়োগের পালা। পিছনে যে গোটা কুড়ি-পঁচিশ কি আরো বেশী গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, তাতে যে মহিলা, পুরুষ এমনকি বাচ্চারাও আছে, তাতে ওনাদের কি? না পোষালে চোখ সরিয়ে নিন না। পুরুষদের ওসবে দোষ নেই। তাদের অশালীন নেই। সবটুকুই শালীন।
এই যে একটু আগে রাস্তা পার হতে গিয়ে একটা ছেলের মোবাইলটা পড়ে গেল, ঝুঁকে তোলার সময়, লো ওয়েস্ট জিন্স উপচে বেরিয়ে এল পশ্চাৎ দেশের ক্লিভেজ, তখনও আমরা কি করলাম?তড়িঘড়ি চোখ সরিয়ে নিলাম। দোষ নেই দাদা,দোষ নেই। ছেলেদের ওসবে দোষ নেই। ওর দেহ, ওর পোশাক, কতটা ঢাকবে আর কতটা খোলা রাখবে, সেই সিদ্ধান্ত ও,ওর। আরে বাবা ওরা হল পুরুষ। উপার্জনকারী শ্রেণী, বংশ রক্ষক প্রজাতি। পরিবারের জিন তো কেবল ওরাই বহন করে।
" সোনার আংটি আবার ব্যাঁকা" কথাটা শোনেন নি? সোনার আংটি অর্থাৎ কিনা পুরুষ প্রজাতি। তাঁরা তো জন্ম নির্দোষ। মেয়েরাই তো তাদের ফাঁদে ফেলে। যেমন ফেলে পেটের দায়ে ল্যাম্প পোস্টের নীচে দাঁড়ানো মেয়েরা। খারাপ তম মেয়েদের উদাহরণ দিতে হলে কি সহজেই না তাদের আমরা টেনে আনি। কিন্তু যারা তাদের উন্মুক্ত দেহাংশের তুল্যমূল্য বিচার করে, দর করে তাদের পসরা কেনে তাদের নাম করে কোন গালাগালি দিতে দেখেছেন? ওখানে যেতেও দম লাগে। ওটাও তো পৌরুষের পরিচয় দাদা। ওটাও পৌরুষের পরিচয়।
সামান্য চাঞ্চল্য দেখা দিল সামনের গাড়ি গুলোর মধ্যে। জল বিয়োগ সেরে, দুই হাফ প্যান্টুল ধারী শালীন ব্যক্তিও ফিরতে লাগলেন নিজেদের গাড়ির দিকে। মেয়েদের শাড়ি ছেড়ে শুনতে পেলাম আপাতত গ্যাস নিয়ে তাত্ত্বিক চর্চা চলছে, ব্রহ্মলোক কাঁপানো একখানা ঢেঁকুর তুলে একজন বললেন, "গ্যাসটা কিছুতেই বেরোচ্ছে না। পেটটা ফুলে আছে।" অন্য জন বললেন, " যাই বলো ভায়া,ঢেঁকুরটা বড় বাজে জিনিস। It's gross, শুনলেই গা ঘিনঘিন করে ওর থেকে পা🔇 ভালো।" অন্য জন হেসে উঠলেন, " হেহে, মানে গাড়িতে -"। উৎসাহিত হয়ে প্রথম ব্যক্তি আবার বললেন, " হ্যাঁ বিলকুল। ওটার মধ্যে একটা আর্ট আছে। আরে ওটার তো নামেই আর্ট আছে। শোনো নি, Fart is an art, that starts with an F." জয় বাঙালি, থুড়ি জয় শালীন বাঙালি।
অনির ডাইরি ২৩শে মার্চ, ২০২৪
#অনিরডাইরি
অফিসে এলে মনে হয়, ইশ কামাই করলেই হত। আবার অফিস কামাই করলেও, অপরাধ বোধে পাগল পাগল লাগে। এই দোদুল্যমানতার মধ্যেই কাটিয়ে দিলাম এত গুলো বছর, পেশাদারিত্বটা আর শিখে উঠতে পারলাম না। আজই যেমন, জানলার বাইরে ঝুলছে ইয়া মোটা কালো মেঘের চাদর, প্রবল বেগে মাথা দোলাচ্ছে দূরে ঘন সবুজ মাঠের পরিসীমা বরাবর বেড়ে ওঠা বুনো মহীরুহের দল আর ভিতরে ভিতরে ডুগরে উঠছি আমি। ইশ এমন দিনে বাড়ি থাকলে কি ভালো ঘুমানো যেত মাইরি-
এমন সময় দরজা ঠেলে শান্তনুর প্রবেশ, “ম্যাডাম, এক ভদ্রলোক এসেছেন। বলছেন এই অফিস থেকে নাকি গত ৮ই নভেম্বর ওনাকে ফোন করা হয়েছিল। উনি মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে কিছু নালিশ করেছিলেন, সেই সংক্রান্ত কারণেই যে ওনাকে ফোন করা হয়েছিল সেটা বলতে পারছেন, কিন্তু কে করেছিল, করে কি বলেছিল কিছু বলতে পারছেন নি। কি বলব? ভোটের পরে আসতে বলি?”
সদ্য নির্বাচন ঘোষিত হয়েছে, অনেক রুটিন কাজই আপাতত নির্বাচন কমিশন কতৃক নির্ধারিত আদর্শ আচরণ বিধিতে আটকায় বলে বন্ধ, তাই বলে একটা লোকের সমস্যাটা কি সেটাও কি শুধাতে পারব নি? বললাম, ডাকো দেখি, কি কন। শান্তনু দরজা খুলে লোকটাকে ইশারায় ডাকল, তবে নিজে ঘর ছেড়ে গেল না। কিছুদিন আগে অমন এক বৃদ্ধ এসেছিলেন, কি যেন গেরোয় দীর্ঘদিন আটকে ছিল ওনার পেনশন, সম্প্রতি এক সাথে তিন বছরের পেনশন ঢুকেছে। একজন দরিদ্র ইলেকট্রিক মিস্ত্রীর কাছে সেটা অনেক টাকা। ভদ্রলোক আনন্দে ডগমগ হয়ে নিজেই এসেছেন আমায় ধন্যবাদ দিতে। আমিও খুব আনন্দের সাথে ওনার সাথে একটা ছবি তুলে নিলাম, বলে দিলাম বছর বছর মনে করে নভেম্বর মাস পড়লেই এসে বেঁচে থাকার শংসা পত্রটা জমা করে যাবেন। মনে রাখার সুবিধার জন্য শান্তনু বলে দিল, “কালী পুজোর পরই চলে আসবেন।“ ভদ্রলোক উৎফুল্ল হয়ে বললেন, “আমি একটু কিছু খাওয়াতে চাই আপনাদের।সামান্য মিষ্টি মুখ-।“ এই সব ক্ষেত্রে আগে আমি বলতাম, কেন খাওয়াবেন, এটা তো আমাদের রুটিন কাজ ইত্যাদি প্রভৃতি। তারপর দেখলাম নিষেধ করলে, বাবুদের গোঁসা হয়, দুঃখ হয়, অপমান হয় ইত্যাদি। তাই আজকাল কেউ খাওয়াতে চাইলে শুধু দু- তিনটে প্রশ্ন করি, “নিজের ইচ্ছাতে খাওয়াচ্ছেন তো? আমি বা আমার অফিসের কেউ খাওয়াতে বলেনি তো? খাওয়ালে কি খুশি হবেন?" যদি উত্তর হ্যাঁ-না-হ্যাঁ আসে তাহলে উফ কি আনন্দ। কারণ আদতে যে আমি জন্ম হ্যাংলা এ নিয়ে তো কোন দ্বিমত নেই।
তো ভদ্রলোক সঠিক উত্তর দিলেন। আমিও অনুমতি দিলাম যা প্রাণ চায় খাওয়ান। আমাদের কোন দাবী নেই। এরপরই ঘটল সেই ঘটনাটা, ভদ্রলোক ট্যাঁক থেকে বার করলেন একটা ময়লা কাপড়ের থলে এবং তার থেকে বেশ কয়েকটা নোট বার করে এগিয়ে দিলেন আমার দিকে, “ একটু মিষ্টি মুখ আজ্ঞে –।“ আমি চেয়ার থেকে আর শান্তনু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এক সাথে লাফিয়ে উঠেছিলাম সেদিন। “করেন কি? করেন কি-” বলতে বলতে দৌড়ে এসে যখন খপ করে লোকটার হাত চেপে ধরেছিল শান্তনু, তখনও বৃদ্ধর চোখেমুখে অপার বিস্ময়। সে যাত্রায় শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধ নিজেই মিষ্টি কিনে এনে খাইয়েছিলেন বটে তবে সেই থেকে আতঙ্কে ভোগে শান্তনু। আমার ঘরে কাউকে সঙ্গে করে নিয়ে এলে বেশ খানিক ক্ষণ অপেক্ষা করে যায়, ব্যাপারটা নিরাপদ কি না বোঝার জন্য।
আজ যিনি ঢুকলেন, বয়স চল্লিশের কোঠায়। শ্যাম বর্ণ, মাঝারি উচ্চতা, চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। পরনে হাতা গোটান সামান্য বিবর্ণ ফুল হাতা শার্ট আর প্যান্ট। হাতে একটা বাজারের ব্যাগ। সামনের ফাঁকা চেয়ারে বসতে বলে জিজ্ঞাসা করলাম, “কি হয়েছে?” ভদ্রলোক একই কথা বললেন, ওনাকে বিগত নভেম্বর মাসের শুরুতে এই অফিস থেকে কেউ ফোন করেছিল। উনি দপ্তরের নাম আর তারিখটা টুকে রেখেছেন কিন্তু যে ফোন করেছিল তার নাম আর নম্বরটা লিখতে ভুলে গেছেন। ভ্রু কুঁচকে আমাকে শুধালেন, ”আপনাদেরও তো একটা ডেটা বেস থাকে নাকি?” ডেটা বেস অনেক ভারী কথা, তবে গরীবের দপ্তরে কিছু রেকর্ডস তো থাকেই। কিন্তু ভদ্রলোকের নাম সেখানে অনুপস্থিত। সেটা জানাতে উনি ভালো করে দাড়ি চুলকে বললেন, “কিন্তু তাহলে তো আমার খুব সমস্যা হয়ে গেল।“
বললাম, আপনাকে ফোন করে কি বলা হয়েছিল, সেটা বলতে পারবেন? তাহলেও না হয় বলে দেওয়া যাবে, পরবর্তী পদক্ষেপ কি হতে পারে। উনি সেটাও বলতে অপারগ। বললাম আচ্ছা, আপনি মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে নালিশটা কি করেছিলেন, সেটা বলতে পারবেন? তাহলেও একটা রাস্তা দেখা এবং দেখানো যেতে পারে। ভদ্রলোক বাজারের ব্যাগ থেকে একটা খেরোর খাতা বার করে আনলেন, চশমাটা নাকের ওপর তুলে বললেন, “নালিশ কি আর একটা। দাঁড়ান আপনাকে দিন ক্ষণ ধরে বলি-।”
প্রমাদ গুণলাম। প্রথম নালিশটা দেখা গেল আজ থেকে বছর দুয়েক আগের। জেলার জনৈক বড় নেতার নামে। “উনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন, অমুক জায়গায় আমার একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেবেন। কিন্তু কথা রাখেননি।“ জিজ্ঞাসা করি, কোন লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন? কোন টাকাপয়সা লেনদেন করেছিলেন? জবাব আসে নেতিবাচক। তাহলে? শুধু মৌখিক প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের নালিশ করেছিলেন? এবার জবাব ইতিবাচক আসে।
দ্বিতীয় নালিশ খোদ ডিএম সাহেবের নামে। এই ডিএম সাহেব নন, পাক্কা এক দশক আগে যিনি এই জেলার ডিএম ছিলেন, তাঁর নামে। সেই সময় নাকি কিছু সরকারী দপ্তরে লোক নেবার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। ইনিও আবেদন করেছিলেন, কিন্তু সিলেক্টেড হননি। কেন হননি, সেটাই নালিশের বিষয়। আমি আবার জিজ্ঞাসা করি, এত বছর আগে আবেদন করেছিলেন তাহলে এত দেরীতে খোঁজ নিচ্ছেন কেন? ভদ্রলোক নেহাৎ ক্যাজুয়াল ভাবে বলেন, “হ্যাঁ একটু দেরী হয়ে গেছে “
তৃতীয় নালিশ গত মাসে করেছেন, হাইওয়ে অথোরিটি অব ইন্ডিয়ার নামে, কোন টোল স্টেশনে নাকি লোক নেওয়া হয়েছে, ওনাকে কেন নেওয়া হয়নি। জিজ্ঞাসা করি, আপনি আবেদন করেছিলেন? একই ভাবে জবাব আসে, “আমাকে জানানো হয়নি।” আমি শান্তনুর দিকে তাকাই, শান্তনু আমার দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকায়। গলা ঝেড়ে বলি দেখুন, তৃতীয় নালিশ তো সদ্য করেছেন, ওটা ছাড়ুন, বাকি দুটো নিয়ে আমাদের অফিস থেকে আদৌ কোন ফোন গিয়েছিল কি না আমরা জানি না। কারণ দুটোর কোনটাই আমাদের অধিকৃত ব্যাপার নয়। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের জন্য পুলিশের কাছে যেতেই পারেন বা আদালতের শরণাপন্ন হতেই পারেন, আর ডিএম সাহেবের ব্যাপারটা নিয়ে একটু ওনার করণেই কথা বললে ভালো হয়। এই তো উল্টো দিকেই ওনার আপিস- ।”
“আচ্ছা আপনাদের কাছে দিদির নম্বর আছে?” কথার মাঝেই আচমকা বলে ওঠে লোকটা। থতমত খেয়ে খানিক ক্ষণ শান্তনুর দিকে তাকিয়ে থাকি আমি। শান্তনুর মুখভঙ্গি দেখে বুঝতে পারি, এই মুহূর্তে আমার মুখটা কেমন লাগছে। নিজেকে সামলে, হাসি চেপে বলি, “না দাদা। এটা নেহাৎ গরীব অফিস, এখানে অত বড় মানুষের নম্বর থাকে না।“ লোকটা বলে, “ হুঁ।“ কেউ দিতে চায় না ওনার নম্বর। আমি কালীঘাটেও গেছি। বেশ কয়েকবার। ওরা কেবল বলে আপনার নালিশ আমরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়ে দিয়েছি। বললাম, দিদির নম্বর দিন, আমি নিজে কথা বলব-, তো বলে, দিদি তো ব্যস্ত মানুষ। তার নম্বর দেওয়াটা কি ঠিক হবে? আপনি বাড়ি যান, আপনার নালিশ আমরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়ে-।”
হাসি চেপে বলি, আপনি দিদির নম্বর চাইতে কালীঘাট চলে গেছেন? শান্তনু করজোড়ে নমস্কারই করে ফেলে লোকটাকে। ভাগ্যে পিছনে চোখ নেই, নাহেল হেব্বি ক্ষেপে যেত লোকটা। আমার ওপরেই যা ক্ষেপে গেল,বাপরে। " কেন যাব না? আমি তো অভিষেকের আপিসেও গেছি, দিদির নম্বর চাইতে। কিন্তু -" লোকটির মুখ ভঙ্গি দেখে বুঝলাম সেখানেও তিনি অসফল। " বললাম দিদির নম্বরটা দিন, তো বলল আপনার কমপ্লেন আমরা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দেব।" কে বলল? মাননীয় সাংসদ স্বয়ং? চোখ বড়বড় করে প্রশ্ন করি আমি। লোকটি হাত নেড়ে বলে, "নাঃ, নাঃ। তিনি নন। তাঁর আপিসের লোক।"
লোকটি কি যেন ভাবতে থাকে। চোখের ইশারা করি, শান্তনু এগিয়ে এসে গায়ে হাত দিয়ে বলে, " দাদা, চলুন। ম্যাডামের অন্য কাজ আছে।" লোকটি কি যেন ভেবে উঠেও পড়ে, তারপর হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে, ঘুরে প্রশ্ন করে, " আচ্ছা মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে ফোন করলেই এই যে ছেলে মেয়েগুলো ধরে, এদের বেতন কে দেয়? সরকার?" কি বলব বুঝতে পারি না। তবে এটা বুঝি, হ্যাঁ বা না যাই বলব, সেটাই ভুল উত্তর হবে। ভদ্রলোক অবশ্য আমার উত্তরের মুখাপেক্ষী নন। নিজের মনেই বলতে থাকেন, " সরকারী পয়সায় বেতন নিবে, আর মুখ্যমন্ত্রীর নম্বর দিবে নি? ইয়ার্কি! এটা নিয়েই তো একটা নালিশ করতে হবে যা দেখি।" বলতে বলতে দরজার কাছে পৌঁছে যায় লোকটা। শান্তনু আগে ভাগেই দরজা খুলে ধরে আছে, লোকটা চৌকাঠ ডিঙাতে গিয়েও থমকে দাঁড়ায়, ঘুরে প্রশ্ন করে, " --- আচ্ছা ম্যাডাম,বলতেছি কি, আপনার বাড়িটা যেন কুথায়?" মুখ ফস্কে বেরিয়ে যায় কলকাতা। লোকটা থুতনিতে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, " কলকাতা? হুঁ। কলকাতা। কালীঘাট তো কলকাতাতেই, তাই না- "।
অনির ডাইরি ১৮ ই মার্চ, ২০২৪
#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা
“Madam amar bus accident hieche”- সাথে একটা উল্টানো বাসের ছবি। সক্কাল সক্কাল এই রকম মেসেজ পেয়ে আঁতকে উঠলাম। এমনিতেই আজ অফিস বেরোতে বেশ দেরী হয়ে গেছে, কারণ অকস্মাৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আজ থেকে তুত্তুরীর নতুন সেশন শুরু, ভোর বেলা মেয়েকে যখন স্কুলে ছাড়তে গেলাম একেবারে ঝকঝক করছিল আকাশ। ঘুম ভাঙ্গা লাল চোখে আড়মোড়া ভাঙছিলেন সূয্যি মামা। তাঁর ভরসাতেই মাথায় ডিম মেখে শ্যাম্পু করতে গেলাম, বেরিয়ে দেখি ডিমের গন্ধে উত্যক্ত আমার বরের মতোই তাঁরও মুখ কালো। জানলার বাইরেটা যেন নিকষ আঁধারে মুড়ে দিয়েছে কেউ। অতঃপর যেমন ঝড়, তেমন বৃষ্টি।
ঝড় বৃষ্টির দাপট কমতে তবে বেরিয়েছি। বড় সাহেবকে বিলম্বের সূচনা দিতে মুঠোফোন খুলেই দেখি ঐ ভয়াবহ মেসেজ আর ছবি। প্রেরক আমার এক বেবি ইন্সপেক্টর। আজ থেকে দেড়-পৌনে দুই বছর আগে যখন হঠাৎই জানতে পারলাম, যে আমি একটা নয়, দুটো নয়, তিন তিনটে আনকোরা ইন্সপেক্টর পেতে চলেছি, সেদিন থেকেই এই আপিসে ইন্সপেক্টরদের এক নতুন শ্রেণী বিন্যাস শুরু হল, ঝানু ইন্সপেক্টররা হল আমার সিনিয়র ইন্সপেক্টর, আর নবাগত গুলো আমার বেবি ইন্সপেক্টর। আদর করে প্রায়ই বলি, “আমার তিনটে বেবি।” সেই বেবিদেরই একজন আজ পথ দুর্ঘটনার শিকার।
তড়িঘড়ি ফোন করে জিজ্ঞাসা করি, “তুমি আছ কেমন?” পথ দুর্ঘটনার খবর দিয়েছে এবং বাসের ছবি তুলে পাঠিয়েছে, তার মানে ঈশ্বরের দয়ায় বড় কিছু হয়নি। অন্তত আমার মন সমানে সেই প্রবোধ দিয়ে চলে। একজন মহিলা হিসেবে, আমি এই Women's intuition এর ওপর বড় বেশি নির্ভর করি। কিন্তু আজ যেন সব হিসেব গুলিয়ে যাচ্ছে। পচা নেটওয়ার্কের সৌজন্যে লাইন পেতে খানিক বিলম্ব হল বটে, বার তিনেকের চেষ্টায় ফোনটা বেজে উঠল। ওপাশ থেকে ভেসে এল চূড়ান্ত নার্ভাস কণ্ঠস্বর, “ম্যাডাম আমার বাস অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে ম্যাডাম। মেচেদা স্টেশন থেকে হলদিয়া-মেচেদা বাস ধরেছিলাম, এত জোরে যাচ্ছিল বাসটা, আচমকা ডিভাইডারে ধাক্কা মেরে আমার চোখের সামনে উল্টে গেল ম্যাডাম।” বুঝতে পারছি, ছেলেটা তার তুখোড় ম্যাডামের কাছে আশ্রয় চাইছে। কিন্তু আজ যে আমার নিজেরই হাত পা কাঁপছে, আমি ওকে কি করে সামলাই?
গলা যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক রেখে বললাম, “আগে বলো কেমন আছ?” জবাব এল “ভালো আছি ম্যাডাম।” বলে ফেলার সাথে সাথেই ফিরে এল নার্ভাস কণ্ঠস্বর, “আমি বসে ছিলাম ম্যাডাম, আমার চোখের সামনে বাসটা উল্টে গেল ম্যাডাম। লোকজন আছড়ে পড়ল আমার ওপর। এমনিতেই প্রচণ্ড ভিড় ছিল বাসটাতে। কত জনের মাথা ফেটে গেল। আমার পাশের ভদ্রমহিলার হাতটা ভেঙ্গে বেঁকে ঝুলতে লাগল। উনি কি রকম বোকার মত আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, 'আমার হাতটা ভেঙ্গে গেছে দেখুন।' সে কি দৃশ্য ম্যাডাম! আমার জামায় এখনও রক্তের দাগ লেগে আছে ছাপকা ছাপকা।”
মাঝ পথে থামিয়ে জানতে চাই, “তুই কেমন আছিস বাবা?” জবাব আসে, “বুকে পিঠে প্রচণ্ড যন্ত্রণা ম্যাডাম। ঐ অবস্থায় সকলে বাঁচার জন্য হুড়োহুড়ি করছে, একে অপরকে ঠেলে, জানলার কাঁচ ভেঙে নামার চেষ্টা করছে, ঐ করতে গিয়ে কতজন যে আমায় মাড়িয়ে চলে গেল ম্যাডাম-।” আবার থামিয়ে দিই ছেলেটাকে, এখন কোথায় আছ? জবাব আসে, “আমার তেমন লাগেনি তো ম্যাডাম, মানে মাথা টাথা ফাটেনি বা কোথাও ভাঙে টাঙেনি বলে আমায় আর অ্যাম্বুলেন্সে তোলেনি, আমি একজন পুলিশের গাড়ি করে হাসপাতালে যাচ্ছি। উনি ছুটি থেকে ফিরছিলেন, আমার অবস্থা দেখে বললেন হাসপাতালে নামিয়ে দেবেন।”
জিজ্ঞেস করি, কোন হাসপাতাল? জবাব এলে বুঝতে পারি, তার সামনে দিয়েই অফিস যাব আমি। বলি, “ঠিক আছে, তুমি যাও। আমি আসছি। আরও আধেক ঘণ্টা লাগবে আমার। ভয় পেও না। কোন দরকার হলে নির্দ্বিধায় ফোন করো।”
চণ্ডীপুর ফ্লাইওভার থেকে নেমে, সোজা যে রাস্তাটা নন্দকুমার যাচ্ছে, তার বাঁ হাতে বড় বড় করে লেখা হাসপাতালের নাম। মস্ত গেট, গাড়ি গলে বটে, কিন্তু বেশি দূর যেতে পারে না। গাড়ি থেকে নেমে কয়েক পা এগোলেই ডান হাতে টালির চালার নীচে বসে আছেন অনেক মানুষ। পাশের কাঁচের দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, ভিতরে দৌড়দৌড়ি করছে উর্দি পরা একদল নারী পুরুষ। সর্বত্র চূড়ান্ত ব্যস্ততার ছাপ। কি করি, কোথা যাই ভাবতে ভাবতে ফোন করি ছেলেটিকে। ওপাশ থেকে ভেসে আসে অচেনা পুরুষ কণ্ঠস্বর, “নমস্কার ম্যাডাম, আমি স্বপন, এসএলও। স্যার ভালো আছেন।” বলতে বলতেই ফোনটা কেড়ে নেয় ছেলেটি, “ম্যাডাম, হ্যালো ম্যাডাম। আমি ভালো আছি, আমায় তিনটে ইঞ্জেকশন দিয়েছে। ব্যথা একটু কম। এবার এক্সরে করতে যাব।”
জানাই আমি এসেছি। স্বপন বাবু সাত তাড়াতাড়ি জানান, “আপনি দাঁড়ান ম্যাডাম, আমি আপনাকে নিয়ে আসতেছি।” দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি। পাঁচ- দশ- পনেরো মিনিট কেটে গেল। গ্রুপ থেকে খুঁজে খুঁজে স্বপন বাবুর নম্বর যোগাড় করে ফোন করেই যাচ্ছি, ধরেনও না, আসেনও না। বেবি ইন্সপেক্টরটাকে ফোন করছি, তার ফোন ও নিরুত্তর। কি হল রে বাবা? হৃদপিণ্ডটা গলার কাছে চলে আসছে উত্তেজনায়। বাঁ হাতে লেখা আছে বটে এনকয়ারি, কিন্তু সেখানে একদল রুগী ভিড় করে বসে আছে। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গাড়ির ড্রাইভার নেমে এসে এদিক ওদিক জিজ্ঞাসা করে ফিরে এসে বলে, “ম্যাডাম বলছে তিন তলায় আছে। নামটা জানতে চাইছিল, আমি তো স্যারের নাম জানিনি। বলল অবস্থা ভালো নয়।”
সে আবার কি? এই তো কথা হল। সটান ভিতরে ঢুকে গেলাম, ক্যাশ কাউন্টারে প্রচণ্ড ভিড়, তারই মধ্যে একটি মেয়েকে পাকড়াও করে জিজ্ঞাসা করলাম, “ভাই আমার অফিস স্টাফ, পথ দুর্ঘটনায় আহত হয়ে এখানে ভর্তি, ও কেমন আছে? কোথায় আছে?” মেয়েটি নাম জেনে অনেক খুঁজেও কিছু বলতে পারল না। আরেকজনের কাছে পাঠাল। তিনিও সহায়তায় অপারগ। মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাব। আবার বলি, একটু আগেই হয়েছে অ্যাকসিডেন্টটা। পুলিশ নিয়ে এসেছে ছেলেটাকে। চেহারার বিবরণও দিই। খাতাপত্র ঘেঁটে মেয়েটি বলে, পথদুর্ঘটনাগ্রস্ত একজন ভর্তি হয়েছে বটে, তবে প্রথমতঃ তার নাম অন্য আর দ্বিতীয়তঃ তিনি গতকাল রাত্রে ভর্তি হয়েছেন।
ধড়ে যেন প্রাণ আসে কয়েক মুহূর্তের জন্য। পরক্ষণেই মনে পড়ে যায়, তাহলে ছেলেটা গেল কোথায়? মেয়েটা সহানুভূতির সুরে বলে, "এমারজেন্সিতে একবার দেখুন-।"
আমার আগে ড্রাইভার দৌড়ায় এমারজেন্সিতে। সেখানেও নেই ছেলেটা। আমাদের দৌড়দৌড়ি দেখে এগিয়ে আসে আরেকটি উর্দি পরা ছেলে, “কি ব্যাপার বলুন তো?” খুলে বলি সবটা। ছেলেটা শুনে বলে, “ও হাসপাতাল, সেটা তো সরকারী। এটা বেসরকারি। নামটা এক বলে অনেকে ভুল করে। আপনারা এগিয়ে এসেছেন, পিছিয়ে যান খানিকটা, চণ্ডীপুর ব্রিজের নীচে দিয়ে বাঁহাতি যে রাস্তাটা নন্দীগ্রামের দিকে বেঁকে গেছে, ঐ পথে কয়েক কিলোমিটার গেলে এ্যাড়াশোল উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র। ঐ খানে দেখতে পারেন।”
প্রায় আড়াই বছর আছি এই জেলায়, প্রথম পা রাখলাম এই পথে। সবটাই অচেনা। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করতে করতে অবশেষে গিয়ে পৌঁছালাম বিশাল সাদা প্রাচীর ঘেরা হাসপাতালে। এবারে আর ফোন করতে হল না, গাড়ি ঢুকতেই ছুটে এলেন এসএলও স্বপন বাবু আর বিশ্বজিত বাবু। ওনাদের অনুসরণ করে একটা একতলা বড় ঘরে ঢুকে দেখি থিকথিক করছে মানুষ। ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। আমার ইন্সপেক্টরটিও সেই ভিড়ে মিশে কি যেন জিজ্ঞাসা করছে। হাতে প্রেসক্রিপশনের একটা কাগজ, মুখটা ফুলে ফুটবলের মত হয়ে গেছে। গিয়ে গায়ে হাত দিতেই আবার সেই এক কথা বলতে শুরু করল, “আমি বসে ছিলাম ম্যাডাম, আমার চোখের সামনে বাসটা উল্টে গেল ম্যাডাম। লোকজন আমাকে মাড়িয়ে চলে গেল ম্যাডাম-।” মাতৃসুলভ আদরের স্বরে বললাম, “ ডাক্তার কি বলল? এক্সরে রিপোর্ট পেলে?” জাবাব দিল, “না ম্যাডাম, বলেছে মোবাইলে পাঠিয়ে দেবে। তবে বলেছে কিছু ভাঙ্গেনি।”
বলি, বেশ এবার আমার সাথে অফিস চল। কাউকে দিয়ে ওষুধ গুলো আনিয়ে নিচ্ছি, আগে কিছু খাবে, তারপর ওষুধ খাবে। তারপর খানিক ক্ষণ চুপ করে শুয়ে থাকবে। তারপর গাড়ি করে যতটা সম্ভব বাড়ির কাছে পৌঁছে দেব। বাধ্য ছেলের মত আমার পাশে পাশে গাড়ি অবধি আসে ছেলেটা। প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে ব্যাগে রাখি আমি, হারিয়ে ফেলে যদি। গাড়িতে বসতে বসতে ছেলেটা বলে," বাড়িতে কিছু বলিনি ম্যাডাম। শুধু আপনাকে/ আপনাদের বলেছি। বললেই সবাই কাঁদবে, ছুটে আসবে। উফ আমার এত বছরের জীবনে এই অভিজ্ঞতা কখনও হয়নি, ম্যাডাম। বাসটা যখন উল্টে পড়ল, এক ঝলক চোখের সামনে বাবা মা আর বউয়ের মুখটা ভেসে উঠল-।"
ভিতর ভিতর কাঁপুনি ধরছে আমার বুঝতে পারি। বুঝতে পারি ছেলেটা ট্রমায় ভুগছে। কথা ঘোরাতে ড্রাইভারকে বলি একটা ওষুধের দোকান দেখে দাঁড় করাতে, ছেলেটা হুঁশ ফিরে পেয়ে, রক্ত লাগা টি শার্টের বুক পকেট থেকে এক মুঠো ওষুধ বার করে, “ওষুধ দিয়েছে ম্যাডাম। এই যে এটা খালি পেটে, এটা কিছু খেয়ে আর এই গুলো রাতের বেলা।”
বাচ্ছাদের মত ওষুধ গোনে ছেলেটা। ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করে বলি, "খালি পেটেরটা আগে খাও। আর তোমাকে ওষুধও দিল? কি ভালো হাসপাতাল রে!" ছেলেটা বলে," বিডিও সাহেবকে ফোন করেছিলাম, উনি বিএমওএইচ সাহেবকে বলে দিয়েছিলেন।" হেসে বলি, বিডিও সাহেব তোমার জন্য এতটা করেছেন, তাঁকে জানাও অন্তত যে ভালো আছো।
থতমত খেয়ে, জিভ কেটে ফোন করে ছেলেটা। বলে, “ স্যার, আমি ভালো আছি স্যার। জেএলসি ম্যাডাম নিজে এসেছেন আমায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।” ওদিক থেকে ভেসে আসে কিছু কথা, ফোন রেখে ছেলেটি বলে, “ম্যাডাম বিডিও স্যার বললেন একবার দেখা করে যেতে।” বিডিও অফিসের অপরিসর রাস্তায় ঢোকে গাড়িটা, এই অফিসে আমি আগেও এসেছি। বিডিও সাহেব বসেন দোতলায়। ছেলেটি কি উঠতে পারবে? যদি পারেও, তাহলেও আমি একা ছাড়ব না। অনাহূত হলেও যাব ওর সঙ্গে সঙ্গে।
তার অবশ্য দরকার হল না, বিডিও সাহেব নিজেই নেমে এলেন আইএমডব্লিউকে দেখতে। ছেলেটি আবার এক কথা বলতে থাকে, কি ভাবে অ্যাকসিডেন্ট হল ইত্যাদি। বলে, " কার মুখ দেখে যে আজ উঠেছিলাম স্যার-"। মাঝ পথে কথা থামিয়ে মজার সুরে বিডিও সাহেব বলেন, “ যার মুখ দেখে উঠেছ,রোজ তার মুখ দেখে উঠবে। তার জন্যই এত বড় দুর্ঘটনা থেকে প্রাণে বেঁচে গেছ। ডাক্তার তিন দিন রেস্ট বলেছে, তুমি সাত দিন নাও। তারপর ফিরে এসো সুস্থ হয়ে, তোমাকে ছাড়া ইলেকশন হয় নাকি?” কে বলে প্রশাসন অমানবিক।
গাড়ি গড়ায় অফিসের দিকে, হন্তদন্ত হয়ে ফোন করে বড় সাহেব, “আরে দূর, এমন একটা মিটিং এ ফেঁসে ছিলাম, এই দেখছি তোমার মেসেজ। কেমন আছে ছেলেটা?” নন্দকুমার মোড় থেকে নিমতৌড়ির দিকে বেঁকে যায় আমাদের গাড়ি, অন্য মনস্ক হয়ে মাথা থেকে একটা একটা করে কাঁচের টুকরো বার করতে থাকে ছেলেটা। অফিসের গ্রুপে লিখতে থাকি, সবাই অ্যাটেনশন, আমার বেবি ইন্সপেক্টরকে সঙ্গে নিয়েই ফিরছি আমি। কেউ ওর জন্য বরফের যোগাড় করো, কেউ গরম চা বানিয়ে রাখো, বেশি করে চিনি দিয়ে। ব্যাটার নার্ভ গুলোকে একটু চাঙ্গা করা দরকার। কেউ ক্যান্টিন থেকে কিছু খাবারদাবার নিয়ে এসো। লাটসাহেব যাতে ভরা পেটের ওষুধটা খেতে পারে। আর বাকিরা রেডি হয়ে যাও ওর মাথা বাছার আর গল্প শোনার জন্য, এক মাথা কাঁচের গুঁড়ো আর ট্রমা নিয়ে ফিরছে ছেলেটা। দুটোই বার করতে হবে মাথা থেকে।
অনির ডাইরি ১৪ই মার্চ, ২০২৪
#অনিরডাইরি #International_Day_of_Action_for_Rivers #আন্তর্জাতিক_নদী_কৃত্য_দিবস
আজ বুঝি আন্তর্জাতিক নদী কৃত্য দিবস। সক্কাল সক্কাল ঘুম ভাঙ্গিয়ে ফরমাইশ করলেন জনৈক গ্রুপের মাননীয় অনুশাসক মহোদয়, নদী নিয়ে কিছু লিখতে হবে। লিখতেই হবে। মুস্কিল হল, ফরমাইশি লেখা একদম লিখতে পারি না যে। মন ধায় একদিকে, আর আঙ্গুলের গতি, সম্পূর্ণ অন্য দিকে।
এমনটিতে নদীর সাথে আমার সম্পর্ক চিরন্তন। এক নদীর ধারেই তো জন্ম আমার। উত্তরবঙ্গের সীমানা ঘেঁষা ঘন সবুজ এক গাঁয়ের যে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আমি জন্মেছিলাম, সেখান থেকে ঢিল ছুঁড়লেই নদী। “-বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে” মার্কা অর্বাচীন নদী নয়, রীতিমত অকুল দরিয়া বুঝলেন। বয়স নেহাৎ কম হল না, এখনও ফি বছর আমার জন্মদিনের আগের রাতে গল্প শোনায় বাবা, সেই নদী পারাপারের গল্প।
সে বছর শীত পড়েছিল জম্পেশ। নির্দিষ্ট সময়ের সপ্তাহ তিনেক আগেই পিত্রালয়ে পাড়ি দিয়েছিল মা, একাকী। সেই যাত্রায় মাকে সঙ্গ দেবার সাধ থাকলেও সাধ্য বাবার ছিল না। শহুরে ডাক্তারের নিদান মোতাবেক যে রবিবার আমার ভূমিষ্ঠ হবার কথা, ঠিক তার আগের দিন অফিস সেরে, যৌথ পরিবারের সপ্তাহ ভরের রেশন তুলে, বাজার করে দিয়ে রাত এগারোটার ট্রেন ধরল বাবা। কয়লার ইঞ্জিন, ধিকিধিকি করতে করতে উদ্দিষ্ট স্টেশনে গিয়ে যখন পৌঁছাল, ঘড়িতে রাত আড়াইটে-পৌনে তিনটে।
স্টেশন থেকে পাক্কা দশ কিমি গেলে তবে পড়ে নদী। নদীর ওপাড়ে মা, হয়তো বা আমিও। আশায় আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেল এক হবু পিতার হৃদয়।
ছোট্ট স্টেশন, ট্রেন চলে যেতেই পলকে নিশুতি। শীতের কামড় ও যেন বেড়ে গেল বহুগুণ। ব্যাগ থেকে পাঁচ সেলের মস্ত টর্চটা বার করে বাবা। স্টেশনের বাইরে থেকেই বাস ছাড়ে, এত রাতে বাসের কঙ্কালটুকু পড়ে আছে কেবল। ফার্স্ট বাস সেই ভোর পাঁচটায়। নিকষ আঁধারের বুক চিরে টর্চের আলো ফেলে হাঁটতে থাকে বাবা।
হাঁটতে হাঁটতে নদীর কুলে যখন এসে পৌঁছায়, কালো কম্বল মুড়ি দিয়ে তখনও ঘুমাচ্ছে নদী। চতুর্দিক জনশূন্য। কাকেরাও নিশ্চুপে সেরে নিচ্ছে রাতের শেষ ঘুমটুকু। নদীর এপারে নেই কোন জনবসতি। পারাপারের প্রথম নাও আসবে ওপার থেকে। তাও সকাল পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটার আগে নয়। তার মানে আরও একটা ঘণ্টা কাটাতে হবে নদীর পারে বসেই। একটা পরিত্যক্ত নৌকার গায়ে ঠেস দিয়ে সিগারেট ধরায় বাবা, নদীর বিস্তৃত কুল বরাবর বহু দূরে কোথাও বুঝি ঝুপ করে জ্বলে ওঠে কোন চিতা। এক ঝলক পোড়া গন্ধ বয়ে আনে নদীর সজল শীতল বাতাস। সামান্য ভয় পায় কি বাবা? পেলেও মানতে রাজি নয় শহুরে জেদি হৃদয়।
শীতল বাতাস এবং পোড়া গন্ধের যুগপৎ আক্রমণ থেকে বাঁচতে, “বোট ঘরে” আশ্রয় নেয় বাবা। ঢালু পাড়ের সব থেকে উঁচু অংশে, একটা একতলা পাকা ঘর। যার না আছে দরজা, না জানলা। সময় অসময়ে নৌকা গুলিকে ওখানে রাখা হয় বলেই অমন নাম। বাইরের থেকেও ভিতরটা যেন আরও কয়েকগুণ বেশি ঠাণ্ডা। নতুন করে সিগারেট ধরায় বাবা। ফস করে দেশলাই জ্বালাতেই কে যেন কেশে ওঠে খকখক করে, চমকে সেদিকে তাকায় বাবা। কোণার জমাট আঁধার কি নড়ে ওঠে সামান্য? এমতবস্থায় টর্চ জ্বালবে কি জ্বালবে না দোনামনা করতে করতেই, কথা বলে ওঠে জমাট বাঁধা অন্ধকারটা, “ কে জামাই নাকি?”
কিঞ্চিৎ ঘড়ঘড়ে অচেনা গলা। এই সব ছোট গ্রামে এমনিই সবাই, সবাইকে চেনে। আর সেযুগে গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় এসে মায়ের চাকরি করা আর বাবা মায়ের অসবর্ণ বিবাহ ঐ ক্ষুদ্র পল্লীসমাজে ছোটখাট একটা আণবিক বোমা বিস্ফোরণের থেকে কম কিছু ছিল না। ফলে আসেপাশের তিনটে গাঁয়ের লোক বাবাকে চিনত। তাদেরই কেউ হয়তো রয়ে গেছে এপাশে, মনে করে সাড়া দেয় বাবা। জমাট অন্ধকারটা এগিয়ে আসে পায়ে পায়ে, “কি জামাই চিনতে পারছ না? আমি নিবারণ গো, সেই যে শীলুর সাথে পড়তাম।” মায়ের ডাক নামটা শুনেও ঠিক ঠাওর করতে পারে না বাবা। ঘাড় নাড়ে আন্দাজে। দলা পাকানো অন্ধকারটা জানতে চায়, “ওপাড়ে যাবা নাকি?” “চল, তোমায় নে যাই” বলে তড়বড় করে ঢালু পথ ধরে নদীর কাছে নেমে যায় মাঝি। বাইরের ঝাপসা অন্ধকারে বাবা দেখে এক নাতি দীর্ঘ মানুষ, মাথা জোড়া টাক। ঐ শীতেও পরনে লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি, তার ওপর আলগোছে একটা চাদর জড়ানো। পাড় থেকে একটা নৌকাকে ঠেলে জলে নামিয়ে চড়ে বসে নিবারণ। হাঁক পাড়ে, “কই গো জামাই? এসো গো।” কাঁধের ব্যাগ আর বড় টর্চটা নিয়ে চেপে বসে বাবাও।
নৌকা ছাড়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে দুম করে উদয় হয় আরেক আগন্তুক। “ওপাড়ে যাও নাকি?” প্রশ্নকর্তার পরনে খাটো ধুতি, ধুতির নীচে এক জোড়া ধুলিমলিন পা। এত বড় পা বাবা ইতি পূর্বে দেখেনি, অবশ্য লোকটিও বিশাল লম্বা। তবে কৃশকায়। সম্ভবত ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। ঐ অন্ধকারে মুখ চোখ কিছুই দেখা যায় না। একটা সস্তার চাদরে মাথা মুড়ি দিয়ে নৌকায় উঠে বসে। নিবারণ একাই বকে যায় নৌকা বাইতে বাইতে, হযবরল গল্প শোনায়। যার কিছুটা বাবা শোনে, কিছুটা শোনে না। কিছু বোঝে, কিছু বোঝে না। নৌকা যখন মাঝ নদীতে আচমকা লক্ষ্য করে বাবা, যে নৌকার তলা দিয়ে প্রবল বেগে জল উঠে আসছে বুড়বুড়ি কেটে।
কিছু নৌকায় যে এমন হয় না তা নয়, তাই এখানে সব নৌকাতেই বালতি মগ রাখা থাকে, জলটা চেঁছে ফেলার জন্য। ঐ অন্ধকারে বালতি মগ ঠাওর করতে পারে না বাবা।
পরিস্থিতি দেখে মাঝির দৃষ্টি আকর্ষণ করে বাবা,জবাবে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে মাঝি। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে নিবারণ মাঝি। “কি আর হইবে জাম্বু, চিন্তা ছাড়েন। সেবারও তো এমনই হয়েছিল মাঝ নদীতে। ভালো মানষি করে পার করাতে গেলাম, মাঝ নদীতে কি যে হল---। জলের ভারে নৌকা গেল উলিটে। সোয়ারি গুলো তো সাঁতরে পলাইল, আমি গ্যালাম ফেঁসে। উল্টানো নৌকার নীচে আটকে গ্যাছিলাম কি না।”
শুনে তো বাবার আত্মারাম খাঁচাছাড়া। কি করবে এই মাঝ নদীতে? এমন সময় এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটল, নৌকার অন্য সহযাত্রীটি “দুঃশালা” বলে সটান উঠে দাঁড়াল নৌকার ওপর, অতঃপর যুগপৎ নিবারণ মাঝি এবং আমার বাবাকে আশ্চর্যচকিত করে নৌকা থেকে লাফিয়ে নামল নদীতে, এবং বাকি পথ থুড়ি নদীটুকু গট গট করে হেঁটে ওপাড়ের আশ্যাওড়া গাছের জঙ্গলে মিলিয়ে গেল।
কতবার যে শুনেছি গল্পটা আর ইয়ত্তা নেই। প্রায় ছাব্বিশ বছর হল চলে গেছে দিদা, গ্রামের সাথেও আর নেই কোন সম্পর্ক। শুনি আজকাল রাক্ষুসী হয়ে গেছে সেদিনের সেই রহস্যময়ী নদী। গোগ্রাসে গিলে ফেলছে গ্রামটাকে। কে জানে কিসের এত ক্ষোভ তার। তবু বড় মন কেমন করে আমার মেয়েবেলার সেই নদীটার জন্য। ভালো থাক নদী, ভালো থাকুক, বেঁচে থাকুক পৃথিবীর সব নদীরা।নদীর বুকেই যে লুকিয়ে আছে মানব সভ্যতার প্রাণভ্রমরা।
পুনশ্চঃ- নিবারণ নামে মায়ের সত্যিই এক সহপাঠী ছিলেন আর ভৌতিক মাঝি বনাম অদ্ভুতুড়ে সহযাত্রীর গল্পটা এক বিখ্যাত সাহিত্যিকের রচনা দ্বারা অনুপ্রাণিত। তিনিও আদতে আমার মায়ের জিলারই বাসিন্দা। সাকিন – খোসবাসপুর। বলুন তো কে?
অনির ডাইরি ৯ই মার্চ, ২০২৪
#অনিরডাইরি #হাওড়ার_কথা
অকাতরে ঘুমাচ্ছিলাম, আচমকা কার যেন উষ্ণ স্পর্শে ভেঙে গেল ঘুমটা। নাইট ল্যাম্পের নীলাভ আলোয়, যতটা দৃশ্যমান, তার থেকে বেশি অদৃশ্য। এক রাশ ঝাঁকড়া চুলের একটা মাথা ঝুঁকে আছে আমার ওপর, উষ্ণ এক জোড়া কচি ঠোঁট ফিসফিসিয়ে উঠল, " মা! মা! আচ্ছা, কাল কি মামমামের জন্মদিন?"
সেই কোন সকালে বেরিয়েছি কাঁথি থেকে, বার্ষিক পরীক্ষা শেষে এক সপ্তাহের ধরে মাতুলালয় গুলজার করছেন শ্রীমতী তুত্তুরী, এবার তার পিতৃগৃহে প্রত্যাবর্তনের পালা। সারা দিন অফিস করে যখন হাওড়া পৌছালাম তীব্র জঠর জ্বালা আর দুঃসহ ক্লানিতে রীতিমত অবসন্ন। কোন মতে দুটো নাকে মুখে গুঁজে মেয়েকে জবরদস্তি জড়িয়ে সেই যে শুয়েছি, এই ঘুম ভাঙল। ঘুমানোর আগে এক প্রস্থ ঝগড়া করতে অবশ্য ভুলিনি মায়ের সাথে। ঘড়িতে মধ্য রাত সবে পেরিয়েছে, বাইরে থেকে এখনও ভেসে আসছে মায়ের কণ্ঠের অগ্নিবর্ষণ। সব কিছু থেকে আমাকে ত্যাজ্য করার ঘোষণা ভেসে আসছে, পিতামাতার প্রতি যাবতীয় দায়িত্ব থেকে আমাকে মুক্ত করা হচ্ছে, হুমকি দেওয়া হচ্ছে বাবাকে, যদি আমার সাথে কোন রকম সম্পর্ক রাখার গুস্তাফি করে, তাহলে তা মাফ করা হবে না। এমনকি আমার পক্ষ নেবার অপরাধে তুত্তুরীকেও যেন কিসব বলা হচ্ছে। ওগুলো এবাড়ির নিত্য কীর্তন। আমি আসব আর মায়ের সাথে একপ্রস্থ খটাখটি লাগবে না, তা আবার হয়?
সবকিছু ছাপিয়ে এক তীব্র লজ্জার আস্তরণ পলকে ঘিরে ফেলল আমায়। ছি ছি, এত বড় ভুল আমার হল কি করে? অনেক রাত অবধি জেগে এবং ভেবে কোন কুল পেলাম না। নিজের জন্মদিন সম্পর্কে মা যখন বলত, "ভূতের আবার জন্মবার" কত রাগ করতাম আমি, আর এবার আমিই বেমালুম ভুলে গেলাম। পরদিন সকালে অবশ্য মা প্রশান্তির প্রতিমূর্তি। কাল প্রতিজ্ঞা করেছিল আমার হাতে কিছু খাবে না, আজ চা বানিয়ে দিলাম, দিব্য খেল। জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর সাহস অবশ্য হলনি। ঘুমন্ত ভিসুভিয়াসকে না জাগানোই ভালো।
এক রাশ কাজ নিয়ে এসেছি, বাবার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের KYC, মায়ের পোস্ট অফিসের পাশবই আপডেট, পেনশন সংক্রান্ত কিছু জটিলতা নিয়ে তত্ত্বতালাশ ইত্যাদি প্রভৃতি। জলখাবার খেয়ে বেরিয়েছিলাম, কাজ সেরে ফিরতে ফিরতে বেলা দুটো। কদমতলা বাজারে দেখি কি দারুণ আনারস বিক্রি হচ্ছে, বিক্রেতা বলেই দিল, " কাঁচা খেতে পারবেন না দিদি। চাটনি বানিয়ে খেতে হবে।" তাই কিনে আনলাম একটা মায়ের জন্য। বড় ভালোবাসে খেতে। বাড়ি ঢোকার মুখে বন্ধ হতে বসা পাড়ার দোকানে কপাল ঠুকে পেয়ে গেলাম কয়েক প্যাকেট দুধ ও। আমাদের এই মধ্যবিত্ত সাবেকি বাঙালি পাড়ায় অসময়ে দুধ পাওয়া প্রায় লটারি পাবার সামিল।
মায়ের হাতে যখন আনারস আর দুধ ধরিয়ে জানতে চাইলাম, খুশি হয়েছে কি না। মা কান এঁটো করে হেসে জানাল আনারস পেয়ে ভীষণ খুশি। বললাম ফিরে এসে পায়েস বানাব, আমার হাতের পায়েস খেতে বড় ভালোবাসে মা। পায়েস বানানোর কথা শুনেও কোন সন্দেহ হল না মায়ের। কারণ মা জানেই না মায়ের জন্মদিন কবে। অফিসের খাতায় ৩০ শে জানুয়ারি, কারণ ইস্কুলে ভর্তি করার সময় ওটাই বলা হয়েছিল। বিয়ের পর মাতামহের খেরোর খাতা ঘেঁটে বাবা আবিষ্কার করেছিল আসলে মার্চ মাসে জন্ম আমার মায়ের। শুধু মা নয়, মাসিদের ক্ষেত্রেও বয়স ধরে গড়ে অমন মন গড়া জন্মতারিখ বসানো হয়েছিল, স্কুলে ভর্তি করার সময়। ফলে আমার মা মাসিরা নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগে অবসর গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।
দুপুরের ভাত খেয়ে আবার বেরোলাম, সদ্য অবসর নেওয়া জনৈক বৃদ্ধ বড়দার সাথে সাক্ষাৎ করতে। বার বার ফোন করেই যাচ্ছে বৃদ্ধ, প্রলোভন দেখিয়ে যাচ্ছেন ডেকার্টস্ লেনের সুরুচির ফিশ রোল খাওয়ানোর। এ আহ্বানে সাড়া না দেবার মত মনের জোর আমার নেই বাপু। বেরোনোর আগে ফিসফিসিয়ে তুত্তুরী বলল, " মা বড় মামাকে বলেছি আজ মামমামের জন্মদিন। মা নিশ্চয়ই কিছু করছে।" কি যে করছি আমি নিজেই জানি না, অথচ আমার কন্যা সাক্ষাৎ অল ইন্ডিয়া রেডিও। তিনি শুধু বড় মামাকে বলেছেন তাই না, বড় মামী, ছোট মামা, বুল্লু দাদা মায় আমার পিসিকেও বলে বসে আছেন। খুড়তুতো ভাইগুলোও তেমন, একগাল হেসে, ষড়যন্ত্রের সুরে জানতে চাইল, "তাহলে ও বেলা আমরা কি করছি?"
কি যে করি, ভাবতে ভাবতে ধর্মতলা পৌঁছে গেলাম। কোন রাজনৈতিক দলের সভার জন্য প্রায় অবরুদ্ধ ধর্মতলা, আড্ডা শেষে বাস পেতে যা হাঁটতে হল, আরেকটু হাঁটলে হাওড়া ব্রিজ পেরিয়ে যেতাম বোধহয়। যখন হাওড়া ময়দানে নামলাম খেয়াল হল আজ বৃহস্পতিবার। ময়দান মার্কেট পুরো বন্ধ। কি যে দিই ভদ্রমহিলাকে, ধুৎ। খালি হাতে বাড়ি ফিরছি যখন, সন্ধ্যা ঘনাচ্ছে। পাড়ার দোকানে দেখি গরম গরম জিলিপি ভাজছে। তাই কিনে নিয়ে গেলাম ভদ্রমহিলার জন্য। এত অল্পতে কেন যে এত খুশি হয়ে যান ভদ্রমহিলা। কোন যুগে ছেড়ে এসেছেন মুর্শিদাবাদ জিলা আর তার নিটোল গ্রাম্য জীবন, তাও মেলায়নি মনের সহজিয়া সুরটা।
বললাম বসো মা, তোমার মুখটা একটু পরিষ্কার করে দিই। জীবনে কত বার ফেসিয়াল করেছে মা, কর গুণে বলা যায়। মায়ের কাছে ওসব অকারণ বিলাসিতা এবং অযথা সময় নষ্ট। প্লাস্টিকের চেয়ারে বসিয়ে ডবল ক্লিন করে, স্ক্রাব করে, গরম জলে ভেজানো তোয়ালে চেপে ধরছি যখন মায়ের মুখে, মা ততক্ষণে "ঘন্টা খানেক সঙ্গে সুমন"। গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছে সদ্য পদত্যাগ করে রাজনীতিতে প্রবেশ করা এক মানুষের কথা। "উহুহু আমার মুখটাই পুড়িয়ে দিলে গো" বলতে বলতেও টিভির পর্দা থেকে চোখ সরায় না মা, সুমনের আকর্ষণ এমনই তীব্র। "যত্ত বাজে কথা" বলে আরো চেপে ধরি আমি।
মুখে জলজ স্প্রে করার পর, টিভিটা গার্ড করে দাঁড়িয়ে ভালো করে ঝাঁকিয়ে দিই মাথাটা, কি ছিটালাম বলো তো? ভালো করে শুঁকে টুকে বলে, "গোলাপ জল নাকি?" সাত বার স্প্রে করার দরকার ছিল, তৃতীয় বারেই মা এমন হাঁচতে আর কাশতে লাগল, ক্ষ্যামা দিলাম। "তোর জ্বালায় আমার বুকে পিঠে সর্দি বসে যাবে এবার।" হড়হড়ে একটা জিনিস মুখে লাগাতে লাগাতে বলি, এটা কি বলো তো? শামুকের লালা। ওয়াক তুলে মা বলে, "কোথা থেকে পাস এসব?" এবার শিট মাস্কের পালা, পাক্কা বিশ মিনিট পর, মুখ মুছে ক্রিম লাগিয়ে বললাম, এবার একটা ভালো শাড়ি পরো।
মুখ ঝামটা দেয় মা। "তোর বাপ কি পরে আছে দেখেছিস? ওর পাশে আমি কি পটের বিবি সাজব?" সত্যি মাইরি, একটা নীল লুঙ্গি আর নীলচে পোলো নেক টি শার্ট পরে মনের আনন্দে খেরোর খাতা লিখছে বৃদ্ধ। আজ যে বউয়ের জন্মদিন সেটাও ভুলে বসেছে। বছর বছর পাট করা নতুন জামা আলমারিতে বসে বুড়ো হয়,বাবার সেই হাতে গোনা এক জোড়া জামা। এক সেট পরে, অন্য সেটটা কাচে। বলতে গেলেই বলে, "সব অমন পরে নষ্ট করতে আছে নাকি। কত কষ্ট করে আমরা বড় হয়েছি জানো।"
আজকে ওসব সেন্টু দেবার দিন নয়, আজকে তার দিন, প্রতিনিয়ত যাকে ঘিরে আবর্তিত হয় বাবার জীবন। আলমারি হাঁটকে চকচকে একটা সেট বৃদ্ধের হাতে ধরিয়ে বলতেই হল, আজকের দিনের বিশেষত্ব। বাবাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয় মা। পোশাক বদলের পর একটা সোয়েটের টিপ পরাতে গিয়ে প্রথম সন্দিগ্ধ করে তুলি মাকে, " আমাকে এত সাজাচ্ছিস কেন?"
শৌভিক এর উপহার দেওয়া সেন্টের বোতল, খুঁজে ছড়িয়ে দিই মায়ের গায়ে। উনুনে ফুটতে থাকে ঘন ক্ষীরের মত পায়েস। ভাইয়েরা কেউ কেক নিয়ে আসে, তো কেউ রাতের খাবার। দুই নাতি নাতনী মিলে সাজায় কেকের ওপর মোমবাতি। ফোনে শুভেচ্ছা জানায় বড় মাসি, পিসিকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে মা। ফোন করে শুভেচ্ছা জানায় মায়ের জামাই, জানতে চায়, "ওষুধ গুলো ঠিক মত খাচ্ছেন তো?" আমরা তিন ভাই বোন আর তুত্তুরীরা দুই ভাইবোন সমস্বরে চিৎকার করি, " কিচ্ছু খাচ্ছে না। ওষুধ খাওয়ায় চূড়ান্ত গাফিলতি করে -"। আচমকা চিৎকারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় মা, থমকে যায় কয়েক মুহূর্ত, তারপর অশ্রু সজল চোখে, এক গাল হেসে বলে, " তোমরাই তো আমার ওষুধ বাবা। তোমরা সবাই ভালো থাকো, আমি এমনিই ভালো থাকব।"
অনির ডাইরি ৫ই মার্চ, ২০২৪
#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা
সে অনেককাল আগের কথা, জানুয়ারি মাস, সদ্য শেষ হয়েছে আমাদের শ্রমিক মেলা, মন জুড়ে তখনও মেলার সুখস্মৃতির মৌতাত। সেদিন রবিবার, আনুষ্ঠানিক ঘরকন্নার দিন। একদিকে কন্যাকে পড়তে বসিয়েছি, অন্য দিকে কন্যার পিতাকে বসিয়েছি পেঁয়াজ কাটতে। বড় গামলায় তেল মশলা মাখিয়ে জরছে দিশি মোরগ। একেবারে "সুখী গৃহকোণ, শোভে গ্রামোফোন”।
এমন সময় যা হয় আর কি, ঝনঝনিয়ে বেজে উঠল মুঠোফোন। ওপারে মাননীয় অতিরিক্ত জেলা শাসক মহোদয়। আমার দপ্তরী ফোনটা কি যেন কারণে অচল ছিল কয়েকদিন,উনি আমার ব্যক্তিগত নম্বরটা যোগাড় করে ফোন করছেন, কারণ শিরে সংক্রান্তি। মাননীয়া আসছেন।
ভদ্রলোক অল্প কথায় মানুষ, শুধু বললেন, "আপনার তো অনেক বেনিফিশিয়ারি (অর্থাৎ বিভিন্ন প্রকল্পে নথিভুক্ত শ্রমিক), দিন না কয়েকজন।" বললাম, এ আর এমন কি ব্যাপার, কত লাগবে বলুন, ২০০-৫০০-১০০০? উনি বললেন, স্টেজ বেনিফিশিয়ারি লাগবে, জনা দশেক। হয়ে যাবে, বলার পর খেয়াল হল, শুধালাম কোথায় আসছেন মাননীয়া? জবাব এল বালিঘড়ি, তারকেশ্বর। নির্মীয়মান গ্রীন ভিউ ইউনিভার্সিটির মাঠে।
কি সর্বনাশ সে তো আমার এলাকার বাইরে। চন্দননগরের বড় সাহেবের খাস তালুক। বললাম ও সে কথা, উনি শুনলে তো। " অত জানি না, আমি আপনার থেকে মাথা গুণে নেব সেদিন।" বড় সাহেবকে জানালাম তৎক্ষণাৎ, শুনে বললেন, " চন্দননগর মহকুমায় হবে তো কি হয়েছে? এটা তুমিই সামলাবে।" শুধু মৌখিক নয়, লিখিত অর্ডার করে দিলেন, সর্ব ঘটে কাঁঠালি কলা আমি। আমায় সহযোগিতা করার জন্য রাখলেন লম্বা পল্টন।
বড় সাহেবের হুকুমে আমার অবস্থা হল নবাব মীর জাফরের মত। ক্ষমতাহীন দায়িত্ব। স্যারের সামনে নীরব থাকলেও, স্যারের অসাক্ষাতে বদলে যেতে লাগল পটভূমিকা। ইগোর লড়াই হতেই পারত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর, যদি না মাননীয়ার আগমন নিকট হত। সব লড়াইয়ে জেতা যায় না, পিছিয়ে আসতে বাধ্য হলাম। নাম তো পাঠালাম দশ জনের, যার মধ্যে আটজনই আমাদের ধনিয়াখালির। তারকেশ্বরের নিকটবর্তী ব্লক।
ধনিয়াখালির ইন্সপেক্টর চঞ্চল একাই একশ। এই দশ জনকে একত্রিত করে, জেলা প্রশাসনের হাতে তুলে দেওয়া এবং অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি পৌঁছে দেবার দায়িত্ব চঞ্চলের। মাঠে শ্রম দপ্তরের স্টল ম্যানেজ করার দায়িত্ব আমার CKCO সোমনাথের। সহযোগী বলতে ধনিয়াখালির SLO অমৃতা। লম্বা লেন্স নিয়ে পোলবার SLO রমেশ রইল ছবি তোলার জন্য।
কাজ তো উঠেই যাবে, স্যারকে বললাম, বিলটা যদি দেন তো কয়েকটা টিশার্ট ছাপাই। যাদের বুকে পিঠে লেখা থাকবে দপ্তর আর প্রকল্পের নাম। শুধু যাঁরা স্টেজ উঠবেন তাঁরাই নয়, ওই একই টিশার্ট পরবে IMW চঞ্চল, CKCO সোমনাথ, আমার SLO অমৃতা, রমেশ আর তারকেশ্বরের দুই SLO। স্টেজ বেনিফিশিয়ারিদের পাখি পড়া করে শেখানো হল, ম্যাডামের হাত থেকে যখন অনুদান নেবেন, একটু তেরছা করে দাঁড়াবেন,যাতে ঠিকঠাক ছবি তুলতে পারে রমেশ।
দিনটা যে কি অবর্ণনীয় চাপের মধ্যে কেটেছিল, কেবল ভুক্তভুগীরাই জানেন। মাননীয়ার নিরাপত্তাবলয় এতটাই কঠিন যে ভাগ্যে অমৃতার বর, কৌশিক বুদ্ধি করে তারকেশ্বর থেকে খাবার আর জল কিনে নিয়ে ঢুকেছিল, নাহলে নিরম্বু উপবাসেই কাটত সারাদিন। শৌচালয় একটা ছিল বটে, দপ্তর গুলোর জন্য নির্দিষ্ট ঘেরাটোপে ঢোকার আগে সেখান থেকে ঘুরে এলে ভালো, নাহলে প্রকৃতির আহ্বান অস্বীকার করে চেপে বসে থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই। কাপড়ে-চোপড়ে যদি করেও ফেলেন তাহলেও মিলবে না বেরোবার অনুমতি। হুঁ হুঁ বাবা, এ হল সিএম সিকিউরিটি। ওই অবস্থায় নিরাপত্তা রক্ষীদের রক্তুচক্ষু দর্শন পূর্বক ন্যাজ গুটিয়ে ফিরে আসতে হবে।
তবে দিনের শেষে রমেশের তোলা ছবি গুলো যখন মুঠো ফোনে ভেসে উঠছিল, হাসি মুখের মাননীয়া, কখনও করমর্দনর করছেন তো কখনও নমস্কার। কখনও পিঠ চাপড়াচ্ছেন তো কখনও কাঁধে হাত দিয়ে নিচ্ছেন কুশল সংবাদ, উল্টো দিকে বিগলিত আমাদের শ্রমিক কুল, পিঠে জ্বলজ্বল করছে দপ্তরের নাম, আমাদের সামাজিক সুরক্ষা যোজনার নাম, পলকে দূর হয়ে গিয়েছিল সব ক্লান্তি।
সেই গল্পই শোনাচ্ছিলাম বর্তমান টিমকে, CKCO শান্তনু বলল, "আমরাও করতে পারি ম্যাডাম।আমরাও পরতে পারি স্কিমের নাম লেখা, দপ্তরের নাম লেখা টি শার্ট।" সে তো পারো, কিন্তু সময় যে বড় স্বল্প। এত জলদি সব যোগাড় হবে কি করে? হক বাবু বললেন, " একবার শুধু অনুমতি দেন, কাল কলকাতা চলে যাই, একদম কিনে, লিখে নিয়ে চলে আসব।" কিন্তু ফাণ্ড? তখন অনেক টাকা এ্যালোটমেন্ট আসত, স্যার কথা দেওয়া সত্ত্বেও টিশার্ট, টিফিন আর গাড়ির বিল ছাড়া নিয়ে ওনার অফিসেএত রকম জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল, যে মনে হত আমার বাপের বাড়ির গুষ্টির জন্য জামা ছাপিয়েছি আর টিফিন কিনেছি বোধহয়। শেষে ধুত্তোর বলে আমার অফিস থেকেই দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। আর এবার তো ভাঁড়ে মা ভবাণী।
রসদ কম তো কি, সাধ যে অসীম। পরদিন সত্যি মহানগর রওনা দিলেন হক বাবু। তার আগের রাতে এক প্রস্থ খণ্ড যুদ্ধ হল কি রঙের টি শার্ট কেনা হবে এবার তাই নিয়ে। সেবারের রং ছিল সাদা, এবার আমার আর মুকুলের পছন্দ কচি-কলাপাতা, বেদজ্যোতি এন্ড পার্টি আকাশীর পক্ষে। শেষ পর্যন্ত সংখ্যা গুরুর জয় হল। আকাশী টি শার্ট এর বুকে - পিঠে ছাপানো হল দপ্তর আর প্রকল্পের নাম।
আর ছবি তোলা? রমেশ আর রমেশের লম্বা লেন্স কোথা পাই? শান্তনু বলল, " কেন অরূপদা আছে না। ওর এই এত্ত বড় লেন্সে ঠিক ভালো ছবি উঠবে।" দেখতে দেখতে এসে গেল দিনটা, সবার আগে সক্কাল সক্কাল টিশার্ট পরে গোটা মহল্লা ঘুরেও এল শুভদীপ্ত। "রংটা এমনিতে ভালোই হয়েছে,তবে পরে নিজেকে কেমন সিভিক ভলান্টিয়ার মনে হচ্ছে ম্যাডাম।"
সাকুল্যে পাঁচ জনকে আনলেই চলবে, যাদের মধ্যে দুজন স্টেজে উঠবে, আর বাকি তিনজন রিজার্ভ থাকবে। কোলাঘাট আর তমলুক ব্লকের পঞ্চায়েত এলাকা থেকে বেনিফিশিয়ারিদের ব্লকে নিয়ে বাসে তুলে দেবে ওই পঞ্চায়েতের SLO। কোলাঘাটের বাসে থাকবে SLO প্রণব বাবু আর তমলুকের বাসে লাল্টু। ওরা আবার হ্যান্ড ওভার করবে নির্দিষ্ট ব্লকের সিকেসিও অর্থাৎ শুভদীপ্ত আর শান্তনুকে। এই দুজনের থেকে মাথা গুণে নেবে IMW মুকুল। সেবারের চঞ্চলের মত, এবারে জেলা প্রশাসনের সাথে বেনিফিশিয়ারি আদান প্রদানের দায়িত্ব IMW মুকুলের। অনুষ্ঠান শেষে আবার একই চেনে চলবে বেনিফিশিয়ারি আদান এবং প্রদান।
সেই মত চারটে স্টাফ কার্ড চেয়ে এবং পেয়েছি আমরা। মুকুল সামগ্রিক ভাবে সবকিছুর দায়িত্বে, সহযোগিতায় শান্তনু এবং শুভদীপ্ত আর ছবি তোলার জন্য অরূপ।
অনুষ্ঠানের দিন সকাল সকাল বিপত্তি, এমন পা কাটল শুভদীপ্তর, যে সাহস করে তাকে ওই ভিড়ের মধ্যে পাঠাতেই পারলাম না। হক বাবু কইলেন, " আপনাকে ভাবতে হবে নি ম্যাডাম। আমি চলে যাচ্ছি, অরূপকে নিয়ে। একদম সামনে থেকে ছবি তুলে আনব ।" বলা যত সহজ, করা ততোটাই দুষ্কর। একে তো মাননীয়ার কড়া নিরাপত্তার গেরো, তার ওপর তাঁকে ঘিরে জন উন্মাদনা।
নিয়ম মেনে মাননীয়া আসার আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা আগে ঢুকে যেতে হয় সবাইকে। যত বেলা বাড়ে ততো কড়াকড়ি হয় নিয়মের। ততো বাঁধন ছাড়া হয় জনপ্লাবন। হুগলী হোক বা পূব মেদিনীপুর, সর্বত্র একই চিত্র। সেবার দপ্তর গুলোর নিজস্ব স্টল ছিল, যেখানে সবাই ভিড় করে বসেছিলাম। এবার কোন স্টলের গল্পই নেই। জেলার শ্রম দপ্তরের সর্বোচ্চ আধিকারিক হিসেবে বড় সাহেবের যাও বা একটা চেয়ার জুটল, বাকিদের দাঁড়ানো ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই।
সামনের দিকে দাঁড়ানো অসম্ভব, তাই মুকুল, শান্তনু, লাল্টু আর প্রণব বাবু থেকে যান পিছে, ছবি তোলার টিম এগিয়ে যায় গুঁড়ি মেরে একদম সামনে। মিশে যায় আগত জন জোয়ারে। এই সব থেকে নিরাপদ দূরত্বে, অফিসের ঘেরাটোপে নিজ নিজ ডেস্ক টপে, মোবাইলে লাইভ ফিড অন করি আমরা। আকাশে ভেসে ওঠে কালো ভ্রমরের মত আকাশযান। শোনা যায় চেনা ঘটঘট শব্দ। দূরে পুলিশ লাইনের মাঠে অবতরণ করে হেলিকপ্টার। মূল প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেন তিনি। হাত নাড়তে নাড়তে স্টেজে ওঠেন তিনি। উঠে দাঁড়ায় অরূপ আর হক বাবুও। লম্বা লেন্সের ফোকাস বিন্দুতে তিনিই শুধু তিনি। শাটার টিপতেই যাবে, আচমকা বুলেটের মত ছুটে আসে জলের পাউচ, সাথে সাথে ঝাঁপিয়ে আসে কুকথার বন্যা। কোন মতে দু চারটে ছবি তুলেই বসে পড়ে দুজনে। এতো মহা জ্বালা। বালিঘড়ির গল্প যখন শুনিয়েছিল ম্যাডাম, তখন তো বলেননি, যে এমন ও ঘটতে পারে।
নির্দিষ্ট সূচি মেনে এগিয়ে চলতে থাকে অনুষ্ঠান। স্বাগত ভাষণ, বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কাজের উদ্বোধন, ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন ইত্যাদি প্রভৃতি। দেখতে দেখতে এসে যায় মাননীয়া কতৃক উপভোক্তাদের হাতে পরিষেবা তুলে দেবার সময়। পিছনের তিন চারটে সারির মানুষকে কর জোড়ে অনুরোধ জানায় হক বাবু, " এবার কিন্তু আমরা একটু উঠে দাঁড়াব, আমাদের দপ্তরের লোকজন স্টেজে উঠতেছে।" মৌখিক সম্মতি জানালেও, পাউচ ছুঁড়তে দ্বিধা বোধ করে না কেউ। কয়েকটা লক্ষ্য ভ্রষ্ট হলেও, বাকি গুলোর নিশানা অব্যর্থ। তাও টলে না আমার লোকজন। ঘাড়ে কাঁধে বেশ কয়েকটা আলু নিয়ে অফিসে ফেরে আমার লোকজন। মোবাইল, ক্যামেরা ভর্তি একরাশ স্মৃতি নিয়ে অফিসে ফেরে আমার লোকজন। অন্যের কাছে নিছক কেজো হলেও আমার কাছে অমূল্য এই স্মৃতি। বদলীর চাকরি আমার, গতকাল হুগলী ছিল, আজ পূব মেদিনীপুর, আগামী কাল আবার না জানে নিয়ে যায় কোন জেলায়। থেকে যাবে শুধু স্মৃতিগুলো। এই স্মৃতি গুলোই যে আমার সম্পদ।
অনির ডাইরি ৪ ঠা মার্চ, ২০২৪
#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা
অনেক দিন ধরেই শুনছি, তিনি আসছেন, তিনি আসছেন- এই এলেন বলে, এই এসে পড়লেন আর কি। জেলা প্রশাসনের অঙ্গে, তন্ত্রে জাগছে কম্পন, আমাদের আর কি? আমরা হলাম অপাংক্তেয় লাইন ডিপার্টমেন্টের দল। আমাদের কাজ বলতে, কেবল এমন কিছু মানুষকে যোগাড় করা, যাঁরা স্টেজে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে নানা অনুদান গ্রহণ করবেন। আর কিছু এমন মানুষ যোগাড় করা, যারা ক্রিকেটের দ্বাদশ ব্যক্তির মত বাউন্ডারি লাইনের বাইরে বসে অপেক্ষা করবে, স্টেজ বেনিফিশিয়ারিদের মধ্যে কেউ গরহাজির হলে, বা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে, তবে ওনাদের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে।
হোক না সামান্য কাজ, তাই নিয়েই মোদের উৎসাহ আর উদ্দীপনা দেখে কে? হতে পারি মোরা ল্যাবার, তাই বলে মোদের স্কিম কি কিছু কম আছে নাকি? বিনামুল্যে সামাজিক সুরক্ষা তো একাই একশ। জেলায় জেলায় দুয়ারে সরকার সফল করে কে? BMSSY আবার কে? তাছাড়াও বয়স্ক নির্মাণ কর্মীদের পেনশন দিই আমরা, বয়স্ক পরিবহন শ্রমিকদের পেনশন দিই আমরা, এমনকি পেনশন প্রাপকের মৃত্যু হলে, তাঁর স্বামী/ স্ত্রীকে ফ্যামিলি পেনশনও দিই আমরা। আর কর্মসাথী? গত ২৩ শে মার্চ, ২০২৩ থেকে দেশ বা রাজ্যের বাইরে কর্মরত পরিযায়ী শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা দেবার লক্ষ্য নিয়ে যে নবীন প্রকল্পটি এসেছে, তার সৌজন্যে সপ্তম দুয়ারে সরকারের সময় থেকে নাওয়া- খাওয়া ভুলতে বসেছে আমাদের ইন্সপেক্টর কুল, সিকেসিও থেকে এসএলওরা।
প্রতিটা প্রকল্প থেকে বেছে বেছে ছয় জনের নাম পাঠালাম, জেলা প্রশাসন তাকে কেটে ছেঁটে করে দিল দুই। অনুমোদিত তালিকা অনুসারে বেশ কিছু দপ্তরের একই প্রকল্প থেকে একাধিক মানুষ স্টেজে উঠবেন, আর আমাদের দুটো প্রকল্প থেকে মাত্র দুই জনকে অনুমোদন দেওয়া হল, বাকি প্রকল্প গুলি বাদ। কে আর মৃত নির্মাণ শ্রমিক বা অবসর প্রাপ্ত বাস ডিপোর টাইম কিপারকে নিয়ে মাথা ঘামায়। শুধু তাই নয়, ছেঁটে ফেলা হল আমিনা বিবিকেও। স্যার ভদ্র ভাবে আর আমি কোমর বেঁধে ঝগড়া করলাম আমিনা বিবির জন্য। এই মেয়েটাকে স্টেজে তুলতেই হবে-
“সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী”তে নালিশ করেছিল আমিনা বিবি। সেই নালিশের তত্ত্বতালাশ করতে গিয়ে তমলুক ব্লকের তৎকালীন IMW যোশুয়া মুর্মু দেখে, একটা চার আর একটা সাত বছরের পুত্রকন্যাকে নিয়ে অত্যন্ত দুস্থ অবস্থার মধ্যে রয়েছে মেয়েটি। জানা যায় মেয়েটি উচ্চ মাধ্যমিক পাশ। দুই বাড়ির অমতে শেখ সানোয়ারকে বিয়ে করেছিল আমিনা বিবি। বিয়ের পর বরের সাথে পাড়ি দেয় সুদূর কর্ণাটকের উত্তর কানাড়া জেলার সিদ্ধাপুরা। সেখানেই একটা টাইলস তৈরির কারখানায় কাজ করতেন শেখ সানোয়ার। সম্প্রতি এই কারখানায় যাবার পথেই পথ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ছেলেটি।
স্বামীর মৃত্যুর পর, তার কাগজপত্র হাঁটকে কর্মসাথীতে নাম নথিভুক্তির কাগজটা খুঁজে পান আমিনা বিবি। লেখাপড়া জানা মেয়ে, বুঝতে অসুবিধা হয়নি, এই প্রকল্পে নথিভুক্ত শ্রমিক যদি কোন দুর্ঘটনায় মারা যান, তাহলে এককালীন দুই লক্ষ টাকার অনুদান পাবে, তার মনোনীত ব্যক্তি। টাকার যে বড্ড দরকার আমিনার, কিন্তু কি ভাবে পাবে, কোথায় জানাতে হবে বুঝতে পারেনি। তাই “সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী”।
আমিনা জানত না, শুধু মৃত্যুকালীন অনুদানই নয়, মৃত স্বামীর মরদেহ ফিরিয়ে আনার জন্যও ২৫ হাজার টাকা অনুদান প্রাপ্য তার। প্রাপ্য তো বটে, কিন্তু আমরা দেব কি ভাবে? নতুন প্রকল্পের বেনিফিট মডিউল তো এখনও আসেইনি। তাহলে কি অফলাইন ছাড়ব? সেক্ষেত্রে কি কি কাগজ পত্র নেওয়া হবে? কি ভাবে সেসব প্রসেস করা হবে? ইন্সপেক্টর কোন এনকোয়ারি করবে কি? করলে কি ভাবে করবে? বাইরের সাক্ষী লাগবে কি না? তারপর কি সমস্ত কাগজ কলকাতা পাঠাতে হবে ইত্যাদি প্রভৃতির জালে জড়িয়ে হাবুডুবুই খাচ্ছিলাম আমরা, এমন সময় ঘোষিত হল, তিনি আসছেন। শুধু আসছেনই না, আসছেন আমাদের অফিসের ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে।
এত তাড়াতাড়ি কি আর আমিনা বিবির সমস্যার সমাধান করতে পারব? দূর তার থেকে অন্য একজন নথিভুক্ত শ্রমিককেই স্টেজে পাঠিয়ে দেব। মাননীয়ার হাত দিয়ে বরং একটা নথিভুক্তির সার্টিফিকেটই দিয়ে দেওয়া হবে। সব শুনে সুকন্যা এমন ধমক লাগাল, আর সোমনাথ দা করল আশ্বস্ত, “অত তোকে ভাবতে হবে না। তুই কেসটা স্ক্যান কর আর টাকা চেয়ে পাঠা। একটা অ্যাপ্রুভাল দিতে ভুলিস না।তারপর চোখ বন্ধ করে বসে থাক-।”
আজ যখন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর হাত দিয়ে বেনেফিটটা দেওয়া হল, আমিনা বিবির হাতে, চার বছরের শিশু পুত্রকে সঙ্গে নিয়েই স্টেজে উঠেছিলেন আমিনা বিবি। বাচ্ছা দেখার কেউ নেই যে বাড়িতে। পরনে বোরখা, মাথায় হিজাব, তারওপর আমাদের দেওয়া টি শার্ট। যাতে আমাদের দপ্তর, আমাদের স্কিমের নাম লেখা। বেনিফিট তুলে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী, পুঁচকেটাকে গাল টিপে আদর করলেন মুখ্যমন্ত্রী, আমিনার কাঁধে হাত রেখে শক্ত হতে বললেন মুখ্যমন্ত্রী। তখন আমি বহুদূরে। নিজের চেম্বারে, নিজের চেয়ারে বসে লাইভ ফিড দেখছি। মাঠে কোন মতে বসতে পেয়েছেন স্যার, ইন্সপেক্টর মুকুল,সিকেসিও শান্তনু, SLO লাল্টু আর প্রণব বাবুর ভাগ্যে একটা চেয়ারও জোটেনি। ছবি তোলার অভিলাষে গুড়ি মেরে একদম সামনে এগিয়ে গেছে হক বাবু আর অরূপ। ছবি তুলতে গিয়ে দমাদ্দম উড়ে আসা জলের পাউচের বাড়ি খাচ্ছে অরূপ, তাও এক অদ্ভুত ভালো লাগায় পূর্ণ সকলের হৃদয়। হোক না নিছক পেটের দায়ে, পেশার গুঁতোয়, তবুও কিছু তো করলাম, কারো তো পাশে দাঁড়াতে পারলাম।
অনির ডাইরি ৩রা মার্চ, ২০২৪
#অনিরডাইরি
সেদিনটাও রবিবার ছিল। সে অনেককাল আগের কথা, ২০০৯ সাল। মাসটা হয় ডিসেম্বর, নয়তো জানুয়ারি। হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা পড়েছিল বটে কিছু। সেদিন পোলিও রবিবার। তখন বাচ্ছাদের পোলিওর ওষুধ খাওয়ানো নিয়ে তীব্র অসন্তোষ ছিল সমাজের একটি অংশের। একদিকে গণ অসন্তোষ অন্য দিকে WHO’র গুঁতো। পরিণামে জেলা শাসকের মাধ্যমে নির্দেশিকা নেমে এল, যে বিভিন্ন কেন্দ্রে এই পোলিও অভিযান কতটা সফল তা ঘুরে দেখবে এবং রিপোর্ট দেবে সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক স্বয়ং।
শৌভিক নতুন বিডিও। খড়গপুরের দুটো স্টেশন আগে, মাদপুরে চতুর্দিকে পুকুর আর ধান জমি দিয়ে ঘেরা মোদের লাল-নীল সংসার। ছিমছাম একতলা কোয়ার্টার। কর্মব্যস্ত দিনে তাও কিঞ্চিৎ জনসমাগম হয়, ছুটির দিনগুলো কাটে চূড়ান্ত নিরিবিলিতে। ছুটির দিনে আমাদের দাম্পত্যালাপ ভিন্ন আওয়াজ বলতে, কেবল দূর থেকে ভেসে আসা আজানের সুর আর ট্রেনের বাঁশি। যে বাঁশির সুর শুনলেই আমার বর সব কাজ ফেলে দৌড়োয় বারন্দায়, ট্রেন দেখবে বলে। দিগন্ত প্রসারী সবুজ ধান ক্ষেতের বুক চিরে চলে গেছে এক ফালি রেল লাইন। লোকাল থেকে মালগাড়ি, আমার বরের সবাইকে দেখা চাইই চাই।
শৌভিকের এই ট্রেন নিয়ে আদিখ্যেতা আমার মাথায় ঢুকত না, ঢোকার সময় ও থাকত না। শনি-রবি বা ছুটির দিন মানেই সেটা ছিল “ঘরসাফাই ডে”। রান্নাবান্না থেকে ঝাড়পোঁচ, বাসন মাজা সবই আমরা নিজেরা করতাম। রান্না অবশ্য আমিই করতাম, রাতের বাসন ভোরে উঠে আমি মাজতাম, আর সকালের বাসন অফিস থেকে ফিরে শৌভিক। ঝাড়াঝাড়ির জন্য আমার ছিল ঝ্যাঁটা আর ন্যাতা আর শৌভিকের ভ্যাকুয়াম ক্লিনার।
তো সেই রবিবারও যাবতীয় গৃহকর্ম নিপটে, দোঁহে বেরোলাম পোলিও রবিবার পর্যবেক্ষণে। আমি কেউ না, আমি যেতে খুব একটা আগ্রহীও ছিলাম না। কিন্তু রবিবারের জনশূন্য কোয়ার্টারে আমাকে একা রেখে যেতে মোটেই রাজি হল না শৌভিক। যদিও আমার সন্দেহ হচ্ছিল, ও ব্যাটা নিজে ঘুমাতে পারবে না বলে আমার দিবানিদ্রার ব্যাঘাত ঘটাল। ড্রাইভার (এবং মালিকও) শৈবাল দার সাদা অ-বাতানুকূল অ্যাম্বাসাডরে চেপে রওনা দিলাম দোঁহে। সারি বদ্ধ ইউক্যালিপ্টাস গাছে মোড়া পিচ রাস্তা দিয়ে বেশ অনেকটা গিয়ে হাই রোড। ফাঁকা হাই রোডে লাগাম ছাড়া ঘোড়ার মত ছোটে গাড়ি। দুদিকে যত দূর চোখ যায়, সবুজ চাষের জমি। মাটির রঙ বুঝি আমাদের হাওড়া-কলকাতার থেকে সামান্য একটু লালচে।
গাড়ি থেকে নেমে, দুদিকে পুকুর আর মাঝখানে ঢালু লাল মোরাম বিছানো রাস্তা দিয়ে বেশ অনেকটা হেঁটে গিয়ে, একটা একতলা ঘর। ঘরের সামনের বারন্দায় বসে বসে হাই তুলছেন এক মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোক, পাশে এক ভদ্রমহিলা বসে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন দূরে কোন গাছের দিকে। আর তৃতীয় কোন জনমনিষ্যি নেই ধারেকাছে। তবে কি এখানেও পোলিও প্রতিরোধ কর্মসূচি বয়কট করেছে স্থানীয় বাসিন্দারা? তাই জন্যই কি শৈবাল দা এখানে নিয়ে এসেছেন আমাদের! সেটা শুধাতেও হাঁটতে হবে অনেকটা, কারণ গাড়ি দাঁড়িয়ে সেই হাইরোডে, আর ফোন গুলোতে একটাও টাওয়ার অবশিষ্ট নাই।
তিন ধাপ সিঁড়ি টপকে খোলা বারন্দায় উঠল শৌভিক। পিছন পিছন আমি। শৌভিক শুধাল, “কি ব্যাপার? কেউ পোলিও খাচ্ছে-টাচ্ছে না?” ভদ্রলোক দাড়ি চুলকে বললেন, “সকাল সকাল এসে সব খেয়ে গেছে আজ্ঞে। আরো কয়েক জন আসবে হয়তো, এখন দুপুরবেলা তো- ।” সামনে রাখা রেজিস্টারের পাতা উল্টে পাল্টে শৌভিক বলল, “আচ্ছা আপনার পরিচয়টা- ।” ভদ্রলোক নিজের এবং পার্শ্ববর্তিনীর পরিচয় দিয়ে শুধালেন, “আর আপনি?” শৌভিক বলল, “আমি বিডিও।” ভদ্রলোক এতক্ষণ বসে কথা বলছিলেন, এবার উঠে দাঁড়ালেন। “শুনতেছি বটে নতুন বিডিও সাহেব আসতেছেন। স্যার আপনের বাড়ি কুথা? স্যার আপনের খোকা আছে-।”
প্রশ্নোত্তর পর্ব আর কোথায় গড়াত জানি না, এমন সময় দূর থেকে লাল মোরামের রাস্তা ধরে এক মহিলাকে হেঁটে আসতে দেখা গেল। কোলে একটি শিশু সহ। ভদ্রলোক কইলেন, “সার- ম্যাডাম একটা বাচ্চাকে অন্তত ভ্যাকসিন খাইয়ে যাননি-।” কাঁথায় মোড়া তুলোর বল। কপাল জোড়া এত্ত বড় কৃষ্ণবরণ চাঁদ মামা। দুই চোখেও পুরু করে কাজল পরান। মাখনের থেকেও মোলায়েম দুটো গালকে আঙুল দিয়ে সামান্য টিপতেই পুতুলের মত ছোট্ট হাঁ করল। শৌভিক সামান্য চাপ দিল ভায়ালে, গোলাপি জিভের ওপর টুপটাপ ঝরে পড়ল লালচে রঙা দুফোঁটা তরল।
তারপর ঘটে গেল কত কি। আমরা দুই থেকে তিন হলাম। মাদপুরের পাট চুকল। শৌভিকও দেখতে দেখতে বিডিও থেকে কবে যেন এসডিও হয়ে গেল। এসডিওগিরির ও প্রায় তিন বছর হতে চলল। ইতিমধ্যে ঘোষিত ভাবে পোলিও মুক্ত হয়েছে ভারত। বিগত ১২ বছরে আক্রান্ত হয়নি আর একটাও শিশু। খুঁজেই পাওয়া যায়নি হতভাগা ভাইরাসটাকে। রবিবার-রবিবার সেই পোলিও অভিযানও বন্ধ হয়ে গেছে। অথবা হলেও আমাদের কানে আর পৌঁছায় না। আমাদেরটা পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে যে। তাই গত রাতে শৌভিক যখন বলল, “ সুপার সাহেব কাল সকালে একবার যেতে বলেছেন। কাল বাচ্ছাদের পোলিও খাওয়ানো হবে, আমার হাত দিয়ে শুরু করতে চান।” আকাশ থেকে পড়লাম আমি, পোলিও আবার ফিরে এসেছে নাকি?
কাঁথি মহকুমা হাসপাতালের আউটডোর ইউনিটে যখন পৌঁছালাম, ঘড়িতে সদ্য নটা। তখনও ভিড় জমেনি তেমন। সুপার সাহেব আর হাসপাতালের দিদিরাই রয়েছেন। সাজানো হচ্ছে আউটডোরটাকে, রঙবেরঙের বেলুন দিয়ে। সুপার সাহেব অত্যন্ত সুবক্তা, গুছিয়ে বললেন," বিগত ১২ বছরে ভারতে এই ভাইরাসের উপস্থিতির কোন প্রমাণ আমরা পাইনি। কিন্তু সম্প্রতি কিছু শিশুর মলে এই ভাইরাসের নমুনা পাওয়া গেছে। আসলে দুয়েকটি প্রতিবেশী দেশে তো সেই ভাবে পোলিও খাওয়ানো হয় না, ওখান থেকে শ্রমিকরা যখন আসে, তাদের বাচ্ছাদের মারফৎ এই ভাইরাসটাকেও নিয়ে আসে। আমরা তাই সম্পূর্ণ বিপন্মুক্ত নই।"
এবার ভ্যাকসিন দেবার পালা। ভাগ্যে ওরাল ভ্যাকসিন, সূচ ফোটানো হলে আমি মোটেই যেতাম না। মাননীয় মহকুমা শাসকের শুভ হস্তেই কর্মসূচি শুরু হবার কথা। তবে ওনার ঘরণী বলে, প্রথম ডোজটা আমাকেই খাওয়াতে বলা হল। আমার জন দিব্য বাবার হাত ধরে হেঁটে এসে লাফিয়ে চেয়ারে উঠে বসল। হাঁ করাতেও হল না। তিনি জিভ বার করেই রেখেছেন। টুপটাপ ঝরে পড়ল ওষুধ। একহাতে ধরানো হল দুটি চকলেট, অন্য হাতের কড়ে আঙুলে লাগানো হল মার্কার। ছোটবেলায় তুত্তুরী বলত, “দ্যাখ দ্যাখ মা, কেমন ভোট দিইছি।”
এবার শৌভিকের পালা। ওর ভাগ্যে যিনি পড়লেন, তাঁকে দেখে শৌভিক বেশ ভড়কে গেল। “ও বাবা, একে আমি খাওয়াতে পারব না।” তিনি যে বড্ড ছোট। কুৎকুতে দুই চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু। গা থেকে ভেসে আসছে দুধ আর বেবি পাউডার মেলানো-মেশানো মোহক সুবাস। সবাই সাহস দিল, “দিন স্যার, দিন। ঠিক পারবেন।”এক হাতে পুঁচকে দুটো গাল টিপে অন্য হাতে যখন ওষুধটা ঢালছিল শৌভিক, মনে হচ্ছিল পনেরো বছর আগের মুহূর্তটারই পুনরাভিনয় দেখছি বুঝি। বিডিও থেকে এসডিও, সেদিনও ওর পাশে ছিলাম, আজও থাকতে পেরেছি ঈশ্বরের কৃপায়। দুজনের দুই রকম চাকরি, মেয়ের লেখাপড়া, বয়স্ক বাবামা, শ্বশুর শাশুড়ি সামলে সেটা যে কতটা দুরূহ, কতটা জটিল, ভুক্তভোগীরাই জানে। সবার ওপর তিলোত্তমার কুহকিনী আকর্ষণ। দিনের শেষে কেবল হাতে থেকে যায়, আরেক জোড়া হাতের উত্তাপ। এই তো চাই কালীদা,বাকিটা ঠিক হয়েই যাবে।
No comments:
Post a Comment