Friday, 11 July 2025

অনির ডাইরি জুলাই, ২০২৫

 

অনির (চুঁচুড়ার) ডাইরি ৩০শে জুলাই, ২০১৯

#ফিরেদেখা #অনিরডাইরি 



প্রতিটা দিন, শুরু হয়, ঠিক একই রকম ভাবে। সেই ঘুম জড়ানো ভারি চোখ, মনের মধ্যে সুপ্ত ইচ্ছা, আজ বেশ রবিবার। আর তারপর? ট্রেনে বিক্রি হওয়া মুচমুচে কচুভাজার মত ঝাল-নুন ছিটোতে থাকে জীবন। 


সকাল ১১টা- “ম্যাডাম, কাল তারা এসেছিল। ঠিক আপনার অসাক্ষাতে। পাক্কা দেড় ঘন্টা ধরে, কি চিৎকার। বলেছে, এবার বেনিফিশিয়ারিদের এনে, আপনার চেম্বারে বসিয়ে বিক্ষোভ দেখাবে?”


“মানে? আমার ঘরে লোক ঢোকাবে? কে ভাই, সেই মহাপুরুষ? ঘরে লোক ঢোকাতে চাওয়াটা দেখছি গাঙ্গেয় হুগলীর মুদ্রাদোষ হয়ে দাঁড়িয়েছে।” 


সকাল ১১টা ১৫- প্রবল ইচ্ছে করছিল বরকে ফোন করে নালিশ করতে,কিন্তু সক্কাল সক্কাল কাউকে ভুঁড়ি নাচিয়ে হাসাতে চাই না। তাই তীব্র ইচ্ছে দমন করে, তাঁকে ফোন লাগালাম, যাঁর ভয়ে আমার তিন তিনটে ইন্সপেক্টরের মুখ কালো হয়ে আছে। ব্যাটারা আবার বলছিল, আমায় নাকি ট্রেনিং করে রোগা এবং কালো লাগছে। ভদ্রলোকের ফোনটা বেজে গেল, যাই হোক। 


১১টা ৩০- “ম্যাডাম, আঠারোটা ফাইল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হয় হারিয়ে গেছে।”


- মানে? কোথায় গেছে? বেড়াতে? ১৮জন একসঙ্গে বেড়াতে গেল? খুঁজেছো? 

- “ম্যাডাম শুভজিৎ ধীমানকে দিয়েছিল।” 

-“না ম্যাডাম আমায় দেয়নি। আমায় দিলে আমি কোনদিন হারাই? আমি সব গুছিয়ে রেখেদি কি না বলুন? নির্ঘাত রমেশকে দিয়েছিল।” 


-“বাঃ তা শুভজিৎ, রমেশ এণারা সব কোথায়?” 

-“শুভজিৎ পুজো করছে।” 

-মানে? 

-“ছুটি নিল যে, হোয়াটস্অ্যাপে।” 

বাঃ। তা ফাইলগুলো দিয়ে কি ধুনো দিচ্ছে?


 -“ম্যাডাম আমি কতবার বলেছি, আমায় দিতে, আমি সব গুছিয়ে রাখি।” 

ঝগড়া থামাবে তোমরা? আমি বলে সদ্য শিখে এলাম-নো ব্লেম গেম- নো স্কেপগোট। কোথায় কোথায় খুঁজেছো? চল আমার সামনে খুঁজবে চলো। 


১২টা- “হ্যালো ম্যাডাম,আপনি ফোন করেছিলেন, সরি আমি ধরতে পারিনি, একটু ইয়ে করছিলুম। ”


“বেশ করছিলেন। আরে আয়াম সরি, আপনি আমার অসাক্ষাতে আমার অফিসে ডেপুটেশন দিয়ে গেলেন, আমি থাকতে পারলুম না। আপনি একাই আমার তিন তিনজন ইন্সপেক্টরকে আমার অসাক্ষাতে চমকে গেলেন, হ্যাঁ গো,তা আপনারা নোটিশ দিয়েছিলেন? কই দেখিনি তো? মারের আগে ধাক্কা তো দেবেন?”


- “কি যে বলেন ম্যাডাম। আপনাদের সঙ্গে আমার কত ভালো সম্পর্ক। আপনারা কত হেল্প করেন।” “তাই বলে ওসব ছেলেপিলে ঢোকানোর গল্প করে যাবেন? আমি না হয়, মজা পেয়েছি,তবে,আমি আর কদ্দিন বলুন তো। এবার ট্রেনিং এ পাঠাক, আমি আর ফিরব না। ”


-“হেঃ হেঃ! ম্যাডাম আপনাকে যেতে দিলে তো।রাগ করছেন কেন? ও তো কথার কথা। ওসব একটু বলতে টলতে হয়। বুঝলেন কি না। আপনি ট্রেনিং এ ছিলেন, তাই দেখা হল না। আপনি মিষ্টি খেতে চেয়েছিলেন, এবার গেলে নিয়ে যাব। রাগটাগ করবেন না। ”


১২টা৩০- “সঞ্চিতা, চিন্তা নেই,অমুক বাবু মিষ্টি নিয়ে আসছেন। ছেলেপিলে আনছেন না। এই, তুমি পাহাড়ে চড়ে কি করছ?”


- “ফাইল খুঁজছি ম্যাডাম। আপনি বললেন তো।” 

-"তাই বলে ধুলোর পাহাড়ে কে চাপতে বলল। শেষে বস্তা চাপা পড়ে মরবে নাকি?” 

-“না ম্যাডাম, এই দেখুন ছটা ফাইল পেয়েছি।"

- "বাঃ গুড গার্ল। ধীমান-কৌশিক কিছু শেখো মাইরি তোমরা। সঞ্চিতা আমার একাই দশ শ।”


- কৌশিক বলে “ম্যাডাম, দাঁড়ান। কাল আমি ময়দানে নামব। সব বস্তামস্তা বিদেয় করে ছাড়ব। ধুলোর আখড়া যত।” 


বেলা ১.৩০- "রমেশ তোমাকে যে ফাইলটার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, সেটা রেডি হয়েছে?“


-"শুনুন না ম্যাডাম, আমি সব গুছিয়ে সঞ্চিতা ম্যাডামকে দেখিয়ে ফাইলটা রাখলাম, আর খুঁজে পাচ্ছি না। 

-” বাঃ। এটা তাহলে উনিশ নম্বর। সাত দিন। মাত্র সাতদিনের জন্য ট্রেনিংএ গেছিলাম রে বাপ, তোমরা তার মধ্যে আর কি কি হারিয়েছো? একটা লিস্ট করে দাও হ্যাঁ। বার বার আমি জানতে চাইব, তোমরা এক এক করে শোনাবে,~ কাঁহাতক সহ্য হয় বাপ? 


বেলা ২.৩০- “হ্যালো ম্যাডাম, চিঠি পেয়েছেন?"

- "আবার? আর কত চিঠি লিখবেন অমুক বাবু? আমি চাপা পড়ে যাব যে। ডিসপিউট চলছে তো। একটু ভরসা রাখুন না। উল্টো পার্টিকেও একটু ভাবতে দিন। এভাবে পত্রাঘাত করলে খেপে যাবে না? ” 

-“না ম্যাডাম। চিঠি আমারই। তবে আইনটা আলাদা।” 

-“ওরে বাবা, আবার নতুন আইন পড়াবেন?” 


বেলা ৩.৩০-“হ্যালো সুকন্যা। এই আইনে কাজ করেছো?” 

-“হ্যাঁ। ”

- বাঃ। সাধে কি তোমায় ফোন করি। শালা সবজান্তা মাইরি। এবার বলো দেখি সোনামণি কি করতে হবে। ” 

-“পড়ে দেখ। ”

- ছিঃ এমন করে দর বাড়াতে আছে? পড়েছি তো। বুঝতে পারলে আর তোমার কি প্রয়োজন। বলো না বাপ-।”


৪টে- “হ্যালো অমুক বাবু, শুনুন। আপনার এই পাঁচ গণ্ডা চিঠির ওপর আরো গুটি ছয়েক অ্যাপ্লিকেশন লাগবে। ফর্মটা কাল এসে নিয়ে যাবেন।” 

-“ আরো ছয় কপি? আমায় যে অমুক বলল-”।


 -“ধুর বাবা। আপনাকে কে বলেছে জানি না, আমায় খোদ আইনের বই বলেছে। জ্যান্ত সরস্বতী বাবা। ভুল বলে না। এবার দয়া করে,আপনি আসুন। আর একদম চিঠি লিখবেন না। ”


৫টা৩০-“দিদি, কাল আসব।” 

- “আচ্ছা। কেন বলো তো?” 

-“সেই যে সেক্সুয়াল হ্যারাজমেন্টের কেসটা-”। 

- “অ্যাঁ? কোন কেস? কে কাকে হ্যারাজ করল। ধুর বাবা, মনে পড়ছে না কেন?” 

- “না। না। দিদি, হ্যারাজমেন্ট অ্যাট ওয়ার্ক প্লেস অ্যাক্টটা নিয়ে বলতে বলেছিলাম না, রেকর্ড করে নেব। ” 

-ওঃ। বাঁচলাম। 


এইভাবেই অর্ধেকটা দিন কেটে গেল, এবার বোধহয় বাড়ি যাবার পালা। সেখানে আবার অঘটনঘটনপটিয়স তথা তাঁর কন্যা, কি পাকিয়ে রেখেছেন কে জানে? তবে সে তো অন্য গল্প। আপাততঃ অনেক হয়েছে বাপ। বাড়ি যাই।

(ছবিতে সেদিনের পাত্রপাত্রী বৃন্দ )

অনির ডাইরি ২৬ শে জুলাই, ২০২৫

#অনিরডাইরি 

জন্মদিন নিয়ে আমার মেয়ের আবেগপ্রবণতা বরাবরই একটু বেশী। মধ্যরাতে চমকে দেওয়া সেলিব্রেশন, দূরাভাসে আপনজনেদের আশীর্বাদ মাখা উষ্ণ কণ্ঠস্বর, বন্ধুদের টুকটাক মেসেজ, দুপুরে মায়ের হাতের পঞ্চব্যঞ্জন, সস্তা হলেও ছুটকোছাটকা কিছু উপহার এই আর কি। কিন্তু তার জন্য একটা ঠিকঠাক দিনে জন্মাতে হয় বাপু। ফি বছর তেনার জন্মদিনে ডুবে বসে থাকেন কল্লোলিনী। বিগত চার বছর পূর্ব মেদিনীপুরে থাকার দরুণ, জলমগ্ন কলকাতার অভিজ্ঞতা আমরা ভুলতে বসেছিলাম প্রায়। তাই এবার বুঝি সুদেআসলে বুঝিয়ে দিল প্রকৃতি। 


দুদিন আগে থেকেই ঘোর নিম্নচাপ, কত সাধ করে লিস্ট বানিয়েছিলাম আমি, কি কি রান্না হবে, কি কি কিনতে হবে, ভেস্তে গেল সবকিছু। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত তাঁর ইস্কুল ঘোষণা করল, জন্মদিনের দিনই হবে পেরেন্টস টিচার মিটিং। যাঃ বাবা, তাহলে রান্না করব কখন? আর যাবই বা কি করে, বিগত দুই দিন ধরে তো আমাদের ফ্যান্সি আবাসনের সামনে এক হাঁটু জল। রান্নার দিদি, বাসন মাজার দিদি কেউ আসতে পারছে না। 


ঠিক করলাম, যাবই না। এমনিতেই তিনি পড়াশোনায় অষ্টরম্ভা, তারওপর সবে নতুন ইস্কুলে ভর্তি হয়েছেন, এখনই আর অত কি জানাশোনার আছে। কিন্তু কমলি ছাড়লে তো! দিদিমনি খোদ আগের দিন ফোন করে অনুরোধ করলেন, " প্লিজ আসুন।" 


শৌভিক বলল, "ছেড়ে দে, এবার আর অত কিছু করতে হবে না। স্কুলে যেতেই হবে যখন, বাইরে কোথাও খেয়ে আসব।" তিনি মুখে বললেন বটে, " তোমরা যা ভালো বোঝ" মনে মনে যে খুশি হলেন না, সেটা একটা গোলাপী তুলোর ভাল্লুককে পেটে চিমটি কাটা দেখেই বুঝতে পারলাম। শৌভিক পুনরায় প্রস্তাব দিল, " ঠিক আছে, তাহলে রবিবার সেলিব্রেশন হোক। আবহাওয়া দপ্তর তো বলছে ঐ দিন কেটে যাবে নিম্নচাপ। আপাতত তো বাড়িতে কিছুই তেমন নেই -"। বেচারী গোলাপী ভাল্লুক, কথা বলতে পারলে নির্ঘাত, " বাবা গো" বলে চিৎকার করত। মোদ্দা কথা এই প্রস্তাব ও নাকচ। 


এই করতে করতে দুপুর গড়িয়ে হল সন্ধ্যা, সন্ধ্যা বিদায় নিয়ে নামল রাত্রি। আমাজন থেকে জোমাটো সকলেই জানিয়ে দিলে আমাদের বন্যাপ্লাবিত ন্যুভরিশ এলাকায় ডেলিভারি দিতে তাঁরা অপারগ। কাঁদকাঁদ তিনি, এরই মাঝে তাঁর ভৌত বিজ্ঞানের শিক্ষক মহাশয় ফোন করে জানালেন, জল জমেছে তাই তিনি আসতে অপারগ বটে, তবে পড়ার ছুটি নেই। আজকের পড়া হবে গুগল মিট এ। আকাশ, বাতাস, মেঘ, কলকাতা, সুইগি, জোমাটো হয়তো বা শৌভিক আর আমার মুণ্ডুপাত করতে করতে তিনি ঘরের দোর দিয়ে পড়তে বসলেন। 


ইত্যবসরে আমি শৌভিককে বললাম, " যা বাবা, গিয়ে অন্তত দুধ আর গোবিন্দ ভোগ চালটা তো নিয়ে আয়। লম্বা লোক আছিস, আমার মত ডুবে তো যাবি না।" তিনি জানতেও পারলেন না, বাবা কখন প্যান্ট গুটিয়ে ছাতা বগলে বাজার করতে বেরোল। শুধু মা নয়, বাপ হওয়া ও কি মুখের কথা! 


পড়া শেষে নিমপাতা চিবানো মুখে বেরিয়ে যখন দেখলেন ঘন দুধ আর সুগন্ধী গোবিন্দভোগ চালের মিশ্র গন্ধে সারা বাড়ি সুরভিত, ঘোর কৃষ্ণ মেঘের ফাঁকে ফুটল হাল্কা আলোর রেখা, " যাক পায়েসটা অন্তত হচ্ছে।" 


শুধু কি পায়েস, হচ্ছিল আরও অনেক কিছু। এলুমিনিয়ামের কড়াইয়ে চাপাচুপি দিয়ে বেক হচ্ছিল কেক। আলমারির মধ্যে খচমচ করছিল তাঁর প্রিয় ফ্লেভারের নাচো চিপস্। আপিসের ব্যাগে ঘাপটি মেরে বসে ছিল তমলুক থেকে কিনে আনা একরাশ রংবেরঙের টফি আর চকলেট। শৌভিকের জামাকাপড়ের তাকে লুকিয়ে ছিল প্লাস্টিকে মোড়া সস্তার লাবুবু পুতুলখানা। ডিনারে ছিল তাঁর মন মত প্রচুর চীজ দেওয়া গার্লিক বাটার চিকেন। ফ্রিজে যেটুকু মাংস ছিল করেই ফেললাম, কালকের চিন্তা কাল করব ক্ষণ। 


মধ্যরাতে যখন সবকিছু সাজিয়ে দিলাম, তাঁর আনন্দের আর সীমা পরিসীমা রইল না। তারওপর আবার পাক্কা বারোটায় কাকিমা আর বোনের ফোন, শ্রীমতী ফুলঝুরি যে ঝুঁটি নাড়িয়ে কি বললেন, তুত্তুরী দিদি তো গলে পড়েই গেলেন। একরাশ আশীর্বাদ আর ভালবাসা নিয়ে হাওড়া থেকে ফোন করল বৃদ্ধ দাদু,দিদা আর মাসি। বুড়োবুড়ির জীবনটাই যে আবর্তিত হয় শ্রীমতী তুত্তুরীকে কেন্দ্র করে। ফটোক্রাউড এর একবছরের মেম্বারশিপ উপহার দিল বাবা। নে ব্যাটা, যত খুশি ছবি তোল আর পোস্ট কর। সারা বছর এই ভাবেই আপনজনদের ভালোবাসায় সিক্ত থাকুক মেয়েটা, সর্বশক্তিমানের কাছে এটাই কামনা। থাক না আরও কিছু বছর এমনি শিশু হয়ে, আমার বুকের কাছে। বড় হবার জন্য তো পড়ে আছে, অনন্ত জীবন। 


পুনশ্চঃ শ্রীমতী গুগল লেন্সে ফেলে দেখে জানালেন, গোলাপী ভদ্রমহিলাটি লাবুবু নয়, এমনকি তার সস্তার প্রতিরূপ লাফুফু ও নয়। তিনি এমনি গোলাপী প্লাশ টয় বটেক। তাতেও তাঁর উল্লাসের সীমা নেই বটে, তবে মাইরি আমাজন, গরীব মানুষকে এমন ভাবে বোকা বানাবে ভাই 👹।


অনির ডাইরি ১৫ই জুলাই, ২০২৫

#অনিরডাইরি 



একদম ইচ্ছে করছিল না বেরোতে। সারাটা সপ্তাহ তো বাড়ির বাইরেই ছিলাম, শনিবারও অধিবেশনে সমবেত হতে হয়েছিল। বর- মেয়ের সাথে একটা দিনও কাটাতে পারলাম না এই সপ্তাহে, ভেবেই বুকের মধ্যে জমছিল ভরা শ্রাবণের মেঘ। 


ঠিক ছিল বারোটায় জমায়েত হবে, ঘড়ি ধরে বারোটায় নামল মুষল ধারে বৃষ্টি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে স্নানে গেলাম, এযাত্রা দোষটা অন্তত বৃষ্টির ঘাড়ে চাপানো যাবে। পৌনে একটা নাগাদ যখন একটা দুরন্ত সেলফি দিয়ে মেসেজ করল সঞ্চিতা, " কি রে তোরা কোথায়"? আমি তখন সবে জুতোয় পা গলিয়েছি, শৌভিক পিছন থেকে বলেই যাচ্ছে, " শোন কিপটেমি করিস না। ভালো কথা বলছি, ক্যাব নিয়ে নে। আমার একটা ৫০০ টাকার কুপন আছে, ওতে তোর হয়ে যাবে -"। 


 রাজপথে নেমে দেখি পিলপিল করছে মানুষ আর গাড়ি। হে ঈশ্বর রবিবার দুপুরে এত মানুষ রাস্তায় বেরোয়? ক্যাব নেব কি নেব না ভাবতে ভাবতেই বাসটা এসে গেল, L মার্কা লিমিটেড স্টপের বাস, আমার সামনে দাঁড়াবার কথা নয়, তাও যখন দাঁড়িয়ে গেল আর কন্ডাক্টরটা এক গাল হেসে বলল, " দিদি যাবে নাকি, হাওড়া হাওড়া -",  উঠেই পড়লাম। ওঠার সাথে সাথেই বাসটা যেন পক্ষীরাজ হয়ে উঠল, আর একটু হলে পড়েই যাচ্ছিলাম।


দিন কয়েকের জন্য হাওড়া যাচ্ছি, এবেলা বন্ধুর বাড়ি নিমন্ত্রণ, ওবেলা বাবার জন্য গলা ফাটাতে হবে এক বৈঠকে, কাল থেকে অফিস। তাই এক কাঁধে আমার আপিস ব্যাগ, অন্য কাঁধের ভারী ব্যাগে ঠুসেঠুসে ভরেছি ঘরে, বাইরে পরার পোশাক আর দৈনন্দিন আবশ্যক সামগ্রী।  শৌভিককে জানিয়ে দিই বাস পেয়ে গেছি, বন্ধুদের ধারাবিবরণী দিতে থাকি কতদূর এলাম,  " লেকটাউন - উল্টোডাঙ্গা - মানিকতলা - গিরিশপার্ক "। 


 হাওড়া স্টেশনে যখন নামলাম, ঘড়ি বলছে বেলা দুটো। আবার মুখ ভার হচ্ছে আকাশের,  বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে মিহি জলকণা। অস্বাভাবিক ফাঁকা হাওড়া, যাও দুই একটা বাস আসছে, কয়েকজন ঢুলঢুলে যাত্রী নামছে আর গায়েব হয়ে যাচ্ছে স্টেশনের ভিতর। আমার বাড়ির বাস আর একটা আসে না। শৌভিক বলে, "সে নাই আসুক, তোর পয়সা তো বাঁচল 😡।"  অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে হাওড়া ময়দানের বাস ধরি, বাকিটা না হয় টোটো করে যাব। শৌভিক মেসেজ করে, " আমরা খেয়ে উঠলাম, তবে তুই আর আজ খেতে পাবি না। তিনটে অবধি কে তোর জন্য না খেয়ে বসে থাকবে -!" 


হাওড়া ময়দানে যখন নামলাম, আড়াইটে বাজছে। ভালো মত বৃষ্টি পড়ছে। সত্যি কেউ আর অপেক্ষা করবে না আমার জন্য, বাকিদের বাড়ি ফেরার সময় গিয়ে পৌঁছাব আমি। বিমর্ষ ভাবে একটা টোটো ধরি। "কেদামতল্লা কেদামতল্লা" হেঁকেই যাচ্ছে বৃদ্ধ রিকেটি অবাঙালি টোটোয়ালা, গাড়ি আর ছাড়েই না। অবশেষে বিশাল বড় গিটার নিয়ে ওঠে একটা মেয়ে, একটু পরে বাজারের ব্যাগ হাতে ওঠে এক দম্পতি তবে ঘোরে চাবি। পঞ্চাননতলা দিয়ে ঢোকার সাথে সাথে দৌড়ে আসে গোটা তিনেক লাল গেঞ্জি পরা অবাঙালি ছেলে। " কিধার যাস" বলে একজন চেপে ধরে টোটোর হ্যান্ডেল, অন্যজন বুড়োর শতছিন্ন কালো গেঞ্জির গলা। আর একজন হিন্দি মিশ্রিত বাংলায় আমাদের বলে, " এটা এই রুটের গাড়ি নয়। নেমে যান, ঐ গাড়িতে বসুন।" বাজার ব্যাগ হাতে দম্পতি সুড়সুড় করে নেমে যায়। গিটার হাতে মেয়েটি আর আমি মুখ চাওয়াচাওয়ি করি। এই ভীমভবানী দুটো ব্যাগ আর ভিজে ছাতা নিয়ে নামা বেশ কষ্টের। 


ভাবতে ভাবতেই একটা ছেলে এগিয়ে এসে টোটোর চাবি খুলে নিতে যায়। এতক্ষণ দুর্বল তর্ক করা বৃদ্ধের গায়ে হঠাৎ যেন সওয়ার হয় সহস্র সিংহের বল, " আব্বে চল, কালকে ছোকরে -" বলে গেঞ্জির গলা চেপে ধরা ছেলেটার হাত মুচড়ে, টোটোর হ্যান্ডেল চেপে ধরা ছেলেটার গালে সপাটে এক চড় মেরে ছুটিয়ে দেয় গাড়ি। পিছন পিছন দৌড়োয় তিন লাল গেঞ্জি, বর্ষিত হয় অসংখ্য "চ" ওয়ালা শব্দ, কিন্তু আমরা ততক্ষণে সব ধরা ছোঁয়ার বাইরে। 


শৌভিকের ভবিষ্যৎবাণী মিথ্যে প্রমাণ করে পৌনে তিনটের মধ্যে পৌঁছে যাই গন্তব্যে। নামার সময় বুড়োকে বলি, "ভাগ্যে তুমি গাড়ি ছেড়েছিলে দাদা, নইলে এখনও বসে থাকতে হত ওদের টোটোয়।" বুড়ো হেসে বলে, " ঘুরিয়ে গালি হামিও দিতে পারতাম দিদি, তুমাদের দুজনের জন্য দিই নাই। মেয়েদের সামনে গালি দিতে হাম শিখা নাহি।" 


বুড়োকে 'খুব ভালো থেকো' বলে, গুটি গুটি এগোই দেবুর বাড়ির দিকে। দেবু  আমার ছোট্টবেলার ইস্কুলের বন্ধু। আমাদের গলির উল্টোদিকে বিশাল খাঁয়েদের বাড়ি। আমাদের সাবেকি মহল্লার অন্যতম অভিজাত পরিবার ওরা। খুব ছোটবেলায় একবার এসেছিলাম ওদের বাড়ি জেঠু আর জেঠিমার সাথে। কার যেন অন্নপ্রাশন ছিল।  ধূসর হলেও সেই স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে বিশাল সিংহদুয়ার, চক মেলানো উঠান, উঠানকে ঘিরে গথিক প্যাটার্নের বাড়ি, বার্মাটিকের সাবেকি আসবাবপত্র। সেই বিশাল বাড়ি আপাতত ভাগ হয়েছে নানা শরিকে, অনেকেই বদলে ফেলেছেন তাদের প্রাক্তন রূপ, বদলায়নি কেবল দেবুদের অংশটা। আমার বাবার মতই, কাকু অর্থাৎ দেবুর বাবাও বাঁচিয়ে রেখেছেন সাবেকিয়ানাটুকু। নাই ডুবুক ঘটি, তাও তো তালপুকুর।


রাজপথ থেকেই উঠে গেছে চারধাপ সিঁড়ি, সিঁড়ি দিয়ে উঠে একফালি লম্বা রোয়াক, রোয়াকের ওপর গাঢ় খয়েরি রঙের ভারী দরজা। দরজার পাশে একটা ঝলমলে পোশাকের দোকান। দোকানটা নতুন হয়েছে। আগে এটাই ছিল কাকু অর্থাৎ দেবুর বাবার ওষুধের দোকান। দেবুর ঠাকুমার নামে দোকানের নাম ছিল রাধা, ফার্মেসি না মেডিক্যাল আজ আর মনে নেই। আমাদের মেয়েবেলায় এই গোটা চত্বরে একটাই ওষুধের দোকান ছিল। ডাক্তারও ছিলেন একজন, ডঃ দলুই। আমার পিসতুতো ভাই বলত 'দৈলে ডাক্তার '। আদতে তিনি ছিলেন হাড়ের ডাক্তার, তবে জ্বর, জ্বালা, পেটখারাপ সবেতেই সবাই ভিড় করত ওনার চেম্বারে। তারপর ওনার প্রেসক্রিপশন নিয়ে সোজা রাধায়। উঁচু চৌকাঠ ডিঙিয়ে একটা মস্ত ঘর, ছাদ জোড়া কড়ি আর বরগা আর দেওয়াল জোড়া কাঁচ লাগানো কাঠের আলমারি। আলমারি ভর্তি ওষুধ।ঘরটাতেও ছিল একটা ওষুধ ওষুধ গন্ধ। একটা আধ মানুষ সমান মস্ত কাঠের পার্টিশনের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকতেন কাকু, গেলেই জুড়তেন গল্প। সবথেকে বেশী ভাব ছিল আমার পিসির সঙ্গে। বুড়ি পিসি আজও বলছিল,' দীননাথের বাড়ি যাবি! খুব ভালো ছিল রে ছেলেটা। নিজের দিদির মত ভালবাসত আমায় -"।


মিহি বৃষ্টির স্পর্শে শৈশব থেকে বাস্তবে ফিরি, ভারী কাঠের দরজা ঠেলে ঢুকি খাঁয়েদের বৈঠক খানায়।সেই উঁচু করিবড়গা ওলা ছাত, সাদা ধপধপে চুনসুরকির মোটা দেওয়াল। মেঝেতে ফরাশ পেতে বসেছে তারাদের জমজমাট আড্ডা। আমাদের ইস্কুলের নাম ছিল তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবন, আমরা প্রাক্তনীরা আজও নিজেদের "তারা" বলে পরিচয় দিতে অত্যন্ত শ্লাঘা বোধ করি। চৌকাঠ ডিঙানোর সাথেসাথেই পড়ে যায় শোরগোল, "এত দেরী করলি কেন?" জুতো খুলে, ভারী ব্যাগটা রেখে, জমিয়ে মাটিতে বসতে বসতে বলি, " বলছি, বলছি সব বলছি। আগে বলতো ব্যাটারা, আমায় ফেলে খেয়ে নিসনি তো?"


ছবিতে - এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যা নামার মুখে দেবুদের সাবেকি বাড়ির দোতলায় আমরা

অনির ডাইরি ১২ই জুলাই, ২০২৫

#অনিরডাইরি 


সময় বড় অমূল্য। মুঠোয় ভরা বালির মত কোথা দিয়ে যে হারিয়ে যায় ব্যাটা। বুকের মধ্যে রেখে যায় এক অচেনা ধড়ফড়ানি। এক কাপ কালো কফি নিয়ে বসেছি মেয়ের রুটিন বানাতে। স্কুলের নয়, বাড়িতে পড়ার রুটিন। দিন বারো হল তিনি নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছেন। মাস পুরোলেই তাঁর ষাণ্মাষিক পরীক্ষা, বিশাল তার সিলেবাস, কি যে করবে মেয়েটা ভেবে আমার হাত পা পেটে ঢুকে যাচ্ছে। 


যা হোক একটা বানিয়ে, তাঁকে বুঝিয়ে উঠতে উঠতেই বেজে গেল বেলা সাড়ে নয়। এখনও স্নান, পুজো, প্রাতরাশ কিস্যু হয়নি। এদিকে সাড়ে দশটায় বেরোনোর কথা, এগারোটা নাগাদ শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনে অপেক্ষা করবে সুকন্যা। আজ আমাদের আধিকারিক সংগঠনের বার্ষিক অধিবেশন। ভেবেছিলাম শাশুড়ি মাতার দেওয়া ঘি রঙের সিল্কের শাড়িটা পরে যাব, কিন্তু গত সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে সেই পরিকল্পনা ত্যাগ করেছি। গোটা মহানগর জুড়ে বিস্তৃত হচ্ছে মেট্রোরেলের জাল আর সেই সৌজন্যে আমাদের বাড়ির সামনে পচপচ করছে মাটি আর কাদা। কি যে পরি, গাঢ় রঙের গোটা দুই শাড়ি বার করে রাখি, শেষ সিদ্ধান্ত আমার বর নেবে। শৌভিককে গোটা দুয়েক শাড়ি দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলে ও ঠিকঠাক বলে দেয়, তবে তার বেশি দেখালেই মাথা চুলকায় আর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। রেগেও যায় অনেক সময় -


বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে, রান্নার দিদি বার দুই জিজ্ঞাসা করল, " কি রান্না হবে বৌদি? মাছ তো নেই -"। মাছ আনতেই তো গেছে আমার বর, সেই সাত সকালে থলে হাতে নাচতে নাচতে। মাছ দেখলে পাগল হয়ে যায় লোকটা, প্রচুর দরাদরি করে, তারপর একগাদা বিভিন্ন রকমের মাছ কিনে আনে। আজ এত দেরী হচ্ছে মানে নির্ঘাত মাছ কেনার সাথে সাথে শরীরচর্চাটাও করে নিচ্ছে, হাঁটতে হাঁটতে গেছে দূরের বড় বাজারে। 


স্নান করতে যাবার আগে বাবাকে ফোনটা করে নিই। নানা কারণে বিগত সপ্তাহ থেকে খুব বিমর্ষ আছে বাবা, তাকে খানিক ভোকাল টনিক খাওয়াই। বয়স হয়ে গেলেই কেন যে মানুষ এত অসহায় বোধ করে। দুই তিন রকম মাছ নিয়ে বাড়ি ফেরেন আমার বর। " আজ দুবেলাই মাছ ভাত হোক, ওবেলারটা তুই রাঁধবি" গদগদ হয়ে বলেন তিনি। স্নান সেরে বেরোতেই সাড়ে দশ, এখনও পুজো, প্রাতরাশ, তৈরি হওয়া কত কিছু বাকি। মনখারাপ করে ব্যাচের গ্রুপে সুকন্যাকে মেসেজ করি, " তুমি চলে যাও, আমি যে কখন বেরোব -"। 


জবাবী মেসেজ আসে, " আরে চাপ নিও না। আমি এখন ছেলের টিফিন পৌঁছাতে যাচ্ছি সল্টলেক, আমারও অনেক টাইম লাগবে।" সরস্বতী মেসেজ করে, " আরে টেনশন করিস না। আমি সবে হাসপাতালে এসেছি শ্বশুরমশাইকে দেখতে, আমারও পৌঁছাতে বহু দেরী।" মনটা ভালো হয়ে যায়, সাধে আমাদের তিনজনের এত মিল। 


অবশেষে বেরোলাম বটে, রাস্তায় অকথ্য জ্যাম। মেট্রো স্টেশনে পৌঁছে দেখি সেন্ট্রাল স্টেশনে কেউ আত্মহত্যা করেছে, আপাতত স্তব্ধ কলকাতার জীবনরেখা। ভাগ্যিস সুকন্যা ছিল - । 


আড্ডা গল্প, ভুরি ভোজে দিনটা কিভাবে যে কেটে গেল। একসাথে অনেকটা পথ হেঁটে মেট্রোয় উঠলাম প্রায় জনা পঁচিশ জন। কে যেন হেসে বলল, একটা কামরা রিসার্ভ করে নিলে মন্দ হত না।পৌনে পাঁচটা নাগাদ বাড়ি ফিরে দেখি এরা বাপমেয়েতে বাতনুকূল যন্ত্র চালিয়ে মহানন্দে দিবানিদ্রা যাচ্ছে। সন্ধ্যা নামার আগে বাড়ি ফেরায় শাশুড়ি মাতা অবশ্য বেপোট খুশি - । 

সন্ধ্যার চা বানাতে গিয়ে দেখি, আমার সাধের কাপের সেটের একটি কাপ ভাঙা। বছর ছয়েক আগের বিবাহবার্ষিকীতে সেটটা উপহার হয়েছিলেন স্বর্গীয় শ্বশুরমশাই। এতদিন তুলেই রেখেছিলাম সেটটা, কেন যে বার করতে গেলাম। আয়াদিদি নিজেও অত্যন্ত লজ্জিত, বার বার বলছেন, " খুব ভুল হয়ে গেছে দিদি, একটা টানতে গিয়ে আরেকটা পড়ে গেল-"।


 একরাশ মন খারাপ নিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। বুকের কাছে ঝনাৎ করে কি যেন পড়াতে ভেঙে গেল ঘুমটা। চোখ খুলে দেখি ঠাকুরের মিছরি। তিনদিন ধরে তাকে আনতে বলছি, আর তিনি বলছেন, " কেন তুই রাস্তায় বেরোস না? তুইও তো আনতে পারিস -"। 'তুমি, না আমি'র চক্করে কাল থেকে উপোসী থাকতে হত ঠাকুরকে। বুঝতে বাকি থাকে না, নেহাৎ আমার মন খারাপ, তাই এনে দিল -


ঘড়িতে সন্ধ্যা সাতটা, ঘুম চোখে ফ্রিজ থেকে মাছ বার করি। হে ভগবান এতো পুরো পাথর হয়ে আছে প্রভু। সময়মত বর বাচ্ছাকে খেতে দিতে পারব তো -। "গরম জল ঢেলে দে না" পেছন থেকে বিশেষজ্ঞ মতামত দেয় আমার বর। ঘুমটা এখনও কাটেনি, টলমল করছে মাথা, তাও পড়তে বসাই মেয়েটাকে। আমি গর্বিত বাংলা মিডিয়াম, পলিনেশন এন্ড ফার্টিলাইজেশন পড়াতে গিয়ে বারবার পরাগ, পরাগরেণু, পরাগধানি বলে ফেলি আমি। গর্ভমুণ্ড শুনে হেসে গড়িয়ে পড়ে তুত্তুরী - ।


এনভায়রনমেন্ট অ্যাপ্লিকেশন পড়াতে পড়াতেই বেজে যায় সাড়ে আট। মুঠোয় বালি ধরার অনুভূতিটা পুনরায় ফিরে আসে আমার বুকের মধ্যে। হে ভগবান এখনও কত কাজ বাকি, আলুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে চিপকো আন্দোলন বোঝাই আমি। ভাতের হাঁড়ি চড়াতে চড়াতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে দারিদ্র্যের সম্পর্ক খোলসা করে বলি আমি। তাও যেন হয় না। মাছের কড়া চাপিয়ে দৌড়ে যাই তার কাছে, যার আমি অর্ধাঙ্গিনী, যিনি ঘণ্টা দেড়েক আগে মিছরির প্যাকেট ছুঁড়ে আমার ঘুম ভাঙিয়ে ছিলেন, তাঁর কাছে। তিনি আপাতত বাতানুকূল যন্ত্র চালিয়ে জমিয়ে ইংক ব্ল্যাক হার্ট পড়ছেন। গিয়ে বলি, " ওগো প্লিজ একটা উপকার করে দাও। আমি তোমার জন্য বেগুন, কালো জিরে আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে পাতলা মাছের ঝোল বসাচ্ছি, তুমি প্লিজ মেয়েটাকে একটু ডাইরেকটিভ প্রিন্সিপলস অফ স্টেট পলিসিটা পড়িয়ে দাও।" 


তিনি একগাল হেসে জবাব দেন, " কাল পড়িয়ে দেব বেশ।" বলি মেয়েটা যে ফেল করবে পরীক্ষায়, তিনি সাধুসন্তের মত প্রবচন দেন," আরে পাশ তো সবাই করে। ফেল কে করে বলতো? ঐ একজন দুজন, ভাব ও সেই একজন দুজনের মধ্যে থাকবে-"। এই কথার কি জবাব দিই আমি।এই কথার কোন জবাব হয়? হয় না। তবে বেগুন - কালো জিরে - কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মাছের ঝোলে হিং, দারচিনি আর ছোট এলাচ তো দেওয়াই যায়, একটু বেশী করে। বিশেষ করে তার জন্য, যে এগুলো দুচক্ষে দেখতে পারে না -।


অনির ডাইরি ১০ই জুলাই, ২০২৫


#অনিরডাইরি 

অবশেষে ট্রেন পেলাম। ঝাড়া আধ ঘন্টা পুতিগন্ধময় দাশনগর স্টেশনে পায়চারি করার পর। মাইরি,এর জন্য সাতসকালে উঠে কাকস্নান সেরে, নাকে মুখে গুঁজে দৌড়ে আসা? বিগত আঠারো বছরে স্টেশনটার অনেক পরিবর্তন হয়েছে, নতুন প্লাটফর্ম হয়েছে, পুরান প্লাটফর্মগুলো দৈর্ঘ্যে এবং উচ্চতায় বেড়েছে, নতুন সিঁড়ি, বসার জায়গা, শৌচালয়, পানীয় জলের কল সব হয়েছে। শুধু পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমটা একই আছে। আগেও কোন ঘোষণা হত না, আজও হয় না। হুড়োহুড়ি করে ফাঁকা ট্রেনে উঠে সিট দখল করে খেয়াল হল, একবার শুধিয়েই নিই, মেদিনীপুর লোকাল এত ফাঁকা কেন!


ওঃ হরি, এটা আমতা লোকাল। যে দিদিমনিকে শুধিয়েছিলাম, তিনি সাবধান করলেন, "এখনি ছাড়বে, নামতে যাবেন না। রামরাজাতলায় নেমে যাবেন।" দক্ষিণ পূর্ব রেলের ওপর ভরসা রেখে নেমেই পড়লাম, পিছন পিছন আরেক ভদ্রমহিলাও নামলেন। নেমে চোখে চোখ পড়তেই একগাল হেসে শুধালেন, " কোথায় যাবে দিদি?" সাতসকালে এই জঘন্য নোংরা ইস্টিশনে দাঁড়িয়ে খেজুরে গল্প করতে একদম ইচ্ছে করছে না, কেজো গলায়, " মেছেদা" বলে সরে গেলাম। 


ভদ্রমহিলাকে দেখেই মনে হয়েছিল গপ্পে বুড়ি, কর্মক্ষেত্রেও দেখলাম আমার অনুমান নির্ভুল। কপাল বৈগুণ্যে তিনি আমার ট্রেনেই উঠলেন এবং গুঁতোগুঁতি করে আমার পাশেই বসলেন। " মেচেদায় তোমার বাড়ি দিদি?" ঘাড় নেড়ে বললাম, নাহ্ আপিস। অযাচিত ভাবেই জানালেন, ওনার বাড়ি মেদিনীপুর লাইনে একটা ছোট স্টেশনে। স্টেশনে নেমে আগে হাঁটতে হত, এখন টোটো যায়। ওনার শ্বশুরবাড়ি গাঁয়ের খুব সম্ভ্রান্ত পরিবার। গোপাল আছে, তিনি মন্দিরে অধিষ্ঠাত। তাঁর নিত্য সেবা করতে হয় শরিকদের। 


"আমি আর পারি না দিদি, মূল্য ধরে দিই।শ্বশুরশাশুড়ি যতদিন জীবিত ছিলেন, অনেক করেছি। এখন গিয়ে বামুন ঠাকুরকে টাকা দিয়ে আসি। তিনিই ফল দুধটুধ কিনে পুজো করেন।" সস্তার কাপড়ের ব্যাগ থেকে বেরোয় একটি বিবর্ণ সাদা প্লাস্টিকের কৌটো, কৌটোর ওপর লেখা রেস্টুরেন্টের নামটা বিবর্ণতর। কৌটো ভর্তি মুড়ি, " খাবে দিদি? খাও না?" সভয়ে মাথা নাড়ি। আমি ট্যালা বটে, এতটাও নয়।


 ভদ্রমহিলা নিজেই একগাল মুখে দেন, খানিক চিবোন তারপর বলেন, "এই কাজটা নতুন, তাও একটা দিন ছুটি করতে হল -"। এত বোর হচ্ছি যে ভাবছি কি করি, ঘুমের ভান করে পড়ে থাকি, নাকি কানে হেড ফোন গুঁজে বসি। 


হে ঈশ্বর, কার মুখ দেখে যে আজ বেরিয়েছি, না আছে ব্যাগে হেড ফোন, মটকা মেরে থাকলেও ইনি ডেকে কথা বলছেন। কত কিছু যে জেনে ফেললাম উলুবেড়িয়া আসতে আসতে। ভদ্রমহিলার শ্বশুরমশাই হোটেলের রাঁধুনী ছিলেন, উনি রান্নাবান্না যা শিখেছেন স্বর্গীয় শ্বশুরমশাইযের থেকেই শিখেছেন। স্বর্গীয় শ্বশুর লোকটি দেবতুল্য ছিলেন, জীবনে মদ বিড়ি সিগারেট কিচ্ছু স্পর্শ করেননি। পরনারীর দিকে চোখ তুলে তাকাননি। সবটুকু পুষিয়ে দিয়েছে অবশ্য ওনার ছেলে, ভদ্রমহিলার সোয়ামী। "দুটো ছোট বাচ্ছা সমেত আমায় ফেলে চলে যায় দিদি, কি কষ্ট করে যে বাচ্ছাদের মানুষ করেছি --"। বলতে বলতে চোখ মোছেন ভদ্রমহিলা। 


সাতসকালে এই কান্নাকাটি, ফ্যাঁচফ্যাঁচানির ভয়টাই আমি পাচ্ছিলাম। এত বছরের পাবলিক সার্ভিস, কম মানুষের সাথে তো মিশিনি, সমস্যার গন্ধ আমি দূর থেকে পাই। মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা, হাত ভর্তি শাঁখাপলা, সিঁথি ভর্তি ডগডগে সিঁদুর, সস্তার সোয়েটের টিপ, ছিট কাপড়ের রং জ্বলা সালোয়ারকামিজ, মুখ চোখে জেবড়ে বসা কালিমা, আর "হৃদয়ের কথা কহিতে ব্যাকুল" মনোভাব আমার কাছে অন্তত বহুক্ষণ আগেই প্রকাশ করেছে ওনার পরিচয়। 


"এক ডাক্তার বাবুর বাড়িতে কাজ করতাম দিদি। কাজ করতে করতে আমি নিজেও অনেক ডাক্তারি শিখে গেছি -"। বলতে বলতে হেঁহেঁ করে হাসেন মহিলা। " চার বছর ছিলাম ওদের বাড়ি, ওনার বাবা খুব অসুস্থ, শয্যাশায়ী, নাক দিয়ে নল ঢুকিয়ে খাওয়াতে হয়। সব আমি করতাম। ডাক্তার বাবু আর বৌদি আমায় ভালবাসত কত! সেই কাজ ছেড়ে দিলাম -, কেন বল তো? আমার মেয়ে একদিন রাতে হঠাৎ এসে হাজির হল দুটো বাচ্ছা সমেত।  বরের সাথে ঝগড়া করে এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছে। তাদের আমি অতরাতে কোথায় পাঠাই? বুড়ি মাসিমাকে জিজ্ঞাসা করে, ওদের দুটি খেতে দিলাম আর রাতে একটু শুতে দিলাম। ব্যাস পরদিন ডাক্তারবাবুর বোন এসে আমায় কি কথা যে শোনাল দিদি, কি বলি -"। 


ডাক্তারবাবু কিছু বললেন না, শুধাই আমি। " উনি তো কলকাতায় থাকেন। মাঝে মাঝে আসেন। বাবামায়ের দেখাশোনা বোনই করে। আমার এত দুঃখ হল দিদি, যাদের জন্য এত করি, তারা আমার এত বড় বিপদে, এইটুকু করল না। পরদিন আমিও বেরিয়ে এলাম ওদের বাড়ি ছেড়ে -।"


"চুপি চুপি তোমায় বলি, বেরিয়ে এসে খুব ভয় পাচ্ছিলাম দিদি। যদি আর কাজ না পাই। ঠাকুরের দয়ায় এটা পেয়ে গেছি এই আর কি। বেতন ও ভালোই দেয়, এখুনি ছুটি করতে চাইছিলাম না, কিন্তু আমার মেয়েটা এত জ্বালাচ্ছে দিদি তোমায় কি বলব। "


তোমার মেয়ে আবার ফিরে গেছে তার বরের কাছে? জানতে চাই আমি। " না,না যেতে চাইলেও আমি যেতে দেব না।" এই প্রথম রাগতস্বরে কথা বলেন ভদ্রমহিলা। " তোমায় কি বলব দিদি, জঘন্য নোংরা লোক একটা -"। গায়ে হাত তোলে? আবার জিজ্ঞাসা করি আমি।  ভদ্রমহিলার মুখে ফুটে ওঠে অবিমিশ্র ঘৃণা। " আরে দিদি লোকটার বয়স প্রায় ষাট।"


মুখে অভাব আর সময় যতই বলিরেখা কেটে যাক না কেন,এই ভদ্রমহিলার বয়স মেরেকেটে পঞ্চাশ হবে। আর এনার জামাতার বয়স ষাট! তিতকুটে ঘৃণায় ভরে ওঠে আমার মন। মনের ছাপ বোধহয় মুখে পড়েছিল, ভদ্রমহিলা ঘাড় নাড়েন। জানতে চাই, " সম্বন্ধ করে?" উনি রেগে বলেন, " না, না। প্রেম।পনেরো বছর বয়সে উনি প্রেম করে পালিয়ে যান ঐ ঘাটের মড়ার সাথে। যার কত গুলো যে বিয়ে আর কতগুলো যে সম্পর্ক তার ঠিক নেই,জমিজমা ট্যাকাপয়সা কিস্যু নাই, ভাড়া বাড়িতে থাকে, কি কাজ করে ঠাকুর জানে, এমন মিনসের সাথে কেউ পালায় দিদি? তারপর দুই দুটা বাচ্ছা নিয়ে এখন ফিরে এসেছেন মায়ের ঘাড়ে। এখন নাকি তিনি আর এই লোকটার সাথে থাকতে পারছেন না। কি বলবে তুমি বল -"।


আমি আর কি বলব, ভদ্রমহিলা বলতে দিলে তো। "আমি বলেছি দিদি, প্রেম করার সময় মনে ছিল না? কোথায় বুড়ি মাকে তুই দেখবি, না আমাকে তোকে দেখতে হচ্ছে। তুমি বললি বিশ্বাস করবে না দিদি, বাচ্ছা গুলো হওয়া ইস্তক সব দায়িত্ব আমি পালন করে এসেছি। ওদের দুধ, হাগিস, জামাকাপড়, বইখাতা, ইস্কুলে ভর্তি করে দেওয়া সব আমি করেছি। সেই বইখাতা গুলো পর্যন্ত বরের ঘরে ফেলে এসেছে। একটা জামা কাপড় পর্যন্ত নিয়ে আসেনি। আমার ভালো সালোয়ার, নাইটি যা ছিল সব দিলাম। একটা বাড়ি ভাড়া করে রেখে এলাম, যে এখানে থেকে নতুন করে জীবন শুরু কর।" 


"বললাম, ভালো রান্না জানিস, ঠাকুরদার থেকে শিখেছিলি, তুই বরং লোকের বাড়ি রান্না করে খা। ও বাবা, বলে কিনা, রান্নার লোক আমি হবনি। আমি রুগী দেখব। রুগী দেখবে ও? রুগী দেখার কাজে হ্যাপা কম? আর চাইলেই সে কাজ পাবে কোথায়? কে রাখবে ওকে?" 


ট্রেন ঝমঝম করে রূপনারায়ণ পেরোয়। আড়মোড়া ভাঙি আমি, কোলাঘাট আসছে, এবার উঠতে হবে। ভদ্রমহিলা করুণ ভাবে আমার হাতটা চেপে ধরেন, " শোন না দিদি, কাল কি হয়েছে। নাতিনাতনী দুটোকে যে দিদিমণির কাছে পড়তে দিয়েছি, তিনি আমায় ফোন করে বললেন কি, যে, ' কাকিমা, তোমার মেয়ে এসে বাচ্ছাগুলোকে মাঝপথে নিয়ে চলে গেল।' আমি বলি, এ আবার কি। মেয়েকে ফোন করি, সে ধরে না। ধরে না। তারপর বলে কি, যে জামাই তাকে ফোন করে ডেকেছে, তার পরিচিত লোকজনের উপস্থিতিতে সালিশী করার জন্য। আমার মেয়ে তখন বলেছে, ঠিক আছে, তবে যা কথা হবে বাচ্ছাদের সামনে হবে। বলে বাচ্ছা গুলোকে পড়া থেকে টেনে নিয়ে গেছে ঐ সভায় -"। 


মানে? জানতে চাই, তোমার নাতিনাতনীর বয়স কত? " দশ এগারো। কি মিষ্টি ওরা দিদি কি বলব। পড়ালেখায় কি ভালো -"। আর তাদের পড়া থেকে তুলে নিয়ে গেছে বাবামায়ের নোংরা কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি দেখার জন্য? ভদ্রমহিলা এই প্রথম একজনের সমর্থন পেয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বললেন, " এই কথাটাই আমি বলেছি দিদি। বলল, না ওর বাচ্ছা তো ওর মতোই হবে।ওদের জানা দরকার ওদের বাপ কেমন -" 


গা গুলিয়ে ওঠে আমার, আর তোমার মেয়ের বাচ্ছা নয়? ঈশ্বর এদের কেন বাচ্ছা দেয় কে জানে। বলেই বুঝি অনধিকার চর্চা করে ফেললাম। জিভ কেটে সরি বলে উঠে পড়ি, এমনিতেই মেছেদা আসছে, ভদ্রমহিলা খপ করে ধরে ফেলেন আমার দুটো হাত, " সরি বলো না দিদি। আমিও এটাই বলি ঠাকুরকে। এদের তুমি কেন দাও ঠাকুর। কত মানুষ সারাজীবন চেয়েও সন্তানসুখ পায় না। আর এরা পেয়েও তার মর্যাদা দেয় না। বাচ্ছা মানুষ করার জন্য আমি যে কি করিনি তুমি জানো না। এমন অনেক কাজ করেছি, যা বললে তুমি ঘেন্নায় কুঁকড়ে যাবে, কিন্তু আমার কোন উপায় ছিল না দিদি। দুটো বাচ্ছা, বুড়ো শ্বশুর শাশুড়ির জন্য অনেক নীচে নেমেছি দিদি -"। 


এতবছরের অভিজ্ঞতা চিৎকার করে বলে আর একটু সময় পেলেই ভদ্রমহিলা তাঁর নৈতিক অবনমনের কথাটা বলে বসবেন। এবার আমি ওনার হাতে মৃদু চাপ দিই, বলি, যা করেছ বেশ করেছ। তোমার প্রিয়জনদের জন্যই তো করেছ? আর তোমার কাজের ফল অন্য কারো ওপর তো চাপাও নি? তাহলে কি? তুমি এখন যাও, গিয়ে নাতিনাতনি সামলাও। 


 আবেগে গলে পড়ে বলেন ভদ্রমহিলা, " আশীর্বাদ করো দিদি, যেন পারি। মেয়ের প্রতি আমার আর কোন দায়বদ্ধতা নেই। কিন্তু ওরা তো নিষ্পাপ শিশু। আমি খুব চেষ্টা করছি ওদের একটা হোস্টেলে ভর্তি করে দেবার।" ঝমঝম করে ট্রেন মেছেদা ঢোকে, হেসে হাত ছাড়িয়ে নিই আমি। এবার নামতে হবে, সামনে আবার অন্য যুদ্ধ।

Wednesday, 21 May 2025

অনির ডাইরি মে, ২০২৫

 অনির ডাইরি ৩১শে মে, ২০২৫ 

#অনিরডাইরি 


এই তো গতকাল বিকালের কথা, শনিবারের ভাতঘুম শেষে, এককাপ ধূমায়িত কফি হাতে, একরাশ সংকোচ সহ শৌভিক বলল, " আচ্ছা, আমরা যে কাল যাচ্ছি, ওনারা জানেন তো?" ওনারা অর্থাৎ আমার বৃদ্ধ মাতাপিতা। 


হতভম্ব হয়ে জানতে চাই, কেন তোকে ওরা যেতে বলেনি? শৌভিক ঘাবড়ে গিয়ে বলে,"না না, যেতে বলার দরকার নেই। শুধু জানতে চাইছি, ওনারা জানেন কি না।" বরকে আর কিছু বলি না আমি, বুঝি জামাইষষ্ঠীতে জামাইকে আসতে বলতে নির্ঘাত ভুলে বসে আছে আমার বুড়ো বাপমা। এমনিতে আমার বরের কোন জামাইসুলভ ঘ্যাম নেই, আমি বললেই যথেষ্ট, তবুও - 

 

ইদানিং প্রায়ই মনে হয়, তুত্তুরীর পাশাপাশী এই অশীতিপর দম্পতিরও মা হয়ে উঠেছি আমি। বিশ্বাস করুন, বাবা মায়ের বাবা-মা হয়ে ওঠাটা মোটেই খুব সহজ কাজ নয়। মায়ের মা হয়েই ফোন করি মাকে, " হ্যাঁ গো, কাল শৌভিককে যেতে বলো নি -"। একরাশ অভিযোগ নিয়ে ফোনটা ধরেছিল মা, " তোর বাবা আমায় এত কটু কথা শোনাচ্ছে -"। বলতে বলতে হঠাৎ থমকে যায়, " বলেছি তো। সেদিন যে বললাম রবিবার এসো বাবা।" 


সেদিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার, মাকে নিয়ে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দেখাতে হাওড়া গিয়েছিলাম আমি। আবহাওয়ার অবস্থা দেখে অফিস ফেরৎ আমাদের আনতে গিয়েছিল শৌভিক। সেদিন মা বলেছিল বটে, কিন্তু বাকি আলোচনায় চাপা পড়ে গিয়েছিল সেই নিমন্ত্রণ। আরেকবার ফোনে বলে দিতে বলে, শুধাই, বাবা তোমায় কটু কথা শোনায় কেন? জবাব আসে, " চা বসিয়েছি, তাই তোর ফোন ধরতে পারিনি। তাই -"। মায়ের ফোন ধরা আর বঙ্গলক্ষী লটারিতে প্রথম পুরষ্কার পাওয়া প্রায় একই, বর্ষীয়ান দম্পতির দাম্পত্য কলহে তাই আর ঢুকি না। 


সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে মহানগরের বুকে, এখনও কেনা হয়নি জামাইষষ্ঠী উপলক্ষে শাশুড়ির উপহার। সময় পেলাম কই। সকাল থেকে পরিকল্পনাই করে চলেছি দোঁহে, কি কেনা যায়। সময়াভাবে শৌভিক অনলাইন অর্ডার দেওয়ার পক্ষে। কয়েক বছর আগেও তিন তিনটে উপহার কিনতাম আজকের দিনে। উপহার মানে শাড়ি। জ্যাঠাইমার জন্য সাদা, মা আর পিসির জন্য উজ্জ্বল রং। বিশের বছর কেড়ে নিয়েছে আমার জ্যাঠাইমাকে। 


ঘড়িতে সন্ধ্যা সাত, এখনও ঠিক করে উঠতে পারিনি কি কিনব আমরা। শাড়িই কিনব কি? বেশি দেরি করলে বন্ধ না হয়ে যায় দোকানপাট। এতক্ষণ নির্বাক বসে থাকা শাশুড়ি মাতা হঠাৎ মৌন ব্রত ভঙ্গ করে বলে ওঠেন, " আজ আমাদের বিয়ের দিন -"। সুঁচ পড়লেও বুঝি শোনা যাবে এই মুহূর্তে। হতভম্ব হয়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকাই আমরা। জানি তো, কিন্তু শ্বশুরমশাইকে ছাড়া এটা যে ওনার প্রথম বিবাহবার্ষিকী। তাই মনে থাকা সত্ত্বেও কিছু বলিনি আমরা - 


নীরবে বসে থাকি আমরা। বৃদ্ধার মনে থাকল কি করে? এত বছর তো কোনদিনও মনে রাখেননি। এই নিয়ে বড় দুঃখ ছিল শ্বশুর মশাইয়ের। প্রায়ই বলতেন, " তোমাদের মায়ের কিছু মনে থাকে না -"। সত্যিই কিছু মনে থাকে না ওনার, নিজের বা শ্বশুরমশাইয়ের জন্মদিন, বিয়ের দিন, ছেলেদের জন্মদিন, নাতনীদের জন্মদিন কিচ্ছু না। বৃদ্ধের ও যে মনে থাকত, তা নয়, একটা ডায়েরিতে সব লিখে রাখতেন বৃদ্ধ। কাক ডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠেই উল্টাতেন সেই ডায়রির পাতা। তাই আমাদের জন্মদিন হোক বা বিয়ের দিন প্রথম ফোনটা শ্বশুরমশাই'ই করতেন। এমনকি জন্মদিনে আমার বাবাকেও প্রথম ফোনটা ওনারই হত।


শ্বশুরমশাইয়ের জন্যই সেলিব্রেট করতাম আমরা। সেলিব্রেশন আর কি, একটা কেক, একটু মিষ্টি। তুত্তুরীর হাতে আঁকা একটা ইকড়িমিকড়ি কার্ড আর স্মৃতিচারণা ব্যাস এইটুকুই। তাতেই কি যে খুশি হয়ে যেত বৃদ্ধ। নীরবে অংশ নিতেন শাশুড়ি মাতা, কোনদিন দেখাতেন না কোন উচ্ছ্বাস। আর আজ - 


ঠিক এই গল্পই তো শুনিয়েছিল সদ্য মাতৃহারা এক বন্ধু কিছুদিন আগে। " জানিস অনি, আজ আমার বাবা মায়ের বিয়ের দিন। বাবাকে ফোন তো করেছিলাম, কিন্তু বিবাহবার্ষিকীর কথা কিছু বলিনি আমি। বাবার সাধারণত এইসব কিছু মনে থাকে না। সারাজীবন মাই মনে রেখেছে। আর আজ যখন মা নেই,বাবা বলল কি জানিস - বললে, ' আজ তো আমাদের বিয়ের দিন।'" কুশীলব ভিন্ন বটে, চিত্রনাট্য একই। উভয়েই মিস করছেন হারিয়ে যাওয়া জীবন সঙ্গীকে, যাদের কখনও ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দেননি যে ভালোবাসার তীব্রতা উভয়পক্ষেই এক সমান। কেন যে দেননি, কেন যে মানুষ সময় থাকতে বলে না - আমিও তোমায় ভালবাসি। 


শৌভিককে বলি একটু মিষ্টি নিয়ে আয়, আমি একছুটে কিনে আনি দুটো শাড়ি,বেশি দেরী করলে বন্ধ না হয়ে যায় দোকানপাট। তারপর চটপট বানিয়ে ফেলব অন্যরকম কিছু। ঘরোয়া ভাবেই হোক না আজ সেলিব্রেশন। জানি শ্বশুরমশাই নেই, থুড়ি তাঁর নশ্বর দেহটা নেই, কিন্তু তিনি আছেন তো বটেই। আশেপাশেই আছেন। এত বছরের ভালোবাসার বাঁধন কাটা কি এতই সোজা -।


অনির ডাইরি ২৭ মে, ২০২৫

#অনিরডাইরি 

"তোর পক্ষে কি আর মানুষ হওয়া সম্ভব নয়?" প্রশ্নকর্তাকে একটু আগেই বলেছি, বেশি না, মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের জন্য ধরে নিই তুই আমায় চিনিস না, আর আমি তোকে চিনি না। আর আমি অপ্রয়োজনে পরপুরুষের সাথে বার্তালাপ করি না। তারপর থেকে তিনি শুরু করেছেন, " কিন্তু আমি করি। এই যে পরনারীর হার, এটাকে আমি জানলা গলিয়ে ফেলে দিই - । এই যে চুলের ব্যান্ড কি বলে যেন স্ক্রাঞ্চি, এটাকেও ফেলে দিই -"। 


একে তো আমি চূড়ান্ত অগোছালো, হদ্দ কুঁড়ে, তারওপর বাড়িটাও হয়ে আছে যেন আস্তাকুড়। মহানাগরিক তিন কামরার ফ্ল্যাটে থেকে কখনও যদি সারাইসুরাইয়ের কাজ করিয়ে থাকেন তো বুঝতে পারবেন আমাদের বাড়ির অবস্থা আপাতত কি সাংঘাতিক।  যা গুচাই, যতটুকু গুছাই, অফিস থেকে ফিরে এসে দেখি সব লণ্ডভণ্ড। এই হট্টমন্দিরে আমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র যে কোথায় রাখি, তাই নিয়েই লেগেছে দাম্পত্য অশান্তি। সেই সন্ধ্যা থেকে, আর নেওয়া যাচ্ছে না বাপু - 


এর ওপর আছেন আমার গর্ভধারিনী। দাম্পত্য কলহে জর্জরিত, পথশ্রমের ক্লান্তিতে সম্পৃক্ত হয়ে রাতের রান্না বসিয়েছি এমন সময় তাঁর ফোন, " হ্যাঁরে তুই আমার ফোন টা রিচার্জ করে দিস নি? এই তো মেসেজ পাঠাচ্ছে ১৭ তারিখে রিচার্জ করার দিন ছিল -"। শাশুড়ি মাতা আজ দুধ রুটি দিয়ে উদর পূর্তি করে নিয়েছেন। রান্না কেবল আমাদের দুইজনের জন্য এবং রান্না খুবই সাদামাটা, চীজ ম্যাগী আর ডবল ডিমের পোচ। কিন্তু রান্না ঘরটার এমন অগোছালো দশা যে ঢুকেই কান্না পাচ্ছে। তার ওপর মায়ের ফোনে রীতিমত ব্যোমকে গিয়ে আমাজন ঘেঁটে দেখি, কই রিচার্জ করার রিমাইন্ডার তো দেয়নি। ফোন ও তো দিব্যি ঢুকছে, তাহলে হল কি? 


মা কেবল বলেই যাচ্ছে, " কিচ্ছু নড়ছে না। একটাও ছবি খুলছে না/রিল দেখতে পাচ্ছি না।" ভগবান এই ভদ্রমহিলাকে কেন যে আমি ফেসবুক একাউন্ট খুলে দিয়েছিলাম। রিল না ড্রাগ কে জানে। বাড়ির কাজ হচ্ছে বলে শ্রীমতী তুত্তুরীকে আজ প্রায় দিন দশেক হল পিত্রালয়ে রেখে এসেছি। উদ্ধারকর্তা হিসেবে তাঁকেই ফোন করি আমি। আমাজন তো বলছে এখনও একমাস বাকি রিচার্জ করতে, কেসটা কি বাঁধালেন ভদ্রমহিলা। ডেটা অফ করে বসে নেই তো? ফোন রিস্টার্ট করে, অনেক ঘেঁটে ঘুটে দেখা গেল তিনি সিম ম্যানেজার থেকে সিম ১ আর সিম ২ এর ফাংশন বদলে বসে আছেন।


যুগপৎ মা এবং বরের ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে তুত্তুরীর ফাঁকা ঘরে আলো নিভিয়ে বসে আছি আমি। মনে পড়ছে সারাদিনের হরেক স্মৃতি। অনেক দিন বাদে দেখা হল ছেলেটার সাথে।কর্মসূত্রে আলাপ হলেও খুব ভালোবাসি ছেলেটাকে, ভালবাসি ওর গোটা পরিবারটাকেই। তাই ছেলেটার, " কেমন আছেন ম্যাডাম"এর জবাবে,  শতেক প্রশ্ন করেছিলাম আমি, " তুমি কেমন আছ? মা কেমন আছেন? বউ কেমন আছে? ছেলে কেমন আছে? ছেলেটা কতবড় হল -"… ইত্যাদি প্রভৃতি। প্রতিটা প্রশ্নেরই সোৎসাহে জবাব দিয়েছে ছেলেটা। সাথে জানিয়েছে আরো অনেক খবর। ভাইয়ের বিয়ের খবর, জেঠু হবার খবর। 


আরেঞ্জড ম্যারেজ ছেলেটার। মেয়ে দেখতে গিয়ে জানতে পারে, হবু বউ বয়সে কয়েক মাসের বড়। অজ গাঁয়ের ছেলে হওয়া সত্ত্বেও বয়সের পার্থক্য জেনে পিছিয়ে আসেনি ছেলেটা। ফিরে এসে বাবাকে - মাকে জানিয়েছে সত্যিটা, সাথে এটাও জানিয়েছে বিয়ে করবে তো এই মেয়েটাকেই করবে, তবে বাবামায়ের আশীর্বাদ এবং অনুমতি সহ। ছেলেটির বাবা মা বিন্দুমাত্র আপত্তি করেনি, এটা শুনে ইস্তক গোটা পরিবারটার প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে গিয়েছিল।  


আজও মনে আছে ছেলেটা বলেছিল, " আমি তো তেমন লেখাপড়া শিখিনি ম্যাডাম, কিন্তু আমার বউ গ্রাজুয়েট। খুব ছোট বেলায় বাবাকে হারিয়েছে, লোকের কাছে চেয়েচিন্তে, বই মেগে এনে পড়েছে কিন্তু পাশ তো করেছে।" মেয়েটার ইচ্ছে ছিল সরকারী চাকরি করবে, শিক্ষিকা হবে। সব ইচ্ছা তো আর পূরণ হয় না। ঐ যে অনুপম রায় বলেছে না, "সব পেলে নষ্ট জীবন"। মেয়েটার ছোটবোনটা অবশ্য এত পড়াশোনা করার দিকে যায়নি। ষোড়শী হতে না হতেই পাশের গাঁয়ের সমৃদ্ধশালী পরিবার থেকে তার বিয়ের সম্বন্ধ আসে এবং দিদি জামাইবাবু দাঁড়িয়ে থেকে তার বিয়ে দিয়ে দেয়।


খবরটা শুনেই বলেছিলাম, কাজটা ঠিক করোনি বাপু। বেআইনি কাজ করেছ। নেহাৎ তখন আমি তোমাদের চিনতাম না, চিনলে আমি খোদ ডিস্ট্রিক চাইল্ড প্রোটেকশন ইউনিটকে খবর দিতাম। ছেলেটা বিস্তর মাথা চুলকে বলেছিল, " কি করব ম্যাডাম। বাপ মরা মেয়ে। আমার শাশুড়িটাও তো তেমন জবরদস্ত নয়। কেমন যেন ন্যালাক্ষ্যাপা -। আমাদের ওপর নির্ভরশীল।" 


আজ তাঁরও খোঁজ নিলাম, " তোমার শাশুড়ি মা কেমন আছেন?" ছেলেটা কিঞ্চিৎ বিমর্ষ হয়ে বলল, "শাশুড়ি মা তো আর নেই ম্যাডাম। মাস ছয় সাত হল -"। আমার হিসেব মত ভদ্রমহিলার বয়স কোনমতেই ৫০/৫২ র বেশী হতে পারে না। এত অল্পবয়সে কি ভাবে চলে গেলেন? ছেলেটা বলে, " বেশ কিছুদিন ধরেই মাথাটা ঠিক ছিল না। খড়গপুরে একটা আশ্রম আছে ওখানে দিয়েছিলাম। ওরা মাসে ৭ হাজার টাকা নেয়, খাওয়াদাওয়া, ওষুধপথ্য সব ওরাই দেয়। কিন্তু মাসে মাসে এত টাকা দেওয়া কি আমাদের মত ঘরে চাটটি খানি কথা বলুন ম্যাডাম। মাস সাতেক পরে ছাড়িয়ে আনি। এমনিতে ভালোই ছিল। কথা বার্তা ভালোই বলত। ফিরে এসে একাই থাকত। আমার বউ রবিবার করে গিয়ে থেকে আসত।  আমিও যেতাম, গিয়ে সপ্তাহের বাজার দোকান করে দিয়ে চলে আসতাম। বউ সোমবার আসত-।"  


"আর তোমার শালী -", মাঝ পথে কথা থামিয়ে জানতে চাই আমি। ছেলেটা বলে, " শালী যে কিছু করেনি তা বলব না। করেছে - রোজ রাতে রান্না করে দিয়ে আসত মাকে। তো সেবারে হয়েছে কি, আমার বউ রবিবার গিয়ে থেকে সোমবার ফিরে এসেছে। মঙ্গলবারও ওর কথা হয়েছিল মায়ের সাথে। বুধবার থেকে আর ফোন ধরে না। শুক্রবার প্রতিবেশীরা খবর দিল -। রাতে রান্না করে বোধহয় বাসন মাজতে যাচ্ছিল। তখনি পড়ে গিয়ে -।" 


মানে? আঁতকে উঠি আমি, " বুধবারে পড়ে গিয়ে মারা গেছেন, শুক্রবারে পড়শীরা দেখতে পায়?" ছেলেটি বিষণ্ন ভাবে মাথা নাড়ে। ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলি আমি, " আর তোমার শালী? সে রাতে খাবার দিতে যায়নি?" ছেলেটি ঢোঁক গিলে বলে, " শেষের দিকে আর খাবার দিতে যেত না। আসলে ম্যাডাম, আমার শাশুড়ি মা বিধবা ভাতা পেত তো। মাসে হাজার টাকা। তাতে কি একটা মানুষের পেট চলে আপনি বলুন? আমার ষাঁড়ু ভাইয়ের এতেই রাগ, শালীকে বলেছিল, ' ওরা তোমার মায়ের সব টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, ওরাই দেখবে। একদম আমাদের বাড়ির খাবার ওবাড়ি পাঠাবে না।' 


তুত্তুরীর ঘরের অন্ধকারে বসে এখনও ততোটাই কেঁপে উঠি আমি, যতটা খবরটা শুনে কেঁপেছিলাম। এক সম্পূর্ণ অপরিচিতা জননীর কথা শুনে। আহা সত্যিই কি পড়ে মরেছিলেন তিনি? নাকি বেঁচেছিলেন বেশ কিছুক্ষণ? আশা করেছিলেন শেষবারের মত এক ঝলক দেখবেন নিজের আত্মজাদের -। পথের পাঁচালীর ইন্দির ঠাকুরুনের শেষ মুহূর্তটার কথা কেন যে বারবার মনে পড়ছে আর ছাপিয়ে যাচ্ছে দুই চোখ। খুব সুসন্তান নই আমি, প্রায়ই রেগে যাই মায়ের ওপর, মেজাজ দেখাই, হাঁপিয়ে উঠি মায়ের আব্দারে, দু দুটি বাড়ির দায়িত্বে, কিন্তু এ অবহেলা যে  আমার স্বপ্নের অতীত। হে ঈশ্বর, মেয়ে হয়ে জন্মানোর অজুহাতে যারা ব্যস্ত থাকে নিজের সংসারে, অবহেলা করে নিজের বৃদ্ধ অসহায় জনক জননীকে, তুমি তাদের ক্ষমা করো। আর শৌভিক আর আমি যখন বুড়ো হব, প্লিজ একটা ভালো বৃদ্ধাশ্রম খুঁজে দিও আমাদের জন্য। শৌভিকের নাম করতে মনে পড়ল, অনেক হয়েছে। যাই পরপুরুষকে আবার ঘরপুরুষ বানাই। সে ছাড়া আর আছে কে -


অনির ডাইরি ২১ শে মে, ২০২৫

#অনিরডাইরি 


" হায় বৌদি, তুমি এই আয়নাটা ফেলে দিবে নাকি?" হতবাক হয়ে শুধায় মেয়েটা। দেখে আমাদের থেকে অনেক বড় মনে হয়, আসলে কিছুটা ছোটই হবে। রোদে জলে খেটে খাওয়া মানুষের ত্বকের বয়স বাড়ে একটু জলদি, আর এই মেয়েটা তো কোন সাজগোজও করে না। রং জ্বলা ম্যাক্সির মত কি যেন একটা পরে গলা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা। মাথায় বিবর্ণ একটা সুতির ওড়না হিজাবের মত পরা। আজ দুই সপ্তাহ ধরে দেখছি মেয়েটার এই এক সাজ। 


আয়নাটা আমাদের বিয়েতে পাওয়া উপহার। ফ্রেমটা ভীষণ সুন্দর দেখতে, কিন্তু কাঁচটার পারা উঠে গেছে জায়গায় জায়গায়। তাই নীচে নামিয়ে রেখেছি। মেয়েটা যেভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে, বলি, তোমার পছন্দ তো তুমি নিয়ে যাও না। মেয়েটা লজ্জা পেয়ে জিভ কেটে বলে, " আমি তো সাজগোজ করি না সোনা। লিয়ে গিয়ে কি করব?" 


বলি,কেন করো না। মেয়েটা হেসে গড়িয়ে পড়ে,প্রায় বধির শাশুড়ি মায়ের গায়ে ঠেলা দিয়ে বলে, " শুনতেছ কাকিমা, তোমার বউমা কি কয়? আমারে সাজতে বলছে। আমি বলে তালাকশুদা মেয়েমানুষ -"। মেয়েটা যে ডিভোর্সী আমি সত্যিই জানতাম না। বাড়ির গল্প খুব একটা করে না মেয়েটা, অবশ্যি আমার সাথে গল্প করার সময় ওর কোথায়। সেই কাক না ডাকা ভোর থেকে খাটতে বেরোয়, অনেক বাড়ি কাজ করে। কাজ বলতে বাসন মাজা, ঘর ঝাড়ামোছা, বাজার করা এইসব। দুপুর বেলা এক প্রস্থ কাজ সেরে বাজার থেকে ঝড়তিপড়তি সবজি দরদস্তুর করে কিনে বাড়ি গিয়ে রান্না করে, রান্না খাওয়া মিটলে টিউশনি করে, অনেক গুলো গুড়িগুড়ি বাচ্ছাকে আরবি পড়ায়। টিউশনি মিটিয়ে আবার বিকালের কাজে বেরোয়। বেশ বর্ণময় চরিত্র বলতে পারেন। 


স্বনির্ভর সবলা নারীদের আমি বরাবরই অনুরাগিনী। আর এতো শ্বশুরমশাই জীবিত থাকাকালীন ওনার বাড়িতেও কাজ করত, ফলে আমার সাথে সখ্য জমতে বেশি দেরী হয়নি। গল্পের বেশিটা জুড়ে থাকেন স্বর্গীয় শ্বশুরমশাই। মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে বৃদ্ধ কার হাতে জল খেয়েছিলেন এই নিয়ে একটা দ্বৈরথ আছে। ও বাড়ির ২৪ ঘণ্টার আয়া মাসি দাবী করেন, " মেসোমশাই আমার হাতে জল খেয়ি স্বর্গে গেছেন" আর এ বলে, "কাকু আমার হাতে পানি খেইয়ে তোমাদের বেহেশতে গেছেন।" 


 মাঝে মাঝে নিজের কথাও বলে মেয়েটা, যেমন সেদিন বলল, " আমি ইচ্ছে করে এত খাটি বৌদি, নিজেকে সুস্থ রাখার জন্য। যেদিন গতর চলবে না, আমারে যে দেখার কেউ নেই। আমার দুটো মেয়ে, তাদের বিয়ে দিয়েছি, আল্লাহ যেন আমারে তাদের বোঝা না বানায়।" 


 একদিন বলল, " এই যে সবজি দেখছ বৌদি, এই সব আমি বাড়ি গিয়ে রাঁধব। বাড়িতে আমার দিদি আছে, সেও এই আবাসনে কাজ করে, কিন্তু ঐ লোকের বাড়িতেই করে, নিজের বাড়িতে কুটোটাও লারে না। আমি না রাঁধলে, না খেয়েই বসে থাকবে।" একদিন বলল, " বাড়িতে দুটো কুমড়ো গাছ লাগাইছি বৌদি, কি সোন্দর দুটো কচি কুমড়ো ধরিচে। তবে ভাড়ার বাড়ি তো, গাছ লাগিয়ে সুখ নাই।" এইসব ছুটকোছাটকা বার্তালাপ থেকে মেয়েটার জীবনের খণ্ডচিত্র পাই আমি। আর দেখি এই ঘেন্না বিধ্বস্ত উপমহাদেশে দুই ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন অর্থনৈতিক স্তরের মহিলার মধ্যে কতটা চিন্তা ও চেতনার মিল।


মাঝে দুদিনের ছুটি নিয়ে দেশে গিয়েছিল মেয়েটা,বাবাকে দেখতে। যাবার দিন আমার সাথে দেখা হয়নি, আজ তাই জমিয়ে গল্প করার মুডে মাটিতে বসেছে মেয়েটা। ইশারায় বলি, সোফায় বস। শাশুড়ি মাতা এতক্ষণ গম্ভীর মুখে সোফায় বসে কাগজ পড়ছিলেন, চেনা মেয়েটার সাহচর্যে তাঁর মুখেও কিঞ্চিৎ হাসির আভা দেখা দেয়। মেয়েটা বলে, " সরি গো বউদি, তোমারে বলে যেতে পারিনি।" অসুবিধা হয়নি, শাশুড়ি মাতার আয়া মেয়েটি বড়ই কর্মঠ, দিব্যি সামলে দিয়েছে। জানতে চাই, তোমার বাবাকে কেমন দেখলে? মেয়েটি বলে, " বাবা? বাবা ঠিকই আসে। আমি বাবাকে দেখতে যাইনি তো বউদি, আমাদের বাড়িতে ঐ যে তোমাদের যেমন হরিনাম সংকীর্তন হয় না, অমনি আসর বসছিল। আমরা বলি মিলাদ। তাও যেতুম নি। বলেই দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার ছোট ভাইপোটা ফোন করে এমন আব্দার করতে লাগল। ছেলেটা আমায় বড় ভালোবাসে বৌদি। আমায় কি বলে ডাকে জানো, ' মেয়ে'। কদিন ধরে আমার সাথে লেউটে ছিল। এক দণ্ডের জন্য ও ছাড়ে নি। আজ ওকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে পালিয়ে এয়েছি, সমানে ফোন করছে আর কাইঁদছে, ' আমার মেয়ে কোথায় গেল ' করে।" 


হেসে বলি, তাহলে তো বাপু তুমি তোমার বাবাকেই দেখতে গিয়েছিলে। তা এই নতুন বাবাটার বয়স কত? জবাব আসে, ছয় বছর মাত্র। শুধাই কোথায় থাকেন তিনি? জবাব আসে হারোয়া। মেয়েটি গড়গড় করে বলে চলে, " এমন কিচু দূর লয় বৌদি, বাসে এক ঘন্টা। কিন্তু আমি তো বাসে চাপতে পারি না। অটো পাল্টে পাল্টে যাই। অনেক সময় লাগে। টাকাও খরচ হয় তেমন।" বলি, বাসে যাও না কেন? মেয়েটি হেসে কুটোপুটি হয়ে বলে, " বাসে উঠলেই আমি বমি করি গো। অটোতেও করি, তবে একটু কম।"


কথা বলতে বলতে উঠে পড়ে মেয়েটা। বুঝি সময় শেষ, এবার বাড়ি গিয়ে রান্না চড়াবে। বুড়ো আয়নাটার গায়ে মায়া মাখানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঠিক করে নেয় মাথার হিজাব। আবার বলি, আয়নাটা তুমিই নিয়ে যাও বরং। মেয়েটা জিভ কেটে বলে, " দূর কি হবে। আজ থেকে বাইশ বচ্ছর আগে আমার বিয়ে হয়েছিল, ওরা লোক ভালো ছেল না। আমার আব্বু শেষে গিয়ে আমার তালাক করিয়ে আনে। সেই সময় আমাদের পরিবারে আর একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায়। আমার বড় বৌদি, দুটো দুধের বাচ্ছা ফেলে গায়ে আগুন দিয়ে মরি যায়। আমি তখন সেই বাচ্ছা দুটোকে আপন করে নিই।" অবাক হয়ে বলি, তোমার দুটো মেয়ে - , মেয়েটা ৩২ পাটি বার করে বলে, " আসলে আমার ভাইঝি। কিন্তু আমি কোনদিন ওদের মায়ের অভাব বোধ করতে দিইনি। বাপেরও না। ল্যাখাপড়া শিখিয়েছি, বে দিয়েছি। আজ আমি মুক্ত।" 


মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে বলি, ভালোই তো। এবার নিজের কথা ভাব। তোমাদের সমাজে তো তালাক হওয়া/ বিধবা/ বিপত্নীক মানুষজন পুনর্বিবাহ করেই থাকে। বয়সটা কোন সমস্যাই নয়, আমার পরিচিত কিছু মানুষই করেছেন। বেশ ভালো আছেন। তোমাকেও নির্ঘাত অনেকে বিয়ে করতে চায়। রহস্যময় হেসে মেয়েটা বলে, "তুমি প্রথম নও যে আমার বিয়ে দেবার চেষ্টা করছ বৌদি। আর একজন ও উঠে পড়ে লেগেছিল কয়েক বছর আগে, কে বলো তো?" বেশ খানিকক্ষণ ঝুলে থাকে সাসপেন্সের পর্দা, তারপর হাসতে হাসতে বলে, " কাকিমা গো। কাকিমা। এই যে তোমার শাশুড়ি মা।"



অনির ডাইরি ১৯ মে, ২০২৫

#অনিরডাইরি 


ঘড়ি বলছে প্রায় পৌনে দুই। মাথার উপর দেদীপ্যমান মধ্যাহ্নের সূর্য, তবে গরম যতটা লাগার কথা, ততোটা কিন্তু লাগছে না। একরাশ ঘণ কালো মেঘ যখন তখন এসে ঢেকে দিচ্ছে সূর্যি মামার মুখমণ্ডল। 


 রাস্তাটা পেরিয়ে উবের ধরলে, পূর্ব অভিজ্ঞতায় দেখেছি অন্তত ৩০/৪০ টাকা কম বিল ওঠে। আজ বরকে সেকথা বলতে গিয়ে হাসির খোরাক হলাম। দীর্ঘ চার/সাড়ে চার বছর পূর্ব মেদিনীপুরবাসী আমি, নিজেকে বড় গ্রাম্য বোধহয় আজকাল। সংকুচিত ভাবে ড্রাইভারকে শুধাই, " ভাই এসি চালাবে তো?" বছর চার পাঁচ আগে মোটেই চালাতে চাইত না ভাড়া করা গাড়ির ড্রাইভার কুল। বললেই বলত অ্যাপে দেখানো ভাড়ায় নাকি এসি চলে না। ঝগড়া করলে নামার সময় ওয়ান স্টার দিত। তৎকালীন টুইটারে ভুরি ভুরি নালিশ করতাম, ফলাফল লবডঙ্কা। গিগ ইকোনমির এটাই তো মাধুর্য - 


আজ অবশ্য সে সমস্যা হল না। একে রবিবার, তায় গরমের আতঙ্ক ফলে পথঘাট প্রায় শুনশান। ট্রাফিক বাতির মৃদু শাসন মেনেও দুদ্দাড় করে ছোটে গাড়ি। আমাদের গন্তব্য কেওড়াতলা মহাশ্মশান। গতকাল ভোর রাতে চলে গেছেন শৌভিকের মেজ জেঠিমা। সকাল সকাল খবর পেয়েও যেতে পারিনি আমরা, কারণ একই সাথে ইলেকট্রিক আর রাজমিস্ত্রিদের ডাকা ছিল। দীর্ঘ সাড়ে চার বছরের অনাবাসে ফ্ল্যাটটা হয়ে উঠেছে হানা বাড়ি। কিছু কাজ না করালেই নয়। 


তাদের ঝটিতি বিদায় করে, প্রায় বধির শাশুড়ি মাতাকে খাইয়েদাইয়ে তবে বেরিয়েছি আমরা। জীবনে প্রথমবার শ্মশানে চলেছি আমি, বুকের মধ্যে কুয়াশার মত ছড়িয়ে পড়ছে মৃদু আতঙ্ক। ফাঁকা ভিআইপি রোড ধরে ছুটতে ছুটতে লেকটাউন থেকে বাঁ হাতের উড়ালপুল ধরে ইএম বাইপাস, মানিস্কোয়ার, সায়েন্স সিটি হয়ে মা ফ্লাইওভার। 


পথের দুধারে দিগন্তবিস্তৃত মাঠ আর ধান ক্ষেত দেখতে অভ্যস্ত আমার পূর্ব মেদিনীপুরিয়া চোখ ঝলসে যায় মহানগরের জৌলুসে। যতদূর চোখ যায়, কেবল বহুতল আর বহুতল। কি তাদের রূপ, কি তাদের চাকচিক্য। চলন্ত গাড়ি থেকে ঘাড় বেঁকিয়ে তল গুনতে গিয়ে বার বার পর্যুদস্ত হই আমি। চুপ করে বসে থাকে শৌভিক, হয়তো বুঁদ হয়ে থাকে শৈশবের কোন স্মৃতিতে। বহরমপুর থেকে যখন রাতারাতি সল্টলেকে বদলী হলেন শ্বশুরমশাই, শৌভিক তখন সপ্তম শ্রেণী। আর পাঁচটা বদলী হয়ে আসা সরকারী কর্মচারীর মতোই আবাসনের জন্য আবেদন করলেন শ্বশুর মশাই। জানা গেল পাওয়া যাবে বটে, কিন্তু এখুনি না। সময় লাগবে বেশ কয়েক মাস, এদিকে শুরু হয়ে গেছে নতুন শিক্ষাবর্ষ। তখন ঐ কয়েকমাসের জন্য ছোট ছেলেকে নিয়ে নিয়ে বহরমপুরের ভাড়া বাড়িতেই রয়ে গেলেন শাশুড়ি মা। শালকিয়ার পৈত্রিক বাড়ি থেকে অফিস করতে লাগলেন শ্বশুরমশাই আর শৌভিককে টেনে নিল তার সল্টলেক নিবাসী মেজজেঠু আর মামণি। দুই দিদির সাথে জেঠুর বাড়িতে কাটানো ঐ কয়েকটা মাস আমার বরের শৈশবের অন্যতম প্রিয় স্মৃতি। 


 পার্ক সার্কাস ফ্লাইওভার থেকে নেমেই বাম হাতে ডিএল খান রোডে ঢোকে গাড়িটা। ১৯৩২ সালে নির্মিত ধনধান্যে সেতু পেরিয়ে ডান দিকে বেঁকে যাই আমরা।এতক্ষণের মৌনতা ভঙ্গ করে , আমায় আলিপুরের ডিএম অফিস চেনায় শৌভিক। পেরিয়ে যায় একের পর এক সুদৃশ্য বাংলো। যার কোনটায় পুলিশের ডিজি থাকেন, তো কোনটায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার। চওড়া রাজপথ থেকে ডান দিকে বেঁকে তুলনামূলক সংকীর্ণ একটা রাস্তায় থামে আমাদের গাড়ি। 


নীল সাদা ধাতব দরজা দিয়ে দুরুদুরু বুকে ভিতরে প্রবেশ করি। শ্মশান শুনলেই গল্প উপন্যাস বা সিনেমার যে দৃশ্য ভেসে ওঠে, এক্ষেত্রে অন্তত বাস্তব তার থেকে একেবারেই আলাদা। প্রশস্ত প্রবেশদ্বারের একদিকে পার্ক করা আছে সারি সারি গাড়ি। অন্য দিকে রেলিং দিয়ে ঘেরা ছিমছাম একটা বাগান। রেলিংয়ের গা ঘেঁষে বসানো গোটা পাঁচেক নারকেল গাছের ছায়ায় বসে গল্প করছে অনেক মানুষ। কারো মুখে শোকের ছাপ নেই, নেই কারো চোখ ভেজা। এরা কি শবদেহের সাথেই এসেছে নাকি স্থানীয় মানুষ এই দুপুরে আড্ডা মারতে এসেছে, বুঝতে পারি না। তবে পরিবেশটা নিমেষে আমার মনের আতঙ্ক কিছুটা কাটিয়ে দেয়।


চতুর্দিকে পরিচ্ছন্নতার ছাপ, এত মানুষ তাও নেই কোন শোরগোল। বাঁধানো রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা গিয়ে বাঁ হাতে গোটা চারেক সিঁড়ি উঠলে একটা বিশাল ঘর। সেই ঘরেই পরপর শোয়ানো আছে মানুষগুলো। মাথার দিকে লোহার রড দিয়ে তৈরি একটা দেওয়াল। দেওয়ালের ওপারে দৃশ্যমান দু দুটো বৈদ্যুতিক চুল্লী। অর্ধবৃত্তাকার লোহার গেট দিয়ে বন্ধ। 


মেরুন বা বাদামী রঙের শাড়ি পরেছে মামণি, ম্যাচিং ব্লাউজ। পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল এখনও অনেকটাই কালো। ঠোঁটে মেরুন রঙের লিপস্টিক। বিগত পনেরো বছর ধরে পক্ষাঘাত গ্রস্ত মানুষটি আজ বাঁশের বিছানায় সাদা চাদর পেতে অকাতরে ঘুমাচ্ছে। মুখটা সামান্য ফাঁক, ঠিক যেমন করে ঘুমাচ্ছিলেন শ্বশুর মশাই, পাক্কা একবছর আগে। পঁয়তাল্লিশ/ পঞ্চাশ মিনিট লাগে নাকি একেকটা দাহ সম্পন্ন হতে। চুল্লী ফাঁকা হলে একদম বাম দিকে যিনি শুয়ে আছেন, তিনি প্রবেশ করবেন। ডান দিকে যাঁরা আছেন, তাদের সরিয়ে দেওয়া হবে এক ঘর। জাত/ ধম্ম/ অর্থ/ পারিবারিক পরিচয়/ প্রতিপত্তি এখানে এসে মিলেমিশে হয়ে যায় একসমান। 


সময় এগিয়ে আসে ক্রমশঃ,বর্ষীয়ান মণিকাকা হঠাৎ বলে ওঠে, " চল একটা প্রণাম করে আসি।" ঘুমন্ত মামণির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে ছোট দেওরের দল। মুঠো করে রাখা হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে চাপ দিতে থাকে ছোটদি। বড়দি হাত বুলিয়ে দেয় মুখে, গালে, মাথায়। এই তো শেষ বার। সময় আসন্ন জানিয়ে দেয় শ্মশান কর্মচারী ছেলেটি। স্নেহধন্য পালকপুত্র, ভ্রাতুষ্পুত্র, দেওরপো, ভাসুরপো, জামাইয়ের দল একে এক সরিয়ে দেয় বুকের ওপর জমা হয়ে থাকা ফুলমালার পাহাড়। মাথার তলা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় বালিশ। শ্মশান কর্মচারীর ইশারায় তোলা হয় মামণিকে। শোয়ানো হয় চুল্লীর সামনে, সবাইকে সামনে থেকে সরে যেতে বলে দূর থেকে লিভারটা তোলে ছেলেটি, পলকে লোহার দরজাটা উঠে গিয়ে বেরিয়ে আসে একরাশ লেলিহান গাঢ় কমলা রঙের অগ্নিশিখা। দুই হাতে চোখ ঢাকি আমি, স্মৃতিপটে ভেসে আসে কিছুকাল আগে মাতৃহারা এক বান্ধবীর কথা, "আমি কাঁদছি না বলে এরা ভেবে নিচ্ছে আমার কোন শোকবোধ নেই। বিশ্বাস কর অনি, আমিও কাঁদতে চাইছি। কিন্তু পারছি না। যতবার চোখ বন্ধ করছি একটাই দৃশ্য ভেসে উঠছে চোখের সামনে, গনগনে আগুনে ঢুকে যাচ্ছে আমার মা।" এই মুহূর্তে বহুদূরে থাকা, নাতনীকে জড়িয়ে সুখে দিবানিদ্রা রত এক মহিলার জন্য ডুকরে ওঠে মন। কেন যে এত অবহেলা করি মাকে, কেন যে এত বিরক্ত হই মায়ের ওপর, কেন যে আর একটু বেশি ভালবাসতে পারি না মাকে।

Friday, 11 April 2025

অনির ডাইরি এপ্রিল, ২০২৫

 অনির ডাইরি ১৪ই এপ্রিল, ২০২৫

#অনিরডাইরি 



এমন কখনও হয়েছে, আচমকা অপ্রত্যাশিত ভাবে অনেক, অনেকটা ভালোবাসা পেয়ে গেছেন? গাঁট গুণে বলতে পারি বটে, কতবার পেয়েছি, কিন্তু পেয়েছি। এমনিই কথা হত মেয়েটার সাথে, তখনও হোযাটসঅ্যাপ/ মেসেঞ্জার কিস্যু আসেনি। বার্তা বিনিময় বলতে এসএমএস,যার মূল্য ছিল এক টাকা/ প্রতি মেসেজ। আমরা কথা বলতাম ই-মেলে। সদ্য সদ্য ইমেল খুলেছিলাম সকলে, এমনিই ফরওয়ার্ডেড মেসেজ পাঠাতাম একে অপরকে।  তারই ফাঁকে ফাঁকে ওই আর কি,  কি রে কেমন আছিস মার্কা বার্তা বিনিময়।


সেটা প্রেম ভালোবাসার সময়, জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে পা দেব কি দেব না সেই নিয়ে দোদুল্যমানতায় ভোগার সময়। ততোদিনে পেশাগত ভাবে দাঁড়িয়ে গেছি আমরা, ফলে " আজকাল পাঁও জমি পে পড়তে নেহি মেরে -"। পুরো প্রজাপতির মত উড়ছি, ভালো মেয়ে, বাধ্য সুসন্তান হতে গিয়ে বঞ্চিত হয়েছি যে সব নিষিদ্ধ আনন্দ থেকে আশ মিটিয়ে পূরণ করছি সব শখ। ঝপ করে কোঁকড়া চুল সোজা করে ফেললাম একদিন। মা জেঠাইমার তো কপালে করাঘাত - এ কি হল। কেন হল ইত্যাদি। কিন্তু পিকচার যে তখনও বাকি। কিনে ফেললাম ছয় পকেট ওয়ালা জিন্স, পোশাকী নাম কার্গো। সেই যে ট্রায়াল রুম থেকে পরে বেরোলাম,আর ছাড়তেই চাই না। সর্বত্র আমার এক পোশাক। ছোট মাসি মাকে বলেই ফেলল, " ছোট দি, মেয়ে সামলা। একে বিয়ে করবে কে -"। 


এদিকে যে বিয়ে করবে, সে ফিসফিসিয়ে কয়, " এটা পরেই বিয়ে করো। আমিও তাই করব। ধুতি পরার বিড়ম্বনা থেকে তো বেঁচে যাব।" এই সবই লিখতাম মেয়েটাকে। সেও লিখত , কিন্তু সে সব গল্প হত বড় শৌখিন, বড় পরিমার্জিত। মেয়েটিও যে ভীষণ পরিশীলিত, আমার মত ধিঙ্গি নয়।  নিজের প্রগলভতা নিয়ে বেশ কিছুটা সঙ্কোচেই ভুগতাম বলতে পারেন। ভাবতাম আমাকে সহ্য করে কেবল, স্বপ্নেও ভাবিনি মেয়েটি আমাকে পছন্দ করে। সেদিন যখন তার ইমেলে ভেসে এল, " থ্যাংকস অনিন্দিতা। তুই আমার সবথেকে প্রিয় বন্ধুদের মধ্যে একজন। যেভাবে আমার দুর্দিনে পাশে ছিলি, আমি কোনদিন ভুলব না -। " আকাশ থেকে পড়লাম আমি, এই সফিস্টিকেটেড, সুন্দর মেয়েটা আমায় তার বেস্ট ফ্রেন্ডদের মধ্যে একজন বলল কি? কি করলাম আমি? ছাপোষা ইমেলের জবাবে, ছাপোষা মেসেজই তো পাঠিয়েছি। 


কি যে ভীষণ মূল্যবান মনে হয়েছিল নিজেকে, সেদিন থেকে সুকন্যা - সঞ্চিতা - পম্পা - নবনীতাদের পাশাপশি আর একটা বেস্ট ফ্রেন্ড বাড়ল আমার। তারপর কেটে গেছে প্রায় দুই দশক। ভৌগোলিক দূরত্ব মাইলের পর মাইল হলেও ফাটল ধরেনি আমাদের বন্ধুত্বে। ভালোবাসা যেন ওর দিক থেকেই বেশি। অবাঙালি, অ - হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও প্রতিটা বাঙালি উৎসবে মুঠোফোনে ফুটে ওঠে ওর শুভেচ্ছা। আমার জন্মদিন, বিয়ের দিন, তুত্তুরীর জন্মদিন - শুভেচ্ছা বার্তা আসবেই, আসবে। একদিন মেসেজ করে বলল, " ভালো বাংলা তো পড়তে পারি না অনি, কিন্তু তোর লেখা পড়ি। খুব ভালো লাগে। না পারলে, আমার বরকে দিয়ে পড়াই -"। কি বলব বুঝতে পারিনি, আর আমি? এত অপদার্থ যে মনে করে ব্যাটার জন্মদিনেও শুভেচ্ছা জানাতে পারি না। ভুলেই যাই, ভুলভাল তারিখে জানাই। ভাগ্যিস ভালোবাসা নিক্তি মেপে হয় না।


সম্প্রতি মাতৃহারা হয়েছে বন্ধুটি। অন্য বন্ধু মারফৎ খবর পেয়েও বুঝতে পারিনি কি করব। প্রায় সাড়ে আটশ কিলোমিটার দূর থেকে ছুটে যাওয়া প্রশ্নাতীত, তাহলে ফোন করব কি? ফোন করেই বা কি বলব, " আহা তোর মা -। নিজেকে সামলা,কাকুকে সামলা -"। বিশ্বাস করুন আমি বলে উঠতে পারিনি।পরিচিতদের গ্রুপে তুফান উঠেছে, সকলে জানিয়েছে,' ওনার আত্মার শান্তি কামনা করি ' বা 'শোক সন্তপ্ত পরিবারকে সমবেদনা জানাই। ',   অনেকের প্রিয়জন বিদায়ের মুহূর্তে আমিও তো এগুলোই লিখি, কিন্তু সেদিন কিছুতেই লিখতে পারিনি। কেমন যেন ঠুনকো মনে হচ্ছিল সব কিছু।


মাঝে একদিন দেখি কি যেন মেসেজ করে ডিলিট করেছে মেয়েটা। সাহস করে লিখি, তোকে কি বলব জানি না রে। এই শোকের কোন সান্ত্বনা হয় না। আশা করিনি জবাব আসবে, কিন্তু আসে, " সবাই মিলে বাবাকে ঠিক রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু মা আর নেই এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না রে।  চেষ্টা করছি স্বাভাবিক থাকার। তুই সাবধানে থাকিস। কাকু কাকিমাকে সাবধানে রাখিস।" মেসেজটা পড়ে সামলাতে পারিনি নিজেকে, প্রিয়জনের প্রিয়জন হারানোর বেদনা এত সংক্রামক কেন হয়। 


দুর্ঘটনার প্রায় দুই সপ্তাহ পর সাহস করে গিয়ে বসলাম বন্ধুর মুখোমুখি। কে যেন বলে গেছেন রাজদ্বারে, শ্মশানে পাশে না থাকলে সে বন্ধুই নয়। পলে পলে অনুভব করছিলাম, কতটা যথার্থ তিনি। আমি কারো বন্ধু হবার যোগ্যই নই। এতো এই সুন্দর সুশীল মেয়েটার মহানুভবতা, যে আজও আমার কুশল সংবাদ নিল। প্রশ্ন করব কি করব না ভাবতে ভাবতে  বোকার মত,  করেই ফেললাম, " কেমন আছেন কাকু?" মেয়েটা স্বাভাবিক ভাবে বললে, " এখন ভালোই আছেন। সেদিন একটু সমস্যা হয়েছিল -"। বুঝতে পারি কাকিমার মৃত্যুর দিন। 


বরাবরের শান্ত মিতভাষী মেয়েটাকে যেন আজ কথায় পেয়েছে, " সেদিন আসলে প্রচণ্ড প্রেশার বেড়ে গিয়েছিল, তাই মাথা ঘুরে গিয়েছিল। আসলে অর্ধ শতকের সঙ্গী তো, মা ভীষণ অসুস্থ ছিল, সবাই জানতাম আজ না হলে কাল দিনটা আসবেই। তাও -। ডাক্তার বলেছিল, আরও চেষ্টা করাই যায়, কিন্তু ওনার যা শারীরিক অবস্থা, কতটা নিতে পারবেন জানি না। আমি সেটাই বাবাকে বুঝিয়ে বললাম, যে মা আর নিতে পারত না। আমার কথাটা বোধহয় মাথায় ঢুকেছে জানিস। দেখলাম আত্মীয়স্বজন যাঁরা এসেছেন, তাদের বলছে, ' আর নিতে পারত না।'"

সাধারণত এই সব কথার পর নীরবতা বিরাজ করে, আজ যেন মেয়েটাকে কথায় পেয়েছে, " জানিস অনি, আমি জানতাম। আমরা সবাই জানতাম, মা আর বেশী দিন নেই। তাই মায়ের ভয়েজ রেকর্ড করে রাখতাম। যখনই মা ফোন করত, আমি রেকর্ড করে রাখতাম। কেবল ভয় হত, আর কটা দিন এই গলাটা শুনতে পাব কে জানে।" ওর চোখ শুকনো, আমারও, কিন্তু ভিতরে ভিতরে রক্তক্ষরণ হয়ে চলে। 


" আমার কাছে সব থেকে বড় সান্ত্বনা কি জানিস, আমি মাকে দেখতে পেয়েছি -"। তোকে চিনতে পেরেছিলেন, শুধাই আমি। মাথা নাড়ে মেয়েটি। " না রে। আমি যখন গিয়ে পৌঁছাই, মা তখন কোমায়। ভাই আমায় পাশ টা দিয়ে কি যেন কাজে চলে গেল। বলে গেল মা অনেকটা স্টেবল। আমি আইসিইউতে ঢুকে দেখি মায়ের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। নার্সকে ডেকে দেখালাম, এমন কেন হচ্ছে? সে কিছু বলতে পারল না। আইসিইউ এর ডাক্তার এসে আমায় বলল, ' আপনাদের তো বলা হয়েছিল ওনাকে ভেন্টিলেশনে দিতে। আপনারা রাজি হননি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ডিসাইড করে আমায় জানান।' ভাইরে আমি প্রায় ছয় শ কিলোমিটার দূর থেকে সবে গেছি, আমি কি ডিসিশন নেব? তাও পাঁচ মিনিটে? ভাই বলেছিল মায়ের ডাক্তার আলাদা করে নিষেধ করেছে, যে ভেন্টিলেশনে দিলেও আর কোন লাভ হবে না। সেটা জানা সত্ত্বেও আমি ঠিক থাকতে পারিনি। বললাম তাই দিন।" 


" মাঝরাতে ফোন এল, মায়ের অবস্থা খুব খারাপ, কি যেন একটা দিতে হবে। দিলেও কিছু হবে কিনা ঠিক নেই, কিন্তু ডাক্তার নাকি রেকমেন্ড করেছে। তখন আমরা কি বলব বল তো -"। এই পর্যন্ত শুনে, টেবিলের এপার থেকে ছুটে ওপারে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরি আমি। এই অসহায়তা আমার অপরিচিত নয়। মধ্যরাতে এমন ফোন আমার কাছেও এসেছিল। সেই সর্বগ্রাসী আতঙ্ক আর চূড়ান্ত অসহায়তা ভাষায় অপ্রকাশ্য। আমার বাহুবন্ধনে ভেঙে পড়ে মেয়েটা, এত ক্ষণে ধরে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা ধুয়ে যায় চোখের জলে।" আমরা কি বলব অনি? মায়ের সেন্স ছিল না, তাও পায়ে হাত বোলাচ্ছিলাম আমরা। আমি হাত দেওয়াতে প্রেশার একটু বাড়ল, ভাই যেই হাত বোলাল, প্রেশার আশি উঠে গেল। আমার ভাইটা বোকার মত জিজ্ঞাসা করছিল সকলকে, ' আমি কি মায়ের পায়ে হাত দিয়েই রাখব?' যদি মা থাকে, যদি আর কটা দিন থেকে যায়। আমরা বললাম দিয়ে দিন, যা দেবার দিয়ে দিন। বিশ্বাস কর, পাঁচ মিনিট পর ফোন করে বলল, " উনি নিতে পারলেন না।"


সময় যে কোথা দিয়ে কেটে গেল জানি না। উঠে পড়ি, আবার এতটা পথ উজিয়ে ফিরতে হবে। রাস্তা অবধি এগিয়ে আসে বন্ধু, বিদায়ী আলিঙ্গনের পর বলে, "কাকু কাকিমাকে যে নিজের কাছে নিয়ে গেছিস অনি, আর যেতে দিস না। যা পারিস, যতটা পারিস ওদের দিয়ে যা, করে যা। ভালবেসে যা। এ যে কি জিনিষ, যার হারায় সেই বোঝে। সব যেন কেমন শূন্য হয়ে যায় -" ।


অনির ডাইরি ১২ই এপ্রিল, ২০২৫

#অনিরডাইরি 


সবে সকাল হয়েছে, পূব আকাশে এক রাশ লালিমা ছড়িয়ে পড়লেও, এখনও উদয় হননি সূর্যদেব। বাতাসে মিষ্টি একটা শীতলতা, গাড়ির জানলার ফাঁক গলে আসা হাওয়ায় ঝিম ধরে যাচ্ছে আমার, ওদিকে গোমড়াথেরিয়াম হয়ে বসে আছে তুত্তুরী। কারণ আর কিছুই নয়, আজ মহাবীর জয়ন্তী, ক্যালেন্ডারে জ্বলজ্বল করছে লাল দাগ, অথচ ছুটি দেয়নি তুত্তুরীদের স্কুল। মোটেই আজকের দিনে ইস্কুলে আসার ইচ্ছে ছিল না তুত্তুরীর, গতরাতে এই নিয়ে অনেক অনুনয় বিনয় করেছিল আমাদের কাছে, যদি ছাড় পাওয়া যায়। আমি এক কথায় রাজি হয়ে গেলেও, পটেনি শৌভিক। ওকেও বেরোতে হবে যে, জেলায় মস্ত মিটিং আছে। 


বাবা বাছা বলতে বলতে, গায়ে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে এসে পড়ে মেয়ের স্কুল। গাড়ি থেকে নামার আগে তিনি বলে যান, " মা আজ কিন্তু তুমি আনতে আসবে - আর সঙ্গে তোমার থলথলে মাকেও নিয়ে আসবে। ফেরার পথে আইসক্রিম খাব কিন্তু।" 


দিদিমাকে আদর করে তিনি ওই সবই বলে থাকেন। আজন্ম কৃশকায়, আন্ডারওয়েট মা ইদানিং সত্যিই বেশ পৃথুলা হয়ে উঠেছে, নাতনীর সেটা বড়ই পছন্দ। সুযোগ পেলেই তিনি দিদিমাকে আক্রমন করেন এবং  ধামসান। এর আগে আমার এবং তুত্তুরীর যুগপৎ জোরাজুরিতে বার দুয়েক মা এসেছে, ছুটির পর নাতনীকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। ফেরার পথে মাথা গুণে বাড়ি শুদ্ধ সবার জন্য কিনে নিয়ে গেছে আইসক্রিম। আজও সেই আব্দার নিয়েই বাড়ি ফিরলাম।


কিন্তু আজ সে আব্দার সটান নাকচ হয়ে গেল। "আমি যেতে পারব না বাবা, আমার শরীরটা কেমন যেন আনচান করছে।" অকালে হার্ট ফেল হয়ে চলে গিয়েছিলেন মাতামহ, মায়ের এই শরীর আনচানকে আমি তাই বড় ভয় করি। পরশুই ডাক্তার দেখিয়ে এনেছি। পরীক্ষা নিরীক্ষা কিছু হয়েছে, কিছু এখনও বাকি। তাই আর জোর করতে পারি না। বাবাকে ধরি, " তুমি চল তাহলে -"। নাতনীর আব্দার ফেলতে অপারগ বাবা নিমরাজি হয়। অতঃপর শশব্যস্ত হয়ে মাকে বলে, " আমাকে এখুনি পাঁচশ টাকা বার করে দাও, আইসক্রিম কিনতে হবে -"। 


বৃদ্ধ বৃদ্ধার খুনসুটি দেখে হেসে বাঁচি না। শ্রীমতী তুত্তুরীর ছুটি হতে এখনও পাঁচ ঘণ্টা বাকি -। হাসতে হাসতে হাল্কা চালে শাশুড়ি মাতাকে জিজ্ঞাসা করি, " তুমি যাবে? নাতনীকে স্কুল থেকে আনতে? ফেরার পথে আইসক্রিম খাওয়াব -।" বিগত জানুয়ারী মাসে, ডান পায়ে পর পর দুটি বড় অপারেশন হয়েছে শাশুড়ি মায়ের। বসাতে হয়েছে ধাতব বল সকেট জয়েন্ট। আজও ভালো করে হাঁটতে পারেন না বৃদ্ধা। ওয়াকার নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোনমতে হাঁটেন। নাহ অস্ত্রোপচার জনিত কোন সমস্যা নেই, আপাতত সমস্যা হাঁটু জোড়াকে নিয়ে। মাস দুয়েক শয্যাশায়ী থাকার দরুণ হাল ছেড়েছে হাঁটু জোড়া। তিনি যে এক কথায় রাজি হয়ে যাবেন, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। 


সবথেকে খুশি বোধহয় আমার বাবা হল, যাক তাহলে বাবাকে আর যেতে হবে না। বাকিদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে অনাবিল আনন্দ। যে মহিলাকে ধমকে চমকেও হাঁটানো যায় না, নড়ানো যায় না, তিনি স্বেচ্ছায় নাতনীকে স্কুল থেকে আনতে যাবেন, এর থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে। 


ঘড়ির কাঁটার সাথে সাথেই চড়তে থাকে বৃদ্ধার উত্তেজনার পারদ, আমাকে অন্তত চার বার জিজ্ঞাসা করেন, " আচ্ছা এই পোশাকে যাওয়া যাবে তো? পোশাকটা অসভ্য নয় তো?" পোশাক বলতে ঘরে পরার সুতির নাইটি। পায়ের এই অবস্থা বলে শাড়ি আর ওনাকে পরতে দেওয়া হয় না। যাই হোক, বৃদ্ধাকে আশ্বস্ত করি, তুমি তো গাড়িতেই বসে থাকবে, আমি রাস্তা পেরিয়ে মেয়েকে নিয়ে ফিরে আসব। কে আর দেখছে। আর দেখলেই বা, এই পোশাকে ও দিব্যি সুন্দর লাগছে আমার স্বর্গীয় শ্বশুরমশাইয়ের প্রিয়তমাকে। 


ঘড়ির কাঁটা পৌঁছে যায় নির্দিষ্ট সময়ের ঘরে, টুকটুক করে রওনা দিই আমরা। বাংলোর সিকিউরিটি, গাড়ির ড্রাইভার, শাশুড়ি মাতার ২৪ ঘণ্টার আয়া, লতা দি এবং আমি মিলে বৃদ্ধাকে বাড়ি থেকে বার করে, গাড়িতে তুলি। বারন্দা থেকে হাত নাড়ে আমার বৃদ্ধ বাবা মা। হুশ করে বেরিয়ে যায় গাড়ি। প্রায় বধির শাশুড়ি মাতাকে চিৎকার করে চেনাতে থাকি কাঁথি শহরের অন্ধিসন্ধি। কি বোঝেন, কতটুকু শোনেন ঈশ্বর জানেন, শুধু ওষ্ঠাধরে ফুটে ওঠে শিশুর মত নির্মল হাসি। পাশ থেকে ড্রাইভার ছেলেটি বলে, " খুব ভালো করেছেন ম্যাডাম। মাঝে মাঝে মাসিমাকে বার করবেন বাড়ি থেকে। মনটাও ভালো হবে -"। 


ইস্কুলের উল্টো দিকে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে যাই আমি। হাত পা নেড়ে বলি, " চুপ করে বসে থাকো, দুষ্টুমি করো না।" ভালো বাচ্ছার মত ঘাড় নাড়ে বৃদ্ধা। তুত্তুরীদের ইস্কুলের সামনে বিশাল ভিড়, বেশ অনেক ক্ষণ দাঁড়াতে হয় তাঁর জন্য। দূর থেকে আমাকে দেখে হাত নাড়েন তিনি। কাছে আসতেই বলি, " তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে রে বাবু। চল দেখবি -"।


গাড়িতে উঠে হতবাক হয়ে যান তিনি, " ঠাম্মা! তুমি এসেছ! আমায় নিতে!" গলা দিয়ে ঝরঝরিয়ে ঝরে পড়ে বিস্ময় মিশ্রিত খুশি। ঠাম্মার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে, তিনি বলেন, " কিন্তু কি ভাবে? ঠাম্মা তো বাড়ি ছেড়ে নড়তেই চায় না। মা তুমি এই মিরাকল টা করলে কিভাবে বলো তো?" কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলি, আমার তো জন্মই মিরাকল ঘটানোর জন্য। আমি অঘটনঘটনপটিয়সী কি না। মেয়ের ভ্রু কুঞ্চন দেখে সিরিয়াস হয়ে বলি, আসল ব্যাপারটা হল মানসিক। আমার মা আর শাশুড়ি মা সমবয়সী। দুজনেই বেতো রুগী। দুজনের মধ্যে একজন যখনই কিছু করে, অন্যজনের মনে হয়, ও পারছে যখন, আম্মো পারব। মা দুদিন এসেছে নাতনীকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে, তাই দেখেই অনুপ্রাণিত হয়েছেন ইনিও। বুঝলি বাবু, ওসব ওষুধপথ্য না, আসলে এরা একে অপরকে দেখে চাঙ্গা হয়। 


বাজারের ঠেলাওয়ালার থেকে একরাশ আইসক্রিম কিনে বাড়ি ফিরি আমরা, অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছিল আরেক বৃদ্ধ দম্পতি, আজকের প্রতীক্ষা যতটা না তুত্তুরী আর আমার জন্য, তার থেকে ঢের বেশী শাশুড়ি মাতার জন্য। আবার সকলের সহায়তায় শাশুড়ি মাতাকে গাড়ি থেকে নামানো হয়, বাড়ি ঢুকে ইউনিফর্ম না ছেড়েই আইসক্রিম খেতে বসে তুত্তুরী, সঙ্গতে তিন বুড়োবুড়ি, আর আমি বলি, সব হবে, আগে একটা ছবি তো তুলে নিই, শৌভিকের বৃদ্ধ মা আর ডেঁপো মেয়েটার, তারপর পাঠাই লোকটাকে। পেশাগত ভাবে বড্ড চাপে থাকে লোকটা, বাড়ির পরিস্থিতি থেকে সম্পূর্ণ অজ্ঞ লোকটা আজ ছুটির দিনেও দৌড়েছে মিটিং করতে, তাকে জানাই তো, মন দিয়ে আপিস সামলা ভাই, বাড়ির জন্য আমি আছি তো - । বিয়ের ষোল সতেরো বছর বাদে, এটাই তো ভালোবাসা, আর কে যেন বলে গেছেন না, ভালোবাসা ছাড়া আর আছে কি?

অনির ডাইরি ১১ই এপ্রিল, ২০২৫

#অনিরডাইরি 


কদিন ধরেই খুঁজছিলাম ছেলেটাকে। আজ দেখা হতেই শুধালাম, " সেই মেয়েটার কি খবর গো?" কোন মেয়েটা? কয়েক মুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে যায় ছেলেটা, তারপরই বুঝতে পারে। মাথা নেড়ে বলে, " নেই ম্যাডাম। ও, ওর বর দুজনেরই -"। 


ব্যস্ত অফিসটাকে যেন হঠাৎ করে ঘিরে ধরে নৈঃশব্দের কালো মেঘ। কোন কথা নেই কারো মুখে। তারপর গলা ঝাড়ে আমার এক ইন্সপেক্টর, কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করে, " কোন মেয়েটা ম্যাডাম?" ইন্সপেক্টরটির স্ত্রী সরকারি স্কুলে পার্শ্ব শিক্ষিকা। হুকুমনামা বেরোনোর দিনই বলছিল, " জানেন ম্যাডাম, আমার বউয়ের স্কুলেরও দুজন আছে, এই লিস্টে। তারা দুজনেই কিন্তু খুব ভালো ছাত্র/ছাত্রী। অনেক অনেক নম্বর পাওয়া -।" 

আমরা সরকারের বেতন ভূক চাকর, বুক ফাটলেও মুখ খোলা পাপ। তাই চুপ করেই থাকি। ইন্সপেক্টর সাহেব ভয়ে ভয়ে আবার শুধায়, " কোন মেয়েটা?" 


এবার মুখ খুলতেই হয়, মেয়েটার কথা শুনেছিলাম বছর খানেক, নাকি তারও আগে -, জনৈক সহকর্মীর স্ত্রীর মুখে। বউটি বড় ভালো, সাদাসিধে, প্রাণ খোলা। বরের বদরাগী বস হিসেবে আমাকে ভয় তো পায়ই না, উল্টে ভালো কিছু রাঁধলেই পাঠিয়ে দেয় কৌটো করে, দেখা হলেই পাকড়াও করে শোনায় একরাশ প্রাণের কথা। গাঁট গুণে বলতে পারি আজ অবধি কবার দেখা হয়েছে বউটির সাথে, কিন্তু এর মধ্যেই ওদের প্রেম কাহিনী থেকে শুরু করে যাবতীয় সাংসারিক জটিলতা, অস্থিরতা, সুখ দুঃখের খতিয়ান জমা পড়েছে আমার কাছে। আমাকে দেখলেই যেন, নরম পানীয়ের মত ভুসভুস করে বেরিয়ে আসে প্রাণের কথা। 


তেমন কথা প্রসঙ্গেই একবার শুনেছিলাম ওর এক বান্ধবীর কথা। দুজনেই সাহিত্যে মাস্টার্স। দুজনেই একসাথে চাকরির পরীক্ষা দিয়েছিল, এর হয়নি, বন্ধুটির হয়ে যায়। চাকরি পাবার পরই ফোন করে একরাশ কথা শোনায় মেয়েটি। ততোদিন প্রিয় পুরুষের সাথে পরিণয় পাশে আবদ্ধ হয়েছে বউটি। বাল্যপ্রেম, দীর্ঘ প্রেমপর্বের পর বিয়ে। বর সরকারী আপিসের ছাপোষা চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী। এই দিয়েই প্রথম আক্রমণ করে মেয়েটি, " তুই এটা কি করলি? এত তাড়াতাড়ি এমন একটা ছেলেকে বিয়ে করে ফেললি? তোর কত কিছু হতে পারত রে -। চাকরি পেয়ে বিয়ে করা উচিৎ ছিল। আমায় দেখ, আমি কেমন স্কুলে চাকরি পেয়ে গেছি, মাস গেলে এত টাকা বেতন। আর তুই -"।


এইটা শোনার পর বউটির মনের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। ওর বর পরে আমায় বলেছিল, " কি ভাবে যে সেদিন বউকে সামলেছিলাম ম্যাডাম। সে তো এই সুইসাইড করে, কি সেই সুইসাইড করে।" একজন কর্মরতা নারী হিসেবে অপর একজন কর্মরতা নারীর কৃতকর্মে মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল সেদিন। অনুপার্জনকারী নিছক গৃহবধূদের প্রতি কর্মরতা নারীদের অসুয়া চিরন্তন।।ব্যাপারটা উল্টো দিক থেকেও সত্যি। তেনারাও ভাবেন আমরা গৃহকর্মে অ-নিপুণ/অক্ষম স্ত্রী/ অপদার্থ পুত্রবধূ/ জঘন্য মা। এ এমন এক দ্বৈরথ যেখানে মেয়েরা কেউ জেতে না, শুধুই হারে। 


সেদিনও হারলাম, বউটি এবং আমি। কিন্তু ওই যে বাদশা খান বলে গেছেন না, চলচ্চিত্র এখনও বাকি, তাকে মান্যতা দিয়েই বোধহয় একদিন দুম করে রায় ঘোষণা করে দিল উচ্চ ন্যায়ালয়। উত্তাল হল রাজ্য রাজনীতি, জল গড়াল সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় অবধি। অধমের জীবন অবশ্য যেমন চলছিল, তেমনি চলতে লাগল। পরিবর্তন বলতে একরাতে বউটির হঠাৎ টেলিফোন, " জানেন ম্যাডাম, আমার সেই বান্ধবীর চাকরি চলে গেছে -"। 


অফিস থেকে ফিরে মাংস কষতে দিয়েছি কড়ায়, তড়িঘড়ি ঢাকা দিয়ে বাগানে নেমে যাই, চাপা গলায় শুধাই, " তুমি জানলে কি করে? এত জনের মধ্যে নাম মিলিয়েছ নাকি?" বউটি থতমত খেয়ে, জিভ কেটে বলে, " না ম্যাডাম, না ম্যাডাম। আমার এক পুরাণ অধ্যাপকের সাথে দেখা হয়েছিল। মন্দিরে গিয়েছিলাম পুজো দিতে, সেখানেই স্যারের সাথে দেখা। স্যার বললেন,' শুনছু, ওর চাকরি চলে গেছে! চাকরী পাবার পর এত বদলে গিয়েছিল, আমার সাথে দেখা হলে তো, চিনতেই পারত না। গায়ে পড়ে, ডেকে কথা বলার চেষ্টা করেও দেখেছি, জুটেছে একরাশ তাচ্ছিল্য।' বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, ভাবতাম আমার প্রতিই যত অসূয়া, স্যারকেও এমন করতো ভাবিনি। প্রাথমিক ধর্ষকাম আনন্দের পর দুঃখই হল। হাজার হোক, প্রাক্তণ সহপাঠী, হঠাৎ চাকরি চলে গেলে, না জানি কত আতান্তরে পড়বে বেচারী। সেই বলতেই ফোন করেছিলাম, লাগল না। মেসেজ করতে গেলাম সোশ্যাল নেটওয়ার্কে, একাউন্ট ডিএক্টিভেট করে বসে আছে। কি যে করি -"।


তেমন কিছু করতে হয়নি, সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের সৌজন্যে অচীরেই সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ফিরে আসে মেয়েটি।আমাদের ঘরের বউটির সাদাসিধে মেসেজের জবাবে হয় হিরণ্ময় নীরবতা, নয় " তোর তো কিছুই হল না"মার্কা কষাঘাত। বছর, বছর ঘুরে অবশেষে ফয়সালা জানিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। অন্তত বউটির বান্ধবী বা তার স্বামীর ক্ষেত্রে ঘটেনি কোন ইতর বিশেষ। চাকরি গেছে দুজনেরই। অবশ্য সুযোগ আছে, আগামী তিন মাসের মধ্যেই হতে চলেছে নতুন পরীক্ষা। একটু কষ্ট করে তাতে পাস করলেই সব ঠিক। এবার বাদ সাধে আমার সহকর্মী ছেলেটি, " না ম্যাডাম, সব ঠিক হবে না। ওই যে পাঁচ হাজার সাদা খাতা জমার লিস্ট আছে না, তাত্তে ওদের নাম আছে -। চাকরী তো গেলই, সুদ সহ ফেরৎ দিতে হবে সব বেতন।"



অনির ডাইরি ১১ই এপ্রিল, ২০২৫

#অনিরডাইরি 


কদিন ধরেই খুঁজছিলাম ছেলেটাকে। আজ দেখা হতেই শুধালাম, " সেই মেয়েটার কি খবর গো?" কোন মেয়েটা? কয়েক মুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে যায় ছেলেটা, তারপরই বুঝতে পারে। মাথা নেড়ে বলে, " নেই ম্যাডাম। ও, ওর বর দুজনেরই -"। 


ব্যস্ত অফিসটাকে যেন হঠাৎ করে ঘিরে ধরে নৈঃশব্দের কালো মেঘ। কোন কথা নেই কারো মুখে। তারপর গলা ঝাড়ে আমার এক ইন্সপেক্টর, কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করে, " কোন মেয়েটা ম্যাডাম?" ইন্সপেক্টরটির স্ত্রী সরকারি স্কুলে পার্শ্ব শিক্ষিকা। হুকুমনামা বেরোনোর দিনই বলছিল, " জানেন ম্যাডাম, আমার বউয়ের স্কুলেরও দুজন আছে, এই লিস্টে। তারা দুজনেই কিন্তু খুব ভালো ছাত্র/ছাত্রী। অনেক অনেক নম্বর পাওয়া -।" 

আমরা সরকারের বেতন ভূক চাকর, বুক ফাটলেও মুখ খোলা পাপ। তাই চুপ করেই থাকি। ইন্সপেক্টর সাহেব ভয়ে ভয়ে আবার শুধায়, " কোন মেয়েটা?" 


এবার মুখ খুলতেই হয়, মেয়েটার কথা শুনেছিলাম বছর খানেক, নাকি তারও আগে -, জনৈক সহকর্মীর স্ত্রীর মুখে। বউটি বড় ভালো, সাদাসিধে, প্রাণ খোলা। বরের বদরাগী বস হিসেবে আমাকে ভয় তো পায়ই না, উল্টে ভালো কিছু রাঁধলেই পাঠিয়ে দেয় কৌটো করে, দেখা হলেই পাকড়াও করে শোনায় একরাশ প্রাণের কথা। গাঁট গুণে বলতে পারি আজ অবধি কবার দেখা হয়েছে বউটির সাথে, কিন্তু এর মধ্যেই ওদের প্রেম কাহিনী থেকে শুরু করে যাবতীয় সাংসারিক জটিলতা, অস্থিরতা, সুখ দুঃখের খতিয়ান জমা পড়েছে আমার কাছে। আমাকে দেখলেই যেন, নরম পানীয়ের মত ভুসভুস করে বেরিয়ে আসে প্রাণের কথা। 


তেমন কথা প্রসঙ্গেই একবার শুনেছিলাম ওর এক বান্ধবীর কথা। দুজনেই সাহিত্যে মাস্টার্স। দুজনেই একসাথে চাকরির পরীক্ষা দিয়েছিল, এর হয়নি, বন্ধুটির হয়ে যায়। চাকরি পাবার পরই ফোন করে একরাশ কথা শোনায় মেয়েটি। ততোদিন প্রিয় পুরুষের সাথে পরিণয় পাশে আবদ্ধ হয়েছে বউটি। বাল্যপ্রেম, দীর্ঘ প্রেমপর্বের পর বিয়ে। বর সরকারী আপিসের ছাপোষা চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী। এই দিয়েই প্রথম আক্রমণ করে মেয়েটি, " তুই এটা কি করলি? এত তাড়াতাড়ি এমন একটা ছেলেকে বিয়ে করে ফেললি? তোর কত কিছু হতে পারত রে -। চাকরি পেয়ে বিয়ে করা উচিৎ ছিল। আমায় দেখ, আমি কেমন স্কুলে চাকরি পেয়ে গেছি, মাস গেলে এত টাকা বেতন। আর তুই -"।


এইটা শোনার পর বউটির মনের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। ওর বর পরে আমায় বলেছিল, " কি ভাবে যে সেদিন বউকে সামলেছিলাম ম্যাডাম। সে তো এই সুইসাইড করে, কি সেই সুইসাইড করে।" একজন কর্মরতা নারী হিসেবে অপর একজন কর্মরতা নারীর কৃতকর্মে মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল সেদিন। অনুপার্জনকারী নিছক গৃহবধূদের প্রতি কর্মরতা নারীদের অসুয়া চিরন্তন।।ব্যাপারটা উল্টো দিক থেকেও সত্যি। তেনারাও ভাবেন আমরা গৃহকর্মে অ-নিপুণ/অক্ষম স্ত্রী/ অপদার্থ পুত্রবধূ/ জঘন্য মা। এ এমন এক দ্বৈরথ যেখানে মেয়েরা কেউ জেতে না, শুধুই হারে। 


সেদিনও হারলাম, বউটি এবং আমি। কিন্তু ওই যে বাদশা খান বলে গেছেন না, চলচ্চিত্র এখনও বাকি, তাকে মান্যতা দিয়েই বোধহয় একদিন দুম করে রায় ঘোষণা করে দিল উচ্চ ন্যায়ালয়। উত্তাল হল রাজ্য রাজনীতি, জল গড়াল সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় অবধি। অধমের জীবন অবশ্য যেমন চলছিল, তেমনি চলতে লাগল। পরিবর্তন বলতে একরাতে বউটির হঠাৎ টেলিফোন, " জানেন ম্যাডাম, আমার সেই বান্ধবীর চাকরি চলে গেছে -"। 


অফিস থেকে ফিরে মাংস কষতে দিয়েছি কড়ায়, তড়িঘড়ি ঢাকা দিয়ে বাগানে নেমে যাই, চাপা গলায় শুধাই, " তুমি জানলে কি করে? এত জনের মধ্যে নাম মিলিয়েছ নাকি?" বউটি থতমত খেয়ে, জিভ কেটে বলে, " না ম্যাডাম, না ম্যাডাম। আমার এক পুরাণ অধ্যাপকের সাথে দেখা হয়েছিল। মন্দিরে গিয়েছিলাম পুজো দিতে, সেখানেই স্যারের সাথে দেখা। স্যার বললেন,' শুনছু, ওর চাকরি চলে গেছে! চাকরী পাবার পর এত বদলে গিয়েছিল, আমার সাথে দেখা হলে তো, চিনতেই পারত না। গায়ে পড়ে, ডেকে কথা বলার চেষ্টা করেও দেখেছি, জুটেছে একরাশ তাচ্ছিল্য।' বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, ভাবতাম আমার প্রতিই যত অসূয়া, স্যারকেও এমন করতো ভাবিনি। প্রাথমিক ধর্ষকাম আনন্দের পর দুঃখই হল। হাজার হোক, প্রাক্তণ সহপাঠী, হঠাৎ চাকরি চলে গেলে, না জানি কত আতান্তরে পড়বে বেচারী। সেই বলতেই ফোন করেছিলাম, লাগল না। মেসেজ করতে গেলাম সোশ্যাল নেটওয়ার্কে, একাউন্ট ডিএক্টিভেট করে বসে আছে। কি যে করি -"।


তেমন কিছু করতে হয়নি, সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের সৌজন্যে অচীরেই সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ফিরে আসে মেয়েটি।আমাদের ঘরের বউটির সাদাসিধে মেসেজের জবাবে হয় হিরণ্ময় নীরবতা, নয় " তোর তো কিছুই হল না"মার্কা কষাঘাত। বছর, বছর ঘুরে অবশেষে ফয়সালা জানিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। অন্তত বউটির বান্ধবী বা তার স্বামীর ক্ষেত্রে ঘটেনি কোন ইতর বিশেষ। চাকরি গেছে দুজনেরই। অবশ্য সুযোগ আছে, আগামী তিন মাসের মধ্যেই হতে চলেছে নতুন পরীক্ষা। একটু কষ্ট করে তাতে পাস করলেই সব ঠিক। এবার বাদ সাধে আমার সহকর্মী ছেলেটি, " না ম্যাডাম, সব ঠিক হবে না। ওই যে পাঁচ হাজার সাদা খাতা জমার লিস্ট আছে না, তাত্তে ওদের নাম আছে -। চাকরী তো গেলই, সুদ সহ ফেরৎ দিতে হবে সব বেতন।"


অনির ডাইরি ৩রা এপ্রিল 

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 


তিন কুড়ি দশ পড়ছিল শৌভিক। আজ না, বেশ কিছুদিন আগে। অবসর প্রাপ্ত আইসিএস অফিসার অশোক মিত্র মহাশয়ের আত্মজীবনী। পরাধীন, অখণ্ড ভারতের এক মহকুমা শাসকের অভিজ্ঞতার সাথে অদ্ভুত ভাবে মিলে যাচ্ছিল ত্রিখণ্ডিত আধুনিক ভারতের আরেক মহকুমা শাসকের অভিজ্ঞতা। যেন সময়টা ফারাক কয়েক দশক নয়, কয়েকটা দিন মাত্র। সব তো একই আছে, কিছুই তো বদলায়নি।

 

যত মিল খুঁজে পাচ্ছিল, ততো উৎফুল্ল হয়ে উঠছিল আমার বর। এক আধ পাতা পড়ছিল আর বই বন্ধ করে আমায় সবিস্তারে শোনাচ্ছিল মিত্তির মশাই(🙏🏼) এর গপ্প। সেদিন , "মধ্যসত্ত্বভোগী" শব্দটার সাথে যেন নতুন করে আলাপ করিয়ে দিলেন মিত্র সাহেব। সেকালেও প্রান্তিক চাষী থেকে গেরস্থের পাতে পৌঁছাতে যেকোন ভূমিজ পদার্থকে পেরোতে হত, একাধিক মধ্যসত্ত্বভোগী। লাভের গুড় খেয়ে মেদুল হত এই সম্প্রদায়, এদিকে সোনার ফসল ফলিয়েও নিকষ তিমিরে তলিয়ে যেত প্রান্তিক চাষী। ওদিকে বাজারে লাগত আগুন, সংসার টানতে নাভিশ্বাস উঠত মধ্যবিত্তের। এই মধ্যসত্ত্বভোগীদের সংখ্যা ছিল, এলাকা ভেদে বিভিন্ন। তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বাখরগঞ্জ এলাকায়  ৬৪ জন (সম্ভবত) মধ্যসত্ত্বভোগীর গল্প শুনিয়েছিল লেখক। 


এই গল্প শোনার কিছুদিনের মধ্যেই একটা নালিশ জমা পড়ল আমার দপ্তরে। নালিশ নয়, আর্জি বলতে পারেন। আমার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য, ডিএম সাহেবকে চিঠি লিখলেন এক বৃদ্ধ নির্মাণ কর্মী। আমি নাকি ইচ্ছা করে তাঁর পেনশন আটকে দিই, আমি নাকি তাঁর স্বর্গীয় স্ত্রীর মৃত্যুকালীন অনুদানেও ভাগ চেয়ে পাঠাই। তাও অগ্রিম, কড়কড়ে পাঁচটি হাজার টাকা আমার মনোনীত ব্যক্তিকে দিলে তবে ছাড়া হবে বৃদ্ধার অনুদান। 


চিঠিটা পড়ে বুঝেছিলাম, বজ্রাহত কাকে বলে। "ম্যাডাম" শব্দটা না লিখলে, চিঠিটা আমি হয়তো পাত্তাও দিতাম না। গুজব ভেবেই উড়িয়ে দিতাম। কিন্তু এই চেয়ারে যে একজন মহিলা আধিকারিক আছে, এটা একটা বুড়ো প্রান্তিক নির্মানকর্মীর তো জানার কথা নয়। 


অতঃপর তদন্ত কমিটি গঠন এবং ইন্সপেকশন। ইন্সপেকশন অন্তে আমার তিন ইন্সপেক্টর ভ্যাবলার মত বসেছিল। " ম্যাডাম, কত জন যে জড়িত আছে, স্তরে, স্তরে।" আরেকপ্রস্থ সেদিন আলাপ হল যেন এই মধ্যসত্ত্বভোগী শব্দটার সাথে। থানা পুলিশ যা করার সে তো আমরা করলামই, আর ঠিক করলাম, এবার থেকে আমার সইয়ে যে যা পাবে, তাকে একটি বার কষ্ট করে পদধূলি দিতেই হবে গরীবের আপিসে। মধ্যসত্ত্বভোগী ব্যতিরেকে সামনাসামনি হব, সরকারী আপিসের লোকজন আর সাধারণ মানুষ। তারপর দেখাই যাক না - 


সম্প্রতি ১২৪ খানা নির্মাণ কর্মী পেনশন অ্যাপ্রুভ হয়েছে আমাদের। আজ তাঁদের ডেকেছিলাম আমরা। উপস্থিতির হার ছিল শতকরা ৮৩%। কিছু মানুষ কখনই প্রথম বার ডাকলে আসেন না। সরকারি আপিস সম্পর্কে যে কি ভীতি এই গাঁয়ের মানুষগুলোর। তার উপর আমাদের নিমতৌড়ির নব্য প্রশাসনিক ভবন এত বড় আর এত ঝাঁ চকচকে, পথ হারিয়ে ফেলে অনেকে। ভয়ে কুঁকড়ে নীচে দাঁড়িয়ে থাকে অনেক বুড়োবুড়ি। লিফটে উঠতে চায় না, ভয় পায়। 


যাই হোক, যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদেরকেই বললাম, পালা পালা করে, কখনও আমি, কখনও ALC নভোনীল বাবু, কখনও বা IMW সৌম্য বা বেদজ্যোতি। বললাম, আজ থেকে আপনারা সকলে আমাদের পেনশনার। এই যে একবার পেনশন চালু হয়ে গেল, আর তা বন্ধ করার ক্ষমতা কারো নেই। এমনকি আমারও না। তাই কেউ যদি পেনশন বন্ধ করে দেবার ভয় দেখায়, হুমকি দেয়, মোটে ভয় পাবেন না। প্রয়োজনে আমাদের লিখিত ভাবে জানাবেন। তারপর আমরা দেখব ব্যাটাকে। বললাম, তবে হ্যাঁ, আপনার পেনশন আপনি কিন্তু বন্ধ করতে পারেন। যদি সময়মত বেঁচে থাকার প্রমাণপত্র জমা না করেন। স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধানের সার্টিফিকেট, আধার আর ব্যাংক পাশবুক এর ফটোকপি নিয়ে মনে করে বছরে একবার আসুন আর সারা বছর নিশ্চিন্তে থাকুন।নিয়মিত দিলে আর আমার কাছে আসতে হবে না, আপনাদের ব্লকে স্থিত শ্রম দপ্তরের আপিসেই দিবেন। এই ইন্সপেক্টর সাহেবদের কাছে।  


বললাম, ভালো করে শুনুন পেনশন চালু হবার অর্থ হল, আপনারা আপাতত ৬০তম বছরের পেনশন টুকু পেয়েছেন। লাইফ সার্টিফিকেট জমা করার সাথে সাথে,যার যতটুকু বিলম্ব হয়েছে পেনশন পেতে, সে ততোদিনের পুরো টাকাটা পাবেন। সেটা অনেক টাকা কিন্তু। একাউন্ট ফেটেও যেতে পারে হয়তো। তখন কেউ যদি অফিসের/ আমার/ ALC সাহেবের/ IMW সাহেবের নাম করে টাকা চায়, দয়া করে দেবেন না। বরং আমাদের লিখিত ভাবে জানাবেন,আমরা তার বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেব।


ক্ষুদ্র আপিস আমাদের, সাধ আকাশ ছোঁয়া হলেও, সাধ্য বড়ই সীমিত। তবুও, চেষ্টা তো করি, আধিকারিক থেকে প্রান্তিক সুবিধাভোগীর মধ্যে সেতু বন্ধনের। বাকিটা না হয়, সময়ের হাতেই ছাড়া থাক  -


Thursday, 6 March 2025

অনির ডাইরি মার্চ, ২০২৫

অনির ডাইরি ৩০ শে মার্চ, ২০২৫ 


এক পুরাতন বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে সেই কাকভোরে বেরিয়েছি কাঁথি থেকে, বন্ধু বেশ অনেকদিন ধরেই ডাকছে, Evolution of Women Empowerment in India অর্থাৎ ভারতে নারী স্বশক্তিকরণের বিবর্তনের ওপর কিছু বলার জন্য, অর্থবর্ষ শেষের চক্করে এত দিন সময়ই দিতে পারিনি বেচারীকে। একের পর এক ডেট দিয়েছি আর বাতিল করেছি। 


আজ গুণে গুণে পাঁচ ছটা কাজ নিয়ে এসেছি মহানগর। সঙ্গে এনেছি একডজন আর্জি, দশ পনেরো কিলো দপ্তরী কাগজ, আর দু দুটো ইন্সপেক্টর। মুকুলকে আমি অঙ্কুরহাটি থেকে তুলেছি, মণীশ নিজেই চলে এসেছে গঙ্গা পেরিয়ে। এত ব্যস্ততা চলছে মাস জুড়ে, যে প্রায় কিছুই পড়ে আসিনি আমি। অবশ্য টপিকটা আমার এত প্রিয় যে এর ওপর এমনিই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বকে যেতে পারি, তাও এখন মনে হচ্ছে একটু দেখে এলে বোধহয় ভালো হত। 


ভেবেছিলাম বন্ধুকে বলব, এসো গল্প করি। দুই সবলা স্বাধীনচেতা নারীর বাক্যালাপে, স্মৃতিচারণে আপসে উঠে আসবে মেয়েদের বিবর্তনের ইতিহাস। এসে দেখি বন্ধুটি আজ দর্শক এবং শ্রোতা, আমার সাথে গোল টেবিলে সামিল এক নবোঢ়া তরুণী। এবং তিনি পুরোদস্তুর প্রস্তুত সম্মুখ সমরের জন্য। আড়ষ্ট ভাবে আলোচনা শুরু হলেও, কখন যেন মেয়েলি আড্ডাতেই দাঁড়িয়ে গেল ব্যাপারটা। কিছু আমি বললাম,কিছু মেয়েটা। অনুষ্ঠান শেষে দেখি, কখন যেন ম্যাডাম থেকে দিদি হয়ে গেছি আমি। মেয়েটা বলছে, " দিদি তোমার কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল তুমি যেন আমার হয়েই বলছ, বিশ্বাস করো গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল।" 


বিয়ের জল শুকাতে না শুকাতেই শাশুড়িকে হারায় মেয়েটি। অনভিজ্ঞ ফুটফুটে নতুন বউকে রাতারাতি হয়ে উঠতে হয় বাড়ির জাঁদরেল গিন্নী। বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে ব্যক্তিগত আর পেশাদারিত্বের ভারসাম্য রক্ষায় আপাতত নাজেহাল মেয়েটা, সাধ্যাতীত করছে, তাও যেন মুঠো ভর্তি জলের মত সব যেন বেরিয়ে যাচ্ছে আয়ত্বের বাইরে। 


নতুন বিয়ের পর, এই পরিবর্তন, এই অবসাদ খুব স্বাভাবিক।  বড় বেশী মানিয়ে নিতে হয় এই সময় মেয়েদের। মজার কথা হল এ এমন এক অগ্নিপরীক্ষা, যাতে কোন পাশ নেই, শুধুই ফেল। এক সিনিয়র দিদি একবার বলেছিল, " বিয়ে ব্যাপারটা হল অনেকটা যেন একটা ডালপালাওয়ালা পরিণত বয়সী গাছকে শিকড় থেকে উপড়ে অন্য পরিবেশে পুনঃ রোপন করে বলা, এতকালের শিক্ষা, সংস্কার, রীতিনীতি সব রাতারাতি ভুলে গিয়ে,নতুন পরিমণ্ডলে নতুন নিয়মে বাঁচ।"


মেয়েটা বিষণ্ন ভাবে বলে, "এত করি, তাও কারো মন পাই না দিদি। " বন্ধুটি আর আমি একসাথে হাহা করে উঠি, সর্বনাশ, বৌমা নম্বর ওয়ান হবার লড়াইয়ে একদম নেমো না বাপু। যা পারো, যতটা পারো,যতটা তোমার শরীর, তোমার বিবেক সায় দেয় ততটাই করো। আমরা নারী বটে, তার মানে মোটেই আমরা সব পারি না। বন্ধুটি তার স্বর্গীয় শ্বশুর মশাইয়ের গল্প শোনায়, " বিয়ের পরপরই আমার শ্বশুরমশাই বলেছিলেন, তুমি যতই ভালো রাঁধ, যতই পা টিপে দাও, সংসার এমন একটা জায়গা, সেখানে না কেউ তোমার সুনাম করবে, না তোমায় ভালবাসবে।" 


বন্ধুর এই শ্বশুরমশাইটির সঙ্গে আমার কখনও আলাপ হয়নি, শুধু গল্পই শুনেছি। আর গল্প শুনেই ওনার গুণমুগ্ধ ভক্ত হয়ে গেছি। বন্ধুটি যখন প্রথম চাকরি পায়, বেতন ছিল খুবই সামান্য। জনসমক্ষে বলার মত নয়। আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব এমনকি ওর স্বামীও বলেছিল, এই বেতনে এত দূর গিয়ে কাজ করার কি প্রয়োজন। এতে তো রাহাখরচও উঠবে না।বরং বাড়িতে থেকে অন্য চাকরির পরীক্ষা দিক। কিন্তু মেয়েটির ভাষায়, " আমার শ্বশুরমশাই একদিন ডেকে বললেন, শোন, আমি তোমার কাছে, কিচ্ছু চাই না। শুধু কথা দাও, এর থেকে অন্তত একশ টাকা বেশি বেতনের চাকরি তুমি যতদিন না পাচ্ছ, এই চাকরি ছাড়বে না। তোমার যাতায়াতের জন্য যা লাগে, তুমি নিঃসঙ্কোচে আমায় বলবে। আমি যে পেনশন পাই, তার সবটা আমার লাগে না, কিছুটা আমি তোমায় দিতেই পারি।"


ঘড়ির কাঁটা বেবাগা ঘোড়ার মত ছুটছে, এবার উঠতেই হয়, পুঁচকে মেয়েটাকে এতক্ষণ সাহসই দিয়েছি দুজনে, এবার একটু ভয় দেখাই। বাপু হে, এগুলো তো কিছুই নয়, একবার দুই থেকে তিন হও, তারপর বুঝবে জ্বালা কাকে বলে। ভাগ্যে আমার মা ছিল, সাড়ে তিন বছর বয়স অবধি একা হাতে মানুষ করে দিয়েছে তুত্তুরীকে। বন্ধুটির ক্ষেত্রেও একই গল্প প্রযোজ্য, ওর বাবা মার কাছেই মানুষ হচ্ছে ওর ছানা। বন্ধুটি বলে, " দেখো না, বাবা মা চার দিনের জন্য বাড়ি গেছে, আমি আর আমার বর পালা করে ছেলেকে অফিসে নিয়ে আসছি।" আমিও তো নিয়ে যেতাম তুত্তুরীকে, যখন লতা দি ছুটি নিত। নইলে সেই মা'ই ভরসা, উজিয়ে হাওড়া গিয়ে মেয়েকে রেখে তারপর অফিস যেতে হত। ২০১৭ সালের  আগষ্ট মাসে শৌভিক কলকাতা ইলেকশনে বদলী হয়ে আসার পর অবশ্য আর ভাবতে হয়নি। প্রয়োজনে ঐ ছুটি নিয়ে মেয়ে সামলাত। 


বরেরা একটু সমব্যথী, সংবেদনশীল না হলে আমাদের মত কর্মরতা মায়েদের যে কি হত। এগিয়ে দিতে দিতে বন্ধুটি বলে, " একদম ঠিক বলেছ দিদি। আমি এক সন্তান, আজ বেশ কয়েকবছর হয়ে গেল বাবা মাকে আমার কাছে এনে রেখেছি। প্রথম দিকে কিছুতেই থাকতে চাইত না ওরা, বিশ্বাস করবে, দরজায় তালা দিয়ে আটকে ছিলাম আমার বুড়োবুড়িকে। আজকাল তাঁরা আমাদের ছেড়ে কোথাও থাকতে চায় না। একসাথেই থাকি সবাই, একই তলায়। এই নিয়ে আমার বরের তরফ থেকে কোন অস্বস্তি, প্রতিবাদ, ক্ষোভ কোনদিন কিচ্ছু অনুভব করিনি।  সত্যিই ও আমার সবথেকে বড় ভরসাস্থল।"


শুনতে শুনতে মনে হল, এ তো আমার গল্প, আমাদের গল্প। আমিও তো জেদ করেই নিয়ে এসেছি বাবা মাকে। শ্বশুর মশাইয়ের মৃত্যুর পর নিয়ে এসেছি শাশুড়ি মাকে।  আমাদের ছোট্ট আণবিক পরিবারটা রাতারাতি যৌথ পরিবার হয়ে গেছে। তাতেও তিল মাত্র বদলায়নি মোদের সম্পর্ক। আমার মতই, হয়তো আমার থেকেও ভালো করে ঘর-বাহির সমান তালে সামলাচ্ছে শৌভিক। মাঝে মাঝে তো মনে হয়, আমার থেকেও বেশি ঘরোয়া, গৃহকর্মনিপুণ আমার বর। নাহ যাই বলুন, বিগত দুয়েক শ বছরে নারী স্বশক্তিকরণের যতটা বিবর্তন ঘটেছে, পুরুষ সংবেদনশীলতা-সহমর্মিতার বিবর্তনও প্রায় ততোটাই ঘটেছে।


অনির ডাইরি ২৭ শে মার্চ, ২০২৫

#অনিরডাইরি 



"ওর স্কুলে কি হয়েছে দেখেছ" পিছন থেকে বলল লতা দি। রবিবারের দুপুর, ভরপেট মাংস ভাত খেয়ে, জমিয়ে নিদ্রাদেবীর আরাধনায় বসেছিলাম থুড়ি শুয়েছিলাম। কিন্তু ফ্রিজে রাখা মিষ্টি গুলো এমন ডাকাডাকি শুরু করলে, তাই সকলের অলক্ষ্যে লুকিয়ে একটা কালো জাম খাচ্ছিলাম। লতা দির কথায় ফ্যালফ্যাল করে তাকালাম, তার স্কুলে আবার কি হয়েছে? কই তিনি তো আমায় কিছু বলেননি। 


আমার মুখের ভাব দেখে লতা দি থেমে থেমে বলল, "একটা ছেলে - ওরই ক্লাসের।" বাকিটা আর বলতে হয় না। মুখের ভিতর দিদিভাইয়ের দেওয়া অমৃতসমান কালোজাম হঠাৎ যেন তেতো হয়ে ওঠে। স্বনামধন্য বাংলা ইংরাজি সংবাদ পত্রের সাথে সাথে কিছু স্থানীয় কাগজও আমাদের বাড়ি আসে। কেন আসে, কেউ জানে না। তেমনি একটা কাগজ আমার হাতে তুলে দেয় লতা দি। প্রথম নাকি দ্বিতীয় পাতা( আজ আর মনে নেই) তলার দিকে বড় বড় করে ছাপা হয়েছে খবরটা। ছেলেটার নামটা পড়ে, ধপ করে বসে পড়লাম। এই ছেলেটার নাম তো শুনেছি মেয়ের মুখে। ভালো বাস্কেটবল খেলে ছেলেটা, ভালো ভায়োলিন বাজায়। ভীষণ জনপ্রিয় ছেলেটা। অগণিত বন্ধুবান্ধব ছেলেটার। কিছুদিন আগে একে নিয়ে একটা ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখেছিল তুত্তুরী। লেখার মুখ্য বিষয় ছিল এক উঠতি খেলোয়াড়ের জীবনের টানাপোড়েন। ছেলেটা শুধু খেলেই যেতে চায়, আর মা বলে, ' পড় বাবু। নইলে খাবি কি?' 


সেই ছেলেটা নেই? ভাবতেই পারছি না। হয়তো একই নাম, হয়তো অন্য ছেলে। তাহলেই বা কি? সেও তো সন্তানতুল্য। খবরটা তুত্তুরীকে জানাব, নাকি জানাব না, এই নিয়ে দোদুল্যমানতায় ভোগে তুত্তুরীর মা আর মাসি। মাসির আপত্তি সত্ত্বেও শেষমেশ মেয়েটাকে জানিয়েই দিই। জীবন বড় রুক্ষ, বড় নির্মম, কতদিন বাঁচিয়ে রাখব মেয়েটাকে। 


এই নিয়ে জীবনে দ্বিতীয়বার মৃত্যুশোক পেল মেয়েটা। প্রথম বার গত মে মাসে, শ্বশুরমশাই যখন চলে গেলেন। মৃত পিতামহের সামনে ভ্যাবলার মত দাঁড়িয়ে ছিল মেয়েটা। শুকনো চোখে অবাক হয়ে দেখছিল সকলের কান্নাকাটি। জনৈকা শোকাতুর আত্মীয়া তো বলেই বসলেন, " তোর মা কাঁদছে, আর তুই একটু কাঁদবি না দাদুর জন্য।" ভয়ে অন্য ঘরে গিয়ে বসেছিল মেয়েটা। আমাকে নিভৃতে পেয়ে ফুঁপিয়ে উঠেছিল, " আমি বিশ্বাস করতে পারছি না মা। ইচ্ছে করছে দাদুকে ঠেলে তুলে দিই ঘুম থেকে। একটা মশা উড়ছিল দাদুর মুখের কাছে, ইচ্ছে করছিল ওটাকে মেরে দিই, কিন্তু বিশ্বাস করো মা, কান্না পাচ্ছিল না। আমি কি খুব খারাপ মা -"। আজও কাগজটা পড়ে তেমনি ফ্যালফ্যাল করে  তাকাচ্ছিল তুত্তুরী, "আমি কি করব মা? আমি কিছু বুঝতেই পারছি না মা।" 


সোমবার স্কুল থেকে বিধ্বস্ত হয়ে ফেরে মেয়েটা। অফিস থেকে ফিরতেই বলে, " কাল আর স্কুল যাব না মা। আজ সারাদিন ক্লাসে যা হল-।"  মেয়েরা সবাই প্রায় কান্নাকাটি করেছে, ছেলেরা করেছে জটলা। একটি মেয়ের নাম করে তুত্তুরী বলে, " ঐ ছেলেটার এক্স গার্লফ্রেন্ড, কিছুদিন আগেই ওদের ব্রেক আপ হয়েছিল। তখন মেয়েটা জনে জনে বলে বেড়িয়েছিল, 'ও আমায় ডাম্প করেছে, তোরা কেউ ওর সঙ্গে কথা বলবি না' অথচ আজ এমন করুণ ভাবে কাঁদছিল, যে ওকে সামলানোই যাচ্ছিল না।" 


শুনতে শুনতে নিজের কৈশোরে ফিরে যাই। আমাদের কঠোর অনুশাসনে মোড়া গার্লস ইস্কুল, এক্স ওয়াই কিছুরই সুযোগ ছিল না। আমার সাদাকালো কৈশোরে একমাত্র রামধনু ছিল আমার একমাত্র বোনঝি মুনাই। কো-এড ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ত মুনাই, আমার জন্য গুছিয়ে আনত হরেকরকম টকমিষ্টি গল্প। প্রেম হোক বা বন্ধুত্ব সেসব ছিল গড়ার গল্প, ভাঙার নয়। যুগটাই আলাদা ছিল বুঝি - 


গভীর রাতেও ঘুম আসে না চোখে। উসখুস করে, লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে মেয়েটা। ফিসফিস করে বলে, "জানো মা, অনেকে বলছিল, বিশেষ করে ছেলেরা, যে এমন মূর্খের মত কাজ করে, তাকে নিয়ে আমরা ভাবতে চাই না।" কি বলব বুঝতে পারি না। বড় প্র্যাকটিক্যাল এই প্রজন্ম। হয়তো এটাই ভালো। তুত্তুরী বলে," আমরা ঐ মেয়েটার সাথেও দেখা করতে গিয়েছিলাম। ওর বর্তমান গার্লফ্রেন্ড -। কেউ কেউ বলছে মেয়েটার বাবা মা জানতে পেরে -"। মেয়ের মুখে হাত চাপা দিই আমি। থাক, আর জানতে চাই না। বলি একটা কবিতা শুনবি? এত রাতে, কবিতা! মা কি পাগল হয়ে গেল ভাবে বুঝি মেয়েটা। বলি, শোন না। তোর মনে যত তুফান উঠছে, সব কেমন জাদুমন্ত্রে শান্ত হয়ে যাবে দেখ - মুঠো ফোনে হেসে ওঠে দাড়ি বুড়ো, মায়ের গলায়, মায়ের গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে তুত্তুরী শোনে, 

" কেউ বা তোমায় ভালোবাসে, কেউ বা বাসতে পারে না যে,

  কেউ বিকিয়ে আছে, কেউ বা সিকি পয়সা ধারে না যে,

 কতকটা যে স্বভাব তাদের কতকটা বা তোমারো ভাই,

  কতকটা এ ভবের গতিক-সবার তরে নহে সবাই।" 


 ভিজে ওঠে মেয়েটার চোখের কোণ,অঙ্গে অঙ্গে লাগে কাঁপন, কিন্তু মা আর দাড়ি বুড়োর যুগলবন্দী থামে না- 

"তোমায় কতক ফাঁকি দেবে  তুমিও কতক দেবে ফাঁকি,

তোমার ভোগে কতক পড়বে,পরের ভোগে থাকবে বাকি।     

মান্ধাতারই আমল থেকে চলে আসছে এমনি রকম--

তোমারি কি এমন ভাগ্য বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম!" 


অনির ডাইরি ৮ই মার্চ, ২০১৫

#অনিরডাইরি #InternationalWomensDay 



আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এই দিনটা এলেই বিশেষ কিছু পোস্ট বাজারে ঘোরে। যার প্রথমটি হল, " আমরা নারী, আমরাই পারি।" ইয়ে দাদা দিদিগণ, বলছি কি, আমিও নারী, কিন্তু মোটেই আমি সব পারি না। সব পারার দায় ও আমার নয়। সব পারলেও কেউ আপনাকে মেডেল দেবে না। উল্টে আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে যাবে অমূল্য সময়, যা আপনি একান্তই নিজের জন্য খরচ করতে পারতেন। 


দ্বিতীয় পোস্ট যেটা কয়েক বছর আগেও মার্কেটে ঘুরত, "নারীদের জন্য বিশেষ দিন আছে। পুরুষদের জন্য নাই।" যে হতভাগ্য ফ্রাস্টু খাওয়া ব্যক্তিবর্গ এই পোস্টগুলি করত, তারা একটু কষ্ট করে গুগল করে দেখত না, যে আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস অবশ্যই আছে, প্রতি বছর ১৯ শে নভেম্বর। ইদানিং অবশ্যি তাঁদের জ্ঞানগম্যি বেড়েছে, তাই দেখলাম লিখছেন, " নারী দিবস আছে, পুরুষ দিবস আছে, মানুষ দিবস নাই।" যদি আপনি তাঁদের দলে পড়েন, তো একটু কষ্ট করে গুগলের সাহায্য নিন কেমন? ১০ই ডিসেম্বর যেন কি দিবস? 


তৃতীয় পোস্টদাতারা অধিকাংশই নারী। এনারা সক্কাল সকাল জমিয়ে লিখে দেন, "আমার নারী দিবসের প্রয়োজন নেই।" অথবা "রোজই তো নারী দিবস।" মাইরি? সত্যি? ওরে ভাই, লেখার আগে দিনটার ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং তাৎপর্য সম্পর্কে তো একটু পড়াশোনা তো করে নিলে পারতিস। মোটেই সব দিন নারী দিবস নয়। সব দিন নারী দিবস হতে পারে না। 


আজকের দিনটা হল পিছনে ফিরে তাকানোর দিন। কোথা থেকে কোথায় এসেছি আমরা। চলুন একটু পিছনে ফিরে তাকাই, বেশী নয় মাত্র দুশো বছর আগেও সোয়ামী মারা গেলে চিতায় পুড়িয়ে দেওয়া হত আমাদের মেয়েদের। আচ্ছা আমরা নাহয় কালা আদমি, অশিক্ষিত বর্বর জাতি। পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র গুলিতে হত না ডাইনি দহন? ন্যূনতম ব্যক্তিত্ব, প্রথা ভাঙার সামান্য প্রচেষ্টা দেখলেই তাকে ডাইনি বলে দেগে দেওয়া হত না কি? জোয়ান অফ আর্ক থেকে সালেম উইচ হান্ট যে অন্য কথা বলে দিদি। 


চলুন নিজের দেশে ফিরি। চলুন একটু এগোই, বেশী না বছর পঁচিশ। অর্থাৎ পৌনে দুশো বছর আগেও মেয়েরা লিখতে পড়তে চাইলে কি বলা  হত জানেন নাকি? চলুন আমিই বলে দিই, বলা হত, মেয়েরা লিখতে পড়তে শিখলে তার বৈধব্যযোগ অবধারিত। আর বিধবা একবার হয়ে গেলে দাঁত নখ বার করে এগিয়ে আসত সমাজ। জাঁতা কলে ফেলে তেল বার করার জন্য। ভাগ্যে তিনি জন্মেছিলেন। বীর সিংহের বীর শিশু। তাই না দুপাতা পড়তে আর দু কলম লিখতে পারছি।


পড়তে যখন শিখেইছেন, তো একটু পড়ুন না। পড়ুন ফুলমণি দাসীর কথা। সেই ১০ বছরের ফুলমণি যার বিয়ে হয়েছিল ৩৫ বছরের হরিমোহন মাইতির সাথে। বিয়ের রাতেই বেড়াল কেটে ছিল হরিমোহন। এমন বলপ্রয়োগ করেছিল বাচ্ছা মেয়েটার ওপর, ফুলশয্যা কণ্টক শয্যা হয়ে গিয়েছিল, মরেই গিয়েছিল মেয়েটা। আমার নারী দিবসের দরকার নেই বলে গলা ফাটানো দিদিমনিরা ভাবতে পারেন? আজ্ঞে হ্যাঁ। এটাই হয়েছিল। এটাই হত। বিশ্বাস না হয় Empress v. Hari Mohan Maiti কেস খুঁজে দেখুন। পড়ুন। দুঃখের কথা কি জানেন? মাত্র এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করেই মুক্তি পেয়ে গিয়েছিল হরিমোহন মাইতি। কারণ বৈবাহিক মিলনকে ধর্ষণ বলে মানতে রাজি হয়নি তৎকালীন প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সমাজ। 


আইন একটা এসেছিল বটে, The Age of Consent Act, 1891 যাতে বলা হয়েছিল, যৌন মিলনের জন্য সম্মতির বয়স মেয়েদের বাড়িয়ে ১০ থেকে ১২ করা হল। শিশুবিবাহ বিরোধী আইন আসতে লেগেছিল আরও চল্লিশ বছর প্রায়। The Child Marriage Restraint Act চালু হয় ১লা এপ্রিল, ১৯৩০ সাল নাগাদ। যাতে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৪ আর ছেলেদের ১৮ ধার্য করা হয়। ভোটাধিকার, সম্পত্তির অধিকার, কাজের ক্ষেত্রে সমবেতনের অধিকার ইত্যাদি পেতে মেয়েদের লেগেছিল আরো অনেক অনেক বছর। খুব সহজে এতটা পেয়ে গেছেন না, তাই হেলায় বলতে/ লিখতে পারেন, এই দিনটা নিষ্প্রয়োজন। কূপমন্ডুকতার বাঁধন ছিঁড়ে তাকিয়ে দেখুন, বাস্তব চিত্র যে ভিন্ন কথা বলে। ২০২৫ এর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের থিম কি জানেন? "Accelerate Action" অর্থাৎ পথ এখনও অনেক বাকি, লিঙ্গ বৈষম্যের লড়াই এখন অনেক জটিল, এখনই অস্ত্র ত্যাগ করলে চলবে নাকি।



অনির ডাইরি ৬ই মার্চ, ২০২৫


#অনিরডাইরি 


অঞ্চিতাদির সঙ্গে আলাপ চন্দননগরের তৎকালীন বড় সাহেবের মাধ্যমে। সালটা সম্ভবত ২০১৮ বা ১৯। বড় সাহেব নির্দেশ দিলেন, গৃহসেবিকাদের নিয়ে একটা কর্মশালা সংগঠিত করতে হবে। নির্দেশ মত চুঁচুড়ার নতুন সার্কিট হাউস বুক করলাম আমরা। চন্দননগর এবং চুঁচুড়া মহকুমার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তত্ত্বতালাশ করে প্রায় ৫০/৬০ জন গৃহশ্রমিক মহিলাকে জোগাড় করলাম আমরা। মূল লক্ষ্য ওদের সামাজিক সুরক্ষা যোজনায় নথিভুক্ত করা, সাথে সাথে গৃহশ্রমিকদের বিভিন্ন অধিকার এবং দাবিদাওয়া বিষয়ে অবহিত করা। 


এই দ্বিতীয় বিষয়টি নিয়ে আমাদের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। প্রয়োজন ও ছিল না। স্যার বললেন, " ওটা তুমি অঞ্চিতাদির ওপর ছেড়ে দাও।" এমন বললে প্রশ্ন করতেই হয়, অঞ্চিতাদি আবার কে? শুনলাম শ্রীমতী অঞ্চিতা ঘটক, পরিচিতি নামক এক এনজিওর মুখ্য কর্ণধার। পরিচিতি মূলতঃ গৃহশ্রমিক যাদের পাতি জনগণ কাজের মাসি বা দিদি বলে সম্বোধন করে, তাদের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে ব্যাপ্ত। 


নির্দিষ্ট দিনে এসে উপস্থিত হলেন অঞ্চিতা দি, যেমন লম্বা, তেমনি ফর্সা, তেমনি গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বর। কিঞ্চিৎ মেদুল এবং প্রখর ব্যক্তিত্বময়ী। প্রথম আলাপেই বেশ ভাব জমে গেল। মনে হল মানুষটা ভীষণ পজিটিভ। সর্বাঙ্গ দিয়ে যেন পজিটিভ এনার্জি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। নিজের সম্বন্ধেও আমার তাই ধারণা। সে অর্থে আমরা সমমেরু সম্পন্ন, কিন্তু বিন্দুমাত্র বিকর্ষণ বোধ হল না।আসলে আমি বরাবরই বীরাঙ্গনাদের অনুরাগী। 


সেদিন কর্মশালার ফাঁকফোকরে অনেক গল্প হল। শুনলাম আশির দশকের শেষ থেকে মহিলাদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে লড়ছেন অঞ্চিতা দি। আপাতত গৃহশ্রমিকদের অধিকার নিয়ে সরব হবার পাশাপাশি আরো অনেক গুলি ইস্যু নিয়ে কাজ করছেন। যার মধ্যে অন্যতম অবশ্যই গার্হস্থ্য হিংসার শিকার মহিলাদের পাশে দাঁড়ানো। তবে আমার সবথেকে ভালো লেগেছিল, কলকাতার বিভিন্ন বস্তি এলাকার নিঃসঙ্গ প্রৌঢ়া-বৃদ্ধাদের নিয়ে অবসর বিনোদনের কার্যক্রম। উচ্চ-মধ্য-নিম্নবিত্ত নির্বিশেষে বয়স্ক মহিলারা যে বড় বেশী নিঃসঙ্গ তা আশেপাশে তাকালেই বুঝতে পারি। কেউ তো তাদের কথা ভাবুক। 


সেদিনের পর বছর দুয়েক আর অঞ্চিতা দির সাথে কোন যোগাযোগ হয়নি আমার। তারপর তো রৈরৈ করে এসে গেল কোভিড। ঝাঁপ ফেলে দিল গোটা বিশ্ব। স্তব্ধ হয়ে গেল জীবন। স্তব্ধ হল না কেবল আমার আপিস। সেদিনও আপিস যাচ্ছিলাম, জনশূন্য অলিগলি রাজসড়ক ধরে প্রায় ১২০/১৫০ কিমি বেগে গাড়ি ছোটাচ্ছিল ড্রাইভার ছেলেটি। আচমকা বেজে উঠল মুঠোফোন, আমার নয়, ড্রাইভারের। প্রথম চোটে গাড়ি চালাতে চালাতেই ফোন ধরল ছেলেটা। তারপর স্তব্ধ হল গাড়ির ইঞ্জিন। উত্তেজিত হয়ে দরজা খুলে মাঝরাস্তায় নেমেই গেল ছেলেটি। বাতানুকূল বন্ধ গাড়ির ভিতর থেকে দেখতে লাগলাম প্রবল হাত পা নাড়ছে ছেলেটি, ফুলে উঠছে গলার শির, লাল হয়ে উঠছে মুখ। তারপরই বাঁধ ভেঙে নেমে এল বারি ধারা। 


বিশ্বাস করুন, কাঁদলে মেয়েদের থেকে অনেক বেশি অসহায় লাগে ছেলেদের। ফোঁপাতে ফোঁপাতে গাড়িতে ফিরে এল ছেলেটি। কি হয়েছে শুধাতে হল না। গড়বড় করে বলেই ফেলল ছেলেটা। ওর অন্তসত্ত্বা স্ত্রীকে প্রবল মেরেছে ছেলেটির মা আর মাসি মিলে। ছেলেটির মা নাকি এক উঠতি মস্তানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, লকডাউনের আগে প্রকাশ্যে তার বাইকে চেপে ঘুরে বেড়াত, তাই নিয়ে ছেলেবউ এর ঘোরতর আপত্তি ছিল। লকডাউন ঘোষিত হওয়ায় সেটা আর করতে পারছিল না। আজ লোকটি বাড়িতে এসে হাজির হয়। প্রতিবাদ করে বউটি, পরিণামে শাশুড়ি-মাসিশাশুড়ি এমনকি মাসতুতো দেওরটিও আচ্ছা করে ধোলাই দিয়েছে মেয়েটিকে। মাথার চুল ছিঁড়ে দিয়েছে।


এইসব ক্ষেত্রে যা হয় আরকি, ৪৯৮ এ ধারায় থানায় বধূ নির্যাতনের নালিশ করতে যায় স্বামী-স্ত্রী মিলে।কেস না নিয়ে, থানা শাশুড়ি এবং তার সঙ্গীকে ডেকে পাঠায়। ব্যাস, তারপর আর কিছুই হয় না। ধামাচাপা পড়ে যায় সব। এদিকে বাড়িতে উত্তোরত্তর বাড়তে থাকে নির্যাতন। যেদিন আমি অফিস যাই, স্বামী স্ত্রী এসে বসে থাকে আমার চেম্বারের বাইরে। " প্লিজ ম্যাডাম, কিছু করুন -"। কি করি আমি? কি করার ক্ষমতা আছে আমার? থানা সহযোগিতা করছে না বলে, পাঠাই নারী উন্নয়ন আধিকারিকের কাছে। তিনি আবার আমারই জেলার মেয়ে, আমারই স্কুলের ছাত্রী। আমার এবং DSWOর যুগপৎ রেফারেন্স সত্ত্বেও সেখান থেকে যে সহমর্মিতা পেয়েছিল ঐ দম্পতি সে আর বলে কাজ নেই। 


এর মধ্যে হল কি, এই নিয়ে বিশদ আলোচনা করার জন্য থানার মেজবাবু মেয়েটিকে একদিন তাঁর কোয়ার্টারে ডেকে পাঠালেন। স্পিকার অন করে বার্তালাপ করার সৌজন্যে সেই আহ্বান শুনল আমার গোটা অফিস। ছেলেমেয়েটি মিলে এবার চেপে ধরলে আমার পা। 'ম্যাডাম বাঁচান। নইলে যুগলে সুইসাইড করব -"। শেষ অস্ত্র হিসেবে ফোন লাগালাম অঞ্চিতা দিকে। নিজের পরিচয় দিলাম, অঞ্চিতা দির কন্ঠে ফুটে উঠল পরিচিত উষ্ণতা। " বলো, বলো অনিন্দিতা। কি খবর।" খুব ছোট করে বললাম। অঞ্চিতা দি বললেন, " আমি একটা ভিসিতে আছি, ভিসি শেষ করেই তোমার সঙ্গে কথা বলছি।" 


আধ ঘন্টা বাদেই কথা হল বিশদে। সব শুনে দিদি প্রশ্ন করলেন, " এই নিয়ে হাজব্যান্ডের স্ট্যান্ড কি? মেয়েটির পক্ষে না বিপক্ষে?" জবাব শুনে বললেন, " হুম, দেখছি। আমাকে মেয়েটির ফোন নম্বর দাও। আসলে আমার মেয়েরা ঠিক এই সময় বন্যা দুর্গত এলাকায় ত্রাণ বিলিতে ব্যস্ত। দুয়েক দিনের মধ্যেই ওরা যোগাযোগ করবে। মেয়েটিকে নিয়ে থানায় ও যাবে।ওদের কাউন্সেলিং এর ও ব্যবস্থা করবে। তারপর দেখা যাক -"।


পরদিন অফিস যাবার পথে ছেলেটির মুখে শুনলাম সেদিন রাতেই ফোন এসেছিল মেয়েটার কাছে। অনেক ক্ষণ ধরে মনোবল বৃদ্ধির কাজ করেছে পরিচিতির মেয়েরা। দিন দুয়েকের মধ্যেই এসে হাজির হল পারমিতা আর শুভ্রা। মেয়েটির সঙ্গে গেল থানায়। এবারে আর কেস নিতে কোন সমস্যা হল না থানার। 


সেই থেকে অঞ্চিতাদি আর তার মেয়েদের ওপর আমার অগাধ ভরসা। যদি কোন মেয়ে নিজে লড়তে চায়, সহযোদ্ধা হবেই ওরা। অন্তত আমার তাই বিশ্বাস। বিগত পাঁচ বছরে আর যোগাযোগ হয়নি অঞ্চিতাদির সাথে। দীর্ঘ দিন বাদে গত সপ্তাহে ফোন করেছিলাম আমি, " দিদি আসন্ন আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে একটা কর্মশালা করতে হবে আমায়, আসবেন?" কোন ঝানু ট্রেনার নয়, আমি চাই আমার মেয়েরা প্রকৃত যোদ্ধার থেকে শিখুক। 


Vini vidi vici কাকে বলে আজ স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করলাম। দিদি এলেন, দেখলেন আর হেলায় জয় করে নিলেন উপস্থিত প্রতিটা মেয়ের মন। আর আমি? আমি বললাম, দিদি একটা hug আর একটা সেলফি প্লিজ।

Wednesday, 26 February 2025

অনির ডাইরি ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

 অনির ডাইরি ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

#অনিরডাইরি 


"ম্যাডাম, আপনাকে একটা কথা বলার ছিল। আমাদের গ্রামে একজনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, বাড়ির লোক ডাইরি লেখাতে গিয়েছিল, থানা থেকে ডাইরি নিচ্ছে না।" থানায় ডাইরি করা যে কি অসম্ভব চাপের তা আমি হাড়েহাড়ে জানি। কিছুদিন আগে আমার নাম করে টাকা তোলার নালিশ পেয়েছিলাম একটি ছেলের বিরুদ্ধে, দপ্তরী তদন্ত করিয়ে তার নামে FIR করতে আক্ষরিক অর্থে কাল ঘাম ছুটে গিয়েছিল। পাক্কা এক সপ্তাহ ধরে আমার লোকজনকে ঘুরিয়ে ছিল থানা, তমলুকের মহকুমা শাসক থেকে পুলিশের বড় সাহেব কাকে না বলেছি - সকলে তৎক্ষণাৎ থানায় ফোন ও করেছেন, কিন্তু দিনের শেষে প্রসব হয়েছে অশ্বডিম্ব। অষ্টম দিনে গিয়ে আইসি সাহেবের বদান্যতায় লক্ষ্য ভেদ করি আমরা। 


লোকটাকে বলি, কোন রাজনৈতিক নেতাকে গিয়ে ধরুন, উনি ফোন করলে নির্ঘাত নিয়ে নেবে। এই নিয়েও হাতে গরম অভিজ্ঞতা আছে আমার। বাঁশবেড়িয়ার শ্রমিক মেলার মাঠে তুচ্ছ রাজনৈতিক কারণ দেখিয়ে ব্যাপক হুজ্জুতি বাঁধিয়েছিল এক পেঁচো মাতাল নেতা। আমার এক ইন্সপেক্টরকে এই মারে তো সেই মারে। অতিরিক্ত জেলা শাসক থেকে থানার বড় বাবু কাকে না ফোন লাগিয়েছি পাগলের মত। ফল হয়েছে ঐ অশ্বডিম্ব। শেষে বাধ্য হয়ে ফোন করেছিলাম তৎকালীন মন্ত্রী তপন দাশগুপ্তকে। ভোজবাজির মত ফোন কাটার পাঁচ মিনিটের মধ্যে পুলিশ এসে আপদটাকে নিয়ে চলে গিয়েছিল। 


লোকটা তাও যায় না। যে থানার নাম বলছে, সেটা কাঁথি মহকুমার অন্তর্গত, মনোগত ইচ্ছা আমি যদি একটু শৌভিককে বলে দিই, মহকুমা শাসক বললে থানা নির্ঘাত ফেরাবে না। এমন সব আব্দার নিয়ে লোকজন প্রায়ই আসে। শৌভিক তমলুকে থাকতেও আসত, কাঁথি যাবার পরও আসে। অধিকাংশই একটা কাজের দরবার করতে আসে। এই লোকটিও অনেক বার বলেছে, " একটু স্যারকে বলুন না, যে কোন কাজ -। ঝাঁট দেবার কাজ, অফিসে বাথরুম সাফ করার কাজ যা হোক -।" আমি যে শৌভিককে বলিনি তাও নয়। কিন্তু কাউকে কাজ দেখে দেওয়া কি অত সোজা, তাও কাঁথির মত জটিল জায়গায়। লোকটির আবার ডিগ্রি বলতেও কিস্যু নাই। বলে সিক্স পাশ, তারও কোন প্রমাণপত্র নাই। 


প্রশ্ন করি, যে নিখোঁজ হয়েছে সে মেয়ে না ছেলে? লোকটি জবাব দেয়, " আজ্ঞে ম্যাডাম, ছেলে মানে লোক। অন্ধ্রপ্রদেশে কাজে গিয়েছিল আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।" বলি, ওখানে চেনাশোনা কেউ নেই? কোন সহকর্মী বা মালিকের নম্বর নেই? লোকটা মাথা চুলকে বলে, " আজ্ঞে ওখানকার কারো নম্বর তো নেই। গাঁয়ের আর একটা ছেলে গিয়েছিল, সে বছর দুয়েক আগে ফিরে এসেছে। আর যায় নাই। সে ফোন করেছিল, মালিক বলেছে, ' কই ও তো আসে নাই।'" 


সে আবার কি কথা? ওর নম্বরে ফোন করলে কি বলছে? লোকটা মাথা চুলকায়," ফোনটায় ফোন করলে, কিছু হচ্ছে না। মানে কোন শব্দ আসছে না বলতেছে -"। শুধাই, লোকটার সাথে লাস্ট কবে কথা হয়েছিল বাড়ির লোকের? "আজ্ঞে, মাস আটেক আগে"। 


চমকে উঠে শুধাই, মানে? কতদিন ধরে নিখোঁজ? লোকটা জবাব দেয়, " আজ্ঞে আট মাস।" আট মাস ধরে নিখোঁজ! আর বাড়ির লোক আজ গেছে পুলিশে খবর দিতে? লোকটা বলে, " আজ্ঞে। প্রথম দুই আড়াই মাস এরা কিছু ভাবেনি। তারপর যখন সন্দেহ হয়েছে তখন খোঁজখবর করা শুরু করেছে।" কেমন যেন সন্দেহ হয় আমার, বাইরে কাজ করতে গিয়ে একটা লোক আট মাস বাড়িতে ফোন করবে না? অন্য গল্প নেই তো? হয়তো অন্য কারো সাথে ঘর বসিয়েছে অন্য কোথাও। বা হয়তো বউটার এমন কোন সম্পর্ক আছে, তাই মনের দুঃখে গৃহত্যাগী হয়েছে লোকটা। 


লোকটা বিষণ্ন ভাবে মাথা নাড়ে, " ঠিকই কইছেন ম্যাডাম। এসব আজকাল ঘরে ঘরে হচ্ছে। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক তো আমাদের গেরামে জল ভাত। আপনাকে গল্প বলেছিলাম না - প্রতিবাদ করায় আমার তুতো ভাইটাকে বেঘোরে মরতে হয়েছিল।" আমাকে এত মানুষ নিত্য এত গপ্প শোনান, ইনি কোন গল্পের কথা বলছেন বুঝতে পারি না। 


হয়তো আমার মুখ দেখেই ধরে ফেলে লোকটা, " বছর নয় আগের কথা। আমাদের পাশেই ওদের বাড়ি। সম্পর্কে আমার মামা হয়। মামা বাইরে কাজে যেত, মামী আর মামাতো বোনটা বাড়িতেই আসর বসাতো। ভাইটা এত কিছু জানত না। জানার বয়স ও হয়নি। কত আর হবে, বছর আটেকের ছেলে। কি মিষ্টি দেখতে ছিল ম্যাডাম, আপনাকে কি বলব। আমাদের বাড়ি প্রায়ই আসত। ছেলেটা একদিন বোধহয় দিদিকে আর ওই ছেলেটাকে ঘরের মধ্যে অস্বস্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলে। ভয় দেখায়, ' বাবাকে বলে দুব।' যেই না বলা অমনি ভাত খাবার পিঁড়ি আছে না ম্যাডাম, ওর দিদি করে কি ওকে ওই পিঁড়ি দিয়ে মাথার পিছনে মারে। মারতেই ও ছিটকে পড়ে যায়। অজ্ঞান হয়ে যায়। তখন দিদি আর ওই ছেলেটা মিলে, চালের বাতার সঙ্গে দড়ি বেঁধে ছেলেটাকে ঝুলিয়ে দেয়।" 


মাগো! আঁতকে উঠি আমি। লোকটা বলে, " হ্যাঁ ম্যাডাম। আমি তো তখন ডিউটিতে। ওর দিদি আমায় ফোন করে বলে, শীঘ্র এসো। ভাই ইলেক্ট্রিকের শক খেয়েছে। আমি কি জানি। আমি বলি, শক খেয়েছে তো আমায় বলছিস কেন? দারুয়ায় ( সরকারী হাসপাতাল) নিয়ে যা। ওদের আর সাহস নেই যে হাসপাতালে আনে। শেষে আমি বলে দিলাম, গাঁয়ের কয়েকজন ছেলেছোকরা ওকে এনে হাসপাতালে ভর্তি করল। হাসপাতাল কি বোকা! ডাক্তার বাবু দেখেই বুঝেছেন, গড়বড় কেস। বলছে শক খেয়েছে, কিন্তু গলায় দড়ির দাগ, কান পট্টির পিছনে আঘাতের চিহ্ন। উনি দিয়েছেন থানায় খবর পাঠিয়ে।


পুলিশ দেখেই তো সব পালিয়েছে। আমার নম্বর দেওয়া ছিল, পুলিশ আমাকেই ফোন করে ডাকল। আমি যা বলার বললাম, যে আমি অমুক জায়গায় কাজ করছিলাম। সবাই সাক্ষী আছে। আর যা জানা আছে নিশ্চয় বলব, আগে ভাইটার দাহসৎকার করি।" শুধাই ওর মা কিছু বলল না? লোকটা ফোঁৎ করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, " মা বলল, মরে গেছে? ওকে কাঁথি তেই দাহ করে এসো। গেরামে আর আনতে হবে না।" 


তীব্র বিবমিষায় ভুগি আমি, অক্ষম রাগে নিশপিশ করে হাত পা। এরা মা? কত নারী, কত দম্পতি হাজার চেয়েও সন্তানের মুখ দেখতে পায় না। আর ঈশ্বর এদের মুড়িমুরকির মত বাচ্ছা দেয়। ছিঃ। প্রশ্ন করি, তারপর কি হল? পুলিশ নিশ্চয় ওর মা আর দিদিকে মারতে মারতে জিপে তুলে নিয়ে গেল? আদালত নির্ঘাত ফাঁসির সাজা দিল? 


লোকটা হাসে। "গেরামে ওসব হয় না ম্যাডাম। গ্রাম অনেক জটিল জায়গা। গ্রামের লোক পুলিশকে আটকে দিল। বললে আমরা দেখে নিচ্ছি। তারপর সভা বসল। ওদের বিচার হল। বিচারে ক্ষতিপূরণ হিসেবে অনেকটা জমি লিখিয়ে নেওয়া হল গ্রামের নামে।" প্রাণের ক্ষতিপূরণ? হতবাক হয়ে বসে থাকি আমি। লোকটা বলে, " হ্যাঁ। এই নিয়েই তো আমার সাথে গ্রামের ঝামেলা। আমি বলেছিলাম ঐ জমিতে ছেলেটার নামে একটা স্মৃতিসৌধ তৈরি হোক। তা নয়, গ্রাম করল কি একটা শীতলা মন্দির বানালো। খানিকটা জমি বিক্রি করে দেওয়া হল। সেই টাকাটা গ্রামের একাউন্টে রাখা আছে -। এখন বলছে ওই টাকায় একটা লক্ষ্মী মন্দির করবে"।


অনির ডাইরি ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 




দ্রুততম গতিতে প্রস্তুত হই আমি। নেই নেই, সময় নেই। বিকাল সাড়ে পাঁচটা-পৌনে ছটায় লগ্ন। ঘড়িতে ইতিমধ্যেই পাঁচটা বেজে পাঁচ, ধড়াচূড়া পরে প্রস্তুত শৌভিক। রবিবারের এই ভাত ঘুমটাই যত নষ্টের গোড়া। কি যে মরণ ঘুম ধরেছিল আমার, পাশ থেকে কখন উঠে গেছে আমার বর, তৈরি হয়েছে কিচ্ছুটি টের পাইনি আমি। এখন তিনি হুমকি দিচ্ছেন, "তিন মিনিট সময়, না হলে তোকে ফেলেই চলে যাব।" 


ইল্লি আর কি, আমায় ফেলে চলে যাবেন! পাঁউসির অন্তোদ্যয় অনাথ আশ্রমে আজ বসেছে গণবিবাহের আসর, যখন থেকে শুনেছি সেই আসরে আমন্ত্রিত মাননীয় মহকুমা শাসক, তখন থেকে মনস্থ করেছি, বরের লেজুড় হয়ে আমিও যাব।শৌভিকের তো যাবার কোন চাড়ই ছিল না, সপ্তাহ শেষে একটা নিখাদ ছুটির দিন, ব্যাটা ঘরে বসে ভারত পাকিস্তানের ম্যাচ দেখতে বেশি আগ্রহী ছিল। আমার ঘ্যানঘ্যানানির জন্য যেখানে যেতে রাজি হল, আমাকে ফেলেই সেখানে যেতে উদ্যত হয়েছে, এই না হলে আমার বর। 


দ্রুত হাতে আলমারি ঘাঁটি আমি, হোক গণবিবাহ, তাও তো বিয়ে বাড়ি রে বাবা। যা হোক পরে তো আর যাওয়া যায় না। পাশ থেকে গজগজ করে শৌভিক, "দুস্থ ছেলেমেয়েদের বিয়ে, সেখানে কি তুই বেনারসী পরে যাবি?" বেনারসী নাহোক, জামদানী পরি একটা, দ্রুত হাতে ঠোঁটে ঘষে নিই সবথেকে ক্যাটক্যাটে লাল লিপস্টিক, পাউডার/ফাউন্ডেশন তো কিছু লাগাতে পারলাম না, এতেই একটু জ্বলজ্বল করবে মুখটা। চোখে বুলিয়ে নিই কাজল। আর কিছু লাগাবার সময় নেই। দুটো ঝুটো কানের দুল, একটা মঙ্গলসূত্র, ঘড়ি আর বালাটা হাতে নিয়েই বেরিয়ে পড়ি। গাড়িতে পরে নেব ক্ষণ। 


বাবা-মা- তুত্তুরী গভীর নিদ্রামগ্ন, শাশুড়ি মাতা জেগেছিলেন, তাঁকেই বলে বেরোই দুজনায়। ঘড়িতে পাঁচটা কুড়ি, পাটে বসেছেন সূর্য দেব। আমাদের গন্তব্য কাঁথি থেকে খুব একটা দূরে নয়, কুড়ি-একুশ কিলোমিটারের মতো হবে। 


দীঘা-নন্দকুমার রোড ধরে সোজা চলতে চলতে, কালীনগরের মোড় থেকে বাম দিকে বেঁকে যাই আমরা। ক্যানেলের পাশ ঘেঁষে সরু পিচের রাস্তা, রাস্তার দুই ধারে ইউক্যালিপটাসের সারি। সেই সারি ভেদ করে যতদূর চোখ যায়, ঘন সবুজ ভেলভেটের মত বিছিয়ে থাকা ধান ক্ষেত। ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যাতেও তাদের রূপে জুড়িয়ে যায় প্রাণ।


 এই পথে আমার খুব বেশি আসা হয়নি, এর আগে একবারই এসেছিলাম ২০২৩ সালের মার্চ মাসে, এই আশ্রমেরই বসন্তোৎসবে। আজও মনে আছে, বাংলায় "অন্ত্যোদয় অনাথ আশ্রম" লেখা বোর্ড টাঙ্গানো বিশাল গেটের ভেতর দিয়ে যখন ঢুকেছিলাম, একনজরে বুঝতে পারিনি, ওটা অনাথ আশ্রম না কোন রিজর্ট! সর্বত্র পরিচ্ছন্নতা আর যত্নের ছাপ, থোকায় থোকায় ফুটে ছিল কেয়ারি করা মরশুমি ফুলের দল। মনে আছে, একটা শেডের তলায় দাঁড় করানো ছিল, অনেকগুলি ছোট বড় গাড়ি। ড্রাইভার নূপুর বাবু বলেছিলেন, "ওই দেখুন বসন্তোৎসবে কত মানুষ এসেছে। দেশবিদেশ থেকে এনারা প্রচুর অনুদান পান।"


হলুদ গোল গলা গেঞ্জি আর সাদা সুতির পাজামা পরিহিত এক ভদ্রলোক দৌড়ে এসেছিলেন আমাদের স্বাগত জানাতে। এক মাথা অবিন্যস্ত কাঁচা পাকা চুল, খালি পা, মুখে এক গাল হাসি। জেনেছিলাম উনিই বলরাম করণ, এই আশ্রমের প্রাণপুরুষ। বলরাম বাবু সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়ে, নিয়ে গিয়েছিলেন আশ্রমের ভিতরে। বিশাল এলাকা জুড়ে আশ্রম। বেশ অনেকটা রাস্তা হেঁটেছিলাম আমরা। একদিকে মস্তপুকুর আর অন্যদিকে বড় বড় বিল্ডিং আর বাগান। লক্ষ্য করেছিলাম সবকিছুই বেশ হাইটেক এখানে। কোথাও তাচ্ছিল্য বা অবহেলা বা দীনতার কোন ছাপ নেই। 


সেবার বলরাম বাবুর মুখেই শুনেছিলাম অন্ত্যোদয় অনাথ আশ্রমের গল্প। স্ত্রী আর তিন মেয়ে ময়না-চায়না আর মণিকে সঙ্গী করে একার চেষ্টায় এই আশ্রমটি গড়ে তোলেন নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। তখন আবাসিকের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। সামর্থ ছিল নগন্য। একটি মাত্র ঘর সম্বল। মেদিনীপুরের ভূমিপুত্র কিনা, তাই জেদ অদম্য। পিছু হটেননি বলরাম বাবু। গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে, দিয়ে এসেছেন একটি করে মাটির হাঁড়ি। ওণার ভাষায়, মা লক্ষীরভান্ডার। আর অনুরোধ করেছেন বাড়ির মা বউদের, " মাগো, তোমরা যখন তোমাদের ছেলেমেয়ের জন্য ভাত বসাবে, তখন আমার অনাথ শিশু গুলোর কথাও একটু ভেবো। একমুঠো চাল ওদের জন্য ফেলে দিও এই হাঁড়িতে। মাসের শেষে এসে, সেই হাঁড়ির চাল নিয়ে যাব আমি। তাই দিয়েই ভরবে আমার বাচ্ছাগুলোর পেট।" 


এই ভাবেই লড়েছেন কিন্তু পিছু হটেননি। বন্ধ হয়নি আশ্রম। আনন্দবাজার পত্রিকার স্থানীয় প্রতিবেদক শ্রী সুব্রত গুহ, যখন জানতে পারেন বলরামবাবু আর ওনার এই লক্ষ্মীর ভান্ডারের গল্প, তখন উনি এই নিয়ে একটি লম্বা প্রতিবেদন লেখেন। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায়, ২০০৪ সালে আট কলম জুড়ে ছাপা হয় সেই প্রতিবেদন। তারপরে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি বলরাম বাবুকে। ২০২৩ সালে এই আশ্রমে ৫০ জন বালক এবং ৫০ জন বালিকা থাকত। পাশেই আর একটি আশ্রম গড়ে তুলেছেন বলরাম বাবু। সেখানে থাকত আরো ৬৫ জন মেয়ে ও শিশু।


সেবার আলাপ হয়েছিল আশ্রমের বহু শুভানুধ্যায়ীর সাথে। এনারা যে শুধু যে নগদ অর্থে সাহায্য করেছেন বা করে চলেছেন তাই নয়, এমনও মানুষের সাথেও আলাপ হয়, যিনি ছেড়ে দিয়েছেন কলকাতায় তাঁর ব্যক্তিগত দোতলা বাড়ি। সেখানে খোলা হয়েছে আশ্রমের একটি টেম্পোরারি অফিস। আশ্রমের কোন শিশু অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ওখানে রেখে ডাক্তার দেখানো হয়। যে সমস্ত আবাসিক বালক বা বালিকা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেছে, তারা ওখানে থেকেই পড়াশোনা করে। শুনেছিলাম তখন নার্সিং পড়ছিল বেশ কয়েকজন মেয়ে। শুনেছিলাম অনাথ আশ্রম চালানো ছাড়াও আরো অনেক কিছু করেন ওনারা। বিনামূল্যে ছানি অপারেশন শিবির করেন, গণবিবাহ দেন, ইত্যাদি প্রভৃতি। তেমনি এক গণবিবাহে আজ শৌভিক আমন্ত্রিত, আর আমি তার প্লাস ওয়ান বলতে পারেন। 


গন্তব্যে পৌঁছে যাই আমরা, আবার সেই বাংলায় বোর্ড লেখা বিশাল লোহার গেট। আজ সেই গেটের ওপর জ্বলজ্বল করছে হ্যালোজেন আলো। অগুনতি ফুলের মালা দিয়ে নববধূর মত সাজানো হয়েছে তাকে। গেট থেকে এঁকেবেঁকে ভিতরে যাওয়ার রাস্তায় গাড়ি প্রবেশ করার সাথেই জ্বলে উঠল শয়ে শয়ে আলো। যেন আমাদেরই প্রতীক্ষায় ঘুমিয়ে ছিল তারা। দৌড়ে এলেন বলরাম বাবু, আজ তাঁর পরণে বুনিয়াদি পাজামা পাঞ্জাবি। 


বিগত বারের মতই বলরাম বাবুকে অনুসরণ করে অনেকটা পথ হাঁটলাম আমরা। আপাত শান্ত আশ্রম আজ গমগম করছে সুবেশ নারী পুরুষের সমাগমে, বরযাত্রী এবং কনেযাত্রীর দল। পরণে তাদের সবথেকে নতুন, সবথেকে মূল্যবান পোশাক খানা। আহা আজ বিয়ে বাড়ি যে! রাস্তার বাঁকে মাথায় প্রদীপ নিয়ে নাচছে আদিবাসী রমণীর দল, মাইকে ভেসে আসছে বেদমন্ত্র। আশ্রমের টিনের শেড খানি আজ ভোল বদলে হয়েছে বিবাহমণ্ডপ। চতুর্দিকে রোশনাই, একই সাথে বিয়ে হচ্ছে এগারো জন কন্যার। যাদের মধ্যে তিনজন আশ্রমবালা, বাকিরা আশেপাশের গ্রামের মেয়ে। 


বলরামবাবু বলতে থাকেন," জানেন স্যার, বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে রীতিমত প্রচার করি আমরা। আশেপাশে যত গাঁ আছে, আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বোঝাই, তোমরা গরীব তো কি? নাবালিকা মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দিবে? মেয়েটাকে বড় হতে দিবেনি? লেখাপড়া শিখতে দিবেনি? ওকে পড়তে দাও, সময় হলে আমি দুব ওর বিয়ে।" শৌভিক জিজ্ঞাসা করে, আজ যাদের বিয়ে হচ্ছে, তাদের বয়স কত। বলরাম বাবু জবাব দেন, ১৯ থেকে ২৪। শৌভিক আবার প্রশ্ন করে, ছেলেগুলো কি সব স্থানীয়? বলরাম বাবু জানান, অধিকাংশই পূব মেদিনীপুরের বাসিন্দা। জনা দুয়েক বাঁকুড়ার ছেলেও আছে। 


গোটা শেডটাকে আজ মুড়ে দেওয়া হয়েছে রংবেরঙের কাপড়, ফুলে আর রোশনাইয়ে। বানানো হয়েছে এগারোটা সুসজ্জিত মণ্ডপ। প্রতিটা মণ্ডপে রাখা আছে স্টিলের খাট, খাটের ওপর নতুন ম্যাট্রেস, নতুন সাইকেল, দানের বাসন আরও কত কি। প্রায় প্রতিটি খাটের ওপর বসে আছে টুকটুকে লাল বেনারসী পরা সুন্দরী কনের দল। সাধ্যমত গহনা পরেছে সকলেই, মাথায় লাল চেলী, চেলীর ওপর শোলার মুকুট, কপালে-কপোলে শ্বেত চন্দনের কল্কা। বরবাবাজীরা আসনপিঁড়ি নিয়ে বসেছে মাটিতে। মুখোমুখি বসেছেন পুরুত ঠাকুর, চলছে শুভ পরিণয়ের বিভিন্ন আচার। যাঁরা কন্যা সম্প্রদান করবেন,তাঁরাও বসেছেন পুরুত ঠাকুরের পাশে। 


খানিকক্ষণ বসে বসে বিয়ে দেখলাম আমরা। অতঃপর বলরাম বাবু ডেকে নিয়ে গেলেন বাইরে। খোলা মাঠে মঞ্চ বেঁধে চলছে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রচুর জন সমাগমে পরিপূর্ণ মাঠখানি। এক পাশে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে জনা চার পাঁচ ফুচকাওয়ালা। তাদের ঘিরে ভিড় জমিয়েছেন বিভিন্ন বয়সী রমণীরা।আছে চা, কফি, লস্যি। মেয়েদের বিয়ের আয়োজনে কোন ত্রুটি রাখেননি বলরাম বাবু। 


সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান স্থগিত রেখে মঞ্চে তোলা হল আমাদের। লাল-গোলাপী বেনারসী পরিহিত দুই পল্লীবালা এসে চন্দনের টিকা, উত্তরীয় আর পুষ্প স্তবক দিয়ে বরণ করে নিল আমাদের। বরণ করা হল উপস্থিত অন্যান্য মান্যগণ্য অতিথিদের, যাঁদের মধ্যে ছিলেন সাংবাদিক সুব্রত বাবুও। সেই সুব্রত গুহ, আনন্দবাজারে যাঁর লেখা প্রতিবেদন রাতারাতি বদলে দেয় পাঁউসির অন্তোদ্যয় অনাথ আশ্রমের ভবিষ্যৎ। সম্প্রতি তিনি একটি বইও লিখেছেন, বলরাম বাবু এবং এই আশ্রমকে নিয়ে। হয় সংক্ষিপ্ত বার্তা বিনিময়, ছোট্ট করে বক্তব্য রাখে আমার বরও, এবার ঘরে ফেরার পালা। ছুটে আসেন বলরাম বাবু, "স্যার না খেয়ে তো যেতে দিব না। রান্না প্রায় শেষ, দুটি খেয়ে যান।মেয়েগুলোর কল্যাণ হবে।" 


নবদম্পতিদের প্রতি একরাশ আশীর্বাদ আর শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে করজোড়ে মাপ চেয়ে বেরিয়ে আসি আমরা, বাড়িতে তিন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আর একটা ঘণ্টু যে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। আসার সময় একটা বাক্স হাতে তুলে দেন বলরাম বাবু, "স্যার এটা কিন্তু নিতেই হবে, আমার আশ্রমের ছেলেদের হাতে বানানো-"। দুহাত পেতে ওনার উপহার আর একরাশ ভিন্ন স্বাদের ভালোলাগা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি আমরা, বাড়ি ফিরে জানতে পারি, ম্যাচটা ইন্ডিয়াই জিতেছে।


অনির ডাইরি ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

#অনিরডাইরি 



ঘুমিয়েই পড়েছিলাম, কার যেন উত্তেজিত কথাবার্তায় চমকে উঠে বসলাম। ঘাড়টা ব্যথা হয়ে গেছে, সোফার ওপর এক পা মুড়ে, রেলিংয়ে মাথা রেখে ঘুমানোর ফল। হাঁটুটাও টনটন করছে। 

সেই হাসপাতাল, সেই ছোট্ট অফিস ঘর, সেই শৌভিক আর আমি। ভোর পাঁচটায় উঠেছি আমরা, তারপর এক কাপ কালো কফি খেয়ে, শ্রীমতী তুত্তুরীকে ঘুম থেকে টেনে তুলে, ভালো করে পরীক্ষা দেবার সদুপদেশ দিয়ে ছটা নাগাদ বেরিয়েছি কাঁথি থেকে। সাতটা থেকে তাঁর কম্পিউটার সায়েন্সের পরীক্ষা, সাতটা থেকে শাশুড়ি মায়ের অস্ত্রোপচার। কিছু দিন আগে যে পায়ে অপারেশন হয়েছিল, আবার সেই পায়েই ছুরি কাঁচি চালাচ্ছেন ডাক্তার বাবু।


কপালের নাম গোপাল একেই বলে। ওনার বয়সের কথা ভেবেই, আগের বার ছোট করে ব্যাপারটা মিটিয়ে দিতে চেয়েছিলেন ডাক্তার বাবু। বল সকেট না পাল্টে, স্ক্রু দিয়ে জুড়ে দিয়েছিলেন হাড় খানা। বলেছিলেন শতকরা ৯০-৯২ ভাগ কেসে এতেই জুড়ে যায় হাড়। আমরা পড়ে গেছি বাকি ৮-১০ শতাংশে।


পকেটে হাত ঢুকিয়ে কোণাকুণি উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে সিসিটিভি মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছে শৌভিক। খোঁজার চেষ্টা করছে শাশুড়ি মাকে কোন ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছে কি না। আমরা যখন এসেছিলাম জনবিরল ছিল হাসপাতালটা, ক্রমে বাড়ছে জনকাকলি। আমাকে জেগে উঠতে দেখে আমার পাশে এসে বসে শৌভিক, বলে, " আরো খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নিতে পারিস। বড় ডাক্তার বাবু এখনও এসে পৌঁছায়নি।" বড় ডাক্তার বাবুটি কোন মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক। গেল বার শাশুড়ি মাতার অপারেশন করেছিলেন যে ডাক্তার, তাঁর মাস্টারমশাই। 


আমরা ব্যাপারটা কপালের ফের বলেই মেনে নিয়েছি, কিন্তু গেল বারের অপারেশন বিফল হওয়ায়, ডাক্তার বাবু থেকে হাসপাতালের সকলে অত্যন্ত সংকুচিত। ডাক্তার বাবু তো বলেই ফেললেন, " বিশ্বাস করুন স্যার, আমি দু রাত ঘুমাতে পারিনি। আমার বউও আমায় খুব বকছে -"। সেই দুরাত না ঘুমানো ডাক্তারই আপাতত ছুরি চালাচ্ছেন শাশুড়ি মায়ের পায়ে, পুরাণ ইমপ্ল্যান্টটা খোলার কাজ চলছে। 


বসে বসে কি যেন সব আবোলতাবোল বকি আমরা, পরিকল্পনা করি, যেদিন "ঝড় থেমে যাবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে,"সেদিন কোথায় কোথায় ঘুরতে যাব আমরা। একটি ছেলে এসে খবর দিয়ে যায়, বড় ডাক্তার বাবু এসে গেছেন, নতুন ইমপ্ল্যান্ট বসানোর কাজ এবার শুরু হবে। জানতে চায়, চা খাব কি না। দুজনে একসাথে মাথা নাড়ি, আমরা ইতিমধ্যেই বড় জ্বালাচ্ছি এদের, আর নয়। দরজা বন্ধ হতেই দৌড়ে সিসিটিভি মনিটরের কাছে গিয়ে বড় ডাক্তার বাবুর গাড়িটা খোঁজে শৌভিক। ছেলেদের গাড়ি নিয়ে যে কেন এত উৎসাহ, আজও বুঝলাম না।  


আবার আমার পাশে এসে বসে শৌভিক, কিছু ক্ষণ চুপচাপ বসে থাকি দুজনে, অস্ত্রোপচার শেষ হতে বেলা নটা সাড়ে নটা বাজবে। অক্সিজেনের কি হঠাৎ অভাব দেখা দিল? নিঃশ্বাস নিতে এত কষ্ট হয় কেন? প্যানিক অ্যাটাক হল নাকি? শৌভিক এমনিতেই এত চাপে আছে, আমার জন্য আর বিব্রত করতে চাই না। উঠে পড়ি সোফা থেকে, জিজ্ঞাসু শৌভিককে ইশারায় বলি, একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি - 


ভোরের কুয়াশা কাটিয়ে পূব আকাশে জ্বলজ্বল করছে কমলা সোনালী সূয্যি মামা। তাঁর প্রকাশে যেন ঝলমলিয়ে উঠছে ধরা। বাতাসে এখনও রয়েছে সামান্য শৈত্য - বুক ভরে নিই তাজা বাতাস। " চাইলে এখানেও থাকতে পারিস-" বলে শৌভিক, উঠে এসেছে আমার পিছু পিছু। বলি, চল চা খেয়ে আসি। হাইরোডের ধারে ঘুপচি চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে চা খাই দুজনে, এক ভাঁড় উত্তপ্ত দুধ চা আর প্রজাপতি বিস্কুট। বিস্কুটে কামড় মারার সাথে সাথেই জিভে জড়িয়ে যায় বনস্পতি। পায়ের কাছে ন্যাজ নাড়ানো ভুলুটাকে খানিক ভেঙে দিলাম। সেও দেখি মুখ ঘুরিয়ে নিল। 


রাস্তার উল্টো দিকে অজানা মহীরুহদের সারির ফাঁকফোকর গলে যতদূর দুচোখ যায় কেবল সবুজ আর সবুজ। সদ্য বপন করা হয়েছে কচি ধান গাছের চারা। গাছের ডালে ডালে আসর জমিয়েছে ফিঙে,শালিক, ছাতারে, বেনে বউ আর বুলবুলিদের গুষ্টি। মাথার ওপর দিয়ে ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাচ্ছে পরিযায়ী হাঁসের দল। রাস্তা দিয়ে সাঁ সাঁ করে ছুটছে বাস, লরি, চারচাকা, বাইক এমন কি সাইকেল ও। কারো সময় নেই, কেউ দুই দণ্ড থমকে দাঁড়াচ্ছে না, তাকিয়ে দেখছে না, কি অনুপম রূপের ডালি নিয়ে হাজির হয়েছে প্রকৃতি। ব্যতিক্রম আমরা, প্রতিটা রোমকূপে ভরে নিই প্রকৃতির দান। "কাছাকাছি কোন জলাশয় আছে মনে হয় -"আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে শৌভিক। "নাহলে এত পরিযায়ী পাখি আসত না।" 


চা শেষ হয়ে যায়, তাও নড়ি না আমরা। মাধ্যমিক পরীক্ষা সংক্রান্ত কি কারণে যেন ফোন করে কেউ। ফোনটা রাখার পর মাধ্যমিক নিয়েই আলোচনা করতে থাকি আমরা। তার মাধ্যমিক, আমার মাধ্যমিক। সম্ভবতঃ ১ লা মার্চ থেকে শুরু হয়েছিল আমাদের মাধ্যমিক। তার অব্যবহিত পূর্বে, সম্ভবত ১২ই ফেব্রুয়ারি নিউমোনিয়া ঘটিত জ্বর আর তীব্র শ্বাসকষ্টের জন্য হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় বাবাকে। মাসিরা, দাদারা, দিদিভাই, জামাইবাবু, তাঁর দাদা সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে না পড়লে বাবাকে ফিরিয়ে আনতে পারতাম না সেবার। 


শুধু কি তাই, মঙ্গল না বুধবার থেকে পরীক্ষা শুরু, শনিবার থেকে কানের যন্ত্রণায় পাগল পাগল আমি। সারা রাত জেগে সেঁক দিচ্ছি কানে, কমে আর না। বাবা তখনও পুরো সুস্থ নয়, তাও সারা রাত জেগেছিল আমার জন্য। আমার কষ্ট দেখে পরদিন বড়দা আমাকে নিয়ে গিয়েছিল ডাক্তারের কাছে। কার মাসতুতো দাদা এত করে রে, বলতে বলতে ছলছলিয়ে ওঠে আমার চোখ। 


শৌভিক হাসি চেপে বলে, "আর আমি কি করেছিলাম জানিস না তো? অ্যাডমিট কার্ড ফেলেই একদিন চলে গিয়েছিলাম পরীক্ষা দিতে।" বাপরে, বলে লাফিয়ে উঠি আমি। জানতে চাই, তারপর? শৌভিক বলে, "তারপর আর কি? আমি তো একাই যেতাম পরীক্ষা দিতে, হলে ঢোকার আগে সব মিলিয়ে নিতে গিয়ে দেখি কার্ডটা নেই। নম্বরটা মুখস্থ ছিল। গার্ড দেবে যে স্যার, তাঁকে বললাম -। তিনি বললেন, 'কাউকে বলো, বাড়ি থেকে এসে দিয়ে যাবে -।' বললাম, আমার বাড়িতে এমন কেউ নেই, যে দিয়ে যেতে পারে। বাবা অফিসে, ভাই খুব ছোট, আমার টেন মানে ও থ্রি/ফোর এ পড়ে। মা ওকে ফেলে তো আসতে পারবে না। আর সল্টলেক মা অত ভালো চিনতও না। সব শুনে, আমার এক বন্ধুর দাদা বলল, 'তোমার বাড়িটা কোথায় বলো, আমি গিয়ে এনে দিচ্ছি।'" 

ভালো মানুষের বোধহয় কোনদিনই আকাল পড়ে না, বলি আমি। শৌভিক হেসে বলে, " হ্যাঁ, কিন্তু মা তাকে দেয়নি। আমরা তখন বিধান আবাসনে থাকতাম, ভাইকে নিয়ে নাকি বাড়িতে একা রেখে আজ আর মনে নেই, কিন্তু মা এসেছিল, অ্যাডমিট কার্ডটা নিয়ে -" বলতে বলতে বোকার মত হাসে শৌভিক। " ততক্ষণে অবশ্য এক ঘন্টা পরীক্ষা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মা এসেছিল -"। 


আশেপাশের লোকজন, ছুটন্ত গাড়ি, লেজ নাড়া ভুলু, পাখিদের ঝাঁককে অগ্রাহ্য করে নিজের বরকে জড়িয়ে ধরি আমি। এটা বুঝি ভ্যালেন্টাইন উইক, আকাশে, বাতাসে, সোশ্যাল মিডিয়ায় মাখামাখি ভালোবাসার রং, তাজ্জব লাগে, জীবনের প্রতিটা দশক ভেদে কত পাল্টে যায় ভালোবাসার সংজ্ঞা। লম্বা লম্বা টেলিফোন, সাংকেতিক বার্তা চালাচালি, সপ্তাহান্তে দেখা, হাতে হাত রেখে ভালোবাসার মিছিলে সামিল হওয়া, ফুল, চকলেট, সুগন্ধী, লং ড্রাইভ, মোমবাতির আলোয় নৈশভোজ সবকিছু কি বালখিল্য লাগে আজকাল। কত এগিয়ে গেছি আমরা। আজকাল প্রেম হয় ওষুধের নাম আর UPI এর স্ক্রীনশটে, আজকাল আব্দার হয় এডাল্ট ডায়াপার, বেড প্যান, লাঠি আর হুইলচেয়ার কেনার। আজকাল দুজনে একসাথে ভাবি, কিছুই তো খায় না বুড়োবুড়ি গুলো, কিভাবে মেটাই ওদের প্রোটিনের চাহিদা। আপাতত বাবামায়েদের জন্য ভাবি, জানি কিছুবছর বাদে নিজেদের জন্যও এগুলোই ভাবতে হবে। এই প্রবাহমানতাই তো জীবন। এই প্রবাহমানতা, এই ছুটে চলার মধ্যেই বেঁচে থাকুক ভালোবাসা, যত খুশি রূপান্তরিত হোক, শুধু হারিয়ে না যায়। সত্যি করে বলুন তো " ভালোবাসা ছাড়া আর আছে কি -"

অনির সরস্বতী পুজোর ডাইরি, ৩রা ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

#অনিরডাইরি 


কাক ডাকা ভোরে উঠে শ্যাম্পু করা, কোঁকড়া চুলকে বশে আনা যে কি কঠিন কাজ! দুই বার করে কন্ডিশনার লাগাতে হয়, যার একটা ধুতে হয় অন্যটা নয়। তারপর আবার বিশেষ ব্রাশ দিয়ে আঁচড়ানো তবে না স্প্রিং এর মত পাকিয়ে থাকবে ব্যাটারা। 


আমার সাজ আপাতত এই টুকুই, এবার নিদ্রিত কন্যাকে ঠেলে তোলার পালা। গত ২৬ শে জানুয়ারি অপরাহ্ন থেকে হাসপাতাল নিবাসী আমার বাবা, এখনও নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে পারছেন না শাশুড়ি মাতা, বাড়ির অবস্থা লণ্ডভণ্ড। পুজো যে আদৌ হবে সেটাই ঠিক হয়েছে মাত্র ২৪ থেকে ২৬ ঘণ্টা আগে। ঈশ্বর মঙ্গল করুন, শৌভিকের নাজির বাবু, CA সাহেব এবং অন্যান্য সহকর্মীদের, কি অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে যে সব আয়োজন করেছে ওরা। যেন ওনাদের বাড়ির পুজো। 


গত শনিবার থেকে ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়েছে মেয়েটার। বাড়ির এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে সবথেকে অবহেলিত বোধহয় আমার মেয়েটাই। মূলতঃ তাঁরই জন্য পুজোয় সম্মতি দিয়েছেন মহকুমা শাসক মহোদয়। বছরে তো একটা দিনই শাড়ি পরে তুত্তুরী, তাও এখনও ঠিক করে উঠতে পারিনি আমি, কি শাড়ি পরবে মেয়েটা। 

এখনও নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে শৌভিক। অন্তত ঘুমের ভান করে পড়ে আছে। সদ্যোত্থিত মেয়েকে বাপের পাশে বসিয়ে একটার পর একটা শাড়ি বার করি আমি, এটা পরবি? নাকি এটা? শেষ পর্যন্ত দুটো শাড়ি পছন্দ করেন শ্রীমতী তুত্তুরী, ফাইনাল ডিসিশন নাকি নেবেন তাঁর বাপ। তাই না বটে, সব করলাম আমি, আর মেয়ে কোন শাড়ি পরবে সেটা ফাইনাল করবে বাবা। মেয়ে গুলো জাত বেইমান হয় মাইরি। 

শেষ পর্যন্ত আমার ফুলশয্যার তত্ত্বে পাঠানো লাল পাড় টিয়াপাখি সবুজ কাঞ্জিভরম টাকেই বেশি পছন্দ হয় বাবার। মেয়েকে শাড়ি পরিয়ে, সাজিয়ে গুছিয়ে হাসপাতাল ছুটি আমি। একবার দেখে আসি আমার বাপ টাকে অন্তত। যত সুস্থ হয়ে উঠছে, ততো অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন তিনি। পারলে আমার সাথেই বেরিয়ে পড়ে হাসপাতাল থেকে। তাঁকে বাবা বাছা বলে, বুঝিয়ে শুনিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে যখন বাড়ি ফিরলাম, ছুটে এল তুত্তুরী, " মা, মা ঠাম্মা আমায় বারবার তুমি ভাবছে। বার বার ডাকছে অনিন্দিতা, অনিন্দিতা করে। বলছে, ' অনিন্দিতা তুমি হাসপাতাল যাবে না? বলছে অনিন্দিতা তুমি সিঁদুর পরনি?' বললাম, আমি অনিন্দিতা নই, আমি অনিন্দিতার ছানা। তো বলল, ওমা, তোমায় তো একেবারে অনিন্দিতার মত লাগছে -"।


অনির ডাইরি ১লা ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

#অনিরডাইরি 


বই মেলায় যাব না, এটাই ঠিক ছিল। ওনারা ডাকাডাকি করছিলেন বেশ অনেক দিন ধরেই, এই নিয়ে ষষ্ঠ সংখ্যা প্রকাশিত হতে চলেছে। ইতিপূর্বে পাঁচটি সংখ্যায় স্থান পেয়েছিল আমার লেখা। এবারেও ঠাঁই নাড়া হয়নি এই অধম। এই সাহিত্যপ্রেমী মানুষগুলো,এই ভিন্নধারার লেখালিখি, এই লিটল ম্যাগাজিনগুলোই তো আজও বাঁচিয়ে রেখেছে মধ্যবিত্ত বাঙালি মণীষাকে। যেতে তো ইচ্ছে করে, কিন্তু বড্ড দূর যে। গুগল ম্যাপ দেখাচ্ছে, এক পিঠ যেতেই লাগবে ঘণ্টা চারেক। বাপরে - 


হঠাৎ একদিন ঘোষণা হল, প্রকাশিতব্য লেখাগুলিকে নিয়ে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতা হয়েছিল। যাতে আমার লেখাটি প্রথম হয়েছে। পুরস্কার দেবেন গ্রুপের অন্যতম কর্ণধার, পুরস্কারের নাম ওনার অকালপ্রয়াত স্ত্রীর নামে। আমি জানতাম ভদ্রলোকের দুই কন্যা, যখনই কিছু লিখতেন,লেখায় উল্লেখ থাকত" বড় কইন্যা" আর "ছোট কইন্যা"র। দুর্ঘটনা ঘটে যাবার দিন গ্রুপের এক স্নেহময়ী দিদি জানালেন, "নারে, ওর একটাই মেয়ে। বউকে আদর করে বড় কইন্যা বলত।" সেই বড়কইন্যার স্মৃতিভরা প্রথম পুরস্কার, আমার কাছে তা অমূল্য। হাত পেতে না নিতে পারলে শান্ত হবে কি এ হৃদয় - 


যাব যে, কিন্তু যাব কি করে? জীবন যে আপাতত আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে আমাদের। এদিকে সদ্য অস্ত্রোপচার হয়ে বাড়ি ফেরা শাশুড়ি, অন্যদিকে আইসিইউতে থাকা বাবা। এদিকে ঐ দিনই শুরু হচ্ছে শ্রীমতী তুত্তুরীর বার্ষিক পরীক্ষা (তাও আবার অঙ্ক) ওদিকে ঐদিনই শেষ হচ্ছে দুয়ারে সরকার। সবার উপরে সরস্বতী পুজো, কি ভাবে সামলাই এত কিছু? 


মাথার মধ্যে ঘোরে নিরন্তর হিসাবনিকাশ। যদি সব ঠিক থাকে, যদি সবকিছু সামলে যেতে পারি, খুঁজে পাব কি? যা ট্যালা হয়ে গেছি আমি। অনেক ভেবে শেষে এক প্রাক্তণ সহপাঠিনীকে মুঠো ফোনে ধরি, গুগল ম্যাপ ধরে মেলাপ্রাঙ্গনে তো পৌঁছে যাব, বাকি পথটুকু তুই একটু নিয়ে যাবি ভাই? একজন পথপ্রদর্শক না থাকলে নির্ঘাত হারিয়ে যাব আমি। 


পরিস্থিতি কিছুতেই আর সামলে ওঠে না যেন, শাশুড়ি মাতার পা উন্নতির বদলে আরো বিগড়ে যায় যেন। ওদিকে বাড়ি ফিরে আসার জন্য পাগল হয়ে ওঠে বাবা। রেগে গিয়ে খুলে ফেলে অক্সিজেন মাস্ক, টলতে টলতে উঠে পড়ে বিছানা ছেড়ে। 


পরীক্ষা শেষে গালফোলা শ্রীমতী তুত্তুরীকে বাড়ি ফিরিয়ে এনে, হাসপাতালে গিয়ে বাবাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করে, শাশুড়ি মাতাকে জলদি ফিরে আসার আশ্বাস দিয়ে বেরোতে গিয়ে দেখি ধড়াচূড়া পরে রেডি আমার বর। ভেবেছিলাম দুয়ারে সরকারের ক্যাম্প দেখতে যাচ্ছেন বুঝি, জবাব পেলাম, " নাহ্ ডিএম সাহেবের থেকে অনুমতি পেয়ে গেছি। তাছাড়া অনেকদিন বইমেলাতে যাওয়াও হয়নি -"। ফুসফুসে যেন পলকে ভরে যায় একরাশ তাজা অক্সিজেন। আজ হারিয়ে যাব না অন্তত।  


নির্দিষ্ট সময়ের মিনিট পনেরো আগেই পৌঁছে যাই আমরা। তিন সাড়ে তিন বছরে কত বদলে গেছে শহরটা। আগেও কি এত মানুষ আসতেন বইমেলায়, নাকি স্মৃতির ওপর জমেছে ধূলিকণার আস্তরণ? হাতে হাত রেখে, হতবাক দৃষ্টিতে মেলাপ্রাঙ্গণ পরিক্রমা করতে করতে নিজেদেরই যেন খুঁজি আমরা। বিভিন্ন বয়সের অনি, বিভিন্ন বয়সী শৌভিক। কোথায় তারা - 


ভাগ্যে শৌভিক সঙ্গে এসেছিল, যে বন্ধুর ভরসায় এসেছিলাম, অনুপস্থিত সেই। মুঠোফোনের ওপার থেকে ভেসে আসে সুন্দরী বান্ধবীর দীর্ঘশ্বাস, "কথা রাখতে পারলাম না অনি রে -"। কি করে কথা রাখবে, প্রিয়জনকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়তে হয়েছিল যে। সমবয়সীদের সমস্যাগুলোও যে সমপর্যায়ের। 

সবথেকে ব্যস্তবন্ধুটি কিন্তু ঠিক খুঁজে বার করে আমাদের, শৌভিকের কান বাঁচিয়ে দেয় একরাশ চোখাচোখা গাল। " অন্তত দশবার ফোন করেছি তোকে, ফোনটা রেখেছিস কেন? ওই দেখ আঁস্তাকুড়, ফেলে দিয়ে আয় এখুনি -"। আমারই ডায়লগ আমাকেই ঘুরিয়ে দেয় চৈতালী।


বই দেখা,বই কেনার পাশাপাশি প্রকাশ পায় আমাদের বই, পুরস্কার হাতে তুলে দেন জনৈকা সুন্দরী সদস্যা। দেখা হয় একরাশ চেনাঅচেনা মুখের সাথে। হয় অনেক গল্প, স্বল্প অবসরে ছোট কইন্যাকে বেশ খানিকটা আদর করে নিই আমি। কি সুন্দর যে দেখতে মেয়েটাকে। এবার ঘরে ফেলার পালা। বেলা ঢলে পড়ার সাথে সাথেই পিলপিল করে লোক ঢুকছে মেলায়, আর বেশীক্ষণ থাকলে সত্যিই হারিয়ে যাব আমরা। 


একরাশ মহানাগরিক জাঙ্ক ফুড খাবার প্ল্যান থাকলেও শেষমেষ আর খাওয়া হয় না কিছুই। খাবার স্টলগুলিতেও মাছির মত ভনভন করছিল পুস্তিকপ্রেমীদের ভিড়। শাশুড়ি মায়ের জন্য কেনা প্রোটিন বিস্কুট গোটা তিনেক সঙ্গে নিতে বলেছিল শৌভিক, কিন্তু শেষ মুহূর্তে বরকে আমার ছায়াসঙ্গী হতে দেখে খুশির চোটে সেটা পুরো ভুলে গেছি আমি। অগত্যা নন্দকুমার মোড়ে থেমে চা আর লেড়ো বিস্কুট দিয়ে টিফিন সারি আমরা। 


ঘনায়মান সন্ধ্যা ক্রমে রাতে পর্যবসিত হয়, আরেকবার মুঠো ফোনে বিতর্কে জড়াই সঞ্চিতা আর আমি। ইতিপূর্বে ৫৭৪২ বার পাঠানো বার্তা নতুন করে পাঠায় সঞ্চিতা, "তোকে আর আমি ফোন করব না কোনদিন। ভালো থাকিস - আর আমি বাঁচি-মরি যাই হোক না কেন, তুইও আমার আর কোন খবর নিবি না।" এরপর মান ভাঙাতে আমার ফোন করাটাই দস্তুর। উভয়ের সোহাগী বার্তালাপে ঘুম ভাঙা শৌভিক বিড়বিড় করে, "তুই আর তোর বন্ধুরা -"। 


 পুরস্কার প্রদানকারী ভদ্রলোক মেসেজ করে জানতে চান, " উপহার পছন্দ হয়েছে কি ম্যাডাম?" পুরস্কারের সাথে পাওয়া উপহারটির কথা তো এতক্ষণে ভূলেই বসেছিলাম। মেসেজ পেয়ে, হ্যাংলার মত মোড়কটি খুলে দেখি, গাড়ির জানালা গলে ঢুকে আসা আলোয় জ্বলজ্বল করছে "বাঙালনামা"। সেই দেখে আমার বাঙাল বরের কি খুশি। 


পথ যেন আর ফুরায় না। শ্রীমতী তুত্তুরী ফোন করে জানান, "তোমরা কতদূরে? চিন্তা করো না, ঠাম্মাকে নৈমিত্তিক ইঞ্জেকশন আমি দিয়ে দিয়েছি। সব সাব্জেক্ট ও পড়ে ফেলেছি -।" অর্ধেকটা বিশ্বাস করি, বাকি অর্ধেকটা অর্থাৎ পড়াশোনার অংশটা ভূতেও বিশ্বাস করবে না। যাক গে, বাদশা খানের ভাষায়, হয়তো চলচ্চিত্র এখনও অসমাপ্ত, তবুও এইভাবেই যায় যদি দিন, যাক না।