অনির (চুঁচুড়ার) ডাইরি ৩০শে জুলাই, ২০১৯
#ফিরেদেখা #অনিরডাইরি
প্রতিটা দিন, শুরু হয়, ঠিক একই রকম ভাবে। সেই ঘুম জড়ানো ভারি চোখ, মনের মধ্যে সুপ্ত ইচ্ছা, আজ বেশ রবিবার। আর তারপর? ট্রেনে বিক্রি হওয়া মুচমুচে কচুভাজার মত ঝাল-নুন ছিটোতে থাকে জীবন।
সকাল ১১টা- “ম্যাডাম, কাল তারা এসেছিল। ঠিক আপনার অসাক্ষাতে। পাক্কা দেড় ঘন্টা ধরে, কি চিৎকার। বলেছে, এবার বেনিফিশিয়ারিদের এনে, আপনার চেম্বারে বসিয়ে বিক্ষোভ দেখাবে?”
“মানে? আমার ঘরে লোক ঢোকাবে? কে ভাই, সেই মহাপুরুষ? ঘরে লোক ঢোকাতে চাওয়াটা দেখছি গাঙ্গেয় হুগলীর মুদ্রাদোষ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
সকাল ১১টা ১৫- প্রবল ইচ্ছে করছিল বরকে ফোন করে নালিশ করতে,কিন্তু সক্কাল সক্কাল কাউকে ভুঁড়ি নাচিয়ে হাসাতে চাই না। তাই তীব্র ইচ্ছে দমন করে, তাঁকে ফোন লাগালাম, যাঁর ভয়ে আমার তিন তিনটে ইন্সপেক্টরের মুখ কালো হয়ে আছে। ব্যাটারা আবার বলছিল, আমায় নাকি ট্রেনিং করে রোগা এবং কালো লাগছে। ভদ্রলোকের ফোনটা বেজে গেল, যাই হোক।
১১টা ৩০- “ম্যাডাম, আঠারোটা ফাইল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হয় হারিয়ে গেছে।”
- মানে? কোথায় গেছে? বেড়াতে? ১৮জন একসঙ্গে বেড়াতে গেল? খুঁজেছো?
- “ম্যাডাম শুভজিৎ ধীমানকে দিয়েছিল।”
-“না ম্যাডাম আমায় দেয়নি। আমায় দিলে আমি কোনদিন হারাই? আমি সব গুছিয়ে রেখেদি কি না বলুন? নির্ঘাত রমেশকে দিয়েছিল।”
-“বাঃ তা শুভজিৎ, রমেশ এণারা সব কোথায়?”
-“শুভজিৎ পুজো করছে।”
-মানে?
-“ছুটি নিল যে, হোয়াটস্অ্যাপে।”
বাঃ। তা ফাইলগুলো দিয়ে কি ধুনো দিচ্ছে?
-“ম্যাডাম আমি কতবার বলেছি, আমায় দিতে, আমি সব গুছিয়ে রাখি।”
ঝগড়া থামাবে তোমরা? আমি বলে সদ্য শিখে এলাম-নো ব্লেম গেম- নো স্কেপগোট। কোথায় কোথায় খুঁজেছো? চল আমার সামনে খুঁজবে চলো।
১২টা- “হ্যালো ম্যাডাম,আপনি ফোন করেছিলেন, সরি আমি ধরতে পারিনি, একটু ইয়ে করছিলুম। ”
“বেশ করছিলেন। আরে আয়াম সরি, আপনি আমার অসাক্ষাতে আমার অফিসে ডেপুটেশন দিয়ে গেলেন, আমি থাকতে পারলুম না। আপনি একাই আমার তিন তিনজন ইন্সপেক্টরকে আমার অসাক্ষাতে চমকে গেলেন, হ্যাঁ গো,তা আপনারা নোটিশ দিয়েছিলেন? কই দেখিনি তো? মারের আগে ধাক্কা তো দেবেন?”
- “কি যে বলেন ম্যাডাম। আপনাদের সঙ্গে আমার কত ভালো সম্পর্ক। আপনারা কত হেল্প করেন।” “তাই বলে ওসব ছেলেপিলে ঢোকানোর গল্প করে যাবেন? আমি না হয়, মজা পেয়েছি,তবে,আমি আর কদ্দিন বলুন তো। এবার ট্রেনিং এ পাঠাক, আমি আর ফিরব না। ”
-“হেঃ হেঃ! ম্যাডাম আপনাকে যেতে দিলে তো।রাগ করছেন কেন? ও তো কথার কথা। ওসব একটু বলতে টলতে হয়। বুঝলেন কি না। আপনি ট্রেনিং এ ছিলেন, তাই দেখা হল না। আপনি মিষ্টি খেতে চেয়েছিলেন, এবার গেলে নিয়ে যাব। রাগটাগ করবেন না। ”
১২টা৩০- “সঞ্চিতা, চিন্তা নেই,অমুক বাবু মিষ্টি নিয়ে আসছেন। ছেলেপিলে আনছেন না। এই, তুমি পাহাড়ে চড়ে কি করছ?”
- “ফাইল খুঁজছি ম্যাডাম। আপনি বললেন তো।”
-"তাই বলে ধুলোর পাহাড়ে কে চাপতে বলল। শেষে বস্তা চাপা পড়ে মরবে নাকি?”
-“না ম্যাডাম, এই দেখুন ছটা ফাইল পেয়েছি।"
- "বাঃ গুড গার্ল। ধীমান-কৌশিক কিছু শেখো মাইরি তোমরা। সঞ্চিতা আমার একাই দশ শ।”
- কৌশিক বলে “ম্যাডাম, দাঁড়ান। কাল আমি ময়দানে নামব। সব বস্তামস্তা বিদেয় করে ছাড়ব। ধুলোর আখড়া যত।”
বেলা ১.৩০- "রমেশ তোমাকে যে ফাইলটার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, সেটা রেডি হয়েছে?“
-"শুনুন না ম্যাডাম, আমি সব গুছিয়ে সঞ্চিতা ম্যাডামকে দেখিয়ে ফাইলটা রাখলাম, আর খুঁজে পাচ্ছি না।
-” বাঃ। এটা তাহলে উনিশ নম্বর। সাত দিন। মাত্র সাতদিনের জন্য ট্রেনিংএ গেছিলাম রে বাপ, তোমরা তার মধ্যে আর কি কি হারিয়েছো? একটা লিস্ট করে দাও হ্যাঁ। বার বার আমি জানতে চাইব, তোমরা এক এক করে শোনাবে,~ কাঁহাতক সহ্য হয় বাপ?
বেলা ২.৩০- “হ্যালো ম্যাডাম, চিঠি পেয়েছেন?"
- "আবার? আর কত চিঠি লিখবেন অমুক বাবু? আমি চাপা পড়ে যাব যে। ডিসপিউট চলছে তো। একটু ভরসা রাখুন না। উল্টো পার্টিকেও একটু ভাবতে দিন। এভাবে পত্রাঘাত করলে খেপে যাবে না? ”
-“না ম্যাডাম। চিঠি আমারই। তবে আইনটা আলাদা।”
-“ওরে বাবা, আবার নতুন আইন পড়াবেন?”
বেলা ৩.৩০-“হ্যালো সুকন্যা। এই আইনে কাজ করেছো?”
-“হ্যাঁ। ”
- বাঃ। সাধে কি তোমায় ফোন করি। শালা সবজান্তা মাইরি। এবার বলো দেখি সোনামণি কি করতে হবে। ”
-“পড়ে দেখ। ”
- ছিঃ এমন করে দর বাড়াতে আছে? পড়েছি তো। বুঝতে পারলে আর তোমার কি প্রয়োজন। বলো না বাপ-।”
৪টে- “হ্যালো অমুক বাবু, শুনুন। আপনার এই পাঁচ গণ্ডা চিঠির ওপর আরো গুটি ছয়েক অ্যাপ্লিকেশন লাগবে। ফর্মটা কাল এসে নিয়ে যাবেন।”
-“ আরো ছয় কপি? আমায় যে অমুক বলল-”।
-“ধুর বাবা। আপনাকে কে বলেছে জানি না, আমায় খোদ আইনের বই বলেছে। জ্যান্ত সরস্বতী বাবা। ভুল বলে না। এবার দয়া করে,আপনি আসুন। আর একদম চিঠি লিখবেন না। ”
৫টা৩০-“দিদি, কাল আসব।”
- “আচ্ছা। কেন বলো তো?”
-“সেই যে সেক্সুয়াল হ্যারাজমেন্টের কেসটা-”।
- “অ্যাঁ? কোন কেস? কে কাকে হ্যারাজ করল। ধুর বাবা, মনে পড়ছে না কেন?”
- “না। না। দিদি, হ্যারাজমেন্ট অ্যাট ওয়ার্ক প্লেস অ্যাক্টটা নিয়ে বলতে বলেছিলাম না, রেকর্ড করে নেব। ”
-ওঃ। বাঁচলাম।
এইভাবেই অর্ধেকটা দিন কেটে গেল, এবার বোধহয় বাড়ি যাবার পালা। সেখানে আবার অঘটনঘটনপটিয়স তথা তাঁর কন্যা, কি পাকিয়ে রেখেছেন কে জানে? তবে সে তো অন্য গল্প। আপাততঃ অনেক হয়েছে বাপ। বাড়ি যাই।
(ছবিতে সেদিনের পাত্রপাত্রী বৃন্দ )
অনির ডাইরি ২৬ শে জুলাই, ২০২৫
#অনিরডাইরি
জন্মদিন নিয়ে আমার মেয়ের আবেগপ্রবণতা বরাবরই একটু বেশী। মধ্যরাতে চমকে দেওয়া সেলিব্রেশন, দূরাভাসে আপনজনেদের আশীর্বাদ মাখা উষ্ণ কণ্ঠস্বর, বন্ধুদের টুকটাক মেসেজ, দুপুরে মায়ের হাতের পঞ্চব্যঞ্জন, সস্তা হলেও ছুটকোছাটকা কিছু উপহার এই আর কি। কিন্তু তার জন্য একটা ঠিকঠাক দিনে জন্মাতে হয় বাপু। ফি বছর তেনার জন্মদিনে ডুবে বসে থাকেন কল্লোলিনী। বিগত চার বছর পূর্ব মেদিনীপুরে থাকার দরুণ, জলমগ্ন কলকাতার অভিজ্ঞতা আমরা ভুলতে বসেছিলাম প্রায়। তাই এবার বুঝি সুদেআসলে বুঝিয়ে দিল প্রকৃতি।
দুদিন আগে থেকেই ঘোর নিম্নচাপ, কত সাধ করে লিস্ট বানিয়েছিলাম আমি, কি কি রান্না হবে, কি কি কিনতে হবে, ভেস্তে গেল সবকিছু। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত তাঁর ইস্কুল ঘোষণা করল, জন্মদিনের দিনই হবে পেরেন্টস টিচার মিটিং। যাঃ বাবা, তাহলে রান্না করব কখন? আর যাবই বা কি করে, বিগত দুই দিন ধরে তো আমাদের ফ্যান্সি আবাসনের সামনে এক হাঁটু জল। রান্নার দিদি, বাসন মাজার দিদি কেউ আসতে পারছে না।
ঠিক করলাম, যাবই না। এমনিতেই তিনি পড়াশোনায় অষ্টরম্ভা, তারওপর সবে নতুন ইস্কুলে ভর্তি হয়েছেন, এখনই আর অত কি জানাশোনার আছে। কিন্তু কমলি ছাড়লে তো! দিদিমনি খোদ আগের দিন ফোন করে অনুরোধ করলেন, " প্লিজ আসুন।"
শৌভিক বলল, "ছেড়ে দে, এবার আর অত কিছু করতে হবে না। স্কুলে যেতেই হবে যখন, বাইরে কোথাও খেয়ে আসব।" তিনি মুখে বললেন বটে, " তোমরা যা ভালো বোঝ" মনে মনে যে খুশি হলেন না, সেটা একটা গোলাপী তুলোর ভাল্লুককে পেটে চিমটি কাটা দেখেই বুঝতে পারলাম। শৌভিক পুনরায় প্রস্তাব দিল, " ঠিক আছে, তাহলে রবিবার সেলিব্রেশন হোক। আবহাওয়া দপ্তর তো বলছে ঐ দিন কেটে যাবে নিম্নচাপ। আপাতত তো বাড়িতে কিছুই তেমন নেই -"। বেচারী গোলাপী ভাল্লুক, কথা বলতে পারলে নির্ঘাত, " বাবা গো" বলে চিৎকার করত। মোদ্দা কথা এই প্রস্তাব ও নাকচ।
এই করতে করতে দুপুর গড়িয়ে হল সন্ধ্যা, সন্ধ্যা বিদায় নিয়ে নামল রাত্রি। আমাজন থেকে জোমাটো সকলেই জানিয়ে দিলে আমাদের বন্যাপ্লাবিত ন্যুভরিশ এলাকায় ডেলিভারি দিতে তাঁরা অপারগ। কাঁদকাঁদ তিনি, এরই মাঝে তাঁর ভৌত বিজ্ঞানের শিক্ষক মহাশয় ফোন করে জানালেন, জল জমেছে তাই তিনি আসতে অপারগ বটে, তবে পড়ার ছুটি নেই। আজকের পড়া হবে গুগল মিট এ। আকাশ, বাতাস, মেঘ, কলকাতা, সুইগি, জোমাটো হয়তো বা শৌভিক আর আমার মুণ্ডুপাত করতে করতে তিনি ঘরের দোর দিয়ে পড়তে বসলেন।
ইত্যবসরে আমি শৌভিককে বললাম, " যা বাবা, গিয়ে অন্তত দুধ আর গোবিন্দ ভোগ চালটা তো নিয়ে আয়। লম্বা লোক আছিস, আমার মত ডুবে তো যাবি না।" তিনি জানতেও পারলেন না, বাবা কখন প্যান্ট গুটিয়ে ছাতা বগলে বাজার করতে বেরোল। শুধু মা নয়, বাপ হওয়া ও কি মুখের কথা!
পড়া শেষে নিমপাতা চিবানো মুখে বেরিয়ে যখন দেখলেন ঘন দুধ আর সুগন্ধী গোবিন্দভোগ চালের মিশ্র গন্ধে সারা বাড়ি সুরভিত, ঘোর কৃষ্ণ মেঘের ফাঁকে ফুটল হাল্কা আলোর রেখা, " যাক পায়েসটা অন্তত হচ্ছে।"
শুধু কি পায়েস, হচ্ছিল আরও অনেক কিছু। এলুমিনিয়ামের কড়াইয়ে চাপাচুপি দিয়ে বেক হচ্ছিল কেক। আলমারির মধ্যে খচমচ করছিল তাঁর প্রিয় ফ্লেভারের নাচো চিপস্। আপিসের ব্যাগে ঘাপটি মেরে বসে ছিল তমলুক থেকে কিনে আনা একরাশ রংবেরঙের টফি আর চকলেট। শৌভিকের জামাকাপড়ের তাকে লুকিয়ে ছিল প্লাস্টিকে মোড়া সস্তার লাবুবু পুতুলখানা। ডিনারে ছিল তাঁর মন মত প্রচুর চীজ দেওয়া গার্লিক বাটার চিকেন। ফ্রিজে যেটুকু মাংস ছিল করেই ফেললাম, কালকের চিন্তা কাল করব ক্ষণ।
মধ্যরাতে যখন সবকিছু সাজিয়ে দিলাম, তাঁর আনন্দের আর সীমা পরিসীমা রইল না। তারওপর আবার পাক্কা বারোটায় কাকিমা আর বোনের ফোন, শ্রীমতী ফুলঝুরি যে ঝুঁটি নাড়িয়ে কি বললেন, তুত্তুরী দিদি তো গলে পড়েই গেলেন। একরাশ আশীর্বাদ আর ভালবাসা নিয়ে হাওড়া থেকে ফোন করল বৃদ্ধ দাদু,দিদা আর মাসি। বুড়োবুড়ির জীবনটাই যে আবর্তিত হয় শ্রীমতী তুত্তুরীকে কেন্দ্র করে। ফটোক্রাউড এর একবছরের মেম্বারশিপ উপহার দিল বাবা। নে ব্যাটা, যত খুশি ছবি তোল আর পোস্ট কর। সারা বছর এই ভাবেই আপনজনদের ভালোবাসায় সিক্ত থাকুক মেয়েটা, সর্বশক্তিমানের কাছে এটাই কামনা। থাক না আরও কিছু বছর এমনি শিশু হয়ে, আমার বুকের কাছে। বড় হবার জন্য তো পড়ে আছে, অনন্ত জীবন।
পুনশ্চঃ শ্রীমতী গুগল লেন্সে ফেলে দেখে জানালেন, গোলাপী ভদ্রমহিলাটি লাবুবু নয়, এমনকি তার সস্তার প্রতিরূপ লাফুফু ও নয়। তিনি এমনি গোলাপী প্লাশ টয় বটেক। তাতেও তাঁর উল্লাসের সীমা নেই বটে, তবে মাইরি আমাজন, গরীব মানুষকে এমন ভাবে বোকা বানাবে ভাই 👹।
অনির ডাইরি ১৫ই জুলাই, ২০২৫
#অনিরডাইরি
একদম ইচ্ছে করছিল না বেরোতে। সারাটা সপ্তাহ তো বাড়ির বাইরেই ছিলাম, শনিবারও অধিবেশনে সমবেত হতে হয়েছিল। বর- মেয়ের সাথে একটা দিনও কাটাতে পারলাম না এই সপ্তাহে, ভেবেই বুকের মধ্যে জমছিল ভরা শ্রাবণের মেঘ।
ঠিক ছিল বারোটায় জমায়েত হবে, ঘড়ি ধরে বারোটায় নামল মুষল ধারে বৃষ্টি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে স্নানে গেলাম, এযাত্রা দোষটা অন্তত বৃষ্টির ঘাড়ে চাপানো যাবে। পৌনে একটা নাগাদ যখন একটা দুরন্ত সেলফি দিয়ে মেসেজ করল সঞ্চিতা, " কি রে তোরা কোথায়"? আমি তখন সবে জুতোয় পা গলিয়েছি, শৌভিক পিছন থেকে বলেই যাচ্ছে, " শোন কিপটেমি করিস না। ভালো কথা বলছি, ক্যাব নিয়ে নে। আমার একটা ৫০০ টাকার কুপন আছে, ওতে তোর হয়ে যাবে -"।
রাজপথে নেমে দেখি পিলপিল করছে মানুষ আর গাড়ি। হে ঈশ্বর রবিবার দুপুরে এত মানুষ রাস্তায় বেরোয়? ক্যাব নেব কি নেব না ভাবতে ভাবতেই বাসটা এসে গেল, L মার্কা লিমিটেড স্টপের বাস, আমার সামনে দাঁড়াবার কথা নয়, তাও যখন দাঁড়িয়ে গেল আর কন্ডাক্টরটা এক গাল হেসে বলল, " দিদি যাবে নাকি, হাওড়া হাওড়া -", উঠেই পড়লাম। ওঠার সাথে সাথেই বাসটা যেন পক্ষীরাজ হয়ে উঠল, আর একটু হলে পড়েই যাচ্ছিলাম।
দিন কয়েকের জন্য হাওড়া যাচ্ছি, এবেলা বন্ধুর বাড়ি নিমন্ত্রণ, ওবেলা বাবার জন্য গলা ফাটাতে হবে এক বৈঠকে, কাল থেকে অফিস। তাই এক কাঁধে আমার আপিস ব্যাগ, অন্য কাঁধের ভারী ব্যাগে ঠুসেঠুসে ভরেছি ঘরে, বাইরে পরার পোশাক আর দৈনন্দিন আবশ্যক সামগ্রী। শৌভিককে জানিয়ে দিই বাস পেয়ে গেছি, বন্ধুদের ধারাবিবরণী দিতে থাকি কতদূর এলাম, " লেকটাউন - উল্টোডাঙ্গা - মানিকতলা - গিরিশপার্ক "।
হাওড়া স্টেশনে যখন নামলাম, ঘড়ি বলছে বেলা দুটো। আবার মুখ ভার হচ্ছে আকাশের, বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে মিহি জলকণা। অস্বাভাবিক ফাঁকা হাওড়া, যাও দুই একটা বাস আসছে, কয়েকজন ঢুলঢুলে যাত্রী নামছে আর গায়েব হয়ে যাচ্ছে স্টেশনের ভিতর। আমার বাড়ির বাস আর একটা আসে না। শৌভিক বলে, "সে নাই আসুক, তোর পয়সা তো বাঁচল 😡।" অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে হাওড়া ময়দানের বাস ধরি, বাকিটা না হয় টোটো করে যাব। শৌভিক মেসেজ করে, " আমরা খেয়ে উঠলাম, তবে তুই আর আজ খেতে পাবি না। তিনটে অবধি কে তোর জন্য না খেয়ে বসে থাকবে -!"
হাওড়া ময়দানে যখন নামলাম, আড়াইটে বাজছে। ভালো মত বৃষ্টি পড়ছে। সত্যি কেউ আর অপেক্ষা করবে না আমার জন্য, বাকিদের বাড়ি ফেরার সময় গিয়ে পৌঁছাব আমি। বিমর্ষ ভাবে একটা টোটো ধরি। "কেদামতল্লা কেদামতল্লা" হেঁকেই যাচ্ছে বৃদ্ধ রিকেটি অবাঙালি টোটোয়ালা, গাড়ি আর ছাড়েই না। অবশেষে বিশাল বড় গিটার নিয়ে ওঠে একটা মেয়ে, একটু পরে বাজারের ব্যাগ হাতে ওঠে এক দম্পতি তবে ঘোরে চাবি। পঞ্চাননতলা দিয়ে ঢোকার সাথে সাথে দৌড়ে আসে গোটা তিনেক লাল গেঞ্জি পরা অবাঙালি ছেলে। " কিধার যাস" বলে একজন চেপে ধরে টোটোর হ্যান্ডেল, অন্যজন বুড়োর শতছিন্ন কালো গেঞ্জির গলা। আর একজন হিন্দি মিশ্রিত বাংলায় আমাদের বলে, " এটা এই রুটের গাড়ি নয়। নেমে যান, ঐ গাড়িতে বসুন।" বাজার ব্যাগ হাতে দম্পতি সুড়সুড় করে নেমে যায়। গিটার হাতে মেয়েটি আর আমি মুখ চাওয়াচাওয়ি করি। এই ভীমভবানী দুটো ব্যাগ আর ভিজে ছাতা নিয়ে নামা বেশ কষ্টের।
ভাবতে ভাবতেই একটা ছেলে এগিয়ে এসে টোটোর চাবি খুলে নিতে যায়। এতক্ষণ দুর্বল তর্ক করা বৃদ্ধের গায়ে হঠাৎ যেন সওয়ার হয় সহস্র সিংহের বল, " আব্বে চল, কালকে ছোকরে -" বলে গেঞ্জির গলা চেপে ধরা ছেলেটার হাত মুচড়ে, টোটোর হ্যান্ডেল চেপে ধরা ছেলেটার গালে সপাটে এক চড় মেরে ছুটিয়ে দেয় গাড়ি। পিছন পিছন দৌড়োয় তিন লাল গেঞ্জি, বর্ষিত হয় অসংখ্য "চ" ওয়ালা শব্দ, কিন্তু আমরা ততক্ষণে সব ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
শৌভিকের ভবিষ্যৎবাণী মিথ্যে প্রমাণ করে পৌনে তিনটের মধ্যে পৌঁছে যাই গন্তব্যে। নামার সময় বুড়োকে বলি, "ভাগ্যে তুমি গাড়ি ছেড়েছিলে দাদা, নইলে এখনও বসে থাকতে হত ওদের টোটোয়।" বুড়ো হেসে বলে, " ঘুরিয়ে গালি হামিও দিতে পারতাম দিদি, তুমাদের দুজনের জন্য দিই নাই। মেয়েদের সামনে গালি দিতে হাম শিখা নাহি।"
বুড়োকে 'খুব ভালো থেকো' বলে, গুটি গুটি এগোই দেবুর বাড়ির দিকে। দেবু আমার ছোট্টবেলার ইস্কুলের বন্ধু। আমাদের গলির উল্টোদিকে বিশাল খাঁয়েদের বাড়ি। আমাদের সাবেকি মহল্লার অন্যতম অভিজাত পরিবার ওরা। খুব ছোটবেলায় একবার এসেছিলাম ওদের বাড়ি জেঠু আর জেঠিমার সাথে। কার যেন অন্নপ্রাশন ছিল। ধূসর হলেও সেই স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে বিশাল সিংহদুয়ার, চক মেলানো উঠান, উঠানকে ঘিরে গথিক প্যাটার্নের বাড়ি, বার্মাটিকের সাবেকি আসবাবপত্র। সেই বিশাল বাড়ি আপাতত ভাগ হয়েছে নানা শরিকে, অনেকেই বদলে ফেলেছেন তাদের প্রাক্তন রূপ, বদলায়নি কেবল দেবুদের অংশটা। আমার বাবার মতই, কাকু অর্থাৎ দেবুর বাবাও বাঁচিয়ে রেখেছেন সাবেকিয়ানাটুকু। নাই ডুবুক ঘটি, তাও তো তালপুকুর।
রাজপথ থেকেই উঠে গেছে চারধাপ সিঁড়ি, সিঁড়ি দিয়ে উঠে একফালি লম্বা রোয়াক, রোয়াকের ওপর গাঢ় খয়েরি রঙের ভারী দরজা। দরজার পাশে একটা ঝলমলে পোশাকের দোকান। দোকানটা নতুন হয়েছে। আগে এটাই ছিল কাকু অর্থাৎ দেবুর বাবার ওষুধের দোকান। দেবুর ঠাকুমার নামে দোকানের নাম ছিল রাধা, ফার্মেসি না মেডিক্যাল আজ আর মনে নেই। আমাদের মেয়েবেলায় এই গোটা চত্বরে একটাই ওষুধের দোকান ছিল। ডাক্তারও ছিলেন একজন, ডঃ দলুই। আমার পিসতুতো ভাই বলত 'দৈলে ডাক্তার '। আদতে তিনি ছিলেন হাড়ের ডাক্তার, তবে জ্বর, জ্বালা, পেটখারাপ সবেতেই সবাই ভিড় করত ওনার চেম্বারে। তারপর ওনার প্রেসক্রিপশন নিয়ে সোজা রাধায়। উঁচু চৌকাঠ ডিঙিয়ে একটা মস্ত ঘর, ছাদ জোড়া কড়ি আর বরগা আর দেওয়াল জোড়া কাঁচ লাগানো কাঠের আলমারি। আলমারি ভর্তি ওষুধ।ঘরটাতেও ছিল একটা ওষুধ ওষুধ গন্ধ। একটা আধ মানুষ সমান মস্ত কাঠের পার্টিশনের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকতেন কাকু, গেলেই জুড়তেন গল্প। সবথেকে বেশী ভাব ছিল আমার পিসির সঙ্গে। বুড়ি পিসি আজও বলছিল,' দীননাথের বাড়ি যাবি! খুব ভালো ছিল রে ছেলেটা। নিজের দিদির মত ভালবাসত আমায় -"।
মিহি বৃষ্টির স্পর্শে শৈশব থেকে বাস্তবে ফিরি, ভারী কাঠের দরজা ঠেলে ঢুকি খাঁয়েদের বৈঠক খানায়।সেই উঁচু করিবড়গা ওলা ছাত, সাদা ধপধপে চুনসুরকির মোটা দেওয়াল। মেঝেতে ফরাশ পেতে বসেছে তারাদের জমজমাট আড্ডা। আমাদের ইস্কুলের নাম ছিল তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবন, আমরা প্রাক্তনীরা আজও নিজেদের "তারা" বলে পরিচয় দিতে অত্যন্ত শ্লাঘা বোধ করি। চৌকাঠ ডিঙানোর সাথেসাথেই পড়ে যায় শোরগোল, "এত দেরী করলি কেন?" জুতো খুলে, ভারী ব্যাগটা রেখে, জমিয়ে মাটিতে বসতে বসতে বলি, " বলছি, বলছি সব বলছি। আগে বলতো ব্যাটারা, আমায় ফেলে খেয়ে নিসনি তো?"
ছবিতে - এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যা নামার মুখে দেবুদের সাবেকি বাড়ির দোতলায় আমরা
অনির ডাইরি ১২ই জুলাই, ২০২৫
#অনিরডাইরি
সময় বড় অমূল্য। মুঠোয় ভরা বালির মত কোথা দিয়ে যে হারিয়ে যায় ব্যাটা। বুকের মধ্যে রেখে যায় এক অচেনা ধড়ফড়ানি। এক কাপ কালো কফি নিয়ে বসেছি মেয়ের রুটিন বানাতে। স্কুলের নয়, বাড়িতে পড়ার রুটিন। দিন বারো হল তিনি নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছেন। মাস পুরোলেই তাঁর ষাণ্মাষিক পরীক্ষা, বিশাল তার সিলেবাস, কি যে করবে মেয়েটা ভেবে আমার হাত পা পেটে ঢুকে যাচ্ছে।
যা হোক একটা বানিয়ে, তাঁকে বুঝিয়ে উঠতে উঠতেই বেজে গেল বেলা সাড়ে নয়। এখনও স্নান, পুজো, প্রাতরাশ কিস্যু হয়নি। এদিকে সাড়ে দশটায় বেরোনোর কথা, এগারোটা নাগাদ শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনে অপেক্ষা করবে সুকন্যা। আজ আমাদের আধিকারিক সংগঠনের বার্ষিক অধিবেশন। ভেবেছিলাম শাশুড়ি মাতার দেওয়া ঘি রঙের সিল্কের শাড়িটা পরে যাব, কিন্তু গত সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে সেই পরিকল্পনা ত্যাগ করেছি। গোটা মহানগর জুড়ে বিস্তৃত হচ্ছে মেট্রোরেলের জাল আর সেই সৌজন্যে আমাদের বাড়ির সামনে পচপচ করছে মাটি আর কাদা। কি যে পরি, গাঢ় রঙের গোটা দুই শাড়ি বার করে রাখি, শেষ সিদ্ধান্ত আমার বর নেবে। শৌভিককে গোটা দুয়েক শাড়ি দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলে ও ঠিকঠাক বলে দেয়, তবে তার বেশি দেখালেই মাথা চুলকায় আর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। রেগেও যায় অনেক সময় -
বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে, রান্নার দিদি বার দুই জিজ্ঞাসা করল, " কি রান্না হবে বৌদি? মাছ তো নেই -"। মাছ আনতেই তো গেছে আমার বর, সেই সাত সকালে থলে হাতে নাচতে নাচতে। মাছ দেখলে পাগল হয়ে যায় লোকটা, প্রচুর দরাদরি করে, তারপর একগাদা বিভিন্ন রকমের মাছ কিনে আনে। আজ এত দেরী হচ্ছে মানে নির্ঘাত মাছ কেনার সাথে সাথে শরীরচর্চাটাও করে নিচ্ছে, হাঁটতে হাঁটতে গেছে দূরের বড় বাজারে।
স্নান করতে যাবার আগে বাবাকে ফোনটা করে নিই। নানা কারণে বিগত সপ্তাহ থেকে খুব বিমর্ষ আছে বাবা, তাকে খানিক ভোকাল টনিক খাওয়াই। বয়স হয়ে গেলেই কেন যে মানুষ এত অসহায় বোধ করে। দুই তিন রকম মাছ নিয়ে বাড়ি ফেরেন আমার বর। " আজ দুবেলাই মাছ ভাত হোক, ওবেলারটা তুই রাঁধবি" গদগদ হয়ে বলেন তিনি। স্নান সেরে বেরোতেই সাড়ে দশ, এখনও পুজো, প্রাতরাশ, তৈরি হওয়া কত কিছু বাকি। মনখারাপ করে ব্যাচের গ্রুপে সুকন্যাকে মেসেজ করি, " তুমি চলে যাও, আমি যে কখন বেরোব -"।
জবাবী মেসেজ আসে, " আরে চাপ নিও না। আমি এখন ছেলের টিফিন পৌঁছাতে যাচ্ছি সল্টলেক, আমারও অনেক টাইম লাগবে।" সরস্বতী মেসেজ করে, " আরে টেনশন করিস না। আমি সবে হাসপাতালে এসেছি শ্বশুরমশাইকে দেখতে, আমারও পৌঁছাতে বহু দেরী।" মনটা ভালো হয়ে যায়, সাধে আমাদের তিনজনের এত মিল।
অবশেষে বেরোলাম বটে, রাস্তায় অকথ্য জ্যাম। মেট্রো স্টেশনে পৌঁছে দেখি সেন্ট্রাল স্টেশনে কেউ আত্মহত্যা করেছে, আপাতত স্তব্ধ কলকাতার জীবনরেখা। ভাগ্যিস সুকন্যা ছিল - ।
আড্ডা গল্প, ভুরি ভোজে দিনটা কিভাবে যে কেটে গেল। একসাথে অনেকটা পথ হেঁটে মেট্রোয় উঠলাম প্রায় জনা পঁচিশ জন। কে যেন হেসে বলল, একটা কামরা রিসার্ভ করে নিলে মন্দ হত না।পৌনে পাঁচটা নাগাদ বাড়ি ফিরে দেখি এরা বাপমেয়েতে বাতনুকূল যন্ত্র চালিয়ে মহানন্দে দিবানিদ্রা যাচ্ছে। সন্ধ্যা নামার আগে বাড়ি ফেরায় শাশুড়ি মাতা অবশ্য বেপোট খুশি - ।
সন্ধ্যার চা বানাতে গিয়ে দেখি, আমার সাধের কাপের সেটের একটি কাপ ভাঙা। বছর ছয়েক আগের বিবাহবার্ষিকীতে সেটটা উপহার হয়েছিলেন স্বর্গীয় শ্বশুরমশাই। এতদিন তুলেই রেখেছিলাম সেটটা, কেন যে বার করতে গেলাম। আয়াদিদি নিজেও অত্যন্ত লজ্জিত, বার বার বলছেন, " খুব ভুল হয়ে গেছে দিদি, একটা টানতে গিয়ে আরেকটা পড়ে গেল-"।
একরাশ মন খারাপ নিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। বুকের কাছে ঝনাৎ করে কি যেন পড়াতে ভেঙে গেল ঘুমটা। চোখ খুলে দেখি ঠাকুরের মিছরি। তিনদিন ধরে তাকে আনতে বলছি, আর তিনি বলছেন, " কেন তুই রাস্তায় বেরোস না? তুইও তো আনতে পারিস -"। 'তুমি, না আমি'র চক্করে কাল থেকে উপোসী থাকতে হত ঠাকুরকে। বুঝতে বাকি থাকে না, নেহাৎ আমার মন খারাপ, তাই এনে দিল -
ঘড়িতে সন্ধ্যা সাতটা, ঘুম চোখে ফ্রিজ থেকে মাছ বার করি। হে ভগবান এতো পুরো পাথর হয়ে আছে প্রভু। সময়মত বর বাচ্ছাকে খেতে দিতে পারব তো -। "গরম জল ঢেলে দে না" পেছন থেকে বিশেষজ্ঞ মতামত দেয় আমার বর। ঘুমটা এখনও কাটেনি, টলমল করছে মাথা, তাও পড়তে বসাই মেয়েটাকে। আমি গর্বিত বাংলা মিডিয়াম, পলিনেশন এন্ড ফার্টিলাইজেশন পড়াতে গিয়ে বারবার পরাগ, পরাগরেণু, পরাগধানি বলে ফেলি আমি। গর্ভমুণ্ড শুনে হেসে গড়িয়ে পড়ে তুত্তুরী - ।
এনভায়রনমেন্ট অ্যাপ্লিকেশন পড়াতে পড়াতেই বেজে যায় সাড়ে আট। মুঠোয় বালি ধরার অনুভূতিটা পুনরায় ফিরে আসে আমার বুকের মধ্যে। হে ভগবান এখনও কত কাজ বাকি, আলুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে চিপকো আন্দোলন বোঝাই আমি। ভাতের হাঁড়ি চড়াতে চড়াতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে দারিদ্র্যের সম্পর্ক খোলসা করে বলি আমি। তাও যেন হয় না। মাছের কড়া চাপিয়ে দৌড়ে যাই তার কাছে, যার আমি অর্ধাঙ্গিনী, যিনি ঘণ্টা দেড়েক আগে মিছরির প্যাকেট ছুঁড়ে আমার ঘুম ভাঙিয়ে ছিলেন, তাঁর কাছে। তিনি আপাতত বাতানুকূল যন্ত্র চালিয়ে জমিয়ে ইংক ব্ল্যাক হার্ট পড়ছেন। গিয়ে বলি, " ওগো প্লিজ একটা উপকার করে দাও। আমি তোমার জন্য বেগুন, কালো জিরে আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে পাতলা মাছের ঝোল বসাচ্ছি, তুমি প্লিজ মেয়েটাকে একটু ডাইরেকটিভ প্রিন্সিপলস অফ স্টেট পলিসিটা পড়িয়ে দাও।"
তিনি একগাল হেসে জবাব দেন, " কাল পড়িয়ে দেব বেশ।" বলি মেয়েটা যে ফেল করবে পরীক্ষায়, তিনি সাধুসন্তের মত প্রবচন দেন," আরে পাশ তো সবাই করে। ফেল কে করে বলতো? ঐ একজন দুজন, ভাব ও সেই একজন দুজনের মধ্যে থাকবে-"। এই কথার কি জবাব দিই আমি।এই কথার কোন জবাব হয়? হয় না। তবে বেগুন - কালো জিরে - কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মাছের ঝোলে হিং, দারচিনি আর ছোট এলাচ তো দেওয়াই যায়, একটু বেশী করে। বিশেষ করে তার জন্য, যে এগুলো দুচক্ষে দেখতে পারে না -।
অনির ডাইরি ১০ই জুলাই, ২০২৫
#অনিরডাইরি
অবশেষে ট্রেন পেলাম। ঝাড়া আধ ঘন্টা পুতিগন্ধময় দাশনগর স্টেশনে পায়চারি করার পর। মাইরি,এর জন্য সাতসকালে উঠে কাকস্নান সেরে, নাকে মুখে গুঁজে দৌড়ে আসা? বিগত আঠারো বছরে স্টেশনটার অনেক পরিবর্তন হয়েছে, নতুন প্লাটফর্ম হয়েছে, পুরান প্লাটফর্মগুলো দৈর্ঘ্যে এবং উচ্চতায় বেড়েছে, নতুন সিঁড়ি, বসার জায়গা, শৌচালয়, পানীয় জলের কল সব হয়েছে। শুধু পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমটা একই আছে। আগেও কোন ঘোষণা হত না, আজও হয় না। হুড়োহুড়ি করে ফাঁকা ট্রেনে উঠে সিট দখল করে খেয়াল হল, একবার শুধিয়েই নিই, মেদিনীপুর লোকাল এত ফাঁকা কেন!
ওঃ হরি, এটা আমতা লোকাল। যে দিদিমনিকে শুধিয়েছিলাম, তিনি সাবধান করলেন, "এখনি ছাড়বে, নামতে যাবেন না। রামরাজাতলায় নেমে যাবেন।" দক্ষিণ পূর্ব রেলের ওপর ভরসা রেখে নেমেই পড়লাম, পিছন পিছন আরেক ভদ্রমহিলাও নামলেন। নেমে চোখে চোখ পড়তেই একগাল হেসে শুধালেন, " কোথায় যাবে দিদি?" সাতসকালে এই জঘন্য নোংরা ইস্টিশনে দাঁড়িয়ে খেজুরে গল্প করতে একদম ইচ্ছে করছে না, কেজো গলায়, " মেছেদা" বলে সরে গেলাম।
ভদ্রমহিলাকে দেখেই মনে হয়েছিল গপ্পে বুড়ি, কর্মক্ষেত্রেও দেখলাম আমার অনুমান নির্ভুল। কপাল বৈগুণ্যে তিনি আমার ট্রেনেই উঠলেন এবং গুঁতোগুঁতি করে আমার পাশেই বসলেন। " মেচেদায় তোমার বাড়ি দিদি?" ঘাড় নেড়ে বললাম, নাহ্ আপিস। অযাচিত ভাবেই জানালেন, ওনার বাড়ি মেদিনীপুর লাইনে একটা ছোট স্টেশনে। স্টেশনে নেমে আগে হাঁটতে হত, এখন টোটো যায়। ওনার শ্বশুরবাড়ি গাঁয়ের খুব সম্ভ্রান্ত পরিবার। গোপাল আছে, তিনি মন্দিরে অধিষ্ঠাত। তাঁর নিত্য সেবা করতে হয় শরিকদের।
"আমি আর পারি না দিদি, মূল্য ধরে দিই।শ্বশুরশাশুড়ি যতদিন জীবিত ছিলেন, অনেক করেছি। এখন গিয়ে বামুন ঠাকুরকে টাকা দিয়ে আসি। তিনিই ফল দুধটুধ কিনে পুজো করেন।" সস্তার কাপড়ের ব্যাগ থেকে বেরোয় একটি বিবর্ণ সাদা প্লাস্টিকের কৌটো, কৌটোর ওপর লেখা রেস্টুরেন্টের নামটা বিবর্ণতর। কৌটো ভর্তি মুড়ি, " খাবে দিদি? খাও না?" সভয়ে মাথা নাড়ি। আমি ট্যালা বটে, এতটাও নয়।
ভদ্রমহিলা নিজেই একগাল মুখে দেন, খানিক চিবোন তারপর বলেন, "এই কাজটা নতুন, তাও একটা দিন ছুটি করতে হল -"। এত বোর হচ্ছি যে ভাবছি কি করি, ঘুমের ভান করে পড়ে থাকি, নাকি কানে হেড ফোন গুঁজে বসি।
হে ঈশ্বর, কার মুখ দেখে যে আজ বেরিয়েছি, না আছে ব্যাগে হেড ফোন, মটকা মেরে থাকলেও ইনি ডেকে কথা বলছেন। কত কিছু যে জেনে ফেললাম উলুবেড়িয়া আসতে আসতে। ভদ্রমহিলার শ্বশুরমশাই হোটেলের রাঁধুনী ছিলেন, উনি রান্নাবান্না যা শিখেছেন স্বর্গীয় শ্বশুরমশাইযের থেকেই শিখেছেন। স্বর্গীয় শ্বশুর লোকটি দেবতুল্য ছিলেন, জীবনে মদ বিড়ি সিগারেট কিচ্ছু স্পর্শ করেননি। পরনারীর দিকে চোখ তুলে তাকাননি। সবটুকু পুষিয়ে দিয়েছে অবশ্য ওনার ছেলে, ভদ্রমহিলার সোয়ামী। "দুটো ছোট বাচ্ছা সমেত আমায় ফেলে চলে যায় দিদি, কি কষ্ট করে যে বাচ্ছাদের মানুষ করেছি --"। বলতে বলতে চোখ মোছেন ভদ্রমহিলা।
সাতসকালে এই কান্নাকাটি, ফ্যাঁচফ্যাঁচানির ভয়টাই আমি পাচ্ছিলাম। এত বছরের পাবলিক সার্ভিস, কম মানুষের সাথে তো মিশিনি, সমস্যার গন্ধ আমি দূর থেকে পাই। মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা, হাত ভর্তি শাঁখাপলা, সিঁথি ভর্তি ডগডগে সিঁদুর, সস্তার সোয়েটের টিপ, ছিট কাপড়ের রং জ্বলা সালোয়ারকামিজ, মুখ চোখে জেবড়ে বসা কালিমা, আর "হৃদয়ের কথা কহিতে ব্যাকুল" মনোভাব আমার কাছে অন্তত বহুক্ষণ আগেই প্রকাশ করেছে ওনার পরিচয়।
"এক ডাক্তার বাবুর বাড়িতে কাজ করতাম দিদি। কাজ করতে করতে আমি নিজেও অনেক ডাক্তারি শিখে গেছি -"। বলতে বলতে হেঁহেঁ করে হাসেন মহিলা। " চার বছর ছিলাম ওদের বাড়ি, ওনার বাবা খুব অসুস্থ, শয্যাশায়ী, নাক দিয়ে নল ঢুকিয়ে খাওয়াতে হয়। সব আমি করতাম। ডাক্তার বাবু আর বৌদি আমায় ভালবাসত কত! সেই কাজ ছেড়ে দিলাম -, কেন বল তো? আমার মেয়ে একদিন রাতে হঠাৎ এসে হাজির হল দুটো বাচ্ছা সমেত। বরের সাথে ঝগড়া করে এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছে। তাদের আমি অতরাতে কোথায় পাঠাই? বুড়ি মাসিমাকে জিজ্ঞাসা করে, ওদের দুটি খেতে দিলাম আর রাতে একটু শুতে দিলাম। ব্যাস পরদিন ডাক্তারবাবুর বোন এসে আমায় কি কথা যে শোনাল দিদি, কি বলি -"।
ডাক্তারবাবু কিছু বললেন না, শুধাই আমি। " উনি তো কলকাতায় থাকেন। মাঝে মাঝে আসেন। বাবামায়ের দেখাশোনা বোনই করে। আমার এত দুঃখ হল দিদি, যাদের জন্য এত করি, তারা আমার এত বড় বিপদে, এইটুকু করল না। পরদিন আমিও বেরিয়ে এলাম ওদের বাড়ি ছেড়ে -।"
"চুপি চুপি তোমায় বলি, বেরিয়ে এসে খুব ভয় পাচ্ছিলাম দিদি। যদি আর কাজ না পাই। ঠাকুরের দয়ায় এটা পেয়ে গেছি এই আর কি। বেতন ও ভালোই দেয়, এখুনি ছুটি করতে চাইছিলাম না, কিন্তু আমার মেয়েটা এত জ্বালাচ্ছে দিদি তোমায় কি বলব। "
তোমার মেয়ে আবার ফিরে গেছে তার বরের কাছে? জানতে চাই আমি। " না,না যেতে চাইলেও আমি যেতে দেব না।" এই প্রথম রাগতস্বরে কথা বলেন ভদ্রমহিলা। " তোমায় কি বলব দিদি, জঘন্য নোংরা লোক একটা -"। গায়ে হাত তোলে? আবার জিজ্ঞাসা করি আমি। ভদ্রমহিলার মুখে ফুটে ওঠে অবিমিশ্র ঘৃণা। " আরে দিদি লোকটার বয়স প্রায় ষাট।"
মুখে অভাব আর সময় যতই বলিরেখা কেটে যাক না কেন,এই ভদ্রমহিলার বয়স মেরেকেটে পঞ্চাশ হবে। আর এনার জামাতার বয়স ষাট! তিতকুটে ঘৃণায় ভরে ওঠে আমার মন। মনের ছাপ বোধহয় মুখে পড়েছিল, ভদ্রমহিলা ঘাড় নাড়েন। জানতে চাই, " সম্বন্ধ করে?" উনি রেগে বলেন, " না, না। প্রেম।পনেরো বছর বয়সে উনি প্রেম করে পালিয়ে যান ঐ ঘাটের মড়ার সাথে। যার কত গুলো যে বিয়ে আর কতগুলো যে সম্পর্ক তার ঠিক নেই,জমিজমা ট্যাকাপয়সা কিস্যু নাই, ভাড়া বাড়িতে থাকে, কি কাজ করে ঠাকুর জানে, এমন মিনসের সাথে কেউ পালায় দিদি? তারপর দুই দুটা বাচ্ছা নিয়ে এখন ফিরে এসেছেন মায়ের ঘাড়ে। এখন নাকি তিনি আর এই লোকটার সাথে থাকতে পারছেন না। কি বলবে তুমি বল -"।
আমি আর কি বলব, ভদ্রমহিলা বলতে দিলে তো। "আমি বলেছি দিদি, প্রেম করার সময় মনে ছিল না? কোথায় বুড়ি মাকে তুই দেখবি, না আমাকে তোকে দেখতে হচ্ছে। তুমি বললি বিশ্বাস করবে না দিদি, বাচ্ছা গুলো হওয়া ইস্তক সব দায়িত্ব আমি পালন করে এসেছি। ওদের দুধ, হাগিস, জামাকাপড়, বইখাতা, ইস্কুলে ভর্তি করে দেওয়া সব আমি করেছি। সেই বইখাতা গুলো পর্যন্ত বরের ঘরে ফেলে এসেছে। একটা জামা কাপড় পর্যন্ত নিয়ে আসেনি। আমার ভালো সালোয়ার, নাইটি যা ছিল সব দিলাম। একটা বাড়ি ভাড়া করে রেখে এলাম, যে এখানে থেকে নতুন করে জীবন শুরু কর।"
"বললাম, ভালো রান্না জানিস, ঠাকুরদার থেকে শিখেছিলি, তুই বরং লোকের বাড়ি রান্না করে খা। ও বাবা, বলে কিনা, রান্নার লোক আমি হবনি। আমি রুগী দেখব। রুগী দেখবে ও? রুগী দেখার কাজে হ্যাপা কম? আর চাইলেই সে কাজ পাবে কোথায়? কে রাখবে ওকে?"
ট্রেন ঝমঝম করে রূপনারায়ণ পেরোয়। আড়মোড়া ভাঙি আমি, কোলাঘাট আসছে, এবার উঠতে হবে। ভদ্রমহিলা করুণ ভাবে আমার হাতটা চেপে ধরেন, " শোন না দিদি, কাল কি হয়েছে। নাতিনাতনী দুটোকে যে দিদিমণির কাছে পড়তে দিয়েছি, তিনি আমায় ফোন করে বললেন কি, যে, ' কাকিমা, তোমার মেয়ে এসে বাচ্ছাগুলোকে মাঝপথে নিয়ে চলে গেল।' আমি বলি, এ আবার কি। মেয়েকে ফোন করি, সে ধরে না। ধরে না। তারপর বলে কি, যে জামাই তাকে ফোন করে ডেকেছে, তার পরিচিত লোকজনের উপস্থিতিতে সালিশী করার জন্য। আমার মেয়ে তখন বলেছে, ঠিক আছে, তবে যা কথা হবে বাচ্ছাদের সামনে হবে। বলে বাচ্ছা গুলোকে পড়া থেকে টেনে নিয়ে গেছে ঐ সভায় -"।
মানে? জানতে চাই, তোমার নাতিনাতনীর বয়স কত? " দশ এগারো। কি মিষ্টি ওরা দিদি কি বলব। পড়ালেখায় কি ভালো -"। আর তাদের পড়া থেকে তুলে নিয়ে গেছে বাবামায়ের নোংরা কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি দেখার জন্য? ভদ্রমহিলা এই প্রথম একজনের সমর্থন পেয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বললেন, " এই কথাটাই আমি বলেছি দিদি। বলল, না ওর বাচ্ছা তো ওর মতোই হবে।ওদের জানা দরকার ওদের বাপ কেমন -"
গা গুলিয়ে ওঠে আমার, আর তোমার মেয়ের বাচ্ছা নয়? ঈশ্বর এদের কেন বাচ্ছা দেয় কে জানে। বলেই বুঝি অনধিকার চর্চা করে ফেললাম। জিভ কেটে সরি বলে উঠে পড়ি, এমনিতেই মেছেদা আসছে, ভদ্রমহিলা খপ করে ধরে ফেলেন আমার দুটো হাত, " সরি বলো না দিদি। আমিও এটাই বলি ঠাকুরকে। এদের তুমি কেন দাও ঠাকুর। কত মানুষ সারাজীবন চেয়েও সন্তানসুখ পায় না। আর এরা পেয়েও তার মর্যাদা দেয় না। বাচ্ছা মানুষ করার জন্য আমি যে কি করিনি তুমি জানো না। এমন অনেক কাজ করেছি, যা বললে তুমি ঘেন্নায় কুঁকড়ে যাবে, কিন্তু আমার কোন উপায় ছিল না দিদি। দুটো বাচ্ছা, বুড়ো শ্বশুর শাশুড়ির জন্য অনেক নীচে নেমেছি দিদি -"।
এতবছরের অভিজ্ঞতা চিৎকার করে বলে আর একটু সময় পেলেই ভদ্রমহিলা তাঁর নৈতিক অবনমনের কথাটা বলে বসবেন। এবার আমি ওনার হাতে মৃদু চাপ দিই, বলি, যা করেছ বেশ করেছ। তোমার প্রিয়জনদের জন্যই তো করেছ? আর তোমার কাজের ফল অন্য কারো ওপর তো চাপাও নি? তাহলে কি? তুমি এখন যাও, গিয়ে নাতিনাতনি সামলাও।
আবেগে গলে পড়ে বলেন ভদ্রমহিলা, " আশীর্বাদ করো দিদি, যেন পারি। মেয়ের প্রতি আমার আর কোন দায়বদ্ধতা নেই। কিন্তু ওরা তো নিষ্পাপ শিশু। আমি খুব চেষ্টা করছি ওদের একটা হোস্টেলে ভর্তি করে দেবার।" ঝমঝম করে ট্রেন মেছেদা ঢোকে, হেসে হাত ছাড়িয়ে নিই আমি। এবার নামতে হবে, সামনে আবার অন্য যুদ্ধ।
No comments:
Post a Comment