Tuesday 22 May 2018

অতঃপর মহাভারত কথা-

অতঃপর মহাভারত কথা- ১
প্রথম দৃশ্য-
সুবিশাল পালঙ্কে পালকের শয্যায় সুখ নিদ্রিত ছিলেন রাজা মশাই। সুরভিত দীপশিখার মৃদু আলো তথা সুবাসে সুখ শান্তি তথা সমৃদ্ধি মাখামাখি। আচমকা কোমল সুরে কে যেন ঢেকে উঠল,“ রাজামশাই!“ “কে রে ব্যাটা?” রীতিমত হুঙ্কার  দিয়ে উঠলেন রাজা,কার এত দুঃসাহস তাঁর সুখ নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটায়? চোখ খুলে ধড়মড়িয়ে উঠে দেখেন, সম্মুখে বেতস পত্রের মত কম্পমান রাজ রক্ষিতা স্বয়ং। কাঁপতে কাঁপতে জানালেন, নগরপাল স্বয়ং প্রতীক্ষারত দুয়ারের সম্মুখে। তাঁরই নির্দেশে রাজনিদ্রা ভঙ্গ। তড়িঘড়ি নির্দেশ দিলেন, রাজ শয়নাগারে প্রবিষ্ট  হলেন নগরপাল। সাষ্টাঙ্গে  প্রণাম জানিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললেন,“মহারাজ, একজন এখনও জীবিত। ” মানে? মানেটা কি হে? নগরপাল প্রবল ঘাবড়ে গিয়ে তালগোল  পাকিয়ে যা বলল, তার সারাংশ হল, আজ প্রভাতে যে চারজন তস্করকে শূলে চড়ানো হয়েছিল, তাদের একজন এখনও দিব্যি বেঁচে আছে। শূল অর্থাৎ সুবিশাল লৌহ অথবা কাষ্ঠদণ্ড, যার অগ্রভাগ অতি তীক্ষ্ণ। সাধারণতঃ অপরাধীর গুহ্যদেশ দিয়ে প্রবিষ্ট হয়ে মাথা ফুঁড়ে বের হয়, নাও বের হতে পারে। প্রবল রক্তক্ষরণ এবং অসীম যাতনায় ছটফটিয়ে মরে যায় অপরাধীরা। তাদের শবদেহ আটকে থাকে শূলগাত্রে। শকুনে ছিঁড়ে খায়।  মুখাগ্নি তথা প্রথাসিদ্ধ  অন্তিম সংস্কারটুকুও জোটে না অভাগাদের কপালে।  নগরবাসীরা অপরাধীদের পরিণতি প্রত্যক্ষ করে এবং শিক্ষা নেয়, একই সাথে ঝিকে মারাও হয় আবার বউকে শেখানোও হয়। 
অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ না করলে সাধারণত কাউকে শূলে চড়ান না রাজামশাই। আজ একদল চোরকে শূলে চড়ানো হয়েছিল। স্বয়ং রাজবাটি থেকে মূল্যবান ধনরত্নাদি চুরি করেছিল, বামাল সমেত ধরা পড়ার পর শূলে চড়ানো হয়। বাকি তিনজন কখন মরে ভূত, চতুর্থ বৃদ্ধ দিব্যি জীবিত আছে। ইতিপূর্বে এরূপ  ঘটনা কখনও কেউ দেখেও নি, শোনেওনি।

পড়িমরি করে রাজামশাই স্বয়ং দৌড়লেন জীবিত বৃদ্ধের কাছে। অবশ্যই কোন মহাপুরুষ হবেন, ধরা পড়ার পরও বৃদ্ধের মুখে কোন শব্দ শোনা যায়নি। আত্মপক্ষ সমর্থনের ন্যূনতম প্রচেষ্টাও করেননি বৃদ্ধ। স্বয়ং রাজবৈদ্যের তত্ত্বাবধানে শূল থেকে নামিয়ে যথাবিহিত সেবাযত্নের পর, রাজামশাই বেতো হাঁটু মুড়ে করজোরে বললেন,“ক্ষমা প্রভু। ক্ষমা। অজ্ঞাতে যে গর্হিত অপরাধ সংঘটিত হয়েছে আপনার সাথে তারজন্য অনুগ্রহ করে মার্জনা করুন।  হে মহাত্মন আপনি কে? অধম কে অনুগ্রহ করে আপনার পরিচয় দিন।”
এতক্ষণে মুখ খুললেন বৃদ্ধ,“মহারাজ আমি মাণ্ডব্য। আজন্ম ঈশ্বরই আমার ধ্যানজ্ঞান। দীর্ঘদিন ধরে মৌনব্রত অবলম্বন করে ঈশ্বরের সাধনায় নিমগ্ন ছিলাম। কয়েকজন তস্কর আমার অজ্ঞাতে আমার আশ্রমে তোমার ধনরত্ন চুরি করে পুঁতে রেখে যায়। পরে তস্কররা ধরা পরার পর, আমার আশ্রম থেকেই  উদ্ধার হয় চুরি যাওয়া-”। বৃদ্ধ চুপ করলেন। লজ্জায় অবনতমস্তক রাজা মশাই সসম্মানে মুক্তি দিলেন বৃদ্ধকে। রাজবৈদ্য শুধু বললেন,“মহাত্মা, অণী অর্থাৎ ভগ্নশূলের অগ্রভাগ এখনও আপনার শরীরে বর্তমান। আমার সীমিত শল্যবিদ্যা তা অপসারণে ব্যর্থ হয়েছে। অণী আপনাকে অতীব যাতনা দেবে। জীবন্মৃত হয়ে থাকতে হবে আপনাকে।” বৃদ্ধ সন্ন্যাসী আকাশের দিকে দুই হাত প্রসারিত করে বললেন,“সবই তাঁর ইচ্ছা। ”
দ্বিতীয় দৃশ্য-
সিংহাসনে আসীন ধর্মদেব স্বয়ং। বড়ই ব্যস্ত তিনি। মানবলোকের পাপপুণ্যের সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম বিচারের ভার তাঁর হস্তে অর্পিত। নিক্তিতে প্রতি মুহূর্তে মেপে চলেছেন কর্মফল। আচমকা ঢং ঢং করে বেজে উঠল যমালয়ের ডঙ্কা। জনৈক যমদূত কুর্ণিশ করে জানাল, মহামতি মুনি মাণ্ডব্য তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী। ইতিমধ্যে কেটে গেছে বেশ কিছু বছর।প্রভূত সাধনার ফলে মাণ্ডব্য (যাঁকে আজকাল আড়ালে অণী মাণ্ডব্য নামে ডাকে সকলে) ত্রিভুবন পূজ্য। ধর্মরাজ সাদরে গ্রহণ করলেন অণী মাণ্ডব্য ঋষিকে। মুনির এক অনুরোধে অশ্বিনীকুমার দ্বয় বার করে দিতে পারতেন ঐ অণী, কিন্তু মুনি রাজি নন।কুশল বিনিময়ের পর ধর্মরাজ জানতে চাইলেন,“অণী কেন অপসারন করছেন না মুনিবর? অহেতুক এই বেদনা সহন করার আবশ্যকতা কি?” মুনি স্মিত হেসে বললেন,“এর উত্তর তো আপনি দেবেন। আমি জ্ঞানতঃ ধর্মতঃ কোন অন্যায় করিনি। তবে কেন? কেন এই অপরিসীম যাতনা আমায় দিলেন?” ধর্মরাজ জানতেন, এই প্রশ্ন উঠতে চলেছে। কিঞ্চিৎ  বিব্রতভাবে জানালেন শৈশবে মুনি এক পতঙ্গের পশ্চাৎদেশে একটি তৃণ প্রবিষ্ট করেছিলেন- তাই আর কি। মুনি শান্ত ভাবে জানতে চাইলেন,“তখন আমার বয়স কি দ্বাদশ বরষ অতিক্রম করেছিল?” ধর্মরাজ ঢোঁক গিলে জানালেন, না। মুনি পলকে অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন,“এই তোর বিচার? যার হাতে ত্রিভুবনের কর্মফলের দায়ভার ন্যস্ত, সে এটুকু জানে না যে বারো বছর বয়সের পূর্বে কৃত কোন অপরাধ পাপের পর্যায়ে পড়ে না। আপনার অজ্ঞানতা তথা অবিমৃষ্যকারিতার যে মূল্য  আমি দিয়েছি, তার বদলে অভিশাপ দিলাম, শূদ্রযোনিতে জন্ম হোক আপনার। যান মর্তলোক আপনার প্রতীক্ষায়। সর্বযোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও, যোগ্যতম  হয়েও আপনি কোনদিন রাজসিংহাসনে আসীন হতে পারবেন না। ঔরসজাত সন্তান থাকা সত্ত্বেও নিঃসন্তান অপুত্রক হয়ে জীবনযাপন করবেন আপনি। সব সাজানো গুটি প্রতিমুহূর্তে ছত্রাকার হয়ে যাবে আপনার। যে অপরিসীম বেদনা আমি সয়েছি, তার চতুর্গুণ সহন করবেন আপনি। ”

তৃতীয় দৃশ্য-
ঠিক সেই মুহূর্তে, সুবাসিত দীপালোকে আলিঙ্গনাবদ্ধ  হলেন এক ভয়াল দর্শন পুরুষ এবং এক অপরূপা নারী। আধো অন্ধকারে পুরুষকে যথোচিত সেবায় সন্তষ্ট করলেন নারী। উদ্দেশ্য ক্ষেত্রজ পুত্রলাভ।আপন পরিচয় গোপন রেখে  মিলনে নিবৃত্ত হলেন নারী। মিলন শেষে গভীর প্রশান্তির নিদ্রায় তলিয়ে গেলেন অঙ্গনা। কর্ত্রীর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন তিনি,কোন ভাবেই নিজের পরিচয় প্রকাশ পেতে দেননি। পার্শ্ববর্তী কুৎসিত অথচ মহাজ্ঞানী পুরুষের মুদিত দুই চোখের পাতা থিরথির করে কাঁপছে,তিনি ত্রিকালজ্ঞ, রাজবধূ অম্বিকার দাসী অঙ্গনার পরিচয় তাঁর অজ্ঞাত নয়। অজ্ঞাত নয় অণী মাণ্ডব্যর অভিশাপের কথাও। আজ এই গভীর রজনীতে অঙ্গনার গর্ভে প্রবিষ্ট  হলেন স্বয়ং ধর্মরাজ। কালক্রমে যিনি বিদুর নামে সুপরিচিত হবেন।জ্ঞানী শ্রেষ্ঠ। হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসনের যথার্থ রক্ষাকর্তা। সকলের অজান্তে যিনি সাজাবেন গুটি, খেলা হবে পাশা। জিতবেনও তিনি হারবেনও তিনি। কালক্রমে তাঁর পুত্র পরিচিত হবেন ধর্মরাজ রূপে, বসবেন হস্তিনাপুরের সিংহাসনে।থাক না,ভবিষ্যৎ কালের গর্ভে। আপাততঃ সদ্য গর্ভিণী  অঙ্গনাকে শেষ বারের মত আলিঙ্গন করে উঠে পড়লেন তিনি, কৃষ্ণ দ্বৈপ্যায়ণ বেদব্যাস।
©Anindita's  blog. ©Anindita Bhattacharya
অতঃপর শ্রীমহাভারত কথা
পর্ব- ২
“আ মর মিনসে,” সাত সকালে প্রিয় নারীর মুখে প্রিয় সম্ভাষণ শুনে মুচকি হাসলেন রাজা। রাজা তো নামে, আসলে এই ক্ষুদ্র জনপদের সর্দার তিনি। জনপদ শব্দটিও অনেকাংশে আলংকারিক। গভীর জঙ্গলের মাঝে কয়েক ঘর দীন দরিদ্র অনার্যের বাস। এরা এখনও প্রবলপরাক্রান্ত আর্য সভ্যতার মূল স্রোতের বিরুদ্ধে নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখে চলেছে। এই গোষ্ঠীর সবথেকে বলশালী ব্যক্তি হলেন রাজা হিড়িম্ব। এদিকে রমণীর কটু সম্ভাষণের তীব্রতা আরো বৃদ্ধি পেল, এই কটু বাক্য না শুনলে বিগত রাতের খোঁয়ারি কাটতে চায় না রাজার, বড় খাণ্ডারনি এই রমণী, এতদিন ধরে সহবাস করছে, তাও রাজাকে বিবাহ করতে রাজি না,বেলা বাড়লেই রাজাকে ধাক্কা মেরে গৃহ হতে বিতাড়ন করে, আবার সূর্যাস্তের সাথে সাথেই সুড়সুড় করে ফিরে আসেন রাজামশাই।সূর্যোদয়ের সাথে সাথে উভয়ের এই কলহ, এই জনপদের অধিবাসীদের দৈনিক মনোরঞ্জনের এক মস্ত খোরাক। আজও এই তরজা কতক্ষণ চলত কে জানে, তার আগেই এক দীর্ঘ দেহী, ঘোর কৃষ্ণবর্ণা,এলোকেশী নারী সবলে সকলকে হটিয়ে, প্রণয়নীর বাহু পাশ ছিন্ন করে, রাজাকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল।
এই নারীকে এই জনপদ ছাড়ুন, গঙ্গাপাড়ের আর্য সৈন্যরা পর্যন্ত সমীহ করে, রীতিমত ভয় পায়। ইনি আদিবাসী রাজা হিড়িম্বর ভগিনী, নাম হিড়িম্বা।তথা রাজার প্রধানা সেনানেত্রী।কর্তব্যে অবিচল, অমিত বলশালিনী এবং অসম্ভব দুঃসাহসীনি। জনা দুয়েক আদিবাসী বালিকার সম্ভ্রম রক্ষার্থে একাকী লড়ে গিয়েছিলেন হস্তিনাপুরের চারজন আর্য সৈন্যর সাথে। সুস্পষ্ট নিষেধ থাকা সত্ত্বেও এরা কেন যে সুযোগ পেলেই জঙ্গলে প্রবেশ করত, আদিবাসী আবালবৃদ্ধবনিতা আজো বোঝে না, যে অনার্যদের প্রতি এদের অপরিসীম ঘৃণা, সেই অনার্য নারীদের প্রতি এদের অদম্য আসক্তি কেন। দাঁত দিয়ে জনৈক আর্য যোদ্ধার কণ্ঠনালী ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল হিড়িম্বা, এলোকেশী করালবদনী রুধির সিক্তা হিড়িম্বাকে দেখে রাক্ষসী ভ্রমে আঁতকে উঠেছিল অবশিষ্ট সিপাইরা। কোনমতে গঙ্গা টপকে প্রাণ নিয়ে পালিয়েছিল। সেদিন থেকে নদীর ওপাড়ের শহর বারণাবতে জোর গুজব, নদীর এপাড়ে বাস করে এক রাক্ষসী, নদী পেরোলেই অপেক্ষা করে আছে সাক্ষাৎ মৃত্যু।
সেই থেকে আসেও না কেউ এপাড়ে, বরং এপাড়ের অধিবাসীরাই মাঝে মাঝে ওপারে যায় সওদা নিয়ে। বনের পাখি, খরগোস, শুষ্ক কাষ্ঠ, জড়িবুটি, শুকনো ফল, মাংস, ঝুড়ি, মদ্য ইত্যাদি নিয়ে গিয়ে বেচে ওপাড়ের হাটে। টুকটাক দেহ ব্যবসাও চলে। তেমনি গতকাল এ গ্রামের কয়েকজন গিয়েছিল বারণাবতের হাটে, অধিকাংশই ফিরে এসেছে, ফেরেনি শুধু এক বুড়ি আর গোটা পাঁচ জোয়ান ছেলে। কাল সন্ধ্যাবেলায় নাকি নতুন রাজবাড়িতে ভোজ ছিল,গৃহপ্রবেশ উপলক্ষে,বারণাবতের আবালবৃদ্ধবনিতা সকলকে সাদর নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, হস্তিনাপুর থেকে আগত মহারাণী দেবী কুন্তী এবং তস্য পুত্র যুবরাজ যুধিষ্ঠির।এপাড়ের বুড়ি আর ছোকরার দলও গিয়েছিল দু মুঠো ঘৃতপক্ক ভালো খাবার আর একটু ভালো মদের লোভে। রাত ভোর হয়ে গেছে কিন্তু বুড়ি বা ছোকরারা কেউ ফেরেনি।প্রাথমিক ভাবে পরিবার পরিজনেরা ভেবেছিল, গুরুভোজন তথা অতি নেশার ঘোরে ওরা হয়তো রাতটা হাটেবাজারেই কাটিয়ে দিয়েছে, সকাল হলে, খোঁয়ারি কাটলে ফিরে আসবে, কিন্তু আজ সকাল বেলাতেই খবর এসেছে, গতকাল রাতে এক ভয়াবহ অগ্নি কাণ্ডে নতুন রাজগৃহ ভস্মীভূত হয়েছে। সপুত্র দেবী কুন্তী পুড়ে মারা গেছেন, মারা গেছে, এরাজ্যের মুখ্য শাসক পুরোচন। কিন্তু এ গ্রামের বুড়ি বা ছেলেদের কোন খবর নেই।
পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে হিড়িম্বর বেশ খানিকটা সময় লাগল। বারণাবতে ভয়ংকর অবস্থা, শোকাকুল জনগণ পথেঘাটে আর্তবিলাপ জুড়েছে, এখনও পর্যন্ত কোন অনার্য আক্রান্ত হয়নি, তবে হতেই বা কতক্ষণ। বারণাবতের জতুগৃহের আগুন গঙ্গা পেরিয়ে এপাড়ে আসতেই বা কতক্ষণ। কিনারা বরাবর রক্ষীদের,গুপ্তচরদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দিলেন হিড়িম্বাকে। বিলাপরত নিখোঁজ যুবকদের স্ত্রী তথা পরিজনদের অবশ্য ভাগিয়ে দিলেন, যত মোদোমাতাল আপদের দল কোথায় আর যাবে,বেলা বাড়লে আপসে ফিরে আসবে।
তরুণ তপন বৃদ্ধ হয়ে, বাণপ্রস্থে চলে গেল, জঙ্গলে নেমে এল রমণীয় সন্ধ্যা, কিন্তু বুড়ি বা ছোকরার দল কেউ ফিরে এল না। আজ আর প্রিয়ার গৃহে গেলেন না রাজা হিড়িম্ব, গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত, মধ্যরাত্রে দুঃসংবাদ নিয়ে এল হিড়িম্বার গুপ্তচর, জঙ্গলে প্রবেশ করেছে এক দল আর্য। হিড়িম্ব গর্জন করে উঠল, হিড়িম্বার ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত হল, আজ রাতের মধ্যেই এই আপদের নিষ্পত্তি করতে হবে। একটাও যেন না বাঁচে।  
বন্য শ্বাপদের মত নিঃশব্দে আগন্তুকদের অনুসরণ করতে লাগল হিড়িম্বা। এরা কারা?পাঁচ জন অতীব সুদর্শন যুবক আর এক অপরূপা নারী। বড় ক্লান্ত সকলে, শুকনো পাতা দিয়ে অগ্নিবলয় রচনা করে আলাপে মগ্ন। অদূরে শিকার করা মাংস শূলপক্ক হচ্ছে, সেই গন্ধে জিভে জল এল হিড়িম্বার। সঙ্গীদের অপেক্ষা করতে বলে আর একটু কাছাকাছি এগিয়ে গেল হিড়িম্বা, এরা কারা, একটু জেনে নেওয়া দরকার।
আগুনের সম্মুখে বসে এক দৃষ্টিতে শূলপক্ক খাদ্যের দিকে তাকিয়েছিলেন ভীমসেন, আচমকা খসখস আওয়াজে চমকে তুলে নিলেন গদা, তখনি অতর্কিতে তার সাথে চার চক্ষুর মিলন হল- মোহিত হয়ে গেল হিড়িম্বা, বজ্রাহতের মত তাকিয়ে রইল হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে। সম্মুখস্থ যুবক অসীম বলশালী, তা তার পেশীবহুল শরীর দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু দুচোখে শৈশবের সরলতা, ক্ষুধার্ত শিশুর মত লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন খাবারের দিকে। ভীমসেন ভাবলেন, কোন স্থানীয় অভুক্তা অনার্যা নারী,এই অরণ্যানীর মতই সাদাসিধে। কি অপার সরলতা এই নারীর দুই চোখে। স্নেহাদ্র হয়ে জীবনে কখনও যা করেননি তাই করলেন, আপন ভাগ থেকে, খানিকটা মাংস পদ্মপাতায় মুড়ে, মাতা এবং ভ্রাতাদের অলক্ষে আলতো করে ছুঁড়ে দিলেন, ফিসফিসিয়ে বললেন “নে। ভাগ”। হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না হিড়িম্বা।একে হত্যা করতে হবে? ভাবতেই বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠল। এ অনুভূতি একে বারেই নতুন হিড়িম্বার কাছে। পারবে তো? জীবনে প্রথম নিজের দক্ষতার ওপর সন্দিহান হল হিড়িম্বা।
©Anindita's Blog ©Anindita Bhattacharya
অতঃপর শ্রীমহাভরত কথা-
(পর্ব-৩)
কে? জলদগম্ভীর  স্বরে প্রশ্ন করলেন মৃত্যু পথযাত্রী বৃদ্ধ। রক্তাক্ত রণাঙ্গনের  এক কোণায়, সাময়িক ভাবে ওণার শেষ শয্যা রচিত। এখন শেষ রাত, মশালের নিভু নিভু আলোয় কেমন যেন রহস্যমাখা চারিধার। অতন্দ্র প্রহরীরাও নিদ্রালু। হয়তো গভীর সুখনিদ্রায় মগ্ন। স্বপ্নেই মিলিত হচ্ছে দারা পুত্র পরিজনের সাথে। কে জানে কাল প্রভাত তপন কার কার মৃত্যু সংবাদ বহন করে আনে।

আজকাল শোকের থেকে লজ্জা হয় বেশী। যুদ্ধে আহত হয়ে আপাততঃ শয্যাশায়ী  তিনি। বেশ বুঝতে পারেন আয়ু আর বেশী দিন নেই। তাছাড়া তাঁর তো ইচ্ছামৃত্যু। চাইলেই মুখের সামনে বিষপাত্র ধরতে পারেন বৃদ্ধ। কিন্তু পারছেন কোথায়?

ইচ্ছামৃত্যু। অর্থাৎ আত্মহত্যার অধিকার। একজন ক্ষত্রিয়ের পক্ষে আত্মহত্যার কল্পনাও পুরুষত্বহীনতার সমতুল। ছিঃ। মৃত্যু হল ক্ষত্রিয়ের লজ্জাবতী প্রেমিকা।রক্তাক্ত রণাঙ্গনে, সম্মুখ সমরে তাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ  করাই ক্ষত্রিয়ের কাম্য। তবু পিতা তাঁকে ইচ্ছামৃত্যুর অনুমোদন দিয়েছিলেন। অনুমতি ছিল তবু পারলেন কোথায় দেবব্রত। সবই হয়তো মায়ের শিক্ষার ফল। সুদূর হিমালয়বাসিনী বৃদ্ধা মাতার জন্য আজকাল বড় মন উচাটন দেবব্রতর।জননী কি এখনও জীবিতা? তিনি নিজেই শতায়ুর দ্বারে দণ্ডায়মান,তাঁর জননীর জীবিত থাকা অসম্ভব। তবু মনে ক্ষীণ আশা, হয়তো হিমালয়ের পবিত্র দূষণমুক্ত বাতাসে এখনও শ্বাসগ্রহণ  করে চলেছেন দেবী গঙ্গা।

চিরকালই বড় নিঃসঙ্গ জননী। অন্তিম বার কবে যে মায়ের সাথে পত্রালাপ হয়েছে আজ আর মনেও পড়ে না। বড় অভিমানী দেবী গঙ্গা। পিতার দ্বিতীয় বিবাহের নিমিত্ত সিংহাসনের অধিকার ত্যাগ করা তথা চিরকুমার থাকার প্রতিজ্ঞার কথা জননীকে পত্রে জানিয়েছিলেন দেবব্রত। তীব্র ভৎসনা পূর্ণ পত্রাঘাত করেন জননী। অভিমানে বেশ কয়েকবছর আর পত্রালাপ করেননি দেবব্রত। তারপর ক্ষমা চেয়ে বহু পত্র পাঠিয়েছেন,জবাব আসেনি কখনও। পত্রবহনকারী দূতের জন্য ব্যাকুল হয়ে প্রতীক্ষা করতেন দেবব্রত, প্রতিবার একই অভিজ্ঞতা বর্ণণা করত সকলে। বন্ধুর হিমালয়ের এক একান্ত নির্জন উপত্যকায় বাস করে দেবব্রতর মাতুলকূল। আদতে পাহাড়ী উপজাতি। তাঁরা তাদের নগরে প্রবেশ করতে দেননি দূতকে। পত্র নগরপালের হাতে দিয়ে একদিন প্রতীক্ষা করে প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হত দূত। জননীর এই নিষ্ঠুর ব্যবহারে হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যেত দেবব্রতের। প্রবল ইচ্ছা করত সবকিছু ছেড়ে দৌড়ে পালিয়ে যায় হিমালয়ের সেই জগৎবিচ্ছিন্ন উপত্যকায়।

মৃতবৎসা ছিলেন জননী। বয়সেও হস্তিনাপুররাজ শান্তনুর থেকে অনেকটাই বড় ছিলেন।মাতা তথা মাতামহের মুখে শোনা, একদিন এক প্রৌঢ়া রমণী আলুলায়িত বেশে এসে উপস্থিত হয়ে ছিলেন ইন্দ্রাবতীর দ্বারে। তাঁকে দেখেই বোঝা যায়, কোন সম্ভ্রান্ত  পরিবারের কুলবধূ তিনি। সাশ্রুনয়নে তিনি আকুল প্রার্থনা করেন উপজাতি প্রধানের কাছে, তাঁর স্বামী গুরুতর অসুস্থ, পথে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে আছেন, তাঁর প্রাণ বাঁচান। ইন্দ্রাবতীর অধিবাসীরা সাধারণতঃ  কোন পথিককে বিমুখ করেন না। তবে তাঁদের কিছু শর্ত থাকে। যেমন এক্ষেত্রে শর্ত রাখা হল,মহিলার স্বামী সুস্থ হয়ে দলপতির কন্যাকে বিবাহ করবে। নারী তাতেই সম্মত হলেন। ওণার স্বামীও বয়োঃবৃদ্ধ, সুঠাম রাজপুরুষ। হিমালয়ের তীব্র ঠাণ্ডা তথা দুর্গমতা ওণাকে কাবু করে ফেলেছিল। সুস্থ হয়ে উনি যখন দলপতির কন্যাকে দেখলেন, সদ্য কিশোরী অনুপম রূপবতী কন্যাটিকে দেখে ওণার হৃদয়ে তীব্র অপত্য স্নেহ জাগ্রত হল।

ঐ ব্যক্তি আসলে ছিলেন তৎকালীন হস্তিনাপুরের দোর্দণ্ডপ্রতাপ মহারাজ প্রতীপ। দীর্ঘপ্রচেষ্টাতেও উনি পুত্রের মুখদর্শনে ব্যর্থ হন। এমনকি একটি জারজ সন্তানেরও জন্ম দিতে পারেননি মহারাজ প্রতীপ।হস্তিনাপুরের সিংহাসনের ভবিষ্যৎ  উত্তরাধিকারী কে হবে, এই দুশ্চিন্তায় উন্মাদপ্রায় হয়ে মহারাজ প্রতীপ তাঁর সতীসাধ্বী স্ত্রীকে অনুরোধ করেন ক্ষেত্রজ পুত্রের জননী হবার জন্য। এদিকে মহারাণী প্রায় বিগতযৌবনা হতে বসেছিলেন, তাও তিনি স্বীয় পতি ছাড়া অন্য কারো ঔরসে সন্তানধারণে অসম্মত হন। শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞজনের পরামর্শে রাজা-রাণী যাত্রা করেন হিমালয়ের উদ্দেশ্যে। কথিত আছে নগরাজে স্বয়ং মহেশ্বরের বাস, কঠোর সাধনায় তাঁকে তুষ্ঠ করাই ছিল ওণাদের লক্ষ্য। হয়তো তাঁরই আশির্বাদে অথবা ইন্দ্রাবতীর ভিষক শ্রীঅশ্বিনীকুমারের ঔষধিগুণে গর্ভবতী হন মহারাণী। সস্ত্রীক হিমালয় ত্যাগ করার পূর্বে করজোরে দলপতিকে প্রতিশ্রুত  দেন মহারাজ প্রতীপ, যদি পুত্র সন্তান হয়,সসম্মানে গঙ্গাকে পুত্রবধূ রূপে বরণ করে নিয়ে যাবেন হস্তিনাপুর।
(চলবে)
   ©Anindita's Blog ©Anindita Bhattacharya

No comments:

Post a Comment