Tuesday 19 December 2017

তোর টিমে,তোর পাশে-


“বিয়ের আগে বলেছিল-চাকরী পাবে। সরকারী চাকরী। তাই না ছেলের সাথে বিয়ে দিলাম। যদি জানতাম বড় সাহেবদের টেবিল ঝাড়পোঁচের কাজ থোড়াই এমন মেয়ের সাথে বিয়ে দিতাম। ” শাশুড়ীর কথা গুলো গলন্ত লোহার মত সুমির কানে ঢুকছে। খুব ইচ্ছা করছে ঘুরিয়ে কিছু বলতে, কিন্তু সুমি পারে না। সেই যে স্কুলে কৃষ্ণা বলত ব্যঙ্গ করে,“ সুমি অতি সুবোধ বালিকা। ” সত্যি জীবনে কারো সাথে ঝগড়া তর্কাতর্কি করেনি সুমি। পারে না জাস্ট।
এই নোংরা মহিলার সাথে মুখে মুখে লাগতে ঘেন্না করে সুমির। বাবা কর্মরত অবস্থায় মারা যাবার পর তার চাকরীটা সুমি পায়। বাবা অফিসার ছিলেন, কিন্তু ডাই ইন হার্নেস কেসে সুমির কপালে যে চাকরীটা জুটেছে তা হল মামুলী পিওনের কাজ।
আকাশ এবং তার বাবা মা যখন সুমিকে দেখতে এসেছিল, তখন মা বলেছিলেন যে অচীরেই সুমি তার মৃত বাবার চাকরীটা পেতে চলেছে। হবু সরকারী চাকুরীরতা পাত্রীর সাথে নিজেদের একমাত্র ডাক্তার পুত্রের বিয়ে দেন আকাশের বাবা মা।
ভীষণ চেনা, ভীষণ আপন ছোট্ট মফঃস্বল শহরটাকে ছেড়ে মহানগরে সংসার পাতে আকাশ আর সুমি। ভুল বললাম, সংসার পাতে আকাশ, আকাশের মা আর বাবা। সুমি তো এবাড়ির একটা ফালতু আসবাব মাত্র। সমর্থ ডাক্তার ছেলের বিয়ে না দিলে আত্মীয়স্বজন কি বলবে?তাই খুঁজে পেতে ছোট্ট শহর থেকে এক হাবাগোবা মেয়েকে ধরে এনেছিল আকাশের মা।
বউ ভাতের পরদিন থেকেই সুমি বুঝতে পেরেছিল, এ বাড়ির সবথেকে অপ্রয়োজনীয় বস্তু হল সুমি। এ বাড়ির কোন কিছুতে বিনা অনুমতিতে হাত দেবার অধিকার সুমির নেই। খিদে পেলেও, ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে শাশুড়িকে বলতে হয়। যদি তিনি অনুমতি নেন, নিজের জন্য খাবার বেড়ে নিতে পারে,  না হলে কি হবে সুমি ভাবতেও পারে না। একদিন না বলে চাট্টি মুড়ি খেয়েছিল বলে,হ্যাংলা, হাভাতের মেয়ে,ছোটলোকের ঘর থেকে আনা মেয়ে,মেয়ে মানুষের এত নোলা কেন? কত কিছুই শুনিয়েছিল শাশুড়ী। তারওপর আকাশ বাড়ি ঢুকতেই, সাতকাহন নালিশ।
শুধু কি তাই? পুজোর শপিং এও সুমিকে নিয়ে যায় না এরা। আকাশ আর তার বাবা মা গিয়ে যা কেনার কিনে আনে। কোন বিয়ে বাড়ি পড়লে, কি উপহার দেওয়া হচ্ছে সে সম্পর্কেও বিন্দু বিসর্গ জানতে পারে না সুমি। আজ অবধি একটা সিনেমা-থিয়েটার-মেলা কোথাও যায়নি আকাশ আর সুমি দোহে। যেখানেই গেছে সপরিবারে গেছে। আজকাল সুমি নিজে থেকেই যেতে চায় না। যা বাপ তোরা যা।
আকাশের যে সুমির প্রতি কোন ভালোবাসা নেই এটা সুমি বেশ ভালোভাবেই জানে। এই ক্লাস ফোর স্টাফের চাকরী পাওয়ার পর দুজনের মানসিক ব্যবধান আরো বেড়েছে। প্রথিতযশা ডাক্তার সেনগুপ্তর স্ত্রী মামুলী পিওন? এই ব্যাপারটা আকাশ কিছুতেই হজম করতে পারে না। “আমার বউ অন্য লোকের টেবিল চেয়ার ঝেড়ে দেয়? টিফিন এনে দেয়, এঁটো চায়ের কাপ তোলে?ছিঃ।বন্ধুবান্ধবদের মুখ দেখাব কি করে?এই চাকরী করার কোন দরকার নেই। ” সুমি কিছুতেই চাকরী ছাড়তে রাজি নয়। চাকরী ছেড়ে দিলে সারাদিন ঐ পাগলী বুড়ির সাথে কাটাতে হবে। ভাবলেই অসুস্থ বোধ করে সুমি। তাছাড়া চাকরীটা খারাপই বা কি? মাথা উঁচু করে চাকরী করে সুমি,আরো অনেক মহিলা গ্রুপ ডি আছে ওদের দপ্তরে। কই কেউ চাকরী ছাড়ছে না তো। নিজের মাইনের পয়সায় নিজের প্রয়োজনীয় টুকিটাকি  জিনিস কেনে সুমি। মাকে ভাইকে পুজোয় জামাকাপড় কিনে দেয়। খামোকা ছাড়তে যাবে কেন।
শাশুড়ীর উৎপাত ইদানিং আর সহ্য হয়না সুমির। ওণার নয়া ফরমান, আপাতত কোন নাতিনাতনী চাই না। ছেলে পিএইডিটা করুক তারপর যেন ওসব নিয়ে ভাবে। এদিকে বিয়ের পর প্রায় পাঁচ বছর কেটে গেছে। ত্রিশের ঘরে ঢুকে বেশ কয়েকবছর কাটিয়েও ফেলেছে সুমি। ঘরে  অফিসে লোকে ওকেই না না অস্বস্তিকর প্রশ্ন করে।আকাশের তাতে কিছু যায় আসে বলে মনে হয় না।  দু একবার সুমি কাঁদতে কাঁদতে বলেছে,“আমাকে এত অপছন্দ যখন ডিভোর্স দিচ্ছ না কেন?” তাও দেবে না আকাশ। কারণ তাহলে নাকি ওদের আত্মীয়স্বজন বলবে, ওর মা ছেলের বউ নিয়ে ঘর করতে পারল না।কি গ্রাম্য মানসিকতা। আজকাল বড় ক্লান্ত লাগে সুমির। সমস্ত প্রতিরোধ ক্ষমতা যেন হারিয়ে যাচ্ছে। নিজেকে জ্যান্ত লাশ বলে বোধহয়।
আজ একত্রিশে ডিসেম্বর। ২০১৭সালের শেষ দিন। আকাশ আর ওর বাবা মায়ের সাথে সুমিকে আসতে হয়েছে আরণ্যক রিসর্টে। জনৈক ওষুধ কোম্পানীর তরফ থেকে বিশাল বর্ষবরণ পার্টি। অন্য ডাক্তাররা যুগলে আসলেও, আকাশ যথারীতি বাবা মাকেও বগলদাবা করে এনেছে। সুমির একটুও আসার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু ডঃ আকাশ সেনগুপ্তর বউ যদি পার্টিতে না যায়, তাহলে নাকি আকাশের বন্ধুমহলে ছিছিক্কার হবে। সুতরাং  -
এসে মন্দ লাগছিল না যদিও। ঝাড়খণ্ডের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে জনবিরল এলাকায় অবস্থিত আধুনিক বিলাসবহুল রিসর্ট। চতুর্দিকে শাল আর ইউক্যালিপটাসের জঙ্গল। জঙ্গলের পিছনে উঁচুনিচু লালচে টিলাগুলি ঘণ সবুজ। ভোরবেলা শালের জঙ্গলে একা হাঁটতে  বেরিয়ে ঝাঁক ঝাঁক সবুজ টিয়া দেখেছে সুমি।
বর্ষবরণের রাত। দেশীবিদেশী গানের সুরে গুঞ্জরিত রিসর্টের কনফারেন্স রুম এখন পাক্কা ডিসকোথেক। বিলায়েতি মদের গ্লাস ট্রেতে নিয়ে দৌড়চ্ছে উর্দিপরা বেয়ারার দল। এককোণে শাশুড়ীর পাশে চুপ করে বসে আছে সুমি। ঘুম পাচ্ছে। স্টার্টার খেয়েই পেট ভর্তি। ইচ্ছা করছে ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, কিন্তু এদের ভয়ে পারছে না। পান থেকে চুন খসলেই অশান্তি আর ভালো লাগে না।
আচমকা ফট্ ফট্ দুমদাম  আওয়াজ। ধড়াম করে আওয়াজে কেঁপে উঠল বাড়িটা। ডিজে গান বন্ধ করে দিল। সবাই উৎকীর্ণ ।  প্রবল হৈচৈ,দৌড়দৌড়ি। অথিতিদের মধ্যে চাপা আশঙ্কার গুঞ্জন।ধড়াম করে দরজা খুলে একদঙ্গল লোক ঢুকে এল ঘরে। প্রত্যেকের হাতে উদ্যত বন্দুক। মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা। একজন এগিয়ে এসে, ঠেট হিন্দিতে বলল,“ মোবাইল-ঘড়ি-ওয়ালেট-গয়নাগাটি যা আছে এক্ষুণি বার করে দে। চালাকি করলেই বা ফোন করার চেষ্টা করলেই-”বলে শূণ্যে দুটো গুলি চালালো। সুদৃশ্য ঝাড়লন্ঠনটা আছড়ে পড়ল মেঝেতে।
সবাই আর্তনাদ করে উঠল। শাশুড়ী থরথরকরে কাঁপছে, আকাশ আর ওর বাবা চটজলদি ঘড়ি মোবাইল ওয়ালেট বার করছে, আকাশ হিসহিসিয়ে বলল,“সুমি কুইক”। সুমি ভ্রুক্ষেপও করল না। একপা একপা করে এগিয়ে গেল মুখে কালো কাপড় ঢাকা দস্যুটির দিকে,যে এই মুহূর্তে সব দিয়ে দেবার হুকুম দিয়েছে, আর দুজন দস্যু ঝাঁপিয়ে পড়ে আটকাতে গেল সুমিকে। সুমির ভ্রুক্ষেপ নেই,গলা দিয়ে শুধু একটাই কথা বেরোলো,“কৃষ্ণা?কৃষ্ণা তুই ডাকাত?” মেয়েটির গলার আওয়াজ হুবহু কৃষ্ণার মত।কোন এককালে কৃষ্ণা ছিল সুমির সহপাঠী। শখের সাংবাদিকতা করত কৃষ্ণা। বেশ ভালোই নাম করেছিল। এক আধা জনপ্রিয় দৈনিকের হয়ে বাংলার  বহুদূরে এক প্রত্যন্ত মাওবাদী এলাকায় সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়েছিল কৃষ্ণা। তারপর আর কৃষ্ণার কোন খবর কেউ পায়নি।

দস্যু মেয়েটি ইশারায় তার সঙ্গীদের বলল সুমিকে ছেড়ে দিতে। তারপর পরিষ্কার বাংলায় বলল,“ডাকাত? আমি?নারে সুমি। ডাকাত এরা। জোর করে আদিবাসীদের জমি নামমাত্র মূল্যে কিনে এখানে বিলাসব্যসনের রিসর্ট বানিয়েছে। সুমি যেখানে মানুষ না খেয়ে মরে যায়, এরা মোচ্ছব করছে?আমরা সাম্যের লড়াই লড়ছি সুমি। হয় সবাই খেতে পাবে,নয়তো কেউ না।এত কথা বলার সময় নেই রে। এই রিসর্টে আমরা আজ আগুন ধরাতে এসেছি। সব গাড়ির চাকার হাওয়া খোলা। যাবার আগে গাড়িগুলোতেও আগুন ধরিয়ে যাব আমরা। সাবধানে  বেরিয়ে যা।পালা। ” সবাই হুড়োহুড়ি করে বেরোতে লাগল, আকাশ সুমির হাত ধরে টানল,“চলো”। সুমি এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,“কৃষ্ণা। আমায় তোদের দলে নিবি? আমিও মুক্তি চাই-”।  কৃষ্ণা হেসে বলল,“পারবি?জানিস তো আমাদের পরিণতি কি? হয় কুকুরের মত গুলি খেয়ে মরা,নয়তো ধরা পড়ে বহু কুকুরের লালসার শিকার হয়ে গুলি খেয়ে মরা। আমাদের এক কমরেডকে শুধু ধর্ষণ করে শান্তি পায়নি, জ্যান্তো গায়ের ছাল ছাড়িয়ে নিয়েছে কুত্তাগুলো। তুই পারবি না।”
“পারব। ”প্রথমবার গলা তুলে চিৎকার করল সুমি। “আমি বাঁচতে চাই কৃষ্ণা।কিছুতেই ফিরে যাব না।  জঙলী টিয়াগুলোর মত খোলা আকাশে ডানা মেলে উড়তে চাই। একটা সুযোগ দে কৃষ্ণা। ”
শাশুড়ী হাউমাউ করে উঠল। আকাশ খপ করে ওর হাতটা ধরে, হিড়হিড় করে টানতে লাগল, অ্যাসিড ঝরানো গলায় হিসহিসিয়ে বলল,“ন্যাকামো বন্ধ কর। ” প্রাণপণে নিজের হাতটা ছাড়াবার চেষ্টা করতে করতে সুমি বারবার বলছিল,“আমি আর ফিরতে চাই না--”। হঠাৎ হিমশীতল গলায় চিৎকার করে উঠল কৃষ্ণা,“এই শুয়ার। ছোড় উসে”। চমকে তাকিয়ে দেখে কৃষ্ণার বন্দুকের নিশানায় আকাশের মাথা। হাত ছাড়িয়ে ছুটল সুমি, কৃষ্ণা শুধু বলল,“বন্ধু চল। ”
©Anindita's Blog

No comments:

Post a Comment