Friday 13 March 2020

অনি এবং তুত্তুরীর ডাইরি, ১৩ই মার্চ ২০২০


প্রথম বলেছিল এষা। “দিদি কনকদি কি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলেছে?” কনকদি হল তুত্তুরীর আদরের মাসি। যিনি পাঁচ দিন বয়স থেকে তুত্তুরীকে কোলেপিঠে করে বড় করেছেন। তিনি সম্প্রতি একটি অ্যানড্রয়েড ফোন কিনেছেন এটা ঘটনা, নিয়েছেন জিও সিমও। কাজেই খুলতেই পারেন। জানালাম, হবে হয়তো। এষা একগাল হেসে বলল, “কি করে জানলাম বলো তো? শ্রীমান কুট্টুসকে তিনি একটি রিকু পাঠিয়েছেন। তাঁর ডিপিটি বড়ই জ্বলজ্বলে, তবে তাঁর মুণ্ডহীন কবন্ধই কেবল দৃশ্যমান। আর যার থোবড়া জ্বলজ্বল করছে তিনি হলেন শ্রীমতী থুড়ি কুমারী তুত্তুরী। ” 
মাসির ফোন আর ইন্টারনেটের ওপর তুত্তুরী যে সুযোগ পেলেই চোরাগোপ্তা আক্রমণ তথা দখলদারি চালায় এটা আমাদের অজ্ঞাত নয়। শ্রীমান কুট্টুস যে তুত্তুরীদিদির প্রিয় ভাই এবং বন্ধু তা আশা করি আপনাদের অজ্ঞাত নয়। আর মাসির যে খুব একটা কুট্টুস পিরিত নেই, এটা এষার অজ্ঞাত নয়। সুতরাং বুঝলেন কি না-

ব্যাপারটা এই অবধি থাকলে তো ভালোই হত। সম্প্রতি আমাদের জবা গাছে একটা এত্ত বড় কমলা ফুল ধরেছিল। মরশুমের প্রথম ফুল। আমার ব্যালকনি বাগিচা আমার বরের যতই অপছন্দ হোক না কেন, মাসির বড়ই প্রিয়। মাসি সেদিন সপ্তাহান্তিক ছুটিতে ছিল। ফিরে আসার দিন দুয়েক পরের সকাল গাছে জল ছিটোতে গিয়ে মনে পড়ে গেল, মাসিকে বলতে গেলাম মরশুমের প্রথম ফুলের গল্প- মাসি আমায় থামিয়ে বলল, “হ্যাঁ। জানি তো। তুমি তো ছবি ছেড়েছিলে-”। ছবি তো আপলোডিয়ে ছিলাম আমার দেওয়ালে,মাসি তো আমার বন্ধু নন, মাসির তো দেখতে পাবার কথা না- ভাবতে গিয়ে খুঁজে পেলাম কারণ। ছবির সেটিংসটি ছিল পাবলিক। অর্থাৎ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল আমার ফুল-  বাপরেঃ আমার প্রোফাইল খুঁজে এবং ঘেঁটে আমার “জবু”র ছবি দেখেছে মাসি! বুঝতে বাকি রইল না, এত খাটুনি আসলে কে খেটেছে-
তৃতীয় ঘটনাটি ঘটেছে একটু আগে, সদ্য আপিস থেকে ফিরে একটু জিরোতে বসেছি মরশুমে প্রথম চালানো বাতানুকূল যন্ত্রের ছত্রছায়ায়। পাশে শুয়ে ডিগবাজি খাচ্ছে তুত্তুরী। আজ্ঞে হ্যাঁ। আজ তার সব পরীক্ষা শেষ হয়েছে। তাই ডিগবাজির সংখ্যাও বেড়েছে বৈকি। এমনি একটি ডিগবাজির ফাঁকে আবিষ্কার করলাম, চোখের পাতায় লাগানো আমার মাস্কারা।আর হ্যাঁ গা থেকে ভুসভুস করে  ভেসে আসছে পর্যায়ক্রমে বডি লোশন এবং পারফিউমের ফুলেল সুবাস। রাগটা কোঁৎ করে গিলে নিলাম। আহা পরীক্ষা শেষ হলে এই বয়সে এট্টু আধটু এসব না করলে, আর কবে করবে। মা কিছু বলছে না দেখে বোধহয় সাহস বেড়ে গেল তুত্তুরীর, পরের ডিগবাজিতে মায়ের গায়ের ওপর উঠে আদুরে নালিশের ভঙ্গীতে জানতে চাইল, “মা তুমি কতদিন আর তুত্তুরী উবাচ লেখ না।” নাঃ রাগটা ঠিক গিলতে পারিনি বেশ বুঝলাম। তাই জানালাম, তুত্তুরী আজকাল খালি পাকামো করে, তেমন কিছু বলে না যা দিয়ে উবাচ লেখা যায়। মিনিট দুয়েক নীরবে চার হাতপা এক করে ডিগবাজি খেয়েই পরের প্রশ্ন বাবাকে, “বাবা কেউ লম্বা, কেউ বেঁটে হয় কেন?”
ঠিক এই প্রশ্নটাই করেছিল তুত্তুরী আজ থেকে ঠিক দু বছর আগে। যা নিয়ে রচিত হয়েছিল সেই দিনের তুত্তুরী উবাচ এবং ফেবুর মনে করিয়ে দেবার সুবাদে যা নিজের দেওয়ালেই আবার শেয়ার করেছি আমি আজ সকালে।
নাঃ আর রাগ সামলানো গেল না মাইরি। এই ভাবে মাসির ফোন দিয়ে আমাকে “স্টক(stalk)” করা? দিলাম উদোম ঝাড়। তুত্তুরী সাংঘাতিক ভয় পায় “ব্লু হোয়েল”কে। বেশী ফোন ঘাঁটলে বাচ্ছাদের শরীরে ব্লু হোয়েল ঢোকে এটা তুত্তুরী জানে। জানা সত্ত্বেও এমন ভুল করল? ছিঃ। কতখানি ঢুকে গেছে গো ব্লু হোয়েল। কাল সকালে না নাক-কান দিয়ে ব্লু হোয়েলের ছানা বেরোয়। শাস্তি স্বরূপ আজ ঠাকুর ঘরে একাকী শুয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে তুত্তুরীকে, যদি মা দুগ্গার কৃপায় মরে ব্লু হোয়েলটা।দিব্যি বালিশ চাদর নিয়ে শুতে যাচ্ছিল তুত্তুরী। ভয়ে শুকিয়ে যাওয়া চোখমুখ দেখে কি অপরিসীম আনন্দ যে হচ্ছিল, মাঝখান থেকে  বাবা ফস্ করে বলে উঠল, “আর তোর মধ্যে যে ব্লু হিপোটা ঢুকেছে তাকে বার করবি কি করে?” উফ্ যেমন বাপ তার তেমন মেয়ে। মূর্তিমান আপদ যত-

Thursday 12 March 2020

কয়েকটা “মাগী”র গল্প –

কয়েকটা “মাগী”র গল্প –
(নারী দিবসের পরিপ্রেক্ষিতে)
বললাম “হ্যাপ্পি উওম্যান্স ডে মাসি”। ঘোলাটে চশমার পিছনে এক জোড়া নিষ্পাপ ছানি পড়া চোখ, চামড়ায় অগুন্তি ভাঁজ, পরনের জীর্ণ সুতির শাড়িটার রঙ কোন এককালে লাল সবুজ ছিল বোধহয়, ব্লাউজটার রঙ কেমন ছিল বুঝতে পারা যায় না, তাপ্পির জালে মুখ লুকিয়েছে সে। ঠিক যেমন বুঝতে পারা যায় না মাসির বয়স কত,৮০-৯০ নাকি আরো বেশী? ঠিক যেমন জানা যায় না মাসির আসল নাম কি ছিল। মাসি পেশায় সব্জিউলি, ওটাই আজ মাসির পরিচয়। বাপের দেওয়া নামটা বিয়ের পর বদলে যায়। আর বিয়ের পরের নামটা ধরে বহুযুগ কেউ ডাকেনি।
প্রত্যহ গুটি কয়েক শশা,দিশি টমেটো, কয়েক ছড়া কাঁঠালি কলা, পাতিলেবু বা মরশুমের সজিনা ফুল বা কচি নিমপাতা নিয়ে বসে মাসি হুগলীর এক চটকল সংলগ্ন বাজারে। একে নারী, তায় পুঁজিহীন, ফলে মূল বাজারে মাসির প্রবেশ নিষেধ। যতবার ঢুকতে গেছে, ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয়েছে মাসিকে, মাসি তাই বসে বাজার থেকে বেশ খানিকটা দূরে, বলা যায় নিরাপদ দূরত্বে, ভিড়ে ভরা রাস্তায় প্লাস্টিক পেতে।
মাসির বাপের বাড়ি ছিল সুদূর ছোটনাগপুর মালভূমির কোন ছোট্ট মফস্বল শহর,নামধাম আর কিছুই মনে নেই মাসির, শুধু বলে, “অনেক বড় বড় গাছ ছিল রে মা, ঝুলা খাটিয়ে খুব দুলতাম আমরা। জলকষ্ট ছিল খুব।কতদিনই বা থেকিছি?” শাদি কবে হয়েছিল, তাও মনে নেই, মনে আছে শুধু গওণা হবার কথা। এক গলা ঘোমটা টেনে,নতুন ট্রাঙ্কে গুটিকয় কাপড় আর একটা সাধের হাত আয়না গুছিয়ে, অচেনা বয়স্ক বরের পিছু পিছু অনেকটা হেঁটে এসে, প্রথমে ভিড়ে ঠাসা ট্রেকার টাইপ গাড়ি তারপর টিরেন। মাসির ছোটছোট ভাই-বোন, সহেলিরা এসেছিল ট্রেকার অবধি, “মুন্না” ছুটেছিল অনেকটা পথ, ধাওয়া করেছিল দিদির ট্রেকারটাকে, লাল রাস্তা দিয়ে ধুলো উড়িয়ে চলা ট্রেকারের সাথে বেশীক্ষণ পারেনি মাসির স্নেহের মুন্না।।মা আসেনি ছাড়তে, মা আসতে চেয়েছিল। মা কাঁদছিল খুব, কাকুতিমিনতি করেছিল, কিছুটা পথ হাঁটতে চেয়েছিল মা, শেষবারের মত তার আত্মজার সাথে, অনুমতি পায়নি। বদলে শুনতে হয়েছিল, “বেহায়া বেশরম অউরত (নির্লজ্জ বেহায়া মাগী)”।
মাসির চটকলে কাজ করা শরাবি বর যখন মারা গেল, রেখে গেল “ফুটা কড়ি” দুটো ছেলেমেয়ে নিয়ে দুটো ভুখা রাত কাটিয়ে,মাসি ঠিক করল,এবার সময় এসেছে, “বেশরম- বেহায়া বাজারের মাগী” হবার। বৃদ্ধা লোলচর্ম খুরখুরে মাসির, আপাতত দুঃখ শুধু একটাই, “বাজারে ঢুকতে না দিল হারামজাদা মদ্দগুলো।“ এ কথা অবশ্য মাসি হাসতে হাসতে সস্নেহে বলে, এখনকার “মদ্দ”গুলোর অনেকের বাপ-দাদার সাথে কোন এককালে কোঁদল করে, বেসাতী শুরু করেছিল মাসি। তারাই উল্টে দিয়েছিল ডালা। অউরৎ দের জন্য সময় বড় ধীরে বদলায়।  

বললাম, “হ্যাপ্পি উওম্যান্স ডে চম্পাদি।“ চম্পাদি আয়া মাসির কাজ করে, পরনে ১২ মাস, সিন্থেটিক শাড়ি, কাঁধে সস্তার ব্যাগ, আর পায়ে বাটার চপ্পল। এই একটাই বিলাসিতা আছে মাসির, বাটার চটি ছাড়া পরে না। আর একটা দুর্বলতা হল বোরলীন। ব্যাগে সবসময় নিয়ে ঘোরে বোরলীন। বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে খসখসে দুহাতে বোরলীন মাখে চম্পাদি।দেখা হলেই গায়ে পড়ে কথা বলে চম্পাদি।
বছর পাঁচেক আগে, চম্পাদির সাথে আলাপ, বাস থেকে নেমে, চায়ের দোকানে জিজ্ঞেস করছিল একটা ঠিকানা। ঠিকানা বলতে,বোনের ভাশুরের আর আমাদের আবাসনের নাম।চম্পাদির বোন-ভগ্নীপতি বিদেশে থাকে। সেই কখনও বলেছিল, “বড়দি কোন সমস্যা হলে, আমার ভাশুর-জার কাছে চলে যাস। ওরা মানুষ ভাল। তারপর তো আমি আছিই।“ সেই আশ্বাসটুকু সম্বল করে, গুটি কয়েক টাকা হাতে, সেই সুদূর সীতারামপুর থেকে ট্রেন- বাস পাল্টে আমাদের আবাসনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল চম্পাদি। কি ভাগ্যি, ওনারা আমাদের বিল্ডিংএই থাকেন, না হলে এই সুবিশাল আবাসনে, শুধু নামের ভরসায় কাউকে খুঁজে বার করা শিবের অসাধ্য। একটা মোবাইল ফোনও যে ছিল না চম্পাদির।
চম্পাদি নিজেই স্বীকার করে, “আমরা হলাম বাংলু”। মুক্তিযুদ্ধের পর সর্বস্বান্ত হয়ে, সপরিবারে পালিয়ে এসেছিলেন চম্পাদির বাবা। তিনি অবশ্য বেশীদিন বাঁচেননি। দুই সমর্থ মেয়ে আর দুই নাবালক ছেলে নিয়ে মহা আতান্তরে  পড়েন চম্পাদির বিধবা মা। পেটের জ্বালায় বেপথু হবার আগেই, বিয়ের সম্বন্ধ আসে চম্পাদির, হবু জামাই একটু বয়স্ক, তবে বিশাল ধনী। দোজবরে। প্রথমা স্ত্রী তিন পুত্র রেখে গত হয়েছেন। পাত্র ইতিমধ্যে নাসবন্ধি করিয়ে বসে আছে, আর বাবা হতে পারবে না, তাই সংসার দেখার জন্য কোন দরিদ্র পরিবারের অল্পবয়সী কুমারী মেয়ে খুঁজছেন, কিচ্ছু লাগবে না, উল্টে হবু শ্বশুরবাড়ির দায়িত্বও তিনি বহন করবেন।
চম্পাদি বলে, “ গালভরা নাম বউ, আসলে বিনা মাইনের ঝি ছিলাম গো। দিনে সংসার টানতাম আর রেতের বেলা কত্তার সেবা করতি হত। বদলে থোক টাকা পৌঁছে যেত মায়ের হাতে। তেনার টাকায় তো মায়ের পাকা বাড়ি উঠল, ভায়েদের কারখানা হইল, বোনের বিয়ে হইল। সবার সব হল গো বুন, আমিই শুধু পড়ি রইলাম, ভেবেছিলাম, বুড়ার এত সেবা করিসি, মরার আগে কমসেকম আমার কথাটা এট্টু ভাববে। একটা বাড়ি না হলেও জীবনসত্ত্ব বা কিছু টাকা দিই যাবে। তা গেল কেমুন? একবার ভাবল না, থাকব কুথায়? খাব কি? যে ছেলেদের কোলে করি বড় করলাম, তারা দিল তাড়িয়ে, ওরা কোনদিন মা বলে মানিই নি। ওদের চোখে আমি ওদের বাপের সেবাদাসী।রক্ষিতা।বুঝলে বুন, রক্ষিতা। পরের ছেলিদের কি বলবা বল, আমার মায়ের পেটের ভাইরাই নিল না আমায়।“
বোনের ভাশুর-জা অবশ্য বিনা বাক্যে আশ্রয় দিয়েছিলেন, বোন বিদেশ থেকে পাঠাতে চেয়েছে বিদেশী মুদ্রা। কিন্তু আর কারো দয়ার দান নিতে সম্মত হয়নি চম্পাদি। আজীবন যে কাজ করে এসেছে, বিনা পারিশ্রমিকে আজকাল অর্থের বিনিময়ে সেই কাজই করে চম্পাদি। বড় মুখ করে বলেন, “গতর খাটিয়ে খাই বুন, মাথা উঁচু করে বাঁচি, কোন পুঙ্গির পূতকে ডরায় না এই মাগী।“

কয়েকটা “মাগী”র গল্প – আজ ৩ এবং ৪ নম্বর “মাগী”
(নারী দিবসের পরিপ্রেক্ষিতে)
বললাম, “হ্যাপ্পি উইমেন্স ডে দীপশিখা”। তুত্তুরীর দাঁতের ডাক্তার, এবং আমার অনুজা সমতুল। পানিহাটির মোটামুটি বনেদি সোনার বেনে পরিবারের মেয়ে, ডানা কাটা পরী না হলেও, দেখতে শুনতে ভালো বলেই জানত নিজেকে। দশ ক্লাসের পরীক্ষার পর, জয়েন্ট এন্ট্রান্সের জন্য পার্ক সার্কাসের কাছে, একটি প্রাইভেট কোচিং ইন্সটিটিউশনে ভর্তি হয়েছিল, আর পাঁচটা সমবয়সী ছেলেমেয়ের মত। সেখানেই সৌম্যর সাথে আলাপ। সৌম্য ছিল যাকে বলে একই সাথে কুল এবং হট, সৌম্য ছিল জটিলতাহীন  বিন্দাস, সৌম্য ছিল নারীপুরুষের সাম্যে বিশ্বাসী, উদারমনা, বন্ধুত্বপরায়ণ। এসব গল্পে যা হয় আরকি, তাই হল, প্রথমে বন্ধুত্ব- পরে প্রেম।
তাজ্জব ব্যাপার, যে সৌম্য বন্ধু হিসেবে এত উদার, প্রেমিকের চপ্পলে পা গলিয়ে, তার প্রথম বক্তব্যটাই ছিল, “চুলের যত্ন নে, আমার লম্বাচুল খুব পছন্দ, আমার আগের গারলফ্রেন্ডের তুলনায় তুই তো টেকো। এক জামা পরে, আর কতদিন ক্লাশে আসবি?রোজই কুর্তি পরে আসিস কেন? তোর দাঁতগুলো ভালো না, হাসলে মাড়ি দেখা যায়, মুখে হাত চাঁপা দিয়ে হাস। হিল পরিস না কেন? তবু একটু লম্বা লাগবে। যাই বলিস, আমাদের দুজনের মধ্যে কিন্তু আমাকেই দেখতে বেশী ভালো।ক্লাসের সব মেয়েরা তোকে ঈর্ষা করে দীপশিখা।“ দীপার মুখে এসে গিয়েছিল, “যাই বলিস, আমাদের দুজনের মধ্যে কিন্তু আমিই বেশী বুদ্ধিমান,আর আমি কি পরব, বা কতটা চুল রাখব এনিয়ে আমার বাবা-মা কোনদিন কিছু বলে না, তুই কোন হরিদাস এলি? “ কথাগুলো মুখের কাছে সুড়সুড় করলেও, সবসময়  বলা যায় না। পারিবারিক শিক্ষা, সহজাত ভদ্রতা বোধ লাগাম পরিয়ে দেয় অভদ্র রসনায়। আজ যখনই দেখা হয়, দিপা বলে, “জানো অনিদি, বলে দিলে ভালো করতাম।“
দীপার পাশে বসে, দীপার সাথে ঘুরতে বেরিয়ে, সৌম্যর নজর সবসময় থাকত আসেপাশে, মাঝে মাঝেই বলত, “ ঐ মেয়েটা অনেকক্ষণ ধরে আমায় ঝারি মারছে দ্যাখ। আঃ ওভাবে তাকায় না উজবুক।“ সিরিয়াসলি? অনেক বেশী নম্বর পেয়েও দীপা ছিল উজবুক? ফোন আসত মেয়েদের গুচ্ছ, গুচ্ছ। দীপার সাথে ফাঁকা বাড়িতে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তেও যদি সৌম্যকে কোন মেয়ে ফোন করত, সৌম্য দীপাকে চোখ মেরে তার সাথে খোলাখুলি ফষ্টিনষ্টি করতে লাগত। দীপা সামান্যতম আপত্তি করলেও শুনতে হত, “মফস্বলের মাল, যত নোংরা তোর মনে।“
জয়েন্টে  দীপা যখন খোদ কলকাতায় ডেন্টিস্ট্রি পড়ার সুযোগ পেয়ে গেল, রাতারাতি ভয়ানক আক্রমণাত্মক হয়ে উঠল সৌম্য। নির্দেশ দিল, “ ওসব বালের দাঁতের ডাক্তারি পড়তে হবে না। এ বছরটা গ্যাপ দে। সামনের বার দুজনে একসঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিঙে লাগাব।“ দীপা বাড়িতে কি বলবে? বাড়ির লোক মানবে কিনা, এসব নিয়ে একবিন্দু মাথা ঘামাতে রাজি নয় সৌম্য। কথা নয়, আদেশ। মানতে দীপা বাধ্য।না মানলে ভুলে যেতে হবে সৌম্যকে। ভুলতেও দেবে না সৌম্য, রোজ এই নিয়ে ঝগড়া ঝাঁটি,কথায় কথায় “খানকি-বেশ্যা” বলে গালমন্দ। রীতিমত বাড়ি এসে বন্ধুবান্ধব সমেত ঝামেলা করার হুমকি-।
তুত্তুরীর আধভাঙ্গা, পোকা খাওয়া  দুধে দাঁতের ওপর ঠুকঠুক করে প্লাস্টিকের হাতুড়ি ঠুকতে ঠুকতে দীপা বলছিল, “ কি দিন গেছে অনিদি। নিজেদের সাময়িক দুর্বলতার মুহূর্তে যতটুকু ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম, ফোনে যে সব আবেগ বিহ্বল কথাবার্তা বলেছিলাম, সেগুলো তুলে তুলে বলত, আমি খানকী। আমার মা সোনাগাছির বেশ্যা। আমার বাবা পারেনি বলে, বারো জনে মিলে আমার মাকে-।
যেন যা হয়েছিল সব একতরফা হয়েছিল। ফোন না ধরলে, নম্বর পাল্টে ফেললে, ল্যান্ডফোনে ফোন করে বাবাকে কুকথা শোনাত।মা হাউহাউ করে কাঁদত, জীবনে আমাদের বাড়িতে কেউ ঐ ভাষায় কথা বলেনি।মা নিছক গৃহবধূ। বাবা পাড়ার একজন সম্মানীয় ব্যক্তি, এখনও আমাদের বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়। আর সেই বাড়ির মেয়ে হিসেবে আমার অপরাধটা কি ছিল অনিদি? ভালোবাসা? দৈহিক আবেদনে সাড়া দেওয়া। আর দেহটা তো আমার,আমার তো কোন অপরাধ বোধ নেই তাহলে? অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল, যে ভেবেছিলাম সুইসাইড করব। সামনেই পরীক্ষা, পড়াশোনা ডকে উঠেছিল,রোজ রাতে মা-মেয়েতে ডুগরে ডুগরে কাঁদতাম। তারপর একদিন ঠিক করলাম, অনেক সয়েছি, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, এবার যে ভাষা সৌম্য বোঝে, সেই ভাষায়ই ওর সাথে কথা বলতে হবে।সেদিন সকালে সৌম্য যখন ফোন করল, তখন আমি ট্রেন ধরব বলে সোদপুর স্টেশনে দাঁড়িয়ে, তুলে বললাম, ‘কিরে শুয়োরের বাচ্ছা খানকীর ছেলে, কি বলবি? শুনে রাখ, তোকে আর ডরায় না এ মাগী।‘ ভেবেছিলাম আরো দশটা খিস্তি খাব, অবাক হয়ে গেলাম সৌম্যর প্রতিক্রিয়া দেখে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল, ‘কি বললি মাগী তুই? তুই আমায় এত বড় কথা বললি? আমার বাবাকে শুয়োর বললি? আমার মাকে--। আমার মা? আমার দেবীতুল্য মাকে তুই খানকী বললি, নরকেও জায়গা হবে না তোর। আমি তোর মুখ দেখতে চাই না। ভাবতেও ঘেন্না হয় এমন একটা মেয়েকে আমি এতদিন ভালবাসতাম’“। 

বললাম “হাপ্পি উইমেন্স ডে পাম্মি অ্যান্টি।“ পাম্মি ওরফে পরমিন্দর কউর, নাকি সিং? কখনও গোটা নামটা জিজ্ঞেস করা হয়নি। আন্টির বয়স ৭৫ তো হবেই, একটা ঝাঁ চকচকে বিউটি পার্লারের মালকিন। এই বয়সেও গায়ের রঙ কাশ্মীরি আপেলের মত। মাছি পিছলানো ত্বকে প্রতিফলিত হয় পার্লারের নিয়ন আলো। ঠোঁটে শোভা পায় লাল টুকটুকে লিপস্টিক, স্লিভলেস ধোপদুরস্ত সালোয়ার কামিজে ঝকমক করেন আন্টি। পার্লারে আসা প্রতিটা মেয়ের সাথে গায়ে পড়ে গল্প করেন আন্টি, বলেন, “আপনা ধ্যান রাখখা করো বেটা,আপনে লিয়ে। জো মন চাহে পহনো, খুব সাজো, খুদসে প্যার করনা শিখো। হাম সবসে তো প্যার কর লেতে, বস ভুল যাতে হ্যায় তো খুদ কো প্যার করনা।“
আন্টির জন্ম অবিভক্ত পাঞ্জাবে। ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার সাক্ষী আন্টির পরিবার। কোনমতে জান নিয়ে একবস্ত্রে পালিয়ে এসেছিলেন ওনারা। ঐ সময় মেয়েদের ওপর যে অকথ্য নির্যাতন হয়েছিল, তা প্রত্যক্ষ করে, কেমন যেন বিকারগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিলেন আন্টির বাবা। আন্টির পাঞ্জাবি মিশ্রিত হিন্দিকে বাংলায় অনুবাদ করলে, ওনার বাবা নাকি, দিনরাত খালি বলতেন,”হে ঈশ্বর আমার মেয়েদের না কোনদিন ঐ দিন দেখতে হয়। জলদি ওদের পাত্রস্থ করিয়ে দাও প্রভু।“
১৫ বছর বয়সে, আন্টির বিয়ে হয়। পাত্রের পরিবারও পূর্ব পাকিস্তানের, তবে তারা আর ফিরতে পারেননি। পাত্রের বয়সটাও অনেক বেশী। বিয়ের পর কলকাতায় আগমন। বরাবরই খুব সাজতে ভালোবাসতেন আন্টি।হাতে কাঁচের চুড়ি,ঝুমকা, মাথায় রঙবেরঙের ট্যাসেল, পাটভাঙা কুর্তা-চুড়িদার- চুন্নি। বাপের ঘরে সবাই বলত, “পরী হ্যায় হামারি লাডো।“ আর বিয়ের পর সাজগোজ থেকেই শুরু হল অশান্তি। ওনার স্বামীর এসব একদম পছন্দ ছিল না। “ আচ্ছি ঘর কি লেড়কিয়া কাহাঁ ইতনি বনঠন কে ছম্মক চ্ছল্লো বানকে ঘুমতি হ্যায়?”
সবথেকে জরাজীর্ণ, বিবর্ণ বসনে স্বামীর সঙ্গে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যেতেন আন্টি।“ ইতনি শরম আতিথি বেটা জী, সব লেড়কিয়া, নয়ে, নয়ে কাপড়ে, জেবর পহন কে তিতলিয়ো কি তরহা ঘুমতি থি, ওর ম্যায়, অহি আপনি দো জড়ি কাপড়ো মে, হর অকেশন মে।লিপস্টিক- পাউডার- কাজল কুছ নাহি থা মেরে পাশ বেটা জী। কিতনা রোই ম্যায়। আপনে কিসমত কো কোষা। মেয়েদের কপাল বেটা জী, শুধু সাজতে ভালবাসতাম বলে কতবার যে “ছেনাল” শব্দটা শুনেছি কি বলব। কিছুতেই তোমাদের আঙ্কলজীকে বোঝাতে পারিনি, যে আমি নিজের জন্য সাজতে চাই, কারো দিল বেহলাতে নয়, বা কারোকে ফাঁসাতে নয়।“
“ছিনাল- ছিনাল- ছিনাল শুনে শুনে কান পাক গেয়ে মেরে। ফির সোচা, আগর মেরে সাজনে সাব্রনে সে কিসিকো ইয়ে লাগে, কে ম্যায় ছিনাল হু, তো ম্যায় ছিনালই আচ্ছি। তোমাদের আঙ্কলজীর সাথে প্রায় ঝগড়া করে খুলি এই পার্লার। ততদিনে ছেলেমেয়েরা সব বড় হয়ে গেছে- সেদিনও বলেছিলেন “ছিনাল অউরত।“সেদিন আর খারাপ লাগেনি বেটা জী, বরং মজা লেগেছিল খুব, গালিওকে পিছে ছুপা হুয়া, উনকা ডর, তবতক দিখ চুকা থা মুঝে। ডরে হুয়ে আদমি গালি নেহি দেগা, তো কওন দেগা বেটা জী?”

কয়েকটা “মাগী’র গল্প- আজ ৫ এবং ৬ নম্বর “মাগী”র কথা
(নারী দিবসের পরিপ্রেক্ষিতে)
বললাম, “হাপ্পি উইমেন্স ডে বৈজয়ন্তী”। বৈজয়ন্তী একটা কলেজে পার্ট টাইম পড়ায়। মৈনাক ও পড়ায়, যদিও অন্য ডিপার্টমেন্ট। আলাপ থেকে বন্ধুত্ব হয়ে প্রেম। বৈজয়ন্তীর আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। টেকেনি। নিজের অতীত নিয়ে বৈজয়ন্তী বরাবরই অকপট। মৈনাক তার হৃদয়ের দ্বার উন্মুক্ত করেছিল যখন, সাবধান করেছিল বৈজয়ন্তী, “ সেকেন্ড হ্যান্ড মালকে প্রপোজ করছিস?” মনোহর দাস তড়াগের জলে তখন হোলি খেলতে নেমেছিলেন অপরাহ্ণের প্রবীণ তপন, একমুঠো আবীর ছুঁড়ে দিয়েছিলেন তিনশ বছরের বুড়ি শহরের দিকে, সেই আবীরের ছোঁয়া লেগেছিল মৈনাকের চকচকে ফর্সা সদ্য কামানো গালে।
আজীবন ভালোবাসার অঙ্গীকারের পাশাপাশি নারীবাদ-  লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে কি বিশাল লেকচার দিয়েছিল মৈনাক সেদিন। মৈনাকের বাবা-মাও মেনে নেন বৈজয়ন্তীকে হবু পুত্রবধূ হিসেবে। ওর অতীত নিয়ে ওনাদের কোন মাথা ব্যথা ছিল না। ওনারা শুধু বলেছিলেন, “তোমাদের সুখেই আমাদের খুশি।“ নিজের বাড়িতে বলতে একটু সময় নিয়েছিল বৈজয়ন্তী, মৈনাক কতটা সিরিয়াস না বুঝে বলতে চায়নি। বৈজয়ন্তী ওনাদের একমাত্র সন্তান, ইতিমধ্যেই যথেষ্ট দুঃখ পেয়েছেন ওনারা বৈজয়ন্তীকে নিয়ে। জানতে পেরে আনন্দের আর সীমা রইল না ওনাদের। দুজনে সমস্বরে বললেন, “ আইবুড়ো ছেলে? তাও তোকে- মানে ইয়ে কোন আপত্তি নেই?”বৈজয়ন্তীর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছিল, “না সেকেন্ড হ্যান্ডে মৈনাকের আপত্তি নেই।“
বাবা- মায়ের পিড়াপিড়িতে মৈনাককে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করল বৈজয়ন্তী। মৈনাককে পেয়ে যেন বিমোহিত বৈজয়ন্তীর বাবা-মা। বিয়ের কথা উঠতে দেরী হল না। “বিয়েটা তাহলে কবে করছ?” বাবার এই প্রশ্নের সামনে প্রথম বার থতমত খেতে দেখল মৈনাককে। বিয়ে? বিয়ে নিয়ে আজ অবধি দুজনের কোন কথা হয়নি, বৈজয়ন্তীর রীতিমত লজ্জা করছিল, বাবা-মা এমন করছেন, যেন এত ভালো পাত্র ছাড়া যায় না, পাছে মৈনাক পালায়, তাই আগেভাগেই ঝুলিয়ে দিতে চান নিজেদের “সেকেন্ড হ্যান্ড” কন্যাকে।
সেদিন বিয়ের কথা ওঠার পর থেকে, কেমন যেন নিস্প্রিয় মনে হয় আজকাল মৈনাককে। বৈজয়ন্তী যদিও ফেরার পথে ট্রেনে তুলে দিতে এসে ক্ষমা চেয়েছিল। বাবা-মা সেকেলে মানুষ, তাছাড়া যে মেয়ের গায়ে একবার দাগ লেগেছে, তাকে নিয়ে ওনারা  দুঃশ্চিন্তা করবেন এটাই তো স্বাভাবিক। দিন দশেক বাদে, মৈনাক বলল, “ বৈজয়ন্তী বিয়ে নিয়ে এত চাপ দিলে কি করে হবে?অনেস্টলি, আমি বিয়ে নিয়ে এখনও কিছু ভাবিনি।“
খুচখাচ অশান্তি চলতেই থাকছিল, মাঝে এসে পড়ল মৈনাকের জন্মদিন। মৈনাকের মা নিমন্ত্রণ করলেন হবু পুত্রবধূকে। খুব হাতে গোনা নিমন্ত্রিত, মৈনাকের দু-একজন বন্ধু, মাসি-মেসো, মামা-মামি। মৈনাকের মা, হাত ধরে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন, বৈজয়ন্তীর অতীতের কথাও লুকোলেন না। এত ভালো লাগছিল বৈজয়ন্তীর, মনে হচ্ছিল, এ বাড়িতে পূর্ণতা পাবে ও, ওর সবটুকু মানিয়ে নিতে, ভালবাসতে কোন সমস্যা নেই মৈনাকের পরিবারের। ধাক্কা খেল বাথরুম ঢুকতে গিয়ে, পাশেই রান্নাঘরে, মাকে চাঁচাছোলা ভাষায় ঝাড়ছে মৈনাক, “কে বলেছে, আমার বউ হিসেবে পরিচয় করাবার? বন্ধু বলতে শেখোনি? আর ও ডিভোর্সি এ কথা কি কেউ জানতে চেয়েছিল? গায়ে পড়ে শোনাবার কি দরকার? ওদিকে ওর বাবা-মা হাত ধুয়ে পিছনে পড়ে আছে, গলায় ঝোলাবে বলে, আর এদিকে আমার নিজের বাবা-মা আমার দুশমন।“
নাঃ কাঁদেনি বৈজয়ন্তী, নিজের ওপর রাগ হয়েছিল খুব। কেন যে এতটা লেখাপড়া শিখে, স্বোপার্জিত অর্থে স্বয়ম্বর মেয়েরাও বিয়েতে নিজের সম্পূর্ণতা খোঁজে। কলেজে যদিও অন্য গসিপ ছড়িয়েছিল, “সেকেন্ড ক্লাশ, সেকেন্ড হ্যান্ড মা-“।  
বললাম, “হ্যাপ্পি উইমেন্স ডে সঞ্চারী।“ পেশায় স্কুল টিচার।প্রাইমারী স্কুল। বয়স চল্লিশ ছুই ছুঁই। অবিবাহিতা। বিয়ে নিয়ে সঞ্চারীর বাবা-মার যত না মাথা ব্যথা, তার থেকেও অনেক বেশী মাথা ব্যথা ওর সহকর্মীদের। বিশেষতঃ বিজন বাবুর। এমনিতে যে সঞ্চারীকে বিজন বাবু খুব একটা পছন্দ করেন তা নয়, বরং জনে জনে বলে বেড়ান, “মাইয়াটা বড় ঠোঁট কাটা। গুরুজনদের সাথে কি ভাবে কথা কইতে হয়, সেটুকুও শিক্ষাদীক্ষা দেয়নি বাপ-মা’য়”। অথচ সঞ্চারীর বিয়ে নিয়ে ওনার উৎসাহ কম নয়।
অনেকবার আয়না দেখেছে সঞ্চারী, ঠোঁট দুটো তো দিব্যি জোড়া, তাহলে? একটা শিক্ষিত, স্বয়ম্বর মেয়ের নিজস্ব মতামত থাকবে না? আর সেটা খোলাখুলি ভাবে প্রকাশ করলেই ঠোঁট কাটা? বেহায়া? তাও তো সঞ্চারী গায়ে পড়ে বলতে যায় না। একটা মেয়ে যে স্বেচ্ছায় বিয়ে না করে থাকতে পারে, এটা এরা কিছুতেই বোঝে না। বিয়ে করা আবার কি? মেয়েদের তো বিয়ে হয়, তোমার হচ্ছে না কেন? এটাই সবার জিজ্ঞাসা। বিগত দশ বছরে কতবার যে জেরা করা হয়েছে সঞ্চারীকে। “ প্রেমিক আছে? বাবা- মা মানছেন না?” “ছেলের বাড়িতে আপত্তি করছে নির্ঘাত?” “আরে আমাদের বলো, আমরা গিয়ে কথা বলি-“। “ প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়েছো নির্ঘাত? তাই বিয়েতে আপত্তি। আরেঃ সব ছেলেরা খারাপ হয় না। আমরা দেখি?” না।না।না। বলতে বলতে মুখ ব্যথা হয়ে গেছে সঞ্চারীর।
প্রতিনিয়ত নতুন নতুন থিয়োরি, “এমন কাউকে ভালোবাসো, যে বিবাহিত?” আজ্ঞে না। “আজকাল তো আবার মেয়েরা মেয়েদের সাথেও- আইন আছে নাকি। তা সেরকম কিছু?” আজ্ঞে না। “ আর কতদিন কুমারী থাকবে? যৌবন বৃথা গেলে মরেও শান্তি পাবে না”। আজ্ঞে না, আর আপনাকে কে বলেছে আমি কুমারী? বিয়ে করার সাথে যৌবন উপভোগের কি সম্পর্ক? বিয়ে না করে, ইয়ে করা যায় না বুঝি?”  সাময়িক ভাবে সবাই চুপ হয়ে গিয়েছিল সেদিন। শুধু বিজন বাবু বলেছিলেন, “মাইয়াটা এক্কেরে বেশরম।আমাদের সামনে কইলেন কন, জনে জনে এসব কথা কয়ে বেড়াবেন না। ভালো পাত্র পাওয়া মস্কিল হবে। কে কমনে ভাংচি দেবে। আর আপনের বয়সটাও তো কম হল না।“
কয়েক মাস হল, সঞ্চারীদের স্কুলে একটা নতুন ছেলে জয়েন করেছে। ইন্দ্র। বয়স বেশী না, বাইশ- তেইশ। বিজনবাবু এবং তার দলবল পূর্ণ উদ্যমে উঠে পড়ে লেগেছে ইন্দ্রর হিল্লে করতে। সঞ্চারীর মাথা ব্যথা করে, কমনরুম তো নয়, যেন ম্যারেজ ব্যুরো। একটা একটা মেয়ের কথা ওঠে, আর ইন্দ্র কাটিয়ে দেয়, “বাপরে কি মোটা।“ “দূর এর তো চুলই নেই।“”ইনি তো সাক্ষাৎ শ্রীচৈতন্যদেব বিজন দা। হাঃ হাঃ হাঃ।“  “কপালটা কত বড়। উটকপালি মেয়ে চলবে না।“”একমাত্র সন্তান? ওরে বাবা, শবশুর-শাশুড়ি সমেত ঘাড়ে এসে চাপবে।“ “ এঃ এর মুখে কি ব্রণর দাগ।“ “বাব্বা এতো সাজুনি?” “নামমাত্র বিবাহে ডিভোর্সি? বিজনদা আপনি শেষে একটা সেকেন্ড হান্ড মেয়ের খোঁজ দিলেন? একদম চলবে না। ছবিও দেখাবার দরকার নেই।“ 
কানে হেড ফোন গুঁজে গান শুনছিল সঞ্চারী। পরীক্ষা শেষ, স্কুল ফাঁকা। তবু আসতে হয়, পুরো সময় কাটাতে হয় স্কুলে। একপাশে গজল্লা চলছে বিজনবাবু- বলাকাদিদের। হঠাৎ বিজনবাবু ডাকলেন, “দিদিমণি, শুনছেন?” পাশ থেকে মৈত্রী একটা কানের কর্ডটা টেনে খুলে দিল, “তোকে বিজনদা কি বলছে শোন।“ বিজনবাবু এবং তার টিম গুছিয়ে এসে বসলেন, “দিদিমণি, শোনেন, এবার বিয়েটা লাগিয়েই দিন। আমরা একটা পাত্র দেখেছি, না কইবেন না। আর না কইলেও শুনছে কে?” প্রাথমিক বিরক্তি কাটিয়ে বেশ কৌতুক বোধ হল সঞ্চারীর। এরা ছেলে দেখে, কথাও বলে নিয়েছে, বাপস। তা পাত্র কে? এবার ঝুলি থেকে বের হল বেড়াল, পাত্র হল শ্রীমান রাজকুমার। সঞ্চারীরই সহকর্মী। ব্যাপারটা যে রাতারাতি ঠিক হয়নি তা বেশ বুঝতে পারল সঞ্চারী। কিছুদিন ধরে একটু বেশীই উৎসাহ দেখা যাচ্ছিল রাজকুমারের মধ্যে। মাঝে মাঝে একদৃষ্টিতে সঞ্চারীর দিকে তাকিয়ে থাকতেও দেখেছে, ছুটির পর, স্কুটিতে করে বাড়ি পৌঁছতে চেয়েছে। রাজকুমারের সদ্য ডিভোর্স হয়েছে, বিয়ে ভেঙে যাবার অসীম শূন্যতা সঞ্চারী না বুঝলেও, রাজকুমারের নিঃসঙ্গতা বোধ সঞ্চারীকেও ছুঁয়ে যেত। যথেষ্ট সহানুভূতিশীল ছিল সঞ্চারী, বুঝত এই মুহূর্তে ঠিক কতটা স্পর্শকাতর রাজকুমার। ঠিক তারই সুযোগ নিয়েছে বিজনবাবু এন্ড পার্টি। সচেতন ভাবে, রাজকুমারকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে সঞ্চারীর দিকে।
দূর থেকে জুলজুল করে রাজকুমারের তাকিয়ে থাকাটা মনখারাপ করিয়ে দিল, কে বলে এদের ঘটকালী করতে? মাথা ঠান্ডা রেখে যতদূর সম্ভব ভদ্র ভাবে বলল, “না। আপনারা জানেন, আগেও বহুবার বলেছি, আমি বিয়ে করতে চাই না।“ কিন্তু কেন? “কারণ আমি বিয়ে করতে চাই না, আশ্চর্য তো?” “রাজকুমারের মধ্যে খারাপটা কি দ্যাখলেন, আগে কন?” এই একই প্রশ্ন আর উত্তর চলল, আধঘণ্টা ধরে, শেষে বিরক্ত হয়ে, সঞ্চারীর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “আমার জন্য সেকেন্ডহ্যান্ড ছেলে খুঁজলেন কেন?” ব্যাস মহিলা –পুরুষ নির্বিশেষে ঝাঁপিয়ে পড়ল সবাই, এমনকি ইন্দ্র পর্যন্ত। “ছেলেদের আবার সেকেন্ডহ্যান্ড কি? আমার ঠাকুমা বলত, ‘সোনার আংটি আবার ব্যাকা!” “বড় জেদ তোর। নিজেকে কি ডানাকাটা পরী ভাবিস? কচি খুকি নাকি তুই? মনের মত ছেলে কোনদিনই জুটবে না।৪০ এর মেয়েদের আবার ব্র্যান্ড নিউ পাত্র জোটে? যা পাচ্ছিস, নিয়ে নে।“ “নিজেরও তো সিলকাটা, নিজ মুখে কইছেন, আবার আমাগো রাজকুমারকে কয় কিনা সেকেন্ডহ্যান্ড, যত ফালতু ধুমসি বুড়ি মা-।“
এই ভাবেই চলতে থাকে- একটা গল্প শেষ হয়। শুরু হয় নতুন গল্প।