Tuesday 22 May 2018

অতঃপর মহাভারত কথা-

অতঃপর মহাভারত কথা- ১
প্রথম দৃশ্য-
সুবিশাল পালঙ্কে পালকের শয্যায় সুখ নিদ্রিত ছিলেন রাজা মশাই। সুরভিত দীপশিখার মৃদু আলো তথা সুবাসে সুখ শান্তি তথা সমৃদ্ধি মাখামাখি। আচমকা কোমল সুরে কে যেন ঢেকে উঠল,“ রাজামশাই!“ “কে রে ব্যাটা?” রীতিমত হুঙ্কার  দিয়ে উঠলেন রাজা,কার এত দুঃসাহস তাঁর সুখ নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটায়? চোখ খুলে ধড়মড়িয়ে উঠে দেখেন, সম্মুখে বেতস পত্রের মত কম্পমান রাজ রক্ষিতা স্বয়ং। কাঁপতে কাঁপতে জানালেন, নগরপাল স্বয়ং প্রতীক্ষারত দুয়ারের সম্মুখে। তাঁরই নির্দেশে রাজনিদ্রা ভঙ্গ। তড়িঘড়ি নির্দেশ দিলেন, রাজ শয়নাগারে প্রবিষ্ট  হলেন নগরপাল। সাষ্টাঙ্গে  প্রণাম জানিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললেন,“মহারাজ, একজন এখনও জীবিত। ” মানে? মানেটা কি হে? নগরপাল প্রবল ঘাবড়ে গিয়ে তালগোল  পাকিয়ে যা বলল, তার সারাংশ হল, আজ প্রভাতে যে চারজন তস্করকে শূলে চড়ানো হয়েছিল, তাদের একজন এখনও দিব্যি বেঁচে আছে। শূল অর্থাৎ সুবিশাল লৌহ অথবা কাষ্ঠদণ্ড, যার অগ্রভাগ অতি তীক্ষ্ণ। সাধারণতঃ অপরাধীর গুহ্যদেশ দিয়ে প্রবিষ্ট হয়ে মাথা ফুঁড়ে বের হয়, নাও বের হতে পারে। প্রবল রক্তক্ষরণ এবং অসীম যাতনায় ছটফটিয়ে মরে যায় অপরাধীরা। তাদের শবদেহ আটকে থাকে শূলগাত্রে। শকুনে ছিঁড়ে খায়।  মুখাগ্নি তথা প্রথাসিদ্ধ  অন্তিম সংস্কারটুকুও জোটে না অভাগাদের কপালে।  নগরবাসীরা অপরাধীদের পরিণতি প্রত্যক্ষ করে এবং শিক্ষা নেয়, একই সাথে ঝিকে মারাও হয় আবার বউকে শেখানোও হয়। 
অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ না করলে সাধারণত কাউকে শূলে চড়ান না রাজামশাই। আজ একদল চোরকে শূলে চড়ানো হয়েছিল। স্বয়ং রাজবাটি থেকে মূল্যবান ধনরত্নাদি চুরি করেছিল, বামাল সমেত ধরা পড়ার পর শূলে চড়ানো হয়। বাকি তিনজন কখন মরে ভূত, চতুর্থ বৃদ্ধ দিব্যি জীবিত আছে। ইতিপূর্বে এরূপ  ঘটনা কখনও কেউ দেখেও নি, শোনেওনি।

পড়িমরি করে রাজামশাই স্বয়ং দৌড়লেন জীবিত বৃদ্ধের কাছে। অবশ্যই কোন মহাপুরুষ হবেন, ধরা পড়ার পরও বৃদ্ধের মুখে কোন শব্দ শোনা যায়নি। আত্মপক্ষ সমর্থনের ন্যূনতম প্রচেষ্টাও করেননি বৃদ্ধ। স্বয়ং রাজবৈদ্যের তত্ত্বাবধানে শূল থেকে নামিয়ে যথাবিহিত সেবাযত্নের পর, রাজামশাই বেতো হাঁটু মুড়ে করজোরে বললেন,“ক্ষমা প্রভু। ক্ষমা। অজ্ঞাতে যে গর্হিত অপরাধ সংঘটিত হয়েছে আপনার সাথে তারজন্য অনুগ্রহ করে মার্জনা করুন।  হে মহাত্মন আপনি কে? অধম কে অনুগ্রহ করে আপনার পরিচয় দিন।”
এতক্ষণে মুখ খুললেন বৃদ্ধ,“মহারাজ আমি মাণ্ডব্য। আজন্ম ঈশ্বরই আমার ধ্যানজ্ঞান। দীর্ঘদিন ধরে মৌনব্রত অবলম্বন করে ঈশ্বরের সাধনায় নিমগ্ন ছিলাম। কয়েকজন তস্কর আমার অজ্ঞাতে আমার আশ্রমে তোমার ধনরত্ন চুরি করে পুঁতে রেখে যায়। পরে তস্কররা ধরা পরার পর, আমার আশ্রম থেকেই  উদ্ধার হয় চুরি যাওয়া-”। বৃদ্ধ চুপ করলেন। লজ্জায় অবনতমস্তক রাজা মশাই সসম্মানে মুক্তি দিলেন বৃদ্ধকে। রাজবৈদ্য শুধু বললেন,“মহাত্মা, অণী অর্থাৎ ভগ্নশূলের অগ্রভাগ এখনও আপনার শরীরে বর্তমান। আমার সীমিত শল্যবিদ্যা তা অপসারণে ব্যর্থ হয়েছে। অণী আপনাকে অতীব যাতনা দেবে। জীবন্মৃত হয়ে থাকতে হবে আপনাকে।” বৃদ্ধ সন্ন্যাসী আকাশের দিকে দুই হাত প্রসারিত করে বললেন,“সবই তাঁর ইচ্ছা। ”
দ্বিতীয় দৃশ্য-
সিংহাসনে আসীন ধর্মদেব স্বয়ং। বড়ই ব্যস্ত তিনি। মানবলোকের পাপপুণ্যের সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম বিচারের ভার তাঁর হস্তে অর্পিত। নিক্তিতে প্রতি মুহূর্তে মেপে চলেছেন কর্মফল। আচমকা ঢং ঢং করে বেজে উঠল যমালয়ের ডঙ্কা। জনৈক যমদূত কুর্ণিশ করে জানাল, মহামতি মুনি মাণ্ডব্য তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী। ইতিমধ্যে কেটে গেছে বেশ কিছু বছর।প্রভূত সাধনার ফলে মাণ্ডব্য (যাঁকে আজকাল আড়ালে অণী মাণ্ডব্য নামে ডাকে সকলে) ত্রিভুবন পূজ্য। ধর্মরাজ সাদরে গ্রহণ করলেন অণী মাণ্ডব্য ঋষিকে। মুনির এক অনুরোধে অশ্বিনীকুমার দ্বয় বার করে দিতে পারতেন ঐ অণী, কিন্তু মুনি রাজি নন।কুশল বিনিময়ের পর ধর্মরাজ জানতে চাইলেন,“অণী কেন অপসারন করছেন না মুনিবর? অহেতুক এই বেদনা সহন করার আবশ্যকতা কি?” মুনি স্মিত হেসে বললেন,“এর উত্তর তো আপনি দেবেন। আমি জ্ঞানতঃ ধর্মতঃ কোন অন্যায় করিনি। তবে কেন? কেন এই অপরিসীম যাতনা আমায় দিলেন?” ধর্মরাজ জানতেন, এই প্রশ্ন উঠতে চলেছে। কিঞ্চিৎ  বিব্রতভাবে জানালেন শৈশবে মুনি এক পতঙ্গের পশ্চাৎদেশে একটি তৃণ প্রবিষ্ট করেছিলেন- তাই আর কি। মুনি শান্ত ভাবে জানতে চাইলেন,“তখন আমার বয়স কি দ্বাদশ বরষ অতিক্রম করেছিল?” ধর্মরাজ ঢোঁক গিলে জানালেন, না। মুনি পলকে অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন,“এই তোর বিচার? যার হাতে ত্রিভুবনের কর্মফলের দায়ভার ন্যস্ত, সে এটুকু জানে না যে বারো বছর বয়সের পূর্বে কৃত কোন অপরাধ পাপের পর্যায়ে পড়ে না। আপনার অজ্ঞানতা তথা অবিমৃষ্যকারিতার যে মূল্য  আমি দিয়েছি, তার বদলে অভিশাপ দিলাম, শূদ্রযোনিতে জন্ম হোক আপনার। যান মর্তলোক আপনার প্রতীক্ষায়। সর্বযোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও, যোগ্যতম  হয়েও আপনি কোনদিন রাজসিংহাসনে আসীন হতে পারবেন না। ঔরসজাত সন্তান থাকা সত্ত্বেও নিঃসন্তান অপুত্রক হয়ে জীবনযাপন করবেন আপনি। সব সাজানো গুটি প্রতিমুহূর্তে ছত্রাকার হয়ে যাবে আপনার। যে অপরিসীম বেদনা আমি সয়েছি, তার চতুর্গুণ সহন করবেন আপনি। ”

তৃতীয় দৃশ্য-
ঠিক সেই মুহূর্তে, সুবাসিত দীপালোকে আলিঙ্গনাবদ্ধ  হলেন এক ভয়াল দর্শন পুরুষ এবং এক অপরূপা নারী। আধো অন্ধকারে পুরুষকে যথোচিত সেবায় সন্তষ্ট করলেন নারী। উদ্দেশ্য ক্ষেত্রজ পুত্রলাভ।আপন পরিচয় গোপন রেখে  মিলনে নিবৃত্ত হলেন নারী। মিলন শেষে গভীর প্রশান্তির নিদ্রায় তলিয়ে গেলেন অঙ্গনা। কর্ত্রীর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন তিনি,কোন ভাবেই নিজের পরিচয় প্রকাশ পেতে দেননি। পার্শ্ববর্তী কুৎসিত অথচ মহাজ্ঞানী পুরুষের মুদিত দুই চোখের পাতা থিরথির করে কাঁপছে,তিনি ত্রিকালজ্ঞ, রাজবধূ অম্বিকার দাসী অঙ্গনার পরিচয় তাঁর অজ্ঞাত নয়। অজ্ঞাত নয় অণী মাণ্ডব্যর অভিশাপের কথাও। আজ এই গভীর রজনীতে অঙ্গনার গর্ভে প্রবিষ্ট  হলেন স্বয়ং ধর্মরাজ। কালক্রমে যিনি বিদুর নামে সুপরিচিত হবেন।জ্ঞানী শ্রেষ্ঠ। হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসনের যথার্থ রক্ষাকর্তা। সকলের অজান্তে যিনি সাজাবেন গুটি, খেলা হবে পাশা। জিতবেনও তিনি হারবেনও তিনি। কালক্রমে তাঁর পুত্র পরিচিত হবেন ধর্মরাজ রূপে, বসবেন হস্তিনাপুরের সিংহাসনে।থাক না,ভবিষ্যৎ কালের গর্ভে। আপাততঃ সদ্য গর্ভিণী  অঙ্গনাকে শেষ বারের মত আলিঙ্গন করে উঠে পড়লেন তিনি, কৃষ্ণ দ্বৈপ্যায়ণ বেদব্যাস।
©Anindita's  blog. ©Anindita Bhattacharya
অতঃপর শ্রীমহাভারত কথা
পর্ব- ২
“আ মর মিনসে,” সাত সকালে প্রিয় নারীর মুখে প্রিয় সম্ভাষণ শুনে মুচকি হাসলেন রাজা। রাজা তো নামে, আসলে এই ক্ষুদ্র জনপদের সর্দার তিনি। জনপদ শব্দটিও অনেকাংশে আলংকারিক। গভীর জঙ্গলের মাঝে কয়েক ঘর দীন দরিদ্র অনার্যের বাস। এরা এখনও প্রবলপরাক্রান্ত আর্য সভ্যতার মূল স্রোতের বিরুদ্ধে নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখে চলেছে। এই গোষ্ঠীর সবথেকে বলশালী ব্যক্তি হলেন রাজা হিড়িম্ব। এদিকে রমণীর কটু সম্ভাষণের তীব্রতা আরো বৃদ্ধি পেল, এই কটু বাক্য না শুনলে বিগত রাতের খোঁয়ারি কাটতে চায় না রাজার, বড় খাণ্ডারনি এই রমণী, এতদিন ধরে সহবাস করছে, তাও রাজাকে বিবাহ করতে রাজি না,বেলা বাড়লেই রাজাকে ধাক্কা মেরে গৃহ হতে বিতাড়ন করে, আবার সূর্যাস্তের সাথে সাথেই সুড়সুড় করে ফিরে আসেন রাজামশাই।সূর্যোদয়ের সাথে সাথে উভয়ের এই কলহ, এই জনপদের অধিবাসীদের দৈনিক মনোরঞ্জনের এক মস্ত খোরাক। আজও এই তরজা কতক্ষণ চলত কে জানে, তার আগেই এক দীর্ঘ দেহী, ঘোর কৃষ্ণবর্ণা,এলোকেশী নারী সবলে সকলকে হটিয়ে, প্রণয়নীর বাহু পাশ ছিন্ন করে, রাজাকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল।
এই নারীকে এই জনপদ ছাড়ুন, গঙ্গাপাড়ের আর্য সৈন্যরা পর্যন্ত সমীহ করে, রীতিমত ভয় পায়। ইনি আদিবাসী রাজা হিড়িম্বর ভগিনী, নাম হিড়িম্বা।তথা রাজার প্রধানা সেনানেত্রী।কর্তব্যে অবিচল, অমিত বলশালিনী এবং অসম্ভব দুঃসাহসীনি। জনা দুয়েক আদিবাসী বালিকার সম্ভ্রম রক্ষার্থে একাকী লড়ে গিয়েছিলেন হস্তিনাপুরের চারজন আর্য সৈন্যর সাথে। সুস্পষ্ট নিষেধ থাকা সত্ত্বেও এরা কেন যে সুযোগ পেলেই জঙ্গলে প্রবেশ করত, আদিবাসী আবালবৃদ্ধবনিতা আজো বোঝে না, যে অনার্যদের প্রতি এদের অপরিসীম ঘৃণা, সেই অনার্য নারীদের প্রতি এদের অদম্য আসক্তি কেন। দাঁত দিয়ে জনৈক আর্য যোদ্ধার কণ্ঠনালী ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল হিড়িম্বা, এলোকেশী করালবদনী রুধির সিক্তা হিড়িম্বাকে দেখে রাক্ষসী ভ্রমে আঁতকে উঠেছিল অবশিষ্ট সিপাইরা। কোনমতে গঙ্গা টপকে প্রাণ নিয়ে পালিয়েছিল। সেদিন থেকে নদীর ওপাড়ের শহর বারণাবতে জোর গুজব, নদীর এপাড়ে বাস করে এক রাক্ষসী, নদী পেরোলেই অপেক্ষা করে আছে সাক্ষাৎ মৃত্যু।
সেই থেকে আসেও না কেউ এপাড়ে, বরং এপাড়ের অধিবাসীরাই মাঝে মাঝে ওপারে যায় সওদা নিয়ে। বনের পাখি, খরগোস, শুষ্ক কাষ্ঠ, জড়িবুটি, শুকনো ফল, মাংস, ঝুড়ি, মদ্য ইত্যাদি নিয়ে গিয়ে বেচে ওপাড়ের হাটে। টুকটাক দেহ ব্যবসাও চলে। তেমনি গতকাল এ গ্রামের কয়েকজন গিয়েছিল বারণাবতের হাটে, অধিকাংশই ফিরে এসেছে, ফেরেনি শুধু এক বুড়ি আর গোটা পাঁচ জোয়ান ছেলে। কাল সন্ধ্যাবেলায় নাকি নতুন রাজবাড়িতে ভোজ ছিল,গৃহপ্রবেশ উপলক্ষে,বারণাবতের আবালবৃদ্ধবনিতা সকলকে সাদর নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, হস্তিনাপুর থেকে আগত মহারাণী দেবী কুন্তী এবং তস্য পুত্র যুবরাজ যুধিষ্ঠির।এপাড়ের বুড়ি আর ছোকরার দলও গিয়েছিল দু মুঠো ঘৃতপক্ক ভালো খাবার আর একটু ভালো মদের লোভে। রাত ভোর হয়ে গেছে কিন্তু বুড়ি বা ছোকরারা কেউ ফেরেনি।প্রাথমিক ভাবে পরিবার পরিজনেরা ভেবেছিল, গুরুভোজন তথা অতি নেশার ঘোরে ওরা হয়তো রাতটা হাটেবাজারেই কাটিয়ে দিয়েছে, সকাল হলে, খোঁয়ারি কাটলে ফিরে আসবে, কিন্তু আজ সকাল বেলাতেই খবর এসেছে, গতকাল রাতে এক ভয়াবহ অগ্নি কাণ্ডে নতুন রাজগৃহ ভস্মীভূত হয়েছে। সপুত্র দেবী কুন্তী পুড়ে মারা গেছেন, মারা গেছে, এরাজ্যের মুখ্য শাসক পুরোচন। কিন্তু এ গ্রামের বুড়ি বা ছেলেদের কোন খবর নেই।
পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে হিড়িম্বর বেশ খানিকটা সময় লাগল। বারণাবতে ভয়ংকর অবস্থা, শোকাকুল জনগণ পথেঘাটে আর্তবিলাপ জুড়েছে, এখনও পর্যন্ত কোন অনার্য আক্রান্ত হয়নি, তবে হতেই বা কতক্ষণ। বারণাবতের জতুগৃহের আগুন গঙ্গা পেরিয়ে এপাড়ে আসতেই বা কতক্ষণ। কিনারা বরাবর রক্ষীদের,গুপ্তচরদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দিলেন হিড়িম্বাকে। বিলাপরত নিখোঁজ যুবকদের স্ত্রী তথা পরিজনদের অবশ্য ভাগিয়ে দিলেন, যত মোদোমাতাল আপদের দল কোথায় আর যাবে,বেলা বাড়লে আপসে ফিরে আসবে।
তরুণ তপন বৃদ্ধ হয়ে, বাণপ্রস্থে চলে গেল, জঙ্গলে নেমে এল রমণীয় সন্ধ্যা, কিন্তু বুড়ি বা ছোকরার দল কেউ ফিরে এল না। আজ আর প্রিয়ার গৃহে গেলেন না রাজা হিড়িম্ব, গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত, মধ্যরাত্রে দুঃসংবাদ নিয়ে এল হিড়িম্বার গুপ্তচর, জঙ্গলে প্রবেশ করেছে এক দল আর্য। হিড়িম্ব গর্জন করে উঠল, হিড়িম্বার ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত হল, আজ রাতের মধ্যেই এই আপদের নিষ্পত্তি করতে হবে। একটাও যেন না বাঁচে।  
বন্য শ্বাপদের মত নিঃশব্দে আগন্তুকদের অনুসরণ করতে লাগল হিড়িম্বা। এরা কারা?পাঁচ জন অতীব সুদর্শন যুবক আর এক অপরূপা নারী। বড় ক্লান্ত সকলে, শুকনো পাতা দিয়ে অগ্নিবলয় রচনা করে আলাপে মগ্ন। অদূরে শিকার করা মাংস শূলপক্ক হচ্ছে, সেই গন্ধে জিভে জল এল হিড়িম্বার। সঙ্গীদের অপেক্ষা করতে বলে আর একটু কাছাকাছি এগিয়ে গেল হিড়িম্বা, এরা কারা, একটু জেনে নেওয়া দরকার।
আগুনের সম্মুখে বসে এক দৃষ্টিতে শূলপক্ক খাদ্যের দিকে তাকিয়েছিলেন ভীমসেন, আচমকা খসখস আওয়াজে চমকে তুলে নিলেন গদা, তখনি অতর্কিতে তার সাথে চার চক্ষুর মিলন হল- মোহিত হয়ে গেল হিড়িম্বা, বজ্রাহতের মত তাকিয়ে রইল হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে। সম্মুখস্থ যুবক অসীম বলশালী, তা তার পেশীবহুল শরীর দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু দুচোখে শৈশবের সরলতা, ক্ষুধার্ত শিশুর মত লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন খাবারের দিকে। ভীমসেন ভাবলেন, কোন স্থানীয় অভুক্তা অনার্যা নারী,এই অরণ্যানীর মতই সাদাসিধে। কি অপার সরলতা এই নারীর দুই চোখে। স্নেহাদ্র হয়ে জীবনে কখনও যা করেননি তাই করলেন, আপন ভাগ থেকে, খানিকটা মাংস পদ্মপাতায় মুড়ে, মাতা এবং ভ্রাতাদের অলক্ষে আলতো করে ছুঁড়ে দিলেন, ফিসফিসিয়ে বললেন “নে। ভাগ”। হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না হিড়িম্বা।একে হত্যা করতে হবে? ভাবতেই বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠল। এ অনুভূতি একে বারেই নতুন হিড়িম্বার কাছে। পারবে তো? জীবনে প্রথম নিজের দক্ষতার ওপর সন্দিহান হল হিড়িম্বা।
©Anindita's Blog ©Anindita Bhattacharya
অতঃপর শ্রীমহাভরত কথা-
(পর্ব-৩)
কে? জলদগম্ভীর  স্বরে প্রশ্ন করলেন মৃত্যু পথযাত্রী বৃদ্ধ। রক্তাক্ত রণাঙ্গনের  এক কোণায়, সাময়িক ভাবে ওণার শেষ শয্যা রচিত। এখন শেষ রাত, মশালের নিভু নিভু আলোয় কেমন যেন রহস্যমাখা চারিধার। অতন্দ্র প্রহরীরাও নিদ্রালু। হয়তো গভীর সুখনিদ্রায় মগ্ন। স্বপ্নেই মিলিত হচ্ছে দারা পুত্র পরিজনের সাথে। কে জানে কাল প্রভাত তপন কার কার মৃত্যু সংবাদ বহন করে আনে।

আজকাল শোকের থেকে লজ্জা হয় বেশী। যুদ্ধে আহত হয়ে আপাততঃ শয্যাশায়ী  তিনি। বেশ বুঝতে পারেন আয়ু আর বেশী দিন নেই। তাছাড়া তাঁর তো ইচ্ছামৃত্যু। চাইলেই মুখের সামনে বিষপাত্র ধরতে পারেন বৃদ্ধ। কিন্তু পারছেন কোথায়?

ইচ্ছামৃত্যু। অর্থাৎ আত্মহত্যার অধিকার। একজন ক্ষত্রিয়ের পক্ষে আত্মহত্যার কল্পনাও পুরুষত্বহীনতার সমতুল। ছিঃ। মৃত্যু হল ক্ষত্রিয়ের লজ্জাবতী প্রেমিকা।রক্তাক্ত রণাঙ্গনে, সম্মুখ সমরে তাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ  করাই ক্ষত্রিয়ের কাম্য। তবু পিতা তাঁকে ইচ্ছামৃত্যুর অনুমোদন দিয়েছিলেন। অনুমতি ছিল তবু পারলেন কোথায় দেবব্রত। সবই হয়তো মায়ের শিক্ষার ফল। সুদূর হিমালয়বাসিনী বৃদ্ধা মাতার জন্য আজকাল বড় মন উচাটন দেবব্রতর।জননী কি এখনও জীবিতা? তিনি নিজেই শতায়ুর দ্বারে দণ্ডায়মান,তাঁর জননীর জীবিত থাকা অসম্ভব। তবু মনে ক্ষীণ আশা, হয়তো হিমালয়ের পবিত্র দূষণমুক্ত বাতাসে এখনও শ্বাসগ্রহণ  করে চলেছেন দেবী গঙ্গা।

চিরকালই বড় নিঃসঙ্গ জননী। অন্তিম বার কবে যে মায়ের সাথে পত্রালাপ হয়েছে আজ আর মনেও পড়ে না। বড় অভিমানী দেবী গঙ্গা। পিতার দ্বিতীয় বিবাহের নিমিত্ত সিংহাসনের অধিকার ত্যাগ করা তথা চিরকুমার থাকার প্রতিজ্ঞার কথা জননীকে পত্রে জানিয়েছিলেন দেবব্রত। তীব্র ভৎসনা পূর্ণ পত্রাঘাত করেন জননী। অভিমানে বেশ কয়েকবছর আর পত্রালাপ করেননি দেবব্রত। তারপর ক্ষমা চেয়ে বহু পত্র পাঠিয়েছেন,জবাব আসেনি কখনও। পত্রবহনকারী দূতের জন্য ব্যাকুল হয়ে প্রতীক্ষা করতেন দেবব্রত, প্রতিবার একই অভিজ্ঞতা বর্ণণা করত সকলে। বন্ধুর হিমালয়ের এক একান্ত নির্জন উপত্যকায় বাস করে দেবব্রতর মাতুলকূল। আদতে পাহাড়ী উপজাতি। তাঁরা তাদের নগরে প্রবেশ করতে দেননি দূতকে। পত্র নগরপালের হাতে দিয়ে একদিন প্রতীক্ষা করে প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হত দূত। জননীর এই নিষ্ঠুর ব্যবহারে হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যেত দেবব্রতের। প্রবল ইচ্ছা করত সবকিছু ছেড়ে দৌড়ে পালিয়ে যায় হিমালয়ের সেই জগৎবিচ্ছিন্ন উপত্যকায়।

মৃতবৎসা ছিলেন জননী। বয়সেও হস্তিনাপুররাজ শান্তনুর থেকে অনেকটাই বড় ছিলেন।মাতা তথা মাতামহের মুখে শোনা, একদিন এক প্রৌঢ়া রমণী আলুলায়িত বেশে এসে উপস্থিত হয়ে ছিলেন ইন্দ্রাবতীর দ্বারে। তাঁকে দেখেই বোঝা যায়, কোন সম্ভ্রান্ত  পরিবারের কুলবধূ তিনি। সাশ্রুনয়নে তিনি আকুল প্রার্থনা করেন উপজাতি প্রধানের কাছে, তাঁর স্বামী গুরুতর অসুস্থ, পথে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে আছেন, তাঁর প্রাণ বাঁচান। ইন্দ্রাবতীর অধিবাসীরা সাধারণতঃ  কোন পথিককে বিমুখ করেন না। তবে তাঁদের কিছু শর্ত থাকে। যেমন এক্ষেত্রে শর্ত রাখা হল,মহিলার স্বামী সুস্থ হয়ে দলপতির কন্যাকে বিবাহ করবে। নারী তাতেই সম্মত হলেন। ওণার স্বামীও বয়োঃবৃদ্ধ, সুঠাম রাজপুরুষ। হিমালয়ের তীব্র ঠাণ্ডা তথা দুর্গমতা ওণাকে কাবু করে ফেলেছিল। সুস্থ হয়ে উনি যখন দলপতির কন্যাকে দেখলেন, সদ্য কিশোরী অনুপম রূপবতী কন্যাটিকে দেখে ওণার হৃদয়ে তীব্র অপত্য স্নেহ জাগ্রত হল।

ঐ ব্যক্তি আসলে ছিলেন তৎকালীন হস্তিনাপুরের দোর্দণ্ডপ্রতাপ মহারাজ প্রতীপ। দীর্ঘপ্রচেষ্টাতেও উনি পুত্রের মুখদর্শনে ব্যর্থ হন। এমনকি একটি জারজ সন্তানেরও জন্ম দিতে পারেননি মহারাজ প্রতীপ।হস্তিনাপুরের সিংহাসনের ভবিষ্যৎ  উত্তরাধিকারী কে হবে, এই দুশ্চিন্তায় উন্মাদপ্রায় হয়ে মহারাজ প্রতীপ তাঁর সতীসাধ্বী স্ত্রীকে অনুরোধ করেন ক্ষেত্রজ পুত্রের জননী হবার জন্য। এদিকে মহারাণী প্রায় বিগতযৌবনা হতে বসেছিলেন, তাও তিনি স্বীয় পতি ছাড়া অন্য কারো ঔরসে সন্তানধারণে অসম্মত হন। শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞজনের পরামর্শে রাজা-রাণী যাত্রা করেন হিমালয়ের উদ্দেশ্যে। কথিত আছে নগরাজে স্বয়ং মহেশ্বরের বাস, কঠোর সাধনায় তাঁকে তুষ্ঠ করাই ছিল ওণাদের লক্ষ্য। হয়তো তাঁরই আশির্বাদে অথবা ইন্দ্রাবতীর ভিষক শ্রীঅশ্বিনীকুমারের ঔষধিগুণে গর্ভবতী হন মহারাণী। সস্ত্রীক হিমালয় ত্যাগ করার পূর্বে করজোরে দলপতিকে প্রতিশ্রুত  দেন মহারাজ প্রতীপ, যদি পুত্র সন্তান হয়,সসম্মানে গঙ্গাকে পুত্রবধূ রূপে বরণ করে নিয়ে যাবেন হস্তিনাপুর।
(চলবে)
   ©Anindita's Blog ©Anindita Bhattacharya

শকুন্তলা

শকুন্তলা ২২/০৫/১৮
ছোট্ট বেলার অমরচিত্রকথা। রঙবেরঙের পুষ্পশোভিত ঘণ সবুজ তপোবনের এক কোণায় মৃগ শিশুকে আলিঙ্গনরতা তরুণী তাপসীর সাথে আচমকা শুভদৃষ্টি হয়ে গেল এক তৃষ্ণার্ত  শ্রান্ত পথভ্রষ্ট যুবকের। প্রাথমিক জড়তা  সঙ্কোচ অবসানে পরিচিত হলেন তাঁরা একে অপরের সাথে, প্রবলপরাক্রান্ত পুরু রাজ দুষ্মণ্ত আর কণ্বের পালিতা কন্যা শকুন্তলা। শকুন্তলার স্নিগ্ধশীতল কমনীয় রূপ বড়ই চিত্রাকর্ষক। যেন সদ্য প্রস্ফুটিত শিশিরসিক্ত   পুষ্প। মোহিত হয়ে গেলেন রাজন।পালকপিতা তথা তপোবনের অধীশ্বর কণ্বমুনির অনুপস্থিতি জ্ঞাত হয়েও গন্ধর্ব বিবাহের প্রস্তাব দিলেন রাজা দুষ্মণ্ত। প্রাথমিক জড়তা ঝেড়ে ফেলে সম্মত হলেন কন্যা। পঞ্চভূতকে সাক্ষী রেখে শুভবিবাহ সম্পূর্ণ হল।সুখস্মৃতির স্মৃতিচিহ্ন   স্বরূপ স্বর্ণাঙ্গুরীয় দিয়ে বিদায় নিলেন রাজা, প্রতিশ্রুতি অচীরেই লোকলস্কর পাঠাবেন সসম্মানে শকুন্তলাকে রাজগৃহে বরণ করে নেওয়া হবে।
এরপর যথারীতি দুর্বাসা মুনির আগমন এবং পতির বিরহে কাতর অন্যমনস্কা শকুন্তলাকে ভর্ৎসনা  ও অভিশাপ প্রদান। ফলশ্রুতি পলকে শকুন্তলাকে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হলেন রাজা। দীর্ঘদিন পিতার আশ্রমে স্বামীর অপেক্ষা করার পর অবশেষে পতিগৃহে যাত্রা করলেন শকুন্তলা।প্রিয়তমা সহচরী অনসূয়া প্রিয়ম্বদা, সাধের তপোবন,স্নেহের মৃগশিশুকে (অথবা তার নাতিপুতি) পিছনে ফেলে সাশ্রুনয়নে সালাঙ্কারা কন্যা চললেন মধুমিলনের উদ্দ্যেশ্যে,গন্তব্য হস্তিনাপুর। পথে হারিয়ে ফেললেন সাধের রাজ অঙ্গুরীয়(অমনি গপ্ করে গিলে ফেলল ইয়া বড় মৎসরাজ/রাণী)। অতঃপর রাজদরবারে সর্বসমক্ষে  চূড়ান্ত অপমানিত হলেন আজন্ম অরণ্যে পালিতা সরলপ্রাণা শকুন্তলা। এমনকি স্বামী পরিত্যক্ত  কন্যাকে ঘৃণা ভরে পরিত্যাগ করলেন সঙ্গে আগত আশ্রমবাসীরাও। একাকিনী আসন্ন প্রসবা শকুন্তলা পুনরায় উধাত্ত  হয়ে গেলেন গভীর বনানীর মাঝে।
এরপর নাটক জমজমাট করতে অবতীর্ণ  হলেন স্বয়ং মৎসরাণী। ধরা পড়লেন ধীবরের জালে, পেট থেকে বের হল সেই মূল্যবান মণিরত্নখচিত রাজ অঙ্গুরীয়। অঙ্গুরীয় দরশনে  বিলুপ্ত স্মৃতি ফিরে পেলেন রাজা। পাপবোধে জর্জরিত রাজা দৌড়লেন শকুন্তলার তত্ত্বতল্লাশে, কিন্তু শকুন্তলা কোথায়?
দীর্ঘ অনুতাপের পর্ব মিটলে পুনরায় অরণ্যে মৃগয়া করতে গেলেন রাজা, সেখানে প্রত্যক্ষ করলেন এক অপরূপ রূপবান বালককে। কি তার বিক্রম!স্বয়ং পশুরাজও তার বিশ্বস্ত  সারমেয় তুল্য বশ্য। মুগ্ধ হয়ে গেলেন রাজা। সস্নেহে জানতে চাইলেন,“কে তুমি? কি তব পরিচয়?” আধো আধো সুমিষ্ট আলাপচারিতার মাঝেই মঞ্চে প্রবেশ বালকের তরুণী মাতার। চমকে উঠলেন রাজন, এই তো সে। হারানিধি। তাপসী শকুন্তলা। নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলেন রাজন,সুখে সপুত্র পতিগৃহে যাত্রা করলেন শকুন্তলা।
এ তো গেলেন মহাকবি কালিদাসের বেতসপত্র সুলভ শকুন্তলা। আসুন এবার মহাভারতের শকুন্তলা তথা দুষ্মণ্তের সাথে  আলাপিত হই।সসৈন্য মৃগয়া করে বহু পশুহত্যার পর শ্রান্ত দুষ্মণ্ত  অনুচরবৃন্দকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে প্রবিষ্ট  হলেন মালিনী নদীর তীরে কণ্ব মুনির অনুপম কাননে। সেখানেই লক্ষ্মী স্বরূপা অতীব রূপবতী তাপসবেশধারীণী কন্যা পিতার অনুপস্থিতিতে তাঁকে যথোচিত সৎকার করলেন। ভোজননান্তে রাজা এই সুনিতম্বিনী চারুহাসিনী রূপযৌবনবতী কন্যাকে প্রশ্ন করলেন,“কে আপনি আর্যা?” কন্যা নিজেকে পরিচয় দিলেন কণ্ব মুনির কন্যা শকুন্তলা বলে। সে পরিচয় নস্যাৎ করে দিলেন রাজন, কারণ মুনি ঊর্ধ্বরেতা তপস্বী। পীড়াপীড়ি  করাতে কন্যা সলজ্জ ভাবে জানালেন তিনি মহাঋষি বিশ্বামিত্রের ঔরসে অপ্সরা মেনকার গর্ভজাত তথা জন্মলগ্নেই পরিত্যক্ত  কন্যা শকুন্তলা। কণ্ব মুনির পালিকা দুহিতা।
মহর্ষি বিশ্বামিত্র আদিতে ক্ষত্রিয় ছিলেন, সুতরাং শকুন্তলা ক্ষত্রিয়কন্যা, তাই গন্ধর্বমতে বিবাহে কোন সমস্যা ছিল না। শকুন্তলা তবু কিঞ্চিৎ  ইতস্ততঃ করছিলেন, পালক পিতার অনুপস্থিতিতে এই ভাবে লুকিয়ে বিবাহ করতে অনিচ্ছুক ছিলেন, কিন্তু অভিজ্ঞ রাজপুরুষের কূটনৈতিক দক্ষতায় সব সঙ্কোচ ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন রাজন। সামান্য তপোবনচারিনী কন্যার সাধ্য কি তাঁর যুক্তি খণ্ডন করে?

তবে মহাভারতের শকুন্তলা আদৌ অমরচিত্রকথা বা কালিদাসের শকুন্তলার ন্যায় আবেগের বশীভূত গর্দভ ছিলেন না, রাজার প্রস্তাবে সম্মত তো হলেন কিন্তু, মিলনের পূর্বে কন্যা রাজাকে দিয়ে অঙ্গীকার করিয়ে নিলেন তাঁর গর্ভজাত পুত্রই হবেন যুবরাজ এবং দুষ্মণ্তের অবর্তমানে তাঁর সমগ্র রাজ্যের অধীশ। প্রসঙ্গত রাজার অপর এক স্ত্রী ছিল, যাঁর নাম লক্ষণা এবং তাঁর গর্ভজাত পুত্রের নাম জনমেজয়।

মিলন শেষে হৃষ্টচিত্ত রাজা দ্রুত ফিরে গেলেন তাঁর রাজ্যে(কণ্ব মুনি জানতে পারলে কি বলবেন চিন্তা করতে করতে)। যাবার পূর্বে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেলেন অচীরেই পাঠাবেন চতুরঙ্গিনী সৈন্যসামন্ত, তখনই যথাবিধি পতিগৃহে গমন করবেন শকুন্তলা, তৎপূর্বে নয়। কোন অঙ্গুরীয়/কণ্ঠহার/কোমরবন্ধনী কিছুই বোধহয় দিয়ে গেলেন না। বা গিয়ে থাকলেও পরশুরামের অনুদিত মহাভারতে তার উল্লেখ নেই।
কণ্বমুনি ফিরে এসে দৈব বলে সব জানতে পেরে মার্জনা করলেন তাঁর আদরের দুহিতাকে। কেটে গেল তিন তিনটি বৎসর। দুর্বাসা কিন্তু এলেন না, ফলে ভুলে যাবার অভিশাপও কেউ দিল না। তবু রাজা যেন ভুলেই যেন ক্ষণিকের সেই মিলন। অমন তো কতই হয়। তিন বৎসর পর (মহাপুরুষরা নাকি দীর্ঘদিন মাতৃগর্ভে বসবাস করে) কণ্বমুনির আশ্রমেই ভরতের জন্ম দিলেন শকুন্তলা।

দুবছর বয়সের মধ্যেই তার মধ্যে দেখা গেল প্রবল পরাক্রম। অরণ্য থেকে হিংস্র জীবজন্ত ধরে এনে বেঁধে রাখতেন পোষ্য অনুগত সারমেয়র মত। তাই তার অপর নাম নাকি সর্বদমন। যাই হোক ভরত যখন তিন বছরের,বিষণ্ণ হৃদয়ে শকুন্তলাকে পতিগৃহে রওণা করে দিলেন মহর্ষি কণ্ব।
বিশাল জমজমাট রাজদরবারে, শিশু পুত্রের হাত ধরে সর্বসমক্ষে এসে দাঁড়ালেন শকুন্তলা। বললেন,“রাজন,তুমি অঙ্গীকার করেছিলে,আমাদের পুত্রই হবে যুবরাজ। এই নাও আমাদের পুত্র, অভিষিক্ত  কর যৌবরাজ্যে। ”দুষ্মন্ত দিব্যি চিনলেন শকুন্তলাকে, কিন্তু তাও সর্বসমক্ষে স্বীকার করলেন না। উল্টে বললেন,“দুষ্ট তাপসী,তুই কে? তোর সাথে আমার ধর্ম, অর্থ বা কামের কোন সম্পর্ক হয়নি। ” লজ্জায় অসম্মানে তথা তীব্র অপমানে সাময়িক ভাবে শকুন্তলার মনে হল তিনি সংজ্ঞা হারিয়েছেন। পরক্ষণে তীব্র ক্রোধ গ্রাস করল তাঁকে,দৃঢ় মুষ্টিতে চেপে ধরলেন প্রাণাধিক পুত্রের হাত। হিসহিস করে বললেন,“দুষ্ট রাজন। তোমার সব মনে আছে। অহেতুক মিথ্যা বললে আমার অভিশাপে তোমার মস্তক শতধা বিদীর্ণ  হবে। আমায় পরিত্যাগ কর, আমি ফিরে যাব আমার অরণ্য মায়ের কোলে, পালক পিতার নিরাপদ আশ্রয়ে কিন্তু এই শিশু?এ তোমার আত্মজ। একে ত্যাগ কোর না।”
রীতিমত প্রেম চোপড়া বা শক্তি কাপুর সুলভ ভঙ্গীতে রাজা বললেন,“আমার ঔরসে?তোমার গর্ভজাত পুত্র? কই? আমার তো মনে পড়ে না।নারীরা এমনি বেশী মিথ্যা বলে। আর যার জননী বারঙ্গণা মেনকা আর জনক ব্রাহ্মণত্ব লোলুপ নির্দয় কামুক বিশ্বামিত্র তার থেকে আর কি বা আশা করা যায়। দুষ্ট তাপসী দূর হও।”
তীব্র স্বরে শকুন্তলা বলল,“মেনকা দেবতাদের পরম কাম্য, দেবী রূপে গণ্য হন।আমি তাঁর কন্যা। মূর্খ রাজা তুমি ভূমিতে চলো, আমি অন্তরীক্ষে। আমি ইন্দ্র কুবেরাদির গৃহে যেতে পারি। যে দুর্জন, সে পরম সজ্জনকেও দুর্জনই দেখে। তুই মূর্খ রাজা।ঘোর পাপাচারী। তোর সাথে মিলনের কথা ভাবলেও বমনেচ্ছা জাগে। শোন রে দুরাত্মা, তোর সাহায্য ব্যতিরেকেও আমার পুত্র সসাগরা ধরিত্রীর অধীশ্বর হবে। ” এই বলে শকুন্তলা সপুত্র নিষ্ক্রমণে উদ্যত হলেন, এমন সময় দৈববাণী হল,শকুন্তলাই সঠিক।
রাজা দেঁতো হেসে মন্ত্রী অমাত্যদের কইলেন, “শুনলেন তো। আমি স্বয়ং এই বালককে পুত্র বলে মানি,তবে কি না শুধু শকুন্তলার কথায় যদি ওকে আপন করে নিতাম- তবে হেঁ হেঁ লোকে দোষ দিত কিনা। ” আর শকুন্তলাকে বললেন,“দেবী!তোমার সতীত্ব প্রতিপাদনের জন্যই তো আমি এইরূপ ব্যবহার করেছিলাম, নয়তো লোকে মনে করত, তোমার সাথে আমার ইয়ে ইন্টুপিন্টু হয়েছিল। তোমার ছেলেই তো রাজা হবে, কথা দিয়েছি না। চলো এবার ঘরে চলো আর হ্যাঁ তুমি কিন্তু আমায় আজ পচুর বাজে কথা বলেছো,হ্যাঁ। আমি খুব দুক্কু পেয়েছি কিন্তু তাও দেখো আমি কতো মহৎপ্রাণ আমি, যাও তোমায় ক্ষমা করলাম। ”
(আসল দুষ্মণ্তকে চেনা চেনা লাগল কি? সত্যিই মহাভারতের জবাব নেই। সাধে কি বলে? “যা নেই (মহা)ভারতে, তা নেই ভারতে”। )

Saturday 12 May 2018

আমাদের গপ্প

আমাদের গপ্প ৬ই এপ্রিল ২০১৭#1
যদি কাউকে সাড়ে দশটায় মেসেজ করা হয়,“ধুৎ! গাড়ি আসেনি। লঞ্চঘাটে দাঁড়িয়ে আছি। ” সেই মেসেজ সে বেলা সাড়ে বারোটায় পড়ে এবং পড়া মাত্র উদ্গ্রীব হয়ে ফোন করে, এখনও রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি কি না জানতে(?) তাহলে কি বুঝব? ভালবাসা নাকি মরিচীকা?
আমাদের গপ্প  ১৭ই এপ্রিল ২০১৭ #2
-তুই একদম আমার বাবার মত নস্!
-ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।
-বাবা হলে কখনওই আমাকে ফেলে সিগন্যাল গ্রীণ দেখলে ল্যাজ তুলে দৌড়ত না।
-ভাগ্যিস্।
-বাবা হলে কখনই ভিড় বাসে, আমি দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও সিট পেলেই, থপ করে বসে পড়ত না।
-যাঃ বাবা। তুই এই দিকের সিটে বসবি কেন?
-আহাঃ! কি যুক্তি! যেন ওটা জেন্টস্ সিট, জেনারেল সিট নয়?
-একটু পরেই তো সিট পেলি রে বাবা--
-তাতে কি? তুই সেই ভাল্লুকের গল্পটা জানিস তো?
-কোন ভা- ল্লু- ক?ও সেই গল্পটা যেখানে ভাল্লুক বলবে এত চর্বি ওলা লোক খাই না! বলে চলে যাবে?
-ইশ্!!!!!ভালো হবে না বলছি---
আমাদের গপ্প #৩ 20.07.2017
-অমুকের ঘাড়ে চাপতে গেলি কেন খামোখা?
-কিঃ?খামোখা তুই ছাড়া অন্য লোকের ঘাড়ে চাপতে যাব কেন?
-মেসেজ করলি যে? অমুক অফিসারের ঘাড়ে।
- সত্যি মাইরি ।  লিখলাম অমুকের ঘরে (ghare)। ঘাড়ে নয়। মানছি ইংরাজি হরফে বাংলা তাই বলে এত সাংঘাতিক ভুল কেবল তুই ই বুঝতে পারিস।
-না মানে, ঘাড়ে চেপে ভেজা খাওয়া তোর স্বভাব কি না--- তাই ভাবলাম আর কি--
#Aninditasblog #আমাদের_গপ্প
https://amianindita.blogspot.com
আমাদের গপ্প #৪ ২৯শে অক্টোবর  ২০১৭
-কি করছিস?
-(অন্যমনস্ক ভাবে) উঁ, লিখছি, মিসির আলির গল্প।
-বাবাঃ তুই এর মধ্যে আবার মিসির আলির গল্পও লিখে ফেললি। তাহলে চেষ্টা চরিত্র করে এবার গোটা চারেক রবীন্দ্রসঙ্গীতও লিখে ফেল-
-হাঃহাঃ। হিহি। হোহো। উফ্ বাপরে বাপ। হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে গেল। কি বাজে লোক বাবা তুই। জঘণ্য। 
http://amianindita.blogspot.com/2017/04/blog-post_17.html
#আমাদের_গপ্প
আমাদের গপ্প #5 ২০শে এপ্রিল ২০১৮
বুদ্ধিমত্তার কোন সীমায় পৌঁছালে, মানুষ পরের মুঠো ফোনকে আপন মনে করে, ব্যাগগত করে? মানছি অফিস যাবার বড় তাড়া, তবুও?
আর তারথেকেও বেশী বুদ্ধি ধরেন যারা, তাঁরা কি করে জানেন? চলন্ত ট্রেনে সওয়ার যাত্রীকে ফোন করে বলে, "ওই, আমার ফোন ফেরৎ দিয়ে যা। এখুনি!"
আমাদের গপ্প ৬ ১২/০৫/১৮
-(খেতে বসে ,মা) উফ্ বাড়িতে এক টুকরো চকলেটও নেই। সব তুত্তুরী খেয়ে বসে আছে।
-(বাবা, খাবার থালার ওপর ঝুঁকে পড়ে, বিড়বিড় করে) ঈশ্বর আছেন।
-(মা, ঘ্যানঘেনে সুরে) সত্যি রে, একটুকরো চকলেটের জন্য প্রাণটা হাহাকার করছে।
-(পাশ থেকে তুত্তুরী, সোৎসাহে) হ্যাঁ বাবা, আমারও।
-(মা, তীব্র কটাক্ষে তুত্তুরীকে অর্ধেক ভস্ম করে দিয়ে, ওষ্ঠ্য ফুলিয়ে) সব খেয়ে বসে আছে, আবার বড় বড় কথা। আমি আজ দুপুরে চকলেটের স্বপ্নও দেখেছি। দেখলাম গাছে চকলেট ফলেছে। (বাবার কোন হেলদোল দেখা গেল না। একমনে রুটি চিবোচ্ছে) সত্যিরে স্বপ্ন দেখলাম, আমার বন্ধু রুণাদের বাড়ির সামনে বিশাল কদম গাছে, যেমন ঘুড়ি আটকায়, তেমনি একটা অতিকায় বোর্ণভিল চকলেট আটকে আছে। রুণা বলল,“গাছটা একটু সাফ করে দে তো। ” আমি ওমনি গাছে উঠে, চকলেটটা হাতিয়ে,ওখানেই বসে খেতে লাগলাম।
-(তুত্তুরী উৎসাহের আতিশয্যে দাঁড়িয়ে উঠে) হ্যাঁ আমিও আজ দুপুরে স্বপ্ন দেখলাম আমি চকলেট ওয়ার্ল্ডে পৌঁছে গেছি। মা কোথায় গেল? পিছন ফিরে দেখি মা গাছে উঠে বসে আছি।
-(বাবা, দুজনের দিকে তাকিয়ে, নির্বিকার ভাবে) আমিও দুপুরে একটা স্বপ্ন দেখেছি। আমার হাতে একটা কুঠার,আর আমি একটা গাছ কাটছি।
-(তুত্তুরী) কোন গাছ? মা যেটায় চড়ে বসেছিল সেটা?
-(বাবা,পুনরায় থালার দিকে তাকিয়ে) আর বলব না।
(এরপরের খণ্ডযুদ্ধ উহ্যই থাক বরং)
শৌভিক,অনি আর তুত্তুরীর গপ্প ২৩/০৮/১৮
-বাবু? আবার তুই আমার ফোনে হাত দিয়েছিলি?
-(ভালোমানুষের মত মুখ করে) না তো মা।
-আবার মিথ্যে কথা? আমার ফোন বলছে-
-বাবা মায়ের মাথাটা গেছে, বলছে মায়ের ফোন নাকি কথা বলছে-
- বলেই তো। ফোন খুলতেই দেখি লুকা মর্ডিক এর ছবি। কে যেন আমার ফোন থেকে গুগল সার্চ করেছিল-
-লুকা মর্ডিককে কি সুন্দর দেখতে বলো বাবা।
-(বাবা পাশ থেকে) একে লুকা মর্ডিকের সাথে বিয়ে দিয়ে দে।
-(দীর্ঘশ্বাস ফেলে) সেকি আর হবে। লুকা মর্ডিকের তো বিয়ে হয়ে গেছে-
-ধুর নিকুচি করেছে মর্ডিকের। ফের যদি আমার ফোন খুলেছিস, পাসওয়ার্ড বদলে দেব। আর জানাবও না।
-(অনুযোগের সুরে) বাবা মা কেন ফোন লক্ করে রাখে বলো তো।
-(মা ব্যঙ্গের সুরে) না হলে তুমি জনগণকে মেসেজ পাঠিয়ে বেড়াও যে। যার সাথেই কথা বলি, ফোন রাখতে না রাখতেই- আমি আশিসদাকে দেখব। নির্মলের ছবি দেখাও। ডিএম সাহেব ছবি লাগায়নি কেন? আমার চাকরী বাঁচলে হয়।
-হুঁঃ। বাবা জানো তো,মা না একটু আগে তোমার ফোন ঘাঁটছিল।
-ঘাঁটিনি। ফোন করছিলাম। তার কারণ তুমি আমার ফোন থেকে দাদুর সাথে মহাভারত রচনা করছিলে। কি লাগানেকুটি মেয়ে বাপু তুই।
-(ষড়যন্ত্রের সুরে)বাবা, তুমিও তোমার ফোনের পাসওয়ার্ডটা পাল্টে ফেল। আর মাকে বোল না। শুধু তুমি জানবে আর আমি জানব।
-(বাবা উপহাস্যের সুরে) হ্যাঁ যাতে এবার তুই আমার কনট্যাক্ট নিয়ে ছেলেখেলা করতে পারিস।
-(অবস্থা বেগতিক দেখে)বাবা মেয়েরা প্যান্ট-শার্ট পরে,ছেলেরা কেন ফ্রক পরে না।
-(বাবা গম্ভীর ভাবে) পরলেই হল। স্কটল্যান্ডের ছেলেরা স্কার্ট পরে তো।
-তুমি পরবে বাবা?
-হ্যাঁ আমিও ঠিক করেছি এবছর পুজোয় ফ্রক পরব। তোর মাকে কিনে দিতে বলিস।
আমাদের গপ্প 7 02.09.18
-(স্কুল থেকে ফেরার পথে রিক্সায় উঠে) বাপরে বাবু,তোকে তো চেনাই যাচ্ছে না। এঁকেছিস না রঙের ওপর গড়াগড়ি খেয়েছিস?
-(গম্ভীর মুখে)মা, প্লিজ ডোন্ট আন্ডার এস্টিমেট মি।
-কে আবার তোকে আন্ডার এস্টিমেট করল?
-বাবা করে তো সব সময়। কাল বলছিলাম টিচার্স ডে তে মিসের জন্য একটা কার্ড বানাব। দাদুকে বললাম আর্ট পেপার কিনে রেখো তো। তুমি কার্ডের মাপে কেটে দেবে আর তাতে আমি রেইন অব হার্টস্ আঁকব।
-শুনে বাবা চোখ গোলগোল করে বলল, তাহলে তো তলায় লিখে দিতে হবে, ইহা একটি ছবি।
-সে যাই হোক, আমি কোন এস্টিমেটই করছি না, শুধু বল সাদা জামাটা লালনীলবেগনি হল কি করে। আর পকেট ভর্তি ওগুলো কি?
-এগুলো? এগুলো হল কালার পেনসিলের খোলা। পেনসিল বাড়লে যে গুলো ঝরে পড়ে না, ওগুলো।
-বুঝলাম। তা ও গুলো বুক পকেটে করে বাড়ি বয়ে আনার কারণটা বুঝলাম না।
-বন্ধু দিল।
-বন্ধু তার কালার পেনসিল বেড়ে খোলা গুলো তোর সাদা জামার বুক পকেটে ঢুকিয়ে দিল আর তুই খুশি খুশি বাড়ি চলে এলি?কি আকাট বাবু তুই।
-বাঃ। ও ভালোবেসে দিল আর আমি নেবো না।
-এটা ভালোবাসা? তোকে বোকা বানিয়েছে আর তুইও -
-আরে বাবা পকেটটা আছে কেন? কেউ কিছু দিলে রাখার জন্যই তো। আমি তো আমার ব্লু পেনসিলটাকেও পকেটে রেখেছি। বাবা যেমন পেন রাখে।
(খানিকবাদে রিক্সা থেকে তীব্র স্বরে হর্ন বাজানো বাইক আরোহীর উদ্দেশ্যে “ওরম তাকিওনা” গানের মজার সুরে) এই হর্ণ বাজিও না।
(একটু পরে ফুটপাতে কলহমান জুড়ির উদ্দশ্যে) এই ঝগড়া কোর না।
(আরো কিছুক্ষণ পরে আনমনে নির্বিকার চিত্তে কণ্ডুয়ন রত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে) এই @Φ‡ চুলকিও না।
-(প্রবল ধমকের সুরে)বাবু ভালগারিটির একটা লিমিট রাখ।
-(অবাক হয়ে)ভালগারিটি মানে?
-অশ্লীলতা। অসভ্যতা।
-আমি কি করলাম?
-কারো প্রাইভেট পার্টস্ নিয়ে কথা বলতে আছে?না দেখতে আছে?তাও রাস্তায়?
-যাঃ বাবা, ও রাস্তায় চুলকাতে পারে আর আমি বলতে পারব না?বললেই ভালগারিটি?
আমাদের গপ্প ৮ ১৮/৯/১৮
-খাবি না?
-নাঃ। একদম খেতে ইচ্ছে করছে না। গা গুলোচ্ছে। একে গরম,তায় মনে হচ্ছে নজর লেগে গেছে।
-কারো নজর লাগেনি। তুইই নজর দিয়েছিলি খাবার গুলোর ওপর। চিকেন,মাটন, পমফ্রেট- উফ্।
-কি কথার ছিরি।  হে ভগবান। তুলে নাও আমায়।
-জিমে গেছে।
-কে?
-ভগবান। তোকে তুলতে হবে তো।
-হিঃ হিঃ। হাহা। হোহো। কি যাতা মাইরি।
-(বাবামায়ের দাম্পত্যালাপে বলপূর্বক অনুপ্রবেশ করে) বাবা তুমি বরং অনুষ্কা শর্মাকে বিয়ে কর?বিরাট কোহলির বউ।  সে একটুও মোটি নয়-
-তোর বাবা আমাকে ছাড়া আর কাউকেই বিয়ে করবে না। বুঝলি। তুই এবার পড়। বাবা-মায়ের সব কথায় কান দেবার দরকার নেই। পাকা মেয়ে।
-(মায়ের কুবাক্য গ্রাহ্য না করে,উঠে গিয়ে বাবার গলা জড়িয়ে) হ্যাঁ বাবা। তুমি বরং সব খেলোয়াড়দের বউদের বিয়ে করে নাও।
-(বাবা হাই তুলে)নাঃ বিয়ে ব্যাপারটা ওভাররেটেড। ওয়েস্টেজ অব টাইম বুঝলি।
-না বাবা। বিয়ে তোমায় করতেই হবে।  তাহলেই সব খেলোয়াড়রা আমাদের বাড়ি চলে আসবে বেশ। ওদের সব মেডেল, ট্রফি কেমন আমাদের দিয়ে দেবে। আমরা সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতে পারব-। বেশ মজা হবে বলো বাবা?(কিয়ৎক্ষণ পরে ফিসফিস করে) বাবা, মাকে বলো না একটা ফ্যান্টা আনতে।
-(বাবাও ফিসফিসিয়ে)তুইই বল বরং।
-(ভিজে বেড়াল সেজে) মা বেরোচ্চো?আমার জন্য ফ্যান্টা আনবে মা?
-তা আনব না?আমার বরের সাথে দুনিয়ার মেয়ের বিয়ে দেবে, আর আমি তোমার জন্যই তো ফ্যান্টা আনব মা।
আমাদের গপ্প ৯ ২৫/১০/২০১৮
দুপাশে দিগন্তরেখা বরাবর নাতি উচ্চ ঘণ সবুজ পাহাড়। যতদূর চোখ যায় হলদে সবুজ ধানক্ষেত। মাঝে রাস্তা দিয়ে নড়বড় করে চলছে গাড়ি। বাবামায়ের মাঝে বসেছে তুত্তুরী, মুখে রবি ঠাকুরের দাড়ির মত প্লাস্টিক পরানো। অাহা গাড়িতে উঠলেই তুত্তুরীর সেইটা হয় যে।
বাবা ঢুলছে দেখে, ফিসফিস করে তুত্তুরী মায়ের কানে কানে বলল,“মা, একটা সত্যি কথা বলব?”
বাবা গো! আমার মেয়ে আজ সত্যি বলতে চাইছে?যার গপ্পের গরু সবসময় গাছের মগডালে চড়ে থাকে। বললাম,“বলো মা। বলে ধন্য করো। আজ কার মুখ দেখে উঠেছি?নির্ঘাত নিজের। ”
“মা, বলছি কি না যে,সেই যে তুমি শীতকালে লিপ বাম কেনো না, যেটা ঠোঁটে মাখলে-”।
অধৈর্য হয়ে বললাম,“হ্যাঁরে বাপ। লিপবাম কাকে বলে আমি জানি। আগে বল-”।
“সেই যে সেবার তুমি নিভিয়ার লিপবাম এনেছিলে, আমি যেটা চারদিনে শেষ করে ফেলেছিলাম বলে খুব বকেছিলে না?”হ্যাঁ।  তো? “মা ওটা না খেতে দারুণ ভালো ছিল। আমি ওটা খেয়ে নিয়েছিলাম। ”
“সর্বনাশ তুই লিপবাম খেয়েছিলি?ওয়াক থুঃ। ”
তাহলে গপ্পটা বলেই ফেলি,২০১৬সালের কথা(সাল তারিখ তুত্তুরীই ধরিয়ে দিল) শীত পড়ার মুখে মেয়ের খুব ঠোঁট ফাটছিল বলে,ওকে এক টিউব লিপবাম কিনে দেওয়া হয়। শুধু ও ব্যবহার করবে। পরের রাতেই তিনি নিখোঁজ হন। খোঁজাখুজি,ধমক ধামকের পর দলামোচড়া টিউবটা দিনচারেক পর বের হয়। আমাদের ধারণা ছিল ঐ টিউবটি ও রেড্ডিকে মাখিয়েছিল। রেড্ডি একটি রক্তিম বর্ণা তুলোভরা পুতুল ছিল। যাকে তার কদিন আগেই তুত্তুরী এক কৌটো বোরোলীন মাখিয়েছিল। এই নিয়ে মাসি বকতে যাওয়ায় মাসিকে শুনতে হয়,“পুতুল বলে কি রেড্ডি মানুষ না?ওর কি শীত লাগে না? গা ফাটে না?” আজ জানা গেল,বেচারা রেড্ডি নির্দোষ ছিল।
আমাদের গপ্প #১০- ২৮শে এপ্রিল, ২০২০
-এই সিনেমাটার জন্য আমি আজ পড়াশোনাও বন্ধ রাখলাম?
- কেন? 
- এই রকম সিনেমাই তো দেখা উচিত, শিক্ষামূলক ছবি। 
-(বাসন ধুতে ধুতে, টিভির পর্দা থেকে ভেসে আসা এলভিসের সুরে অন্যমনস্ক হয়ে)ও। হ্যাঁগো, বলছি কি না, তুমি যে লাইনগুলো লিখেছিলে না, তুমি কি ওগুলো ‘মিন’ করেছিলে?
- কোন লাইন? কবে?
-সেই যে বিয়ের আগে-
-ও বাবা! সে তো অনেককাল আগের কথা- কি লিখেছিলাম কে আর মনে রেখেছে?
- আরেঃ ঐ যে গো, মেসেজ পাঠিয়েছিলে না, “ Like a river flows surely to the sea/Darling so it goes/ Some things are meant to be/ Take my hand, take my whole life too/ For I can't help falling in love with you”। 
-(নৈবিত্তিক ভাবে) অ। ও তো আমি পড়েছিলাম, এই সব লাইন লিখে পাঠালে মেয়েরা খুশিটুশি হয়, তাই আর কি-
-ধ্যাৎ। আমি জানি, তুমি সত্যি কথাটা বলছ না। তুমি যা অনুভব করেছিলে, তাই লিখেছিলে-
-হুঁ। তাহলে তো এখনও যা অনুভব করছি,তাই দেখতে যাচ্ছি। 
- কি?
- How to Murder Your Wife।