Wednesday 2 May 2018

কোন এক দিন -

কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে অনাম্নী স্রোতোস্বিনী। বইছে মৃদুমন্দ পবন। ঘণ বনানীর মাঝে এক বিশাল পিপ্পলী বৃক্ষতলে ধ্যানমগ্ন জনৈক তাপস। পরণে শ্বেতবস্ত্র, উর্ধ্বাঙ্গে পীতাভ উত্তরীয়, উভয়ই অতি সাধারণ। অসাধারণ শুধু তাঁর দীপ্তি। অপরূপ রূপময় তাপসের মুখমণ্ডলে খেলা করে চলেছে অদ্ভূত প্রশান্তি, ইনি যে অত্যন্ত অভিজাত বংশীয় অসীম জ্ঞানের অধিকারী তা এঁণার মুখমণ্ডল তথা দেহবিভঙ্গে সুস্পষ্ট। যদিও চোখের নীচের মৃদু কালিমা একথা লুকাতে অক্ষম যে আপাততঃ ইনি কিঞ্চিৎ  কায়ক্লেশে আছেন। স্বীয় ক্লেশকে অদ্যাবধি বিন্দুমাত্র  গুরুত্ব দেননি উনি, কিন্তু প্রিয়জনের বেদনায় বড় দ্রুত কাতর হয়ে পড়েন আজকাল। বিশেষতঃ সেই প্রাণাধিকা নারী, যাঁর যাবতীয় কায়ক্লেশের মূল হোতা এই দুর্ভাগা তাপস, এমনকি তাঁরই অবিমৃষ্যকারিতার জন্য জনসমক্ষে আর্যকন্যাকে বিবস্ত্র হতে হয়েছে, যতবারই সেই দৃশ্যাবলী চোখের সামনে ভেসে ওঠে কেঁপে ওঠেন তাপস। ছিঃ।  ছিঃ। যে পুরুষ নিজের স্ত্রীর মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, কি প্রয়োজন তার প্রাণধারণে?
এই যে রাজনন্দিনী সর্ব বিলাস ত্যাগ করে তাঁর অনুগামিনী হয়ে এই গভীর জঙ্গলে বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন, এর জন্য দায়ী কে? কোনদিন শিকার জোটে, কোনদিন নিকটস্থ জনপদ থেকে জোটে ভিক্ষালব্ধ কয়েকমুঠি যব, কোনদিন শুধুই বনের ফল আর কোনদিন শুধুই শীতল জলে নৈশাহার সমাধা করেন তাঁরা। কতদিন প্রিয়ার মুখে হাসি দেখেননি তিনি। মাটির কুঁড়ে ঘরকে সহস্তে নিকিয়ে কি অপরূপ বিন্যাসে সাজিয়ে রাখেন প্রিয়া, প্রিয়ার হাতের মায়াজালে সামান্য যবও যেন পরিণত হয় দেবভোগ্য অমৃতে। এত গুণের অধিশ্বরীর এই পরিণতি কেন? সুদূর মাতুলালয়ে সযতনে থাকা নিজ শিশুপুত্রদের স্মরণ করে প্রায় প্রতিটি রজনীই নিঃশব্দ অশ্রুমোচনে যাপন করেন আর্যা। ভাবেন তাপস বুঝি উপলব্ধি করতে অক্ষম, অথচ বিগত একবছরে এক পলের জন্যও তিনি বিস্মৃত হননি তাদের। তাঁর জন্যই পাঁচটি দুগ্ধপোষ্য শিশুকে পিতৃমাতৃহীন হয়ে মাতুলালয়ে কাটাতে হবে আরো দ্বাদশ বর্ষ, ভাবতেই সিক্ত হয়ে উঠল আঁখিপল্লব।

আত্মবিস্মৃত হয়েছিলেন তাপস,আচমকা কিঞ্চিৎ অসহিষ্ণু অথচ বজ্রগম্ভীর কণ্ঠস্বরে কে যেন ডেকে উঠল,“ মহারাজ!মহারাজ? আপনি কি সংজ্ঞা হারিয়েছেন?”  অন্য কেউ এই সম্বোধন  করলে তাপস ভাবতেন নির্ঘাত ব্যঙ্গ, কিন্তু তাঁর এই বিশালদেহী ভ্রাতাটি যে আদৌ ব্যঙ্গ নয়,বরং পরম শ্রদ্ধা তথা ভালোবাসায় তাঁকে এই চরম দুর্দিনেও মহারাজ বলে ডাকেন, তা তাপসের অনবগত নয়। মৃদু হেসে বললেন,“নাঃ। সামান্য ধ্যানের প্রচেষ্টা। ”
তাঁর এই ভ্রাতাটি অন্যান্য ভাইদের তুলনায় দর্শন বা বুদ্ধিবৃত্তিতে বেশ সাধারণ। তবে অমিত বলশালী এবং শিশুর মতই সরল। সুখের দিনে প্রজারা আড়ালে বলতেন এই রাজকুমার শুধুমাত্র “দাদা আর গদা” ছাড়া কিছুই বোঝেন না। কথাটা মিথ্যা নয়। ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভূত হওয়া সত্ত্বেও ইনি গদা ছাড়া অন্যান্য কোন শস্ত্রচালনাতেই তেমন দক্ষ নন। রাজনীতি, কূটনীতির জটিলতাও তেমন বোঝেন না।রাজপাট ত্যাগ করে বনবাস কালে ইনি ব্যাপক অশান্তি করেন শিশুদের মত। না রাজকীয় ভোগবিলাসে তেমন যে আসক্তি আছে তা নয়, তবে ইনি বড় জলদি ক্ষুধাকাতর হয়ে পড়েন। ইতিপূর্বে কিয়ৎকাল বনবাসের অভিজ্ঞতা থেকে ভালই জানতেন যে জঙ্গলে অর্ধেক দিবস অভুক্ত  থাকতে হয়, তাই কিছুতেই এযাত্রা বনবাসে আসতে আগ্রহী ছিলেন না। শেষে তাপস ক্রুদ্ধ হয়ে, এই ভ্রাতাকে ত্যাগ করেই সপরিবারে বনবাস যাত্রা করেন। বেশ কিছুটা পথ গিয়ে পিছন ফিরে দেখেন, শিশুর মত মাটিতে পা ঘষতে ঘষতে তাঁদের অনুসরণ করছেন মধ্যমকুমার।
শুধু কি তাই, বনবাসে এসে সকলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শিকার এবং ভিক্ষাবৃত্তি সম্পন্ন করেন, কিন্তু এণাকে শিকারে পাঠালেও বিপদ ভিক্ষাবৃত্তিতে নিযুক্ত করলেও বিপদ।শিকারে গেলে বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও অনাবশ্যক বেশী জীবজন্তু বধ করে নিয়ে আসেন  কুমার। যাতে সকলের পেট ভরে যাওয়ার পর অবশিষ্টাংশ তাঁর উদরপূর্তিতে যেতে পারে। আর ভিক্ষা করতে গিয়ে একমুঠি যব প্রদান করা গৃহস্থের দিকে এমন কটমট করে তাকান যে তাঁরা প্রাণভয়ে ভাঁড়ার উপুড়হস্ত করে দেন। খবর আসতে বিলম্ব হয়নি তাপসের কানে। ফলে আপাততঃ শিকার এবং ভিক্ষা দুই নিষেধ।
সারাদিন বাতাসে গদাযুদ্ধ আর গৃহিণীকে গৃহকর্মে সহায়তা করেই দিন কাটে তাপসের। রাতে সকলের পাতে যখন একমুঠি যবের মণ্ড তুলে দেন প্রিয়া, শিশুর মত হস্ত এবং পাত্র লেহন করেন মধ্যম কুমার। মাটিতে পড়ে থাকা গুঁড়াও অঙ্গুলি স্পর্শে তুলে নিয়ে মুখে দেন। তাপস জানেন প্রিয়া তথা অন্যান্য কুমারেরা তাঁদের অংশ থেকেও কিছুটা সস্নেহে তুলে দেয় মধ্যমকুমারের পাত্রে। দেন তিনিও, এক চুটকি উদ্বৃত্ত   যবের মণ্ড পেয়ে কুমারের দুই চোখ চিকচিকিয়ে ওঠে। নিভৃতে বিড়বিড় করেন তাপস,“যাঁদের জন্য তোমায় এই জঠরাগ্নি সহন করতে হচ্ছে, ইন্দ্রের বজ্র নেমে আসুক তাদের মাথায়। ”
“মহারাজ?” আবার অসহিষ্ণু হয়ে প্রশ্ন করলেন মধ্যম কুমার
“কি ভ্রাতা?”সস্নেহে জানতে চাইলেন তাপস।
“মহারাজ,চলুন ফিরে যাই। আমাদের রাজ্যে। ফিরিয়ে আনি আমাদের শিশুগুলিকে। আবার পাটরাণী হয়ে রাজপ্রাসাদ আলো করে বসুন আর্যকন্যা। ”
“ভ্রাতা,তুমি কি বিস্মৃত হয়েছ?বারো বছর এই বনভূমিই আমাদের রাজপাট,ঐ মৃৎকুটির আমাদের রাজপ্রাসাদ। তারপর,এই বনভূমি ত্যাগ করে আমাদের আশ্রয় নিতে হবে কোন সম্পূর্ণ অচেনা অনাত্মীয় গৃহে।লুকিয়ে রাখতে হবে নিজেদের ছদ্মবেশ তথা ছদ্মপরিচয়ের অবগুণ্ঠনে।  যেখানে আমাদের কেউ না চিনতে পারে। যদি ধরা পড়ে যাই,তো আরো বারো বছরের বনবাস সুনিশ্চিত। ”
এক ঝলক আগুন চলকে উঠল কুমারের দুইচোখে,পর মুহূর্তেই তার স্থান অধিকার করল একরাশ সরলতা। দুষ্টু হাসি হেসে কুমার বললেন,“জানি ভ্রাতাঃ। জানি। তাই তো এক সুপ্রস্তাব এনেছি। দেখুন কৃষক যেমন স্বল্প বীজবপন করে, আহরণ করে বিপুল পরিমাণ শস্য,বুদ্ধিমান ব্যক্তি যেমন বিপদে অল্প ধর্ম বিসর্জন দেন বৃহত্তর ধর্মরক্ষার স্বার্থে, সোমলতার প্রতিনিধি যেমন পূতিকা,তেমনি বৎসরের প্রতিনিধি মাস। চলুন আমরা এই জঙ্গলে অতিবাহিত তের মাসকেই গণ্য করে তের বৎসর হিসাবে। ব্যাস হয়ে গেল আমাদের বারো বৎসরের বনবাস আর এক বৎসর অজ্ঞাতবাস। দেখুন এই অন্তিম এক মাসে তো কোন কৌরব বংশীয় চর আমাদের সন্ধানে আসেনি, তো এই একমাস অজ্ঞাতবাস হল কি না?”
কুমারের কুযুক্তিতে হো হো করে হেঁসে উঠলেন তাপস। সেই অট্টহাসের শব্দে আতঙ্কিত হয়ে উড়ে গেল পিপ্পলী-বৃক্ষের শাখাপ্রশাখায় আয়েস রত জনা কয়েক বায়স। রীতিমত আহত চক্ষে মধ্যমকুমার বললেন,“জানতেম। জানতেম আপনি মানবেন না। তাই আরো একটি উত্তম প্রস্তাব আছে। একটা ভালো ধর্মের ষণ্ড জোগাড় করে, তাকে ভরপেট খাইয়ে, হস্তপদ মর্দন করে যথাবিহিত সেবা করে, তাকে প্রীত করতে পারলেই সব পাপক্ষলন হয়ে যাবে। আমি একটা ষণ্ড জুটিয়েও এনেছি। আবডালে রাখা আছে। মহানন্দে ঘাস চিবোচ্ছে। এবার আপনিও মেনে নিন ভ্রাতা। এযাতনা আমার যাও সহ্য হয়, প্রিয়া বা কনিষ্ঠ ভ্রাতাদের কষ্টে বুক ফেটে যায় আমার। ”
স্নেহের ভ্রাতাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ  করলেন তাপস, এই কুমারের শ্মশ্রুগুম্ফের বৃদ্ধি বড়ই স্বল্প, নেই বললেই চলে, অঙ্গরাজ তো জনসমক্ষে  তাঁর এই স্নেহের ভ্রাতাটিকে পেটুক এবং তূবরক(মাকুন্দ) বলে গালি দিতেন। কেশরাজি অবশ্য খুব একটা কম না,বরং বেশ ঘণ। ভাইয়ের চুলে সস্নেহে বিলি কাটতে কাটতে বললেন,“ভীমসেন,তুমি জানো, আমি তোমার প্রস্তাব রক্ষা করতে অপারগ। এবার বলো তো,এই ভয়ানক হাস্যকর প্রস্তাব তোমার মগজে কে ঢুকিয়েছে। ” পিছন থেকে অদ্ভূত মোহক গলায় কে যেন বলে উঠল,“আমি”। চমকে করজোড়ে উঠে দাঁড়ালেন তাপস, সম্মুখে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন,তিনি  এক অনিন্দ্যসুন্দর পুরুষ।  তাঁর গাত্রবর্ণ ঘণ নীল,মস্তকে শোভা পাচ্ছে শিখিপুচ্ছ। একজোড়া লালচে ভেজা ওষ্ঠ এবং অধরে খেলা করছে মোহন হাসি। তার রূপে আলোকিত এই বনানী। নতজানু হয়ে প্রণাম করতে গেলেন বনবাসী ইন্দ্রপ্রস্থের রাজা যুধিষ্ঠির, খপ করে তাঁকে ধরে বুকে যিনি জড়িয়ে ধরলেন, তাঁর মূল মন্ত্র বুঝি, “কোন খেলা যে খেলব কখন-”। আর নাম? তাও কি বলার অপেষ্কা রাখে? তিনি দীনবন্ধু। তিনিই জগৎপতি।

Monday 30 April 2018

কন্যা-


বিশাল রাজপ্রাসাদের সীমানা বরাবর সম্পূর্ণ আড়ম্বরহীন একতল গৃহ। ছাপোষা শয়নকক্ষ, রন্ধনশালা আর শস্ত্রাগার। এখানে পদার্পণ  করলে একথা অনুমান করা দুষ্কর হয়ে পড়ে যে, এই গৃহের অধিবাসীর দাপটে রীতিমত  কম্পমান আসমুদ্রহিমাচল।
ক্লান্ত হয়ে, মাটিতেই বসে পড়ল আগন্তুক। বড় কোমল সে, এতবছর রাজপ্রাসাদে প্রায় অসূর্যস্পর্শা হিসেবে বেড়ে ওঠা, পিতার বড় আদরের জেষ্ঠ্য কন্যা। তার এই পরিণতি বোধহয় স্বয়ং বিধাতাপুরুষও কল্পনা করতে পারেনি। শৈশব থেকেই বড় জেদী সে, হবে নাই  বা কেন? তার রূপের খ্যাতি জম্বুদ্বীপের সীমানা টপকে ছড়িয়ে পড়েছে দূরদূরান্তে। শুধুই রূপ না, সঙ্গীত, গণিত, রাজনীতি ন্যায় তথা জ্যোতিষশাস্ত্রে রীতিমত গভীর জ্ঞান অর্জন করেছে সে, নারী মাত্রই শুধু রূপের আধার, অন্তঃপুরের প্রদীপ এই তত্ত্বকে রীতিমত ঘৃণা করে সে।
কোন শৈশবে শাল্বরাজ তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্রের জন্য তার করপ্রার্থনা করে রেখেছিলেন। পিতা চাইলেই বিনা অঘটনে তার বিবাহ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু ভবিতব্য কে খণ্ডাতে পারে? তিনকন্যার জন্য বিশাল স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করলেন পিতা।দেখতে দেখতে এসে গেল শুভদিন। অথবা তার জীবনের সবথেকে অশুভ দিন। ঘোষক সাড়ম্বরে ঘোষণা করলেন, “হুঁশিয়ার! আসছেন তিন রাজবালা”। চন্দ্রের মত সুন্দর দুই কনিষ্ঠ ভগিনীর সমস্ত সাজসজ্জা ম্লান করে দিয়ে সূর্যের মত সভায় প্রবিষ্ট হল সে। হাতে সুগন্ধী বরমলা। সকলেই জানত তার হাতের মালিকা কার গলায় পড়তে চলেছে-
আচমকা তুরীভেরি বাজিয়ে রঙ্গমঞ্চে প্রবিষ্ট  হলেন এই গৃহের অধিবাসী। তপ্তকাঞ্চন বর্ণ, সুবিশাল দেহী, টানাটানা দুইচোখ যেন কোন বেদনাময় কাব্য, ওষ্ঠে খেলা করছে চরম ঔদাসীন্য। তিনি এসেই ঘোষণা করলেন, তিনকন্যাকেই তিনি তাঁদের কুলবধূ হিসাবে নিয়ে যেতে এসেছেন। ক্ষমতা থাকলে তাকে আটকে দেখাক, বাকি উপস্থিত ক্ষত্রিয়কূল।
কন্যা হতবাক হয়ে গেল তার দয়িতের কাপুরুষতায়। নূন্যতম  প্রতিবাদটুকুও করতে পারল না সে। পরম মর্যাদায় তিনকন্যাকে রথে সওয়ার হতে অনুরোধ করলেন অনুপ্রবেশকারী আর্য। নতমস্তকে রথে উঠে, অশ্রুসজল চোখে দয়িতের দিকে তাকালো কন্যা। দৃষ্টি নয়তো চাবুক,নড়ে উঠল তিনকন্যার পিতার সৈন্যদল, সদলবলে আক্রমণ করল অনুপ্রবেশকারী আর্যকে। কন্যা অবাক হয়ে গেল, একা আর্য পরাস্ত করল তার পিতা তথা হবু শ্বশুরের সৈন্যদলকে।
তিনকন্যাকে নিয়ে আর্য এসে উপনীত হলেন বিশাল রাজপ্রাসাদে। এই মুহূর্তে আর্যাবর্ত তথা জম্বুদ্বীপের সবথেকে প্রতিপত্তিশালী রাজপরিবারের পুত্রবধূ হতে চলেছে তিনকন্যা। বাকি দুই ভগিনীর আনন্দ সীমাহীন। শুধু কন্যার চোখ ছলছল। বিধবা রাজমাতা স্বয়ং এলেন তিনকন্যাকে স্বাগত জানাতে। সঙ্গে রাজকুমার। অপহরণকারী আর্যের বিমাতা এবং বৈমাত্রেয় ভাই। এই ভাইয়ের জন্যই তিনকন্যাকে তুলে এনেছেন আর্য স্বয়ম্বরসভা থেকে। পথে একটি বারও কন্যাদের দিকে চোখ তুলে তাকাননি আর্য। তীব্র বেদনার সাথে সাথে অন্তরে এক অদ্ভূত জ্বলুনি টের পাচ্ছে কন্যা। তার রূপের কাছে ম্লান দ্বিপ্রহরের সূর্য, আর তার দিকে একটি বার ফিরেও তাকালো না আর্য? অথচ নিজের বিমাতার সাথে কেমন খোশগল্প  জুড়েছেন দেখো। বিধবা রাজমাতাও অপরূপা, আর্যর সমবয়সীই হবেন। কথায় কথায় আর্যের বাহুতে হাত রাখছেন রাজমাতা, আর বুকের ভিতর তীব্র জ্বলুনি টের পাচ্ছে কন্যা।
রাজমাতার নির্দেশে তিনকন্যাকে অন্দরমহলে প্রবিষ্ট হবার বিনম্র অনুরোধ করলেন আর্য। ক্রোধে অন্ধ হয়ে গেল কন্যা, বাকি দুই ভগিনীর চোখে চোখ রেখে বললেও, তারবেলায় মাটির দিকে তাকিয়ে যন্ত্রের মত বলে গেলেন আর্য। না যাবে না কন্যা অন্দরমহলে।শাণিত ভাষায় তীব্র কণ্ঠে ঘোষণা করল কন্যা নিজের বাগদত্তা হবার সংবাদ। পলকের জন্য চমকে চোখে রাখলেন আর্য, যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠ হল কন্যা । শিউরে উঠল তনুমন। ব্যাপারটা দৃষ্টির অগোচর হল না বিধবা রাজমাতার। আপদ বিদায় করার মত করে নির্দেশ দিলেন কন্যাকে সাড়ম্বরে তার দয়িতের রাজ্যে ফেরত পাঠাতে। আর্য স্বয়ং উদ্যত হলেন তাকে পৌঁছে আসতে, কর্কশ কণ্ঠে নিষেধ করলেন রাজমাতা। “তুমি নয় দেবদত্ত। রাজগুরুর তত্ত্বাবধানে পাঠিয়ে দাও কন্যাকে। ” যথা আজ্ঞা বলে ব্যবস্থা করতে উদ্যত হলেন দেবদত্ত।
রজগুরুর অনুগামিনী হয়ে রথে উঠলেন কন্যা, দেহ বিদায় নিল কিন্তু হৃদয় পড়ে রইল আর্য দেবদত্তের চরণে। কি অবহেলায় সেই হৃদয়কে পদদলিত করলেন দেবদত্ত ভাবতেই চিড়বিড়িয়ে উঠল কন্যা। দেবদত্তের নির্দেশে তাকে গ্রহণ করতে রাজি হয়ে গেল শাল্ব রাজ্যের যুবরাজ। কিন্তু ঘৃণাভরে তাকে প্রত্যাখ্যান করল কন্যা। তার হৃদয়ে ইদানিং এক বলিষ্ঠ পুরুষের বাস। বড় বেশী বিলম্বে বুঝেছে কন্যা। দেবদত্তের প্রতি তীব্র বিরাগ আসলে গভীর প্রেমের পূর্বরাগ। বৃদ্ধ রাজগুরুর কাছে গিয়ে কেঁদে পড়ল কন্যা। মিথ্যা গল্প ফাঁদল, তার প্রাক্তণ দয়িতের নাকি সন্দেহ ইতিমধ্যেই তাকে ভোগ করেছেন দেবদত্ত। পরের আঘ্রাত পুষ্পকে রাণী বানাতে অনিচ্ছুক শাল্বরাজের জেষ্ঠ্যপুত্র।
অগত্যা দেবদত্তের কাছেই ফিরে এসেছে কন্যা । এখন মধ্যযামিনী। সদ্য রথ থেকে নেমে শালীনতার তোয়াক্কা না করে ছুটে এসেছে কণ্যা,তার আসল প্রেমের কাছে।
নিদ্রিত দেবদত্তের ওষ্ঠে মৃদু ভাবে ওষ্ঠ ছোঁয়াতেই চমকে ঘুম থেকে জেগে উঠল দেবদত্ত। সুগন্ধী মৃয়মান দ্বীপের আলোকে কন্যা যেন তিলোত্তমা। কয়েক মুহূর্তের দুর্বলতা কাটিয়ে দূরে সরে গেলেন দেবদত্ত। “কি ব্যাপার দেবী?” কন্যা বলপূর্বক লজ্জার অবগুণ্ঠন খুলে মনের ভাব সুস্পষ্ট ভাবে জানালো দেবদত্তকে। দেবদত্তের দুই চোখে আজব মুগ্ধতা তথা অসহায়তার লুকোচুরি। পদতলে বসে পা জড়িয়ে ধরল, কন্যা, নিজের সমস্ত গর্ব,অহং,মদকে বিসর্জন  দিয়ে কাতর অনুনয় করল,“অনুগ্রহ করে আমাকে গ্রহণ করুন প্রভু। ” দেবদত্তের ওষ্ঠ আর অধর ফাঁক হল কিছু বলার জন্য, ঠিক সেই মুহূর্তে পদ্মফুলের সুগন্ধে ভরে উঠল কক্ষ। সপাটে দরজা খুলে প্রবেশ করলেন রাজমাতা। বয়সে দেবদত্তের বয়সী বা একটু ছোটই হবেন। আগুন ঝরানো চোখে কন্যার দিকে তাকিয়ে, তার  কেশ আকর্ষণ করে সরিয়ে আনলেন দেবদত্তের কাছ থেকে। তীব্র বেদনায় ককিয়ে উঠল ষোড়শী কন্যা।আঁতকে উঠলেন দেবদত্ত ও। হিসহিসিয়ে বলে উঠলেন রাজমাতা,“ভুলে গেছো?তোমার প্রতিজ্ঞা?” অবনত দুই চোখে দেখা দিল অশ্রুবিন্দু, কাঁপা গলায় দেবদত্ত জানালো,“ভুলিনি মাতঃ। রাজসিংহাসনের কোন দাবী আমি কখনই করব না। শুধু অনুমতি দিন,  এই অসহায়া নারীকে আপনার অঞ্চলে একটু স্থান দিন। ”রক্তবর্ণ নয়নে চিৎকার করে উঠলেন রাজমাতা,“রাক্ষসী এসেই তোমায় হাত করে নিয়েছে-এত বছরে তোমার চোখে কখনও কারো জন্য এই মুগ্ধতা দেখিনি দেবদত্ত। শুধু আমি, আমিই ছিলাম তোমার দুই নয়নের অধিশ্বরী। প্রত্যহ তোমার নীবর প্রেমের পুষ্পে উপাসনা  হয় আমার। সেখানে কে এই অর্বাচীন বালিকা?আমার রাজ্যে, আমাদের জীবনে এর কোন স্থান নেই। মৃত্যুই এই পাপিষ্ঠার একমাত্র পরিত্রাণের উপায়। না হলে একে সৈন্যশিবিরে  ছুঁড়ে ফেলতে আমার তিলমাত্র সময় লাগবে না।” রাজমাতার পায়ে আছড়ে পড়লেন দেবদত্ত,“না। রাজমাতা না। আমি আপনার দাসানুদাস। শুধু এই বালিকাকে মুক্তি দিন। প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলাম, জীবনে এর মুখদর্শন করব না।” ঘৃণায় কুঁচকে গেল রাজমাতার মুখ। “একদর্শনেই এত প্রেম দেবদত্ত? কি আছে এর মধ্যে?” তুড়ি বাজিয়ে দেহরক্ষীদের ডাকলেন রাজমাতা, দুই ভয়াল দর্শনা নারী ঢুকে এল দেবদত্তের কুমার কুটীরে। টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগল কন্যাকে। অক্ষম বেদনায় নতমস্তকে বসে আছেন দেবদত্ত, আর সহ্য হল না কন্যার, কোন মতে হাত ছাড়িয়ে অঙ্গুরীয়তে জমিয়ে রাখা বিষের শরণাপন্ন  হতে বাধ্য হল কন্যা। পাগলের মত ছুটে এল দেবদত্ত,বিষক্রিয়ায় নীলাভ মৃত্যুপথযাত্রীনীকে বুকে আঁকড়ে ডুকরে উঠলেন হস্তিনাপুরের যুবরাজ দেবদত্ত। দয়িতের চুলে আলতো করে অঙ্গুলি সঞ্চালন করতে করতে, মৃদু স্বরে বলল কন্যা,“কেঁদো না। ফিরে আসব। তোমাকে নিয়ে যেতে। শুধু আমার নামটুকু ভুলো না- অম্বা। ”

Saturday 21 April 2018

অনির সাপ্তাহিক ডাইরি, এপ্রিল, ২০১৮

অনির সাপ্তাহিক ডাইরি ১৬-২১শে এপ্রিল, ২০১৮
এবারের সাপ্তাহিক ডাইরি আমাদের মাসিকে নিয়ে।মাসি মানে মায়ের বোন নয় কিন্তু, তেনারা সকলেই সুশিক্ষিত সুচাকুরে, স্বাধীনচেতা, অত্যন্ত প্রগতিশীল মেহনতি নারী। চুপি চুপি বলে রাখি, এই অধমের নারীবাদী হবার মূল অনুপ্রেরণা, কোথাও না কোথাও আমার মা এবং তাঁর তিন বোন।যাই হোক, এই মাসি হল, আমাদের কাজের মাসি।সেই যে, সীতা ভ্রমে যাকে অপহরণ করতে বসেছিল ভিক্ষুক রূপী রাবণ (আশা করি এই বহুল প্রচারিত জোকটি, আপনাদেরও পরিচিত), সেই মাসি। ধরে নেওয়া যাক মাসির নাম- নমিতা।
সমস্ত কাজের মাসিদের যেসব গুণাবলী থেকে থাকে, আমাদের নমিতা মাসিও তার ব্যতিক্রম নয়। যেমন ধরুন ৩১শে ডিসেম্বর মধ্যরাত্রের ঘণ্টাধ্বনি মিলিয়ে যাবার আগেই, মাসির দাবী সনদ এসে পৌঁছায়,”বওদি, মাইনেটুকুন বাড়াতে হবে কিন্তু”। যেমন ধরুন প্রতিটি মেজে যাওয়া বাসনে মাসি হস্তাক্ষর রেখে যায়,আতশকাঁচ ছাড়াও দেখতে পাবেন, হয় এঁটো লেগে আছে, নয়তো সাবান।বলতে গেলেই অস্বীকার, আর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে, গা মুচড়ে বলবে, “ বওদি, তুমিই খালি বল।“ শুধু কি তাই, মাসির কাজের সময় যদি শ্যেন দৃষ্টিতে নজর না রাখা হয়, তাহলে হয়তো মাসি, একটা ঘর ঝাঁটই দেয় না, বা জল না পাল্টে এক পুঁচকে বালতির জলে গোটা বাড়ি কাদা তকতকে করে মুছে দিয়ে পালায়। কাঁহাতক খিটিরখিটির করা যায়, আর তাছাড়া, নিরপেক্ষ ভাবে বলুন তো, কোন ওপরওয়ালা তার অধস্তন কর্মচারীকে নিয়ে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট থাকে? সুতরাং আমরা বহুদিন হাল ছেড়ে দিয়েছি, মাসিও মনের আনন্দে উত্তরোত্তর ফাঁকি মেরে যায়। তবে হ্যাঁ, মাসির নামে অসৎ হবার বদনাম, শত্রুও দিতে পারবে না, আর একটা বড় গুণ হল, মাসি ছুটি নেবার আগে জানিয়ে দেয়, এবং ঠিক যেদিন ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যায়, পৃথিবী উল্টে না গেলে, সেইদিনই মাসির প্রত্যাবর্তন ঘটে।
মাসির বাড়ি বনগাঁ, আপাতত এখানেই কোথাও বাড়ি ভাড়া করে থাকে, এক পশলা বৃষ্টিতেই মাসির ঘরে একহাঁটু জল জমে যায়। মাসে চারটে আবশ্যিক ছুটি ছাড়াও মাসি জলজমার ছুটি পায়। দিতেই হয়। মাসি বিধবা,একাই থাকে।আগে রান্নার কাজ করত, রোজগারও ভালোই হত, কিন্তু বর্তমানে শ্বেতীর প্রাবল্য বড়ই বেড়ে যাওয়ায়, আমাদের এই প্রগতিশীল ন্যুভেরিশ মহল্লায় মাসি আর রান্নার কাজ পায় না। অগত্যা ঘরমোছা-বাসনমাজা। তিনটি কন্যা, সকলেই মাসির মতে সুপাত্রস্থ।তাদের দায়ে-অদায়ে মাসি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়য়, অথচ বিগত চার বছরে, মাসির বিপদে কখনও কারোর টিকিও দেখিনি।একবার ভয়াবহ ফুড পয়জনিং-এ বেশ কিছুদিন ভোগার পর, দুর্বল শরীরে কাজে যোগ দিয়ে, কাঁদতে কাঁদতে মাসি বলেছিল, “কি করব বওদি, কাজ না কইরলে খাব কি? মুড়ি খেয়ে কাটিয়েছি বওদি চারদিন। আমার বড় মেয়ে পাশেই থাকে।এই কয়দিনে এক থালা ভাতও দিতি পারেনি জানো। রেঁধে আনতি গেছিল, ওর বর এক নাথি মেরে নর্দমায় ফেলে দিইছে।“প্রসঙ্গত মাসির বড় মেয়ে পাঁচ বাড়ি রান্না করে সংসার প্রতিপালন করে। বছর ত্রিশ পয়ত্রিশ বয়স, মাসির মতই সুরূপা, বেশ সুন্দরীই বলা চলে। আর জামাই রিক্সা টানে, তারপর চুল্লু খায়। মেয়েটির তুলনায় বেশ বয়স্ক দেখতে। বউ তার স্বীয় উপার্জন থেকে বাপের বাড়িতে কিছু দিতে গেলেই, নেশাগ্রস্ত পুরুষ সিংহ জেগে ওঠে। প্রায়ই মার খায় মেয়েটি, তবু পড়ে থাকে, “মেয়েজাত” পুরুষ অভিভাবক ছাড়া চলে নাকি?
যাই হোক, বছর খানেক আগের ঘটনা, কি কারণে সেদিন অফিস যাইনি।মাসি, এসেছে বাসন মাজতে, আচমকা মাসির ফোন বেজে উঠল, ফোন ধরে, মাসির সে কি চিৎকার, আর কান্না।আমরা দৌড়ে গেলাম, কি ব্যাপার? জুতো রাখার জায়গায় মাসি ধপ করে বসে পড়ে বুক চাপড়ে চাপড়ে কাঁদছে, “কি সব্বোনাশ হল বওদি আমার,”। যা শুনলাম, সাময়িক ভাবে আমারও গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেল, মাসির মেজোজামাই বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে। উন্মত্ত হয়ে, জামাকাপড় খুলে গোটা বাড়িতে আস্ফালন করে বেড়াচ্ছে। নতুন কেনা কালার টিভি, ফ্রীজ, কাঁচের আলমারি, বাসনকোসন সব ভেঙে চুরমার করেই ক্ষান্ত হয়নি, বউকে বেদম পিটিয়ে, বউয়ের কোল থেকে বছর ছয়েকের আতঙ্কিত শিশুকন্যাকে কেড়ে নিয়ে তুলে আছাড় মেরেছে।ঐ ভাঙচুরের মধ্যেই বাচ্ছাটা বমি এবং হিসি করে গোঙাচ্ছে, আর তার মা, পালিয়ে একটা ঘরের দরজা বন্ধ করে, আলো নিভিয়ে ফিসফিস করে তার মাকে ফোন করছে।
শুনে প্রথমেই বললাম, আগে পাড়া প্রতিবেশী বা আত্মীয়স্বজন কারো নম্বর থাকলে তাকে ফোন করে বলো ওদের উদ্ধার করতে, আর তুমি এখুনি যাও, মেয়ে আর নাতনীকে নিয়ে এস। আসার আগে, পুলিশে ডাইরি করিয়ে এসো। বড় জামাইয়ের নামেও এর আগে বহুবার থানায় জানাতে বলেছি, প্রতিবার মাসি বলে, “জামাইমানুস বওদি। অত দোষ ধইরতে নেই।তাইড়ে দিলে, বাচ্ছাকাচ্ছা নিই মেয়ে আমার যাবে কুথা? এই দেকো না, আমার বর ও তো, দা দিয়ে মারি আমার সামনের দাঁত গুলা ভেইনে দিইছিল, তাও তো তার শেষ নিশ্বাস অবধি তাইর সেবা আমিই করলাম বওদি।“ এবারে তেমন কোন জ্ঞান দেবার চেষ্টা করল না। দ্রুত হাতে মাসির ফোন ঘেঁটে, অনুরোধ মোতাবেক জনৈক প্রভাতের নাম্বার বার করে ফোনে ধরে দিলাম। শুনলাম, প্রভাত হল মেয়েটির ভাশুর। সে আশ্বাস দিল, সে দেখছে। মাসি চোখ মুছে, ফিরে গেল, এত রাতে মেয়ের বাড়ি যাওয়া অসম্ভব নাকি, সেই বনগাঁর ভিতর দিকে কোন আধা গ্রাম, তাই কাল সকালেই মাসি যাবে।
ছুটি এবং কিছু নগদ দিয়ে যাকে আগের রাতে বিদায় করলাম, পরদিন দেখি সে কাজে হাজির। যাওনি? মাসি বাসন মাজতে মাজতে বিষাদ মাখা কেজো সুরে বলল, “কি কওরবো বলো বওদি, আমার কি কম জ্বালা? পভাত জেতি নিষেধ কইরল যে।“ কে প্রভাত? ও মেয়ের ভাশুর? তা তার এত সাহস হয় কি করে? আর তুমিই বা তার কথা শুনে গেলে না কেন? মেয়ে আর বাচ্ছাটাকে যদি পাগলটা খুন করে?” কি কওরবো বল বওদি, পভাতের কাছে আমার অনেক টাকার দেনা আছি, বুঝেছো। সেবার বন্যায় আমাদের দ্যাশের বাড়ি ধবসি গেল, তারপর বরের চিকিচ্ছা, মেইয়েদের বিয়ে, খেপে খেপে প্রায় চল্লিশ হাজার টাকার মত ধার এখনও শোধা বাকি। পভাত টাকা দিছিল এই শর্তে, যে ওর পাগল ভাইয়ের সাথে আমার বড় মেয়ের বিইয়ে দিতি হইবে।“ মানে? তুমি আগে থেকে জানতে পাগল? “ হ্যাঁ গো। এমনই ভালো ছেলে, বিএ- এমএ পাশ। অঙ্কের ছাত্রর পড়ায়। তবে মাথা বেগড়ি গেলেই এমন করে। পভাত তো নিজেও বড় অপিসার। বেরামপুরে থাকে।“ মানে? বহরমপুর থেকে সে বলল, সে দেখছে, বনগাঁয় কিভাবে সব ম্যানেজ করবে, আর তুমি গেলে না? “ হ্যাঁ বওদি, কাল সারা রাত শুধু কেইন্দেছি। আমার বড় মেয়েটা ঠিকই করছিল, যে পালিয়ে গিয়ে রিক্সাওলাকে বিয়ে করল। তখন পভাত বলল, তাহলে মেজোটার সাথে দিয়ে দাও। মেয়ে আমার বিয়ে করতে চায়নি বওদি। জামাইকে তো দেখতেও কুচ্ছিত।বুড়ো হাবড়া, সব চুল পেকি গেছে। এট্টাও দাঁত নেই। মেয়েটার আমার সবে ২৪ পুরোবে।“
তবে আবার কি? ফিরিয়ে নিয়ে এস। দেনার দায়ে, যে পাপ করেছ, প্রায়শ্চিত্ত কর। মাসির সেই এক কথা, আনলে খাবে কি? ভালো করে বোঝালাম,গতরে খেটে খাবে, তোমার মত। তোমার মাটির এক কামরার ঘরে ভাগাভাগি করে থাকবে, নিরাপদ তো থাকবে অন্তত। মাসি নিমরাজি হয়ে গেল, দিন চারেক বাদে একগাল হেসে ফিরে এল।“পভাত সব ঠিক করে দিয়েছে বওদি। নতুন টিভি, আলমারি কিনি দিইয়েছে,ওদের সংসার তো পভাতই টানে।“ আর পাগলাটা? “ও এখন ঠিক আছে।“ মেয়েকে আনলে না? “মেয়ে আসতে চাইল না বওদি। বলল, এরা আমার জীবন বরবাদ কইরছে, এত সহজে ছেড়ে দেব নাকি? পভাতকে বলেছে আমাকে বিয়ে করতে হবে তোমাকে।“ বাঃ। মধুরেন সমাপয়েতঃ। তা তোমার পভাত কি বলেছে? জবাব পেলাম, প্রভাত বলেছে, ভেবে পরে জানাবে। আপাতত, ভাইকে সামলে, লক্ষ্মী মেয়ের মত ঘরকন্যা করতে। কিন্তু প্রভাত তো ঐ বুড়োটার দাদা, অনেক বড় না, তোমার মেয়ের থেকে? মাসি, দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল, “পুরুষমানসের আবার বয়স আর চরিত্তির।“
কিছুদিন পর শুনলাম প্রভাত নাকি ভেবে চিন্তে জানিয়েছে, এই মুহূর্তে বিয়ে করতে অপারগ।আরো ভাই আছে, তাদের সংসারও প্রভাতকেই টানতে হয়, কাজেই- তবে সামনেই অবসর নেবার দিন আসছে, তখন ভেবে দেখবে। আপাতত কন্যা পাগলের সাথেই ঘরকন্যা করুক।
মাস ছয়েক আগে শুনলাম, মেয়েটি আসন্নপ্রসবা, মাসির লম্বা ছুটি চাই। শালীনতার সীমা অতিক্রম না করেই জানতে চাইলাম, এটা বৈবাহিক ধর্ষণের পরিণাম নয়তো? মাসি এমন হাঁ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, যে বেশ বুঝলাম বৈবাহিক ধর্ষণ শব্দবন্ধটি মাসির একেবারেই অপরিচিত। চারটি রসকদম্ব নিয়ে ফিরে এল মাসি, নাতি হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার মাসি আবার ছুটির দরখাস্ত পেশ করল, নাতির মুখে ভাত। প্রভাত, বিশাল ধূমধাম করে অন্নপ্রাশন করছে ভাইপোর, সারা গ্রাম নিমন্ত্রিত। সোনার চেন দিয়ে মুখ দেখেছে, মাসি কি দেবে তাই নিয়ে মাসি ভয়ানক উদ্বিগ্ন ছিল, আংটি, জামা ইত্যাদি কেনার টাকাও প্রভাতই দিয়েছে।সম্ভবত ধার, মাসি নিজেও জানে না এখনও, সময়মত বলবে প্রভাত। দিলাম ছুটি, সবাই দিয়েছে। কাজ সেরে মাসি চলে যাচ্ছে, দরজা বন্ধ করতে গিয়ে শুনলাম মাসির ফোন বাজছে, মাসি ফোন ধরে উল্লসিত স্বরে বলছে, “কি গো পভাত? তোমার ছেলি কি কইরছে অ্যাঁ?খেলছে? হে হে হে......” ।

Thursday 15 March 2018

আবোল তাবোল১৫/০৩/১৮


খুব ইচ্ছে করে, একদিন এমনি,রোজকার মত নাকে মুখে গুঁজে, দৌড়তে দৌড়তে ভিড় বাসে উঠে, ছুটতে ছুটতে জনা দুয়েক লোককে গোঁত্তা মেরে উল্টোডাঙা ফুট ব্রীজে উঠব- তারপর নামবে প্রকাণ্ড আলস্য। বিশাল হাই তুলে, সেঁটিয়ে দাঁড়াব রেলিং  এর সাথে। পিছনে ছুটে আসা,গোঁত্তা মারতে উদ্যত নিত্যযাত্রীটিকে ইশারায় বলব,“যা না ভাই। যা। এগিয়ে যা। ” আমার আজ আর জাস্ট যেতে ইচ্ছা করছে না। ফুটব্রীজের ওপর থেকে হাঁ করে দেখব, ধুলোমাখা মহানগরের ব্যস্ত জনজীবন। কেমন দৌড়চ্ছে সবাই দেখ-। শুধু দৌড়েই যাচ্ছে, আমার আজ কোথাও যাবার নেই, আমার আজ কিচ্ছু করার নেই। গুটগুট করে নেমে একটা ফাঁকা বাস ধরে,সোজ্-জা বাড়ি। চেনা কলিং বেলের আওয়াজে,তুত্তুরী যখন দরজা খুলবে- চিৎকার করে বলব“সারপ্রাইজ”। আজ শুধু মা আর মেয়ের দিন। বন্ধ কর-কলিংবেল আর মোবাইল ফোনের প্যাঁ পোঁ।

ভীষণ ইচ্ছে করে একদিন,নৈহাটী স্টেশনে নেমে আর লঞ্চ ঘাটের দিকে উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়ব না। বরং উল্টোদিকে দৌড়ে আবার উঠে পড়ব, শিয়ালদহ মুখী ফিরতি ট্রেনে। ভালো দেখে জানলার ধারে বসে, এক ঠোঙা খোলা শুদ্ধ বাদাম ভাজা কুটকুট করে খাব, আর তাজ্জব হয়ে দেখব অফিস টাইমের ব্যস্ততা। অত্যন্ত শ্লথগতিতে দৌড়াবে মস্তিষ্কের ঘোড়াগুলো- এতসব ছুটছে কোথায়?

খুব ইচ্ছে করে,একদিন দৌড়তে দৌড়তে লঞ্চঘাটে পৌঁছাব,কিন্তু লঞ্চে উঠব না। উন্মুক্ত জেটির ওপর খোলা আকাশের নীচে রৌদ্রস্নান করব, সামনে দিয়ে নূপুর পরে টুকটুক করে বয়ে যাবে ভরা জোয়ারের নদী। নদীর তো কোন ব্যস্ততা নেই। তাহলে সে যাচ্ছে কোথায়?দিনান্তে সবাই ঘরে ফেরে,তুই কেন ফিরিস না নদী? আহা তোর জন্য বুঝি কেউ উন্মুখ হয়ে নেই?অথবা আছে,তুই জানিস না। ফিরে যা নদী। একবার অন্তত ফিরে গিয়েই দেখ না-

খুব ইচ্ছে করে,একদিন,সাড়ে এগারোটায় ঢুকে সাড়ে বারোটায় জবাব পাঠাবার আব্দার নিয়ে আসা ইমেলের জবাবে , একটা প্রকাণ্ড জিভ কাটা, এক চোখ বন্ধ ইমোজী পাঠাতে। অ্যাল্
 
খুব ইচ্ছে করে,একদিন, চেয়ারটাকে পিছনে হেলিয়ে, টেবলের ওপর জোড়া পা তুলে চিৎকার করে গাইতে,“ আমি আজ হেড অফিসে পাঠাব না ফ্যাক্স------”।
একটাই ভয় যদি জুজু ফোন তোলে---