Monday 30 April 2018

কন্যা-


বিশাল রাজপ্রাসাদের সীমানা বরাবর সম্পূর্ণ আড়ম্বরহীন একতল গৃহ। ছাপোষা শয়নকক্ষ, রন্ধনশালা আর শস্ত্রাগার। এখানে পদার্পণ  করলে একথা অনুমান করা দুষ্কর হয়ে পড়ে যে, এই গৃহের অধিবাসীর দাপটে রীতিমত  কম্পমান আসমুদ্রহিমাচল।
ক্লান্ত হয়ে, মাটিতেই বসে পড়ল আগন্তুক। বড় কোমল সে, এতবছর রাজপ্রাসাদে প্রায় অসূর্যস্পর্শা হিসেবে বেড়ে ওঠা, পিতার বড় আদরের জেষ্ঠ্য কন্যা। তার এই পরিণতি বোধহয় স্বয়ং বিধাতাপুরুষও কল্পনা করতে পারেনি। শৈশব থেকেই বড় জেদী সে, হবে নাই  বা কেন? তার রূপের খ্যাতি জম্বুদ্বীপের সীমানা টপকে ছড়িয়ে পড়েছে দূরদূরান্তে। শুধুই রূপ না, সঙ্গীত, গণিত, রাজনীতি ন্যায় তথা জ্যোতিষশাস্ত্রে রীতিমত গভীর জ্ঞান অর্জন করেছে সে, নারী মাত্রই শুধু রূপের আধার, অন্তঃপুরের প্রদীপ এই তত্ত্বকে রীতিমত ঘৃণা করে সে।
কোন শৈশবে শাল্বরাজ তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্রের জন্য তার করপ্রার্থনা করে রেখেছিলেন। পিতা চাইলেই বিনা অঘটনে তার বিবাহ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু ভবিতব্য কে খণ্ডাতে পারে? তিনকন্যার জন্য বিশাল স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করলেন পিতা।দেখতে দেখতে এসে গেল শুভদিন। অথবা তার জীবনের সবথেকে অশুভ দিন। ঘোষক সাড়ম্বরে ঘোষণা করলেন, “হুঁশিয়ার! আসছেন তিন রাজবালা”। চন্দ্রের মত সুন্দর দুই কনিষ্ঠ ভগিনীর সমস্ত সাজসজ্জা ম্লান করে দিয়ে সূর্যের মত সভায় প্রবিষ্ট হল সে। হাতে সুগন্ধী বরমলা। সকলেই জানত তার হাতের মালিকা কার গলায় পড়তে চলেছে-
আচমকা তুরীভেরি বাজিয়ে রঙ্গমঞ্চে প্রবিষ্ট  হলেন এই গৃহের অধিবাসী। তপ্তকাঞ্চন বর্ণ, সুবিশাল দেহী, টানাটানা দুইচোখ যেন কোন বেদনাময় কাব্য, ওষ্ঠে খেলা করছে চরম ঔদাসীন্য। তিনি এসেই ঘোষণা করলেন, তিনকন্যাকেই তিনি তাঁদের কুলবধূ হিসাবে নিয়ে যেতে এসেছেন। ক্ষমতা থাকলে তাকে আটকে দেখাক, বাকি উপস্থিত ক্ষত্রিয়কূল।
কন্যা হতবাক হয়ে গেল তার দয়িতের কাপুরুষতায়। নূন্যতম  প্রতিবাদটুকুও করতে পারল না সে। পরম মর্যাদায় তিনকন্যাকে রথে সওয়ার হতে অনুরোধ করলেন অনুপ্রবেশকারী আর্য। নতমস্তকে রথে উঠে, অশ্রুসজল চোখে দয়িতের দিকে তাকালো কন্যা। দৃষ্টি নয়তো চাবুক,নড়ে উঠল তিনকন্যার পিতার সৈন্যদল, সদলবলে আক্রমণ করল অনুপ্রবেশকারী আর্যকে। কন্যা অবাক হয়ে গেল, একা আর্য পরাস্ত করল তার পিতা তথা হবু শ্বশুরের সৈন্যদলকে।
তিনকন্যাকে নিয়ে আর্য এসে উপনীত হলেন বিশাল রাজপ্রাসাদে। এই মুহূর্তে আর্যাবর্ত তথা জম্বুদ্বীপের সবথেকে প্রতিপত্তিশালী রাজপরিবারের পুত্রবধূ হতে চলেছে তিনকন্যা। বাকি দুই ভগিনীর আনন্দ সীমাহীন। শুধু কন্যার চোখ ছলছল। বিধবা রাজমাতা স্বয়ং এলেন তিনকন্যাকে স্বাগত জানাতে। সঙ্গে রাজকুমার। অপহরণকারী আর্যের বিমাতা এবং বৈমাত্রেয় ভাই। এই ভাইয়ের জন্যই তিনকন্যাকে তুলে এনেছেন আর্য স্বয়ম্বরসভা থেকে। পথে একটি বারও কন্যাদের দিকে চোখ তুলে তাকাননি আর্য। তীব্র বেদনার সাথে সাথে অন্তরে এক অদ্ভূত জ্বলুনি টের পাচ্ছে কন্যা। তার রূপের কাছে ম্লান দ্বিপ্রহরের সূর্য, আর তার দিকে একটি বার ফিরেও তাকালো না আর্য? অথচ নিজের বিমাতার সাথে কেমন খোশগল্প  জুড়েছেন দেখো। বিধবা রাজমাতাও অপরূপা, আর্যর সমবয়সীই হবেন। কথায় কথায় আর্যের বাহুতে হাত রাখছেন রাজমাতা, আর বুকের ভিতর তীব্র জ্বলুনি টের পাচ্ছে কন্যা।
রাজমাতার নির্দেশে তিনকন্যাকে অন্দরমহলে প্রবিষ্ট হবার বিনম্র অনুরোধ করলেন আর্য। ক্রোধে অন্ধ হয়ে গেল কন্যা, বাকি দুই ভগিনীর চোখে চোখ রেখে বললেও, তারবেলায় মাটির দিকে তাকিয়ে যন্ত্রের মত বলে গেলেন আর্য। না যাবে না কন্যা অন্দরমহলে।শাণিত ভাষায় তীব্র কণ্ঠে ঘোষণা করল কন্যা নিজের বাগদত্তা হবার সংবাদ। পলকের জন্য চমকে চোখে রাখলেন আর্য, যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠ হল কন্যা । শিউরে উঠল তনুমন। ব্যাপারটা দৃষ্টির অগোচর হল না বিধবা রাজমাতার। আপদ বিদায় করার মত করে নির্দেশ দিলেন কন্যাকে সাড়ম্বরে তার দয়িতের রাজ্যে ফেরত পাঠাতে। আর্য স্বয়ং উদ্যত হলেন তাকে পৌঁছে আসতে, কর্কশ কণ্ঠে নিষেধ করলেন রাজমাতা। “তুমি নয় দেবদত্ত। রাজগুরুর তত্ত্বাবধানে পাঠিয়ে দাও কন্যাকে। ” যথা আজ্ঞা বলে ব্যবস্থা করতে উদ্যত হলেন দেবদত্ত।
রজগুরুর অনুগামিনী হয়ে রথে উঠলেন কন্যা, দেহ বিদায় নিল কিন্তু হৃদয় পড়ে রইল আর্য দেবদত্তের চরণে। কি অবহেলায় সেই হৃদয়কে পদদলিত করলেন দেবদত্ত ভাবতেই চিড়বিড়িয়ে উঠল কন্যা। দেবদত্তের নির্দেশে তাকে গ্রহণ করতে রাজি হয়ে গেল শাল্ব রাজ্যের যুবরাজ। কিন্তু ঘৃণাভরে তাকে প্রত্যাখ্যান করল কন্যা। তার হৃদয়ে ইদানিং এক বলিষ্ঠ পুরুষের বাস। বড় বেশী বিলম্বে বুঝেছে কন্যা। দেবদত্তের প্রতি তীব্র বিরাগ আসলে গভীর প্রেমের পূর্বরাগ। বৃদ্ধ রাজগুরুর কাছে গিয়ে কেঁদে পড়ল কন্যা। মিথ্যা গল্প ফাঁদল, তার প্রাক্তণ দয়িতের নাকি সন্দেহ ইতিমধ্যেই তাকে ভোগ করেছেন দেবদত্ত। পরের আঘ্রাত পুষ্পকে রাণী বানাতে অনিচ্ছুক শাল্বরাজের জেষ্ঠ্যপুত্র।
অগত্যা দেবদত্তের কাছেই ফিরে এসেছে কন্যা । এখন মধ্যযামিনী। সদ্য রথ থেকে নেমে শালীনতার তোয়াক্কা না করে ছুটে এসেছে কণ্যা,তার আসল প্রেমের কাছে।
নিদ্রিত দেবদত্তের ওষ্ঠে মৃদু ভাবে ওষ্ঠ ছোঁয়াতেই চমকে ঘুম থেকে জেগে উঠল দেবদত্ত। সুগন্ধী মৃয়মান দ্বীপের আলোকে কন্যা যেন তিলোত্তমা। কয়েক মুহূর্তের দুর্বলতা কাটিয়ে দূরে সরে গেলেন দেবদত্ত। “কি ব্যাপার দেবী?” কন্যা বলপূর্বক লজ্জার অবগুণ্ঠন খুলে মনের ভাব সুস্পষ্ট ভাবে জানালো দেবদত্তকে। দেবদত্তের দুই চোখে আজব মুগ্ধতা তথা অসহায়তার লুকোচুরি। পদতলে বসে পা জড়িয়ে ধরল, কন্যা, নিজের সমস্ত গর্ব,অহং,মদকে বিসর্জন  দিয়ে কাতর অনুনয় করল,“অনুগ্রহ করে আমাকে গ্রহণ করুন প্রভু। ” দেবদত্তের ওষ্ঠ আর অধর ফাঁক হল কিছু বলার জন্য, ঠিক সেই মুহূর্তে পদ্মফুলের সুগন্ধে ভরে উঠল কক্ষ। সপাটে দরজা খুলে প্রবেশ করলেন রাজমাতা। বয়সে দেবদত্তের বয়সী বা একটু ছোটই হবেন। আগুন ঝরানো চোখে কন্যার দিকে তাকিয়ে, তার  কেশ আকর্ষণ করে সরিয়ে আনলেন দেবদত্তের কাছ থেকে। তীব্র বেদনায় ককিয়ে উঠল ষোড়শী কন্যা।আঁতকে উঠলেন দেবদত্ত ও। হিসহিসিয়ে বলে উঠলেন রাজমাতা,“ভুলে গেছো?তোমার প্রতিজ্ঞা?” অবনত দুই চোখে দেখা দিল অশ্রুবিন্দু, কাঁপা গলায় দেবদত্ত জানালো,“ভুলিনি মাতঃ। রাজসিংহাসনের কোন দাবী আমি কখনই করব না। শুধু অনুমতি দিন,  এই অসহায়া নারীকে আপনার অঞ্চলে একটু স্থান দিন। ”রক্তবর্ণ নয়নে চিৎকার করে উঠলেন রাজমাতা,“রাক্ষসী এসেই তোমায় হাত করে নিয়েছে-এত বছরে তোমার চোখে কখনও কারো জন্য এই মুগ্ধতা দেখিনি দেবদত্ত। শুধু আমি, আমিই ছিলাম তোমার দুই নয়নের অধিশ্বরী। প্রত্যহ তোমার নীবর প্রেমের পুষ্পে উপাসনা  হয় আমার। সেখানে কে এই অর্বাচীন বালিকা?আমার রাজ্যে, আমাদের জীবনে এর কোন স্থান নেই। মৃত্যুই এই পাপিষ্ঠার একমাত্র পরিত্রাণের উপায়। না হলে একে সৈন্যশিবিরে  ছুঁড়ে ফেলতে আমার তিলমাত্র সময় লাগবে না।” রাজমাতার পায়ে আছড়ে পড়লেন দেবদত্ত,“না। রাজমাতা না। আমি আপনার দাসানুদাস। শুধু এই বালিকাকে মুক্তি দিন। প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলাম, জীবনে এর মুখদর্শন করব না।” ঘৃণায় কুঁচকে গেল রাজমাতার মুখ। “একদর্শনেই এত প্রেম দেবদত্ত? কি আছে এর মধ্যে?” তুড়ি বাজিয়ে দেহরক্ষীদের ডাকলেন রাজমাতা, দুই ভয়াল দর্শনা নারী ঢুকে এল দেবদত্তের কুমার কুটীরে। টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগল কন্যাকে। অক্ষম বেদনায় নতমস্তকে বসে আছেন দেবদত্ত, আর সহ্য হল না কন্যার, কোন মতে হাত ছাড়িয়ে অঙ্গুরীয়তে জমিয়ে রাখা বিষের শরণাপন্ন  হতে বাধ্য হল কন্যা। পাগলের মত ছুটে এল দেবদত্ত,বিষক্রিয়ায় নীলাভ মৃত্যুপথযাত্রীনীকে বুকে আঁকড়ে ডুকরে উঠলেন হস্তিনাপুরের যুবরাজ দেবদত্ত। দয়িতের চুলে আলতো করে অঙ্গুলি সঞ্চালন করতে করতে, মৃদু স্বরে বলল কন্যা,“কেঁদো না। ফিরে আসব। তোমাকে নিয়ে যেতে। শুধু আমার নামটুকু ভুলো না- অম্বা। ”

No comments:

Post a Comment