Thursday 3 May 2018

প্রাণস্বরূপিনী-


সুনিবিড় বনানীর মর্মস্থলে লুক্কায়িত এক পুষ্পদ্যান। প্রাথমিক দর্শনে ভ্রম হওয়া অস্বাভাবিক নহে, দেব যন্ত্রবিদ্ বিশ্বকর্মা অথবা দানবকূলশ্রেষ্ঠ ময় স্বয়ং স্বহস্তে  নির্মাণ করেছেন এই উদ্যানের। আপাততঃ উদ্যানের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এক সুবিশাল বট বৃক্ষতলে গভীর আলাপচারিতায় মগ্ন দুই সুবেশ যুবক। যুবক ঠিক নয়, যৌবন অস্তাচলে গমন করতে উদ্যত হয়েছে কিন্তু যেতে পারেনি। দুই একটি শ্বেত কেশ বা শ্মশ্রু রাজিই তার একমাত্র প্রমাণ, অন্যথা দুই যুবকই অনুপম সৌন্দর্যের অধীশ্বর। ঋজু দীর্ঘ দেহে বলিষ্ঠ পেশীদের আঁকিবুকি, উন্নত নাসা, গভীর আঁখি, ঘণ আঁখিপল্লব। শুধু একজনের গাত্রবর্ণ দুধে আলতা অপরজনের নবজলধরশ্যাম। শ্যামল যুবকের দুই চোখে মাখামাখি আজব দুষ্টুমি, শ্বেতাঙ্গ যুবকের দুই আঁখি যেন বেদনার কবিতা।
বৃক্ষতলে ভগ্নপ্রায় বেদীর উপর কিছুটা উচ্চ আসনে আসীন শ্যামল যুবক, তার পদতলে নতমুখে আসীন শ্বেতাঙ্গ যুবক। শ্যামল যুবক তাকে কিছু বোঝাবার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, অপরজনও বুঝতে চায়, কিন্তু বিশ্বাসঘাতক হৃদয় বারবার ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে। অবশেষে সস্নেহে শ্বেতাঙ্গ যুবককে বুকে আঁকড়ে ধরলেন শ্যামল যুবক। আলিঙ্গনাবদ্ধ  অবস্থায় কেটে গেল বেশ অনেকটা সময়, শ্বেতাঙ্গ যুবক কিছুক্ষণ ফুঁপিয়ে গুমরে অশ্রু বিসর্জন করলেন, তারপর  ধীরে ধীরে মেনে নিলেন শ্যামল যুবার বক্তব্য।
ঘণ বনানীর ভিতর থেকে কয়েকজোড়া বিষাক্ত  চোখ এতক্ষণ পর্যবেক্ষণ করছিল দুজনারে। এবার ডালপালা সরিয়ে বেরিয়ে এল তারা। সকলের অগ্রভাগে যিনি, তিনিও যথেষ্ট রূপবান,শুধু দুই চোখে ধিকিধিকি জ্বলছে ঈর্ষার সবুজ আগুন। সঙ্গী যুবকও ততোধিক রূপবান, তার দুই চোখে তীব্র ব্যঙ্গ।  আলিঙ্গনাবদ্ধ  দুই যুবক ওণাদের পদস্পর্শে সচকিত হয়ে তাকিয়ে আগত যুবকদের দ্রুত প্রীতি সম্ভাষণ জানালো।
শ্যামল এবং গৌর উভয় যুবাই ঈষৎ  নত হয়ে করজোড়ে বলে উঠলেন,“প্রণাম মহরাজ। ” মহারাজ অর্থাৎ যাঁর দুই চোখে খেলে বিষ, যিনি বিদ্রুপের সুরে তাঁর সঙ্গে আগত সঙ্গী যুবকের দিকে তাকিয়ে বললেন,“অঙ্গরাজ, ঠিক কতদিনের বন্ধুত্ব আমাদের?” অঙ্গরাজ বিদ্রুপাত্মক স্বরে বললেন,“মনে নেই সখা। সেই যে হস্তিনাপুরে শস্ত্র প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়েছিল, সে হল অনেক কাল। তোমরা তখন সদ্য শস্ত্রচালনা শিখেছ। তৃতীয় পার্থর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে রাজ্যজুড়ে। আমারও কানে এল বটে, ভাবলেম, আমিও পরশুরামের শিষ্য বটে, যিনি না জানি কতবার ক্ষত্রিয়শূণ্য করছেন এ ধরা, তাঁর সুশিষ্য হয়ে একবার দেখাই যাক না, কত বড় ধনুর্ধর এই তৃতীয় পার্থ। ” মহারাজ হো হো করে হেসে বলে উঠলেন, “তা কি দেখলে হে? কতবড় বীর কৌন্তেয়?” অঙ্গরাজ জিহ্বা ভর্তি বিষ নিয়ে উচ্চারণ করলেন,“উফ্ মস্ত বড় বীর বটে। আমার সাথে লড়লেনই না। আমি সূতপুত্র কি না। তবু ভালো আমার অঙ্গুলি গুলি অবিকৃত আছে, শোনা যায় এক নিষাদ পুত্রকে তো-। ”।  মহারাজ আবার অট্টহাস্য করে বললেন,“আসলে ভয় পায় । ভয়। সখা। আমি তৎক্ষণাৎ তোমায় অঙ্গরাজ্যের অধীশ্বর রূপে স্বীকৃতি দিয়েছিলাম। তাও-”। দুই সখার অট্টহাস্যে উড়ে গেল বটে আশ্রয় নেওয়া পাখির দল। শ্বেতাঙ্গ যুবক অর্থাৎ তৃতীয় পার্থ নীরব এবং অবনতমস্তক রইলেন, কোন প্রত্যুত্তর না পেয়ে মহারাজ দুর্যোধন আবার শুরু করলেন,“তা সখা এত বৎসরে কতবার তোমায় এভাবে আলিঙ্গন করেছি আমি?” ছলছল চোখে পার্থ তাকালেন উপহাসরত দুই প্রতিপক্ষের দিকে। হ্যাঁ প্রতিপক্ষই তো। আগামী কাল প্রভাতে শুরু হতে চলেছে এক চিলতে রাজসিংহাসনের অধিকার দিয়ে কুরু পাণ্ডব যুদ্ধ। উভয় পক্ষের সব আয়োজন পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছে। পড়ন্ত বিকালে নিজ শিবিরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে যুযুধান প্রতিপক্ষের নেতৃবর্গকে দেখে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত তৃতীয় পার্থ। এরা কারা?এদের বিরুদ্ধে ধারণ করতে হবে শস্ত্র? পিতামহ ভীষ্ম যাঁর কোলে চেপে কেটেছে শৈশব?গুরু দ্রোণ? যাঁকে পিতৃ অধিক শ্রদ্ধা করেন পার্থ,ভালোবাসেন।ভ্রাতা দুর্যোধন? বিকর্ণ? যাদের সাথে পিঠোপিঠি খুনসুটি করে কেটেছে শৈশব? জয়দ্রথ? একমাত্র ভগিনী দুঃশলার স্বামী? মাতুল শল্য? না অসম্ভব। একমাত্র অঙ্গরাজ কর্ণ ব্যতিরেকে এঁদের কারো বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ অসম্ভব। কর্ণকে মারতে অবশ্য হাত কাঁপবে না পার্থর।
যাই হোক পার্থর এই চিত্তবৈকল্য প্রত্যক্ষ করেই সখা কৃষ্ণ তাকে টেনে এনেছে কুরুক্ষেত্র প্রান্তর থেকে বহুদূর এই বনানীর অভ্যন্তরে। পাপাচারী দুর্যোধন নির্ঘাত চর মারফৎ খবর পেয়ে পশ্চাৎধাবন করেছে। একাকী এসেছে না সৈন্যদল সমেত? যুদ্ধ শুরুর প্রারম্ভেই যদি ঘায়েল করা যায় কৃষ্ণ আর অর্জুনকে, বাকি পাণ্ডবদের পরাস্ত করা এক পলকের ব্যাপার। হতাশায়, বেদনায় চিন্তাশক্তিহীন হয়ে পড়ল।

অর্জুনকে খুব একটা পাত্তাও দিলেন না মহারাজ দুর্যোধন। সজোরে করতালি  বাজাতেই, অরণ্যের গাছপালা সরিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল শয়ে শয়ে সুসজ্জিত  যোদ্ধা। পলকে ঘিরে ফেলল কৃষ্ণার্জুনকে। অক্ষম ক্রোধে গুমরে উঠল অর্জুন, গাণ্ডীব!সাধের গাণ্ডীবকে হেলায় ফেলে এসেছেন শিবিরে। আচমকা ঘিরে ধরা সৈন্যরা দুভাগ হয়ে গেল, জঙ্গলের রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হলেন, এক সুদেহী পুরুষ,  তামাটে গাত্রবর্ণ, পেশীবহুল শরীর।  কাঁধ পর্যন্ত কেশরাজি, পুষ্প মালিকা সহযোগে চুড়া করে বাঁধা। মস্তকে সুবর্ণ মুকুটে শোভা পাচ্ছে শিখি পুচ্ছ। চন্দন চর্চিত দেহ সুবাসে পরিপূর্ণ। কোমরবন্ধনীতে আটকে আছে একটি ধাতব চক্র। একহস্তে ভারী গদা, অপর হস্তে একটি সদ্য উৎপাটিত রক্তকমল এবং শঙ্খ। সহসা শ্রী বিষ্ণু বলে ভ্রম হওয়া দুষ্কর নয়। তিনি বাসুদেবের উদ্দেশ্য কটু মন্তব্য করে বললেন,“ঐ ধূর্ত বাসুদেব, শুনি তুই নাকি নিজেকে স্বয়ং বিষ্ণুর অবতার বলে দাবী করিস?” শ্রীকৃষ্ণের পক্ষে হাসি চেপে রাখা ক্রমেই দুষ্কর হয়ে উঠছিল, তাও দাঁতে দাঁত চেপে তিনি কইলেন,“এমন দুর্মতি আমার কেন হবে আর্য?” আর্য শুনেই সেই ব্যক্তি পুনরায় দন্ত কিড়মিড়িয়ে বললেন,“আর্য? আমি কোন সাধারণ আর্য নহি, আমি হলাম বঙ্গ-কিরাত-পৌণ্ড্রের অধিপতি পৌণ্ড্রক। আমি স্বয়ং শ্রীবিষ্ণু। দুর্যোধনের পরম সুহৃদ।” অট্টহাস্যে ফেটে পড়লেন পার্থ এবং পার্থসারথী উভয়ই। ছদ্ম ভক্তিতে ডগমগ হয়ে উভয়ে প্রণাম করলেন, “প্রণাম শ্রীবিষ্ণু!“ দুর্যোধন ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বলে উঠলেন,“ আরেঃ বাসুদেব,তোর সাহস হয় কি করে,আমার পরম সুহৃদের অবমাননা করিস?তুই কে? মথুরারাজ কংসের মামুলী ভৃত্য। কৌশলে প্রভুকে হত্যা করে তার রাজপাট দখল করতে গিয়েছিলি। এত ধূর্ত তুই যে সিংহাসনে স্বয়ং বা অধিস্থান করে, পুতুলরাজা বসালি? জরাসন্ধের ভয়ে যুদ্ধ ছেড়ে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে এলি দ্বারকা,।  ধিক্। ধিক্। শত ধিক্ তোরে। ক্ষত্রিয় কূলের কলঙ্ক। রমণীমোহন, প্রেমলীলায় পারদর্শী, নারীদের ও অধম তুই। নিজেকে শ্রীবিষ্ণুর অবতার বলে দাবী করিস তুই? থুঃ। ”
শ্রীকৃষ্ণের ওষ্ঠে এবং অধরে তখনও খেলা করছে পড়ন্ত কমলা রোদের মত এক চিলতে নির্মল হাসি। সখা মানহানির  প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠলেন পার্থ। কি কুৎসিত  ভাষায়ই না তাকে অসম্মান করল দুর্যোধন এবং কর্ণ। দেবী কুন্তীর ক্ষেত্রজ পুত্রকে পিতৃপরিচয় তথা বাকি ভাইদের সাথে দ্রৌপদীকে ভাগ করে নেওয়া, বৃহণ্ণলা সেজে উত্তরের সঙ্গলিপ্সার মত হীন কটুক্তি শুনতে হল। তখনও নীরব কেশব। ক্রোধে ফুঁসছে পার্থ।
পৌণ্ড্রক নাটুকে ভঙ্গীতে বলতে লাগলেন,“শুধু কি তাই? আপনি কি জানেন মহারাজ, কেশবের একটি রক্ষিতা আছে।” পলকে কঠিন হয়ে গেল কেশবের দৃষ্টি। দুর্যোধন এবং কর্ণ উল্লসিত  হয়ে জানতে চাইল, “কে? নির্ঘাত কোন বহুভোগ্যা নারী?”  উত্তরে মিচকে হেঁসে পৌণ্ড্রক বলল,“ না জানি নে বাপু। গোকুলে বসবাসের দিনগুলিতে দুইজনের প্রেম তথা রমনের গল্প পোষা গবাদি  পশুগুলির মুখে মুখে ফিরত। সে নারী কিন্তু বিবাহিতা ছিলেন। ”
“স্তব্ধ হও মূর্খ। ” গর্জে উঠলেন কেশব। কেঁপে উঠল ধরিত্রী। “ তাঁর সম্পর্কে একটি কুবাক্য উচ্চারণ করলে জিহ্বা উৎপাটিত করব। ” পৌণ্ড্রক কর্ণপাত না করে বলে চলল,“আমি সম্প্রতি তাকে খুঁজে বার করেছি। এই মহাশয়, গোকুল ত্যাগ করার পর একটি বারও তার তত্ত্বতল্লাশ পর্যন্ত করেনি জানেন? সেদিন হতে নাকি সেই নারী মূক এবং বধির হয়ে কোন মতে স্বামীর অন্নে প্রতিপালিত হচ্ছে। কি অপরূপ রূপসী সে নারী কি কইব মহারাজ। কেশব বধের অন্তে আমিই হব তার নতুন কেশব। ঐ নারী দেবভোগ্যা।  নাম -”। কথা শেষ করতে পারল না,  পৌণ্ড্রকের কাটা মুণ্ড গড়িয়ে এল কেশবের রক্তিম চরণতলে। ঘুরন্ত সুদর্শন চক্র থেকে ছুটছে আগুনের ফুলকি।আগুন ঝরানো  স্বরে কেশব বলে উঠলেন,“মূঢ় মতি । তোদের এত দুঃসাহস, আমার প্রাণস্বরূপিনীকে নিয়ে কুৎসা রটাস? কোন অষ্টাদশ দিন ব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের প্রয়োজন নেই, আমি এই মুহূর্তে ধ্বংস করব কুরু বংশ এবং তাদের অনুগামী সকলকে। ” কেশবের রূপ দেখে আতঙ্কিত হয়ে দৌড়োদৌড়ি শুরু করে দিল দুর্যোধনের সৈন্যদল। সহসা ঘোর কৃষ্ণবর্ণ মেঘ ঢেকে দিল, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ঠিক আগের দিনের সূর্য। লকলকে জিহ্বা বার করে ছুটে এলেন পবন এবং অগ্নিদেব। জঙ্গলে লেগে গেল দাবানল, সমুদ্রে বাড়্বানল। প্রবল ভূকম্পে কেঁপে উঠল মেদিনী। সমগ্র বিশ্ববাসী ত্রাহি মধুসূদন ডাক ছাড়ল। কেশবের ঐ ভয়ানক রূপ দর্শন করে কাপুরুষের মত দৌড়ে পালাতে লাগলেন কুরুরাজ এবং অঙ্গরাজ। সুদর্শনকে পুনরায় অঙ্গুলিতে ধারণ করলেন কেশব, এমন সময় তাঁর চরণতলে আছড়ে পড়লেন তৃতীয় পার্থ,“তিষ্ঠ প্রভু। তিষ্ঠ। ” একাগ্র চিত্তে সমস্ত উপাসনা করতে লাগলেন তাঁর চিরসখার, সুগভীর সখ্যতার আবডালে যাঁকে প্রাণাধিক ভালোবাসেন পার্থ। দরদর করে দুই চোখ দিয়ে ঝরে পড়তে লাগল অশ্রুকণা।
কতক্ষণ সময় এইভাবে কেটেছে পার্থ জানেন না, আচমকা একজোড়া উষ্ণ হাতের স্নেহস্পর্শে চোখ খুললেন তিনি। সম্মুখে কেশব। সেই চিরপরিচিত সদাহাস্যপরায়ণ  কেশব। “চল সখা। ”  বিনা বাক্যব্যয়ে উঠে পড়লেন পার্থ। কিছুই মনে পড়ছে না। এতক্ষণ তাঁরা জঙ্গলে কি করছিলেন?কেশবও নীরব। রথে উঠলেন পার্থ, আসন গ্রহণ করলেন পার্থসারথী। রথ ছাড়ার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে জানতে চাইলেন,“কোন সংশয় নেই তো সখা?” পার্থ অবাক হয়ে বললেন,“নাঃ। কিসের সংশয় সখা?” নিরুত্তর রইলেন কেশব। ছুটল চতুঃঅশ্বের রথ, পার্থ শুধু অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন তাঁর বাল্যসখার দুই আঁখি টলটলায়মান, মাঝে মাঝে ঝরে পড়ছে মুক্তার মত দু একটি অশ্রুকণা।

Wednesday 2 May 2018

কোন এক দিন -

কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে অনাম্নী স্রোতোস্বিনী। বইছে মৃদুমন্দ পবন। ঘণ বনানীর মাঝে এক বিশাল পিপ্পলী বৃক্ষতলে ধ্যানমগ্ন জনৈক তাপস। পরণে শ্বেতবস্ত্র, উর্ধ্বাঙ্গে পীতাভ উত্তরীয়, উভয়ই অতি সাধারণ। অসাধারণ শুধু তাঁর দীপ্তি। অপরূপ রূপময় তাপসের মুখমণ্ডলে খেলা করে চলেছে অদ্ভূত প্রশান্তি, ইনি যে অত্যন্ত অভিজাত বংশীয় অসীম জ্ঞানের অধিকারী তা এঁণার মুখমণ্ডল তথা দেহবিভঙ্গে সুস্পষ্ট। যদিও চোখের নীচের মৃদু কালিমা একথা লুকাতে অক্ষম যে আপাততঃ ইনি কিঞ্চিৎ  কায়ক্লেশে আছেন। স্বীয় ক্লেশকে অদ্যাবধি বিন্দুমাত্র  গুরুত্ব দেননি উনি, কিন্তু প্রিয়জনের বেদনায় বড় দ্রুত কাতর হয়ে পড়েন আজকাল। বিশেষতঃ সেই প্রাণাধিকা নারী, যাঁর যাবতীয় কায়ক্লেশের মূল হোতা এই দুর্ভাগা তাপস, এমনকি তাঁরই অবিমৃষ্যকারিতার জন্য জনসমক্ষে আর্যকন্যাকে বিবস্ত্র হতে হয়েছে, যতবারই সেই দৃশ্যাবলী চোখের সামনে ভেসে ওঠে কেঁপে ওঠেন তাপস। ছিঃ।  ছিঃ। যে পুরুষ নিজের স্ত্রীর মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, কি প্রয়োজন তার প্রাণধারণে?
এই যে রাজনন্দিনী সর্ব বিলাস ত্যাগ করে তাঁর অনুগামিনী হয়ে এই গভীর জঙ্গলে বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন, এর জন্য দায়ী কে? কোনদিন শিকার জোটে, কোনদিন নিকটস্থ জনপদ থেকে জোটে ভিক্ষালব্ধ কয়েকমুঠি যব, কোনদিন শুধুই বনের ফল আর কোনদিন শুধুই শীতল জলে নৈশাহার সমাধা করেন তাঁরা। কতদিন প্রিয়ার মুখে হাসি দেখেননি তিনি। মাটির কুঁড়ে ঘরকে সহস্তে নিকিয়ে কি অপরূপ বিন্যাসে সাজিয়ে রাখেন প্রিয়া, প্রিয়ার হাতের মায়াজালে সামান্য যবও যেন পরিণত হয় দেবভোগ্য অমৃতে। এত গুণের অধিশ্বরীর এই পরিণতি কেন? সুদূর মাতুলালয়ে সযতনে থাকা নিজ শিশুপুত্রদের স্মরণ করে প্রায় প্রতিটি রজনীই নিঃশব্দ অশ্রুমোচনে যাপন করেন আর্যা। ভাবেন তাপস বুঝি উপলব্ধি করতে অক্ষম, অথচ বিগত একবছরে এক পলের জন্যও তিনি বিস্মৃত হননি তাদের। তাঁর জন্যই পাঁচটি দুগ্ধপোষ্য শিশুকে পিতৃমাতৃহীন হয়ে মাতুলালয়ে কাটাতে হবে আরো দ্বাদশ বর্ষ, ভাবতেই সিক্ত হয়ে উঠল আঁখিপল্লব।

আত্মবিস্মৃত হয়েছিলেন তাপস,আচমকা কিঞ্চিৎ অসহিষ্ণু অথচ বজ্রগম্ভীর কণ্ঠস্বরে কে যেন ডেকে উঠল,“ মহারাজ!মহারাজ? আপনি কি সংজ্ঞা হারিয়েছেন?”  অন্য কেউ এই সম্বোধন  করলে তাপস ভাবতেন নির্ঘাত ব্যঙ্গ, কিন্তু তাঁর এই বিশালদেহী ভ্রাতাটি যে আদৌ ব্যঙ্গ নয়,বরং পরম শ্রদ্ধা তথা ভালোবাসায় তাঁকে এই চরম দুর্দিনেও মহারাজ বলে ডাকেন, তা তাপসের অনবগত নয়। মৃদু হেসে বললেন,“নাঃ। সামান্য ধ্যানের প্রচেষ্টা। ”
তাঁর এই ভ্রাতাটি অন্যান্য ভাইদের তুলনায় দর্শন বা বুদ্ধিবৃত্তিতে বেশ সাধারণ। তবে অমিত বলশালী এবং শিশুর মতই সরল। সুখের দিনে প্রজারা আড়ালে বলতেন এই রাজকুমার শুধুমাত্র “দাদা আর গদা” ছাড়া কিছুই বোঝেন না। কথাটা মিথ্যা নয়। ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভূত হওয়া সত্ত্বেও ইনি গদা ছাড়া অন্যান্য কোন শস্ত্রচালনাতেই তেমন দক্ষ নন। রাজনীতি, কূটনীতির জটিলতাও তেমন বোঝেন না।রাজপাট ত্যাগ করে বনবাস কালে ইনি ব্যাপক অশান্তি করেন শিশুদের মত। না রাজকীয় ভোগবিলাসে তেমন যে আসক্তি আছে তা নয়, তবে ইনি বড় জলদি ক্ষুধাকাতর হয়ে পড়েন। ইতিপূর্বে কিয়ৎকাল বনবাসের অভিজ্ঞতা থেকে ভালই জানতেন যে জঙ্গলে অর্ধেক দিবস অভুক্ত  থাকতে হয়, তাই কিছুতেই এযাত্রা বনবাসে আসতে আগ্রহী ছিলেন না। শেষে তাপস ক্রুদ্ধ হয়ে, এই ভ্রাতাকে ত্যাগ করেই সপরিবারে বনবাস যাত্রা করেন। বেশ কিছুটা পথ গিয়ে পিছন ফিরে দেখেন, শিশুর মত মাটিতে পা ঘষতে ঘষতে তাঁদের অনুসরণ করছেন মধ্যমকুমার।
শুধু কি তাই, বনবাসে এসে সকলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শিকার এবং ভিক্ষাবৃত্তি সম্পন্ন করেন, কিন্তু এণাকে শিকারে পাঠালেও বিপদ ভিক্ষাবৃত্তিতে নিযুক্ত করলেও বিপদ।শিকারে গেলে বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও অনাবশ্যক বেশী জীবজন্তু বধ করে নিয়ে আসেন  কুমার। যাতে সকলের পেট ভরে যাওয়ার পর অবশিষ্টাংশ তাঁর উদরপূর্তিতে যেতে পারে। আর ভিক্ষা করতে গিয়ে একমুঠি যব প্রদান করা গৃহস্থের দিকে এমন কটমট করে তাকান যে তাঁরা প্রাণভয়ে ভাঁড়ার উপুড়হস্ত করে দেন। খবর আসতে বিলম্ব হয়নি তাপসের কানে। ফলে আপাততঃ শিকার এবং ভিক্ষা দুই নিষেধ।
সারাদিন বাতাসে গদাযুদ্ধ আর গৃহিণীকে গৃহকর্মে সহায়তা করেই দিন কাটে তাপসের। রাতে সকলের পাতে যখন একমুঠি যবের মণ্ড তুলে দেন প্রিয়া, শিশুর মত হস্ত এবং পাত্র লেহন করেন মধ্যম কুমার। মাটিতে পড়ে থাকা গুঁড়াও অঙ্গুলি স্পর্শে তুলে নিয়ে মুখে দেন। তাপস জানেন প্রিয়া তথা অন্যান্য কুমারেরা তাঁদের অংশ থেকেও কিছুটা সস্নেহে তুলে দেয় মধ্যমকুমারের পাত্রে। দেন তিনিও, এক চুটকি উদ্বৃত্ত   যবের মণ্ড পেয়ে কুমারের দুই চোখ চিকচিকিয়ে ওঠে। নিভৃতে বিড়বিড় করেন তাপস,“যাঁদের জন্য তোমায় এই জঠরাগ্নি সহন করতে হচ্ছে, ইন্দ্রের বজ্র নেমে আসুক তাদের মাথায়। ”
“মহারাজ?” আবার অসহিষ্ণু হয়ে প্রশ্ন করলেন মধ্যম কুমার
“কি ভ্রাতা?”সস্নেহে জানতে চাইলেন তাপস।
“মহারাজ,চলুন ফিরে যাই। আমাদের রাজ্যে। ফিরিয়ে আনি আমাদের শিশুগুলিকে। আবার পাটরাণী হয়ে রাজপ্রাসাদ আলো করে বসুন আর্যকন্যা। ”
“ভ্রাতা,তুমি কি বিস্মৃত হয়েছ?বারো বছর এই বনভূমিই আমাদের রাজপাট,ঐ মৃৎকুটির আমাদের রাজপ্রাসাদ। তারপর,এই বনভূমি ত্যাগ করে আমাদের আশ্রয় নিতে হবে কোন সম্পূর্ণ অচেনা অনাত্মীয় গৃহে।লুকিয়ে রাখতে হবে নিজেদের ছদ্মবেশ তথা ছদ্মপরিচয়ের অবগুণ্ঠনে।  যেখানে আমাদের কেউ না চিনতে পারে। যদি ধরা পড়ে যাই,তো আরো বারো বছরের বনবাস সুনিশ্চিত। ”
এক ঝলক আগুন চলকে উঠল কুমারের দুইচোখে,পর মুহূর্তেই তার স্থান অধিকার করল একরাশ সরলতা। দুষ্টু হাসি হেসে কুমার বললেন,“জানি ভ্রাতাঃ। জানি। তাই তো এক সুপ্রস্তাব এনেছি। দেখুন কৃষক যেমন স্বল্প বীজবপন করে, আহরণ করে বিপুল পরিমাণ শস্য,বুদ্ধিমান ব্যক্তি যেমন বিপদে অল্প ধর্ম বিসর্জন দেন বৃহত্তর ধর্মরক্ষার স্বার্থে, সোমলতার প্রতিনিধি যেমন পূতিকা,তেমনি বৎসরের প্রতিনিধি মাস। চলুন আমরা এই জঙ্গলে অতিবাহিত তের মাসকেই গণ্য করে তের বৎসর হিসাবে। ব্যাস হয়ে গেল আমাদের বারো বৎসরের বনবাস আর এক বৎসর অজ্ঞাতবাস। দেখুন এই অন্তিম এক মাসে তো কোন কৌরব বংশীয় চর আমাদের সন্ধানে আসেনি, তো এই একমাস অজ্ঞাতবাস হল কি না?”
কুমারের কুযুক্তিতে হো হো করে হেঁসে উঠলেন তাপস। সেই অট্টহাসের শব্দে আতঙ্কিত হয়ে উড়ে গেল পিপ্পলী-বৃক্ষের শাখাপ্রশাখায় আয়েস রত জনা কয়েক বায়স। রীতিমত আহত চক্ষে মধ্যমকুমার বললেন,“জানতেম। জানতেম আপনি মানবেন না। তাই আরো একটি উত্তম প্রস্তাব আছে। একটা ভালো ধর্মের ষণ্ড জোগাড় করে, তাকে ভরপেট খাইয়ে, হস্তপদ মর্দন করে যথাবিহিত সেবা করে, তাকে প্রীত করতে পারলেই সব পাপক্ষলন হয়ে যাবে। আমি একটা ষণ্ড জুটিয়েও এনেছি। আবডালে রাখা আছে। মহানন্দে ঘাস চিবোচ্ছে। এবার আপনিও মেনে নিন ভ্রাতা। এযাতনা আমার যাও সহ্য হয়, প্রিয়া বা কনিষ্ঠ ভ্রাতাদের কষ্টে বুক ফেটে যায় আমার। ”
স্নেহের ভ্রাতাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ  করলেন তাপস, এই কুমারের শ্মশ্রুগুম্ফের বৃদ্ধি বড়ই স্বল্প, নেই বললেই চলে, অঙ্গরাজ তো জনসমক্ষে  তাঁর এই স্নেহের ভ্রাতাটিকে পেটুক এবং তূবরক(মাকুন্দ) বলে গালি দিতেন। কেশরাজি অবশ্য খুব একটা কম না,বরং বেশ ঘণ। ভাইয়ের চুলে সস্নেহে বিলি কাটতে কাটতে বললেন,“ভীমসেন,তুমি জানো, আমি তোমার প্রস্তাব রক্ষা করতে অপারগ। এবার বলো তো,এই ভয়ানক হাস্যকর প্রস্তাব তোমার মগজে কে ঢুকিয়েছে। ” পিছন থেকে অদ্ভূত মোহক গলায় কে যেন বলে উঠল,“আমি”। চমকে করজোড়ে উঠে দাঁড়ালেন তাপস, সম্মুখে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন,তিনি  এক অনিন্দ্যসুন্দর পুরুষ।  তাঁর গাত্রবর্ণ ঘণ নীল,মস্তকে শোভা পাচ্ছে শিখিপুচ্ছ। একজোড়া লালচে ভেজা ওষ্ঠ এবং অধরে খেলা করছে মোহন হাসি। তার রূপে আলোকিত এই বনানী। নতজানু হয়ে প্রণাম করতে গেলেন বনবাসী ইন্দ্রপ্রস্থের রাজা যুধিষ্ঠির, খপ করে তাঁকে ধরে বুকে যিনি জড়িয়ে ধরলেন, তাঁর মূল মন্ত্র বুঝি, “কোন খেলা যে খেলব কখন-”। আর নাম? তাও কি বলার অপেষ্কা রাখে? তিনি দীনবন্ধু। তিনিই জগৎপতি।

Monday 30 April 2018

কন্যা-


বিশাল রাজপ্রাসাদের সীমানা বরাবর সম্পূর্ণ আড়ম্বরহীন একতল গৃহ। ছাপোষা শয়নকক্ষ, রন্ধনশালা আর শস্ত্রাগার। এখানে পদার্পণ  করলে একথা অনুমান করা দুষ্কর হয়ে পড়ে যে, এই গৃহের অধিবাসীর দাপটে রীতিমত  কম্পমান আসমুদ্রহিমাচল।
ক্লান্ত হয়ে, মাটিতেই বসে পড়ল আগন্তুক। বড় কোমল সে, এতবছর রাজপ্রাসাদে প্রায় অসূর্যস্পর্শা হিসেবে বেড়ে ওঠা, পিতার বড় আদরের জেষ্ঠ্য কন্যা। তার এই পরিণতি বোধহয় স্বয়ং বিধাতাপুরুষও কল্পনা করতে পারেনি। শৈশব থেকেই বড় জেদী সে, হবে নাই  বা কেন? তার রূপের খ্যাতি জম্বুদ্বীপের সীমানা টপকে ছড়িয়ে পড়েছে দূরদূরান্তে। শুধুই রূপ না, সঙ্গীত, গণিত, রাজনীতি ন্যায় তথা জ্যোতিষশাস্ত্রে রীতিমত গভীর জ্ঞান অর্জন করেছে সে, নারী মাত্রই শুধু রূপের আধার, অন্তঃপুরের প্রদীপ এই তত্ত্বকে রীতিমত ঘৃণা করে সে।
কোন শৈশবে শাল্বরাজ তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্রের জন্য তার করপ্রার্থনা করে রেখেছিলেন। পিতা চাইলেই বিনা অঘটনে তার বিবাহ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু ভবিতব্য কে খণ্ডাতে পারে? তিনকন্যার জন্য বিশাল স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করলেন পিতা।দেখতে দেখতে এসে গেল শুভদিন। অথবা তার জীবনের সবথেকে অশুভ দিন। ঘোষক সাড়ম্বরে ঘোষণা করলেন, “হুঁশিয়ার! আসছেন তিন রাজবালা”। চন্দ্রের মত সুন্দর দুই কনিষ্ঠ ভগিনীর সমস্ত সাজসজ্জা ম্লান করে দিয়ে সূর্যের মত সভায় প্রবিষ্ট হল সে। হাতে সুগন্ধী বরমলা। সকলেই জানত তার হাতের মালিকা কার গলায় পড়তে চলেছে-
আচমকা তুরীভেরি বাজিয়ে রঙ্গমঞ্চে প্রবিষ্ট  হলেন এই গৃহের অধিবাসী। তপ্তকাঞ্চন বর্ণ, সুবিশাল দেহী, টানাটানা দুইচোখ যেন কোন বেদনাময় কাব্য, ওষ্ঠে খেলা করছে চরম ঔদাসীন্য। তিনি এসেই ঘোষণা করলেন, তিনকন্যাকেই তিনি তাঁদের কুলবধূ হিসাবে নিয়ে যেতে এসেছেন। ক্ষমতা থাকলে তাকে আটকে দেখাক, বাকি উপস্থিত ক্ষত্রিয়কূল।
কন্যা হতবাক হয়ে গেল তার দয়িতের কাপুরুষতায়। নূন্যতম  প্রতিবাদটুকুও করতে পারল না সে। পরম মর্যাদায় তিনকন্যাকে রথে সওয়ার হতে অনুরোধ করলেন অনুপ্রবেশকারী আর্য। নতমস্তকে রথে উঠে, অশ্রুসজল চোখে দয়িতের দিকে তাকালো কন্যা। দৃষ্টি নয়তো চাবুক,নড়ে উঠল তিনকন্যার পিতার সৈন্যদল, সদলবলে আক্রমণ করল অনুপ্রবেশকারী আর্যকে। কন্যা অবাক হয়ে গেল, একা আর্য পরাস্ত করল তার পিতা তথা হবু শ্বশুরের সৈন্যদলকে।
তিনকন্যাকে নিয়ে আর্য এসে উপনীত হলেন বিশাল রাজপ্রাসাদে। এই মুহূর্তে আর্যাবর্ত তথা জম্বুদ্বীপের সবথেকে প্রতিপত্তিশালী রাজপরিবারের পুত্রবধূ হতে চলেছে তিনকন্যা। বাকি দুই ভগিনীর আনন্দ সীমাহীন। শুধু কন্যার চোখ ছলছল। বিধবা রাজমাতা স্বয়ং এলেন তিনকন্যাকে স্বাগত জানাতে। সঙ্গে রাজকুমার। অপহরণকারী আর্যের বিমাতা এবং বৈমাত্রেয় ভাই। এই ভাইয়ের জন্যই তিনকন্যাকে তুলে এনেছেন আর্য স্বয়ম্বরসভা থেকে। পথে একটি বারও কন্যাদের দিকে চোখ তুলে তাকাননি আর্য। তীব্র বেদনার সাথে সাথে অন্তরে এক অদ্ভূত জ্বলুনি টের পাচ্ছে কন্যা। তার রূপের কাছে ম্লান দ্বিপ্রহরের সূর্য, আর তার দিকে একটি বার ফিরেও তাকালো না আর্য? অথচ নিজের বিমাতার সাথে কেমন খোশগল্প  জুড়েছেন দেখো। বিধবা রাজমাতাও অপরূপা, আর্যর সমবয়সীই হবেন। কথায় কথায় আর্যের বাহুতে হাত রাখছেন রাজমাতা, আর বুকের ভিতর তীব্র জ্বলুনি টের পাচ্ছে কন্যা।
রাজমাতার নির্দেশে তিনকন্যাকে অন্দরমহলে প্রবিষ্ট হবার বিনম্র অনুরোধ করলেন আর্য। ক্রোধে অন্ধ হয়ে গেল কন্যা, বাকি দুই ভগিনীর চোখে চোখ রেখে বললেও, তারবেলায় মাটির দিকে তাকিয়ে যন্ত্রের মত বলে গেলেন আর্য। না যাবে না কন্যা অন্দরমহলে।শাণিত ভাষায় তীব্র কণ্ঠে ঘোষণা করল কন্যা নিজের বাগদত্তা হবার সংবাদ। পলকের জন্য চমকে চোখে রাখলেন আর্য, যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠ হল কন্যা । শিউরে উঠল তনুমন। ব্যাপারটা দৃষ্টির অগোচর হল না বিধবা রাজমাতার। আপদ বিদায় করার মত করে নির্দেশ দিলেন কন্যাকে সাড়ম্বরে তার দয়িতের রাজ্যে ফেরত পাঠাতে। আর্য স্বয়ং উদ্যত হলেন তাকে পৌঁছে আসতে, কর্কশ কণ্ঠে নিষেধ করলেন রাজমাতা। “তুমি নয় দেবদত্ত। রাজগুরুর তত্ত্বাবধানে পাঠিয়ে দাও কন্যাকে। ” যথা আজ্ঞা বলে ব্যবস্থা করতে উদ্যত হলেন দেবদত্ত।
রজগুরুর অনুগামিনী হয়ে রথে উঠলেন কন্যা, দেহ বিদায় নিল কিন্তু হৃদয় পড়ে রইল আর্য দেবদত্তের চরণে। কি অবহেলায় সেই হৃদয়কে পদদলিত করলেন দেবদত্ত ভাবতেই চিড়বিড়িয়ে উঠল কন্যা। দেবদত্তের নির্দেশে তাকে গ্রহণ করতে রাজি হয়ে গেল শাল্ব রাজ্যের যুবরাজ। কিন্তু ঘৃণাভরে তাকে প্রত্যাখ্যান করল কন্যা। তার হৃদয়ে ইদানিং এক বলিষ্ঠ পুরুষের বাস। বড় বেশী বিলম্বে বুঝেছে কন্যা। দেবদত্তের প্রতি তীব্র বিরাগ আসলে গভীর প্রেমের পূর্বরাগ। বৃদ্ধ রাজগুরুর কাছে গিয়ে কেঁদে পড়ল কন্যা। মিথ্যা গল্প ফাঁদল, তার প্রাক্তণ দয়িতের নাকি সন্দেহ ইতিমধ্যেই তাকে ভোগ করেছেন দেবদত্ত। পরের আঘ্রাত পুষ্পকে রাণী বানাতে অনিচ্ছুক শাল্বরাজের জেষ্ঠ্যপুত্র।
অগত্যা দেবদত্তের কাছেই ফিরে এসেছে কন্যা । এখন মধ্যযামিনী। সদ্য রথ থেকে নেমে শালীনতার তোয়াক্কা না করে ছুটে এসেছে কণ্যা,তার আসল প্রেমের কাছে।
নিদ্রিত দেবদত্তের ওষ্ঠে মৃদু ভাবে ওষ্ঠ ছোঁয়াতেই চমকে ঘুম থেকে জেগে উঠল দেবদত্ত। সুগন্ধী মৃয়মান দ্বীপের আলোকে কন্যা যেন তিলোত্তমা। কয়েক মুহূর্তের দুর্বলতা কাটিয়ে দূরে সরে গেলেন দেবদত্ত। “কি ব্যাপার দেবী?” কন্যা বলপূর্বক লজ্জার অবগুণ্ঠন খুলে মনের ভাব সুস্পষ্ট ভাবে জানালো দেবদত্তকে। দেবদত্তের দুই চোখে আজব মুগ্ধতা তথা অসহায়তার লুকোচুরি। পদতলে বসে পা জড়িয়ে ধরল, কন্যা, নিজের সমস্ত গর্ব,অহং,মদকে বিসর্জন  দিয়ে কাতর অনুনয় করল,“অনুগ্রহ করে আমাকে গ্রহণ করুন প্রভু। ” দেবদত্তের ওষ্ঠ আর অধর ফাঁক হল কিছু বলার জন্য, ঠিক সেই মুহূর্তে পদ্মফুলের সুগন্ধে ভরে উঠল কক্ষ। সপাটে দরজা খুলে প্রবেশ করলেন রাজমাতা। বয়সে দেবদত্তের বয়সী বা একটু ছোটই হবেন। আগুন ঝরানো চোখে কন্যার দিকে তাকিয়ে, তার  কেশ আকর্ষণ করে সরিয়ে আনলেন দেবদত্তের কাছ থেকে। তীব্র বেদনায় ককিয়ে উঠল ষোড়শী কন্যা।আঁতকে উঠলেন দেবদত্ত ও। হিসহিসিয়ে বলে উঠলেন রাজমাতা,“ভুলে গেছো?তোমার প্রতিজ্ঞা?” অবনত দুই চোখে দেখা দিল অশ্রুবিন্দু, কাঁপা গলায় দেবদত্ত জানালো,“ভুলিনি মাতঃ। রাজসিংহাসনের কোন দাবী আমি কখনই করব না। শুধু অনুমতি দিন,  এই অসহায়া নারীকে আপনার অঞ্চলে একটু স্থান দিন। ”রক্তবর্ণ নয়নে চিৎকার করে উঠলেন রাজমাতা,“রাক্ষসী এসেই তোমায় হাত করে নিয়েছে-এত বছরে তোমার চোখে কখনও কারো জন্য এই মুগ্ধতা দেখিনি দেবদত্ত। শুধু আমি, আমিই ছিলাম তোমার দুই নয়নের অধিশ্বরী। প্রত্যহ তোমার নীবর প্রেমের পুষ্পে উপাসনা  হয় আমার। সেখানে কে এই অর্বাচীন বালিকা?আমার রাজ্যে, আমাদের জীবনে এর কোন স্থান নেই। মৃত্যুই এই পাপিষ্ঠার একমাত্র পরিত্রাণের উপায়। না হলে একে সৈন্যশিবিরে  ছুঁড়ে ফেলতে আমার তিলমাত্র সময় লাগবে না।” রাজমাতার পায়ে আছড়ে পড়লেন দেবদত্ত,“না। রাজমাতা না। আমি আপনার দাসানুদাস। শুধু এই বালিকাকে মুক্তি দিন। প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলাম, জীবনে এর মুখদর্শন করব না।” ঘৃণায় কুঁচকে গেল রাজমাতার মুখ। “একদর্শনেই এত প্রেম দেবদত্ত? কি আছে এর মধ্যে?” তুড়ি বাজিয়ে দেহরক্ষীদের ডাকলেন রাজমাতা, দুই ভয়াল দর্শনা নারী ঢুকে এল দেবদত্তের কুমার কুটীরে। টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগল কন্যাকে। অক্ষম বেদনায় নতমস্তকে বসে আছেন দেবদত্ত, আর সহ্য হল না কন্যার, কোন মতে হাত ছাড়িয়ে অঙ্গুরীয়তে জমিয়ে রাখা বিষের শরণাপন্ন  হতে বাধ্য হল কন্যা। পাগলের মত ছুটে এল দেবদত্ত,বিষক্রিয়ায় নীলাভ মৃত্যুপথযাত্রীনীকে বুকে আঁকড়ে ডুকরে উঠলেন হস্তিনাপুরের যুবরাজ দেবদত্ত। দয়িতের চুলে আলতো করে অঙ্গুলি সঞ্চালন করতে করতে, মৃদু স্বরে বলল কন্যা,“কেঁদো না। ফিরে আসব। তোমাকে নিয়ে যেতে। শুধু আমার নামটুকু ভুলো না- অম্বা। ”