Friday 5 July 2024

অনির ডাইরি জুলাই, ২০২৪

অনির ডাইরি ২৬শে জুলাই, ২০২৪ 

#অনিরডাইরি 


যদি শুধান জীবনের সংজ্ঞা কি, তো আমি বলব, "life is a journey, from one celebration to another." অন্তত আমার কাছে তো তাই। মাথার মধ্যে সবসময় গুণগুণ করে হরেক রকম পরিকল্পনা। যেমন ধরুন,  আমাদের বিবাহবার্ষিকীর পরদিন থেকেই আমি মশগুল হয়ে পড়ি শ্রীমতী তুত্তুরীর জন্মদিনের আকাঙ্ক্ষায়। মনে মনে চলে হাজার হিসেব নিকেশ। কি দেব মেয়েটাকে, কি রাঁধব মেয়েটার জন্মদিনে ইত্যাদি প্রভৃতি। আর সেলিব্রেশনের ব্যাপারে মুকেশ আম্বানিই আমার আদর্শ। আহা, হতেই পারে উনি শশধর আর আমি মামুলী শশক, তাই বলে কি শখ থাকবে না, নাকি।


আমাজন থেকে প্রথম উপহারটা যখন এল, তখনও জন্মদিন আসতে এক মাসেরও বেশি দেরী। বেশ অনেক দিন ধরে দেখে শুনে, রিভিউ পড়ে অর্ডার করলাম। একটু সাধ্যের বাইরেই হয়ে গেল বুঝি। আচ্ছা কুরিয়রওয়ালা যদি আপন মনে করে নিয়ে নেয়! কি হবে? এই ভেবে তিন চার রাত ঘুমই এল না আমার। নির্দিষ্ট দিনে কুরিয়রের ছেলেটা যখন ফোন করে বলল, " ওটিপি-টা বলুন ম্যাডাম। প্যাকেজটা বাংলোর সিকিউরিটিকে দিয়ে দিয়েছি-" বিশ্বাসই হল না যেন। যতক্ষণ না সিকিউরিটি ছেলেটি ফোন ধরে আশ্বস্ত করল। বাড়ি ফিরে ভয়ে ভয়ে প্যাকেট খুলে তবে শান্তি। শ্রীমতী  তুত্তুরীর নাকের ডগা দিয়ে ওর জন্মদিনের উপহার আলমারিতে তুলে রাখলাম আমি। তিনি জানতেও পারলেন না, যে এবারের পার্সেলটা তাঁর জন্য এসেছে, আমার না।


দ্বিতীয় উপহারের বেলায় অবশ্য তাঁকে বোকা বানানো গেল না। আমি অফিস থেকে ফেরার সাথে সাথেই তিনি আমার পিছন পিছন নেচে নেচে ঘুরতে লাগলেন। " মা আজ যে পার্সেলটা এসেছে না, ওতে কি আছে? কেমন যেন নরম নরম লাগল।" চালে ভুল করলাম, যখন বললাম, " আমি জানি না। বাবা কিছু অর্ডার দিয়েছে হয়তো।" তিনি বললেন, " উঁহু, প্যাকেটে তোমার নাম লেখা।" সে যাত্রা অবশ্য উদ্ধার করেছিল শৌভিকই, বলেছিল ওতে হ্যান্ড টাওয়েল আছে। " তোর জন্মদিনে আমরা বাথরুমে নতুন হ্যান্ড টাওয়েল ঝোলাব।"


দেখতে দেখতে এসেই গেল দিনটা। আগের দিন সকালে লিস্ট করে ধরিয়ে দিলাম বাংলোয় বাজার করে যে ছেলেটি তাকে। দুটো রেড ভেলভেট পেস্ট্রি আনবে। মোমবাতি একেবারে আনবে না। কি শখে যে আফগানি সেন্টেড ক্যান্ডেল গুলো কিনেছিলাম, লেখা ছিল জ্বাললেই হৃদয়ে তুফান উঠবে। আদতে দেখলাম জ্বালালেই আমার বরের হাঁচি শুরু হয়ে যায়। ওরই মধ্যে একটা জ্বালিয়ে দেব ক্ষণ। বললাম বেলুন আনবে একটু বেশি করে। আমার আধবুড়ি মেয়ে এখনও বেলুন দেখে গলে যায়। 


আনবে তো সই, কিন্তু তাঁর নজর এড়িয়ে ফোলাবে কে? ঘর সাজানোই বা হবে কি করে? তিনি জেনে গেলে তো আর সারপ্রাইজ থাকবে না  ব্যাপারটা। অগত্যা আগের দিন সকালে বসে বসে প্রচুর হোমওয়ার্ক দিলাম। তলায় গোটা গোটা করে লিখে দিলাম, সাড়ে নটার মধ্যে শেষ না করলে, কেটেই ফেলব। যতক্ষণ না হোমওয়ার্ক শেষ হচ্ছে, ঘর থেকে বেরোবি না। 


অফিস থেকে ফিরে, কোন মতে এক কাপ কফি খেয়ে, বাইরের ঘরের দরজায় আগল দিয়ে, পর্দা টেনে নামলাম বেলুন ফোলাতে। জীবনে হ্যাপি বার্থডে লেখা বেলুন ফোলাইনি, সে যে কি ঝঞ্ঝাট।  রাতের রান্না করে যে ছেলেটি স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই সাহায্য করতে এল,  তাই না সাড়ে নটার মধ্যে শেষ হল ব্যাপারটা। ইতিমধ্যে যে কতবার দরজা খটখট করে গেছে তুত্তুরী তার ইয়োত্তা নেই। প্রবেশের অনুমতি কিছুতেই মেলেনি। হয়ে যাবার পরও বাইরে থেকে দরজায় ছিটকানি আটকে রাখলাম। অর্থাৎ শ্রীমতী তুত্তুরীর প্রবেশ নিষেধ (আপাতত)। 


দেখতে দেখতে এসে গেল মধ্যরাত। তখনও গ্যাসে ফুটছে পায়েস, ভাপা দইয়ের জল আর কিছুতেই মরছে না। সারাদিনের পরিশ্রমে বেঁকে যেতে চাইছে পিঠ আর কোমর। তবে ওই যে বললাম মুকেশ জীই আমার আদর্শ। তাঁকে স্মরণ করে, টেবিলের ওপর সাজিয়ে দিলাম পুঁচকে পেস্ট্রি, জ্বালিয়ে দিলাম সুরভিত মোমবাতি। আজ যদি শৌভিক হেঁচেছে তো ওরই একদিন কি আমার একদিন। এক পাশে যত্ন করে সাজালাম আমার আর শৌভিকের দেওয়া উপহার গুলি। এবার অপেক্ষা কেবল তাঁর জন্য। 


শৌভিককে বলে এলাম, আমি ঘর অন্ধকার করে অপেক্ষা করছি, তুই মেয়েটাকে ডেকে নিয়ে আয়। কাঁপা কাঁপা মোমবাতির আলোয়, প্রায় অন্ধকার ঘরে ক্যামেরা চালিয়ে অপেক্ষা করছি আমি, দরজা খুলল, "হ্যাপি বা -" বলে চিৎকার করে বাকিটা গিলে নিলাম।ক্ষুদেটা কোথায়? এতো ধেড়েটা এসেছে ল্যাপটপ রাখতে। উফ ভগবান! এত কিছুর মাঝে একটা কাজ দিয়েছিলাম, সেটাও করেনি। বিস্তর ধমক খেয়ে মাথা চুলকে শৌভিক বলল, "অ, তুই আমাকে ওকে ডেকে আনতে বলেছিলি! আমি ভাবলাম, কি যে ভাবলাম -"। মাঝপথে আমার রুদ্র মূর্তি দেখে থতমত খেয়ে, " এই তো যাচ্ছি। এখুনি ডেকে আনছি -"। 


অতঃপর তিনি এলেন এবং -


অনির ডাইরি ২৫শে জুলাই, ২০২৫

#অনিরডাইরি 



লোকটা বলল, "জানেন ম্যাডাম, আমার মনটা খুব খারাপ।" কি যেন ভাবছিলাম গভীর ভাবে, কিন্তু কেউ এমন বললে শুধাতেই হয়, কেন, কি হয়েছে ইত্যাদি। জবাবে লোকটা ম্রিয়মাণ হয়ে বলল, "মেয়েটার শরীরটা একদম ভালো নেই।"


 লোকটা গ্রামে থাকে।  পেটের টানে শহরে আসে। কর্মসূত্রেই আমার সাথে পরিচয়। কিছু জমিজমা আছে, পুকুর আছে। মাঝে মাঝেই বাগানের আখ, শাক, উচ্ছে, থানকুনি পাতা, পুকুরের জ্যান্ত শোল, মৌরলা মাছ নিয়ে আসে আমার জন্য। নিষেধ করলে, বকলে দুঃখ পায়। বদলে লতা দি বাগানের চারটি আম, গাছের কাঁঠাল, ভাঙ্গানো কাজু  এইসব টুকটাক ভরে দেয় লোকটার ব্যাগে। আমি নিজে দিতে গিয়ে দেখেছি ভয়ানক অস্বস্তিতে ভোগে লোকটা। 


কর্মসূত্রে দিনের বেশ অনেকটা সময় এক সাথে কাটাতে হয়। মনের না না দুঃখের কথা এই সময় শোনায় লোকটা। বাবা মায়ের আটকে যাওয়া বার্ধক্য ভাতা, বর্ষায় ত্রিপল না পাওয়া, মালিকের সাথে ঝামেলা ইত্যাদি প্রভৃতি। যেখানে পারি, হস্তক্ষেপ করি, কিন্তু আমার ক্ষমতাও যে বড় সীমিত। 


লোকটার দুই সন্তান, ছেলেটার বয়স সাড়ে চার, মেয়েটা তার থেকে একটু বড়। ছেলেটা দস্যু প্রকৃতির, মেয়েটা ধীর স্থির শান্ত। ছেলেটার শতেক আব্দার, মেয়েটাকে 'বল তোর কি চাই' বললে সে ভ্যাবলার মত তাকিয়ে তাকে। আমি দুটোর কাউকেই দেখিনি, সবটাই লোকটার মুখে শোনা। 


মেয়েটাকে নিয়ে লোকটার দুশ্চিন্তার শেষ নেই। এই কিছুদিন আগে স্কুলে আরেকটা বাচ্ছা মেয়েটির হাতের ওপর ভারী দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। কচি হাত যে ভাঙেনি এই ঈশ্বরের আশীর্বাদ। তারপর কিছুদিন পর বেপোট জ্বর আর বমি নিয়ে  হাসপাতালে ভর্তি করতে হল। এখন আবার এই অগ্নিমান্দ্য। কি আর বলি, বললাম, ওর যা ভালো লাগে তাই খেতে দিন। মুখরোচক কিছু যদি খায় -


লোকটা বিমর্ষ ভাবে বলল, " সব বলেছি ম্যাডাম। কিছুতেই খেতে চাইছে না। ঘরের দুধের ঘি, বলছি ঘি ভাত খা। তো কইছে, না। টাটকা পুকুরের মাছ ধরে ভেজে দিতে চাইছি, তাও খাবে না। বলছি কি খাবি বল? ম্যাগি খাবি? চাউমিন খাবি? মাংস আনব? সবেতেই না।" 


বললাম, তাহলে একবার ডাক্তার দেখিয়ে নিন। পেটে কৃমি থাকতে পারে। এমনকি জন্ডিস হলেও এটা হয় দেখেছি। লোকটা চিন্তিত ভাবে বললে, " আর একটা জিনিস দেখছি। রোজ রাতে কি ভয় পাচ্ছে মেয়েটা। মাঝে মাঝেই ঘুম থেকে উঠে আমাদের কাছে চলে আসছে। আর বলছে, ' আমার খুব ভয় লাগছে।'" গল্পটা কোন দিকে গড়াচ্ছে বুঝেও, অন্য দিকে ঘোরাই, আবার বলি ডাক্তার দেখান। একটা অল্পবয়সী মেয়ে রাতে ভয় পাচ্ছে তার অনেক কারণ থাকতে পারে। মন বড় জটিল জিনিস। প্রার্থনা করি, খারাপ কিছু যেন না হয়।


পরের দিন আবার শুধাই মেয়েটার খবর। জবাব পাই একই রকম আছে। সেই খাদ্যে অনীহা, রাতে ভয়। লোকটা বলে, " বাড়ির লোক কইছে, হাওয়া বাতাস লেগিছে নির্ঘাত।" বলেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সামলে নেয় লোকটা, " আমি ওসব মানি না ম্যাডাম। বাড়ির বউ-ঝি'রা কইছে আরকি। আমি ডাক্তারের কাছে গেছিলাম। ওষুধটা পাল্টে দিলে।" 


সেটা বোধহয় শুক্রবার ছিল। সোমবার অফিসে বেরিয়েছি, লোকটা বলল, " মেয়েকে ঝাড়ালাম ম্যাডাম। " মহানগরে বসে এই সব ব্যাপার নিয়ে যতটা খিল্লি করা যায়, এই পল্লী বাংলায় বসে সেটা করতে পারলাম না আমি। সবথেকে বড় কথা, মেয়েটা ওনার। শুধু শুধালাম, " মেয়েটাকে মারধর করেনি তো? মেয়েটা ভালো আছে তো? যা হয়েছে আপনাদের সামনেই হয়েছে তো? ওকে একা ছাড়েননি তো গুণীন টুনিনের সাথে -"।


মেয়েটা ভালো আছে ছাড়া সবকটার জবাবেই না বলল লোকটা। বলল, " শনিবার যা হল ম্যাডাম আপনাকে কি আর বলি। রাতে সে মেয়ে যা করতে লাগল, কেবল বলছে ভয় লাগছে। বলছে আর গোটা বাড়ি দৌড়ে বেড়াচ্ছে। পাগলের মত ছুটছে। তখন আমি বললাম, দাঁড়াও তো দেখি। বলে দুটো লঙ্কা পুড়িয়ে যেই ধোঁয়াটা দিয়েছি, মেয়ে দৌড়ল সোজা সদর দরজার দিকে। বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে যাবে। আমার মা, বউ তাকে ধরে রাখতেই পারে না। তখন আমি করলাম কি, গেলাম ঝাঁটা নিয়ে -।" 


আঁতকে উঠি আমি, ঝাঁটা মানে? মুড়ো খ্যাংড়া? মারলেন মেয়েটাকে? লোকটা আঁতকে উঠে বলে, "না না ম্যাডাম, খেজুর পাতার ঝাড়ু। মারিনি, গায়ে বুলিয়েছি মাত্র। ঝাঁট দিবার মত করে -। তাতেই মেয়ের কি ছটফটানি, ' উরি বাবা গো, মা গো, বুকে কি ব্যথা গো '। চোখ গুলো যেন কোটর থিকে ঠেলে বেরিয়ে আসে। বাড়িতে তো কান্নার রোল উঠে গেল। সবাই আমায় এই মারে, কি সেই মারে। 'গুণিন ডাকবি কি না বল -'। 

 

ভয়ে দৌড়ালাম ওঝার কাছে। সে তো শুনে আমায় মারতে এল। বলল, মন্ত্র তন্ত্র না পড়ে কেন লঙ্কার ধুঁয়া দিছু? বলল আড়াই হাজার টাকা নিবে। আমি বললাম তাই সই। তারপর রাত তিনটের সময়, তেমাথার মোড়ে তিন ঘড়া জল দিয়ে ওকে স্নান করিয়ে, ঝাড়া হল।" মারেনি তো? আবার প্রশ্ন করি আমি। লোকটা জিভ কেটে বলে," নানা আমরা সবাই ছিলাম। ঝাড়া হতেই মেয়ে শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। আজ সকাল থেকে দিব্য খাচ্ছে সব।" 


তারপর কেটে গেছে বেশ অনেক গুলো দিন।রোজ শুধাই আমি, মেয়েটা কেমন আছে। খাওয়া দাওয়া করছে কি না। জবাব ইতিবাচকই আসে। আজ একটু অন্য জবাব এল। লোকটা বলল, " শরীর ঠিকই আছে, কিন্তু মেয়েটার খুব মন খারাপ। এত কানছিল আজ সকালে।" উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করি, কাঁদছিল কেন? লোকটা এক রাশ বিরক্তি চেপে বলল, " এই যে আমার ছেলেটা, একেবারে গাছ বাঁদর। ওর মা ঠিকই করে পেটায়। আজ ও কি মার মারল ছেলেটাকে।" 


বাধা দিয়ে বলি, মেয়েটার কি হল রে বাবা। লোকটা জিভ কেটে বলে, " সেটাই কইঠি ম্যাডাম। ছেলেটা এত বদমাশ, মেয়েটা যখন ঘুমাচ্ছিল, ওরই ( মেয়েটার) স্কুল ব্যাগ থেকে কাগজ কাটা কাঁচি বার করে দিয়েছে এক খাপলা চুল কেটে। একদম সামনের চুল ম্যাডাম। এমন কেটিছে পুরো টাক দেখা যাইতেছে। মেয়েটাকে ন্যাড়া করা ছাড়া কোন গতি নেই।"


ছেলেটার গুণ কীর্তন আরো কিছুক্ষণ চলত, মাঝ পথে থামিয়ে দিই আমি, বলি, " ওই যে মেয়েটার মাথা থেকে যাকে ঝেড়ে নামিয়েছেন, সেই চেপেছে ওর মাথায়। চেপেই বুঝেছে, যে কোথায় এলাম। কোনটা যে মানুষ, আর কোনটা যে ভূত। কে যে কার মাথায় চাপল।"




অনির ডাইরি ২৩শে জুলাই, ২০২৪

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 


লাদাখ থেকে ফিরেই ডাকে দুই খানা চিঠি পেলাম। দুটিই এসেছে জেলা শাসকের পাবলিক গ্রিভান্স সেল থেকে। প্রথম চিঠিতে কোন এক শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধির নামে কিছু গোল গোল নালিশ লেখা। কে লিখেছে, কোথা থেকে লিখেছে কিছু লেখা নেই। অভিযোগকারী জেলা শাসককে লিখেছেন, তিনি শ্রম দপ্তর সংক্রান্ত চিঠি দেখে আমাদের পাঠিয়ে দিয়েছেন।


 Dদ্বিতীয় চিঠিটি ও একই ব্যক্তির নামে লেখা, তবে এটি অনেক গোছানো। প্রেরক নিজের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর, অন্যান্য তথ্য সহ বেশ সুন্দর করে লিখেছেন যে তিনি একজন বর্ষীয়ান নাগরিক, এককালে পেশায় নির্মাণ কর্মী ছিলেন। আমাদের দপ্তরের উপভোক্তা। নিয়মিত পেনশন পান। কিন্তু এই Rপেনশন পাবার জন্য তাঁকে নিয়মিত ঐ ব্যক্তিকে টাকা দিতে হয়। যা পান তার শতকরা বেশ বড় একKটা শতাংশ। শুধু তাই নয়, ওনার স্ত্রীও আমাদের নথিভুক্ত শ্রমিক ছিলেন, যার অকালমৃত্যুর পর মনোনীত উত্তরাধিকারী হিসেবে ভদ্রলোকের প্রাপ্য থেকেও ছেলেটি বেশ মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করেছে, কারণ অফিস তথা ম্যাDডামকে দিতে হবে। 


এই অবধি পড়ে Rরীতিমত টলে গেলাম। এই মহকুমায় শ্রম দপ্তরের মাথায় যে একজন ম্যাডাম Kআছেন, তা এক অজ গাঁয়ের বুড়ো রাজমিস্ত্রির তো জানার কথা নয়। এই সব ক্ষেত্রে যা করি সাধারণত, প্রথমেই মৌখিক ভাবে বড় সাহেবকে জানালাম, অতঃপর গোপন ফাইল খুলে  গঠন করলাম এক তদন্তকারী কমিটি। লিখলাম, দেখে শুনে আগামী দশ পনেরো দিনের মধ্যে রিপোর্ট দাও দেখি। 


কি যে ভীষণ মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম সেদিন। আমি বিশ্ব হ্যাংলা। যদি বলত ম্যাডাম সিঙ্গারা জিলিপি খায়, তো সত্যিই কিছু মনে করতাম না। তাই বলে বুড়ো পেনশনারের টাকা, মরা মানুষের টাকা খাই? ছিঃ ছিঃ। বাড়ি ফিরে ঘর অন্ধকার করে বসে রইলাম খানিক ক্ষণ, শৌভিক বাড়ি ঢুকতেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম। কোন মতে এক হাতে আমায় জড়িয়ে, অন্য হাতে পকেট থেকে ফোন, মানিব্যাগ বার করতে করতে শৌভিক বলল, " আমার যে কি হল সে তো জানিস না। আমি গেছি দীঘা, একগাদা লোক আজ এসেছে, হাজার সমস্যা নিয়ে। মোবাইল,টিভি দেখার সুযোগই পাইনি। হঠাৎ দুপুর বেলা ডিএম সাহেবের ফোন। ' এসব কি শুনছি গো, আমি তো মাটিতে পুঁতে গেলাম।'"


Dবরকে ছেড়ে খাটে জুত করে বসি আমি, কেস তো বেশ জটিল মনে হচ্ছে। শৌভিক বলে, " শোন না, আমি তো কিছুই বুঝতে পারি না। বললাম কি হয়েছে স্যার? স্যার বললেন, ' তুমি অমুক টিভি দেখো নি ?' বললাম, সকাল থেকে সময়ই তো পাইনি। স্যার বললেন, ' মোবাইলে দেখতে পারবে?'  সম্মতি জানিয়ে খুলে দেখি, তমুক পান্ডা পুরো পর্দা কাঁপাচ্ছে। কি না, মহকুমা শাসক লিখিত ভাবে অমুক কেন্দ্রীয় সরকারী সংস্থার কাছে বারো লাখ টাকা ঘুষ চেয়েছে।" 


কি! Rছিটকে উঠি আমি। Kশৌভিক ঘাড়


নেড়ে বলে, " ভাব। এসডিও'র এমন দুর্দিন এল যে লিখিত ভাবে ঘুষ চাইতে হল। তারপর বুঝলাম, ব্যাপারটা। ওই কেন্দ্রীয় সংস্থা উপকূল বরাবর কিছু কাজ করবে। তার জন্য কিছু মানুষকে সরাতে হবে। যাদের সরানো হবে, তাদের কি হারে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, সেটাও ওরা জানিয়েছিল। সেই অনুযায়ী আমার বিডিও'রা হিসেব করে আমায় পাঠায়, আমি কম্পাইল করে ডিএম সাহেবকে পাঠাই। তিনি যেখানে পাঠানোর পাঠিয়ে দেন। মনে পড়ল সেটার পরিমাণ ছিল বারো লাখ বটে।" 


হাসব না কাঁদব বুঝতে পারি না। যেমন চ্যানেল, তেমন নেতা। শৌভিক হাসতে হাসতে খানিক দাড়ি চুলকে বলে, "শোন না। কাহিনী আভি বাকি হ্যায়। আমি ডিএম সাহেবকে ফোন করে জানালাম, বারো লাখের গল্পটা। স্যার যে কি রেগে গেলেন, কি বলব। তারপর ফোন রেখে, আবার চ্যানেলটা খুলে দেখি, অন্য সুর ধরেছে আর আমার নাম করছে না। এবার স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাদের নামে চিল্লাচ্ছে, বলছে আসলে ওরাই নাকি ঘুষ চেয়েছে।"


দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলাম, ভাগ্যে দুজনে দুটো আলাদা আপিস তথা দপ্তরে চাকরি করি। যখনই মনে হয়, যত অখাদ্য যমের অরুচি ঘটনাবলী কি কেবল আমার সাথেই ঘটে, পাশ থেকে আশ্বস্ত করে শৌভিক, না এটা কোন ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। আশ্বস্ত করে, সাহস দেয় ঘনিষ্ট আধিকারিক বন্ধুবান্ধবও -"এমন তো আকছার ঘটে, সাদা কালো লং শটে।"  ওপরওয়ালার নামেই তো তোলা তোলে লোকজন। 


রাত গড়ায়, দিন যায়। তদন্ত করে আসে আমার দলবল। সূর্য তখন ঢলে পড়ছে পশ্চিমে, ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে তদন্তকারীরা বলে, "একেবারে প্রত্যন্ত গ্রাম ম্যাডাম। গাড়ি ও যায় না। আমরা গাড়ি থেকে নেমে টোটো করে গেলাম। লোকটা একেবারে গোবেচারা প্রকৃতির। সে তো আমাদের দেখে ভয়েই অস্থির।" অপরজন বলে, " যা বুঝলাম ম্যাডাম, এরা স্কিম সম্বন্ধে কিস্যু জানে না। লাইফ সার্টিফিকেট কি তাই বোঝে না। সময়মত বেঁচে থাকার প্রমাণ দিতে পারেনি বলে ওর পেনশন আটকে গিয়েছিল। এটা এমন কিছুই নয়, গুচ্ছ গুচ্ছ এমন কেস আসে। আপনি লিখে পাঠিয়ে দিলেই বোর্ড ছেড়ে দেয়। লোকটা সেটা না জানার জন্য, দালালের খপ্পরে পড়ে ছিল।" 


বিশদে শুনতে শুনতে বিষণ্ণ হয়ে ওঠে হৃদয়। বলি ডাকো দেখি বাবু বিবিদের। যোগাযোগের অভাবেই তৈরি হয়, যত অভিযোগ। এবার থেকে আমার সইয়ে যে যা সুবিধা বা অনুদান পাবে, তাকে একবার অন্তত প্রত্যক্ষ হাজিরা দিতে হবে আমার সামনে। আমি নিজে মুখে একবার বুঝিয়ে বলে দেব,  কি ভাবে প্রতি নভেম্বরে এসে জমা করতে হয় বেঁচে থাকার প্রমাণ। যদি কেউ না পারেন, তাতেও ভয় পাবার কোন কারণ নেই। আমি আছি তো। আছে আমার টিম। আর আপনার কানা কড়িটিও আমার বা আমার টিমের চাই না। আমরা শুধু চাই, আপনারা ভালো থাকুন।


অনির ডাইরি ২২শে জুলাই, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



"That day can be regarded as one of the most memorable days of my school life—November 14, 2022. There was the excitement of going to school in a colorful dress and without any books, but there was also the grief of leaving my school. That was the first and last children's day and last day in my previous school, "Tamralipta Public School."


I only spent six months at that school, but everyone felt so close to my heart. Just like every other day, I reached the school at ten; the school was supposed to be over by one, unlike other days. As I walked through the corridor, I saw the students wearing colorful dresses; it seemed that they were the colorful blossoms of an orchard.


As I entered the classroom, I noticed that the class had been decorated by my classmates, mainly using balloons. I sat with my best friend Shimly and took a walk down memory lane. We were both about to cry but somehow swallowed it. I distributed chocolates among all my friends and asked them to forget all the bitter memories and together cherish the good ones.


At twelve o'clock, we were served our meal of rice and chicken curry. The happiness of eating together and all the other emotions made the meal seem tastier. Finally, the moment came that I knew would happen one day but was never ready for. I hugged my friends and touched the feet of my teachers. With a final look at my classroom, I came down the stairs and out of the gate. It has been almost two years since that day, but I still remember the smallest of details. That day was just special for me.


গত সোমবার রচনা লিখতে দিয়ে গিয়েছিলাম, "One day at school." বাধ্য ছাত্রীর মত তিনি লিখে তো রেখেছিলেন, কিন্তু তাঁর বাবার আর দেখার সময় হয়নি। বললেই বলেন, " আমি সময়টা কোথায় পাচ্ছি বল?" তা অবশ্যি ঠিক। একে মহকুমা শাসক তায় আবার ঘাড়ে চেপেছে সমুদ্র সুন্দরীর গুরুদায়িত্ব। ফলে অবসর সময় তাঁর আপাতত অত্যন্ত সীমিত। তাই বলে একটা রচনা এক সপ্তাহেও দেখে দিতে পারবে না? 


রাগ করে আজ নিজেই বসলাম চেক করতে। পড়তে পড়তে কখন যে ভিজে গেল দুই চোখ। এটা কি লিখেছে মেয়েটা। আমি যে প্রত্যক্ষ সাক্ষী সেই দিনটার। আমিই তো আনতে গিয়েছিলাম সেদিন মেয়েকে স্কুল থেকে। ট্রান্সফার সার্টিফিকেট তুলে, একরাশ উদ্বেগ নিয়ে প্রতীক্ষা করছিলাম মস্ত স্কুল বাড়িটার সামনে। ভয় পাচ্ছিলাম, কতটা কান্নাকাটি করবে মেয়েটা। প্রশান্ত মুখে, পিঠে ব্যাগ নিয়ে সামান্য মাথা নীচু করে গুটগুট করে হেঁটে এল মেয়েটা। আমার হাত ধরে কয়েক পা এগিয়ে হঠাৎ থেমে গেল। শেষ বারের মত ঘুরে তাকাল স্কুল বিল্ডিংটার দিকে, বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়েই রইল, বাইরে থেকে যেন নিজের ক্লাস রুমটাই খোঁজার চেষ্টা করল খানিক। তারপর একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে, মাথা নেড়ে ইশারা করল, "চল যাই।" 


সন্তানের অব্যক্ত বেদনায় সেদিন হৃদয় বিদীর্ণ হলেও দুই জনের শিক্ষায় সামলে নিতে পেরেছিলাম নিজেকে এবং মেয়েকেও। প্রথম জন আমার বাবা, যিনি ছোট থেকে শিখিয়েছেন, "Look back in anger"। এগোতে গেলে, মাঝে মাঝে একরাশ ক্ষোভ নিয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই হয়। যদি না তাকাতে পারো, তাহলে আর এগোলে কোথায়? 


দ্বিতীয় জন শৌভিকের বাবা, আমার স্বর্গীয় শ্বশুরমশাই। কোন এক উঠতি লেখকের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে, একদা তিনি বলেছিলেন, " আজ যতই প্রশংসা পাক না কেন, এ ছেলে বেশী দূর যাবে না। কারণ এর জীবনে কোন দুঃখ নেই।" নিপাট, নিখাদ সুখ মানুষকে বড় ভদভদে, ম্যাদামারা করে তোলে। দুঃখ হল সেই আগুন,যা যাবতীয় খাদ গলিয়ে শুদ্ধ করে আমাদের চিন্তা এবং চেতনাকে। থাক না কিছুটা দুঃখ তুত্তুরীর ও। ভাবতে শিখুক তলিয়ে,  উপলব্ধি করতে শিখুক জীবনের প্রতিটা রূপ রস গন্ধ। তবেই না কৃতজ্ঞ থাকতে শিখবে, জীবনের প্রতিটা মানবিক সমীকরণের জন্য। নিজেকে সামলে নতুন হোমওয়ার্ক দিই, " An embarrassing moment", লেখ ব্যাটা দেখি কি লিখিস। এবার তো কাঁদালি, পরের বার হাসিয়ে দেখা দিকি।


অনির ডাইরি ১৫ই জুলাই, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



মাস দুয়েক আগের কথা। দিন তিনেক হল চলে গেছেন শ্বশুরমশাই। মহানগরের বুকে প্রগাঢ় হচ্ছে সন্ধ্যা। ভিডিও কলে উমার সাথে গল্প করছিলাম আমরা, অর্থাৎ আমি আর তুত্তুরী। বাড়ি ফাঁকা, আজ সকালেই দুর্গাপুর রওনা দিয়েছে ওরা। কাল আমাদের পালা। "বন্দরের কাল হল শেষ-" মহানগরের পাঠ চুকিয়ে, এতদিনের বিশ্বস্ত গৃহসেবিকাদের ছুটি দিয়ে, বৃদ্ধা শাশুড়িকে নিয়ে কাল সকালেই কাঁথি ফিরব আমরা। আবার কবে সামনাসামনি দেখা হবে কে জানে। শ্বশুরমশাইয়ের এভাবে অকস্মাৎ চলে যাওয়াটা যেন কেমন রাতারাতি বদলে দিয়েছে আমাদের জীবন। 


বার্তালাপের মধ্যেই হঠাৎ করে সবিতাদির আগমন, " অ বড়বৌদি, কে যেন এইয়েছেন। তোমাদের কোন জ্ঞাতিই হবেন বোধহয়।" গত পরশু রাত থেকে লোক আর ফোন আসার বিরাম নেই। আত্মীয়স্বজন, শ্বশুরমশাইয়ের সুহৃদ, আবাসনে অধিবাসী বৃন্দ, শুভানুধ্যায়ীগণ - কে না আসছে, দুমিনিট শাশুড়ি মা বা তাঁর ছেলেদের সাথে কথা বলতে। শারীরিক অসুস্থতার জন্য শেষের কয়েক বছর গৃহবন্দী থাকলেও, নিজ গুণে কি যে অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন ভদ্রলোক, প্রতি মুহূর্তে তা উপলব্ধি করছি আমরা।


গিয়ে দেখি, বসার ঘরের সোফায় বসে আছেন এক প্রৌঢ়, এক মাথা কাঁচা পাকা চুলে সাদারই আধিক্য। মাঝারি উচ্চতা, রোদে পোড়া শ্যাম বর্ণ। চোখে মোটা পাওয়ারের চশমা। গালে দুয়েকদিনের না কামানো কাঁচাপাকা দাড়ি।পরনে প্রায় বিবর্ণ  পোলো নেক টিশার্ট আর ঢলঢলে প্যান্ট। কাঁধে একটি শান্তিনিকেতনী ঝোলা। 


ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসছেন। চেনা চেনা লাগলেও, কিছুতেই চিনতে পারছি না আমি। শেষে বিস্তর মাথাটাথা চুলকে শুধালাম, " আপনি কি শ্বশুরমশাইয়ের বন্ধু?" ভদ্রলোক একই রকম মিটিমিটি হাসতে হাসতে জবাব দিলেন, " তা বলতেই পারো। আমার নাম  -"। 


ভদ্রলোকের নাম শুনে চমকে উঠলাম, নামটা অত্যন্ত পরিচিত। ভদ্রলোক এই আবাসনেরই বাসিন্দা। অবসর প্রাপ্ত  আইএএস অফিসার। ডিএম ছিলেন বেশ কিছু বছর। শুনেছি বেশ দোর্দণ্ডপ্রতাপ জেলাশাসক ছিলেন ভদ্রলোক।


খাতির করার মত কিছুই নেই বাড়িতে, তবুও সসম্ভ্রমে বলি, "একটু চা বলি।" উনি একই রকম ভাবে হেসে, হাত নেড়ে বলেন, " না না, তুমি বসো।" প্রথমেই শৌভিকের তত্ত্বতলাশ করেন ভদ্রলোক। ঠিক এই মুহূর্তেই হাঁটতে বেরিয়েছে শৌভিক। আবাসনে কয়েক পা হেঁটে, টুকিটাকি এক গাদা জিনিস কিনে ফিরবে। বুড়োবুড়ির ছাপোষা সংসারে অনেক কিছুই বাড়ন্ত। ফোন করে বললেই দিয়ে যায় স্থানীয় দোকানদার, হঠাৎ অসুস্থতার জন্য সেটুকুও বলে যেতে পারেননি শ্বশুরমশাই। বিগত দুদিন তুত্তুরীকে বগল দাবা করে উমাই দোকানবাজার করছিল। আজ শৌভিক গেছে। 


শৌভিকের সাথে কথা বলার সুযোগ না পেয়ে দৃশ্যতই মুষড়ে পড়লেন ভদ্রলোক। অতঃপর নিজেকে সামলে নিয়ে শুধালেন, " তোমার শাশুড়ি মাতা -"। শাশুড়ি মা বাড়িতেই আছেন, কাল চলে যাবেন বলে টুকটুক করে কতকিছু যে গোছাচ্ছেন। একটু আগে শ্বশুর মশাইয়ের না খাওয়া ওষুধ গুলো ব্যাগে ঢোকানো নিয়ে সবিতা দির সাথে এক প্রস্থ ঝামেলা করলেন। সবিতা দি ভালোমানুষের মতোই বলতে গিয়েছিল, " অ মাসিমা, ওগুলা তো মেসোমশাইয়ের ওষুধ। ওগুলো নিয়া কি করবা? ওগুলা খাবা না যেন।" আমিও নিষেধ করলাম, কিন্তু বৃদ্ধা বড় জেদি। তাঁর বক্তব্য, জ্যেষ্ঠ পুত্রকে না দেখিয়ে খাবেন না বটে, তাই বলে এত গুলি ওষুধ অকারণে ফেলেই বা যাবেন কেন। শুধু কি ওষুধ, শ্বশুরমশাইয়ের হাত ঘড়ি, পেন, পাথরের পেনস্ট্যান্ড, মুখে মাখার মেডিকেটেড ক্রিম আরও কতকিছু যে ব্যাগে ভরছেন তার ইয়ত্তা নেই। আর থেকে থেকে বলছেন, "কোন কিছুই তো বলে গেল না। কিছুই তো বলে গেল না।" 


সেভাবে কান্নাকাটি আর করছেন না বটে, কিন্তু যে মানুষটা চলে গেছে,তাঁর ফেলে যাওয়া জিনিসপত্রের মধ্যেই যেন তাঁকে খুঁজে চলেছেন শাশুড়ি মা। কি কি ভাবে যে শোক প্রকাশ করে মানুষ। গতকাল কে যেন বলে গেছে, " তুমি খুব শক্ত মেয়ে -"। যিনি বলেছেন তিনি নিঃসন্দেহে শাশুড়ি মাতার তারিফ করতেই বলেছেন, কিন্তু তারিফ করতে গিয়ে অজান্তেই আহত করে গেছেন বৃদ্ধাকে। কাল থেকে বার বার বলে চলেছেন শাশুড়ি মা, " কান্নাকাটি না করলে কি শোক হয় না? আমার শক্ত না হয়ে উপায় আছে, বলো তো? আমি যদি এখন কান্নাকাটি করি, তোমরা সবাই যে আমায় নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়বে।" 


সেই কথাই বলি ভদ্রলোককে। উনিও মাথা নাড়েন, " শোক বড় ব্যক্তিগত ব্যাপার বুঝলে। এই যে আমার কথাই ধর না, আমার স্ত্রী মারা গেছেন আজ বেশ কয়েক বছর হল। আমি একাই থাকি। মাঝে মধ্যেই ছেলেমেয়েদের কাছে চলে যাই।  নিজেই ড্রাইভ করি, গাড়ি নিয়েই বেরিয়ে পড়ি। লোকে ভাবে আমি খুব ভালো আছি। কেমন সুন্দর ঝাড়া হাত পা। কেউ বোঝে না, আমি কতটা নিঃসঙ্গ। 


আমার স্ত্রী ভীষণ ঘুরতে ভালবাসত জানো। সারা জীবন সরকারী চাকরগিরি করেছি, একে তো ছুটি পেতাম না। তারপর ঐ মাইনেতে দুটো বাচ্ছাকে বড় করা। ফ্ল্যাট কেনা -"। বলতে বলতে হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে ফেলেন ভদ্রলোক, "জানো এখানে ফ্ল্যাট কেনার মূলে ছিলেন আমার বাবা। বাবা বলত, 'এয়ারপোর্টের পাশে ফ্ল্যাট কেন', যাতে তাঁর নাতনীরা প্লেন থেকে নেমেই বাড়ি ঢুকে পড়তে পারে। বাবার কথা শুনে ফ্ল্যাট কিনলাম। অথচ বাবাই সেভাবে ভোগ করতে পারলেন না।" 


চুপ করে থাকি আমি। ভদ্রলোক গলা ঝেড়ে আবার শুরু করেন, " এত কিছু করতে গিয়ে ঘুরে বেড়ানোটা আর সেভাবে হয়নি। বাচ্ছারা বড় হয়ে যাবার পর, আমার স্ত্রীর ইচ্ছে ছিল ওর ষাট বছর হলে, দুজনেই সিনিয়র সিটিজেন কোটায় ছাড় পাব, তখন ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাসে করে সারা ভারত ঘুরব, শুধু দুজনে। ৫৯ পুরো হবার আগেই ক্যান্সার ধরা পড়ল। ৬২র মধ্যে সব শেষ।"

 কি বলব বুঝতে পারি না। জীবন কেন যে এত অনিত্য। নাম, যশ, অর্থ, প্রতিপত্তি, প্রেম, বন্ধুত্ব, এমনকি পরিবারও সবই কেমন যেন এই টক্কা, তো এই সব ফক্কা। তবুও কেমন ডিনায়াল মোডে থাকি আমরা। বাস করে চলি মূর্খের স্বর্গে।

অনির ডাইরি, ১১ই জুলাই, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



"ম্যাডাম, অমুক পিকনিকে যাবে নি বলতেছে।" ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিল শান্তনু। বর্ষার পিকনিক আসতে আর মাত্রই দিন দুয়েক বাকি।  যাদের জন্য এত হ্যাপা করে পিকনিক, তারাই বলছে পিকনিকে যাবে না?  বললাম ডাকো ব্যাটাকে, দেখি তার আবার কি হল। 


সামান্য ভয়ে ভয়েই ঘরে ঢুকল ছেলেটি, " ম্যাডাম ডাকতেছিলেন?" শুধাই, পিকনিকে কেন যাবে না, বাবা। ছেলেটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই জবাব দেয়, " সত্যি বলছি ম্যাডাম, যাবার খুব ইচ্ছা ছিল, কিন্তু অত সকালে যে বেরোতে পারব না ম্যাডাম।" 


সকাল সকালই বটে, ছেলেটির বাড়ির সামনে দিয়ে আমাদের দীঘামুখী বাস বেরোবে ভোর ছটায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, " একদিন একটু কষ্ট করে সকালে উঠতে পারবে নি?" ছেলেটি হেসে বলল, "কেন পারব না ম্যাডাম, আমি তো রোজ আরো ভোরে উঠি। যেতে পারব না, আমার মায়ের জন্য। মাকে স্নানটা না করিয়ে যে বেরোতে পারব না ম্যাডাম।" 

শুধালাম, "তোমার বাড়িতে এমন কেউ নেই, যে তোমার মাকে একদিন স্নান করিয়ে দিতে পারবে?" ছেলেটি জবাব দিল, " মা অন্য কারো কাছে করবে না ম্যাডাম।" 


 খানিক দম নিয়ে, ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল ছেলেটি, তারপর বলল, "আপনাকে সব বলা যায় ম্যাডাম। আমার মায়ের বয়স প্রায় নব্বই।আমরা বেশ অনেকগুলি ভাইবোন। আমি সবথেকে ছোট। মা যে কি চরম দারিদ্র্যের মধ্যে দিয়ে আমাদের বড় করেছিল ম্যাডাম, আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। আজ সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, সকলেরই চলে যায় ভালো ভাবে। বাবার মৃত্যুর পর, সবাই মিলে বসা হয়েছিল, মা কার কাছে কদিন থাকবে এই নিয়ে। 


সেদিন মা আমায় আলাদা করে ডেকে বলেছিলেন, ' আমি তোর কাছেই থাকব। তুই যা খাবি, আমাকেও দুটি দিস।' সেই থেকে মা আমার কাছেই থাকেন। 


আপনি এই অফিসে আসার পর একবার আমি আপনাকে ফোন করে জানালাম না, যে মাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি - সেই যে স্ট্রোক হল মায়ের,শরীরের ডান দিকটা একদম পড়ে গেল ম্যাডাম। সে যে কি অবস্থা কি বলি। মা পুরো শয্যাশায়ী, মল মূত্র সবই বিছানায় করে ফেলছে, আমি আর আমার বউ হাতে করে সেই সব সাফ করছি। সত্যি বলতে কি ম্যাডাম, ওর কাছে এতটা আশা আমি করিনি। ও যে আমার মায়ের জন্য এতটা করবে আমি ভাবতেও পারিনি ম্যাডাম। 


এখন ফিজিও থেরাপি করে মা অনেক ভালো আছে, আমার হাত ধরে সামান্য হলেও অন্তত হাঁটতে তো পারছে। এখন সমস্যা কি বলুন তো ম্যাডাম, মায়ের কোষ্ঠকাঠিন্য আছে। ফলে রোজ রাতে একটা আয়ুর্বেদিক ওষুধ খায়। ভোর হলেই মায়ের পায়খানা পায়। সে যে কি দুর্গন্ধ ম্যাডাম কি বলব। পুরো বাড়ি ছাড়ুন, মহল্লায় টেকা যায় না। সেই সব সাফ করে, মাকে চান করিয়ে টিভিটা চালিয়ে দিয়ে তবে বেরোতে পারি আমি। এত কিছু তো ভোর ছটার মধ্যে হবে না ম্যাডাম।" 


ইশারায় বলি, ভালোই সেন্টু দিলে বাবা, তোমায় আর পিকনিকে যেতে বলে কে? বলি এবার কেটে পড়। ছেলেটা হাসতে হাসতে উঠে যেতে যেতে বলে, "জানেন ম্যাডাম, মা না পুরো ছেলেমানুষ হয়ে গেছে। মায়ের জন্য একটা সোফা কিনতে হল আমায়। স্নান করিয়ে মাকে সোফায় বসিয়ে, টিভিটা অন করে দিয়ে আমি বেরিয়ে আসি। মা সারাদিন টিভি দেখে -"। 


হাসতে গিয়েও হাসতে পারি না। কুশীলব ভিন্ন হলেও বৃদ্ধ মা আর ছেলের এই গল্পটা যে আমার ভীষণ পরিচিত। শ্বশুর মশাই মারা যাবার রাতে, ঠিক এমনি ভাবেই বলছিল শৌভিক, "মাকে একা রাখা যাবে না।" তখন বোধহয় রাত এগারোটা। শুনশান  নাচিন্দা মন্দির চত্বর এক পলকে পেরিয়ে গেলাম আমরা। রাস্তার আলো আঁধারির দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম আমি, একা সত্যিই ওনাকে রাখা যাবে না। কানে প্রায় বধির। হাঁটুর ব্যথায় প্রায় স্থবির। চোখের জ্যোতিও তেমন নেই। সব থেকে বড় কথা, কিছুই তো জানেন না, বোঝেন না ভদ্রমহিলা। 


সাথে সাথে মনে হল, কাজটা মোটেও সহজ নয়। বাড়িটা যে বৃদ্ধার প্রাণভোমরা। নিজের হাতে সাজিয়েছেন প্রতিটা কোনা। নিজের হাতে তকতকে সাফ রেখেছেন আজ এই মধ্য সত্তরেও। শরিকি বাড়িতে বেড়ে ওঠা শাশুড়ি মাতা, আজীবন স্বপ্ন দেখেছেন, একটা বাড়ি হবে, যা হবে একান্তই ওনার। 


শ্বশুর মশাইয়ের কর্মসূত্রে জীবনের অধিকাংশ সময়ই কেটেছে বিভিন্ন সরকারী আবাসনে। ওই যে অবসর নেবার সময় চিঠি আসবে, সরকারী আবাস ছেড়ে দাও, এটা শাশুড়ি মাতার কাছে ছিল মূর্তিমান দুঃস্বপ্ন। কত দাম্পত্য কলহ যে হয়েছে এটা নিয়ে। ১৯৭৯ সালে বাসু ভট্টাচার্যের একটা সিনেমা এসেছিল, নাম গৃহপ্রবেশ। তার মুখ্য চরিত্র মানসী ওরফে শর্মিলা ঠাকুর হয়ে উঠেছিলেন যেন শাশুড়ি মা। শ্বশুরমশাই অবশ্য অমর বা সঞ্জীব কুমার হয়ে উঠতে পারেননি। প্রিয়াকে তুষ্ট করে, অবসর নেবার বেশ কিছু বছর আগেই ফ্ল্যাটটা কেনেন শ্বশুর মশাই। কর্জ করেও যে দামে কেনেন, বর্তমানে শুনলে হাসি পাবে। তা পাক, কিন্তু ওই অবাঞ্ছিত পরিস্থিতিতে তো আর পড়তে হয়নি। বাড়িটা ওনার এতোই প্রিয়, বাড়ি ছেড়ে একবেলার জন্য ও কোথাও যেতে চান না ভদ্রমহিলা। এখন কি হবে কে জানে।  যা জেদি বৃদ্ধা।


ভেবেছিলাম, বোঝাতে হবে, হয়তো ছেলেদের একটু রাগও দেখাতে হবে। বাস্তব বড়ই বিচিত্র। কল্পনার থেকে একেবারেই আলাদা।শ্বশুরমশাইয়ের মৃত্যুর পরের দিন, আমরা আর জনা দুই গৃহসেবিকা ছাড়া বাড়ি ফাঁকা। শৌভিক গেছে কি যেন দপ্তরী ট্রেনিংএ। ঠিক হয়েছে রাতে দুজনে একসাথে কথাটা পাড়ব। সদ্য স্নান সেরে বেরিয়েছেন শাশুড়ি মা। এতদিনের চেনা মুখের দিকে আর তাকাতে পারছি না যেন। বিমর্ষ ভাবে  নড়বড় করতে করতে গিয়ে সোফায় বসলেন শাশুড়ি মা,  অতঃপর ইশারায় ডাকলেন আমায়। উনি বসে, আমি দাঁড়িয়ে। কৃপা প্রার্থীর মত আমার দিকে তাকিয়ে একগাল হাসলেন, তারপর বললেন, "আমি তোমাদের সাথেই চলে যাব কেমন। এই ফ্ল্যাট জুড়ে তোমার শ্বশুর মশাইয়ের এত এত স্মৃতি। এখানে আর থাকতে পারব না। তোমরা আমায় নিয়ে যাবে তো - । " 


প্রায় দুই মাস হতে চলল, কাঁথিতে আছেন শাশুড়ি মা, আপাতদৃষ্টিতে ভালোই তো আছেন। স্বর্গীয় শ্বশুরমশাইয়ের মতোই যতনে রেখেছে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র। এই বৃদ্ধাও ভোগেন কোষ্ঠকাঠিন্যে। এনার পুত্রও মায়ের জন্য কিনে আনেন আয়ুর্বেদিক ঔষধ। শাশুড়ি মাও যথেষ্ট সাবধানী, সবথেকে প্রশংসনীয় ওনার নিয়মানুবর্তিতা। ঘড়ির কাঁটা ধরে ভোর পাঁচটায় উঠে পড়েন ঘুম থেকে। ছটায় দুটো সুগার ফ্রি দিয়ে এক কাপ কালো চা খেয়েই স্নানে চলে যান। স্নান সেরে দৈনিক খবরের কাগজটা নিয়ে কাটান কিছুটা সময়। পৌনে নটায় প্রাতঃরাশ, পৌনে একটায় দ্বিপ্রাহরিক আহার, চারটে নাগাদ ফল, সন্ধ্যে ছটায় চা, রাত পৌনে নটায় নৈশ ভোজ সেরে, ঠিক নটায় ঘুমিয়ে পড়েন শাশুড়ি মা। সারাদিন হয় সোফায় বসে ঝিমান, নয়তো বই পড়েন শাশুড়ি মা। টিভি দেখার তেমন নেশা নেই, দূরদর্শনের সন্ধ্যে সাতটার খবরটা দেখেন আর দেখেন দিদি নম্বর ওয়ান। 


নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার দিন খুব টেনশনে ছিলেন, যদি রচনা না আসতে পারেন শো করতে। প্রোগ্রাম শেষে এক গাল হাসি বৃদ্ধার, " যাক এত ব্যস্ততার মধ্যেও তো রচনা ব্যানার্জি এসেছে বলো।" এই নির্বিকল্প রেজিমেন্টেড রুটিনের মধ্যেও মাঝে মধ্যেই ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে নেন বৃদ্ধা, আমরা আছি তো? আমরা কে কোথায় আছি? খেয়াল রাখেন, কে কখন বেরোচ্ছি।  বেরোবার আগে আসছি বললেই, এক গাল হেসে শুধান, " আজ আর দেরী হবে না তো? ও অনিন্দিতা, আজ তাড়াতাড়ি ফিরবে তো?"


অনির ডাইরি ৭ই জুলাই, ২০২৪

#তাম্রলিপ্তকড়চা 



ভোরের এলার্ম বাজার আগেই ঘুম ভেঙে গেছে আজ। বলতে পারেন চাপা উত্তেজনায় ভালো ঘুমই হয়নি কাল। হাত বাড়িয়ে মুঠো ফোনটা টেনে নিয়ে whatsapp খুলতেই মেসেজের বন্যা। ভোর ৪টে ৫১য় মেসেজ করেছে বেদজ্যোতি, "শুভ সকাল বন্ধুগণ, সবাই তৈরি হয়ে যাও।" সবার আগে বেরোতে হয়েছে যে ওকে, মাছ, মাংসের যোগাড় করতে। 

৫টা ১৫ - মেসেজ করল সৌরভ, বাস ছাড়ল মানিকতলা থেকে। নীচে বাসের লাইভ লোকেশন শেয়ার করেছে শান্তনু। মানিকতলা থেকে বাস যাবে মেছেদা বাসস্টান্ড। কোলাঘাট আর শহীদ মাতঙ্গিনীর লোকজন ওখান থেকেই বাসে উঠবে। 


সৌরভের মেসেজের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কাঁধে হাত দিয়ে এক গাল হেসে ছবি পোস্ট করেছে সৌম্য আর সন্দীপ। অর্থাৎ মোরা হাজির। ভোর ভোর বাইক চালিয়ে চলে এসেছে দুটোতে। সেখান থেকে বাস রামতারক,রাধামনি হয়ে আসবে আমাদের নিমতৌড়ি। ময়নার SLO রা নিমতৌড়ি থেকেই বাসে উঠবে। সকলের জন্য মুড়ি আর চিড়ে বাজার প্যাকেট নিয়ে উঠবে শুভদীপ্ত। কোন সকালে বেরিয়েছে সব। এরপর বাস দাঁড়াবে খঞ্চি। উঠবে নন্দকুমার ব্লকের লোকজন। তারপরের স্টপ নন্দকুমার মোড়। সপরিবারে বাসে উঠবেন হক বাবু। তারপর চণ্ডীপুর, সবার শেষে বাসে উঠব সকন্যা আমি। 


সৌরভের ওপর দায়িত্ব পড়েছে প্রথম বাসে ওঠার। বিস্তর গাঁইগুঁই করছিল সৌরভ, "ম্যাডাম , অত ভোরে বাসস্ট্যান্ডে আসব কি করে? একটা টোটো পাব না।" শান্তনুকে তাই ট্যাগ করা হয় সৌরভের সাথে। জানতাম, আমার RLO ইন্সপেক্টর মুখে যাই বলুক, নিজ দায়িত্বে অবিচল। আমার বিশ্বাসকে যথার্থ প্রমাণ করে ফুটে উঠল সৌরভের মেসেজ, বাস মেছেদা ছাড়ল। সঙ্গে সঙ্গেই শুভাশিস এর এক গাল হাসিওয়ালা নিজস্বী। পিছনে গাল ফুলিয়ে বসে আছে রঞ্জিত। বাস কেন কোলাঘাট যাবে না এই নিয়ে কাল গোঁসা হয়েছিল বাবুর। রেগে বলেছিল, "যাবই না।" মিনিট দশেক ধরে সকলের বিস্তর কাকুতিমিনতির পর, বিস্তর কান মাথা চুলকে বলে, "ম্যাডাম আবার জানতে পারলে very poor, ACR দিবেন। থাক, বাইক নিয়েই চলে আসব।" এই রগড় এই আপিসে প্রায়ই হয়। যে কোন শুভ কাজের আগে রঞ্জিতের গোঁসা করাটা খুব দরকার। রঞ্জিত চটে গেছে মানে, সব নির্বিঘ্নে হবে। উপরি পাওনা হল, মাথা গরমের মাশুল হিসেবে কাল না হলে পরশু রঞ্জিত অবশ্যই কিছু না কিছু খাওয়াবে। 


ভালোয় ভালোয় যেন কেটে যায় আজকের দিনটা। বিভিন্ন বয়সের এত গুলো মানুষকে নিয়ে চলেছি আমরা। সবাইকে সুস্থ ভাবে বাড়ি না ফেরানো পর্যন্ত আমার শান্তি নেই। কি যে ঝামেলার মধ্যে দিয়ে হচ্ছে পিকনিকটা।প্রস্তাবটা প্রথম তুলেছিল তমলুক পুরসভার SLO সুতপা, "ম্যাডাম একদিন আমাদের দীঘা নিয়ে চলুন না।" নিয়ে চলুন, বললেই তো বেরিয়ে পড়া যায় না, ইন্সপেক্টর, CKCO, SLO, কালেকটিং এজেন্ট মিলিয়ে শতাধিক সদস্য আমার টিমের। তার ওপরে আছেন তাঁদের পরিবার বর্গ। বিগত শীতের পিকনিকে মাথা ছুঁয়েছিল প্রায় শ দেড়েক। এত জনকে একসাথে নিয়ে যাওয়া, আবার নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া কি চাট্টি খানি কথা? এতো আর নন্দকুমারে পিকনিক করা নয় যে, যে যার মত যাবে, খাবে, গানবাজনা করবে আবার নিজ দায়িত্বে বাড়ি ফিরে যাবে। একই জেলায় হলেও, মেছেদা থেকে দীঘা পৌঁছতে লাগে অন্তত তিন ঘণ্টা। লোক তুলতে তুলতে গেলে, আরো আধেক ঘণ্টা বেশি ধরুন। একদিনে এতটা যাতায়াত করা যায় নাকি, ফলে রাতে থাকতে হবে। সপ্তাহান্তে দীঘায় এতগুলো ঘর পাওয়া কি মুখের কথা? 


সুতপা অনড়, " রাতে থাকব না ম্যাডাম। যাব আর চলে আসব। প্লিজ ম্যাডাম -"। সুতপা চলে যাবার পর সহকর্মীদের নিয়ে একবার বসলাম, এতজনকে এই ভাবে এক বেলার জন্য দীঘা নিয়ে যাওয়া ব্যাপারটা কতটা বাস্তবসম্মত। জনগণের দেখলাম উৎসাহের শেষ নেই। শান্তনু তখনই চেনা বাসের নম্বর ঘোরাল, "দাদা, তমলুক থিকে দীঘা, যাতায়াত। কত ভাড়া লিবে?" জবাব এল বারো থেকে পনেরো হাজারের আশেপাশে। 


এবার একটা হোটেল খোঁজ দরকার। এতগুলো লোক যাতে একসাথে খেতে বা বসতে পারে। বেদজ্যোতি আর হক বাবু বললেন, "গোটা কয়েক ঘর ও লাগবে ম্যাডাম। ব্যাগপত্তর রাখতে, জামা কাপড় বদলাতে, শৌচাগারের যদি প্রয়োজনে। কারো যদি শরীর খারাপ হয় হঠাৎ -"। 


 দীঘা আমার প্রচণ্ড প্রিয় জায়গা, কিন্তু সপ্তাহান্তে বা ছুটির দিনে দীঘা আমার কাছে বিভীষিকা। এত ভিড় হয় দীঘায় যে তার আগের/ পরের দিন অফিস যেতে জিভ বেরিয়ে যায়। তার থেকে মন্দারমণি, তাজপুর, শঙ্করপুর অনেক ভালো। মন্দারমণিতে একটি হোটেলে আমরা একবার পিকনিক করেছিলাম। রামকৃষ্ণ মিশনের পাশেই, একদম নিরিবিলি। সারাদিন সমুদ্রে দাপালেও কেউ কিছু বলার নেই। রান্নাবান্না ও বেশ ভালো। কেবল একটু শুঁটকি মাছের গন্ধ আসে মাঝেমধ্যে এই যা। 


সেই মত কথা বলতে গিয়ে হোঁচট খেলাম আমরা। শুধু খেতেই লাগবে মাথাপিছু ৯০০টাকা। হোটেলওয়ালা অমায়িক ভাবে বললেন, "দেখুন সপ্তাহের মাঝে এলে মাথা পিছু ৯০০র বেশি আপনাদের কিছু দিতে হবে না। কিন্তু শনি-রবি'টাই তো আমাদের ব্যবসার সময়। ওই সময় এতজন এলে তো আমরা হোটেলের এমনি আবাসিকদের কোন পরিষেবা দিতে পারব না। তাই গোটা হোটেলটাই আপনাদের নিতে হবে। ভাড়া বেশি নয়, মাত্র ১৪হাজার।" 


সপ্তাহের মাঝে, কি করে যাই? আপিসে তালা মেরে? আগামী কয়েক মাসের মধ্যে সপ্তাহের মাঝে একটাও ছুটি পড়েনি কি? দেখা গেল এমন দুটি দিন আছে,যার একটিতে পড়েছে মহরম, অন্যটি স্বাধীনতা দিবস। তাহলে উপায়? 


আরো কয়েকটি হোটেল দেখা হল আশেপাশে, এমনকি মিশনেও কথা বললাম আমরা। সর্বত্র আগুন দাম। মাথা পিছু চাঁদা ১৩০০/১৫০০ পড়ে যাচ্ছে। এত টাকা চাঁদা দিয়ে কেউ কি আদৌ যাবে? শুভদীপ্ত গম্ভীর ভাবে মাথা নেড়ে বলে, "না ম্যাডাম। কেউ যাবে নি। চাঁদা হাজার টাকা বা তার নীচে রাখলে ভালো হয়।" শুভাশীষ বলে, " ম্যাডাম দীঘাতেই করুন। সস্তা হবে।" 


খুঁজে পেতে এক সরকারী অতিথিশালায় যোগাযোগ করলাম আমরা, " ভাই, শুধু যাব, খাব আর চলে আসব। পাচক আমরাই নিয়ে যাব, নিজেরাই রান্না করে খাবো, আপনাদের ওপর কোন চাপ পড়বে না। আমাদের লাগবে বলতে ডাইনিং হল আর একটা দুটো ঘর।" ছোটখাট যে অধিকর্তার সাথে কথা হল, তিনি আশ্বস্ত করলেন, হয়ে যাবে। টাকাপয়সা কিছু লাগবে না। 


আমরাও পূর্ণোদ্যমে নেমে পড়লাম খাবার মেন্যু, পাচক, বাজার ইত্যাদি নিয়ে। মাঝে দিন কয়েকের ছুটি নিয়ে লাদাখ যাওয়া, ফিরে এসেই পিকনিক। সব ব্যবস্থা করে, ছুটিতে গেলাম আমি। যেদিন বিমানে উঠব,তার আগের রাতে বার্তা পাঠালেন মাননীয় আধিকারিক মহোদয়, কি সব যেন প্রশাসনিক জটিলতায় আটকে গেছে সব। আমাদের কোনরূপ সহায়তা করতে ওনারা নাচার। 


কি সর্বনাশ, বাস বুক হয়ে গেছে যে। এক পয়সাও চাঁদা ওঠেনি এখনও, হক বাবু পকেট থেকে টাকা দিয়ে বুক করিয়ে ফেলেছেন বাস খানা। অনেক দরদস্তুর করে সস্তায় মারাত্বক পুষ্টিকর এক ঠাকুর (এখানে বলে পূজারী) বুক করে ফেলেছে বেদজ্যোতি। বুক করিয়ে ফেলেছে দুটি তাগড়াই ছাগল একটা নধর মুর্গি। যাঁরা মাটন খাবেন না, তাঁদের জন্য। ট্রলার ওয়ালার সাথে কথা হয়ে গেছে, ওই দিন সবথেকে বড় সবথেকে টাটকা পমফ্রেট মাছগুলো আমাদের দিতে হবে বলে। সেই মোতাবেক হিসেব করে চাঁদা ও ঠিক হয়ে গেছে। গ্রুপে জানিয়েও দেওয়া হয়েছে। এখন ক্যান্সেল করলে হয়ে নাকি। 


সব খুলে বললাম ও। অনেক পুরাণ বন্ধু, ভেবেছিলাম অনুনয়, বিনয়ে কাজ হবে। ফলাফল একই। বুঝতে পারছি, বন্ধু ও অসহায়। চাকরি মানেই যে চাকরগিরি। এদিকে রাত বাড়ছে, পরদিন ভোরেই রাজ্য ছাড়ব আমরা। অন্য কোথাও জায়গা দেখার অবকাশ আর নেই। কোন মতে অফিসিয়াল গ্রুপে জানিয়ে দিলাম, পিকনিক আপাতত বন্ধ। মুষড়ে পড়া বউকে আদর করে আশ্বস্ত করে শৌভিক, " কেন ঢেউসাগর আছে তো।" 


মিলেনিয়াম পার্কের মতই ঢেউসাগর একটা বিনোদন মূলক পার্ক। সমুদ্রের একদম ধারে। বেশ কয়েকবার গেছি সেখানে শৌভিক এর সাথে। ওখানকার ফুড কোর্টে দারুণ কোল্ড কফি উইথ আইসক্রিম পাওয়া যায়। তাই বলে পিকনিক? বড় ভিড় হয় যে। ঘুরে আবার মেসেজ করি গ্রুপে, ঢেউসাগরে হতে পারে কি? আমি তো থাকছি না, তোমরা একটু দেখবে? 


আমার অনুপস্থিতিতে সত্যিই সবটা ঘুরে দেখেন হকবাবু আর বেদজ্যোতি। কথা বলে ফুড কোর্টের সাথে, শুধু খেতে ভাড়া দিবে নাকি তোমরা? রান্না বাপু আমাদের বুক করা পূজারীই করবে। খুঁজে পেতে একটা হোটেল ও বার করে ওরা, সাধ্যের মধ্যে পাওয়া যায় ঘর। সবকিছু হয়ে যাবার পর আবার প্রশাসনিক জটিলতায় ধাক্কা খাই আমরা। দিন ঠিক করার সময় খেয়াল ছিল না, পরের দিন রথ যে। অনেক বাধা বিঘ্ন কাটিয়ে অবশেষে দিন দুয়েক আগে পাকা হয়েছে পিকনিক। 


টিং করে মেসেজ আসে, হক বাবু লিখেছেন, "আমরা নাচিন্দা মন্দির ছাড়িয়েছি ম্যাডাম।" মিনিট দশেকের মধ্যেই এসে যাবে রূপশ্রী বাইপাস এসে পড়বে বাসটা। এবার আমার বাসে ওঠার পালা। হে ঈশ্বর দিনটা যেন ভালোয় ভালোয় কেটে যায়। সবাই যেন চূড়ান্ত উপভোগ করতে পারে আর হ্যাঁ, দিনান্তে সবাইকে যেন তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারি।



অনির ডাইরি ৫ই জুলাই, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



"মা, মা"। মুঠো ফোনের ওপারেই শ্রীমতী তুত্তুরী একজোড়া জ্বলজ্বলে চোখ। আপিস থেকে ফিরে, গোটা ছয়েক বীজ গণিত আর গোটা তিরিশেক ভয়েস চেঞ্জ করতে দিয়ে সবে নেটফ্লিক্সটা খুলেছিলাম, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, " বলো মা।" তিনি একখান জাবদা ইতিহাস বই আমায় ধরিয়ে বলেন, অ্যাংলো ফেঞ্চ রাইভালরি ইন কার্ণাটিক'টা একটু বুঝিয়ে দাও তো। কাল স্যার টেস্ট নেবেন ক্লাসে।" 


ধড়মড় করে উঠে বসি, " অ্যা? আর সেটা তুই আমায় এখন বলছিস? ক্লাসে এই চ্যাপ্টারটা পড়ানো হয়ে গেছে? তিনি নৈর্ব্যক্তিক ভাবে নাক চুলকে বললেন, " হয়ে গেছে হয়তো।" অতঃপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে, " আমি সেদিন যাইনি হয়তো। তুমি একটু রেডি করে দাও।" 


বাঃ কি সরল সমাধান। দাক্ষিণাত্যে ইঙ্গ ফরাসী বৈরিতার বিন্দুমাত্র যার মনে নেই, তাকে কিনা সেই চ্যাপ্টারটা পড়ে, বুঝে, পড়িয়ে মুখস্থ করিয়ে দিতে হবে। সাধে বলে, মা হওয়া কি মুখের কথা ! এদিক তাকিয়ে বিস্তর মাথা চুলকে দ্বারস্থ হলাম কন্যার পিতার। " ওগো একটু পড়িয়ে দাও না মেয়েটাকে।" 


প্রসঙ্গত শ্রীমতী তুত্তুরীর কোন গৃহ শিক্ষক নাই। সব বিষয় আমিই পড়াই, ইংরেজি আর ইতিহাসের উত্তর গুলি শৌভিক দেখে দেয় সময় মত। সেই অর্থে এটা তো ওরই পড়ানোর কথা। বেশ অনেকদিন পর আজ মোটামুটি ভদ্র সভ্য সময়ে বাড়ি ফিরেছে শৌভিক, এক কাপ কালো কফি খেয়ে, খানিক গড়িয়ে নিয়ে তিনি আপাতত হাঁটতে বেরোচ্ছেন। এমন সময় ইঙ্গ ফরাসী বৈরিতা বা কন্যার ক্লাস টেস্ট নিয়ে যে তিনি বিন্দুমাত্র ভাবিত নন, সেটা তিনি সুস্পষ্ট ভাবে বুঝিয়েই গেলেন। 


পড়ে রইলাম আমরা মা আর মেয়ে। আমি যে কেন এই ভাবে কেটে পড়তে পারি না, বিড়বিড় করতে করতে বই খুললাম। শুরু হল পড়ানো, " বুঝলি বাবু, সেই যে ভাস্কো দা গামা -", বলে ঢোঁক গিলি আমি, ভ্রু কুঁচকে তুত্তুরী বলে, " তিনি তো পর্তুগালের লোক ছিলেন" । ধড়াম করে বই বন্ধ করে বলি, " ওরকম করলে পড়াবই না। যা বাপের কাছে যা -"। 

 

ক্লাস টেস্টের নাম বাবাজী এবং মা ছাড়া গতি নেই, বুঝে ইশারায় মুখে চাবি লাগায় তুত্তুরী। আমি আবার শুরু করি, " তিনি তো এসে নামলেন কালিকটে, ব্যাস ইউরোপ চিনে গেল ভারতে আসার পথ। পর্তুগিজদের পিছু পিছু ডাচ, ফ্রেঞ্চ, দিনেমার, ব্রিটিশ সবাই একে একে এসে পৌঁছাল আমাদের দেশে। আচ্ছা তোকে সেই গল্পটা বলেছি -"?


 নড়ে চড়ে বসে তুত্তুরী, "কোন গল্প?" সেই যে আমার ঠাকুমার মুখে শোনা গল্পটা। জুত করে বসে বলি, তাহলে শোন, আমার ঠাকুমার পিতামহের নাম ছিল বেণীমাধব মুখার্জি। ধন্য স্মৃতিশক্তি ছিল ওনার। শ্রুতিধর যাকে বলে আর কি। একবার হয়েছে কি, উনি গঙ্গা স্নানে গেছেন, গিয়ে দেখেন, একটা ডাচ আর একটা দিনেমারের মধ্যে প্রচণ্ড ঝগড়া চলছে। দুজনেই উজাড় করে দিচ্ছে যার যার মাতৃ ভাষার অমূল্য রতন। ঝগড়া আর বেশী ক্ষণ মৌখিক রইল না, অচীরেই শুরু হল হাতাহাতি। দুটো লাল মুখো মারামারি করছে দেখে ছুটে এল গোরা পল্টন। ধরে নিয়ে গেল দুটোকেই। আদালতে কেস উঠল। বেণীমাধব মুখুজ্জে সেযুগে মধ্য হাওড়ার বেশ গণ্য মান্য ব্যক্তি ছিলেন। সাক্ষী হিসেবে ডাক পড়ল ওনার। উনি গিয়ে এজলাসে হুবহু বলে দিলেন, কে কাকে কি বলেছে এবং বললেন ডাচ এবং দিনেমার ভাষায়। জজ সাহেব তো হতবাক, বললেন, "বাবু, তুমি এদের ভাষা জানো?" জবাবে উনি বললেন, "না ধর্মাবতার। আমি শুধু এটা জানি, যে সেদিন কে কি বলেছিল।"


আবার ইতিহাসে ফিরি আমরা, তো যা বলছিলাম, সবাই এলো তো, কিন্তু এল কেন? তুত্তুরীর ওষ্ঠাধরের মধ্যে সামান্য ফাঁক হল, "ব্যবসা?" একদম, হাঁফ ছেড়ে বলি। এই তো সব বুঝে গেছিস। বাকিটা রিডিং পড়ে নিলেই পারবি। চোখ গোল গোল করে ধমকায় তুত্তুরী, "পড়াও।" 


ওই আর কি, আম্বানি আর আদানি কেস। কে একচেটিয়া ব্যবসা করবে তাই নিয়েই যত ক্যাওস বুঝলি কি না। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি না ফরাসী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। বাকি যারা ছিল, সব আপ্পুলিশ, বুঝলি কি না। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্থাপিত হয়েছিল সেই ১৬০০ সালে। তখন ইংল্যান্ডের রাণী ছিলেন প্রথম এলিজাবেথ। হঠাৎ কি যেন মনে পড়ে যায়, এক গাল হেসে বলি, "এই  জানিস, এই এলিজাবেথ কে ছিলেন?" 

শ্রীমতী তুত্তুরী গম্ভীর মুখে ভ্রু দিয়ে ইশারা করে বইয়ের দিকে, মুখে বলে, " জানি, অষ্টম হেনরির মেয়ে ছিলেন। মা অ্যান বোলেন।" হাসিটা অর্ধেক গিলে আবার কিছু বলতে যাই, হাত দেখিয়ে থামিয়ে দেন শ্রীমতী, " জানি জানি অষ্টম হেনরীর ছটা বউ ছিল। যার মধ্যে দুজনের উনি গর্দান নেন। একজন সন্তান প্রসব করতে গিয়ে রক্তক্ষরণে মারা যান। একজনকে নির্বাসন দেন। একজনকে বোন বলে ঘোষণা করেন ইত্যাদি ইত্যাদি।  " বেশ কিছু বছর আগে অষ্টম হেনরিকে নিয়ে নির্মিত, "টিউডর" বলে একটি ওয়েব সিরিজ দেখেছিলাম। এমন বর্ণময় চরিত্র ছিল লোকটার যে প্রতি এপিসোড শেষেই মেয়েকে গল্প শোনাতাম আজ কি দেখলাম। তারই প্রতিদান পেলাম। 


চিরতা চিবানো মুখে পুনরায় ইংল্যান্ডে প্রবেশ করি, স্যার টমাস রো'র সাথে ১৬১৫ সালে ভারতে আসি। তখন দিল্লীর সিংহাসনে আসীন বাদশাহ জাহাঙ্গীর। উইলিয়াম ডালরিমপ্লের "অ্যানার্কি"র কয়েকটা অনুচ্ছেদ ভেসে ওঠে চোখের সামনে, ভেসে ওঠে বইয়ে পড়া জাহাঙ্গীরের অতুল ঐশ্বর্যের কথা। কেমন করে স্যার টমাস রো'কে  নাকে দড়ি বেঁধে ঘুরিয়েছিলেন ভারত সম্রাট। শেষে দয়া করে ছুঁড়ে দেন বাণিজ্যের অধিকার। 

বই মনে করায়, নিঃশুল্ক বাণিজ্যের অধিকার পেতে গোরাদের লেগেছিল আরো ৭৫ বছর। ভারতের সিংহাসনে তখন জাহাঙ্গীরের সুযোগ্য পৌত্র আওরঙ্গজেব।  তবে সে সুবিধা সীমাবদ্ধ ছিল বঙ্গদেশের চার দেওয়ালের মধ্যে। বঙ্গ- বিহার - উড়িষ্যায় নিঃশুল্ক বাণিজ্যের ফারমান দিলেন বাদশাহ ফারুকশিয়ার। 


ততোদিনে ব্রিটিশদের শক্তপোক্ত উপনিবেশ গড়ে উঠেছে মাদ্রাজে। ১৬৮৮ সালে পর্তুগালের রাজকুমারী ক্যাথরিন ব্রিগ্যাঞ্জাকে বিয়ে করে মুম্বাই যৌতুক পেয়েছেন ইংল্যান্ডের রাজা। রাজার থেকে  বছরে মাত্র ১০ পাউন্ড ভাড়ায় তার স্বত্ত্ব পেয়েছে কোম্পানি। ১৬৯০ এ ভিত্তি স্থাপন হয়েছে আমাদের সাধের কলকাতার। 


ব্রিটিশরা যখন এতটা এগিয়ে গেছে, হঠাৎ এসে উদয় হল ফরাসীরা। ফরাসী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্থাপিতই হল ১৬৬৪ সালে। বলতে বলতে হঠাৎ খেয়াল হয়, " এই বাবু, সবাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কেন খুলছে বলতো?" তুত্তুরীর জবাব পেয়ে চুপসে যাই, আজকালকার বাচ্ছা গুলো কেন যে এত কিছু জানে - সব এই আপদ গুগলের দোষ। 


মঞ্চে প্রবেশ করেন চন্দননগরের বড়সাহেব। কে বলুন তো? ডুপ্লে মশাই, যোশেফ ফ্রাঁসোয়া ডুপ্লে। এই একটি লোকই তো খেলা জমিয়ে দিয়েছিল। ইউরোপে বাঁধল অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকারের যুদ্ধ, ভারতেও ইংরেজদের উদোম পিটিয়ে মাদ্রাজ তথা ব্রিটিশদের ফোর্ট জর্জ কেল্লা দখল করে নিল ডুপ্লে আর তার দলবল। ইংরেজরা আর কি করে, কাঁদতে কাঁদতে  গিয়ে পড়ল, কর্নাটকের নবাব আনোয়ারুদ্দিনের পায়ে। 


নবাব ও তেমনি, তিনি নির্দেশ পাঠালেন, ওদের দুর্গ ওদের ফেরৎ দাও। বয়েই গেছে, কানেই তুললে না ডুপ্লে সাহেব। ক্ষুব্ধ নবাব তখন ফরাসীদের শায়েস্তা করতে পাঠালেন এক বিরাট সেনা দল।  ডুপ্লে আর তার দলবলের কাছে গোহারান হেরে গেল নবাবের সুশিক্ষিত সেনা দল। ব্যাস আর একটু, আর একটু হলেই হয়তো বদলে যেত পরাধীন ভারতের ইতিহাস, কিন্তু - 


ওই যে বলে না রাখে হরি, মারে কে, ঠিক সেই সময়ই ইউরোপে বন্ধ হয়ে গেল যুদ্ধ। দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হল কি যেন জটিল নামের এক চুক্তি। বিনা যুদ্ধে, আপদ ব্রিটিশদের মাদ্রাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হল ডুপ্লে আর তাঁর দলবল। 

 

ইউরোপের ছড়ি খেয়ে যতই এরা ভাব করে নেবার নাটক করুক না কেন, এত বৈরিতা, এত বিষ কি ওমন এক চুক্তিতে যায় নাকি? বছর ঘুরল না লেগে গেল, দ্বিতীয় কর্নাটকের যুদ্ধ। এমনিতেই অবিশ্বাস আর ক্ষোভ ছিলই একে অপরের প্রতি, তারওপর হায়দ্রাবাদ আর কর্নাটকের শাসকদের আভ্যন্তরীন কোন্দল, যাকে বলে,

 "নারদ নারদ খ্যাংরা কাঠি,

 লেগে যা নারদ ঝটাপটি।"

 হাসতে হাসতে বিছানায় শুয়ে পড়ে তুত্তুরী।


ধমকে বলি, হাসিস না শোন। এদিকে হায়দ্রাবাদে নিজামের ছেলে বনাম নাতি, ওদিকে কর্নাটকের নবাব আনোয়ারুদ্দিন বনাম চাঁদ সাহেব।এক তরফে ব্রিটিশ, অন্য তরফে ফরাসী। সে কি যুদ্ধ। যুদ্ধের পর যুদ্ধ। যুদ্ধ আর সীমাবদ্ধ থাকে না ইতিহাস বইয়ের পাতায়, নেমে আসে বর্তমানে। লাঠালাঠি যুদ্ধ হয়, পেন পেন্সিল, বালিশ পাশবালিশ দিয়ে। ক্রমেই পিছিয়ে পড়তে থাকে লাল মুখো গোরার দল। তুত্তুরী আপত্তি তোলে, "ফরাসীরাও কিন্তু লাল মুখো গোরাই ছিল মা।" ক্ষণিক থামি আমি, তাও বটে। উল্টো দিক থেকে মঞ্চে প্রবেশ করেন মির জাফরের হবু দোসর রবার্ট ক্লাইভ, বইয়ের পাতায় ক্লাইভের পুঁচকে তৈল চিত্র দেখে বিমোহিত হয়ে যায় তুত্তুরী, " ওমা কি কিউট দেখতে -"। আর আমায় থামায় কে? আমি বাঙালি, আড়াইশ বছর আগে যে ভুল করেছি, আর সে পথে হাঁটতে নারাজ। ক্লাইভ নয়তো, ক্লাইভ পন্থীই সই, পলাশীর প্রান্তর না হোক, কাঁথিই সই -। 


  হাঁটা শেষ করে ফিরে এসে নেহাৎ শৌভিক জাপটে ধরে নিরস্ত করল তাই, না হলে নির্ঘাত বদলে যেত পরাধীন ভারতের ইতিহাস। মাঝখান থেকে রেগে মেগে বইটাই কেড়ে নিল তুত্তুরী, "অনেক হয়েছে মা,তোমায় আর আমাকে ইতিহাস পড়াতে হবে না। অন্তত যে চ্যাপ্টারে যুদ্ধ আছে, সেই চ্যাপ্টার তো হরগিজ আর পড়ছি না তোমার কাছে।" রাষ্ট্র ভাষায় কি যেন বলে, ভালোর দিনই নেই মাইরি।

Friday 7 June 2024

অনির ডাইরি জুন, ২০২৪

 অনির ডাইরি ২৯শে জুন, ২০২৪

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 


পাঁজা পাঁজা ডেথ কেস নিয়ে বসেছে মুকুল। নির্বাচনী আদর্শ আচরণবিধির গুঁতোয় চার মাস কিছু ছাড়তে পারিনি আমরা। এবার কাজ গুটানোর পালা। সত্যি কথা বলতে কি, এই কাজটা করতে আমার একটুও ভালো লাগে না। প্রতিনিয়ত এত মানুষ মরে কেন? আমি একটা প্যাটার্ন দেখেছি, অধিকাংশ ডেথ কেসেই মৃতের বয়স হয় ৪২/৪৪ নয় ৫৭/৫৯। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, কিন্তু উপরিউক্ত চারটি বয়স যেন বড় ভয়াবহ। দুর্ঘটনা জনিত মৃত্যুর অবশ্য কোন বয়স নেই। একটু আগেই একটা ২৬ বছরের ছেলের কেস ছাড়লাম। নাইতে নেমে ডুবে মৃত্যু। 


স্বাভাবিক মৃত্যুতে ৫০ হাজার, দুর্ঘটনা জনিত মৃত্যুতে ২ লাখ ছাড়তে হয়। এত টাকার ব্যাপার, বিভিন্ন ধাপে খুঁটিয়ে দেখতে হয় সব। ছেলেটির ক্ষেত্রেও দেখতে হল। পুলিশ কি রিপোর্ট দিয়েছে, খুন টুন নয়তো? পেটে মদ পাওয়া যায়নি তো? অন্যান্য জীবন বীমার মত এখানেও আত্মহত্যা করলে অনুদান মেলে না। মেলে না মদ খেয়ে রেষারেষি করে মারা গেলে বা কোন দাঙ্গা হাঙ্গামায় প্রাণ হারালে। মস্ত পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট খুলে খুঁটিয়ে পড়ি, মুকুল আর আমি। ডাক্তারি পরিভাষা অধিকাংশই বোধগম্য হয় না। ভাগ্যে গুগল আছে। একটু আগেই তো একটা ডেথ কেস পেয়েছিলাম, যাতে কজ অব ডেথ ডাক্তার বাবু লিখেছেন AMI। 


লেঃ মুকুল আর লেঃ আমি, AMI মানে কি রে বাবা? ভাগ্যে গুগল বলল Acute myocardial infarction। এই শব্দ বন্ধ আমাদের পরিচিত। ডাক্তার বাবুর পরিচয় পড়তে গিয়ে দেখি, তিনি এমবিবিএস। মুকুলকে বলি, বুঝলে মুকুল, এলোপ্যাথি ডাক্তার, তাই এমন ভাবে লিখেছেন। 


হাসপাতালে মৃত্যু ছাড়া, এলোপ্যাথি ডাক্তার বাবুদের ডেথ সার্টিফিকেট আমরা পাই কোথায়? অধিকাংশই বিএসসি, ডিএমএস। অর্থাৎ হোমিওপ্যাথ ডাক্তার বাবু। মাঝে মধ্যে দুয়েক জন আয়ুর্বেদিক ডাক্তার বাবুও পেয়ে যাই আমরা। এনাদের সকলেই কমবেশী লেখেন কার্ডিও রেসপিরেটরি ফেলিওর বা সিভিএ।কেউ কেউ স্ট্রোক ও লেখেন। স্ট্রোকটাই যে CVA এটা বুঝতে আমার বেশ কিছু দিন সময় লেগেছিল। রেনাল ফেলিওর ও পাই। মেয়েদের ক্ষেত্রে ব্রেস্ট ক্যান্সার বা জরায়ু মুখ ক্যান্সার। 


কিছু দিন আগে এমনি একটি মেয়ের ডেথ কেস এসেছিল, খুবই অল্প বয়স। চেক করতে সময় লাগছিল বলে বরটি মাঝে মধ্যেই বন্ধু বান্ধব জুটিয়ে হম্বিতম্বি করে যেত ব্লক অফিসে এসে। একদিন তো ইন্সপেক্টর সাহেবকে বলেই ফেলল, টাকাটা পেলে নতুন করে বিয়ে করে। আমাদের গাফিলতিতে ছেলেটির ঘর বসছে না। ধমকিত, চমকিত হয়ে মুখ লাল করে আমার ঘরে এসে বসেছিল ইন্সপেক্টর সাহেব। ঘড়িতে বোধহয় চারটে বাজছিল, শীতের বেলা, সূর্যি মামা পাটে বসছিলেন, দুজনে নীরবে পোর্টাল খুলে মেয়েটির পাশবইয়ের ছবিটা দেখছিলাম। অল্প বয়সী হাসিখুশি একটা মেয়ে - একবার হারিয়ে গেলে কেউ মনে রাখে না। কিচ্ছু মনে রাখে না।


আর একটি কেস পেয়েছিলাম জলে ডুবে মৃত্যু। সংশ্লিষ্ট ইন্সপেক্টর সাহেব কিছুতেই ছাড়ছিলেন না কেসটা। বেশ কিছুদিন আটকে রেখে খুঁটিয়ে সব দেখছিলেন, নানা নথি আনতে বলছিলেন। পঞ্চায়েত প্রধানকে নিয়ে মেয়েটির বর আর শ্বশুর মশাই এসেছিলেন আমার কাছে। শত অনুরোধেও নাক গলাইনি আমি। বলেছিলাম আটকে যখন রেখেছে নিশ্চই কোন কারণ আছে। আমার ইন্সপেক্টরদের নাক বড় তীক্ষ্ণ। কিভাবে যে এরা ঘাপলার গন্ধ পায়। কিছুদিন আগে বেদজ্যোতি যেমন দুটি নির্ভেজাল সুন্দর আধার কার্ডকে জাল বলে পাকড়াও করেছিল। আমার সামনে যখন প্রমাণ সমেত নিয়ে এল কাগজ গুলো, আমি হতবাক। এরা তো আসলকে হার মানায় রে ভাই। এত প্রতিভা লোকগুলো রাখে কোথায়। আমার বিশ্বাস আর ইন্সপেক্টর সাহেবের সন্দেহকে সত্য প্রমাণ করে,ধরা পড়ে, মেয়েটি জলে ডুবে মারা যায়নি। মেরে জলে ফেলে দেওয়া হয়। 


এতদিন ধরে এই কাজ করছি, তাও কেন যে এত মন খারাপ হয় কাজটা করতে। আজ যেন দুর্ঘটনা জনিত মৃত্যুরই দিন, পরপর দুটি ছেলের কেস এল, পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু। একই জায়গায়। দুটি দুর্ঘটনাই আমাদের আপিসের স্বল্প দূরে রামতারকে ঘটেছে। একজন রাত ১০টা ৫ এ হেঁটে বাড়ি ফিরছিল,অন্য জন সকাল ১১টা নাগাদ বাস ধরবে বলে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিল। দুজনকেই মোটর সাইকেল ধাক্কা মেরে চলে যায়। দুজনেরই স্ত্রী আবেদন করেছে। সুন্দর হাতে লেখা বা টাইপ করা চিঠি, স্বামীর মৃত্যুতে শোকাহত স্ত্রী কেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আবেদন করতে পারেনি। তলায় সদ্য স্বাক্ষরের মত ইঁকড়িবিকড়ি করে নাম সই করেছে হতভাগ্য স্ত্রীরা। 


পেটের দায়ে কি যে জঘন্য কাজ করি। এত মন খারাপ হয়ে যায় এই কাজটা করতে। কিছুদিন আগে আমার এক বেবি ইন্সপেক্টর বলছিল, " আপনি শুধু পোর্টালে দেখে মন কষ্টে ভোগেন, আমাদের অবস্থাটা ভাবুন একবার ম্যাডাম। আমাদের এই কেসগুলোর এনকোয়ারি করতে হয় প্রত্যক্ষ ভাবে। কিছুদিন আগে এক ভদ্রমহিলা এসেছিলেন তাঁর ছেলের মৃত্যুর কেস ফাইল করতে,এত কাঁদছিলেন, এমন ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলেন ম্যাডাম, যে বিশ্বাস করুন মনে হচ্ছিল আমি অফিস ছেড়ে কোথাও পালিয়ে যাই।"


আজ অবশ্য একটানা ডেথ কেস ছাড়তে পারছি না আমরা। মাঝে মাঝেই এসে হামলা করছেন বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা।সপ্তাহ দুয়েক ছুটি নিয়েছিলাম কিনা। প্রথমে ঢুকলেন শাসক দলের শ্রমিক সংগঠনের এক নেতা। কম্পিউটারের দিকে তাকিয়েই বললাম, বলুন অমুক বাবু,কি সমস্যা? তিনি যুৎ করে বসে বললেন, " আগে বলুন ভালো আছেন? স্যার (অর্থাৎ শৌভিক) ভালো আছেন? বেবি (অর্থাৎ শ্রীমতী তুত্তুরী) ভালো আছে?" দায়সারা ভাবে জবাব দেবার পর প্রশ্নবাণ ভেসে এল, " বাবা মা? শ্বশুর শাশুড়ি?" এতক্ষণ ধরে হুঁ হুঁ করে জবাব দিতে থাকা আমি, এবার চেয়ার সমেত ঘুরে বসি। " ধুৎ শ্বশুর মশাই মারা গেছেন জানেন না?" 


চেয়ার থেকে প্রায় হড়কে পড়েন ভদ্রলোক, "অ্যাঁ! ওমা সেকি? কবে? কেন? কিভাবে? হায় হায় স্যার পিতৃহীন হয়ে গেলেন গো।" কাজ থামিয়ে আবার ঘুরে বসি ওনার দিকে, মুকুল এক মনে ডেথ কেসের পাতা উল্টাচ্ছে, মুখ লাল, হয়তো গরমে। সেদিকে আঙুল দেখিয়ে বলি, দেখছেন আপনাদের ব্লকের ইন্সপেক্টর সাহেব কেমন রাগে আগুন হয়ে যাচ্ছেন? ডেথ কেস না ছেড়ে শ্বশুর মশাইয়ের কথা বলার এটা কি সময় বলুন তো?" ভদ্রলোক থতমত খেয়ে গেলেন। পরিস্থিতি সামলাতে লঘু গলায় বলি, " আপনি আমার সাথে খোশ গল্প করতে এয়েছেন নাকি কোন কাজ নিয়ে এসেছেন? সেটা তো বলুন।" 


ভদ্রলোক যখন কাজের কথা তোলেন, বুঝতে পারি, কথায় দম আছে। সমস্যাটা ঠিকই ধরেছেন। সৌরভকে ডেকে পাঠাই, সবাই মিলে আলোচনা করে,মহানগরে ফোন করি। সদর আপিসের শীলমোহর অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সে মৌখিক হলেও চলবে। শীলমোহর পেয়েছি কি পাইনি, দরজা খুলে মুখ গলায় চঞ্চল।" ম্যাডাম অমুক ট্রেড ইউনিয়নের অমুক বাবু, তমুক ট্রেড ইউনিয়নের তমুক বাবু, ওদের কার্তিক বাবু, এদের গৌর বাবু সবাই আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন। ওনারা বলছেন একসাথে ঢুকতে দিলেও চলবে।" 


হেসে ফেলি সজোরে। চেম্বারে বসে থাকা শাসক দলের নেতাটির দিকে তাকিয়ে বলি, " দেখছেন তো, এতক্ষণ আমার ঘরে থাকলে কি হয়। অন্য ট্রেড ইউনিয়ন গুলো ভেবে নেয় সব সুবিধে বুঝি আমি আপনাকেই দিয়ে দিলাম।" দল বেঁধে ঘরে ঢোকা বর্ষীয়ান শ্রমিক নেতারা সমস্বরে প্রতিবাদ জানান, "না ম্যাডাম। আমাদের মধ্যে ওমন কোন ব্যাপার নেই। আপনি কথা বলছেন দেখে আমরা ভাবলাম, আমাদের কথা গুলোও যদি এট্টু শোনেন।" শাসক দলের নেতাটিও সহমত প্রকাশ করেন। 


আজব আপিস মাইরি আমার। এই আপিসে যাঁরা আসেন, রাজনৈতিক বৈরিতার আলখাল্লা যেন বাইরে খুলে আসেন। জনৈক বামপন্থী সংগঠনের নেতার পিছনে লাগি আমি, " আপনি যে বলেছিলেন বাংলা এবার লালে লাল হবে, তার কি হইল? ধুৎ মা লক্ষ্মীদের ওপর দোষ দিবেননি তো।" অপর নেতাকে কিছুদিন আগে চন্দ্রবোড়া সাপে কেটেছিল। তাঁর কুশল সংবাদ নিই আমি। ডেপুটেশন দেবার আগেই পরিস্থিতিকে ঘরোয়া বানিয়ে ফেলি আমি। এত বছর ল্যাবার গিরির কিছু তো সুফল আছে রে বাবা। 


মিনিট দশেকের মধ্যে সবাইকে বিদায় জানিয়ে পুনরায় ডেথ কেসে ফিরি আমি। আবার সেই মনখারাপ করা কাজ। প্রথম কেসটার ওপর মাউস রাখার আগেই ঘরে ঢুকে আসে সৌরভ আর নন্দন। সঙ্গে এক প্রৌঢ়। " ম্যাডাম এনার সদ্য পেনশন চালু হয়েছে। তেরো জনের নতুন পেনশন কেস কলকাতা অ্যাপ্রুভ করে পাঠিয়েছে আজ। ইনি তাঁদের অন্যতম। এনার আরো একটা পরিচয় আছে, ইনি ডিএম আপিসে জনৈক সাহেবের গাড়ি চালান। আমরা চাইছিলাম, আপনার হাত দিয়ে ওনার PPO (Pension Payment Order) টি দিতে।"


লাফিয়ে উঠি আমি, অভিনন্দন জানাই আমি। পোজ দিয়ে ছবি তুলি আমি, ভদ্রলোককে আগামী দিনগুলির জন্য অনেক শুভেচ্ছা জানাই আমি, তারপর খেয়াল হয়, " এই সৌরভ, এই নন্দন তোমরা আমার ছবি তুললে কেন? কাজ তো সব তোমরা করেছ বাবা। আর করেছে মহানগরে পরিবহন শ্রমিকদের বোর্ড। আমি কে? নিছক একটা দুটো সই আর ছবিটার গ্ল্যামার কসেন্ট বাড়ানো ছাড়া কি করেছি আমি?"


হিমভূমি থেকে অনির ডাইরি,২০শে জুন, ২০২৪

(পর্ব - ২) 

#অনিরডাইরি 


লাদাখ ভ্রমণের কথা ভাবলেই প্রথম যেটা মাথায় আসে, তা হল শ্বাসকষ্ট হবে না তো? শ্বাস কষ্ট হওয়াটাই তো স্বাভাবিক, আমরা বাঙালি, মোটামুটি সমুদ্র সমতলের বাসিন্দা, প্রতি প্রশ্বাসে ১০০% অক্সিজেন অণু নিতে অভ্যস্ত। শ্রীনগর বা মানালিতে সেটা কমে হয় ৭৮-৮৩ শতাংশ। খুব শ্বাসকষ্ট বা COPD তে ভোগা মানুষ ছাড়া, ওইটুকু তফাৎ আমরা বুঝতেও পারি না। লেহ তে কিন্তু ওটাই নেমে দাঁড়ায় ৬৫% এ। অর্থাৎ আপনি শ্বাস তো নিচ্ছেন, কিন্তু অক্সিজেন পাচ্ছেন অর্ধেকের একটু বেশি। কেউ যদি সটান ১০০ থেকে ৬৫ তে এসে হাজির হন, তাঁর ফুসফুস এই ফারাকটা মেটাতে অক্ষম হয়। তখনই শুরু হয় শ্বাস কষ্ট। 


সবার যে হয় তাও নয়, তবুও বর্তমানে সরকার নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন যে আপনি যদি বিমান পথে সটান লেহতে এসে নামেন আপনাকে অন্তত দুদিন লেহতেই থাকতে হবে। আমরা সড়ক পথে শ্রীনগর থেকে এসেছি, পথে কার্গিল এ একরাত কাটিয়েছি, তাও শৌভিক তিন রাত দুদিন বরাদ্দ করেছিল লেহ এর জন্য। 


লেহ এর প্রকৃতি এতটাই সুন্দর যে আপনি সত্যিই হোটেলে বসে জানলা দিয়ে নীল আকাশ  আর দূরের তুষার আবৃত পর্বত চূড়া দেখেই দিন কাটিয়ে দিতে পারেন। আকাশ যে কি অসম্ভব নীল এখানে বলে বোঝাতে পারব না। খালি চোখে অনেক অনেক দূর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পাবেন। এখানে রাত আটটা অবধি ঝকঝকে দিনের আলো থাকে। আবার ভোর পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার মধ্যে আলো ফুটে যায়। দূরের পাহাড় চূড়ায় ঝিলিক মারে রোদ। রাতে টলটলে আকাশে সোনার থালার মত চাঁদ ওঠে , ঝাঁপিয়ে পড়ে জোছনা।


সবাই লাদাখের শ্বাস কষ্ট নিয়ে সাবধান করে, ঠাণ্ডা নিয়ে সতর্ক করে, কিন্তু কেউ লাদাখের আলোর কথা বলে না। বাপরে কি চড়া আলো, লেহ তে প্রবেশ করার সাথে সাথে সানস্ক্রিন আর রোদ চশমা বাধ্যতামূলক। রোদ চশমার সাধ্য কি বশ মানায় এই আলোকে। চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়ে। 


স্থানীয় লোকজন, হোটেল কর্মচারী, ভাড়া গাড়ির ড্রাইভার সবাই আপনাকে সচেতন করতে থাকবে। অন্তত আমাদের তো করেছে, বলেছে জল খেতে থাকুন। এখানে তেষ্টা পায় না, তবুও কিছু ক্ষণ ছাড়া ছাড়া জল খান। হাইড্রেটেড থাকা ভীষণ জরুরী। বলেছে মাথায় পারলে ঘোমটার মত স্কার্ফ জড়ান, ফুল হাতা জামা কাপড় পরুন, শরীরের উন্মুক্ত অংশে দু আড়াই ঘণ্টা ছাড়া ছাড়া সানস্ক্রিন লাগান। এখানে রোদে আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মির পরিমাণ সাংঘাতিক বেশি। স্থানীয়দের কিছু হয় না, কিন্তু আমাদের শহুরে আদুরে ত্বক পুড়িয়ে ফোস্কা ফেলে দিতে পারে। 


প্রকৃতি ছাড়া লেহতে দেখার মত বলতে, আছে বেশ অনেক গুলি বৌদ্ধবিহার যেমন অলচি, শে, স্ফীটুক, ফেয়াং, হেমিস, থিকসে, লিকির ইত্যাদি। আর আছে কিছু রাজপ্রাসাদ যেমন লেহ প্যালেস, স্টোক প্যালেস, জোরাবর ফোর্ট ইত্যাদি,  আছে সিন্ধু নদ, আছে নিম্মু যেখানে মিলিত হয়েছে সিন্ধু আর যাস্কার নদী। 


এখানকার বৌদ্ধ বিহার গুলি অধিকাংশই প্রাচীন,নির্মাণ কাল পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতক। প্রায় প্রতিটি বিহারের প্রার্থনা গৃহে আঁকা রয়েছে চোখ জুড়ানো সব ছবি। ছবি গুলির বয়স বিহারের বয়সের সমানই প্রায়।  অধিকাংশ বিহারেই ছবি তোলা নিষেধ। অলচিতে তো ক্যামেরা এমনকি মোবাইল নিয়েও প্রবেশ নিষিদ্ধ। লকারে রেখে যেতে হয়। যেখানে অনুমতি মেলে, সেখানেও প্রায়ান্ধকার প্রার্থনা গৃহে  টিমটিমে আলোয় ছবি তুলতে হয়। 


প্রভু অবলোকিতেশ্বরের ছবিটি তেমনিই ভাবে তোলা। অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্বের এক রূপ,যাঁর এগারোটা মুখ এবং সহস্র বাহু। তথাগত বুদ্ধ চলে গেছেন, মৈত্রেয় বুদ্ধ এখনও আসেননি, এই মুহূর্তে জগৎ ও জীবনের ভার বহন করে চলেছেন অবলোকিতেশ্বর। এগারোটা মাথার মধ্যে দশটা মাথা দিয়ে তিনি দশ দিকে নজর রেখে চলেছেন আর হাজার হাত দিয়ে ভক্তদের রক্ষা   করে চলেছেন। কথিত আছে, ভুবনের ভার গ্রহণ করার  পর ভক্তদের দুর্দশা দেখে অবলোকিতেশ্বরের মস্তক বিদীর্ণ হয়ে যায়। তাঁর মাথা ফেটে এগারো টুকরো হয়ে যায়। তখন অমিতাভ বুদ্ধ সেই এগারোটি টুকরোর প্রতিটি থেকে একটি করে মুখ বানিয়ে দেন। যাতে সব দিকে সমান ভাবে নজর রাখতে পারেন অবলোকিতেশ্বর। সাথে সাথে দেন সহস্র বাহু, যাতে হাজার হাতে ভক্তদের রক্ষা করতে পারেন অবলোকিতেশ্বর 🙏।



হিমভূমি থেকে অনির ডাইরি ১৮ই জুন, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


লাদাখের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর কার্গিল। শ্রীনগর থেকে যোজিলা পাস ধরে কার্গিল পৌঁছাতে গুগল ম্যাপ বলে সময় লাগবে ঘণ্টা পাঁচেকের আশেপাশে। পথে বাধ্যতামূকভাবে সোনমার্গে থামে গাড়ি, জিরো পয়েন্টে থামে গাড়ি। আপনি যেখানে চাইবেন সেখানেই থামে গাড়ি। আর থামে দ্রাসে। 


কার্গিল থেকে ৬৩ কিলোমিটার দূরে, দ্রাস একটি আপাত শান্ত, চোখ জুড়ানো সবুজ পাহাড় দিয়ে ঘেরা উপত্যকা। চকচকে ন্যাশনাল হাইওয়ের একদিকে রয়েছে হাতে গোনা কয়েকটা ঝুপড়ি টাইপের দোকান, এক ডজন পর্যটক হঠাৎ এসে হাজির হলেই উপচে পড়ে দোকান গুলো। খাবার বলতে চা, কফি, মোমো, চাউমিন, ম্যাগি। ভাত ও পাবেন, পাঞ্জাব তথা উত্তর ভারতের রীতি অনুসারে রাজমা চাওল, দহি চাওল ইত্যাদি। চানা বাটোরাও খাচ্ছিল বটে লোকজন।


এই পুঁচকে দোকানগুলোর উল্টো দিকে, রাজপথের অপর পারে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত গোলাপী বালি পাথরের এক স্মৃতি সৌধ, পোশাকী নাম, কার্গিল ওয়ার মেমোরিয়াল। ওখানে ঘুমিয়ে আছেন কার্গিল যুদ্ধের বীর সেনানী বৃন্দ। প্রবেশ অবাধ, তবে ঢুকতে গেলে ভারতীয়ত্বের প্রমাণ দেখানো আবশ্যিক। বিশাল গোলাপী তোরণ এর সামনে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল হাতে, মাথায় হেলমেট, চোখে কালো চশমা পরে দাঁড়িয়ে আছে জনা কয়েক সিপাহী। তাঁদের একজনকে প্রত্যেকের আধার কার্ড দেখাতে হয়, তবে মেলে প্রবেশের অনুমতি। প্রবেশের পূর্বে অপর জন বিস্তারিত ভাবে বলে দেন এই স্মৃতি সৌধের মাহাত্ম্য। 


সেপ্টেম্বর থেকে প্রবল ঠাণ্ডায় দুর্গম হয়ে পড়ে এই সব এলাকা। বরফের পুরু চাদরে ঢেকে যায় চরাচর। ঠাণ্ডার দাপট থেকে বাঁচতে এই সময় ভারতীয় এবং পাকিস্তানি আর্মি করত কি, দুর্গম কিছু পোস্ট ফাঁকা রেখে নেমে যেত নীচের আবাস যোগ্য ছাউনি গুলিতে। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলেই উভয়ে পুনরায় দখল করে নিত যার যার ছাউনি। সবটাই বিশ্বাস আর ভরসার ব্যাপার। তবুও এটাই হয়ে আসছিল আবহমান কাল ধরে। 


কিন্তু ওই যে বলে না, যুদ্ধে অনৈতিক কিছুই নাই। ১৯৯৯ সালে শীতের দাপট কমতে যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী দখল করতে গেল তাদের ফেলে আসা ছাউনি, দেখা গেল বিস্তৃর্ণ এলাকা ততোদিনে দখল করে বসে আছে পাকিস্তান আর্মি। দ্রাস, কার্গিল, বাটালিক, টুরটুক ইত্যাদি ততোদিনে পাকিস্তানের দখলে। কৌশলগত ভাবে প্রতিটা পোস্ট এমন ভাবে বানানো,যে বাইরে বা নীচে থেকে তার দখল নেওয়া যতটা কঠিন। আকাশ পথে বিমান হানা করেও তাদের হঠানো সহজ নয়।আর অনুপ্রবেশকারীরাও তো খালি হাতে আসেনি, এনেছে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, কামান, রকেট লঞ্চার আরো কত কি। দস্তুর মত তৈরি হয়েই এসেছে ওরা। 


মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে চূড়ান্ত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে কিভাবে দখলীকৃত এলাকা পুনর্দখল করে ভারত, ছত্রে ছত্রে তাই বর্ণিত রয়েছে স্মৃতি সৌধের প্রতিটি ইঞ্চি জুড়ে। একসাথে তিনটি অপারেশন শুরু হয়, বায়ু পথে ভারতীয় বায়ুসেনার অপারেশন সফেদ সাগর। মাত্র তিন মাসের মধ্যে পাক্কা ৫০০০ বার বিমান হানা দেয় ভারতীয় বায়ুসেনারা। লক্ষ্য ছিল গর্তে লুকিয়ে থাকা শত্রুকে খুঁচিয়ে বার করে আনা। জলপথে ভারতীয় নৌবাহিনী শুরু করে অপারেশন তলোয়ার। জলপথে পাকিস্তানের সাপ্লাই চেন কেটে দেয় ভারতীয় নেভি। এবার লড়াই মাটির ওপর। এবার পালা সম্মুখ সমরের। শুরু হয় ভারতীয় সৈন্য বাহিনীর অপারেশন বিজয়। যাতে শহীদ হন ৫৪৫ জন বীর সেনানী। যাঁদের একজনের জীবনী নিয়েই সম্প্রতি তৈরি হয়েছে সুপার হিট ফিল্ম শেরশাহ। আজ্ঞে হ্যাঁ, পরম বীর চক্র বিজেতা ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা। 


মুখ্য তোরণ থেকে বাঁধানো রাস্তা সোজা চলে গেছে দূরে প্রায় ১০০ফুট উঁচু ভারতীয় পতাকার দিকে। পথের দুদিকে কালো পাথরের সমাধি রয়েছে ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা সহ অন্যান্য সেনানায়ক বৃন্দের। রাখা আছে বফর্স কামান। যা কেনা নিয়ে দুর্নীতি বিতর্ক টলিয়ে দিয়েছিল তৎকালীন সরকারের গদি আবার কার্গিল যুদ্ধে যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর মূল ভরসা। 

 সুউচ্চ পতাকাটির ডান দিকে ক্যাপ্টেন মনোজ পাণ্ডে মিউজিয়াম আর বাম দিকে যুদ্ধে নিহত সৈন্যদের সমাধি ফলক। মিউজিয়াম ভর্তি সেদিনের ছবি। যুদ্ধে জেতার পর হাসি মুখে আসল বীরেরা, যুদ্ধে শহীদ বীরেরা, যুদ্ধে মৃত শত্রু পক্ষ, যুদ্ধে অস্ত্র সমর্পণ করা শত্রু। আর রাখা আছে শয়ে শয়ে গুলি, রাইফেল, পিস্তল, বন্দুক ইত্যাদি। যা উদ্ধার হয়েছিল শত্রুর কাছ থেকে। উদ্ধার হয়েছিল পাকিস্তানের সবুজ পতাকাও, যা আজও টাঙানো আছে এই মিউজিয়ামে, তবে উল্টো করে।


অনির ডাইরি ১৪ই জুন, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


অবশেষে "লাপাতা লেডিজ" দেখলাম। দেখতে দেখতে দেখতে আর পাঁচজন সোহাগী বউয়ের মত আমারও মনে এই প্রশ্ন জাগছিল, আচ্ছা সত্যিই যদি আমি কোনদিন হারিয়ে যাই, আমার বর ও কি -। থাকতে না পেরে প্রশ্নটা করেই ফেললাম, " হ্যাঁ গো, আমি যদি কোনদিন হারিয়ে -"। নাহ শেষ করিনি প্রশ্নটা। কারণ মাঝপথে মনে পড়ে গেল, সত্যিই তো হারিয়ে গিয়েছিলাম আমি। 


সে অনেক কাল আগের কথা। বাংলা তখনও লাল। আর জঙ্গলমহল একটু বেশি লাল। রাজনৈতিক পরিবর্তন মধ্যবিত্তের বিলাসী স্বপ্ন মাত্র। আমি সহ শ্রম কমিশনার হিসেবে খড়্গপুরে কর্মরত। আট নমাস হল বিয়ে হয়েছে। মেদিনীপুর অফিস তখনও তৈরি হয়নি। ১৫টি ব্লক আর ২টি মিউনিসিপ্যালিটি, অথচ মাত্র ৪ জন ইন্সপেক্টর। প্রত্যেকেরই আয়ু কয়েক মাস মাত্র। যুবা ইন্সপেক্টর বা কম্প্যুটর জানা ক্লার্ক তখন কল্পনারও অতীত । মাসে মাত্র দশ দিনের গাড়ি। ফলে অনেক হিসাব করে চলতে হত।  


খড়্গপুর আইআইটি তখন ঠিকা শ্রমিক অসন্তোষে জর্জরিত । প্রায়ই ত্রিপাক্ষিক মিটিং ডাকতে হত মহকুমা শাসকের চেম্বারে। যদিও এটা আমাদের এক্তিয়ার ভুক্ত ছিল না, কিন্তু বারংবার অনুরোধ করলেও কেন্দ্রীয় সরকারী লেবার এনফোর্সমেন্ট অফিসারের দেখা পাওয়া যেত না। শ্রমিক সংগঠন গুলি এমনিই জঙ্গী ছিল যে এই মিটিং মানেই গণ্ডগোল অনিবার্য। তৎকালীন মহকুমা শাসকের প্রবল ব্যক্তিত্বের ভয়ে শুধু হাতাহাতিটুকু হত না।


 সেদিনের মিটিং শেষ হতে হতে সন্ধ্যা ৬টা। ডিসেম্বর মাস, তেমনি জমিয়ে পড়েছে শীত। শৌভিক তখন বিডিও খড়্গপুর-২। খড়্গপুরের মাত্র দুটো স্টেশন পর মাদপুর নামক গ্রামে আমাদের লালনীল সংসার । আমার ফিরতে দেরী হলে প্রায় দিনই ও ছুঁতোনাতা করে এসডিও অফিসে এসে হাজির হত। সেদিনও মিটিং শেষে ফোন করলাম, যদি আনতে আসে। দুর্ভাগ্যবশত সেদিনই কি যেন কাজে আটকে গিয়েছিল শৌভিক, ফলে ট্রেন ছাড়া গতি নেই।  


খড়্গপুর এসডিও অফিস থেকে রেল স্টেশন ছিল হেঁটে আড়াই মিনিট । ৫টা৪৫ এ একটা টাটা লোকাল ছিল, যেটা কখনই সময়ে আসত না। ফলে আশা ছিল পেয়েই যাব। স্টেশনে পৌছে দেখি থিকথিক করছে লোক। বহু ট্রেন বাতিল। তখন জঙ্গলমহল দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন কোটেশ্বর রাও, ওরফে কিষণজী। যৌথ বাহিনী তখনও সক্রিয় নয়। ট্রেন বাতিল হওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। স্টেশনে পৌঁছে শুনি, আমার টাটা প্যাসেঞ্জারও বাতিল হয়েছে।  


হ্যাংলার মত শৌভিককে আবার ফোন করলাম, যদি ম্যানেজ করে এসে নিয়ে যায় একটু। জবাব এল,“স্টেশনে অপেক্ষা কর। আসছি। ” তুত্তরীর আগমনের খবর সবে ঘোষিত হয়েছে। প্রাকমাতৃত্বকালীন ক্লান্তি হঠাৎ হঠাৎ আক্রমণ করত আমায়। সেদিনও এমনি আক্রমণে বেসামাল হয়ে স্টেশনের বেঞ্চে বসে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই,হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে শুনি টাটা প্যাসেঞ্জার আসছে। 


তড়িঘড়ি শৌভিককে ফোন করে বারণ করি। ততক্ষণে ওর গাড়ি হাই রোডের কাছে এসে পড়েছিল। তাও আরো ১৮/১৯ কিলোমিটার তো বটেই। বরং মাদপুর ষ্টেশনে গাড়িটা থাকলে সুবিধা হয়। স্টেশন থেকে বিডিও কোয়ার্টার হাঁটা পথে মিনিট চার। কিন্ত পথটা বড় নির্জন, যার খানিকটা আবার বাঁশবনের মধ্যে দিয়ে যেতে হত। ভর সন্ধ্যে বেলা শ্রীমতী তুত্তুরীকে উদরে বহন করে ওই পথে যেতে গা শিরশির করত। মাথায় একটা লোহার কাঁটা বা চাবি গুঁজে যাতায়াত করতে বলত জেঠাইমা। যাতে ভূতে না ধরে আর কি। 


শৌভিক আমার ফোন পেয়ে ফিরে গেল, যেতে যেতে আমাকে জানিয়ে গেল, স্টেশনে গাড়ি থাকবে।  


 ট্রেন ছাড়লো। বেশ ভিড়। কোন মতে এক টুকরো সিট্ পেলাম। শীতের ভয়ে জানলা বন্ধ। বাইরেও ঘুট্ঘুটে অন্ধকার । বেশ কিছুক্ষণ পর ট্রেন থামল। আন্দাজ করলাম জকপুর। পরের স্টেশনে নামব। আর মিনিট পাঁচ মাত্র। দরজার কাছে এগিয়ে যাব বলে উঠে পড়লাম। আমার সামনে দাঁড়ানো প্রৌঢ়কে ইঙ্গিত করলাম বসতে, উনি সৌজন্যবশতঃ রাজি হলেন না। বলতে বাধ্য হলাম, যে আমার গন্তব্য মাদপুর । বলা মাত্র কামরায় যেন বাজ পড়ল। “ মাদপুর? এটাতো মাদপুর যায় না। ” বলে সমস্বরে চিৎকার করে উঠলেন একাধিক ব্যক্তি । 


“মানে? এটা হাওড়া যাচ্ছে তো?” ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। উত্তর শুনে আতঙ্কের শীতল স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে। ট্রেনটা ঝাড়গ্রাম হয়ে টাটা যাচ্ছে। ঝাড়গ্রাম তখন প্রায় মুক্তাঞ্চল। খুনজখম রোজকার ঘটনা।


ট্রেন তখনও ছাড়েনি। দৌড়ে নামতে গেলাম, পারলাম না। জায়গাটার নাম নিমপুরা। রাতের নিমপুরা ছিল কয়লা মাফিয়াদের বিচরণভূমি। একলা মহিলা সহযাত্রীকে সেখানে কেউ নামতে দিতে রাজি না। দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে যা দেখলাম, আমারও সাহস হল না। কোন প্লাটফর্মের বালাই নেই। অন্ধকার রেলইয়ার্ড। সারি সারি মালগাড়ি শবদেহের মত নিশ্চুপ পড়ে আছে। অগত্যা সহযাত্রীদের উপদেশ শিরোধার্য।  


 হতাশ হয়ে পড়লাম। আমার কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে জনৈক মহিলা বললেন, “ আমি কলাইকুন্ডা নামব।তুমিও নেমো। বাড়ির লোককে বল কলাইকুন্ডা আসতে। ” বাড়ির লোককে আসতেই হবে, কারণ বাস ট্রেকারের গল্প ছেড়েই দিলাম,রাতে ফিরে যাবার কোন ট্রেন পর্যন্ত নেই।সবই কিষণজীর দয়া।   


শৌভিককে ফোন করব কি, টাওয়ার শূন্য । কোনমতে কান্না সংবরণ করলাম। সৌভাগ্যবশত কলাইকুন্ডা আসার আগেই দুটি টাওয়ার পেলাম। রিং হতেই, শৌভিকের উদ্গ্রীব কন্ঠস্বর,“কোথায়? শৈবালদা (বিডিও সাহেবের ড্রাইভার) অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর খোঁজ নিয়ে জেনেছে ট্রেন ক্যানসেল। আমরা তোকে আনতে খড়্গপুর যাচ্ছি।” ঐ মুহূর্তে, প্রিয় কন্ঠস্বর শুনে আবেগে গলা বুজে আসল। কোনমতে সব বললাম। শুনে শৌভিক বলল,“সর্বনাশ । কলাইকুন্ডায় নেমে, নিজের পরিচয় দিয়ে স্টেশনমাষ্টারের ঘরে বস। আমি আসছি। ”


 কলাইকুন্ডায় পৌছে চক্ষু চড়কগাছ। এ কোথায় এলাম? ট্রেন কি চক্রাকারে ঘুরে আবার নিমপুরায় ফিরে এল? সেই অন্ধকার রেলইয়ার্ড। সারি সারি মৃতমালগাড়ি । প্লাটফর্ম বা স্টেশনমাষ্টারের ঘর কই? ভ্যাবাচাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছি, বাকিরা নেমে অন্ধকারে হারিয়ে গেল। শুধু সেই মহিলা যাননি। অধৈর্য হয়ে বললেন, “নামো। ট্রেন ছেড়ে দিবে যে। ” 


নামতে গিয়ে দেখি, সিঁড়ি শেষ হয়ে যাবার পরেও বেশ খানিকটা লাফাতে হবে। ফার্স্ট ট্রেইমস্টার সবে পেরিয়েছে, ডাক্তার বাবু বলেছেন, " মা এবং বেবি উভয়ের জন্যই এটা হ্যাপি পিরিয়ড"। আশা করি লাফালে কিছু হবে না, পরমেশ্বরের নাম নিয়ে ঝপাং করে লাফ দিলাম।  


লাফ দিলেই বা কি, দুটি ট্রেনের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। কোন রাস্তা নেই। ভদ্রমহিলাকে অনুনয় করে বললাম, “যদি দয়া করে একটু স্টেশনমাষ্টারের ঘরটা দেখিয়ে দেন। ” উনি পাত্তা দিলেন না। বললেন ,“ ওখানে যেতে হবে নি। আমার সাথে এস। কে আসছে? বর? বল কলাইকুন্ডা বাজারে আসতে। হাইরোডের ওপর। আসতে সুবিধা হবে। ”


ফোন মৃত। টাওয়ার নেই। নিরুপায় হয়ে ওনাকে অনুসরণ করতে থাকলাম। তেলের ট্যাঙ্কারের তলা দিয়ে উবু হয়ে কোনমতে গলে, এপারে এসে দেখি, নিশ্ছিদ্র অন্ধকারময় চরাচর । অন্ধের মত মহিলার পিছু পিছু হাঁটছি। বুঝতে পারছি পিচ রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, দুদিকে বিশাল বিশাল মহীরুহের কঙ্কাল। হাঁটছি আর ভাবছি, কি কি হতে পারে এই মুহূর্তে আমার সঙ্গে। ভাবছি আমায় খুঁজতে এসে কি বিপদে পড়তে পারে আমার বর। ভাবছি আর কেঁপে উঠছি।


ভদ্রমহিলার কোন বিকার নেই, উনি নানা প্রশ্ন করতে করতে চলেছেন। আমি কি করি। বাপের বাড়ি কোথায়। বর কি করে। বর কিসে আনতে আসছে ইত্যাদি। মেপে উত্তর দিচ্ছি। বললাম শ্রম দপ্তরে কাজ করি। বর মাদপুর বিডিও অফিসে মালপত্র সরবরাহ করে। বিডিও সাহেব খুব ভাল। ওনার গাড়িটা দিয়েছেন নিয়ে যাবার জন্য। মিথ্যা বলতে খারাপ লাগছিল। কিন্তু নিরূপায় । প্রায় প্রতিদিন কোন না কোন পঞ্চায়েত প্রধানের গলাকাটা মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দু একজন শিক্ষক বা সরকারি কর্মচারীও থাকছেন মৃত্যুমিছিলে। সে যে কি অন্ধকার দিন। 


বেশ কিছুটা হেটে হাইরোডে পড়লাম। অন্ধকার কিছুটা ফ্যাকাশে । কয়েকটা ফাঁকা চালা দেখে বুঝতে পারলাম বাজারে এসেছি। বাজার কোথায়, এতো জনমানবশূন্য বাজারের কঙ্কাল। শুধু একটা মিষ্টির দোকানে একটা জিরো পাওয়ারের আলো জ্বলছে। দোকান ফাঁকা। একটা বুড়ো লোক বসে বসে বিড়ি ফুঁকছে। মহিলা একটা বন্ধ দোকানে টোকা মারতে অর্ধেক ঝাঁপ খুলে এক বছর ২৩/২৪ এর ছেলের মুখ দেখা গেল। মহিলার নির্দেশে সে চেন দিয়ে বাঁধা একটা ল্যান্ডফোন এগিয়ে দিল।  


 ফোনে প্রিয়তমের কন্ঠস্বর শুনে আবার বুজে এল গলা। ভাগ্যিস এত রাতেও অচেনা নম্বরের ফোনটা ধরেছিল। সব খুলে বললাম, মৃদু ধমকাল, ওর কথা না শুনে স্টেশন ছেড়ে এসেছি বলে। ফোন রেখে মিষ্টির দোকানের মচমচে বেঞ্চে এসে বসলাম। শৌভিক বলেছে মিনিট পনেরোর মধ্যে পৌছে যাবে। ভদ্রমহিলাকে বললাম, আমার জন্য অনেক করেছেন। অনেক রাত হল, এবার বাড়ি যান। উনি কর্ণপাত করলেন না। নানা প্রশ্ন করছেন। আমাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মাপছেন। আমি শুধু জানতে পারলাম ওনার নাম পার্বতী মাহাতো। WBSEDCL চাকরি করেন।  


নামেই হাইরোড। এতক্ষণ বসে রইলাম, বাস, ট্রেকার ছাড়ুন একটা মোটরবাইক, সাইকেল ও চোখে পড়ল না। মিনিট পনেরো পরে দূরে সত্যিই একজোড়া হেডলাইট দেখা গেল। উন্মত্ত হয়ে দৌড়ে গেলাম মাঝরাস্তায়। হ্যাঁ। শৌভিকের গাড়িই বটে। অ-বাতানুকূল সাদা এম্বাসেডর। মহিলাও দৌড়ে এলেন। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষলেন শৈবাল দা। বামদিকের দরজা খুলে সরে বসল শৌভিক। লাফিয়ে উঠে দড়াম করে দরজা বন্ধ করলাম। জানলা দিয়ে হাত নাড়লাম পার্বতীদির দিকে। ইশারায় শৌভিককে দেখিয়ে বললাম “আমার বর”। উনি মৃদু হেসে হাত নাড়লেন। রকেটের বেগে উল্টোদিকে দৌড়ল গাড়ি। 


গাড়ি ছাড়ার পর সেদিনের শৌভিক কেবল বলেছিল, "তোমার যে এত গুণ -"। সেদিনের শৌভিকের মতোই বাক্য সম্পূর্ণ করি না আমি। থাক, কিছু প্রশ্ন - কিছু উত্তর অনুক্তই থাক।  


পুনশ্চ - লাপতা লেডিজ আমার মোটামুটি লেগেছে। আহামরি মোটেও নয়। বরং বেশ সাদামাটা। ছক ভাঙার চেষ্টাটাও যেন কেমন চর্বিতচর্বণ মনে হয়েছে আমার। কিছুটা পঞ্চায়েত, কিছুটা লিপস্টিক আন্ডার মাই বুরখা, কিছুটা অন্য কি যেন, যার নাম পেটে আসে কিন্তু মুখে আসে না। অভিনয় ও নেহাৎ যথাযথ। খুব অসামান্য কিছু না। 


আর কোয়ার্টারে ফিরে সেদিন আমার মুখে সব শুনে আমার বাবার দৃঢ় ধারণা হয়, ভদ্রমহিলা নির্ঘাত স্থানীয় মাওবাদী কমিটির মহিলা কমান্ডার। নিজের মতবাদের সমর্থনে বাবা জোর গলায় চ্যালেঞ্জ করেছিল, যে ঐ মহিলার দেওয়া সব তথ্য ভূয়ো। আমি ওনাকে কিছুতেই খুঁজে পাব না। আমি কিন্তু সত্যি খুজে পায়নি। হয়তো অন্যমনস্ক ছিলাম, শুনতে ভূল করেছি— অথবা বাবাই ঠিক। কিছু রহস্য না সমাধান হওয়াই ভাল। কি বলেন?

অনির ডাইরি ১১ই জুন, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


লোকটা খুব বাজে। খুব খুব বাজে লোক। বয়স আশি ছাড়িয়েছে কম দিন তো হল না, ধূমপানের আধিক্যে ফুসফুস দুটো যে ঝাঁঝরা, তাও অজানা নেই লোকটার। যে ছোকরা ডাক্তারকে এতকাল দেখিয়ে এসেছে, সে এখন আর ছোকরা নেই যদিও, প্রায় পায়ে ধরে নিষেধ করেছিল, " কাকু সিগারেটটা প্লিজ ছাড়ুন। আর মিষ্টিটাও।"


আজ্ঞে হ্যাঁ, মিষ্টি। সুগার ধরেছে বেশি দিন না, বছর দশেক হবে, ওই বয়সের অন্যান্য মানুষজন কি করে? বিষবৎ মিষ্টিকে পরিত্যাগ করে তাই তো? আইয়ে কভি বুড়োর হাভেলি পে, দেখবেন কি নেই - ফ্রিজে পাবেন জ্যাম, চিটচিটে আমের চাটনি, মিটসেফে পাবেন মুড়কি আর গুড়ের বাতাসা। খুঁজলে চিনির বাতাসা বা মুড়কিও যে পাবেন না, একথা জোর গলায় বলতে পারি না। বাড়ির কেয়ার গিভার যে দিদি তাঁর ওপরে নির্দেশ আছে, সকালে কাজে আসার সময় তেল - লুন - লকড়ি, সিগারেটের (আজ্ঞে হ্যাঁ দৈনিক ২প্যাকেট) মত নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির পাশাপাশি, গলির মুখের বিহারী দোকান থেকে মাঝে মাঝেই গরম জিলিপি, গজা, বালুসাই কিনে আনার জন্য। সবাই মিলে, চায়ের টেবিলে চাকুম চুকুম আর কি।


মুঠোফোন মারফৎ এই সব খবরাখবর যখন আমার কানে এসে পৌঁছায়, মনে হয় খামচে মাথার সব চুল ছিঁড়ে ফেলি। আর কি করব বলুন তো? দেড়শ কিলোমিটার দূর থেকে আর কি করতে পারি আমি? কেয়ার গিভার মেয়েটিকেই ধমকাই-চমকাই আমি, মেয়েটি কাঁদো কাঁদো সুরে বলে, "কি করব দিদিভাই? না এনে দিলে মেসোমশাই একা একাই নড়বড় করতে করতে বেরিয়ে পড়েন সিগারেট কিনতে।"


আমি গিয়ে অশান্তি করি, তাঁর গলার জোর আমার থেকেও বেশি। আর জোর যার, মুলুক ও যে তাঁর। তিনি আজকাল আমার কোন কথাতেই কর্ণপাত করেন না। সে নাই করুন, নিয়মিত ডাক্তার তো দেখানো দরকার, তার আগে দরকার কিছু নৈমিত্তিক পরীক্ষা করার। এত দূর থেকে ফোনে ব্যবস্থা করে লোক পাঠাই, তিনি তাঁর সঙ্গে খোশ গল্প করে তাঁকে ভাগিয়ে দেন। ছেলেটি আমায় ফোন করে বলে, " দিদি মেসোমশাই কথা দিয়েছেন,দুয়েক দিনের মধ্যেই আমায় ডাকবেন।" 


কেন দুয়েক দিন, তা বুঝতে আমার বাকি থাকে না। লোকটা দিন কয়েক মিষ্টি না খেয়ে সুগার কমিয়ে তারপর রক্ত দেবে। যাতে প্রাথমিক রিপোর্ট ঠিক আসে আর কি। দুয়েক দিন গড়িয়ে যায় মাসের পর। শ্বশুর মশাইয়ের হঠাৎ প্রয়াণ, শাশুড়ি মাকে শিকড় শুদ্ধ তুলে নিয়ে কাঁথি আসা, শৌভিকের নির্বাচন সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল পাগল হয়ে যাচ্ছি বুঝি, ফলে মাঝে বেশ কিছু দিন খোঁজ নিতে পারিনি আমি। লোকটাও দিব্য চালিয়ে গেছে তার (অ)স্বাভাবিক জীবন যাত্রা।  


ভোট শেষে বাড়ি ফিরবে শৌভিক, সময়াভাবে শ্বশুর মশাইয়ের ডেথ সার্টিফিকেটটাও তুলতে পারেনি এত দিন। আরো নানা কাজ আছে, শাশুড়ি মাতাকে নিয়েই ফিরতে হবে এবার, শুধু ফেরাই নয়,ওনাকে নিয়ে যেতে হবে ট্রেজারি ও, নাহলে চালু হবে না পেনশন - ফলে দিন দুয়েক ছুটি নিয়েই যাবে। ভাবলাম এই মওকায় লোকটাকেও ডাক্তার দেখিয়ে আসি, একটা বেলার তো ব্যাপার। 


যে ছেলেটি টেস্ট করে তাকেই শুধালাম বাড়ির কাছে কোন ভালো ডাক্তার বসেন কি, যাঁর কাছে বেশি ক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না। এতদিন যাকে দেখানো হত, তিনি এতটাই দূরে বসেন, আর তেমনি ভিড় হয়। ছেলেটি বিশ বছর ধরে এই পরিবারের সাথে যুক্ত, অনেক সুখ দুঃখের সাথী। চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করি, ছেলেটি বলল, " দিদি আপনি ডাক্তারঠাকুরকে দেখাতে পারেন। শুনেছি ভালো ডাক্তার। গলির মুখেই তো বসেন।" 


নামটাও ছেলেটি লিখিয়ে দিল, দুই নম্বরে নাম। তবে তার আগে টেস্ট গুলো করিয়ে নিলাম আমি, অধমের মাথায় যা যা এল, সব টেস্ট। দেখা গেল সোডিয়াম বেশ কম আর মূত্রে প্রোটিন বেরিয়ে যাচ্ছে। বাকি ঠিকই লাগল। নির্দিষ্ট দিনে বাড়ির দরজায় এসে থামল টোটো, গলির মধ্যে বাড়ি আমাদের, গাড়িতে উঠতে গেলেও হাঁটতে হবে কয়েক পা।টোটো চলে আসে চৌকাঠের কাছে। 


 আমার ধমক খেয়ে লাঠি ধরে গুটগুট করে টোটোয় গিয়ে উঠল লোকটা। হাঁপাচ্ছে খুব। দুমিনিট গেলেই ডায়গনস্টিক সেন্টার, সেখানেই বসেন ডাক্তার বাবু। টোটো থেকে নেমে চেম্বারের বাইরে অবধি কয়েক গজ যেতেও হাঁপিয়ে পড়ে লোকটা। আজ বোধহয় একটু বেশীই হাঁফায় লোকটা। গায়ে এখনও সিগারেটের গন্ধ। পর্যায়ক্রমে বাতানুকূল যন্ত্র এবং পাখার হাওয়ায় কিঞ্চিৎ ধাতস্থ হতে না হতেই ডাক পড়ে ভিতরে। অল্প বয়সী ডাক্তার, মিষ্টি ব্যবহার। " আসুন কাকা, বসুন।" রিপোর্ট গুলো দেখেন, আঙুলে পালস অক্সিমিটার লাগান, ব্লাড প্রেশার মাপেন, বুকে স্টেথো ঠেকান অতঃপর, খসখস করে প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, " ওনার বুকের মধ্যে তো গান বাজনা চলছে। নিউমোনিয়া বাঁধিয়েছেন। এখুনি হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।"


বাতনুকূল যন্ত্রের মৃদু গুনগুন শব্দ ছাড়া নিঃশব্দ চরাচর। বুড়ো লোকটার মুখটা পলকে শুকিয়ে আমসি হয়ে যায়। অন্য দিনের থেকে সামান্য বেশি হাঁপালেও হাঁপাতে পারে, বাকি তো কিছু অস্বাভাবিকতা আমাদের নজরে পড়ছে না। বললাম বাড়িতে রেখে চিকিৎসা কি একেবারেই সম্ভব নয়। মডেলদের মত করে প্রথমে হাসেন ডাক্তার বাবু, তারপর মীনা কুমারীর মত দুচোখে এসে জমে মন খারাপ করা মেঘ,মাথা নাড়িয়ে বলেন, " যত শীঘ্র সম্ভব ভর্তি করে দিন। দেখুন অমুক, অমুক জায়গায় যদি বেড পান।" অমুক এবং অমুক প্রাইভেট নার্সিং হোম। এখানেই খটকা লাগে আমার।


শুধাই, আপনি কোন ওষুধ লিখলেন না? এতদিন যা খাচ্ছে তার ডোজ কমবেশী কিছু করবেন না? উনি বলেন, "যা লিখেছি ওটা হাসপাতালের জন্য। দেখলেই ওরা বুঝবে।" চেম্বার ছেড়ে বেরিয়ে আসি আমরা। টোটোওয়ালা বাইরেই বসে ছিল আমাদের জন্য। টোটো থেকে নামিয়ে, হাত ধরে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল বৃদ্ধকে। একই ভাবে আবার ফেরৎ নিয়ে যায় টোটো অবধি।


মাথা কাজ করছে না আমার। এত রাতে কি করি? তবে যাই করি না কেন, নিকটবর্তী প্রাইভেট নার্সিং হোমে নিয়ে যাব না। ২০২১ সালে মধ্য হাওড়ার দুই নার্সিং হোমে যা নারকীয় অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এখনও দুঃস্বপ্ন দেখি মাঝে মধ্যে। টোটোওয়ালা বুদ্ধি দেয়, "আজ রাতটা অক্সিজেন দিয়ে দেখুন না দিদি।" মনস্থ করি, তাই করব, কাল সকালে গাড়ি ভাড়া করে সোজা কাঁথি, মাননীয় মহকুমা শাসক বলে দিলে কাঁথি হাসপাতালে একটা বেড কি আর পাওয়া যাবে না? মধ্যবিত্ত শহুরে বাঙালি সরকারী হাসপাতালগুলিকে যতই খিস্তিখেউর করুক না কেন, সরকারী হাসপাতাল এবং সরকারী ডাক্তারদের কোন তুলনা হয় না। 


শৌভিক কে ফোন করতে খুব সঙ্কোচ হচ্ছিল।বেচারা সবমিলিয়ে এমন ফেঁসে আছে। দুদণ্ড জিরোতেও পারছে না লোকটা। তবুও করলাম। শৌভিক শুনে বলল, " কোন এন্টিবায়োটিক দেয়নি?" বললাম না তো। কেবল বলছে, নিউমোনিয়া আর হাসপাতালে ভর্তি করতে। শৌভিক বলল, " শোন নিউমোনিয়া আমার বাবার ও হয়েছিল। মনে আছে আমরা দীঘায় ছিলাম, বাড়ি থেকে আয়া মাসি হাউমাউ করে ফোন করেছিল?" খুব মনে আছে সেদিনটার কথা। কি ভাবে যে মাথা ঠাণ্ডা রেখে, কাঁথি হাসপাতালের ডাক্তার বাবুকে ফোন করে সে যাত্রা বাবাকে বাঁচিয়েছিল শৌভিক। 


শৌভিক বলল, " একদম। শুধু ফোনে সব শুনে ওষুধ দিয়েছিল অভিষেক ডাক্তার। তুই আমাকে সব রিপোর্ট, এই ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন আর এমনিতে কি ওষুধ খায়, সব জানা।" বাড়ি এসে এদিক ওদিক ফোন করি আমি। অক্সিজেন এর ব্যবস্থা করি আমি। একরাতের জন্য অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর দিতে চায় না কেউ। এক মাসের গল্পে আসুন। 


ডাক্তার বাবু রাউন্ডে আছেন জানায় শৌভিক, ঘণ্টা খানেক বাদে সব দেখে জানাবেন। একটা ঘণ্টা রীতিমত হৃদপিণ্ড মুঠোয় ধরে বসে থাকি আমি। রাত নটা নাগাদ আসে সেই কাঙ্ক্ষিত ফোনটা, শৌভিকের জবানীতে ভেসে আসে বিস্ময়, " এতো আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করছে, হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেছেন কেন? রিপোর্ট দেখে তো স্যার আমি কিছু বুঝছি না। ওনার যা বয়স বলছেন রিপোর্ট তো এমনিই আসার কথা। চেস্টের এক্সরে করিয়েছেন কি?" জবাব দিই, কই না তো। সব শুনে তিনটি ওষুধ লিখে দেন ডাক্তার বাবু, আর দুটি ওষুধ দেন দিনে দুবার নেবুলাইজ করার জন্য। বলেন, " অক্সিজেনটা মাপতে থাকবেন স্যার। যদি অনেক ক্ষণ ধরে ৮০র অনেক নীচে থাকে, বা রোগী যদি ভুলভাল বকতে থাকে,তাহলে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করে দেবেন। আর দিন কয়েক পর বুকের একটা ছবি (Xray) তুলে একটু আমায় পাঠাবেন। অন্য ওষুধ উনি যা খান, আপাতত তাই খাবেন।" 


রাত সোয়া নটা, কোন মতে খুঁজে পেতে ধুলো ঝেড়ে বার করি পালস অক্সিমিটার, বৃদ্ধের আঙুলে লাগিয়ে রিডিং আসে ৯৫-৯৬। সহরষে নিজের বরকে সে খবর দিই আমি।অতঃপর বেরিয়ে পড়ি ওষুধ কিনতে। আজ রাতেই কয়েক দাগ ওষুধ পড়ে গেলে, হয়তো সুস্থ হয়ে উঠবে বৃদ্ধ। বন্ধ হতে বসা কদমতলা বাজারের এক কোনের প্রায় ঝাঁপ ফেলা সাহেবী নামের ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনে ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরি আমি। নতুন করে আঙুলে লাগাই পালস অক্সিমিটার, রিডিং ৯০ এর অনেক ওপরে। বরং বৃদ্ধার রিডিং ৮০ এর অনেক কম আসে। ফুসফুসের রোগে তো তিনিও ভোগেন। বৃদ্ধের পাশে বসে আঘ্রাণ করেন যে সিগারেটের ধোঁয়া গুলো। ইনহেলার নেবার কথা রোজ সকাল বিকাল মনে করাই তুত্তুরী আর আমি। আজ চেক করতে গিয়ে দেখি ইনহেলার শেষ হয়ে গেছে কবেই, অথচ তিনি নৈমিত্তিক স্তোক বাক্য দেন, " হ্যাঁ নিয়েছি। আমি খুব ভালো আছি।" এবাড়িতে সবাই এত মিথ্যুক কেন? 


ভাগ্যে আন্দাজে কিনে এনেছিলাম বৃদ্ধার ওষুধটাও। প্রায় ঘাড় ধরে দুটোকে ওষুধ খাওয়াই, টানাই আমরা মা - মেয়ে। সারা রাত মাপা হয় অক্সিজেন। পরদিন সকালে দুজনেই ফিট। অক্সিজেন লেভেল ও যথাযথ। কেয়ার গিভার মেয়েটিকে ফোন করে বলা হয়, "আজ থেকে আর সিগারেট আনিস না। দিদিভাই আছে, জানিসই তো কেমন মাথা গরম। কুরুক্ষেত্র কাণ্ড করছে কাল থেকে।" শৌভিককে বলা হয়, " তুমি ওকে নিয়ে যাও। আর পারছি না। একে একটাও সিগারেট খাইনি সকাল থেকে, তারওপর তোমার বউয়ের চোপা। উফ পাগল পাগল লাগছে রে বাবা -"। এরপর ও বলবেন লোকটা ভালো? সাধে আমার ঠাকুমা বলতো, " কলি যুগে উপকারীকে বাঘে খায়।" ঘোর কলি বুঝলেন, ঘোর কলি।


পুনশ্চঃ- সব চরিত্র কাল্পনিক কিন্তু। আর হ্যাঁ, ছবির মানুষ গুলোর সাথে লেখার কুন সম্পর্ক লাই ।



অনির ডাইরি ৬ই জুন, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


আমি বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর মধ্যে পড়ি না। বরং "বুদ্ধুজীব" হিসেবেই অধিক স্বচ্ছন্দ বোধ করি। বিশেষত রাজনৈতিক সচেতনতা নিয়ে যদি কথা বলেন, তো জোর গলায় বলতে পারি, আমার দপ্তরী বাহনচালকও আমার থেকে অধিক সচেতন। কত কিছু যে জানতে পারি ভদ্রলোকের থেকে। আসমুদ্রহিমাচল জুড়ে যাবতীয় রাজনৈতিক কূটকচালি, আকচাআকচি সব ভদ্রলোকের নখদর্পণে।


গ্রাম্য রাজনীতি যে মহানগর কেন্দ্রিক রাজনীতির থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র তা আমি পদে পদে টের পাই, ওনার সৌজন্যে। যেমন ধরুন, কিছুদিন আগে উনি আমাকে বললেন, " জানেন তো ম্যাডাম, আমাদের গাঁয়ের বউ ঝিরা অমুক পার্টির ওপর খুব খেপে আছে।" প্রশ্ন করার আগেই ভেসে আসে উত্তর, " আসলে গেল বার তো ওরা সব বাড়িতে একটা করে শাড়ি আর সানিয়া মির্জা দিয়েছিল।" 

এবার কথা থামাতে বাধ্য হই আমি, প্রশ্ন করি, বাড়ি বাড়ি একটা করে সানিয়া মির্জা মানে কি? এত জন সানিয়া মির্জা এল কোথা থেকে? ভদ্রলোক এক গলা জিভ কেটে বলেন, " আপনারা অন্য কিছু বলেন নাকি?" তারপর ইশারায় বোঝান নাকের নথ। সহস্রাব্দের শুরুর দিকে সানিয়া মির্জা নাকে যে সোনালী রিংটা পরতেন, তেমনি কিছু হবে বুঝে আর এগোই না। 


ভোট চাইতে উপঢৌকন দেওয়া যে দণ্ডনীয় অপরাধ তা ভুলে প্রশ্ন করি, সব বাড়িতে শাড়ি দিয়েছিল? কি শাড়ি? জবাব আসে, " ওই যে গো, হাটে বিকোয়, একশ দুইশ টাকার শাড়ি।" এক দুশো টাকায় শাড়ি হয়? বলতে গিয়েও, বলি না। মনে পড়ে যায়, চুঁচুড়ায় থাকতে ঝুমার সাথে গিয়েছিলাম বটে একটা ওমন হাটে। দেড়শ টাকা দিয়ে একখান শাড়ি আম্মো কিনিছিলাম। পরার পর মনে হয়ে ছিল মশারি পরেছি বুঝি। হোক মশারি, তাও তো শাড়ি বটে রে বাবা। তাও ফোকোটে পাওয়া, তারওপর আবার নথ, তা যারা এত কিছু দিয়েছিল গেল বার,তাদের এবার ভোট দিবেনি কেন? ড্রাইভার সাহেব মিচকে হেসে বলেন, "নকল ছেল ম্যাডাম। সোনার রং করা ছিল। নাকে পরতেই রং উঠি গেছে।"


জিজ্ঞাসা করলাম, আপনাদের বাড়িতেও দিয়েছিল? জবাব দিলেন, " না ম্যাডাম। আমরা কোন দলে নাই তো। তাই দেয়নি। আমাদের কিছুই দেয় না। সেবার ঝড়ে অত ক্ষতি হল, একটা ত্রিপল চাইতে গ্যালাম, তাই দিলে না। শেষে আপনি বলে দিলেন বলে নূপুর দা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে ব্লক থেকে একটা যোগাড় করে দিলে।" বাকিটা ব্যক্তিগত বলে আর কথা বাড়াই না। 


তখনও ঘোষিত হয়নি নির্বাচনী নির্ঘণ্ট, আমার এই অরাজনৈতিক ড্রাইভারকে নিয়ে বেশ খুশিই ছিলাম আমি। নির্বাচন ঘোষণা হবার সাথে সাথেই দেখি তিনি এক দলে নাম লিখিয়ে বসে আছেন। তা ভালো,স্বাধীন দেশের নাগরিক,রাজনৈতিক ভাবে সক্রিয় হওয়াটাই তো বাঞ্ছনীয়। আপিসের ডিউটি সেরেই,দৌড়ে দৌড়ে দাদার আপিসে হাজিরা দিতে যান, দেওয়াল লিখতে যান, ফেস্টুন ব্যানার বানাতে দিতে যান।  দল বেঁধে গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ান, দাদার জন্য ভোট মাগেন। আর পরদিন আপিস যাবার পথে আমায় গল্প শোনান। "জানেন ম্যাডাম, ওদের বাড়ি ১৫টা ভোট, তাই বলে কি ওরা যা ইচ্ছে তাই চাইবে? ওদের ১৭ বছরের ছেলে, কোথা থিকা একটা ১৫ বছরের মেয়েকে ভাগিয়ে এনিছে। পুলিশও ওমনি কেস দিয়ে দিছে, ছেলেটাকে বয়েজ হোমে আর মেয়েটাকে গার্লস হোমে চালান করে দিয়েছে। এখন ওরা বলে কিনা, তোমার দাদাকে বলে আমাদের ছেলেকে ছাড়িয়ে এনে দাও -। আমি সোজা বলেছি,আমি পারব না। তখন বলে কি, আমরা এত বছর ধরে ওই পার্টি করি, আজ যদি পার্টি আমাদের পাশে না দাঁড়ায়, তো ভোটের কথা ভুলে যাও। আমিও কয়ে আইছি, ভাইরে তোদের ১২/১৫টা ভোটের আমার দরকার নাই। কপালে থাকলে আমার দাদা এমনিই জিতবে। নিজের ছেলেকে সামলাতে পারে না, তাদের আবার এত কথা। জানেন ম্যাডাম, অর বাপ মিষ্টির দোকানে থালাবাটি ধুয়ে ছেলেকে মানুষ করেছে। লেখাপড়া শিখিয়েছে, আর সেই ছেলে কি করেছে, না পেরেম - ।" 


শুনতে শুনতে ভালো লাগে। কারো মধ্যে তো এই সমাজ সচেতনাটুকু আছে। কোন দিন আবার চিন্তিত হয়ে বলেন, " জানেন ম্যাডাম, দাদাকে বলিচি, কিছু টাকা লাগবে। গ্রামে একদিন ফিস্টি দিতে হবে। ওদের অনেক ট্যাকা,ওরা তিনবার দিশি মুরগি খাইয়ে দিয়েছে। আমরা একবারও না দিলে একটাও ভোট পাব না।" জিজ্ঞাসা করি, আপনারা কি খাওয়াবেন? খাসি? উনি মাথা চুলকে বলেন,অত টাকা কুথায় পাই। প্যাঙ্গাস মাছের ঝোল,আলু ভাজা আর ভাত খাওয়াব।" 


সাত দফায় ভোট, উত্তর থেকে ধীরে ধীরে নামছে নির্বাচনী উত্তাপ। আমার লোকলস্কর সবাই ব্যাপৃত "গর্বের পর্বে"। "একা কুম্ভ" হয়ে আমরা কয়েকজন রক্ষা করে চলেছি ফাঁকা আপিসটাকে। আদর্শ আচরণ বিধির সৌজন্যে লোক সমাগম আপাতত বড়ই সীমিত। তারই মধ্যে টুকটাক এসে ঘুরে যান বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা। সুযোগ পেলেই জমে ওঠে বৈঠকী গপ্প। কি হবে মনে হয় নির্বাচনী ফলাফল? ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত জনৈক বামপন্থী নেতা টেবিল বাজিয়ে বলে যান, " আমি বলতেছি ম্যাডাম,আপনি মিলিয়ে নিবেন, আমরা ৪২ এ ৪২টাই পাব। সব সিট আমরা নিয়ে নিব। কুনো ফুল আমরা ফুটতেই দিব নি।" হাসি চেপে গম্ভীর ভাবে বলি, "অমুক বাবু, সত্যি সত্যি বলুন তো, কি খেয়েছেন? সেটা কি তরল না বায়বীয়? খুব মূল্যবান কিছু?  ৪২ এ ৪২টাই আপনারা পাবেন, আমাকে অজ্ঞ পেয়ে এমন গাঁজাখুরি গল্প দেবেন?"


 ভদ্রলোক হেহে করে খানিক হাসেন, হাত কচলান, তারপর মাথা চুলকে,ষড়যন্ত্রের সুরে ফিসফিস করে বলেন, "আসল সমস্যা কি জানেন ম্যাডাম? মেয়েরা। ওই যে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার-। হাতে দুটো ট্যাকা কি এসেছে, মেয়েরা ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। কুনো কথাই আর শুনতেছে না। আমার বউই ধরেন না, উঠতে বসতে কইছে, তোমার কথা শুনব ক্যান? আমার যাকে পছন্দ, আমি তাকে ভোট দুব। "


পূর্ব মেদিনীপুরের এক প্রান্তিক ব্লকের এক ছাপোষা বামপন্থী নেতার মুখে সেদিন যা শুনেছিলাম, আজ সামাজিক মাধ্যম ভেসে যাচ্ছে সেই একই কথায়, হয়তো একটু পরিশীলিত ভাবে বলছেন, কিন্তু বলছেন তো সেই একই কথা না। বলছেন মেয়েরাই তো তরিয়ে দিল এই নির্বাচন। বলছেন, তত্ত্ব কথা, ন্যায় অন্যায়, সমাজ দর্শন কিচ্ছু বুঝল না মাইরি মেয়েগুলো, দল বেঁধে গিয়ে ভোট দিয়ে এল ক্ষমতাসীন দলকে। চাঁচাছোলা ভাষায় বলছেন পাঁচশ, হাজার টাকার কি মহিমা মাইরি। বলছেন, সময় থাকতে বউ গুলোকে হাত খরচা দিলে আর এই দিন দেখতে হত না। পড়ছি আর ভাবছি, উফ আদমসুমারি অনুসারে লিঙ্গানুপাতে এত পিছিয়ে থেকেও কত্ত শক্তিশালী মাইরি আমাদের মেয়েরা! আর এই সত্যিটা এত দিন কেউ বুঝল না! যাঃ বহুৎ না ইনসাফি হ্যায় মাইরি।

Friday 17 May 2024

অনির ডাইরি মে, ২০২৪

 অনির ডাইরি ২৭শে মে, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় বেজে উঠল পাশে অনাদরে পড়ে থাকা মুঠো ফোনটা। কোন মতে হাত বাড়িয়ে কানে ঠেকাতেই, ওপাশ থেকে ভেসে এল চেনা, ছদ্ম কন্ঠস্বর, " দরজা খুলতে কি শ্বশুরমশাইকে ফোন করব?" অষ্টপ্রহর আমার বুড়ো বাপটাকে ধরে টানাটানি করে লোকটা। বিরক্ত হয়ে কিছুদিন আগেও বলতাম, " কেন? তোর ও তো একটা বাবা আছে, মাঝে মধ্যে তাকে ধরেও তো টানতে পারিস।" শ্বশুরমশাই চলে যাবার পর থেকে কথাটা আর বলতে পারি না। সেই সুযোগে লাগামছাড়া হয়ে উঠেছে শয়তানটা। 


গজগজ করতে করতে উঠে দিয়ে দরজা খুলে দিই। সাড়ে তিনটে অবধি তো জেগে ছিলাম আমিও। মাঝে মাঝেই চলছিল টুকরোটাকরা বার্তা বিনিময়। এটা আমার আজকের নয়, বিগত ১৬ বছরের অভ্যাস। শৌভিক রাত জাগলেই রাত জাগি আমি। মাঝে,মাঝেই ফোন- মেসেজ করে জানাই, একা নও, আমিও "জেগে আছি"। 


আগে একাকীই জাগতাম, ইদানিং অনেক রাত পর্যন্ত সঙ্গ দেয় তুত্তুরী। গতকালও রাত দেড়টা অবধি জেগেছে মেয়েটা। আরো হয়তো জাগত খানিকক্ষণ, আমার দোষেই রাগ করে নিজের ঘরে চলে গেল। আসলে হয়েছে কি,রাত দেড়টা অবধি আসন্ন অলিম্পিক, খেলার জগৎ, খেলা নিয়ে বিশ্ব রাজনীতির ওপর এন্তার বকবক করে আমার মাথা ধরিয়ে দেওয়ার পর, তাঁর মনে হয়েছে, মাকে একটা ধাঁধা ধরা যাক। সেটা যে ধাঁধা, সেই ঘোষণা ব্যতিরেকেই তিনি আমায় শুধালেন, " বলো তো মা, Bay of Bengal কোন state?" 


আমার সাদা মনে কোন কাদা নেই মাইরি, আমি বললাম, "বঙ্গোপসাগর কোন একটা স্টেটে কেন থাকবে? ভারতের গোটা পূর্ব উপকূল জুড়েই তো -"। তিনি সবজান্তা হাসি হেসে বললেন, " পারলে না তো? Bay of Bengal is in liquid state, এটা তো সবাই জানে।" কেমন রাগটা ধরে। শাণিত জিহ্বাকে শাসন করে, বললাম, " এবার আমি একটা প্রশ্ন শুধাচ্ছি,জবাব দে দেখি, বঙ্গোপসাগর ভারতের কোন কোন রাজ্যের সীমানা স্পর্শ করে -"। তিনি চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে শুরু করলেন, " বাংলা - উড়িষ্যা -"। তারপর অখণ্ড নীরবতা, তিনি ভাবছেন। ভেবে টেবে বললেন, " আসাম"। শায়িত অবস্থা থেকে উঠে বসলাম আমি। বললাম, " আসামের ধারে পাশে কোন সমুদ্র নেই।" ভড়কে গেলেন তিনি, ঢোঁক গিলে বললেন, " ঝাড়খণ্ড?" বললাম "land locked state।" এরপর একের পর এক উড়ে এল, " মহারাষ্ট্র এবং কেরালা।"


হাসতে হাসতে বিদ্যালয় জীবনের কথা মনে পড়ে গেল। মোটামুটি তুত্তুরীর বয়সেই আমার এক প্রিয় বান্ধবী ডিব্রুগড় তৈল খনির ম্যাপ পয়েন্টিং করেছিল অধুনা ছত্রিশ গড়ে। এখন অবশ্য তিনি জাঁদরেল দিদিমণি। ছাত্রছাত্রীদের কান ধরে ভূগোল পড়ান। সেটাই বললাম তুত্তুরীকে। বললাম, কাল সকালে ভারতের মানচিত্র মুখস্ত করবি। তাতে তিনি রেগে গরগর করতে করতে চলে গেলেন, যাবার সময় বলে গেলেন, " নিজে ভূগোলে ভালো বলে কি অহংকার।"


সেটাও সবিস্তারে লিখেছিলাম শৌভিককে। রাত সাড়ে তিনটে অবধি রেমালের গতিপ্রকৃতি নিয়ে মিনিটে মিনিটে windy দেখছি আমি। আর আকুল প্রার্থনা করছি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কাছে, একে তো ভোট নিয়ে জেরবার এই বঙ্গ, এরওপর তুফানের অভিঘাত যে বড় সাংঘাতিক হয়ে যাবে। অন্তত আমার বরের কাছে। জীবনের কঠিনতম অধ্যায়ের মধ্যে দিয়ে চলছে লোকটা। এমন ত্রহ্যস্পর্শ যোগ সচরাচর দেখা যায় না। একে তো নির্বাচনী গুঁতো, তারওপর নির্বাচনের ঠিক এগারো দিন পূর্বে আকস্মিক পিতৃবিয়োগ। তারও ওপর রেমাল বাবুর আগমনী। এবারেরটা প্লিজ তুমি নিয়ে নাও। পরের বারেরটা পাক্কা আমরা নিয়ে নেব। 


তারপরই বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সে আর কতটুকুই বা, ঘরের লোক ঘরে ফিরে এসেছে,এবার আরাম করে ঘুমাব। সে গুড়ে বালি, জ্বর নিয়ে ফিরেছেন তিনি। প্যারাসিটামল দিয়ে গরম কালো কফি খেয়ে, মাত্র কয়েক ঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে আবার যখন বেরোল শৌভিক,বলে গেল, " অপেক্ষা না করে খেয়ে নিস। কাঁথির কাজ গুটিয়ে, আমায় একবার দীঘা যেতে হবে।" 


আকাশের মুখ ভার, বইছে জোরালো বাতাস। সাথে ক্রমশই বাঁধন হারা হচ্ছে বৃষ্টি। জলভরা বাতাসের দাপটে ছিটকে পড়ছে বাগানের টব গুলো। "এমন দিনে তারে বলা যায়", বলাই যায়। বললামও, "আমাকে নিয়ে যাবে? প্লিজ?" জীবনের নানা ওঠাপড়ার মাঝে কবে যে আমাদের বিয়ের দিনটা এসে চলে গেছে,মনে রাখিনি কেউই। দেশ জোড়া গর্বের পর্বের মধ্যে, তা রাখার কথাও নয়। কিন্তু আজ তো আর সেই চাপ নেই, আজকের দিনটা তো একসাথে থাকাই যায়। 


জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে শৌভিক বলল, " কে বলল নেই? চাপের বাবা, কাকা, মেসোশ্বশুর সবাই আছে। গিয়ে যদি চুপ করে বসে থাকতে আপত্তি। না থাকে তো চল। আমাকে কিন্তু বিরক্ত করা চলবে না। আমাকে আমার কাজ করতে দিতে হবে। রাজি?" তাই সই, মামা না থাকার থেকে কানা মামাই ভালো বাপু। পরিস্থিতি অনুকূল হোক বা প্রতিকূল একসাথে থাকতে পারাটাই আসল। বাকিটা ঠিক হয়েই যাবে।


অনির ডাইরি ২৩শে মে, ২০২৪ 

#অনিরডাইরি 



বেশ কিছুদিন আগের কথা, অফিস থেকে ফিরে শ্রীমতী তুত্তুরীকে পড়তে বসিয়েছি, হঠাৎ চিৎকার করে উঠল মুঠোফোনটা। অচেনা নম্বর হলেও চিনতে পারলাম, আজ সকালেই বোধহয় ফোন এসেছিল এই নম্বরটা থেকে। তখন ধরতে পারিনি। এখন ধরলাম, ওপাশ থেকে এক পুরুষ কণ্ঠ বলল, " ম্যাডাম আমি অঞ্জন।" কোন অঞ্জন, এই নামে একাধিক ব্যক্তিকে চিনি। জবাব এল,ম্যাডাম আমি SLO অঞ্জন, তমলুক ব্লক। 


চিনতে আর কোন সমস্যা হল না। আমার সাথে চেহারা গত সাদৃশ্যের জন্য, অঞ্জনকে আমি আলাদা করে গোবলু SLO বলে ডাকি। অঞ্জনের ফোন পেয়ে প্রমাদ গুনলাম। আমার এই গোবলু SLO টি মাঝে মধ্যেই আমাকে রচনাসম মেসেজ পাঠায়। মেসেজ গুলো শুরু হয়, " ম্যাডাম আপনি কত ভালো" দিয়ে এবং শেষ হয়, " আমার সাথে কেন এমন হয়েছে? আমার খুব দুঃখ হয়েছে" এবং "মার্জনা করবেন ম্যাডাম, আমি আপনার নির্দেশ পালনে অপারগ।" 


শতাধিক সদস্য নিয়ে গঠিত আমার তাম্রলিপ্ত পরিবার। সবাই আমার কাছে সমান গুরুত্বপুর্ণ, সমান স্নেহের পাত্র, সবাইকে সমান ভালোবাসি। কিন্তু বিভিন্ন রোগের যেমন বিভিন্ন দাওয়াই হয়, তেমনি বিভিন্ন সহকর্মীকে ও বিভিন্ন ভাবে সামলাতে হয়। কাউকে বেপোট ধমকাতে হয়, "কেটেই ফেলব" না বললে জাস্ট সে নড়ে না, আবার কাউকে বকলেই কেলো। তাদের সোনা,বাবা, বাছা না বললে সে নড়ে না। অঞ্জন দ্বিতীয় পর্যায় ভুক্ত। অঞ্জনের সব অভিযোগ যে সব সময় আমি মেটাতে পারি, তা নয়। যাদের নামে দুদিন আগে আমার কাছে নালিশ করে, দুদিন পর তারাই এসে পান চিবাতে চিবাতে বলে যায়, "ম্যাডাম আজ ব্লকে অঞ্জন দা খাওয়াল। কি ভালো মুর্গীর ঝোলটা যে হয়েছিল। আর তরকারিটা ম্যাডাম, উফ কি বলব আপনাকে -"। মনে হয় ব্যাটাদের কান ধরে ঘর থেকেই বার করে দি। আর অঞ্জনটাকে দিই ব্লক করে। 


তেমনি কিছু আসতে চলেছে ভেবে বললাম, "বলো"। অঞ্জন বলল, " কাল অফিসে থাকবেন ম্যাডাম? আমি একটু যাব নিমন্ত্রণ করতে।" কিসের নিমন্ত্রণ রে, বিয়ে করছ নাকি? তাই সবাইকে মুরগির ঝোল আর তরকারি খাইয়েছ? অঞ্জন এক গলা জিভ কেটে বলে, "না না ম্যাডাম। বিয়ে তো অনেকদিন আগেই করেছি। আসলে আমার মেয়ের জন্মদিন। বর্গভীমা মন্দিরে ওই দিন ভোগ দেব। আপনাদের সকলের নিমন্ত্রণ। প্লিজ আসবেন।"


বললাম সে তো আসবই, কিন্তু তোমাকে আর কষ্ট করে আসতে হবে নি। আমি বলে দিলেই সবাই চলে যাবে। তাও কথা শুনল না অঞ্জন। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি, গোটা রাজ্য পুড়ছে অকস্মাৎ তাপ প্রবাহে, তারই মধ্যে ঘোর দ্বিপ্রহরে এসে হাজির হল অঞ্জন। জনে জনে নিমন্ত্রণ করল আলাদা করে। আমায় তো সপরিবারে। "ম্যাডাম স্যারকে অবশ্যই আনবেন। আর তুত্তুরীকেও।" বলেই দিলাম,ওসব পারব না বাপু। একজনের স্কুল আর এক জনের নির্বাচন, কাউকে পাবে নি। আমি একা অবশ্যই যাব।


বললাম তো যাব, কিন্তু এদিকে যে উত্তরোত্তর তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে বুড়ো তপন। গোটা পূব মেদিনীপুর জুড়ে ত্রাহি ত্রাহি রব। শান্তনু বলল, "খাবার না হয় লিয়ে চলে আসব ম্যাডাম। ঠাণ্ডা ঘরে বসে খেয়ে নিবেন।" ব্যাপারটা আমার যতটা পছন্দ হল, অঞ্জনের তার তিলমাত্রও হল না। " এলে অনেক ভালো হত ম্যাডাম। মেয়েটা খুব খুশি হত - "। এরপর আর কোন কথা চলে না। 


চলে না বললেও, আতঙ্ক তো যায় না। কি গরম বাপ রে! বর্গভীমা মন্দিরের নীচে জুতো খুলে ওই খাড়া সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পা পুড়ে আংরা না হয়ে যায়। অফিসে শুভাশিষ, শান্তনু, নন্দন যদিও বারবার বলতে লাগল, " কিচ্ছু চিন্তা নেই ম্যাডাম। পিছন দিক দিয়ে সুন্দর রাস্তা আছে, ছায়ায় ঢাকা, দোতলায় উঠে জুতো খুলতে হয়।" হক বাবু বললেন, " দেখবেন ম্যাডাম, দেবস্থানে গরম লাগবে নি।" 


তাই সই। তারপর ও আসতে থাকে না না চিন্তা। মন্দিরে ভোগ, নির্ঘাত মাটিতে বসে খেতে হবে। শাড়ি পরে গেলে সুবিধা না সালোয়ার পরি? শান্তনু বলল, "দাঁড়ান ম্যাডাম সব খবর লিয়ে লিচ্ছি।"মিনিট দশেক পরেই ফোন, "ম্যাডাম মাটিতে বসে খাওয়ার পাশাপাশি চেয়ার টেবিলও থাকবে। অঞ্জনদা নিজে বাজার করে দিচ্ছে, মন্দিরের ভোগ ছাড়াও আরো অনেক কিছু থাকছে ম্যাডাম।" 


সে তো আগেই শুনেছি, নন্দন আজ সকালেই বলেছে, "তিন রকম মাছ থাকছে ম্যাডাম। বাটা, রুই আর শোল।" দেবী বর্গভীমার নিত্য ভোগ শৌভিক তমলুকের এসডিও থাকাকালীন বেশ কয়েকবার খেয়েছি। সাদা ভাত, শুক্তো, মুগ ডাল, পোস্ত ছড়ানো চৌকো করে কাটা, খোসা সমেত গুঁড়ি গুঁড়ি আলু ভাজা, শাক পাতা-কুমড়ো দিয়ে একটা তেলতেলে ঘ্যাঁট, রুই মাছের ঝাল, শোল মাছের টক আর পায়েস। সব কটি পদই অনবদ্য, অনুপম খেতে। আমরা চাটুজ্জে, আমাদের বংশে শোল মাছ ভক্ষণ নিষিদ্ধ। ভাগ্যে বিয়ে করে গোত্রান্তর হয়েছিল, নাহলে দেবীর এই অনুপম প্রাসাদ থেকে বঞ্চিত হতাম। শোল মাছের টকের কথা লিখতে বসে এখনও রসে পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে আমার রসনা। ঠিক করলাম, বাটা রুই নয়, ওটাই খাব কেবল, আশ মিটিয়ে। 


নির্দিষ্ট দিনে, টিফিন টাইমে গিয়ে হাজির হলাম বর্গভীমা মন্দিরের কাছে। মেয়েকে নিয়ে অঞ্জন স্বয়ং এল খিড়কি দুয়ারের পথ দেখাতে। মেয়েটি যেন হুবহু বাপের ফটো কপি। শুভ জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে বললাম, তোমার বাবাকে কিন্তু আমি অন্য নামে ডাকি। মেয়েটি এক গাল হেসে বলল, "জানি তো। তুমি বাবার নাম দিয়েছ গোবলু SLO, বাড়িতে আমিও তাই বলে ডাকি। থুড়ি রাগাই বাবাকে।" এই পুঁচকে বয়সেই নিরুপম বাচিক শিল্পী মেয়েটি। দারুণ আবৃত্তি করে, নানা জায়গা থেকে মেডেল জিতে আনে। সামান্য অনুরোধেই গোটা তিনেক শোনাল আমাদের। 


মন্দিরের ভিতরে আলো ছায়ার আজব কারিকুরি। যেখানে রোদ পড়ছে,সেখানে পা রাখা যায় না। ছায়াময় অংশটি আবার বেশ শীতল। এক্কা দোক্কা খেলার মত করে মন্দির চত্বর পার হয়ে গেলাম।মাঝখানে রাজরাণীর মত বসে আছেন দেবী বর্গভীমা। প্রচুর বিয়ে হয় এখানে। এই প্রখর রৌদ্রেও বেশ কয়েক জোড়া বর বধূ সেজেগুজে প্রস্তুত। তাদের পাশ কাটিয়ে বাম দিকে খাবার জায়গায় গিয়ে হাজির হলাম আমরা। আজ গোটাটাই আমাদের জন্য সংরক্ষিত। তেমনই ব্যবস্থা করেছে অঞ্জন। 


এবার ভোজনের পালা। আমাদের জন্যই সবাই প্রতীক্ষা করছিল এতক্ষণ। একটা ছোট টেবিলে আমি, ALC নভোনীল বাবু,ইন্সপেক্টর মুকুল আর একজন অপরিচিত ব্যক্তি বসলাম,বাকিরা দলবদ্ধ ভাবে মাটিতে লম্বা করে পেতে রাখা আসনে বসে পড়ল। অঞ্জন স্বয়ং পরিবেশন করতে নামল। প্রায় দেড় মাস আগের কথা, তাও যতটুকু মনে পড়ে, প্রথমেই এল গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত, সাথে স্যাল্যাড, অসম্ভব ভালো শুক্তো, মুগ ডাল, ঘন্ট, পোস্ত ছড়ানো খোলা শুদ্ধ গুড়ি আলু ভাজা। প্রতিবারই ভাবি, এটা আর একটু নেব। চাইবার আগেই পরের আইটেম এসে যায় পাতে। কোনটা ফেলে কোনটা যে খাই। 


ভাবতে ভাবতেই এত্ত বড় বাটা মাছ স্বহস্তে পাতে তুলে দিল অঞ্জন। নিষেধ করার অবকাশ পেলাম না। বাটা আমার ঘোরতর অপছন্দের মাছ। এত কাঁটাওয়ালা মাছ আবার মানুষে খায়। ভেবেই এসেছিলাম, ওটা খাব না। না জিজ্ঞাসা করেই দিয়ে দিল যখন, অপচয় তো আর করতে পারি না। মুখে দিয়েই বুঝলাম, না খেলে পস্তাতাম। বাটাও এত সুস্বাদু হয়? ভাবলাম, অন্তত দুপিস টক শোল খাব। অসভ্য উদর জায়গা দিলে তো। আরো অনেক কিছু ছিল যে, চাটনি, পরমান্ন, ক্ষীরের মত দই,রসগোল্লা----। 


রাতে বাড়ি ফিরে দেখি অঞ্জন মেসেজ করেছে, "Mam আজ আপনি এসেছেন। আমার মেয়ে কে আশির্বাদ করলেন, আমি, আমার মেয়ে ও স্ত্রী খুব খুশি হয়েছি। আমরা সত্যিই খুব আনন্দ পেয়েছি। আমার খুব ভালো লেগেছে। Mam আমার পরিবারের পক্ষ থেকে আপনাকে প্রনাম জানাচ্ছি।" ভালো করে পড়লাম বার কয়েক, নাহ আজ আর কোন নালিশ করেনি অঞ্জন তার ম্যাডামের কাছে।


অনির ডাইরি ১৪ই মে , ২০২৪

#অনিরডাইরি 



ঢং করে বেল বাজতেই ধড়মড় করে উঠে বসলাম।ঘড়ি বলছে, রাত সাড়ে তিন-পৌনে চার। এই একটা আওয়াজের জন্যই এতক্ষণ সোফায় বসে আছি। জেগে বসে আছি লিখতে পারলাম না, কারণ বেশ বুঝতে পারছি আমার চোখ জুড়ে গিয়েছিল। 


দুঃসংবাদ আসার আধ ঘন্টার মধ্যেই বেরিয়ে পড়েছি আমরা কাঁথি থেকে। দুটো পিট্টু ব্যাগের মধ্যে কোন মতে ভরে নিয়েছি কিছু জামাকাপড়। কি নিয়েছি, কি নিইনি জানি না। মাথাই চলছিল না। শূন্যতা বুঝি একেই বলে। গাড়ি সময়মত এসে গেলেও, কিঞ্চিৎ বিলম্ব করছিল শৌভিকের ব্যক্তিগত দেহরক্ষক।  উত্তেজিত হয়ে বার বার ফোন করতে করতে বাইরের বাগানে পায়চারি করছিলেন ড্রাইভার নূপুর বাবু। মাঝে মাঝে বলছিলেন, " স্যার, জানেন তো, অমুক ভট্টাচার্য সাহেব যখন এসডিও ছিলেন, ঠিক এমনি হয়েছিল। সেবারও নির্বাচন চলছিল, তারই মধ্যে ওনাকে নিয়েও এমনি মাঝ রাতে ছুটতে হয়েছিল।"


কথার সুর টেনে শৌভিক বলে, " অমুক সাহেব যখন ডায়মন্ড হারবারের এসডিও ছিলেন, নমিনেশন চলাকালীন ওনার পিতৃবয়োগ হয়। উনিও অমনি গিয়ে, দাহ করে, কাছা নিয়ে পরের দিন নমিনেশন নিয়েছিলেন।" জিজ্ঞাসা করি, "তুই কাছা নিবি না তো?" দৃঢ় ভাবে মাথা নাড়ে শৌভিক। "নিয়ম কানুন কিছু মানবি?" একই ভাবে মাথা নাড়ে দৃঢ়তার সঙ্গে। জানতাম এটাই বলবে। শ্বশুর মশাই নিজে চূড়ান্ত নাস্তিক ছিলেন, দাদা শ্বশুর বা দিদি শাশুড়ি মারা যেতে মানেননি কোন নিয়ম। তাঁর শিক্ষায় শিক্ষিত তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র, অন্য কিছু করবে, এটা দুরাশা। 


জানাই, আমি কিন্তু মানব।  শৌভিকের নাস্তিকতা নিয়ে যতটা গর্বিত ছিলেন শ্বশুর মশাই, আমার আস্তিকতা, পুজো,উপোস ইত্যাদি নিয়ে অখুশি তো ছিলেন না। বরং ভোর বেলা টাটকা ফুল তুলে পুজো করতে দেখে এক অদ্ভুত খুশির আভা ছড়িয়ে পড়ত বৃদ্ধের চোখেমুখে। 


 "বাবার বন্ধুদেরও খবর দিতে হবে -" মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে শৌভিক। " সবার নম্বর তো নেই। দীনু কাকুকে বলি, যাকে পারবে খবরটা দিয়ে দেয় যেন।" প্রায় মিনিট পনেরো পর, বাংলোর সামনে এসে দাঁড়ায় এক দ্বিচক্র যান, পিছনের আসন থেকে নেমে দৌড়ে আসে শৌভিকের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী। কোন মতে উর্দিটা গলিয়েছেন, হাতে একটা প্লাস্টিকের ঝোলা। " সরি স্যার, আপনি ছুটি দেবার পর দিদির বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। খবর পেয়েই ছুটে আসছি।" শৌভিক প্রশ্ন করে, " খেয়ে এসেছ তো?" 


অন্ধকার হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলে গাড়ি। হৃদয়ে অদ্ভুত এক দোদুল্যমানতা, হয়তো আয়া দিদি ভুল দেখেছে। হয়তো এখুনি ফোন আসবে, " অ বড়দা, কাকু আবার জেগে উঠিছেন।" সেই ফোন আর আসে না। অন্য ফোন আসতে থাকে এক গাদা, কাকারা, পিসি, পিসেমশাই পইপই করে বলতে থাকে, " সাবধানে আয়। আমরা তো আছি।" ছোট ভাইকে ফোন করে একই কথা শোনায় শৌভিক। আজ দুর্গাপুর-আসানসোল এলাকায় ভোট ছিল,গাড়ি ঘোড়া কিছুই সহজলভ্য নয়। তারওপর সঙ্গে অত ছোট বাচ্ছা, এত রাতে কোন হঠকারি সিদ্ধান্ত নেবার কোন দরকার নেই। 


নাচিন্দা মন্দিরের সামনে আলোর মালা, অক্ষয় তৃতীয়া উপলক্ষে মেলা বসেছে। এই তো মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেই অফিস থেকে ফিরলাম এই পথ দিয়ে। তখন ভাবছিলাম শ্রীমতী তুত্তুরীকে যদি একবার দেখাতে পারতাম এই আলোকমালা। পাশে শুকনো মুখে বসে আছে তুত্তুরী, মাঝে মাঝে ফিসফিস করে বলছে, " আমার খুব ভয় করছে মা। দাদু কি সত্যিই চলে গেছে? ফুলঝুরি যে বড্ড ছোট, ওর কি দাদুর কথা আদৌ কিছু মনে থাকবে?"


রাত সোয়া একটা, ঘুমন্ত শহরের বুক চিরে গাড়ি এসে থামল চেনা বাড়িটার সামনে। আপাতদৃষ্টিতে সব একই আছে, অথচ কিছুই আর এক নেই। এত ক্ষণ মনে হচ্ছিল সময় যেন কাটছেই না। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, এই পথ না শেষ হলেই বোধহয় ভালো ছিল। ফ্ল্যাটের বাইরে ছেড়ে রাখা এত গুলো জুতোই বলে দিচ্ছে এই বাড়িতে আজ কোন কিছুই স্বাভাবিক নেই।  চার ভাই, দুই ভাই বউ, বোন, ভগ্নিপতি, ভাইপো, ভাগ্নে, ভাগ্নে বউ ঘিরে আছে আমার মজলিশি শ্বশুরটাকে। আড্ডা দিতে বড় ভালোবাসতেন ভদ্রলোক। স্টাডি রুমের সিঙ্গেল খাটটাতে আজ একাই শুয়ে আছেন ভদ্রলোক। একটা চোখ যেন আধ বোজা, মুখটা সামান্য খোলা, ঠিক যেন ঘুমাচ্ছেন। একটা ইঞ্চি পাড় সাদা কাপড় বুক অবধি চাপা দেওয়া। পাখার হাওয়ায় সেটা এমন থিরথির করে কাঁপছে যেন মৃদু মন্দ শ্বাস নিচ্ছেন উনি। " ক্যাথেটার নিয়ে পাজামা পরতে অসুবিধা হচ্ছিল বলাতে, আমাজন থেকে একজোড়া ধুতি অর্ডার করেছিলাম বাবার জন্য। শেষে এই কাজে লাগল ধুতিটা -!"  মৃদু অথচ হালকা সুরে কাকে যেন বলে ওঠে শৌভিক।


রাত দুটো নাগাদ একে একে বাড়ি পাঠানো হল কাকা পিসিদের। সবাই বয়োজ্যেষ্ঠ, কেউই সম্পূর্ণ সুস্থ তো নয়, রাতটা একটু না জিরোলে শরীর দেবে কি করে। আবাসিক সমবায়ের জনৈক কর্তাব্যক্তি আগেই ডেকে এনেছিলেন ডাক্তার, তিনি দেখে গেছেন শ্বশুরমশাইকে। কথা দিয়ে গেছেন ভোর পাঁচটার সময় এসে ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দেবেন। শববাহী গাড়ি ইত্যাদির জন্যও শৌভিককে চিন্তা করতে নিষেধ করে গেছেন। সকাল সাতটা-আটটার মধ্যে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কাকা - পিসিরাও ততোক্ষণে এসে হাজির হবে সবাই। আপাতত অনন্ত প্রতীক্ষা। প্রাথমিক প্রতীক্ষা উমাদের জন্য। রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ কোন মতে একটা গাড়ি যোগাড় করে দুর্গাপুর থেকে রওনা দিয়েছে উমারা। 


শ্বশুর মশাইয়ের কাছেই বসে রইল শৌভিক। ছোট ভাই বলেছে ফোনে, "বাবাকে যেন একা ছাড়িস না, দাদা। " খানিকক্ষণ আমিও বসলাম, তারপর জায়গা ছেড়ে দিলাম তুত্তুরীকে। জীবনে প্রথম মৃত্যু দেখল মেয়েটা। ব্যাপারটা এখনও অনুধাবন করতে অসুবিধা হচ্ছে ওর। টেবিলের ওপর এখনও রাখা আছে শ্বশুর মশাইয়ের শেষ না করা বই, ডাইরিতে ওনার হাতে লেখা আজ পর্যন্ত কি কি ওষুধ খেয়েছেন, ঢাকা দেওয়া গ্লাসে অর্ধেক জল - সবকিছুই বাবার সাথে ভাগ করে নিতে চায় তুত্তুরী। মেয়ের মুখে সব খুঁটিনাটি শুনতে চায় শৌভিক। 


শাশুড়ি মা কিছুক্ষণ পরপরই জানতে চাইছেন, ছোট ছেলে কতদূর এল। দুঃখিত ভাবে মাথা নেড়ে বলছেন, "যে যাবার সে তো চলেই গেছে, ওরা এত রাতে অতটুকু বাচ্ছা নিয়ে এভাবে না এলেই ভালো করত।" কখনও বা বলছেন, " আচ্ছা অনিন্দিতা, তুমি গ্যাস বুক করতে পারো? আমি তো কিছুই জানি না। সব তোমার শ্বশুরমশাই করতেন।" সত্যিই শ্বশুর মশাই সব করতেন, টাকাপয়সা তোলা, গৃহ সহায়িকাদের বেতন দেওয়া, ফোনে দোকানবাজার, ওষুধ আনানো, বাড়ির প্রতিটা কোণে নজর রাখা - সব, সব করতেন অসুস্থ বৃদ্ধ একাই। বৃদ্ধা তো মোবাইলে ফোনটুকুও ধরতে স্বচ্ছন্দ নন। 


কাঁথি থেকে কলকাতা আসার পথে এই কথাটাই বলছিলাম আমরা,  এনাকে একা গৃহ সহায়িকা বা আয়া দিদির ভরসায় মহানগরে ছেড়ে যাওয়া অবাস্তব। তবে সে তো অনেক পরের কথা, এখনও তো শ্বশুরমশাই আছেন। ঘুমিয়ে আছেন স্টাডি রুমে। অপেক্ষা করছেন আদরের কনিষ্ঠ পুত্র আর পুত্রবধূর জন্য। চোখ রগড়ে, "আসছি" বলে হাঁক পেড়ে, দরজা খুলি আমি। আমার সামনেই সপরিবারে আমাদের উমারাণী। উমার কোলে সদ্য ফোটা ফুলের মত ঘুমন্ত ফুলঝুরি, মুখের মধ্যে দুটো আঙুল পুরে ঘুমাচ্ছে। দুহাত বাড়িয়ে কোলে নিই মেয়েটাকে, উমা কোন মতে জানতে চায়, " দিদিভাই, বাবা কোথায়?"

অনির ডাইরি ১৩ ই মে, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



কিছু কিছু রাত কেন যে আসে? আসবে একদিন এতো জানা কথাই, তাই বলে এমন অতর্কিতে কেন এসে হাজির হয়! দিব্য তো চলছিল দিনটা, গতানুগতিক ভাবে, সেই ভোরে ওঠা, তুত্তুরীকে স্কুলে পৌঁছানো, আমাদের অফিস, ফিরে এসে কফির কাপে দৈনিক চব্য, শ্রীমতী তুত্তুরীকে পড়তে বসানো, পড়া আধখেঁচড়া ফেলে ঝটপট চিকেন স্টু রান্না করা, সাড়ে নটায় নৈশভোজ - কোথাও এক বিন্দু বিচ্যুতি ছিল না দিনটার মধ্যে। 


রাত দশটা নাগাদ, মোবাইলটা নিয়ে বসলাম। একটা নতুন ওয়েব সিরিজ ধরেছি, সেটাই এবার দেখব যুৎ করে। পাঁচ মিনিট দেখেছি কি দেখিনি, দরজা খুলে ঢুকে এল শৌভিক। একদম সাধারণ ভাবে বলল, " বাবা মারা গেছে।" লিখতে বসে, এখনও হাত কাঁপছে, ধড়পড় করছে বুক।শুনে আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, " যাঃ! কি যাতা বলছিস।" তারপর খুব রাগ হল, একি ধরণের অলক্ষুণে কথাবার্তা। 


শৌভিক একই রকম শান্ত ভাবে বলল, " হ্যাঁ রে, সত্যি। বাবা মারা গেছে।" কোন মতে বললাম কে বলল? জবাব এল, " সবিতা দি ফোন করেছিল। বলল, কাকু এই মাত্র চলে গেলেন।" সবিতা দি হল বাড়ির দিনরাতের সহায়িকা। বৃদ্ধ-বৃদ্ধার নড়বড়ে শারীরিক অবস্থার জন্য, দুই বউয়ের পরোক্ষ ইন্ধনে, প্রবল ধমকধামক দিয়ে যাকে রাখতে বাধ্য করেছিল দুই ছেলে। 


কথা বলতে বলতেই হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখে শৌভিক, পরক্ষণেই ফোন করে সবিতা দিকে, " তুমি আমায় ফোন করার কতক্ষণ আগে ঘটেছে ঘটনাটা? দশ মিনিট? আচ্ছা, তার মানে ৯টা ৫০।" ফোন রেখে আবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে শৌভিক, "চার ঘণ্টার আগে ডেথ সার্টফিকেট পাওয়া যাবে না। তার মানে রাত দুটো। শব বাহী গাড়িও যোগাড় করতে হবে।" 


আমি অঝোরে কাঁদছি, ঘড়ি থেকে আমার দিকে চোখ নামিয়ে ধমকে উঠল, " দাঁড়া এখন ঘ্যানঘ্যান করিস না। আত্মীয়স্বজনদের ফোন করতে হবে। পিসিকে ফোন করে দি, ওই বরং সবাইকে খবর দিয়ে দিক। আমি গাড়িকে খবর দি, ব্যাগ গুছাই। সিকিউরিটিকে কি নেব,না নেব না?"   


বেশ খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে থাকি আমি, আমার বরটা কি যন্ত্র হয়ে গেল! বাবাকে ঘিরেই তো ঘুরত ওর জীবন। বাবার শিক্ষা, বাবার আদর্শ, বাবার জীবন দর্শন - থেকে বাবা বিচ্যুত হলেও, আমার বর হয় না। আর আজ যখন সেই বাবা চলে গেছে চিরতরে, ও এতটুকু ভেঙে পড়ছে না কেন? 


চোখ মুছে পাশের ঘরে গিয়ে দেখি, কাকে যেন ফোন করছে শৌভিক, " গুড ইভনিং ম্যাম। আমি শৌভিক বলছি, এসডিও কন্টাই। এই মাত্র খবর এল, আমার বাবা মারা গেছেন। যদি অনুমতি দেন তো -"। বুঝতে পারলাম মাননীয়া জেলা শাসক মহোদয়াকে ফোন করছে, স্টেশন লিভের অনুমতি নিতে। কাঁথিতে আগামী ২৫ শে মে নির্বাচন, এই মুহূর্তে শেষ পর্যায়ের কাজ চলছে পুরোদমে। আগামী কাল সকাল সাতটা থেকে শুরু হবে ইভিএম কমিশনিং এর কাজ। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সামনে, প্রতিটা ইভিএম মেশিন খুলে তাতে ব্যালট পেপার ভরে সিল করা। সেই কর্মযজ্ঞ চলবে কাল পরশু দুই দিন ধরে। 


"অনেক ধন্যবাদ ম্যাম" দিয়ে ফোন শেষ হল। বুঝলাম অনুমতি পেয়েছে। এবার ড্রাইভারকে ধরার পালা। সে বেচারী সবে খেতে বসেছিল। ব্যক্তিগত নম্বরে ততোক্ষণে একের পর এক ফোন এসেই চলেছে। কিছু শৌভিক ধরছে, কিছু আমি। তীব্র শোকের মধ্যেও পিসি দায়িত্ব নিয়ে সবাইকে খবর দিয়ে দিয়েছে, আর যথারীতি কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। আমরাও কি পারছি? আমি তো পারছি না। বিগত ১৬ বছরে কোনদিন বৃদ্ধকে সুস্থ দেখিনি। দু বার কর্কট রোগ জরাজীর্ণ করে দিয়েছিল শরীরের সব অঙ্গ তন্ত্র। তারওপর ছিল মারাত্মক শ্বাসকষ্ট। দিনে একবার, কখনও দুবার নেবুলাইজ করতেন। অক্সিজেন ও রাখা থাকত, প্রয়োজন হলেই যাতে নিতে পারেন। ইদানিং দেখা দিয়েছিল প্রস্টেটের সমস্যা। 


কিছুদিন আগেই প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, আধ বেলা ছুটি নিয়ে দৌড়ে এসেছিল শৌভিক। অথচ কিছুতেই ডাক্তারের কাছে গেলেন না বৃদ্ধ। যেন বড় ছেলেকে দেখার জন্যই ঘাপটি মেরে বসে ছিল যত ব্যাধি। ছেলে এল, ওমনি সব ঠিক। ফিরে যাবার সময় বারবার বলল শৌভিক, "কাঁথি চল"। তাও এলেন না। কেন যে এলেন না, কি জানি এলে হয়তো অন্য রকম হত সবকিছু। সেবার শৌভিক বলে এসেছিল," আগামী ২৬ শে মে পর্যন্ত কিন্তু আর আসতে পারব না। সাবধানে থেকো।"


 এই বলাটাই যেন কাল হয়ে গেল, বিগত দিন কয়েক ধরে এমন ছেলেমানুষী শুরু করলেন বৃদ্ধ। আজই তো সকালে ফোন করেছিল ছেলেটা, এই আবাসনে বাড়ি বাড়ি ঘুরে রক্ত -মল-মূত্রের নমুনা সংগ্রহ করে ছেলেটা। রাগত স্বরে বলল, " দিদি আর পারছি না। মেসোমশাইকে নিয়ে আমি জ্বলে পুড়ে মরলাম। একবার করে বলে," সুপ্রিয় এসে ক্যাথিটারটা লাগিয়ে দিয়ে যাও। দুদিন যেতে না যেতেই বলে, সুপ্রিয় খুলে দিয়ে যাও।" শুনুন দিদি,প্রতিবার ক্যাথিটার লাগাতে ২০০০ টাকা লাগে। সে ওনার টাকা, উনি জলে দিন। কিন্তু এই খোলা পরার চক্করে প্রতিবার রক্তক্ষরণ তো হচ্ছে। এইভাবে চলতে থাকলে ঈশ্বর না করুন, প্রস্টেট ক্যান্সার না হয়ে যায়। পরশু লাগিয়েছি,আজ বলছে আমি ডাক্তারের কাছে যাব, খুলে দিয়ে যাও। আমি আর যাচ্ছি না।"


কি সর্বনাশ, কোন ডাক্তারের কাছে যাবে আবার? হেঁপো বৃদ্ধের তো একা একা বাড়ি থেকে বেরোনোই নিষেধ। সেসব পাত্তা না দিয়ে এই তো দুদিন আগে কোন হাসপাতালে যেন ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিল একাকী। প্রস্টেট সংক্রান্ত ডাক্তার। দুর্গাপুর থেকে আমার দেওর পইপই করে নিষেধ করেছিল, বলেছিল," একটু দাঁড়িয়ে যাও, আমি আসছি।ঘন্টা চার- পাঁচের মধ্যে পৌঁছে যাব।" যথারীতি কথা শোনেনি বৃদ্ধ। তাকে ভুজুংভাজুং দিয়ে নিরস্ত করে, একাই চলে গিয়েছিল। সাধে আমার দেওর গোঁসা করে, যে "বাবা কেবল দাদাকেই ভরসা করে।" 


এত যে জেদ করে ডাক্তারের কাছে গেল,তার কথাও তো পছন্দ হল না বাবার। ক্যাথেটার লাগানো নিয়ে কোন কথাই শোনেননি নাকি ডাক্তার। বলেছেন, "ওতে অভ্যস্ত হতে হবে। এই সমস্যা আপনার চলতেই থাকবে। এই বয়সে ভুলেও অস্ত্রোপচারের কথা ভাববেন না।" তাও কি সব টেস্ট করিয়ে প্রায় চার পাঁচ ঘণ্টা পর বাড়ি ফিরেছিলেন বৃদ্ধ। অতক্ষণ হাসপাতালের হাওয়ায় থাকার জন্য সেকেন্ডারি ইনফেকশন হতে পারে বলে, জ্যেষ্ঠ পুত্রের কাছে তার জন্য প্রবল ধমকও খেয়েছেন। 


আবার সেই জ্যেষ্ঠ পুত্রেরই শরণাপন্ন হলাম আমি, "ওগো দেখো, বাবা কি করছে।" সকাল পৌনে দশটা নাগাদ বাবাকে ফোন করল শৌভিক, " আজ আবার কোন ডাক্তারের কাছে যাচ্ছ?" জানা গেল, কোন্নগরের আহমেদ ডাক্তারের কাছে যাবে শ্বাসকষ্টের জন্য। তিনি তো হোমিওপ্যাথ। আজ প্রায় তিরিশ বছর ধরে শ্বাসকষ্টে ভোগেন শ্বশুর মশাই, দীর্ঘদিন ধরে যে অ্যালোপাথ ডাক্তারকে দেখাতেন, তাকে আজকাল বাতিল করেছেন। কারণ তাঁর কাছে গেলেই তিনি বলেন, "আমার কাছে ঠিক কেন এসেছেন? ওষুধ, পত্র, নেবুলাইজার, স্টেরয়েড, অক্সিজেন সবই তো বাড়িতে মজুত থাকে। শ্বাসকষ্টের আর তো কোন চিকিৎসা নেই।" যথারীতি বাবার তাঁকে আর পছন্দ হয় না। সম্প্রতি দুয়েক বছর অন্য এক ডাক্তারকে দেখাচ্ছিলেন, তিনি পরের বার ব্রংকিয়োস্কপি করে যেতে বলেছিলেন। সেটা করতেও বাবার আতঙ্ক, তা না করিয়ে এবার তিনি হোমিওপ্যাথ ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে চাইছেন।


মনে আছে শৌভিক বলেছিল, " তুমি আগে স্টেরয়েডটা তো চালু করো। ভাই আসছে -"। আমার দেওর সত্যিই আসছিল, কিন্তু কপাল গুণে আজ ১৩ ই মে, দুর্গাপুরে নির্বাচন। একটা বাস, গাড়ি কিছু পায়নি। ট্রেনে অমানুষিক ভিড়। খোঁজ নিয়ে জানাল, কাল বিকাল থেকে হয়তো কিছু বাস চলবে। প্রথম বাসেই এসে হাজির হবে কলকাতা। দরকার হলে আহমেদ ডাক্তারকে বলেও ওষুধ আনা যায়, তাই আনবে। শৌভিক বলল, " তুমি ক্যাথেটারটা লাগিয়েই রেখো। দু সপ্তাহ পর্যন্ত তো লাগানো যায়, তারমধ্যে আমার ভোট মিটে গেলেই আমি ২৬ শে রাতেই চলে যাব। তারপর তোমাদের কাঁথি নিয়ে চলে আসব। তার আগে আসতে চাইলেও কোন অসুবিধা নেই,অনিন্দিতা তো আছে।" মনে আছে বৃদ্ধ বলেছিল, " হ্যাঁ, সেই ভালো। এখন আমি এমনিতেই বেশ ভালো আছি।" 


তড়িঘড়ি খাটের নীচের বাক্স খুলে ব্যাগ বার করে শৌভিক, কি সব জামা কাপড় ভরে হড়বড় করে। মেশিনের মত করে যায় একের পর এক কাজ, ফোন ধরে চলে যন্ত্রের মত। দুর্গাপুর থেকে এক গলা কান্না নিয়ে ফোন করে আমার দেওর, " বৌদি, বাবা আর নেই না?" কি জবাব দিই? বলি, " কাঁদিস না বাবা। সবিতা দি কি দেখতে কি দেখেছে। আমরা এখনই বেরোচ্ছি, গিয়ে দেখি। নিজে না দেখলে আমি অন্তত বিশ্বাস করছি না -"। পাশ থেকে শৌভিক বলে চলে, "নেই। নেই। বাবা আর নেই।বাবা চলে গেছে-"।

অনির ডাইরি ১১ই মে, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


ঠিক করেছিলাম, হীরামাণ্ডী দেখব না। কিছুতেই দেখব না। স্বাধীনতা পূর্ব অখণ্ড ভারত, পতিতালয়, একজন জাঁদরেল মহিলা চরিত্র আর স্বাধীনতা সংগ্রাম - বড় চেনা ছক হে বাপু। একটা রাজকাহিনীই যথেষ্ট ভাই, থাক আর দেখে কাজ নেই। 


১ লা মে, সারা ভারত ভেসে গেল হীরামাণ্ডী ঝড়ে, আমি ডুবে রইলাম চাকরি থেকে সাসপেন্ড হওয়া, obsessive-compulsive disorder এ ভোগা এক সত্যান্বেষী সাধু সান্নিধ্যে। Mr. Monk, তাঁর জটিল জটিল সব কেস আর তাঁর হাজারো ফোবিয়া নিয়ে দিব্য রইলাম আমি। সিদ্ধান্তে অনড় আমি, হীরামাণ্ডী দেখছি না। দেখব না বিগত সোমবার সুকন্যা যখন লিখল, "দুদিন ধরে হীরামাণ্ডী দেখলাম। কি জঘন্য মেলোড্রামাটিক লাগল -"। নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ালাম। আমার বাপু Mr Monkই ভালো। 


তারপরই হল কেলো। আমার দেওয়ালে হঠাৎই একদিন এসে উদয় হলেন ফরিদা জালাল। তাঁর মুগ্ধ নয়ন জুড়ে এক তরুণ যুবক। বৃদ্ধার বিলাত ফেরৎ নাতি, তাজদার বালোচ। গোটা রিল জুড়েই তাজদার, বিভিন্ন ভঙ্গিমায় তাজদার। শুধু তাকানো, আর মধুর হাসি। তাতেই কাঁপন ধরিয়ে দেয় হৃদয়ে, যেমন দিতেন সাদা কালো যুগের নায়কেরা। কে এই তাজদার বালোচ? আগে কি দেখেছি কোথাও? মুগ্ধ হৃদয় কিছুই বলে উঠতে অক্ষম। গুগল বলল, দেখেছ তো। আলবৎ দেখেছ। "তাজ - ডিভাইডেড বাই ব্লাড" সিরিজে। আরে এই তো সেই রগচটা শাহজাদা মুরাদ। 


মাগো, তাতে তো একটুও ভালো লাগেনি এনাকে। চোখে পুরু সুর্মা, দুই চোখে রাজ্যের বিরক্তি আর ক্রোধ। দেখলেই কেমন যেন ক্ষ্যাপা বলির্বদ মনে হত। সিংহাসনের মত ওই সিরিজের সব গোলাপী আলোও একজনই চুরি করে নিয়েছিলেন - শাহজাদা সেলিম। মুরাদ ছিল নিছক বিরক্তি উদ্রেককারী এক আপদ। তাজদার একদমই তার উল্টো। সফিস্টিকেটেড, শান্ত, মৃদু ভাষী। গুগল বলল, ইন্টারনেটের লেটেস্ট ক্রাশ এখন তাজদার। আরও জানতে পারলাম, হীরামাণ্ডীতে তাজদারের পরিণতি মোটেই সুখকর নয়, বরং মর্মান্তিক। তাতে যেন আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠল চরিত্রটা। সুকন্যাকে সবার আগে জানালাম, দেখব ভাবছি সিরিজটা। শুধু তাজদারের জন্য। সু বলল, "আরে অদিতি রাও হায়দারিকেও দেখো। কি অসাধারণ সুন্দর।" 


দেখতে শুরু করে আর সময়ের হিসেব রইল না। কাকে ছেড়ে কাকে দেখি? মণীষা কৈরালা তো একাই একশ। সোনাক্ষির বিষাক্ত নজর। অদিতির বিখ্যাত swan walk, হাঁটতে হাঁটতে কাঁধ থেকে আঁচল নামিয়ে আঙুলে প্যাঁচানো, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানো। উফ্। সবার ওপর উস্তাদ জী। কি অসামান্য অভিনয় ভদ্রলোকের। গল্প ইত্যাদি নিয়ে অবশ্য বলার কিছু নেই। বেশ সাদামাটা গল্প, তা হোক, আমরা তো এরকম কত বিলাতী শো দেখে গদগদ হয়ে যাই। আর এতো খাঁটি স্বদেশী। 


দেখতে শুরু করার আগে, শৌভিককে ঢাক ঢোল পিটিয়ে শুনিয়ে এলাম, আমি হড়কেছি। তাজদারের রিলটাও দেখলাম,আহা একই বলে "আঁখো কি গুস্তাকিয়া-"। আমার বর দিনান্তে বাড়ি এসে কফি খেতে বসেছিল, যথারীতি তাজদারকে পছন্দ হল না। আজ অবধি আমার কোন ক্রাশকেই বা আমার বরের পছন্দ হয়েছে? সবার মধ্যেই ও গুচ্ছের খুঁত খুঁজে বার করে এবং সুকুমার রায়ের কথা "না বুঝবি তো মগজে তোর গজাল দিয়ে গোঁজাব" করে সে গুলো আমার মাথায় ঢোকায়। 


প্রথম আপত্তি তুলল তাজদারের গোঁফ নিয়ে। আরে গোঁফ তো তোরও আছে রে ভাই। যখন দেখল মাথা থেকে তাজদারকে কোনভাবেই বার করতে পারছে না, তখন অন্য পথ ধরল। " আজ একটা দারুণ ভূতের সিনেমা দেখব। মালায়ালাম সিনেমা। ব্লক বাস্টার শুধু নয়, খুব হাই ক্রিটিক রেটিং ও পাচ্ছে। দেখবি? মামুট্টি আছে।" মামুট্টি আমার বাবার প্রিয়তম নায়ক তথা অভিনেতা। খুঁজে খুঁজে ইউটিউব থেকে মামুট্টির সিনেমা বার করে দেখে বাবা। আমি বরাবরই বাবার মেয়ে, বাবার যাকে পছন্দ, আমারও তাকেই ভালো লাগে। তবে এ ক্ষেত্রে মামুট্টির থেকেও যাকে বেশি পছন্দ হল, সে হল ভূত। ভূত বা ভৌতিক সিনেমা আমার চিরকালীন দুর্বলতা। 


 জিজ্ঞাসা করলাম, কি নাম? জবাব এল ভ্রমযুগম। মুখে কি ভাব ফুটল জানি না, শৌভিক চোখ গোল গোল করে বলল, " ভ্রমযুগম মানে জানিস? Age of madness।" চটজলদি নৈশভোজের পাট চুকিয়ে, ঘর অন্ধকার করে একরাশ উৎসাহ নিয়ে যুগলে দেখতে বসলাম। শ্রীমতী তুত্তুরীকেও আহ্বান জানানো হয়েছিল, তিনি যখন শুনলেন প্রায় আড়াই ঘণ্টার ছায়াছবি, সটান পিঠটান দিলেন। "বাবা গো, এত বড় সিনেমা কে দেখবে -"। 


অগত্যা আমি আর তুমিই ভরসা। শুরু হল সিনেমা। সাদাকালো। শুনলাম গোটা সিনেমাটাই নাকি সাদাকালো। ষোড়শ শতকের কেরালা। দক্ষিণ মালাবার অঞ্চলে পর্তুগিজ আক্রমণে পর্যুদস্ত এক রাজার দুই কর্মচারী, কোন মতে দাস ব্যবসায়ীদের হাত থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় এক গহীন জঙ্গলে। জঙ্গলের পাশ দিয়ে বয়ে যায় খরস্রোতা নদী, নদী টপকাতে পারলেই নিরাপদ আশ্রয়। অন্ধকারে নদী না পেরিয়ে,জঙ্গলের মধ্যেই আশ্রয় নেয় দুজনে। রাতের বেলা এক সুন্দরী পেত্নী ( যক্ষী) আক্রমণে নিহত হয় একজন, অন্যজন পালাতে পালাতে গিয়ে উপস্থিত হয় ভগ্নপ্রায় এক বিশাল অট্টালিকায়। 


এত বড় হাভেলী, কিন্তু বাসিন্দা কেবল দুই জন। বৃদ্ধ কিছুটা ক্ষেপা গৃহকর্তা কদুমন পোট্টি আর এক পাচক তথা গৃহসেবক। গৃহকর্তার নিমন্ত্রণে একটা রাতের জন্য থেকে যেতে রাজি হয়ে লোকটি, এমনিতেই বেশ কিছুদিন ধরে অভুক্ত। সামান্য দুমুঠো অন্নের জন্য থেকেই যায় লোকটি। এই থেকে যাওয়াই কাল হয়ে দাঁড়ায় হতভাগ্য লোকটির জন্য। কেন এবং কিভাবে সেটাই নিয়েই গল্প। যদি প্রশ্ন করেন,ভালো লেগেছে কি না, তো আমি তো অন্তত বলব মোটামুটি। অভিনয় নিয়ে কোন কথা হবে না, মাত্র তিনজন চরিত্র নিয়ে গড়িয়েছে গল্পটা। কদুমন পোট্টি - পাচক আর আশ্রিত ব্যক্তি। তিনজনেই ফাটিয়ে অভিনয় করেছে, কাকে ফেলে, কার কথা বলি। গোটা ফিল্মটাই সাদাকালো, এই বর্ণহীনতা আলাদাই এক মাত্রা এনে দেয় ভৌতিক সিনেমায়। শুধু আর একটু ছোট হলে বড় ভালো হত।  


সেটাই বললাম শৌভিককে। আর বললাম, ভূতটা মোটেই ভয় দেখানো টাইপ লয়। ভয় টয় কিস্যু তেমন লাগল না বাপু। শৌভিক মানলে তো নাই, উল্টে রেগে আগুন হয়ে বলল, " আসলে তুই কিছু বুঝিসই নি। এই সব সিনেমা তোর জন্য না, তুই যা তো, যা, গিয়ে হীরামাণ্ডীই দেখ।" যেন না বললে আমি দেখতাম না 😤।

অনির ডাইরি ৯ই মে, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



অফিসে বেরিয়ে, গাড়িতে উঠেই ফোনটা করলাম, " হ্যাপি বাড্ডে বাবা।" বিগত দিন কয়েক ধরেই, শ্বশুরমশাইয়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, গলার জোরও এসে ঠেকেছে তলানিতে, সেই অবস্থাতেই কোন মতে বললেন, " সে তো কালকে ছিল।"


সে আবার কি কথা, গতকাল কি করে থাকতে পারে? আজই তো ২৬ শে এপ্রিল, বাংলায় ১২ই বৈশাখ। আজকের দিনেই তো ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন ভদ্রলোক। আজকের দিনটার জন্য কবে থেকে আঁচলে গিঁট বেঁধে রেখেছি আমি। ভেবেছিলাম, তুত্তুরীকে বগলদাবা করে, সটান গিয়ে হাজির হব মহানগরে। সঙ্গে নিয়ে যাব পায়েস, কেক আর ওনার প্রিয় দুয়েকটি পদ। বৃদ্ধের হঠাৎ অসুস্থতা দিলে সব কেঁচে গণ্ডুষ করে। এবার তাই শুকনো ফোনই সম্বল।


কিন্তু বৃদ্ধ মানলে তো। যতবার আমি বলি, আজই আপনার জন্মদিন, ততোবার বৃদ্ধ বলে, "মোটেই না, গতকাল ছিল -।" এতো মহাজ্বালা। ভ্রাইভারের কান বাঁচিয়ে, দুদিক থেকে হিসেব করতে বসলাম দুজনে - ১৪ই এপ্রিল ছিল পয়লা বৈশাখ, তাহলে ১৫ই এপ্রিল, ২রা------- করতে করতে দেখা গেল, সত্যিই ২৬ নয়, ২৫ শে এপ্রিলই ছিল ১২ই বৈশাখ। শ্বশুরমশাইয়ের ৭৮ তম জন্মদিন। 


এক অদ্ভুত বিষাদের মেঘ পলকে ঢেকে দিল আমায়। ইশ্ বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়ে, এত বড় ভুল কি করে করতে পারলাম? পিসি - বাবা - মা- শ্বশুর মশাই আর শাশুড়ি মাতা এই পাঁচ বয়োজ্যেষ্ঠকে কেন্দ্র করেই প্রতি মুহূর্তে আবর্তিত হয় আমাদের জীবন। আর এই পাঁচজনের মধ্যে, জন্মদিন নিয়ে আবেগ কেবল এই বৃদ্ধেরই আছে। বাকিদের ক্ষেত্রে জন্মদিনটা "ভূতের আবার জন্মবার" গোছের হলেও, শ্বশুরমশাই কিন্তু আশা করেন যে ওনার জন্মদিনে সবাই উপস্থিত থাকব, পায়েস বানানো হবে, কেক কাটা হবে। নাতনীরা শোরগোল করবে। সস্তাতম হলেও একটা নতুন জামা গায়ে গলাবেন উনি - একটা দিন, বছরে কেবল একটা দিনের জন্য উনিই হবেন সকল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। 


২০২১ সাল অবধি তাই তো হত। তখন যে একসাথে থাকতাম সবাই। পেশার টানে ইদানিং ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছি আমরা। গেল বার যখন কাঁথি আসেন, কথা প্রসঙ্গে বলেই ফেলেছিলেন শ্বশুরমশাই। " আমার জন্মদিনটা কারো মনে থাকে না।" অভিমানটুকু যদিও ছিল শাশুড়ি মাতার প্রতি। তিনি যে সত্যিই ভুলে যান। ভুলে না গেলেও, তাঁর নিজেরই যা শারীরিক অবস্থা কতটুকুই বা করতে পারতেন তিনি। 


দুর্বল অস্থিচর্মসার বৃদ্ধের অভিমানী কথা গুলো বড়ই মর্মন্তুদ লেগেছিল আমার। তখনই ঠিক করেছিলাম শৌভিক না পারলেও, সবৎসা আমি ঠিক গিয়ে হাজির হব ওনার জন্মদিনে। এমনই ভাগ্যের পরিহাস যে জন্মদিনের ঠিক তিনদিন আগে ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়লেন বৃদ্ধ। এমনিতেই দু-দুবার কর্কট রোগাক্রান্ত, তারওপর আছে তীব্র শ্বাসকষ্ট। গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে আবার প্রস্টেট সংক্রান্ত জটিলতা। ডাক্তার সাফ বলে দিয়েছে, অপারেশনের প্রশ্নই ওঠে না। ওনার যা শারীরিক অবস্থা, ওই ধকল উনি নিতে পারবেন না। 


সেই সংক্রান্ত জটিলতায় হঠাৎ এমন কাবু হয়ে পড়েন, যে নির্বাচনী ব্যস্ততার মধ্যেও একদিনের ছুটি নিয়ে দৌড়াতে হয় শৌভিককে। ফলে বাতিল করতে হয়েছে আমাদের অতর্কিত হামলার পরিকল্পনা। ভাবলাম শুকনো একটু শুভেচ্ছাই জানাই, তাও একটু ভালো লাগবে বৃদ্ধের। জানাতে গিয়ে দেখি, তাতেও কেলো করেছি। বিলম্বিত শুভেচ্ছা জানালাম, বৃদ্ধ ধন্যবাদ দিল বটে, ছিটেফোঁটাও যে খুশি হল না, তা আমি এই পৌনে দুশ কিলোমিটার দূর থেকেও দিব্য অনুভব করলাম। মদ্যাভাবে গুড়ং দদাৎ কেস হল আর কি।


নাঃ, এত দূর থেকে এই অভিমানী বৃদ্ধের জন্মদিন পালন,যা দেখছি আমার একার দ্বারা সম্ভব নয়। কেন যে ইংরেজি মতের জন্মদিনটা পালন করেন না ভদ্রলোক, কে জানে বাবা। ফোনটা রেখে, উমাকে ধরলাম। বাড়ির ছোট বউ শুধু নয়,উমা হল বৃদ্ধের আদরের কন্যা। আমার মত অপদার্থ নয়,ও নির্ঘাত ঠিক টাইমে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। ওকেই বলি,ভাই রে পরের বার থেকে সঠিক তিথিটা আমাকেও একটু মনে করিয়ে দিস তো। 


হরি ! হরি! ফোন ধরে তিনি কইলেন, " না দিদিভাই, বাবার জন্মদিন তো ২৮ শে এপ্রিল। এই দেখো না, আমি রিমাইন্ডার দিয়ে রেখেছি, ফোন করব বলে।" নিজেদের গুণপনায় নিজেরাই মুগ্ধ হলাম, হাসলাম গলা ফাটিয়ে। তারপর প্রতিশ্রুতি বদ্ধ হলাম, সামনের বছর থেকে এপ্রিল পড়লেই মনে করিয়ে দেব একে অপরকে। তারপর যে প্রান্তেই থাকি না, বরগুলো যত ব্যস্তই থাকুক না কেন, ছানাগুলোকে ট্যাঁকে নিয়ে আমরা দুজনে ঠিক গিয়ে হাজির হব মহানগরের এক প্রান্তে বুড়োবুড়ির সংসারে। একজন পায়েস আনব, অন্যজন কেক। 


কিন্তু সেতো আসছে বছরের কথা, এবছর কি হবে? সময় যে বড় নির্মম, নিমেষে লণ্ডভণ্ড করে দেয় সব হিসেব।সময় বড় চঞ্চলও, মুঠোর ফাঁক গলে কেবলই হারিয়ে যেতে চায়। তাই বলে আমরা ছাড়ব নাকি? দুজনেরই টুকটাক কাজ ছিল মহানগরে, জুটিয়ে বাটিয়ে, নানা অজুহাত দেখিয়ে সব একই সঙ্গে ফেললাম আমরা। যাতে ওই সুযোগে মেলে মহানগর যাওয়ার অনুমতি। তারপর? তারপর আর কি! শ্বশুরমশাইয়ের দুই পুত্রবধূর সম্মিলিত উদ্যোগে কেক ও হল,পায়েসও হল, নাতনীদের হুল্লোড়ও হল।মাত্র এক সপ্তাহ দেরী হল এই যা। পাট ভাঙ্গা পাঞ্জাবি পড়লেন শ্বশুর মশাই, পরিপাটি করে আঁচড়ালেন মাথার চার গাছি চুল, তারপর জমিয়ে এসে বসলেন গিন্নীর পাশে। আলগোছে বললেন, "তুমিও একটা ভালো শাড়ি পরলেই তো পারতে।" আমরা ততক্ষণে চিৎকার জুড়েছি, ফুঁ দাও, ফুঁ দাও। যতটা অভিমান জমিয়েছিলে, ততো জোরে ফুঁ দাও তো দেখি।


চিত্র সৌজন্য - শ্রীমতী তুত্তুরী

অনির ডাইরি ৬ই মে, ২০২৪

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 


অফিসে ঢোকার ঠিক মুখেই ফোনটা বাজল। আজ ICSE আর ISC এর রেজাল্ট বেরিয়েছে, অনেকেই ফোন করে তাঁদের সন্তানদের রেজাল্টের খবর দিচ্ছেন। যখনই কেউ ফোন করছে, অভিনন্দন জানানো দূর আমি আকাশ থেকে পড়ছি, " কি বলছেন গো? আপনার ছেলে/মেয়ে? ICSE/ISC পাশ করেছে? কি করে সম্ভব? ওই পুঁচকে মেয়ে/ছেলেটাকে তো সেদিনই দেখলাম, নাক দিয়ে ইয়ে গড়াচ্ছে/ লুকিয়ে নাক খুঁটছে। সে কোন যাদু মন্ত্রে এত ধেড়ে হয়ে গেল রাতারাতি?" সময় এত দ্রুত কেন ছোটে, কে জানে। 


ভাবলাম তেমনই কেউ করছে বুঝি। আমার যে বয়সের গাছ পাথর রইল না, সেই অনুভূতি নতুন করে জাগাতে। ফোন খুলে দেখি আমার বর। তার আবার কি হল? এই তো ঘন্টা খানেক আগেই দেখা হল। "বেরো - বেরো- বেরো- বেরো" করে প্রায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ভাগাল বাড়ি থেকে। রোজই তাই করে, নাহলে আমি নাকি আরো দেরী করব, অফিস বেরোতে। 


অসময়ে বাড়ির ফোন এলে একটু ভয় ভয়ই লাগে। ফোন ধরে তাই বললাম, "কি আবার হল? সব ঠিক -"। কথা শেষ করতে না দিয়ে ওদিক থেকে গম্ভীর গলায় শৌভিক বলল, " আমার জুতোয় একটা ব্যাঙ ঢুকে বসেছিল।" প্রথমে মনে হল, এটা বলতে এই নির্বাচনী ব্যস্ততার মাঝে আমায় ফোন করেছে?  পরক্ষণেই অনুধাবন করলাম, জুতোয় ব্যাঙ ঢোকা মোটেই ভালো ব্যাপার লয়। বললাম, " ঝেড়ে পরেছিলি তো?" 


উল্টো দিক থেকে কাঁদো কাঁদো সুরে শৌভিক বলল, " না তো।" মানে কি? অ্যাঁ? ব্যাঙ একটা বড়সড় জিনিস, কিন্তু আরশোলা-মাকড়সা -টিকটিকি তো ঢুকে থাকতেই পারে। হরবখত ঢোকে, তাই তুত্তুররীকে ছোট থেকে জুতো ঝেড়ে পরতে শিখিয়েছি। অথচ তার বাপ সেটা শেখেনি?


 বলাতে শোভিক বলল, "আরে রোজই তো পরি। আজ তাড়া ছিল, তারওপর একটা ফোন ও এসেছিল। তাই কথা বলতে বলতে সটান দিয়েছি পা গলিয়ে। একটা পা দিব্য গলে গেল, অন্যটা আর গলেই না। জোর করে ঢোকাতে গেলাম, পায়ের আঙুলে কেমন যেন কুড়কুড় করল।" 


 উফ ভগবান। এমন আপদ, যে  বোঝেওনি যে ভিতরে একটা আস্ত জীব ঢুকে বসে আছে। তারওপর দিয়ে চেপে পা ঢোকাতে গেছে আবার। কে জানে,ব্যাঙটা আছে, না থেঁতলে গেছে? শৌভিক আশ্বস্ত করার ঢঙে বলে, " আছে, আছে। পা কেন ঢুকছে না দেখার জন্য আমি যখন জুতোর ভিতরে হাত গলালাম, হাত বার করে দেখি, হাতের ওপর বসে একটা হোৎকা ব্যাঙ গম্ভীর মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর আমার হাত থেকে সটান এক লাফ মেরে বাগানে পালিয়ে গেল।" 


নিজের কানকে বিশ্বাস হয় না। বলি, " তুই আবার জুতোর মধ্যে হাত ঢুকিয়ে ব্যাঙটাকে টেনে বারও করেছিস? এত বুদ্ধি রাখিস কোথায় রে?" ফোনের ওপাশে হিহি করে হাসতে থাকে শৌভিক।ছোটবেলায় ঠাকুমা বলত, ব্যাঙের গায়ে গরল থাকে, হাত দিলেই হাতে ঘা হয়। কে জানে, কোন হাত ঢুকিয়েছিল। কে জানে, কি হবে লোকটার হাতে। তবু ব্যাঙ অবধি ঠিক আছে, কিন্তু ব্যাঙ যার খাদক তিনি যদি ওমন ঘাপটি মেরে বসে থাকেন, কি হবে? তাকেও কি ওমন ন্যাজ ধরে টেনে বার করে সোহাগী ফোন করবে?  হে ঈশ্বর, কার পাল্লায় পড়েছি? আর হ্যাঁ, হে ঈশ্বর এটাও বলো দিকি বাপু, এটা বাড়ি না চিড়িয়াখানা?


অনির ডাইরি ১লা মে, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



আমার বাবা আর মায়ের প্রেম তথা বিবাহের গল্প আগেও বহুবার লিখেছি। কখনও ইনিয়েবিনিয়ে, কখনও বা সোজাসাপ্টা। আসলে আমি জন্ম রোমান্টিক, আর শরৎ বাবু বা শরদ্বিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এর দুয়েকটি হাতে গোনা গল্প বাদে, এটাই আমার প্রিয়তম প্রেমের গল্প। 


গ্রাম রামনগর, ব্লক বেলডাঙ্গা ২, জিলা মুর্শিদাবাদ, এটাই ছিল আমার মায়ের আদি ঠিকানা। মাতামহ যখন মারা যান, মা তখন নবম শ্রেণী, মা সদ্য শাড়ি। মাত্র দুটো শাড়ি ছিল মায়ের। একটা কাচত, একটা পরতো। তারই একটা হঠাৎ চুরি হয়ে গেল একদিন। নিরূপায় হয়ে দিদার সাদা থান পরেই কাটাতে হল মাকে বেশ কিছুদিন। খবর পেয়েই  এক জোড়া নতুন শাড়ি কিনে পাঠিয়ে দিল বড় মেসোমশাই। 


 মাতামহের অকাল মৃত্যুর পর নিঃসহায় এবং মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত দিদার হাত ধরে আশ্বাস দিয়েছিলেন বড় মেসোমশাই, " কেউ না থাকুক, আমি আছি। জামাতা নয়, আজ থেকে আমাকে নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্র বলেই মনে করবেন।" আমৃত্যু সেই প্রতিশ্রুতি পালন করে গেছেন মায়েদের "জাম্বু"। এহেন জাম্বুর নির্দেশেই একদিন রামনগরের লক্ষণ রেখা পেরিয়ে মহানগরের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিল মা। লক্ষ্য একটা চাকরী। 


পড়ন্ত বিকালে ঢলে পড়া সূর্যের আলোয় স্নাত হয়ে, লালগোলা প্যাসেঞ্জার থেকে শিয়ালদা স্টেশনে যখন নামল মা, বাংলা তখন জ্বলছে আগুনের সত্তরের দহনে। আপাততঃ ঠিকানা বড় মাসির বাড়ি। বড় মেসোমশাইয়ের কড়া নির্দেশ, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। স্বাবলম্বী হতেই হবে। তার জন্য কাজ চাই, একটা চাকরী। কিন্তু চাকরী পাওয়া কি এতই সহজ? 


বেশ কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করে, স্থানীয় পোস্ট অফিসে ছোটখাট কাজ জুটল। এমন কিছু না, খাম পোস্টকার্ড লিখে দেওয়া, ফিক্সড ডিপোজিটের ফর্ম ভরে দেওয়ার মামুলী কাজ। ভ্যাক্যান্সি থাকলে দুয়েক দিনের এক্সট্রা ডিপার্টমেন্টাল কর্মীর কাজ। তাতেও চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা। রোজ যে কাজ জোটে তা নয়,কোনদিন বেশ কয়েক টাকা জুটল,কোনদিন ঠনঠন গোপাল।বড় মেসোমশাইয়ের কড়া নির্দেশ, লেগে থাকো। অধ্যাবসায় না থাকলে কিস্যু হয় না। 


 কর্মসূত্রেই আলাপ শান্তি মাসির সাথে। মহিলা সদ্য বিধবা, এক কন্যা সন্তান নিয়ে বড় বিপদে আছেন। অনেকদিন বাচ্ছার দুধের টাকাও জোটে না। মৃত স্বামীর বন্ধুদের কাছে হাত পাতেন। ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে দুই নিঃসহায় রমণীর। খুলতে থাকে লুকিয়ে রাখা বেদনার ঝাঁপি। মা জানতে পারে, শান্তি মাসির স্বামী আদতে মৃত নয়, নিখোঁজ। প্রতিপক্ষ বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল, তারপর আর তার কোন খোঁজ মেলেনি। শোনা যায় পিটিয়ে মেরে লাশ গুম করে দেওয়া হয়েছে। শান্তি মাসির মাধ্যমেই মা পরিচিত হয় তাঁর মৃত স্বামীর বন্ধু থুড়ি কমরেডদের সাথে। কমরেডদের মধ্যমণি, এক  ভয়ানক আঁতেল নকশাল নেতা। গ্রাম থেকে জীবিকার সন্ধানে আসা কৃষ্ণাঙ্গী মেয়েটাকে মোটেই পাত্তা দেয় না সে। কিন্তু মেয়েটির যে  ওণাকে বড় ভালো লাগে। সাম্য- বিপ্লব-যৌথ খামার মার্কা বুলি মেয়েটির স্বঘোষিত মোটা মাথায় একবিন্দু ঢোকে না। তবুও নেতাবাবুর অনুগামিনী হয়ে পড়ে সে। সময় পেলেই পিছনের সারিতে বসে শুনতে থাকে দিন বদলের বৈপ্লবিক স্বপ্নের ইতিকথা।  


একজনের নীরব প্রেম আর একজনের খেয়াল না করার গল্প গড়ায় বেশ কিছুদিন। আচমকা পট পরিবর্তন ঘটে সাধের বঙ্গভূমিতে। কাশিপুর বরানগর ভেসে যায় রুধির ধারায়। বছর ঘুরে যায়, বদলায় না, পরিস্থিতি। উল্টে শুরু হয় ব্যাপক ধরপাকড়। নেতামশাইয়ের পৈতৃক বাড়িতে হামলা হয় সিপিএম-পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর। লুটপাট ভাঙচুরের সাথে বেধড়ক মেরেধরে তুলে নিয়ে যায় নেতাকে। মরেই যেত হয়তো। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় ছেলেটি। 


এরপর আর কি?জেলহাজত। জামিনে ছাড়াতে হল যে জরিমানা প্রদানের প্রয়োজন, তা ছেলেটির বৃদ্ধ পিতার সাধ্যাতীত। অনির্দিষ্ট কালের জন্য জেল হাজতে থাকার জন্য যখন ছেলেটি মানসিক ভাবে প্রস্তুত, হঠাৎ একদিন জানানো হল তার জামিন মঞ্জুর হয়েছে। জরিমানা কে দিল? বিক্রি করার মত আর কোন গহণাও ততোদিনে ছেলেটির মায়ের অবশিষ্ট নেই। অবশিষ্ট বলতে সাড়ে সাত বিঘার শরিকি পৈত্রিক বাড়ি শুধু। তবে কি বৃদ্ধ পিতা সেটাই করে বসল?


উদ্বিগ্ন হয়ে জেলের বাইরে বেরিয়ে রীতিমত চমকে গেল ছেলেটি, জেলের বাইরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সেই পিছনের সারিতে বসে থাকা কৃষ্ণাঙ্গী সরল গ্রাম্য মেয়েটি। দুজনেই নীরব, শেষে ছেলেটি জানতে চাইল, “টাকা জোটালে কি করে?” মেয়েটি মাটির দিকে তাকিয়ে জানালো, দেশে গিয়ে ধান বেচে টাকা আনতে একটু দেরী করে ফেলেছে। 


এরপরের গল্প শুধুই প্রেমের,রোদে বৃষ্টিতে হাত ধরে মাইলের পর মাইল হেঁটে যাওয়া। অবশেষে ১৯৭৪এর ১লা মে,শ্রমিক দিবসের দিন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয় দুইজনে। সেদিন কোন শাঁখ বাজেনি, কেউ উলু দেয়নি, মানা হয়নি কোন লোকাচার, এমনকি বরবেশও পরেনি ছেলেটি। মেয়েটি অবশ্য সেজেছিল, সামান্য প্রসাধন, ছেলেটিরই কিনে দেওয়া তুঁতে রঙের বেনারসী আর ধার করে আনা দিদির বিয়ের গয়নায়। সামান্য রেজিস্ট্রি বিবাহ, কনের তরফে সই করেন মেয়েটির জামাইবাবু তথা আমার বড় মেসোমশাই স্বর্গীয় অজিত কুমার সিংহ মহাশয় আর ছেলেটির তরফে জনৈক অবসর প্রাপ্ত আইসিএস অফিসার এইচ এল বেরি সাহেব। বাংলার নকশাল আন্দোলন নিয়ে বেরি সাহেবের মাত্রাতিরিক্ত উৎসাহই ওণাকে ছেলেটির ঘনিষ্ট তথা শুভানুধ্যায়ী বানিয়ে ছিল। 


ক্লেদাক্ত মহানগরের কোন এক নিভৃত কিনু গোয়ালার গলিতে লালনীল সংসার সাজায় এক হেরে যাওয়া নকশাল নেতা আর চাকরী সন্ধানে উন্মুখ এক নিপাট সরল মেয়ে। ফুল বিবর্জিত নিভৃত বাসরে ছেলেটি প্রতিশ্রুতি দেয়, "আমার পক্ষে আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। তবে তোমায় নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে। আজ থেকে আমিই তোমার শিক্ষক, প্রস্তুত হও ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষার জন্য।” 


সেদিনের সেই দামাল দম্পতির প্রেমবিবাহের আজ পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হল।