Friday 7 June 2024

অনির ডাইরি জুন, ২০২৪

 অনির ডাইরি ২৯শে জুন, ২০২৪

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 


পাঁজা পাঁজা ডেথ কেস নিয়ে বসেছে মুকুল। নির্বাচনী আদর্শ আচরণবিধির গুঁতোয় চার মাস কিছু ছাড়তে পারিনি আমরা। এবার কাজ গুটানোর পালা। সত্যি কথা বলতে কি, এই কাজটা করতে আমার একটুও ভালো লাগে না। প্রতিনিয়ত এত মানুষ মরে কেন? আমি একটা প্যাটার্ন দেখেছি, অধিকাংশ ডেথ কেসেই মৃতের বয়স হয় ৪২/৪৪ নয় ৫৭/৫৯। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, কিন্তু উপরিউক্ত চারটি বয়স যেন বড় ভয়াবহ। দুর্ঘটনা জনিত মৃত্যুর অবশ্য কোন বয়স নেই। একটু আগেই একটা ২৬ বছরের ছেলের কেস ছাড়লাম। নাইতে নেমে ডুবে মৃত্যু। 


স্বাভাবিক মৃত্যুতে ৫০ হাজার, দুর্ঘটনা জনিত মৃত্যুতে ২ লাখ ছাড়তে হয়। এত টাকার ব্যাপার, বিভিন্ন ধাপে খুঁটিয়ে দেখতে হয় সব। ছেলেটির ক্ষেত্রেও দেখতে হল। পুলিশ কি রিপোর্ট দিয়েছে, খুন টুন নয়তো? পেটে মদ পাওয়া যায়নি তো? অন্যান্য জীবন বীমার মত এখানেও আত্মহত্যা করলে অনুদান মেলে না। মেলে না মদ খেয়ে রেষারেষি করে মারা গেলে বা কোন দাঙ্গা হাঙ্গামায় প্রাণ হারালে। মস্ত পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট খুলে খুঁটিয়ে পড়ি, মুকুল আর আমি। ডাক্তারি পরিভাষা অধিকাংশই বোধগম্য হয় না। ভাগ্যে গুগল আছে। একটু আগেই তো একটা ডেথ কেস পেয়েছিলাম, যাতে কজ অব ডেথ ডাক্তার বাবু লিখেছেন AMI। 


লেঃ মুকুল আর লেঃ আমি, AMI মানে কি রে বাবা? ভাগ্যে গুগল বলল Acute myocardial infarction। এই শব্দ বন্ধ আমাদের পরিচিত। ডাক্তার বাবুর পরিচয় পড়তে গিয়ে দেখি, তিনি এমবিবিএস। মুকুলকে বলি, বুঝলে মুকুল, এলোপ্যাথি ডাক্তার, তাই এমন ভাবে লিখেছেন। 


হাসপাতালে মৃত্যু ছাড়া, এলোপ্যাথি ডাক্তার বাবুদের ডেথ সার্টিফিকেট আমরা পাই কোথায়? অধিকাংশই বিএসসি, ডিএমএস। অর্থাৎ হোমিওপ্যাথ ডাক্তার বাবু। মাঝে মধ্যে দুয়েক জন আয়ুর্বেদিক ডাক্তার বাবুও পেয়ে যাই আমরা। এনাদের সকলেই কমবেশী লেখেন কার্ডিও রেসপিরেটরি ফেলিওর বা সিভিএ।কেউ কেউ স্ট্রোক ও লেখেন। স্ট্রোকটাই যে CVA এটা বুঝতে আমার বেশ কিছু দিন সময় লেগেছিল। রেনাল ফেলিওর ও পাই। মেয়েদের ক্ষেত্রে ব্রেস্ট ক্যান্সার বা জরায়ু মুখ ক্যান্সার। 


কিছু দিন আগে এমনি একটি মেয়ের ডেথ কেস এসেছিল, খুবই অল্প বয়স। চেক করতে সময় লাগছিল বলে বরটি মাঝে মধ্যেই বন্ধু বান্ধব জুটিয়ে হম্বিতম্বি করে যেত ব্লক অফিসে এসে। একদিন তো ইন্সপেক্টর সাহেবকে বলেই ফেলল, টাকাটা পেলে নতুন করে বিয়ে করে। আমাদের গাফিলতিতে ছেলেটির ঘর বসছে না। ধমকিত, চমকিত হয়ে মুখ লাল করে আমার ঘরে এসে বসেছিল ইন্সপেক্টর সাহেব। ঘড়িতে বোধহয় চারটে বাজছিল, শীতের বেলা, সূর্যি মামা পাটে বসছিলেন, দুজনে নীরবে পোর্টাল খুলে মেয়েটির পাশবইয়ের ছবিটা দেখছিলাম। অল্প বয়সী হাসিখুশি একটা মেয়ে - একবার হারিয়ে গেলে কেউ মনে রাখে না। কিচ্ছু মনে রাখে না।


আর একটি কেস পেয়েছিলাম জলে ডুবে মৃত্যু। সংশ্লিষ্ট ইন্সপেক্টর সাহেব কিছুতেই ছাড়ছিলেন না কেসটা। বেশ কিছুদিন আটকে রেখে খুঁটিয়ে সব দেখছিলেন, নানা নথি আনতে বলছিলেন। পঞ্চায়েত প্রধানকে নিয়ে মেয়েটির বর আর শ্বশুর মশাই এসেছিলেন আমার কাছে। শত অনুরোধেও নাক গলাইনি আমি। বলেছিলাম আটকে যখন রেখেছে নিশ্চই কোন কারণ আছে। আমার ইন্সপেক্টরদের নাক বড় তীক্ষ্ণ। কিভাবে যে এরা ঘাপলার গন্ধ পায়। কিছুদিন আগে বেদজ্যোতি যেমন দুটি নির্ভেজাল সুন্দর আধার কার্ডকে জাল বলে পাকড়াও করেছিল। আমার সামনে যখন প্রমাণ সমেত নিয়ে এল কাগজ গুলো, আমি হতবাক। এরা তো আসলকে হার মানায় রে ভাই। এত প্রতিভা লোকগুলো রাখে কোথায়। আমার বিশ্বাস আর ইন্সপেক্টর সাহেবের সন্দেহকে সত্য প্রমাণ করে,ধরা পড়ে, মেয়েটি জলে ডুবে মারা যায়নি। মেরে জলে ফেলে দেওয়া হয়। 


এতদিন ধরে এই কাজ করছি, তাও কেন যে এত মন খারাপ হয় কাজটা করতে। আজ যেন দুর্ঘটনা জনিত মৃত্যুরই দিন, পরপর দুটি ছেলের কেস এল, পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু। একই জায়গায়। দুটি দুর্ঘটনাই আমাদের আপিসের স্বল্প দূরে রামতারকে ঘটেছে। একজন রাত ১০টা ৫ এ হেঁটে বাড়ি ফিরছিল,অন্য জন সকাল ১১টা নাগাদ বাস ধরবে বলে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিল। দুজনকেই মোটর সাইকেল ধাক্কা মেরে চলে যায়। দুজনেরই স্ত্রী আবেদন করেছে। সুন্দর হাতে লেখা বা টাইপ করা চিঠি, স্বামীর মৃত্যুতে শোকাহত স্ত্রী কেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আবেদন করতে পারেনি। তলায় সদ্য স্বাক্ষরের মত ইঁকড়িবিকড়ি করে নাম সই করেছে হতভাগ্য স্ত্রীরা। 


পেটের দায়ে কি যে জঘন্য কাজ করি। এত মন খারাপ হয়ে যায় এই কাজটা করতে। কিছুদিন আগে আমার এক বেবি ইন্সপেক্টর বলছিল, " আপনি শুধু পোর্টালে দেখে মন কষ্টে ভোগেন, আমাদের অবস্থাটা ভাবুন একবার ম্যাডাম। আমাদের এই কেসগুলোর এনকোয়ারি করতে হয় প্রত্যক্ষ ভাবে। কিছুদিন আগে এক ভদ্রমহিলা এসেছিলেন তাঁর ছেলের মৃত্যুর কেস ফাইল করতে,এত কাঁদছিলেন, এমন ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলেন ম্যাডাম, যে বিশ্বাস করুন মনে হচ্ছিল আমি অফিস ছেড়ে কোথাও পালিয়ে যাই।"


আজ অবশ্য একটানা ডেথ কেস ছাড়তে পারছি না আমরা। মাঝে মাঝেই এসে হামলা করছেন বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা।সপ্তাহ দুয়েক ছুটি নিয়েছিলাম কিনা। প্রথমে ঢুকলেন শাসক দলের শ্রমিক সংগঠনের এক নেতা। কম্পিউটারের দিকে তাকিয়েই বললাম, বলুন অমুক বাবু,কি সমস্যা? তিনি যুৎ করে বসে বললেন, " আগে বলুন ভালো আছেন? স্যার (অর্থাৎ শৌভিক) ভালো আছেন? বেবি (অর্থাৎ শ্রীমতী তুত্তুরী) ভালো আছে?" দায়সারা ভাবে জবাব দেবার পর প্রশ্নবাণ ভেসে এল, " বাবা মা? শ্বশুর শাশুড়ি?" এতক্ষণ ধরে হুঁ হুঁ করে জবাব দিতে থাকা আমি, এবার চেয়ার সমেত ঘুরে বসি। " ধুৎ শ্বশুর মশাই মারা গেছেন জানেন না?" 


চেয়ার থেকে প্রায় হড়কে পড়েন ভদ্রলোক, "অ্যাঁ! ওমা সেকি? কবে? কেন? কিভাবে? হায় হায় স্যার পিতৃহীন হয়ে গেলেন গো।" কাজ থামিয়ে আবার ঘুরে বসি ওনার দিকে, মুকুল এক মনে ডেথ কেসের পাতা উল্টাচ্ছে, মুখ লাল, হয়তো গরমে। সেদিকে আঙুল দেখিয়ে বলি, দেখছেন আপনাদের ব্লকের ইন্সপেক্টর সাহেব কেমন রাগে আগুন হয়ে যাচ্ছেন? ডেথ কেস না ছেড়ে শ্বশুর মশাইয়ের কথা বলার এটা কি সময় বলুন তো?" ভদ্রলোক থতমত খেয়ে গেলেন। পরিস্থিতি সামলাতে লঘু গলায় বলি, " আপনি আমার সাথে খোশ গল্প করতে এয়েছেন নাকি কোন কাজ নিয়ে এসেছেন? সেটা তো বলুন।" 


ভদ্রলোক যখন কাজের কথা তোলেন, বুঝতে পারি, কথায় দম আছে। সমস্যাটা ঠিকই ধরেছেন। সৌরভকে ডেকে পাঠাই, সবাই মিলে আলোচনা করে,মহানগরে ফোন করি। সদর আপিসের শীলমোহর অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সে মৌখিক হলেও চলবে। শীলমোহর পেয়েছি কি পাইনি, দরজা খুলে মুখ গলায় চঞ্চল।" ম্যাডাম অমুক ট্রেড ইউনিয়নের অমুক বাবু, তমুক ট্রেড ইউনিয়নের তমুক বাবু, ওদের কার্তিক বাবু, এদের গৌর বাবু সবাই আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন। ওনারা বলছেন একসাথে ঢুকতে দিলেও চলবে।" 


হেসে ফেলি সজোরে। চেম্বারে বসে থাকা শাসক দলের নেতাটির দিকে তাকিয়ে বলি, " দেখছেন তো, এতক্ষণ আমার ঘরে থাকলে কি হয়। অন্য ট্রেড ইউনিয়ন গুলো ভেবে নেয় সব সুবিধে বুঝি আমি আপনাকেই দিয়ে দিলাম।" দল বেঁধে ঘরে ঢোকা বর্ষীয়ান শ্রমিক নেতারা সমস্বরে প্রতিবাদ জানান, "না ম্যাডাম। আমাদের মধ্যে ওমন কোন ব্যাপার নেই। আপনি কথা বলছেন দেখে আমরা ভাবলাম, আমাদের কথা গুলোও যদি এট্টু শোনেন।" শাসক দলের নেতাটিও সহমত প্রকাশ করেন। 


আজব আপিস মাইরি আমার। এই আপিসে যাঁরা আসেন, রাজনৈতিক বৈরিতার আলখাল্লা যেন বাইরে খুলে আসেন। জনৈক বামপন্থী সংগঠনের নেতার পিছনে লাগি আমি, " আপনি যে বলেছিলেন বাংলা এবার লালে লাল হবে, তার কি হইল? ধুৎ মা লক্ষ্মীদের ওপর দোষ দিবেননি তো।" অপর নেতাকে কিছুদিন আগে চন্দ্রবোড়া সাপে কেটেছিল। তাঁর কুশল সংবাদ নিই আমি। ডেপুটেশন দেবার আগেই পরিস্থিতিকে ঘরোয়া বানিয়ে ফেলি আমি। এত বছর ল্যাবার গিরির কিছু তো সুফল আছে রে বাবা। 


মিনিট দশেকের মধ্যে সবাইকে বিদায় জানিয়ে পুনরায় ডেথ কেসে ফিরি আমি। আবার সেই মনখারাপ করা কাজ। প্রথম কেসটার ওপর মাউস রাখার আগেই ঘরে ঢুকে আসে সৌরভ আর নন্দন। সঙ্গে এক প্রৌঢ়। " ম্যাডাম এনার সদ্য পেনশন চালু হয়েছে। তেরো জনের নতুন পেনশন কেস কলকাতা অ্যাপ্রুভ করে পাঠিয়েছে আজ। ইনি তাঁদের অন্যতম। এনার আরো একটা পরিচয় আছে, ইনি ডিএম আপিসে জনৈক সাহেবের গাড়ি চালান। আমরা চাইছিলাম, আপনার হাত দিয়ে ওনার PPO (Pension Payment Order) টি দিতে।"


লাফিয়ে উঠি আমি, অভিনন্দন জানাই আমি। পোজ দিয়ে ছবি তুলি আমি, ভদ্রলোককে আগামী দিনগুলির জন্য অনেক শুভেচ্ছা জানাই আমি, তারপর খেয়াল হয়, " এই সৌরভ, এই নন্দন তোমরা আমার ছবি তুললে কেন? কাজ তো সব তোমরা করেছ বাবা। আর করেছে মহানগরে পরিবহন শ্রমিকদের বোর্ড। আমি কে? নিছক একটা দুটো সই আর ছবিটার গ্ল্যামার কসেন্ট বাড়ানো ছাড়া কি করেছি আমি?"


হিমভূমি থেকে অনির ডাইরি,২০শে জুন, ২০২৪

(পর্ব - ২) 

#অনিরডাইরি 


লাদাখ ভ্রমণের কথা ভাবলেই প্রথম যেটা মাথায় আসে, তা হল শ্বাসকষ্ট হবে না তো? শ্বাস কষ্ট হওয়াটাই তো স্বাভাবিক, আমরা বাঙালি, মোটামুটি সমুদ্র সমতলের বাসিন্দা, প্রতি প্রশ্বাসে ১০০% অক্সিজেন অণু নিতে অভ্যস্ত। শ্রীনগর বা মানালিতে সেটা কমে হয় ৭৮-৮৩ শতাংশ। খুব শ্বাসকষ্ট বা COPD তে ভোগা মানুষ ছাড়া, ওইটুকু তফাৎ আমরা বুঝতেও পারি না। লেহ তে কিন্তু ওটাই নেমে দাঁড়ায় ৬৫% এ। অর্থাৎ আপনি শ্বাস তো নিচ্ছেন, কিন্তু অক্সিজেন পাচ্ছেন অর্ধেকের একটু বেশি। কেউ যদি সটান ১০০ থেকে ৬৫ তে এসে হাজির হন, তাঁর ফুসফুস এই ফারাকটা মেটাতে অক্ষম হয়। তখনই শুরু হয় শ্বাস কষ্ট। 


সবার যে হয় তাও নয়, তবুও বর্তমানে সরকার নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন যে আপনি যদি বিমান পথে সটান লেহতে এসে নামেন আপনাকে অন্তত দুদিন লেহতেই থাকতে হবে। আমরা সড়ক পথে শ্রীনগর থেকে এসেছি, পথে কার্গিল এ একরাত কাটিয়েছি, তাও শৌভিক তিন রাত দুদিন বরাদ্দ করেছিল লেহ এর জন্য। 


লেহ এর প্রকৃতি এতটাই সুন্দর যে আপনি সত্যিই হোটেলে বসে জানলা দিয়ে নীল আকাশ  আর দূরের তুষার আবৃত পর্বত চূড়া দেখেই দিন কাটিয়ে দিতে পারেন। আকাশ যে কি অসম্ভব নীল এখানে বলে বোঝাতে পারব না। খালি চোখে অনেক অনেক দূর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পাবেন। এখানে রাত আটটা অবধি ঝকঝকে দিনের আলো থাকে। আবার ভোর পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার মধ্যে আলো ফুটে যায়। দূরের পাহাড় চূড়ায় ঝিলিক মারে রোদ। রাতে টলটলে আকাশে সোনার থালার মত চাঁদ ওঠে , ঝাঁপিয়ে পড়ে জোছনা।


সবাই লাদাখের শ্বাস কষ্ট নিয়ে সাবধান করে, ঠাণ্ডা নিয়ে সতর্ক করে, কিন্তু কেউ লাদাখের আলোর কথা বলে না। বাপরে কি চড়া আলো, লেহ তে প্রবেশ করার সাথে সাথে সানস্ক্রিন আর রোদ চশমা বাধ্যতামূলক। রোদ চশমার সাধ্য কি বশ মানায় এই আলোকে। চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়ে। 


স্থানীয় লোকজন, হোটেল কর্মচারী, ভাড়া গাড়ির ড্রাইভার সবাই আপনাকে সচেতন করতে থাকবে। অন্তত আমাদের তো করেছে, বলেছে জল খেতে থাকুন। এখানে তেষ্টা পায় না, তবুও কিছু ক্ষণ ছাড়া ছাড়া জল খান। হাইড্রেটেড থাকা ভীষণ জরুরী। বলেছে মাথায় পারলে ঘোমটার মত স্কার্ফ জড়ান, ফুল হাতা জামা কাপড় পরুন, শরীরের উন্মুক্ত অংশে দু আড়াই ঘণ্টা ছাড়া ছাড়া সানস্ক্রিন লাগান। এখানে রোদে আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মির পরিমাণ সাংঘাতিক বেশি। স্থানীয়দের কিছু হয় না, কিন্তু আমাদের শহুরে আদুরে ত্বক পুড়িয়ে ফোস্কা ফেলে দিতে পারে। 


প্রকৃতি ছাড়া লেহতে দেখার মত বলতে, আছে বেশ অনেক গুলি বৌদ্ধবিহার যেমন অলচি, শে, স্ফীটুক, ফেয়াং, হেমিস, থিকসে, লিকির ইত্যাদি। আর আছে কিছু রাজপ্রাসাদ যেমন লেহ প্যালেস, স্টোক প্যালেস, জোরাবর ফোর্ট ইত্যাদি,  আছে সিন্ধু নদ, আছে নিম্মু যেখানে মিলিত হয়েছে সিন্ধু আর যাস্কার নদী। 


এখানকার বৌদ্ধ বিহার গুলি অধিকাংশই প্রাচীন,নির্মাণ কাল পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতক। প্রায় প্রতিটি বিহারের প্রার্থনা গৃহে আঁকা রয়েছে চোখ জুড়ানো সব ছবি। ছবি গুলির বয়স বিহারের বয়সের সমানই প্রায়।  অধিকাংশ বিহারেই ছবি তোলা নিষেধ। অলচিতে তো ক্যামেরা এমনকি মোবাইল নিয়েও প্রবেশ নিষিদ্ধ। লকারে রেখে যেতে হয়। যেখানে অনুমতি মেলে, সেখানেও প্রায়ান্ধকার প্রার্থনা গৃহে  টিমটিমে আলোয় ছবি তুলতে হয়। 


প্রভু অবলোকিতেশ্বরের ছবিটি তেমনিই ভাবে তোলা। অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্বের এক রূপ,যাঁর এগারোটা মুখ এবং সহস্র বাহু। তথাগত বুদ্ধ চলে গেছেন, মৈত্রেয় বুদ্ধ এখনও আসেননি, এই মুহূর্তে জগৎ ও জীবনের ভার বহন করে চলেছেন অবলোকিতেশ্বর। এগারোটা মাথার মধ্যে দশটা মাথা দিয়ে তিনি দশ দিকে নজর রেখে চলেছেন আর হাজার হাত দিয়ে ভক্তদের রক্ষা   করে চলেছেন। কথিত আছে, ভুবনের ভার গ্রহণ করার  পর ভক্তদের দুর্দশা দেখে অবলোকিতেশ্বরের মস্তক বিদীর্ণ হয়ে যায়। তাঁর মাথা ফেটে এগারো টুকরো হয়ে যায়। তখন অমিতাভ বুদ্ধ সেই এগারোটি টুকরোর প্রতিটি থেকে একটি করে মুখ বানিয়ে দেন। যাতে সব দিকে সমান ভাবে নজর রাখতে পারেন অবলোকিতেশ্বর। সাথে সাথে দেন সহস্র বাহু, যাতে হাজার হাতে ভক্তদের রক্ষা করতে পারেন অবলোকিতেশ্বর 🙏।



হিমভূমি থেকে অনির ডাইরি ১৮ই জুন, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


লাদাখের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর কার্গিল। শ্রীনগর থেকে যোজিলা পাস ধরে কার্গিল পৌঁছাতে গুগল ম্যাপ বলে সময় লাগবে ঘণ্টা পাঁচেকের আশেপাশে। পথে বাধ্যতামূকভাবে সোনমার্গে থামে গাড়ি, জিরো পয়েন্টে থামে গাড়ি। আপনি যেখানে চাইবেন সেখানেই থামে গাড়ি। আর থামে দ্রাসে। 


কার্গিল থেকে ৬৩ কিলোমিটার দূরে, দ্রাস একটি আপাত শান্ত, চোখ জুড়ানো সবুজ পাহাড় দিয়ে ঘেরা উপত্যকা। চকচকে ন্যাশনাল হাইওয়ের একদিকে রয়েছে হাতে গোনা কয়েকটা ঝুপড়ি টাইপের দোকান, এক ডজন পর্যটক হঠাৎ এসে হাজির হলেই উপচে পড়ে দোকান গুলো। খাবার বলতে চা, কফি, মোমো, চাউমিন, ম্যাগি। ভাত ও পাবেন, পাঞ্জাব তথা উত্তর ভারতের রীতি অনুসারে রাজমা চাওল, দহি চাওল ইত্যাদি। চানা বাটোরাও খাচ্ছিল বটে লোকজন।


এই পুঁচকে দোকানগুলোর উল্টো দিকে, রাজপথের অপর পারে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত গোলাপী বালি পাথরের এক স্মৃতি সৌধ, পোশাকী নাম, কার্গিল ওয়ার মেমোরিয়াল। ওখানে ঘুমিয়ে আছেন কার্গিল যুদ্ধের বীর সেনানী বৃন্দ। প্রবেশ অবাধ, তবে ঢুকতে গেলে ভারতীয়ত্বের প্রমাণ দেখানো আবশ্যিক। বিশাল গোলাপী তোরণ এর সামনে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল হাতে, মাথায় হেলমেট, চোখে কালো চশমা পরে দাঁড়িয়ে আছে জনা কয়েক সিপাহী। তাঁদের একজনকে প্রত্যেকের আধার কার্ড দেখাতে হয়, তবে মেলে প্রবেশের অনুমতি। প্রবেশের পূর্বে অপর জন বিস্তারিত ভাবে বলে দেন এই স্মৃতি সৌধের মাহাত্ম্য। 


সেপ্টেম্বর থেকে প্রবল ঠাণ্ডায় দুর্গম হয়ে পড়ে এই সব এলাকা। বরফের পুরু চাদরে ঢেকে যায় চরাচর। ঠাণ্ডার দাপট থেকে বাঁচতে এই সময় ভারতীয় এবং পাকিস্তানি আর্মি করত কি, দুর্গম কিছু পোস্ট ফাঁকা রেখে নেমে যেত নীচের আবাস যোগ্য ছাউনি গুলিতে। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলেই উভয়ে পুনরায় দখল করে নিত যার যার ছাউনি। সবটাই বিশ্বাস আর ভরসার ব্যাপার। তবুও এটাই হয়ে আসছিল আবহমান কাল ধরে। 


কিন্তু ওই যে বলে না, যুদ্ধে অনৈতিক কিছুই নাই। ১৯৯৯ সালে শীতের দাপট কমতে যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী দখল করতে গেল তাদের ফেলে আসা ছাউনি, দেখা গেল বিস্তৃর্ণ এলাকা ততোদিনে দখল করে বসে আছে পাকিস্তান আর্মি। দ্রাস, কার্গিল, বাটালিক, টুরটুক ইত্যাদি ততোদিনে পাকিস্তানের দখলে। কৌশলগত ভাবে প্রতিটা পোস্ট এমন ভাবে বানানো,যে বাইরে বা নীচে থেকে তার দখল নেওয়া যতটা কঠিন। আকাশ পথে বিমান হানা করেও তাদের হঠানো সহজ নয়।আর অনুপ্রবেশকারীরাও তো খালি হাতে আসেনি, এনেছে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, কামান, রকেট লঞ্চার আরো কত কি। দস্তুর মত তৈরি হয়েই এসেছে ওরা। 


মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে চূড়ান্ত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে কিভাবে দখলীকৃত এলাকা পুনর্দখল করে ভারত, ছত্রে ছত্রে তাই বর্ণিত রয়েছে স্মৃতি সৌধের প্রতিটি ইঞ্চি জুড়ে। একসাথে তিনটি অপারেশন শুরু হয়, বায়ু পথে ভারতীয় বায়ুসেনার অপারেশন সফেদ সাগর। মাত্র তিন মাসের মধ্যে পাক্কা ৫০০০ বার বিমান হানা দেয় ভারতীয় বায়ুসেনারা। লক্ষ্য ছিল গর্তে লুকিয়ে থাকা শত্রুকে খুঁচিয়ে বার করে আনা। জলপথে ভারতীয় নৌবাহিনী শুরু করে অপারেশন তলোয়ার। জলপথে পাকিস্তানের সাপ্লাই চেন কেটে দেয় ভারতীয় নেভি। এবার লড়াই মাটির ওপর। এবার পালা সম্মুখ সমরের। শুরু হয় ভারতীয় সৈন্য বাহিনীর অপারেশন বিজয়। যাতে শহীদ হন ৫৪৫ জন বীর সেনানী। যাঁদের একজনের জীবনী নিয়েই সম্প্রতি তৈরি হয়েছে সুপার হিট ফিল্ম শেরশাহ। আজ্ঞে হ্যাঁ, পরম বীর চক্র বিজেতা ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা। 


মুখ্য তোরণ থেকে বাঁধানো রাস্তা সোজা চলে গেছে দূরে প্রায় ১০০ফুট উঁচু ভারতীয় পতাকার দিকে। পথের দুদিকে কালো পাথরের সমাধি রয়েছে ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা সহ অন্যান্য সেনানায়ক বৃন্দের। রাখা আছে বফর্স কামান। যা কেনা নিয়ে দুর্নীতি বিতর্ক টলিয়ে দিয়েছিল তৎকালীন সরকারের গদি আবার কার্গিল যুদ্ধে যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর মূল ভরসা। 

 সুউচ্চ পতাকাটির ডান দিকে ক্যাপ্টেন মনোজ পাণ্ডে মিউজিয়াম আর বাম দিকে যুদ্ধে নিহত সৈন্যদের সমাধি ফলক। মিউজিয়াম ভর্তি সেদিনের ছবি। যুদ্ধে জেতার পর হাসি মুখে আসল বীরেরা, যুদ্ধে শহীদ বীরেরা, যুদ্ধে মৃত শত্রু পক্ষ, যুদ্ধে অস্ত্র সমর্পণ করা শত্রু। আর রাখা আছে শয়ে শয়ে গুলি, রাইফেল, পিস্তল, বন্দুক ইত্যাদি। যা উদ্ধার হয়েছিল শত্রুর কাছ থেকে। উদ্ধার হয়েছিল পাকিস্তানের সবুজ পতাকাও, যা আজও টাঙানো আছে এই মিউজিয়ামে, তবে উল্টো করে।


অনির ডাইরি ১৪ই জুন, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


অবশেষে "লাপাতা লেডিজ" দেখলাম। দেখতে দেখতে দেখতে আর পাঁচজন সোহাগী বউয়ের মত আমারও মনে এই প্রশ্ন জাগছিল, আচ্ছা সত্যিই যদি আমি কোনদিন হারিয়ে যাই, আমার বর ও কি -। থাকতে না পেরে প্রশ্নটা করেই ফেললাম, " হ্যাঁ গো, আমি যদি কোনদিন হারিয়ে -"। নাহ শেষ করিনি প্রশ্নটা। কারণ মাঝপথে মনে পড়ে গেল, সত্যিই তো হারিয়ে গিয়েছিলাম আমি। 


সে অনেক কাল আগের কথা। বাংলা তখনও লাল। আর জঙ্গলমহল একটু বেশি লাল। রাজনৈতিক পরিবর্তন মধ্যবিত্তের বিলাসী স্বপ্ন মাত্র। আমি সহ শ্রম কমিশনার হিসেবে খড়্গপুরে কর্মরত। আট নমাস হল বিয়ে হয়েছে। মেদিনীপুর অফিস তখনও তৈরি হয়নি। ১৫টি ব্লক আর ২টি মিউনিসিপ্যালিটি, অথচ মাত্র ৪ জন ইন্সপেক্টর। প্রত্যেকেরই আয়ু কয়েক মাস মাত্র। যুবা ইন্সপেক্টর বা কম্প্যুটর জানা ক্লার্ক তখন কল্পনারও অতীত । মাসে মাত্র দশ দিনের গাড়ি। ফলে অনেক হিসাব করে চলতে হত।  


খড়্গপুর আইআইটি তখন ঠিকা শ্রমিক অসন্তোষে জর্জরিত । প্রায়ই ত্রিপাক্ষিক মিটিং ডাকতে হত মহকুমা শাসকের চেম্বারে। যদিও এটা আমাদের এক্তিয়ার ভুক্ত ছিল না, কিন্তু বারংবার অনুরোধ করলেও কেন্দ্রীয় সরকারী লেবার এনফোর্সমেন্ট অফিসারের দেখা পাওয়া যেত না। শ্রমিক সংগঠন গুলি এমনিই জঙ্গী ছিল যে এই মিটিং মানেই গণ্ডগোল অনিবার্য। তৎকালীন মহকুমা শাসকের প্রবল ব্যক্তিত্বের ভয়ে শুধু হাতাহাতিটুকু হত না।


 সেদিনের মিটিং শেষ হতে হতে সন্ধ্যা ৬টা। ডিসেম্বর মাস, তেমনি জমিয়ে পড়েছে শীত। শৌভিক তখন বিডিও খড়্গপুর-২। খড়্গপুরের মাত্র দুটো স্টেশন পর মাদপুর নামক গ্রামে আমাদের লালনীল সংসার । আমার ফিরতে দেরী হলে প্রায় দিনই ও ছুঁতোনাতা করে এসডিও অফিসে এসে হাজির হত। সেদিনও মিটিং শেষে ফোন করলাম, যদি আনতে আসে। দুর্ভাগ্যবশত সেদিনই কি যেন কাজে আটকে গিয়েছিল শৌভিক, ফলে ট্রেন ছাড়া গতি নেই।  


খড়্গপুর এসডিও অফিস থেকে রেল স্টেশন ছিল হেঁটে আড়াই মিনিট । ৫টা৪৫ এ একটা টাটা লোকাল ছিল, যেটা কখনই সময়ে আসত না। ফলে আশা ছিল পেয়েই যাব। স্টেশনে পৌছে দেখি থিকথিক করছে লোক। বহু ট্রেন বাতিল। তখন জঙ্গলমহল দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন কোটেশ্বর রাও, ওরফে কিষণজী। যৌথ বাহিনী তখনও সক্রিয় নয়। ট্রেন বাতিল হওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। স্টেশনে পৌঁছে শুনি, আমার টাটা প্যাসেঞ্জারও বাতিল হয়েছে।  


হ্যাংলার মত শৌভিককে আবার ফোন করলাম, যদি ম্যানেজ করে এসে নিয়ে যায় একটু। জবাব এল,“স্টেশনে অপেক্ষা কর। আসছি। ” তুত্তরীর আগমনের খবর সবে ঘোষিত হয়েছে। প্রাকমাতৃত্বকালীন ক্লান্তি হঠাৎ হঠাৎ আক্রমণ করত আমায়। সেদিনও এমনি আক্রমণে বেসামাল হয়ে স্টেশনের বেঞ্চে বসে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই,হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে শুনি টাটা প্যাসেঞ্জার আসছে। 


তড়িঘড়ি শৌভিককে ফোন করে বারণ করি। ততক্ষণে ওর গাড়ি হাই রোডের কাছে এসে পড়েছিল। তাও আরো ১৮/১৯ কিলোমিটার তো বটেই। বরং মাদপুর ষ্টেশনে গাড়িটা থাকলে সুবিধা হয়। স্টেশন থেকে বিডিও কোয়ার্টার হাঁটা পথে মিনিট চার। কিন্ত পথটা বড় নির্জন, যার খানিকটা আবার বাঁশবনের মধ্যে দিয়ে যেতে হত। ভর সন্ধ্যে বেলা শ্রীমতী তুত্তুরীকে উদরে বহন করে ওই পথে যেতে গা শিরশির করত। মাথায় একটা লোহার কাঁটা বা চাবি গুঁজে যাতায়াত করতে বলত জেঠাইমা। যাতে ভূতে না ধরে আর কি। 


শৌভিক আমার ফোন পেয়ে ফিরে গেল, যেতে যেতে আমাকে জানিয়ে গেল, স্টেশনে গাড়ি থাকবে।  


 ট্রেন ছাড়লো। বেশ ভিড়। কোন মতে এক টুকরো সিট্ পেলাম। শীতের ভয়ে জানলা বন্ধ। বাইরেও ঘুট্ঘুটে অন্ধকার । বেশ কিছুক্ষণ পর ট্রেন থামল। আন্দাজ করলাম জকপুর। পরের স্টেশনে নামব। আর মিনিট পাঁচ মাত্র। দরজার কাছে এগিয়ে যাব বলে উঠে পড়লাম। আমার সামনে দাঁড়ানো প্রৌঢ়কে ইঙ্গিত করলাম বসতে, উনি সৌজন্যবশতঃ রাজি হলেন না। বলতে বাধ্য হলাম, যে আমার গন্তব্য মাদপুর । বলা মাত্র কামরায় যেন বাজ পড়ল। “ মাদপুর? এটাতো মাদপুর যায় না। ” বলে সমস্বরে চিৎকার করে উঠলেন একাধিক ব্যক্তি । 


“মানে? এটা হাওড়া যাচ্ছে তো?” ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। উত্তর শুনে আতঙ্কের শীতল স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে। ট্রেনটা ঝাড়গ্রাম হয়ে টাটা যাচ্ছে। ঝাড়গ্রাম তখন প্রায় মুক্তাঞ্চল। খুনজখম রোজকার ঘটনা।


ট্রেন তখনও ছাড়েনি। দৌড়ে নামতে গেলাম, পারলাম না। জায়গাটার নাম নিমপুরা। রাতের নিমপুরা ছিল কয়লা মাফিয়াদের বিচরণভূমি। একলা মহিলা সহযাত্রীকে সেখানে কেউ নামতে দিতে রাজি না। দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে যা দেখলাম, আমারও সাহস হল না। কোন প্লাটফর্মের বালাই নেই। অন্ধকার রেলইয়ার্ড। সারি সারি মালগাড়ি শবদেহের মত নিশ্চুপ পড়ে আছে। অগত্যা সহযাত্রীদের উপদেশ শিরোধার্য।  


 হতাশ হয়ে পড়লাম। আমার কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে জনৈক মহিলা বললেন, “ আমি কলাইকুন্ডা নামব।তুমিও নেমো। বাড়ির লোককে বল কলাইকুন্ডা আসতে। ” বাড়ির লোককে আসতেই হবে, কারণ বাস ট্রেকারের গল্প ছেড়েই দিলাম,রাতে ফিরে যাবার কোন ট্রেন পর্যন্ত নেই।সবই কিষণজীর দয়া।   


শৌভিককে ফোন করব কি, টাওয়ার শূন্য । কোনমতে কান্না সংবরণ করলাম। সৌভাগ্যবশত কলাইকুন্ডা আসার আগেই দুটি টাওয়ার পেলাম। রিং হতেই, শৌভিকের উদ্গ্রীব কন্ঠস্বর,“কোথায়? শৈবালদা (বিডিও সাহেবের ড্রাইভার) অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর খোঁজ নিয়ে জেনেছে ট্রেন ক্যানসেল। আমরা তোকে আনতে খড়্গপুর যাচ্ছি।” ঐ মুহূর্তে, প্রিয় কন্ঠস্বর শুনে আবেগে গলা বুজে আসল। কোনমতে সব বললাম। শুনে শৌভিক বলল,“সর্বনাশ । কলাইকুন্ডায় নেমে, নিজের পরিচয় দিয়ে স্টেশনমাষ্টারের ঘরে বস। আমি আসছি। ”


 কলাইকুন্ডায় পৌছে চক্ষু চড়কগাছ। এ কোথায় এলাম? ট্রেন কি চক্রাকারে ঘুরে আবার নিমপুরায় ফিরে এল? সেই অন্ধকার রেলইয়ার্ড। সারি সারি মৃতমালগাড়ি । প্লাটফর্ম বা স্টেশনমাষ্টারের ঘর কই? ভ্যাবাচাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছি, বাকিরা নেমে অন্ধকারে হারিয়ে গেল। শুধু সেই মহিলা যাননি। অধৈর্য হয়ে বললেন, “নামো। ট্রেন ছেড়ে দিবে যে। ” 


নামতে গিয়ে দেখি, সিঁড়ি শেষ হয়ে যাবার পরেও বেশ খানিকটা লাফাতে হবে। ফার্স্ট ট্রেইমস্টার সবে পেরিয়েছে, ডাক্তার বাবু বলেছেন, " মা এবং বেবি উভয়ের জন্যই এটা হ্যাপি পিরিয়ড"। আশা করি লাফালে কিছু হবে না, পরমেশ্বরের নাম নিয়ে ঝপাং করে লাফ দিলাম।  


লাফ দিলেই বা কি, দুটি ট্রেনের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। কোন রাস্তা নেই। ভদ্রমহিলাকে অনুনয় করে বললাম, “যদি দয়া করে একটু স্টেশনমাষ্টারের ঘরটা দেখিয়ে দেন। ” উনি পাত্তা দিলেন না। বললেন ,“ ওখানে যেতে হবে নি। আমার সাথে এস। কে আসছে? বর? বল কলাইকুন্ডা বাজারে আসতে। হাইরোডের ওপর। আসতে সুবিধা হবে। ”


ফোন মৃত। টাওয়ার নেই। নিরুপায় হয়ে ওনাকে অনুসরণ করতে থাকলাম। তেলের ট্যাঙ্কারের তলা দিয়ে উবু হয়ে কোনমতে গলে, এপারে এসে দেখি, নিশ্ছিদ্র অন্ধকারময় চরাচর । অন্ধের মত মহিলার পিছু পিছু হাঁটছি। বুঝতে পারছি পিচ রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, দুদিকে বিশাল বিশাল মহীরুহের কঙ্কাল। হাঁটছি আর ভাবছি, কি কি হতে পারে এই মুহূর্তে আমার সঙ্গে। ভাবছি আমায় খুঁজতে এসে কি বিপদে পড়তে পারে আমার বর। ভাবছি আর কেঁপে উঠছি।


ভদ্রমহিলার কোন বিকার নেই, উনি নানা প্রশ্ন করতে করতে চলেছেন। আমি কি করি। বাপের বাড়ি কোথায়। বর কি করে। বর কিসে আনতে আসছে ইত্যাদি। মেপে উত্তর দিচ্ছি। বললাম শ্রম দপ্তরে কাজ করি। বর মাদপুর বিডিও অফিসে মালপত্র সরবরাহ করে। বিডিও সাহেব খুব ভাল। ওনার গাড়িটা দিয়েছেন নিয়ে যাবার জন্য। মিথ্যা বলতে খারাপ লাগছিল। কিন্তু নিরূপায় । প্রায় প্রতিদিন কোন না কোন পঞ্চায়েত প্রধানের গলাকাটা মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দু একজন শিক্ষক বা সরকারি কর্মচারীও থাকছেন মৃত্যুমিছিলে। সে যে কি অন্ধকার দিন। 


বেশ কিছুটা হেটে হাইরোডে পড়লাম। অন্ধকার কিছুটা ফ্যাকাশে । কয়েকটা ফাঁকা চালা দেখে বুঝতে পারলাম বাজারে এসেছি। বাজার কোথায়, এতো জনমানবশূন্য বাজারের কঙ্কাল। শুধু একটা মিষ্টির দোকানে একটা জিরো পাওয়ারের আলো জ্বলছে। দোকান ফাঁকা। একটা বুড়ো লোক বসে বসে বিড়ি ফুঁকছে। মহিলা একটা বন্ধ দোকানে টোকা মারতে অর্ধেক ঝাঁপ খুলে এক বছর ২৩/২৪ এর ছেলের মুখ দেখা গেল। মহিলার নির্দেশে সে চেন দিয়ে বাঁধা একটা ল্যান্ডফোন এগিয়ে দিল।  


 ফোনে প্রিয়তমের কন্ঠস্বর শুনে আবার বুজে এল গলা। ভাগ্যিস এত রাতেও অচেনা নম্বরের ফোনটা ধরেছিল। সব খুলে বললাম, মৃদু ধমকাল, ওর কথা না শুনে স্টেশন ছেড়ে এসেছি বলে। ফোন রেখে মিষ্টির দোকানের মচমচে বেঞ্চে এসে বসলাম। শৌভিক বলেছে মিনিট পনেরোর মধ্যে পৌছে যাবে। ভদ্রমহিলাকে বললাম, আমার জন্য অনেক করেছেন। অনেক রাত হল, এবার বাড়ি যান। উনি কর্ণপাত করলেন না। নানা প্রশ্ন করছেন। আমাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মাপছেন। আমি শুধু জানতে পারলাম ওনার নাম পার্বতী মাহাতো। WBSEDCL চাকরি করেন।  


নামেই হাইরোড। এতক্ষণ বসে রইলাম, বাস, ট্রেকার ছাড়ুন একটা মোটরবাইক, সাইকেল ও চোখে পড়ল না। মিনিট পনেরো পরে দূরে সত্যিই একজোড়া হেডলাইট দেখা গেল। উন্মত্ত হয়ে দৌড়ে গেলাম মাঝরাস্তায়। হ্যাঁ। শৌভিকের গাড়িই বটে। অ-বাতানুকূল সাদা এম্বাসেডর। মহিলাও দৌড়ে এলেন। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষলেন শৈবাল দা। বামদিকের দরজা খুলে সরে বসল শৌভিক। লাফিয়ে উঠে দড়াম করে দরজা বন্ধ করলাম। জানলা দিয়ে হাত নাড়লাম পার্বতীদির দিকে। ইশারায় শৌভিককে দেখিয়ে বললাম “আমার বর”। উনি মৃদু হেসে হাত নাড়লেন। রকেটের বেগে উল্টোদিকে দৌড়ল গাড়ি। 


গাড়ি ছাড়ার পর সেদিনের শৌভিক কেবল বলেছিল, "তোমার যে এত গুণ -"। সেদিনের শৌভিকের মতোই বাক্য সম্পূর্ণ করি না আমি। থাক, কিছু প্রশ্ন - কিছু উত্তর অনুক্তই থাক।  


পুনশ্চ - লাপতা লেডিজ আমার মোটামুটি লেগেছে। আহামরি মোটেও নয়। বরং বেশ সাদামাটা। ছক ভাঙার চেষ্টাটাও যেন কেমন চর্বিতচর্বণ মনে হয়েছে আমার। কিছুটা পঞ্চায়েত, কিছুটা লিপস্টিক আন্ডার মাই বুরখা, কিছুটা অন্য কি যেন, যার নাম পেটে আসে কিন্তু মুখে আসে না। অভিনয় ও নেহাৎ যথাযথ। খুব অসামান্য কিছু না। 


আর কোয়ার্টারে ফিরে সেদিন আমার মুখে সব শুনে আমার বাবার দৃঢ় ধারণা হয়, ভদ্রমহিলা নির্ঘাত স্থানীয় মাওবাদী কমিটির মহিলা কমান্ডার। নিজের মতবাদের সমর্থনে বাবা জোর গলায় চ্যালেঞ্জ করেছিল, যে ঐ মহিলার দেওয়া সব তথ্য ভূয়ো। আমি ওনাকে কিছুতেই খুঁজে পাব না। আমি কিন্তু সত্যি খুজে পায়নি। হয়তো অন্যমনস্ক ছিলাম, শুনতে ভূল করেছি— অথবা বাবাই ঠিক। কিছু রহস্য না সমাধান হওয়াই ভাল। কি বলেন?

অনির ডাইরি ১১ই জুন, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


লোকটা খুব বাজে। খুব খুব বাজে লোক। বয়স আশি ছাড়িয়েছে কম দিন তো হল না, ধূমপানের আধিক্যে ফুসফুস দুটো যে ঝাঁঝরা, তাও অজানা নেই লোকটার। যে ছোকরা ডাক্তারকে এতকাল দেখিয়ে এসেছে, সে এখন আর ছোকরা নেই যদিও, প্রায় পায়ে ধরে নিষেধ করেছিল, " কাকু সিগারেটটা প্লিজ ছাড়ুন। আর মিষ্টিটাও।"


আজ্ঞে হ্যাঁ, মিষ্টি। সুগার ধরেছে বেশি দিন না, বছর দশেক হবে, ওই বয়সের অন্যান্য মানুষজন কি করে? বিষবৎ মিষ্টিকে পরিত্যাগ করে তাই তো? আইয়ে কভি বুড়োর হাভেলি পে, দেখবেন কি নেই - ফ্রিজে পাবেন জ্যাম, চিটচিটে আমের চাটনি, মিটসেফে পাবেন মুড়কি আর গুড়ের বাতাসা। খুঁজলে চিনির বাতাসা বা মুড়কিও যে পাবেন না, একথা জোর গলায় বলতে পারি না। বাড়ির কেয়ার গিভার যে দিদি তাঁর ওপরে নির্দেশ আছে, সকালে কাজে আসার সময় তেল - লুন - লকড়ি, সিগারেটের (আজ্ঞে হ্যাঁ দৈনিক ২প্যাকেট) মত নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির পাশাপাশি, গলির মুখের বিহারী দোকান থেকে মাঝে মাঝেই গরম জিলিপি, গজা, বালুসাই কিনে আনার জন্য। সবাই মিলে, চায়ের টেবিলে চাকুম চুকুম আর কি।


মুঠোফোন মারফৎ এই সব খবরাখবর যখন আমার কানে এসে পৌঁছায়, মনে হয় খামচে মাথার সব চুল ছিঁড়ে ফেলি। আর কি করব বলুন তো? দেড়শ কিলোমিটার দূর থেকে আর কি করতে পারি আমি? কেয়ার গিভার মেয়েটিকেই ধমকাই-চমকাই আমি, মেয়েটি কাঁদো কাঁদো সুরে বলে, "কি করব দিদিভাই? না এনে দিলে মেসোমশাই একা একাই নড়বড় করতে করতে বেরিয়ে পড়েন সিগারেট কিনতে।"


আমি গিয়ে অশান্তি করি, তাঁর গলার জোর আমার থেকেও বেশি। আর জোর যার, মুলুক ও যে তাঁর। তিনি আজকাল আমার কোন কথাতেই কর্ণপাত করেন না। সে নাই করুন, নিয়মিত ডাক্তার তো দেখানো দরকার, তার আগে দরকার কিছু নৈমিত্তিক পরীক্ষা করার। এত দূর থেকে ফোনে ব্যবস্থা করে লোক পাঠাই, তিনি তাঁর সঙ্গে খোশ গল্প করে তাঁকে ভাগিয়ে দেন। ছেলেটি আমায় ফোন করে বলে, " দিদি মেসোমশাই কথা দিয়েছেন,দুয়েক দিনের মধ্যেই আমায় ডাকবেন।" 


কেন দুয়েক দিন, তা বুঝতে আমার বাকি থাকে না। লোকটা দিন কয়েক মিষ্টি না খেয়ে সুগার কমিয়ে তারপর রক্ত দেবে। যাতে প্রাথমিক রিপোর্ট ঠিক আসে আর কি। দুয়েক দিন গড়িয়ে যায় মাসের পর। শ্বশুর মশাইয়ের হঠাৎ প্রয়াণ, শাশুড়ি মাকে শিকড় শুদ্ধ তুলে নিয়ে কাঁথি আসা, শৌভিকের নির্বাচন সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল পাগল হয়ে যাচ্ছি বুঝি, ফলে মাঝে বেশ কিছু দিন খোঁজ নিতে পারিনি আমি। লোকটাও দিব্য চালিয়ে গেছে তার (অ)স্বাভাবিক জীবন যাত্রা।  


ভোট শেষে বাড়ি ফিরবে শৌভিক, সময়াভাবে শ্বশুর মশাইয়ের ডেথ সার্টিফিকেটটাও তুলতে পারেনি এত দিন। আরো নানা কাজ আছে, শাশুড়ি মাতাকে নিয়েই ফিরতে হবে এবার, শুধু ফেরাই নয়,ওনাকে নিয়ে যেতে হবে ট্রেজারি ও, নাহলে চালু হবে না পেনশন - ফলে দিন দুয়েক ছুটি নিয়েই যাবে। ভাবলাম এই মওকায় লোকটাকেও ডাক্তার দেখিয়ে আসি, একটা বেলার তো ব্যাপার। 


যে ছেলেটি টেস্ট করে তাকেই শুধালাম বাড়ির কাছে কোন ভালো ডাক্তার বসেন কি, যাঁর কাছে বেশি ক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না। এতদিন যাকে দেখানো হত, তিনি এতটাই দূরে বসেন, আর তেমনি ভিড় হয়। ছেলেটি বিশ বছর ধরে এই পরিবারের সাথে যুক্ত, অনেক সুখ দুঃখের সাথী। চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করি, ছেলেটি বলল, " দিদি আপনি ডাক্তারঠাকুরকে দেখাতে পারেন। শুনেছি ভালো ডাক্তার। গলির মুখেই তো বসেন।" 


নামটাও ছেলেটি লিখিয়ে দিল, দুই নম্বরে নাম। তবে তার আগে টেস্ট গুলো করিয়ে নিলাম আমি, অধমের মাথায় যা যা এল, সব টেস্ট। দেখা গেল সোডিয়াম বেশ কম আর মূত্রে প্রোটিন বেরিয়ে যাচ্ছে। বাকি ঠিকই লাগল। নির্দিষ্ট দিনে বাড়ির দরজায় এসে থামল টোটো, গলির মধ্যে বাড়ি আমাদের, গাড়িতে উঠতে গেলেও হাঁটতে হবে কয়েক পা।টোটো চলে আসে চৌকাঠের কাছে। 


 আমার ধমক খেয়ে লাঠি ধরে গুটগুট করে টোটোয় গিয়ে উঠল লোকটা। হাঁপাচ্ছে খুব। দুমিনিট গেলেই ডায়গনস্টিক সেন্টার, সেখানেই বসেন ডাক্তার বাবু। টোটো থেকে নেমে চেম্বারের বাইরে অবধি কয়েক গজ যেতেও হাঁপিয়ে পড়ে লোকটা। আজ বোধহয় একটু বেশীই হাঁফায় লোকটা। গায়ে এখনও সিগারেটের গন্ধ। পর্যায়ক্রমে বাতানুকূল যন্ত্র এবং পাখার হাওয়ায় কিঞ্চিৎ ধাতস্থ হতে না হতেই ডাক পড়ে ভিতরে। অল্প বয়সী ডাক্তার, মিষ্টি ব্যবহার। " আসুন কাকা, বসুন।" রিপোর্ট গুলো দেখেন, আঙুলে পালস অক্সিমিটার লাগান, ব্লাড প্রেশার মাপেন, বুকে স্টেথো ঠেকান অতঃপর, খসখস করে প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, " ওনার বুকের মধ্যে তো গান বাজনা চলছে। নিউমোনিয়া বাঁধিয়েছেন। এখুনি হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।"


বাতনুকূল যন্ত্রের মৃদু গুনগুন শব্দ ছাড়া নিঃশব্দ চরাচর। বুড়ো লোকটার মুখটা পলকে শুকিয়ে আমসি হয়ে যায়। অন্য দিনের থেকে সামান্য বেশি হাঁপালেও হাঁপাতে পারে, বাকি তো কিছু অস্বাভাবিকতা আমাদের নজরে পড়ছে না। বললাম বাড়িতে রেখে চিকিৎসা কি একেবারেই সম্ভব নয়। মডেলদের মত করে প্রথমে হাসেন ডাক্তার বাবু, তারপর মীনা কুমারীর মত দুচোখে এসে জমে মন খারাপ করা মেঘ,মাথা নাড়িয়ে বলেন, " যত শীঘ্র সম্ভব ভর্তি করে দিন। দেখুন অমুক, অমুক জায়গায় যদি বেড পান।" অমুক এবং অমুক প্রাইভেট নার্সিং হোম। এখানেই খটকা লাগে আমার।


শুধাই, আপনি কোন ওষুধ লিখলেন না? এতদিন যা খাচ্ছে তার ডোজ কমবেশী কিছু করবেন না? উনি বলেন, "যা লিখেছি ওটা হাসপাতালের জন্য। দেখলেই ওরা বুঝবে।" চেম্বার ছেড়ে বেরিয়ে আসি আমরা। টোটোওয়ালা বাইরেই বসে ছিল আমাদের জন্য। টোটো থেকে নামিয়ে, হাত ধরে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল বৃদ্ধকে। একই ভাবে আবার ফেরৎ নিয়ে যায় টোটো অবধি।


মাথা কাজ করছে না আমার। এত রাতে কি করি? তবে যাই করি না কেন, নিকটবর্তী প্রাইভেট নার্সিং হোমে নিয়ে যাব না। ২০২১ সালে মধ্য হাওড়ার দুই নার্সিং হোমে যা নারকীয় অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এখনও দুঃস্বপ্ন দেখি মাঝে মধ্যে। টোটোওয়ালা বুদ্ধি দেয়, "আজ রাতটা অক্সিজেন দিয়ে দেখুন না দিদি।" মনস্থ করি, তাই করব, কাল সকালে গাড়ি ভাড়া করে সোজা কাঁথি, মাননীয় মহকুমা শাসক বলে দিলে কাঁথি হাসপাতালে একটা বেড কি আর পাওয়া যাবে না? মধ্যবিত্ত শহুরে বাঙালি সরকারী হাসপাতালগুলিকে যতই খিস্তিখেউর করুক না কেন, সরকারী হাসপাতাল এবং সরকারী ডাক্তারদের কোন তুলনা হয় না। 


শৌভিক কে ফোন করতে খুব সঙ্কোচ হচ্ছিল।বেচারা সবমিলিয়ে এমন ফেঁসে আছে। দুদণ্ড জিরোতেও পারছে না লোকটা। তবুও করলাম। শৌভিক শুনে বলল, " কোন এন্টিবায়োটিক দেয়নি?" বললাম না তো। কেবল বলছে, নিউমোনিয়া আর হাসপাতালে ভর্তি করতে। শৌভিক বলল, " শোন নিউমোনিয়া আমার বাবার ও হয়েছিল। মনে আছে আমরা দীঘায় ছিলাম, বাড়ি থেকে আয়া মাসি হাউমাউ করে ফোন করেছিল?" খুব মনে আছে সেদিনটার কথা। কি ভাবে যে মাথা ঠাণ্ডা রেখে, কাঁথি হাসপাতালের ডাক্তার বাবুকে ফোন করে সে যাত্রা বাবাকে বাঁচিয়েছিল শৌভিক। 


শৌভিক বলল, " একদম। শুধু ফোনে সব শুনে ওষুধ দিয়েছিল অভিষেক ডাক্তার। তুই আমাকে সব রিপোর্ট, এই ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন আর এমনিতে কি ওষুধ খায়, সব জানা।" বাড়ি এসে এদিক ওদিক ফোন করি আমি। অক্সিজেন এর ব্যবস্থা করি আমি। একরাতের জন্য অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর দিতে চায় না কেউ। এক মাসের গল্পে আসুন। 


ডাক্তার বাবু রাউন্ডে আছেন জানায় শৌভিক, ঘণ্টা খানেক বাদে সব দেখে জানাবেন। একটা ঘণ্টা রীতিমত হৃদপিণ্ড মুঠোয় ধরে বসে থাকি আমি। রাত নটা নাগাদ আসে সেই কাঙ্ক্ষিত ফোনটা, শৌভিকের জবানীতে ভেসে আসে বিস্ময়, " এতো আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করছে, হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেছেন কেন? রিপোর্ট দেখে তো স্যার আমি কিছু বুঝছি না। ওনার যা বয়স বলছেন রিপোর্ট তো এমনিই আসার কথা। চেস্টের এক্সরে করিয়েছেন কি?" জবাব দিই, কই না তো। সব শুনে তিনটি ওষুধ লিখে দেন ডাক্তার বাবু, আর দুটি ওষুধ দেন দিনে দুবার নেবুলাইজ করার জন্য। বলেন, " অক্সিজেনটা মাপতে থাকবেন স্যার। যদি অনেক ক্ষণ ধরে ৮০র অনেক নীচে থাকে, বা রোগী যদি ভুলভাল বকতে থাকে,তাহলে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করে দেবেন। আর দিন কয়েক পর বুকের একটা ছবি (Xray) তুলে একটু আমায় পাঠাবেন। অন্য ওষুধ উনি যা খান, আপাতত তাই খাবেন।" 


রাত সোয়া নটা, কোন মতে খুঁজে পেতে ধুলো ঝেড়ে বার করি পালস অক্সিমিটার, বৃদ্ধের আঙুলে লাগিয়ে রিডিং আসে ৯৫-৯৬। সহরষে নিজের বরকে সে খবর দিই আমি।অতঃপর বেরিয়ে পড়ি ওষুধ কিনতে। আজ রাতেই কয়েক দাগ ওষুধ পড়ে গেলে, হয়তো সুস্থ হয়ে উঠবে বৃদ্ধ। বন্ধ হতে বসা কদমতলা বাজারের এক কোনের প্রায় ঝাঁপ ফেলা সাহেবী নামের ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনে ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরি আমি। নতুন করে আঙুলে লাগাই পালস অক্সিমিটার, রিডিং ৯০ এর অনেক ওপরে। বরং বৃদ্ধার রিডিং ৮০ এর অনেক কম আসে। ফুসফুসের রোগে তো তিনিও ভোগেন। বৃদ্ধের পাশে বসে আঘ্রাণ করেন যে সিগারেটের ধোঁয়া গুলো। ইনহেলার নেবার কথা রোজ সকাল বিকাল মনে করাই তুত্তুরী আর আমি। আজ চেক করতে গিয়ে দেখি ইনহেলার শেষ হয়ে গেছে কবেই, অথচ তিনি নৈমিত্তিক স্তোক বাক্য দেন, " হ্যাঁ নিয়েছি। আমি খুব ভালো আছি।" এবাড়িতে সবাই এত মিথ্যুক কেন? 


ভাগ্যে আন্দাজে কিনে এনেছিলাম বৃদ্ধার ওষুধটাও। প্রায় ঘাড় ধরে দুটোকে ওষুধ খাওয়াই, টানাই আমরা মা - মেয়ে। সারা রাত মাপা হয় অক্সিজেন। পরদিন সকালে দুজনেই ফিট। অক্সিজেন লেভেল ও যথাযথ। কেয়ার গিভার মেয়েটিকে ফোন করে বলা হয়, "আজ থেকে আর সিগারেট আনিস না। দিদিভাই আছে, জানিসই তো কেমন মাথা গরম। কুরুক্ষেত্র কাণ্ড করছে কাল থেকে।" শৌভিককে বলা হয়, " তুমি ওকে নিয়ে যাও। আর পারছি না। একে একটাও সিগারেট খাইনি সকাল থেকে, তারওপর তোমার বউয়ের চোপা। উফ পাগল পাগল লাগছে রে বাবা -"। এরপর ও বলবেন লোকটা ভালো? সাধে আমার ঠাকুমা বলতো, " কলি যুগে উপকারীকে বাঘে খায়।" ঘোর কলি বুঝলেন, ঘোর কলি।


পুনশ্চঃ- সব চরিত্র কাল্পনিক কিন্তু। আর হ্যাঁ, ছবির মানুষ গুলোর সাথে লেখার কুন সম্পর্ক লাই ।



অনির ডাইরি ৬ই জুন, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


আমি বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর মধ্যে পড়ি না। বরং "বুদ্ধুজীব" হিসেবেই অধিক স্বচ্ছন্দ বোধ করি। বিশেষত রাজনৈতিক সচেতনতা নিয়ে যদি কথা বলেন, তো জোর গলায় বলতে পারি, আমার দপ্তরী বাহনচালকও আমার থেকে অধিক সচেতন। কত কিছু যে জানতে পারি ভদ্রলোকের থেকে। আসমুদ্রহিমাচল জুড়ে যাবতীয় রাজনৈতিক কূটকচালি, আকচাআকচি সব ভদ্রলোকের নখদর্পণে।


গ্রাম্য রাজনীতি যে মহানগর কেন্দ্রিক রাজনীতির থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র তা আমি পদে পদে টের পাই, ওনার সৌজন্যে। যেমন ধরুন, কিছুদিন আগে উনি আমাকে বললেন, " জানেন তো ম্যাডাম, আমাদের গাঁয়ের বউ ঝিরা অমুক পার্টির ওপর খুব খেপে আছে।" প্রশ্ন করার আগেই ভেসে আসে উত্তর, " আসলে গেল বার তো ওরা সব বাড়িতে একটা করে শাড়ি আর সানিয়া মির্জা দিয়েছিল।" 

এবার কথা থামাতে বাধ্য হই আমি, প্রশ্ন করি, বাড়ি বাড়ি একটা করে সানিয়া মির্জা মানে কি? এত জন সানিয়া মির্জা এল কোথা থেকে? ভদ্রলোক এক গলা জিভ কেটে বলেন, " আপনারা অন্য কিছু বলেন নাকি?" তারপর ইশারায় বোঝান নাকের নথ। সহস্রাব্দের শুরুর দিকে সানিয়া মির্জা নাকে যে সোনালী রিংটা পরতেন, তেমনি কিছু হবে বুঝে আর এগোই না। 


ভোট চাইতে উপঢৌকন দেওয়া যে দণ্ডনীয় অপরাধ তা ভুলে প্রশ্ন করি, সব বাড়িতে শাড়ি দিয়েছিল? কি শাড়ি? জবাব আসে, " ওই যে গো, হাটে বিকোয়, একশ দুইশ টাকার শাড়ি।" এক দুশো টাকায় শাড়ি হয়? বলতে গিয়েও, বলি না। মনে পড়ে যায়, চুঁচুড়ায় থাকতে ঝুমার সাথে গিয়েছিলাম বটে একটা ওমন হাটে। দেড়শ টাকা দিয়ে একখান শাড়ি আম্মো কিনিছিলাম। পরার পর মনে হয়ে ছিল মশারি পরেছি বুঝি। হোক মশারি, তাও তো শাড়ি বটে রে বাবা। তাও ফোকোটে পাওয়া, তারওপর আবার নথ, তা যারা এত কিছু দিয়েছিল গেল বার,তাদের এবার ভোট দিবেনি কেন? ড্রাইভার সাহেব মিচকে হেসে বলেন, "নকল ছেল ম্যাডাম। সোনার রং করা ছিল। নাকে পরতেই রং উঠি গেছে।"


জিজ্ঞাসা করলাম, আপনাদের বাড়িতেও দিয়েছিল? জবাব দিলেন, " না ম্যাডাম। আমরা কোন দলে নাই তো। তাই দেয়নি। আমাদের কিছুই দেয় না। সেবার ঝড়ে অত ক্ষতি হল, একটা ত্রিপল চাইতে গ্যালাম, তাই দিলে না। শেষে আপনি বলে দিলেন বলে নূপুর দা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে ব্লক থেকে একটা যোগাড় করে দিলে।" বাকিটা ব্যক্তিগত বলে আর কথা বাড়াই না। 


তখনও ঘোষিত হয়নি নির্বাচনী নির্ঘণ্ট, আমার এই অরাজনৈতিক ড্রাইভারকে নিয়ে বেশ খুশিই ছিলাম আমি। নির্বাচন ঘোষণা হবার সাথে সাথেই দেখি তিনি এক দলে নাম লিখিয়ে বসে আছেন। তা ভালো,স্বাধীন দেশের নাগরিক,রাজনৈতিক ভাবে সক্রিয় হওয়াটাই তো বাঞ্ছনীয়। আপিসের ডিউটি সেরেই,দৌড়ে দৌড়ে দাদার আপিসে হাজিরা দিতে যান, দেওয়াল লিখতে যান, ফেস্টুন ব্যানার বানাতে দিতে যান।  দল বেঁধে গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ান, দাদার জন্য ভোট মাগেন। আর পরদিন আপিস যাবার পথে আমায় গল্প শোনান। "জানেন ম্যাডাম, ওদের বাড়ি ১৫টা ভোট, তাই বলে কি ওরা যা ইচ্ছে তাই চাইবে? ওদের ১৭ বছরের ছেলে, কোথা থিকা একটা ১৫ বছরের মেয়েকে ভাগিয়ে এনিছে। পুলিশও ওমনি কেস দিয়ে দিছে, ছেলেটাকে বয়েজ হোমে আর মেয়েটাকে গার্লস হোমে চালান করে দিয়েছে। এখন ওরা বলে কিনা, তোমার দাদাকে বলে আমাদের ছেলেকে ছাড়িয়ে এনে দাও -। আমি সোজা বলেছি,আমি পারব না। তখন বলে কি, আমরা এত বছর ধরে ওই পার্টি করি, আজ যদি পার্টি আমাদের পাশে না দাঁড়ায়, তো ভোটের কথা ভুলে যাও। আমিও কয়ে আইছি, ভাইরে তোদের ১২/১৫টা ভোটের আমার দরকার নাই। কপালে থাকলে আমার দাদা এমনিই জিতবে। নিজের ছেলেকে সামলাতে পারে না, তাদের আবার এত কথা। জানেন ম্যাডাম, অর বাপ মিষ্টির দোকানে থালাবাটি ধুয়ে ছেলেকে মানুষ করেছে। লেখাপড়া শিখিয়েছে, আর সেই ছেলে কি করেছে, না পেরেম - ।" 


শুনতে শুনতে ভালো লাগে। কারো মধ্যে তো এই সমাজ সচেতনাটুকু আছে। কোন দিন আবার চিন্তিত হয়ে বলেন, " জানেন ম্যাডাম, দাদাকে বলিচি, কিছু টাকা লাগবে। গ্রামে একদিন ফিস্টি দিতে হবে। ওদের অনেক ট্যাকা,ওরা তিনবার দিশি মুরগি খাইয়ে দিয়েছে। আমরা একবারও না দিলে একটাও ভোট পাব না।" জিজ্ঞাসা করি, আপনারা কি খাওয়াবেন? খাসি? উনি মাথা চুলকে বলেন,অত টাকা কুথায় পাই। প্যাঙ্গাস মাছের ঝোল,আলু ভাজা আর ভাত খাওয়াব।" 


সাত দফায় ভোট, উত্তর থেকে ধীরে ধীরে নামছে নির্বাচনী উত্তাপ। আমার লোকলস্কর সবাই ব্যাপৃত "গর্বের পর্বে"। "একা কুম্ভ" হয়ে আমরা কয়েকজন রক্ষা করে চলেছি ফাঁকা আপিসটাকে। আদর্শ আচরণ বিধির সৌজন্যে লোক সমাগম আপাতত বড়ই সীমিত। তারই মধ্যে টুকটাক এসে ঘুরে যান বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা। সুযোগ পেলেই জমে ওঠে বৈঠকী গপ্প। কি হবে মনে হয় নির্বাচনী ফলাফল? ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত জনৈক বামপন্থী নেতা টেবিল বাজিয়ে বলে যান, " আমি বলতেছি ম্যাডাম,আপনি মিলিয়ে নিবেন, আমরা ৪২ এ ৪২টাই পাব। সব সিট আমরা নিয়ে নিব। কুনো ফুল আমরা ফুটতেই দিব নি।" হাসি চেপে গম্ভীর ভাবে বলি, "অমুক বাবু, সত্যি সত্যি বলুন তো, কি খেয়েছেন? সেটা কি তরল না বায়বীয়? খুব মূল্যবান কিছু?  ৪২ এ ৪২টাই আপনারা পাবেন, আমাকে অজ্ঞ পেয়ে এমন গাঁজাখুরি গল্প দেবেন?"


 ভদ্রলোক হেহে করে খানিক হাসেন, হাত কচলান, তারপর মাথা চুলকে,ষড়যন্ত্রের সুরে ফিসফিস করে বলেন, "আসল সমস্যা কি জানেন ম্যাডাম? মেয়েরা। ওই যে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার-। হাতে দুটো ট্যাকা কি এসেছে, মেয়েরা ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। কুনো কথাই আর শুনতেছে না। আমার বউই ধরেন না, উঠতে বসতে কইছে, তোমার কথা শুনব ক্যান? আমার যাকে পছন্দ, আমি তাকে ভোট দুব। "


পূর্ব মেদিনীপুরের এক প্রান্তিক ব্লকের এক ছাপোষা বামপন্থী নেতার মুখে সেদিন যা শুনেছিলাম, আজ সামাজিক মাধ্যম ভেসে যাচ্ছে সেই একই কথায়, হয়তো একটু পরিশীলিত ভাবে বলছেন, কিন্তু বলছেন তো সেই একই কথা না। বলছেন মেয়েরাই তো তরিয়ে দিল এই নির্বাচন। বলছেন, তত্ত্ব কথা, ন্যায় অন্যায়, সমাজ দর্শন কিচ্ছু বুঝল না মাইরি মেয়েগুলো, দল বেঁধে গিয়ে ভোট দিয়ে এল ক্ষমতাসীন দলকে। চাঁচাছোলা ভাষায় বলছেন পাঁচশ, হাজার টাকার কি মহিমা মাইরি। বলছেন, সময় থাকতে বউ গুলোকে হাত খরচা দিলে আর এই দিন দেখতে হত না। পড়ছি আর ভাবছি, উফ আদমসুমারি অনুসারে লিঙ্গানুপাতে এত পিছিয়ে থেকেও কত্ত শক্তিশালী মাইরি আমাদের মেয়েরা! আর এই সত্যিটা এত দিন কেউ বুঝল না! যাঃ বহুৎ না ইনসাফি হ্যায় মাইরি।

Friday 17 May 2024

অনির ডাইরি মে, ২০২৪

 অনির ডাইরি ২৭শে মে, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় বেজে উঠল পাশে অনাদরে পড়ে থাকা মুঠো ফোনটা। কোন মতে হাত বাড়িয়ে কানে ঠেকাতেই, ওপাশ থেকে ভেসে এল চেনা, ছদ্ম কন্ঠস্বর, " দরজা খুলতে কি শ্বশুরমশাইকে ফোন করব?" অষ্টপ্রহর আমার বুড়ো বাপটাকে ধরে টানাটানি করে লোকটা। বিরক্ত হয়ে কিছুদিন আগেও বলতাম, " কেন? তোর ও তো একটা বাবা আছে, মাঝে মধ্যে তাকে ধরেও তো টানতে পারিস।" শ্বশুরমশাই চলে যাবার পর থেকে কথাটা আর বলতে পারি না। সেই সুযোগে লাগামছাড়া হয়ে উঠেছে শয়তানটা। 


গজগজ করতে করতে উঠে দিয়ে দরজা খুলে দিই। সাড়ে তিনটে অবধি তো জেগে ছিলাম আমিও। মাঝে মাঝেই চলছিল টুকরোটাকরা বার্তা বিনিময়। এটা আমার আজকের নয়, বিগত ১৬ বছরের অভ্যাস। শৌভিক রাত জাগলেই রাত জাগি আমি। মাঝে,মাঝেই ফোন- মেসেজ করে জানাই, একা নও, আমিও "জেগে আছি"। 


আগে একাকীই জাগতাম, ইদানিং অনেক রাত পর্যন্ত সঙ্গ দেয় তুত্তুরী। গতকালও রাত দেড়টা অবধি জেগেছে মেয়েটা। আরো হয়তো জাগত খানিকক্ষণ, আমার দোষেই রাগ করে নিজের ঘরে চলে গেল। আসলে হয়েছে কি,রাত দেড়টা অবধি আসন্ন অলিম্পিক, খেলার জগৎ, খেলা নিয়ে বিশ্ব রাজনীতির ওপর এন্তার বকবক করে আমার মাথা ধরিয়ে দেওয়ার পর, তাঁর মনে হয়েছে, মাকে একটা ধাঁধা ধরা যাক। সেটা যে ধাঁধা, সেই ঘোষণা ব্যতিরেকেই তিনি আমায় শুধালেন, " বলো তো মা, Bay of Bengal কোন state?" 


আমার সাদা মনে কোন কাদা নেই মাইরি, আমি বললাম, "বঙ্গোপসাগর কোন একটা স্টেটে কেন থাকবে? ভারতের গোটা পূর্ব উপকূল জুড়েই তো -"। তিনি সবজান্তা হাসি হেসে বললেন, " পারলে না তো? Bay of Bengal is in liquid state, এটা তো সবাই জানে।" কেমন রাগটা ধরে। শাণিত জিহ্বাকে শাসন করে, বললাম, " এবার আমি একটা প্রশ্ন শুধাচ্ছি,জবাব দে দেখি, বঙ্গোপসাগর ভারতের কোন কোন রাজ্যের সীমানা স্পর্শ করে -"। তিনি চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে শুরু করলেন, " বাংলা - উড়িষ্যা -"। তারপর অখণ্ড নীরবতা, তিনি ভাবছেন। ভেবে টেবে বললেন, " আসাম"। শায়িত অবস্থা থেকে উঠে বসলাম আমি। বললাম, " আসামের ধারে পাশে কোন সমুদ্র নেই।" ভড়কে গেলেন তিনি, ঢোঁক গিলে বললেন, " ঝাড়খণ্ড?" বললাম "land locked state।" এরপর একের পর এক উড়ে এল, " মহারাষ্ট্র এবং কেরালা।"


হাসতে হাসতে বিদ্যালয় জীবনের কথা মনে পড়ে গেল। মোটামুটি তুত্তুরীর বয়সেই আমার এক প্রিয় বান্ধবী ডিব্রুগড় তৈল খনির ম্যাপ পয়েন্টিং করেছিল অধুনা ছত্রিশ গড়ে। এখন অবশ্য তিনি জাঁদরেল দিদিমণি। ছাত্রছাত্রীদের কান ধরে ভূগোল পড়ান। সেটাই বললাম তুত্তুরীকে। বললাম, কাল সকালে ভারতের মানচিত্র মুখস্ত করবি। তাতে তিনি রেগে গরগর করতে করতে চলে গেলেন, যাবার সময় বলে গেলেন, " নিজে ভূগোলে ভালো বলে কি অহংকার।"


সেটাও সবিস্তারে লিখেছিলাম শৌভিককে। রাত সাড়ে তিনটে অবধি রেমালের গতিপ্রকৃতি নিয়ে মিনিটে মিনিটে windy দেখছি আমি। আর আকুল প্রার্থনা করছি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কাছে, একে তো ভোট নিয়ে জেরবার এই বঙ্গ, এরওপর তুফানের অভিঘাত যে বড় সাংঘাতিক হয়ে যাবে। অন্তত আমার বরের কাছে। জীবনের কঠিনতম অধ্যায়ের মধ্যে দিয়ে চলছে লোকটা। এমন ত্রহ্যস্পর্শ যোগ সচরাচর দেখা যায় না। একে তো নির্বাচনী গুঁতো, তারওপর নির্বাচনের ঠিক এগারো দিন পূর্বে আকস্মিক পিতৃবিয়োগ। তারও ওপর রেমাল বাবুর আগমনী। এবারেরটা প্লিজ তুমি নিয়ে নাও। পরের বারেরটা পাক্কা আমরা নিয়ে নেব। 


তারপরই বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সে আর কতটুকুই বা, ঘরের লোক ঘরে ফিরে এসেছে,এবার আরাম করে ঘুমাব। সে গুড়ে বালি, জ্বর নিয়ে ফিরেছেন তিনি। প্যারাসিটামল দিয়ে গরম কালো কফি খেয়ে, মাত্র কয়েক ঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে আবার যখন বেরোল শৌভিক,বলে গেল, " অপেক্ষা না করে খেয়ে নিস। কাঁথির কাজ গুটিয়ে, আমায় একবার দীঘা যেতে হবে।" 


আকাশের মুখ ভার, বইছে জোরালো বাতাস। সাথে ক্রমশই বাঁধন হারা হচ্ছে বৃষ্টি। জলভরা বাতাসের দাপটে ছিটকে পড়ছে বাগানের টব গুলো। "এমন দিনে তারে বলা যায়", বলাই যায়। বললামও, "আমাকে নিয়ে যাবে? প্লিজ?" জীবনের নানা ওঠাপড়ার মাঝে কবে যে আমাদের বিয়ের দিনটা এসে চলে গেছে,মনে রাখিনি কেউই। দেশ জোড়া গর্বের পর্বের মধ্যে, তা রাখার কথাও নয়। কিন্তু আজ তো আর সেই চাপ নেই, আজকের দিনটা তো একসাথে থাকাই যায়। 


জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে শৌভিক বলল, " কে বলল নেই? চাপের বাবা, কাকা, মেসোশ্বশুর সবাই আছে। গিয়ে যদি চুপ করে বসে থাকতে আপত্তি। না থাকে তো চল। আমাকে কিন্তু বিরক্ত করা চলবে না। আমাকে আমার কাজ করতে দিতে হবে। রাজি?" তাই সই, মামা না থাকার থেকে কানা মামাই ভালো বাপু। পরিস্থিতি অনুকূল হোক বা প্রতিকূল একসাথে থাকতে পারাটাই আসল। বাকিটা ঠিক হয়েই যাবে।


অনির ডাইরি ২৩শে মে, ২০২৪ 

#অনিরডাইরি 



বেশ কিছুদিন আগের কথা, অফিস থেকে ফিরে শ্রীমতী তুত্তুরীকে পড়তে বসিয়েছি, হঠাৎ চিৎকার করে উঠল মুঠোফোনটা। অচেনা নম্বর হলেও চিনতে পারলাম, আজ সকালেই বোধহয় ফোন এসেছিল এই নম্বরটা থেকে। তখন ধরতে পারিনি। এখন ধরলাম, ওপাশ থেকে এক পুরুষ কণ্ঠ বলল, " ম্যাডাম আমি অঞ্জন।" কোন অঞ্জন, এই নামে একাধিক ব্যক্তিকে চিনি। জবাব এল,ম্যাডাম আমি SLO অঞ্জন, তমলুক ব্লক। 


চিনতে আর কোন সমস্যা হল না। আমার সাথে চেহারা গত সাদৃশ্যের জন্য, অঞ্জনকে আমি আলাদা করে গোবলু SLO বলে ডাকি। অঞ্জনের ফোন পেয়ে প্রমাদ গুনলাম। আমার এই গোবলু SLO টি মাঝে মধ্যেই আমাকে রচনাসম মেসেজ পাঠায়। মেসেজ গুলো শুরু হয়, " ম্যাডাম আপনি কত ভালো" দিয়ে এবং শেষ হয়, " আমার সাথে কেন এমন হয়েছে? আমার খুব দুঃখ হয়েছে" এবং "মার্জনা করবেন ম্যাডাম, আমি আপনার নির্দেশ পালনে অপারগ।" 


শতাধিক সদস্য নিয়ে গঠিত আমার তাম্রলিপ্ত পরিবার। সবাই আমার কাছে সমান গুরুত্বপুর্ণ, সমান স্নেহের পাত্র, সবাইকে সমান ভালোবাসি। কিন্তু বিভিন্ন রোগের যেমন বিভিন্ন দাওয়াই হয়, তেমনি বিভিন্ন সহকর্মীকে ও বিভিন্ন ভাবে সামলাতে হয়। কাউকে বেপোট ধমকাতে হয়, "কেটেই ফেলব" না বললে জাস্ট সে নড়ে না, আবার কাউকে বকলেই কেলো। তাদের সোনা,বাবা, বাছা না বললে সে নড়ে না। অঞ্জন দ্বিতীয় পর্যায় ভুক্ত। অঞ্জনের সব অভিযোগ যে সব সময় আমি মেটাতে পারি, তা নয়। যাদের নামে দুদিন আগে আমার কাছে নালিশ করে, দুদিন পর তারাই এসে পান চিবাতে চিবাতে বলে যায়, "ম্যাডাম আজ ব্লকে অঞ্জন দা খাওয়াল। কি ভালো মুর্গীর ঝোলটা যে হয়েছিল। আর তরকারিটা ম্যাডাম, উফ কি বলব আপনাকে -"। মনে হয় ব্যাটাদের কান ধরে ঘর থেকেই বার করে দি। আর অঞ্জনটাকে দিই ব্লক করে। 


তেমনি কিছু আসতে চলেছে ভেবে বললাম, "বলো"। অঞ্জন বলল, " কাল অফিসে থাকবেন ম্যাডাম? আমি একটু যাব নিমন্ত্রণ করতে।" কিসের নিমন্ত্রণ রে, বিয়ে করছ নাকি? তাই সবাইকে মুরগির ঝোল আর তরকারি খাইয়েছ? অঞ্জন এক গলা জিভ কেটে বলে, "না না ম্যাডাম। বিয়ে তো অনেকদিন আগেই করেছি। আসলে আমার মেয়ের জন্মদিন। বর্গভীমা মন্দিরে ওই দিন ভোগ দেব। আপনাদের সকলের নিমন্ত্রণ। প্লিজ আসবেন।"


বললাম সে তো আসবই, কিন্তু তোমাকে আর কষ্ট করে আসতে হবে নি। আমি বলে দিলেই সবাই চলে যাবে। তাও কথা শুনল না অঞ্জন। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি, গোটা রাজ্য পুড়ছে অকস্মাৎ তাপ প্রবাহে, তারই মধ্যে ঘোর দ্বিপ্রহরে এসে হাজির হল অঞ্জন। জনে জনে নিমন্ত্রণ করল আলাদা করে। আমায় তো সপরিবারে। "ম্যাডাম স্যারকে অবশ্যই আনবেন। আর তুত্তুরীকেও।" বলেই দিলাম,ওসব পারব না বাপু। একজনের স্কুল আর এক জনের নির্বাচন, কাউকে পাবে নি। আমি একা অবশ্যই যাব।


বললাম তো যাব, কিন্তু এদিকে যে উত্তরোত্তর তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে বুড়ো তপন। গোটা পূব মেদিনীপুর জুড়ে ত্রাহি ত্রাহি রব। শান্তনু বলল, "খাবার না হয় লিয়ে চলে আসব ম্যাডাম। ঠাণ্ডা ঘরে বসে খেয়ে নিবেন।" ব্যাপারটা আমার যতটা পছন্দ হল, অঞ্জনের তার তিলমাত্রও হল না। " এলে অনেক ভালো হত ম্যাডাম। মেয়েটা খুব খুশি হত - "। এরপর আর কোন কথা চলে না। 


চলে না বললেও, আতঙ্ক তো যায় না। কি গরম বাপ রে! বর্গভীমা মন্দিরের নীচে জুতো খুলে ওই খাড়া সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পা পুড়ে আংরা না হয়ে যায়। অফিসে শুভাশিষ, শান্তনু, নন্দন যদিও বারবার বলতে লাগল, " কিচ্ছু চিন্তা নেই ম্যাডাম। পিছন দিক দিয়ে সুন্দর রাস্তা আছে, ছায়ায় ঢাকা, দোতলায় উঠে জুতো খুলতে হয়।" হক বাবু বললেন, " দেখবেন ম্যাডাম, দেবস্থানে গরম লাগবে নি।" 


তাই সই। তারপর ও আসতে থাকে না না চিন্তা। মন্দিরে ভোগ, নির্ঘাত মাটিতে বসে খেতে হবে। শাড়ি পরে গেলে সুবিধা না সালোয়ার পরি? শান্তনু বলল, "দাঁড়ান ম্যাডাম সব খবর লিয়ে লিচ্ছি।"মিনিট দশেক পরেই ফোন, "ম্যাডাম মাটিতে বসে খাওয়ার পাশাপাশি চেয়ার টেবিলও থাকবে। অঞ্জনদা নিজে বাজার করে দিচ্ছে, মন্দিরের ভোগ ছাড়াও আরো অনেক কিছু থাকছে ম্যাডাম।" 


সে তো আগেই শুনেছি, নন্দন আজ সকালেই বলেছে, "তিন রকম মাছ থাকছে ম্যাডাম। বাটা, রুই আর শোল।" দেবী বর্গভীমার নিত্য ভোগ শৌভিক তমলুকের এসডিও থাকাকালীন বেশ কয়েকবার খেয়েছি। সাদা ভাত, শুক্তো, মুগ ডাল, পোস্ত ছড়ানো চৌকো করে কাটা, খোসা সমেত গুঁড়ি গুঁড়ি আলু ভাজা, শাক পাতা-কুমড়ো দিয়ে একটা তেলতেলে ঘ্যাঁট, রুই মাছের ঝাল, শোল মাছের টক আর পায়েস। সব কটি পদই অনবদ্য, অনুপম খেতে। আমরা চাটুজ্জে, আমাদের বংশে শোল মাছ ভক্ষণ নিষিদ্ধ। ভাগ্যে বিয়ে করে গোত্রান্তর হয়েছিল, নাহলে দেবীর এই অনুপম প্রাসাদ থেকে বঞ্চিত হতাম। শোল মাছের টকের কথা লিখতে বসে এখনও রসে পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে আমার রসনা। ঠিক করলাম, বাটা রুই নয়, ওটাই খাব কেবল, আশ মিটিয়ে। 


নির্দিষ্ট দিনে, টিফিন টাইমে গিয়ে হাজির হলাম বর্গভীমা মন্দিরের কাছে। মেয়েকে নিয়ে অঞ্জন স্বয়ং এল খিড়কি দুয়ারের পথ দেখাতে। মেয়েটি যেন হুবহু বাপের ফটো কপি। শুভ জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে বললাম, তোমার বাবাকে কিন্তু আমি অন্য নামে ডাকি। মেয়েটি এক গাল হেসে বলল, "জানি তো। তুমি বাবার নাম দিয়েছ গোবলু SLO, বাড়িতে আমিও তাই বলে ডাকি। থুড়ি রাগাই বাবাকে।" এই পুঁচকে বয়সেই নিরুপম বাচিক শিল্পী মেয়েটি। দারুণ আবৃত্তি করে, নানা জায়গা থেকে মেডেল জিতে আনে। সামান্য অনুরোধেই গোটা তিনেক শোনাল আমাদের। 


মন্দিরের ভিতরে আলো ছায়ার আজব কারিকুরি। যেখানে রোদ পড়ছে,সেখানে পা রাখা যায় না। ছায়াময় অংশটি আবার বেশ শীতল। এক্কা দোক্কা খেলার মত করে মন্দির চত্বর পার হয়ে গেলাম।মাঝখানে রাজরাণীর মত বসে আছেন দেবী বর্গভীমা। প্রচুর বিয়ে হয় এখানে। এই প্রখর রৌদ্রেও বেশ কয়েক জোড়া বর বধূ সেজেগুজে প্রস্তুত। তাদের পাশ কাটিয়ে বাম দিকে খাবার জায়গায় গিয়ে হাজির হলাম আমরা। আজ গোটাটাই আমাদের জন্য সংরক্ষিত। তেমনই ব্যবস্থা করেছে অঞ্জন। 


এবার ভোজনের পালা। আমাদের জন্যই সবাই প্রতীক্ষা করছিল এতক্ষণ। একটা ছোট টেবিলে আমি, ALC নভোনীল বাবু,ইন্সপেক্টর মুকুল আর একজন অপরিচিত ব্যক্তি বসলাম,বাকিরা দলবদ্ধ ভাবে মাটিতে লম্বা করে পেতে রাখা আসনে বসে পড়ল। অঞ্জন স্বয়ং পরিবেশন করতে নামল। প্রায় দেড় মাস আগের কথা, তাও যতটুকু মনে পড়ে, প্রথমেই এল গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত, সাথে স্যাল্যাড, অসম্ভব ভালো শুক্তো, মুগ ডাল, ঘন্ট, পোস্ত ছড়ানো খোলা শুদ্ধ গুড়ি আলু ভাজা। প্রতিবারই ভাবি, এটা আর একটু নেব। চাইবার আগেই পরের আইটেম এসে যায় পাতে। কোনটা ফেলে কোনটা যে খাই। 


ভাবতে ভাবতেই এত্ত বড় বাটা মাছ স্বহস্তে পাতে তুলে দিল অঞ্জন। নিষেধ করার অবকাশ পেলাম না। বাটা আমার ঘোরতর অপছন্দের মাছ। এত কাঁটাওয়ালা মাছ আবার মানুষে খায়। ভেবেই এসেছিলাম, ওটা খাব না। না জিজ্ঞাসা করেই দিয়ে দিল যখন, অপচয় তো আর করতে পারি না। মুখে দিয়েই বুঝলাম, না খেলে পস্তাতাম। বাটাও এত সুস্বাদু হয়? ভাবলাম, অন্তত দুপিস টক শোল খাব। অসভ্য উদর জায়গা দিলে তো। আরো অনেক কিছু ছিল যে, চাটনি, পরমান্ন, ক্ষীরের মত দই,রসগোল্লা----। 


রাতে বাড়ি ফিরে দেখি অঞ্জন মেসেজ করেছে, "Mam আজ আপনি এসেছেন। আমার মেয়ে কে আশির্বাদ করলেন, আমি, আমার মেয়ে ও স্ত্রী খুব খুশি হয়েছি। আমরা সত্যিই খুব আনন্দ পেয়েছি। আমার খুব ভালো লেগেছে। Mam আমার পরিবারের পক্ষ থেকে আপনাকে প্রনাম জানাচ্ছি।" ভালো করে পড়লাম বার কয়েক, নাহ আজ আর কোন নালিশ করেনি অঞ্জন তার ম্যাডামের কাছে।


অনির ডাইরি ১৪ই মে , ২০২৪

#অনিরডাইরি 



ঢং করে বেল বাজতেই ধড়মড় করে উঠে বসলাম।ঘড়ি বলছে, রাত সাড়ে তিন-পৌনে চার। এই একটা আওয়াজের জন্যই এতক্ষণ সোফায় বসে আছি। জেগে বসে আছি লিখতে পারলাম না, কারণ বেশ বুঝতে পারছি আমার চোখ জুড়ে গিয়েছিল। 


দুঃসংবাদ আসার আধ ঘন্টার মধ্যেই বেরিয়ে পড়েছি আমরা কাঁথি থেকে। দুটো পিট্টু ব্যাগের মধ্যে কোন মতে ভরে নিয়েছি কিছু জামাকাপড়। কি নিয়েছি, কি নিইনি জানি না। মাথাই চলছিল না। শূন্যতা বুঝি একেই বলে। গাড়ি সময়মত এসে গেলেও, কিঞ্চিৎ বিলম্ব করছিল শৌভিকের ব্যক্তিগত দেহরক্ষক।  উত্তেজিত হয়ে বার বার ফোন করতে করতে বাইরের বাগানে পায়চারি করছিলেন ড্রাইভার নূপুর বাবু। মাঝে মাঝে বলছিলেন, " স্যার, জানেন তো, অমুক ভট্টাচার্য সাহেব যখন এসডিও ছিলেন, ঠিক এমনি হয়েছিল। সেবারও নির্বাচন চলছিল, তারই মধ্যে ওনাকে নিয়েও এমনি মাঝ রাতে ছুটতে হয়েছিল।"


কথার সুর টেনে শৌভিক বলে, " অমুক সাহেব যখন ডায়মন্ড হারবারের এসডিও ছিলেন, নমিনেশন চলাকালীন ওনার পিতৃবয়োগ হয়। উনিও অমনি গিয়ে, দাহ করে, কাছা নিয়ে পরের দিন নমিনেশন নিয়েছিলেন।" জিজ্ঞাসা করি, "তুই কাছা নিবি না তো?" দৃঢ় ভাবে মাথা নাড়ে শৌভিক। "নিয়ম কানুন কিছু মানবি?" একই ভাবে মাথা নাড়ে দৃঢ়তার সঙ্গে। জানতাম এটাই বলবে। শ্বশুর মশাই নিজে চূড়ান্ত নাস্তিক ছিলেন, দাদা শ্বশুর বা দিদি শাশুড়ি মারা যেতে মানেননি কোন নিয়ম। তাঁর শিক্ষায় শিক্ষিত তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র, অন্য কিছু করবে, এটা দুরাশা। 


জানাই, আমি কিন্তু মানব।  শৌভিকের নাস্তিকতা নিয়ে যতটা গর্বিত ছিলেন শ্বশুর মশাই, আমার আস্তিকতা, পুজো,উপোস ইত্যাদি নিয়ে অখুশি তো ছিলেন না। বরং ভোর বেলা টাটকা ফুল তুলে পুজো করতে দেখে এক অদ্ভুত খুশির আভা ছড়িয়ে পড়ত বৃদ্ধের চোখেমুখে। 


 "বাবার বন্ধুদেরও খবর দিতে হবে -" মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে শৌভিক। " সবার নম্বর তো নেই। দীনু কাকুকে বলি, যাকে পারবে খবরটা দিয়ে দেয় যেন।" প্রায় মিনিট পনেরো পর, বাংলোর সামনে এসে দাঁড়ায় এক দ্বিচক্র যান, পিছনের আসন থেকে নেমে দৌড়ে আসে শৌভিকের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী। কোন মতে উর্দিটা গলিয়েছেন, হাতে একটা প্লাস্টিকের ঝোলা। " সরি স্যার, আপনি ছুটি দেবার পর দিদির বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। খবর পেয়েই ছুটে আসছি।" শৌভিক প্রশ্ন করে, " খেয়ে এসেছ তো?" 


অন্ধকার হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলে গাড়ি। হৃদয়ে অদ্ভুত এক দোদুল্যমানতা, হয়তো আয়া দিদি ভুল দেখেছে। হয়তো এখুনি ফোন আসবে, " অ বড়দা, কাকু আবার জেগে উঠিছেন।" সেই ফোন আর আসে না। অন্য ফোন আসতে থাকে এক গাদা, কাকারা, পিসি, পিসেমশাই পইপই করে বলতে থাকে, " সাবধানে আয়। আমরা তো আছি।" ছোট ভাইকে ফোন করে একই কথা শোনায় শৌভিক। আজ দুর্গাপুর-আসানসোল এলাকায় ভোট ছিল,গাড়ি ঘোড়া কিছুই সহজলভ্য নয়। তারওপর সঙ্গে অত ছোট বাচ্ছা, এত রাতে কোন হঠকারি সিদ্ধান্ত নেবার কোন দরকার নেই। 


নাচিন্দা মন্দিরের সামনে আলোর মালা, অক্ষয় তৃতীয়া উপলক্ষে মেলা বসেছে। এই তো মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেই অফিস থেকে ফিরলাম এই পথ দিয়ে। তখন ভাবছিলাম শ্রীমতী তুত্তুরীকে যদি একবার দেখাতে পারতাম এই আলোকমালা। পাশে শুকনো মুখে বসে আছে তুত্তুরী, মাঝে মাঝে ফিসফিস করে বলছে, " আমার খুব ভয় করছে মা। দাদু কি সত্যিই চলে গেছে? ফুলঝুরি যে বড্ড ছোট, ওর কি দাদুর কথা আদৌ কিছু মনে থাকবে?"


রাত সোয়া একটা, ঘুমন্ত শহরের বুক চিরে গাড়ি এসে থামল চেনা বাড়িটার সামনে। আপাতদৃষ্টিতে সব একই আছে, অথচ কিছুই আর এক নেই। এত ক্ষণ মনে হচ্ছিল সময় যেন কাটছেই না। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, এই পথ না শেষ হলেই বোধহয় ভালো ছিল। ফ্ল্যাটের বাইরে ছেড়ে রাখা এত গুলো জুতোই বলে দিচ্ছে এই বাড়িতে আজ কোন কিছুই স্বাভাবিক নেই।  চার ভাই, দুই ভাই বউ, বোন, ভগ্নিপতি, ভাইপো, ভাগ্নে, ভাগ্নে বউ ঘিরে আছে আমার মজলিশি শ্বশুরটাকে। আড্ডা দিতে বড় ভালোবাসতেন ভদ্রলোক। স্টাডি রুমের সিঙ্গেল খাটটাতে আজ একাই শুয়ে আছেন ভদ্রলোক। একটা চোখ যেন আধ বোজা, মুখটা সামান্য খোলা, ঠিক যেন ঘুমাচ্ছেন। একটা ইঞ্চি পাড় সাদা কাপড় বুক অবধি চাপা দেওয়া। পাখার হাওয়ায় সেটা এমন থিরথির করে কাঁপছে যেন মৃদু মন্দ শ্বাস নিচ্ছেন উনি। " ক্যাথেটার নিয়ে পাজামা পরতে অসুবিধা হচ্ছিল বলাতে, আমাজন থেকে একজোড়া ধুতি অর্ডার করেছিলাম বাবার জন্য। শেষে এই কাজে লাগল ধুতিটা -!"  মৃদু অথচ হালকা সুরে কাকে যেন বলে ওঠে শৌভিক।


রাত দুটো নাগাদ একে একে বাড়ি পাঠানো হল কাকা পিসিদের। সবাই বয়োজ্যেষ্ঠ, কেউই সম্পূর্ণ সুস্থ তো নয়, রাতটা একটু না জিরোলে শরীর দেবে কি করে। আবাসিক সমবায়ের জনৈক কর্তাব্যক্তি আগেই ডেকে এনেছিলেন ডাক্তার, তিনি দেখে গেছেন শ্বশুরমশাইকে। কথা দিয়ে গেছেন ভোর পাঁচটার সময় এসে ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দেবেন। শববাহী গাড়ি ইত্যাদির জন্যও শৌভিককে চিন্তা করতে নিষেধ করে গেছেন। সকাল সাতটা-আটটার মধ্যে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কাকা - পিসিরাও ততোক্ষণে এসে হাজির হবে সবাই। আপাতত অনন্ত প্রতীক্ষা। প্রাথমিক প্রতীক্ষা উমাদের জন্য। রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ কোন মতে একটা গাড়ি যোগাড় করে দুর্গাপুর থেকে রওনা দিয়েছে উমারা। 


শ্বশুর মশাইয়ের কাছেই বসে রইল শৌভিক। ছোট ভাই বলেছে ফোনে, "বাবাকে যেন একা ছাড়িস না, দাদা। " খানিকক্ষণ আমিও বসলাম, তারপর জায়গা ছেড়ে দিলাম তুত্তুরীকে। জীবনে প্রথম মৃত্যু দেখল মেয়েটা। ব্যাপারটা এখনও অনুধাবন করতে অসুবিধা হচ্ছে ওর। টেবিলের ওপর এখনও রাখা আছে শ্বশুর মশাইয়ের শেষ না করা বই, ডাইরিতে ওনার হাতে লেখা আজ পর্যন্ত কি কি ওষুধ খেয়েছেন, ঢাকা দেওয়া গ্লাসে অর্ধেক জল - সবকিছুই বাবার সাথে ভাগ করে নিতে চায় তুত্তুরী। মেয়ের মুখে সব খুঁটিনাটি শুনতে চায় শৌভিক। 


শাশুড়ি মা কিছুক্ষণ পরপরই জানতে চাইছেন, ছোট ছেলে কতদূর এল। দুঃখিত ভাবে মাথা নেড়ে বলছেন, "যে যাবার সে তো চলেই গেছে, ওরা এত রাতে অতটুকু বাচ্ছা নিয়ে এভাবে না এলেই ভালো করত।" কখনও বা বলছেন, " আচ্ছা অনিন্দিতা, তুমি গ্যাস বুক করতে পারো? আমি তো কিছুই জানি না। সব তোমার শ্বশুরমশাই করতেন।" সত্যিই শ্বশুর মশাই সব করতেন, টাকাপয়সা তোলা, গৃহ সহায়িকাদের বেতন দেওয়া, ফোনে দোকানবাজার, ওষুধ আনানো, বাড়ির প্রতিটা কোণে নজর রাখা - সব, সব করতেন অসুস্থ বৃদ্ধ একাই। বৃদ্ধা তো মোবাইলে ফোনটুকুও ধরতে স্বচ্ছন্দ নন। 


কাঁথি থেকে কলকাতা আসার পথে এই কথাটাই বলছিলাম আমরা,  এনাকে একা গৃহ সহায়িকা বা আয়া দিদির ভরসায় মহানগরে ছেড়ে যাওয়া অবাস্তব। তবে সে তো অনেক পরের কথা, এখনও তো শ্বশুরমশাই আছেন। ঘুমিয়ে আছেন স্টাডি রুমে। অপেক্ষা করছেন আদরের কনিষ্ঠ পুত্র আর পুত্রবধূর জন্য। চোখ রগড়ে, "আসছি" বলে হাঁক পেড়ে, দরজা খুলি আমি। আমার সামনেই সপরিবারে আমাদের উমারাণী। উমার কোলে সদ্য ফোটা ফুলের মত ঘুমন্ত ফুলঝুরি, মুখের মধ্যে দুটো আঙুল পুরে ঘুমাচ্ছে। দুহাত বাড়িয়ে কোলে নিই মেয়েটাকে, উমা কোন মতে জানতে চায়, " দিদিভাই, বাবা কোথায়?"

অনির ডাইরি ১৩ ই মে, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



কিছু কিছু রাত কেন যে আসে? আসবে একদিন এতো জানা কথাই, তাই বলে এমন অতর্কিতে কেন এসে হাজির হয়! দিব্য তো চলছিল দিনটা, গতানুগতিক ভাবে, সেই ভোরে ওঠা, তুত্তুরীকে স্কুলে পৌঁছানো, আমাদের অফিস, ফিরে এসে কফির কাপে দৈনিক চব্য, শ্রীমতী তুত্তুরীকে পড়তে বসানো, পড়া আধখেঁচড়া ফেলে ঝটপট চিকেন স্টু রান্না করা, সাড়ে নটায় নৈশভোজ - কোথাও এক বিন্দু বিচ্যুতি ছিল না দিনটার মধ্যে। 


রাত দশটা নাগাদ, মোবাইলটা নিয়ে বসলাম। একটা নতুন ওয়েব সিরিজ ধরেছি, সেটাই এবার দেখব যুৎ করে। পাঁচ মিনিট দেখেছি কি দেখিনি, দরজা খুলে ঢুকে এল শৌভিক। একদম সাধারণ ভাবে বলল, " বাবা মারা গেছে।" লিখতে বসে, এখনও হাত কাঁপছে, ধড়পড় করছে বুক।শুনে আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, " যাঃ! কি যাতা বলছিস।" তারপর খুব রাগ হল, একি ধরণের অলক্ষুণে কথাবার্তা। 


শৌভিক একই রকম শান্ত ভাবে বলল, " হ্যাঁ রে, সত্যি। বাবা মারা গেছে।" কোন মতে বললাম কে বলল? জবাব এল, " সবিতা দি ফোন করেছিল। বলল, কাকু এই মাত্র চলে গেলেন।" সবিতা দি হল বাড়ির দিনরাতের সহায়িকা। বৃদ্ধ-বৃদ্ধার নড়বড়ে শারীরিক অবস্থার জন্য, দুই বউয়ের পরোক্ষ ইন্ধনে, প্রবল ধমকধামক দিয়ে যাকে রাখতে বাধ্য করেছিল দুই ছেলে। 


কথা বলতে বলতেই হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখে শৌভিক, পরক্ষণেই ফোন করে সবিতা দিকে, " তুমি আমায় ফোন করার কতক্ষণ আগে ঘটেছে ঘটনাটা? দশ মিনিট? আচ্ছা, তার মানে ৯টা ৫০।" ফোন রেখে আবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে শৌভিক, "চার ঘণ্টার আগে ডেথ সার্টফিকেট পাওয়া যাবে না। তার মানে রাত দুটো। শব বাহী গাড়িও যোগাড় করতে হবে।" 


আমি অঝোরে কাঁদছি, ঘড়ি থেকে আমার দিকে চোখ নামিয়ে ধমকে উঠল, " দাঁড়া এখন ঘ্যানঘ্যান করিস না। আত্মীয়স্বজনদের ফোন করতে হবে। পিসিকে ফোন করে দি, ওই বরং সবাইকে খবর দিয়ে দিক। আমি গাড়িকে খবর দি, ব্যাগ গুছাই। সিকিউরিটিকে কি নেব,না নেব না?"   


বেশ খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে থাকি আমি, আমার বরটা কি যন্ত্র হয়ে গেল! বাবাকে ঘিরেই তো ঘুরত ওর জীবন। বাবার শিক্ষা, বাবার আদর্শ, বাবার জীবন দর্শন - থেকে বাবা বিচ্যুত হলেও, আমার বর হয় না। আর আজ যখন সেই বাবা চলে গেছে চিরতরে, ও এতটুকু ভেঙে পড়ছে না কেন? 


চোখ মুছে পাশের ঘরে গিয়ে দেখি, কাকে যেন ফোন করছে শৌভিক, " গুড ইভনিং ম্যাম। আমি শৌভিক বলছি, এসডিও কন্টাই। এই মাত্র খবর এল, আমার বাবা মারা গেছেন। যদি অনুমতি দেন তো -"। বুঝতে পারলাম মাননীয়া জেলা শাসক মহোদয়াকে ফোন করছে, স্টেশন লিভের অনুমতি নিতে। কাঁথিতে আগামী ২৫ শে মে নির্বাচন, এই মুহূর্তে শেষ পর্যায়ের কাজ চলছে পুরোদমে। আগামী কাল সকাল সাতটা থেকে শুরু হবে ইভিএম কমিশনিং এর কাজ। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সামনে, প্রতিটা ইভিএম মেশিন খুলে তাতে ব্যালট পেপার ভরে সিল করা। সেই কর্মযজ্ঞ চলবে কাল পরশু দুই দিন ধরে। 


"অনেক ধন্যবাদ ম্যাম" দিয়ে ফোন শেষ হল। বুঝলাম অনুমতি পেয়েছে। এবার ড্রাইভারকে ধরার পালা। সে বেচারী সবে খেতে বসেছিল। ব্যক্তিগত নম্বরে ততোক্ষণে একের পর এক ফোন এসেই চলেছে। কিছু শৌভিক ধরছে, কিছু আমি। তীব্র শোকের মধ্যেও পিসি দায়িত্ব নিয়ে সবাইকে খবর দিয়ে দিয়েছে, আর যথারীতি কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। আমরাও কি পারছি? আমি তো পারছি না। বিগত ১৬ বছরে কোনদিন বৃদ্ধকে সুস্থ দেখিনি। দু বার কর্কট রোগ জরাজীর্ণ করে দিয়েছিল শরীরের সব অঙ্গ তন্ত্র। তারওপর ছিল মারাত্মক শ্বাসকষ্ট। দিনে একবার, কখনও দুবার নেবুলাইজ করতেন। অক্সিজেন ও রাখা থাকত, প্রয়োজন হলেই যাতে নিতে পারেন। ইদানিং দেখা দিয়েছিল প্রস্টেটের সমস্যা। 


কিছুদিন আগেই প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, আধ বেলা ছুটি নিয়ে দৌড়ে এসেছিল শৌভিক। অথচ কিছুতেই ডাক্তারের কাছে গেলেন না বৃদ্ধ। যেন বড় ছেলেকে দেখার জন্যই ঘাপটি মেরে বসে ছিল যত ব্যাধি। ছেলে এল, ওমনি সব ঠিক। ফিরে যাবার সময় বারবার বলল শৌভিক, "কাঁথি চল"। তাও এলেন না। কেন যে এলেন না, কি জানি এলে হয়তো অন্য রকম হত সবকিছু। সেবার শৌভিক বলে এসেছিল," আগামী ২৬ শে মে পর্যন্ত কিন্তু আর আসতে পারব না। সাবধানে থেকো।"


 এই বলাটাই যেন কাল হয়ে গেল, বিগত দিন কয়েক ধরে এমন ছেলেমানুষী শুরু করলেন বৃদ্ধ। আজই তো সকালে ফোন করেছিল ছেলেটা, এই আবাসনে বাড়ি বাড়ি ঘুরে রক্ত -মল-মূত্রের নমুনা সংগ্রহ করে ছেলেটা। রাগত স্বরে বলল, " দিদি আর পারছি না। মেসোমশাইকে নিয়ে আমি জ্বলে পুড়ে মরলাম। একবার করে বলে," সুপ্রিয় এসে ক্যাথিটারটা লাগিয়ে দিয়ে যাও। দুদিন যেতে না যেতেই বলে, সুপ্রিয় খুলে দিয়ে যাও।" শুনুন দিদি,প্রতিবার ক্যাথিটার লাগাতে ২০০০ টাকা লাগে। সে ওনার টাকা, উনি জলে দিন। কিন্তু এই খোলা পরার চক্করে প্রতিবার রক্তক্ষরণ তো হচ্ছে। এইভাবে চলতে থাকলে ঈশ্বর না করুন, প্রস্টেট ক্যান্সার না হয়ে যায়। পরশু লাগিয়েছি,আজ বলছে আমি ডাক্তারের কাছে যাব, খুলে দিয়ে যাও। আমি আর যাচ্ছি না।"


কি সর্বনাশ, কোন ডাক্তারের কাছে যাবে আবার? হেঁপো বৃদ্ধের তো একা একা বাড়ি থেকে বেরোনোই নিষেধ। সেসব পাত্তা না দিয়ে এই তো দুদিন আগে কোন হাসপাতালে যেন ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিল একাকী। প্রস্টেট সংক্রান্ত ডাক্তার। দুর্গাপুর থেকে আমার দেওর পইপই করে নিষেধ করেছিল, বলেছিল," একটু দাঁড়িয়ে যাও, আমি আসছি।ঘন্টা চার- পাঁচের মধ্যে পৌঁছে যাব।" যথারীতি কথা শোনেনি বৃদ্ধ। তাকে ভুজুংভাজুং দিয়ে নিরস্ত করে, একাই চলে গিয়েছিল। সাধে আমার দেওর গোঁসা করে, যে "বাবা কেবল দাদাকেই ভরসা করে।" 


এত যে জেদ করে ডাক্তারের কাছে গেল,তার কথাও তো পছন্দ হল না বাবার। ক্যাথেটার লাগানো নিয়ে কোন কথাই শোনেননি নাকি ডাক্তার। বলেছেন, "ওতে অভ্যস্ত হতে হবে। এই সমস্যা আপনার চলতেই থাকবে। এই বয়সে ভুলেও অস্ত্রোপচারের কথা ভাববেন না।" তাও কি সব টেস্ট করিয়ে প্রায় চার পাঁচ ঘণ্টা পর বাড়ি ফিরেছিলেন বৃদ্ধ। অতক্ষণ হাসপাতালের হাওয়ায় থাকার জন্য সেকেন্ডারি ইনফেকশন হতে পারে বলে, জ্যেষ্ঠ পুত্রের কাছে তার জন্য প্রবল ধমকও খেয়েছেন। 


আবার সেই জ্যেষ্ঠ পুত্রেরই শরণাপন্ন হলাম আমি, "ওগো দেখো, বাবা কি করছে।" সকাল পৌনে দশটা নাগাদ বাবাকে ফোন করল শৌভিক, " আজ আবার কোন ডাক্তারের কাছে যাচ্ছ?" জানা গেল, কোন্নগরের আহমেদ ডাক্তারের কাছে যাবে শ্বাসকষ্টের জন্য। তিনি তো হোমিওপ্যাথ। আজ প্রায় তিরিশ বছর ধরে শ্বাসকষ্টে ভোগেন শ্বশুর মশাই, দীর্ঘদিন ধরে যে অ্যালোপাথ ডাক্তারকে দেখাতেন, তাকে আজকাল বাতিল করেছেন। কারণ তাঁর কাছে গেলেই তিনি বলেন, "আমার কাছে ঠিক কেন এসেছেন? ওষুধ, পত্র, নেবুলাইজার, স্টেরয়েড, অক্সিজেন সবই তো বাড়িতে মজুত থাকে। শ্বাসকষ্টের আর তো কোন চিকিৎসা নেই।" যথারীতি বাবার তাঁকে আর পছন্দ হয় না। সম্প্রতি দুয়েক বছর অন্য এক ডাক্তারকে দেখাচ্ছিলেন, তিনি পরের বার ব্রংকিয়োস্কপি করে যেতে বলেছিলেন। সেটা করতেও বাবার আতঙ্ক, তা না করিয়ে এবার তিনি হোমিওপ্যাথ ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে চাইছেন।


মনে আছে শৌভিক বলেছিল, " তুমি আগে স্টেরয়েডটা তো চালু করো। ভাই আসছে -"। আমার দেওর সত্যিই আসছিল, কিন্তু কপাল গুণে আজ ১৩ ই মে, দুর্গাপুরে নির্বাচন। একটা বাস, গাড়ি কিছু পায়নি। ট্রেনে অমানুষিক ভিড়। খোঁজ নিয়ে জানাল, কাল বিকাল থেকে হয়তো কিছু বাস চলবে। প্রথম বাসেই এসে হাজির হবে কলকাতা। দরকার হলে আহমেদ ডাক্তারকে বলেও ওষুধ আনা যায়, তাই আনবে। শৌভিক বলল, " তুমি ক্যাথেটারটা লাগিয়েই রেখো। দু সপ্তাহ পর্যন্ত তো লাগানো যায়, তারমধ্যে আমার ভোট মিটে গেলেই আমি ২৬ শে রাতেই চলে যাব। তারপর তোমাদের কাঁথি নিয়ে চলে আসব। তার আগে আসতে চাইলেও কোন অসুবিধা নেই,অনিন্দিতা তো আছে।" মনে আছে বৃদ্ধ বলেছিল, " হ্যাঁ, সেই ভালো। এখন আমি এমনিতেই বেশ ভালো আছি।" 


তড়িঘড়ি খাটের নীচের বাক্স খুলে ব্যাগ বার করে শৌভিক, কি সব জামা কাপড় ভরে হড়বড় করে। মেশিনের মত করে যায় একের পর এক কাজ, ফোন ধরে চলে যন্ত্রের মত। দুর্গাপুর থেকে এক গলা কান্না নিয়ে ফোন করে আমার দেওর, " বৌদি, বাবা আর নেই না?" কি জবাব দিই? বলি, " কাঁদিস না বাবা। সবিতা দি কি দেখতে কি দেখেছে। আমরা এখনই বেরোচ্ছি, গিয়ে দেখি। নিজে না দেখলে আমি অন্তত বিশ্বাস করছি না -"। পাশ থেকে শৌভিক বলে চলে, "নেই। নেই। বাবা আর নেই।বাবা চলে গেছে-"।

অনির ডাইরি ১১ই মে, ২০২৪

#অনিরডাইরি 


ঠিক করেছিলাম, হীরামাণ্ডী দেখব না। কিছুতেই দেখব না। স্বাধীনতা পূর্ব অখণ্ড ভারত, পতিতালয়, একজন জাঁদরেল মহিলা চরিত্র আর স্বাধীনতা সংগ্রাম - বড় চেনা ছক হে বাপু। একটা রাজকাহিনীই যথেষ্ট ভাই, থাক আর দেখে কাজ নেই। 


১ লা মে, সারা ভারত ভেসে গেল হীরামাণ্ডী ঝড়ে, আমি ডুবে রইলাম চাকরি থেকে সাসপেন্ড হওয়া, obsessive-compulsive disorder এ ভোগা এক সত্যান্বেষী সাধু সান্নিধ্যে। Mr. Monk, তাঁর জটিল জটিল সব কেস আর তাঁর হাজারো ফোবিয়া নিয়ে দিব্য রইলাম আমি। সিদ্ধান্তে অনড় আমি, হীরামাণ্ডী দেখছি না। দেখব না বিগত সোমবার সুকন্যা যখন লিখল, "দুদিন ধরে হীরামাণ্ডী দেখলাম। কি জঘন্য মেলোড্রামাটিক লাগল -"। নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ালাম। আমার বাপু Mr Monkই ভালো। 


তারপরই হল কেলো। আমার দেওয়ালে হঠাৎই একদিন এসে উদয় হলেন ফরিদা জালাল। তাঁর মুগ্ধ নয়ন জুড়ে এক তরুণ যুবক। বৃদ্ধার বিলাত ফেরৎ নাতি, তাজদার বালোচ। গোটা রিল জুড়েই তাজদার, বিভিন্ন ভঙ্গিমায় তাজদার। শুধু তাকানো, আর মধুর হাসি। তাতেই কাঁপন ধরিয়ে দেয় হৃদয়ে, যেমন দিতেন সাদা কালো যুগের নায়কেরা। কে এই তাজদার বালোচ? আগে কি দেখেছি কোথাও? মুগ্ধ হৃদয় কিছুই বলে উঠতে অক্ষম। গুগল বলল, দেখেছ তো। আলবৎ দেখেছ। "তাজ - ডিভাইডেড বাই ব্লাড" সিরিজে। আরে এই তো সেই রগচটা শাহজাদা মুরাদ। 


মাগো, তাতে তো একটুও ভালো লাগেনি এনাকে। চোখে পুরু সুর্মা, দুই চোখে রাজ্যের বিরক্তি আর ক্রোধ। দেখলেই কেমন যেন ক্ষ্যাপা বলির্বদ মনে হত। সিংহাসনের মত ওই সিরিজের সব গোলাপী আলোও একজনই চুরি করে নিয়েছিলেন - শাহজাদা সেলিম। মুরাদ ছিল নিছক বিরক্তি উদ্রেককারী এক আপদ। তাজদার একদমই তার উল্টো। সফিস্টিকেটেড, শান্ত, মৃদু ভাষী। গুগল বলল, ইন্টারনেটের লেটেস্ট ক্রাশ এখন তাজদার। আরও জানতে পারলাম, হীরামাণ্ডীতে তাজদারের পরিণতি মোটেই সুখকর নয়, বরং মর্মান্তিক। তাতে যেন আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠল চরিত্রটা। সুকন্যাকে সবার আগে জানালাম, দেখব ভাবছি সিরিজটা। শুধু তাজদারের জন্য। সু বলল, "আরে অদিতি রাও হায়দারিকেও দেখো। কি অসাধারণ সুন্দর।" 


দেখতে শুরু করে আর সময়ের হিসেব রইল না। কাকে ছেড়ে কাকে দেখি? মণীষা কৈরালা তো একাই একশ। সোনাক্ষির বিষাক্ত নজর। অদিতির বিখ্যাত swan walk, হাঁটতে হাঁটতে কাঁধ থেকে আঁচল নামিয়ে আঙুলে প্যাঁচানো, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানো। উফ্। সবার ওপর উস্তাদ জী। কি অসামান্য অভিনয় ভদ্রলোকের। গল্প ইত্যাদি নিয়ে অবশ্য বলার কিছু নেই। বেশ সাদামাটা গল্প, তা হোক, আমরা তো এরকম কত বিলাতী শো দেখে গদগদ হয়ে যাই। আর এতো খাঁটি স্বদেশী। 


দেখতে শুরু করার আগে, শৌভিককে ঢাক ঢোল পিটিয়ে শুনিয়ে এলাম, আমি হড়কেছি। তাজদারের রিলটাও দেখলাম,আহা একই বলে "আঁখো কি গুস্তাকিয়া-"। আমার বর দিনান্তে বাড়ি এসে কফি খেতে বসেছিল, যথারীতি তাজদারকে পছন্দ হল না। আজ অবধি আমার কোন ক্রাশকেই বা আমার বরের পছন্দ হয়েছে? সবার মধ্যেই ও গুচ্ছের খুঁত খুঁজে বার করে এবং সুকুমার রায়ের কথা "না বুঝবি তো মগজে তোর গজাল দিয়ে গোঁজাব" করে সে গুলো আমার মাথায় ঢোকায়। 


প্রথম আপত্তি তুলল তাজদারের গোঁফ নিয়ে। আরে গোঁফ তো তোরও আছে রে ভাই। যখন দেখল মাথা থেকে তাজদারকে কোনভাবেই বার করতে পারছে না, তখন অন্য পথ ধরল। " আজ একটা দারুণ ভূতের সিনেমা দেখব। মালায়ালাম সিনেমা। ব্লক বাস্টার শুধু নয়, খুব হাই ক্রিটিক রেটিং ও পাচ্ছে। দেখবি? মামুট্টি আছে।" মামুট্টি আমার বাবার প্রিয়তম নায়ক তথা অভিনেতা। খুঁজে খুঁজে ইউটিউব থেকে মামুট্টির সিনেমা বার করে দেখে বাবা। আমি বরাবরই বাবার মেয়ে, বাবার যাকে পছন্দ, আমারও তাকেই ভালো লাগে। তবে এ ক্ষেত্রে মামুট্টির থেকেও যাকে বেশি পছন্দ হল, সে হল ভূত। ভূত বা ভৌতিক সিনেমা আমার চিরকালীন দুর্বলতা। 


 জিজ্ঞাসা করলাম, কি নাম? জবাব এল ভ্রমযুগম। মুখে কি ভাব ফুটল জানি না, শৌভিক চোখ গোল গোল করে বলল, " ভ্রমযুগম মানে জানিস? Age of madness।" চটজলদি নৈশভোজের পাট চুকিয়ে, ঘর অন্ধকার করে একরাশ উৎসাহ নিয়ে যুগলে দেখতে বসলাম। শ্রীমতী তুত্তুরীকেও আহ্বান জানানো হয়েছিল, তিনি যখন শুনলেন প্রায় আড়াই ঘণ্টার ছায়াছবি, সটান পিঠটান দিলেন। "বাবা গো, এত বড় সিনেমা কে দেখবে -"। 


অগত্যা আমি আর তুমিই ভরসা। শুরু হল সিনেমা। সাদাকালো। শুনলাম গোটা সিনেমাটাই নাকি সাদাকালো। ষোড়শ শতকের কেরালা। দক্ষিণ মালাবার অঞ্চলে পর্তুগিজ আক্রমণে পর্যুদস্ত এক রাজার দুই কর্মচারী, কোন মতে দাস ব্যবসায়ীদের হাত থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় এক গহীন জঙ্গলে। জঙ্গলের পাশ দিয়ে বয়ে যায় খরস্রোতা নদী, নদী টপকাতে পারলেই নিরাপদ আশ্রয়। অন্ধকারে নদী না পেরিয়ে,জঙ্গলের মধ্যেই আশ্রয় নেয় দুজনে। রাতের বেলা এক সুন্দরী পেত্নী ( যক্ষী) আক্রমণে নিহত হয় একজন, অন্যজন পালাতে পালাতে গিয়ে উপস্থিত হয় ভগ্নপ্রায় এক বিশাল অট্টালিকায়। 


এত বড় হাভেলী, কিন্তু বাসিন্দা কেবল দুই জন। বৃদ্ধ কিছুটা ক্ষেপা গৃহকর্তা কদুমন পোট্টি আর এক পাচক তথা গৃহসেবক। গৃহকর্তার নিমন্ত্রণে একটা রাতের জন্য থেকে যেতে রাজি হয়ে লোকটি, এমনিতেই বেশ কিছুদিন ধরে অভুক্ত। সামান্য দুমুঠো অন্নের জন্য থেকেই যায় লোকটি। এই থেকে যাওয়াই কাল হয়ে দাঁড়ায় হতভাগ্য লোকটির জন্য। কেন এবং কিভাবে সেটাই নিয়েই গল্প। যদি প্রশ্ন করেন,ভালো লেগেছে কি না, তো আমি তো অন্তত বলব মোটামুটি। অভিনয় নিয়ে কোন কথা হবে না, মাত্র তিনজন চরিত্র নিয়ে গড়িয়েছে গল্পটা। কদুমন পোট্টি - পাচক আর আশ্রিত ব্যক্তি। তিনজনেই ফাটিয়ে অভিনয় করেছে, কাকে ফেলে, কার কথা বলি। গোটা ফিল্মটাই সাদাকালো, এই বর্ণহীনতা আলাদাই এক মাত্রা এনে দেয় ভৌতিক সিনেমায়। শুধু আর একটু ছোট হলে বড় ভালো হত।  


সেটাই বললাম শৌভিককে। আর বললাম, ভূতটা মোটেই ভয় দেখানো টাইপ লয়। ভয় টয় কিস্যু তেমন লাগল না বাপু। শৌভিক মানলে তো নাই, উল্টে রেগে আগুন হয়ে বলল, " আসলে তুই কিছু বুঝিসই নি। এই সব সিনেমা তোর জন্য না, তুই যা তো, যা, গিয়ে হীরামাণ্ডীই দেখ।" যেন না বললে আমি দেখতাম না 😤।

অনির ডাইরি ৯ই মে, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



অফিসে বেরিয়ে, গাড়িতে উঠেই ফোনটা করলাম, " হ্যাপি বাড্ডে বাবা।" বিগত দিন কয়েক ধরেই, শ্বশুরমশাইয়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, গলার জোরও এসে ঠেকেছে তলানিতে, সেই অবস্থাতেই কোন মতে বললেন, " সে তো কালকে ছিল।"


সে আবার কি কথা, গতকাল কি করে থাকতে পারে? আজই তো ২৬ শে এপ্রিল, বাংলায় ১২ই বৈশাখ। আজকের দিনেই তো ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন ভদ্রলোক। আজকের দিনটার জন্য কবে থেকে আঁচলে গিঁট বেঁধে রেখেছি আমি। ভেবেছিলাম, তুত্তুরীকে বগলদাবা করে, সটান গিয়ে হাজির হব মহানগরে। সঙ্গে নিয়ে যাব পায়েস, কেক আর ওনার প্রিয় দুয়েকটি পদ। বৃদ্ধের হঠাৎ অসুস্থতা দিলে সব কেঁচে গণ্ডুষ করে। এবার তাই শুকনো ফোনই সম্বল।


কিন্তু বৃদ্ধ মানলে তো। যতবার আমি বলি, আজই আপনার জন্মদিন, ততোবার বৃদ্ধ বলে, "মোটেই না, গতকাল ছিল -।" এতো মহাজ্বালা। ভ্রাইভারের কান বাঁচিয়ে, দুদিক থেকে হিসেব করতে বসলাম দুজনে - ১৪ই এপ্রিল ছিল পয়লা বৈশাখ, তাহলে ১৫ই এপ্রিল, ২রা------- করতে করতে দেখা গেল, সত্যিই ২৬ নয়, ২৫ শে এপ্রিলই ছিল ১২ই বৈশাখ। শ্বশুরমশাইয়ের ৭৮ তম জন্মদিন। 


এক অদ্ভুত বিষাদের মেঘ পলকে ঢেকে দিল আমায়। ইশ্ বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়ে, এত বড় ভুল কি করে করতে পারলাম? পিসি - বাবা - মা- শ্বশুর মশাই আর শাশুড়ি মাতা এই পাঁচ বয়োজ্যেষ্ঠকে কেন্দ্র করেই প্রতি মুহূর্তে আবর্তিত হয় আমাদের জীবন। আর এই পাঁচজনের মধ্যে, জন্মদিন নিয়ে আবেগ কেবল এই বৃদ্ধেরই আছে। বাকিদের ক্ষেত্রে জন্মদিনটা "ভূতের আবার জন্মবার" গোছের হলেও, শ্বশুরমশাই কিন্তু আশা করেন যে ওনার জন্মদিনে সবাই উপস্থিত থাকব, পায়েস বানানো হবে, কেক কাটা হবে। নাতনীরা শোরগোল করবে। সস্তাতম হলেও একটা নতুন জামা গায়ে গলাবেন উনি - একটা দিন, বছরে কেবল একটা দিনের জন্য উনিই হবেন সকল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। 


২০২১ সাল অবধি তাই তো হত। তখন যে একসাথে থাকতাম সবাই। পেশার টানে ইদানিং ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছি আমরা। গেল বার যখন কাঁথি আসেন, কথা প্রসঙ্গে বলেই ফেলেছিলেন শ্বশুরমশাই। " আমার জন্মদিনটা কারো মনে থাকে না।" অভিমানটুকু যদিও ছিল শাশুড়ি মাতার প্রতি। তিনি যে সত্যিই ভুলে যান। ভুলে না গেলেও, তাঁর নিজেরই যা শারীরিক অবস্থা কতটুকুই বা করতে পারতেন তিনি। 


দুর্বল অস্থিচর্মসার বৃদ্ধের অভিমানী কথা গুলো বড়ই মর্মন্তুদ লেগেছিল আমার। তখনই ঠিক করেছিলাম শৌভিক না পারলেও, সবৎসা আমি ঠিক গিয়ে হাজির হব ওনার জন্মদিনে। এমনই ভাগ্যের পরিহাস যে জন্মদিনের ঠিক তিনদিন আগে ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়লেন বৃদ্ধ। এমনিতেই দু-দুবার কর্কট রোগাক্রান্ত, তারওপর আছে তীব্র শ্বাসকষ্ট। গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে আবার প্রস্টেট সংক্রান্ত জটিলতা। ডাক্তার সাফ বলে দিয়েছে, অপারেশনের প্রশ্নই ওঠে না। ওনার যা শারীরিক অবস্থা, ওই ধকল উনি নিতে পারবেন না। 


সেই সংক্রান্ত জটিলতায় হঠাৎ এমন কাবু হয়ে পড়েন, যে নির্বাচনী ব্যস্ততার মধ্যেও একদিনের ছুটি নিয়ে দৌড়াতে হয় শৌভিককে। ফলে বাতিল করতে হয়েছে আমাদের অতর্কিত হামলার পরিকল্পনা। ভাবলাম শুকনো একটু শুভেচ্ছাই জানাই, তাও একটু ভালো লাগবে বৃদ্ধের। জানাতে গিয়ে দেখি, তাতেও কেলো করেছি। বিলম্বিত শুভেচ্ছা জানালাম, বৃদ্ধ ধন্যবাদ দিল বটে, ছিটেফোঁটাও যে খুশি হল না, তা আমি এই পৌনে দুশ কিলোমিটার দূর থেকেও দিব্য অনুভব করলাম। মদ্যাভাবে গুড়ং দদাৎ কেস হল আর কি।


নাঃ, এত দূর থেকে এই অভিমানী বৃদ্ধের জন্মদিন পালন,যা দেখছি আমার একার দ্বারা সম্ভব নয়। কেন যে ইংরেজি মতের জন্মদিনটা পালন করেন না ভদ্রলোক, কে জানে বাবা। ফোনটা রেখে, উমাকে ধরলাম। বাড়ির ছোট বউ শুধু নয়,উমা হল বৃদ্ধের আদরের কন্যা। আমার মত অপদার্থ নয়,ও নির্ঘাত ঠিক টাইমে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। ওকেই বলি,ভাই রে পরের বার থেকে সঠিক তিথিটা আমাকেও একটু মনে করিয়ে দিস তো। 


হরি ! হরি! ফোন ধরে তিনি কইলেন, " না দিদিভাই, বাবার জন্মদিন তো ২৮ শে এপ্রিল। এই দেখো না, আমি রিমাইন্ডার দিয়ে রেখেছি, ফোন করব বলে।" নিজেদের গুণপনায় নিজেরাই মুগ্ধ হলাম, হাসলাম গলা ফাটিয়ে। তারপর প্রতিশ্রুতি বদ্ধ হলাম, সামনের বছর থেকে এপ্রিল পড়লেই মনে করিয়ে দেব একে অপরকে। তারপর যে প্রান্তেই থাকি না, বরগুলো যত ব্যস্তই থাকুক না কেন, ছানাগুলোকে ট্যাঁকে নিয়ে আমরা দুজনে ঠিক গিয়ে হাজির হব মহানগরের এক প্রান্তে বুড়োবুড়ির সংসারে। একজন পায়েস আনব, অন্যজন কেক। 


কিন্তু সেতো আসছে বছরের কথা, এবছর কি হবে? সময় যে বড় নির্মম, নিমেষে লণ্ডভণ্ড করে দেয় সব হিসেব।সময় বড় চঞ্চলও, মুঠোর ফাঁক গলে কেবলই হারিয়ে যেতে চায়। তাই বলে আমরা ছাড়ব নাকি? দুজনেরই টুকটাক কাজ ছিল মহানগরে, জুটিয়ে বাটিয়ে, নানা অজুহাত দেখিয়ে সব একই সঙ্গে ফেললাম আমরা। যাতে ওই সুযোগে মেলে মহানগর যাওয়ার অনুমতি। তারপর? তারপর আর কি! শ্বশুরমশাইয়ের দুই পুত্রবধূর সম্মিলিত উদ্যোগে কেক ও হল,পায়েসও হল, নাতনীদের হুল্লোড়ও হল।মাত্র এক সপ্তাহ দেরী হল এই যা। পাট ভাঙ্গা পাঞ্জাবি পড়লেন শ্বশুর মশাই, পরিপাটি করে আঁচড়ালেন মাথার চার গাছি চুল, তারপর জমিয়ে এসে বসলেন গিন্নীর পাশে। আলগোছে বললেন, "তুমিও একটা ভালো শাড়ি পরলেই তো পারতে।" আমরা ততক্ষণে চিৎকার জুড়েছি, ফুঁ দাও, ফুঁ দাও। যতটা অভিমান জমিয়েছিলে, ততো জোরে ফুঁ দাও তো দেখি।


চিত্র সৌজন্য - শ্রীমতী তুত্তুরী

অনির ডাইরি ৬ই মে, ২০২৪

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 


অফিসে ঢোকার ঠিক মুখেই ফোনটা বাজল। আজ ICSE আর ISC এর রেজাল্ট বেরিয়েছে, অনেকেই ফোন করে তাঁদের সন্তানদের রেজাল্টের খবর দিচ্ছেন। যখনই কেউ ফোন করছে, অভিনন্দন জানানো দূর আমি আকাশ থেকে পড়ছি, " কি বলছেন গো? আপনার ছেলে/মেয়ে? ICSE/ISC পাশ করেছে? কি করে সম্ভব? ওই পুঁচকে মেয়ে/ছেলেটাকে তো সেদিনই দেখলাম, নাক দিয়ে ইয়ে গড়াচ্ছে/ লুকিয়ে নাক খুঁটছে। সে কোন যাদু মন্ত্রে এত ধেড়ে হয়ে গেল রাতারাতি?" সময় এত দ্রুত কেন ছোটে, কে জানে। 


ভাবলাম তেমনই কেউ করছে বুঝি। আমার যে বয়সের গাছ পাথর রইল না, সেই অনুভূতি নতুন করে জাগাতে। ফোন খুলে দেখি আমার বর। তার আবার কি হল? এই তো ঘন্টা খানেক আগেই দেখা হল। "বেরো - বেরো- বেরো- বেরো" করে প্রায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ভাগাল বাড়ি থেকে। রোজই তাই করে, নাহলে আমি নাকি আরো দেরী করব, অফিস বেরোতে। 


অসময়ে বাড়ির ফোন এলে একটু ভয় ভয়ই লাগে। ফোন ধরে তাই বললাম, "কি আবার হল? সব ঠিক -"। কথা শেষ করতে না দিয়ে ওদিক থেকে গম্ভীর গলায় শৌভিক বলল, " আমার জুতোয় একটা ব্যাঙ ঢুকে বসেছিল।" প্রথমে মনে হল, এটা বলতে এই নির্বাচনী ব্যস্ততার মাঝে আমায় ফোন করেছে?  পরক্ষণেই অনুধাবন করলাম, জুতোয় ব্যাঙ ঢোকা মোটেই ভালো ব্যাপার লয়। বললাম, " ঝেড়ে পরেছিলি তো?" 


উল্টো দিক থেকে কাঁদো কাঁদো সুরে শৌভিক বলল, " না তো।" মানে কি? অ্যাঁ? ব্যাঙ একটা বড়সড় জিনিস, কিন্তু আরশোলা-মাকড়সা -টিকটিকি তো ঢুকে থাকতেই পারে। হরবখত ঢোকে, তাই তুত্তুররীকে ছোট থেকে জুতো ঝেড়ে পরতে শিখিয়েছি। অথচ তার বাপ সেটা শেখেনি?


 বলাতে শোভিক বলল, "আরে রোজই তো পরি। আজ তাড়া ছিল, তারওপর একটা ফোন ও এসেছিল। তাই কথা বলতে বলতে সটান দিয়েছি পা গলিয়ে। একটা পা দিব্য গলে গেল, অন্যটা আর গলেই না। জোর করে ঢোকাতে গেলাম, পায়ের আঙুলে কেমন যেন কুড়কুড় করল।" 


 উফ ভগবান। এমন আপদ, যে  বোঝেওনি যে ভিতরে একটা আস্ত জীব ঢুকে বসে আছে। তারওপর দিয়ে চেপে পা ঢোকাতে গেছে আবার। কে জানে,ব্যাঙটা আছে, না থেঁতলে গেছে? শৌভিক আশ্বস্ত করার ঢঙে বলে, " আছে, আছে। পা কেন ঢুকছে না দেখার জন্য আমি যখন জুতোর ভিতরে হাত গলালাম, হাত বার করে দেখি, হাতের ওপর বসে একটা হোৎকা ব্যাঙ গম্ভীর মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর আমার হাত থেকে সটান এক লাফ মেরে বাগানে পালিয়ে গেল।" 


নিজের কানকে বিশ্বাস হয় না। বলি, " তুই আবার জুতোর মধ্যে হাত ঢুকিয়ে ব্যাঙটাকে টেনে বারও করেছিস? এত বুদ্ধি রাখিস কোথায় রে?" ফোনের ওপাশে হিহি করে হাসতে থাকে শৌভিক।ছোটবেলায় ঠাকুমা বলত, ব্যাঙের গায়ে গরল থাকে, হাত দিলেই হাতে ঘা হয়। কে জানে, কোন হাত ঢুকিয়েছিল। কে জানে, কি হবে লোকটার হাতে। তবু ব্যাঙ অবধি ঠিক আছে, কিন্তু ব্যাঙ যার খাদক তিনি যদি ওমন ঘাপটি মেরে বসে থাকেন, কি হবে? তাকেও কি ওমন ন্যাজ ধরে টেনে বার করে সোহাগী ফোন করবে?  হে ঈশ্বর, কার পাল্লায় পড়েছি? আর হ্যাঁ, হে ঈশ্বর এটাও বলো দিকি বাপু, এটা বাড়ি না চিড়িয়াখানা?


অনির ডাইরি ১লা মে, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



আমার বাবা আর মায়ের প্রেম তথা বিবাহের গল্প আগেও বহুবার লিখেছি। কখনও ইনিয়েবিনিয়ে, কখনও বা সোজাসাপ্টা। আসলে আমি জন্ম রোমান্টিক, আর শরৎ বাবু বা শরদ্বিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এর দুয়েকটি হাতে গোনা গল্প বাদে, এটাই আমার প্রিয়তম প্রেমের গল্প। 


গ্রাম রামনগর, ব্লক বেলডাঙ্গা ২, জিলা মুর্শিদাবাদ, এটাই ছিল আমার মায়ের আদি ঠিকানা। মাতামহ যখন মারা যান, মা তখন নবম শ্রেণী, মা সদ্য শাড়ি। মাত্র দুটো শাড়ি ছিল মায়ের। একটা কাচত, একটা পরতো। তারই একটা হঠাৎ চুরি হয়ে গেল একদিন। নিরূপায় হয়ে দিদার সাদা থান পরেই কাটাতে হল মাকে বেশ কিছুদিন। খবর পেয়েই  এক জোড়া নতুন শাড়ি কিনে পাঠিয়ে দিল বড় মেসোমশাই। 


 মাতামহের অকাল মৃত্যুর পর নিঃসহায় এবং মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত দিদার হাত ধরে আশ্বাস দিয়েছিলেন বড় মেসোমশাই, " কেউ না থাকুক, আমি আছি। জামাতা নয়, আজ থেকে আমাকে নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্র বলেই মনে করবেন।" আমৃত্যু সেই প্রতিশ্রুতি পালন করে গেছেন মায়েদের "জাম্বু"। এহেন জাম্বুর নির্দেশেই একদিন রামনগরের লক্ষণ রেখা পেরিয়ে মহানগরের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিল মা। লক্ষ্য একটা চাকরী। 


পড়ন্ত বিকালে ঢলে পড়া সূর্যের আলোয় স্নাত হয়ে, লালগোলা প্যাসেঞ্জার থেকে শিয়ালদা স্টেশনে যখন নামল মা, বাংলা তখন জ্বলছে আগুনের সত্তরের দহনে। আপাততঃ ঠিকানা বড় মাসির বাড়ি। বড় মেসোমশাইয়ের কড়া নির্দেশ, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। স্বাবলম্বী হতেই হবে। তার জন্য কাজ চাই, একটা চাকরী। কিন্তু চাকরী পাওয়া কি এতই সহজ? 


বেশ কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করে, স্থানীয় পোস্ট অফিসে ছোটখাট কাজ জুটল। এমন কিছু না, খাম পোস্টকার্ড লিখে দেওয়া, ফিক্সড ডিপোজিটের ফর্ম ভরে দেওয়ার মামুলী কাজ। ভ্যাক্যান্সি থাকলে দুয়েক দিনের এক্সট্রা ডিপার্টমেন্টাল কর্মীর কাজ। তাতেও চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা। রোজ যে কাজ জোটে তা নয়,কোনদিন বেশ কয়েক টাকা জুটল,কোনদিন ঠনঠন গোপাল।বড় মেসোমশাইয়ের কড়া নির্দেশ, লেগে থাকো। অধ্যাবসায় না থাকলে কিস্যু হয় না। 


 কর্মসূত্রেই আলাপ শান্তি মাসির সাথে। মহিলা সদ্য বিধবা, এক কন্যা সন্তান নিয়ে বড় বিপদে আছেন। অনেকদিন বাচ্ছার দুধের টাকাও জোটে না। মৃত স্বামীর বন্ধুদের কাছে হাত পাতেন। ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে দুই নিঃসহায় রমণীর। খুলতে থাকে লুকিয়ে রাখা বেদনার ঝাঁপি। মা জানতে পারে, শান্তি মাসির স্বামী আদতে মৃত নয়, নিখোঁজ। প্রতিপক্ষ বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল, তারপর আর তার কোন খোঁজ মেলেনি। শোনা যায় পিটিয়ে মেরে লাশ গুম করে দেওয়া হয়েছে। শান্তি মাসির মাধ্যমেই মা পরিচিত হয় তাঁর মৃত স্বামীর বন্ধু থুড়ি কমরেডদের সাথে। কমরেডদের মধ্যমণি, এক  ভয়ানক আঁতেল নকশাল নেতা। গ্রাম থেকে জীবিকার সন্ধানে আসা কৃষ্ণাঙ্গী মেয়েটাকে মোটেই পাত্তা দেয় না সে। কিন্তু মেয়েটির যে  ওণাকে বড় ভালো লাগে। সাম্য- বিপ্লব-যৌথ খামার মার্কা বুলি মেয়েটির স্বঘোষিত মোটা মাথায় একবিন্দু ঢোকে না। তবুও নেতাবাবুর অনুগামিনী হয়ে পড়ে সে। সময় পেলেই পিছনের সারিতে বসে শুনতে থাকে দিন বদলের বৈপ্লবিক স্বপ্নের ইতিকথা।  


একজনের নীরব প্রেম আর একজনের খেয়াল না করার গল্প গড়ায় বেশ কিছুদিন। আচমকা পট পরিবর্তন ঘটে সাধের বঙ্গভূমিতে। কাশিপুর বরানগর ভেসে যায় রুধির ধারায়। বছর ঘুরে যায়, বদলায় না, পরিস্থিতি। উল্টে শুরু হয় ব্যাপক ধরপাকড়। নেতামশাইয়ের পৈতৃক বাড়িতে হামলা হয় সিপিএম-পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর। লুটপাট ভাঙচুরের সাথে বেধড়ক মেরেধরে তুলে নিয়ে যায় নেতাকে। মরেই যেত হয়তো। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় ছেলেটি। 


এরপর আর কি?জেলহাজত। জামিনে ছাড়াতে হল যে জরিমানা প্রদানের প্রয়োজন, তা ছেলেটির বৃদ্ধ পিতার সাধ্যাতীত। অনির্দিষ্ট কালের জন্য জেল হাজতে থাকার জন্য যখন ছেলেটি মানসিক ভাবে প্রস্তুত, হঠাৎ একদিন জানানো হল তার জামিন মঞ্জুর হয়েছে। জরিমানা কে দিল? বিক্রি করার মত আর কোন গহণাও ততোদিনে ছেলেটির মায়ের অবশিষ্ট নেই। অবশিষ্ট বলতে সাড়ে সাত বিঘার শরিকি পৈত্রিক বাড়ি শুধু। তবে কি বৃদ্ধ পিতা সেটাই করে বসল?


উদ্বিগ্ন হয়ে জেলের বাইরে বেরিয়ে রীতিমত চমকে গেল ছেলেটি, জেলের বাইরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সেই পিছনের সারিতে বসে থাকা কৃষ্ণাঙ্গী সরল গ্রাম্য মেয়েটি। দুজনেই নীরব, শেষে ছেলেটি জানতে চাইল, “টাকা জোটালে কি করে?” মেয়েটি মাটির দিকে তাকিয়ে জানালো, দেশে গিয়ে ধান বেচে টাকা আনতে একটু দেরী করে ফেলেছে। 


এরপরের গল্প শুধুই প্রেমের,রোদে বৃষ্টিতে হাত ধরে মাইলের পর মাইল হেঁটে যাওয়া। অবশেষে ১৯৭৪এর ১লা মে,শ্রমিক দিবসের দিন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয় দুইজনে। সেদিন কোন শাঁখ বাজেনি, কেউ উলু দেয়নি, মানা হয়নি কোন লোকাচার, এমনকি বরবেশও পরেনি ছেলেটি। মেয়েটি অবশ্য সেজেছিল, সামান্য প্রসাধন, ছেলেটিরই কিনে দেওয়া তুঁতে রঙের বেনারসী আর ধার করে আনা দিদির বিয়ের গয়নায়। সামান্য রেজিস্ট্রি বিবাহ, কনের তরফে সই করেন মেয়েটির জামাইবাবু তথা আমার বড় মেসোমশাই স্বর্গীয় অজিত কুমার সিংহ মহাশয় আর ছেলেটির তরফে জনৈক অবসর প্রাপ্ত আইসিএস অফিসার এইচ এল বেরি সাহেব। বাংলার নকশাল আন্দোলন নিয়ে বেরি সাহেবের মাত্রাতিরিক্ত উৎসাহই ওণাকে ছেলেটির ঘনিষ্ট তথা শুভানুধ্যায়ী বানিয়ে ছিল। 


ক্লেদাক্ত মহানগরের কোন এক নিভৃত কিনু গোয়ালার গলিতে লালনীল সংসার সাজায় এক হেরে যাওয়া নকশাল নেতা আর চাকরী সন্ধানে উন্মুখ এক নিপাট সরল মেয়ে। ফুল বিবর্জিত নিভৃত বাসরে ছেলেটি প্রতিশ্রুতি দেয়, "আমার পক্ষে আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। তবে তোমায় নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে। আজ থেকে আমিই তোমার শিক্ষক, প্রস্তুত হও ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষার জন্য।” 


সেদিনের সেই দামাল দম্পতির প্রেমবিবাহের আজ পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হল।

Wednesday 10 April 2024

অনির ডাইরি এপ্রিল, ২০২৪

অনির ডাইরি ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



বাড়ি তো নয়, সাপেদের বারোয়ারি বৈঠক খানা যেন। তদসত্ত্বেও আলো না জ্বেলে, খালি পায়ে, প্রাণের ভয়কে তুচ্ছ করে, পা টিপে টিপে এসে যতটা সম্ভব নীরবে ফ্রিজের দরজা খুলে সবে কেকে এক কামড় দিয়েছি--- পিছন থেকে ভেসে এল শৌভিকের জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর, “কি করছিস?” একেই বোধহয় বলে, 'যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই -'। বাইরের ঘর থেকে এখনও ভেসে আসছে সুরের তীব্র মূর্ছনা, তার মধ্যেও টের পেয়েছে মাইরি। 


খট করে আলো জ্বালাল শৌভিক, কঠিন ভর্ৎসনার সুরে বলল, “এই তুই নাকি রোগা হবি? তোকে কতবার বলেছি, দরকার হলে রাতে একটা রুটি বেশী খাবি, কিন্তু মাঝরাতে উঠে চোরের মত ওই সব খাবি না। রাখ - ”। দুহাতে দুই স্লাইস, মুখ ভর্তি কেক, কি আর জবাব দি। ফোলা গাল নিয়ে চোরের মত মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। খানিকক্ষণ তিরস্কারের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর, একটু নরম হল মুখের রেখা গুলো। গলাটাও যেন সামান্য মোলায়েম হল, তিনি বললেন, “যেটা মুখে পুরেছিস, ওটা খা। বাকিগুলো ফ্রিজে রেখে বাইরের ঘরে আয়, তোকে একটা মজার গল্প বলার আছে।”


এই মজার গল্পটা সেই সকাল থেকে চলছে। অফিস টাইমে প্রথম ফোন করে বলেছিল, একটা দারুণ মজার কি যেন ঘটেছে, বাড়ি এলেই বলবে। বাড়ি এসে যখন মনে করে শুধালাম, বলল, রাতে খাবার পর বলবে। নৈশ ভোজের পর যখন জানতে চাইলাম, বলল, " এখন ভালো লাগছে না

 একটু গান শুনি, কাল বলব।" এখন আবার বলছে, এখুনি বলবে, এক মুখে যে কত কথা বলে লোকটা। 


গম্ভীর মুখে সোফায় গিয়ে বসলাম, শৌভিক বলল, “ শোন আজ দুপুরে একটা ফোন এসেছিল। অচেনা নম্বর। আমি “হ্যালো” বলতে ওপাশ থেকে এক অপরিচিত পুরুষ কণ্ঠ বলল, “আচ্ছা এটা কি কাঁথি মহকুমা শাসকের দপ্তর?” হ্যাঁ বলাতে বলল, আচ্ছা এসডিও সাহেবের নাম কি শৌভিক ভট্টাচার্য? বললাম হুঁ, তো বলল, “ওনার সাথে একটু কথা বলা যাবে?” অসহিষ্ণু হয়ে বললাম, বলছি তো, বলুন। 


ওদিকের কন্ঠস্বরে পলকে নেমে এল সম্ভ্রমের পর্দা, ভদ্রলোক অত্যন্ত বিনীত ভাবে নিজের পরিচয় দিলেন, জানলাম ভদ্রলোক বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের একজন পদস্থ আধিকারিক। অতঃপর তিনি বললেন, "স্যার যদি কিছু মনে না করেন, তো একটা প্রশ্ন করি।" অনুমতি পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, " আচ্ছা স্যার, আপনি কি গত বৃহস্পতিবার কোন ভাবে সল্টলেকে এসেছিলেন?" 


হেসে বললাম, আমি বিগত পাঁচ মাসে একবারও কলকাতা যাইনি। আর যেদিনকার কথা বলছেন, সেদিন তো এখানে পুরোদমে ইলেকশনের কাজ চলছিল। ভদ্রলোক শুনে আশ্বস্ত হলেন, তারপর যেটা বললেন সেটাই মজার। বললেন, " স্যার, গত বৃহস্পতিবার,দুপুর বেলা, সল্টলেকে অমুক জায়গায় ট্রাফিক পুলিশ একটা গাড়িকে, ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গের জন্য আটকায়। আটকানোর সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে একটি লোক নেমে আসে এবং সটান ট্রাফিক পুলিশের কলার চেপে ধরে। সাথে উদ্দাম খিস্তিখেউর। যার সারাংশ হল, " তুই জানিস, আমি কে? তুই জানিস, তুই কার গাড়ি আটকেছিস? আমি সায়ন মান্না, SDO কন্টাই"।" 


কি বলব,বুঝে উঠতে পারি না। কোন মতে বলি, সে আবার কে?বললেই হল, পুলিশ আই কার্ড দেখতে চায়নি? 


শৌভিক বলে, "আমিও তাই বললাম। SDO কন্টাই হলেও তো তার ট্রাফিক নিয়ম ভাঙার কোন অধিকার নেই। পুলিশ আইনানুগ ব্যবস্থা নিল না কেন? ভদ্রলোক বললেন, " কি আর বলব স্যার, ছেলেটি নতুন। সে ভয় পেয়ে গাড়িটাকে ছেড়ে দেয়। তারপরই স্থানীয় লোকজন, অন্যান্য গাড়িওয়ালারা ছেলেটির ওপর চড়াও হয়।" বাঃ অফিসারের গাড়ি বলে বেশ তো ছেড়ে দিলে -"। এই জল অনেকদূর গড়ায়, কমিশনারেটের মধ্যেও উত্তেজনা দেখা দেয়, এমন ভাবে কর্তব্যরত পুলিশের গায়ে হাত তোলা, গাল মন্দ করাটা কেউই ভালো ভাবে নিতে পারেনি। 


 কাঁথির মহকুমা শাসকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দিকে প্রথম পা বাড়াতেই ধরা পড়ে, যে কাঁথির মহকুমা শাসকের নাম মোটেই সায়ন মান্না নয়। অন্তত এখনও নয়। আর ভিডিও ফুটেজে যে লোকটির ছবি উঠেছে, তাকে মোটেই আমার মত দেখতে নয়। তারপরই ওরা ঘটনাটা আমাকে জানাতে ফোন করে।" 


সাগ্রহে জানতে চাই,ওরা ওর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে তো নাকি? শৌভিক কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিরুৎসুক ভাবে বলে, " নেবেই তো বলল। বলল দরকারে আপনারও সাক্ষ্য লাগবে স্যার।" বুঝতে পারলাম, মজার গল্প এখানেই শেষ। কিন্তু আমার মাথায় ঘুরতে থাকে হাজার গণ্ডা প্রশ্ন। কে এই মহাশয়? আর এত মহকুমা থাকতে কাঁথি কেন রে বাবা? কত আজব ঘটনাই যে নিত্য ঘটে চলেছে আমাদের আশেপাশে। নাহ্ লালমোহন বাবু ঠিকই কয়ে গেছেন, "ট্রুথ ইজ স্ট্রংগার দ্যান ফিকশন"।

অনির ডাইরি ২৩শে এপ্রিল, ২৯২৪ 

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 



সদ্য বিদেয় নিয়েছে শীত, বাতাসে লেগেছে সামান্য উষ্ণতার ছোঁয়া। এই সময়, প্রভাতী সূর্যের আলো মেখে হাঁটতে দারুণ লাগে। ভোর ভোর শ্রীমতী তুত্তুরীকে স্কুলে নামিয়ে, বাগানেই হাঁটছিলাম। হঠাৎ ডাকল শৌভিক, "জলদি একবার ভিতরে আয় -"। 


এই সময়টা সাধারণত স্নানে যায় শৌভিক, আজ আবার কি হল? স্নান না করে, ডাকাডাকি মানেই কিছু অপাট করেছি আমি। কি করলাম রে বাবা, ভাবতে ভাবতে বাড়ির ভিতরে ঢুকে দেখি, বাংলো চেম্বারের লাগোয়া বাথরুমের সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার বর। মুখে ভেবলে যাওয়া হাসি। নিশ্চিন্ত হলাম, হাসি মুখ যখন,তাহলে ফাঁসি দিবে নি। তবে সেই নিশ্চিন্ত ভাব বেশী ক্ষণ টিকল কই? 


বাথরুমের প্লাস্টিকের দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ, ভিতর থেকে প্রবল দুম - দুম, খচ মচ আওয়াজ আসছে। লতাদি ব্যবহার করে এই বাথরুম টা, হতবাক হয়ে বললাম, "সাত সকালে লতাদিকে বাথরুমে বন্ধ করে দিয়েছিস?" শৌভিকের হাসিটা যেন রবার দিয়ে কেউ মুছে দিল,কপালে পটপট করে পড়ে গেল অনেকগুলো ভাঁজ, নেহাৎ, কলিযুগ - নইলে ভস্ম হয়ে যেতাম নির্ঘাত। 


পিছন থেকে লতা দির গলা ভেসে এল, " আরে আমাকে কেন বন্ধ করবে? বাথরুমে গোসাপ ঢুকছে -"। অ্যাঁ! গোসাপ, আমাদের হাওড়ার ভাষায় গোহাড়গিলে। আছে বটে কয়েকখানা,মাঝে মধ্যে বাগানের পাঁচিল বরাবর গুটগুট করে হেঁটে যায়।  ছাতের জল যাবার নর্দমায় জমিয়ে বসে, ল্যাজ নেড়ে নেড়ে ঝগড়াও করে। কিন্তু বিগত এক দেড় বছরে কোনদিন বাংলোর ভিতরে ঢোকার ধৃষ্টতা দেখায়নি। 


শৌভিক বলল, " চান করতে যাবার আগে ভাবলাম ওয়াশিং মেশিন টা চালিয়ে দিয়ে যাই। জল বেরোনোর পাইপটা বাথরুমে ঢোকাতে দরজা খুলেছি,দেখি কোণাকুণি উল্টো দিকে বসে তিনি ঝিমোচ্ছেন। কাল রাতে বোধহয়, সান শেডের ওপর উঠেছিল পাখি বা কাঠবিড়ালির ছানা খেতে। তাল সামলাতে না পেরে বাথরুমের জানলার খড়খড়ি গলে ভেতরে পড়ে গেছে।" 


বুঝলাম যে পথ দিয়ে পড়েছে, সে পথ আর খুঁজে পায়নি।টাইলস লাগানো দেওয়াল বেয়ে প্রায় সাত ফুট চড়া, ওই ধুমসোর পক্ষে অসম্ভব। সারা রাত চেষ্টা করেছে নির্ঘাত। তারপর ক্লান্ত হয়ে যখন ঘুমাতে গেছে, তখনই আমার বর দরজা খুলে তাকে নতুন আলোর পথ দেখিয়েছে। তিনি আপাতত পূর্ণ বিক্রমে দরজা ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছেন। যে হারে ধুপধাপ করছেন, এই মান্ধাতার আমলের ফাইবারের দরজা কতক্ষণ টিকবে কে জানে। এক ধমক মেরে আগে তাকে শান্ত করলাম। 


ওনার আব্দার মত দরজা খুলে দিলেও জ্বালা।চৌকাঠ ডিঙালেই শ্যাম বাজারের মত পাঁচ মাথার মোড়ে গিয়ে পড়বে। যার  কোন দিকের রাস্তা গিয়েছে রান্না ঘর, খাবার ঘর, ভাঁড়ার ঘরের দিকে। তো কোনটা শৌভিকের বাংলো চেম্বারের দিকে। অবশিষ্ট পথ বেঁকে গেছে তুত্তুরী আর আমাদের শয়ন কক্ষের দিকে। কোন পথ যে তিনি ধরবেন, কে বলতে পারে। 


জানতে চাইলাম, বন দপ্তরকে খবর দিয়েছ? শৌভিক খানিক মাথা আর দাড়ি চুলকে, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, " নাহ, সামান্য একটা গোহাড়গিলের জন্য কেন শুধু শুধু আর ওদের জ্বালাব। নীলোৎপল বলেছে, ' স্যার আপনারা বেরিয়ে গেলে,আমি ওকে ঠিক বার করে দুব।" 


 এই না হলে আমার বরের বুদ্ধি। নীলোৎপল বলল, আর উনিও বিশ্বাস করলেন। নীলোৎপল বাংলোর যাবতীয় ঝাড়পোঁচ, বাগান ঝাঁট দেওয়ার কাজ করে। যাই বলা হয় খুব নিষ্ঠা ভরে করে, তাই বলে এই ধুমসো গোসাপকে বার করতে পারে কখনও। ওজনে নীলোৎপলের অর্ধেক হবে ব্যাটা। আপাতত আমার ধমক খেয়ে শান্ত হলেও, একটু আগে যে হারে গজরাচ্ছিল। 


রেগে গিয়ে বললাম, তুমি বন দপ্তরের আধিকারিককে ফোন করবে? নাকি আমি সুকন্যাকে ফোন করব? সুকন্যা বনবিবি কিনা,  বন দপ্তরের সঙ্গেই সহবাস করে। এইসব সমস্যায় আমার নির্ভরযোগ্য ঠিকানা।  আঁতে ঘা লাগল বোধহয় বাবুর, ফোন করলেন স্থানীয় আধিকারিককে, জানা গেল তিনি বদলী হয়ে গেছেন। তবে নতুন আধিকারিকের নম্বরটা দিয়ে দিলেন। তাঁকে মুঠো ফোনে ধরে,নিজের পরিচয় দিয়ে, অতিথির আগমন সমাচার দিতেই, তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়া হল, " ওটাকে রেসকিউ করতে হবে। ওটাকে রেসকিউ করতে হবে। মারবেন না যেন প্লিজ -"। 


মারব কি, আমরা তো শুধু ব্যাটাকে বাথরুম থেকে বার করে বাগানে ছেড়ে দিতে চাই। নেহাৎ নিজেদের সাহসে কুলোচ্ছে না। কে বলে সরকারি দপ্তর নড়ে না, আধা ঘন্টার মধ্যেই বন দপ্তরের লোকজন এত্ত বড় একটা সাঁড়াশি নিয়ে এল, দরজা খুলল, খপ করে ধরে একটা হাতখাঁচায় পুরে নিল। তিনি তখনও আমার ধমক খেয়ে নীরব। জুলজুল করে তাকিয়ে দেখছিল চারিধার। 


বন দপ্তরের লোকজন জানতে চাইল, " স্যার এটাকে নিয়ে কি করব?" আমরা দুজনেই কইলাম,বাগানে ছেড়ে দিতে। কিন্তু কি মনে করে,ওনারা বললেন, "দরকার নেই স্যার, আবার যদি ঢুকে পড়ে। সামনের রাস্তায় ছেড়ে দিচ্ছি, আসে পাশে এত ফাঁকা জায়গা আছে, চলে যাবে।" 


আমাদের চোখের সামনে দিয়ে চলে গেলেন তিনি।  আমরা যুগলে নিঃসন্দেহ ছিলাম, রাস্তায় ছেড়ে দেবার সাথে সাথেই খোকা বাবুর ( নাকি খুকি বিবি) প্রত্যাবর্তন হবে। কিন্তু আমাদের বিশ্বাসকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে, তিনি আর ফিরে এলেন নি। শুনেছিলাম গোসাপ থাকলে নাকি সাপ আসে না। কথাটা যে কতবড় সত্যি টের পেলাম কিছু দিনের মধ্যেই। বার তিনেক দেখা মিলল, মাননীয় পন্নগ মহোদয়ের। বুড়ো থপথপে গোহাড়গিলের মত তাঁরা সটাং শৌচাগারে সেঁধালেন না,বরং উঁকি ঝুঁকি মারতে লাগলেন শয়ন কক্ষে। আমার প্রবল বুদ্ধিমতী কন্যা তো, ফালতু তার মনে করে ওমন এক ফণাধরকে টান মেরে ফেলেই দিচ্ছিলেন সম্প্রতি। নেহাৎ অন্তিম মুহূর্তে তিনি চিড়িক করে একটু জিভ বার করেছিলেন,নাহলে যে কি হত, ভেবে আমার মা, পিসি, শাশুড়ির এখনও হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। 


ব্লিচিং, কার্বলিক অ্যাসিড যাই দাও,ব্যাটাদের ওপর কোন প্রভাব পড়ে না। এই ভাবেই চলছিল, সাপের সাথে লুকোচুরি। হঠাৎ করে আজ সকালে এসে উদয় হলেন ইনি। এবার ইনি যে তিনিই তার কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। DNA টেস্ট তো আর করিনি রে বাপু, তবে ওই আরকি, শিবরাম চক্রবর্তীর "হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন" সিরিজ পড়ে বড় হওয়া আমাদের মন, কেবলই বলে চলছে,  " আবার সে এসেছে ফিরিয়া।"অনির ডাইরি ২৩শে এপ্রিল, ২৯২৪ 

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 


সদ্য বিদেয় নিয়েছে শীত, বাতাসে লেগেছে সামান্য উষ্ণতার ছোঁয়া। এই সময়, প্রভাতী সূর্যের আলো মেখে হাঁটতে দারুণ লাগে। ভোর ভোর শ্রীমতী তুত্তুরীকে স্কুলে নামিয়ে, বাগানেই হাঁটছিলাম। হঠাৎ ডাকল শৌভিক, "জলদি একবার ভিতরে আয় -"। 


এই সময়টা সাধারণত স্নানে যায় শৌভিক, আজ আবার কি হল? স্নান না করে, ডাকাডাকি মানেই কিছু অপাট করেছি আমি। কি করলাম রে বাবা, ভাবতে ভাবতে বাড়ির ভিতরে ঢুকে দেখি, বাংলো চেম্বারের লাগোয়া বাথরুমের সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার বর। মুখে ভেবলে যাওয়া হাসি। নিশ্চিন্ত হলাম, হাসি মুখ যখন,তাহলে ফাঁসি দিবে নি। তবে সেই নিশ্চিন্ত ভাব বেশী ক্ষণ টিকল কই? 


বাথরুমের প্লাস্টিকের দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ, ভিতর থেকে প্রবল দুম - দুম, খচ মচ আওয়াজ আসছে। লতাদি ব্যবহার করে এই বাথরুম টা, হতবাক হয়ে বললাম, "সাত সকালে লতাদিকে বাথরুমে বন্ধ করে দিয়েছিস?" শৌভিকের হাসিটা যেন রবার দিয়ে কেউ মুছে দিল,কপালে পটপট করে পড়ে গেল অনেকগুলো ভাঁজ, নেহাৎ, কলিযুগ - নইলে ভস্ম হয়ে যেতাম নির্ঘাত। 


পিছন থেকে লতা দির গলা ভেসে এল, " আরে আমাকে কেন বন্ধ করবে? বাথরুমে গোসাপ ঢুকছে -"। অ্যাঁ! গোসাপ, আমাদের হাওড়ার ভাষায় গোহাড়গিলে। আছে বটে কয়েকখানা,মাঝে মধ্যে বাগানের পাঁচিল বরাবর গুটগুট করে হেঁটে যায়।  ছাতের জল যাবার নর্দমায় জমিয়ে বসে, ল্যাজ নেড়ে নেড়ে ঝগড়াও করে। কিন্তু বিগত এক দেড় বছরে কোনদিন বাংলোর ভিতরে ঢোকার ধৃষ্টতা দেখায়নি। 


শৌভিক বলল, " চান করতে যাবার আগে ভাবলাম ওয়াশিং মেশিন টা চালিয়ে দিয়ে যাই। জল বেরোনোর পাইপটা বাথরুমে ঢোকাতে দরজা খুলেছি,দেখি কোণাকুণি উল্টো দিকে বসে তিনি ঝিমোচ্ছেন। কাল রাতে বোধহয়, সান শেডের ওপর উঠেছিল পাখি বা কাঠবিড়ালির ছানা খেতে। তাল সামলাতে না পেরে বাথরুমের জানলার খড়খড়ি গলে ভেতরে পড়ে গেছে।" 


বুঝলাম যে পথ দিয়ে পড়েছে, সে পথ আর খুঁজে পায়নি।টাইলস লাগানো দেওয়াল বেয়ে প্রায় সাত ফুট চড়া, ওই ধুমসোর পক্ষে অসম্ভব। সারা রাত চেষ্টা করেছে নির্ঘাত। তারপর ক্লান্ত হয়ে যখন ঘুমাতে গেছে, তখনই আমার বর দরজা খুলে তাকে নতুন আলোর পথ দেখিয়েছে। তিনি আপাতত পূর্ণ বিক্রমে দরজা ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছেন। যে হারে ধুপধাপ করছেন, এই মান্ধাতার আমলের ফাইবারের দরজা কতক্ষণ টিকবে কে জানে। এক ধমক মেরে আগে তাকে শান্ত করলাম। 


ওনার আব্দার মত দরজা খুলে দিলেও জ্বালা।চৌকাঠ ডিঙালেই শ্যাম বাজারের মত পাঁচ মাথার মোড়ে গিয়ে পড়বে। যার  কোন দিকের রাস্তা গিয়েছে রান্না ঘর, খাবার ঘর, ভাঁড়ার ঘরের দিকে। তো কোনটা শৌভিকের বাংলো চেম্বারের দিকে। অবশিষ্ট পথ বেঁকে গেছে তুত্তুরী আর আমাদের শয়ন কক্ষের দিকে। কোন পথ যে তিনি ধরবেন, কে বলতে পারে। 


জানতে চাইলাম, বন দপ্তরকে খবর দিয়েছ? শৌভিক খানিক মাথা আর দাড়ি চুলকে, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, " নাহ, সামান্য একটা গোহাড়গিলের জন্য কেন শুধু শুধু আর ওদের জ্বালাব। নীলোৎপল বলেছে, ' স্যার আপনারা বেরিয়ে গেলে,আমি ওকে ঠিক বার করে দুব।" 


 এই না হলে আমার বরের বুদ্ধি। নীলোৎপল বলল, আর উনিও বিশ্বাস করলেন। নীলোৎপল বাংলোর যাবতীয় ঝাড়পোঁচ, বাগান ঝাঁট দেওয়ার কাজ করে। যাই বলা হয় খুব নিষ্ঠা ভরে করে, তাই বলে এই ধুমসো গোসাপকে বার করতে পারে কখনও। ওজনে নীলোৎপলের অর্ধেক হবে ব্যাটা। আপাতত আমার ধমক খেয়ে শান্ত হলেও, একটু আগে যে হারে গজরাচ্ছিল। 


রেগে গিয়ে বললাম, তুমি বন দপ্তরের আধিকারিককে ফোন করবে? নাকি আমি সুকন্যাকে ফোন করব? সুকন্যা বনবিবি কিনা,  বন দপ্তরের সঙ্গেই সহবাস করে। এইসব সমস্যায় আমার নির্ভরযোগ্য ঠিকানা।  আঁতে ঘা লাগল বোধহয় বাবুর, ফোন করলেন স্থানীয় আধিকারিককে, জানা গেল তিনি বদলী হয়ে গেছেন। তবে নতুন আধিকারিকের নম্বরটা দিয়ে দিলেন। তাঁকে মুঠো ফোনে ধরে,নিজের পরিচয় দিয়ে, অতিথির আগমন সমাচার দিতেই, তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়া হল, " ওটাকে রেসকিউ করতে হবে। ওটাকে রেসকিউ করতে হবে। মারবেন না যেন প্লিজ -"। 


মারব কি, আমরা তো শুধু ব্যাটাকে বাথরুম থেকে বার করে বাগানে ছেড়ে দিতে চাই। নেহাৎ নিজেদের সাহসে কুলোচ্ছে না। কে বলে সরকারি দপ্তর নড়ে না, আধা ঘন্টার মধ্যেই বন দপ্তরের লোকজন এত্ত বড় একটা সাঁড়াশি নিয়ে এল, দরজা খুলল, খপ করে ধরে একটা হাতখাঁচায় পুরে নিল। তিনি তখনও আমার ধমক খেয়ে নীরব। জুলজুল করে তাকিয়ে দেখছিল চারিধার। 


বন দপ্তরের লোকজন জানতে চাইল, " স্যার এটাকে নিয়ে কি করব?" আমরা দুজনেই কইলাম,বাগানে ছেড়ে দিতে। কিন্তু কি মনে করে,ওনারা বললেন, "দরকার নেই স্যার, আবার যদি ঢুকে পড়ে। সামনের রাস্তায় ছেড়ে দিচ্ছি, আসে পাশে এত ফাঁকা জায়গা আছে, চলে যাবে।" 


আমাদের চোখের সামনে দিয়ে চলে গেলেন তিনি।  আমরা যুগলে নিঃসন্দেহ ছিলাম, রাস্তায় ছেড়ে দেবার সাথে সাথেই খোকা বাবুর ( নাকি খুকি বিবি) প্রত্যাবর্তন হবে। কিন্তু আমাদের বিশ্বাসকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে, তিনি আর ফিরে এলেন নি। শুনেছিলাম গোসাপ থাকলে নাকি সাপ আসে না। কথাটা যে কতবড় সত্যি টের পেলাম কিছু দিনের মধ্যেই। বার তিনেক দেখা মিলল, মাননীয় পন্নগ মহোদয়ের। বুড়ো থপথপে গোহাড়গিলের মত তাঁরা সটাং শৌচাগারে সেঁধালেন না,বরং উঁকি ঝুঁকি মারতে লাগলেন শয়ন কক্ষে। আমার প্রবল বুদ্ধিমতী কন্যা তো, ফালতু তার মনে করে ওমন এক ফণাধরকে টান মেরে ফেলেই দিচ্ছিলেন সম্প্রতি। নেহাৎ অন্তিম মুহূর্তে তিনি চিড়িক করে একটু জিভ বার করেছিলেন,নাহলে যে কি হত, ভেবে আমার মা, পিসি, শাশুড়ির এখনও হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। 


ব্লিচিং, কার্বলিক অ্যাসিড যাই দাও,ব্যাটাদের ওপর কোন প্রভাব পড়ে না। এই ভাবেই চলছিল, সাপের সাথে লুকোচুরি। হঠাৎ করে আজ সকালে এসে উদয় হলেন ইনি। এবার ইনি যে তিনিই তার কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। DNA টেস্ট তো আর করিনি রে বাপু, তবে ওই আরকি, শিবরাম চক্রবর্তীর "হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন" সিরিজ পড়ে বড় হওয়া আমাদের মন, কেবলই বলে চলছে,  " আবার সে এসেছে ফিরিয়া।"


অনির ডাইরি ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 



 " কঁহি তো ইয়ে দিল কভি মিল নেহি পাতে, কঁহি সে নিকল আয়ে জন্মোঁ কে নাতে -"। নবুর আর আমার ক্ষেত্রে এই লাইনটা অব্যর্থ। আমি হাওড়ার মেয়ে, নবুর বাড়ি তমলুক। আর দুজনের দেখা হল কিনা, ভরা গ্রীষ্মে, তৎকালীন ভারতের দীর্ঘতম প্ল্যাটফর্মে। 


বছর সতেরো আগের কথা, আমার চাকরী জীবনের প্রথম পোস্টিং। পেশাদারী মনোভাব আসতে তখনও বাকি বেশ কিছু সময়। একদম ভালো লাগত না চাকরি করতে। প্ল্যাটফর্মে পা রাখলেই মনে হত ফিরতি ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরে যাই। হয়তো স্বভাব, অথবা আমার পেশাদারিত্বের অভাব, যে কোন কারণেই হোক, তৎকালীন বড় সাহেব কোন কাজেরই যোগ্য মনে করলেন না আমায়। সকাল থেকে বিকেল গালে হাত দিয়ে বসে থাকি, একটা অপরিচ্ছন্ন, আধা অন্ধকার স্যাঁতস্যাতে ঘরে। যার গাল ভরা নাম, "চেম্বার"। যাবার সময় দাশনগর থেকে একটা টাইমস অফ ইন্ডিয়া কিনে নিয়ে যাই, সারাদিন তাই মুখস্থ করি। এর জন্য দৈনন্দিন সাত আট ঘণ্টার জার্নি, কার পোষায়? 


আমার কম্পিউটার ইন্টারনেট কিচ্ছু নেই, আমার মোবাইল বলতে বোতাম টেপা পুঁচকে রিলায়েন্সের CDMA ফোন। রেডিও চলত বটে কিন্তু মেরেকেটে উলুবেড়িয়া পর্যন্ত। কি যে অপরিসীম যাতনায় কাটছিল দিনগুলো।  তারওপর লোকাল ট্রেনে নিত্য যাত্রা। "একটু সরে বসুন" বলতেও গলা শুকিয়ে যায়। যাতায়াত শুরু করার দিন দুই তিনের মধ্যেই প্রত্যক্ষ করলাম, এই সরে-নড়ে বসাকে কেন্দ্র করে এক মাঝবয়সী নিত্যযাত্রিনী সপাটে চড় কষালেন একটি অল্পবয়সী মেয়ের গালে। বাবা গো!


আরো কুঁকড়ে গেলাম আমি। আরো নত হল শির, আরো বেঁকলো শিরদাঁড়া। এমনি এক আঁকাবাঁকা দিনে হঠাৎ করে গায়ে পড়েই ভাব জমালো নবু। দিন দুয়েক ধরে লক্ষ্য করছিলাম বটে, লেডিজ কামরায় এক নতুন মুখ, কিন্তু ভাব জমানোর দুঃসাহস হয়নি। আলাপ হতে দেখলাম মেয়েটা মন্দ নয়। বরং বেশ ভালোই। দেখলাম প্রায় সব ব্যাপারেই দুজনে মোটামুটি সম মানসিকতাসম্পন্ন। দেখলাম একই ট্রেনে যাতায়াত করি দুজনে, এমনকি দুজনের কর্মস্থল ও পাশাপাশি।চেহারাও দুজনের গোলগাল, দুজনেই ভোজন বিলাসী,  দুজনেই বকবক করতে ভালোবাসি, সবথেকে বড় কথা দুজনেই নতুন এই শহরে। 


ভাব জমতে দেরী হল না। বিভীষিকার ট্রেন যাত্রা দেখতে দেখতে হয়ে উঠল চূড়ান্ত মনোরঞ্জক। ওই যে বললাম, উভয়েই খাদ্যরসিক, আমরা যেন ট্রেনে উঠতামই খাবার জন্য। মুখ না চললে আড্ডা জমে নাকি? মায়েরা এদিকে ভরপেট ডাল ভাত খাইয়ে পাঠাত, ব্যাগে ভর্তি টিফিন, ফল দিত, তাতে কি? ওগুলো আবার মানুষেখায়? টিফিন ফেলে, আমরা খুঁজতাম দশ টাকায় দশটা পুঁচকে মুসম্বি, মরশুমের সবেদা, জালে বাঁধা নারকেল কুল, ডাব, ঝালমুড়ি, কাঠি গজা, কুচো গজা,  কুচো পান্তুয়া, দিলখুশ, বাদাম চাক,মদন কটকটি, পাশকুড়ার চপ এবং  চা। অচীরেই আরও দুজন বাড়ল আমাদের টিমে, নিয়তি কাকিমা আর নন্দিতা দি। দুই চূড়ান্ত বর্ণময় চরিত্র। 


প্রসঙ্গত নিয়তি কাকিমাই হলেন সেই থাপ্পড় কষানো মহিলা। সামান্য রগচটা ছিলেন বটে, কি ভাবে যেন আমাদের দুজনকে অন্ধের মত ভালোবেসে ফেললেন। BSNL এ চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ছিলেন কাকিমা, যে কোন দপ্তরী বিষয়ে ওনার জ্ঞান ছিল বাঁধিয়ে রাখার মত। একবার কি কারণে যেন ট্রেন ভয়াবহ লেট। সবাই অফিস পৌঁছলাম সাড়ে বারোটার পর। সবাইকে হাফ সিএল আবেদন করতে হল। বাকি অর্ধেক দিবস অফিস করে, নবু, আমি, নন্দিতা দি তো জমায়েত হলাম খড়গপুর স্টেশনে, কাকিমার পাত্তা নেই। ফোন ও লাগে না। শেষে বাধ্য হয়ে ওকে ছাড়াই রওনা দিলাম আমরা। পরদিন যাবার ট্রেনে আবার কাকিমার সাথে দেখা, আমরা হই হই করে উঠলাম, কাল কোথায় ছিলে? কোন ট্রেন ধরলে? অফিসে কি খুব বকা খেলে ইত্যাদি প্রভৃতি। জুত করে বসে কাকিমা বললেন," আর বলিস নি। নতুন সাহেব হেব্বি কড়া।  আপিসে ঢুকতেই বলল, এটা অফিস আসার সময়? যান হাফ সিএল এর আবেদন করুন।  তাই করলাম। হাফ সিএল দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।" 


মাঝে মাঝে কাকিমা খাওয়াত। শুধু আমাদের নয়, প্রায় অর্ধেক লেডিজ কামরাকে। সবাই দীর্ঘ দিনের নিত্য যাত্রী,সবাই পুরাণ বন্ধু। সবাই টুকটাক খাওয়াত। কাকিমা যেদিন খাওয়াতেন, সবার জন্য মোচার চপ,আমাদের জন্য ডিমের চপ। কিন্তু সেটা বাকিদের বলাও যাবে না,দেখানো ও যাবে না। ডিম দেখা গেলেই কাকিমার রক্ত চক্ষু দেখতে হবে। সর্বোপরি বাকিরা কি ভাববে, ভয়ে গরম গোটা ডিমটা গালে পুরে বসে থাকতাম আমরা। 


আর নন্দিতাদির কথা যে কি বলি, প্রায় পাহাড়ের মত চেহারা ছিল নন্দিতাদির। চাঁদ পানা মুখ, বড় বড় এক জোড়া চোখ, মাছি বসলে পিছলে যায় এমন মসৃণ ত্বক। কাঁধ পর্যন্ত ছাঁটা রেশমী কালো চুল। সকালের ট্রেন পাঁশকুড়া ছাড়ালেই লেডিজ কামরা ফাঁকা হয়ে যেত, তখন সিটের ওপর পা মুড়ে বসে বাবা রামদেবের শেখানো প্রাণায়াম শুরু করতো নন্দিতাদি। বলতো রোজ নাকি ২৫ গ্রাম করে ওজন কমছে। দেখতে দেখতে শিল্পা শেট্টির মত হয়ে যাবে নন্দিতা দি। 


কেন যে শিল্পা হতে চাইত কে জানে। কে বলে মোটা মেয়েদের কোন আবেদন থাকে না? বিশাল মোটা হওয়া সত্ত্বেও নন্দিতাদির যে কত, কত শত অনুরাগী ছিল তার ইয়াত্তা নেই। কেউ ব্যাগ বয়ে দেয়, তো কেউ বাতাস করে। কেউ জুস খাওয়ায়, তো কেউ চা। লোকালের লেডিজ কামরায় অতটা খেলতে পারত না নন্দিনী দি। কিন্তু আরণ্যকে যেদিন ফিরতাম আমরা, মাঝে মাঝেই আধ গ্লাস চা খেয়ে বলতো, "এই সুজন খাবে?" সুজন নাম্নী ভদ্রলোক বিনা আপত্তিতে ওই আধ গ্লাস চা নিত আর খেয়েও ফেলত। কাকিমা দাঁত কিড়মিড় করে বলতো, " মরণ" আর নবু বলতো, "ওয়াক"। 


নিন্দুকে  বলত নন্দিতাদির হাতের মোটা সোনার বালাটা ওমনি কোন স্তাবকের দেওয়া উপহার।  প্রসঙ্গত এক্ষেত্রে নিন্দুক অর্থাৎ নিয়তি কাকিমা খোদ। কাকিমা এবং নন্দিতাদি কেউই কাউকে সহ্য করতে পারত না। দুজনেই একে অপরের অসাক্ষাতে, বিষ উগরে দিত অন্যজনের নামে। আর সাক্ষাতে গলা জড়াজড়ি করে গান গাইত, " -আবার দেখা যদি হল সখা, প্রাণের মাঝে আয়।"  কপাল চাপড়ে  বিড়বিড় করত নবু, " ওরে তোদের কি প্রেম রে" । 


 ভালো সময় কেন যে এত স্বল্প স্থায়ী হয়। আমাদের দৈনন্দিন অফিস যাওয়া,আমাদের অনন্ত আড্ডা, একসাথে ইমেল আইডি, অরকুট একাউন্ট খোলা, কাকিমার কাছে ঝগড়া, নন্দিতাদির কাছে বাৎস্যায়ন শিক্ষা, আমাদের  পার্ক হোটেলে আড্ডা, পুরাতন বাজারের নিউ রেস্টুরেন্টের ২৫ টাকায় আট পিস মাটন ( খেয়ে বেরিয়ে নিয়তি কাকিমা বলতো নির্ঘাত পাঁঠি খাইয়েছে),বোগদার বিস্কুটের মত ভাজা মোগলাই পরোটা, সকাল বাজারের ঘন বাদাম লস্যি, রেলওয়ে পার্কের পিকনিক- সব ফেলে  একদিন বিয়ে করে চেন্নাই চলে গেল নবু। জীবন হয়ে পড়ল আবার বিবর্ণ।ফাঁকা হয়ে গেল আমাদের লেডিজ কামরা, আরো ধুলি মলিন হয়ে পড়ল শহরটা, আরো অসহ্য হয়ে উঠল অফিসটা।


"এতো আকছার ঘটে, সাদা কালো লং শটে- "। এমনই ভেবে নিয়েছিলাম আমি। আমাকে তো আসতেই হবে এ পথে, পেয়ে যাব আবার নবুর মতই কাউকে। জমে উঠবে আবার আমাদের আড্ডা।অতই যদি সহজ হত জীবন। আরো আড়াই বছর থাকতে হয়েছিল ওই আপিসে, যাতায়াত করতে হয়েছিল ওই পথেই, কাউকে পাইনি নবুর মত। হয়তো নবুও কাউকে পায়নি আমার মতো। তাই না এত বছর বাদেও এত দূরে থেকেও মানসিক ভাবে এতটা বেঁধে আছি আমরা। আজও পাশাপাশি বসলে মনে হয়, কই সময় তো এগোয়নি। এই তো এখুনি এসে হাজির হবে কাকিমা, তার পিছু পিছু নন্দিতা দি। তারপরই জমে উঠবে আমাদের আড্ডা। ঠিক সতেরো বছর আগের মত। কে জানে, দৈনিক ২৫ গ্রাম করে কমতে কমতে, এতদিনে হয়তো সত্যিই শিল্পা শেঠি হয়ে গেছে নন্দিতা দি। বললেই হেসে গড়িয়ে পড়ে নবু, তারপর মুখ ঝামটে বলে, " তুই থাম।"

অনির ডাইরি ১৩ই এপ্রিল, ২০২৪ 

#অনিরডাইরি 



জানলার বাইরে নিকষ আঁধার। দূরে নিম গাছের মাথার ওপর জ্বলজ্বল করছে ঈদের বাঁকা চাঁদ। দূরে কোথাও বৃষ্টি হয়েছে নির্ঘাত, বাতাসে কেমন যেন হালকা হিমেল আমেজ। আশ মিটিয়ে ফুটেছে বেল আর কামিনী। খোলা জানলার ফাঁক গলে আসা হাওয়ায় চড়া ফুলেল সৌরভ। এই জন্যই বোধহয় বাতাসের আরেক নাম গন্ধবহ। 


এত সুন্দর পরিবেশ আর এমন মোহক প্রকৃতি, কিন্তু কিছুই যেন স্পর্শ করছে না আমায়। হৃদয় জুড়ে বিষাদের অন্ধকূপ। সদ্য মাতৃহারা হয়েছে জনৈক সহেলী। “মা চলে গেল রে---- আমার সব শেষ হয়ে গেল অনি-”-কয়েক ঘণ্টা আগে শোনা প্রিয়বন্ধুর মর্মান্তিক বিলাপ কিছুতেই ভুলতে পারছি না যেন। 


"কি রে, ঘর অন্ধকার করে ভূতের মত বসে আছিস কেন?" শৌভিকের কণ্ঠস্বরে চমকে উঠি, বেদনার কারণ ওর অজ্ঞাত নয়। তবে ছেলেদের শোকের প্রকাশ বড় কম। সমাজ সেটাই শেখায় যে। পুরুষ মানে সিংহ। হৃদয় বিদীর্ণ হোক, দায়িত্ব পালনে যেন কোন ত্রুটি না হয়। আলো না জ্বালিয়ে মিনিট দুয়েক পায়চারি করল শৌভিক, তারপর শুধাল, " গান শুনবি?" কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ঘর ভেসে গেল এলভিসের মধু ঢালা কণ্ঠ, " As the river flows, surely to the sea-"। আমাদের বিয়ের আগের রাতে এই গানের কয়েকটা লাইন লিখে পাঠিয়েছিল শৌভিক। আমি এমন পণ্ডিত, যে ভেবেছিলাম ওগুলো বুঝি আমার জন্যই লেখা। 


চুপচাপ শুনছিলাম দুজনে, হঠাৎ শৌভিক বলল, " মিক জ্যাগার মানে স্যার মিক জ্যাগার, একবার বলেছিলেন, ' ঈশ্বর যদি কখনও আমাদের সাথে কথা বলেন, তাহলে নির্ঘাত তাঁর কন্ঠস্বর এলভিসের মতোই হবে।' অথচ এই লোকটা মাত্র ৪২ বছর বয়সে কি মর্মান্তিক ভাবেই না মারা যায়। এমনিতেই শেষের দিকে মানসিক অবসাদে ভুগতেন। একে বিটলসের উত্থান, তারপর বব ডিলান তো ছিলেনই। একদিন পড়ে গেলেন বাথ রুমে। মাথায় এমন চোট লাগল, যে মাথার বেশ কিছু টিস্যু আলাদা হয়ে গেল। তারপর থেকে কি যে হল, শরীরের সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ফুলে যেতে লাগল। চরম অনাচার ও করতেন। প্রাসাদোপম বাড়ি গ্রেসল্যান্ড, একাই থাকতেন, খেতেন কেবল চীজ বার্গার আর কোক। আর কিচ্ছু না। পড়েও ছিল এমন এক ডাক্তারের পাল্লায় যে ওনার মৃত্যুর আগের সাত মাসে ৭৫৬টা ইনজেকশন আর ৫৩০০ বড়ি প্রেসক্রাইব করেছিল।" 


আঁতকে উঠি আমি, " এতো জীবন্ত গিনিপিগ বানিয়ে ফেলেছিল লোকটাকে।" বিষণ্ন ভাবে মাথা নাড়ে শৌভিক। বলে, "এর ফলে ওনার মারাত্মক কোষ্ঠ কাঠিন্য হয়। মলত্যাগ করতে বসে এমন চাপ দেন, যে হার্ট ফেল করে যায়। মারা যাবার অনেক পরে he was discovered with his pants down." এতক্ষণের পাথর চাপা বেদনা, হৃদপিণ্ডের ভালভ ঠেলে উঠে আসতে চায় গলার কাছে। অসহ্য বেদনায় শিউরে ওঠে স্বর তন্ত্রী। অন্য কি যেন গান চালায় শৌভিক। 


অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, গায়ে হাত দিয়ে ডাকল শৌভিক," তুই তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা পড়ছিলি না, কদিন আগে?" পড়ছিলাম বটে। পড়তে দিয়েছিল সুকন্যা। জোর করে ব্যাগে ভরে দিয়েছিল আগের বার যখন কলকাতা গিয়েছিলাম। এই কিন্ডলের যুগেও, বই চালাচালি আমাদের প্রায়ই হয়। শৌভিক বলে চলে, "কাকতালীয়ই বটে, আজকালের মধ্যেই তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে একটা লেখা পড়লাম। আমাদের সার্ভিসেরই এক অবসর প্রাপ্ত ভদ্রলোকের লেখা। উনি যখন ব্যারাকপুরে পোস্টেড ছিলেন, তারাদাস বাবুর সাথে অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। প্রায়ই আড্ডা দিতেন দুজনে। এমনি এক আড্ডায় তারাদাস বাবু বলেছিলেন, ' জানেন, বাবা (বিভূতিভূষণ) যখন মারা যান, আমার বয়স তিন বছর।' 


শৌভিককে থামিয়ে বলে উঠি, তাই বোধহয় যে কটা গল্প পড়লাম, কোন গল্পেই বাবার কথা নেই। কোন চরিত্রেরই বাবাকে নিয়ে তেমন কিছু লেখেননি। " হবে হয়তো," বলে শৌভিক, তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের জবানীতে ফিরে যায়, " বাবা যখন মারা যাচ্ছে, মানে আমার তো কিছু মনে নেই, শুনেছি আর কি, যে মা বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ' হ্যাঁ গো, তুমি চলে গেলে, আমাদের চলবে কি করে? আমরা খাব কি?' বাবা মৃত্যু শয্যায় বলেছিল, ' কেন তোমার বড় ছেলেকে রেখে গেলাম যে। ওই তোমাকে দেখবে।' মা তাজ্জব হয়ে বলেছিল, "বড় ছোট কি? আমার তো একটাই ছেলে, তার বয়স সবে তিন। সে কি করে সংসার টানবে?" বাবা হেসে বলেছিল, " কেন? অপূর্ব রইল তো।" বিশ্বাস করুন,বাবা মারা যাবার পর থেকেই ধীরে ধীরে পথের পাঁচালীর বিক্রি বাড়তে লাগল। পরে মাণিক বাবু যখন পথের পাঁচালী বানালেন বিক্রি আরও বেড়ে গেল। মাণিক বাবুর সৌজন্যে যেটা হল, পথের পাঁচালীর পাশাপাশি অপরাজিতও লোকে পড়তে লাগল। ফলে ওটারও বিক্রি বাড়ল। ওর জন্য দেখতে দেখতে আরণ্যক, দেবযান ইত্যাদি বইয়েরও বিক্রি বেড়ে গেল। রয়ালটির পয়সাতেই দিব্য চলে গেল আমাদের। কিভাবে বলেছিল জানি না, কিন্তু অপূর্ব একাই প্রায় ২৫/২৬ বছর আমাদের সংসারটা টেনে দিল, সত্যিই বাবার বড় ছেলে হয়ে -। " 


এতক্ষণ গলার কাছে জমাট বাঁধা ব্যথা ঝরঝর করে ঝরে পড়ল দুই চোখ, দুই গাল বেয়ে। জোরে জোরে ফোঁপাতে লাগলাম আমি, চোখের সামনে ভেসে ভেসে যেতে লাগলেন ফোকলা নুয়ে পড়া ইন্দির ঠাকরুন, হরিহর, সর্বজয়া, দুর্গা, অপু আর নিশ্চিন্দিপুরের খেলার মাঠ। যেখানে থোকা থোকা কাশ ফোটে। আর সেই কাশের বুক চিরে এক রাশ মেঘের মত ধোঁয়া ছেড়ে কু ঝিকঝিক করতে করতে ছুটে যায় স্বপ্নের রেলগাড়ি। 


মুখ ঝামটে বললাম, শত্তুর, শত্তুর! দিব্য একা একা কষ্ট পাচ্ছিলাম, তাও তো সহনীয় ছিল। গান শোনাতে ডেকে, সে কষ্ট বহুগুণ বাড়িয়ে দিল। ইচ্ছে করে, খুঁজে খুঁজে এই সব গল্প বলছে, যাতে কষ্ট বাড়ে। টকের জ্বালায় পালিয়ে এসে, তেঁতুল তলায় বাস করা হয়ে গেল আমার। উঠে চলে যাব বলে দরজা অবধি গেলাম ও, ওদিকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গান ধরলেন, " চৈত্রপবনে মম চিত্তবনে বাণীমঞ্জরী সঞ্চলিতা- ওগো ললিতা"। শৌভিক বলল "নাহ্ জমছে না। বড় বাবুরটা চালাই বরং।" শৌভিক বলল, "এই গানটা শুনে যা - ।"


গান ধরলেন দেবব্রত বিশ্বাস। একই সুর, একই কথা, একই গান। তবু যেন আলাদা। তবু যেন ব্যতিক্রম। এতক্ষণের উগ্র শোকের ওপর সামান্য হলেও যেন পড়ল যতি চিহ্ন। মুঠো ফোনটা আমার হাতে দিয়ে শৌভিক দেখাল, "দেখ একাই গাইছেন, বাড়িতে হারমোনিয়াম বাজিয়ে।" অবাক হয়ে ভাবি, কে রেকর্ড করেছিল, কিভাবেই বা করেছিল। তখন তো মোবাইল ক্যামেরার যুগ ছিল না, যে সবাই ডিজিটাল ক্রিয়েটর।


ভাবতে ভাবতে কি মনে হয়, জিজ্ঞাসা করি, রবি ঠাকুর ওনার গান শুনে গিয়েছিলেন। শৌভিক কি যেন ভাবে তারপর বলে, " এটা নিয়ে একটা মজার গল্প পড়েছিলাম। বোস বলছি। একবার ওনাকে, মানে দেবব্রত বিশ্বাসকে নাগরিক সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। তাতে ওনার হাতে মানপত্র তুলে দেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় খোদ। সেই সভায় দেবব্রত বিশ্বাস বলেন, যে উনি রবীন্দ্রনাথকে চিনতেন ব্রাহ্ম সমাজের 'রবি বাবু' বলে। ওনার জবানিতে, " মাঝে মাঝে রবি বাবু আসতেন আমাদের সমাজের সভায়। এসে কি যে গাইতেন,ঘুম পেয়ে যেত। তো একবার হয়েছে কি, আমার এক বন্ধু বলল, ' চলো শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসব দেখে আসি। সে বিশ্বভারতীরই ছাত্র।গেলাম তার সাথে। প্রার্থনার জন্য উপাসনা গৃহে সমবেত হয়েছি সবাই, দেখি ভিড়ের মধ্যে রবি বাবুও রয়েছেন। বললাম বন্ধুকে, ' আরে আমাদের সমাজের রবিবাবুও এসেছেন দেখি।" বন্ধু তো ভিরমি খাবার যোগাড়। বলে, "আরে গোটা বিশ্বভারতীই তো ওনার। উনিই তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।"


সেই রবীন্দ্র সঙ্গীতের সাথে আমার পরিচয়। তারপর গান শিখতে গেলাম ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীর কাছে। তিনি দুটি গান শিখিয়েছিলেন, একটা কি ভুলে গেছি, অন্যটা "সংকোচের এই বিহ্বলতা"। সংকোচের এই বিহ্বলতা খারাপ লাগেনি। বেশ একটা মার্চিং টিউনের মত লেগেছিল। প্রথম রেকর্ড ওটাই করি। তবে রবীন্দ্র সঙ্গীতের সাথে আমার গাঁটছড়া বেঁধে দিলেন আমার দুই ঈশ্বর, পঙ্কজ মল্লিক আর কানন বালা।" 


শুনতে শুনতে কখন যেন প্রলেপ পড়েছে ক্ষতের ওপর। শুকিয়ে গেছে চোখের জলও। থেমে গেছেন দেবব্রত বিশ্বাস ও। কানায় কানায় পূর্ণ হয়েছে হৃদয়ের ডালি। 'ব্রাহ্ম সমাজের রবি বাবু'র কথা ভেবে অধরের কোণে ফুটে উঠেছে একফালি হাসিও। দম ফেলে শৌভিক বলল, " আর গান না শুনলেও হয়। সিনেমা দেখবি? কাল তো তুত্তুরীর স্কুল ছুটি। ভোরে ওঠার তাড়া নেই।" গররাজি হয়ে জানতে চাই কি সিনেমা, জবাব আসে, " শ্রী স্বপন কুমারের বাদামী হায়নার কবলে।" এরপরের সময়টুকু শুধুই আফশোস আর হাত কামড়ানোর। কেন যে রাজি হলাম সিনেমাটা দেখতে। তবে সে তো অন্য গল্প।

অনির ডাইরি ৯ই এপ্রিল, ২০২৪

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 



ইফতার শব্দটা আজকাল লিখতে বড় ভয় লাগে। কে জানে কার কোন ভাবাবেগে আঘাত লাগে। বড় বেশি যেন আঞ্চলিক- সাম্প্রদায়িক হয়ে পড়েছি আমরা। কেউ যেন কাউকে দেখতে পারি না। সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই কেবল কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি, দম বন্ধ হয়ে আসে। কত যে অঢেল সময় এই নেটিজেনদের হাতে। 


মোরা ছাপোষা লেবার। এত জটিলতা কি আর মোদের মাথায় ঢোকে। আমরা তো বসে থাকি, কবে মাহে রমজান আসে আর হক বাবু রোজা রাখা শুরু করেন। আর আমরা শুরু করি মোদের ইফতার থুড়ি জলযোগের পরিকল্পনা। হক বাবু নিজেই নিরস্ত করেন, "একটু শেষের দিকে করুন ম্যাডাম, ফলের দামটাও একটু কমবে।" বেশ, শেষের দিকেই সই, কিন্তু মুস্কিল হল, মাস শেষ হবার আগেই যে নির্বাচনী নির্ঘণ্ট ঘোষণা হয়ে গেল। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল নির্বাচনী নিত্যকর্মে। তাহলে কি এবার আর আমাদের ইফতার পার্টি হবে নি?


তা আবার হয় নাকি। আমাদের সবার সব অনুষ্ঠানে সবার আগে অংশ নেন হক বাবু। সে যোশুয়ার ক্রিসমাস হোক বা আমাদের দীপাবলী। এই তো সেদিন আমাদের বসন্তোৎসব ছিল, বারবার বলা হল এবার আর আপনাকে থাকতে হবে নি। কি প্রাণান্তকর গরমটাই না পড়েছে, "তিনটে বাজলে বাড়ি চলে যান হক বাবু।" গেলেন কেমন? শেষ মুহূর্ত অবধি সব কিছুর তদারক করে গেলেন। সবার হাতে সিন্নির বাটি, ঘোলের গ্লাস তুলে দিলেন। যারা যারা ভালোবেসে রং মাখাতে গেল, কাউকে নিরস্ত করলেন না। শেষে থাকতে না পেরে পৌনে ছটার সময় আমি জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম, আজ রোজা রাখেননি নাকি হক বাবু? জবাব এল, "রেখেছি তো ম্যাডাম। এই বেরোব। রাস্তায় রোজা ভেঙে নেব ক্ষণ।"


এহেন হক বাবুর ইফতার কি আর ছোটখাট ভাবে হয়। মুস্কিল হল অন্যান্য অনুষ্ঠানে বাজার করার কাজটাও হকবাবু নিজেই করেন, এবার তো আর ওণাকে বলা যায় না। ইন্সপেক্টররাও সব ব্লকে। টিফিন টাইমে অরূপকে নিয়ে ফল কিনতে বেরোল রবি। অবস্থা দেখে হক বাবু বললেন," ম্যাডাম আমিও যাই। ওরা যে কি কিনবে-"।


ইফতার মানে তো শুধু ফল নয়, যতদূর জানি কিছু ভাজাভুজি ও থাকে। থাকে আদা আর ছোলাও। কে যেন বলল," একটু আখের গুড় ও আনব ম্যাডাম?" কেন রে বাবা হক বাবু মুগুর ভাঁজবেন নাকি? বুঝলাম কেন ফল কিনতে হক বাবু খোদ গেলেন। সাড়ে পাঁচটার ঘন্টা পড়ার সাথে সাথে‌ শুরু হয়ে গেল ফল কাটা। প্লাস্টিকের বালতিতে ঘোল বানাতে বসল বেদজ্যোতি। দই, কাজু, কিশমিশ মেশানো অমৃত। ৪০ টাকা দিয়ে এক চাঁই বরফ কিনে নিয়ে এল শান্তনু।নিখুঁত হাতে সব কিছু মিশিয়ে ওপর থেকে হালকা করে কোকো পাউডার ছড়িয়ে দিল বেদজ্যোতি। লস্যিতে কোকো? প্রথমে নাক সিঁটকালেও, শেষ হয়ে যাবার পর হেব্বি দুঃখ হচ্ছিল। গেলাম ও কাগজের গ্লাস হাতে যদি আরো খানেক পাওয়া যায়, দেখি বালতি উল্টে খেয়ে নিয়েছে ব্যাটারা। 


সন্ধ্যা গাঢ় হবার সাথে সাথেই বিভিন্ন ব্লক থেকে একে একে এসে উপস্থিত হতে লাগল ইন্সপেক্টর - CKCO রা।  এসে গেলেন আমাদের বড় সাহেবও। ততক্ষণে পোশাক বদলে ফেলেছেন হক বাবু। স্যারকে দেখে বিগলিত হয়ে বললেন, " স্যার আপনি আসায় আমি যে কি খুশি হয়েছি -"। খুশি আমরাও, এবার প্রতীক্ষা সেই মাহেন্দ্রক্ষণের, কখন রোজা ভাববেন হক বাবু। তার আগে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করবেন হক বাবু। সেই প্রার্থনায় যেমন থাকবে ওনার পরিবার - প্রিয়জন, তেমনি থাকবে এই আপিস আর আপিসের লোকজনও। থাকবে এই পোড়া দেশও। আহা বড় জ্বালা এই দেশের, পদে পদে বৈচিত্র্য। এত রকম বিবিধতা নিয়ে পথ চলা কি মুখের কথা। তাও যে টিকে আছে, সে কেবল আমাদের দেশ বলেই না। বড় উর্বর এই দেশের মাটি, আবাদ করলেই সোনা ফলে। তার সুযোগ নিয়েই ঘৃণা চাষ করতে নেমেছে একদল মানুষ, যাদের কেউ স্বদেশী, কেউ বা বিদেশী। ওরা জানে না, ওরা বোঝে না, ঘৃণার চাষ আগেও করার চেষ্টা করেছিল যেন কারা। গাল ভরা নাম দিয়েছিল, " divide and rule",  তখন তাদের সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না, আজ সে সাম্রাজ্য খুঁজতে অনুবীক্ষণ যন্ত্র লাগে।

অনির ডাইরি ৮ই এপ্রিল, ২০২৪

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 



মিটিংয়ের মাঝে হঠাৎ তেনার ফোন,একরাশ উত্তেজনা গিলে তিনি কইলেন,‘ হ্যালো মা! ব্যস্ত আছ?“ কাজের কথা শেষ হয়ে গেছে একটু আগেই, এখন আসন্ন নির্বাচন নিয়ে উত্তপ্ত বাদানুবাদ চলছে, সেটাই গোগ্রাসে গিলছিলাম। তবু মেয়ের ফোন বলে কথা, আর তিনি তো সচরাচর আপিস টাইমে ফোন করেন না। নির্ঘাত গুরুতর কিছু, তাই বললাম,‘ তেমন না। বল-। ’


প্রায় লাফাতে লাফাতে তিনি বললেন,‘জানো আমার ঘরে সাপ ঢুকেছিল!’ শুনে এমন ‘অ্যাঁ’ বলে চিৎকার করলাম আমি, সম্মুখের যুযুধান সব পক্ষ সাময়িক ভাবে ঘাবড়ে চুপ করে গেল। শ্রীমতী তুত্তুরী অবশ্য সরব রইলেন,‘ হ্যাঁ গো মা। আমি স্কুল থেকে ফিরে পোশাক বদলাব বলে জানলা বন্ধ করতে গেছি, দেখি বাইরে থেকে একটা তার ভিতরে ঢুকে ঝুলছে। আমি চিৎকার করে মাসিকে জিজ্ঞাসা করলাম, জানলায় কোন কাজ হয়েছে কিনা। মাসি তখন আমার জন্য ঘোল বানাচ্ছিল, শুনতে পেল না বোধহয়। ভাবলাম তারটাকে জানলা দিয়ে বাইরে বার করে দি। ওমা যেই হাত দিতে গেছি অমনি চিড়িক করে জিভ বার করেছে। আমি তো সঙ্গে সঙ্গে বাবা গো বলে এক লাফ -।”


 এই অবধি শুনে আমার হৃদপিণ্ডটাই প্রায় গলার কাছে উঠে এল বুঝি। কন্যা যথারীতি অদম্য, তিনি বলে চলেন,‘ আমার চিৎকার শুনে মাসি আর শঙ্কর কাকু( কেয়ারটেকার) দৌড়ে এল। ওরা কত খটখট, হ্যাটহ্যাট,ভাগভাগ করল সে ব্যাটা আর নড়েই না। শেষে বাবাকে ফোন করলাম। বাবা বলল, ‘একটু অপেক্ষা করে দেখ, নিজেই সটকে পড়বে।’ আরও পনেরো বিশ মিনিট ধরে সম্মিলিত চিৎকারেও যখন কিছু হল না। তখন বাবাকে বললাম এবার কি একটু বন দপ্তরকে খবর দেবে? মিনিট দশেকের মধ্যেই ওণারা এলেন এই এত্তবড় সাঁড়াশির মত একটা যন্ত্র নিয়ে আর ওটাকে ধরে নিয়ে চলে গেল।’ 


ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল, বললাম,‘ যাক শান্তি।’ মেয়েটা যে ঐ পরিস্থিতিতেও মাথা ঠাণ্ডা রেখে সর্প কাণ্ড সামলাতে পেরেছে তার জন্য অভিনন্দন জানাতে গেলাম, তিনি দুঃখী দুঃখী স্বরে বললেন,‘ কিন্তু আমার জন্য ও বাস্তুচ্যুত  হল মমি -’।