অনির ডাইরি ২৯শে জুন, ২০২৪
#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা
পাঁজা পাঁজা ডেথ কেস নিয়ে বসেছে মুকুল। নির্বাচনী আদর্শ আচরণবিধির গুঁতোয় চার মাস কিছু ছাড়তে পারিনি আমরা। এবার কাজ গুটানোর পালা। সত্যি কথা বলতে কি, এই কাজটা করতে আমার একটুও ভালো লাগে না। প্রতিনিয়ত এত মানুষ মরে কেন? আমি একটা প্যাটার্ন দেখেছি, অধিকাংশ ডেথ কেসেই মৃতের বয়স হয় ৪২/৪৪ নয় ৫৭/৫৯। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, কিন্তু উপরিউক্ত চারটি বয়স যেন বড় ভয়াবহ। দুর্ঘটনা জনিত মৃত্যুর অবশ্য কোন বয়স নেই। একটু আগেই একটা ২৬ বছরের ছেলের কেস ছাড়লাম। নাইতে নেমে ডুবে মৃত্যু।
স্বাভাবিক মৃত্যুতে ৫০ হাজার, দুর্ঘটনা জনিত মৃত্যুতে ২ লাখ ছাড়তে হয়। এত টাকার ব্যাপার, বিভিন্ন ধাপে খুঁটিয়ে দেখতে হয় সব। ছেলেটির ক্ষেত্রেও দেখতে হল। পুলিশ কি রিপোর্ট দিয়েছে, খুন টুন নয়তো? পেটে মদ পাওয়া যায়নি তো? অন্যান্য জীবন বীমার মত এখানেও আত্মহত্যা করলে অনুদান মেলে না। মেলে না মদ খেয়ে রেষারেষি করে মারা গেলে বা কোন দাঙ্গা হাঙ্গামায় প্রাণ হারালে। মস্ত পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট খুলে খুঁটিয়ে পড়ি, মুকুল আর আমি। ডাক্তারি পরিভাষা অধিকাংশই বোধগম্য হয় না। ভাগ্যে গুগল আছে। একটু আগেই তো একটা ডেথ কেস পেয়েছিলাম, যাতে কজ অব ডেথ ডাক্তার বাবু লিখেছেন AMI।
লেঃ মুকুল আর লেঃ আমি, AMI মানে কি রে বাবা? ভাগ্যে গুগল বলল Acute myocardial infarction। এই শব্দ বন্ধ আমাদের পরিচিত। ডাক্তার বাবুর পরিচয় পড়তে গিয়ে দেখি, তিনি এমবিবিএস। মুকুলকে বলি, বুঝলে মুকুল, এলোপ্যাথি ডাক্তার, তাই এমন ভাবে লিখেছেন।
হাসপাতালে মৃত্যু ছাড়া, এলোপ্যাথি ডাক্তার বাবুদের ডেথ সার্টিফিকেট আমরা পাই কোথায়? অধিকাংশই বিএসসি, ডিএমএস। অর্থাৎ হোমিওপ্যাথ ডাক্তার বাবু। মাঝে মধ্যে দুয়েক জন আয়ুর্বেদিক ডাক্তার বাবুও পেয়ে যাই আমরা। এনাদের সকলেই কমবেশী লেখেন কার্ডিও রেসপিরেটরি ফেলিওর বা সিভিএ।কেউ কেউ স্ট্রোক ও লেখেন। স্ট্রোকটাই যে CVA এটা বুঝতে আমার বেশ কিছু দিন সময় লেগেছিল। রেনাল ফেলিওর ও পাই। মেয়েদের ক্ষেত্রে ব্রেস্ট ক্যান্সার বা জরায়ু মুখ ক্যান্সার।
কিছু দিন আগে এমনি একটি মেয়ের ডেথ কেস এসেছিল, খুবই অল্প বয়স। চেক করতে সময় লাগছিল বলে বরটি মাঝে মধ্যেই বন্ধু বান্ধব জুটিয়ে হম্বিতম্বি করে যেত ব্লক অফিসে এসে। একদিন তো ইন্সপেক্টর সাহেবকে বলেই ফেলল, টাকাটা পেলে নতুন করে বিয়ে করে। আমাদের গাফিলতিতে ছেলেটির ঘর বসছে না। ধমকিত, চমকিত হয়ে মুখ লাল করে আমার ঘরে এসে বসেছিল ইন্সপেক্টর সাহেব। ঘড়িতে বোধহয় চারটে বাজছিল, শীতের বেলা, সূর্যি মামা পাটে বসছিলেন, দুজনে নীরবে পোর্টাল খুলে মেয়েটির পাশবইয়ের ছবিটা দেখছিলাম। অল্প বয়সী হাসিখুশি একটা মেয়ে - একবার হারিয়ে গেলে কেউ মনে রাখে না। কিচ্ছু মনে রাখে না।
আর একটি কেস পেয়েছিলাম জলে ডুবে মৃত্যু। সংশ্লিষ্ট ইন্সপেক্টর সাহেব কিছুতেই ছাড়ছিলেন না কেসটা। বেশ কিছুদিন আটকে রেখে খুঁটিয়ে সব দেখছিলেন, নানা নথি আনতে বলছিলেন। পঞ্চায়েত প্রধানকে নিয়ে মেয়েটির বর আর শ্বশুর মশাই এসেছিলেন আমার কাছে। শত অনুরোধেও নাক গলাইনি আমি। বলেছিলাম আটকে যখন রেখেছে নিশ্চই কোন কারণ আছে। আমার ইন্সপেক্টরদের নাক বড় তীক্ষ্ণ। কিভাবে যে এরা ঘাপলার গন্ধ পায়। কিছুদিন আগে বেদজ্যোতি যেমন দুটি নির্ভেজাল সুন্দর আধার কার্ডকে জাল বলে পাকড়াও করেছিল। আমার সামনে যখন প্রমাণ সমেত নিয়ে এল কাগজ গুলো, আমি হতবাক। এরা তো আসলকে হার মানায় রে ভাই। এত প্রতিভা লোকগুলো রাখে কোথায়। আমার বিশ্বাস আর ইন্সপেক্টর সাহেবের সন্দেহকে সত্য প্রমাণ করে,ধরা পড়ে, মেয়েটি জলে ডুবে মারা যায়নি। মেরে জলে ফেলে দেওয়া হয়।
এতদিন ধরে এই কাজ করছি, তাও কেন যে এত মন খারাপ হয় কাজটা করতে। আজ যেন দুর্ঘটনা জনিত মৃত্যুরই দিন, পরপর দুটি ছেলের কেস এল, পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু। একই জায়গায়। দুটি দুর্ঘটনাই আমাদের আপিসের স্বল্প দূরে রামতারকে ঘটেছে। একজন রাত ১০টা ৫ এ হেঁটে বাড়ি ফিরছিল,অন্য জন সকাল ১১টা নাগাদ বাস ধরবে বলে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিল। দুজনকেই মোটর সাইকেল ধাক্কা মেরে চলে যায়। দুজনেরই স্ত্রী আবেদন করেছে। সুন্দর হাতে লেখা বা টাইপ করা চিঠি, স্বামীর মৃত্যুতে শোকাহত স্ত্রী কেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আবেদন করতে পারেনি। তলায় সদ্য স্বাক্ষরের মত ইঁকড়িবিকড়ি করে নাম সই করেছে হতভাগ্য স্ত্রীরা।
পেটের দায়ে কি যে জঘন্য কাজ করি। এত মন খারাপ হয়ে যায় এই কাজটা করতে। কিছুদিন আগে আমার এক বেবি ইন্সপেক্টর বলছিল, " আপনি শুধু পোর্টালে দেখে মন কষ্টে ভোগেন, আমাদের অবস্থাটা ভাবুন একবার ম্যাডাম। আমাদের এই কেসগুলোর এনকোয়ারি করতে হয় প্রত্যক্ষ ভাবে। কিছুদিন আগে এক ভদ্রমহিলা এসেছিলেন তাঁর ছেলের মৃত্যুর কেস ফাইল করতে,এত কাঁদছিলেন, এমন ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলেন ম্যাডাম, যে বিশ্বাস করুন মনে হচ্ছিল আমি অফিস ছেড়ে কোথাও পালিয়ে যাই।"
আজ অবশ্য একটানা ডেথ কেস ছাড়তে পারছি না আমরা। মাঝে মাঝেই এসে হামলা করছেন বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা।সপ্তাহ দুয়েক ছুটি নিয়েছিলাম কিনা। প্রথমে ঢুকলেন শাসক দলের শ্রমিক সংগঠনের এক নেতা। কম্পিউটারের দিকে তাকিয়েই বললাম, বলুন অমুক বাবু,কি সমস্যা? তিনি যুৎ করে বসে বললেন, " আগে বলুন ভালো আছেন? স্যার (অর্থাৎ শৌভিক) ভালো আছেন? বেবি (অর্থাৎ শ্রীমতী তুত্তুরী) ভালো আছে?" দায়সারা ভাবে জবাব দেবার পর প্রশ্নবাণ ভেসে এল, " বাবা মা? শ্বশুর শাশুড়ি?" এতক্ষণ ধরে হুঁ হুঁ করে জবাব দিতে থাকা আমি, এবার চেয়ার সমেত ঘুরে বসি। " ধুৎ শ্বশুর মশাই মারা গেছেন জানেন না?"
চেয়ার থেকে প্রায় হড়কে পড়েন ভদ্রলোক, "অ্যাঁ! ওমা সেকি? কবে? কেন? কিভাবে? হায় হায় স্যার পিতৃহীন হয়ে গেলেন গো।" কাজ থামিয়ে আবার ঘুরে বসি ওনার দিকে, মুকুল এক মনে ডেথ কেসের পাতা উল্টাচ্ছে, মুখ লাল, হয়তো গরমে। সেদিকে আঙুল দেখিয়ে বলি, দেখছেন আপনাদের ব্লকের ইন্সপেক্টর সাহেব কেমন রাগে আগুন হয়ে যাচ্ছেন? ডেথ কেস না ছেড়ে শ্বশুর মশাইয়ের কথা বলার এটা কি সময় বলুন তো?" ভদ্রলোক থতমত খেয়ে গেলেন। পরিস্থিতি সামলাতে লঘু গলায় বলি, " আপনি আমার সাথে খোশ গল্প করতে এয়েছেন নাকি কোন কাজ নিয়ে এসেছেন? সেটা তো বলুন।"
ভদ্রলোক যখন কাজের কথা তোলেন, বুঝতে পারি, কথায় দম আছে। সমস্যাটা ঠিকই ধরেছেন। সৌরভকে ডেকে পাঠাই, সবাই মিলে আলোচনা করে,মহানগরে ফোন করি। সদর আপিসের শীলমোহর অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সে মৌখিক হলেও চলবে। শীলমোহর পেয়েছি কি পাইনি, দরজা খুলে মুখ গলায় চঞ্চল।" ম্যাডাম অমুক ট্রেড ইউনিয়নের অমুক বাবু, তমুক ট্রেড ইউনিয়নের তমুক বাবু, ওদের কার্তিক বাবু, এদের গৌর বাবু সবাই আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন। ওনারা বলছেন একসাথে ঢুকতে দিলেও চলবে।"
হেসে ফেলি সজোরে। চেম্বারে বসে থাকা শাসক দলের নেতাটির দিকে তাকিয়ে বলি, " দেখছেন তো, এতক্ষণ আমার ঘরে থাকলে কি হয়। অন্য ট্রেড ইউনিয়ন গুলো ভেবে নেয় সব সুবিধে বুঝি আমি আপনাকেই দিয়ে দিলাম।" দল বেঁধে ঘরে ঢোকা বর্ষীয়ান শ্রমিক নেতারা সমস্বরে প্রতিবাদ জানান, "না ম্যাডাম। আমাদের মধ্যে ওমন কোন ব্যাপার নেই। আপনি কথা বলছেন দেখে আমরা ভাবলাম, আমাদের কথা গুলোও যদি এট্টু শোনেন।" শাসক দলের নেতাটিও সহমত প্রকাশ করেন।
আজব আপিস মাইরি আমার। এই আপিসে যাঁরা আসেন, রাজনৈতিক বৈরিতার আলখাল্লা যেন বাইরে খুলে আসেন। জনৈক বামপন্থী সংগঠনের নেতার পিছনে লাগি আমি, " আপনি যে বলেছিলেন বাংলা এবার লালে লাল হবে, তার কি হইল? ধুৎ মা লক্ষ্মীদের ওপর দোষ দিবেননি তো।" অপর নেতাকে কিছুদিন আগে চন্দ্রবোড়া সাপে কেটেছিল। তাঁর কুশল সংবাদ নিই আমি। ডেপুটেশন দেবার আগেই পরিস্থিতিকে ঘরোয়া বানিয়ে ফেলি আমি। এত বছর ল্যাবার গিরির কিছু তো সুফল আছে রে বাবা।
মিনিট দশেকের মধ্যে সবাইকে বিদায় জানিয়ে পুনরায় ডেথ কেসে ফিরি আমি। আবার সেই মনখারাপ করা কাজ। প্রথম কেসটার ওপর মাউস রাখার আগেই ঘরে ঢুকে আসে সৌরভ আর নন্দন। সঙ্গে এক প্রৌঢ়। " ম্যাডাম এনার সদ্য পেনশন চালু হয়েছে। তেরো জনের নতুন পেনশন কেস কলকাতা অ্যাপ্রুভ করে পাঠিয়েছে আজ। ইনি তাঁদের অন্যতম। এনার আরো একটা পরিচয় আছে, ইনি ডিএম আপিসে জনৈক সাহেবের গাড়ি চালান। আমরা চাইছিলাম, আপনার হাত দিয়ে ওনার PPO (Pension Payment Order) টি দিতে।"
লাফিয়ে উঠি আমি, অভিনন্দন জানাই আমি। পোজ দিয়ে ছবি তুলি আমি, ভদ্রলোককে আগামী দিনগুলির জন্য অনেক শুভেচ্ছা জানাই আমি, তারপর খেয়াল হয়, " এই সৌরভ, এই নন্দন তোমরা আমার ছবি তুললে কেন? কাজ তো সব তোমরা করেছ বাবা। আর করেছে মহানগরে পরিবহন শ্রমিকদের বোর্ড। আমি কে? নিছক একটা দুটো সই আর ছবিটার গ্ল্যামার কসেন্ট বাড়ানো ছাড়া কি করেছি আমি?"
হিমভূমি থেকে অনির ডাইরি,২০শে জুন, ২০২৪
(পর্ব - ২)
#অনিরডাইরি
লাদাখ ভ্রমণের কথা ভাবলেই প্রথম যেটা মাথায় আসে, তা হল শ্বাসকষ্ট হবে না তো? শ্বাস কষ্ট হওয়াটাই তো স্বাভাবিক, আমরা বাঙালি, মোটামুটি সমুদ্র সমতলের বাসিন্দা, প্রতি প্রশ্বাসে ১০০% অক্সিজেন অণু নিতে অভ্যস্ত। শ্রীনগর বা মানালিতে সেটা কমে হয় ৭৮-৮৩ শতাংশ। খুব শ্বাসকষ্ট বা COPD তে ভোগা মানুষ ছাড়া, ওইটুকু তফাৎ আমরা বুঝতেও পারি না। লেহ তে কিন্তু ওটাই নেমে দাঁড়ায় ৬৫% এ। অর্থাৎ আপনি শ্বাস তো নিচ্ছেন, কিন্তু অক্সিজেন পাচ্ছেন অর্ধেকের একটু বেশি। কেউ যদি সটান ১০০ থেকে ৬৫ তে এসে হাজির হন, তাঁর ফুসফুস এই ফারাকটা মেটাতে অক্ষম হয়। তখনই শুরু হয় শ্বাস কষ্ট।
সবার যে হয় তাও নয়, তবুও বর্তমানে সরকার নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন যে আপনি যদি বিমান পথে সটান লেহতে এসে নামেন আপনাকে অন্তত দুদিন লেহতেই থাকতে হবে। আমরা সড়ক পথে শ্রীনগর থেকে এসেছি, পথে কার্গিল এ একরাত কাটিয়েছি, তাও শৌভিক তিন রাত দুদিন বরাদ্দ করেছিল লেহ এর জন্য।
লেহ এর প্রকৃতি এতটাই সুন্দর যে আপনি সত্যিই হোটেলে বসে জানলা দিয়ে নীল আকাশ আর দূরের তুষার আবৃত পর্বত চূড়া দেখেই দিন কাটিয়ে দিতে পারেন। আকাশ যে কি অসম্ভব নীল এখানে বলে বোঝাতে পারব না। খালি চোখে অনেক অনেক দূর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পাবেন। এখানে রাত আটটা অবধি ঝকঝকে দিনের আলো থাকে। আবার ভোর পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার মধ্যে আলো ফুটে যায়। দূরের পাহাড় চূড়ায় ঝিলিক মারে রোদ। রাতে টলটলে আকাশে সোনার থালার মত চাঁদ ওঠে , ঝাঁপিয়ে পড়ে জোছনা।
সবাই লাদাখের শ্বাস কষ্ট নিয়ে সাবধান করে, ঠাণ্ডা নিয়ে সতর্ক করে, কিন্তু কেউ লাদাখের আলোর কথা বলে না। বাপরে কি চড়া আলো, লেহ তে প্রবেশ করার সাথে সাথে সানস্ক্রিন আর রোদ চশমা বাধ্যতামূলক। রোদ চশমার সাধ্য কি বশ মানায় এই আলোকে। চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়ে।
স্থানীয় লোকজন, হোটেল কর্মচারী, ভাড়া গাড়ির ড্রাইভার সবাই আপনাকে সচেতন করতে থাকবে। অন্তত আমাদের তো করেছে, বলেছে জল খেতে থাকুন। এখানে তেষ্টা পায় না, তবুও কিছু ক্ষণ ছাড়া ছাড়া জল খান। হাইড্রেটেড থাকা ভীষণ জরুরী। বলেছে মাথায় পারলে ঘোমটার মত স্কার্ফ জড়ান, ফুল হাতা জামা কাপড় পরুন, শরীরের উন্মুক্ত অংশে দু আড়াই ঘণ্টা ছাড়া ছাড়া সানস্ক্রিন লাগান। এখানে রোদে আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মির পরিমাণ সাংঘাতিক বেশি। স্থানীয়দের কিছু হয় না, কিন্তু আমাদের শহুরে আদুরে ত্বক পুড়িয়ে ফোস্কা ফেলে দিতে পারে।
প্রকৃতি ছাড়া লেহতে দেখার মত বলতে, আছে বেশ অনেক গুলি বৌদ্ধবিহার যেমন অলচি, শে, স্ফীটুক, ফেয়াং, হেমিস, থিকসে, লিকির ইত্যাদি। আর আছে কিছু রাজপ্রাসাদ যেমন লেহ প্যালেস, স্টোক প্যালেস, জোরাবর ফোর্ট ইত্যাদি, আছে সিন্ধু নদ, আছে নিম্মু যেখানে মিলিত হয়েছে সিন্ধু আর যাস্কার নদী।
এখানকার বৌদ্ধ বিহার গুলি অধিকাংশই প্রাচীন,নির্মাণ কাল পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতক। প্রায় প্রতিটি বিহারের প্রার্থনা গৃহে আঁকা রয়েছে চোখ জুড়ানো সব ছবি। ছবি গুলির বয়স বিহারের বয়সের সমানই প্রায়। অধিকাংশ বিহারেই ছবি তোলা নিষেধ। অলচিতে তো ক্যামেরা এমনকি মোবাইল নিয়েও প্রবেশ নিষিদ্ধ। লকারে রেখে যেতে হয়। যেখানে অনুমতি মেলে, সেখানেও প্রায়ান্ধকার প্রার্থনা গৃহে টিমটিমে আলোয় ছবি তুলতে হয়।
প্রভু অবলোকিতেশ্বরের ছবিটি তেমনিই ভাবে তোলা। অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্বের এক রূপ,যাঁর এগারোটা মুখ এবং সহস্র বাহু। তথাগত বুদ্ধ চলে গেছেন, মৈত্রেয় বুদ্ধ এখনও আসেননি, এই মুহূর্তে জগৎ ও জীবনের ভার বহন করে চলেছেন অবলোকিতেশ্বর। এগারোটা মাথার মধ্যে দশটা মাথা দিয়ে তিনি দশ দিকে নজর রেখে চলেছেন আর হাজার হাত দিয়ে ভক্তদের রক্ষা করে চলেছেন। কথিত আছে, ভুবনের ভার গ্রহণ করার পর ভক্তদের দুর্দশা দেখে অবলোকিতেশ্বরের মস্তক বিদীর্ণ হয়ে যায়। তাঁর মাথা ফেটে এগারো টুকরো হয়ে যায়। তখন অমিতাভ বুদ্ধ সেই এগারোটি টুকরোর প্রতিটি থেকে একটি করে মুখ বানিয়ে দেন। যাতে সব দিকে সমান ভাবে নজর রাখতে পারেন অবলোকিতেশ্বর। সাথে সাথে দেন সহস্র বাহু, যাতে হাজার হাতে ভক্তদের রক্ষা করতে পারেন অবলোকিতেশ্বর 🙏।
হিমভূমি থেকে অনির ডাইরি ১৮ই জুন, ২০২৪
#অনিরডাইরি
লাদাখের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর কার্গিল। শ্রীনগর থেকে যোজিলা পাস ধরে কার্গিল পৌঁছাতে গুগল ম্যাপ বলে সময় লাগবে ঘণ্টা পাঁচেকের আশেপাশে। পথে বাধ্যতামূকভাবে সোনমার্গে থামে গাড়ি, জিরো পয়েন্টে থামে গাড়ি। আপনি যেখানে চাইবেন সেখানেই থামে গাড়ি। আর থামে দ্রাসে।
কার্গিল থেকে ৬৩ কিলোমিটার দূরে, দ্রাস একটি আপাত শান্ত, চোখ জুড়ানো সবুজ পাহাড় দিয়ে ঘেরা উপত্যকা। চকচকে ন্যাশনাল হাইওয়ের একদিকে রয়েছে হাতে গোনা কয়েকটা ঝুপড়ি টাইপের দোকান, এক ডজন পর্যটক হঠাৎ এসে হাজির হলেই উপচে পড়ে দোকান গুলো। খাবার বলতে চা, কফি, মোমো, চাউমিন, ম্যাগি। ভাত ও পাবেন, পাঞ্জাব তথা উত্তর ভারতের রীতি অনুসারে রাজমা চাওল, দহি চাওল ইত্যাদি। চানা বাটোরাও খাচ্ছিল বটে লোকজন।
এই পুঁচকে দোকানগুলোর উল্টো দিকে, রাজপথের অপর পারে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত গোলাপী বালি পাথরের এক স্মৃতি সৌধ, পোশাকী নাম, কার্গিল ওয়ার মেমোরিয়াল। ওখানে ঘুমিয়ে আছেন কার্গিল যুদ্ধের বীর সেনানী বৃন্দ। প্রবেশ অবাধ, তবে ঢুকতে গেলে ভারতীয়ত্বের প্রমাণ দেখানো আবশ্যিক। বিশাল গোলাপী তোরণ এর সামনে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল হাতে, মাথায় হেলমেট, চোখে কালো চশমা পরে দাঁড়িয়ে আছে জনা কয়েক সিপাহী। তাঁদের একজনকে প্রত্যেকের আধার কার্ড দেখাতে হয়, তবে মেলে প্রবেশের অনুমতি। প্রবেশের পূর্বে অপর জন বিস্তারিত ভাবে বলে দেন এই স্মৃতি সৌধের মাহাত্ম্য।
সেপ্টেম্বর থেকে প্রবল ঠাণ্ডায় দুর্গম হয়ে পড়ে এই সব এলাকা। বরফের পুরু চাদরে ঢেকে যায় চরাচর। ঠাণ্ডার দাপট থেকে বাঁচতে এই সময় ভারতীয় এবং পাকিস্তানি আর্মি করত কি, দুর্গম কিছু পোস্ট ফাঁকা রেখে নেমে যেত নীচের আবাস যোগ্য ছাউনি গুলিতে। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলেই উভয়ে পুনরায় দখল করে নিত যার যার ছাউনি। সবটাই বিশ্বাস আর ভরসার ব্যাপার। তবুও এটাই হয়ে আসছিল আবহমান কাল ধরে।
কিন্তু ওই যে বলে না, যুদ্ধে অনৈতিক কিছুই নাই। ১৯৯৯ সালে শীতের দাপট কমতে যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী দখল করতে গেল তাদের ফেলে আসা ছাউনি, দেখা গেল বিস্তৃর্ণ এলাকা ততোদিনে দখল করে বসে আছে পাকিস্তান আর্মি। দ্রাস, কার্গিল, বাটালিক, টুরটুক ইত্যাদি ততোদিনে পাকিস্তানের দখলে। কৌশলগত ভাবে প্রতিটা পোস্ট এমন ভাবে বানানো,যে বাইরে বা নীচে থেকে তার দখল নেওয়া যতটা কঠিন। আকাশ পথে বিমান হানা করেও তাদের হঠানো সহজ নয়।আর অনুপ্রবেশকারীরাও তো খালি হাতে আসেনি, এনেছে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, কামান, রকেট লঞ্চার আরো কত কি। দস্তুর মত তৈরি হয়েই এসেছে ওরা।
মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে চূড়ান্ত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে কিভাবে দখলীকৃত এলাকা পুনর্দখল করে ভারত, ছত্রে ছত্রে তাই বর্ণিত রয়েছে স্মৃতি সৌধের প্রতিটি ইঞ্চি জুড়ে। একসাথে তিনটি অপারেশন শুরু হয়, বায়ু পথে ভারতীয় বায়ুসেনার অপারেশন সফেদ সাগর। মাত্র তিন মাসের মধ্যে পাক্কা ৫০০০ বার বিমান হানা দেয় ভারতীয় বায়ুসেনারা। লক্ষ্য ছিল গর্তে লুকিয়ে থাকা শত্রুকে খুঁচিয়ে বার করে আনা। জলপথে ভারতীয় নৌবাহিনী শুরু করে অপারেশন তলোয়ার। জলপথে পাকিস্তানের সাপ্লাই চেন কেটে দেয় ভারতীয় নেভি। এবার লড়াই মাটির ওপর। এবার পালা সম্মুখ সমরের। শুরু হয় ভারতীয় সৈন্য বাহিনীর অপারেশন বিজয়। যাতে শহীদ হন ৫৪৫ জন বীর সেনানী। যাঁদের একজনের জীবনী নিয়েই সম্প্রতি তৈরি হয়েছে সুপার হিট ফিল্ম শেরশাহ। আজ্ঞে হ্যাঁ, পরম বীর চক্র বিজেতা ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা।
মুখ্য তোরণ থেকে বাঁধানো রাস্তা সোজা চলে গেছে দূরে প্রায় ১০০ফুট উঁচু ভারতীয় পতাকার দিকে। পথের দুদিকে কালো পাথরের সমাধি রয়েছে ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা সহ অন্যান্য সেনানায়ক বৃন্দের। রাখা আছে বফর্স কামান। যা কেনা নিয়ে দুর্নীতি বিতর্ক টলিয়ে দিয়েছিল তৎকালীন সরকারের গদি আবার কার্গিল যুদ্ধে যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর মূল ভরসা।
সুউচ্চ পতাকাটির ডান দিকে ক্যাপ্টেন মনোজ পাণ্ডে মিউজিয়াম আর বাম দিকে যুদ্ধে নিহত সৈন্যদের সমাধি ফলক। মিউজিয়াম ভর্তি সেদিনের ছবি। যুদ্ধে জেতার পর হাসি মুখে আসল বীরেরা, যুদ্ধে শহীদ বীরেরা, যুদ্ধে মৃত শত্রু পক্ষ, যুদ্ধে অস্ত্র সমর্পণ করা শত্রু। আর রাখা আছে শয়ে শয়ে গুলি, রাইফেল, পিস্তল, বন্দুক ইত্যাদি। যা উদ্ধার হয়েছিল শত্রুর কাছ থেকে। উদ্ধার হয়েছিল পাকিস্তানের সবুজ পতাকাও, যা আজও টাঙানো আছে এই মিউজিয়ামে, তবে উল্টো করে।
অনির ডাইরি ১৪ই জুন, ২০২৪
#অনিরডাইরি
অবশেষে "লাপাতা লেডিজ" দেখলাম। দেখতে দেখতে দেখতে আর পাঁচজন সোহাগী বউয়ের মত আমারও মনে এই প্রশ্ন জাগছিল, আচ্ছা সত্যিই যদি আমি কোনদিন হারিয়ে যাই, আমার বর ও কি -। থাকতে না পেরে প্রশ্নটা করেই ফেললাম, " হ্যাঁ গো, আমি যদি কোনদিন হারিয়ে -"। নাহ শেষ করিনি প্রশ্নটা। কারণ মাঝপথে মনে পড়ে গেল, সত্যিই তো হারিয়ে গিয়েছিলাম আমি।
সে অনেক কাল আগের কথা। বাংলা তখনও লাল। আর জঙ্গলমহল একটু বেশি লাল। রাজনৈতিক পরিবর্তন মধ্যবিত্তের বিলাসী স্বপ্ন মাত্র। আমি সহ শ্রম কমিশনার হিসেবে খড়্গপুরে কর্মরত। আট নমাস হল বিয়ে হয়েছে। মেদিনীপুর অফিস তখনও তৈরি হয়নি। ১৫টি ব্লক আর ২টি মিউনিসিপ্যালিটি, অথচ মাত্র ৪ জন ইন্সপেক্টর। প্রত্যেকেরই আয়ু কয়েক মাস মাত্র। যুবা ইন্সপেক্টর বা কম্প্যুটর জানা ক্লার্ক তখন কল্পনারও অতীত । মাসে মাত্র দশ দিনের গাড়ি। ফলে অনেক হিসাব করে চলতে হত।
খড়্গপুর আইআইটি তখন ঠিকা শ্রমিক অসন্তোষে জর্জরিত । প্রায়ই ত্রিপাক্ষিক মিটিং ডাকতে হত মহকুমা শাসকের চেম্বারে। যদিও এটা আমাদের এক্তিয়ার ভুক্ত ছিল না, কিন্তু বারংবার অনুরোধ করলেও কেন্দ্রীয় সরকারী লেবার এনফোর্সমেন্ট অফিসারের দেখা পাওয়া যেত না। শ্রমিক সংগঠন গুলি এমনিই জঙ্গী ছিল যে এই মিটিং মানেই গণ্ডগোল অনিবার্য। তৎকালীন মহকুমা শাসকের প্রবল ব্যক্তিত্বের ভয়ে শুধু হাতাহাতিটুকু হত না।
সেদিনের মিটিং শেষ হতে হতে সন্ধ্যা ৬টা। ডিসেম্বর মাস, তেমনি জমিয়ে পড়েছে শীত। শৌভিক তখন বিডিও খড়্গপুর-২। খড়্গপুরের মাত্র দুটো স্টেশন পর মাদপুর নামক গ্রামে আমাদের লালনীল সংসার । আমার ফিরতে দেরী হলে প্রায় দিনই ও ছুঁতোনাতা করে এসডিও অফিসে এসে হাজির হত। সেদিনও মিটিং শেষে ফোন করলাম, যদি আনতে আসে। দুর্ভাগ্যবশত সেদিনই কি যেন কাজে আটকে গিয়েছিল শৌভিক, ফলে ট্রেন ছাড়া গতি নেই।
খড়্গপুর এসডিও অফিস থেকে রেল স্টেশন ছিল হেঁটে আড়াই মিনিট । ৫টা৪৫ এ একটা টাটা লোকাল ছিল, যেটা কখনই সময়ে আসত না। ফলে আশা ছিল পেয়েই যাব। স্টেশনে পৌছে দেখি থিকথিক করছে লোক। বহু ট্রেন বাতিল। তখন জঙ্গলমহল দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন কোটেশ্বর রাও, ওরফে কিষণজী। যৌথ বাহিনী তখনও সক্রিয় নয়। ট্রেন বাতিল হওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। স্টেশনে পৌঁছে শুনি, আমার টাটা প্যাসেঞ্জারও বাতিল হয়েছে।
হ্যাংলার মত শৌভিককে আবার ফোন করলাম, যদি ম্যানেজ করে এসে নিয়ে যায় একটু। জবাব এল,“স্টেশনে অপেক্ষা কর। আসছি। ” তুত্তরীর আগমনের খবর সবে ঘোষিত হয়েছে। প্রাকমাতৃত্বকালীন ক্লান্তি হঠাৎ হঠাৎ আক্রমণ করত আমায়। সেদিনও এমনি আক্রমণে বেসামাল হয়ে স্টেশনের বেঞ্চে বসে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই,হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে শুনি টাটা প্যাসেঞ্জার আসছে।
তড়িঘড়ি শৌভিককে ফোন করে বারণ করি। ততক্ষণে ওর গাড়ি হাই রোডের কাছে এসে পড়েছিল। তাও আরো ১৮/১৯ কিলোমিটার তো বটেই। বরং মাদপুর ষ্টেশনে গাড়িটা থাকলে সুবিধা হয়। স্টেশন থেকে বিডিও কোয়ার্টার হাঁটা পথে মিনিট চার। কিন্ত পথটা বড় নির্জন, যার খানিকটা আবার বাঁশবনের মধ্যে দিয়ে যেতে হত। ভর সন্ধ্যে বেলা শ্রীমতী তুত্তুরীকে উদরে বহন করে ওই পথে যেতে গা শিরশির করত। মাথায় একটা লোহার কাঁটা বা চাবি গুঁজে যাতায়াত করতে বলত জেঠাইমা। যাতে ভূতে না ধরে আর কি।
শৌভিক আমার ফোন পেয়ে ফিরে গেল, যেতে যেতে আমাকে জানিয়ে গেল, স্টেশনে গাড়ি থাকবে।
ট্রেন ছাড়লো। বেশ ভিড়। কোন মতে এক টুকরো সিট্ পেলাম। শীতের ভয়ে জানলা বন্ধ। বাইরেও ঘুট্ঘুটে অন্ধকার । বেশ কিছুক্ষণ পর ট্রেন থামল। আন্দাজ করলাম জকপুর। পরের স্টেশনে নামব। আর মিনিট পাঁচ মাত্র। দরজার কাছে এগিয়ে যাব বলে উঠে পড়লাম। আমার সামনে দাঁড়ানো প্রৌঢ়কে ইঙ্গিত করলাম বসতে, উনি সৌজন্যবশতঃ রাজি হলেন না। বলতে বাধ্য হলাম, যে আমার গন্তব্য মাদপুর । বলা মাত্র কামরায় যেন বাজ পড়ল। “ মাদপুর? এটাতো মাদপুর যায় না। ” বলে সমস্বরে চিৎকার করে উঠলেন একাধিক ব্যক্তি ।
“মানে? এটা হাওড়া যাচ্ছে তো?” ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। উত্তর শুনে আতঙ্কের শীতল স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে। ট্রেনটা ঝাড়গ্রাম হয়ে টাটা যাচ্ছে। ঝাড়গ্রাম তখন প্রায় মুক্তাঞ্চল। খুনজখম রোজকার ঘটনা।
ট্রেন তখনও ছাড়েনি। দৌড়ে নামতে গেলাম, পারলাম না। জায়গাটার নাম নিমপুরা। রাতের নিমপুরা ছিল কয়লা মাফিয়াদের বিচরণভূমি। একলা মহিলা সহযাত্রীকে সেখানে কেউ নামতে দিতে রাজি না। দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে যা দেখলাম, আমারও সাহস হল না। কোন প্লাটফর্মের বালাই নেই। অন্ধকার রেলইয়ার্ড। সারি সারি মালগাড়ি শবদেহের মত নিশ্চুপ পড়ে আছে। অগত্যা সহযাত্রীদের উপদেশ শিরোধার্য।
হতাশ হয়ে পড়লাম। আমার কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে জনৈক মহিলা বললেন, “ আমি কলাইকুন্ডা নামব।তুমিও নেমো। বাড়ির লোককে বল কলাইকুন্ডা আসতে। ” বাড়ির লোককে আসতেই হবে, কারণ বাস ট্রেকারের গল্প ছেড়েই দিলাম,রাতে ফিরে যাবার কোন ট্রেন পর্যন্ত নেই।সবই কিষণজীর দয়া।
শৌভিককে ফোন করব কি, টাওয়ার শূন্য । কোনমতে কান্না সংবরণ করলাম। সৌভাগ্যবশত কলাইকুন্ডা আসার আগেই দুটি টাওয়ার পেলাম। রিং হতেই, শৌভিকের উদ্গ্রীব কন্ঠস্বর,“কোথায়? শৈবালদা (বিডিও সাহেবের ড্রাইভার) অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর খোঁজ নিয়ে জেনেছে ট্রেন ক্যানসেল। আমরা তোকে আনতে খড়্গপুর যাচ্ছি।” ঐ মুহূর্তে, প্রিয় কন্ঠস্বর শুনে আবেগে গলা বুজে আসল। কোনমতে সব বললাম। শুনে শৌভিক বলল,“সর্বনাশ । কলাইকুন্ডায় নেমে, নিজের পরিচয় দিয়ে স্টেশনমাষ্টারের ঘরে বস। আমি আসছি। ”
কলাইকুন্ডায় পৌছে চক্ষু চড়কগাছ। এ কোথায় এলাম? ট্রেন কি চক্রাকারে ঘুরে আবার নিমপুরায় ফিরে এল? সেই অন্ধকার রেলইয়ার্ড। সারি সারি মৃতমালগাড়ি । প্লাটফর্ম বা স্টেশনমাষ্টারের ঘর কই? ভ্যাবাচাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছি, বাকিরা নেমে অন্ধকারে হারিয়ে গেল। শুধু সেই মহিলা যাননি। অধৈর্য হয়ে বললেন, “নামো। ট্রেন ছেড়ে দিবে যে। ”
নামতে গিয়ে দেখি, সিঁড়ি শেষ হয়ে যাবার পরেও বেশ খানিকটা লাফাতে হবে। ফার্স্ট ট্রেইমস্টার সবে পেরিয়েছে, ডাক্তার বাবু বলেছেন, " মা এবং বেবি উভয়ের জন্যই এটা হ্যাপি পিরিয়ড"। আশা করি লাফালে কিছু হবে না, পরমেশ্বরের নাম নিয়ে ঝপাং করে লাফ দিলাম।
লাফ দিলেই বা কি, দুটি ট্রেনের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। কোন রাস্তা নেই। ভদ্রমহিলাকে অনুনয় করে বললাম, “যদি দয়া করে একটু স্টেশনমাষ্টারের ঘরটা দেখিয়ে দেন। ” উনি পাত্তা দিলেন না। বললেন ,“ ওখানে যেতে হবে নি। আমার সাথে এস। কে আসছে? বর? বল কলাইকুন্ডা বাজারে আসতে। হাইরোডের ওপর। আসতে সুবিধা হবে। ”
ফোন মৃত। টাওয়ার নেই। নিরুপায় হয়ে ওনাকে অনুসরণ করতে থাকলাম। তেলের ট্যাঙ্কারের তলা দিয়ে উবু হয়ে কোনমতে গলে, এপারে এসে দেখি, নিশ্ছিদ্র অন্ধকারময় চরাচর । অন্ধের মত মহিলার পিছু পিছু হাঁটছি। বুঝতে পারছি পিচ রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, দুদিকে বিশাল বিশাল মহীরুহের কঙ্কাল। হাঁটছি আর ভাবছি, কি কি হতে পারে এই মুহূর্তে আমার সঙ্গে। ভাবছি আমায় খুঁজতে এসে কি বিপদে পড়তে পারে আমার বর। ভাবছি আর কেঁপে উঠছি।
ভদ্রমহিলার কোন বিকার নেই, উনি নানা প্রশ্ন করতে করতে চলেছেন। আমি কি করি। বাপের বাড়ি কোথায়। বর কি করে। বর কিসে আনতে আসছে ইত্যাদি। মেপে উত্তর দিচ্ছি। বললাম শ্রম দপ্তরে কাজ করি। বর মাদপুর বিডিও অফিসে মালপত্র সরবরাহ করে। বিডিও সাহেব খুব ভাল। ওনার গাড়িটা দিয়েছেন নিয়ে যাবার জন্য। মিথ্যা বলতে খারাপ লাগছিল। কিন্তু নিরূপায় । প্রায় প্রতিদিন কোন না কোন পঞ্চায়েত প্রধানের গলাকাটা মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দু একজন শিক্ষক বা সরকারি কর্মচারীও থাকছেন মৃত্যুমিছিলে। সে যে কি অন্ধকার দিন।
বেশ কিছুটা হেটে হাইরোডে পড়লাম। অন্ধকার কিছুটা ফ্যাকাশে । কয়েকটা ফাঁকা চালা দেখে বুঝতে পারলাম বাজারে এসেছি। বাজার কোথায়, এতো জনমানবশূন্য বাজারের কঙ্কাল। শুধু একটা মিষ্টির দোকানে একটা জিরো পাওয়ারের আলো জ্বলছে। দোকান ফাঁকা। একটা বুড়ো লোক বসে বসে বিড়ি ফুঁকছে। মহিলা একটা বন্ধ দোকানে টোকা মারতে অর্ধেক ঝাঁপ খুলে এক বছর ২৩/২৪ এর ছেলের মুখ দেখা গেল। মহিলার নির্দেশে সে চেন দিয়ে বাঁধা একটা ল্যান্ডফোন এগিয়ে দিল।
ফোনে প্রিয়তমের কন্ঠস্বর শুনে আবার বুজে এল গলা। ভাগ্যিস এত রাতেও অচেনা নম্বরের ফোনটা ধরেছিল। সব খুলে বললাম, মৃদু ধমকাল, ওর কথা না শুনে স্টেশন ছেড়ে এসেছি বলে। ফোন রেখে মিষ্টির দোকানের মচমচে বেঞ্চে এসে বসলাম। শৌভিক বলেছে মিনিট পনেরোর মধ্যে পৌছে যাবে। ভদ্রমহিলাকে বললাম, আমার জন্য অনেক করেছেন। অনেক রাত হল, এবার বাড়ি যান। উনি কর্ণপাত করলেন না। নানা প্রশ্ন করছেন। আমাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মাপছেন। আমি শুধু জানতে পারলাম ওনার নাম পার্বতী মাহাতো। WBSEDCL চাকরি করেন।
নামেই হাইরোড। এতক্ষণ বসে রইলাম, বাস, ট্রেকার ছাড়ুন একটা মোটরবাইক, সাইকেল ও চোখে পড়ল না। মিনিট পনেরো পরে দূরে সত্যিই একজোড়া হেডলাইট দেখা গেল। উন্মত্ত হয়ে দৌড়ে গেলাম মাঝরাস্তায়। হ্যাঁ। শৌভিকের গাড়িই বটে। অ-বাতানুকূল সাদা এম্বাসেডর। মহিলাও দৌড়ে এলেন। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষলেন শৈবাল দা। বামদিকের দরজা খুলে সরে বসল শৌভিক। লাফিয়ে উঠে দড়াম করে দরজা বন্ধ করলাম। জানলা দিয়ে হাত নাড়লাম পার্বতীদির দিকে। ইশারায় শৌভিককে দেখিয়ে বললাম “আমার বর”। উনি মৃদু হেসে হাত নাড়লেন। রকেটের বেগে উল্টোদিকে দৌড়ল গাড়ি।
গাড়ি ছাড়ার পর সেদিনের শৌভিক কেবল বলেছিল, "তোমার যে এত গুণ -"। সেদিনের শৌভিকের মতোই বাক্য সম্পূর্ণ করি না আমি। থাক, কিছু প্রশ্ন - কিছু উত্তর অনুক্তই থাক।
পুনশ্চ - লাপতা লেডিজ আমার মোটামুটি লেগেছে। আহামরি মোটেও নয়। বরং বেশ সাদামাটা। ছক ভাঙার চেষ্টাটাও যেন কেমন চর্বিতচর্বণ মনে হয়েছে আমার। কিছুটা পঞ্চায়েত, কিছুটা লিপস্টিক আন্ডার মাই বুরখা, কিছুটা অন্য কি যেন, যার নাম পেটে আসে কিন্তু মুখে আসে না। অভিনয় ও নেহাৎ যথাযথ। খুব অসামান্য কিছু না।
আর কোয়ার্টারে ফিরে সেদিন আমার মুখে সব শুনে আমার বাবার দৃঢ় ধারণা হয়, ভদ্রমহিলা নির্ঘাত স্থানীয় মাওবাদী কমিটির মহিলা কমান্ডার। নিজের মতবাদের সমর্থনে বাবা জোর গলায় চ্যালেঞ্জ করেছিল, যে ঐ মহিলার দেওয়া সব তথ্য ভূয়ো। আমি ওনাকে কিছুতেই খুঁজে পাব না। আমি কিন্তু সত্যি খুজে পায়নি। হয়তো অন্যমনস্ক ছিলাম, শুনতে ভূল করেছি— অথবা বাবাই ঠিক। কিছু রহস্য না সমাধান হওয়াই ভাল। কি বলেন?
অনির ডাইরি ১১ই জুন, ২০২৪
#অনিরডাইরি
লোকটা খুব বাজে। খুব খুব বাজে লোক। বয়স আশি ছাড়িয়েছে কম দিন তো হল না, ধূমপানের আধিক্যে ফুসফুস দুটো যে ঝাঁঝরা, তাও অজানা নেই লোকটার। যে ছোকরা ডাক্তারকে এতকাল দেখিয়ে এসেছে, সে এখন আর ছোকরা নেই যদিও, প্রায় পায়ে ধরে নিষেধ করেছিল, " কাকু সিগারেটটা প্লিজ ছাড়ুন। আর মিষ্টিটাও।"
আজ্ঞে হ্যাঁ, মিষ্টি। সুগার ধরেছে বেশি দিন না, বছর দশেক হবে, ওই বয়সের অন্যান্য মানুষজন কি করে? বিষবৎ মিষ্টিকে পরিত্যাগ করে তাই তো? আইয়ে কভি বুড়োর হাভেলি পে, দেখবেন কি নেই - ফ্রিজে পাবেন জ্যাম, চিটচিটে আমের চাটনি, মিটসেফে পাবেন মুড়কি আর গুড়ের বাতাসা। খুঁজলে চিনির বাতাসা বা মুড়কিও যে পাবেন না, একথা জোর গলায় বলতে পারি না। বাড়ির কেয়ার গিভার যে দিদি তাঁর ওপরে নির্দেশ আছে, সকালে কাজে আসার সময় তেল - লুন - লকড়ি, সিগারেটের (আজ্ঞে হ্যাঁ দৈনিক ২প্যাকেট) মত নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির পাশাপাশি, গলির মুখের বিহারী দোকান থেকে মাঝে মাঝেই গরম জিলিপি, গজা, বালুসাই কিনে আনার জন্য। সবাই মিলে, চায়ের টেবিলে চাকুম চুকুম আর কি।
মুঠোফোন মারফৎ এই সব খবরাখবর যখন আমার কানে এসে পৌঁছায়, মনে হয় খামচে মাথার সব চুল ছিঁড়ে ফেলি। আর কি করব বলুন তো? দেড়শ কিলোমিটার দূর থেকে আর কি করতে পারি আমি? কেয়ার গিভার মেয়েটিকেই ধমকাই-চমকাই আমি, মেয়েটি কাঁদো কাঁদো সুরে বলে, "কি করব দিদিভাই? না এনে দিলে মেসোমশাই একা একাই নড়বড় করতে করতে বেরিয়ে পড়েন সিগারেট কিনতে।"
আমি গিয়ে অশান্তি করি, তাঁর গলার জোর আমার থেকেও বেশি। আর জোর যার, মুলুক ও যে তাঁর। তিনি আজকাল আমার কোন কথাতেই কর্ণপাত করেন না। সে নাই করুন, নিয়মিত ডাক্তার তো দেখানো দরকার, তার আগে দরকার কিছু নৈমিত্তিক পরীক্ষা করার। এত দূর থেকে ফোনে ব্যবস্থা করে লোক পাঠাই, তিনি তাঁর সঙ্গে খোশ গল্প করে তাঁকে ভাগিয়ে দেন। ছেলেটি আমায় ফোন করে বলে, " দিদি মেসোমশাই কথা দিয়েছেন,দুয়েক দিনের মধ্যেই আমায় ডাকবেন।"
কেন দুয়েক দিন, তা বুঝতে আমার বাকি থাকে না। লোকটা দিন কয়েক মিষ্টি না খেয়ে সুগার কমিয়ে তারপর রক্ত দেবে। যাতে প্রাথমিক রিপোর্ট ঠিক আসে আর কি। দুয়েক দিন গড়িয়ে যায় মাসের পর। শ্বশুর মশাইয়ের হঠাৎ প্রয়াণ, শাশুড়ি মাকে শিকড় শুদ্ধ তুলে নিয়ে কাঁথি আসা, শৌভিকের নির্বাচন সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল পাগল হয়ে যাচ্ছি বুঝি, ফলে মাঝে বেশ কিছু দিন খোঁজ নিতে পারিনি আমি। লোকটাও দিব্য চালিয়ে গেছে তার (অ)স্বাভাবিক জীবন যাত্রা।
ভোট শেষে বাড়ি ফিরবে শৌভিক, সময়াভাবে শ্বশুর মশাইয়ের ডেথ সার্টিফিকেটটাও তুলতে পারেনি এত দিন। আরো নানা কাজ আছে, শাশুড়ি মাতাকে নিয়েই ফিরতে হবে এবার, শুধু ফেরাই নয়,ওনাকে নিয়ে যেতে হবে ট্রেজারি ও, নাহলে চালু হবে না পেনশন - ফলে দিন দুয়েক ছুটি নিয়েই যাবে। ভাবলাম এই মওকায় লোকটাকেও ডাক্তার দেখিয়ে আসি, একটা বেলার তো ব্যাপার।
যে ছেলেটি টেস্ট করে তাকেই শুধালাম বাড়ির কাছে কোন ভালো ডাক্তার বসেন কি, যাঁর কাছে বেশি ক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না। এতদিন যাকে দেখানো হত, তিনি এতটাই দূরে বসেন, আর তেমনি ভিড় হয়। ছেলেটি বিশ বছর ধরে এই পরিবারের সাথে যুক্ত, অনেক সুখ দুঃখের সাথী। চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করি, ছেলেটি বলল, " দিদি আপনি ডাক্তারঠাকুরকে দেখাতে পারেন। শুনেছি ভালো ডাক্তার। গলির মুখেই তো বসেন।"
নামটাও ছেলেটি লিখিয়ে দিল, দুই নম্বরে নাম। তবে তার আগে টেস্ট গুলো করিয়ে নিলাম আমি, অধমের মাথায় যা যা এল, সব টেস্ট। দেখা গেল সোডিয়াম বেশ কম আর মূত্রে প্রোটিন বেরিয়ে যাচ্ছে। বাকি ঠিকই লাগল। নির্দিষ্ট দিনে বাড়ির দরজায় এসে থামল টোটো, গলির মধ্যে বাড়ি আমাদের, গাড়িতে উঠতে গেলেও হাঁটতে হবে কয়েক পা।টোটো চলে আসে চৌকাঠের কাছে।
আমার ধমক খেয়ে লাঠি ধরে গুটগুট করে টোটোয় গিয়ে উঠল লোকটা। হাঁপাচ্ছে খুব। দুমিনিট গেলেই ডায়গনস্টিক সেন্টার, সেখানেই বসেন ডাক্তার বাবু। টোটো থেকে নেমে চেম্বারের বাইরে অবধি কয়েক গজ যেতেও হাঁপিয়ে পড়ে লোকটা। আজ বোধহয় একটু বেশীই হাঁফায় লোকটা। গায়ে এখনও সিগারেটের গন্ধ। পর্যায়ক্রমে বাতানুকূল যন্ত্র এবং পাখার হাওয়ায় কিঞ্চিৎ ধাতস্থ হতে না হতেই ডাক পড়ে ভিতরে। অল্প বয়সী ডাক্তার, মিষ্টি ব্যবহার। " আসুন কাকা, বসুন।" রিপোর্ট গুলো দেখেন, আঙুলে পালস অক্সিমিটার লাগান, ব্লাড প্রেশার মাপেন, বুকে স্টেথো ঠেকান অতঃপর, খসখস করে প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, " ওনার বুকের মধ্যে তো গান বাজনা চলছে। নিউমোনিয়া বাঁধিয়েছেন। এখুনি হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।"
বাতনুকূল যন্ত্রের মৃদু গুনগুন শব্দ ছাড়া নিঃশব্দ চরাচর। বুড়ো লোকটার মুখটা পলকে শুকিয়ে আমসি হয়ে যায়। অন্য দিনের থেকে সামান্য বেশি হাঁপালেও হাঁপাতে পারে, বাকি তো কিছু অস্বাভাবিকতা আমাদের নজরে পড়ছে না। বললাম বাড়িতে রেখে চিকিৎসা কি একেবারেই সম্ভব নয়। মডেলদের মত করে প্রথমে হাসেন ডাক্তার বাবু, তারপর মীনা কুমারীর মত দুচোখে এসে জমে মন খারাপ করা মেঘ,মাথা নাড়িয়ে বলেন, " যত শীঘ্র সম্ভব ভর্তি করে দিন। দেখুন অমুক, অমুক জায়গায় যদি বেড পান।" অমুক এবং অমুক প্রাইভেট নার্সিং হোম। এখানেই খটকা লাগে আমার।
শুধাই, আপনি কোন ওষুধ লিখলেন না? এতদিন যা খাচ্ছে তার ডোজ কমবেশী কিছু করবেন না? উনি বলেন, "যা লিখেছি ওটা হাসপাতালের জন্য। দেখলেই ওরা বুঝবে।" চেম্বার ছেড়ে বেরিয়ে আসি আমরা। টোটোওয়ালা বাইরেই বসে ছিল আমাদের জন্য। টোটো থেকে নামিয়ে, হাত ধরে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল বৃদ্ধকে। একই ভাবে আবার ফেরৎ নিয়ে যায় টোটো অবধি।
মাথা কাজ করছে না আমার। এত রাতে কি করি? তবে যাই করি না কেন, নিকটবর্তী প্রাইভেট নার্সিং হোমে নিয়ে যাব না। ২০২১ সালে মধ্য হাওড়ার দুই নার্সিং হোমে যা নারকীয় অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এখনও দুঃস্বপ্ন দেখি মাঝে মধ্যে। টোটোওয়ালা বুদ্ধি দেয়, "আজ রাতটা অক্সিজেন দিয়ে দেখুন না দিদি।" মনস্থ করি, তাই করব, কাল সকালে গাড়ি ভাড়া করে সোজা কাঁথি, মাননীয় মহকুমা শাসক বলে দিলে কাঁথি হাসপাতালে একটা বেড কি আর পাওয়া যাবে না? মধ্যবিত্ত শহুরে বাঙালি সরকারী হাসপাতালগুলিকে যতই খিস্তিখেউর করুক না কেন, সরকারী হাসপাতাল এবং সরকারী ডাক্তারদের কোন তুলনা হয় না।
শৌভিক কে ফোন করতে খুব সঙ্কোচ হচ্ছিল।বেচারা সবমিলিয়ে এমন ফেঁসে আছে। দুদণ্ড জিরোতেও পারছে না লোকটা। তবুও করলাম। শৌভিক শুনে বলল, " কোন এন্টিবায়োটিক দেয়নি?" বললাম না তো। কেবল বলছে, নিউমোনিয়া আর হাসপাতালে ভর্তি করতে। শৌভিক বলল, " শোন নিউমোনিয়া আমার বাবার ও হয়েছিল। মনে আছে আমরা দীঘায় ছিলাম, বাড়ি থেকে আয়া মাসি হাউমাউ করে ফোন করেছিল?" খুব মনে আছে সেদিনটার কথা। কি ভাবে যে মাথা ঠাণ্ডা রেখে, কাঁথি হাসপাতালের ডাক্তার বাবুকে ফোন করে সে যাত্রা বাবাকে বাঁচিয়েছিল শৌভিক।
শৌভিক বলল, " একদম। শুধু ফোনে সব শুনে ওষুধ দিয়েছিল অভিষেক ডাক্তার। তুই আমাকে সব রিপোর্ট, এই ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন আর এমনিতে কি ওষুধ খায়, সব জানা।" বাড়ি এসে এদিক ওদিক ফোন করি আমি। অক্সিজেন এর ব্যবস্থা করি আমি। একরাতের জন্য অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর দিতে চায় না কেউ। এক মাসের গল্পে আসুন।
ডাক্তার বাবু রাউন্ডে আছেন জানায় শৌভিক, ঘণ্টা খানেক বাদে সব দেখে জানাবেন। একটা ঘণ্টা রীতিমত হৃদপিণ্ড মুঠোয় ধরে বসে থাকি আমি। রাত নটা নাগাদ আসে সেই কাঙ্ক্ষিত ফোনটা, শৌভিকের জবানীতে ভেসে আসে বিস্ময়, " এতো আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করছে, হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেছেন কেন? রিপোর্ট দেখে তো স্যার আমি কিছু বুঝছি না। ওনার যা বয়স বলছেন রিপোর্ট তো এমনিই আসার কথা। চেস্টের এক্সরে করিয়েছেন কি?" জবাব দিই, কই না তো। সব শুনে তিনটি ওষুধ লিখে দেন ডাক্তার বাবু, আর দুটি ওষুধ দেন দিনে দুবার নেবুলাইজ করার জন্য। বলেন, " অক্সিজেনটা মাপতে থাকবেন স্যার। যদি অনেক ক্ষণ ধরে ৮০র অনেক নীচে থাকে, বা রোগী যদি ভুলভাল বকতে থাকে,তাহলে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করে দেবেন। আর দিন কয়েক পর বুকের একটা ছবি (Xray) তুলে একটু আমায় পাঠাবেন। অন্য ওষুধ উনি যা খান, আপাতত তাই খাবেন।"
রাত সোয়া নটা, কোন মতে খুঁজে পেতে ধুলো ঝেড়ে বার করি পালস অক্সিমিটার, বৃদ্ধের আঙুলে লাগিয়ে রিডিং আসে ৯৫-৯৬। সহরষে নিজের বরকে সে খবর দিই আমি।অতঃপর বেরিয়ে পড়ি ওষুধ কিনতে। আজ রাতেই কয়েক দাগ ওষুধ পড়ে গেলে, হয়তো সুস্থ হয়ে উঠবে বৃদ্ধ। বন্ধ হতে বসা কদমতলা বাজারের এক কোনের প্রায় ঝাঁপ ফেলা সাহেবী নামের ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনে ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরি আমি। নতুন করে আঙুলে লাগাই পালস অক্সিমিটার, রিডিং ৯০ এর অনেক ওপরে। বরং বৃদ্ধার রিডিং ৮০ এর অনেক কম আসে। ফুসফুসের রোগে তো তিনিও ভোগেন। বৃদ্ধের পাশে বসে আঘ্রাণ করেন যে সিগারেটের ধোঁয়া গুলো। ইনহেলার নেবার কথা রোজ সকাল বিকাল মনে করাই তুত্তুরী আর আমি। আজ চেক করতে গিয়ে দেখি ইনহেলার শেষ হয়ে গেছে কবেই, অথচ তিনি নৈমিত্তিক স্তোক বাক্য দেন, " হ্যাঁ নিয়েছি। আমি খুব ভালো আছি।" এবাড়িতে সবাই এত মিথ্যুক কেন?
ভাগ্যে আন্দাজে কিনে এনেছিলাম বৃদ্ধার ওষুধটাও। প্রায় ঘাড় ধরে দুটোকে ওষুধ খাওয়াই, টানাই আমরা মা - মেয়ে। সারা রাত মাপা হয় অক্সিজেন। পরদিন সকালে দুজনেই ফিট। অক্সিজেন লেভেল ও যথাযথ। কেয়ার গিভার মেয়েটিকে ফোন করে বলা হয়, "আজ থেকে আর সিগারেট আনিস না। দিদিভাই আছে, জানিসই তো কেমন মাথা গরম। কুরুক্ষেত্র কাণ্ড করছে কাল থেকে।" শৌভিককে বলা হয়, " তুমি ওকে নিয়ে যাও। আর পারছি না। একে একটাও সিগারেট খাইনি সকাল থেকে, তারওপর তোমার বউয়ের চোপা। উফ পাগল পাগল লাগছে রে বাবা -"। এরপর ও বলবেন লোকটা ভালো? সাধে আমার ঠাকুমা বলতো, " কলি যুগে উপকারীকে বাঘে খায়।" ঘোর কলি বুঝলেন, ঘোর কলি।
পুনশ্চঃ- সব চরিত্র কাল্পনিক কিন্তু। আর হ্যাঁ, ছবির মানুষ গুলোর সাথে লেখার কুন সম্পর্ক লাই ।
অনির ডাইরি ৬ই জুন, ২০২৪
#অনিরডাইরি
আমি বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর মধ্যে পড়ি না। বরং "বুদ্ধুজীব" হিসেবেই অধিক স্বচ্ছন্দ বোধ করি। বিশেষত রাজনৈতিক সচেতনতা নিয়ে যদি কথা বলেন, তো জোর গলায় বলতে পারি, আমার দপ্তরী বাহনচালকও আমার থেকে অধিক সচেতন। কত কিছু যে জানতে পারি ভদ্রলোকের থেকে। আসমুদ্রহিমাচল জুড়ে যাবতীয় রাজনৈতিক কূটকচালি, আকচাআকচি সব ভদ্রলোকের নখদর্পণে।
গ্রাম্য রাজনীতি যে মহানগর কেন্দ্রিক রাজনীতির থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র তা আমি পদে পদে টের পাই, ওনার সৌজন্যে। যেমন ধরুন, কিছুদিন আগে উনি আমাকে বললেন, " জানেন তো ম্যাডাম, আমাদের গাঁয়ের বউ ঝিরা অমুক পার্টির ওপর খুব খেপে আছে।" প্রশ্ন করার আগেই ভেসে আসে উত্তর, " আসলে গেল বার তো ওরা সব বাড়িতে একটা করে শাড়ি আর সানিয়া মির্জা দিয়েছিল।"
এবার কথা থামাতে বাধ্য হই আমি, প্রশ্ন করি, বাড়ি বাড়ি একটা করে সানিয়া মির্জা মানে কি? এত জন সানিয়া মির্জা এল কোথা থেকে? ভদ্রলোক এক গলা জিভ কেটে বলেন, " আপনারা অন্য কিছু বলেন নাকি?" তারপর ইশারায় বোঝান নাকের নথ। সহস্রাব্দের শুরুর দিকে সানিয়া মির্জা নাকে যে সোনালী রিংটা পরতেন, তেমনি কিছু হবে বুঝে আর এগোই না।
ভোট চাইতে উপঢৌকন দেওয়া যে দণ্ডনীয় অপরাধ তা ভুলে প্রশ্ন করি, সব বাড়িতে শাড়ি দিয়েছিল? কি শাড়ি? জবাব আসে, " ওই যে গো, হাটে বিকোয়, একশ দুইশ টাকার শাড়ি।" এক দুশো টাকায় শাড়ি হয়? বলতে গিয়েও, বলি না। মনে পড়ে যায়, চুঁচুড়ায় থাকতে ঝুমার সাথে গিয়েছিলাম বটে একটা ওমন হাটে। দেড়শ টাকা দিয়ে একখান শাড়ি আম্মো কিনিছিলাম। পরার পর মনে হয়ে ছিল মশারি পরেছি বুঝি। হোক মশারি, তাও তো শাড়ি বটে রে বাবা। তাও ফোকোটে পাওয়া, তারওপর আবার নথ, তা যারা এত কিছু দিয়েছিল গেল বার,তাদের এবার ভোট দিবেনি কেন? ড্রাইভার সাহেব মিচকে হেসে বলেন, "নকল ছেল ম্যাডাম। সোনার রং করা ছিল। নাকে পরতেই রং উঠি গেছে।"
জিজ্ঞাসা করলাম, আপনাদের বাড়িতেও দিয়েছিল? জবাব দিলেন, " না ম্যাডাম। আমরা কোন দলে নাই তো। তাই দেয়নি। আমাদের কিছুই দেয় না। সেবার ঝড়ে অত ক্ষতি হল, একটা ত্রিপল চাইতে গ্যালাম, তাই দিলে না। শেষে আপনি বলে দিলেন বলে নূপুর দা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে ব্লক থেকে একটা যোগাড় করে দিলে।" বাকিটা ব্যক্তিগত বলে আর কথা বাড়াই না।
তখনও ঘোষিত হয়নি নির্বাচনী নির্ঘণ্ট, আমার এই অরাজনৈতিক ড্রাইভারকে নিয়ে বেশ খুশিই ছিলাম আমি। নির্বাচন ঘোষণা হবার সাথে সাথেই দেখি তিনি এক দলে নাম লিখিয়ে বসে আছেন। তা ভালো,স্বাধীন দেশের নাগরিক,রাজনৈতিক ভাবে সক্রিয় হওয়াটাই তো বাঞ্ছনীয়। আপিসের ডিউটি সেরেই,দৌড়ে দৌড়ে দাদার আপিসে হাজিরা দিতে যান, দেওয়াল লিখতে যান, ফেস্টুন ব্যানার বানাতে দিতে যান। দল বেঁধে গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ান, দাদার জন্য ভোট মাগেন। আর পরদিন আপিস যাবার পথে আমায় গল্প শোনান। "জানেন ম্যাডাম, ওদের বাড়ি ১৫টা ভোট, তাই বলে কি ওরা যা ইচ্ছে তাই চাইবে? ওদের ১৭ বছরের ছেলে, কোথা থিকা একটা ১৫ বছরের মেয়েকে ভাগিয়ে এনিছে। পুলিশও ওমনি কেস দিয়ে দিছে, ছেলেটাকে বয়েজ হোমে আর মেয়েটাকে গার্লস হোমে চালান করে দিয়েছে। এখন ওরা বলে কিনা, তোমার দাদাকে বলে আমাদের ছেলেকে ছাড়িয়ে এনে দাও -। আমি সোজা বলেছি,আমি পারব না। তখন বলে কি, আমরা এত বছর ধরে ওই পার্টি করি, আজ যদি পার্টি আমাদের পাশে না দাঁড়ায়, তো ভোটের কথা ভুলে যাও। আমিও কয়ে আইছি, ভাইরে তোদের ১২/১৫টা ভোটের আমার দরকার নাই। কপালে থাকলে আমার দাদা এমনিই জিতবে। নিজের ছেলেকে সামলাতে পারে না, তাদের আবার এত কথা। জানেন ম্যাডাম, অর বাপ মিষ্টির দোকানে থালাবাটি ধুয়ে ছেলেকে মানুষ করেছে। লেখাপড়া শিখিয়েছে, আর সেই ছেলে কি করেছে, না পেরেম - ।"
শুনতে শুনতে ভালো লাগে। কারো মধ্যে তো এই সমাজ সচেতনাটুকু আছে। কোন দিন আবার চিন্তিত হয়ে বলেন, " জানেন ম্যাডাম, দাদাকে বলিচি, কিছু টাকা লাগবে। গ্রামে একদিন ফিস্টি দিতে হবে। ওদের অনেক ট্যাকা,ওরা তিনবার দিশি মুরগি খাইয়ে দিয়েছে। আমরা একবারও না দিলে একটাও ভোট পাব না।" জিজ্ঞাসা করি, আপনারা কি খাওয়াবেন? খাসি? উনি মাথা চুলকে বলেন,অত টাকা কুথায় পাই। প্যাঙ্গাস মাছের ঝোল,আলু ভাজা আর ভাত খাওয়াব।"
সাত দফায় ভোট, উত্তর থেকে ধীরে ধীরে নামছে নির্বাচনী উত্তাপ। আমার লোকলস্কর সবাই ব্যাপৃত "গর্বের পর্বে"। "একা কুম্ভ" হয়ে আমরা কয়েকজন রক্ষা করে চলেছি ফাঁকা আপিসটাকে। আদর্শ আচরণ বিধির সৌজন্যে লোক সমাগম আপাতত বড়ই সীমিত। তারই মধ্যে টুকটাক এসে ঘুরে যান বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা। সুযোগ পেলেই জমে ওঠে বৈঠকী গপ্প। কি হবে মনে হয় নির্বাচনী ফলাফল? ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত জনৈক বামপন্থী নেতা টেবিল বাজিয়ে বলে যান, " আমি বলতেছি ম্যাডাম,আপনি মিলিয়ে নিবেন, আমরা ৪২ এ ৪২টাই পাব। সব সিট আমরা নিয়ে নিব। কুনো ফুল আমরা ফুটতেই দিব নি।" হাসি চেপে গম্ভীর ভাবে বলি, "অমুক বাবু, সত্যি সত্যি বলুন তো, কি খেয়েছেন? সেটা কি তরল না বায়বীয়? খুব মূল্যবান কিছু? ৪২ এ ৪২টাই আপনারা পাবেন, আমাকে অজ্ঞ পেয়ে এমন গাঁজাখুরি গল্প দেবেন?"
ভদ্রলোক হেহে করে খানিক হাসেন, হাত কচলান, তারপর মাথা চুলকে,ষড়যন্ত্রের সুরে ফিসফিস করে বলেন, "আসল সমস্যা কি জানেন ম্যাডাম? মেয়েরা। ওই যে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার-। হাতে দুটো ট্যাকা কি এসেছে, মেয়েরা ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। কুনো কথাই আর শুনতেছে না। আমার বউই ধরেন না, উঠতে বসতে কইছে, তোমার কথা শুনব ক্যান? আমার যাকে পছন্দ, আমি তাকে ভোট দুব। "
পূর্ব মেদিনীপুরের এক প্রান্তিক ব্লকের এক ছাপোষা বামপন্থী নেতার মুখে সেদিন যা শুনেছিলাম, আজ সামাজিক মাধ্যম ভেসে যাচ্ছে সেই একই কথায়, হয়তো একটু পরিশীলিত ভাবে বলছেন, কিন্তু বলছেন তো সেই একই কথা না। বলছেন মেয়েরাই তো তরিয়ে দিল এই নির্বাচন। বলছেন, তত্ত্ব কথা, ন্যায় অন্যায়, সমাজ দর্শন কিচ্ছু বুঝল না মাইরি মেয়েগুলো, দল বেঁধে গিয়ে ভোট দিয়ে এল ক্ষমতাসীন দলকে। চাঁচাছোলা ভাষায় বলছেন পাঁচশ, হাজার টাকার কি মহিমা মাইরি। বলছেন, সময় থাকতে বউ গুলোকে হাত খরচা দিলে আর এই দিন দেখতে হত না। পড়ছি আর ভাবছি, উফ আদমসুমারি অনুসারে লিঙ্গানুপাতে এত পিছিয়ে থেকেও কত্ত শক্তিশালী মাইরি আমাদের মেয়েরা! আর এই সত্যিটা এত দিন কেউ বুঝল না! যাঃ বহুৎ না ইনসাফি হ্যায় মাইরি।